লিখেছেনঃ মুহাম্মাদ আব্দুল আলিম
আকবরের ধর্মচিন্তা ধর্মচিন্তা নিয়ে আলোচনা করতে গেলে বেশ কয়েকটি বিষয় আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে পড়ে। সম্রাট আকবরের ধর্মভাবনার দুটি দিক – একটি হলো তার ব্যক্তিগত বিশ্বাস, অপরটি হলো তার রাষ্ঠনীতি, এই দুটি ধারার মধ্যে ঘনিষ্ট যোগাযোগ আছে। আকবরের ধর্মভাবনার ওপর তুর্ক – মুঘল ঐতিহ্য, ভক্তিবাদী সন্ত ও সুফি দর্শন এবং এর সাথে আকবরের কিছু নিজস্ব অন্তর্মুখী অনুসন্ধিৎসু মনের প্রভাব পড়েছিল। সুফিদের দর্শনের দ্বারা আকবর বেশ প্রভাবিত হয়ে পড়েছিলেন। অধ্যাপক আতহার আলীর ভাষ্য অনুযায়ী, আকবর পয়গম্বরের মতো প্রথাগত ধারায় তিনি ছিলেন নিরক্ষর, কিন্তু উচ্চতর চিন্তা, নীতি ও শিল্প – সাহিত্যের রস্বাসদনে তার কোন ঘাটতি ছিল না। (সুলহ – ই – কুল এবং আকবরের ধর্মীয় ভাবনা, পৃষ্ঠা – ৮২)
আকবরের পুর্বপুরুষদের মধ্যে ধর্মচিন্তার বীজ নিহিত ছিল। বাবরের আত্মজীবনী পড়লে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে তিনি ছিলেন একজন উদার প্রকৃতির মানুষ। পিতা হুমায়ুন ছিলেন ধৈর্যশীল ও ভাবুক প্রকৃতির, মাতা হামিদাবানু ছিলেন উদার ও ধর্মপ্রাণা। তাই আকবরের ধর্মচিন্তা ছিল পুর্বপুরুষদের প্রভাব ও প্রতিফলনের ফল। যেমন –
- ১) আকবর চেঙ্গিজ খানের উদার, সর্ববাদী আদর্শ দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। চেঙ্গিজ খানের জীবনীকার জুবাইনী লিখেছেন, তিনি (চেঙ্গিজ খান) ধর্মান্ধতা ত্যাগ করে সর্বধর্মকে সম্মান করতেন। (Chingiz eschewed bigotry and preference of one faith to another, placing some over others)। তৈমুর ও তাঁর বংশধররা ধর্মীয় সহনশীলতার নীতি অনুসরণ করেন, তিনি শিয়াদের উপর কোনদিন অত্যাচার ও নিপীড়ন করেন নি। খ্রীষ্টান ও পৌত্তলিকরা তাঁদের শাসন ও সৈন্যবাহিনীতে স্থান পেয়েছিল।
- ২) আকবরের পারিবারিক সম্পূর্ণভাবে ধর্মীয় সংকীর্ণতার উর্ধে ছিল। পিতা হুমায়ুন সুফিবাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। মাতা হামিদাবানু ছিলেন উদার ও ধর্মপ্রাণা। ধর্মান্ধতা তাঁদের মনে স্থান পায়নি। আকবরকে পিতা – মাতার এই ধর্মীয় উদার দৃষ্টিভঙ্গি সর্বদায় আকৃষ্ট করত। আকবরের বাল্যকাল ছিল পরিচিত ও প্রশস্ত। তিনি তুর্কী, মুঘল, আফগান, পারসিক নানা জাতির মানুষের সাথে মিশে তাঁর মধ্যে এক উদার মানবিক চিন্তার জন্ম হয়েছিল।
- ৩) ধর্ম ও দর্শন আলোচনা বাল্যকাল থেকেই আকবরকে আকৃষ্ট করত। বৈরাম খান যখন অভিভাবক ছিলেন তখন তিনি প্রচুর সাধু ও ফকিরদের সাথে মেলামেশা করার সুযোগ পেয়েছিলেন। সাম্রাজ্যভার হাতে নেওয়ার পরেও এই প্রভাব তাঁর মধ্যে সমানভাবে দেখা যায়। তাই সাফল্যলাভের আশায় তিনি বার বার ছুটে যেতে বিভিন্ন পীর – ফকির – দরবেশদের আস্তানায়।
- ৪) আকবরের শিক্ষাগুরুদের প্রভাবও তাঁর ধর্মনীতি গ্রহণে বিশেষ ভুমিকা রাখে। তাঁর অন্যতম শিক্ষক আব্দুল লতিফ আকবরকে মরমী সাধনার প্রতি আকৃষ্ট করে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন।
রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও বৌদ্ধিক ক্ষেত্রে হিন্দু ও মুসলমান পরস্পরের কাছে এসেছিল। কবীর, গুরু নানক ও অন্যান্য যেসব ভক্তিবাদী সাধু – সন্তরা ছিলেন তাঁরা জাতিভেদপ্রথা, পুরোহিততন্ত্র ও প্রচলিত ধর্মশাস্ত্রের চরম বিরোধীতা করেন। অনুরুপ চিশতি ও কুব্রাবিয়া সম্প্রদায়ের সুফিরা বিভিন্ন ধর্মের মানুষকে সমীহ করতেন ও আশ্রয় দিতেন, ফলে সকলেই তাঁদের শ্রদ্ধা করত। সুফিদের খানকায় হিন্দি ভক্তিমূলক গান গাওয়া হত এবং সেসব গানে রাধা – কৃষ্ণের কাহিনীও স্থান পেত। গুজরাট, মালব ও কাশ্মীরে হিন্দুরা উচ্চপদে অধিষ্ঠিত হয়েছিল। লোদীদের আমলে হিন্দু রাজারা আমীর পদে উন্নীত হয়েছিলেন। ইব্রাহীম লোদীর প্রধানমন্ত্রী ছিলেন হিমু। তাই আকবর এই পরধর্ম সহিষ্ণুতা উত্তরাধীকার সূত্রে পেয়েছিলেন যা তার পরধর্মচিন্তা ও রাষ্ট্রনীতিকে প্রভাবিত করেছিল।
আকবরের এই বিবর্তনকে তিনটি স্তরে বিভক্ত করা যায়। প্রথম স্তর (১৫৫৬ – ৭৩), দ্বিতীয় স্তর (১৫৭৩ – ৮০), তৃতীয় স্তর (১৫৮০ – ১৬০৫)।
জীবনের প্রথম পর্বে আকবর আর্থিক ক্ষতিস্বীকার করে হিন্দুদের ওপর স্থাপিত তীর্থ কররের বিলোপ সাধন করেন। আগে বিদ্রোহী গ্রামের শিশু ও মহিলাদের ক্রীতদাস দাসী হিসেবে বিক্রি করা হতো, আকবর এই অমানবিক প্রথাকেই উচ্ছেদ করেন। স্বয়ং আকবর রাজপুত মহিলাদের বিবাহ করলেও তাদেরকে কোনদিন ধর্মান্তরিত করেন নি বরং স্বাধীনভাবে নিজ নিজব ধর্ম পালনের পূর্ণ অধিকার দেন। আকবরের সভাসদদের সব থেকে প্রিয়পাত্র বীরবল অভিযানের সময় তার আরাধ্য দেবতার মূর্তিগুলো সঙ্গে নিয়ে যেতেন, আকবর কোনদিন তাঁকে বাধা দেননি। আকবর রক্ষণশীন উলামাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন, তা সত্ত্বেও তাঁর রাষ্ট্রনীতির মধ্যে উদারনীতির প্রতিফলন ঘটেছিল। তিনি হিন্দুদের সাথে আপসের নীতি গ্রহণ করেছিলেন। সমগ্র ভারতবর্ষে শান্তি ও ঐক্য প্রতিষ্ঠার রাজনৈতিক প্রয়োজনের কথা চিন্তা করেই আকবর এসব পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। আকবর ১৫৬৪ খ্রীষ্টাব্দে হিন্দুদের উপর আরোপিত জিজিয়া করের বিলোপসাধন করেন। আবুল ফজল লিখেছেন, উলামাদের বিরোধীতা সত্ত্বেও আকবর এই সিদ্ধান্ত নেন (Much chatter on the part of the ignorant i.e. the Ulema)। আকবর জানিয়েছিলেন যে হিন্দুরা রাষ্ট্রের সম্প্রসারণে আগ্রহী, সেবা ও আন্তরিকতায় কোন অভাব নেই।
প্রথম পর্বে ব্যক্তিগতভাবে আকবর ছিলেন গোঁড়া সুন্নী মুসলমান। তিনি নিয়মিতভাবে নামাজ পড়তেন, নিজের হাতে মসজিদ পরিস্কার করেন। হেজাজের দরিদ্র মানুষদের মধ্যে বিতরণের জন্য তিনি হজ্জযাত্রীদের সঙ্গে ছয়লক্ষ টাকা পাঠিয়েছিলেন। এই পর্বে আকবর তার দরবারের দুই প্রধান আব্দুল্লাহ সুলতানপুরি ও শেষ আব্দুন নবীর অনুরক্ত ছিলেন। আব্দুল্লাহ সুলতানপুরি ছিলেন একজন প্রসিদ্ধ আলেম। বৈরাম খানের পতনের পর তিনি দরবারের প্রাধান্য লাভ করেন এবং মখদুম – উপ – মুলক উপাধী অর্জন করেন। আব্দুন নবী ছিলেন এক পণ্ডিত ছিলেন পরিবারের একজন বিদ্বান ধর্মতত্ত্ববিদ। উজির মুজাফফার খানের পরামর্শ অনুযায়ী আকবর তাঁকে সদর নিযুক্ত করেন। আকবর তাঁর কাছ থেকে কুরআন ও হাদীসের ব্যাখ্যা শুনতেন। আকবর মানসিকভাবে, উদার, সর্বধর্মসমন্বয়ী, সহনশীল ধর্মনীতির জন্য প্রস্তুত হয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর দরবার ছিল রক্ষণশীলদের প্রভাবাধীন।
দ্বিতীয় পর্বে (১৫৭৩ – ৮০) ধর্ম নিয়ে আলোচনা চলেছিল, গভীর নির্জনে তিনি ধর্মসাধনায় মগ্ন হতেন। এই পর্বে রাষ্ট্রনীতির ওপর এর গভীর প্রভাব পড়েছিল। এই পর্বে আকবর উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক সাফল্যলাভ করেন। উজবেক অভিজাতদের বিদ্রোহ দমন করেন, মালব, রাজস্থান ও গুজরাটে তিনি সামরিক সাফল্য লাভ করেন। আকবরের মধ্যে এই ধারণা জন্মেছিল তিনি হলেন ঈশ্বরের মনোনীত ব্যক্তি (Chosen instrument of God for unifying India under his command)। ভারতকে ঐক্যবদ্ধ করে শান্তি ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা হলো তার রাজনৈতিক লক্ষ্য। এই পর্বে বাদায়ুনীর রচনায় আকবরের মানসিকতার প্রতিফলন ঘটেছে। বাদায়ুনীর ভাষ্য অনুযায়ী, সম্রাটের কোন প্রতিদ্বন্দী নেই, তিনি সন্ত ও মুইনিয়া সম্প্রদায়ের লোকদের সঙ্গে পরামর্শ শুরু করেন, কুরআন ও হাদীস আলোচনা করেন (Question of Sufism, scientific enquiries into philosophy and law were order of the day)। উদারনৈতিক সুফি চিন্তাবিদ মাওলানা জালালুদ্দীন রুমির মসনবী শরীফ শুনতে তিনি ভালবাসতেন। মইনুদ্দীন ও অন্যান্য সুফি সন্তদের মাজারে তিনি শ্রদ্ধা জানাতে যেতেন।
১৫৭৫ খ্রীষ্টাব্দে আকবর ফতেপুর সিক্রিতে তার প্রাসাদের কাছেই ইবাদতখানা বা উপাসনালয় স্থাপন করেন। এর আগে এখানে সুফি দরবেশ শেখ আব্দুল্লাহ নিয়াজীর খানকা ছিল। এখানে ধর্ম নিয়ে আলোচনা হত। দুটি কারণে এই ধরণের আলোচনা হতো। কৌতুহলী মানুষের কৌতুহল নিবৃত্ত করা এবং অন্যধর্মের ওপর ইসলামের শ্রেষ্ঠত্য প্রতিপন্ন করা ছিল এ ধরণের আলোচনার লক্ষ্য। উম্মীয়, আব্বাসীয় শাসক ও সদ্য ধর্মান্তরিত ইলখানিদ মোঙ্গল শাসকরা এ ধরণের আলোচনার ব্যবস্থা করতেন। হেরাতের তৈমুর বংশীয় শাসক এ ধরণের আলোচনার ব্যবস্থা করেছিলেন। আকবর শুনেছিলেন বাংলার আফগান সুলতান সুলেমান কারনানী শেখ ও উলামাদের সঙ্গে আলোচনা করেন। প্রথমে ইবাদতখানা শুধু মুসলিম ধর্মতত্ত্ববিদরা শুধু আলোচনা করতেন, প্রত্যেক বৃহস্পতিবার রাত্রে আকবর এদের আলোচনা শুনতেন। আকবরের শয়নকক্ষেও ধর্মজ্ঞ ব্যক্তিরা গিয়ে তাঁকে ধর্মের কথা শোনাতেন। আকবর ধর্মজ্ঞদের বলেছিলেন যে তার উদ্দেশ্য হলো সত্যকে জানা (to ascertain the truth and discover the reality)। কিন্তু তিনি দেখলেন যে উলামাদের উদ্দেশ্য হলো অন্যরকম। ধর্মের কোনো বিষয়ে তাঁদের মতের মিল ছিল না, নিজ নিজ সম্প্রদায়ের শ্রেষ্ঠত্য প্রমাণ করার জন্য তারা ব্যস্ত ছিলেন, বিরোধীদের দমন করার দিকে তাদের দৃষ্টি ছিল।
আকবর নিজে অতীন্দ্রিয়বাদী ছিলেন। ১৫৭৮ খ্রীষ্টাব্দে অতীন্দ্রিয়বাদী এক অভিজ্ঞতার পর আকবর ইবাদতখানার আলোচনা সকলের কাছে উন্মুক্ত করে দেন। হিন্দু, জৈন, পারসিক ও খ্রীষ্টান পাদ্রীরা ধর্ম নিয়ে আলোচনার জন্য ইবাদতখানায় এসেছিলেন। হিন্দুপণ্ডিত পুরুষোত্তম ও দেবী, জৈন গুরু হরিবিজয় সুরি, বিজয়ব সেন সুরি ও ভানুচন্দ্র উপাধ্যায়, খ্রীষ্টান পাদ্রী ফাদার রুডালফো, আকোয়া ভিভা ও এন্টনি মনসেরাট এবং জরাথুষ্ট ধর্মের পণ্ডিত দস্তুর মাহিয়ারজি রাণা আকবরের সঙ্গে ধর্ম আলোচনায় যোগ দেন। ইবাদতখানার আলোচনা থেকে নানা বিভ্রাবতির সৃষ্টি হয়। আর পি ত্রিপাঠি লিখেছেন যে সহনশীলতা বাড়েনি, বরং অসহিষ্ণুতা বেড়েছিল (Instead of bringing credit, the Ibadat Khana brought growing discredt)। আকবরের ইবাদতখানার অসারতা উপলব্ধি করে বন্ধ করে দেন (১৫৮১)।
