৩-রা এপ্রিল ফোর্ট উইলিয়ামে খবর এলো ১৭০৭-এর ফেব্রুয়ারীতে আওরঙ্গজেব ইহলোক ত্যাগ করেছেন। চারিদিক থেকে মৃত্যুর খবর দিয়ে কৃতিত্ব নেওয়ার ধূম পড়ে গেল। ফোর্ট উইলিযাম কতৃপক্ষ দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল। দ্রুত এক সভা ডাকা হল। সমস্ত রকম লেনদেন বন্ধ করা হল। আদায়কারী ডারেল ও স্পেনসারকে এক সার্জেন্ট ও ২০ সৈনিকের পাহারা দিয়ে দুর্গে আসতে বলা হল। কাসিমবাজারের ফিক ও বাগডেনকে এত্তেলা পাঠানো হল, সেরকম বুঝলে কোম্পানির সমস্ত মালপত্তর নিয়ে ফোর্টে চলে আসে যেন। এক পারিবারিক উত্তরাধিকার যুদ্ধের আশঙ্কা করে ৭-ই এপ্রিল কাউন্সিলের সভা ডাকা হল। সর্বসম্মতিক্রমে ঠিক হল, ৫০০০ মন চাল আর ১০০০ মন গম মজুতের ব্যবস্থা করা হবে। দরকার পড়লে তা মাদ্রাজেও পাঠানো যেতে পারে। কাশিমবাজার থেকে ফিক আর বাগডেনকে খবর পাওয়ার সঙ্গে চলে আসতে বলা হল এবং সঙ্গে কোম্পানির কোষাগার ও সনদের জন্যে দেয় টাকা আনতে বলা হল। আরও বলা হল সবরকমের বস্ত্র যা মজুত রয়েছে তা যতটা পারা যায় বিক্রয় করে দেওযা হোক এবং অবিক্রিত কাপড় কোম্পানির বেনিয়ান হরিকিষেণের কাছে ছেড়ে আসতে হবে। কোম্পানি ভয় পেয়েছিল যদি উত্তরাধিকার যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে তো আশপাশের জমিদাররা কোম্পানির কুঠি আক্রমণ করে লুঠ করতে পারে। কুঠি পাহারার জন্যে ৬০ জন কালা সিপাহি নিযুক্ত করা হয়।
পাটনা থেকে লয়েড আর কাওথর্প খবর পাঠালো ২৩-শে ফেব্রুয়ারী সম্রাট মারা যাওয়ার পর সুলতান, আসাদ খান ও রাজকীয় কোষাগার লুঠ করে বণিকদের উপরও লেভি বসিষেছে। উদ্দেশ্য মহৎ, দেশ রক্ষা। কোলকাতার কাউন্সিল খবর পাঠালো যত দ্রুত সম্ভব সল্টপিটার একজায়গায় মজুত করে কোলকাতায় নিয়ে আসতে। পারলে ঘুষ দিয়েও আনতে হবে। পাটনা থেকে উত্তর এলো এখন নদীতে পানি কম তাই সল্টপিটার আনা সম্ভব হচ্ছে না। যদি তাদের চলে যেতে বাধ্য করা হয় কোম্পানির দায়িত্বশীল দেশি চাকুরেদের হাতে টাকাপয়সা ও মালপত্র দেখভালের জন্যে রেখে আসা হবে। নাছোড়বান্দা ফোর্ট উইলিয়াম কতৃপক্ষ পুনরায় খবর পাঠালো যে কোন ভাবেই হোক সল্টপিটার নিয়ে আসতে হবে। যদিও ১২-ই মে খবর আসে সুলতান, তার পুত্র, যুবরাজ ১ লাখ টাকা যুদ্ধের খরচ হিসাবে ইংরেজদের কাছে চেয়েছে। সরাসরি দিতে অস্বীকার করায় ইংরেজদের দেশীয় কর্মচারীদের বন্দি করা হয়।
