লিখেছেনঃ আমিনুল ইসলাম
একটা বিশেষ মহল থেকে বার বার এটা বলা হচ্ছে যে, অযােধ্যায় বাবরি মসজিদের তলায় একাদশ শতাব্দীর তিনশাে ষাটটি স্তম্ভ বিশিষ্ট একটা মন্দির ছিল এবং ওখানেই শ্রীরামচন্দ্র জন্মগ্রহণ করেছিলেন। প্রথম মুঘল সম্রাট বাবরের (১৫২৬-৩০) আদেশে নাকি ওই মন্দির ভেঙে মসজিদ করা হয়। কোনাে ঐতিহাসিক বা প্রত্নতাত্বিক কিন্তু আজও পর্যন্ত প্রমাণ করতে পারেননি যে, শ্রীরামের জন্মভূমিতে মসজিদ করা হয়েছে। এমনকি বাবরি মসজিদ তৈরি (সম্ভবত ১৫২৮-২৯ সালে বাবরের সেনাপতি মীর বাকি বাবরি মসজিদ তৈরি করেন, তৈরি করার পর এতে একটি শিলালেখ লাগানাে হয়, যার থেকে এই তথ্য পাওয়া যায়) হবার ২০০ বছরের মধ্যে কোনাে ইঙ্গিত সমকালীন লেখার মধ্যে নেই যে, ঠিক কোথায় শ্রীরামচন্দ্রের জন্ম হয়েছিল এবং মন্দির ধ্বংস করে মসজিদ তৈরি করা হয়েছিল।১
বরং বাবরের ধর্মীয় উদারতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ভূপালের রাজ গ্রন্থাগারে তাঁর শেষ ‘ইচ্ছাপত্র’-এ সংরক্ষিত আছে। রাজ্যশাসন সম্পর্কে পুত্র হুমায়ুনকে তিনি এই ‘ইচ্ছাপত্র’এ যে মূল্যবান নির্দেশ দিয়েছিলেন তাতে বাবরের উদারতা সম্পর্কে আমাদের সন্দেহ অনেকটাই নিরসন হয়। বাবর এই ‘ইচ্ছাপত্র’-এ হুমায়ুনের উদ্দেশ্যে বলেছেন, “হে আমার পুত্র, ভারতবর্ষে বিভিন্ন ধর্মের লােক বাস করে। তাই ঈশ্বরকে ধন্যবাদ যে, নৃপতিদেরও যিনি নৃপতি তিনিই তােমার ওপর এই দেশ শাসনের ভার ন্যস্ত করেছেন। সুতরাং তােমার কাছ থেকে আশা করা যাচ্ছে যে, তুমি ধর্মীয় কুসংস্কার দিয়ে তােমার মনকে প্রভাবিত হতে দিবে না, এবং সকল সম্প্রদায়ের লােকদের ধর্মবিশ্বাস ও ধর্মীয় আচরণের প্রতি যােগ্য সম্মান প্রদর্শন করে নিরপেক্ষভাবে বিচার করবে; বিশেষ করে গাে-হত্যা থেকে বিরত থাকবে যা তােমাকে ভারত-জনদের হৃদয় জয় করার পক্ষে সহায়ক হবে। এই এদেশের অধিবাসীদের কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করবে; কোনাে সম্প্রদায়ের লােকদেরই ধর্মস্থানকে ধ্বংস করবে না; এবং সর্বদাই ন্যায়বিচার-প্রিয় হবে যাতে রাজা ও প্রজার মধ্যেকার সম্পর্ক মধুর থাকে এবং দেশে শান্তি ও স্বাচ্ছন্দ্য থাকে; অত্যাচারের অসির বদলে প্রেম ও কৃতজ্ঞতার অসির দ্বারা ইসলাম ধর্ম প্রচারের পথই প্রকৃতপক্ষে কাম্য মনে করবে; শিয়া ও সুন্নিদের মধ্যেকার বিভেদকে সর্বদা তুচ্ছ মনে করবে, অন্যথায় ওই বিভেদ ইসলাম ধর্মকে দুর্বল করে দিবে; প্রজাবর্গের বিভিন্ন প্রকার বৈশিষ্ট্যকে বছরের বিভিন্ন প্রকার ঋতুর মতাে মনে করে খাপ খাইয়ে চলবে যাতে রাজ্যের শাসনব্যবস্থা ব্যধিমুক্ত থাকে।”২ প্রকৃতপক্ষে বাবর পিতা হিসেবে হুমায়ুনকে যে নির্দেশ দিয়েছিলেন, তা মুঘলদের রাজকর্তব্য প্রতিপালনের সুস্পষ্ট নির্দেশ বলা যেতে পারে। হুমায়ুনও পিতার আদেশ যথাসম্ভব পালন করে মুঘল রাজবংশের ঐতিহ্য বজায় রেখে গেছেন। তাই এহেন বাবর রামমন্দির ধ্বংস করবেন, এমন কথা ভাবতে আমাদের কষ্ট হয়।
তাছাড়া বিশ্বাস অনুসারে শ্রীরামচন্দ্রকে যদি মেনেও নেওয়া যায়, কিন্তু কোন স্থানে তার জন্ম সে সম্পর্কে নির্দিষ্টভাবে কিছু বলা যায় কি? বিশ্বাসের বস্তুর জন্মস্থানের বাস্তব অস্তিত্ব থাকে নাকি? অযােধ্যার ইতিহাস দেখলে দেখা যাবে যে, অযােধ্যা বিভিন্ন যুগে নানা ধর্মে বিশ্বাসী মানুষের কাছে পুণ্যভূমি বলে বিবেচিত হয়ে এসেছে, বিশেষভাবে কোনও একক সম্প্রদায়ের নয়। তাছাড়া শ্রীরাম বলে কোনও রাজা ছিলেন কিনা তারই কোনও ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই। রামায়ণ সম্পূর্ণই মহাকবি বাল্মীকির কপােলকল্পিত মহাকাব্য। এই মহাকাব্যে যে শ্রীরামের কথা বলা হয়েছে তিনি যদি ঐতিহাসিক চরিত্রও হন, তবুও তার সময়ের অযােধ্যা যে আজকের অযােধ্যা, তার কোনও প্রমাণ নেই। বরং প্রাচীন ভারতের ইতিহাস গবেষকরা দেখিয়েছেন, শ্রীরামের যুগে বর্তমান অযােধ্যার স্থানে জনবসতি সে-রকম ছিল বললেই চলে। এমনকি শ্রীরামের ঐতিহাসিকত্বে বিশ্বাসী ঐতিহাসিকেরাও (যেমন অধ্যাপক বি বি লাল, বি পি সিংহ, আর জি গৌর প্রমুখেরা, এরা স্বনামধন্য পুরাতত্ত্ববিদও) আজকের অযােধ্যার স্থানে রামমন্দিরের অস্তিত্বে বিশ্বাসী নন। সুতরাং ১৬ শতকে গড়ে ওঠা বাবরি মসজিদ যেখানে, ঠিক সেখানেই শ্রীরাম ভূমিষ্ঠ হয়েছিলেন, এই দাবি একেবারেই উদ্দেশ্যপ্রণােদিত।
অথচ ১৬ শতকের গােড়ার দিকে মুঘল সম্রাট বাবর অযােধ্যায় প্রাচীন রামমন্দির ভেঙে বাবরি মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, এই ধর্মীয় ফ্যাসিবাদী প্রচারের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা ‘রামমন্দির নিমার্ণ আন্দোলন’-এর ফলে ১৯৯২-র ৬ ডিসেম্বর হিন্দুত্ববাদী উগ্র করসেবকদের তাণ্ডবে বাবরি মসজিদ বিধ্বস্ত হয়। এই বর্বরােচিত কর্মকাণ্ডে সাফল্য লাভের পূর্ব থেকে অবশ্য মধ্যযুগের মুসলিম শাসকদের বিরুদ্ধে ব্যাপকভাবে হিন্দু মন্দির ধ্বংস ও তার উপর মসজিদ প্রতিষ্ঠার সাম্প্রদায়িক প্রচার চলছিল। এই প্রেক্ষিতে প্রাক-ব্রিটিশ বা প্রাকআধুনিক ভারতে ধর্মস্থান বা উপাসনালয় তথা মন্দির কলুষিত করা ও তা ধ্বংসের একটি ইতিহাসসম্মত পর্যালােচনা তুলে ধরা দরকার।
মধ্যযুগে ভারতে মুসলিম শাসনের মূল্যায়নে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক ঐতিহাসিকরা ইতিহাস লিখনের নীতিমালা ও মৌলিক সত্য অস্বীকার করে সম্পূর্ণভাবে মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছিলেন। তাদের রচনায় তাই সাজানাে গল্প ও জালিয়াতি ব্যাপার পূর্ণমাত্রায় উপস্থিত ছিল। স্যার উইলিয়াম রবার্টসন, চার্লস গ্রান্ট, জেমস মিল, টমাস মরিস, আলফ্রেড লায়াল, আলেকজান্ডার ক্যানিংহাম, এইচ টি প্রিন্সেপ, ফার্গুসন, হেনরি ইলিয়ট প্রমুখ ব্যক্তিরা বুদ্ধিজীবী মঞ্চ থেকে মুসলিমদের বিরুদ্ধে বিরামহীন তৎপরতা চালিয়েছেন। তারা তাদের লেখায় প্রচার করেছেন যে, ভারতীয় হিন্দুরা ভয়াবহরূপে মুসলিমদের দ্বারা শােষিত, পদদলিত ও অত্যাচারিত হয়েছিল এবং বাস্তবিক পক্ষে ইংরেজরাই হিন্দুদের মুসলিমদের নিপীড়ন থেকে ‘মুক্ত’ করেছিল। হিন্দুরা যেহেতু ইংরেজ শাসনে শান্তিতে বসবাস করছে, ইংরেজ শাসনের প্রতি তাদের ‘ঋণী’ মনােভাব গ্রহণ করে তাই ইংরেজ শাসনকে পূর্ণ সমর্থন জানানাে উচিত। এই সঙ্গে এ সমস্ত ইংরেজ ইতিহাসবিদরা ভারতের জনমানসে দৃঢ়ভাবে হিন্দু-মুসলিম দ্বন্দ্ব প্রােথিত করে দেবার জন্য অবিরাম প্রচার চালিয়ে গেছেন যে, হিন্দু ও মুসলমান বরাবরই পরস্পরের প্রতি আক্রমণাত্মক ছিল, উভয়ের মধ্যে সম্প্রীতির কোনও ইতিহাস পাওয়া যায় না এবং মুসলিম শাসনকালে হিন্দুদের উপর বর্বরােচিত অত্যাচার (হিন্দুদের হত্যা করা, পূজার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি, হিন্দু দেবদেবীর মূর্তি ভাঙা, মন্দির ধ্বংস, মন্দির কলুষিত করা, বলপ্রয়ােগ করে ধর্মান্তকরণ ইত্যাদি) চালানাে হয়েছে। উনিশ শতকের ভারতে প্রখ্যাত ব্রিটিশ ইতিহাসকার ইলিয়ট ও ডওসন তাদের সম্পাদিত বিশাল আট খণ্ডের ইতিহাস সংকলন ‘The History of India as told by its own Historians’-এ৩ উপরােক্ত বিষয়গুলি অত্যন্ত উদ্দেশ্যপ্রণােদিতভাবে তুলে ধরেছেন, তাদের উপনিবেশ রক্ষার উপযােগী বিভেদপন্থার অঙ্গ হিসেবে। পরবর্তীকালে ইতিহাস বিকৃতি ও সাম্প্রদায়িক অপপ্রচারের উৎস ও প্রেরণা হিসেবে ইংরেজ শাসকগােষ্ঠীর এই কুৎসা ছিদ্রান্বেষীদের আজ খুব কাজে লাগছে।
আরব বণিকদের মাধ্যমে ভারতে প্রথম ইসলাম প্রবেশ করে সপ্তম শতকে। তারপর আসে শান্তি ও ভ্রাতৃত্বের ধর্ম প্রচারকরা। প্রথম সামরিক অভিযান হয় সিন্ধু প্রদেশে অষ্টম। শতকের প্রথম দিকে, নেতৃত্ব দেন মহম্মদ বিন কাসিম (৭১২-১৫)। এরপর ৯৮৬ সালে গজনীর সুলতান সুবক্তগীন পাঞ্জাবের রাজা জয়পালকে আক্রমণ করে কাবুলের পূর্বদিকে লামঘান শহরের কাছে পরাজিত করে বৈভবশালী লামঘান শহরের প্রচুর ধনসম্পদ লুণ্ঠন করেন। ৯৯৭ সালে সুবক্তগীনের মৃত্যুর পর পুত্র সুলতান মাহমুদ (৯৯৭-১০৩০) ১০০০ সাল থেকে ভারত ভূখণ্ডে আক্রমণ চালিয়ে ধ্বংসকাণ্ড চালান। ১০২৬ সালে বিখ্যাত সােমনাথ মন্দির লুণ্ঠন করে মাহমুদ বিপুল পরিমাণ সােনা, রুপা, হীরে, জহরত, মণিমুক্তা গজনীতে নিয়ে যান। তবে সমকালীন হিন্দু রাজারাও এ-কাজে পিছিয়ে ছিলেন না। প্রাচীন ভারতের শ্রেষ্ঠ ইতিহাসকার কলহনের বিখ্যাত ‘রাজতরঙ্গিনী’ থেকে জানা যায়, একাদশ শতকে কাশ্মীরের হিন্দুরাজা হর্ষ (১০৮৯-১১০১) স্বীয় রাজকোষের সমৃদ্ধির জন্য বহু হিন্দু মন্দির লুণ্ঠন করে বিখ্যাত হয়ে আছেন। কলহন লিখেছেন, কোনাে গ্রাম শহর বা নগরে এমন একটা মন্দির অবশিষ্ট ছিল না যার মূর্তি রাজা হর্ষের দ্বারা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়নি। হর্ষের শাসনকালে ‘দেবােৎপাটননায়ক’ নামক একটি পদ সৃষ্টি করা হয়েছিল এই নির্দিষ্ট কাজের দায়িত্ব পালন করার জন্য।৪ উল্লেখ্য, কলহনের পিতা চম্পক ছিলেন রাজা হর্ষের অন্যতম মন্ত্রী। দ্বাদশ শতকে গুজরাটেরপারমার হিন্দু রাজারাও (যেমন সুভাত বর্মণ ১১৯৩-১২১১) সম্পদের লােভে দাভয় ও ক্যাম্বে অঞ্চলের বহু জৈন মন্দির লুণ্ঠন করেন।৫ সুতরাং যে সমস্ত ঐতিহাসিকেরা মাহমুদের কাজের মধ্যে অবিমিশ্র পরধর্ম বিদ্বেষই আবিষ্কার করেন তাদের আবিষ্কার যে ভ্রান্ত সে বিষয়ে সন্দেহ থাকতে পারে না।
সুলতান মাহমুদ সম্পর্কে ঈশ্বরীপ্রসাদ বলেন, মাহমুদ স্বাধীন সুলতান হিসেবে এই উপমহাদেশে পৌত্তলিকতা এবং বর্ণবাদ প্রথা ধ্বংস করে ইসলাম প্রচারের নিমিত্ত যুদ্ধাভিযানে প্রবৃত্ত হন। আবার অনেক ঐতিহাসিক ঈশ্বরীপ্রসাদের উক্তির প্রতিবাদ করে বলেন, পাক-ভারত অভিযানে সুলতান মাহমুদের প্রকৃত ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্য ছিল। কারণ—প্রথমত, সুলতান মাহমুদের সতেরাে বার যুদ্ধাভিযানের মধ্যে কয়েকবার মুসলিম শাসকদের বিরুদ্ধেও যুদ্ধ পরিচালিত হয়। যেমন, তাঁর চতুর্থ অভিযান ১০০৬ সালে মুলতানের শাসক আবুল ফতেহ দাউদের বিরুদ্ধে, ১০০৭ সালে নওয়াজ শাহের বিরুদ্ধে পঞ্চম অভিযান এবং ১০১০ সালের অষ্টম অভিযানও বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। দ্বিতীয়ত, মাহমুদ ভারতে কোনও স্থায়ী আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেননি। তৃতীয়ত, মাহমুদের শাসনামলে অমুসলিমদের পূর্ণ ধর্মীয় স্বাধীনতা ছিল। বিজিত হিন্দু ও অন্য ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি পালনে কোনও প্রকার বাধা ছিল না।
সুলতান মাহমুদ অবশ্য হিন্দুদের কয়েকটি মন্দির ধ্বংস করেছিলেন। একমাত্র যুদ্ধের সময়ই মন্দির ধ্বংস করা হয়েছিল। শান্তির সময় তিনি কখনও কোনও মন্দির ধ্বংস করেননি বা কোনও মন্দির তার হস্তে অপবিত্র হয়নি। তাছাড়া মন্দিরগুলাে ছিল যুগ যুগ ধরে সঞ্চিত ধনরত্নের ভান্ডার।৬ গুপ্তধনের সন্ধান না পেলে তিনি হয়তাে কোনও মন্দিরের উপর আক্রমণই চালাতেন না। পৌত্তলিকদের শাস্তি দেওয়া বা ইসলাম প্রচারের কোনও বাসনা তার ছিল না। সুলতান-দরবারের বিখ্যাত ঐতিহাসিক ও প্রত্যক্ষদর্শী আলবেরুনী (৯৭৩-১০৪৮) বলেন, “বিদেশি বণিকদের নিকট উৎপাদিত উদ্বৃত্ত সামগ্রী বিক্রয় করে যে সমস্ত ধর্মপ্রাণ হিন্দু ধনী হয়েছিলেন, তাদের দানের ধনরত্ন মন্দিরে সঞ্চিত হয়েছিল।” এছাড়া হিন্দুদের এই পবিত্র স্থানগুলােতে প্রবেশ করা বড় দুঃসাধ্য ছিল বলে অনেক সময় রাজাগণও নিরাপত্তার জন্য এই মন্দিরগুলাের মধ্যে প্রচুর ধনরত্ন সঞ্চয় করে রাখতেন। সুতরাং দেব মূর্তি ভেঙ্গে ইসলাম প্রচার ও মন্দির অপবিত্র করার জন্য সুলতান মাহমুদ বারবার পাক-ভারত অভিযান করেছিলেন বলে সমালােচকগণ যে মত প্রকাশ করে থাকেন, ইতিহাসের বিচারে তা অসত্য।
রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্যই তিনি পাক-ভারত অভিযান করেন। স্বীয় সাম্রাজ্যের স্বার্থে তিনি ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত দখল করেন। তবে বিশেষভাবে হিন্দুরাজন্যবর্গ কর্তৃক চুক্তির শর্ত লংঘন, সুলতানের আনুগত্য প্রত্যাহার, শত্রুকে সাহায্য দিয়ে রাজনৈতিকভাবে বিশ্বাসঘাতকতা, ভারতীয় মিত্রদের উপর শক্ত প্রতিবেশীর হামলা এবং আশ্রিত ভারতীয় রাজাদের বিদ্রোহ ঘােষণার জন্যই সুলতান মাহমুদ বার বার পাক-ভারত অভিযান পরিচালনা করতে বাধ্য হয়েছিলেন। সুরজিৎ দাশগুপ্তের গ্রন্থে৭ এ বিষয়ে বিস্তারিত আলােকপাত করা হয়েছে।
(২)
গজনীর সুলতান সুবক্তগীন বা মাহমুদ ভারতে ইসলামিক বা কোনও ধরনের রাজ্য প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা করেনি। কিন্তু বাস্তব চৈতন্যর উদয় হতে বেশী সময় লাগেনি। তাই দাস বংশের প্রতিষ্ঠাতা কুতুবউদ্দিন আইবক (১২০৬-১২১০) ১২০৬-এ স্থির করলেন যে, ভারতে স্থায়ীভাবে বসবাস করবেন। গড়ে ওঠে দিল্লিকেন্দ্রিক প্রথম ভারতীয় মুসলিম রাষ্ট্র। ধর্মীয় নীতির ক্ষেত্রে এই রাষ্ট্রের দুটি মুখ্য উপাদান লক্ষ্য করা যায়—
১. ভারতে প্রচলিত সুফি মতবাদের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপােষকতা, বিশেষ করে চিস্তি সম্প্রদায়ের।
২. বাছাই করে বিশেষ কিছু মন্দির কলুষিত করার নীতি, যার উদ্দেশ্য ছিল পরাজিত হিন্দু রাজাদের শাসনের বৈধতা নষ্ট করে তাদের সম্পূর্ণ বিনাশ সাধন।
সুফি সাধকেরা ছিলেন ধর্মীয় ও সামাজিক ক্ষেত্রে অত্যন্ত উদারপন্থী, কোনওরকম ধর্মীয়। রক্ষণশীলতা তাদের স্পর্শ করতে পারেনি। তারা সুলতানি আমলে (১২০৬-১৫২৬) তাদের মরমী দর্শন ও গভীর মানবপ্রেমের পথে ভারতীয়দের ইসলাম ধর্মে আকৃষ্ট করতে পেরেছিলেন, বলপ্রয়ােগের দ্বারা ধর্মান্তরকরণের প্রয়ােজন ঘটেনি। দিল্লির সুলতানরা কেউই হিন্দুদের ওপর জোর জুলুম বা অত্যাচার করে ইসলাম চাপিয়ে দেননি। উদারপন্থী সুফি সাধকদের পৃষ্ঠপােষকতা করে তারা কট্টর ইসলামি শাসন প্রতিষ্ঠার বিরােধিতা করেছেন। সমসাময়িক মুসলিম ঐতিহাসিকদের বিবরণে তার সাক্ষ্য পাওয়া যায়।
দিল্লির সুলতানদের ধর্মীয় উদারতার পাশাপাশি লক্ষ্যণীয় তাদের হিন্দু মন্দির কলুষিত বা ধ্বংসের বীভৎস কার্যকলাপ। হিন্দু মন্দির ধ্বংস করার উদ্দেশ্য আর যাই হােক না কেন, হিন্দুদের ইসলাম ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট করা নিশ্চয় নয়। কেন না কী করে আমরা ভাবতে পারি যে, কোনও সম্প্রদায়ের হৃদয় জয় করা যায় তাদের মন্দির ধ্বংস করে? এই ধ্বংসক্রিয়া তাদের মনে ইসলাম সম্বন্ধে প্রেম নয়, বরং ঘৃণারই উদ্রেক করাতে পারে। তাহলে এ ধরনের কার্যকলাপের উদ্দেশ্য হিন্দুদের ধর্মান্তরিত করা নয়, নিশ্চয়ই অন্য কোনও অভিপ্রায় ছিল। এটা লক্ষ্যণীয় যে, সাধারণত কেবলমাত্র শত্রুপক্ষের এলাকার মন্দিরগুলিই ধ্বংস করা হয়েছে। মন্দিরগুলাে ষড়যন্ত্র বা বিদ্রোহের কেন্দ্র হয়ে না দাঁড়ালে সুলতানের নিজের এলাকার মধ্যে কখনও তা ধ্বংস করা হত না। শত্রুর এলাকায় মন্দির ধ্বংস করা যেন জয়ের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
সুতরাং যদি বলা হয় যে, মুসলিম তুর্কিরা তাদের শাসন শুরু করেছিল বিনা বিচারে জীবন, সম্পত্তি ও ধর্ম ধ্বংস করে, তাহলে সেটা ইতিহাস ভুল পড়ার বিশাল দৃষ্টান্ত দেখাবে।৮ মন্দির ধ্বংস করার যেসব দৃষ্টান্ত সমকালীন বর্ণনায় পাওয়া যায়, সেগুলি শুধু যুদ্ধকালীন কার্যকলাপের ভিত্তিতেই পরীক্ষা করা উচিত নয়, সমকালীন ঐতিহাসিকদের অতিরঞ্জিত করার অভ্যাসের পরিপ্রেক্ষিতেও দেখা উচিত। হাসান নিজামি যেমন কালিঞ্জরের সব মন্দির ধ্বংসের কথা যথার্থ তৃপ্তির সঙ্গে বলেছেন, বাস্তবে অধিকাংশ প্রাক-মুসলিম মন্দিরগুলি ওখানে, অন্তত মহােবা ও খাজুরাহােতে এখনও অক্ষত আছে।৯ ওই একই ধরনের অতিশয়ােক্তি বেনারস, কালপী, দিল্লি ও আজমীর বিজয়ের বর্ণনাতেও পাওয়া যায়। এতে অবশ্য কোনাে সন্দেহ নেই যে, কতকগুলি মন্দির ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, এমনকি ইচ্ছাকৃতভাবে ধ্বংসও করা হয়েছিল। ইলতুৎমিস (১২১১-১২৩৬) উজ্জয়িনীর মহাকাল মন্দির ধ্বংস এবং আজমীরে বিগ্রহ পালের বিদ্যালয়কে মসজিদে রূপান্তরিত করেছিলেন বলে মিনহাজউদ্দিন উল্লেখ করেছেন।১০ তবে এ সময় প্রচুর মন্দির তৈরিও হয়েছে, বহুক্ষেত্রে সরকারি আনুকূল্যেই। দিল্লির কাওয়াতুল মসজিদ অবশ্যই হিন্দু মন্দিরের মাল-মশলা দিয়ে তৈরি। বাদাউনে ইলতুৎমিসের মসজিদও তাই।১১ এমন বহু উদাহরণ ইতিহাসের পাতায় ছড়িয়ে রয়েছে। তবে এ বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়াটা বােধহয় যুক্তিযুক্ত নয়। কারণ মন্দির-মঠ প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে ক্ষয়প্রাপ্ত হয় এবং প্রতিদ্বন্দ্বী হিন্দু সম্প্রদায়ের অসহিষ্ণুতাও অনেক ক্ষেত্রে এ ধরণের ক্ষতির জন্য দায়ী।
(৩)
