লিখেছেনঃ সুরজিৎ দাশগুপ্ত
মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীকে আমরা জাতির জনক বলে জানি। কিন্তু যে অর্থে বাল গঙ্গাধর তিলক বা বিপিনচন্দ্র পাল কি চিত্তরঞ্জন দাশ অথবা ক্ষুদিরাম বসু বা ভগৎ সিং কি সূর্য সেনকে আমরা জাতীয়তাবাদী বলে জানি, সে-অর্থে কি গান্ধীকে জাতীয়তাবাদী বলতে পারি? একথা ঠিক যে, রাউলাট আইনের বিরুদ্ধতা থেকে করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে আন্দোলন পর্যন্ত গান্ধীই ছিলেন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রধান সেনাপতি। কিন্তু ভারত স্বাধীন হওয়ার পরেও তাকে জাতীয়তাবাদী নেতা বলে পরিচয় দিলে তার পরিচয়কে কি সংকুচিত তথা বর্তমান বিশ্বে তার অবস্থানকে অবান্তর ও অপ্রাসঙ্গিক করে ফেলা হয় না? আধুনিক পৃথিবীর ইতিহাসে তার আদর্শ ও শিক্ষা কি আজও অর্থময়, বিবেচ্য ও মূল্যবান নয়?
আত্মজীবনীতে গান্ধী লিখেছেন মিস্টার কোটস তাঁকে The Perfect Way এবং The New Interpretation of the Bible নামে আরও দু’খানি বই পড়তে দিয়েছিলেন এবং বই দুটিতে তিনি হিন্দু ধর্মের সঙ্গে মিল পান। কিন্তু হিন্দু ধর্মের তো শাক্ত, শৈব, বৈষ্ণব প্রভৃতি অনেক রকম মত বা রূপ আছে। কোন্ হিন্দু ধর্মের সঙ্গে গান্ধী ওই বই দু’খানির সমমর্মিতা পেয়েছিলেন তা কিন্তু স্পষ্ট করেনি তিনি। হয়তো নিজের বৈষ্ণব মতের সঙ্গেই মিল পেয়েছিলেন। পরের পৃষ্ঠাতেই গান্ধী লিখেছেন, “Tolstoys the Kingdom of God is within you overwhelmed me. It left an abiding impression on me.’ গান্ধী বিশদ করেননি যে টলস্টয়ের ওই বইটি তাকে কীভাবে প্রভাবিত করেছিল। কিন্তু আমরা গ্রন্থটি পাঠ করে বলতে পারি যে, গ্রন্থটির প্রতিপাদ্য হল যেখানে অহিংসা, যেখানে প্রেম, সেখানে ঈশ্বর, অহিংসা ও প্রেমের রূপ ধরেই মানুষের কাছে আসেন। এই বক্তব্য নিয়ে টলস্টয়ের একটি গল্প আছে Twenty-three stories গ্রন্থে। বিশেষত ইউরোপভ্রমণের পরে টলস্টয় আধুনিক সভ্যতার সমরায়োজন ও যন্ত্রনির্ভর বা বস্তুলোলুপতার ঘোর বিরোধী এবং সেই সঙ্গে গভীরভাবে আদি খ্রিস্টনীতিতে বিশ্বাসী হয়ে ওঠেন। গান্ধীও টলস্টয়ের চিন্তাভাবনা ও আলোচনায় একান্তভাবে অনুপ্রাণিত হন তখন থেকেই। টলস্টয়ের মাধ্যমে বৈষ্ণব ভাবনায় ভাবিত গান্ধীও হলেন তলে তলে খ্রিস্টিয় অহিংসা ও প্রেমে উদ্বুদ্ধ। এ প্রসঙ্গে ফিরে আসব দক্ষিণ আফ্রিকায় গান্ধীর কাজকর্মের-সুরাদে।
১৮৯৩ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার দাদা আবদুল্লা অ্যান্ড কোম্পানির ইংরেজ ব্যারিস্টারকে সাহায্য করার জন্য মোহনদাস গ্রান্ধী প্রথম দক্ষিণ আফ্রিকার যান। তখন ট্রান্সভালও অরেঞ্জিয়া ছিল ওলন্দাজদের এবং নাটাল ও কেপ কলোনি ছিল ইংরেজদের অধীনে। দু’পক্ষের মধ্যে ১৮৯৯ সালে যে যুদ্ধ শুরু হয়, তা ১৯০২ পর্যন্ত চলে, এই যুদ্ধ বোয়ার বা বুয়োর যুদ্ধ নামে পরিচিত। এই যুদ্ধে গান্ধী মনে মনে ওলন্দাজ পক্ষের সমর্থক হয়েও ইংরেজ পক্ষকেই সহায়তা করেন ব্রিটিশ ভারতের অনুগত প্রজারূপে। এজন্য ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বর্ণপদক পেলেও তিনি ভুলতে পারেননি যে ইংরেজরা ভারতীয়দেরকে কেমন নীচু চোখে দেখে। ইংরেজরা ভারতীয়দের কুলি বলে সম্বোধন করত, এমনকি গান্ধীকেও উল্লেখ করত কুলি ব্যারিস্টার বলে।
