লিখেছেনঃ সুরজিৎ দাশগুপ্ত
একে তো বসন্ত ঋতু। তদুপরি শান্তিনিকেতন। আমাদের হারানো যৌবন। তখন সবাই ছিল কত সুন্দর সুন্দরী, সকলের গলায় শুনেছি মোহন বাঁশরি। বড় স্মৃতি ভারাতুর এই দারুণ ফাল্গুন-চৈত্র। পিউকাহা পিউহার কাতর ডাকে রাতের ঘুম ছিড়ে যায় বারবার, ঘুম ভাঙে কোকিলের কোলাহলে।
সেবার বসন্ত পূর্ণিমাতে এই শান্তিনিকেতনে হয়েছিল সাহিত্যমেলা। উপলক্ষ্য ছিল একুশে ফেব্রুয়ারির একবছর পূর্তি উদ্যাপন আর বাংলা ভাগের পাঁচ বছর বাদে দুই বাংলার সাহিত্য-সংস্কৃতি কতদূর কোল্পথে এগিয়েছে তার বিচার-বিশ্লেষণ। ভাবনাটা ছিল অন্নদাশঙ্কর রায়ের। জন্মেছিলেন ওড়িশায়, বসন্ত ঋতু যখন তুঙ্গে, খ্রিস্টাব্দ মতে পনেরো মার্চ। রবীন্দ্রনাথ ও সাহিত্যের টানে বাংলাকে ভালোবেসে চলে এসেছিলেন এই শান্তিনিকেতনে।
বাল্যকাল থেকে অন্নদাশঙ্কর যে-বাংলাকে একান্তভাবে খুঁজছিলেন সে ছিল গঙ্গাপদ্মা-মেঘনা বিধৌত অখণ্ড বাংলা। সেই বাংলার নদীর কূলে কূলে ছড়ানো নিসর্গ আর মানুষের, সংসার ছিল স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের লীলাবিশ্ব। সেই বাংলার পদ্মাতীরের কুঠিবাড়ির নিভৃতে তিনি শুরু করেছিলেন ‘গীতাঞ্জলি’র ইংরেজি অনুবাদ যা তাকে। পরে বিশ্ববিখ্যাত করে। সেই বাংলার শহরে শহরে গ্রামে গ্রামে কখনও মাঠেঘাটে তাঁবুঘরে কখনও নদীবুকে নৌকোঘরে বাস করেছেন অন্নদাশঙ্কর। যেমন কর্মসূত্রে তেমনই ভালোবেসে। সাধে কী বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত তার বইয়ের নাম ‘আমার ভালোবাসার দেশ’। তার মানসে বাংলা ছিল অখণ্ড শাশ্বত বাংলা। তাই ওই বইটির ভূমিকার শিরোনাম দিয়েছিলেন এক জাতি দুই দেশ।
বাংলা তো আগেও একবার ভাগ হয়েছিল। তখনও রবীন্দ্রনাথের বক্তব্য ছিল শাসক ও সরকার ভাগ হলেই মানুষ ও সাহিত্য ভাগ হয় না, বাঙালি বাঙালিই থাকে। সন ১৩১৩-র ফাল্গুনে সাহিত্য সম্মিলনে তিনি বলেছিলেন, বাঙালির ঐক্যের মূলসূত্রটা কী? আমরা এক ভাষায় কথা কই। আমরা দেশের এক প্রান্তে যে বেদনা অনুভব করি ভাষার দ্বারা দেশের অপর সীমান্তে তাহা সঞ্চার করিয়া দিতে পারি; রাজা তাঁহার সমস্ত সৈন্যদল খাড়া করিয়া তাহার রাজদণ্ডের সমস্ত বিভীষিকা উদ্যত করিয়াও ইহা পারেন না। শত বৎসর পূর্বে আমাদের পূর্বপুরুষ যে গান গাহিয়া গিয়াছেন শত বৎসর পরেও সেই গান বাঙালির কণ্ঠ হইতে উৎপাটিত করিতে পারে এত বড়ো তরবারি কোনো রাজাস্ত্রশালায় আজও শানিত হয় নাই। আবার ১৯৫৩-র ফাল্গুনে বসন্ত উৎসবের সঙ্গে যে-সাহিত্যমেলা অনুষ্ঠিত হয় তার উদ্বোধনে রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর পিতার ঠিক এই কথাগুলোই উদ্ধৃতিরূপে উচ্চারণ করেছিলেন।
প্রতিবারের মতো সেবারও বসন্তোৎসবের প্রভাতী বৈতালিকে আশ্রমকন্যারা নেচে নেচে গাইল, ‘ওরে গৃহবাসী খোল দ্বার খোল’। সতিই দ্বার খুলে গিয়েছিল। পাকিস্তান থেকে এসেছিলেন প্রবীণ-নবীন মিলিয়ে পাঁচজন সাহিত্যিক। আলোচনাচক্র নয়, সাহিত্য সম্মেলনও নয়, দু’বাংলার সাহিত্যিকদের মিলনমেলা। সংগীতভবনের মঞ্চে সাহিত্যসভা। আর বাইরে আড্ডা, গান, দাবা খেলা, কোনও বিকেলে চায়ের আসর, কোনও নৈশ আহারের পরে ‘ও আমার চাঁদার আলো’ ‘পূর্ণ চাঁদের মায়ায়’ গানে গানে কফি পার্টি। আর তখনও ঢাকার কলেজ চত্বরে চত্বরে পথে পথে ঘরে ঘরে ফাল্গুন বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছিল এক বছরের টাটকা স্মৃতিভরা আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলতে পারি।)