আকবরের চেয়েছিলেন আলোচনার মাধ্যমে ধর্মতত্ত্ববিদরা তাদের দৃষ্টিভঙ্গির ব্যবধান কমিয়ে আনবেন, কিন্তু তা সম্ভব হয়নি। এরা ব্যবধান বজায় রাখতে এবং নিজ নিজ ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। যদি আকবর নিজে সত্য উপলব্ধির কথা ভেবে থাকতেন তাহলে ব্যবক্তিগত আলোচনার মাধ্যমেই তা করতে পারতেন। (If Akbar’s object was to himself arrive at an understanding of the fundamentals of all religions, he could have done so by means of private discussions)। তবে ইবাদতখানার আলোচনা থেকে কোন লাভ হয়নি এমন নয়, এই আলোচনা থেকে আকবর উপলব্ধি করেন যে সব ধর্মের মধ্যে সত্য আছে, সব পথেই ঈশ্বর উপলব্ধি ঘটে। (All religions had elements of truth, and that all of them led to the same supreme reality)। এই ধারণা থেকে আকবর ক্রমশ সুল – ই – কুল মতাদর্শের দিকে এগোতে থাকেন।
ইবাদতখানার আলোচনা বন্ধ হলেও আকবর তার সত্যানুসন্ধান থেকে বিরত হননি। তিনি কিছু নির্বাচিত ব্যক্তিকে আমন্ত্রণ করে ধর্মোপদেশ নিতেন। আলাপ – আলোচনার মধ্য দিয়ে আকবরের সমন্বয়বাদী দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠে, ধর্মের মর্ম বোঝা তার পক্ষে সহজ হয়। আকবরের ধর্মচিন্তার ওপর খ্রীষ্টান, হিন্দু, জৈন ও জরাথুষ্ট ধর্মের প্রভাব পড়েছিল। শিখ গুরুদের উদার মানবতাবাদ ও ঈশ্বরপ্রেম তাঁকে মুগ্ধ করেছিল। খ্রীষ্ঠান পাদ্রীরা তাঁকে খ্রীষ্টান ধর্মতত্ত্ব ও সাধনার সঙ্গে পরিচিত করেন। তবে খ্রীষ্টানদের ত্রিত্ববাদ ও অবতারত্ত্ব তাঁর পছন্দ হয়নি, অন্যধর্মের প্রতি অসহিষ্ণুতা তাকে ব্যথিত করেছিল। পারিবারিক সূত্রে তিনি হিন্দুধর্ম ও তার আচার – আচরণের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। হিন্দুধর্মের কর্মফল ও জন্মান্তরবাদ তঁকে প্রভাবিত করেছিল। জৈন গুরুদের কাছ থেকে তিনি পেয়েছিলেন অহিংসা ও সর্বপ্রাণীর প্রতি করুণা। দেশের মধ্যে প্রাণীহত্যা তিনি কমিয়ে দেন, নিরামিশ আহার গ্রহণ করেন। পার্সিদের সূর্য ও আলোকের উপাসনার দ্বারা আকবর প্রভাবিত হন। পারসিদের প্রভাবে নৌরোজ উৎসব, এলাহী বছর, ঝরোকাদর্শন প্রভৃতি প্রবর্তন করেন।
অধ্যাপক আতহার আলীর ভাষ্য অনুযায়ী, ঈশ্বর সম্পর্কে আকবরের ধারণা সর্বেশ্বরবাদ দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত ছিল। ‘এক হৃদয় মাতানো সৌন্দর্য সহস্র অন্তরালোকে আলোকিত করে।’ ১৫৭৯ খ্রীষ্টাব্দে আকবর ‘মজহর’ ঘোষণার মধ্যমে নূতন মর্যাদার অধিকারী হল। নিজামউদ্দীন আহমেদের ‘তাবাকাত –ই – আকবরী’ এবং বাদায়ুনীর ‘মুনতাখাবুত তাওয়ারিখ’ এ এই ঘোষণার মূল পাঠ রক্ষিত আছে। শেখ আব্দুন নবী, আব্দুল্লাহ সুলতানপুরি ও শেখ মুবারক সহ সাতজন উলামা এই ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করেন। আকবরের ‘মজহর’ ঘোষণা নিয়ে নানা বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। ভিনসেন্ট স্মিথ বলেন, পোপকে অনুসরণ করে এই অমোঘ ঘোষণা জারি করে তিনি নিজের ধর্মীয় কর্তৃত্ব বৃদ্ধি করেন (Akbar had conferred upon himself the attributes of infallibility)। অন্যরা বলেছেন, উসমানিয়া খলিফা ও ইরানের শিয়া শাসকদের প্রভাব থেকে মুক্ত হবার জন্য আকবর এই ঘোষণা করেন। পাকিস্তানি ঐতিহাসিকদের কয়েকজন বলেছেন এটি হলো একটি ‘অসৎ দলীল’ (Dishonest document), নিরক্ষর আকবর ধর্মীয় আইন ব্যাখ্যার দায়িত্ব নিজের হাতে তুলে নিয়েছিলেন।
এই ঘোষণায় লেখা হয় যে, আকবর হলেন ইসলামের সুলতান, বিশ্বাসীদের নেতা এবং ঈশ্বরের প্রতিনিধি (Akbar was the Sultan of Islam, the asylum of mankind, the commender of the faithfull, the shadow of God over worlds)। খলিফারা এই ধরণের উপাধী নিতেন, তৈমুর বংশীয় শাসকরা খলিফাদের কর্তৃত্ব মানতেন না, তাদের প্রভাবমুক্ত হবার প্রশ্ন ওঠে না। কুরআন ও হাদীস উদ্ধৃত করে দাবি করা হয় যে বিজ্ঞ ও ন্যায়পরায়ণ শাসক হিসেবে আকবর জনগণের আনুগত্যের অধিকারী। ভবিষ্যতে ধর্মীয় আইনের ব্যাখ্যা নিয়ে কোন বিবাদ দেখা দিলে সম্রাট জনগণ ও শাসনের স্বার্থে চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন। (for the welfare of mankind and proper functioning of the administrative affairs of worlds)। কুরআন ও হাদীস বিরোধী নয় এমন সব বিষয়ে সম্রাটের আদেশদানের অধিকার ছিল সর্বজনস্বীকৃত। সুতরাং ‘মহজর’ ঘোষণা অভিনব ছিল বলা যায় না। গিয়াসুদ্দীন বলবন ও আলাউদ্দীন খিলজী প্রয়োজনীয় আইন জারি করার অধিকার দাবি করেছিলেন। ইবাদতখানায় আলোচনায় আকবর দেখেছিলেন যে উলামারা কোন বিষয়ে একমত নন, প্রত্যেকটি বিষয়ে তাঁদের মধ্যে অমিল রয়েছে।
মথুরার এক ব্রাহ্মণের বিরুদ্ধে মসজিদের মশলাপত্র দিয়ে মন্দির নির্মাণ এবং পয়গম্বরের নিন্দার অভিযোগ উঠেছিল। রক্ষণশীল উলামা আব্দুন নবী তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেন, আকবর তা পছন্দ করেন নি। আকবর ও রক্ষণশীলদের মধ্যে ব্যবধান বাড়তে থাকে। আব্দুন নবী একজন আফগান ও শিয়াকে মৃত্যুদণ্ড দেন। এই সময় শেখ মুবারক আকবরকে বলেছিলেন যে আপনি হলেন ইমাম এবং শাস্ত্রের ব্যাখ্যাকার ‘মুজতাহীদ’, উলামাদের পরামর্শের কোন প্রয়োজন নেই। আকবর ধর্মতত্ত্ববিদদের সঙ্গে আলাপ – আলোচনার পর ‘মহজর’ ঘোষণা করেন। বাদায়ুনী বলেছেন, কয়েকজন স্বেচ্ছায় স্বাক্ষর দিয়েছিল, কয়েকজন দিয়েছিল ইচ্ছার বিরুদ্ধে। আকবর নিজেকে ‘মুজতাহীদ’ বলে দাবি করেননি, তবে শাস্ত্রের বিভিন্ন ব্যাখ্যার মধ্যে জনস্বার্থে একটিকে গ্রহণ করার অধিকার দাবি করেন। সুতরাং কিছু ঐতিহাসিকের মতে ‘মহজর’ কিছুতেই ‘অসৎ দলীল’ নয়, বরং রাষ্ট্র ও ধর্মীয় আইনের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানের প্রয়াস (It appears to be a major constructive effort, fully in comformity with the Islamic law and providing a basis for the adjustment of temporal government and the shariat)। তবে এই আইনের সীমাবদ্ধতা আকবর মানেননি বলে পাকিস্তানি ঐতিহাসিকরা অভিযোগ করেছেন, এজন্য তিনি নিরঙ্কুশ স্বৈরাচার প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন।
এস এ এ রিজভির ভাষ্যমতে, ‘মহজর’ ঘোষণার আসল তাৎপর্য হলো এর মধ্যে পাওয়া যায় তার সুল – ই – কুল আদর্শের প্রধান বৈশিষ্ঠ্যগুলি। আকবর এগুলিকে কার্যকরী করার সিদ্ধান্ত নিলে রক্ষণশীলদের সঙ্গে তাঁর বিচ্ছেদ ঘটে যায় (It was the first effective deelaration of the principle of Sulh – I – Kul which he had decided to implement firmly)। মহজরের আন্তর্জাতিক তাৎপর্য ছিল বলে সতীশচন্দ মনে করেন। উত্তর ভারতে সাম্রাজ্য স্থাপন করে আকবর পশ্চিম এশিয়ার শক্তিশালী শাসকদের (তুরস্কের সুলতান ও পারস্যের শাহ) জানাতে চেয়েছিলেন যে তিনি তাদের সমকক্ষ। হিন্দুস্তানে শান্তি, নিরাপত্তা ও স্বাচ্ছন্দ্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বিদেশের (ইরাক, ইরান) বহু ধর্মজ্ঞ ও বিদ্বান ব্যক্তি এখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। সম্রাট সকলের প্রতি ন্যায়বিচার করবেন, রাষ্ট্রযন্ত্র জনকল্যানের জন্য কাজ করে যাবে। মহজর ঘোষণার জন্য উলামা সম্প্রদায় বিভক্ত হয়ে পড়েনি, তারা আগেই নানাভাবে বিভক্ত ছিল।
মুঘল শাসকরা ধর্মজ্ঞ, বিদ্বান ব্যক্তি, দাতব্য প্রতিষ্ঠান ইত্যাদিকে নিষ্কর ভূমি মিলক, মাদাদিমাস বা সয়ুরগল অনুদান দিতেন। এগুলি তদারকির দায়িত্ব ছিল ‘সদরের’। সাধারণত মুসলমানরা এসব অনুদান ভোগ করত, অমুসলমানরাও বাদ যেত না। হিন্দু রাজা ও অভিজাতরা অমুসলমানদের এ ধরণের অনুদান দিতেন। ১৫৬৫ খ্রীষ্টাব্দে শেখ আব্দুন নবী সদর পদ পান। সদর হওয়ার পর তিনি দুটি পরিবর্তন ঘটিয়েছিলেন। তিনি আফগানদের প্রদত্ত মাদাদিমাস অধিগ্রহণ করেন এবং শুধু তার অনুমোদিত ব্যক্তিরাই এই অনুদান পেত। আকবরের কঠোর সমালোচক বাদায়ুনী জানিয়েছেন যে আব্দুন নবীর কাজকর্মের ফলে মাদাদিমাস ভোগীরা দুর্দশার মধ্যে পড়েছিলেন, তবে অস্বীকার করা যায় না যে এর ফলে রাষ্ট্রের খাস জমির পরিমান পেড়েছিল। মাদাদিমাস গ্রহীতাদের জমিগুলিকে তিনি একত্র করার অনুমতি দেন, এতে তদারকির কাজ সহজ হয়েছিল। এই পর্বে আকবর সদরের কাজকর্মে হস্তক্ষেপ করেননি। বাদায়ুনী লিখেছেন যে আব্দুন নবী এত নিষ্কর জমি ও পেনসন বিলিয়েছিলেন যা আর কোন সদর – উস – সুদুর পারেননি (Never was there in the reign of any monarch a sadr – us – sudur so powerful as Shaikh Abdun Nabi)। সদরের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল, আকবর নিজেই অভিযোগগুলি তদন্ত করে অনুদান কমিয়ে দেন। অনুগৃহীতদের তিনি বানিজ্য ও অন্যান্য পেশায় অর্থ উপার্জনে উৎসাহ দেন। ১৫৮০ খ্রীষ্টাব্দে আকবর সুবাগুলি গঠন করে প্রত্যেক সুবায় একজন করে সদর নিযুক্ত করেন। সদর – উস – সুদুরের ক্ষমতা হ্রাস পায়। ছটি সার্কেলে দেশটি ভাগ করে প্রতিটি সার্কেলে তিনি একজন করে সুপারভাইজার নিযুক্ত করেন। চাষের সম্প্রসারণ ঘটানোর জন্য ১৫৮৯ খ্রীষ্টাব্দে তিনি মাদাদিমাসের অর্ধাংশ জমি এবং বাকি অর্ধাংশ আবাদযোগ্য জমিতে দেন। এসব নিষ্করভূমি সাধারণত মুসলমানদের দেওয়া হতো। ১৫৭৫ খ্রীষ্টাব্দের পরে আকবর দরিদ্র দীন – হীন, বিদ্রোহী এমনকি হিন্দুদের মাদাদিমাস দেন (The mean, the rebel and even to Hindus)। বাদায়ুনী এ ধরণের উক্তি করেছেন। ১৫৮০ খ্রীষ্টাব্দের পর নিষ্কর জমির অনুদান হিন্দু, জৈন ও পার্সিদের দেওয়া হয়। জেসুইটরা চার্চ নির্মাণের জন্য অনুদান লাভ করেছিল। সাধু, সন্ত ও সন্যাসীদের জমির প্রয়োজন ছিল না, আকবর তাদের আর্থিক অনুদান দেন। আকবর ফতেপুর সিক্রিতে হিন্দু, মুসলমান ও যোগীদের খাদ্য সরবরাহের জন্য তিনটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন – ধর্মপুর, খয়েরপুর ও যোগীপুর। গোঁড়া রক্ষণশীলদের প্রভাবমুক্ত হয়ে আকবর সব ধর্মের মানুষদের মধ্যে রাষ্ট্রীয় অনুদান বিলিয়েছিলেন। (Akbar opened the doors of the state for more equitable distribution of its patronage to all section irrespective of their faiths)। মাদাদিমাস দানের ওপর তিনি নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করে যোগ্যদের রেখে দেন, অযোগ্যদের বিতাড়িত করেন। (তথ্যসূত্রঃ মোগল সাম্রাজ্য থেকে ব্রিটিশরাজ, সুবোধ কুমার মুখোপাধ্যায়, পৃষ্ঠা – ৭৯ – ৮৫)
