লিখেছেনঃ শঙ্করলাল রায়
মহাভারত যে যুগে রচিত হয়, সেই যুগে বঙ্গ কর্বট সুহ্ম প্রভৃতি বিশাল বিশাল আয়তনের সব জনপদের নাম পাওয়া যায়। মহাভারতের একটি অধ্যায়ে বলা হয়েছে যে, অসুর রাজ বলির কোন সন্তান না থাকায় তিনি ক্ষেত্রজ সন্তান গ্রহণে বাধ্য হন। সেই সূত্রে তাঁর রানী সুদেষ্ণার গর্ভে পাঁচটি পুত্র সন্তান জন্ম গ্রহণ করেন সেই যুগের অন্যতম বীর্যবান ঋষি দীর্ঘতমার ঔরসে। রানী সুদেষ্ণার গর্ভজাত ও দীর্ঘতমার ঔরসে উৎপন্ন ঐ পঞ্চপুত্রের নামকরণ করা হয় যথাক্রমে অঙ্গ বঙ্গ কলিঙ্গ সুহ্ম ও পুণ্ড।
বলি রাজার উক্ত ক্ষেত্রজ সন্তান যে পাঁচটি রাজ্য শাসন করতেন তাঁদের নাম থেকেই এই পাঁচটি রাজ্যের নাম করণ করা হয়েছিল। অঙ্গ বঙ্গ কলিঙ্গ সুহ্ম ও পুণ্ড্র এই বিশাল জনপদের মধ্যে অঙ্গ দেশ বলতে বিহারের ভাগলপুর, কোশী, বেগুসরাই প্রভৃতি স্থান নিয়ে ছিল অঙ্গ দেশ – যা মহাভারতে উল্লিখিত দুর্যোধন কর্তৃক প্রদত্ত কুন্তীপুত্র কর্ণের রাজধানী। আর কলিঙ্গ যে ওড়িষা তা বলাই বাহুল্য। কিন্তু বঙ্গ সুহ্ম ও পুণ্ড্র যে বাংলার সঙ্গেই যুক্ত ছিল এবং তা যে সর্ববৃহৎ ভূখণ্ড তা প্রাচীন গ্রন্থাদি পাঠেই জানা যায়।
বাঙালী জাতির আবাসস্থল বলে আমরা জানি যে সমগ্র বঙ্গ দেশ প্রাচীন কালে বহু জাতির মিলিত বসবাসের স্থান ছিল তা বাংলাকে বিভিন্ন নামে অভিহিত হওয়া থেকে অনুমান করে নিতে পারি। যেমন – গৌড়, বঙ্গ, সমতট, চন্দ্রদীপ, বঙ্গাল, পুণ্ড, বরেন্দ্র, রাঢ় (লাঢ়), তাম্রলিপ্ত, কঙ্কগ্রাম, কজঙ্গল, দণ্ডভুক্তি, খাড়ি, নাব্য প্রভৃতি। তবে এসব নামধারী স্থান সমূহ ভিন্ন ভিন্ন ভৌগােলিক সীমারেখা দ্বারা বিভক্ত ছিল। জৈনধর্মগ্রন্থ আচারাঙ্গ সুত্রে রাঢ় বা লাঢ় দেশের নামােল্লেখ আছে। ওখানে রাঢ় দেশের দুই বিভাগের কথা বলা হয়েছে। বজ্জভূমি (বজভূমি) ও সুব্বভূমি (সুহ্মভূমি)। বৌদ্ধ জাতক গ্রন্থেও সুহ্মভূমির নাম পাওয়া যায়।
লাঢ় বা রাঢ় আবার দুই খণ্ডে বিভক্ত ছিল। উত্তর রাঢ় এবং দক্ষিণ রাঢ়। অজয় নদ রাঢ়ের দুখণ্ডের সীমারেখা দ্বারা চিহ্নিত।
বীরভূম জেলা হল উত্তর রাঢ়। যদিও সেই যুগে বীরভূম জেলা কিন্তু বীরভূম নামে পরিচিত ছিল না। এর নাম ছিল বজ্জভূমি বা বজ্রভূমি। বােধ হয় বজ্রের মত কঠিন মাটি বলেই এই নামকরণ করা হয়। ডঃ অতুল সুর লিখেছেন —
“বজ্রযানী বৌদ্ধ সমাজ ‘বীরভূম’ নামের উৎস সন্ধানে (অপর নাম কালযান বা সহজযান) এই বীরভূম থেকেই উদ্ভূত হয়েছিল। বজ্রযানের দুই শাখার মধ্যে সহজযানের প্রবর্তক ছিলেন লুইপাদ নামে এক জন বাঙালী। তীব্বতের বৌদ্ধ সমাজ তাঁকে সিদ্ধাচার্য বলে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন।” (“বাংলা ও বাঙালীর বিবর্তন”, ১১৮ পৃষ্ঠা)
বজ্রযানী বৌদ্ধসমাজ যদি সত্যিই এই বীরভূম থেকেই উদ্ভূত হয়ে থাকে তবে অনুমান করে নিতে দ্বিধা নেই যে, নেপাল ও তিব্বতে প্রাপ্ত ধর্মগ্রন্থের রচয়িতা ছিলেন বীরভূমেরই সন্তান। মহামহােপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপাল ও তিব্বত পরিভ্রমণ করে যে সব বৌদ্ধদোহা আবিষ্কার করেছিলেন (যদিও তা খণ্ডিতাংশ) যে গুলি সান্ধ্যভাষা বা অবহট্ট ভাষায় রচিত হয়ে চর্যাগীতি বলে সুপরিচিত। প্রায় সকল পণ্ডিতবর্গই এগুলিকে বাংলা ভাষার আদিরূপ বলে উল্লেখ করেছেন। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী চর্যাগীতি সমূহ একত্রিত করে ‘চর্যাচর্যবিনিশ্চয়’ নামে পুস্তক প্রকাশ করেন। এপর্যন্ত মােট ২২ জন চর্যাপদ রচয়িতার নাম পাওয়া গেছে। তার মধ্যে লুইপাদ, কাহুপাদ, সরােজ বজ্র প্রভৃতি কবিরা প্রধান। সরােজ বজ্র রচিত চর্যাপদের নাম ‘ডাকিনী বগুহ্য গীতি মর্মোপদেশ’ ।
সুতরাং অনায়াসে অনুমান করা চলে যে বজ্রভূমি সঞ্জাত বজ্রযানী বৌদ্ধসমাজের চর্যাপদ রচয়িতারা বীরভূমেরই বাসিন্দা ছিলেন। বাংলায় মুসলমান আক্রমণের ফলে তারা তিব্বত ও নেপালে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন।
বীরভূমের নাম জৈন ও বৌদ্ধ যুগে সুহ্ম প্রদেশান্তর্গত লাঢ় বা রাঢ় অঞ্চলের বজ্জভূমি বা বজ্রভূমি বলে উল্লেখিত হতে দেখলেও অন্যত্র একে ‘কামকোটি’ নামেও অভিহিত হতে দেখা যায় –
‘কোমকোটি বীরভূম জানিবে নিয্যসচেতন’
-মহেশ্বরের কুল পঞ্জিকা
আবার
‘বীরাভূঃ কামকোটি স্যাৎ প্রাচ্যং গঙ্গা জয়ন্বিতা’
ইত্যাদি সংস্কৃত শ্লোকের উল্লেখ বীরভূম সম্বন্ধীয় রচনাদিতে আখচার দেখতে পাওয়া যায়। সুতরাং বীরভূম জেলাটিকে বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন নামে অভিহিত করা হয়েছে তার একটু আভাষ পাওয়া গেল।
কিন্তু বঙ্গভূমিই বলুন, আর কামকোটিই বলুন, বীরভূমকে যে জৈন ও বৌদ্ধযুগে রাঢ় দেশ বলা হয়েছে এবং তা সুহ্ম প্রদেশান্তর্গত তার প্রমান এখনাে কিছু অবশিষ্ট আছে কি? আপনারা নিশ্চয় জানেন যে, সাঁইথিয়া থানান্তর্গত একটি গ্রামের নাম ‘রাঢ় খেন্দ’– রাঢ় কেন্দ্র সম্ভবত:। তার অর্থ এই যে সমগ্র রাঢ় অঞ্চলের কেন্দ্রভূমিই হয়ত কোন কালে ছিল। দক্ষিণ রাঢ়ের শেষ প্রান্ত, অজয়ের তীরে শ্যামরূপার গড়ের নিকটে রাঢ়েশ্বর শিব মন্দির রয়েছে (তারাশঙ্কর তাঁর ‘রাধা’ উপন্যাসের পটভূমি নির্বাচন করেছিলেন এখানে) তার নিকটস্থ গ্রামের নাম ‘আড়া’। আড়া শব্দটি কি রাঢ়া? মানে রাঢ়? বীরভূমে সুহ্ম রায় নামে ধর্মঠাকুরের সন্ধান পাওয়া যায়। সুহ্মেশ্বরী নামেও একদেবী রয়েছেন। এই সব নাম করণের মধ্যেই প্রমান রয়েছে সুহ্ম দেশের, প্রমান রয়েছে লাঢ় বা রাঢ়ের।
সে তাে হলাে। কিন্তু বজভূমিই যে বীরভূম আর বজ্রযানী বৌদ্ধ সমাজের উৎপত্তিস্থলই যে বীরভূম জেলা তা জানা যাবে কি উপায়ে?
অতীতের বীরভূম আর বর্তমানের বীরভূমে দুটি স্থান রয়েছে “বজ্র” শব্দ দিয়ে। একটি হলাে রামপুরহাট শহরের পূর্বপ্রান্তে অবস্থিত সুবৃহৎ গ্রাম মাড়গ্রামে “বজ্রাবাড়ী” নামে একটি স্থান। নাতিউচ্চ একটি ঢিবি। যার চতুঃস্পার্শ্ব ছোট ছােট পাতলা ইটের প্রাকার সদৃশ একটি স্থান। সম্ভবত: বজ্রাবাড়ী হলাে সেই স্থান। বজ্রযানীদের মঠ-বাড়ি – সংঘারাম বা বৌদ্ধবিহার। পাতলা ইটের গাঁথুনী যুক্ত ঢিবি মতাে নাতিউচ্চ উক্ত ভূখণ্ডে একসময় একটি গােলাকার সুবৃহৎ ইঁদারা সদৃশ ভিত দেখতে পাওয়া যেত। বজ্রাবাড়ী সংলগ্ন দর্জিপাড়ায় মুজিবর রহমান নামে জনৈক ব্যক্তি আমাকে জানিয়ে ছিলেন। বলা যায়না ঐ গােলাকার ভিতটিই বজ্রযানী বৌদ্ধদের স্থূপ কি না! ঐ ‘বজ্র’ শব্দযুক্ত অন্য আরাে একটি স্থানের নাম পাওয়া যায় – সেটি বর্তমানে ঝাড়খণ্ড সীমানায় — তবুও যে সময়ের কথা বলছি সেই সময়ে স্থানটি বীরভূমের আদি সীমানার মধ্যেই ছিল। স্থানটি হলাে – রাণীবহাল থেকে ময়ূরাক্ষী নদী পেরিয়ে দুমকা জেলান্তর্গত মশলিয়ার দিকে যেতে যে সব গ্রাম পেরুতে হয় যেমন কুণ্ডহিত, কান্না, খেজুরী প্রভৃতি তারই মধ্যে একটি গ্রামের নাম “বজ্রভূমি বৃন্দাবনী”। স্থানীয় লােকেরা বলেন এই গ্রামে একদা গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু একরাত্রি আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন।
“বজ্রভূমি বৃন্দাবনী” কিন্তু জৈনধর্মাবলম্বীদের কাছে মহাতীর্থ স্বরূপ। তার আগে বলে নিই – জৈনধর্মাবলম্বীরা ঝাড়খণ্ডের বহু স্থানকেই সিংহভূমি বলে অভিহিত করে থাকেন। কারণ জৈনধর্মের শেষতম তীর্থংকর মহাবীরের প্রতীক চিহ্ন হল সিংহ। সেই জন্য মহাবীরের অপর নাম সিংহপ্রভু। হিন্দুদের দেবদেবীর বাহন বলে যেমন নানা পশুপাখি রয়েছে জৈন ধর্মের ২৪ জন তীর্থংকরদের তেমনি প্রত্যেকের আলাদা আলাদা প্রতীক চিহ্ন রয়েছে – যেমন বৃষ, হস্তি, বরাহ, অশ্ব, মেষ, সাপ, শংখ, কচ্ছপ ইত্যাদি।
মহাবীর যখন রাজন্যসুখ পরিত্যাগ করে সন্ন্যাস গ্রহণ করেন তখন। প্রথম এসেছিলেন ময়ূরাক্ষী নদীর উৎসস্থল বলে কথিত মৌরাখ আশ্রমে। স্থানটি ত্রিকূট পাহাড়। বর্তমানে দেওঘর সীমানার মধ্যে। অচিরাৎ ঐ আশ্রমের পূর্বজ সন্ন্যাসীরা মহাবীরকে বিতাড়িত করেন তাঁর অনাচারী সাধন পদ্ধতি অনুসরণের অপরাধে।
মহাবীর ময়ূরাক্ষী তীর ধরে ক্রমশ: এগিয়ে চলেন তাঁর পূর্বজ তীর্থংকর পার্শ্বনাথের পথ পরিক্রমণে। এসে পৌঁছান রাজনগরের অদূরে তন্ত্রের পাহাড়ের পাদমূলে। তন্ত্রের পাহাড়কে অনেকে তাঁতলৈ নামেও অভিহিত করে থাকেন। তার পার্শ্ববর্তী গ্রামের নামও তাঁতলৈ। ওখানে। রয়েছে এক ত্রিবেণী সঙ্গম – ছােট তিনটি কাঁদর সিদ্ধেশ্বরী, ফটকে ও নুন বিল নিয়ে এক নাতি প্রশস্ত জলাশয়। কাছেই সতী ঘাটা নামে স্থান রয়েছে। ওখানকার মাটি খুঁড়ে একটি প্রাচীন মন্দির উদ্ধার করা হয়েছে। দ্বাদশ হস্ত বিশিষ্ট এক মূর্তিও আবিষ্কৃত হয়েছে – মূর্তিটির মস্তকোপরি এক বৃহৎ সর্প ফনা মেলে রয়েছে। অনুমিত হয় যে, ওই মূর্তিটি মহাবীরের পূর্ব তীর্থংকর পরেশনাথের। জৈন ধর্মাবলম্বিরা বলেন, তাঁতলৈই গ্রামের তন্তুবায়দের দিয়ে মহাবীরের অনুসরণকারী জনৈক ব্রাহ্মণ মহাবীরের পরিত্যক্ত বস্ত্রখণ্ড রিফু করিয়ে মহাবীরের দাদার কাছ থেকে প্রচুর উপঢৌকন আদায় করেছিলেন।