মুসলিমগণ যেসব মন্দির ধ্বংস বা কলুষিত করেছিল তার অধিকাংশই ঘটেছে সামরিক অভিযানের সময়ে; আর যেসব ক্ষেত্রে সামরিক অভিযান সম্পর্কিত ছিল না, সেসব ক্ষেত্রে ধর্ম নয়, বরং বিজেতার ধনলিপ্সাই দায়ী ছিল। কারণ, এটা সুবিদিত যে, তকালে হিন্দু মন্দিরগুলােতে প্রচুর ধনরত্ন গচ্ছিত থাকত এবং এখনও থাকে। কালের নিয়মে জরাজীর্ণ হয়েও বহু বৌদ্ধ স্থাপত্য ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। ব্রাহ্মণ্যবাদী শক্তিও বহু ধ্বংস করেছিল। অনেক হিন্দু মন্দিরও কালের গ্রাসে গুরুত্বহীন হয়ে ধ্বংস হয়েছিল। এককালে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল জুড়ে বৌদ্ধ বা হিন্দুরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল, যেটা বিবেকানন্দসহ বহু মনীষী স্বীকার করেছেন। এক্ষেত্রে ওইসব অঞ্চলে বৌদ্ধ বা হিন্দু মন্দির নব মুসলিমদের কাছে তার প্রয়ােজনীয়তা হারিয়েছিল। কালক্রমে সেগুলি জরাজীর্ণ হয়ে ধ্বংসাবশেষে পরিণত হয়েছিল। সেই অব্যবহৃত ধ্বংসাবশেষ হয়ত পরে অনেক মুসলিম স্থাপত্যে ব্যবহৃত হয়ে থাকতে পারে।
বাংলার কয়েকটি প্রাচীন ইসলামধর্মীয় সৌধের প্রত্নসাক্ষ্যেও অ-ইসলামীয় অলংকরণ ব্যবহৃত হওয়ার দৃষ্টান্ত রয়েছে। বহুকাল পরের মানুষদের এরকম মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক যে, সে-যুগে প্রাক-ইসলামীয় ধর্মস্থান ধ্বংস করেই ওই সব অলংকরণগুলি আহৃত হয়ে ইসলামীয় সৌধে ব্যবহৃত হয়েছিল। কিন্তু বাংলার সহজযানী বৌদ্ধদের দলে দলে ইসলাম ধর্মগ্রহণের প্রেক্ষাপটটাই এই রকম ঘটনার অন্য রকম অথচ অতি যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা উপস্থিত করেছে।
আমরা দেখেছি যে, সহজযানীদের পূর্বসূরী বৌদ্ধ বজ্রযানীদের মধ্যে বুদ্ধদেবের নানা শক্তিরূপের দ্যোতক হিসাবে বহু বৌদ্ধদেবদেবীর উদ্ভব ও তাদের পূজার ব্যাপক প্রকাশ ঘটেছিল। ওই সব দেবদেবী যে সব বৌদ্ধ মন্দির বা মঠে পূজিত হত সেগুলি নানা বৌদ্ধ প্রতীক চিহ্নেও সজ্জিত হত। বজ্রযানীদের সূচনার আমলে তাদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির কারণে সেই অলংকরণগুলি নির্মিত হত বাংলায় দুষ্প্রাপ্য উচ্চমূল্যের পাথর দিয়ে। কিন্তু সহজযানী আমলে বাংলার বৌদ্ধদের মূল অংশের লােকেদের মধ্য থেকে মূর্তিপূজার অবসান হয়ে যাওয়ায় ওই সমস্ত বজ্রযানী বিগ্রহ ও সৌধগুলি পরিত্যক্ত হয়ে ধ্বংসােন্মুখ অবস্থায় চলে গিয়েছিল বলেই মনে হয়। কিন্তু ২/১টি ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। ছাড়া সেগুলি বর্ণহিন্দুদের দেবালয়ে পরিবর্তিত না হওয়াই স্বাভাবিক। এই সব পরিত্যক্ত সৌধগুলির অধিকাংশের অবস্থান নিশ্চিতই সহজযানী অধ্যুষিত গ্রামাঞ্চলেই ছিল। আর সেগুলি গ্রামের চারণভূমির মতাে গ্রামবাসীদের সাধারণ সম্পত্তিতে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। তাই কোনও গ্রামের সহজযানীরা ইসলামধর্মী হয়ে যাওয়ার পর প্রাথমিক পর্যায়ে যে সব ইসলামীয় ধর্মাচরণের জন্য সৌধের প্রয়ােজন দেখা দিয়েছিল তা সেই সব ব্যবহার্য অথচ পরিত্যক্ত বজ্রযানী সৌধগুলি মেটাত। কিছু ইসলামি চিহ্ন যুক্ত করেই এই পরিত্যক্ত বৌদ্ধ/জৈন সৌধগুলিকে ইসলামীয় করে নেওয়া হত।
আবার কোনও নির্মিয়মান ইসলামি সৌধের অলংকরণে ধ্বংসপ্রাপ্ত অ-ইসলামীয় সৌধগুলির অংশ বিশেষ সংযােজিত হত। কে বলতে পারে যে, ভারতে মসজিদ সমূহের মধ্যে সর্ববৃহৎ আদিনা মসজিদে (পাণ্ডুয়া: নির্মাণ ১৩৭৫ খ্রীঃ) যে সব বৌদ্ধ অলংকরণ চিহ্ন রয়েছে সেগুলি কয়েকশত বছর পূর্বে ধ্বংসপ্রাপ্ত প্রাচীন বৌদ্ধ ও হিন্দু রাজাদের পরিত্যক্ত রাজধানী পাণ্ডুয়া থেকে এভাবেই সংগৃহীত হয়নি? গৌড় ও পাণ্ডুয়ার পুরাকীর্তি সার্ভে করে জে ডি বেগলার বিশেষ কৃতিত্ব অর্জন করেন। তিনি ১৮৮৭-৮৮ সালে ‘আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ বেঙ্গল রিপাের্ট’ প্রণয়ন ও প্রকাশ করেন। এই গ্রন্থ, যা লন্ডনের ‘স্কুল অফ ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজ’-এর গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত আছে। বেগলার এই গ্রন্থে আদিনা মসজিদের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দেন এবং প্রতিটি অংশের পরিমাপ দেন। আদিনা মসজিদের এরূপ সার্ভে পূর্বে হয়নি, যদিও তার সকল মন্তব্য গ্রহণযােগ্য নয়— উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় যে, ভাগলপুর ডিভিসনের কৈলাস পাহাড়ের মন্দিরসমূহ ধ্বংস করে পাণ্ডুয়ার আদিনা মসজিদ নির্মিত হয়। এ কথা সত্য যে, আদিনা মসজিদের মিহরাব, মিম্বর ও অন্যান্য অংশে হিন্দু ভাস্কর্যের ভগ্নাবশেষ দেখা যায়। তিনি বলেন, “The sanctum of the temple, judging from the remnants of heavy pedestals of statues, now built into the pulpit and the superb canopied trefoil now doing the duty of prayer niche stood where the main prayer nich now stands : nothing world probably so tickle the fancy of a bigot (?) as the power of placing the sanctum of his orthobox cult (in this case the main prayer niche) on the spot where hated infidel had his sanctum.’ সহজ কথায় বেগলার বলতে চান যে, হিন্দু মন্দির ভেঙ্গে আদিনা মসজিদের কেন্দ্রীয় মিহরাব এবং মিম্বর নির্মিত হয়েছে এবং এ কাজে মুসলিম স্থাপতি তার ধর্মীয় উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন। প্রথমত, এমন কোনাে প্রমাণ পাওয়া যায়নি যে, আদিনা মসজিদ হিন্দু মন্দিরের ভিত্তি ভূমির উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। বেগলার স্বয়ং আদিনা মসজিদের চত্বরে ৫-৬ ফুট গভীরে খনন করে যাচাই করে দেখেন। কিন্তু এই চত্বরে হিন্দু মন্দিরের কোনাে ভিত্তিভূমি পাওয়া যায়নি। দ্বিতীয়ত, সুদূর ভাগলপুর থেকে হিন্দু মন্দির ভেঙ্গে ধ্বংসাবশেষ সংগ্রহ করে আদিনা মসজিদ নির্মিত হয়নি, কারণ যাতায়াতের অসুবিধা। বিচ্ছিন্নভাবে এখানে ওখানে হিন্দু মন্দিরের ভাস্কর্য ভগ্নাবস্থায় পাওয়া যায়। সেগুলি আদিনা মসজিদে ব্যবহৃত হয়ে থাকতে পারে। কিন্তু তাতে প্রমাণ হয় না যে, মন্দির ভেঙে নির্মাণ উপকরণ আনা হয়েছে। তাই মনে রাখা প্রয়ােজন যে, কোনও প্রাচীন ইসলামীয় সৌধে অ-ইসলামীয় অলংকরণের অবিস্থিতি অনিবার্যভাবে প্রমাণ করে না যে, সেই সৌধটি নির্মাণে নিকটবর্তী কোনও অ-ইসলামীয় ধর্মস্থানের, যেখানে তখনও ধর্মাচরণ চলছিল—তাকে ধ্বংস করেই সেই সব অলংকরণ আহৃত হয়েছিল।
ইসলাম ধর্মীয় সৌধে হিন্দু মন্দিরের অংশবিশেষ ব্যবহারের আরও একটি পরিপ্রেক্ষিতও আলােচনা প্রয়ােজন। যদিও বাংলায় ইসলাম ধর্মগ্রহণকারীদের একটা বড় অংশই বৌদ্ধ সহজযানীরা ছিল, তবু বাংলার গ্রামাঞ্চলে ব্রাহ্মণ্যবাদীদের বিচার অস্পৃশ্য বা জল-অচল শূদ্র জাতির লােকেদের একটা উল্লেখযােগ্য অংশও ব্রাহ্মণ্যবাদীদের অতলান্ত ঘৃণা-বিদ্বেষ-অত্যাচার থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য ও ইসলামের ধর্মীয় সাম্যের আকর্ষণে সে ধর্ম গ্রহণ করেছিল। এরকম ব্রাত্যজন অধ্যুষিত গ্রামে মুষ্টিমেয় বর্ণ হিন্দুরও অধিষ্ঠান ছিল। সে সব গ্রামে তাদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত দেবালয়ের অবস্থিতি নিশ্চিতই ছিল। কিন্তু এরকম মন্দির কোনও ব্যক্তি বিশেষের পারিবারিক বংশানুক্রমিক সম্পত্তি ছিল বলেই সে সব মন্দিরের রক্ষণাবেক্ষণ বা পূজার্চনা সেই সব পরিবারের অর্থানুকূল্যেই সাধিত হত। কিন্তু সে রকম কোনও পরিবারের আর্থিক অবস্থার বিপর্যয় ঘটলে তাদের পক্ষে আর মন্দিরের ব্যয় সংকুলন সম্ভব হত না। ফলে প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী এরকম মন্দিরের স্বত্বাধিকারীরাই মন্দির পরিত্যাগ করে বিগ্রহকে নদী বা জলাশয়ে বিসর্জন দিতেন। তুর্কি আগমনের বহু শত পূর্ব থেকেই বাংলায় তথা ভারতে এরকম অজস্র পরিত্যক্ত মন্দির বা বিগ্রহের অস্তিত্ব ছিল এবং আজও আছে। ইসলাম। ধর্মগ্রহণকারী ব্রাত্যজনদের অধ্যুষিত গ্রামেও এরকম পরিত্যক্ত মন্দির বা বিগ্রহের অবস্থানও স্বাভাবিক ঘটনা। এখন ইসলাম ধর্মগ্রহণকারী সেখানকার একদা ব্রাত্য মানুষদের ওই রকম পরিত্যক্ত মন্দির বা বিগ্রহের প্রতি কি মনােভাব পােষণ করা স্বাভাবিক? ব্রাত্য জীবনে যারা কখনও সে সব মন্দিরে প্রবেশাধিকার পায়নি, ব্রাহ্মণদের বিধানে যে সব মন্দিরে দেবতাদের পূজা দেওয়ার অধিকার তাদের ছিল না—তাদের কাছ থেকে কি সেই সব পরিত্যক্ত মন্দির বা বিগ্রহের প্রতি কোনাে ধর্মীয় মােহ আশা করা সঙ্গত? তাই ওই ধর্মান্তরিত ব্রাত্যজনেরা যখন তাদের নতুন ধর্মের প্রয়ােজনে কোনও সৌধ নির্মাণ করেছিল, তখন তাতে ওই পরিত্যক্ত মন্দিরের অংশ বা বিগ্রহ সংযােজিত করেছিল। মনে রাখা প্রযােজন যে পর্বতহীন গাঙ্গেয়বঙ্গে পাথরের বড়ই অভাব ছিল এবং যা পাওয়া যেত সেগুলি হতাে দুর্মূল্য। যার পরিবর্ত হিসাবে মন্দির বা বিগ্রহের পাথর ব্যবহৃত হয়েছিল, তারা তা করেছিল সেগুলির প্রস্তর মূল্যের জন্যই—হিন্দু ধর্মীদের মনে আঘাত করার জন্য নয়, তাদের উপহাস করার জন্যও নয়। পাশাপাশি স্মরণ রাখতে হবে যে বাংলার মানুষরা সুফি সন্তদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল। আর তৎকালীন জগতে বিশ্বমানবতাবাদের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রবক্তা সুফিদের প্রতি ভিন্নধর্মীদের ধর্মস্থান ধ্বংস করার প্ররােচণা দেওয়ার অভিযােগ করা এক ঐতিহাসিক বাতুলতা ছাড়া আর কিছুই নয়।
এ বিষয়ে আরও কিছু বলা দরকার। সেকালে ঝড়-খরা-বন্যা-ভূচাল-মহামারী হলে লােকে বাড়িঘর ছেড়ে অন্যত্র চলে যেত। রাজস্ব বা সামন্ত পীড়নেও পালাত। এভাবে পাকা মন্দির মসজিদ পরিত্যক্ত হত। তাছাড়া পাথুরে মন্দির-মসজিদ হলে স্থানীয় লােক অর্থাভাবে মেরামত করতে পারত না বলে এক সময়ে সেগুলাে জীর্ণ হয়ে ভেঙে পড়ত। হিন্দুদের হাজারাে বিশ্বাসে সংস্কারে নিয়ন্ত্রিত জীবন। কাজেই ভাঙা মন্দিরের পাথরের উপযােগ নেই তাদের কাছে। কিন্তু মুসলিমদের সে-সংস্কার ছিল না বলে ওরা পরিত্যক্ত বা জীর্ণ মন্দিরের পাথর উত্তর ভারতের অনেক মসজিদে ব্যবহার করেছে। তুর্কিমুঘলরা শাসন প্রশাসন চালিয়েছে হিন্দু দিয়েই, তাছাড়া গােটাভারত কখনও তুর্কি-মুঘল অধিকারেও ছিল না। হিন্দু প্রজা রইল, তার পেশা রইল, তার পারিবারিক জীবন রইল, সামাজিক জীবন রইল, তার শাস্ত্র ও শাস্ত্রাচার রইল, লক্ষ লক্ষ ঘরে গৃহ দেবতা রইল, গাঁয়ে-গঞ্জে-শহরে-বন্দরে মন্দিরও রইল। কয়েকটি মসজিদে কয়েক টুকরাে মূর্তি অঙ্কিত পাথর দেখেই কি বলা যায় যে তুর্কি-মুঘলরা মন্দির ভেঙেছে? হ্যা মন্দিরও ওরা ভেঙেছে, বিদ্রোহী হিন্দু ধনী-মানী-মহাজন-জমিদার-সামন্তকেও হয় এককভাবে অথবা স্ববংশে হত্যা অবশ্যই করেছে প্রশাসনিক প্রয়ােজনে, আজও করতে হয়। পাকিস্তানে মসজিদে সৈন্যরা সবুট ঢুকে লােক হত্যা করেছিল। ১৯৭১-এ এরাই বাংলাদেশের রমনা কালীমন্দির ভেঙেছিল। এই সেদিন শিখ স্বর্ণমন্দিরে সবুট সৈন্য প্রবেশ করে নরহত্যা করেছে। রাজারা এমন কাজ করেই। তাই সমস্ত মন্দির ও মঠের ক্ষতিসাধনের জন্য মুসলিম কার্যকলাপকে দায়ী করলে স্বাভাবিক ধ্বংসের বিষয়টি এবং প্রতিবাদী হিন্দু মতবাদের অসহিষ্ণুতাকে উপেক্ষা করা হবে।
অথচ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ওই ধরনের ক্ষতিসাধনে মুসলিমদের দায়ী করা হয়েছিল যুদ্ধকালীন কার্যকলাপ থেকে; যখন এরকম হয়নি, তখনও তার উদ্দেশ্য ধরা উচিত বিজয়ীর ধর্মীয় উৎসাহের জন্য নয়। ইতিহাসের উৎসাহী বর্ণনার মধ্যে ধর্মীয় উৎসাহ ছাড়া আরও বেশি কিছু রয়েছে। মন্দির ধ্বংস করার ও আল্লাহর আবাসস্থল তৈরি করার’ অতিরঞ্জিত বর্ণনায় একটা প্রচারের মূল্য ছিল। এতে মধ্য এশিয়া থেকে লােক সংগ্রহ করার সুবিধা হত ধর্মের গৌরব ও জাগতিক ধন পাবার সম্ভাবনা দেখিয়ে।১২ জাঁকজমকপূর্ণ ভাষায় রচিত ‘ফতেনামা’ (বিজয়কাহিনি) বা ‘চাচনামা’ তৈরি করা হয়েছিল এজন্যই।
(৪)
সুলতানরা পূর্বতন রাজনৈতিক কর্তৃত্বকে নিশ্চিহ্ন করার জন্যও মন্দির ধ্বংস করার নীতি গ্রহণ করেছিলেন অথাৎ পরাজিত হিন্দু রাজাদের শাসনের বৈধতা নষ্ট করে তাদের সম্পূর্ণভাবে বিনাশ করার জন্য। হিন্দু রাজন্যবর্গের বৈধতা যুক্ত থাকত রাজকীয় মন্দিরের সঙ্গে যেখানে অধিষ্ঠিত থাকত রাজবংশের রাষ্ট্রদেবতার মূর্তি। সেই মন্দিরগুলিই আক্রান্ত হত, যার ফলে পরাজিত হিন্দু রাজারা তাদের ঈশ্বর প্রদত্ত বৈধতা হারিয়ে ফেলে নিজেদের চিরতরে বিধ্বস্ত বােধ করতেন ও মাথা তুলে দাঁড়াবার সাহস ও মানসিকতা হারিয়ে ফেলতেন। যে সব হিন্দু মন্দির এইভাবে রাজবংশের রাজকীয় মন্দিরের মর্যাদা লাভ করেনি সেগুলি সুলতানি শাসনে আক্রান্ত হয়নি। খাজুরাহাের বিখ্যাত মন্দির যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
প্রসঙ্গক্রমে মীরজুমলা কর্তৃক কোচবিহারের রাজমন্দির ধ্বংসের কথা উল্লেখ করা যায়। ঐতিহাসিক আর এম ইটন তাঁর গ্রন্থে১৩ বিস্তারিত ও প্রামাণ্য তথ্য দিয়ে দেখিয়েছেন যে, ওই সব মন্দির ধ্বংস বা অপবিত্র করার পেছনে রয়েছে বিজয়ী রাজা কর্তৃক পরাজিত রাজার কুলদেবতার মন্দির ধ্বংস করার প্রেরণা। যার ফলে পরাজিত রাজা যে কেবল তার জাগতিক ক্ষেত্র থেকেও উৎসাদিত হলেন তাই নয়, তিনি তার পারত্রিক ক্ষেত্র থেকেও উৎখাত হলেন। এ দ্বারা আরও প্রমাণিত হলাে যে, যে রাজা তার কুলদেবতাকে রক্ষা করতে অসমর্থ তাঁর রাজত্ব করার কোনােও নৈতিক অধিকার নেই। আর এই রাষ্ট্রনৈতিক প্রথাশাসকদের আবিষ্কার। বা আমদানি করা নয়। প্রাক ইসলাম যুগে সারা ভারতেই তা অনুসৃত হত।
ষষ্ঠ শতকে রচিত “বৃহৎ সংহিতায় বলা হয়েছে, যদি কোনও মন্দিরে দেববিগ্রহ ভেঙে যায় বা ভেঙে দেওয়া হয়, কোনও ফাটল দেখা দেয় বা কোনওভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয় তাহলে তা রাজা ও দেশের অনিবার্য ধ্বংসের বার্তা ঘােষণা করে। এই বিশ্বাস হিন্দুরাজাদের মানসিকতায় দৃঢ়ভাবে প্রােথিত থাকার ফলে এক হিন্দু রাজা তার প্রতিদ্বন্দ্বী অন্য হিন্দু রাজার রাষ্ট্র দেবতার বিগ্রহ ও মন্দির ধ্বংস বা কলুষিত বা ক্ষতিগ্রস্ত করেছে ষষ্ঠ শতক থেকে।১৪ এ সমস্ত বিবেচনা করেই বলা যায় যে, এ মন্তব্যটি অত্যন্ত সঠিক যে পরাজিত রাজার রাজমন্দির ও বিগ্রহ ধ্বংস করার প্রেরণা কোনও বিশেষ ধর্মানুসারীদের অপর ধর্মের প্রতি বিদ্বেষ থেকে আসেনি। এটা ভারতে প্রচলিত রাষ্ট্রতত্ত্বেরই প্রবাহমান ধারার একটি বিশেষ অংশ।
দ্বাদশ শতক থেকে দিল্লির সিংহাসনে আসীন সুলতান ও তাদের সেনাপতিরাও এই দেশজ ঐতিহ্য ও প্রথা অনুসরণ করেই হিন্দুরাজাদের শাসনের বৈধতা নষ্ট করে তাদের চূড়ান্ত বিনাশ ঘটানাের উদ্দেশ্যে, যাকে স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রের দৃষ্টিভঙ্গিতে যুক্তি সঙ্গত বলা যেতে পারে। সুতরাং সুলতানি শাসনে হিন্দু মন্দির ধ্বংসের সঙ্গে ধর্মকে টেনে আনা যুক্তিযুক্ত নয়, ধর্মবােধই যদি মন্দির ভাঙার হেতু হবে তাহলে সিকান্দার লােদি-ই (১৪৮৯-১৫১৭) বা কেন জৈনপুরের সমস্ত মসজিদ ধ্বংস করার ইচ্ছা প্রকাশ করবেন। যেখানে জৈনপুরের শাসকও ছিলেন তারই মত মুসলমান।১৫
(৫)
হিন্দুরাজারাও যে অন্য ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ধর্মস্থান বিনষ্ট করতে পিছপা ছিলেন না তার বহু দৃষ্টান্ত ইতিহাসে রয়েছে। ধর্মবিবাদ প্রাচীন ভারতে গােটা অধ্যায় জুড়েই ছিল। হিউয়েন সাঙ (খ্রিঃ ৬২৯-৬৪৫) ও ইতিহাসবিদ কলহন উভয়েই শৈব রাজাদের সঙ্গে বৌদ্ধদের বিবাদ এবং শৈব রাজাদের হাতে বৌদ্ধ সাধু-শ্রমণ হত্যা এবং বৌদ্ধমঠ ধ্বংসের কথা উল্লেখ করেছেন।১৬ দক্ষিণ ভারতের তামিলনাড়ু, কর্ণাটক, অন্ধ্রপ্রদেশ প্রভৃতি এলাকায় প্রাচীন যুগে শৈবদের সঙ্গে জৈনদের শত্রুতা ও জৈন নিধন এবং জৈন ধর্মস্থান বলপূর্বক শৈব ধর্মস্থানে রূপান্তরের প্রমাণ আছে। লিঙ্গায়েত সম্প্রদায়ের হাতে জৈনদের হয়রানি এত বেড়ে গিয়েছিল যে জৈনগণ তাদের রক্ষার জন্য বিজয়নগরের শাসকদের কাছে আবেদন জানাতে বাধ্য হয়।১৭ ইংরেজ ইতিহাসবিদ ভিনসেন্ট স্মিথ যাঁকে ভারতের নেপােলিয়ন বলেছেন সেই সমুদ্রগুপ্ত (খ্রিঃ ৩৩০-৩৮০) থেকে শুরু করে অজাতশত্রু (খ্রিঃ পূঃ ৫৫৪-৫২৭), চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য (খ্রিঃ পূঃ ৩২৪-২৯৮), কণিষ্ক (খ্রিঃ ১২০-১৬২), হর্ষবর্ধন (খ্রিঃ ৬০৬-৪৬), দ্বিতীয় পুলকেশী (খ্রিঃ ৬১১-৬৪২), প্রথম মহেন্দ্র বর্মণ (খ্রিঃ ৬০০-৬৩০), ২য় মহেন্দ্র বর্মণ (খ্রিঃ ৬৬৮-৬৭০), প্রথম রাজেন্দ্র (খ্রিঃ ১০১৪-১০৪৪) প্রত্যেকেই বীর হিসেবে খ্যাত এবং মানতেই হবে তারা ছিলেন বড় যােদ্ধা। শুধু বােঝা মুশকিল তাঁদের রাজনীতিতে অহিংসার স্থান কোথায়? হিন্দু সংস্কৃতির আধ্যাত্মিক ভিত্তির একটা বড় দিক যে অহিংসতা, হিন্দু রাজন্যবর্গের আচরণে কিন্তু তা প্রতিফলিত নয়। সুতরাং হিন্দুধর্মের সহিষ্ণুতা নিয়ে যে এত কথা বলা হয় সে সম্পর্কে একটু ভেবে দেখা দরকার।১৮ রাজনীতি ও অহিংসা যদি একসঙ্গে হিন্দু রাজত্বে না চলে তাহলে শুধু মুসলিমদের বেলায় দোষ খোঁজা ঠিক কাজ হবে কেন?