দক্ষিণ আফ্রিকার ভারতীয়দের অবস্থা সম্বন্ধে চেতনা জাগাবার উদ্দেশ্যে ভারতীয় পক্ষ থেকে ১৯০৪ সালে ‘ইন্ডিয়ান ওপিনিয়ন’ পত্রিকার প্রকাশ শুরু হয়। তাতে প্রত্যেক সংখ্যাতেই গান্ধীর কিছু-না-কিছু লেখা থাকত। পত্রিকার সহকারী সম্পাদক ছিলেন ভারতীয়দের প্রতি সহানুভূতিশীল এক ইংরেজ ভদ্রলোক, তাঁর নাম ছিল মিস্টার পোলক। আর্থিক সংকটে পত্রিকাটির অস্তিত্ব বিপন্ন হলে সমাধানের উদ্দেশ্যে গান্ধী জোহান্সবার্গে আসেন, ডারবানে ফেরার জন্য তাকে ট্রেনে তুলে দিতে এসে পোলক সাহেব পথে পড়বেন বলে গান্ধীকে একখানি বই দেন, বইটির নাম Unto this Last লেখকের নাম জন রাসকিন। আত্মজীবনীতে গান্ধী লিখেছেন, ‘Three moderns have lefta deep impression on my life and captivated me: Raychandbhai by his living contact; Tolstoy by his book the Kingdom of God is Within You and Ruskin by Unto his last.’ এখানে বলে রাখি, লন্ডন থেকে ব্যারিস্টার হয়ে ফেরার পরে গান্ধীর সঙ্গে বোম্বেতে রায়চাঁদ ভাইয়ের ঘনিষ্ঠতা হয়, পেশায় জহুরি হলেও তিনি কবিতা লিখতেন ও বিভিন্ন ধর্মশাস্ত্রে পণ্ডিত ছিলেন।
Unto this Last-এর শিক্ষাতে গান্ধী ডারবান থেকে চোদ্দ মাইল দূরে বাগান ও একটা বাড়িসহ একশো একর জমি কিনে তার নাম রাখলেন ফিনিকস সেটলমেন্ট। এবার থেকে তিনি নানারকম বই পড়া শুরু করলেন। ম্যাক্সমুলেয়রেব Indian, What Can It Teach Us? বইটি পড়ে তিনি প্রধান প্রধান উপনিষদগুলি পড়ে ফেলতেন, সেই সঙ্গে ওয়াশিংটন আরভিন ও টমাস কার্লাইলের লেখা মুহাম্মদ ও ইসলাম সম্বন্ধে দু’টি বই পড়ে মুহাম্মদ সম্বন্ধে বিশেষ শ্রদ্ধান্বিত হলেন। আত্মজীবনীতে লিখলেন, ‘I made too an intensive study of Tolstoy’s books — The Gospels in Brief, What to Do? and other books made a deep impression on me, I began to realize more and more the infinite possibilities of universal love.’অহিংসা ও প্রেম সম্বন্ধে যে আগ্রহ, যে ধারণা, যে বিশ্বাস জন্মেছিল ছাত্রাবস্থায় লন্ডন প্রবাসের কালে তা আরও দৃঢ় ও পরিণত রূপ, আরও সমৃদ্ধতর রূপ পেল এই দক্ষিণ আফ্রিকায় বাসকালের পর্বে।
এদিকে শ্বেতাঙ্গ শাসকদের বিরুদ্ধে আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গ ভূমিপুত্র জুলুদের একটা অভ্যুত্থান ঘটে ১৯০৬ সালের এপ্রিল মাসে। চার মাসের মধ্যে সেই অভুত্থানকে দমন করে ইংরেজরা এক অর্ডিন্যান্স বা অধ্যাদেশ জারি করে যে জুলুদের সঙ্গে এশীয়দের সবাইকে জন্মচিহ্ন ও আঙুলের ছাপসহ নাম নথিভুক্ত করতে হবে এবং নথিকরণের প্রমাণ হিসেবে একটা শংসাপত্র সর্বদা সঙ্গে রাখতে হবে। অন্যথায় মোটা জরিমানা বা তিনমাসের জেল হবে অথবা ট্রান্সভাল থেকে