সেই একুশে ফেব্রুয়ারির রক্তস্রোত শক্তি অর্জন করতে করতে ক্রমশ হয়ে উঠতে লাগল পাকিস্তানি উর্দুর বন্ধননাশা, গর্জমান প্রাণস্রোত। অবশেষে ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচন এবং মুজিবুর রহমানের আওয়ামি লিগের। একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ। তা হলে এবার হবে সেনা শাসনের অবসান। কিন্তু বাড়া ভাতে ছাই পড়ল ১৯৭১-এর পয়লা মার্চ। জেনারেল ইয়াহিয়ার সামরিক সরকার ঘোষণা করল যে, ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া মুলতুবি থাকল। অর্থাৎ বাঙালির হাতে ক্ষমতা না দেওয়ার বাহানা। ফলে শুরু হল পাকিস্তানের থেকে বাংলাভাষীদের মুক্তির আন্দোলন।
পরদিন ২ মার্চ। ঢাকায় হরতাল ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় ছাত্র জমায়েতে পেশ করা হয় স্বাধীনতার প্রস্তাব ও সেই সঙ্গে বাংলাদেশের মানচিত্র আঁকা পতাকা তোলা হয়। পরদিন পল্টন ময়দানে বিশাল জনসভায় ঘোষিত হয় স্বাধীনতার ইস্তাহার— ৫৪ হাজার ৫ শত ৬ বর্গমাইল বিস্তৃত ভৌগোলিক এলাকার ৭ কোটি মানুষের আবাসিক ভূমি হিসেবে স্বাধীন ও সার্বভৌম এ রাষ্ট্রের নাম বাংলাদেশ। এই। সভাতেই সিদ্ধান্ত হয় যে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হবে ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’। সেদিনকার ভাষণে মুজিবুর রহমান বলেন, হয়তো এটাই আমার শেষ ভাষণ। আমি মরে গেলেও ৭ কোটি মানুষ দেখবে দেশ সত্যিকারের স্বাধীন হয়েছে। চারদিন পরে ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানের জনসভায় বঙ্গবন্ধুর সেই বিখ্যাত ভাষণ— এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। পরদিনও সকালবেলা বক্তৃতাটি রেডিয়ো পাকিস্তান ঢাকা থেকে পুনঃসম্প্রচারিত হয়। সেই বার্তা ক্রমে ক্রমে পৌঁছে গেল বাঙালির ঘরে ঘরে।
ঘটনাপ্রবাহ বয়ে চলল দুর্বার বেগে। পল্টন ময়দানে ৯ মার্চ আবার জনসমুদ্র। প্রবীণ দেশনেতা মৌলানা ভাসানি পূর্ববাংলার স্বাধীনতাকে স্বীকার করে নেওয়ার জন্য। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে আহ্বান জানালেন। আর পশ্চিম পাকিস্তানিদের উদ্দেশে বললেন, তোমরা তোমাদের সংবিধান রচনা করো, আমরা আমাদের সংবিধান রচনা করি। লাকুম দ্বীনুকুম ওয়ালিয়া দ্বীন’। তোমার পন্থা তোমার পন্থা, আমার পন্থা আমার। এ তো খোদ কোরআনের অলকাফিরূন সূরারই পন্থা প্রদর্শন। সেদিন ছিল পূর্ব পাকিস্তানের নতুন গর্ভনর টিক্কা খানের শপথ নেওয়াও দিন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর অসহযোগ আন্দোলনের ডাকে সেদিন টিক্কা খানের শপথ নেওয়াও হল না! আর ঢাকা থেকে করাচিতে ফিরে এয়ার মার্শাল আসগর খান সাংবাদিক সম্মেলনে জানালেন, ঢাকা কান্টনমেন্টেও কোথাও তিনি পাকিস্তানের পতাকা দেখতে পাননি।