ভাই ভাই দ্বন্দ্ব কি শুধু মধ্যযুগে? প্রাচীন যুগে ছিল না? সিংহাসনের লােভেই তাে কুরুপাণ্ডবের যুদ্ধ। সে যুদ্ধ তাে ভাইয়ে-ভাইয়ে যুদ্ধ। অভিমুন্যের মত বালককে হত্যা করেছিল কে? নিজের কাকা জ্যাঠারাই তাে? সম্রাট অশােক (খ্রিঃ পূঃ ২৭৩-২৩২) সম্রাট হওয়ার জন্য ভাইদের খুন করেন।১৯ অজাতশত্রুর কথাই ধরি, বাবা বিম্বিসারকে (খ্রিঃ পূঃ ৫৮২৫৫৪) বধ করেন। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য রাজা ধনানন্দকে খুন করেই ক্ষমতায় বসেন। শেষ মৌর্য সম্রাট বৃহদ্রথকে খুন করেই তাঁর সেনাপতি পুষ্যমিত্র শুঙ্গ (খ্রিঃ পূঃ ১৮৫-১৪৯) বংশের প্রতিষ্ঠা করেন। এলাহাবাদ প্রান্ত শিলালিপি অনুসারে সমুদ্রগুপ্ত অন্যান্য রাজকুমারদের হত্যা করেছিলেন। বিশাখ দত্ত রচিত ‘দেবী চন্দ্রগুপ্ত’ নাটক অনুসারে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত (খ্রিঃ ৩৮০-৪১৫) রামগুপ্তকে হত্যা করে তার পত্নীকে বিয়ে করে সিংহাসনে বসেন। ৫ম শতকে স্কন্দগুপ্ত তার বড় ভাই পুরুগুপ্তকে হটিয়ে রাজা হন। চালুক্যরাজ পুলকেশী তাঁর কাকাকে হত্যা করে রাজা হন। চালুক্য রাজা পঞ্চম বিক্রমাদিত্য তাঁর পূর্বসূরীকে হত্যা করে ক্ষমতায় বসেন। হিন্দুরাষ্ট্র নেপালের রাজবংশের হত্যালীলা তাে হাল আমলের। ভগবৎ গীতায় শ্রীকৃষ্ণ তাে ক্ষমতার জন্য গুরু ও আত্মীয়কে খুন করার উপদেশ পর্যন্ত দিয়েছেন।
ভারতীয় বিদ্যাভবন প্রকাশিত ও রমেশচন্দ্র মজুমদার সম্পাদিত ‘The History and Culture of the Indian People’-এর ৫ম খণ্ডে উল্লেখ আছে যে, শৈব রাজারা হাজার হাজার জৈনকে শূলে হত্যা করেছিল। একবার একদিনে ৮০০০ জৈনকে শুলে হত্যা করার কথা তামিল পুরাণেই উল্লিখিত হয়েছে। এ তথ্য ডি এন ঝা-ও তার গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন।২০ দাক্ষিণাত্যের কোনও কোনও মন্দির গাত্রে আজও এই শূলবিদ্ধকরণ উৎকীর্ণ দেখতে পাওয়া যায়। এ জাতীয় অসহিষ্ণুতার সবচেয়ে চমকপ্রদ দৃষ্টান্ত শ্রীরঙ্গমের শৈবরাজা প্রথম কুলােতুঙ্গ (খ্রিঃ ১০৭০-১১২০) স্থাপন করে গেছেন—তাঁর ব্রাহ্মণ্য প্রতাপে স্বয়ং রামানুজম (১০১৭-১১৩৭) ও তার শিষ্যবৃন্দসহ শ্রীরঙ্গম (তামিলনাড়ু) ছেড়ে মহীশূরে ২৫ বছরের জন্য সরে যেতে বাধ্য করা হয়।২১ এই উগ্রতার আরও প্রকাশ দেখা যায়। দ্বিতীয় কুলােতুঙ্গ কর্তৃক চিদাম্বরম মন্দিরের প্রাঙ্গণ থেকে বিষ্ণুমূর্তি সরানাের মধ্যে। এছাড়াও এর দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় এক সভা কর্তৃক সেই সব শৈবদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার সিদ্ধান্তের মধ্যে, যারা মুক্তভাবে বৈষ্ণবদের সঙ্গে মেলামেশা করবে।২২ আরও দৃষ্টান্ত দেওয়া যেতে পারে। ১২৬৬ সালে কুম্ভমেলার অধিকার নিয়ে হরিদ্বারে তীব্র লড়াই হয়েছিল শৈব যােগী ও বৈষ্ণব সাধুদের মধ্যে।২৩ ১৭৬০ সালের শৈব ও বৈষ্ণবরা আরও এক ভয়ঙ্কর যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। এক বর্ণনা অনুযায়ী সেই যুদ্ধে ১৮০০০ মানুষ নিহত হন।২৪ সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের আরও এক দৃষ্টান্ত রয়েছে অযােধ্যায়। এখানে ১৭০৭ সালে তীর্থ যাত্রীদের দক্ষিণা ও উপঢৌকনের অধিকার নিয়ে শৈব সন্ন্যাসী ও বৈষ্ণব বৈরাগীদের মধ্যে প্রত্যক্ষ দাঙ্গা-হাঙ্গামা বাধে।২৫
গুজরাটের রাজা অজয়দেব সিংহাসনে বসেই জৈনদের উপর কঠোরতা শুরু করেন ও তাদের গুরুকে চরম শাস্তি দিয়ে হত্যা করা হয়। লাজপৎ রায়ের ‘ভারতের ইতিহাস’ গ্রন্থের ৮৯ পৃষ্ঠায় লেখা হয়েছে, পাণ্ডে বংশের রাজা সুন্দর হাজার হাজার জৈনকে ভয়ানক শাস্তি দেন এবং নাক, কান কেটে তাদের হত্যা করেন। তাদের অপরাধ ছিল তারা হিন্দুধর্ম গ্রহণ করতে অস্বীকার করে। স্মিথের লেখাতেও এর সমর্থন রয়েছে। এছাড়া রামায়ণে কথিত আছে, মান্ধাতা একজন জৈন-শ্রমণকে গুরুতর শাস্তি দিয়েছিলেন। বৌদ্ধদের উপরও সাম্প্রদায়িক অত্যাচার চরমে উঠেছিল।
বাংলার কর্ণসুবর্ণের রাজা নরেন্দ্র গুপ্ত তথা শশাঙ্কের (খ্রিঃ ৬১৯-৬৩২) আদেশ ছিল সেতুবন্ধ হতে হিমগিরি পর্যন্ত যত বৌদ্ধ আছে—বালক-বৃদ্ধ নির্বিশেষে তাদের হত্যা করতে হবে, যে না করবে তার মৃত্যুদণ্ডহবে। রাজা শশাঙ্ক বৌদ্ধধর্মের মূলােৎপাটনের জন্য এমন কোনও প্রচেষ্টা ছিল না যা তিনি করেননি। তিনি বুদ্ধগয়ার পবিত্র বােধিবৃক্ষ (যে বৃক্ষের তলায় বসে দিব্যজ্ঞান লাভ করেছিলেন বুদ্ধদেব) কেটে জ্বালিয়ে দেন।২৬ তিনি পাটলিপুত্রতে বুদ্ধদেবের পদচিহ্নের নিদর্শন সম্বলিত পাথর খণ্ডটি ভেঙে টুকরাে টুকরাে করে দেন। বহু বৌদ্ধভিক্ষুকদের তিনি দেশত্যাগ করতে বাধ্য করেন। অবশ্য ঐতিহাসিক নীহাররঞ্জন রায়ের মতে, শশাঙ্কের এরূপ ধ্বংস সাধনের কারণ বৌদ্ধ বিদ্বেষ নয়; প্রকৃত কারণ বৌদ্ধধর্মের অনুরাগী হর্ষবর্ধনের এই অঞ্চলে আক্রমণ। “বৌদ্ধধর্মের রাজকীয় মুখপাত্র তখন হর্ষবর্ধন, ব্রাহ্মণ্য ধর্মের শশাঙ্ক ; রাষ্ট্রক্ষেত্রে উভয়ে উভয়ের প্রতিদ্বন্দ্বী এবং উভয়েই সংগ্রামরত। এই অবস্থায় শশাঙ্কের পক্ষে গয়ার বােধিদ্রুম কাটিয়া পােড়াইয়া ফেলা, বুদ্ধ-প্রতিমাকে অন্য মন্দিরে স্থানান্তরিত করা এবং সেই স্থানে শিবমূর্তি প্রতিষ্ঠা করা, কুসীনারার এক বিহার হইতে ভিক্ষুদিগকে তাড়াইয়া দিয়া বৌদ্ধধর্মের উচ্ছেদ সাধনের চেষ্টা;পাটলিপুত্রে বুদ্ধপদাঙ্কিত একটি প্রস্তরখন্ডকে গঙ্গায় নিক্ষেপ করা প্রভৃতি কিছুই অস্বাভাবিক নয়।”২৭
তবে শশাঙ্ক যে একেবারে বৌদ্ধ বিদ্বেষী ছিলেন না তা শ্রী রায় একেবারে অস্বীকার করেননি। “য়ুয়ান-চোয়াঙ হয়তােশশাঙ্কের মৃত্যুর কিছুকাল পরেই ভারতবর্ষে আসিয়াছিলেন। তিনি কিন্তু বলিতেছেন, শশাঙ্ক ছিলেন নিদারুণ বৌদ্ধ-বিদ্বেষী এবং তিনি বৌদ্ধধর্মের উচ্ছেদসাধনেও সচেষ্ট হইয়াছিলেন। সেই উদ্দেশ্যে তিনি কী কী অপকর্ম করিয়াছিলেন, তাহার একটি নাতিবৃহৎ তালিকাও দিয়াছেন। য়ুয়ান-চোয়াঙের বিবরণের পরিণতির— অর্থাৎ দূরারােগ্য চর্মরােগে শশাঙ্কের মৃত্যুকাহিনীর—একটু ক্ষীণ প্রতিধ্বনি মঞ্জুশ্রীমূলকল্পগ্রন্থেও আছে এবং খুব আশ্চর্যের বিষয়, মধ্যযুগীয় ব্রাহ্মণ্যকুলপঞ্জীতেও আছে। বৌদ্ধবিদ্বেষী শশাঙ্কের প্রতি বৌদ্ধ লেখকদের বিরাগ স্বাভাবিক, কিন্তু বহুযুগ পরবর্তী ব্রাহ্মণ্যকুলপঞ্জীতে তাহার প্রতিধ্বনি শুনিতে পাওয়া একটু আশ্চর্য বই কি।…কিন্তু তাঁহার বিবরণ সর্বদা মিথ্যা এবং শশাঙ্কের বৌদ্ধ-বিদ্বেষ ছিল না, একথা বলিয়া শশাঙ্কের কলঙ্কমুক্তির চেষ্টাও আধুনিক ব্রাহ্মণ্য মানুষের অসার্থক প্রয়াস।”২৮ অষ্টম শতকে হিন্দুধর্মের পুনরুত্থানকালে দক্ষিণ ভারতীয় ভাষাবিদ কুমারিল ভট্টও বৌদ্ধ নির্যাতনের স্বপক্ষে রীতিমত শাস্ত্রীয় নির্দেশই জারি করেছিলেন। বৌদ্ধ মাত্রই ‘বধ্য’- এইমতের প্রচার করেছিলেন তিনি।২৯ কুমারিলের থেকে বয়সে ছােটো ও তার সমসাময়িক শংকরাচার্য (৭৮৮-৮২০) এ বিষয়ে আরও কঠিন অপসহীন ছিলেন। তিনি ভগবৎ ও পঞ্চ রাত্রিসহ অ-বৈদিক সমস্ত ধারাকে পরিষ্কারভাবে বর্জন করেছিলেন।৩০
‘শঙ্কর বিজয়’ থেকে জানা যায়, রাজা সুধা অসংখ্য জৈন ও বৌদ্ধ পণ্ডিতের মস্তক উলুখড়ে নিক্ষেপ করে ঘােটনদণ্ডে নিষ্পেষণ করে তাদের দুষ্টুমতি চূর্ণ-বিচূর্ণ করেছিলেন।
অষ্টম শতকেই গাড়ােয়ালের হিন্দুরাজা তিব্বতের রাজা লামা ইয়ােসীহােতকে বৌদ্ধধর্ম ত্যাগ করাবার চেষ্টায় তাকে যেভাবে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছিলেন, তার বর্ণনা শরৎচন্দ্র দাস প্রণীত ‘Indian Pandits in the land of snow’ নামক গ্রন্থে পাওয়া যাবে। সপ্তম শতকে কুমায়ুনে রীতিমত প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল বৌদ্ধধর্ম। অথচ শঙ্করাচার্যের আন্দোলন সেখানে একটি বৌদ্ধ মন্দিরও প্রায় অবশিষ্ট রাখেনি।৩১
মধ্যযুগের শুরুতে বিহারের বিভিন্ন ভাস্কর্য শিল্পগুলিতে বৌদ্ধ এবং ব্রাহ্মণ্য ধর্মের অনুগামীদের মধ্যে প্রকাশ্যে তীব্র সংঘর্ষ অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। এই সকল স্থাপত্যশিল্পে দেখা যায় বৌদ্ধ দেব-দেবী এমনকি দেবী অপরাজিতা শৈব দেব-দেবীদের পদতলে দলিত হচ্ছে। ধর্মতত্ত্বানুসারে বৌদ্ধদের বিরুদ্ধে শঙ্করাচার্য সূচিত ধর্মযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বিরােধটা একটা ব্যাপকতর ক্ষেত্রে প্রতিফলিত হয়েছিল। বৌদ্ধদের বিরুদ্ধে আদর্শগত প্রচারের ফলেই যে তারা ভারত থেকে মুছে গিয়েছিল—এটা ভাবা অত্যন্ত ভুল হবে। সম্ভবত তাদের ওপর চরম অত্যাচার করা হয়েছিল।৩২ এরপর তাদের কাছে দুটো পথ খােলা রইল: হয় অন্য দেশে পালিয়ে যাওয়া, অন্যথায় যে অবস্থায় তারা বাস করছে সেই দুর্বল সামাজিক অবস্থান থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করা। এটা বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য যে, পাঞ্জাব সিন্ধু এবং উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের অন্যান্য যে সকল ভূভাগ নিয়ে কাশ্মীর রাজ্য গঠিত—উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের কেবল সেইসব জায়গাগুলিতে ধর্ম হিসাবে ইসলাম পা রাখার জায়গা পেয়েছিল। অর্থাৎ ওইসব অঞ্চলে ধর্ম হিসেবে ইসলাম তার প্রতিষ্ঠার সুযােগ পেয়েছিল। একইভাবে মুসলমান জনসংখ্যার আধিক্য নালন্দা (বিহার শরীফ), ভাগলপুর (চম্পানগর) এবং বর্তমানের বাংলাদেশ (পূর্ববঙ্গ) প্রভৃতি সেই সকল অঞ্চলে দেখা যেত—সেখানে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীর সংখ্যা অধিক মাত্রায় বর্তমান ছিল। বৌদ্ধধর্ম কেন যে ভারত থেকে অন্তর্ধান করল সে বিষয়ে তাদের অন্তর্নিহিত রূপান্তর বা পরিবর্তনের দিক থেকে সঠিক ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে না, বরং বৌদ্ধদের প্রতি হিন্দু রাজশক্তি এবং তার ধর্মীয় নেতৃত্বের দৃষ্টিভঙ্গির বিরােধের সঙ্গে ব্যাপারটির অধিকতর যােগ আছে।
খ্রিঃ পুঃ ২য়-৩য় শতকে লিখিত ‘দিব্যবদান’ পুস্তক থেকে জানা যায়, পুষ্যমিত্র শুঙ্গ একজন বৌদ্ধ নির্যাতনকারী হিসেবে যথেষ্ট খ্যাতি বা কুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন। সম্রাট অশােকের নির্মিত ৮৪০০০ বৌদ্ধ স্থূপ ধ্বংস করেন তিনি। এর পরেই ভেঙে গুড়িয়ে দেওয়া হয় মগধের বৌদ্ধ কেন্দ্রসমূহ। তিনি বৌদ্ধ মঠ-মন্দির ধ্বংস করে পুড়িয়ে হত্যা করেছিলেন বহু সন্ন্যাসীকে।৩৩ আর এইভাবে তিনি শাকল অর্থাৎ আধুনিক শিয়ালকোট পর্যন্ত অভিযান করেন। অবশ্য এ বিষয়ে কিছু অতিরঞ্জন থাকতে পারে, কারণ শুঙ্গশাসনের মধ্যেও কিছু বৌদ্ধ স্থূপ নির্মিত হওয়ার প্রমাণ আছে।৩৪ এ সময়ে ভারহুতের বিখ্যাত বৌদ্ধস্তুপেরও অস্তিত্ব বিরাজমান ছিল। বুদ্ধের জন্ম স্থান কপিলাবস্তুতেই কোশলের হিন্দুরাজা বিরুধক অসংখ্য নিরীহ শান্তিপ্রিয় বৌদ্ধধর্মাবলম্বীকে হত্যা করেন। হত্যাযজ্ঞ সমাপন করে কপিলাবস্তু থেকে ৫০০ বৌদ্ধ যুবতী রমণীকে তিনি নিজ আলয়ে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। তারা দৃঢ়ভাবে এর বিরুদ্ধতা করায় কোশলরাজ নৃশংসভাবে এই ৫০০ রমণীকে হত্যা করেন। অন ইন্ডিয়ান সাংস ট্রাভেলস ইন ইন্ডিয়া: টমাস ওয়াটার্স’-এর উদ্ধৃতি দিয়ে একথা লিখেছেন বিমলানন্দ শাসমল তাঁর স্বাধীনতার ফঁাকি’ গ্রন্থে।৩৫
ময়নামতী মহাবিহার ধ্বংস হয় ব্রাহ্মণ্যবাদীদের হাতে। ভােজবর্মার বেলাবলিপি থেকে জানা যায়, পরম বিষ্ণুভক্ত জাতবর্মা সােমপুরের মহাবিহার ধ্বংস করেছিলেন।৩৬ বৌদ্ধ নিপীড়নের কিছু নমুনা প্রসঙ্গে বিখ্যাত ‘সােমপুরবিহার’-এর ধ্বংসের কথা নীহাররঞ্জন রায় এভাবে উল্লেখ করেছেন: “…ভারতীয় কোনও রাজা বা রাজবংশের পক্ষে পরধর্মবিরােধী হওয়া অস্বাভাবিক, এ যুক্তি অত্যন্ত আদর্শবাদী যুক্তি, বিজ্ঞানসম্মত যুক্তি তাে নয়ই। অন্যকাল এবং ভারতবর্ষের অন্য প্রান্তের বা দেশখন্ডের দৃষ্টান্ত আলােচনা করিয়া লাভ নাই; প্রাচীনকালের বাঙলাদেশের কথাই বলি। বঙ্গাল-দেশের সৈন্য-সামন্তরা কি সােমপুর মহাবিহারে আগুন লাগায় নাই? বর্মণ রাজবংশের জনৈক প্রধান রাজকর্মচারী ভট্ট-ভবদেব কি বৌদ্ধ পাষণ্ড বৈতালিকদের উপর জাতক্রোধ ছিলেন না? সেন-রাজ বল্লাল সেন কি ‘নাস্তিকদের (বৌদ্ধ) পদোচ্ছেদের জন্যই কলিযুগে জন্মলাভ করেন নাই?”৩৭
অন্যদিকে বিশ্ববিখ্যাত বৌদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয় নালন্দা ধ্বংসের কারণ হিসাবে বলা হয় যে, বখতিয়ার খলজি (খ্রিঃ ১২০৪-১২০৬) এই অঞ্চল দখল করার সময়ে মঠের বৌদ্ধ পণ্ডিতদের ব্রাহ্মণ বলে ভুল করে তাঁদের হত্যা করেন এবং মঠটিও ধ্বংস করেন। মুসলিম রাজশক্তিকে সাধারণের নিকটে হেয় করার সমর কৌশলের এটা অন্যতম একটা প্রয়াস মাত্র, তা ধ্বংস হয় ব্রাহ্মণ্য আক্রমণে। কিংবদন্তি ও জনশ্রুতিতেও অনেক ঐতিহাসিক সত্য লুকিয়ে থাকে। বুদ্ধগয়া নালন্দা ও রাজগীরে বিখ্যাত তীর্থস্থান অথবা ধ্বংসাবশেষের উপরে লিখিত একটি পরিচিতি পুস্তিকায় এর কিছুটা আঁচ পাওয়া যাবে। যদিও সে বর্ণনায় কিছুটা অলৌকিকত্বের তত্ত্ব ঢােকান হয়েছে। বখতিয়ার খলজির আক্রমণ তত্ত্বের সাথে কোনও ভনিতা না করে এ তত্ত্বটি পুস্তিকাটিতে সংযােজিত হয়েছে। “…শংকরাচার্যের প্রচেষ্টাতেই বৌদ্ধধর্মের প্রভাব ক্ষয় হয়ে গিয়েছিল। প্রবাদ আছে, তারা সারা ভারতে পরিভ্রমণ করে বৌদ্ধ পণ্ডিতকে তর্কযুদ্ধে পরাজিত করে ধর্মান্তরিত করেন। …একদিন ঐ মন্দিরে যখন শাস্ত্র চর্চা চলছিল তখন দুজন কোমল স্বভাব ব্রাহ্মণ সেখানে উপস্থিত হন। কয়েকটি অল্প বয়স্ক ভিক্ষু তাঁহাদের উপর পরিহাসচ্ছলে জল ছিটিয়ে দেন। এতে তাঁদের ক্রোধ বেড়ে যায়। বারাে বৎসরব্যাপী সূর্যের তপস্যা করে তাঁরা যজ্ঞাগ্নি নিয়ে নালন্দার প্রসিদ্ধ গ্রন্থাগারে এবং বৌদ্ধ বিহারগুলিতে অগ্নিসংযােগ করেন। ফলে নালন্দা অগ্নিসাৎ হয়ে যায়।”৩৮ তবে কোনও ভনিতা না করে তিব্বতীয় শাস্ত্র ‘পাগসাম-ইয়ান জাং’ ‘উগ্র হিন্দুদের হাতে নালন্দার গ্রন্থাগার পােড়ানাে হয়েছে বলে উল্লেখ করেছে।৩৯ ডি আর পাতিল অবশ্য খুব পরিষ্কার করে বলেছেন যে, ওটা ধ্বংস করেছিল শৈবরা।৪০ এই মতের মােটামুটি দীর্ঘ আলােচনা করেছেন আর এস শর্মা এবং কে এম শ্রীমালি।৪১
পতঞ্জলির মহাভাষ্য থেকে এও জানা যায় যে, মৌর্য রাজারা তাদের অর্থভাণ্ডার পূর্ণ করবার জন্য নির্মিত দেবদেবীর ধাতুমূর্তি গলিয়ে ফেলতেন। সুতরাং অর্থের যখন খুব প্রয়ােজন হত তখন শুধু মৌর্য শাসকেরা নয়, অন্যান্য শাসকেরাও দেবদেবীর এমনকি ধর্মীয় পবিত্রতা রক্ষা করত না। কোটিল্য তার অর্থশাস্ত্রে এই দুষ্কর্মমূলক কাজকে বৈধ বলে মান্যতা দিয়েছেন। ইতিহাসে অশােক, যিনি মহামতি নামে খ্যাত, যা যা করেছিলেন তার । তুলনামূলক মূল্যায়ন করলে তার মধ্যে প্রশংসার অনেক কিছু রয়েছে। কিন্তু তার নীতি ব্রাহ্মণদের আর্থিক সুযােগ-সুবিধাগুলি বিশেষভাবে সংকুচিত করেছিল।
উল্লেখ্য, দেড়শাে বছর আগেও সম্রাট অশােক (খ্রিঃ পূঃ ২৭৩-২৩২) ছিলেন পুরাণে উল্লেখিত অস্পষ্ট এক মৌর্য রাজা। ১৮৩৭ সালে জেমস প্রিন্সেপ ব্রাহ্মী হরফে লেখা একটি অনুশাসনের পাঠোদ্ধার করেন যেখানে দেবানং পিয়দসি (দেবতাদের প্রিয়) নামে একজন রাজার উল্লেখ পাওয়া যায়। পরবর্তীকালে একই ধরণের লেখ আরও আবিষ্কৃত হয়। প্রথম দিকে এই লেখগুলি অশােকের বলে চিহ্নিত হয়নি। কিন্তু ১৯১৫ সালে আরেকটি লেখ আবিষ্কৃত হল যেখানে অশােক পিয়দসির উল্লেখ রয়েছে। এই লেখ এবং শ্রীলঙ্কার ইতিবৃত্ত ‘মহাবংশ’ স্পষ্টভাবে প্রমাণ করল যে, মৌর্যরাজ অশােক এবং লেখর দেবানং পিয়দসি একই ব্যক্তি।
বৌদ্ধ কাহিনি অনুসারে অশােক তার সমস্ত প্রতিদ্বন্দ্বীদের হত্যা করে সিংহাসন অধিকার করেন এবং অত্যাচারী শাসকরূপে রাজত্ব শুরু করেন। কিন্তু অশােকের অনুশাসনে এই ধারণার সমর্থন পাওয়া যায় না। অশােকের রাজত্বকালের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা খ্রিস্টপূর্ব ২৬০ অব্দে কলিঙ্গ জয়ের পরে তার বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ। সম্রাট তার নিজের ভাষায় এই যুদ্ধের যে ভয়াবহতার বর্ণনা দিয়েছেন সম্ভবত তা অতিরঞ্জিত। বলেছেন, “দেড় লক্ষ সৈন্য বন্দি, এক লক্ষ নিহত এবং তার বহুগুণ সংখ্যক মানুষ বিনষ্ট হয়েছিল।” এক শ্রেণির পণ্ডিতের লেখা পড়ে আমাদের বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হয়, যুদ্ধের ফলে পরাজিত জনগণের অবর্ণনীয় দুঃখকষ্ট অশােককে বিচলিত করে এবং নাটকীয়ভাবে তিনি বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেন।