বহিষ্কার করা হবে। গান্ধীর নেতৃত্বে ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন অধ্যাদেশটির আইনীকরণের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে, তবু সেটাকে আইনে পরিণত করা হয়। তখন গান্ধী প্যাসিভ রেজিস্টান্স অ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠা করে শুরু করেন আইন অমান্য আন্দোলন। আন্দোলনটি শুরু করেন ১৯০৬ – এর সেপ্টেম্বরে। পরের মাসেই এই আন্দোলনের আদর্শ ও উদ্দেশ্য ব্রিটিশ মনীষীদের কাছে ব্যাখ্যার জন্য ও ব্রিটিশ জনমত সংগঠনের জন্য গান্ধী ইংল্যান্ড যাত্রা করেন। এদিকে পুরো ১৯০৭ ধরে আন্দোলন চলতে থাকে দক্ষিণ আফ্রিকায়। অবশেষে ১৯০৭এর ২৬ ডিসেম্বর গান্ধীর নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হল। গান্ধী গ্রেফতারি স্বীকারের আগে বললেন, ‘এটা একটা ধর্মীয় যুদ্ধ, আমরা শেষ পর্যন্ত লড়ব।’
‘ধর্মীয় যুদ্ধ’ চলতে থাকে। একমাস পরে গান্ধীকে ছেড়ে দেওয়া হয়। যেসব ভারতীয় আইন মোতাবেক শংসাপত্র পেয়েছিলেন, তারা গান্ধীর নেতৃত্বে ১৯০৮-এর ১৬ আগস্ট ও ২৩ আগস্ট সমবেতভাবে প্রবল উৎসাহেতাদের শংসাপত্রগুলি আগুনে পোড়নোর উৎসব করেন। আবার গান্ধী গ্রেফতার হলেন। এবার তাকে দুমাসের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হল। গান্ধীর এই শাস্তির প্রতিবাদে লন্ডনে উপস্থিত বিশিষ্ট ভারতীয়রা ১৬ অক্টোবর এক সভা করলেন। দু’মাসের কারাদণ্ড ভোগ করার পর তিনি মুক্ত হলেন বটে, কিন্তু কোনও শংসাপত্র না থাকার জন্য আবার তাকে গ্রেফতার করার পরে ছেড়ে আসা হল রাজ্যের বাইরে আর অবাধ্য জেদি গান্ধী ফিরে এলেন সঙ্গে সঙ্গে। এবার তিন মাসের জন্য কারাদণ্ড। জেলে থাকাকালে তিনি টলস্টয়, থারো, এমার্সন প্রমুখের রচনার সঙ্গে গীতা, বাইবেল, মনুস্মৃতি প্রভৃতি পড়েন। ছাড়া পেলেন ১৯০৯-এর মে মাসের শেষ সপ্তাহে। আবার শুরু হল তাঁর সরকার বিরোধী অর্থাৎ আইন অমান্যের আন্দোলন।
আন্দোলনটাকে বিস্তৃত এবং ইংল্যান্ডের সুশীল সমাজকে এই আন্দোলন সম্পর্কে সচেতন করার উদ্দেশ্যে মোহন গান্ধী আবার ইংল্যান্ডে এলেন ১৯০৯-এর ১০ জুলাই। এই সময় দু’জন ইংরেজকে হত্যার অপরাধে মদনলাল ধিংড়ার ফাঁসি হয়। ফাঁসির আগে মদনলাল একটি দেশপ্রেম উদ্দীপক ভাষণ দেন এবং স্বয়ং চার্চিল ভাষণটির উচ্চ প্রশংসা করেন, কিন্তু গান্ধী বলেন যে ভাষণটি দেশপ্রেমের পরিচায়ক হলেও তার সন্ত্রাসবাদ মানবজাতির পক্ষে ক্ষতিকারক। তখন তার মনে প্রশ্ন জাগল, তা হলে মানবজাতির পক্ষে কী বা কোন পথ শুভঙ্কর? তার মনে পড়ল, গতবার তিন মাস জেলে থাকাকালে তিনি থোরো, টলস্টয় প্রমুখের সঙ্গে এডওয়ার্ড কার্পেন্টারের লেখা পড়েছিলেন। কার্পেন্টারের বক্তব্য ছিল এই রকম যে, সভ্যতা এমন একটা ব্যাধি যা চিকিৎসাসাধ্য এবং পড়ার সময়ই গান্ধীর মনে হয়েছিল যে, তিনি এর ঠিক চিকিৎসা করে মানুষকে রোগমুক্ত করবেন। এই সঙ্গে তাঁর মনে পড়ল টলস্টয়ের কথাও। তখন তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার স্থানীয় অধিবাসী আর এশিয়াবাসীদের সঙ্গেইউরোপীয় শাসকগোষ্ঠী কীরকম অমানুষিক ব্যবহার করছে আর সেসবের উত্তরে নির্যাতিত সহিষ্ণুতার সঙ্গে কীরকম আন্দোলন করছে, সেসবের দীর্ঘ বিবরণ দিয়ে গান্ধী ১৯০৯-এর অক্টোবর একটি চিঠি লিখলেন টলস্টয়কে। এইটেই টলস্টয়কে গান্ধীর প্রথম চিঠি।