তাঁতলৈ শুধু নয় – আশে পাশে যত গ্রাম আছে সব গ্রামেই দু’চার ঘর জৈন ধর্মাবলম্বী ‘শরাক’ সম্প্রদায় রয়েছেন। এই সব শরাক সম্প্রদায় যে কতদিন পূর্ব থেকে এঅঞ্চলে বাস করছেন সে সম্বন্ধে সঠিক তথ্য এঁরাও জানেন না। অনুমান করে নিতে অবশ্য দোষ নেই যে বীরভূম যখন বজ্রভূমি নামে পরিচিত ছিল তখন থেকেই এঁদের বাস।
মহাবীরের পথ পরিক্রমণের একটি পথ রেখার বর্ণনা দিয়ে সাঁইথিয়া নিবাসী ভােজরাজ জৈন একটি পুস্তক রচনা করেছিলেন বীরপ্রভু কি উপসর্গ লীলাস্থলী বীরভূম কি কুছ প্রমুখ ‘স্থান’ নামে উক্ত পুস্তকে তিনি বহু গ্রামের নাম উল্লেখ করেছিলেন যেগুলি রাজনগর থানা, মহম্মদ বাজার থানা ও সাঁইথিয়া থানান্তর্গত। বলিহারপুর, ভাগাবাঁধ, টাং দহ, বাঁশকুলী, রাউতাড়া, আঙ্গার গােড়ে, উশকা প্রভৃতি হল সেই সব গ্রাম। তাতে তিনি মহাবীরের বীরভূমে বসবাসের জীবন্ত বর্ণনা দিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে – বাবুলাল জৈন জমাদার নামে একজন গবেষক “প্রাচ্য জৈন সরাক শােধ কার্য” নামক গবেষণা গ্রন্থেও এতদঞ্চলের শরাক সম্প্রদায় – সম্বন্ধে বিস্তারিত লিখেছেন।
“শরাক” সম্প্রদায় বলতে কেবলীদের বাণী শ্রবণ করে সেই ধর্ম অনুসরণ করেন যারা তাদেরকে ‘শ্রাবক’ বলা হয়। জৈন ধর্মে এঁদেরকেই ‘শরাক’ বলা হয়েছে।
আচার্য ক্ষিতিমােহন সেন “বাংলা দেশ ও জৈনধর্ম” নামক প্রবন্ধে বলেছেনঃ-
“তীর্থংকরেরা ধর্মউপদেশ দিয়েছেন কিন্তু লেখেন নাই। শ্রুতকেবলীরা এই সমস্ত উপদেশ সংগ্রহ ও সুবিন্যস্ত করেন। … চতুর্থ শ্রুতকেবলী ভদ্রবাহু রচিত বহু শাস্ত্র রহিয়াছে।…. এইগুলি প্রাচীনতম জৈন শাস্ত্র।… এই ভদ্রবাহুর জন্মভূমি বাংলাদেশ।”
বৌদ্ধ ধর্মের লুইপাদ এ আর জৈন ধর্মের ভদ্রবাহু এই দুই মহান বাঙালী ধর্মপ্রবর্তকদের ধর্মপােদেশ গ্রন্থায়িত না করলে এইসব ধর্ম কোথায় গিয়ে দাঁড়াতাে ভাবলে বিস্মিত হতে হয়।
– ডঃ অমলেন্দু মিত্রের ‘রাঢ়ের সংস্কৃতি ও ধর্ম ঠাকুর’ বইয়ের ভূমিকা লিখেছেন বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের রীডার ও রাঢ় গবেষণা পর্ষদের অধ্যক্ষ প্রয়াত ড: পঞ্চানন মণ্ডল। সেই ভূমিকার এক জায়গায় লিখেছেন –
“রাঢ় বা লাঢ় দেশের বজ্রভূমি ও সুহ্মভূমিতে খৃষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দে জৈন ধর্মের বিশেষ প্রচার হয়েছিল। শ্ৰমণ ভগবান মহাবীর বজ্রভূমির অস্থিক বর্ধমানে ও স্বস্থিত বর্ধমানে বহুবর্ষ যাপন করেছিলেন। জংভয় অসুরের আনুকূল্যে তার সিদ্ধিলাভ হয়েছিল।”
স্বস্তিত ও অস্থিক বর্ধমান হলাে বর্তমানে বর্ধমান জেলা ও বীরভূম জেলা সংলগ্ন ‘মঙ্গলকোট’। অজয় তখন বয়ে যেত আরাে দক্ষিণ দিক দিয়ে। এই তাে সেদিন অজয় নদের তীর থেকে বহু জৈনমূর্তি আবিষ্কৃত হয়েছে। সুতরাং বজ্রভূমি যে বীরভূম জেলাই সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। আর জৈন ধর্ম যে এঅঞ্চলে ব্যাপক বিস্তার লাভ করেছিল তাতেও কোন সন্দেহ নেই। ডঃ অতুল সুর তার ‘বাংলা ও বাঙালীর বিবর্তন’ নামক এ গ্রন্থের ১০৩ পৃষ্ঠায় লিখেছেন “জৈন ধর্মই প্রথম বাঙলা দেশে শিকড় গেড়েছিল। এর প্রাদুর্ভাব বিশেষ করে ঘটে ছিল মানভূম, সিংহভূম, বীরভূম ও বর্ধমান জেলায়।” ঠিক এই কথায় লিখেছেন ডঃ নীহার রঞ্জন রায় তাঁর ‘বাঙালীর ইতিহাস’ নামক গ্রন্থে —
“জৈন ধর্মের ঐতিহাসিকত্ব স্বীকার করিলে বলিতে হয়–মানভূম, সিংহভূম, বীরভূম ও বর্ধমান বাংলার এই চারিটি জেলার স্থাননাম জৈন তীর্থংকর ভগবান মহাবীরের নাম হইতে গৃহীত হইয়াছে।”
মহাবীর যখন বজ্রভূমিতে বাস করছিলেন সেই সময় পরদেশী নামে একজন ক্রুর স্বভাবের রাজা সেয়ম্বিয়া নগরীতে বাস করতেন (সেয়ম্বিয়ার বর্তমান নাম সাঁইথিয়া)। শক্তিপুজার নামে এমন কি নরবলি পর্যন্ত দিতেন। মহাবীরের সংস্পর্শে এসে পরদেশী রাজা সম্পূর্ন বদলে গিয়ে মহাবীরের পাদপদ্মে তাঁর রাজত্ব নিবেদন করে এর নাম দেন বীরভূম। সেই থেকে সমগ্র জেলাটির নাম হয়ে যায় বীরভূম।
সেই যুগে শ্রমণ বা তীর্থংকরদের ভূমিদান করা ছিল এক মহানব্রত। আচার্য বিনােবাভাবের ভূদান যজ্ঞের মতাে ব্যাপারটা। শ্রমণেরা সংঘ বা সংঘারামের জন্য সামান্য জমি রেখে সম্পূর্ণটাই বিলিয়ে দিতেন ভূমিহীনদের হাতে। জৈনধর্ম গ্রন্থ ‘আচারঙ্গ সুত্ত’ (সুত্র) এবং অন্যান্য জৈন গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে বাবুলাল জমাদার তার শরাক গবেষণা পুস্তকে এসব বিস্তারিত লিখেছেন।
বীরভূম নামটি মহাবীরের বীরপ্রভু, অতিবীর প্রভৃতি উপনাম থেকে গৃহীত। বর্ধমান হলাে সরাসরি মহাবীরের প্রধান নাম বর্ধমান থেকে সে কথা ইতিহাসের পাঠক মাত্রেই জানেন। ‘সিংভূম’ হলাে তাঁর প্রতীক জাত নাম আর মানভূম হলাে বর্ধমান শব্দের শুধুমাত্র ‘মান’ টুকু নিয়ে।
এই সব নাম করণের বিরােধিতা হতে পারে এমন বহু যুক্তি আছে। বলা বাহুল্য সেগুলিও অকাট্য নয়। প্রয়ােজনে তারও বিস্তারিত তথ্যসহ যুক্তি পরিবেশন করা যেতে পারে।
জৈনধর্মাবলম্বীদের কাছে পরদেশী রাজার কাহিনী যেমন সুপরিচিত তেমনি মহম্মদ বাজার থানা অধীন ডেউচার অদূরে উশকা গ্রামের যােগীপাহাড় হলাে তাঁদের কাছে এক মহাতীর্থ। ঐ পাহাড়ের শীর্ষে আছে মহাবীরের নামাঙ্কিত জৈনমন্দির। কলকাতা শ্বেতাম্বরী জৈন সমাজের পঞ্চায়েত সমিতি সমগ্র অঞ্চলটি ক্রয় করে অতিথিশালা, প্রার্থনা গৃহ প্রভৃতি নির্মাণ করেছেন। উক্ত যােগীপাহাড়ে চণ্ডকৌশিক নামে এক বৃহৎ সৰ্প মহাবীরের পাদমূলে দংশন করেছিল। ঐ সর্পদংশনে মহাবীরের মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী ছিল কিন্তু কঠোর তপস্যায় সিদ্ধপুরুষ মহাবীর নাকি তাঁর ক্ষতস্থান থেকে দুধ বের করে উক্ত বিষ সম্পূর্ণ নষ্ট করে ফেলেছিলেন। এই অত্যাশ্চর্য ঘটনার স্থানটি জৈনদের কাছে মহাপবিত্রভূমি। বলা উচিত যে ‘উশকা’ শব্দটি কৌশিক শব্দেরই রূপান্তরিত নাম।
কামকোটির নাম বীরভূম হলাে কি করে
বীরভূমের আদিনাম ছিলাে কামকোটি (‘কাম কোটি বীরভূম জানিবে নিয্যস’ মহেশ্বরের কুলপঞ্জিকা)। কিন্তু কাম কোটি এই নামটি পরবর্তী কালে ‘বীরভূম’ নামে পরিচিত লাভ করলাে কি ভাবে তার কোন লিখিত বিবরণ বা নথীপত্র পাওয়া সম্ভব নয়। গুপ্ত, পাল বা সেন বংশীয় রাজাদের কোন তাম্রশাষণ পাওয়া গিয়েছে এমন কথাও শােনা যায় না। বীরভূমের পাইকর, বারা এবং অন্যান্য স্থানে যে সকল পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শনাদি আবিষ্কৃত হয়েছে তার মধ্যে ‘বীরভূম’ নামকরণ বিষয়ে জ্ঞাতব্য তথ্যাদি পাওয়া যায়নি। ভবিষ্যতে পাওয়া যাবে কি না কে জানে। অথচ সুহ্ম প্রদেশান্তর্গত লাঢ় বা রাঢ় অঞ্চলের মধ্যে যে কামকোটি সে কথা বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়। কিন্তু কোন অবস্থাতেই ‘বীরভূম’ নামকরণের সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না। নানা মুনির নানা মতের মতাে অনেকগুলি মত প্রচলিত আছে। তার মধ্যে কয়েকটি হলোঃ
এ দেশের ঘন জঙ্গলাকীর্ণ অঞ্চলের আদিম বাসিন্দারা জল হাওয়ার গুণে বলবান বীর্যবান ও শারীরিক শক্তিমত্তায় বহিঃশত্রু এবং বন্য জন্তু – জানােয়ারদের হিংস্র আক্রমণ প্রতিহত করতে বীরত্বের পরিচয় দিতেন; বলতে গেলে জীবন যাপনের তাগিদে সর্বদাই বিপরীত পরিস্থিতির মধ্যদিয়ে চলতে হত। যে মাটিতে বা ভূমিতে এই রকম বীর জাতির বাস তাদের দেশ অবশ্যই বীরভূম বা বীরদেশ। আবার ইতিহাসের বিভিন্ন পুস্তকে এই অঞ্চলের হিন্দুরাজাদের বিশেষত: লখনুর বা রাজনগরের আদিরাজাদের ‘বীর’ উপাধি থেকে বীরভূম নামের উৎপত্তি বলে বীরভূমের ইতিহাস রচয়িতারা মন্তব্য করে গেছেন। কেউ কেউ আবার মল্লরাজ বীর হাঘিরের নামানুসারে বীরভূম নামের উৎপত্তি, এই কথাও বলেছেন। এ ছাড়া বহুশত বৎসর পূর্বে ভারতের উত্তর পশ্চিম – সীমান্ত থেকে (সম্ভবতঃ পাঞ্জাব) বীর সিংহ এবং চৈতন্য সিংহ নামক দুই ভাই বীরভূমে ভাগ্যান্বষণে এসে এখানকার আদিম জাতিদের পরাস্ত করে রাজত্ব কায়েম করেন এবং সিউড়ীর অদূরে রাজনগরের কাছে বীরসিংহপুর নামে রাজধানী প্রতিষ্ঠা করেন। সেই থেকে এই জেলার ১ নাম হয়েছে বীরভূম বলে অনেকে বলেন। (রাজনগরের ১২ মাইল উত্তরে বর্তমান মশানজোড় জলাধার থেকে দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে তরণীপাহাড়ে বীররাজার একটি দুর্গ ছিল – যার ধ্বংসাবশেষ এখনাে দেখা যায়)।