কিন্তু তার একটি অনুশাসন অনুসারে কলিঙ্গ জয়ের আড়াই বছর পরে তিনি বৌদ্ধধর্মের অনুরাগী সমর্থক হয়ে ওঠেন। এই ধর্মের প্রভাবে তিনি রণবিজয়ের পথ ত্যাগ করে ‘ধম্ম’ বিজয়ের (ধম্মঘােষ) পথ গ্রহণ করেন। অথচ এই অশােক বৌদ্ধধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে জনসাধারণকে (বিশেষ করে হিন্দুদের বৌদ্ধ ধর্মে ধর্মান্তরিত করার চেষ্টায় সরকারিভাবে রাষ্ট্রব্যবস্থাকে ব্যবহার করেছিলেন।৪২ অশােকের শিলালিপি দু ধরনের। এক ধরনের শিলালিপির মধ্যে লেখা আছে, ভিন্নমতাবলম্বী সন্ন্যাসী ও সন্ন্যাসিনীদের মঠ থেকে বহিষ্কার করা হবে।৪৩ অশােকের সময়ে বৌদ্ধদের সঙ্গে হিন্দুদের বিশেষ করে ব্রাহ্মণদের এই যে অসহিষ্ণুতা ঐতিহাসিকেরা যে কেনই বা এড়িয়ে গেলেন তা বােঝা মুশকিল।
কাশ্মীরে হুন শাসক শিবের উপাসক মিহিরকুল (খ্রিঃ ৫০২-৫৪২) ১৬০০টি বৌদ্ধমঠ ধ্বংস করেন এবং হাজার হাজার বৌদ্ধ সন্ন্যাসী ও তাদের গৃহস্থ অনুগামীদের হত্যা করেন।৪৪ এই বর্ণনা অবিশ্বাস্য নয়। এর প্রতিক্রিয়ায় ব্রাহ্মণ দেবতাদের নিধন হতেও দেখা যায় বৌদ্ধ দেবতাদের দ্বারা।৪৫ কাশ্মীরে বৌদ্ধদের নিগ্রহ সম্পর্কে প্রমাণ মেলে রাজা ক্ষেমগুপ্তর (খ্রিঃ ৯৫০-৫৮) আমল থেকে। তিনি বৌদ্ধ মঠ ও বিগ্রহ ধ্বংস করেছিলেন। ক্ষেমগুপ্ত শ্রীনগরে বৌদ্ধমন্দির জয়েন্দ্ৰবিহার ধ্বংস করেন এবং তার থেকে পাওয়া জিনিসপত্র দিয়ে মেগৌরীশ্বর নামে একটি মন্দির নির্মাণ করেন।৪৬ উত্তরপ্রদেশের সুলতানপুর জেলার সাতচল্লিশটি জনশূন্য দুর্গানগরী আসলে বৌদ্ধশহরের ভগ্নাবশেষ। বৌদ্ধদের বিরুদ্ধে চরম জয় পাওয়ার পর ব্রাহ্মণরা এইসব শহর জ্বালিয়ে দিয়েছিল।৪৭ উত্তর ভারতের বেশ কিছু লিপি এবং পুরাণের অনুচ্ছেদেও বৌদ্ধ নিগ্রহের প্রমাণ রয়েছে। তিব্বতীয় এক গাথা অনুযায়ী একাদশ শতকের কালচুরি রাজা কর্ণ মগধের বহু বৌদ্ধবিহার ও মন্দির ধ্বংস করেন। বৌদ্ধ বিরােধিতার এক উল্লেখযােগ্য উদাহরণ রয়েছে দক্ষিণ ভারতে। ত্রয়ােদশ শতকের আলভার (বৈষ্ণব ধর্মের) শাস্ত্রের উল্লেখ অনুযায়ী, বৈষ্ণব কবি ও সন্ত তিরুমানকাই নাগপত্তনমের স্থূপ থেকে বিরাট এক সােনার বুদ্ধমূর্তি চুরি করে সেটাকে গলিয়ে মন্দির তৈরির কাজে লাগিয়েছিলেন। এই মন্দির গড়তে তাঁকে নাকি স্বয়ং বিষ্ণু নির্দেশ দিয়েছিলেন।৪৮
কান্যকুব্জের রাজা কুমার শিলাদিত্য বৌদ্ধ ধর্মের পৃষ্ঠপােষক ছিলেন। এই অপরাধে ব্রাহ্মণরা তাকে গুপ্ত হত্যার চেষ্টা করেছিল। হিউয়েঙ সাঙ (৬২৯-৬৪৫) অযােধ্যা পরিদর্শন করে লিখেছেন, অযােধ্যায় শতাধিক বৌদ্ধমঠ ছিল এবং এই মঠগুলিতে প্রায় ৩০০০ বৌদ্ধ শ্ৰমণ ছিলেন। হিন্দু মন্দির ছিল মাত্র ১০টি। অথচ সেই অযােধ্যায় বর্তমানে বৌদ্ধমঠই নেই, আছে কেবল হিন্দু মন্দির। এই বৌদ্ধ বিহারগুলির অধিকাংশই সেদিন কারা ধ্বংস করেছিলেন? তখন তাে মুসলিম শাসকদের এদেশে আগমন ঘটেনি। আর মধ্যযুগে ওড়িশার মন্দিরগুলিকে ধ্বংস করেছিল কারা? জাজপুর, পুরী, ভূবনেশ্বর, কোনারকের মন্দিরগুলি ধ্বংস হওয়ার প্রকৃত সত্য গােপন করা হচ্ছে কেন? ওই মন্দিরগুলি ভেঙেছিলেন বিখ্যাত হিন্দু সেনাপতি কালচাঁদ রায় ভাদুড়ী, পিতা নয়নচঁাদ রায় ভাদুড়ী। উপবীতধারী বীরেন্দ্র ব্রাহ্মণ। কালাচঁাদকে কালাপাহাড় নামে অভিহিত করে তার আসল পরিচয়টিকে আড়াল করা যায় না।৪৮ক কালাচঁাদ রায় ওরফে কালাপাহাড়ের ঘটনাবহুল জীবন কাহিনিতে রয়েছে উড়িষ্যার মন্দির ধ্বংসের ইতিহাস। কুমুদকুমার ভট্টাচার্য লিখেছেন: “সুগভীর শাস্ত্রজ্ঞানের অধিকারী ও নিষ্ঠাবান বৈষ্ণব কালাচঁাদ রায় ভাদুড়ী ১৫৬৬ সালে বাংলার সুলতান সুলেমান কররানীর ফৌজদার ছিলেন। জগন্নাথ মন্দিরের পাণ্ডারা তাকে লাঞ্ছিতঅপমানিত করে বলপূর্বক মন্দির থেকে থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল, পূজার্চনার অধিকার থেকে তাকে বঞ্চিত করেছিল। তখন তিনি মন্দিরে দাঁড়িয়ে শপথ নিয়েছিলেন, দেববিগ্রহসহ সমস্ত মন্দির গুড়িয়ে দিয়ে তিনি এই লাঞ্ছনা-অবমাননার প্রতিশােধ গ্রহণ করবেন। প্রতিহিংসার আগুনে জ্বলতে-জুলতে কালাচঁাদ বাংলাদেশে ফিরে এসে স্বেচ্ছায় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন। ধর্মান্তরিত হওয়ার পরে তার নাম হয় মহম্মদ ফারমূলী। সুলতানের অনুমতি নিয়ে তিনি ওড়িষ্যার রাজা মুকুন্দদেবের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করলেন। জাজপুরের যুদ্ধে রাজা মুকুন্দদেবকে পরাজিত ও হত্যা করে তিনি শুরু করেছেন মন্দির-ধ্বংসের অভিযান।”৪৮খ
তাছাড়া ব্রাহ্মণ্যবাদের নিপীড়ন হতে আত্মরক্ষার তাগিদেই হিন্দুদের একাংশ কি দলে দলে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে বাধ্য হয়নি ? এই ব্রাহ্মণ্যবাদীরাই তাে অগণিত বৌদ্ধদের ধর্মের নামে হত্যা করেছে।৪৯ সুতরাং এই দাবি মেনে নেওয়া অসম্ভব যে, ‘আপন করে নেওয়াই হিন্দুধর্মের ‘ঝোঁক’ও ‘সহিষ্ণুতা হল হিন্দু ধর্মের অন্তর্নিহিত বৈশিষ্ট্য। তাই ইসলাম হিংসামুক্ত ভারতে হিংসা-বিদ্বেষ বয়ে এনেছিল, এটা বলা মানে পূর্বোক্ত প্রমাণগুলিকে অস্বীকার করা। ভারতে ইসলামের আবির্ভাবের পূর্ব থেকেই উগ্র ধর্মযােদ্ধা ও জঙ্গী নানা গােষ্ঠীর অস্তিত্ব বিদ্যমান ছিল এবং তারা বিরােধী গােষ্ঠীদের বিরুদ্ধে তাে বটেই, নিজেদের মধ্যেও যুদ্ধ করত। তাই ডেভিড এন লােরেনজেন যথার্থইদাবি করেছেন যে, সাধু-সন্ন্যাসীদের সামরিক ঐতিহ্য মুসলমান শাসনের সময় তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছিল।৫০
(৬)
হিন্দুরাজারা মধ্যযুগে যে সুযােগ পেলেই মসজিদ ধ্বংস করতেন, তা আজ আর অপ্রকাশিত নয়। ঔরঙ্গজেবের সময়ে (১৬৫৮-১৭০৭) রাজপুত রাজা ভীম সিংহ আমেদাবাদের বিখ্যাত মসজিদ সহ মােট ৩০০ মসজিদ ধ্বংস করেছিলেন।৫১ পরে এই ভীমসিংহ আবার মারাঠাদের বিরুদ্ধে ঔরঙ্গজেবের সেনাপতি হয়েছিলেন। চিতােরে রাণা কুম্ভের একটি শিলালেখ রয়েছে, যেখানে উৎকীর্ণ আছে যে, রাণা গুজরাটে ফিরােজ শাহের মসজিদ ভেঙেছিলেন।৫২ আজিজ আহমদের গ্রন্থ৫৩ হতে জানা যায়, মহীপাল লাহাের বিজয়কালে বহু মুসলমান হত্যা করেন ও বহু মসজিদ ভেঙে মন্দির করেন। রাণা সঙ্গের সামন্ত রায় সেনের আদেশে চান্দোরি, সারাংপুর, রণথম্ভোরে মসজিদ ভেঙে সেখানে আস্তাবল তৈরি করা হয়। ১৮ শতকে শিখ ও জাঠেরাও এ ধরনের কাজ করেছিল। যদুনাথ সরকার লিখেছেন, “বদন সিংহের নেতৃত্বে জাঠেরা আগ্রায় অভিযান চালিয়ে বাড়ি ঘর, বাগান ও মসজিদ ভেঙেছে।” ১৮০৯ সালে হিন্দুরা প্রায় ৫০টি মসজিদ ধ্বংস করে কাশীতে।৫৪ দলিল দস্তাবেজ ঘাঁটলে এরকম তথ্য হয়তাে আরও পাওয়া যাবে।।
মধ্যযুগে মসজিদের তাৎপর্য ছিল স্বাধীন হিন্দু রাষ্ট্রের রাজকীয় অনুগ্রহধন্য মন্দির থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। মুসলিম শাসকেরা ইসলামীয় উপাসনালয়ের সাথে কোনাে অচ্ছেদ্য ব্যক্তিগত বন্ধনে আবদ্ধ থাকতেন না এবং একটি বিশেষ অঞ্চলে রাজকীয় সার্বভৌমত্বের প্রতীক হিসেবেও জনমানসে তাদের আদৌ কোনাে গ্রহণযােগ্যতা ছিল না। অন্যদিকে প্রাকআধুনিক যুগে হিন্দু রাজ-মন্দির পূজিত রাষ্ট্র-দেবতা রাজা এবং রাজবংশীয়দের উপস্থিতিসহ অত্যন্ত আড়ম্বরপূর্ণ শােভাযাত্রা সহকারে রাজধানী নগরী পরিভ্রমণ করতেন। তাই রাজানুগ্রহপুষ্ট দেবালয়সমূহ শান্তি ও সমৃদ্ধির কালে যেমন রাজকীয় ছত্রচ্ছায়ায় সুরক্ষিত থাকত, যুদ্ধবিগ্রহ চলাকালীন সেগুলি প্রায়ই শত্রুসেনার আক্রমণের অন্যতম লক্ষ্যে পরিণত হত। অপরপক্ষে ইসলামীয় উপাসনাস্থলগুলি রাজনৈতিকভাবে নিষ্ক্রিয় হওয়ার কারণে (তাছাড়া মসজিদে ধনসম্পদ রাখার কোনাে সুযােগ নেই) সেগুলি অপবিত্রকরণ বা ধ্বংসসাধন পৃষ্ঠপােষক রাজবংশের ক্ষমতার অবলুপ্তির বার্তা বহন করত না। তাই ভারতবর্ষের ইতিহাসে মসজিদের রাজনৈতিক অবমাননা তুলনামূলকভাবে কম।
যাইহােক, আদিমধ্যযুগে ও মধ্যযুগের ভারত-ইতিহাসে হিন্দু রাজাদের নিজেদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব-সংঘাতের ফলে মন্দির বিনষ্ট হওয়ার বহু উদাহরণ৫৫ পাওয়া যায়—
১. পল্লব রাজবংশের রাজা প্রথম নরসিংহবর্মন (৬৩০-৬৬৮) চালুক্যদের রাষ্ট্রদেবতা মন্দিরের মূল বিগ্রহ গণেশ মূর্তি ৬৪২ সালে লুণ্ঠন করেন।
২. চালুক্য রাজা ৬৯৩ সালে উত্তর ভারতে অভিযান চালিয়ে পরাজিত রাজাদের মন্দির থেকে গঙ্গা ও যমুনার দেবীমূর্তি লুণ্ঠন করেন।
৩. অষ্টম শতকে কাশ্মীর রাজ ললিতাদিত্যের (৬৯৯-৭৩৬) রাজ্যে হানা দিয়ে পাল রাজারা কাশ্মীরে রাজাদের রাষ্ট্রদেবতা রামস্বামী নামক বিষ্ণু মূর্তিকে ভেঙে দেন।
৪. অষ্টম শতকে পাণ্ড্য রাজা শ্রীবল্লভ সিংহল আক্রমণ করে তাঁর রাজধানীতে একটি সােনার বুদ্ধমূর্তি লুণ্ঠন করে নিয়ে যান।।
৫. দশম শতকের গােড়ার দিকে প্রতিহার রাজা হেরম্বপদ কাংড়ার শাহী রাজাকে হারিয়ে সােনার বিষ্ণুমূর্তি লুণ্ঠন করেন।
৬. দশম শতকের মাঝামাঝি ওই বিষ্ণুমূর্তি আবার ছিনিয়ে নেন চান্দেলা রাজ যশােবর্মন এবং সেটাকে খাজুরাহের লক্ষ্মণ মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করেন।
৭. একাদশ শতকের প্রথম দিকে চোল রাজা প্রথম রাজেন্দ্র (১০১৪-১০৪২) বিভিন্ন রাজমন্দির থেকে বিভিন্ন দেবমূর্তি লুট করেন।
৮. একাদশ শতকের মাঝের দিকে চোল রাজ রাজাধিরাজ (১০১৮-১০৫৪) চালুক্য রাজাকে যুদ্ধে পরাজিত করে চালুক্য রাজবংশের রাষ্ট্র দেবতা দ্বারপালিকা বিগ্রহ বিধ্বস্ত ও মন্দির পুড়িয়ে দেন।
৯. ওড়িশার সূর্যবংশী গজপতি বংশের রাজা কপিলেন্দ্র ১৪৬০ সালে তামিল রাজাদের রাজত্বে যুদ্ধাভিযান চালিয়ে বহু শৈব ও বৈষব মন্দির বিধ্বস্ত করেন।
১০. বিজয়নগরের রাজা কৃষ্ণদেব রায় ১৫১৪ সালে উদয়গিরির রাজাকে যুদ্ধে হারিয়ে বালকৃষ্ণ মূর্তি তাঁর রাজধানীতে নিয়ে যান।
১১. ছয় বছর পর ওই কৃষ্ণদেব রায় গান্ধারপুর দখল করে রাজবিগ্রহ ভিট্টলকে বিজয়নগরে নিয়ে যান।
১২. দশম শতকের গােড়ার দিকে রাষ্ট্রকূট রাজা তৃতীয় ইন্দ্র তাঁর শত্রুপক্ষীয় প্রতিহার রাজার রাষ্ট্রদেবতার কলাপ্রিয় মন্দির ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়ে নিজেই বিস্তারিতভাবে তার বিবরণ লিপিবদ্ধ করে গেছেন।
‘মােট কথা রাষ্ট্রীয় আধিপত্য প্রতিষ্ঠার প্রতিযােগিতার সাধারণ স্থান হিসাবে মন্দিরগুলি নির্ধারিত হত।’৫৬ তুর্কি সুলতানদের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবার পরও হিন্দু রাজারা প্রতিপক্ষের মন্দির ধ্বংসের এই প্রথা ও পরম্পরা অব্যাহত রেখেছিল। ফলে এটা প্রমাণিত সত্য যে, পরাজিত রাজার মন্দির ভাঙা মুসলিম শাসকদের কোনাে একচেটিয়া বিশেষত্ব নয়। তাদের রাজত্বকালে হিন্দু রাজারাও একই কর্মকাণ্ডের সাক্ষর রেখে গেছেন।
আসলে রাজা এবং প্রধানদের ক্রমবর্ধমান উৎসর্গ ও দান গ্রহণের মাধ্যমে মন্দির, বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ধন-সম্পদের অকল্পনীয় ভাণ্ডারে পরিণত হয়েছিল। কেবল চোল রাজ প্রথম রাজরাজ একাই সুবিশাল তাঞ্জোর মন্দিরে ৪১,৫৫৭ কলঞ্জ (প্রায় ৪৮৪ পাউণ্ড) ওজনের স্বর্ণসামগ্রী, ১০,০০০ মণ মণিরত্ন, সম পরিমাণ সােনা ও ৫৭টি গ্রাম দান করেছিলেন। সােমনাথের মন্দির ১০,০০০ গ্রামের রাজস্ব ভােগ করত। তেমনি নালন্দা ও বলভীর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দুটির প্রত্যেকে ২০০ গ্রাম থেকে রাজস্ব পেত। এই ধরণের উদাহরণ আরও অনেক ছিল।৫৭ ফলে ধনসম্পদে পূর্ণ মন্দির ও ধর্মপ্রতিষ্ঠানগুলি ভারতীয় শাসক আর বিদেশি আক্রমণকারী উভয়কেই আকর্ষণ করেছিল। কাশ্মীরের বেশ কয়েকজন রাজা দেবতার সম্পদ কেড়ে নিয়েছিলেন। শংকরবর্মণ (৮৮৩-৯০২) ৬৪টি মন্দির লুট করেছিলেন। রাজা কলশ (১০৬৩-৮৯) সূর্যমূর্তি ধ্বংস করেন এবং বৌদ্ধ মঠ থেকে বহু মূর্তি নিয়ে চলে যান।৫৮ মন্দির লুণ্ঠনের পেছনে অবশ্যই রাজাদের লােভ কাজ করেছিল। তবে অনেক সময় যুদ্ধজয়ের স্মারকরূপেও রাজাগণ মন্দিরের সম্পদ তুলে নিয়ে যেতেন এমন দৃষ্টান্ত আমরা পাই। সঠিকভাবেই মন্তব্য করা যায় যে, তৎকালীন সময়ে লুটতরাজ বা ধ্বংস সাধন ছিল রাজকীয় কার্যকলাপেরই একটি প্রশংসনীয় দিক। আর ধনদৌলতের ভাণ্ডার রূপে মন্দির ছিল সামরিক অভিযানের সব থেকে আকর্ষণীয় লক্ষ্য।৫৯
(৭)
ইতিহাসে বার বার দেখা গিয়েছে যে, কোনাে শাসকশ্রেণি তাদের ধর্মমত যাই হােক না কেন, তাদের অধীনস্থ প্রজাকুলের ওপর যেমন, তেমনি শত্রুদের ওপর অত্যাচার ও লুণ্ঠন করা এবং লুণ্ঠিত সামগ্রী প্রধানত সেই শাসক শ্রেণির অভিজাতদের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা করে নেওয়াটা মধ্য যুগের শাসক শ্রেণির যেন একটা বিশেষ অধিকারের মধ্যে গণ্য হত। যদি কোনাে মুসলমান নেতা বা রাজন্য হিন্দু মন্দির লুণ্ঠন করতেন সে ক্ষেত্রে ঐতিহাসিকেরা সত্য ঘটনাকে চাপা দিয়ে বা তাকে উপেক্ষা করে অন্যায়কারীর পক্ষে মানুষের মনে কোনে শুভেচ্ছা জাগাতে পারেন না। ঐতিহাসিকের কর্তব্য, এই সব লুণ্ঠন বা আক্রমণের কারণগুলি যথাযথ ব্যাখ্যা সহকারে বিচার বিশ্লেষণ করা। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক মুহম্মদ হাবিব তার প্রণীত ‘সুলতান মাহমুদ অফ গজনী’ পুস্তকে গজনীর মাহমুদের লুণ্ঠনের উপর এই ধরণের বিচার-বিশ্লেষণ করেছেন। এমনকি সাধারণ যে কোনাে মানুষ দেখতে পাবেন। যে, ভারতের সকল মন্দিরই সােমনাথ বা তিরুপতি মন্দিরের মত সম্পদশালী ছিল না সত্য, কিন্তু মন্দিরগুলি বলতে গেলে মসজিদগুলির তুলনায় অনেক বেশি সম্পদশালী ছিল। একাদশ শতাব্দীর প্রারম্ভে সােমনাথ মন্দিরের অধীনে ছিল পাঁচশত দেবদাসী, তিনশত নাপিত ও বিভিন্ন ধরণের পুরােহিত। একটু আগেই বলেছি, এর দেবােত্তর সব সম্পত্তির মধ্যে দশ হাজার গ্রাম ছিল। কোনও মজিদের স্থাপত্য-কৌশলের মধ্যে সম্পদ গচ্ছিত রাখার মত কোনও সংরক্ষিত স্থানের সুযােগ নেই। এটা প্রার্থনার উদ্দেশ্যে খােলা কাঠামাে মাত্র। অন্যদিকে এই ধরণের মন্দিরে গচ্ছিত সম্পদ আহরণের উদ্দেশ্যে কিছু হিন্দু শাসক মূল্যবান ধাতুতে নির্মিত দেবদেবীর মূর্তি ধ্বংস করে নিজের কোষাগার পূর্ণ করতেন। এই সমস্ত বিবরণ থেকে এটা সুস্পষ্ট যে, তুর্কি মুসলমান শাসকদের ভারতে আসার আগে থেকেই হিন্দু মন্দিরগুলি হিন্দুরাজাদের রাজনৈতিক প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার কেন্দ্রস্থল হয়ে দাঁড়িয়েছিল, যার ফলে অগণিত দেবমূর্তি ও মন্দির ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল। তাই যারা ভাবেন, তুর্কি আক্রমণকারীরা ভারতে তাদের রাজ্য বিস্তারের জন্য প্রথম মন্দির ধ্বংস প্রথা চালু করেন, তাদের ভাবনা মােটেই ইতিহাসসম্মত নয়। কিন্তু তা হলেও মুসলিম রাজা-বাদশাহদের অপরাধ লঘু হয় না, একই কাজ হিন্দু রাজারাও করেছেন এই অজুহাতে। তবে এটা প্রমাণিত যে, ধর্ম নির্বিশেষে সেকালের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ছিল এরকমই।
সুলতানি শাসনকালে লিপিবদ্ধ না হওয়ায় মন্দির কলুষিত ও ধ্বংসের ঘটনার প্রকৃত সংখ্যা জানা যায় না। তবে বিখ্যাত ঐতিহাসিক অধ্যাপক রিচার্ড এম ইটনের লেখায় জানা গেছে, পাঁচ শতাব্দীর বেশি সময়ে (১১৯২-১৭২৯) আশিটি মন্দির মুসলিম সুলতানদের দ্বারা কলঙ্কিত বা বিধ্বস্ত হওয়ার প্রামাণ্য ঐতিহাসিক বিবরণী পাওয়া যায়।৬০ অথচ মুসলমান বাদশাহদের দ্বারা হাজার হাজার মন্দির ধ্বংসের কথা বলা হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে উগ্র জাতীয়তাবাদীরা সীতরাম গােয়েলের তথ্যকে তাদের যুক্তি হিসেবে তুলে ধরে থাকেন।৬১ গােয়েলের এই তথ্য প্রধানত ইলিয়ট ও ডওসন থেকে সংগৃহীত, যে গ্রন্থটির অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল মুসলিম শাসকদের বর্বরতার কথা তুলে ধরে ভারতীয়দেরকে ব্রিটিশ রাজত্বের সুফল সম্পর্কে সচেতন করা। যাইহােক, অধ্যাপক ইটনের তালিকায় দিল্লির তুর্ক-আফগান শাসকদের রাজ্য বিস্তারের ২০০ বছরের (১১৯২-১৩৯৪) ইতিহাসে মন্দির ধ্বংস করার ২৪টি ঘটনার বিবরণ উল্লিখিত রয়েছে যা শুরু হয়েছিল ১১৯৩ সালে মহম্মদ ঘােরি (১১৭৫-১১৯২) কতৃক আজমীরে পরাজিত রাজপুত রাজার রাজকীয় মন্দির লুণ্ঠনের মাধ্যমে। পরবর্তী ২০০ বছরের পরিধিতে (১৩৯৪-১৬০০) অধ্যাপক রিচার্ড এম ইটন শত্রু রাজাদের মন্দির ধ্বংসের ঘটনার ইতিহাস তন্ন তন্ন করে অনুসন্ধান চালিয়ে ৩১টি মন্দির বিধ্বস্ত করার তালিকা প্রস্তুত করেছেন।