সল্টপিটার, সোরা বা পটাশিয়াম নাইট্রেট যা বারুদ তৈরীর অন্য উপাদান ছিল তা ফোর্ট উইলিযামের ট্রেডার্স কাউন্সিল প্রধান রপ্তানি দ্রব্য বলে গণ্য করত। উইলসন সাহেবের বই থেকে ১৭০৪-এর রোজনামচা ও শলাপরামর্শ (Diary and consultation) হিসাবে পাচ্ছি, ‘ইংরেজ ডিরেক্টররা বারবার তাগাদা দিচ্ছেন আর মাদ্রাজ কাউন্সিল চিঠি লিখছে মানের উৎকৃষ্টতা বিচার না করেই অধিক পরিমাণে সল্টপিটার পাঠানো হোক। কারণ হিসাবে বলা হচ্ছে সাতটি ওলন্দাজ ও চারটি ফরাসি জাহাজ সল্টপিটার কেনার জন্যে বাংলা অভিমুখে যাত্রা করেছে। ১৩-ই মার্চ হুগলির ব্যবসায়ীরা একযোগে বলছেন, অগ্রিম না দিলে কোলকাতায় কোন সল্টপিটার পাঠানো হবে না। অবশেষে কোলকাতার কাউন্সিল রাজি হয়ে লিখছেন তাঁরা অতিরিক্ত প্রতি মন সল্টপিটারের জন্যে এক আনার একটু বেশি দিতে রাজি আছেন’। ওই বছর অন্তত চারটি ক্ষেত্রে সল্টপিটারের জাহাজ বোঝাইয়ের উল্লেখ রয়েছে। জাহাজদুটির নাম ডাচেস আর সিপিও।
প্রথমটিতে বোঝাইয়ের সময় বিস্ফোরণে একজন ইংরেজ, এগারোজন জেন্টু (হিন্দু) ও একজন মুসলিম মারা গেছে। সিপিওতে ২০০ টি বান্ডিলে ২৭ হাজার টাকার সল্টপিটার বোঝাই করা হয়েছিল। সল্টপিটারের প্রয়োজন ছিল বারুদ তৈরীতে আর বারুদ ছোটানো হত আগ্নেয়াস্ত্র দ্বারা। ইংরেজ তথা ইউরোপীয়রা আগ্নেয়াস্ত্র তৈরীতে ভারতীয়দের তুলনায় পারদর্শী ছিল। তার প্রমাণ পাওযা যায় হুগলির মুঘল আধিকারিকদের কাছে ইংরেজদের দেয় ঘুষ/উপঢৌকন/নজরানা (যে নামই দেওযা হোক) হিসাবে পিস্তল, বন্দুক, বন্দুকে ব্যবহৃত চকমকি (ফ্লিন্ট) বা ফ্লিন্টের তৈরী পাত্র।
২৮-শে এপ্রিল ফোর্ট উইলিযাম কতৃপক্ষ সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্তে এল, ‘সম্রাট মারা যাওয়ায়, দুই রাজত্বের মধ্যবর্তী সময়ে কেউ লক্ষ্য করার নেই, তাই কেল্লাটিকে আরও মজবুত করার এটাই আমাদের কাছে এখন উৎকৃষ্ট সময়। তাই সিদ্ধান্তে আসা হল, নদীর দিকে দুটি নিয়মিত ঘাঁটি করা হবে যাতে স্থলের দিকে উত্তর দেওযা যায়। বক্সিকে আদেশ দেওযা হল সুচারুরূপে কাজটি শেষ করতে এবং উক্ত প্রান্ত থেকে শহরে সকল প্রয়োজনীয় বস্তু আনা হয়। এটিকে দ্রুত তৈরী করতে হবে, কারণ এর থেকে ভালো সময় হয়তো আর পাওযা যাবে না’।
ইংরেজরা যে ভারতের রাজনীতিতে শ্যেনদৃষ্টি রেখে চলেছে তা ফোর্ট উইলিয়ামের ডায়রি দেখলেই বোঝা যায়। তারা শাহ আলম (বাহাদুর শাহ), আজম শাহ ও কামবক্সের উত্তরাধিকারের লড়াই নিয়েও কয়েকটি কলম লিখেছে। ১৪-ই জুলাই খবর এলো শাহ আলম জিতে গেছেন। তবে ইংরেজ আপাতত অতটুকুতেই থামতে বাধ্য হল। কারণ, ২০ বছর আগের পিটুনিটা ভালোই হয়েছিল। ভারতীয়দের নৈতিকতার অধঃপতন ও প্রতিরক্ষার উপাদান অস্ত্রনির্মাণ বিষয়ে উদাসিনতা ৫০ বছর পর ইংরেজদের একপ্রকার ডেকে এনে সিংহাসনে বসিয়ে দেয়।
‘নবজাগরণ’ অ্যান্ড্রোয়েড অ্যাপ্লিকেশনটি প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর টেলিগ্রাম চ্যানেলে জয়েন হতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর ফেসবুক পেজে লাইক করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।