অন্যমত হলাে – বীরভূম হলাে নানা ধর্মীয় চেতনার সঙ্গমস্থল (ডঃ অতুল সুর তাঁর ‘বাঙলা ও বাঙালীর বিবর্তন’ নামক বইয়ে বীরভূমকে বাংলার ধর্মীয় চেতনার যাদুঘর বলে উল্লেখ করেছেন)। এখানে আছে বহু পীঠস্থান, একান্ন সতীপীঠের পাঁচটি পীঠ বক্রেশ্বর, কংকালীতলা, ফুল্লরা, নন্দীকেশ্বরী, নলাটেশ্বরী প্রভৃতি মহাপীঠগুলি এই জেলাতেই আছে আবার তারাপীঠের মত মত সিদ্ধপীঠও এই জেলাতেই। এই সব পীঠস্থানে বহু সাধক বীরাচারে তন্ত্রসাধনা করে গেছেন। সেই হিসেবে বীরাচারী তান্ত্রিকদের পুণ্যভূমি এই বীরভূমি নামান্তরে বীরভূম।
ভাষা তাত্ত্বিকদের মত অনুসারে আদি অষ্ট্ৰিক মানব গােষ্ঠী দ্রাবিড়জাতির বাসছিল এই জঙ্গলের দেশে-মুন্ডারী ভাষায় ‘বির’ অর্থে জঙ্গল। বনজঙ্গলাধ্যুষিত ভূমি থেকেই এই জেলার নাম হয়েছে বির+ভূমি=বিরভূমি নামান্তরে বীরভূম।
উপরােক্ত এই সব মতগুলি হলাে প্রচলিত মত। কিন্তু সব চাইতে বিস্ফোরক মত যেটি এবং যে মতটি সব চাইতে গ্রহণযােগ্য বলে মনে হয়, সেটি হলাে জৈন ধর্মাবলম্বীদের মত। এই মতটি সম্বন্ধে জৈনধর্মাবলম্বীরা যে সব যুক্তিদেন তা যথার্থ এবং সঙ্গত বলে মেনে নিতে হয়। জৈন ধর্মে চব্বিশ জন তীর্থংকর আছেন। শেষতম তীর্থংকর হলেন ভগবান মহাবীর। জৈগ্রন্থাদিতে তাঁকে ‘বীরপ্রভু’ – ‘অতিবীর’-‘সম্মতি’ এবং ‘বর্ধমান’ নামে অভিহিত করা হয়। লক্ষ্য করে দেখা গেছে, জৈন ধর্মের তীর্থংকরদের এক এক জনের একাধিক নাম আছে। যেমন প্রথম তীর্থংকর ঋষভনাথ হলেন-‘আদিনাথ’। নবম তীর্থংকর পুষ্পদন্তস্বামী ‘সুবিধিনাথ’ নামে পরিচিত। বীরভূমের উপর দিয়ে অতীতকালে জৈন তীর্থংকরেরা নানা স্থানে যাতায়াত করতেন। শুধু তাই নয়, বীরভূম জেলার সীমান্ত থেকে মাত্র সত্তর মাইলের মধ্যে সুমেত শিখর বা পরেশনাথ পাহাড়ে আছে কুড়িজন তীর্থংকরের সমাধি (গিরিডি বা দেওঘর থেকে স্থানটি খুব বেশী দূরে নয়; বলা বাহুল্য পূর্বে দেওঘর সহ সমগ্র সাঁওতাল পরগনা ছিল বীরভূমের অন্তর্ভূক্ত)।
জৈন গ্রন্থাদি পাঠে জানা যায় যে, বীরপ্রভু অর্থাৎ মহাবীর সর্বপ্রথম তপস্যার জন্য আসেন দেওঘরের সন্নিকট ‘তিউর মৌরনাচ’ পাহাড়ের চূড়ায় সুবিশাল সমতল ভূমিতে অবস্থিত মৌরাখ আশ্রমে। কিন্তু অন্যান্য তপস্বীদের বিরােধিতায় প্রায় নগ্ন মহাবীর মাত্র পনের দিনের মধ্যেই ওখান থেকে সরে যেতে বাধ্য হন। এখনাে উক্ত মৌরনাচ পাহাড়ের চূড়া জৈন ধর্মাবলম্বীদের কাছে এক মহাতীর্থ রূপে পরিচিত। ঐ আশ্রমের নিচে প্রবাহিত ঝর্ণা থেকেই শুরু হয়েছে, ময়ুরাক্ষী নদী। মহাবীরের সময়ে এই ময়ুরাক্ষীর নদীর নাম ছিল সুবর্ণবালুকা। প্রচলিত মত হল — ‘তিউর মৌর নাচ’ পাহাড়ে অবস্থিত মৌরাখ আশ্রমের নামানুসারে নাকি ময়ুরাক্ষী নদীর নামটি গৃহীত হয়েছে।
মৌরাখ আশ্রম থেকে মহাবীর ক্রমশঃ অজয় নদের ধারে ধারে বীরভূম ও বর্ধমান জেলার সীমান্তবর্তী মঙ্গলকোট গ্রামের বাইরে শূলপানি শিব মন্দিরে আসেন এবং তার চাতুর্মাসিক তপস্যা সমাপন করেন। পরে কাঞ্চননগরে বর্তমানে বর্ধমান শহর তৈরী হলে ঐগ্রামের নাম হয় অস্থিকগ্রাম।
বীরপ্রভু এরপর বীরভূমে আসেন। অজয় নদী পেরিয়ে তিনি বােলপুর, সিউড়ি, রাজনগর হয়ে ময়ুরাক্ষী-সিদ্ধেশ্বরী-ফটকেনদীর ত্রিবেণী সঙ্গমে তশ্বের পাহাড়ের পাদদেশে – যেখানে একটি উষ্ণজলের কুণ্ডু আছে, সেখানে তিনি ধ্যানস্থ হন। স্থানটির ভৌগােলিক অবস্থান হল পূর্বে বর্ণিত তরণী পাহাড় থেকে আন্দাজ দু’মাইল দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে এবং রাজনগরের উত্তর-পূর্ব কোণে মাত্র দু’তিন মাইলের মধ্যে। স্থানটির বর্তমান নাম হলাে তাতলই। তাঁতলই এর কাছেই আছে সতীঘাট নামক এক পবিত্রস্থান। আশে পাশের গ্রামগুলি হলাে জয়তারা, বিলকান্দি, বাঁশকুলী, লাউবেড়িয়া, কুন্ডহিত, ঢাকা, ঘুড়িগড়, হাড়জুড়িয়া, সিলাজোরি, শাদীপুর প্রভৃতি। এসব গ্রামে এখনাে দু এক ঘর জৈনধর্মাবলম্বী ‘শরাক’ (শ্রাবক) জাতিদের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। এর মধ্যে কিছু কিছু গ্রাম অবশ্য বিহারের (বর্তমাণ ঝাড়খণ্ড) মধ্যে পড়েছে।
যাই হােক, উপরােক্ত গ্রামগুলি ধরে আমরা যদি পরিক্রমা শুরু করি এবং খোঁজ খবর করতে থাকি তাহলে জানতে পারবাে যে বীরপ্রভু ক্রমশঃ এগিয়ে চলেছেন সাঁইথিয়ার দিকে। পথে যে সব গ্রাম পড়ছে তার প্রায় সব গ্রামেই জৈন ধর্মাবলম্বী শরাক জাতি দু’চার ঘর আছেই – যেমন ধরুন বলিহারপুর, ভাগাবাঁধ, টাংদহ, জামজুরি, হকিকতপুর প্রভৃতি (অবশ্য এর মধ্যে দু একটি গ্রামের শাকরা এখন আর শরাক নেই – মিশে গেছেন হিন্দুদের মধ্যে)।
সাঁইথিয়া পৌঁছানাের আগে বীরপ্রভু ডেউচার (পূর্বনাম দক্ষিণ বাচাল) সন্নিকট যােগীপাহাড়ী নামক পাহাড়ে ধ্যানস্থ হয়েছিলেন (বর্তমানে ওখানে একটি জৈন মন্দির স্থাপিত হয়েছে)। শােনা যায়, ঐস্থানেই মহাবীরকে চন্ড কৌশিক নামে এক মহাবিষধর সর্প দংশন করেছিল। ধর্মবিশ্বাস এই যে, উক্ত চন্ডকৌশিক সর্প পূর্বজন্মে ছিলেন এক মহাক্রোধী শাপভ্রষ্ট মুনি – যার নাম ছিল গােভদ্রমুনি। সর্পদংশনের ফলে মহাবীরের শরীর থেকে রক্তের বদলে নাকি দুধ বেরিয়ে আসে। এই আশ্চর্য ঘটনা দৃষ্টে চন্ড কৌশিক নামক বিষধর সর্প তার পূর্ব জন্মের স্মৃতি ফিরে পান। (যােগী-পাহাড়ের নিকটতম গ্রামের নাম ছিল ‘কৌশিক’ বর্তমানে যেটা ‘উশকা’ নামে পরিচিত। কৌশিক নামটি বলা বাহুল্য চন্ডকৌশিক নামেরই রূপান্তর।) পরে অবশ্য চন্ডকৌশিকের মৃত্যু হয় ওখানেই। এবং মহাবীর নিজ হাতে তার অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়া সম্পাদন করেন।
এরপর মহাবীর রাউতাড়া গ্রাম (পূর্বনাম উত্তর বাচাল) পার হয়ে আঙ্গারগােড়ে আসেন। কথিত আছে যে আঙ্গারগােড়ের পূর্ব নাম ছিল সােনার-গােড়ে; এক মহাবিষধর সর্পের বিষ নিঃশ্বাসে জ্বলে পুড়ে কয়লা অর্থাৎ আঙ্গারে পরিণত হয় এবং সেই থেকে আঙ্গার গােড়ে নামে এর পরিচিতি। ওখান থেকে বীরপ্রভু ময়ুরাক্ষী নদীর তীরে তীরে সাঁইথিয়ায় আসেন। সাঁইথিয়ার পূর্বনাম ছিল সংস্কৃত নাম শ্বেতাম্বিকা নগরী। তখন কার দিনে এখানে পরদেশী নামে এক অনার্য রাজার রাজধানী ছিল এবং তাঁর রাজধানীর নাম ছিল সেয়ংবিয়া (আচারাঙ্গ সূত্র)। জৈনগ্রন্থাদির পাঠককুলের কাছে পরদেশী নামক রাজার নাম অপরিচিত নয়। ইনি অত্যন্ত নিষ্ঠুর প্রকৃতির ব্যক্তি ছিলেন। শক্তি পূজার নামে রক্তের নদী বইয়ে দিতেন। মহাবীরের ধর্মাপদেশ শ্রবণ করে তাঁর মন পরিবর্তন হয়ে যায় এবং তিনি মহাবীরের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। জৈন গ্রন্থাদিতে তিনি পরদেশী শ্রাবক (শরাক) রাজা রূপে বিখ্যাত হয়ে আছেন। সেয়ংবিয়া নগরী ত্যাগ করে মহাবীর কুন্ডলা, কোটাসুর প্রভৃতি স্থান পরিভ্রমণ করে একচক্রা নগরীতে (বীরচন্দ্রপুর) আসেন – এবং ওখান থেকে রাজগ্রামের পথে যােগীগুহা সীতাপাহাড়ী প্রভৃতি স্থানে তাঁর ধ্যান গম্ভীর কঠোর তপশ্চর্যার আশ্চর্য সব কাহিনী জৈনগ্রন্থাদিতে উল্লেখিত হয়ে আছে।
ঐ রাজগ্রামের পথ ধরে রাজমহল পর্বতমালার গভীর বনাঞ্চল ভেদ করে গঙ্গা নদী পার হয়ে মগধের দিকে চলে যান – এবং রাজগীর হয়ে পাওয়াপুরীতে নির্বাণ লাভ করেন।
মহাবীরের জীবনপঞ্জির উল্লেখ করা আমার উদ্দেশ্য নয়। আমার বক্তব্য হলাে – জৈন গ্রন্থাদিতে বীরভূমের নাম বীরপ্রভু মহাবীর বা অতিবীরের নামানুসারেই যে হয়েছিল বলে প্রচার করা হয়। তার কার্যকারণের বিবরণ পেশ করা।
জৈন সম্প্রদায়ের মত হলাে – একচক্রানগরী মহাবীরের স্মৃতিকে কর ধারণ করে বীরচন্দ্রপুর নামে পরিচিতি লাভ করেছে। এই ভাবে চিন্তা থাকা বিচিত্র নয়। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে বীরসিংহপুরের উত্তরে তন্ত্রেশ্বর বা তাতলই পাহাড়ের নিচে উষ্ণজলের কুন্ডের কাছে মহাবীর তপস্যা করেছিলেন। এখানে যে মন্দির আছে সেখানে শিবলিঙ্গ ছাড়া একটি পাথরের মূর্তিও আছে যার মাথার উপরে সর্পফণা বিস্তার করে যেন ছত্র ধরে আছে। মহাবীরের পূর্বজ তীর্থংকর হলেন পার্শ্বনাথ এবং তাঁর প্রতীক চিহ্ন হলাে সর্প। কোনই সন্দেহ নেই যে উক্ত দেববিগ্রহটি আসলে পার্শ্বনাথের এবং মন্দিরটি আসলে জৈন মন্দির। – বীরসিংহপুর যদিও বীররাজার নামাঙ্কিত বলে উল্লেখিত হলেও, মহাবীরের স্মৃতিকে স্মরণে রেখে সন্দেহ করা চলে যে ঐরকম নামের মূলে মহাবীর বা বীরপ্রভুর নাম যুক্ত হয়ে আছে। কারণ, মহাবীরের প্রতীক চিহ্ন হলাে সিংহ। খুবই কি অসম্ভব — যে বীরপ্রভুর ‘বীর’ আর তার প্রতীক ‘সিংহ’ যুক্ত হয়ে বীর+সিংহ=বীরসিংহপুর হয়েছে?
আর, ঐ তন্ত্রেশ্বর বা আঁতলই পাহাড়ের তিন চার মাইলের মধ্যে তরণী পাহাড় – যার দুরত্ব রাজনগর থেকে দশ বারাে মাইলের মধ্যে তার শীর্ষদেশে বীর রাজার প্রাসাদ বা গড় — সেটিও বীরপ্রভুরই নামাঙ্কিত – অসম্ভব কি?