উত্তরে টলস্টয় ৮ অক্টোবর খুব খুশি হয়ে লিখলেন, ‘Among us, too, this fight between gentleness and brutality, between humility and love and pride and violence, make itsefl ever more strong felt, especially in one of the sharpest, conflicts betwen religious duty and the State laws…’ এখানে ধর্মীয় কর্তব্য মানে গির্জার বিধান নয়, বিবেকের নির্দেশ আর রাষ্ট্রের আইন মানে আদালত-পুঁলিশ-সৈন্যবাহিনীর শাসন। এ চিঠির মর্ম হল ধর্ম ও রাষ্ট্রের পারস্পরিক বৈপরীত্য। টলস্টয়ের উত্তর পেয়ে গান্ধী আর একটি চিঠিতে ১০ নভেম্বর লেখেন যে, দক্ষিণ আফ্রিকায় ভারতীয়দের সংগ্রাম আধুনিক যুগের মহত্তম যুদ্ধ, as it has been idealised both as to the goal as also to the methods adopted to reach the goal” অর্থাৎ উদ্দেশ্য ও উপায়কে এক করে সামনে রাখা হয়েছে। এই আদর্শের স্বপক্ষে টলস্টয় যদি দুকথা লেখেন তাহলে আন্দোলনটা আরও সফল হতে পারে। আন্দোলনটা সফল হলে it will be not only a truimph of reigion, love and truth over irreligious, hatread and falsehood, but it is highly likely to serve as an example to the millions in India and to people in other parts of the world… কিন্তু শারীরিক অসুস্থতার কারণে এ চিঠির কোনও উত্তর টলস্টয় দিতে পারেননি।
গান্ধীও তিন দিন পরে অর্থাৎ ১৩ নভেম্বর লন্ডন থেকে দক্ষিণ আফ্রিকার পথে ফিরে চললেন। ফেরার পথে জাহাজে বসে টানা দশ দিন ধরে মাতৃভাষা গুজরাতিতে আধুনিক সভ্যতা ও স্বাধীন ভারত সম্বন্ধে তার মনের কথা লিখতে লাগলেন। এতদিন ধরে অধ্যয়ন ও অভিজ্ঞতা থেকে যা যা ভেবেছেন, সেসব কথা বিষয় ভাগ করে গুছিয়ে লিখতে লিখতে একটা ছোট বইয়ের বা ইস্তেহারের আকার নিল; ছোট এই বইয়ের নাম রাখলেন ‘হিন্দ স্বরাজ’। এই পুস্তিকাটিতে রাষ্ট্রীয় শক্তির বাহন ও রূপগুলিকে চিহ্নিত করে, সমালোচনা করে, কেমন করে এইগুলির দাসত্ব থেকে মুক্তি লাভ করা যায় তার পথনির্দেশ করেছেন। কিন্তু গুজরাতিতে প্রকাশের অব্যবহিত পরেই বইটিকে ব্রিটিশ সরকার নিষিদ্ধ করে। তখন গুজরাতি ‘হিন্দ স্বরাজ’-এর ইংরেজি অনুবাদ করে গান্ধী ইংরেজিতে প্রকাশ করলেন Indian Home Rule নামে এবং তার এক কপি পাঠিয়ে দিলেন টলস্টয়কে। টলস্টয় যে বইটি মন দিয়ে পড়ছেন সেকথা তার ডায়েরিতে লিখেছেন, তার এক বন্ধুকে চিঠিতেও লিখেছেন, কিন্তু সুস্থ হয়ে পরে বিশদ চিঠি দেবেন আশ্বাস দিয়ে গান্ধীকে লেখেন, ‘I have read your book with great interest, for I consider the question three dealt with — passive resistance — to be of the greatest importance not only for Indians, but for the whole of humanily.’