দিল্লির সুলতানরা হিন্দু রাজাদের সঙ্গে যুদ্ধ করে রাজ্য বিস্তার করেছিলেন বলেই মধ্যযুগে ভারতীয় প্রথা বা ঐতিহ্য অনুযায়ী তারা বিভিন্ন মন্দির ধ্বংস করেছিলেন। কিন্তু মুঘল সাম্রাজ্য বিস্তার বা প্রতিষ্ঠার সময় মুঘল সম্রাট বাবর (১৫২৬-১৫৩০), হুমায়ুন (১৫৩০-৪০ ও ১৫৪৫-৫৬), আকবর (১৫৫৬-১৬০৫) মূলত আফগান সুলতানদের পরাজিত করে গদিয়ান হয়েছিলেন বলেই এই তিন মুঘল সম্রাট হিন্দু মন্দিরের ধ্বংস ঘটাননি—এটাই প্রামাণ্য ইতিহাস। বাবরের নির্দেশে বাবরি মসজিদ গড়ার (অযােধ্যার প্রাচীন রামমন্দির ধ্বংস করে) কাহিনি ভিত্তিহীন। বিভেদকামী ইংরেজ শক্তি বাবরি মসজিদ নিয়ে মনগড়া ইতিহাস লিখেছেন। ফৈজাবাদের কমিশনার ও সেটেলমেন্ট অফিসার পি. কার্নেগি তহশিলের ইতিহাস (?) লিখতে গিয়ে কোনও প্রমাণ ব্যতিরেকে বলেছেন, “অযােধ্যা যেহেতু রামের জন্মস্থান, তাই সেখানে নিশ্চয় একটি চমৎকার মন্দির থেকে থাকবে এবং মনে হয়, বাবরের নির্দেশেই ঐ মন্দির ধ্বংস করা হয়। এভাবেই ইংরেজরা একটি পৌরাণিক চরিত্রকে মানব-চরিত্র রূপে খাড়া করে তার জন্মস্থান নির্দিষ্ট করেছেন এবং সরকারি গেজেটিয়ারে এই অনৈতিহাসিক মন্তব্য লিপিবদ্ধ হওয়ায় পরবর্তীকালে এই গেজেটিয়ারকে প্রামাণ্য নথি হিসেবে গ্রহণ করা হতে থাকে। অনুরূপভাবে বারবাকি জেলার ‘গেজেটিয়ার’-এ হ্যামিলটন লিখেছেন, “হিন্দুদের রক্ত দিয়ে চুন-সুরকির মশলা মেখে মসজিদের ভিত্তি নির্মাণের জন্যে জালাল শাহ লাখৌরী ইট সরবরাহ করেছিল।” ১৫২৮ খ্রিষ্টাব্দে নির্মিত বাবরি মসজিদের ভিত্তি হিন্দুদের রক্ত দিয়ে চুন-সুরকির মশলা মেখে’ তৈরি করা হয়েছিল—এই ভয়ঙ্কর তথ্য হ্যামিলটন কোথা থেকে পেয়েছিলেন? কোনও ঐতিহাসিক এই তথ্য (?) না জানলেও ইংরেজ-আমলারা হিন্দুমুসলমানের মধ্যে বিভেদ বজায় রাখার শয়তানী মতলব নিয়ে এই ভয়াবহ গল্পকথা শুনিয়েছেন। আজ পর্যন্ত প্রামাণ্য ঐতিহাসিক গবেষণায় কোথাও পাওয়া যায় না যে, বাবর কোনও মন্দির ধ্বংস করে সেখানে মসজিদ তৈরি করেছিলেন। দুই ব্রিটিশ ঐতিহাসিক উইলিয়াম রাসব্রুক ও স্ট্যানলি লেনপুল বাবরের যে দুটি প্রামাণ্য জীবনী রচনা করেছেন, তাতে বাবর কর্তৃক মন্দির ভেঙে মসজিদ গড়ার কোনও বর্ণনা নেই।
আকবর পরবর্তীকালে মুঘল বাদশাহরা পূর্বতন সুলতানি সাম্রাজ্যের বাইরে গিয়ে সাম্রাজ্য বিস্তার করতে গেলে হিন্দু রাজাদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন। তার ফলে মন্দির ধ্বংসের ঘটনা আবার ঘটতে থাকে। এইভাবে মুঘল সাম্রাজ্যের সম্প্রসারণকালে ও আঠারাে শতকের সঙ্কটের সময়ে ১৬০০ থেকে ১৭২৯ সাল পর্যন্ত মুঘলদের বিনষ্ট করা ২৫টি মন্দির গবেষক ইটনের মন্দির ধ্বংসের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। তিনি অসংখ্য শিলালিপি, ঘটনাপঞ্জি ও বিদেশি পর্যটকদের বিবরণী ইত্যাদি তন্ন তন্ন করে ঘেঁটে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, সেইসব মন্দিরই ধ্বংস বা কলুষিত করা হয়েছে যেগুলির রাজনৈতিক সংযােগ ছিল অর্থাৎ যেগুলি কোনাে শত্রু বা বিদ্রোহী রাজার পৃষ্ঠপােষণাপ্রাপ্ত।
(৮)
তুর্ক-আফগান সুলতানরা ও পরবর্তীকালে বাদশাহরা ভারতীয় রাষ্ট্র দৃঢ় ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠা করার পর মন্দির ধ্বংস নয়, বাস্তবত হিন্দুমন্দির রক্ষণাবেক্ষণ ও নির্মাণের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। গজনীর মাহমুদকে হিন্দু মন্দির লুণ্ঠনকারী হিসেবে চিত্রিত করা হলেও, পারস্যের নবজাগরণের অন্যতম প্রতিনিধির মযার্দাতেই তিনি পন্ডিতদের বসবাসের জন্য এক আবাসকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। হিন্দুদের উপর ইসলাম চাপিয়ে দেবার জন্য উলেমাদের পরামর্শ ইলতুৎমিস গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছিলেন। শেরশাহ (১৫৪০-৪৫) পর্যন্ত ওই অভিমত বলবৎ ছিল। ফিরােজ শাহ তুঘলক (১৩৫১-৮৮) মুসলিম কট্টরবাদীদের হাত থেকে এক হিন্দু ফার্সিনবিশের জীবন রক্ষা করেছিলেন। ফিরােজ শাহ তুঘলক ও সিকন্দার লােদির সময়ে বহু সংস্কৃত কাব্যের ফারসি অনুবাদ করানাে হয়।
অ-মুসলমানদের নিয়মমাফিক পুজো করার স্বাধীনতা ছিল এবং তাদের মন্দিরগুলিও পুরানাে পবিত্রতা ধরে রেখেছিল। বেরিলি ও মথুরার যাতায়াতের পথে প্রত্নতত্ত্ববিভাগের প্রধান ক্যানিংহাম কমপক্ষে ১০০০ খ্রিস্টাব্দের একটি পুরাতন মন্দির দেখেছিলেন এবং এই মন্দিরের চত্বরে তীর্থযাত্রীদের খােদাই করা বহু লিপি তার দৃষ্টিগােচর হয়। ১২৪৬-১২৯০ সালের মধ্যে এইসব লিপির অন্তত ১৫টিতে তীর্থযাত্রীদের কথা উল্লিখিত হয়েছে।৬২ নতুন মন্দির নির্মাণেও স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছিল। দিল্লির পুরনাে কিল্লায় প্রাপ্ত এবং পারসিক ও সংস্কৃতে লেখা একটি শিলালিপির-ভগ্নাংশ নির্মিত মন্দিরের ভরণপােষণের জন্য বার বিঘা জমি দেবার কথা নথিভুক্ত করেছে। মন্দিরটি শ্রীকৃষ্ণকে উৎসর্গ করা হয়েছিল।৬৩ ধর্মীয় সঙ্কীর্ণ নীতির পরিপােষণ সত্ত্বেও হিন্দু প্রজার স্বার্থে ফিরােজ তুঘলকও যে দিল্লির সন্নিকটবর্তী অঞ্চলে কয়েকটি নতুন মন্দির নির্মাণ করেছিলেন, সে-তথ্যও আজ ঐতিহাসিক তথ্য হিসাবে স্বীকৃত। যেমন ললিতপুরে ১৩৫৮এ একটি মন্দির নির্মিত হয়েছিল।৬৪ আরও স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় তার সময়ে, যেখানে দিল্লিতে তাঁর পূর্বসূরিদের সময়ে তৈরি নতুন মন্দিরগুলির কথা বলা হয়েছে: “হিন্দুরা ও মূর্তি পূজাকারীরা…নতুন মন্দিরগুলি শহরে ও চার পাশে তৈরি করেছে।…মালিয়া গ্রামে একটি পুষ্করিণী আছে যেখানে ওরা মূর্তি পূজার মন্দির তৈরি করেছে এবং বিশেষ কয়েকটি দিনে হিন্দুরা ওখানে ঘােড়ায় চড়ে অস্ত্র নিয়ে যেতে অভ্যস্ত…ওরা হাজারে হাজারে সমবেত হয় এবং মূর্তিপূজা করে।”৬৫ ফিরােজ তুঘলক স্বীকার করেছেন যে, ওই ধরনের মূর্তির আবাস মালিহপুর এবং কোহনা গ্রামে তৈরি করা হয়েছে ও পূজা নিয়মিত করা হচ্ছে। এখানে জৈনদের তিনটি মূর্তিও পাওয়া গিয়েছে। যাদের প্রতিষ্ঠা তারিখ দেওয়া হয়েছে বিক্রম সংবৎ ১৩২৫/১২৭৮ সাল।৬৬ ফিরােজ খলজির সময়ে এমনকি রাজধানীতেও হিন্দুরা ধর্মীয় স্বাধীনতা ভােগ করত: “প্রতিদিন হিন্দুরা… আমার প্রাসাদের নীচ দিয়ে যায় শঙ্খ-ঘণ্টা বাজিয়ে যমুনার পাড়ে মূর্তিপূজা করার জন্য।…আমার নাম যখন খুৎবাতে পড়া হচ্ছে ইসলামের রক্ষক বলে, আল্লাহ ও তাঁর নবীর এই শত্রুরা আমার চোখের সামনে গৌরবের সঙ্গে তাদের ধনদৌলত প্রদর্শন করছে এবং আমার রাজধানীর মুসলিমদের মধ্যে সাড়ম্বরে বাস করছে। তারা ঢােলক ও অন্যান্য বাদ্যযন্ত্র বাজায় এবং তাদের হিন্দু আচার চালিয়ে যায়।”৬৭ ফিরােজ তুঘলকের রাজত্বকালে ১৩৫২ খ্রীষ্টাব্দে গয়াতে সূর্যমন্দির নির্মিত হয়৬৮ এবং মন্দিরের গায়ে সংস্কৃত লিপিতে সুলতানের নাম দুবার খােদিত হয়। একই মনােভাব হিন্দু শাসকরাও ব্যক্ত করেন। ১২৪৬ খ্রীষ্টাব্দে গুজরাটের ভেরাওয়াল নামক স্থানে চালুক্য রাজা অর্জুনদেবের পৃষ্ঠপােষকতায় নুরুদ্দীন ফিরােজ একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। আরও অনেক পরে রাণা কুম্ভ (১৪৩৩-৬৪) যে বিজয় স্তম্ভ নির্মাণ করেন তার গায়ের স্তম্ভে চমৎকার আরবি অক্ষরে ‘আল্লাহ’ নয়বার তিনতলায় ও আটবার আটতলায় খােদিত করেন। এইসব তথ্য থেকে বােঝা যায় মধ্যযুগের ভারতে হিন্দু-মুসলিম একসঙ্গে চলার পথটি কিভাবে তৈরি হয়।৬৯
পঞ্চদশ শতকে কাশ্মীরের শাসক জয়নুল আবেদিন হিন্দুদের মন্দির নির্মাণ করেন, হিন্দু উৎসবে যােগদান করেন ও গাে-হত্যার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন।৭০ সুলতানশাহীকালে হিন্দুদের বসন্ত, হােলি ও দীপাবলি উৎসবে মুসলিম রাজন্যরা যােগ দিতেন। একটি সংস্কৃত শিলালিপিতে দেখা যায়, মহম্মদ বিন তুঘলক (১৩২৫৫১) ১৩২৬ সালে বিদার জেলার মঙ্গলার্থে একটি বিখ্যাত শিবমন্দির সংস্কারের জন্য রাজকোষ থেকে প্রচুর অর্থ মঞ্জুর করে এক পদস্থ মুসলিম কর্মচারীকে দায়িত্ব প্রদান করেছিলেন। ইবন বতুতার বিবরণে৭১ পাওয়া যায় হিন্দু রাজা সুলতানকে জিজিয়া দান করলেই যে কোনও স্থানে স্বাধীনভাবে মন্দির নির্মাণ করতে পারতেন। মধ্যপ্রদেশের বাতিহাগড়ে (দামােহ জেলা) পাওয়া ১৩২৮ সালের একটি লিপি থেকে জানা যায়, মহম্মদ বিন তুঘলক একটি গাে-মঠ নির্মাণ করেছিলেন।৭২ লিপিটির বক্তব্য অনুযায়ী নির্মাণ কার্য শেষ করেছিলেন খাজা জালালউদ্দিন, যিনি তাঁর কর্মচারী ধানৌকে প্রতিষ্ঠানটির একজন প্রশাসকরূপে নিয়ােগ করেন।৭৩ সমসাময়িক একটি জৈন রচনা অনুযায়ী, তিনি শত্ৰুঞ্জয় মন্দির পরিদর্শন করে জৈন সংঘের একজন নেতার উপযােগী আরাধনামূলক কাজ করেন।৭৪ তিনি যখন দুর্ভিক্ষের সময়ে দিল্লি থেকে রাজধানী স্থানান্তরিত করে নতুন জায়গায় নিয়ে যান, তখন সেখানকার নামকরণ করেন সংস্কৃত ভাষায় ‘স্বর্গ-দুয়ারি’। তিনি ‘হােলি’ খেলতেন এবং যােগীদের সঙ্গে আলােচনায় বসতেন।৭৫ ১৩২৫-এ একটি ফরমানে মহম্মদ বিন তুঘলক সমস্ত আধিকারিকদেরকে জৈন পুরােহিতদের রক্ষা করার নির্দেশ দিচ্ছেন। তিনি জৈনদের জন্য উৎকণ্ঠা ব্যক্ত করতেন, তিনি দুজন জৈন নেতার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেন।৭৬ রাজকোষের আর্থিক সমৃদ্ধির জন্য কাশ্মীরের হিন্দু ও বৌদ্ধ মন্দিরগুলির দেবদেবীর সােনা-রুপার নির্মিত মূর্তিগুলি গলিয়ে ফেলার পরামর্শ (এই পরামর্শ দিয়েছিলেন সুলতানের ব্রাহ্মণ মন্ত্রী) দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখান করে কাশ্মীরের সুলতান শিহাব-অলদিন (১৩৫৫-১৩৭৩)। মন্দিরগুলি উপযুক্তভাবে সুরক্ষিত করার নির্দেশনামাও জারি করেছিলেন তিনি। মুলতানে প্রসিদ্ধ আদিত্য মন্দির ধ্বংস হলে ‘কারামিতা’ বংশীয় মুসলমান শাসকরা তা পুননির্মাণ করেন।৭৭ অথচ মুলতান তখন ‘কুব্বাতুল ইসলাম’ অর্থাৎ ‘ডােম অফ ইসলাম’ নামে অভিহিত ছিল, মুলতানে মুসলমানেরাই ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ।
অনেকক্ষেত্রে সুলতানরা নিজেদের শক্তির দম্ভ ও পরাজিত শত্রুর রাজ্য জয় করার পর স্বীয় প্রতাপ দেখানাের জন্য মন্দির এমনকী মসজিদও ধ্বংস করেছেন। ঐতিহাসিক রমিলা থাপার সিকন্দর লােদী (১৪৮৯-১৫১৭) কর্তৃক জৌনপুর জয়ের পর মসজিদ ভঙ্গের ঘটনা উল্লেখ করে মন্তব্য করেছেন যে, “সিকন্দর লােদি জৌনপুরের সুলতানের মসজিদ ভেঙে দিয়ে নিজের শক্তির পরিচয় দিয়েছিলেন।”৭৮ আধুনিককালে ডেভিড ম্যাকাচিন তাঁর গবেষণায়৭৯ প্রমাণ করেছেন যে, সুলতানি আমলে মন্দির নির্মাণ বন্ধ হয়নি এবং এইসব মন্দির কালক্রমে যতই জীর্ণ হােক তাদের দেউলে পূজিত মূর্তি এখনও দেখা যায়। বিষ্ণুপুরের মল্লরাজারা এই কাজে অগ্রণী ছিলেন এবং মালভূম জেলার পশ্চিমাংশে জৈনরাও এ বিষয়ে ত্রয়ােদশ শতকে তৎপর ছিলেন। ম্যাকচিনের এই সচিত্র গবেষণাপত্রে সুলতানি যুগের ও পরবর্তীকালের যেসব মন্দিরের উল্লেখ আছে তার থেকে প্রমাণিত হয়েছে যে, কালের গ্রাসে বহু মন্দির ধ্বংস হয়েছে কিন্তু জরাজীর্ণ হলেও সুলতানি যুগে হিন্দু মন্দির বহুক্ষেত্রেই অক্ষত অবস্থায় তাদের অস্তিত্ব বজায় রেখেছিল।
(৯)
অথচ আধুনিক ঐতিহাসিক শ্রীরাম শর্মা তাঁর ‘দ্য রিলিজিয়াস পলিসি অফ দ্য মুঘল এম্পাররস’ গ্রন্থে দিল্লির সম্রাটদের উপরােক্ত সহিষ্ণুতার চিত্র আলােচনা না করেই, একের পর এক অসহিষ্ণুতার দৃষ্টান্ত একত্রিত করে তুলে ধরেছেন। গ্রন্থটির প্রথম অধ্যায়ই সম্ভবত দুর্বলতম অংশ, যেখানে দিল্লির সুলতানি আমল সম্পর্কে আলােচনা আছে। প্রথম পৃষ্ঠাতেই বলা হয়েছে, হিন্দু ও মুসলিম প্রজার মধ্যে বিভেদের ভিত্তিতে ভারতে সুলতানি সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছিল। বহু কথিত বিবৃতিটির পুনরুক্তি করে এই গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে যে, “আলাউদ্দিন খলজি হিন্দুদের দামী পােশাক পরা, ঘােড়ায় চড়া এবং গাড়ি বা পাল্কিতে ভ্রমণের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন।”৮০ কিন্তু বারণির বিবরণী খুঁটিয়ে বিশ্লেষণ করে মােরল্যাণ্ড তার গ্রন্থে৮১ দেখিয়েছেন, ওই নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছিল কেবলমাত্র গ্রামের মােড়লদের ওপর, সব হিন্দুর ওপর নয়। অথচ এরকম একটা ভুল তথ্য ভারতের জনমানসের একটা বিরাট অংশকে দীর্ঘদিন ধরে ভাবাচ্ছে। সুলতানি রাষ্ট্রে হিন্দুরা যে ধর্মীয় স্বাধীনতা ভােগ করত, তা বারণির বিবরণেও সমর্থন পাওয়া যায়। বারণি বলেছেন, রাজধানীতে এবং প্রাদেশিক কেন্দ্রসমূহে প্রকাশ্যে মূর্তিপূজা প্রচলিত ছিল। জালালউদ্দিন বলেন, “হিন্দুরা যমুনা নদীতে দেবদেবীর মূর্তি বিসর্জন দেবার জন্য রাজপ্রাসাদের নীচ দিয়ে শােভাযাত্রা করে, বাদ্য-সহকারে গান গাইতে গাইতে ও নাচতে নাচতে যায়, আর আমি অসহায়।” এই প্রশস্ত সহনশীল নীতি পালিত হয়েছিল সুলতানি যুগে।
আর মুঘল সম্রাটরা রাজত্বের শুরু থেকেই তাদের সাম্রাজ্যের মধ্যে অবস্থিত হিন্দু মন্দিরকে রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি হিসেবে গণ্য করতেন যার সুরক্ষা ও রক্ষণাবেক্ষণ রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব। তারা এমনকি মন্দিরের পুরােহিতের ভরণপােষণ ও নতুন মন্দির প্রতিষ্ঠায় পৃষ্ঠপােষকতাও করেছেন। তাদের প্রতিষ্ঠিত গােবিন্দ দাস মন্দির তার উজ্জ্বল উদাহরণ। পরবর্তীকালে জাহাঙ্গীর (১৬০৫-১৬২৭), শাহজাহান (১৬২৭-৫৮) ও ঔরঙ্গজেবের শাসনকালে পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের ও রথযাত্রা উৎসবের দেখাশােনার কাজে বিশেষভাবে নিযুক্ত থাকতেন মুঘল সম্রাটের প্রতিনিধি হিসেবে ওড়িশার মনসবদার। পুরীর মন্দিরের পুরােহিতরা মুঘল শাসকদের পুরীর মন্দির ও জগন্নাথদেবের মূর্তির রক্ষক হিসেবে গণ্য করতেন। অথচ জাহাঙ্গীর নাকি তার পিতার ধর্মীয় নীতি থেকে বিচ্যুত হয়েছিলেন বলে। শ্ৰীশর্মা অভিযােগ করেছেন। বাস্তবে যতটা বিচ্যুত হয়েছিলেন বলে মনে হয় শর্মা তার থেকে বেশি বিচ্যুতির ইঙ্গিত করেছেন।৮২ বিস্ময়করভাবে তিনি এমন বহু প্রসঙ্গের উল্লেখ করেছেন, যেগুলি ভুল। যেমন ‘তুজুক-ই-জাহাঙ্গীরী’ (ফারসি রচনা) থেকে ধর্মান্তর, সন্ন্যাসীদের সঙ্গে মেলামেশার জন্য দুই মুসলিমের শাস্তি এবং কল্যাণ কর্তৃক দু’জন মুসলিম হত্যা ইত্যাদি সবগুলির ক্ষেত্রে পৃষ্ঠা সংখ্যা ভুল দেওয়া হয়েছে।৮৩ তবে এর চেয়েও গুরুতর, কয়েকটি জায়গায় জাহাঙ্গীরের উক্তি ভুল পরিবেশিত হয়েছে। জাহাঙ্গীর কখনােই কাংড়া বিজয় উপলক্ষে উৎসব উদ্যাপন করতে হিন্দু মন্দির অপবিত্র করেননি, কাজেই তা নিয়ে তার গর্বকরার প্রশ্নই ওঠে না।৮৪ জাহাঙ্গীরের কাংড়া অভিযানের উল্লেখ আছে ‘তুজুক-ই-জাহাঙ্গীরী’-এর ৩৪০-৩৪২ পৃষ্ঠায় (৩৪৬-৪৯ পৃষ্ঠাতে নয়) এবং সেখানে ঐরকম কিছু পাওয়া যায়নি। কাজেই দেখা যাচ্ছে, পাঠ্যপুস্তক রচয়িতাদের খুবই প্রিয় এই ঘটনাটির (শর্মার কাছে এ জন্য তারা ঋণী) কোনাে ভিত্তিই নেই। একইভাবে আর এক জায়গায় বলা হয়েছে: “যখন তিনি (জাহাঙ্গীর)—৮ম বর্ষে আজমীর যান, তখন বরাহ অবতারের মন্দিরটি ধ্বংস করা হয় এবং মূর্তিগুলি ভেঙে ফেলা হয়।”৮৫ এবং এ তথ্যের সূত্র হিসেবে ‘তুজুক-ই-জাহাঙ্গীরী’, পৃ.১২৫ (সংশােধিত, পৃ. ১২৪) দেওয়া হয়েছে, এটি বিভ্রান্তিকর। ‘তুজুক-ই-জাহাঙ্গীরী’ অনুসারে, জাহাঙ্গীর ওই মন্দির পরিদর্শনে গিয়েছিলেন তারই এক মুখ্য রাজপুত আমির যিনি মন্দিরটি বানিয়েছিলেন, তাকে সঙ্গে নিয়ে এবং সেখানে বিষ্ণুর বরাহমূর্তিটি দৃষ্টিকটু লাগায় সেটি মন্দির থেকে বার করে দেন। মন্দির ধ্বংসের আদেশ তিনি কখনােই দেননি। গুজরাট থেকে জৈনদের বহিষ্কার সম্পর্কে জাহাঙ্গীরের আদেশটিও শ্রীশৰ্মা অতিরঞ্জিত করেছেন, এবং এই প্রসঙ্গে বেণীপ্রসাদের মতের বিরােধিতা করেও ভুল করেছেন। শুধু যে ইউরােপীয় পর্যটকদের বিবরণী থেকেই গুজরাটে জৈন সম্প্রদায়ের নিরবিচ্ছিন্ন বসবাসের কথা জানা যায় তাই নয়, জাহাঙ্গীর যে জৈন মন্দির ও ধার্মিকদের পৃষ্ঠপােষকতা করতেন তার উল্লেখ আমরা তার আমলের রচনাদিতেও পাই।৮৬
আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য হল, কালীঘাটের কালীমন্দিরের জন্য সম্রাট জাহাঙ্গীর জমি দান করেছিলেন। ১৬০৬ সালে সেনাপতি মানসিংহের অনুরােধ জাহাঙ্গীর কলকাতার সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের সদস্য কামদেব গঙ্গোপাধ্যায়কে ৫৯৫ বিঘা ৯ কাঠা ৩ ছটাক জমি দান করেন। কামদেবের বংশধর লক্ষ্মীকান্ত দিল্লির বাদশার কাছ থেকে এই জমির সনদ পান। সেই জমিতেই আজকের এই মন্দির প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। মন্দিরের কাজ শুরু করেছিলেন। সন্তোষ রায়চৌধুরী, শেষ করেন তাঁর পুত্র রামদুলাল। বড়িশার সাবর্ণ রায়চৌধুরীর পরিবারে হাতে সম্রাট জাহাঙ্গীরের জমিদানের সনদ আজও রয়েছে।৮৭
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী ঐতিহাসিকরা ও তাদের দেশীয় অনুগামীরা ঔরঙ্গজেবকে হিন্দু বিদ্বেষী হিসেবে চিহ্নিত করলেও আধুনিক গবেষণায় জানা যায় যে, তিনিও পূর্ববর্তী মুঘল বাদশাহদের মতই হিন্দু মন্দিরগুলির সুরক্ষা ও দেখাশােনার দায়িত্ব অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেছেন। পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের উদাহরণ তাে পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে। গৌতম ভদ্রের গ্রন্থ থেকে জানা যায়, ঔরঙ্গজেব জৈন ও শৈব সম্প্রদায়ের জন্যও বহু নিষ্কর জমি দান করেছিলেন। বিহার থেকে পাওয়া অনেক সনদের সাক্ষ্য থেকে হিন্দু মন্দিরের জন্য তাঁর নিষ্কর জমি দানের কথাও জানা যায়।৮৮ বিখ্যাত বেনারস ফরমানে তিনি হিন্দু ও ব্রাহ্মণদের ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার সুনিশ্চিত করেন।৮৯ তাঁর সময়ে মুঘল রাজদরবারে হিন্দু সভাসদদের ‘রাম রাম’ বলে অন্যান্যদের এমনকি সম্রাটকে সম্বােধন করার ব্যবস্থাও বহাল ছিল। তিনি সারা দেশ থেকে হিন্দু পন্ডিতদের সমবেত করে মনুসংহিতা, অর্থশাস্ত্র ও অন্যান্য হিন্দুশাস্ত্রের ভিত্তিতে নিপীড়নমূলক ব্যবস্থাগুলির অপসারণ করে হিন্দুদের জন্য ধমীয় সামাজিক নিয়ম চালু করার উদ্যোগ নেন। আজকের ‘হিন্দুকোড’ বিল-এর অগ্রগণ্য ‘জাওয়াবিৎ-ই-আলমগিরী’ ঔরঙ্গজেবের আমলেই সূত্রবদ্ধ করা হয়।