মা আমার মনে হয়, অতীতকালে রাজনগরের রাজারা ছিলেন জৈনধর্মাবলম্বী এবং তাঁরা মহাবীরের ‘বীর’ উপাধিটি গ্রহণ করেছিলেন সেই সঙ্গে প্রতীক চিহ্নের সিংহ শব্দটিও নিজেদের নামের সঙ্গে জুড়ে নিয়েছিলেন।
তন্ত্রের বা তাঁতলইয়ের আশে পাশে যত গ্রাম আছে তার প্রায় প্রত্যেক গ্রামেই জৈনধর্মাবলম্বী শরাক সম্প্রদায় আছেন। এবং তাঁরা জৈন ধর্মের প্রায় সব নিয়মই মেনে চলেন। সম্পূর্ণ নিরামিষাশী এই শরাক সম্প্রদায় জৈনধর্মের শ্বেতাম্বর শ্রেণী ভুক্ত। গ্রামগুলি হলাে – বাঁশকুলী, সীলাজুরি, বিলকান্দি, শাদীপুর, কুন্ডহিত, শনিদহ, পালা জোরি, গড় জোরি ইত্যাদি ইত্যাদি। এই তথ্যের দ্বারা মহাবীরের কাছে এই শরাক বা শ্রাবক সম্প্রদায় যে জৈনধর্ম গ্রহণ করেছিলেন সে কথা বিশ্বাস করতে হয়। উপরােক্ত গ্রামগুলি যদিও এখন সাঁওতাল পরগণার দুমকা জেলার অন্ত ভুক্ত তবুও একসময় এইগ্রামগুলি বীরভূম জেলারই অংশ ছিল এবং রাজনগর ছিল তাদের সদর। ইংরেজ আমলে সিউড়ীতে তাদের ফৌজদারী ও দেওয়ানী মামলার নিষ্পত্তি হতাে। ১৮৫৬ খ্রীষ্টাব্দ থেকে সাঁওতাল বিদ্রোহের পরে সাঁওতাল পরগণা তৈরী হলে শাসন কার্যের সুবিধার জন্য এগুলি ‘বীরভূম’ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়।
কামকোটি নামক সুহ্মদেশান্তর্গত লাঢ় বা রাঢ় অঞ্চলের এই ঘন বনজঙ্গলাকীর্ণ রুক্ষ কঠিন মৃত্তিকার বৃহৎ জেলাটি যে জৈনধর্মের শেষতম তীর্থংকর মহাবীরের নাম অনুসারে বীরভূম নামে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে জৈনমতাবলম্বীদের এই মত একেবাবে নস্যাৎ করা যায় না।
বীরভূমের সঙ্গে জৈন ও বৌদ্ধ ধর্মের সম্বন্ধ
জৈন ধর্মগ্রন্থ আচারাঙ্গ সূত্রে লাঢ় বা রাঢ় দেশের নাম পাওয়া যায়। ওখানে রাঢ় দেশের দুই বিভাগের কথা বলা হয়েছে – বজ্জভূমি (বজ্রভূমি) ও সুব্বভূমি (সুহ্মভূমি)। আবার বৌদ্ধ জাতক গ্রন্থেও এই নাম দুটির উল্লেখ আছে। ওখানেও দুটি দেশকে বজ্জভূমি এবং সুব্বভূমি বলে অবিহিত করা হয়েছে।
বলাই বাহুল্য যে, জৈন ধর্ম ও বৌদ্ধ ধর্ম খুবই পাশাপাশি চলে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। জৈনধর্মের শেষতম তীর্থংকর ভগবান মহাবীর ও বৌদ্ধ ধর্মের প্রবর্তক ভগবান গৌতম বুদ্ধের মধ্যে বয়সের তারতম্য মাত্র ৫০ বছরের ফারাক। বিশিষ্ট পণ্ডিত রাহুল সাংকৃত্যায়নের গ্রন্থাদিপাঠে জানা যায় যে, মহাবীর ও বুদ্ধদেব ধর্মপ্রচারের সময় রাঢ় দেশের বজ্জভূমিতে একই সময়ে অবস্থান করে গেছেন।
এই লাঢ় বা রাঢ় দুটি ভূমিখণ্ডে বিভক্ত ছিল। উত্তর রাঢ় এবং দক্ষিণ রাঢ়। অজয় নদ হলাে এই দুই রাঢ়ের সীমা রেখা। অজয় নদের উত্তর তীরের ভূমিখণ্ড হলাে উত্তর রাঢ় আর তা হলাে বীরভূম জেলা।
যদিও বীরভূম জেলাকে সেই যুগে বজ্জভূমি বা বজ্রভূমি বলা হতাে। বােধ হয় বজ্রের মত কঠিন মৃত্তিকা বলেই এই নাম। বিশিষ্ট গবেষক ডঃ অতুল সুরের অভিমত হলাে – বজ্রযানী বৌদ্ধ সমাজ (অপর নাম কালযান বা সহজযান) এই বীরভূম থেকেই উদ্ভূত হয়েছিল (ডঃ অতুল সুর রচিত ‘বাংলা ও বাঙালীর বিবর্তন’ পৃষ্ঠা ১১৮)।
বজ্রযানের দুই শাখার মধ্যে সহজযানের প্রবর্তক ছিলেন লুইপাদ নামে একজন বাঙালী। তিব্বতের বৌদ্ধ সমাজ তাঁকে সিদ্ধাচার্য বলে পূজা করে।
বজ্রযানী বৌদ্ধসম্প্রদায় যদি সত্য সত্যই এই বীরভূম থেকে উদ্ভুত হয়ে থাকে তবে অনুমান করে নিতে দ্বিধা নেই যে, তীব্বতে প্রাপ্ত বহু বৌদ্ধগ্রন্থের রচয়িতাই ছিলেন বীরভূমের বাসিন্দা। – বীরভূমের নাম জৈন ও বৌদ্ধ যুগে সুহ্ম দেশের লাঢ় বা রাঢ় অঞ্চলের বজ্জভূমি বা বজ্রভূমি – বলে উল্লিখিত হলেও এই জেলাটিকে অন্যত্র ‘কামকোটি’ নামেও অভিহিত হতে দেখা যায়। মহেশ্বরের কুলপঞ্জিকায় উল্লেখ আছেঃ
“কামকোটি বীরভূম জানিবে নিয্যস”
তা হলে, আমাদের এই বীরভূমকে যে বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন নামে উল্লেখ করা হয়েছে তার একটু আভাষ পাওয়া গেল। কিন্তু বজ্রভূমিই বলুন বা কামকোটিই বলুন, বীরভূম নামটা তবে পাওয়া গেল কি ভাবে? সে সম্বন্ধে প্রমানাদি উপস্থিত করে যাব। ইতিমধ্যে রাঢ় ও সুহ্ম এই শব্দ দুটির কোন হদিশ বীরভূমে পাওয়া যায় কি না দেখা যাক।
আপনারা নিশ্চয় জেনে থাকবেন যে, সাঁইথিয়া থানান্তর্গত একটি স্থানের নাম ‘রাঢ় খেন্দ’ (‘রাঢ় কুণ্ড’ও হতে পারে) তবে আমার মনে হয়, ওটা আসলে ‘রাঢ় কেন্দ্র’। অনুমান সঠিক যদি হয়, তবে নিশ্চিত বলা যায় যে, সমগ্র রাঢ় অঞ্চলের এটাই হয়ত কেন্দ্রস্থল। এখান থেকেই হয়ত রাঢ়ের যাবতীয় বিষয়াদি পরিচালিত হতাে। কে জানে, হয়তাে কি না ? বিশেষজ্ঞরা একটু ভাবনা চিন্তা করুন না। এখন সুহ্ম নিয়ে একটু খোঁজ খবর করা যাক। “বীরভূমে সুহ্মেশ্বরীদেবী এবং সুহ্ম রায় নামে ধর্মঠাকুর ও রয়েছেন” (‘রাঢ়ের সংস্কৃতি : ধর্মঠাকুর’-ড: অমলেন্দু মিত্র, পৃষ্ঠা ২)
কি অর্থে এবং কতদিন আগে থেকে বীরভূমে এই সব দেবদেবী পূজিত হয়ে আসছেন তা নিশ্চিত করে বলা না গেলেও একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, এসবই সুহ্মদেশান্তর্গত লাঢ় বা রাঢ় অঞ্চলের দেবদেবী। আর বীরভূমেই যখন এই নামে দেবদেবী রয়েছেন তখন অনুমান করা ভুল হবে না যে, জেলাটি সুহ্ম দেশেরই অংশ। এখানে বীরভূম সীমান্তে অবস্থিত শ্যামরূপার গড় যা অজয় নদের তীর ঘেঁষে, সেখানে রয়েছেন রাঢ়েশ্বর শিব (শ্যামরূপার গড়কে সেনপাহাড়ী নামেও অভিহিত করা হয়)। আর ঐ গড়ের নিকটস্থ গ্রামটির নাম ‘আড়া’। বীরভূমের আঞ্চলিক উচ্চারণে রাঢ় থেকে রাঢ়া আর তাই থেকে আড়া – খুবই সম্ভব।
তা হলে রাঢ় এবং সুহ্ম এই দুটি স্থান সম্বন্ধে মােটামুটি ধারণা পাওয়া গেল। কিন্তু বজ্রভূমি?
হ্যাঁ তাও আছে। রামপুরহাট শহর থেকে পাঁচ মাইল পূর্বে মাড়গ্রাম নামক সবৃহৎ গ্রামটিতে ‘বজ্রাবাড়ি’ নামক একটি নাতিউচ্চ টিবি বিদ্যমান। যেটি দর্জিপাড়া নামে একটি পাড়ায় অবস্থিত এবং যার জন্মশতবর্ষ মহাধুমধামে পালিত হলাে সেই বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ডঃ কুদরত-এ-খােদার বসত বাড়ির কাছেই। বজ্রাবাড়ি শব্দটি এই সন্দেহের সৃষ্টি করে যে, ঐ ঢিবিটির অভ্যন্তরে নিশ্চয় বজ্রযানী বৌদ্ধদের কোন মঠ, স্তুপ বা সংঘরাম এর ভগ্নাবশেষ আছে। একমাত্র বিজ্ঞান সম্মত খনন কার্য পরিচালনার দ্বারাই এর সত্যাসত্য নিরূপিত হতে পারে। এ ব্যাপারে আরাে আগ্রহের সৃষ্টি করে এই জন্য যে, বজ্রাবাড়ির চতুস্পার্শ্ব খুব পাতলা পাতলা ইটের গাঁথুনীর একটা ভিত দেখা যায়। তাছাড়া, বজ্রাবাড়ির পাশের একটি পুষ্করিণীর জলসেচের সময় ঐখানে পালযুগের নির্মিত বহুতর ভগ্নমূর্তি আবিষ্কৃত হয়েছিল বলে জানা যায়। জানি না, যে, পুরাতত্ত্ব বিভাগ এবং বৌদ্ধধর্মাবলম্বীরা এবিষয়ে একটু খোজ খবর করবেন কি না।
ওখানে যদি বৌদ্ধধর্মের ব্যাপারদি আবিষ্কৃত হয় (হবেই) তবে বৌদ্ধধর্মের প্রভাব বিষয়ে একটা স্পষ্ট ধারণা হবে। কিন্তু, বলা হয়ে থাকে যে, বীরভূমে জৈন ধর্মেরও ব্যাপক বিস্তার ঘটেছিল তার প্রমান কি?
আসুন, সে সম্বন্ধে একটু খোজ খবর নেওয়া যাক! ১৯১০ খৃষ্টাব্দে রচিত বৃটিশ ঐতিহাসিক তথা বীরভূমের এক সময়ের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মিস্টার এল.এস.এস, ওমালীর বীরভূম ডিস্ট্রেক্ট গেজেটিয়ার-এ উল্লেখ আছে যে, এই বীরভূমের উপর দিয়ে জৈন তীর্থংকরেরা যাতায়াত করতেন। একথার সত্যতা ডব্লিউডব্লিউ হান্টার সাহেব তাঁর ‘অ্যানালস অব রুরাল বেঙ্গল’ বইটিতেও উল্লেখ করেছেন। এমন কি বীরভূম গৌরব পণ্ডিত হরেকৃষ্ণ সাহিত্যরত্ন তার ‘বীরভূম বিবরণ’ গ্রন্থেও লিখে রেখেছেন।
তা ওঁরা ওঁদের গ্রন্থাদিতে উল্লেখ করলেও চাক্ষুষ প্রমান এই যে – এই জেলার বিভিন্ন গ্রামে জৈনধর্মাবলম্বী শরাক সম্প্রদায়ের উপস্থিতি। গ্রামগুলি হলাে — বলিহারপুর, ভাগাবাঁধ, টাংদহ, হকিকতপুর, বাঁশকুলী, তাঁতলৈ প্রভৃতি। বলা বাহুল্য যে, এই গ্রামগুলি রাজনগর থেকে বেশি দূরে নয়। এছাড়াও রামপুরহাট শহরের তিন মাইল দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে খড়বােনা নামক গ্রামেও এঁদের অবস্থিতি বিদ্যমান।
জৈনধর্মের শরাক সম্প্রদায়ের ব্যাপক উপস্থিতি দেখা যায় রানীবহাল থেকে ময়ুরাক্ষী নদী পেরিয়ে মশলিয়া যেতে একটি বিচিত্র নামের গ্রাম। নামটি হলাে, ‘বজ্রভূমি বৃন্দাবনী’। ঐ গ্রামটি যদিও এখন দুমকা জেলার অন্তর্গত, তবুও ওটি ১৮৫৬ খৃষ্টাব্দের পূর্বপর্যন্ত বীরভূম জেলার অন্তর্ভুক্ত ছিল। মারগ্রামের ‘বজ্রবাড়ি’ ওর দুমকার ‘বজ্রভূমি বৃন্দাবনী’ এই দুটি নাম থেকেই প্রতীতি জন্মায় যে বীরভূমের আদিনাম যে ‘বজ্রভূমি’ ছিল সেটার সামান্যতম নিদর্শন এখনাে বিদ্যমান। এর মধ্যে মাড়গ্রামের বজ্রাবাড়ি বৌদ্ধ সংস্কৃতি সমৃদ্ধ, আর দুমকার বজভূমি বৃন্দাবনী হলাে জৈন ধর্মের। এছাড়া আর কিছু ?