টলস্টয় এখানে প্যাসিভ রেজিস্ট্যান্স যুগ্ম শব্দটি ব্যবহার করলেও ১৯০৭এর দ্বিতীয়ার্ধেই গান্ধীর মনে হয় ওই শব্দবন্ধে তাঁর আরব্ধ সংগ্রামের সম্পূর্ণ অর্থ ব্যক্ত হচ্ছে না। তখন প্রথমে ‘সদাগ্রহ’ শব্দটি বাছা হয়, পরে মনোনয়ন করলেন ‘সত্যাগ্রহ’ শব্দটি অর্থাৎ ‘the force which is born of truth and love or non-violence’. আবার প্যাসিভ রেসিস্ট্যান্সের ধারণাটি তিনি পেয়েছিলেন ঊনবিংশ শতাব্দীর মার্কিন মনীষী হেনরি ডেভিড থোরোর কাছ থেকে। তাঁকে ১৮৪৯ সালে কারারুদ্ধ করা হয়, কারণ মার্কিন সরকার আরোপিত নির্বাচন বাবদ করটি অসংগত বলে দিতে তিনি রাজি হননি এবং তাঁর বক্তব্য ব্যাখ্যা করে লেখেন Civil Disobedience বইটি। সে বইটি পড়েই গান্ধীর মাথায় আসে নিস্ক্রিয় প্রতিরোধের ধারণা। আর তা-ই পরে সত্যাগ্রহের রূপ লাভ করে অর্থাৎ সত্যাগ্রহের আদর্শটিও গান্ধী বিদেশি ভাবুকের কাছ থেকে পেয়েছিলেন। আবার গান্ধীবাদীদের সমাজে সুপরিচিত তত্ত্ব বা শব্দ ‘সর্বোদয়’ ও প্রকৃতপক্ষে রাসকিন-এর Unto this Last বইখানির গুজরাতি অনুবাদ।
এইভাবে মহাত্মা গান্ধীর ভাবনাচিন্তার ও তত্ত্বসত্যের উৎস সন্ধান করলে আমরা দেখব তার প্রায় সকল ভাবগুরুই অভারতীয় বা বিজাতীয়। তিলক বা সাভারকরের মতো জাতীয়তাবাদী নেতৃবৃন্দের সঙ্গে এখানেই তার মৌল পার্থক্য। তারা গণেশপূজা বা শিবাজি উৎসব প্রচলন করে দেশবাসীর মানসে জাতীয়তাবাদী ভাবধারাকে প্রবাহনের প্রয়াস পেয়েছিলেন, এমনকি সুভাষচন্দ্রও স্বামী বিবেকানন্দের মশাল থেকেই আপন দেশপ্রেমকে জ্বালিয়ে তুলেছিলেন এবং পরে গুরুর পদে বরণ করেছিলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনকে। পক্ষান্তরে মোহনদাস গান্ধী প্রথম থেকেই আপন সংগ্রামী জীবনপথের দিশা নিয়েছিলেন বাইবেল টলস্টয় থোরো রাসকিন কার্পেন্টার প্রমুখের কাছ থেকে এবং তাদের প্রক্ষেপিত আলোতেই চিনে নিয়েছিলেন আপন সত্যকে। এটা ঠিক যে, দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ভারতে এসে ভারতকে স্বাধীন করার জন্য তিনি যে সংগ্রাম শুরু করেন তাকে জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম বলে মনে হয়, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা ছিল মানব সমাজের জন্য ধন-জন-বৈষম্য, মিথ্যা-লক্ষ্য, যান্ত্রিকতা, শোষণ, হিংসা ইত্যাদির বিরুদ্ধে। সংগ্রাম এবং এই সংগ্রামে প্রয়োগ করার জন্য ককগুলি সম্পূর্ণ নতুন ধরনের অস্ত্রের পরীক্ষা। তাই