সমসাময়িক ঐতিহাসিক ভীম সেন ও ঈশ্বরদাসের লেখা থেকে জানা যায়, ঔরঙ্গজেব তাঁর রাজত্বের প্রথম ২২বছর কোনও ধর্মীয় নীতি গ্রহণ করেননি। সনামী বিদ্রোহীদের সঙ্গে রাজপুতদের যােগসাজস ঔরঙ্গজেবকে বিক্ষুব্ধ করে তােলে। তারা মুঘল সার্বভৌম শক্তিকে চ্যালেঞ্জ করে। তার উপর শিবাজীর উত্থান ঔরঙ্গজেবকে আক্রমণাত্মক করে তােলে। তাছাড়া গুজরাটে হিন্দুরা মসজিদ নির্মাণে বাধা দেওয়ার ফলে পরিস্থিতি বদলে যায়। এই পরিস্থিতিতে সহজেই বলা যায়, ঔরঙ্গজেবের মন্দির ধ্বংসের আদেশ ছিল সম্পূর্ণ রাজনৈতিক কারণে। অতি সম্প্রতি বি এন পাণ্ডে তাঁর গবেষণামূলক রচনা ইসলাম অ্যান্ড ইন্ডিয়ান কালচার’ গ্রন্থে বহু তথ্য দিয়ে দেখিয়েছেন যে, ঔরঙ্গজেব মােটেই হিন্দুবিদ্বেষী ছিলেন না। অপ্রিয় কাজ তিনি করতে বাধ্য হয়েছেন আইনশৃঙ্খলাগত কারণে, কারও প্রতি বিদ্বেষবশত নয়। প্রকৃতপক্ষে সার্বভৌম শক্তিকে চ্যালেঞ্জ করলে, ঔরঙ্গজেব কেন, কোনও কালেই কোনও শক্তিই মন্দির বা মসজিদ ধ্বংস করতে কুণ্ঠিত হয় না।
তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, মধ্যযুগের মুসলিম শাসকরা কখনও হিন্দু বিদ্বেষ থেকে বা। হিন্দুধর্মকে আঘাত করার জন্য হিন্দু মন্দিরের বিনষ্ট ঘটাননি। মন্দির ধ্বংসের প্রধানতম কারণ অর্থনৈতিক—মণি-মুক্তা সংগ্রহ এবং ধনদৌলত লুঠ, আর অন্যতম বড় কারণ। রাজনৈতিক প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা। তাছাড়া পরাজিত হিন্দু রাজার শাসনের বৈধতা নষ্ট করতে এবং রাষ্ট্র বিরােধী ষড়যন্ত্রের আখড়া হিসেবে মুসলিম শাসকরা ভারতে সাম্রাজ্য বিস্তারের সময় মন্দির কলুষিত বা ধ্বংস করেছেন। পরবর্তীকালে মুসলিম রাষ্ট্র দৃঢ়ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হবার পর—সুলতানি শাসনের শেষ পর্যায় থেকে মুঘল শাসকদের শাসনকালে মুসলিম বাদশাহরা হিন্দু মন্দিরগুলি সুরক্ষা ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজে আত্মনিয়ােগ করেছেন। আধুনিক তথ্যনিষ্ঠ ইতিহাস এই সত্যই প্রমাণ করছে। ভারতে মুসলিম শাসন সম্পর্কে আমরা বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের অসামান্য উক্তি স্মরণ করতে পারি—“মুসলমান রাজত্ব ভারতবর্ষেই প্রতিষ্ঠিত ছিল। বাহিরে তাহার মূল ছিল না। এই জন্য মুসলমান ও হিন্দু সভ্যতা পরস্পর জড়িত হইয়া ছিল। পরস্পরের মধ্যে স্বাভাবিক আদান-প্রদানের সহস্র পথ ছিল।”
তথ্যসূত্রঃ
১. অনিরুদ্ধ রায় ও শ্যামল চক্রবর্তী, অযােধ্যাকাণ্ড, ন্যাশনাল বুক এজেন্সি, কলকাতা, ২০০৪, পৃ. ৫-১১।
২. দ্য ইন্ডিয়ান রিভিউ, আগস্ট ১৯২৯।
৩. এইচ এম ইলিয়ট সম্পাদিত, দ্য হিস্টরি অফ ইন্ডিয়া অ্যাজ টোল্ড বাই ইটস্ ওন হিস্টরিয়ানস, ১ম খণ্ড; ডওসন সম্পাদিত, ২য়-৮ম খণ্ড, লন্ডন, ১৮৬৭-৭৭; ২য় খণ্ড এম হাবিবকৃত ইনট্রোডাকশন ও কে এ নিজামিকৃত সাপ্লিমেন্টসহ পুনর্মুদ্রিত, আলিগড়, ১৯৫২; পুনর্মুদ্রণ, দিল্লি, ১৯৮১।
৪. ডি ডি কোশাম্বী, অ্যান ইনট্রোডাকশান টু দ্য স্টাডি অফ ইন্ডিয়ান হিস্টরি, বাংলা অনুবাদ ভারত-ইতিহাস চর্চার ভূমিকা, কে পি বাগচী অ্যান্ড কোম্পানি, তৃতীয় মুদ্রণ, কলকাতা, ২০১৩, পৃ. ৩০৮। লন্ডনের ‘দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকায় একটি বইয়ের আলােচনা প্রসঙ্গে রাজা হর্ষ সম্পর্কে ইংরেজ ঐতিহাসিক উইলিয়াম ডালরিম্পল মন্তব্য করেছেন, “শুধু এই কশ্মীরী রাজা একাই অন্তত চার হাজার বৌদ্ধ পুণ্যস্থান ধ্বংস করার জন্য দম্ভ করতেন।
৫. হরবংশ মুখিয়া, মধ্যযুগীয় ভারতের ইতিহাস ও সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি, অন্তর্ভুক্ত। রমিলা থাপার হরবংশ মুখিয়া বিপানচন্দ্র, সাম্প্রদায়িকতা ও ভারত ইতিহাস রচনা, কে পি বাগচি অ্যান্ড কোম্পানি, দ্বিতীয় মুদ্রণ, কলকাতা, ১৯৮৯, পৃ. ৪৭।
৬. রমিলা থাপার, ধর্মস্থান ধ্বংসের পিছনে, মার্কসবাদী পথ, ফেব্রুয়ারি ২০১৫, কলকাতা।
৭. সুরজিৎ দাশগুপ্ত, ভারতবর্ষ ও ইসলাম, ডি এম লাইব্রেরী, কলকাতা, ১৯৯১, দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ দ্রষ্টব্য।
৮. টি এম তিতাস, ইন্ডিয়ান ইসলাম: এ রিলিজিয়াস হিস্টরি অফ ইসলাম ইন ইন্ডিয়া, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, অক্সফোর্ড, ১৯৩০, পৃ.১৫-৩৫; দিল্লি সংস্করণ, ১৯৭৯।
৯. ক্যানিংহাম রিপাের্টস, একবিংশ অধ্যায়, পৃ. ২৫, ৫৮-৫৯ ও ৭১-৭৯।
১০. মিনহাজউদ্দিন, তবকৎ-ই-নাসিরি, এশিয়াটিক সােসাইটি অফ বেঙ্গল, কলকাতা, ১৮৬৪; এইচ এ রেভার্টিকৃত ইংরেজি অনুবাদ, এশিয়াটিক সােসাইটি অফ বেঙ্গল, কলকাতা, ১৮৮০; এ কে এম যাকারিয়া অনূদিত ও সম্পাদিত, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ১৯৮৩; পুনর্মুদ্রিত, দিল্লি, ১৯৭০, পৃ. ১৭৬। আমরা আরও কিছু মন্দির ধ্বংসের কথা উল্লেখ করতে পারি। সুলতানি যুগে মন্দির ধ্বংসের ব্যাপারে প্রমাণ পাওয়া যায় প্রচুর লিপিমালায়। যেমন ১২৯৬ সালে কাশীতে (বেনারস) নির্মিত একটি মন্দিরে উত্তীর্ণ লিপিতে। (পুষ্পপ্রসাদ, সংস্কৃত ইনষ্ক্রিপসনস অফ দ্য দিল্লি সুলতানেট, দিল্লি, ১৯৯০, পৃ. ১৪৯-৫২)। ১৩২৩ সালে তুঘলক বংশের শাসনকালে অন্ধ্রের ওয়ারাঙ্গলের কাকতীয় নৃপতি দ্বিতীয় প্রতাপরুদ্র সুলতানি সার্বভৌমত্ব অস্বীকার করায় যুবরাজ জুনা তাকে সম্মুখ সমরে পরাস্ত করে রাজধানীর কেন্দ্রে অবস্থিত শিবমন্দিরটি সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করেন। (অঞ্জন সাহা, প্রাক-আধুনিক ভারতে মন্দির অপবিত্রকরণ/লুণ্ঠন/ধ্বংসসাধন : ইতিহাসের একটি বিতর্কিত অধ্যায়, দেখুন-ইতিহাস অনুসন্ধান-১৯, পশ্চিমবঙ্গ ইতিহাস সংসদ, কলকাতা, ২০০৫, পৃ. ২৫৭)। একইভাবে ১৩৫৯ সালে সুলতান ফিরােজ শাহ তুঘলক উড়িষ্যা আক্রমণকালে (প্রতিপক্ষ তৃতীয় ভানুদেব) পুরীর বিখ্যাত জগন্নাথ মন্দির অপবিত্র করেন। (ইলিয়ট ও ডওসন সম্পাদিত, প্রাগুক্ত, খণ্ড-৩, পৃ. ৩১৪)। ঔরঙ্গজেবের সেনাধ্যক্ষ এবং বাংলার সুবাদার মীর জুমলা ১৬৬১ সালে পার্শ্ববর্তী কোচবিহারের রাজা ভীমনারায়ণের মন্দিরগুলি ধ্বংস করেন। কেননা তিনি মুঘল সাম্রাজ্যের উত্তর-পূর্ব সীমান্তে ক্রমাগত নানা গণ্ডগােল সৃষ্টি করছিলেন। (কাফি খান, হিস্টরি অফ আলমগির, অনুবাদ-এস মইনুল হক, করাচি, ১৯৭৫, পৃ. ১৪২-৪৩)। ১৬৬২ সালে আসামকে সাম্রাজ্যভুক্ত করার উদ্দেশ্যে মুঘলবাহিনী মীর জুমলার নেতৃত্বে ব্রহ্মপুত্র অববাহিকা পর্যন্ত অগ্রসর হয় এবং তার নির্দেশে গারগাঁওয়ের বৃহৎ মন্দিরটি বিধ্বস্ত করে সেখানে একটি মসজিদ নির্মাণ করা হয় বলে জগদীশ নারায়ণ সরকার উল্লেখ করেছেন। দেখুন জগদীশ নারায়ণ সরকার, লাইফ অফ মীর জুমলা, কলকাতা, ১৯৫২। ১১. ক্যানিংহাম রিপাের্টস, একাদশ অধ্যায়, পৃ. ১।
১২. এ বি এম হাবিবুল্লাহ, ফাউন্ডেশন অফ মুসলিম রুল ইন ইন্ডিয়া ১২০৬ – ১২৯০, বাংলা অনুবাদ- অনিরুদ্ধ রায়, ভারতে মুসলিম শাসনের প্রতিষ্ঠা, প্রগ্রেসিভ পাবলিশার্স, কলকাতা, ২০০৭, পৃ. ২৭২।
১৩. আর এম ইটন, এসেজ অন ইসলাম অ্যান্ড ইন্ডিয়ান হিস্টরি, নতুন দিল্লি, ২০০২।
১৪. রিচার্ড এইচ ডেভিস, লাইভস অফ ইন্ডিয়ান ইমেজেস, প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি প্রেস, ইউ এস এ, ১৯৯৭; প্রথম ভারতীয় সংস্করণ, দিল্লি, ১৯৯৯, পৃ. ৫৩।
১৫. রমিলা থাপার, ভারতবর্ষের ইতিহাস, ওরিয়েন্ট লংম্যান, কলকাতা, ২০০১, পৃ. ২৭৮।
১৬. গৌতম নিয়ােগী, ইতিহাস ও সাম্প্রদায়িকতা,পুস্তক বিপণি, কলকাতা, ১৯৯১, পৃ. ৩৯। আরও দেখুন- রমিলা থাপার, ধর্মস্থান ধ্বংসের পিছনে, মার্কসবাদী পথ, ফেব্রুয়ারি ২০১৫, কলকাতা।
১৭. দেখুন-বি পি দেশাই, জৈনইজম ইন সাউথ ইন্ডিয়া, শােলাপুর, ১৯৫৭, পৃ. ২৩, ৬৩, ৮২, ৮৩, ১২৪, ৩৯৭-৪০২।
১৮. ডি এন ঝা, আর্লি ইন্ডিয়া:এ কনসাইজ হিস্টরি, বাংলা অনুবাদ-গৌরীশংকর দে, প্রগ্রেসিভ পাবলিশার্স, কলকাতা, ২০০৮, পৃ. ১৮৬।
১৯. বৌদ্ধ কিংবদন্তী অনুসারে অশােক প্রথম জীবনে অর্থাৎ বৌদ্ধধর্ম গ্রহণের পূর্বে অত্যন্ত নিষ্ঠুর ছিলেন এবং ৯৯ জন ভাইকে তরবারির আঘাতে হত্যা করে সিংহাসনে বসেন। দেখুন- রামশরণ শর্মা, ভারতের প্রাচীন অতীত, ওরিয়েন্ট ব্ল্যাক সােয়ান, প্রথম প্রকাশ, কলকাতা, ২০১১, পৃ. ১৭৯। আরও দেখুন-ইরফান হাবিব ও বিবেকানন্দ ঝা, মৌর্য যুগের ভারতবর্ষ, ভাষান্তর- কাবেরী বসু, ন্যাশন্যাল বুক এজেন্সি, ২০১৪, পৃ. ৩৫।
২০. ডি এন ঝা, আর্লি ইন্ডিয়া: এ কনসাইজ হিস্টরি, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৮৬।
২১. কে এ নীলকান্ত শাস্ত্রী, এ হিস্টরি অফ সাউথ ইন্ডিয়া, ৭ম মুদ্রণ, দিল্লি, পৃ. ৪৩২। কে এ নীলকান্ত শাস্ত্রী, দ্য চোলস, ইউনিভার্সিটি অফ মাদ্রাজ, ১৯৭৫, পৃ. ৬৪৪। রামানুজমের নিগ্রহের বিশ্লেষণাত্মক মূল্যায়নের জন্য দেখুন-রিচার্ড এইচ ডেভিস, দ্য স্টোরি অফ দ্য ডিসাপিয়ারিং জৈনস: রিটেলিং দ্য শৈব-জৈন এনকাউন্টার ইন মিডিয়াভ্যাল সাউথ ইন্ডিয়া, অন্তর্ভুক্ত-জন ই কট সম্পাদিত, ওপেন বাউন্ডারিজ : জৈন কমিউনিটিজ অ্যান্ড কালচারস ইন ইন্ডিয়ান হিস্টরি, আলবানি, ১৯৯৮, পৃ. ২১৩ – ২৪।
২২. কে এ নীলকান্ত শাস্ত্রী, দ্য চোলস, প্রাগুক্ত, পৃ. ৬৪৪-৬৪৫। মধ্যযুগে বিশেষ করে চতুর্দশ শতকে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে শৈব ও বৈষ্ণবদের বিরােধের ফলে মন্দিরের সম্পত্তি বিপূলভাবে আত্মসাৎ করেছিল হিন্দুরাই। “সামন্ততন্ত্রের বিলম্বিত পর্যায়ে ধনবান ভূস্বামীরা যে কোন বর্ণের শাসনকেই ভেঙে ফেলতে পারত—তার জন্য কোন শাস্তি পেতে হত না। গায়ের জোরে বা রাজার বদান্যতায় ভূস্বামী হওয়া নিম্নবর্ণীয়রা পরিচয় গােপন করতে ব্রাহ্মণ পুরােহিতদের পর্যাপ্ত ধনসম্পদ দিয়ে নিজেদের উচ্চ বংশদ্ভুতির দাবি প্রতিষ্ঠা করত। নব্য ‘ব্রাহ্মণদের হঠাৎ আবির্ভাব সমেত এরকম জাতে ওঠার ঘটনা সারা দেশেই ঘটেছে। যাই হােক না কেন, ইসলাম ধর্ম কিন্তু বর্ণব্যবস্থার অন্তঃসারশূন্যতাকে তুলে ধরতে সাহায্য করেছিল—যে ব্যবস্থায় দেবতারা নিজেদের মন্দিরই রক্ষা করতে পারে।” দেখুন- ডি ডি কোশাম্বী, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩০৯।
২৩. জি এস ঘুরসে, ইন্ডিয়ান সাধুজ, বম্বে, ১৯৬৪, পৃ. ১০৩।
২৪. ক্লস ক্লস্টারমায়ার, দ্য অরিজিনাল দক্ষ সাগা; অন্তর্ভুক্ত-অরবিন্দ শর্মা সম্পাদিত, এসেজ অন দ্য মহাভারত, লিডেন, ১৯৯১, পৃ. ১১২।।
২৫. রামশরণ শর্মা, কমিউনাল হিস্টরি অ্যান্ড রামাজ অযােধ্যা, সংশােধিত সংস্করণ, দিল্লি, ২০০০, পৃ. ১৪-১৫।
২৬. ডি এন ঝা, ইন সার্চ অফ এ হিন্দু আইডেন্টিটি, বাংলা অনুবাদ, পশ্চিমবঙ্গ ইতিহাস সংসদ, ২০০৬, কলকাতা, পৃ. ২৫। ডি এন ঝা, আর্লি ইন্ডিয়া: এ কনসাইজ হিস্টরি, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৬৫।
২৭. নীহাররঞ্জন রায়, বাঙালীর ইতিহাস, আদিপর্ব, দে’জ পাবলিশিং হাউস, ৭ম সংস্করণ, কলকাতা, ১৪১৬, পৃ. ৫০৬।
২৮. নীহাররঞ্জন রায়, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫০৫-৫০৬। রমেশচন্দ্র মজুমদার শশাঙ্কের কলঙ্কমুক্তির চেষ্টা করেছেন। তিনি শশাঙ্কের অত্যাচারের কথা স্বীকার করেননি। শশাঙ্কের বিরুদ্ধে আনীত বৌদ্ধনির্যাতন ও রাজ্যবর্ধন-হত্যার অভিযােগ খণ্ডনে রমেশচন্দ্র প্রয়াসী হয়েছেন নির্দিষ্ট প্রমাণের ভিত্তিতে নয়, বরং বিশেষ একটি নেতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকে। যে সকল ঐতিহাসিক শশাঙ্কের বৌদ্ধ-নির্যাতনের ঘটনাকে জরুরি রাজনীতির কারণের সঙ্গে সম্পর্কিত করে দেখতে চেয়েছেন, তাদের সেই যুক্তিগ্রাহ্য প্রবণতাকে তিনি সাম্প্রদায়িক স্বার্থের খাতিরে জাতীয় স্বার্থ বিসর্জনের সামিল’ বলে অভিহিত করেছেন। খুব সম্ভব হিন্দু রাজা শশাঙ্কই এ ক্ষেত্রে হিন্দু জাতীয়তার প্রতীক রূপে এবং হর্ষবর্ধন-রাজ্যবর্ধন ও মগধের বৌদ্ধগণ তার প্রতিপক্ষরূপে গৃহীত হয়েছেন। (রমেশচন্দ্র মজুমদার সম্পাদিত, হিস্টরি অফ বেঙ্গল, খণ্ড-১, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা, ১৯৪৩, পৃ. ৬৭)। রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ‘বৌদ্ধতীর্থ’বা বৌদ্ধচাৰ্য্যগণের প্রতি শশাঙ্কের অত্যাচারের কাহিনী সম্পূর্ণরূপে বিশ্বাসযােগ্য নহে’ বললেও তিনি অবশ্য স্বীকার করেছেন যে, “শশাঙ্ক কর্তৃক বােধিদ্রুম বিনাশ, কুশীনগরে ও পাটলিপুত্রে বৌদ্ধকীর্তি ধ্বংস প্রভৃতি কার্য্যের বােধহয় অন্য কোন কারণ ছিল।” (রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, বাঙ্গালার ইতিহাস, অখণ্ড সংস্করণ, প্রথম ভাগ, দে’জ পাবলিশিং হাউস, কলকাতা, ২০১৪, পৃ. ৬৭-৬৮)। ডি ডি কোশাম্বী কিন্তু শশাঙ্কের অত্যাচার তথা বৌদ্ধবিদ্বেষের কথা অস্বীকার করেননি। তিনি লিখেছেন : “শশাঙ্কের আক্রমণের লক্ষণীয় বৈশিষ্ট হল তার অভিনব ধর্মীয় ভেক; তিনি বৌদ্ধ স্থাপত্যগুলি ধ্বংস করেছিলেন এবং বুদ্ধ যে বৃক্ষের তলায় বসে বােধি লাভ করেছিলেন সেটি পুড়িয়ে দিয়েছিলেন। এটা প্রমাণ করে যে ভিত্তিতে কিছু সংঘাত ছিল এবং এই প্রথম তা যুদ্ধের মধ্য দিয়ে উত্তীর্ণ হল ধর্মীয় চেতনার স্তরে। ” (ডি ডি কোশাম্বী, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৫৪)। রামশরণ শর্মাও লিখেছেন, শৈব রাজা গৌড়েশ্বর শশাঙ্ক বুদ্ধগয়ায় বােধিবৃক্ষ ধ্বংস করেছিলেন এবং বৌদ্ধদের উপর বহু অত্যাচার করেছেন। দেখুন-রামশরণ শর্মা, ভারতের প্রাচীন অতীত, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৪৬।
২৯. উইলহেলম হাবফাস,ট্রাডিশন অ্যান্ড রিফ্লেকশন :এক্সপ্লোরেশন ইন ইন্ডিয়ান থট, আলবানি, ১৯৯১, পৃ. ৬১।
৩০. ডি এন ঝা, ইন সার্চ অফ এ হিন্দু আইডেন্টিটি, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৪। শঙ্করাচার্যের আগ্রাসী মনােভাব সম্বন্ধে ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত লিখেছেন : “শঙ্কর দিগ্বিজয়ে’ (৭৯০) আছে—বৌদ্ধ গুরু বধের প্রায়শ্চিত্তস্বরূপ যখন কুমারিল ভট্ট তুষানলে প্রবেশ করেন, সে সময়ে শঙ্কর তার নিকট উপস্থিত হলে কুমারি ল বলেছিলেন— ‘তথাগতাক্রান্তভূদশেষং স বৈদিকো ইধ্বা বিরলী বভূব’ অর্থাৎ ‘বৌদ্ধেরা সমস্ত দেশ অধিকার করে নিয়েছে, বৈদিক মার্গও লুপ্তপ্রায় অবস্থা। বৌদ্ধ সাম্যবাদ জনসাধারণের মধ্যে প্রচারিত হওয়ায় ব্রাহ্মণ ও তৎসঙ্গীদের বুনিয়াদী স্বার্থে যে বিশেষ আঘাত পড়েছিল এবং তা দূর করার জন্যে পুরােহিতবর্গ আর উচ্চস্তরের লােকেরা যে কি করেছিলাে তা পূর্বেই বলা হয়েছে। তারা ‘নবক্ষত্রিয়’ শ্রেণী সৃষ্টি করে তাদের সাহায্যে সাম্যবাদীদের উপর নির্যাতন শুরু করে দিল। কুমারিল নিজেই মহারাষ্ট্র দেশের এক রাজাকে প্ররােচিত করে বহু সহস্র বৌদ্ধের প্রাণনাশের কারণ হয়েছিলেন। এখন শঙ্করও সেই মত গ্রহণ করে দিগ্বিজয়ে বেরিয়ে পড়েন। যে বেদান্ত। মত প্রচারকল্পে শঙ্কর দেশ ভ্রমণে বেরিয়েছিলেন সেটা যে কতদুর অভিজাতদের স্বার্থের অনুকূলে চালিত হয়েছিল তাহা শঙ্করের কার্যই প্রকাশ পায়। তিনি ভিন্ন মতাবলম্বীদের তর্কে পরাস্ত করার জন্য ‘বেদ একমাত্র অভ্রান্ত প্রামাণ্য’ বলে গ্রহণ করলেন এবং খৃষ্টীয় ‘নাইট টেমপলার’দের মত একদল ষণ্ডা গুণ্ডা পালােয়ান চেলা তার সঙ্গে সবসময়ই থাকত; উদ্দেশ্যপ্রহারপুর্বক স্বীয় মত প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা। বেদের বিরুদ্ধে কোনও মতই তিনি গ্রাহ্য করেননি। অন্যত্র ‘শঙ্কর দিগ্বিজয়’ গ্রন্থে উল্লিখিত আছে যে, বৌদ্ধ ও জৈনদের তর্কে পরাস্ত করে তাদের মাথা কেটে নিয়ে চেঁকিতে কুটবার ব্যবস্থার কথা আছে। তাবেদার নব-ক্ষত্রিয়েরা এদের হুকুম তামিল করবার জন্যে মােতায়েন থাকত। এই প্রচার অমােঘ অস্ত্র নিয়েই নব-বৈদিকের দল অর্থাৎ বৈদান্তিকেরা দিগ্বিজয়ে বার হতেন। সঙ্গে সঙ্গে শঙ্কর বৌদ্ধ ও জৈনদের। ‘পুনর্জন্মবাদ’, ‘কর্মফলবাদ’ রূপ মতবাদের অস্ত্রকে নিজস্ব করে তাদের বিরুদ্ধে অভিযান করেন। “তাের শিল, তাের নােড়া, তাের ভাঙ্গব দাঁতের গােড়া’—যেন এই ভাব আর প্রণালী তিনি গ্রহণ করেছিলেন।” দেখুন-ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত , বাঙ্গলার ইতিহাস, চিরায়ত প্রকাশন, প্রথম পরিমার্জিত সংস্করণ, কলকাতা, ২০১৪, পৃ. ৬৫।
৩১. দীনেশচন্দ্র সেন, প্রাচীন বাংলা সাহিত্যে মুসলমানের অবদান, করুণা প্রকাশনী, কলকাতা, ১৯৯৫, পৃ. ১১-১২। R D Sanwal, Social Stratification in Rural Kumaon, 1967, P. 22.