হ্যাঁ, এই যে আসুন, মহম্মদবাজার থানা অধীন ডেউচায় দক্ষিণপশ্চিম কোনে যােগীপাহাড়ীর জৈন তীর্থক্ষেত্রে। এখানে টিলা সদৃশ পাহাড়ে জৈনতীর্থংকর মহাবীরের স্মৃতিধন্য একটি ক্ষুদ্র মন্দির আছে। শােনা যায় ওখানে চন্ডকৌশিক নামক এক বিষধর নাগ মহাবীরের পাদমূলে দংশন করেছিল। যদিও ঐ দংশনে মহাবীরের মৃত্যু হয়নি কিন্তু চন্ডকৌশিক তাঁর সর্পজন্ম থেকে মুক্তিলাভ করেছিল। যােগী পাহাড়ী সংলগ্ন গ্রামটির নাম ‘উশকা’। যা সম্ভবতঃ কৌশিক নামেরই অপভ্রংশ।
এ ছাড়া, ইলামবাজার থানান্তৰ্গত ঘুড়িষায় আবিষ্কৃত হয়েছে মহাবীরের পূর্বজ তীর্থংকর ভগবান পরেশ নাথের অক্ষত কিছু মূর্তি। ওটা একটা জৈন স্তুপ। বর্তমানে স্থানটি পুরাতত্ত্ব বিভাগের তত্বাবধানে সংরক্ষিত।
তা হলে প্রায় বােঝা গেল যে, বীরভূমের সঙ্গে জৈন তীর্থংকরদের যাতায়াত ছিল বলে যা বলা হয়ে থাকে তা একেবারে অমূলক নয়।
এই প্রসঙ্গে বলি যে, জৈনধর্মের ২৪ জন তীর্থংকরদের মধ্যে ২০জন তীর্থংকরের সমাধি আছে বীরভূমের আদি সীমানায় অবস্থিত বর্তমানেবিহারের ধানবাদ জেলার পরেশনাথ পাহাড়ে। বর্তমানে জৈন ধর্মাবলম্বিরা ঐ পাহাড়কে মহাবীরের অন্যতম নাম সম্মতি থেকে সম্মেত শিখর বলে উল্লেখ করে থাকেন। এখন যে বীরভূম তার সীমানা থেকে পরেশ নাথের (পরেশনাথ পাহাড়) দূরত্ব মাত্র ৭০ মাইল। ডঃ অতুল সুর তাঁর ‘বাঙলা ও বাঙালীর বিবর্তন’ গ্রন্থের ১১৩ পৃষ্ঠায় লিখেছেন : জৈনধর্মের উত্থানও বীরভূমের আশেপাশেই ঘটেছিল ….. সুতরাং এসকল তীর্থংকর যে বীরভূমের সঙ্গে সুপরিচিত ছিল, এবিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। হয়ত মহাবীরের মতাে তারাও বীরভূমে এসে ছিলেন। ড: নীহাররঞ্জন রায় প্রণীত ‘বাঙালীর ইতিহাস’ পৃষ্ঠা ৩০৬-তে বলেছেন
“…জৈন সাহিত্যের ঐতিহাসিকত্ব স্বীকার করিলে বলিতে হয়, বর্ধমান, মানভূম, বীরভূম ও সিংহভূম এই চারিটি জেলার স্থান নাম জৈনতীর্থংকর ভগবান মহাবীরের নাম থেকে গৃহীত হইয়াছে।”
‘বীরভূম’ নামের উৎস
পশ্চিমবঙ্গের মানচিত্রের মাঝামাঝি অঞ্চলে প্রায় ত্রিভূজাকার একটি জেলা নজরে আসে – যার বর্তমানের নাম বীরভূম। পশ্চিমে বিন্ধ্যপর্বতমালার পাদদেশ থেকে তরঙ্গায়িত মালভূমি ক্রমশঃ পূর্বে গঙ্গাবিধৌত পলিমাটির দেশের দিকে ক্রমশঃ এগিয়ে গিয়ে এই জেলার ভূমিকে যেন স্পষ্টতঃ দুটি ভাগে বিভক্ত করেছে। পশ্চিমে ঘনজঙ্গলাবৃত রুক্ষ কর্কশ মাটি, ছােটবড় পাহাড়-টীলা-উঁচু নিচু কাকুরে মাটি, আর পূর্বে রসালাে কোমল সমতল ভূমি। এর মস্তকোপরি রয়েছে রাজমহল পর্বত মালার নিকটবর্তী গঙ্গার সংকীর্ণ খাত। পশ্চিমে রয়েছে বিহারের সাঁওতাল পরগণার জঙ্গলাকীর্ণ পাহাড়ী এলাকা। দক্ষিণে বর্ধমান জেলা যেন এলিয়ে শুয়ে আছে এর ঠিক পাদমূলে – আর পূর্বে এই জেলার অঙ্গে যেন লেপ্টে রয়েছে মুর্শিদাবাদ। বহুকাল পূর্বে এই জেলার কিন্তু এরকম চেহারা ছিল না। এটি আরাে বৃহদাকার জেলা ছিল। এর সীমানা ছােটনাগপুর থেকে রাজমহল পর্বতমালা — এবং কর্ণসুবর্ণ থেকে (মুর্শিদাবাদের কানসােনা এবং রাঙামাটি সহ) বাঁকুড়া জেলার অনেক খানি জুড়ে। আর ছিল সমগ্র সাঁওতাল পরগণার সম্পূর্ণাংশ, দেওঘর, মধুপুর, গিরিডি পর্যন্ত শুধু নয়, পরেশনাথ পাহাড় পর্যন্ত বিস্তৃত। যুগে যুগে ইতিহাসের উত্থান পতনের মধ্য দিয়ে সংকীর্ণ হতে হতে এই বীরভূম জেলা আজকের মানচিত্রে অঙ্কিত আকারে এসে ঠেকেছে।
এই বীরভূম ঠিক কবেকার তার সঠিক তথ্য পরিবেশন করা দুরূহ। তবে মহাভারত, রামায়ন প্রভৃতি গ্রন্থ শুধু নয় – জৈন ধর্মের গ্রন্থাদি এবং বৌদ্ধ ধর্মের বিভিন্ন সূত্র থেকে ও এই জেলার নাম বীরভূম ছিল না। ছিল অন্য নাম। “ঐতরেয় আরণ্যক, ঐতরেয় ব্রাহ্মণ ও অথর্ব সংহিতা প্রভৃতি বৈদিক গ্রন্থে — অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ প্রভৃতি প্রদেশের নাম উল্লিখিত আছে। মহাভারত বিষ্ণুপুরাণ ও গড়ুর পুরাণে অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, পুণ্ড্র ও সুহ্ম এই পঞ্চপ্রদেশের নাম উল্লিখিত আছে।”
চন্দ্রবংশীয় বলিরাজার পত্নী সুদেষ্ণার গর্ভে ও দীর্ঘতমা ঋষির ঔরসে অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, সুহ্ম ও পুণ্ড্র নামে পাঁচ পুত্র জন্ম গ্রহণ করলে এই পঞ্চপুত্রের নামানুসারে পাঁচটি প্রদেশের নামকরণ করা হয়।
উপরােক্ত পাঁচটি প্রদেশের মধ্যে (সুহ্ম) নামক প্রদেশটিই যে রাঢ়দেশের মধ্যেই যে এই বীরভূম জেলা – সে বিষয়ে ঐতিহাসিকরা একমত। “বর্তমানের রাঢ়দেশের আরাে এক নাম ছিল সুহ্ম। ভাগীরথীর পশ্চিম তীরস্থিত রাঢ় বা রাঢ়া এই দুই ভাগে বিভক্ত ছিল। অজয় নদ এই দুই ভাগের সীমারেখা ছিল। রাঢ়া ভূমি দক্ষিণে দামােদর এবং সম্ভবতঃ রূপনারায়ণ নদ পর্যন্ত ছিল।” (বাংলাদেশের ইতিহাস, প্ৰথমখণ্ড, ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদার)
তা হলে যে সীমানার কথা বলা হচ্ছে – তা যে বীরভূম জেলাই সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। আবার, জৈন ধর্মের আচারঙ্গ সূত্র নামক বইয়ে আমরা লাঢ় বা রাঢ় দেশের নাম পাই। সেখানেও রাঢ়দেশের দুই বিভাগের কথা বলা হয়েছে — বজ্জভূমি (বজভূমি) ও সুব্বভূমি (সুহ্মভূমি)। বৌদ্ধ জাতক গ্রন্থ সমূহেও আমরা সুহ্মদেশের উল্লেখ দেখতে পাই। ওখানেও এই দেশকে বহৃভূমি বা বজ্জভূমি বলে উল্লিখিত হয়েছে। তার প্রমাণ ও আমরা পাই বীরভূমের নানা স্থান থেকে বজ্রযানী সম্প্রদায় যে এই বীরভূম তথা বজ্রভূমি থেকেই উদ্ভব হয়েছিল সে কথা ভাবতে হবে। বলা বাহুল্য যে মৃত্তিকার কঠিনতার জন্যই একে ‘বত্রভূমি’ ‘বজ্জভূমি’ বলা হত।
বৌদ্ধ ধর্মের সঙ্গে বীরভূমের সম্বন্ধ একেবারে বুদ্ধের জীবনকাল থেকে। কেননা বৌদ্ধগ্রন্থ ‘দিব্যাবদান’ থেকে আমরা জানতে পারি যে গৌতম বুদ্ধ বীরভূম অতিক্রম করেই পুণ্ড্রবর্ধন পর্যন্ত গিয়েছিলেন। খৃষ্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীতে বিখ্যাত চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন সাং বীরভূম অঞ্চলে এসেছিলেন। তাঁর ভ্রমণ বৃত্তান্তে তিনি লিখেছেন যে সে সময়। বীরভূমে বহু বৌদ্ধ বিহার ছিল। বস্তুতঃ বাঙলা দেশ মুসলমান কর্তৃক বিজিত হওয়ার সময় পর্যন্ত, বীরভূমে এই সকল বৌদ্ধবিহারের অস্তিত্ব ছিল। বাংলা বিজয়ের সময় মুসলমানগণ রাজমহলের পথ দিয়ে বীরভূমের ওপরই প্রথম ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।
ও মুসলমানেরা বৌদ্ধদের মঠ, বিহার ও মুর্তি সমূহ ধ্বংস করায় বৌদ্ধরা তিব্বত, নেপাল ও চট্টগ্রামে পালিয়ে যায়। তখন থেকেই বীরভূমের সঙ্গে বৌদ্ধ ধর্মের বিচ্ছেদ ঘটে। (বাংলা ও বাঙালীর বিবর্তন – ডঃ অতুল সুর, পৃ ১১৪)
বীরভূমের সঙ্গে ‘সুহ্ম’ শব্দ দুটি জড়িয়ে রয়েছে। অথচ এই ‘রাঢ়’ শব্দটি বড়ই মজার এবং বিতর্কিত ও বটে। শব্দটির উচ্চারণ বিকৃতিই শুধু নয় – বহু রকম অর্থ বহন করে। আলেকজাণ্ডারের ভারত আক্রমণের সময় ‘গঙ্গারিড’ বা ‘গঙ্গারাঢ়’ বা গঙ্গারিডি সে বিষয়ে সন্দেহ করা চলে না। অথচ অনেকে ‘গঙ্গারিডি’ শব্দটিকে খুব সহজ ব্যাখ্যার সূত্রে ‘গঙ্গাহৃদি’ অর্থাৎ গঙ্গাতীরস্থিত অধিবাসীদের ‘হৃদয়বৃত্তি’ এই অর্থ করেছেন। আসলে ভার্জিলের জর্জিকাশ কাব্যে ‘গঙ্গারিডি’ নাম প্রাপ্তী সূত্রে ‘হৃদি শব্দটি মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে।
আলােচনা বিস্তৃত করে লাভ নেই, পূর্বেই বলা হয়েছে, জৈন ধর্ম গ্রন্থ আচারঙ্গ সূত্রে একে ‘লাড়’ বলা হয়েছে। ‘লাড়’ অর্থে সাপ। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে রাঢ় শব্দটি অশুচি সূচক শব্দের প্রকাশ। এমনকি, হিন্দী, গুজরাটি, মৈথিলী মারাঠী ভাষাতেও শব্দটির অর্থ অসভ্য বা নীচ। আবার সাঁওতাল পরগণার প্রত্যন্তাঞ্চলে ‘রাঢ়’ শব্দটি চুয়াড় বা অস্পৃশ্য বলে এখনাে বােঝায়। ঐ সাঁওতালী বা মুণ্ডারী ভাষায় এর বানান বা উচ্চারণ ভেদে অনেকগুলি অর্থ হয় — যেমন, লার=সুতাে, লাড়=সুর, এই রকম অনেক কিছু। মােট কথা — ‘রাঢ়’ কিম্বা ‘লাড়, আর ‘লার’ যে বানানই লিখুন, আর যে ভাবেই উচ্চারণ করুন শব্দটির মূলে অসভ্যতা, অস্পৃশ্যতা, ক্রুরতা ইত্যাদি লুকিয়ে আছে। কারণ হয়ত এই যে, বীরভূম তথা রাঢ় অঞ্চলের গভীর বনাঞ্চলে নিম্নকোটির লােকেরা বসবাস করত বলেই হয়ত জীবন যাপনের তাগিদে সর্বদা বিপরীত অবস্থার মুখােমুখী হয়ে চলত, তাই ক্রুরতা বা হিংস্রতা তাদের আচরণগত অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল। সেই জন্য তাঁরা চুয়াড় বা অস্পৃশ্য বা অসভ্য। তখন রাঢ়দেশ বহৃভূমি ও সুহ্মভূমি এই দুইভাগে বিভক্ত ছিল। জৈন তীর্থঙ্কর মহাবীর পথহীন এই দুই প্রদেশে ভ্রমণ করার সময় এখানকার লােকেরা তাঁকে প্রহার করে এবং তাদের ‘চু চু’ শব্দে উত্তেজিত হয়ে কুকুরগুলিও তাকে কামড়ায়।
জৈন সন্ন্যাসীগণ অতিশয় খারাপ খাদ্য খাইয়া কোনমতে বজ্রভূমিতে বাস করেন। কুকুর ঠেকাইবার জন্য সর্বদাই তাঁহারা একটি দীর্ঘ দণ্ড সঙ্গে রাখিতেন। জৈন গ্রন্থাকার দুঃখ প্রকাশ করিয়া লিখিয়াছেন যে, রাঢ়দেশে ভ্রমণ অতিশয় কষ্টকর (বাংলাদেশের ইতিহাস -ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদার প্রাচীন যুগ, ১ম খণ্ড, পৃঃ ২৩)।
আচারঙ্গ সূত্রে রাঢ়ে অসভ্য জাতির বাস, এই অর্থে অনার্য সম্প্রদায়ের কথা ববাঝাতে চাইলেও – জৈন ধর্মের ‘পন্নাবনা’ বা প্রজ্ঞাপনা নামক গ্রন্থে ‘লাঢ়’ বা ‘রাঢ়’ দেশীয় লােকদের আর্য বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এ থেকে একথাই প্রমাণিত হয় যে, রাঢ় দেশে আর্য অনার্য দুই শ্রেণীর অধিবাসীই বাস করতেন।
রাঢ় দেশ বলতে যে আমাদের এই বীরভূম জেলাকেও বােঝায় তার একটি চমকপ্রদ উল্লেখ ডঃ অমলেন্দু মিত্রের রাঢ়ের সংস্কৃতি ও ধর্মঠাকুর গ্রন্থের একস্থানে আছে,