[২]
ইমামে রাব্বানী হযরত শায়েখ আহমদ ফারুক সেরহিন্দ মোজাদ্দেদ আলফেছানি (রাঃ) ছিলেন দ্বিতীয় সহস্রাব্দের মোজাদ্দেদ বা সমাজ সংস্কারক।
তিনি ১৪ই শাওয়াল ৯৭১ হিজরিতে ভারতের সেরহিন্দ শহরে জন্ম গ্রহন করেন। তিনি আকবর ও জাহাঙ্গীর দুই অত্যাচারী ইসলাম বিরোধী সম্রাটের মধ্যবর্তী সময়ে মোজাদ্দেদ হিসাবে আত্নপ্রকাশ করেন। সম্রাট আকবর ছিলেন ইসলাম ধর্মের ঘোর বিরোধী। তার শাসনামলে মোসলমানদের দুরবস্হার কোন সীমা ছিল না। সম্রাট আকবর ইসলাম ধর্মের পরিবর্তে নতুন এক ধর্মের প্রবর্তন করেন। ইহা ছিল স্পষ্টতই এক কুফরী ধর্ম অথচ এই নতুন ধর্মের নাম দেওয়া হলো ‘দ্বীন-ই-ইলাহী’ ।
আকবরের প্রণীত এই এক পক্ষের কাছে দারুনভাবে প্রশংসিত আর অপর পক্ষের কাছে তা নিরেট ভণ্ডামি ও আবর্জনার মত পরিতাজ্য। এই ধর্মের মাধ্যমেই আকবর স্বধর্মের নিপাত সাধনের এক সুগভীর চক্রান্ত ফেঁদেছিলেন বলে বহু ঐতিহাসিক মত প্রকাশ করেছেন।
এই নতুন ধর্মের প্রধান উপাদান ছিল সূর্যের উপাসনা করা। বাদশাহ প্রভাতে, দ্বিপ্রহরে, সন্ধায় ও অর্ধরাত্রে বাধ্যতামূলকভাবে সূর্য পূজা করিতেন। তিনি তিলক লাগাতেন ও পৈতা পরতেন। সূর্যদয়ের সময় ও মধ্যরাত্রিতে নহবত ও নাকাড়া বাজান হতো। এই নতুন ধর্মে সূর্যের নাম উচ্চারনকালে ‘জাল্লাত কুদরাতুহু’ বলা হতো। বাদশাহ বিশ্বাস করতেন যে, সূর্য বাদশাহ গনের অভিবাবক ও হিতাকাঙ্খী। তিনি তাই হিন্দুদের কাছ থেকে সূর্যকে বশীভূত করার মন্ত্র শিখেছিলেন। মাঝরাত্রে ও ভোরে তিনি এই মন্ত্র পাঠ করতেন। শিবরাতে তিনি যোগীদের আসরে সমস্ত রাত্রি বসে থাকতেন এবং বিশ্বাস করতেন যে, ইহাতে আয়ু বৃদ্ধী পায়।
পারসিক ধর্মগুরুরাও আকবরের ইবাদত খানায় আগমন করতো। তাদের মাধ্যমে আকবর আগুন পুজা, শিখা অনির্বাণ প্রজ্বলিত করার নির্দেশ দেয়। এবং সূর্য পুজা শুরু করে” (মুন্তাখাবুত তাওয়ারিখ)
ঐতিহাসিক বাদায়ুনী বলেন, আকবর প্রদীপ জ্বালানোর সময় দন্ডায়মান হয়ে শ্রদ্ধা জ্ঞপন করে সভাসদদের জন্য বাধ্যতামূলক করে।”
‘ব্রাক্ষ্মদান’ নামক জনৈক ব্রাক্ষ্মনকে বাদশাহ রাজকবি নিযুক্ত করেন। ইতিহাসে তিনিই ”বিরবল” নামে পরিচিত । তারই পরামর্শে ‘দেবী’ নামক জনৈক হিন্দু দর্শনিক বাদশাহর সহিত মেলামেশা করার সুযোগ পায়। রাত্রিকালে বাদশাহর অন্দরমহলেও এই দার্শনিকের অবাধ যাতায়াত ছিল। বাদশাহ তাহার সহিত সাক্ষাৎ করার জন্য সর্বদা উদগ্রীব থাকতেন। এই দেবী ও গৌতম নামের জনৈক ব্রাক্ষ্মনের কাছ থেকে বাদশাহ মূর্তি, সূর্য, আগুন, ব্রক্ষ্মা, মহামায়া, বিষ্ণু, কৃষ্ণ ও মহাদেব পূজার কায়দা কানন শুনে বড়ই উৎফুল্ল হতেন এবং এইসব গ্রহনও করতেন। ইহা ছারা এই ধর্মে আগুন, পানি, গাছ, গাভী পূজা করা হত। নক্ষত্র পূজার ব্যাপারেও বাদশাহ অত্যধিক বাড়াবাড়ি করতেন। হিন্দুদের পুনর্জন্মবাদে বিশ্বাস করাও ছিল এই ধর্মের কর্তব্য। হির বিজয় সূরী নামক জনৈক সাধুকে বাদশাহ ‘জগৎগুরু’ উপাধি দেন। সম্রাট আকবর হিন্দুদের পূনর্জন্মবাদে বিশ্বাস করতেন। মৃত্যুর পর তিনিও পুনরায় অন্য কোন সিংহাসনে আরোহন করবেন বলে বাদশাহ বিশ্বাস করতেন। ব্রাক্ষ্মনগন তাকে বুঝিয়ে দিয়েছিল যে, শক্তিশালী বাদশাহর শরীরে আত্নার জন্ম হয় এবং কামেল মণীষীগনের আত্না মৃত্যুর সময় মস্তকের তালু দিয়া বাহির হয়ে যায়। এই ধারনার বশবর্তী হয়ে তিনি মাথার তালুর চুল কামাইয়া ফেলিতেন এবং মস্তকের চারিদিকে চুল রেখে দিতেন। বাদশাহ জৈন সাধুদের যথেষ্ট প্রভাবিত হয়েছিলেন। সাধু সঙ্গ লাভের পর হতে তাহার নিকট সব সময় এমনকি ভ্রমনের সময়েও একজন জৈন সাধু থাকত। ”হির বিজয়সুরী” নামক এক সাধুকে তিনি ‘জগৎগুরু’ উপাধী দিয়েসিলেন। নন্দা বিজয়সূরী নামক এক সাধুকে তিনি ‘খশফহম’ উপাধী দিয়েছিলেন। হির বিজয় সূরীকে খুশী করবার জন্য তিনি ধর্মপর্ব ‘পর্যুষনে’ বার দিন জীব হত্যা নিষিদ্ধ করবার ফরমান জারী করেছিলেন। জৈন ধর্ম অনুযায়ী বাদশাহ নিজেও মাংশ ভক্ষন ত্যাগ করেছিলেন। এ বিষয়ে বাদশাহ স্বয়ং সূরীজিকে এক পত্র প্রেরন করেন। উহাতে তিনি সূরীজি কর্তৃক কিরূপ প্রভাবিত হন তাহার পরিচয় পাওয়া যায়।
পত্রটি নিম্নরূপঃ
“আমি আপনার উপদেশ অনুযায়ী সম্পূর্নরূপে জীবহিংসা পরিত্যাগ করতে পারি নি। তবে আমি আগের চেয়ে এখন অনেক কম মাংশ আহার করি। আপনি হয়ত জানেন যে, আমি ফতেহপুর হতে আজমীর পর্যন্ত রাজপথের পার্শ্বে প্রতি একশ ক্রোশ পর পর একশত চৌদ্দটি স্তম্ভ নির্মান করেছি। ঐগুলি প্রায় ছত্রিশ হাজার হরিনের শিং দিয়ে সজ্জিত করেছি। ঐগুলি আমি নিজ হাতে শিকার করেছিলাম। আমি এত জীবের প্রান সংহার করেছি। আমার মতো পাপী কেহ নেই।ইহা ছাড়া আমি প্রতিদিন নানা প্রকার জীবের মাংশ সহ পাচশত চড়াই পাখীর জিহ্বা দ্বারা উদর পূর্তি করতাম। ঐ কথা ভাবিতে গেলেও এখন আমি আতংকিত হয়ে উঠি। আপনার শ্রীমুখের অমিয়বানী আমাকে মাংসাহারে অরুচি এনে দিয়েছে। এখন বৎসরে ছয়মাস বা ততোধিক সময় আমি মাংস আহার করি না।”
অগ্নিপূজকদের দ্বারাও বাদশাহ যথেষ্ট প্রভাবিত হয়েছিলেন। তাঁর আদেশে দরবারের সন্মুখে সর্বক্ষন অগ্নি প্রজ্জলনের ব্যাবস্হা করা হয়। ঘন্টাধ্বনি প্রভৃতি গ্রহন করা হয় খৃষ্টানদের নিকট থেকে। মোটকথা ইসলাম ছাড়া অন্য সব ধর্মই বাদশাহর চোখে সুন্দর মনে হত। তার চোখে সবচেয়ে সুন্দর মনে হতো হিন্দুধর্ম। তাই তার নতুন ধর্ম ‘দ্বীন-ই-ইলাহী’ বেশীর ভাগ উপাদানই হিন্দুধর্ম হতে গৃহীত হয়েছিল। তাই সঙ্গত কারনেই হিন্দু এবং রাজপুতদের নিকটই এই অদ্ভুত ধর্ম সমাদর লাভ করেছিল সবচাইতে বেশী। সম্ভবত বাদশাহ আকবেরর কাম্যও ছিল তাই। ‘দ্বীন-ই-ইলাহী’ র মূলমন্ত্র ছিল ‘লা ইলাহা ইল্লালাহু আকবারু খলিলুল্লাহ’ ”যারা নুতন ধর্মে দাখিল হত তাদেরকে এরূপ শপথ বাক্য উচ্চারন করতে হতো- ‘আমি অমুকের পুত্র অমুক এতদিন বাপ দাদাদের অনুকরনে ইসলাম ধর্মের উপর প্রতিষ্ঠত ছিলাম, এখন স্বেছ্ছায় ও সজ্ঞানে পূর্ব ধর্ম পরিত্যাগ করে ‘দ্বীন-ই-ইলাহী’ গ্রহন করছি এবং এই ধর্মের জন্য জীবন, সম্পদ ও সম্মান বিসর্জন দিতে প্রস্তুত আছি।’ ‘দ্বীন-ই-ইলাহী’ র লোকেরা চিঠিপত্রের শিরোনামে ‘আল্লাহ আকবর’ লিখিত এবং পরস্পরের সাক্ষাতের সময় সালামের পরিবর্তে একজন বলত ‘আল্লাহ আকবর’ এবং অপরজন এর জবাবে বলত ‘জাল্লাজালালুহু’। বাদশাহ তাদেরকে শিজরা স্বরূপ তাহার একখানি প্রতিকৃতি প্রদান করতেন। তারা বাদশাহর এই প্রতিকৃতি পরম শ্রদ্ধাভরে নিজ নিজ পাগড়ীতে বসিয়ে রাখত। বাদশাহ যে সব পুজাপর্বন করতেন অনুসারীগনকেও সেই সব করতে হত। উপরন্তু তাদেরকে বাদশাহকেও সেজদা করতে হত। ভন্ড সূফীদের সর্দার ‘তাজুল আরেফিন’ বাদশাহকে সেজদা করা ওয়াজেব বলে ফতোয়া দান করেন। এই সেজদার নাম করন করা হয় ‘জমিন বোছ’ (মাটি চুম্বন)। তিনি বলেন বাদশাহর প্রতি সন্মান প্রদর্শন করা ফরজে আইন এবং চেহারা কেবলায়ে হাজত ও কাবায়ে মুরাদ। ভারতের ভ্রষ্ট সূফীদের কার্যপ্রনালী দলীলরূপে খাড়া করে তিনি এর ব্যাখ্যা প্রদান করেন। সাধারন ব্যক্তিছাড়াও বিশিষ্ট আলেমগনও এই শেরেকি কার্যে অভ্যস্থ ছিলেন। এই নুতন ধর্মে সূদ ও জুয়া ছিল হালাল। খাছ দরবারে জুয়া খেলার জন্য একটি বিরাট অট্টালিকা নির্মান করা হয় এবং সব থেকে মজার কথা হল যেসব জুয়াড়ীদেরকে জুয়া খেলার জন্য পুঁজি বা মূলধন থাকত না তাদের রাজকোষ থেকে সুদের উপর ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা হত। মদ্যপান করাও হালাল সাব্যস্থা করা হয়। বাদশাহ স্বয়ং দরবারের নিকট একটি শরাবখানা খুলে দেন। নওরোজ অনুষ্ঠানে অধিকাংশ আলেম, কাজী ও মুফতিগনকে শরাব পান করতে বাধ্য করা হত। এই সব অনুষ্ঠানে বিভিন্ন লোকের নামে পেয়ালা নির্বাচিত হত। ফৈজি বলতেন, “আমি এই পেয়ালাটি পান করছি ফকিহদএর অন্ধ বিশ্বাসের নামে।”
এই ধর্মে দাড়ি মুন্ডনের ব্যাপারে অত্যধিক গুরুত্ব দেয়া হত। বাদশাহ এই ব্যাপারে রাজপুত পত্নীদের দ্বারা প্রভাবান্বিত হন। আকবর মায়ের মৃত্যুর পরেই মায়ের শোকে দাড়ি মুণ্ডন করে আদর্শের ভিত্তি স্থাপন করেন। পরদিন থেকে দরবারের যত উচ্চপদস্থ কর্মচারি ছিলেন তাঁরা নিজের দাঁড়ি মুণ্ডন করে বাদশাহের পদপ্রান্তে উৎসর্গ করেন। এইভাবে আকবর নিজের ধর্মের ও বুদ্ধির সাফল্যে বেশ আনন্দ উপভোগ করতে লাগলেন।
অপবিত্রতার জন্য স্নান করা ইসলামে ফরজ বা বাধ্যতামূলক। কিন্তু বাদশাহ আকবরের ধর্মে এর বিপরিত মত প্রকাশ করা হয়। বলা হয় যে ‘মনী’ বা ‘বীর্য উৎকৃষ্ট মানুষ সৃষ্টির বীজ। তাই গোসল করে সহবাস করাটাই উত্তম।
তা ছাড়া বিবাহ সম্পর্কে আইন করা হয় কেউ তাহার চাচাত, মামাত, ফুফাত ইত্যাদি সম্পর্কের বোনকে বিবাহ করতে পারবে না।
ষোল বৎসর পুর্বে বালক এবং চৌদ্দ বৎসরের পুর্বে বালিকাদের বিবাহ দেওয়া যাবে না এবং কেউ একাধিক বিবাহ করতে পারবে না।
যুবতী নারীদের বাধ্যতামুলকভাবে চেহারা খুলে পথ চলা ছিল এই ধর্মের আইন।
শহরের বাইরে বিভিন্ন জায়গায় পতিতাদের বসতি স্থাপন করে ব্যাভিচারকে আইন সঙ্গত করা হয়। পতিতালয় গুলির নাম দেয়া হয় ‘শয়তানপুর’। এই সব স্থানে পুলিশ প্রহরার ব্যবস্হা করা হয়।
খৎনারূপ সুন্নতকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য বার বৎসরের আগে বালকদের খৎনা করা নিষিদ্ধ করা হয়। বড় হয়ে সে নিজের ইচ্ছায় খৎনা করাতেও পারে আবার নাও করাতে পারে – এরকম আদেশ জারি করা হয়।