রাজনৈতিক কর্মতৎপরতার জন্যে ধানমণ্ডীর বঙ্গবন্ধুর ভবনটির সঙ্গে আমেরিকার হোহায়াইট হাউস ও ইংল্যাণ্ডের প্রধানমন্ত্রীর বাসগৃহের তুলনা শুরু করল সংবাদ মাধ্যম। সিনেমার হলগুলোতে সিনেমার শুরুতে ও শেষে ‘জয় বাংলা, বাংলার জয়’ গান শোনা যেতে লাগল আর তাতে গলা মেলাতে লাগল হলসুদ্ধ গোটা বাঙালি। রেডিও টিভির শিল্পী ও কর্মীরা বাঁধা পড়ল এক বাঙালি আবেগে। বঙ্গবন্ধুর ফরমান ছাড়া সরকারি দফতরগুলোও অচল। আকাশের নীচে নদীর বুকে বাংলার জয়গান গেয়ে বেড়াতে লাগল নৌকোর মাঝিরাও। অবিশ্বাস্য উন্মাদনায় আগুয়ান সাত কোটি জাগ্রত বাঙালি।
২৯ মার্চ গাজিপুর সেনা ছাউনিতে সামরিক বাহিনীর বাঙালির অংশ পাকিস্তান সরকারের অস্ত্র সমর্পণের আদেশ অমান্য করে হাত মেলাল নাগরিক বাঙালির সঙ্গে। পাকিস্তানি সেনাদের যাতায়াতের বাধা দেওয়ার জন্য রাস্তায় রাস্তায় ব্যারিকেড। কারফিউর মধ্যেও গুলি বিনিময়। প্রচুর হতাহত হল দু’পক্ষেরই। চারদিকে সাজো সংজ্ঞা। ধানমণ্ডীর বাড়িতে ১৯ মার্চ বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করলেন বঙ্গবন্ধু। সেই প্রথম জয় বাংলা বাহিনীর সশস্ত্র কুচকাওয়াজ এবং মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক সালাম গ্রহণ। সেদিন ভোর থেকেই হাজার হাজার মানুষ আমার সোনার বাংলা গেয়ে গেয়ে বন্যার মতো নেমে আসে ঢাকার পথে পথে। সেই গান দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল যশোরে সাতক্ষীরায় খুলনায় সিলেটে বাগেরহাটে দিনাজপুরে দিকে দিকে। ২৫ মার্চ মধ্যরাতের অন্ধকারে ট্যাঙ্ক ও কামান নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল পাকিস্তানি বাহিনী। শুরু হল নৃশংস গণহত্যা। গ্রেফতার করা হল বঙ্গবন্ধু মুজিবুর রহমানকে। গ্রেফতারের পূর্বমুহুর্তে তার অমর ঘোষণা— ‘From today Bangladesh is Independent.’
পরবর্তী ইতিহাস যেমন ভয়ংকর তেমনই রোমাঞ্চকর। কী আনন্দ কী দুরাশা। কী গরিমা কী বেদনা। কত উল্লাস কত হুতাশ। বিশ্বহৃদয়ও তাতে বিচলিত না হয়ে পারেনি। কত ভাবে কত জনে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন, মুক্তিযোদ্ধাদের দেন উৎসাহ ও প্রেরণা। ভারত সরকারও ডিসেম্বরে যোগ দেয় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে। শেষে ন’মাস পরে ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস। একাত্তরের বসন্তে এই মুক্তিযুদ্ধ শুরুর ও স্বাধীনতা ঘোষণার স্মরণে এবার ২০১২র বসন্তে বাংলাদেশ সরকার যেসব বিদেশি নাগরিক সেদিন মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিপোষণ ও প্রণোদন জুগিয়েছিলেন তাদেরকে সম্মান জানাতে চলেছে ২৭ মার্চ ঢাকায়। স্বভাবতই সম্মানপ্রাপকদের অন্যতম অগ্রণী বসন্তসন্তান অন্নদাশঙ্কর রায়। এই সম্মাননা বাঙালি জাতি সংহতির পুনর্ঘোষণা, বাংলার অখণ্ডতা ও আবহমানতার পুনঃপ্রবর্তন।
বছর বছর বসন্ত এসে মনে করিয়ে দেয় বাংলা শুধু সোনার বাংলা নয়, সবুজ বাংলাও। তার বুকের ভিতরে আছে অশোক-পলাশ-শিমূলের আগুন, তার সন্তানসন্ততি ভাষার জন্য প্রাণদানে বাঙালি, স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামে বাঙালি। বাঙালি চিরকাল বাঙালি।
‘নবজাগরণ’ অ্যান্ড্রোয়েড অ্যাপ্লিকেশনটি প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর টেলিগ্রাম চ্যানেলে জয়েন হতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর ফেসবুক পেজে লাইক করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।