“বীরভূমের সঁইথিয়া থানায় রাঢ়কুণ্ড” বা রাখে। নামে একটি গ্রাম এখনাে আছে। কি অর্থে কতদিন আগে এই নামটি সৃষ্টি হয়েছে তা সহসা বলা শক্ত। …… বীরভূম সীমান্তে অজয়ের তীরে শ্যামরূপার গড়ের নিকটে রাঢ়েশ্বর শিব বিরাজ করছেন। নিকটে ‘আড়া’ (অর্থাৎ রাঢ়া সম্ভবতঃ নামে আর একটি) গ্রাম বর্তমান”।
বীরভূমে সুহ্মেশ্বরী এবং সুহ্ম রায় নামক ধর্মঠাকুর ও আছেন। (উক্তগ্রন্থ পৃষ্ঠা ২) তা হলে বীরভূম জেলাকে রাঢ়দেশ বলে মেনে নিতে আমাদের অসুবিধে নেই। অথচ ‘বীরভূম’ এই নামটি কিন্তু এই জেলাটির সর্বশেষনাম। ‘সর্বশেষ নাম’ এই অর্থে আমি বােঝাতে চাইছি যে, বীরভূমের নাম পূর্বে কখনাে ‘বজ্জভূমি’ বা ‘বজ্রভূমি’ বলতে এই জেলার বজ্রকঠিন মৃত্তিকার জন্যই যে, তাও উল্লেখ । করেছি। এখনাে ‘বজ্রভূমি’—‘বৃন্দাবনী’ নামে একটি স্থান বিদ্যমান – স্থানটি যদিও বিহার প্রদেশন্তর্গত সাঁওতার পরগণার (বর্তমান দুমকা জেলা) একটি গ্রাম। স্থানটিতে যদি কেউ যেতে চান, তবে রাণীবহাল থেকে ময়ূরাক্ষী নদী পেরিয়ে বাঁশকুলী গ্রামকে বাঁ দিকে ছেড়ে উত্তর পশ্চিম দিকে যে পথ গিয়েছে সেই পথে তিন চারটি গ্রামের পড়ে গিয়ে দেখতে পাবেন। বলা বাহুল্য যে ঐ বজ্রভূমি – বৃন্দাবনী গ্রামে জৈন ধর্মাবলম্বী শরাক (শ্রাবক) সম্প্রদায়ের বসবাস আছে। যখন বীরভূম জেলা ভেঙে সাঁওতাল পরগণা হয়নি তখন উক্ত বজ্রভূমি – বৃন্দাবনী বীরভূমেই ছিল –এবং রাজনগর থেকে যাতায়াত খুব সহজ ছিল।
এখনাে হয়ত যাওয়ার পথ আছে, তবে ঐ পথ সম্বন্ধে আমার জানা নেই। খুব অকিঞ্চিৎকর এবং গভীর তাৎপর্য পূর্ণ ঐ ‘বজ্র’ শব্দটি দিয়ে অন্য একটি স্থানের দিকেও আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি – দিদিভাই পত্রিকাতে আমি মাড়গ্রাম পরিক্রমা নামক একটি ধারাবাহিক রচনা লিখেছিলাম, পাঠকদের মনে থাকতে পারে।
‘বজ্র’ শব্দটি দিয়ে স্থানটির বিশদ পরিচয় পেতে পারতেন। যাইহােক, মাড়গ্রামবাসীরা ঐখানে মৃত ব্যক্তির সমাধি দেন। বজ্রাবাড়ীতে যদি আপনি দাঁড়ান তাে, দেখতে পাবেন যে, আশে পাশের জমি থেকে স্থানটি বেশ উঁচু। ‘বজ্রবাড়ী’র নিকটে বাস করেন শ্রীমুজিবর রহমান। তিনি যখন খুব ছােট ছিলেন তখন বৃহৎ আকারের একটি গােলাকার প্রাচীরের মতাে স্থান দেখতে পেতেন বজ্রাবাড়ীতে। পরে সেটি মাটির সঙ্গে মিশে গেছে বলে মুজিবর জানালেন। আমার কিন্তু সন্দেহ হয় যে, বজ্রযানী বৌদ্ধদের ওখানে একটি সংঘারাম ছিল অতীতে। সন্দেহ করার কারণ হলাে ব’ ও ‘বাড়ীর’ সন্ধি।
মােট কথা, বজ্রভূমিতে যে জৈন ও বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব ছিল তা আমরা জানি এবং বজ্রযানী বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের উদ্ভব এই জেলা থেকেই হয়েছিল বা বজ্রযানী বৌদ্ধদের প্রভাব এখানে ছিল সেকথা ‘পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি’ নামক বইয়ে বিনয় ঘােষ উল্লেখ করেছেন। এই রকম ধারণা ডঃ অতুল সুর তার ‘বাংলা ও বাঙালীর বিবর্তন’ নামক বইটিতেও করেছেন। তার কারণও আছে, বীরভূমের মুর্শিদাবাদ সংযুক্ত যে সকল গ্রাম রয়েছে। তার প্রায় প্রতি গ্রাম থেকেই বৌদ্ধ দেবদেবীর মূর্তি পাওয়া গেছে বা এখনাে পাওয়া যাচ্ছে। লােহাপুর সংলগ্ন ‘বারা’ গ্রামকে বৌদ্ধ দেবদেবীর মূর্তির মিউজিয়াম বলে উল্লেখ করেছেন অনেকে।
তুলনায় জৈন মূর্তি বিশেষ কিছু পাওয়া যায়নি এই জেলা থেকে। অথচ দেখা যাচ্ছে যে, জৈন তীর্থংকরেরা ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন স্থানে যাতায়াতের সময় এই বীরভূম জেলাকে পরিক্রমা করেছেন। শুধু তাই নয় – এই জেলার বর্তমান সীমানা থেকে মাত্র সত্তর মাইল দূরেই রয়েছে পরেশ নাথ পাহাড়। যেখানে চব্বিশজন জৈন তীর্থংকরের সমাধি রয়েছে। সমগ্র ভারতের এতস্থান ছেড়ে এই বীরভূমের আদি সীমানার। মধ্যেই যখন এতজন তীর্থংকরের সমাধি তখন একদা বীরভূম যে জৈন ধর্মের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল সে কথা চিন্তা করে দেখতে হবে। অথচ, বীরভূম নিয়ে ইতিপূর্বে যারা লেখালেখি করেছেন, তাঁদের রচনা থেকে এ বিষয়ে প্রায় কিছুরই আভাস পাওয়া যায় না। তবে, একথা জানা যায় যে, জৈন তীর্থংকরদের যাতায়াত ছিল বীরভূমের উপর দিয়ে।
W.W. Hunter প্রণীত The Annuals of Rural Bengal-বইতে এবং ১৯১০ খৃষ্টাব্দে L.S.S.O malley I.C.S. প্রণীত বীরভূম ডিস্ট্রিক্ট গেজেটীয়ারে জৈন তীর্থংকরদের বীরভূম অতিক্রম করার কথা উল্লেখ আছে। এ ছাড়াও ডঃ হরেকৃষ্ণ মুখােপাধ্যায় রচিত ‘বীরভূম বিবরণ’ এবং গৌরীহর মিত্রের ‘বীরভূমের ইতিহাস’ গ্রন্থে ও ঐ একই রকম কথার উল্লেখ আছে। কিন্তু জৈন ধর্মের প্রভাব সম্বন্ধে বিশেষ কিছুই উল্লেখ নেই। ‘রাজনগরের ইতিহাস’ পুস্তক রচয়িতা গােবিন্দ গােপাল সেনগুপ্ত জৈন তীর্থংকরদের বীরভূম অতিক্রম করার কথা’র বেশী কিছু উল্লেখ করেন নি। এ বিষয়ে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের রীডার ও রাঢ় গবেষণা পর্ষদ এর অধ্যক্ষ ডঃ পঞ্চানন মণ্ডল মহাশয় ডঃ অমলেন্দু মিত্রের ‘রাঢ়ের সংস্কৃতি ও ধর্মঠাকুর’ বইটির ভূমিকায় রাঢ় দেশে জৈন ধর্মের প্রভাব বিষয়ে ইঙ্গিত করেছেন এবং ডঃ মিত্র জৈন প্রভাব নিয়ে আলােচনা করেন নি বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। ডঃ পঞ্চানন মণ্ডল মহাশয়ের ভূমিকা থেকে উদ্ধৃতির লােভ সংবরণ করতে পারলাম না — লাঢ় বা রাঢ় দেশের বজ্রভূমি ও সুহ্মভূমিতে খৃষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দে জৈন ধর্মের বিশেষ প্রচার হয়েছিল। শ্ৰমণ ভগবান মহাবীর বজ্রভূমির অস্থিত বর্ধমানে ও স্বস্তিক বর্ধমানে বহুবর্ষ ব্যাপী দিনযাপন করেছিলেন। জংভয়-অসুরের আনুকূল্যে তার সিদ্ধিলাভ হয়েছিল। তার-পিশাচকে নিধন করে তিনি মােহমুক্ত হয়েছিলেন, ব্যন্তর যক্ষ শূলপাণি। ধর্মকে বশীভূত করে চম্পা নগরী বর্ধমানে তিনি ধর্মপ্রচার করেছিলেন। মহাবীর প্রচারিত জৈন ধর্ম তখন এ দেশের বিশেষতঃ রাঢ়দেশের প্রাক-ব্রাহ্মণ্য আর্য ও বণিক সমাজে ওতপ্রােত হয়ে মিশে গিয়েছিল। ফলে বঙ্গ ভাষায় পুরাতন ধর্ম ও মনসা-সাহিত্যে জৈন ধর্মের প্রভূত প্রভাব লক্ষ্য করা দুঃসাধ্য নয়। রাঢ় দেশে সংকলিত ধর্মঠাকুরের পুরাণ কথায় জৈন পুরাণ যে ভাবে মিশে রয়েছে কিঞ্চিৎ বিশ্লেষণ করে তা দেখাচ্ছি। কোন ধর্মে কার প্রভাব কতখানি সে পরিমাপ না করেও বলা যেতে পারে, প্রতিকূল্য ও আনুকূল্যের মাধ্যমে বিভিন্ন পুরাতন ও নতুন ধর্মে সংঘর্ষ ও সমন্বয় ঘটে থাকে, যেমন ব্রাহ্মণ-সন্ন্যাসী কমঠ ও ধরনেন্দ সর্প অর্থাৎ কূর্ম-ধর্ম কমঠাসুর হয়ে জৈন ধর্মের প্রবর্তক পার্শ্বনাথের প্রথমে ছিলেন প্রতিকূল; পরে অনুকূল হয়ে তাঁর ফণাধারী সর্প লাঞ্ছন হয়েছিলেন। বজ্রভূমিতে ব্যস্তর শূলপাণি – যক্ষের স্বীকৃতি লাভ করে তবেই জৈন মহাবীর রাঢ়দেশে প্রতিষ্ঠালাভ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। দ্বাবিংশ তীর্থংকর নেমিনাথ, যােড়শ তীর্থংকর শান্তিনাথ, পঞ্চদশ তীর্থংকর ধর্মনাথ, দশম তীর্থংকর শীতল নাথ প্রমুখ অনেক তীর্থংকরই রাঢ় দেশের বহুস্থলে স্বয়ং ধর্ম ঠাকুর হয়ে আজো পূজা পেয়ে আসছেন। অষ্টম শতাব্দে রবিসেন রচিত সংস্কৃত গ্রন্থে পার্শ্বনাথের নিকট পদ্মাবতী ফণীশ্বরের উপস্থিতির বিবরণ রয়েছে। উপরন্তু, মনসা কাব্যের কেতকা, সনকাদি মূল চরিত্র সমূহের অনেককেই দেখা যায়, তাঁরা ‘কেতক’, ‘শ্রেণীক’, প্রভৃতি নামে জৈন মহাবীরের আত্মীয় গােষ্ঠীর মধ্যে রয়েছেন।”
বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের রীডার ও রাঢ় গবেষণা পর্ষদের অধ্যক্ষ ডঃ পঞ্চানন মণ্ডলের এই প্রকার প্রামাণ্য তথ্য পরিবেশনের দ্বারা রাঢ় অঞ্চল তথা বীরভূম অঞ্চলে ব্যাপক ভাবে ধর্মঠাকুর এবং সর্পদেবী মনসা পূজার প্রচলনের মূলে জৈন ধর্মের প্রভাব যে আছে, তা মেনে নিতে হয়। কারণ, লাড় শব্দের অর্থ যদি সাপ হয়, আর পার্শ্বনাথের প্রতীক যখন সাপ – (রাজনগরের অদূরে তন্ত্ৰেশ্বর পাহাড় বা তাতলৈ পাহাড়ের নিচে ময়ূরাক্ষী ফটকে ও সিদ্ধেশ্বরী নদীর সঙ্গমস্থলে সেখানে একটি উষ্ণ জলের কুণ্ডুও আছে সেখানে যে মন্দির আছে, সেখানে শিবলিঙ্গ ছাড়া দ্বাদশ হস্ত বিশিষ্ট একটি পুরুষদেব বিগ্রহের মূর্তিও আছে সেটি পার্শ্বনাথের মূর্তি বলে আমার মনে হয় এবং পূর্বে ওটা জিন পার্শ্বনাথের মন্দির ছিল বলেও আমার অনুমান) তখন ধর্মঠাকুর এবং মনসা পূজার মূলে জৈন ধর্মের প্রভাব সম্বন্ধে সন্দেহের অবকাশ দেখি না। এদিকে বৌদ্ধ দেবদেবীর প্রভাবও যে সর্পদেবী মনসা পূজায় অংশত প্রভাব বিস্তার করেছে তার প্রমাণ ও পাওয়া যায়। “বজ্রযান বৌদ্ধ সমাজেও ‘জাঙ্গুলী’ নামে এক সর্পদেবীর পূজা, সাধনা, মন্ত্রাদি বহুল পরিমাণে প্রচলিত ছিল। সর্পদংশন করলে তার বিষনষ্ট করতে জাঙ্গুলী ছিল অদ্বিতীয়। জাঙ্গুলীর নাম শুনলে সাপ পালিয়ে যায় এ বিশ্বাস সেকালের বৌদ্ধদের ছিল। বৌদ্ধদের মন্ত্র থেকে বুঝতে পারা যায় যে, জাঙ্গুলীর উপাসনা আদিবাসী সমাজ থেকে গৃহীত হয়েছিল। কেন না, নিম্নস্তরের সমাজে সাপের রােজা’রা যে সকল মন্ত্র উচচারণ করে এ মন্ত্র তারই অনুরূপ।” (বাংলা ও বাঙালীর বিবর্তন – ডঃ অতুল সুর)
উপরােক্ত তথ্যাদির দ্বারা মােটামুটিভাবে দেখা যাচ্ছে যে এককালে অর্থাৎ জৈন ও বৌদ্ধ এই দুই ধর্মেই বীরভূমের নাম ‘বজ্জভূমি’ বা ‘বজ্রভূমি’ বলে পরিচিত ছিল। কিন্তু অন্যত্র দেখছি ‘কামকোটি’ এই নামেও বীরভূমের পরিচিতি রয়েছে। কুল পঞ্জিকা থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছি,
“বীরাভূঃ কামকোটিঃ স্যাৎ প্রাচ্যং গঙ্গাজয়ান্বিতা
অরণ্যকা প্রতীচ্যাঞ্চ দেশাে দার্ষদ উত্তরে।