মৃত ব্যক্তি সম্পর্কে এই বিধান জারি করা হয় যে – এই ধর্মাবলম্বী কোন লোকের মৃত্যু হলে তাহার গলায় কাচা গম ও পাকা ইট বেঁধে তাহাকে পানিতে নিক্ষেপ করতে হবে এবং যেখানে পানি পাওয়া যাবে না সেখানে মৃতদেহ জ্বালিয়ে দিতে হবে অথবা পূর্ব দিকে মাথা ও পশ্চিম দিকে অর্থাৎ কাবা শরিফের দিকে পা করে দাফন বা সমাধিস্থ করতে হবে।
আকবর তাঁর নতুন ধর্মে নিজের, রাজপুতদের এবং সভাসদদের সুবিধার্থে এক অভিনব বিয়ের প্রথা চালু করলেন যার নাম মুতআ বিবাহ বা অস্থায়ী বিবাহ। অর্থাৎ দু – এক মাস বা কিছুদিনের জন্য জন্য একটা বিয়ে করে আবার তাকে তালাক বা বর্জন করা যাবে। বলা বাহুল্য এরমব বিবাহ ইসলামে বহু আগেই রহিত হয়ে গেছে। অথচ বিয়ের নামে এরকম রহিত প্রথাকে পুনরায় প্রচলন করে নারীর নারীত্বকে কলঙ্কিত করতে আকবরের হৃদয় কোন সময়ের জন্য কেঁপে ওঠেনি।
খ্রিষ্টানদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে আকবর বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীমের পরিবর্তে “যীশুর নামে শুরু করছি” ব্যবহার করে।
মসজিদে আজান দেওয়া ও জামাতে বা একসাথে ঐক্যবদ্ধ হয়ে নামায পড়াকে সম্রাট আকবর নিষিদ্ধ করেছিলেন। (মুনতাখাবুত তাওয়ারিখ, পৃষ্ঠাঃ ৩১৪)
পবিত্র মক্কা শরীফে হজ্জ্ব পালন করা যুগে যুগে সব দেশের স্বচ্ছল মুসলমানের জন্য ফরজ বা জরুরী, কিন্তু এই হজ্জ্ব পালনও আকবরের নির্দেশে নিষিদ্ধ করা হয়।
কুকুর ও শুয়োর ইসলাম ধর্মে ঘৃণ্য পশু বলে বিবেচিত। কিন্তু আকবর কুকুর ও শুয়োরকে আল্লাহর কুদরত বা মহিমা প্রকাশক বলে ঘোষণা করেন।
তিনি কুরআন বিশ্বাস করতে নিষেধ করেন। তিনি চাইতেন সারা পৃথিবীর মানুষ কুরআনের প্রদর্শিত পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে ধ্বংসের কারণ হয়ে যাক।
ইসলামের বিশ্বাস অনুযায়ী পরকাল ও পুনরুত্থানের দিবসে বিচার ব্যবস্থাকে বিশ্বাস করাটা জরুরী। কিন্তু সম্রাট আকবর এই বিচার ব্যবস্থাকে অস্বীকার করতেন।
মুসমানদের একে অপরের সাথে সাক্ষাত হলে ‘আসসালামু আলাইকুম’ (আল্লাহ আপনার উপর শান্তি বর্ষণ করুন) বলে সম্বোধন করার নিয়ম আছে। এর উত্তরে ‘ওয়া আলাইকুমুস সালাম’ (আল্লাহ আপনার উপরেও শান্তি বর্ষণ করুন) বলা হয়। যুগ যুগ ধরে এই নিয়ম মুসলমানদের মধ্যে চলে আসছে। কিন্তু সম্রাট আকবর এই প্রথার বিলোপ সাধন করার চেষ্টা করেন। তিনি ‘আল্লাহু আকবর’ বলার নিয়ম প্রচলন করেন। এর উত্তরে ‘জাল্লা জালালুহু’ বলা হত। এবারেও হিন্দু প্রজাগণ তাঁর কাছে আবেদন করে বললেন, “সম্রাট আপনার কাজকর্ম দেখে সমস্ত হিন্দুই আপনার উপরে সন্তুষ্ট। তাই শ্রদ্ধায় হিন্দুরা আপনাকে দিল্লীশ্বর ও জগদীশ্বর বলে। কিন্তু আপনি সালাম তুলে দিয়ে ‘আল্লাহ’ শব্দ ব্যবহার করেন কেন? আপনি এটাও তুলে দিন।” তখন আকবর হিন্দু প্রজাদিগকে শান্ত করে বললেন, “মুসলমানদের জন্যই আমিই আল্লাহ হয়ে প্রকাশিত হয়েছি।” অর্থাৎ ‘আল্লাহু আকবর’ মানে আকবরই আল্লাহ। তাঁর অনুগত হিন্দু প্রজাগণ আবার অভিযোগ করলেন, “আল্লাহ শব্দটা হিন্দু বিরোধী অতএব এটাকে তুলে দিন।” আকবর হিন্দুদের সন্তুষ্ট করার জন্য তাই করলেন। সারা দেশে ঘোষণা করে দেওয়া হল, আজ থেকে ‘সালাম’ বা ‘আল্লাহ’ পরিবর্তে ‘আদাব’ শব্দ ব্যবহার করতে হবে।
তাঁর শাষনামলে তারই দরবারী আলেম আব্দুন নবী মুসলমানদের জন্য ফরজ ইবাদত জাকাত না দেয়ার একটি বুদ্ধি আবিষ্কার করে। (নাউযুবিল্লাহ) যেহেতু জাকাতের জন্য মালের একবছর পূর্ণ হওয়া শর্ত তাই সে এক বছর হওয়ার পুর্বেই সকল সম্পদ স্ত্রীর নিকট অর্পন করতো এবং বছর শেষ হলে আবার গ্রহণ করতো। এর মাধ্যমে সে জাকাত না দেয়ার রাস্তা আবিস্কার করে। আকবরকে তুষ্ট করার জন্য সে সময়কার বড় ধর্মব্যবসায়ী তাজউদ্দীন আকবরের ইবাদতখানায় প্রবেশ করে এবং ‘জমীন বোছ’ নামে আকবরকে সেজদা প্রথার প্রচলন করে।
হাজী ইব্রাহিম নামক একজন আকবরের সামনে দাড়ি মুন্ডন সংক্রান্ত এক মিথ্যে বর্ননা উপস্থাপন করে এবং এতে প্রভাবিত হয়ে আকবর দাড়ি মুন্ডন করতে শুরু করে এবং এটা বৈধ বলে ঘোষণা করে। (মুন্তাখাবুত তাওয়ারিখ দ্বিতীয় খন্ড ২৮৭ পৃষ্ঠা)
আকবরের প্রতি জৈন দের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। ষোড়শ শতাব্দীতে আগ্রায় জৈনদের একটি বড় কেন্দ্র ছিলো। আকবর সর্বপ্রথম সেখানে তাদের সহচর্যে আসে। হিরনা বিজয়া শুরী ও জয়চন্দ্র শূরী নামক দুইজন জৈনের সহচর্যের প্রভাবে আকবরের নতুন ধর্মচিন্তা বিশেষভাবে প্রভান্বিত হয়। প্রকৃতপক্ষে আকবরের গোশত খাওয়া পরিত্যাগ করা এবং কোন প্রানী হত্যা করার ব্যাপারে বিধিনিষেধ আরোপ মূলত জৈনদের প্রভাবেই হয়েছিলো। (a short history of Muslim rule in India. p.292)
‘হিজরী’ সাল হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) এর সাথে সম্পর্কযুক্ত, অনুরুপ ‘খ্রীষ্টাব্দ’ যীশুখ্রীষ্ট বা হযরত ঈশা (আঃ) এর সাথে সম্পর্কযুক্ত। একটি নতুন সালের ব্যবস্থা করার জন্য অনেক হিন্দু প্রজা সম্রাট আকবরের কাছে আবেদন করলেন, “আমরা ভারতে সংখ্যাগরিষ্ঠ, আমাদের জন্য একটা পৃথক সালের ব্যবস্থা করা হোক।” প্রজাদের আবেদন মেনে তাই করা হোল, পৃথক সালের নাম রাখা হোল ‘ইলাহি’ বছর।
সম্রাট আকবর মুসলমানদের মসজিদ ও উপাসনালয়গুলোকে গুদাম ঘর ও হিন্দু প্রজাদের ক্লাব ঘরে রূপান্তরিত করেও আকবর এক বিশেষ শ্রেণীর বাহবা কুড়িয়েছিলেন। (মুনতাখাবুত তাওয়ারিখ, পৃষ্ঠাঃ ৩১৪)
আকবরের প্রসঙ্গে রাহুল সংস্কৃত্যায়ন তাঁর গ্রন্থে লিখেছেন, “আকবর গো – হত্যা একেবারে বন্ধ করে দিয়েছিলেন এবং সেই অপরাধে শাস্তি ছিল মৃত্যুদণ্ড। ১৫৮৩ – হুকুম অনুযায়ী বছরে একশত দিনের বেশি মাংস – ভক্ষণ বর্জিত ছিল। এই হুকুম কেবল রাজধানীতেই নয়, এমনকি সারা রাজ্যে চালু ছিল। ‘দ্বীন-ই-ইলাহী’ র অনুগামীদের জন্য শ্মশ্রু – মুণ্ডন আবশ্যক ছিল। তাদের জন্য শুধু গো – মাংসই নয়, রসুন – পিঁয়াজও পরিত্যাজ্য ছিল। এই ধর্মের বাইরের লোকেদের কাছেও তা বাধ্যতামূলক ছিল। ইসলামে সোনা ও জরির বস্ত্র পরিধান নিষিদ্ধ, কিন্তু ‘দ্বীন-ই-ইলাহী’ তে সর্বজনীন প্রার্থনা ও অন্যান্য সময়ে সে সব ধারণ করা আবশ্যক বলে গণ্য হতো। দরসনিয়াদের (‘দ্বীন-ই-ইলাহী’ র অনুগামীদের) জন্য রমজান মাসের রোজা ও হজ মানা করে দেওয়া হয়েছিল। আরবি, ইসলামী শরীয়ত, কোরআনের ব্যাখ্যাও পাঠ করা নিষিদ্ধ ছিল। ৯৮৯ হিজরীতে (১৫৮১ – ৮২) বহু রক্ষণশীল শেখ ও ফকিরকে কান্দাহারের দিকে নির্বাসিত করে দেওয়া হয় – পূর্ব থেকেই বসবাসকারী ইলাহী নামক সম্প্রদায়ের শেখদের ও তাদের শিষ্যদের সিন্ধু – কান্দাহারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। খৎনা করাও নিষিদ্ধ ছিল।
প্রাতঃকাল, সায়ংকাল, মধ্যাহ্ন ও মধ্যরাত্রি – চারবার পূর্বদিকে মুখ করে পুজা করা হত, সুর্যের সহস্র নাম জপ করা হত। আকবর স্বয়ং দু’কান ধরে পরিক্রমা করতেন। সূর্যোদয় ও মধ্যরাত্রির প্রার্থনার জন্য নাকাড়া বাজানো হতো।” (আকবর, রাহুল সংস্কৃত্যায়ন, পৃষ্টাঃ ২৬৫)
উক্ত গ্রন্থে আরও লেখা আছে, “এ ছাড়া কোন শিশুপুত্রের নাম মুহাম্মাদ রাখতে দেওয়া হত না, আর যাদের নামের সঙ্গে মুহম্মদ ছিল, দীক্ষার সময় তা বদলে দেওয়া হত। নতুন মসজিদ নির্মাণ নিষিদ্ধ করা হয়েছিল এবং পুরোনো মসজিদের সংস্কারেও অনুমতি ছিল না।” (প্রাগুক্ত, পৃষ্টাঃ ২৬৫)
মুক্ত বুদ্ধীজীবী সম্প্রদায় আকবরের মানসিক অবস্থা পরিবর্তন করার বিরাট ভুমিকা পালন করে। আবুল ফজল ছিলো একজন নাস্তিক। এর প্রভাবে আকবর সৃষ্টি জগত সব প্রকৃতির দান মনে করে। আল্লাহ, রসূল, শরীয়ত এসব আলেমদের আবিস্কার বলে ধারনা করা শুরু করে। এভাবে নামাজ, রোজা, হজ্জ নিয়েও তারা বিভিন্ন কটুক্তি করতো এবং উপহাস করতো।
তার ইবাদতখানায় আলোচনা চলাকালে কোন আলেম কোন বিষয়কে হালাল ফতোয়া দিলে অপরজন সেটা হারাম ফতোয়া দিতো। এসব দেখে আকবর ধর্মের উপর ভক্তি হারাতে লাগলো।
ঐ সময়কার অত্যন্ত চতুর ঐতিহাসিক আবুল ফজল আকবরের উপর গভীর প্রভাব বিস্তার করে, সে আকবরকে ইমামদের অনুসরন না করার জন্য উদ্বুদ্ধ করে এবং তার ইবাদতখানার দরজা সকল জাতি ধর্মের জন্য উন্মুক্ত করার ব্যবস্থা গ্রহণ করে।”
আবুল ফজল এ সময় ফতোয়া জারি করে, ডাক্তারের পরামর্শে স্বাস্থ্য রক্ষা করার জন্য মদ পান করা বৈধ। তার পরামর্শ অনুযায়ী সকলের মদ প্রাপ্তির সুবিধার্থে সম্রাট আকবর তার প্রাসাদের নিকটে মদের দোকান প্রতিষ্ঠা করে। নববর্ষের ভোজের সময় আকবর তার উলামা, কাজী, মুফতীদের মদ পানের জন্য উৎসাহিত করতো। ঐ সময় মাত্রাতিরিক্ত মদ পানের ফলে ইসমাঈল নামক জৈনক ভন্ড আলেম মৃত্যুবরণ করে। আকবরের কাজী আব্দুস সামি দরবারের প্রধান বিচারপতি ছিলো। সে মদ, জুয়া ব্যাভিচার ইত্যাদি বৈধ মনে করতো।” (মুন্তাখাবুত তাওয়ারিখ দ্বিতীয় খন্ড)
মোল্লা শীরি নামক জনৈক দরবারী আলেম আকবরকে সূর্য পুজায় উৎসাহিত করে সূর্যের প্রশস্তি সূচক এক হাজার লাইনের একটি কবিতা লিখে উপহার দেয়।
ঐতিহাসিক বাদায়ুনি ও জেসুইট পাদ্রীগণ অভিযোগ করেন যে, আকবর নতুন ধর্মচিন্তা প্রমাণ করে সম্রাট ইসলাম ধর্ম পরিত্যাগ করেছিলেন। ঐতিহাসিক ভিনসেন্ট স্মিথ তাঁর ‘আকবর দ্য গ্রেট মুঘল’ গ্রন্থের ২২১ ও ২২২ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, “আকবরের নতুন ধর্মমতের পরিকল্পনা ছিল হাস্যকর, অহংকারের স্বাভাবিক ফল এবং অসংযত স্বৈরাচারের বীভৎস প্রকাশ। এটা ছিল আকবরের বুদ্ধিহীনতার প্রধান স্তম্ভ, তাঁর জ্ঞানের পরিচয় নয়।”
স্মিথ আরও লিখেছেন, “১৫৫৬ – ১৫৭৪ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত আকবর ছিলেন একজন আগ্রহশীল সুন্নী মুসলমান; ১৫৭৪ – ৮২ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে তাঁর ভাবপ্রবণ মনে ধর্ম সংক্রান্ত ব্যাপারে পরিবর্তনের সূচনা হয় এবং তখন তাঁকে একজন সন্দেহবাদী, প্রত্যাদেশে অবিশ্বাসী, যুক্তিবাদী, মুসলিম বলে আখ্যা দেওয়া যায়, এবং অবশেষে ১৫৮২ – ১৬০৫ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে ইসলাম ধর্মকে পুরোপুরি ত্যাগ করেন।” (প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা – ৩৩৮)