৩২. রামশরণ শর্মা, ভারতের সাম্প্রদায়িকতার ইতিহাস ও রামের অযােধ্যা, পত্রপুট, কলকাতা, ১৯৯৭, পৃ. ২৫। রামশরণ শর্মা দেখিয়েছেন, কিভাবে বিহারে আদি মধ্যযুগে বৌদ্ধমূর্তিগুলি শৈব্যরা ধ্বংস করেছে এবং লখনউ মিউজিয়ামে রক্ষিত জৈনদের পূজ্য মূর্তিগুলিকে বৈষ্ণবরা বিকৃত করে তাদের পূজ্য মূর্তিতে পরিণত করার চেষ্টা করেছে। (রামশরণ শর্মা, কমিউনাল হিস্টরি অ্যান্ড রামাজ অযােধ্যা, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৩-১৪)। বুদ্ধকে বিষ্ণুর অবতার রূপে বিচার প্রসঙ্গে পদ্মনাভ এস জৈনি এই অন্তদৃষ্টিমূলক অবলােকন করেছেন : …বৌদ্ধ মন্দিরে ব্রাহ্মণ পুরােহিতের দায়িত্ব নেওয়ার একটা পথ খােলা রইল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রায়শই ধনী এবং সমৃদ্ধ এই সব মন্দির, যেমন উড়িষ্যার জগন্নাথপুরী মন্দির, দক্ষিণ ভারতের কাদ্রি বিহার (যতদিন না ব্রিটিশ সরকার শ্রীলঙ্কার বৌদ্ধদের কাছে ফিরিয়ে দেয়) এমনকী বুদ্ধগয়া এবং সারনাথের মন্দিরসমূহ ব্রাহ্মণ পুরােহিতদের হাতে চলে যায় এবং বৈষ্ণব বা শৈব মন্দিরে রূপান্তরিত হয়। (পদ্মনাভ এস জৈনি, কালেক্টেড পেপারস অন বুদ্ধিস্ট স্টাডিজ, দিল্লি, ২০০১, পৃ. ২৯০)। সপ্তম শতকে জৈন গুহামন্দিরের শৈব মন্দিরে রূপান্তরের উদাহরণও রয়েছে। (রমিলা থাপার, কালচারাল ট্র্যানজ্যাকশান অ্যান্ড আর্লি ইন্ডিয়া, দিল্লি, ১৯৮৭, পৃ. ১০। কে আর শ্রীনিবাসন, সাউথ ইন্ডিয়া, অন্তর্ভুক্ত- এ ঘােষ সম্পাদিত, জৈন আর্ট অ্যান্ড আর্কিটেকচার, খণ্ড-২, দিল্লি, ১৯৭৫। আর চম্পকলক্ষ্মী, রিলিজিয়াস কনফ্লিক্ট ইন দ্য তামিল কান্ট্রি, জার্নাল অফ দ্য এপিগ্রাফিক্যাল সােসাইটি অফ ইন্ডিয়া, খণ্ড-৪, ১৯৭৮, পৃ. ৬৯-৮১)। যে কেউ খেয়াল করলে দেখতে পাবেন হিমালয়ের বদ্রীনাথের নারায়ণ মূর্তি বুদ্ধমূর্তির উপরেই গঠিত। দেখুন- সাদিকুজ্জামান ও সুরঞ্জন চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত, শরবিদ্ধ স্বদেশ, ভাষা ও সাহিত্য, কলকাতা, ১৯৯৩, মুখবন্ধ, পৃ. ৪।
৩৩. ডি এন ঝা, আর্লি ইন্ডিয়া:এ কনসাইজ হিস্টরি, প্রাগুক্ত, পৃ. ১১২। দিব্যবদান, ই বি কাওয়েল ও আর এ নীল সম্পাদিত, কেমব্রিজ, ১৮৮৬, পৃ. ৪৩৩-৩৪। আরও দেখুন- রামশরণ শর্মা, ভারতের প্রাচীন অতীত, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৪৬
৩৪. রামশরণ শর্মা, ভারতের সাম্প্রদায়িকতার ইতিহাস ও রামের অযােধ্যা, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৩-২৪।
৩৫. বিমলানন্দশাসমল, স্বাধীনতার ফাঁকি, হিন্দুস্থান বুক সার্ভিস, কলকাতা, ১৯৯১, পৃ. ৪৮।
৩৬. এন জিমজুমদার,ইন্সক্রিপশনস অফ বেঙ্গল, দ্বিতীয় খণ্ডে প্রকাশিত ভােজবর্মার বেলবা তাম্রশাসন (৫ম বর্ষ), রাজশাহী, পৃ. ১৪-২৪; এপিগ্রাফিয়া ইন্ডিকা, ২১তম খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে বিপুল শ্ৰমিত্রের নালন্দা তাম্রশাসন, পৃ. ৯৭। ৩৭. নীহাররঞ্জন রায়, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫০৬।
৩৮. বুদ্ধগয়া গয়া-দর্শন রাজগীর নালন্দা পাওয়াপুরী (পর্যটক সহায়ক পুস্তিকা), নালন্দা, পৃ. ১৬-১৭; দেখুন- আমীর হােসেন, বাঙালীর বিভাজন, অনুষ্টুপ, বিশেষ শীতকালীন সংখ্যা ১৪০৮, কলকাতা।
৩৯. বি এন এস যাদব, সােসাইটি অ্যান্ড কালচার ইন নর্দার্ন ইন্ডিয়া ইন দ্য টুয়েলফথ সেঞ্চুরি, এলাহাবাদ, ১৯৭৩, পৃ. ৩৪৬।
৪০. ডি আর পাতিল, অ্যান্টিকোয়ারিয়ান রিমেইনস অফ বিহার, পাটনা, ১৯৬৩, পৃ. ৩০৪।
৪১. আর এস শর্মা এবং কে এম শ্রীমালি, এ কমপ্রিহেনসিভ হিস্টরি অফ ইন্ডিয়া, খণ্ড-৪, ভাগ ২ (৯৮৫-১২০৬), অধ্যায় ২৫ (খ) : বৌদ্ধধর্ম, পাদটীকা, পৃ. ৭৯-৮২।
৪২. হরবংশমুখিয়া, মধ্যযুগীয় ভারতের ইতিহাস ও সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৭-৪৮।
৪৩. রমিলা থাপার, প্রাগুক্ত, পৃ. ৬০
৪৪. স্যামুয়েল বীল, সি ইউ কি:বুদ্ধিস্ট রেকর্ডস অফ দ্য ওয়েস্টার্ন ওয়ার্ল্ড, দিল্লি, ১৯৬৯, পৃ. ১৭১-৭২। ডি এন ঝা, আর্লি ইন্ডিয়া:এ কনসাইজ হিস্টরি, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৮৫। আরও দেখুন-এ ইরালি, দ্য ফার্স্ট স্প্রিং : দ্য গােল্ডেন এজ অফ ইন্ডিয়া, পেঙ্গ ইন বুকস, নিউ দিল্লি, ২০১১, পৃ. ৭৩৫।
৪৫. রামশরণ শর্মা, ভারতের প্রাচীন অতীত, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৪৬।
৪৬. ডি এন ঝা, আর্লি ইন্ডিয়া:এ কনসাইজ হিস্টরি, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৮৫। রাজতরঙ্গিনী অফ কলহন, ৬.১৭১-৭৩।
৪৭. এ ফুয়েরার, মনুমেন্টাল অ্যান্টিকুইটিজ অ্যান্ড ইন্সক্রিপসনস ইন দ্য নর্থ ওয়েস্টার্ন প্রভিনসেস অ্যান্ড আউথ, এলাহাবাদ, ১৯৯১, পৃ. ৩২৫; উল্লেখিত-বি এন এস যাদব, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৪৬।
৪৮. রিচার্ড এইচ ডেভিস, লাইভস অফ ইন্ডিয়ান ইমেজেস, প্রাগুক্ত, পৃ. ৮৩।
৪৮ক. কুমুদকুমার ভট্টাচার্য, হিন্দু-পাদ-পাদশাহী, অন্তর্ভুক্ত-কুমুদকুমার ভট্টাচার্য সম্পাদিত, হিন্দু-পাদ-পাদশাহী, বর্ণপরিচয়, কলকাতা, ১৯৯৩, পৃ. ১৪০। সুখময় মুখােপাধ্যায় বিভিন্ন সূত্র হতে বলেছেন যে, কালাপাহাড় ছিলেন আফগান মুসলমান। তিনি সিকন্দর সূরের ভ্রাতা ছিলেন, তাঁর নামান্তর রাজু। এ থেকে অনেকে কালাপাহাড়কে হিন্দু বলে মনে করেন। কিন্তু রাজু নাম হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যেই প্রচলিত (সুখময় মুখােপাধ্যায়, বাংলার ইতিহাস, খান ব্রাদার্স অ্যান্ড কোম্পানি, ঢাকা, ২০১৫, পৃ. ৭৪৫)। কিন্তু ব্লকম্যান বলেন যে, কালাপাহাড় পূর্ব জীবনে হিন্দু ছিলেন, তার আসল নাম ছিল রাজু। তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন এবং কালাপাহাড় নামে পরিচিত হন। (জার্নাল অফ দ্য এশিয়াটিক সােসাইটি অফ বেঙ্গল, খণ্ড-৪৪, পৃ. ৩০৩)। আবদুল করিমের অভিমতও একই।
(আবদুল করিম, বাংলার ইতিহাস, সুলতানি আমল, জাতীয় সাহিত্য প্রকাশ, ১ম প্রকাশ, ঢাকা, ২০০৭, পৃ.৩৮৯)। বাংলার অধিপতি সােলায়মান কাররানীর (১৫৬৫৭২) প্রধান সেনাপতি ছিলেন এই কালাপাহাড়। কাররানী আফগান বংশীয় তাজ খান কাররানী (১৫৬৪-৬৫) বাংলায় কাররানী বংশের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি অল্পদিন রাজত্ব করে মারা যান। এর পর তার ভ্রাতা সােলায়মান কাররানী বাংলার সিংহাসনে বসেন। আব্বাস খান শেরওয়ানীর ‘তারিখ-ই শেরশাহী’ গ্রন্থে তাজ খান ও সােলায়মানের যাবতীয় কার্যকলাপ সম্পর্কে জানা যায়। সােলায়মান খুব বিচক্ষণ ও বিজ্ঞ প্রশাসক ছিলেন। শেরশাহের মতাে আফগানদেরকে ঐক্যবদ্ধ করে তিনি বাংলা ও বিহারে এক শক্তিশালী রাজ্য স্থাপন। করেন। ইতিপূর্বে তিনি বিহারের গভর্নর বা শাসনকর্তা ছিলেন। সম্রাট আকবরের সভা-ঐতিহাসিক আবুল ফজল লিখেছেন যে, আফগানরা দলে দলে সােলায়মানের নেতৃত্ব গ্রহণ করে ও তিনি অসাধারণ ক্ষমতার অধিকারী হন। স্টুয়ার্টের মতে, সােলায়মানের অধীনে ৩৬০০ হাতি, ৪০ হাজার অশ্বারােহী সৈন্য, ১৪ হাজার পদাতিক সৈন্য এবং ২০ হাজার কামান ছিল। (চালর্স স্টুয়ার্ট, হিস্টরি অফ বেঙ্গল, লন্ডন, ১৯১৩, পৃ. ১৫২)। তিনি উড়িষ্যা জয় করতে সংকল্প করেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি দুর্ধর্ষ সেনাপতি কালাপাহাড়ের অধীনে অভিযান প্রেরণ করেন। কূটসামার নিকট যুদ্ধে উড়িষ্যার রাজা মুকুন্দদেব (১৫৫৭-৬৮) পরাজিত ও নিহত হন এবং তার সৈন্যাধ্যক্ষ রামচন্দ্র ভঞ্জ ধৃত ও নিহত হন (১৫৬৮)। বিজয়ী আফগান বাহিনী উড়িষ্যা দখল করে এবং বহু ধনরত্ন হস্তগত করে। এই উড়িষ্যা অভিযান সম্পর্কে অনিরুদ্ধ রায় লিখেছেন: “১৫৬৭ সালের শেষে আকবর যখন চিতাের অভিযান। নিয়ে ব্যস্ত তখন সুলেমান একটা শক্তিশালী সৈন্যদল নিয়ে উড়িষ্যা আক্রমণ করেন।..ওর ছেলে বায়াজিদ ওঁর সঙ্গে ছিলেন। তাছাড়া ছিলেন ওঁর অভিজাত সিকান্দার উজবাক, যিনি আগে মুঘল সৈন্যদলে কাজ করেছেন। এছাড়া ছিলেন বাটনী আফগান সেনাপতি কালাপাহাড়। ছােটনাগপুর ও ময়ূরভঞ্জের মধ্য দিয়ে সৈন্যদল এগােলে মুকুন্দ ওদের বিরুদ্ধে ছােট রাজা রঘুভঞ্জকে পাঠান। কিন্তু উড়িষ্যার সেনাপতিরা বিশ্বাসঘাতকতা করে মুকুন্দদেবকে হত্যা করে। ঐ সেনাপতিদের মধ্যে একজন রামচন্দ্র ভঞ্জ এখন সিংহাসনে বসেন। কিন্তু সুলেমান বিশ্বাসঘাতকতা করে ওকে বন্দী করে হত্যা করেন। ইব্রাহিম খান সূরকেও হত্যা করা হয়। মুকুন্দদেবের শেষ যুদ্ধ ও তার নিহত হবার বিবরণ মাদলাপঞ্জী ও আবুল ফজলের আকবরনামায় দুরকম ভাবে আছে। মাদলাপঞ্জীতে বলা হচ্ছে যে রামচন্দ্র ভঞ্জ মুকুন্দদেবকে হত্যা করেছিলেন এবং বাংলার সৈন্যরা রামচন্দ্রকে হত্যা করে। কিছু পরে রঘুভঞ্জ নিজেকে রাজা বলে ঘােষণা করলে সুলেমান কাররানী ওঁকে হত্যা করেন। অন্যদিকে আবুল ফজল বলছেন যে মুকুন্দদেবকে রঘুভঞ্জ পরাজিত ও নিহত করেন। এটা মানলে রামচন্দ্র ভঞ্জর কাজকর্ম অস্বীকার করা হয় যার কথা উড়িষ্যার দলিলে বার বার বলা হয়েছে। জাজপুর তখন উত্তর উড়িষ্যার রাজধানী এবং অভিজাতদের অন্তর্দ্বন্দ্বের ফলে সুলেমানের উড়িষ্যা বিজয় সহজ হয়ে গিয়েছিল এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। আকবর চিতাের অভিযানে ব্যস্ত থাকার ফলে মুকুন্দদেব মুঘলদের কাছ থেকে কোনাে সাহায্য পাননি। অবশ্য উনি সাহায্য চেয়েছিলেন কিনা এটার কোনাে নিশ্চয়তা নেই। সাহায্য চাইলে আকবর জৌনপুরের শাসনকর্তাকে আদেশ দিতেন হয়ত যুদ্ধ করার কিন্তু সেটি ছিল প্রচুর সময়সাপেক্ষ। তাছাড়া মুনীম খানের সঙ্গে সুলেমানের প্রীতির সম্পর্ক ছিল। সম্ভবত মুনীম খানকে নিশ্চপ করে রাখার জন্যই কয়েকমাস আগে সুলেমান ওঁকে পাটনায় নিমন্ত্রণ। করেছিলেন। উড়িষ্যার পতনের পর সুলেমান তান্ডাতে ফিরে যান। কালাপাহাড় ও অন্যান্যদের উপর আদেশ থাকে উড়িষ্যাকে সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণে আনতে। এই অভিযানেই আফগান সেনাপতি কালাপাহাড় পুরীর জগন্নাথ মন্দির ধ্বংস করেন।” দেখুন অনিরুদ্ধ রায়, মধ্য যুগের বাংলা, প্রগ্রেসিভ পাবলিশার্স, কলকাতা, ২০১২, পৃ. ১৪৭-১৪৮। এর পর সােলায়মান কাররানী তার উজির লােদী খানকে উড়িষ্যার ও কতলু লােহানীকে পুরীর শাসনকর্তা নিয়ােগ করেন। এই সময়ে কোচবিহারের রাজা বিশ্ব সিংহ তার পুত্র ও খ্যাতনামা সেনাপতি শুক্লধ্বজের (চিলা রায় নামে সুপরিচিত) অধীনে একদল সৈন্য কাররানী রাজ্য আক্রমণ করতে পাঠান। সােলায়মান কররানী শুক্লধ্বজকে পরাজিত ও বন্দী করেন। তারপর তিনি কালাপাহাড়কে কোচবিহার জয়ের জন্য প্রেরণ করেন। তিনি ব্রহ্মপুত্র নদ ধরে অগ্রসর হন ও তেজপুর পর্যন্ত অধিকার করেন। কিন্তু মুসলিম বাহিনী রাজ্য জয়ের চেষ্টা করেনি, বরং কামাখ্যা, হাজু ও অন্যান্য স্থানে মন্দির ধ্বংস করে ফিরে আসেন। এই সময়ে উড়িষ্যায় এক বিদ্রোহ দেখা দেয়। এইজন্য সােলায়মান কাররানী কালাপাহাড়কে ডেকে পাঠান এবং কোচবিহারের বিজিত স্থান প্রত্যার্পণ করে ও শুক্লধ্বজকে মুক্তি দিয়ে তিনি বিশ্ব সিংহের সঙ্গে মিত্রতা স্থাপন করেন (১৫৬৮)। মুঘল সম্রাট আকবরের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে সােলায়মান কাররানী খুব দূরদর্শিতার পরিচয় দেন। তিনি যদিও কার্যত বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার সর্বেসর্বা শাসক ছিলেন, তবুও তিনি প্রকাশ্যে সার্বভৌম ক্ষমতার দাবি করেননি। তিনি শাহ অথবা সুলতান উপাধি ধারণ করেননি। এইজন্য সম্রাট আকবর (১৫৫৬-১৬০৫) কাররানী রাজ্য আক্রমণ করার অজুহাত পাননি। এই সময়ে আফগানদের মধ্যে ঐক্য বজায় ছিল এবং সােলায়মান কাররানী বিপুল সামরিক শক্তির অধিকারী ছিলেন। এই কারণে সম্রাট আকবর কাররানী রাজ্য আক্রমণ করতে সাহস করেননি। ১৫৭২ সালে সােলায়মান কাররানীর মৃত্যু হয়।