বিন্ধ্য পৰ্বোদ্ভবা নদ্য দক্ষিণে বহবঃ স্থিতাঃ।”
এই শ্লোক থেকেই তাে জানা যাচ্ছে যে, বীরভূম পূর্বে কামকোটি নামে প্রসিদ্ধ ছিল। কুলপঞ্জিকাকার মহেশ্বরের উদ্ধৃতি –
“কামকোটি বীরভূম জানিবে নিৰ্য্যস”।
বীরভূমের ইতিহাস রচয়িতা গৌরীহর মিত্র যথার্থ লিখেছেন যে –
“কামকোটি বলিয়া কোন স্থান এখন বীরভূমে পরিদৃষ্ট হয় না। তবে কান্তার, কামতা, কেউটা প্রভৃতি অপভ্রংশ নামের গ্রাম এই জেলায় দেখা যায়।”
‘বজ্রভূমি’ এই নামকরণের মূলে যেমন বজের মত কঠিন মৃত্তিকা বােঝায় — তেমনি ‘কামকোটি’ এই শব্দটির কিন্তু যথার্থ অর্থ করে নেওয়া মুস্কিল। খুব সহজ ব্যাখ্যা ধরলে মানেটা মদন ইচ্ছা সম্বন্ধীয় ব্যাপার স্যাপার বােঝালেও অত সহজ কথা নিশ্চয় হয় না। তবে কি ‘কৌম’ শব্দের সঙ্গে সম্বন্ধ বলে ধরে নিতে হবে? ‘কৌম’ ও ‘কোট’ (দুর্গ) এই শব্দ দুটির সন্ধি বলে মেনে নিলে অনেকটা সহজ হয় বলে আমার ধারণা। ‘কামকোটি’র অন্য ব্যাখ্যা কেউ দিলে আমাদের মেনে নিতে আপত্তি নেই।
এবার শুরু হােক কামকোটি বা বজ্রভূমি পরবর্তী কালে পাল্টে গিয়ে বীরভূম নামে এই জেলাটির পরিচিতি হল কি করে? বীরভূম নামকরণের মূলে নানা ব্যক্তি নানা রকম উক্তি করেছেন। তার মধ্যে ‘বীরভূম গেজেটীয়ার’, ‘বীরভূমের ইতিহাস’, ‘বীরভূম বিবরণ’ প্রভৃতি গ্রন্থে বিষ্ণুপুরের রাজা একদা শিকার করতে করতে এই জঙ্গলের দেশে এসে স্থানীয় লােকেদের বীরত্বের পরিচয় পেয়ে একে ‘বীরভূমি’ এই নামে অভিহিত করেন (Virmati ie vigoraus soil – L.S.S.O.’ Malley Birbhum District Gezeteer 1910) বলে উল্লেখ করেছেন।
বহুশত বৎসর পূর্বে ভারতের উত্তর পশ্চিম সীমান্ত থেকে (সম্ভবতঃ পাঞ্জাব) বীরসিংহ এবং চৈতন্যসিংহ নামক দুইভাই এতদঅঞ্চলে ভাগ্যান্বেষণে এসে এখানকার আদিম জাতিদের পরাস্ত করে রাজত্ব কায়েম করেন এবং সিউড়ীর অদূরে রাজনগরের কাছে বীরসিংহপুর নামে রাজধানী প্রতিষ্ঠা করেন। সেই থেকে এই জেলার নাম বীরভূম হয়েছে – এই রকম সন্দেহ করেন কেউ কেউ।
অন্যমত হলাে বীরভূম হচ্ছে নানা ধর্মীয় চেতনার সঙ্গমস্থল। এই জেলাতে আছে একান্ন সতী পীঠের পাঁচটি পীঠ বক্রেশ্বর, কংকালীতলা, ফুল্লরা, নন্দীকেশ্বরী, নলাটেশ্বরী মহাপীঠগুলি। আবার তারাপীঠের মতাে সিদ্ধপীঠও এই জেলাতেই।
এ জেলাতেই বহু পীঠস্থান আছে। এই সকল পীঠস্থানে বহু সাধক বীরচারে তন্ত্রসাধনা করে গেছেন। সেই হিসেবে বীরচারী তান্ত্রিক দের পুণ্যভূমি এই বীরভূমি – নামন্তরে বীরভূম।
আবার ভাষা তাত্ত্বিকদের মত অনুসরণ করলে বলতে হয় যে, আদি অষ্ট্রিক ভাষী মানব গােষ্ঠীর বাস ছিল এই জঙ্গলের দেশে। মুণ্ডারী ভাষায় যেহেতু ‘বির’ অর্থে জঙ্গল – অতএব, বনজঙ্গলাধ্যুষিত ভূমি থেকেই এইজেলার নাম বির+ভূমি -বীরভূম।
উপরােক্ত মতগুলির মধ্যে ‘মুণ্ডারী’ ভাষার ‘বির’ শব্দটি থেকে উদ্ভুত ‘বীরভূম’ শব্দটিকে আমরা প্রাথমিকভাবে গ্রহণযােগ্য বলে মনে করতে পারি। কিন্তু তা হলেও ‘বীরভূম’ নামের উৎপত্তি কিন্তু এ সকল কথা থেকেই সৃষ্টি হয়েছে এমন কথা দৃঢ়ভাবে মেনে নিতে অসুবিধা আছে।
পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, জৈন তীর্থংকরেরা সুদূর অতীতে এই বীরভূমের উপর দিয়ে যাতায়াত করতেন (বীরভূমের মূল সীমানার মধ্যেই যখন পরেশনাথ পাহাড়ে কুড়িজন তীর্থংকরের সমাধি আর ঐ পরেশনাথ পাহাড় জৈনদের কাছে ‘সম্মেত শিখর’ নামেও পরিচিত — বলা বাহুল্য যে, জৈন ধর্মের শেষতম তীর্থংকর মহাবীরের অন্যনাম হলাে ‘সম্মতি’)। সেই সময় এতদঞ্চলে জৈন ধর্মের বিস্তার নিশ্চয় হয়েছিল। (ডঃ পঞ্চানন মণ্ডলের মন্তব্য স্মর্তব্য) তাই, জৈন ধর্মালম্বীদের মত অনুসারে ‘বীরভূম’ নামটি জৈন তীর্থংকর ভগবান মহাবীরের নামানুসারে সৃষ্টি হয়েছে। বলে যে প্রচার হয়েছে তার মূলে প্রকৃত সত্য আছে – এটিই যথার্থ।
ডঃ নীহার রঞ্জন রায় রচিত বাঙালীর ইতিহাস গ্রন্থে উল্লেখ আছে এই কথা কয়টি –
“জৈন পুরাণের ঐতিহাসিকত্ব স্বীকার করিলে বলিতে হয়, মানভূম, সিংভূম, বীরভূম ও বর্ধমান এই চারটি স্থান নাম জৈন তীর্থংকর মহাবীর বা বর্ধমানের সঙ্গে জড়িত” (দে’জ সংস্করণ পৃঃ ৩০৬)।
তাই ডঃ নীহাররঞ্জন রায়ের উক্তির যথার্থতা খুঁজতে হলে – মহাবীরের পথ পরিক্রমা অনুসরণ করে দেখতে হয়।
পূর্বোল্লিখিত তন্ত্রেশ্বর বা তাতলৈ পাহাড়ের নিকটে মহাবীর ধ্যানস্থ হয়েছিলেন। বলতে গেলে ওখান থেকেই তাঁর নগ্ন যাত্রা শুরু হয়। পূর্বেই তাঁর পরিধেয় বস্ত্র ছিন্ন হয়েছিল। জনৈক ব্রাহ্মণ তাঁর সেই ছিন্ন বস্ত্র নিয়ে মহাবীরের অনুসরণ করছিলেন বস্ত্রের অন্য অংশটি সংগ্রহার্থে। তাঁতলৈ-এ এসে মহাবীরের পরিত্যক্ত বস্ত্র খণ্ডটি সংগ্রহ করে তাঁতলৈ নিবাসী জনৈক তন্তুবায়ের দ্বারা রিপু করিয়ে মহাবীরের জ্যৈষ্ঠ ভ্রাতার কাছে উপস্থিত করে প্রচুর উপঢৌকন প্রাপ্ত হয়েছিলেন–বলে জৈন সাহিত্যে উল্লিখিত আছে। বলাই বাহুল্য যে, অদ্যাবধি উক্ত তাতলৈ গ্রামে বহু তাঁতীদের নিবাস আছে। আশে পাশে প্রতি গ্রামের জৈনধর্মাবলম্বী শরাক জাতি (শ্ৰমণ) বসবাস করেন। তাঁতলৈ থেকে একটি প্রাচীন পথ ক্রমশঃ সাঁইথিয়ার দিকে এগিয়ে এসেছে – যে পথে একদা মহাবীর হেঁটে চলে গেছেন। মহাবীরের পরিক্রমণ পথে বর্তমানে যে সব গ্রাম পড়ছে তার নামগুলাে হল জয়তারা, বিলকান্দি, বাঁশকুলী, ঢাকা লাউবেড়িয়া, খুড়িগড়, হাড়জুড়িয়া, শিলাজোরি, শাদীপুর, ভাগাবাঁধ, জামজুরি, বলিহারপুর, হকিকৎপুর প্রভৃতি (বলে নিই, নামগুলাে পর পর নয়, ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে)। ঐসব গ্রামে এখনাে বহুল পরিমাণে জৈনধর্মাবলম্বী (শরাক) সম্প্রদায় বাস করেন মহাবীর ঐ পথে দ্বারকানদের তীরে দ্বারবাসিনীর মন্দির ছাড়িয়ে ডেউচা পার হয়ে যােগীপাহাড় নামক পাহাড়ে ধ্যানস্থ হন। ঐখানেই মহাবীর চণ্ডকৌশিক নামক সর্প কর্তৃক দংশিত হন। জৈন গ্রন্থে উল্লেখ আছে, মহাযােগী ও ব্রহ্মচারী মহাবীরের শরীর থেকে রক্তের বদলে দুধ বেরিয়ে আসে।
উক্ত যােগীপাহাড়ের শ্বেতাম্বর জৈন সমাজ কর্তৃক একটি জৈন মন্দির স্থাপিত হয়েছে মহাবীরের স্মৃতি রক্ষার্থে। স্থানটি অতি মনােরম (এ সম্বন্ধে আমার কিঞ্চিৎ নিবেদন আছে বীরভূম জেলা পরিষদের কাছে – মহাবীরের স্মৃতিধন্য উক্ত যােগীপাহাড় এলাকাকে বীরভূমের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্ররূপে সজ্জিত করে তুলে সে বিষয়ে প্রচার করতে অনুরােধ করছি)। মহাবীর উক্ত চণ্ড কৌশিক সূর্পের অন্ত্যেষ্টি সম্পাদন করে সাঁইথিয়ার দিকে অগ্রসর হন। সাঁইথিয়ার তখনকার দিনে নাম ছিল শ্বেতাধিকা বা স্বেয়ম্বিয়া নগরী সেখানে পরদেশী নামে ক্রুর স্বভাবের একজন রাজা ছিলেন। মহাবীরের সংস্পর্শে এসে তিনি সম্পূর্ণ বদলে গিয়ে সমগ্র রাজ্যটি মহাবীরের পাদমূলে অর্পন করে – এই জেলার নামকরণ ভগবান মহাবীরের নামানুসারে করেন বীরভূমি। সেই থেকে এই জেলার নাম বীরভূম, জৈন সাহিত্যে এরকমই কথা আছে। প্রসঙ্গতঃ বলা যায় যে, বর্তমান কালে আচার্য বিনােবা ভাবের ভূদান যজ্ঞের মতাে মহাবীরকে রাজ্যদান একটা পুণ্যকর্ম বলে মনে করা হতাে। যদিও সর্বত্যাগী মহাবীর তার কিছুই গ্রহণ না করে জনগণকেই তা ফিরিয়ে দিয়ে যান। এই ভাবে শুধু বীরভূম নয় সিংভূম (সিংহ + ভূমি = মহাবীরের প্রতীক চিহ্ন সিংহ), মানভূম, বর্ধমান (মহাবীরের অপর নাম) প্রভৃতি স্থানগুলির নাম মহাবীরের সঙ্গে জড়িত হয়ে রয়েছে সে বিষয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।
বীরভূমঃ ধর্মীয় চেতনার যাদুঘর
পশ্চিমবঙ্গের মানচিত্রের মাঝামাঝি স্থানে যে ত্রিভুজাকার ভূখণ্ড নজরে পড়ে তার বর্তমান নাম বীরভূম। পশ্চিমে বিন্ধ্য পর্বতমালার পাদদেশ থেকে তরঙ্গায়িত মালভূমি পূর্বদিকে গঙ্গা বিধৌত পলিমাটির দেশের দিকে ক্রমশ: বিস্তার লাভ করে এই বীরভূমকে যেন দুই ভাগ করেছে। পশ্চিমে ঘন জঙ্গলাকীর্ণ নির্জন স্থানে ছােট-ছােট নদী নালার তীরে, নাতিউচ্চ পাহাড়ের পাদমুলে কিম্বা শীর্ষে ছিল বহু মুনি ঋষির সাধন মার্গের তপােবন। বীরভূমের ভাণ্ডীর বনে ছিলাে বিভাণ্ডক মুনির আশ্রম, শিয়ানে ছিল ঋষ্যশৃঙ্গ মুনির, শীতলগ্রামে সন্দীপন মুনির। গর্গ মুনির,দুর্বাসা ও মাণ্ডব্য মুনির আশ্রম ছিল এই বীরভূমে। তারাপীঠে ছিল বশিষ্ট মুনির সাধনক্ষেত্র। বীরভূমের মানচিত্র যদি শিল্পীর দৃষ্টিতে দেখি তবে মনেই হতে পারে যেন একজন ধ্যানমৌনী ঋষি তপস্যায় নিমগ্ন। তন্ত্রপীঠের অনেকগুলি পীঠ এই বীরভূমের মধ্যেই রয়েছে। বক্রেশ্বর, কংকালীতলা, ফুল্লরা, নন্দীকেশরী, ললাটেশ্বরী, তারাপীঠ প্রভৃতি। একই জেলার মধ্যে একান্ন সতীপীঠের এতগুলি পীঠ ভারতের আর কোথাও নেই। এই সব পীঠ, উপপীঠ ও সিদ্ধপীঠকে কেন্দ্র করে নানা কাহিনী ছড়িয়ে আছে এই দেশের লােকের মুখে-মুখে।
এই বীরভূমে বিভিন্ন ধর্মমতের অভ্যুদয় ঘটেছিল বলে বিভিন্ন পণ্ডিতদের অভিমত। তার কারণও আছে। বীরভূমের গ্রামাঞ্চলে গ্রামদেবতা ধর্মরাজের পূজার বহুল প্রচলন আছে। কারাে কারাে মতে ধর্মরাজ আসলে বুদ্ধ দেবের প্রতীক। কেননা এটি অনুষ্ঠিত হয় বৈশাখী পূর্ণিমাতে, বুদ্ধ দেবের জন্ম ও মৃত্যুর একই দিনে। এছাড়া “এই বীরভূমেই হয়তাে মনসাদেবীর পূজার উদ্ভব হয়েছিল বলে মনে হয়।” (বাঙালীর ধর্মীয় চেতনার বিকাশ — ডঃ অতুল সুর) বাউল সম্প্রদায়ের প্রাদুর্ভাবও এই বীরভূমেই খুব বেশী।