সম্রাট আকবরের ওপর মসজিদ ধ্বংসের অভিযোগ করেছেন জেসুইট পাদ্রীরা। তাঁদের ভাষ্য অনুযায়ী, আকবর পিতৃ – পুরুষদের ধর্মীয় বিশ্বাস তথা ইসলামকে জলাঞ্জলী দিয়েছেন। জেসুইট পিনহারো গির্জার জন্য প্রাসাদের নিকটে একটি সুন্দর জায়গা পাওয়ার কথা উল্লেখ করে লিখেছেন, “এই বাদশাহ মুহাম্মাদের অলীক ধর্মকে নষ্ট করে দিয়েছেন, তার একদম বদনাম করে ছেড়েছেন। এই শহরে না কোন মসজিদ আছে, না কুরআন। আগে যে মসজিদগুলি ছিল, সেখানে হয় ঘোড়ার আস্তাবল, না – হয় গুদামঘর বানিয়ে দেওয়া হয়েছে। মুসলমানদের অত্যান্ত লজ্জিত করার জন্য প্রত্যেক শুক্রবার সাতচল্লিশটি কিংবা পঞ্চাশটি শূকর এনে তাদের তাড়িয়ে দেওয়া হয়। তিতি তাদের দাঁতগুলো সোনায় মুড়ে রাখেন। বাদশাহ নিজে একটি ধর্ম প্রবর্তন করেছেন, তিনি নিজে তার পয়গম্বর। তাঁর অনেক অনুগামী আছে, তবে পয়সার জন্য। তিনি ভগবান ও সূর্যের পুজা করেন। তিনি হিন্দু ও জৈন সম্প্রদায়ের অনুসরণ করেন। আমাদের পাঠশালায় খুব উচ্চ মনসবপ্রাপ্ত আমিরের পুত্র, তৎপর বাদশাহের তিন পুত্র পড়াশুনা করে, দুই শাহজাদা খ্রীষ্টান হতে চায়।” (সি এইচ পেনে অনুদিত ও সম্পাদিত, আকবর অ্যান্ড দ্য জেসুইটস, লণ্ডন, ১৯২৬, পৃষ্ঠা – ৬৭, দ্য রিলিজিয়াস পলিসি অফ দ্য মুঘল এম্পায়ারস, লেখকঃ শ্রীরাম শর্মা, পৃষ্ঠা – ৪৬)
তৃতীয় জেসুইট মিশনের অন্যতম সদস্য ছিলেন ফাদার জেরোন জেভিয়ার। তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন যে সম্রাট আকবর মুসলমান ছিলেন না। আকবর ছিলেন বহু দেবদেবীবাদী ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন। তিনি বলেছেন, “আকবর চান নতুন ধর্ম তৈরি করতে যার মাথা হবেন তিনি নিজে। শোনা যায় যে, তাঁর ধর্ম ইতিমধ্যে বহুলোকে অনুসরণ করতে শুরু করেছে। কিন্তু আসলে এরা অধিকাংশই তোষামোদকারী এবং এমন লোক যাদের অর্থ দিয়ে কেনা হয়েছে। …… অল্পবিস্তর নিশ্চয়তার সঙ্গে একথা বলা যায় যে, আকবরের প্রবল ইচ্ছা লোকে তাঁকে দেখুক ও মান্য করুক দেবতা রূপে বা অন্তত একজন ধর্মগুরু হিসেবে। তিনি চান যে, লোকে বিশ্বাস করুক যে, তিনি অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী এবং ব্যধিগ্রস্ত ব্যক্তিকে সারিয়ে তুলতে সক্ষম তাঁর নিজের পা ধোয়ার জল দিয়ে।” (আকবর অ্যান্ড দ্য জেসুইটস, পৃষ্ঠা – ৬৮)
পাদ্রী জেভিয়ার লাহোর থেকে ১৫৯৫ খ্রীষ্টাব্দের আগস্ট – সেপ্টেম্বর মাসে নিজেদের চিঠিপত্রে উল্লেখ করেছেন যে, আকবর ইসলাম বিরোধী। জেভিয়ার বলেছেন, “বাদশাহ তাঁর মস্তিষ্ক থেকে মুহাম্মাদের ধর্মকে একেবারে দূর করে দিয়েছিলেন। তাঁর আকর্ষণ হিন্দু ধর্মের দিকে। ভগবান ও সূর্যের পুজা করেন। এখন হিন্দুরা অনুগ্রহভাজন। আমিন জানিনে, মুসলমানরা এটাকে কি মনে করেন। বাদশাহ মুহাম্মাদের নামেও ঠাট্টা – বিদ্রুপ করেন।”
এখানে আকবর সম্পর্কে খ্রীষ্টান পাদ্রীদের বক্তব্যকে রাহুল সংস্কৃত্যায়ন অতিরঞ্জিত ও প্রচুর অতিশয়োক্তি বলে উল্লেখ করেছেন। তাঁর মতে খ্রীষ্টান পাদ্রীরা ইসলাম সম্পর্কে নিজেদের বিদ্বেষকে সম্রাট আকবরের উপর চাপিয়ে দিয়েছেন।
আকবর সম্পর্কে অন্য সূত্রেও বহু কিছু জানা যায়। যেমন বুরহান আহমেদ ফারুকী লিখেছেন: “The Emperor (Akbar) had ceased to believe in the quran, he did not believe in life after death, nor in the Day of Judgement. He had gone further. He had determined publicly to use the new formula: ‘there is no god but Allah and Akbar is God’s Representative’. But as this led to commotions, he thought it wiser to restrick the use of this formula to a few people within the precnts of the Haram. Sajdah or the form of prostration reserved by Islam for God alone, was made compulsory before the Emperor.
Wine was declared lawful, and bacon was made an ingredient of wine; Jizyah or the military tax was abolished and beef was declared unlawful. Pigs and Dogs were specially reared and regarder as manifestation of God. The Salat or the prescribed prayers, the Saum or the prescribed facts and the Hajj or puilgrimage to Mecca were abolished. The Islamic Calender was replaced by his new – fangled Ilahi months and years. Indeed Islam after a thousand years was considered to have played Itself out, the study of Arabic was looked upon as if it were something unlawfull; the law of Islam or Figh, Tafsir or the exegesis of the Quran and Hadith or the traditional of the Prophet were ridiculed; and those who prosecuted these studies were looked down as deserving of contempt.
The ‘Ajan’ or call to the prayers, and the Namaz – I – Jamat or congregational prayers which used to be, as prescribed by Islam, offered five time a day in the state hall were stopped Such names as Ahmad, Muhammad and Mustafa, the various names of the Prophet of God, had become offensive to the Emperor, and to utter them was a crime. Mosques and prayer room were changed into stone – rooms and into Hindu guardrooms.
Islam was in great distress. Unbelievers could openly ridicule and condemm Islam and the Muslims. The rites of Hinduism were were celebrated in every street and corner, while Muslims were not permited to carry out the injunctions of Islam. The Hindus when they ovserved fast could compel the Muslims not to eat and drink in public, while they themselves could eat and drink publicly during Ramajan. At several places Muslims had to pay with their lives for sacrificing the cow on ‘Id – ul – Adha’. A number of Mosques were destroyed by Hindus and temples erected in their place.” (Mujaddid’s Concern to Tawhid; by Burhan Ahmad Faruqi, 2nd Edition, Lahore, 1943, P. 12 – 14)
একদিন আবুল ফজল বাদশাহকে একখানি কেতাব দেখিয়ে বলেন, আপনার জন্য ফেরেশতা এটা আসমান হতে এনেছেন। সেই কেতাবের একস্থানে একটি আরবি বাক্য লিখিত ছিল, যার অর্থ এইরূপঃ ‘হে মানুষ তুমি গাভী হত্যা কর না । যদি কর তবে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে।’ নিরক্ষর সম্রাট এটা বিশ্বাস করলেন এবং গরু জবাই করা নিষিদ্ধ ঘোষনা করে দিলেন। কানুন জারী করলেন, কসাই এর সাথে কেউ আহার করলে তার হাত কেটে দেয়া হবে এমনকি তাহার স্ত্রীও যদি তাহার সাথে আহার করে তবে তার আঙ্গুল কাটা হবে। এই নুতন ধর্মে গরু, উট, ভেড়া প্রভৃতি জন্তুর গোশত হারাম বলে ঘোষিত হল। পক্ষান্তরে বাঘ ভাল্লুকের গোশত হালালের মর্যাদা লাভ করে। মোট কথা সর্বক্ষেত্রে ইসলামের বিরোধিতা করাই ছিল ‘দ্বীন-ই-ইলাহী’ র মূল উদ্দেশ্য।
আকবর উলামায়ে সূ তথা অসৎ দরবারী আলেমদের এমন ব্যপক প্রভাবে প্রভাবিত হওয়ার কারনে হক্কানী আলেমগন ইবাদতখানা পরিত্যাগ করেন। এবং অনেকে পবিত্র মক্কা শরীফে হিজরত করেন। আর এদিকে বাদশা আকবরও এসময় সৎ আলেমদের সংসর্গ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়, এবং তাদের দিল্লী থেকে বহিস্কার করে শুধু তাই নয়, আইন করে সকল হক্কানী আলেমদের বাক স্বাধীনতা হরন করে নেয়।” (মুন্তাখাবুত তাওয়ারিখ দ্বিতীয় খন্ড ২১২ পৃষ্ঠা)
একদিন সভাসদগনকে আকবর ডেকে বললেন, ভারতের জ্ঞানী ও বুদ্ধিমান যোগী ঋষীদের লিখিত হিন্দি ভাষার পুস্তক গুলি নির্ভুল জ্ঞানের উৎস। আমরা জদি এইগুলি ফার্সী ভাসায় অনুবাদ করে নেই তা হলে আমাদের ইহকাল ও পরকালে শান্তি লাভ হবে। তৎক্ষনাৎ বাদশাহর বাসনা পুরন করবার ব্যবস্থা করা হল। অনুবাদ করার জন্য অনেক আলেম নিয়োগ করা হল এবং এর জন্য পৃথক দফতর কায়েম করা হলো। সঙ্গে সঙ্গে আরবী ভাষা পড়া ও জানা অপরাধ বলে সাব্যস্ত হলো। এর পরিবর্তে জ্যোতিষ শাস্ত্র, অংক, চিকিৎসা, ইতিহাস ও কথা কাহিনী প্রভৃতি পুস্তকের প্রচলন করা হল। এর পর বাদশাহ আকবর হিন্দুদের উপর হতে কয়েক কোটি টাকার জিজিয়া কর উঠিয়ে নিলেন। পূর্বে যারা ‘এলমে ফিকাহ’ শিক্ষা দান করতেন তাদেরকে একশত বিঘা জমি জায়গীরসরূপ দেয়া হত। বাদশাহ আকবর এই জায়গীর ছিনিয়ে নিলেন। ইসলামী আইন অনুযায়ী বিচার করার জন্য নিযুক্ত করা হত। জায়গীর প্রথা বন্ধ করার ফলে ইসলামী বিচার ব্যবস্হার মূলে কুঠারাঘাত করা হল। এমনি করে ইসলামী হুকুমতের শেষ চিহ্ন টুকুও বিলুপ্ত করার জন্য বাদশাহ আকবর সর্বশক্তি নিয়োগ করলেন। ফলে কয়েক বৎসরের মধ্যে হুকুমতের কোন ক্ষেত্রেই আর ইসলামের চিহ্ন অবশিষ্ট রইল না। মসজিদ বিরান হল। মাদ্রাসা ধ্বংস হল। অধিকাংশ আলেম দেশ ত্যাগে বাধ্য হল। শেষ পর্যন্ত বাদশাহ আকবরের রাজত্বে এমন এক শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্হিতির সৃষ্টি হল যাতে সুন্নি মুসলমানগন অতিষ্ট হয়ে উঠলেন। কারন একমাত্র সুন্নী মুসলমানগন ব্যতিত অন্য সব সম্প্রদায়ের লোকেরা ছিল বাদশাহর প্রিয়। কাফেররা সন্মানিত হল, মোসলমানগন হলেন অপদস্হ। ইসলামী আহকাম পালন করতে গিয়ে তারা প্রতিটি ক্ষেত্রে কাফেরদের বিদ্রুপবানে জর্জরিত হতে লাগলেন। হিন্দুরা একাদশীর দিন উপবাস থাকেন। তাই সেই দিন মুসলমানদেরকেও উপবাস করতে বাধ্য করা হত। অথচ রমজান মাসে অমুসলিমেরা অবাধে খদ্যদ্রব্য বেচাকেনা করত ও প্রকাশ্যে আহার করত। স্বয়ং বাদশাহ যাদের শায় তাদের বিরুদ্ধে শাহী অনুকম্পা পৃষ্ঠপোষকতা হতে সম্পুর্নরুপে বন্চিত মুসলমান কি-ইবা করতে পারবেন। তাহারা অন্তরে অন্তরে দগ্ধীভুত হতে লাগলেন। আল্লাহপাকের তরফ থেকে সাহায্য আসবার প্রতীক্ষায় থাকা ছারা তারা আর করনীয় কিছুই খুজে পেলেন না। একজন মোজাদ্দেদের প্রতীক্ষা করতে করতে তাহারা ধৈর্যের শেষ সীমানায় এসে পৌছলেন। ‘কতদিন পর আসিবে সেই সত্য নূর- ইয়া এলাহী রহমত তোমার আর কতদুর?’