টলস্টয়ও তাঁকে লিখেছিলেন, তার সংগ্রাম শুধু ভারতীয়তের জন্য নয়, সমগ্র মানবজাতির জন্য। বিশের দশকে তিনি বোঝেন যে বহুজনগ্রাহ্য ধর্মশাস্ত্র ‘গীতা’র সঙ্গে তার চিন্তাভাবনা মিলছে না। ‘গীতা’র শিক্ষা হল ক্ষাত্রধর্ম পালনের শিক্ষা—অস্ত্র তুলে নাও ও যুদ্ধ করো, রাজ্য জয় করো। এদিকে তার পাশ্চাত্য শিক্ষাগুরুরা গান্ধীকে সম্পূর্ণ অন্য শিক্ষা দিয়েছেন—অহিংসা ও বিশ্বশান্তিই মানুষের ন্যায্য প্রাপ্য, তাতেই সব মানুষের সমান ও স্বাভাবিক অধিকার। তখন গান্ধীজি গীতার এক নতুন ভাষা রচনা করলেন যার মূল বাণী হল—প্রেম, শান্তি ও সত্য।
মোহনদাস গান্ধী ভারতকে ব্রিটিশ শাসনের হাত থেকে যতটা মুক্ত করতে চেয়েছিলেন তার চেয়ে বেশি চেয়েছিলেন বিশ্বকে এক রাশ ধর্মান্ধতা, মিথ্যা মূল্যবোধ, প্রলোভনবৃত্তি, হিংসার শাসন থেকে মুক্ত করতে। তাই ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী অ্যাটলি যখন ঘোষণা করলেন যে, ১৯৪৮-এর জুন মাসের মধ্যে ভারতকে স্বাধীনতা দেওয়া হবে তখন গান্ধীজি নতুন একটি সংগ্রামে জয়ের লক্ষ্য নির্ণয় করলেন–স্বাধীন ভারতকে গড়তে হবে সেকিউলার রাষ্ট্ররূপে, যেখানে ধর্ম হবে ব্যক্তির একান্তে পালনীয় ব্যক্তিগত সত্য আর রাষ্ট্র হবে জনজীবনে পালনীয় পার্থিব সত্য। এই সেকিউলারিজমের আদর্শটিও গান্ধী পেয়েছিলেন লন্ডনে ছাত্রাবস্থায় এবং তখন সেকিউলারিজমের অন্যতম প্রবক্তা চার্লস ব্র্যাডল-এর শেষকৃত্যে ১৮৯১ সালের ৩০ জানুয়ারি তিনিও যোগ দিয়েছিলেন। নাটকীয়তা এইখানে যে যাঁরা মনে করেন ভারত একটি ধর্মপ্রাণ দেশ, তাঁদেরই কেউ ১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি নিজ ধর্ম অনুসারে গান্ধীকে প্রণাম করার ছলে হত্যা। করেন। পরদিন ৩১ জানুয়ারি ‘বাপুজী অমর রহে’, মহাত্মাজি অমর রহে’ ধ্বনিতে মুখরিত দিল্লির যমুনাতীরে জ্বলল যে চিতা তার আগুন থেকে মশাল জ্বালিয়ে নিলেন ও নিচ্ছেন, বিশ্বের সেইসব মহৎ ও সাহসী মানুষ যাঁরা মানবের মর্যাদা ও মুক্তির জন্য, সত্যাগ্রহ ও সংহতির জন্য শাসক ও শোষকের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করছেন ও করবেন। যেমন মার্টিন লুথার কিং কনিষ্ঠ, নেলসন ম্যান্ডেলা, দালাই লামা, আউভ সান সু কাই এবং আরও অনেকে।
সুলতান মাহমুদের ভারত অভিযান সম্পর্কে জানতে পড়ুন
সুলতান মাহমুদের ভারত অভিযান ও সোমনাথ মন্দির প্রসঙ্গ (১ম পর্ব)
সুলতান মাহমুদের ভারত অভিযান ও সোমনাথ মন্দির প্রসঙ্গ (২য় পর্ব)