এই বীরভূমে বৌদ্ধ ধর্মের বজ্রযানী সম্প্রদায়ের উদ্ভব ঘটেছিল বলে অনুমিত হয়। এদেশের মাটির নাম বজ্জভূমি বা বজ্রভূমি। বজ্রকঠিন মাটির জন্যই এই নাম হওয়া সম্ভব। বজ্রযানী বৌদ্ধ দেবদেবীর বহু মূর্তি এখানকার অনেক স্থান থেকে আবিষ্কৃত হয়েছে। বজ্রযানীদের কল্পনায় আদি বুদ্ধকে ‘বজ্রধর’ বলা হয়। তার শক্তি হলেন প্রজ্ঞাপারমিতা বলাই বাহুল্য যে, লােহাপুর সংলগ্ন ‘বারা’ গ্রামে বহু বৌদ্ধমূর্তি পাওয়া গিয়েছে। তার মধ্যে প্রজ্ঞাপারমিতার একাধিক মূর্তি আবিষ্কৃত হয়েছে। যদিও তার মধ্যে চুরিও হয়ে গেছে কিছু মূর্তি, তবুও কোলকাতার যাদুঘরের আশুতােষ হলে এখনাে বারায় পাওয়া মূর্তি প্রদর্শিত হচ্ছে। বজ্রযান বৌদ্ধ ধর্মের উপর অনার্য সম্প্রদায়ের গভীর ছাপ আছে। বজ্রযান মণ্ডলের দেবীগণের নাম থেকে এবিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে অসুবিধা হয় না যে বীরভূমের আদি বাসিন্দা অনার্য জাতিদের বিভিন্ন নাম থেকেই সব দেবীদের নামকরণ করা হয়েছিল।
বুদ্ধদেব যে বীরভূমে এসেছিলেন তার উল্লেখ বৌদ্ধগ্রন্থ ‘দিব্যাবদান’ গ্রন্থ থেকেই জানা যায়, গৌতমবুদ্ধ বীরভূম অতিক্রম করেন পুণ্ড্রবর্ধন পর্যন্ত গিয়েছিলেন। হিউয়েন সাং তাঁর ভ্রমণ বৃত্তান্তে উল্লেখ করেছেন যে, তিনি বীরভূমে বহু বৌদ্ধ বিহার দেখেছিলেন। মুসলমান আক্রমণের পূর্ব পর্যন্ত এইসব বিহারের অস্তিত্ব ছিল বলে ঐতিহাসিক ড: অতুল সুরের মত। বখতিয়ার খিলজি লক্ষ্ণুর (রাজনগর) আক্রমণ করতে রাজমহলের পথ দিয়ে বীরভূমে প্রবেশ করেছিলেন। সেই আক্রমণের সময় বখতিয়ার খিলজীর সহসেনারা বৌদ্ধদের মঠ ও বিহারগুলি ধ্বংস করলে বৌদ্ধরা নেপাল তিব্বত ও চট্টগ্রামে পালিয়ে যায়। এবং তখন থেকেই বীরভূমের সঙ্গে বৌদ্ধদের ও বৌদ্ধধর্মের বিচ্ছেদ ঘটে। (অবশ্য এবিষয়ে অন্যমত হলোঃ কর্ণসুবর্ণের রাজা শশাংক ছিলেন বৌদ্ধ ধর্মবিদ্বেষী – তিনি তাঁর অনুচরবর্গের সহায়তায় বহু বৌদ্ধ মঠ ইত্যাদি ভেঙে দেন। বলা বাহুল্য যে শশাংকের রাজ্যসীমা ছিলাে মুর্শিদাবাদ থেকে রাজমহল পর্যন্ত। এর মধ্যে বীরভূমের বহু অংশ পড়ে) কিন্তু ঐ আক্রমণের ফলে সকলেই যে পালাতে পেরেছিলেন এমন মনে করার কারণ নেই। বৌদ্ধ শ্রমণেরা পালাতে সক্ষম হলেও সাধারণ শ্রেণীর বৌদ্ধ ধর্মের বৌদ্ধধর্মাবলম্বীরা ইতস্তত: ছড়িয়ে ছিটিয়ে এই বীরভূমেই থেকে যান এবং হিন্দুদের সঙ্গে মিশে যাওয়ার চেষ্টা করেন। সেই সময় ব্রাহ্মণ্যবাদ অত্যন্ত প্রবল ও ছুঁতমার্গীতায় কঠোর ছিল। বৌদ্ধধর্মের শেষ পর্যায়ে যখন ঐ ধর্মে স্বেচ্ছাচারিতা চরমে পৌঁছায়। এবং সঠিক নেতৃত্বের অভাবে দিশেহারা হয়ে পড়ে তখন হিন্দুধর্মের ছত্রছায়ায় এদের ঠাঁই হয়নি। যুগে যুগে রাজন্যবর্গের সমর্থনেই নানা ধর্মের অভ্যুদয় ঘটে এবং প্রতিপালিত হয়। হর্ষবর্ধনের পরে ভারতের আর কোন পরাক্রমশালী রাজাই বৌদ্ধধর্মের পৃষ্ঠপােষকতা করেননি ফলে এদেশে বৌদ্ধধর্মের বিস্তার লাভ হয়নি। অবশ্য পালযুগে বাঙলায় বৌদ্ধধর্মের অভ্যুদয় হয়েছিল। আজো বাংলা তথা বীরভূমের বিভিন্ন গ্রাম থেকে পাল যুগের বহু বৌদ্ধ মূর্তি আবিষ্কৃত হয়ে চলেছে।
অনেক পরে এদেশে মুসলিম রাজত্ব কায়েম হলে বহু বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন।
এই বীরভূমের বিভিন্ন গ্রামে বহু ইসলাম ধর্মাবলম্বী পীরের সমাধি আছে। তারা সবাই ছিলেন সুফি মতবাদে বিশ্বাসী। সুফি সম্প্রদায়ের ধর্মীয় মত হলাে পরধর্ম বা পরমত সহিষ্ণুতার এবং সর্বধর্ম সমন্বয়বাদিতার। ঐসব সুফি দরবেশে জীবন যাপন পদ্ধতি অনেকটা বৌদ্ধ শ্রমণদের মত ছিল এবং তারা শ্ৰমণদের মত মুণ্ডিত মস্তক এমনকি ভ্রু পর্যন্ত কামিয়ে ফেলতেন। রাহুল সাংকৃত্যায়ণ-এর গ্রন্থাদি পাঠে জানা যায় যে, পরিত্যক্ত বৌদ্ধ মঠাদিতে এই সকল সুফী পীরেরা বসবাস করতেন। সেজন্য দিশেহারা বৌদ্ধদের ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করা তাঁদের পক্ষে অপেক্ষাকৃত সহজ : হয়েছিল।
বীরভূমের এতদঞ্চলের বর্তমান ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের অনেকেরই পূর্বপুরুষ ছিলেন বৌদ্ধ, সকলেই হয়ত নয়। এমন মনে করার কারণও আছে। নানা কারণে সকলেই যে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন তা নয়, নেতৃত্বের অভাবে দিশেহারা বজ্রযানী বৌদ্ধেরা নেড়া নেড়ী সম্প্রদায় নামে ঈশ্বরােপাসনার এক নতুন পথে চলতে থাকেন। ের নিত্যানন্দ মহাপ্রভু পুত্র বিশ্বরূপ তাদের এই সম্প্রদায়কে হিন্দু ধর্মের মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেন। আজো বীরচন্দ্রপুরে নেড়া নেড়ী তলা নামে একটি স্থান বিদ্যমান।
বীরভূমের এই প্রান্তে মুসলমানদের নেড়ে বা নড়িয়া বিকৃত উচ্চারণে সম্বােধন করা হয়। তার মূলে বৌদ্ধদের মুণ্ডিত বা ‘ন্যাড়া’ শব্দেরই রূপান্তর বলে মনে হয়।
বীরভূমের উপর দিয়ে জৈন তীর্থংকরেরা নানা স্থানে যাতায়াত করতেন ধর্মপ্রচারের জন্য। এর বহু প্রমাণ বীরভূমে অদ্যাবধি বিদ্যমান। রাজনগর এবং তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চল সমূহই ছিল বীরভূমের আদি প্রাণকেন্দ্র। এখনাে রাজনগরের পার্শ্ববর্তী গ্রাম গুলিতে জৈনধর্মাবলম্বী শরাক সম্প্রদায়ের অবস্থিতি বর্তমান। তা ছাড়া বীরভূমের বর্তমান সীমান্ত থেকে মাত্র সত্তর মাইলের মধ্যে সুমেত শিখর বা পরেশনাথ পাহাড়ে আছে। কুড়িজন জৈন তীর্থংকরের সমাধি (গিরিডি বা দেওঘর থেকে স্থানটি খুব বেশী দুরে নয়। বলা বাহুল্য যে দেওঘর, গিরিডি, মধুপুর প্রভৃতি স্থানগুলি ১৮৫৬ খৃষ্টাব্দের পূর্ব পর্যন্ত বীরভূমের অন্তর্গত ছিল।) এ থেকে বুঝে নিতে কষ্ট হয় না যে এত জন তীর্থংকরের সমাধি যখন বীরভূমের আদি সীমানার মধ্যেই পড়ে তখন এর আশে পাশেই কোথাও জৈন ধর্মের আবির্ভাব ঘটেছিল। তাই তাে আমরা দেখতে পাই – বীরভূমের প্রান্তীয় জেলা গুলিতেও প্রচুর পরিমাণে শরাক জাতির অবস্থান।
জৈন ধর্মের শেষ তীর্থংকর মহাবীর এই বীরভূমের মাটিতেই তার ধর্মীয় উপাসনার উপযুক্ত ক্ষেত্র বলে মনে করেছিলেন। তিনি বর্ধমান জেলার মঙ্গলকোটের তপস্যা শেষে অজয় নদ পার হয়ে বীরভূমের রাজনগরের অতি সন্নিকট তন্ত্রের বা তাতলৈ নামক স্থানে এক পাহাড়ের পাদদেশে এক উষ্ণ জলের কুণ্ডের কাছে সিদ্ধেশ্বরী, ময়ুরাক্ষী ও ফটকে নদীর ত্রিবেণী সঙ্গমে ধ্যানস্থ হয়েছিলেন। ওখানে আছে শিবলিঙ্গ ছাড়া দ্বাদশ হস্ত বিশিষ্ট এক দেব বিগ্রহ যার মস্তকোপরি ফণা বিস্তার করা সর্প আছে। যেটি মহাবীরের পুর্বজ তীর্থংকর পার্শ্বনাথের মূর্তি। পরে তিনি ডেউচার নিকট যােগীপাহাড়ে ধ্যানস্থ হন। ঐখানে কৌশিক নামে (ব্যক্তি বিশেষ) এক বিষধর সর্প মহাবীরকে দংশন করলে তার শরীর থেকে রক্তের বদলে নাকি দুধ বেরিয়েছিল বলে জৈনগ্রন্থে উল্লেখ আছে। উক্ত যােগীপাহাড়ে একটি জৈন মন্দির স্থাপিত হয়েছে। মহাবীর সাঁইথিয়ায় এসেছিলেন বলে জানা যায়। সাঁইথিয়ার সংস্কৃত নাম হলাে শ্বেতাম্বিকা নগরী। নামান্তরে সেয়াম্বিয়া পরে যার বর্তমান নাম সাঁইথিয়া। শ্বেতাধিকা>সেয়াম্বিয়া>সাঁইথিয়া নাম হয়েছে। ওখানে ছিলেন পরদেশী নামে ক্রুর স্বভাবের একজন অনার্য রাজা। তিনি মহাবীরের সংস্পর্শে এসে সম্পূর্ণ বদলে যান। জৈন ধর্মের পুস্তকাদিতে এই পরদেশী রাজা বিখ্যাত শরাক রাজা রূপে পরিচিত।
জৈন মতাবলম্বীরা বলেন যে, মহাবীরের ‘বীর’ শব্দ নিয়ে ‘বীরভূম’ এই নাম হয়। এবং এই নামটি ঐ অনার্য রাজা পরদেশীই নাকি প্রবর্তন করেন। জৈন মতাবলম্বীদের যুক্তি হলাে – বীরভূমে বহু স্থানে ‘বীর’ এই শব্দ দিয়ে প্রচুর জায়গার নাম আছে। যেগুলাে মহাবীরের বীরভূম পদার্পণের পরে রাখা হয়েছিল। কিন্তু এই মত অভ্রান্ত নয়। বীরভূম নাম করণের মুলে আরাে বহু মত আছে। বীরভূমের আদি নাম ছিল কামকোটি – “কামকোটি বীরভূম জানিবে নিয্যস” – (মহেশ্বরের কুল পঞ্জিকা)।
বিভিন্ন ধর্মীয় প্রচারকদের শুভাগমনে এই বীরভূম যুগে যুগে ধর্মীয় চেতনার সম্মিলিত স্রোতধারায় স্নাত হয়ে গৌরবান্বিত হয়ে আছে তা বলাই বাহুল্য।
গ্রন্থপঞ্জী
বাংলা গ্রন্থ
- ১। বীরভূমের ইতিহাস — শ্রী গৌরীহর মিত্র
- ২। বীরভূম বিবরণ — ডঃ হরেকৃষ্ণ মুখােপাধ্যায়
- ৩। রাঢ়ের সংস্কৃতি ধর্মঠাকুর — ডঃ অমলেন্দু মিত্র
- ৪। রাজনগরের ইতিহাস — গােবিন্দ গােপাল সেনগুপ্ত
- ৫। বাংলাদেশের ইতিহাস (প্রাচীনযুগ) –ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদার
- ৬। বাঙালীর ইতিহাস — ডঃ নীহার রঞ্জন রায়
- ৭। বাঙলা ও বাঙালীর বিবর্তন — ডঃ অতুল সুর
- ৮। চর্যাচর্যবিনিশ্চয় — হরপ্রসাদ শাস্ত্রী
- ৯। বাংলা দেশ ও জৈন ধর্ম — ক্ষিতিমােহন সেন
- ১০। বাংলা স্থান-নাম — ডঃ সুকুমার সেন।
- ১১। বাংলার সামাজিক ইতিহাস — ডঃ অতুল সুর
- ১২। বাঙালীর নৃতাত্ত্বিক পরিচয় — ডঃ অতুল সুর
- ১৩। বাঙ্গালার ইতিহাস –শ্রী রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়
- ১৪। বীরভূম জেলার পূরাকীর্তি — শ্রীদেবকুমার চক্রবর্তী
- ১৫। বৌদ্ধধর্ম — হরপ্রসাদ শাস্ত্রী
- ১৬। সূফীমতের উৎস সন্ধানে — শ্রী পার্বতী চরণ ভট্টাচার্য
- ১৭। গঙ্গারিডি ও বঙ্গভূমি — প্রভাতকুমার ঘােষ।
- ১৮। বৌদ্ধদের দেবদেবী — বিনয়তােষ ভট্টাচার্য
- ১৯। শরাক সমাজ স্মরণিকা — ১৩৮৫ সম্পাদক প্রভাসচন্দ্র মাজি।
- ২০। পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি — বিনয় ঘােষ
- ২১। রাধা — তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
ইংরেজি গ্রন্থ
- ২২। Annals of Rural Bengal — W.W.Hunter !
- ২৩। Birbhum District Gezetear (1910)–L.S.S.O’ Malley.
হিন্দী পুস্তক
- ২৪। প্রাচ্য জৈন শরাক শােধ কার্য (হিন্দী পুস্তক) – বাবুলাল জৈন জমাদার
- ২৫। বীর প্রভু কি উপসর্গ – লীলাস্থলী বীরভূম কি কুছ প্রমুখ স্থান–নীরঞ্জন ব্যানার্জী রচিত এবং ভােজরাজ জৈন কর্তৃক হিন্দী রূপান্তর।
‘নবজাগরণ’ অ্যান্ড্রোয়েড অ্যাপ্লিকেশনটি প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর টেলিগ্রাম চ্যানেলে জয়েন হতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর ফেসবুক পেজে লাইক করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।