৪৮খ. কুমুদকুমার ভট্টাচার্য, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৪০-১৪১। আবুল ফজলের ‘আকবরনামা’য় কালাপাহাড়ের যুদ্ধের বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে। বেভারিজ নিজে গ্রন্থটির ইংরেজি অনুবাদ করেন। এলাহি বখশ তার খুরশীদ জাহান নুমা’ গ্রন্থে কটকে কালাপাহাড়ের যুদ্ধের বিবরণ দেন, কিন্তু বেভারিজ অপ্রয়ােজনীয় মনে করে তা বাদ দেন। কালাপাহাড় একজন অসমসাহসী যােদ্ধা ছিলেন এবং কোচবিহারসহ বিভিন্ন সীমান্ত এলাকা যুদ্ধ করে সােলায়মান কাররানীর জন্য বিরাট সফলতা লাভ করেন। এই সফলতার অন্যতম ছিল উড়িষ্যা বিজয়, এটি কালাপাহাড়ের নেতৃত্বে সম্পন্ন হয়েছিল, যেটা পূর্বেই বলা হয়েছে। উত্তর উড়িষ্যার রাজধানী জাজপুর থেকে কালাপাহাড় ওরফে রাজুর নেতৃত্বে ১৫৬৭ সালে এক শক্তিশালী আফগান সেনাবাহিনী জগন্নাথ মন্দির অভিযানের জন্য প্রেরণ করা হয়। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপােষকতায় মন্দির লুণ্ঠনের ঘটনাটি ছিল শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বাংলার মুসলমান শাসকদের অমুসলিম স্থাপনার প্রতি সম্মান প্রদর্শনের কার্যকর নীতির বিচু্যতি। অবশ্য আর এম ইটন ও অন্যান্য অনেকেই বলেছেন, সুলতান। সােলায়মান কাররানীর উদ্দেশ্য ছিল সুস্পষ্টভাবে রাজনৈতিক, ধর্মীয় নয়। অভিযানটি পরিচালনার সামান্য আগে উড়িষ্যার রাজা মুকুন্দদেব প্রকৃতপক্ষে তাঁর চরম শত্রু মুঘল সম্রাট আকবরের সাথে একটি চুক্তি সম্পাদন করেন। কিন্তু রাজা বাংলার সিংহাসনের জন্য সােলায়মানের তিক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী ইব্রাহিম খান সুরকে আশ্রয় দেন এবং আকবরের দূতকে বলেন, বাংলা জয়ে তার উচ্চাভিলাষ পূরণের জন্য তিনি ইব্রাহিমকে খুশি মনে সাহায্য করবেন। (আবুল ফজল, আকবরনামা, হেনরি বেভারিজ অনূদিত, এশিয়াটিক সােসাইটি অফ বেঙ্গল, কলকাতা, ১৮৯৭-১৯২১, পুনর্মুদ্রণ, নিউ দিল্লি, ১৯৭৯, ২ : ৩৮১-৮২, ৪৮০; টেক্সট, ২: ২৫৪-৫৫, ৩২৭) সুলতান সােলায়মানের পক্ষে তাঁর রাজত্বের একেবারে লাগােয়া কোনাে স্থান থেকে অস্থিতিশীলতার হুমকি সহ্য করা কঠিন ছিল, তাই মুকুন্দদেবকে শাস্তি প্রদানের উদ্দেশ্যে তার উড়িষ্যা অভিযানের যৌক্তিকতা উপলব্ধি করা যায়। কিন্তু জগন্নাথ মন্দিরটি সাধারণ কোনাে মন্দির ছিল না। উড়িষ্যার রাজাদের গজপতি রাজবংশের অকুণ্ঠ সমর্থনপুষ্ট এই মন্দিরটি উক্ত রাজবংশের অব্যাহত ও অবিচ্ছেদ্য শাসনের স্থাপত্য প্রতিনিধি হিসেবে বিবেচিত হত। (A Eschmann, H. Kulke, and G. C Tripathi Edited, The Cult of Jagannath and the Regional Tradition of Orissa, Manohar Publishers, New Delhi, 1978, P. 200-208) এটার ধ্বংস তাই ছিল অত্যন্ত বাস্তববাদী ও পরিকল্পিত রাজনৈতিক পদক্ষেপ। ভারতে সাধারণভাবে মুসলমান ও হিন্দু শাসকদের মতাে কাররানীরাও মনে করতেন, রাষ্ট্রীয় মন্দির—সাধারণত রাজার প্রধান রাজধানীতে একটি একক ও সমৃদ্ধ স্থাপনা—রাজবংশটির গৌরব ফুটিয়ে তুলত এবং কোনাে হিন্দু রাজবংশের পুরােপুরি ধ্বংসের জন্য এটির বিধ্বস্তকরণ বা লুণ্ঠন ছিল যৌক্তিক ও প্রয়ােজনীয়। (রিচার্ড এইচ ডেভিস, ইন্ডিয়ান আর্ট অফজেক্টস অ্যাজ। লুট, জার্নাল অফ এশিয়ান স্টাডিজ-৫২, নং-১, ফেব্রুয়ারি ১৯৯৩, পৃ. ২২-৪৮)। রাজনৈতিক কারণে পরাজিত শত্রুর সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ধ্বংস করার উদ্দেশ্য যে পরাজিত শত্রুকে নিজের পদানত করে রাখা, তার অসামরিক সংস্কৃতিও পঙ্গু করে দেওয়া তা স্পষ্টায়িত হয়ে যায়। আঠারাে শতকে ইংরেজরা মহীশূর বিজয়ের পর এমন কাজ করেছিল। ১৮৫৭-র সিপাহী তথা মহাবিদ্রোহের সময় ইংরেজরা দিল্লি দখল করার পর রাজকীয় মহাফেজ খানার মূল্যবান বহু পুঁথি জালিয়ে দেয়। মধ্যযুগে তাে বটেই এমনকি আধুনিক যুগেও এই ধরনের ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড অন্য দেশের পাশাপাশি ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলেও সংঘটিত হয়েছে। যেমন, বেশ কয়েক বছর আগে ২০০৪ সালে মহারাষ্ট্রের পুনের ভাণ্ডারকর গবেষণা কেন্দ্রটি উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের আক্রমণের শিকার হয়। উল্লেখ্য, মার্কিন ঐতিহাসিক জেমস্ লেইন ছত্রপতি শিবাজীকে নিয়ে যে গ্রন্থটি (শিবাজী:এ হিন্দু কিং ইন ইসলামিক ইন্ডিয়া) রচনা করেছিলেন পুনের ভাণ্ডারকর গবেষণা কেন্দ্রটি লেখককে যােগ্য সহায়তা দিয়েছিল। কিন্তু শিবাজী ভক্তদের অভিযােগ বইটিতে নাকি শিবাজী সম্পর্কে বহু মর্যাদা হানিকর বক্তব্য পরিবেশিত হয়েছিল। ছত্রপতির অপমান ভক্তদের কাছে অসহ্য। তারা গবেষণা কেন্দ্রে প্রবেশ করে সেখানকার অমূল্য নথিপত্র, পুঁথি ও গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র নষ্ট করে সবকিছু তছনছ করে দেয়। যাইহােক, এই জগন্নাথ মন্দির ধনরত্নের জন্য বিশেষভাবে প্রসিদ্ধ ছিল। কালাপাহাড়ের অশ্বারােহী বাহিনী এত দ্রুত বেগে অগ্রসর হয় যে, তারা শত্রুদের অজান্তে হঠাৎকরে গন্তব্যস্থলে পৌঁছে যায়। এই সময়ে উড়িষ্যার রাজা দুর্বল থাকায় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা অবহেলিত হয়, ফলে কালাপাহাড়ের বাহিনীকে কোনাে বাধার সম্মুখীন হতে হয়নি। পুরীর জনগণ দীর্ঘদিন স্বাধীন থাকায় এবং অনেকদিন ধরে শত্রুর মােকাবিলা না করায় মুসলমান অভিযানের কথা প্রথমে তাদের বিশ্বাসই হয়নি। পুরীর জনগণ বলে, এই মুসলিম আক্রমণকারীরা কী অদ্ভুত লােক, তারা কি আমাদের মুর্তি ধ্বংস করতে পারবে? আক্রমণ শুরু হলে অনেক ব্রাহ্মণ মহিলা যাঁরা মূল্যবান গহনাপত্র নিয়ে মন্দিরে নিরাপদে আশ্রয় নেয়, তাদের বন্দী করা হয়। ঐতিহাসিক নিয়ামতউল্লাহ যিনি ঘটনার প্রায় ৪০ বছর পর কলম ধরেছিলেন, তিনি তাঁর ‘তারিখ-ই-খানজাহানী ওয়া মখজন-ই-আফগানী’ গ্রন্থে বলেন যে, জগন্নাথ মন্দির আংশিক ধ্বংস করা হয়। মন্দিরের কৃষ্ণমূর্তি মণিমুক্তায় খচিত ছিল, মূর্তির প্রত্যেক অ-প্রত্যঙ্গ সােনার তৈরি এবং দুই চোখ ছিল হীরার তৈরি। কালাপাহাড় এই মূর্তি ধ্বংস করে টুকরাে টুকরাে করে এবং আবর্জনাময় স্থানে ফেলে দেয়। বিভিন্ন আকৃতির আরও সাতটি সােনার মূর্তি কৃষ্ণমূর্তির চারিদিকে বেষ্টন করেছিল, এগুলির প্রত্যেকটির ওজন ছিল পাঁচ আকবরী মণ (এক আকবরী মণ-এর ওজন ছিল প্রায় ২৮ সের। দেখুন-ইরফান হাবিব, মুঘল ভারতের কৃষি ব্যবস্থা ১৫৫৬১৭৬০, বাংলা অনুবাদ, কলকাতা, ১৯৮৫, পৃ. ৩৯২)। বিভিন্ন দেবদেবীর ৭০০ মূর্তি বিজয়ীদের করায়ত্ত হয়। সেনাবাহিনীর এমন কোনাে লােক ছিল না যে একটি বা দুটি সােনার মূর্তি পায়নি। দেখুন-খাজা নিয়ামতউল্লাহ : তারিখ-ই-খানজাহানী ওয়া মখজন-ই-আফগানী, এস এম ইমামউদ্দিন সম্পাদিত, এশিয়াটিক সােসাইটি অফ পাকিস্তান, ঢাকা, ১৯৬০, ১:৪১৩-৪১৫; যদুনাথ সরকার সম্পাদিত, হিস্টরি অফ বেঙ্গল, খণ্ড-২, ঢাকা ইউনিভার্সিটি, ১৯৪৮, পৃ. ১৮৩-৮৪।
৪৯. কুমুদকুমার ভট্টাচার্য, হিন্দু-পাদপাদশাহী, অন্তর্ভুক্ত- কুমুদকুমার ভট্টাচার্য সম্পাদিত, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৪১।
৫০. ডেভিড এন লােরেনজেন, ওয়ারিয়র অ্যাসেটিকস ইন ইন্ডিয়ান হিস্টরি, জার্নাল অফ দ্য আমেরিকান ওরিয়েন্টাল সােসাইটি, পৃ. ৬১-৭৫। বিস্তারিত দেখুনউইলিয়াম আর পিঞ্চ, পিজান্টস অ্যান্ড মঙ্কস ইন ব্রিটিশ ইন্ডিয়া, দিল্লি, ১৯৯৬। আরও দেখুন-ডি এন ঝা, ইন সার্চ অফ এ হিন্দু আইডেন্টিটি, প্রাগুক্ত, ২০০৬।
৫১. দেখুন-রমেশচন্দ্র মজুমদার সম্পাদিত, দ্য মুঘল এম্পায়ার, ভারতীয় বিদ্যাভবন, ১৯৭৪, পৃ. ৫১।
৫২. অতীশ দাশগুপ্ত, বাংলার ধর্মীয় সংস্কৃতির জননী:সম্প্রীতি, যুবশক্তি প্রকাশনী, কলকাতা, পৃ. ৯২।
৫৩. আজিজ আহমদ, স্টাডিজ ইন ইসলামিক কালচার ইন দ্য ইন্ডিয়ান এনভায়রনমেন্ট, অক্সফোর্ড, ১৯৬৪।
৫৪. জেলা গেজেটিয়র বেনারস, ১৮০৯, পৃ. ২০৭-৮।
৫৫. রিচার্ড এইচ ডেভিস, লাইভস অফ ইন্ডিয়ান ইমেজেস, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫১-৮৩। বিস্তারিত জানতে দেখুন -আর এম ইটন, টেম্পল ডি-সিক্রেশন ইন প্রি-মডার্ন ইন্ডিয়া, ফ্রন্টলাইন, ২২ ডিসেম্বর ২০০০। আর এম ইটন, এসেজ অন ইসলাম অ্যান্ড ইন্ডিয়ান হিস্টরি, প্রাগুক্ত, পৃ. ১০৩-১০৭। আরও দেখুন-ডি এন ঝা, আর্লি ইন্ডিয়া:এ কনসাইজ হিস্টরি, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৬৯-১৮১।
৫৬. আর এম ইটন, এসেজ অন ইসলাম অ্যান্ড ইন্ডিয়ান হিস্টরি, প্রাগুক্ত, পৃ. ১০৭।
৫৭. ডি এন ঝা, আর্লি ইন্ডিয়া: এ কনসাইজ হিস্টরি, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৮০। আরও দেখুন- রামশরণ শর্মা, ভারতের প্রাচীন অতীত, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৪৬ এবং ২৬৭।
৫৮. ডি এন ঝা, আর্লি ইন্ডিয়া: এ কনসাইজ হিস্টরি, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৮০-১৮১।
৫৯. ডি এন ঝা, আর্লি ইন্ডিয়া: এ কনসাইজ হিস্টরি, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৮১।
৬০. দেখুন-রিচার্ড এম ইটন, টেম্পল ডি-সিক্রেশন অ্যান্ড ইন্দো-মুসলিম স্টেটস, ফ্রন্টলাইন, ৫ জানুয়ারি ২০০১। আরও দেখুন-রিচার্ড এইচ ডেভিস, লাইভস অফ ইন্ডিয়ান ইমেজেস, প্রাগুক্ত, পৃ. ৬৬-৬৯। আর এম ইটন প্রদত্ত অপর এক পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায় যে, ১৫৭০১৭৬০ পর্যন্ত এই ১৯০ বছরে বঙ্গদেশে তারিখ-সম্বলিত মােট ২১৯টি ইটের মন্দির নির্মিত হয়। বাদশাহ ঔরঙ্গজেবের শাসনকালেও (১৬৫৮-১৭০৭) শুধু বঙ্গদেশেই ইটের বড় বড় মন্দির নির্মিত হয়েছিল ৫০টিরও বেশি। (দেখুন- আর এম। ইটন, দ্য রাইজ অফ ইসলাম অ্যান্ড দ্য বেঙ্গল ফ্রন্টিয়ার ১২০৪-১৭৬০, বাংলা অনুবাদ হাসান শরীফ, ইসলামের অভ্যুদয় এবং বাংলাদেশ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, প্রথম প্রকাশ, ঢাকা, ২০০৮, পৃ. ২২৭)। অপরদিকে, এ সময়ে বঙ্গদেশে মােট মসজিদ নির্মিত হয়েছে ১০৫টি।
৬১. সীতারাম গােয়েল, হিন্দু টেম্পল : হােয়াট হ্যাপেন্ড টু দেম, খণ্ড-৩২, নিউ দিল্লি, ১৯৯০-৯১।
৬২. ক্যানিংহাম রিপাের্টস, প্রথম অধ্যায়, পৃ. ২০৬; এ বি এম হাবিবুল্লাহ, ফাউন্ডেশন অফ মুসলিম রুল ইন ইন্ডিয়া, বাংলা অনুবাদ-বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ২০০৪, পৃ. ২২২।
৬৩. রিপাের্টস অফ দ্য আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া ১৯০৯-১০, পৃ. ১৩১। এপিগ্রাফিয়া ইন্ডিকা, খণ্ড-২১, পৃ. ১৭৫-৭৬। এ বি এম হাবিবুল্লাহ, প্রাগুক্ত, পৃ. ২২২।
৬৬. রিপাের্টস অফ দ্য আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া ১৯২৩-২৪, পৃ. ৯২।
৬৭. এ বি এম হাবিবুল্লাহ, প্রাগুক্ত, পৃ. ২২৩।
৬৮. ক্যানিংহাম রিপাের্টস, তৃতীয় অধ্যায়, পৃ. ১২৪।
৬৯. আতাহার আলি, এনকাউন্টার অ্যান্ড ইফ্লোরিসসেন্স: জেনেসিস অফ মিডিয়াভ্যাল সিভিলাইজেশান, প্রেসিডেন্সিয়াল অ্যাড্রেসেস টুইন্ডিয়ান হিস্টরি কংগ্রেস, গােরক্ষপুর, ১৯৮৯। দেখুন-সােশাল-সায়েন্টিস্ট, নং-২০০-২০১, জানু-ফেব্রু, ১৯৯০।
৭০. আবুল ফজল, আইন-ই-আকবরী, খণ্ড ২, নাভাল কিশাের, পৃ. ১৮৫; দেখুন ইকতিদার আলম খান, মধ্যযুগের ভারতে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র শাসন পদ্ধতি, অন্তর্ভুক্ত। গৌতম চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত, সেতু প্রকাশনী সংস্করণ, কলকাতা, ২০১১, পৃ. ৩।
৭১. ইবন বতুতা, ট্রাভেলস্ ইন এশিয়া অ্যান্ড আফ্রিকা ১৩২৪-১৩৫৪, অনুবাদ এইচ এ আর গিব, ওরিয়েন্টাল বুকস, দিল্লি, ১৯৮৬।
৭২. এপিগ্রাফিয়া ইন্ডিকা, খণ্ড-২৩, পৃ. ৯৭।
৭৩. হীরালাল, ডেসক্রিপ্টিভ লিস্টস অফ ইনক্রিপশনস ইন সেন্ট্রাল প্রভিনসেস অ্যান্ড বেরার, নাগপুর, ১৯১৬, পৃ. ৫০। মাহদি হাসান, তুঘলক ডায়ন্যাস্টি, ১৯৬৩, পৃ. ৩৩৪-৩৫।
৭৪. এম বি জাভেরি, কম্পারেটিভ অ্যান্ড ক্রিটিক্যাল স্টাডি অফ মন্ত্রশাস্ত্র, পৃ. ২৮; মাহদি হাসান, তুঘলক ডায়ন্যাস্টি, ১৯৬৩, পৃ. ৩২১।
৭৫. এ এস উষা সম্পাদিত, ফখরউদ্দিন ইসামি: ফুতুহুস সালাতিন, মাদ্রাজ, ১৯৫৮, পৃ. ৫১৫।
৭৬. জৈনদের অনুকূলে প্রচারিত এই ফরমানের বিবরণ পাওয়া যাবে, এডমন্ড দ্য উঙ্গের-এর ব্যক্তিগত সংগ্রহের যে ক্যাটালগ বি ডব্লিউ রবিনসন তৈরি করেছেন তার মধ্যে, ইসলামিক পেইন্টিং অ্যান্ড দ্য আর্ট অফ দ্য বুক, লন্ডন, ১৯৭৬, পৃ. ২৮৩-৮৪। আরও দেখুন- অমলেন্দু দে, ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে ধর্মীয় মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মনিরপেক্ষতা, অন্তর্ভুক্ত-অমলেন্দু দে, ধর্মীয় মৌলবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতা, রত্না প্রকাশন, কলকাতা, ১৯৯২, পৃ. ৩৮।
৭৭. ক্যানিংহাম রিপাের্ট, পঞ্চম অধ্যায়, পৃ. ১১৪-১৯। তবে প্রশ্নের অবকাশ আছে যে, কোনাে অঞ্চল সেখানকার বাসিন্দা সমেত বিজয়ী রাষ্ট্রের অঙ্গীভূত হলে কি ঘটত? এ প্রসঙ্গে বলা চলে যে, ইসলামীয় রাষ্ট্রকাঠামাে বাস্তববােধ ও দীর্ঘকালীন ঐতিহ্যের দ্বারা প্রভাবিত হওয়ায় সাধারণত সেখানকার প্রাচীন মন্দির সমূহের সুরক্ষার জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হত। দেখুন-রিচার্ড এম ইটন, টেম্পল ডি-সিক্রেশন অ্যান্ড ইন্দো-মুসলিম স্টেটস, ফ্রন্টলাইন, ৫ জানুয়ারি ২০০১।
৭৮. রমিলা থাপার, প্রাগুক্ত, পৃ. ২০৯, পাদটিকা।
৭৯. ডেভিড ম্যাকাচিনের গবেষণাপত্র, এশিয়াটিক সােসাইটি পত্রিকা, দ্বাদশ খণ্ড, ১৯৭০।
৮০. শ্রীরাম শর্মা, রিলিজিয়াস পলিসি অফ দ্য মুঘল এম্পাররস, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৪০; এশিয়া পাবলিশিং হাউস, ২য় সংস্করণ, বােম্বে, ১৯৬২, পৃ. ৫।
৮১. মােরল্যাণ্ড, অ্যাগরেরিয়ান সিস্টেম অফ মুসলিম ইন্ডিয়া, কেমব্রিজ, ১৯২৯; পুনর্মুদ্রণ, নিউ দিল্লি, ১৯৬৮, পৃ. ৩২ ও টীকা।
৮২. আতাহার আলি, মুঘল সম্রাটদের ধর্মনীতি, অন্তর্ভুক্ত-ইরফান হাবিব সম্পাদিত, মধ্যকালীন ভারত, খণ্ড-২, কে পি বাগচি অ্যান্ড কোম্পানি, তৃতীয় সংস্করণ, কলকাতা, ২০০৯।
৮৩. শ্রীরাম শর্মা, রিলিজিয়াস পলিসি অফ দ্য মুঘল এম্পাররস, প্রাগুক্ত, পৃ. ৬০ – ৬২।
৮৪. শ্রীরাম শর্মা, রিলিজিয়াস পলিসি অফ দ্য মুঘল এম্পাররস, প্রাগুক্ত, পৃ. ৬২।
৮৫. শ্রীরাম শর্মা, রিলিজিয়াস পলিসি অফ দ্য মুঘল এম্পাররস, প্রাগুক্ত, পৃ. ৬২ – ৬৩।
৮৬. কমিশারিয়েট, হিস্টরি অফ গুজরাট ১৫৭৩-১৭৫৮, খণ্ড-২, ওরিয়েন্ট লংম্যান, ১৯৫৭, পৃ. ২৫৫-৬৬। অন্যান্য মুঘল সম্রাট অর্থাৎ বাবর, আকবর, শাহজাহান ও ঔরঙ্গজেব প্রমুখদের প্রশাসনে অমুসলিমদের অংশগ্রহণ ও তাদের মন্দির নীতি সম্বন্ধে বিস্তারিত জানতে হলে পড়তে হবে আমারই বিভিন্ন প্রবন্ধ। যেমন- সম্রাট বাবর ও তার ধর্মনিরপেক্ষতা, মধ্যযুগের ভারত : ধর্ম রাষ্ট্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা, সম্রাট আকবরের ধর্মীয় নীতি ও ষােড়শ শতকের ভারতবর্ষ, বাদশাহ শাহজাহানের ধর্মনীতি:নব মূল্যায়ন, সম্রাট ঔরঙ্গজেব ও তার ধর্মীয় সহিষ্ণুতা প্রভৃতি গবেষণামূলক প্রবন্ধ।
৮৭. কলমচি, কালীঘাটের মন্দির জাহাঙ্গিরের দেওয়া জমিতে, কালান্তর, ৪ আগস্ট ২০০৭, কলকাতা।
৮৮. গৌতম ভদ্র, মুঘল যুগে কৃষি অর্থনীতি ও কৃষক বিদ্রোহ, সুবর্ণরেখা, কলকাতা, ১৪২০, পৃ. ৩০। বিস্তারিত দেখুন-কালীকিঙ্কর দত্ত, সাম ফরমানস, সনদস অ্যান্ড পরওয়ানাস ১৫৭৮-১৮০২, খণ্ড-২, পাটনা, ১৯৬২। আরও দেখুন-জ্ঞানচন্দ্র, জার্নাল অফ পাকিস্তান হিস্টরিক্যাল সােসাইটি, ১৯৫৭, ১৯৫৮, ১৯৫৯।
৮৯. বি এন পাণ্ডে, ইসলাম অ্যান্ড ইন্ডিয়ান কালচার, বাংলা অনুবাদ- শান্তিময় রায়, ইসলাম ও ভারতীয় সংস্কৃতি, মল্লিক ব্রাদার্স, কলকাতা, ১৯৯৪, পৃ. ৪০-৪১।