হযরত সেলিম চিশতি (রহঃ) এর পুত্র মাওলানা বদরুদ্দীন ছিলেন উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী। বিশিষ্ট দরবারীদের মধ্যে একমাত্র তিনিই বাদশাহর এইসব কুফরি আকিদার বিরোধিতা করলেন। প্রতিবাদ স্বরূপ তিনি সরকারী চাকুরী হতে ইস্তফা দিলেন। বাদশাহ তাহাকে দেওয়ানে খাছে ডেকে নিয়ে অনেক বুঝালেন। কিন্তু তিনি নিজ সিদ্ধান্তে রইলেন। হুকুমতের তরফ থেকে তার প্রটি কঠোরতা আরোপিত হল। কঠোরতা চরমে উঠলে তিনি নীরবে হজ্ব করতে চলে গেলেন। বাংলা ও বিহারের মুসলমাননের নিকট যখন বাদশাহ আকবরের এই পথভ্রষ্টতার সংবাদ পৌছল তখন তারা অত্যন্ত বিচলিত হয়ে পরলেন। তারা এই বিরাট ফেতনায় শঙ্কিত হয়ে হক্কানী আলেমগনের স্বরনাপন্ন হলেন। কাজী মোহাম্মদ ইয়াজদি ছিলেন জৌনপুরের অধিবাসী। তিনি ফতোয়া জারী করলেন, “বাদশাহ আকবরের কার্যকলাপ ভারতবর্ষে ইসলাম বিপন্ন করতেছে। সুতরাং তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা ন্যায়সঙ্গত।” কিন্তু প্রবল প্রতাপান্বিত মুঘল সাম্রাজ্যে এইসব কর্মসূচী কোন প্রভাব বিস্তার করতে পারল না। শতকরা পচানব্বই ভাগ দেশবাসী হিন্দু। তারা সবাই বাদশাহর পক্ষে। তাছারা দুনিয়াদার আলেম ভন্ড সূফীকূল, শিয়া প্রভৃতি গোষ্টিও বাদশাহর হাতকে শক্তিশালী করেছে। জৈন, পারসী ও অন্নান্য সম্প্রদায়ের লোকদেরও রয়েছে বাদশাহর প্রতি অকুন্ঠ সমর্থন। সুতরাং বাদশাহ নির্বিঘ্নে ইসলাম বিরোধী শক্তির পৃষ্ঠপোষকতা করে যেতে লাগলেন। সমগ্র হিন্দুস্হানে ইসলামের এই ঘোর দুর্দিনে হজরত মোজাদ্দেদ আলফেছানি শায়েখ আহমদ ফারুকী সেরহিন্দি (রঃ) তাহার মোজাদ্দেদ সুলভ প্রজ্ঞা ও দৃঢ়সংকল্প নিয়ে সংস্কারের কর্যে ঝাপিয়ে পড়লেন। বেদাত ও কুফরীর যাতাকলে পিষ্ঠ ইসলামের ভয়াবহ দূরবস্হা দেখে তাহার ফারুকী রক্ত টগবগ করে ফুটে উঠল। গভীরভাবে পরিস্হতি বিশ্লেষন করে মোজাদ্দেদে আলফেছানি (রঃ) সিদ্ধান্তে আসলেন যে, সর্বপ্রথম বাদশাহর এছলাহ হওয়া প্রয়োজন। কারন বাদশাহ রূহ এবং জনগন শরীর তুল্য। রূহের ব্যাধী দুরিভূত হলে শরীরও ব্যাধিমুক্ত হবে। কিন্তু বাদশাহর এছলাহ হওয়ার পুর্বে আমিরওমরাহ গনের এছলাহ হওয়া প্রয়োজন। হজরত মোজাদ্দেদ (রঃ) সেই দিকেই মনোনিবেশ করলেন। খান খানান, খানে আজম, সৈয়দ ছদরে জাহান, মোর্তজা খান, মহব্বত খান প্রমুখ ওমরাহ গন পুর্ব হতেই মোজাদ্দেদ (রঃ) এর মুরিদ ছিলেন। তিনি তাঁদের দ্বারা বাদশাহ আকবরকে এইসব কুফরি কর্যকলাপ হতে তওবা করার জন্য আহ্বান জানালেন। তিনি ওমরাহগনকে নির্দেশ দিলেন – “তোমরা বাদশাহকে আমার পক্ষ থেকে বলে দাও যে, বাদশাহী ক্ষনস্হায়ী। এইসব আড়ম্বর চিরদিন থাকবে না। দুই দিনের চাকচিক্যের মোহে সত্যকে অস্বীকার করা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। সুতরাং অবিলম্বে এইসব কুফরী কাজ হতে তওবা করে চিরনিরাপত্তার ধর্ম ইসলামের সুশীতল পুষ্পশোভিত বাগিচায় আগমন করা উচিৎ। নতুবা গজব আসবে। আল্লাহ পাকের গজব হতে বাচবার সাধ্য কেউর নেই। আল্লাহ পাক সর্বশক্তিমান। বাদশাহীর পরোয়া তিনি করেন না। ফেরাউন, নমরুদ প্রমুখ প্রবল পরাক্রমশালী বাদশাহগনও আল্লাহর গজবে ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। সেই গজব থেকে কেউই তাদেরকে উদ্ধার করতে সক্ষম হয়নি।” মোর্শেদের কথামত ওমরাহগনও বাদশাহ আকবরকে নানাভাবে বুঝাতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না। শেরেক, কুফরীর প্রভাবে তাহার মন পাষান হয়ে গিয়েছে। হেদায়েতের নূর সেখানে প্রবেশ করতে পারল না। বাদশাহ নিজ সিদ্ধান্তে অটল রইলেন। একদিন বাদশাহ একটি অশুভ স্বপ্ন দেখলেন। স্বপ্ন তাকে অস্থির করে তুললো। রাজ্যের সমস্ত স্বপ্ন ব্যাখ্যাবিদ ও জ্যোতিষগনকে তিনি স্বপ্নের বিষয়বস্তু জানালেন এবং উহার অর্থ জানতে চাইলেন। তারা বাদশাহকে জানালেন, “এই স্বপ্নের অর্থ হছ্ছে এই যে বাদশাহর পতন অতি সন্নিকটে।” বাদশাহ তা শুনে ভীত ও চিন্তিত হয়ে পরলেন। তিনি অনেকটা দমে গেলেন। নতুন করে ফরমান জারী করা হলো যে- পুর্বে ‘দ্বীন-ই-ইলাহী’ পালনের ব্যাপারে যে সব বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হত, এখন হতে তা থাকবে না। যারা সেজদা করতে ইছ্ছুক না -তাদেরকে আর সেজদা করতে বাধ্য করা হবে না। এদিকে হযরত মোজাদ্দেদ আল ফেছানি (রঃ) এর সারগর্ভ বাণী ও তার উজ্জল ব্যাক্তিত্যের আলোকে আলোকিত হয়ে লোকজন ‘দ্বীন-ই-ইলাহী’ র অসত্যতা ও অসারতা বোঝতে পেরে দলেদলে তার প্রতি আকৃষ্ট হতে লাগলো এবং ইসলামের সুশীতল ছায়ায় এসে আশ্রয় নিতে লাগল। বিষয়টা বাদশাহ আকবরের আর অজানা রইল না। বাদশাহ তাই জনসমক্ষে ‘দ্বীন-ই-ইলাহী’ র শান-শওকত ও জাকজমকতা প্রদর্শন করার জন্য কিছুদিন পর এক উৎসবের আয়োজন করলেন। উৎসবে দুটি পৃথক দরবার নির্মান করা হল। একটির নাম করা হল ‘আকবরী দরবার’ যা নির্মান করা হল বহু অর্থ ব্যয় করে। চোখ ঝলসানো আলোক সজ্জার ব্যবস্হা করা হল। ব্যবস্হা করা হল মনোরম মঞ্চ ও বিছান হল জৌলুসপূর্ন গালিচা। পুষ্পের সৌরভ, আতরের সুঘ্রানে আকবরী দরবার পরিনত হল ছোটছোট শাদ্দাদের বেহেশতে। ব্যবস্থা করা হল শাহী খাবারের ও সুমিষ্ট ফল-মুল ইত্যাদির। অপর দিকে মুহাম্মদী দরবারের অবস্হা ছিল খুবই করুন। ছিন্নভিন্ন ও জরাজীর্ন কাপড় দ্বারা তৈরী করা হলো মুহাম্মদী দরবার। খাবারের ব্যবস্হা করা হলো নিম্নমানের। আলোক সজ্জার কোনো ব্যবস্হা নেই। নিতান্ত সাধারনভাবে তৈরী এই দরবারটিকে আকবরী দরবারের তুলনায় জীর্নশীর্ন কুড়েঘর মনে হতে লাগল। ইসলাম জরাজীর্ন ও বর্তমানযুগের অনুপযযোগী বা অচল এবং ‘দ্বীন-ই-ইলাহী’ জাকজমকপূর্ন ও আধুনিক এটা জনসাধারনকে বুঝানোর জন্যই এ দুটি দরবার করা হল। কিন্তু সম্রাট এটা বোঝলেন না যে, সত্য চিরদিনই সত্য। সত্য কোনদিনই সময়ের অধীন নয়। অবশেষে সেই উৎসবের দিন আসল। সম্রাট আকবর তাহার সভাসদ, আমির-ওমরাহ ও বিশিষ্ট অতিথিগনকে সঙ্গে নিয়ে মহাসমারোহে আকবরী দরবারে প্রবেশ করলেন। লোভী দুনিয়াদার লোকরাও তার অনুসরন করল। আনন্দ উল্লাসে মুখরিত হয়ে উঠলো ‘আকবরী দরবার’। এমন সময় হজরত মোজাজ্জেদ আলফেসানী শয়েখ আহমদ ফারুকি সেরহিন্দ (রঃ) তার কিছু মুরিদান সহ আগমন করিলেন। তাহার বুঝিতে বাকি রইল না কোন উদ্দেশ্যে এই উৎসবের আয়োজন এবং কেনই বা দুই দরবারের মধ্যে আকাশ পাতাল ব্যবধান। মুসলমানদের হেয় ও অপদস্ত করাই যে বাদশাহর উদ্দেশ্য এটা বুঝতে আর বাকি রইল না। কিন্তু মান, সম্মান, ইজ্জত কাউর নিজের অর্জিত সম্পদ নয়। ইহা আল্লাহ প্রদত্ত এক নেয়ামত। তিনি যাকে ইছ্ছা ইহা দান করেন। হজরত মোজাজ্জেদ (রঃ) তার মুরিদান সহ মোহাম্মদী দরবারে প্রবেশ করলেন। আহারের সময় হল। এমন সময় হজরত মোজাজ্জেদ (রঃ) এক মুরিদকে বলিলেন, যাও মোহাম্মদী দরবারের চতুর্দিকে লাঠি দ্বারা দাগ দিয়ে আস এবং এক মুষ্ঠি ধুলি তার হাতে দিয়ে বলিলেন সম্রাটের দরবারের দিকে তা নিক্ষেপ কর। উক্ত মুরিদ তাই করল। মূহুর্তের মধ্যে একটি ঘুর্নিঝর উঠিয়া আকবরী দরবারকে ঘিরে ফেলল। দরবারে মহা ধুমধাম চলছিল। হটাৎ তুফান দেখে সবাই ভয় পেয়ে গেল। কি করিবে বুঝিয়া উঠার আগেই তাবু উড়ে গেল। আসবাবপত্র, সাজসজ্জা, খদ্যসাগ্রী সমস্তই তছনছ হয়ে গেল। নিমন্ত্রিত অতিথিগন একে অন্যের উপর পরে ধস্তাধস্তি করতে লাগল। তাবুর খুটি গুলো উপড়ে উঠে তাহাদের মস্তকে আঘাত করতে শুরু করল। একটি খুটি গিয়ে সম্রাটের মস্তকে পর পর সাতটি আঘাত করল। আঘাত পেয়ে সম্রাট মারাত্নক আহত হয়ে শয্যাশায়ী হলেন এবং কিছুদিন পরেই মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করলেন। সুদীর্ঘ পঞ্চাশ বৎসরের কালিমা যুক্ত শাসনের অবসান হল। ক্ষমতায় আসলেন তার পূত্র জাহাঙ্গীর। জাহাঙ্গীরের যৌবনকাল এই বাতিল ধর্মের উপরেই অতিবাহিত হয়েছিল। হিন্দু ব্রাহ্মন ও যোগীদের সাহচর্য পিতার ধর্মমতের প্রভাব তাকেও ইসলাম ধর্ম হতে উদাসীন করে রেখেছিল। ফলে আকবরের মৃত্যু হল ঠিকই কিন্তু রয়ে গেল তার ‘দ্বীন-ই-ইলাহী’ র সমস্ত বাতিল মতবাদ ও হুকুমত।
সম্রাট জাহাঙ্গীর ছিলেন পিতা আকবরের প্রতিষ্ঠিত ‘দ্বীন-ই-ইলাহী’ র একনিষ্ঠ অনুসারি। পিতার নাম উচ্চারনের পুর্বে তিনি ‘আমার মোর্শেদ’ শব্দ উচ্চারন করতেন। তিনি বলতেন, “আমার মোর্শেদ বুজর্গ ছিলেন বগুবিধ প্রশংসনীয় গুনের অধিকারী। তাহার গুনাবলীর সামান্যতম অংশও যদি কোন বিরাটকায় পুস্তক রচনা করা যায় তবুও তাঁর গুনাবলীর সামান্যতম অংশও বর্ননা করা সম্ভব হবে না। অজস্র ধন সম্পদ, হস্তী-অশ্ব, সৈন্যসামন্ত ও বিশাল পরাক্রমের অধিকারী হওয়া সত্তেও তিনি আল্লাহর দরবারে বড়ই দীনতা ও হীনতা প্রকাশ করতেন। আমার ওয়ালেদ ধর্মে জ্ঞানী ও পন্ডিতগনের সাহচর্য বড়ই পছন্দ করতেন। বিশেষ করে হিন্দু ধর্মের পন্ডিতগনের সাহচর্য ছিল তাঁর অত্যধিক পছ্ন্দনীয়। তিনি সূর্য ও বিভিন্ন দেবতার পূজা করতেন। এইসব করায় কি দীনে মোহাম্মদীর সহিত সত্রুতা ছিল বলে প্রমানিত হয়?” জাহাঙ্গীরের ধর্মবিশ্বাস ছিল এইরকম। তিনিও তাঁর পিতা আকবরের মত মনে করতেন যে, বিবেক যাহা ভাল বলে গ্রহন করবে সেই অনুযায়ী আল্লাহপাকের ইবাদত বন্দেগী করলেই চলবে। তাই ইসলামী শরীয়ত পালনের ব্যাপারে কোন গুরুত্বই তিনি দিলেন না। কবির ভাষায় “যে পথিক চলে না পথ নবীদের পথে, পড়ে রয় সে বহুদুর মনজিল হতে।” মানুষ বদল হল কিন্তু আদর্শ বদল হলনা। জাহাঙ্গীর তাঁর পিতার মত মুরিদ করতে লাগলেন। তিনি সূর্যকে বড়ই সম্মান করতেন এবং পরম শ্রদ্ধাভরে সশব্দে সুর্যের নাম উচ্চারন করতেন। সমস্ত কার্যের উপর নক্ষত্রের প্রভাব আছে বলে তিনি বিশ্বাস করতেন এবং মনে করতেন নক্ষত্রসমুহ নুরে এলাহীর বিকাশস্থল। জ্যোতিস শাস্ত্রে তার অগাধ বিশ্বাস ছিল। তার সভার প্রধান জ্যোতিষ ছিল কৃষ্ণদৈবজ্ঞ । বিশেষ বিশেষ কাজ করবার পুর্বে তিনি জ্যোতিষদের পরামর্শ অনুযায়ী শুভক্ষন ও শুভলক্ষন এর প্রতি বিশেষ লক্ষ্য রাখতেন। তিনি তাহার মুরিদগনকে উপদেশ দিতেন, “কোন ধর্মের প্রতি শত্রুতা করে নিজের মুল্যবান সময় নষ্ট করও না । যুদ্ধের সময় এবং শিকারের সময় ছাড়া কোন জীবকে হত্যা কর না। নক্ষত্রসমুহকে সম্মান করিও। কেননা ঐসব আল্লাহর নূরের বিকাশস্থল এবং ঘটনা ও অবস্হার উপর একমাত্র আল্লাহর প্রভাব আছে বলে মনে কর।” বাদশাহ মনে করতেন, যেহেতু তিনি হিন্দু – মুসলমান সকল জাতির বাদশাহ সুতরাং সব ধর্মের প্রতিই তার সমান পৃষ্টপোষকতা থাকা উচিৎ। এই ধারনার বশবর্তী হয়ে তিনি যেরূপ হিন্দু সাধুদের সম্মান করতেন তেমনি মুসলমান পীর ফকিরদের প্রতিও ভক্তি রাকতেন। তার এই আপোষমূলক নীতির ফলে কাফেরদের প্রভাবতো বিন্দুমাত্র কমলো না বরং আরও বেড়ে গেল। সম্রাট জাহাঙ্গীর সিংহাসনে উপবেশন করে পিতার আমলের আমির ওমরাহগনকে তাদের স্ব স্ব পদে বহাল রাখলেন। ফলে শাহী দরবারে হিন্দুদের প্রভাব বিন্দুমাত্রও কমলনা। কারন দরবারের বড় বড় পদগুলো সব হিন্দুদের দখলেই ছিল। ফলে জিজিয়া কর পুনঃপ্রবর্তিত হলো না, গরু জবেহ বন্ধের হুকুম রহিত হল না । বাদশাহ দুনিয়াদার আলেম ও ভন্ড সুফীদের কার্যকলাপের প্রতি উদাসীন রইলেন। ফলে পরিস্থিতি এমন আকার ধারন করল যে, প্রকৃত ইসলামের নিশানা সমগ্র দেশ থেকে মুছে যাবার উপক্রম হল। ইহার উপর যোগ হল নুতন আর এক ফেতনা। এই ফেতনার মুল নায়িকা হলেন সম্রাট জাহাঙ্গীরের বেগম নুরজাহান। নুরজাহান ছিলেন শিয়া। শিয়া মতাবলম্বীদের কেন্দ্র হল ইরান। বাদশাহ হুমায়ুন ইরানের সুলতানের সহায়তায় শের শাহের হাত থেকে দিল্লীর মসনদ পুনরুদ্ধার করেছিলেন। তখন থেকে শিয়াদের এক বিড়াট দল ভারতবর্ষে এসে বসবাস করতে থাকে এবং শাহী অনুকম্পায় রাষ্ট্রের বহু বিশিষ্ট পদ দখল করতে থাকে। সম্রাট জাহাঙ্গীর ছিলেন আশেক মেজাজের মানুষ। তিনি নুরজাহানকে অত্যধিক ভালবাসতেন। নুরজাহান ছিলেন অত্যধিক বুদ্ধিমতি। সম্রাট জাহাঙ্গীরের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ক্রমে ক্রমে বাদশাহ ও বাদশাহীর উপর একছত্র প্রভাব করে ফেললেন। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌছল যে, সম্রাট জাহাঙ্গীর কেবল নামমাত্র বাদশাহ রইলেন। প্রকৃত ক্ষমতা চলে গেল নুরজাহানের হাতে। বাদশাহ স্বয়ং বলতেন, “আমার বাদশাহী এখন নুরজাহানের ও তার দলের হাতে। আর আমি এক সের শরাব আর আধাসের গোশ্ত পাইলেই খুশী।” নুরজাহানের নানা ছিলেন ইরানের উজির। নুরজাহানের এইরুপ প্রভাব প্রতিপত্তির কথা তার নিকট পৌঁছল। উজির সাব ছিলেন বিখ্যাত শিয়া নেতা। শিয়াগন সুন্নি মোসলমানদের প্রতি চরম শত্রুতা ভাব পোষন করত। নুরজাহানের সাহায্যে তারা সুন্নি মুসলমানদের কোনঠাসা করবার পরিকল্পনা করলো এবং সফলও হল। নুরজাহানের ভ্রাতা আসফ খান হলেন সম্রাট জাহাঙ্গীরের উজির। শিয়া সম্প্রদায়ভুক্ত নুরুল্লা শুছতরীকে প্রধান কাজী নিযুক্ত করা হল। এই কাজী সাহেব সুন্নি মোসলমানদের প্রতি অত্যধিক বিদ্বেষভাব পোষন করতেন। হজরত মোজাদ্দেদ আলফেসানি (রঃ) পরিবর্তিত পরিস্হিতি বিশ্লেষন করে সংস্কারের নুতন পরিকল্পনা প্রনয়ন করবার বিষয়ে চিন্তা শুরু করলেন। পরিস্থিতি ভয়াবহ। আল্লাহর সন্তুষ্টির প্রতি কারও লক্ষ্য নেই। রসুল পাক (সাঃ) এর প্রদর্শিত সরল পথের উপর চলবার কারো আগ্রহ নেই। গতানুগতিক নফসপরস্হ আর শয়তানী স্রোতে গা ভাসিয়ে দিয়ে সবাই অমুল্য সময় বৃথা অতিবাহিত করছে। মুঘল হুকুমত এই শয়তানী ধ্যান ধারনার পৃষ্ঠপোষক। মোজাদ্দেদ আলফেছানি (রঃ) হুকুমত হতে এই শয়তানী শক্তি নির্মুল করার জন্য দন্ডায়মান হলেন। বাদশাহ বদল করলে কাজ হবে না । বাদশাহর এছলাহ (সংশোধন) করতে হবে। তার জন্য সর্বপ্রথমে এছলাহ করতে হবে হুকুমতের আমির – ওমরাহগনের। কারন তাদের সংশোধন ব্যতিরেকে বাদশাহর সংশোধন স্থায়ী হবে না। হজরত মোজাদ্দেদ (রহঃ) তাই ইসলামী আইন-কানুন আকিদা-বিশ্বাসের প্রতি উৎসাহিত করার জন্য খানে আজম, লালাবেগ, খান জাহান, কলীজ খান, শায়েখ ফরিদ প্রমুখ দরবারীদের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। তিনি শায়েখ ফরিদের নিকট লিখলেন, “দেহের মধ্যে আত্মা যেরূপ, বাদশাহ জনসাধারনের মধ্যে সেইরূপ। অন্তর পবিত্র থাকলে দেহও যেমন পবিত্র থাকে। তদ্রুপ বাদশাহ আদর্শবান হলে দেশবাশীও আদর্শবান হয়। আপনি জানেন, পুর্ববর্তী জামানার মুসলমানরা কতই না দুরবস্থার মধ্যে দিনাতিপাত করেছে। ইসলামের প্রথমাবস্থায় মুসলমানগন নগন্য সংখ্যক থাকা সত্বেও এইরূপ দুরবস্হার সম্মুখীন হননি। মুসলমান নিজ ধর্ম পালন করত। আল্লাহ পাক ফরমাইয়াছেন, “লাকুম দিনুকুম ওয়ালিয়াদিন”। অর্থাৎ “তোমাদের জন্য তোমাদের ধর্ম, আর আমাদের জন্য আমাদের ধর্ম।” কিন্তু কিছুকাল পুর্বে বেদীনরা প্রকাশ্যে দৃঢ়তার সাথে তাদের ইসলামী রাষ্ট্রে তাদের ধর্মের প্রচারনা চালাত, কিন্তু মুসলমান গন তদের ধর্ম প্রচার করার ক্ষমতা রাখতেন না। এমনকি এরকম করলে তাদের হত্যা করা হত। আহা কি আফছোস! কি সর্বনাশ! “কি বিপদ! কি কষ্ট!” হজরত মোজাদ্দেদ আলফেছানি (রঃ) আমির লালাবেগের নিকট লিখলেন, প্রায় এক শতাব্দী অতীত হল, ইসলাম পথিকের ন্যায় দিন গুজরান করতেছে। কাফেরগন দারূল ইসলামে প্রকাশ্যভাবে কুফরী আহকাম জারী করেও তৃপ্ত হছ্ছে না । তাদের বাসনা ইসলামী আহকাম নিশ্চিহ্ন হয়ে যাক। মুসলমান ও মুসলমানীর নাম নিশানা যেন বাকী না থাকে। তারা এত বেড়ে গিয়েছে যে, মুসলমান গন ইসলামের কোন শেয়ার প্রচার করতে গেলে তাদেরকে হত্যা করা হয়। গরু কোরবানী করা ইসলামের একটি বিশেষ কাজ। কাফেররা জিজিয়া কর দিতে রাজী হলেও গো হত্যা করতে দিতে রাজী হবেনা বলে মনে হয়। বর্তমানে বাদশাহর রাজত্বের শুরুতেই যদি ইসলামী হুকুমগুলি জারী করা হয় এবং মুসলমানকে সম্মানিত করা হয় তবেই কার্য সিদ্ধি হবে, নতুবা মুসলমানগন সংকটজনক অবস্হায় পতিত হবে। ইয়া আল্লাহ রক্ষা কর! রক্ষা কর ! আল্লাহপাকই জানেন কোন সৌভাগ্যবান ব্যক্তি এই সৌভাগ্যের আকাঙ্খা করে এবং কোন বীরপুরুষ উক্ত দৌলত হাসিল করতে সক্ষম হয়।” কলিজ খানের নিকট লিখিলেন, “আপনার মাধ্যমে এই দুঃসময়েও শ্রেষ্টনগরী লাহোরে যে শরীয়তের অনেক হুকুম প্রচারিত ও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তাহার জন্য আপনার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছ.—হজরত রসুলে পাক (সঃ) বলেছেন, “আমার উম্মতগনের মধ্যে সর্বদাই সত্য পথে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত থেকে জয়ী হবে। বিপক্ষ দল তদের ক্ষতির চেষ্টা করেও সফলকাম হবে না। এইভাবে কিয়ামত পর্যন্ত তাদের অস্তিত্ব বজায় থাকবে।” এইভাবে হজরত মোজাদ্দেদ আলফেছানি (রঃ) হুকুমতের বিভিন্ন গুরুত্বপুর্ন ব্যক্তিবর্গের সহিত যোগাযোগ করে তাদেরকে ইসলাম প্রচারে উদ্বুদ্ধ করেন। সুন্নত ওয়াল জামাতই একমাত্র উদ্ধারপ্রাপ্ত দল এবং তাদের অনুসরনের জন্য দেশের বাদশাহ ও জনসাধারনকে উৎসাহিত করা এবং সমাজের সর্বক্ষেত্রে এই আকিদা প্রতিষ্ঠিত করার মাধ্যমেই যে প্রকৃত ইসলামের খেদমত করা হয়, বিভিন্ন মকতুবের মাধ্যমে তিনি সবাইকে উত্তম রূপে বিশ্লেষন করে দেখালেন। ক্রমে ক্রমে আব্দুর রহিম খানখান জাহান, ছদরে জাহান, খান জাহান, মীর্জা দারাব, কলিজ খান, নবাব শায়েখ ফরিদ, হাকিম ফাতহুল্লাহ, শায়েখ আব্দুল ওয়াহাব, সেকান্দার খান লোদী, খেজের খান লোদী, জব্বারী খান, মীর্জা বদিউজ্জামান, সৈয়দ মাহমুদ, সৈয়দ আহমদ প্রভৃতি ব্যক্তি গন হজরত মোজাদ্দেদ আলফেছানি (রঃ) এর দলভুক্ত হলেন। তিনি তাদেরকে নকশবন্দিয়া তরিকার শ্রেষঠত্ব, বেলায়েত, নবুয়ত, সুন্নতের অনুসরন, ক্বলবের সুস্থতা, নফসে আম্বারার স্বভাব ও তার অনিষ্ট থেকে মুক্ত হবার উপায় ইত্যকার বিভিন্ন বিষয়ে অবগত করিয়ে তাদেরকে সংশোধন করলেন। ফলে হুকুমতের এক বিড়াট অংশ হতে বেদাত ও বেদাত সুলভ মনোভাব দুরীভুত হল। মনে প্রানে এই দল হজরত মোজাদ্দেদ আলফেছানি (রঃ) এর নির্দেশে বাদশাহ জাহাঙ্গীরকে ইসলামের প্রতি উৎসাহিত করতে লাগলেন। বাদশাহ জাহাঙ্গীর আমির ওমরাহগনের মুখে সত্য পথের সন্ধান পেয়ে শরীয়ত প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে আগ্রহান্বিত হয়ে উঠলেন। হজরত মোজাদ্দেদ আলফেছানি (রঃ) সেনাবাহিনির মধ্যেও ইসলাম প্রচারের ব্যবস্হা করলেন। সেনাবাহানী হুকুমতের আর একটি গুরুত্বপুর্ন অংশ। এই অংশের সংশোধন হওয়াও জরুরী। হজরত মোজাদ্দেদ আলফেছানি (রঃ) শায়েখ বদিউদ্দীন (রঃ) কে সেনাবাহিনীর মধ্যে সুন্নত ওয়াল জামাতের আকিদা বিশ্বাস, ক্বলব পরিশুদ্ধ করা ও ক্বলবি জ্ঞান অর্জনের উদ্দেশ্যে নকশবন্দিয়া তরিকার শ্রেষ্ঠত্ব, প্রভৃতি বিষয় প্রচার করার জন্য নিযুক্ত করলেন। আস্তে আস্তে সেনাবাহিনীর এক বিড়াট অংশ হজরত মোজাদ্দেদ আলফেছানি (রঃ) এর ভক্ত হয়ে উঠল এবং অনেকেই তার মুরিদ হলেন। মোজাদ্দেদিয়া কাফেলা দিন দিন বেড়ে চলল। হজরত মোজাদ্দেদ আলফেছানি (রঃ) বিভিন্ন শহর ও গুরুত্বপুর্ন পল্লীঅঞ্চলে খলিফা নিযুক্ত করলেন। তিনি তাহাদের প্রতি নিয়মিত সারগর্ভ নসিহত ও জেহাদের কর্মসুচী পেশ করতে লাগলেন। তার মকতুবাদের অনুলিপি প্রায় একই সঙ্গে বিভিন্ন খলিফার নিকটে প্রেরিত হতে থাকল। এইসব মকতুব ছিল এক একটি সংগ্রামেী ইশতেহার। জেহাদ দ্বিমুখী। প্রথমত নিজের নফসের ও মনের এছলাহ বা সংশোধন ও অপরটি হছ্ছে হুকুমতের বিভিন্ন ক্ষেত্রে, সমাজের বিভিন্ন জায়গায় দীর্ঘ্যকাল ধরে পুঞ্জিভুত বেদাত ও কুসংস্কারের বিলুপ্তিসাধন। সমাজ জীবনে এই বিভ্রান্তির মুল উৎস হছ্ছে দুনিয়াদার আলেম ও ভন্ড সূফিগনের মংড়া বাক্যসমুহ। হজরত মোজাদ্দেদ আলফেছানি (রঃ) দুনিয়াদার আলেমদের স্বরূপ উন্মোচন করে দিলেন এবং তাদের ফেতনা থেকে মোসলমানদের মুক্ত করার জন্য চেষ্টা করে যেতে লাগলেন। তিনি লিখলেনঃ “হাদিস শরীফে উল্লেখ আছে, নিশ্চয় ঐ ব্যক্তিই কিয়ামতের দিন সর্বাপেক্ষা কঠিন শাস্তি ভোগ করবে, যে আলেম নিজের এলেম দ্বারা উপকৃত হয়নি।” ভন্ড সূফীকুলও দীনের মধ্যে ফেতনা বা বিভ্রান্তি সৃষ্টির এক অন্যতম হাতিয়ার। তাদের বাতিল চিন্তাধারা সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রবেশ করে মুসলমানদের আকিদা বিপর্যস্ত করে দিয়েছিল। তাদের অসৎ কার্যকলাপের প্রাবল্য শরীয়তের সৌন্দর্যকে বিকৃত ও বিবর্ন করে দিয়ে মুসলমানদের পদস্খলন ঘকাইতেছিল। হজরত মোজাদ্দেদ আলফেছানি (রঃ) এই বিভ্রান্ত দলের ভিতেও আঘাত হানলেন।
যাইহোক ঐতিহাসিকদের মতে সম্রাট আকবর নতুন ধর্মমত প্রবর্তন করলেও প্রচার করে অনুসারীর সংখ্যা বাড়ানোর দিকে কোন মনোযোগ দেননি। ব্লকম্যান নামে উনিশ শতকের এক বিখ্যাত পণ্ডিত এই ‘দ্বীন-ই-ইলাহী’ ধর্মের দীক্ষিত মানুষদের এক তালিকা প্রস্তুত করেছিলেন। এই তালিকায় ১৮ জনের বেশি নাম নেই। সেই তালিকায় যাদের নাম ছিল তাঁরা হলেন যথাক্রমে, [১] শেখ মোবারক (নাগৌরী) [২] আবুল ফজল (খলিফা), [৩] ফৈজী (কবিরাজ), [৪] জাফর বেগ, [৫] আসফ খান (কবি), [৬] কাসিম কাবুলী (কবি), [৭] আব্দুস সামাদ (চিত্রকর, কবি) [৭] আজম খান, [৮] শাহ মুহাম্মাদ শাহাবাদী (ঐতিহাসিক), [৯] সূফি আহমেদ, [১০] সর্দার জাহাঁ (মহা মুফতি), [১১] সর্দার জাহাঁর ১ নং পুত্র, [১২] সর্দার জাহাঁর ২ নং পুত্র, [১৩] মীর শরিফ আমলী, [১৪] সুলতান খাজা বদর, [১৫] মীর জানী (হাকিম ঠাটঠা), [১৬] নকী সুস্তরী (কবি), [১৭] শেখজাদা গোসালা (বানারসী), [১৮] রাজা বীরবল।
সম্রাট আকবরের ‘দ্বীন-ই-ইলাহী’ ধর্মের অনুসারী নগণ্য ছিল বলে তিনি তাঁর ধর্ম নিয়ে কোন গর্ববোধ করতেন না। দীক্ষা গ্রহণে কোন জবরদস্তি ছিল না বলেই আকবরে ঘনিষ্ঠ মান সিংহ, ভগবান দাস, টোডরমল প্রমূখ্য ব্যক্তিত্ব আকবর প্রবর্তিত এই ধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করেন নি। সম্রাট আকবর কেন জোর করে লোকেদের তাঁর ধর্মে দীক্ষা দিতেন না এ নিয়ে ইতিহাস গ্রন্থে এক মজার ঘটনার উল্লেখ আছে। ঐতিহাসিক গোলাম আহমেদ মোর্তাজা লিখেছেন, “আকবর ফৈজীর লেখা নিজ গুণগান সম্বলিত কবিতা হাতে নিয়ে দণ্ডায়মান হলেন। কিন্তু ঐতিহাসিক নাটকীয় ঘটনা এই যে, মাত্র তিন লাইন কবিতা আবৃত্তি করেই আকবর চোখে যেন কুয়াশাচ্ছন্ন অন্ধকার দেখতে লাগলে। তবু মনকে চাঙ্গা করে আবৃত্তি করতে লাগলেন, কিন্তু পারলেন না। তিনি যেন নিজ কানে শুনতে পাচ্ছিলেন নিজের বুকের স্পন্দন। হৃদকম্পনের কারণে তাঁর একটি হাত বুকে বোলাতে লাগলেন। একটার পর একটা উপসর্গ দেখা দিতে লাগল। প্রথমে চোখ বিদ্রোহ করল, তারপর কণ্ঠস্বর বিদ্রোহী হয়ে উঠল। শেষে তাঁকে মিম্বরের উঁচু ধাপ থেকে নীচে নেমে আসতে হোল। সকলেই হতবাক। সমস্ত প্রোগ্রাম পণ্ড। অবশেষে কোনরকমে বললেন, ‘জোর করে নয়, ইচ্ছা করলে যে কেউ এই নতুন ধর্ম ‘দ্বীন-ই-ইলাহী’ গ্রহণ করতে পারে।’ …………
১৫৮৮ খ্রীষ্টাব্দে রাজা ভগবান দাসের ভাগ্না, দত্তক পুত্র এবং উত্তরাধীকারী মান সিংহকে আকবর তাঁর নতুন ধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করতে অনুরোধ বা আদেশ করেছিলেন। কিন্তু তিনি যা জবাব দিয়েছিলেন তা চমকপ্রদ ও উল্লেখযোগ্য। মান সিংহ বলেছিলেন, ‘যদি জীবন উৎসর্গ করার সংকল্পই হয় মহামান্য সম্রাটের মতবাদ গ্রহণের একমাত্র অর্থ, তাহা হইলে আমার ধারণা, আমি যে সম্রাটের একজন বিশ্বস্ত অনুসারী তাহার প্রমাণ আমি যথেষ্টই দিয়েছি। কিন্তু আমি একজন হিন্দু, সম্রাট আমাকে মুসলমান হইতে বলিতেছেন না। আমি তৃতীয় কোন ধর্মের কথা অবগত নহি।’ নবরত্নের এই অন্যতম সদস্য রাজা টোডরমলও আকবরের ধর্ম প্রত্যাখ্যান করেছিলেন এবং তিনি ১৫৯০ খৃষ্টাব্দে হিন্দু অবস্থাতেই পরলোকগমন করেন।” (চেপে রাখা ইতিহাস, পৃষ্ঠা – ১৫২/১৫৩)
আকবর তাঁর ধর্ম কেন প্রবর্তন করেছিলেন এ নিয়ে ঐতিহাসিক মহলে নানা বিশ্লেষণ পাওয়া যায়। অনেকের মতে, সম্রাট হিন্দু মুসলমানের মধ্যে ঐক্য স্থাপনের জন্যই এটা করেছিলেন। তবে ঐতিহাসিক বাদায়ুনির মতে, আবুল ফজলের মতো স্তাবকদের প্ররোচনাতেই সম্রাট এই মতবাদের প্রচলন করেন। আকবরের জীবদ্দশাতেই এই মতবাদ টিকে ছিল ছিল। তাঁর মৃত্যুর পরা সম্রাটের সাথে সাথেই তাঁর ধর্মেরও সমাধীস্থ হয়। আর যাঁরা ‘দ্বীন-ই-ইলাহী’ ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন তাঁদের সাধারণত এই ধর্মের প্রতি কোন টান ছিল না। শুধুমাত্র সম্রাটকে খুশি করে রাজসভার সুযোগ সুবিধা ও বিভিন্ন পদ হাতানোর জন্যই এই ধর্মের অনুসারী হয়েছিলেন।
বিভিন্ন ঐতিহাসিক আকবরের বিরুদ্ধে ইসলাম ধ্বংস করার অভিযোগ আনলেও কিছু ঐতিহাসিক ভিন্ন মত পোষন করেছেন। তাঁদের মতে ‘দ্বীন-ই-ইলাহী’ প্রধানত একটি ধর্মনৈতিক দার্শনিক মতবাদ ছাড়া অন্য কিছু নয়। যদিও আকবর সেই সময় কিছু ইসলামী আচার আচরণ বন্ধ করে দিয়েছিলেন তবুও একথা কোনদিন বলা যায় না যে তিনি ইসলামবিরোধী দৃষ্টিভঙ্গির জন্য এসব কাজ করেছিলেন। আকবর ইসলামের উপ – সম্প্রদায়ের সীমাবদ্ধতাকে আশ্রয় দেননি। এই দৃষ্টিভঙ্গি ইসলামের সর্বজনীনতার প্রতি তাঁর শ্রদ্ধারই বহিঃপ্রকাশ। তিনি হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) এর পদচিহ্ন বলে পাথর সংরক্ষিত করে ‘কদম – রসুল’ সৌধ নির্মাণ করেছিলেন। আকবর কুরআন শরীফকে অশ্রদ্ধা করেছেন অথবা মসজিদে আরবী ভাষার ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছেন বলে কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না। যে সমস্ত মাদ্রাসায় আকবরের বিরোধীরা সম্রাটের বিরুদ্ধে বিদ্রোহকে উসকে দিয়েছিলেন সেইসব মাদ্রাসাকেই আকবর বন্ধ করে দিয়েছিলেন। তিনি ভক্তভরে সূফি – সাধকদের সমাধীতে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করতেন। সম্রাট ইসলাম ধর্ম প্রচারকদের জন্য সরকারি পৃষ্ঠোপোষকতা ও হজ্জ্বযাত্রীদের জন্য নানা সুবিধার ব্যবস্থা করেছিলেন বলে ঐতিহাসিকরা মন্তব্য করেছেন।
আতহার আলির মতে, “এই মত ব্যাখ্যা করা যায় না যে, আকবরের আমলের শেষ বছরগুলিতে সামগ্রিকভাবে ইসলামের ক্ষতি হয়েছিল।” (সুলহ – ই – কুল এবং আকবরের ধর্মীয় ভাবনা, অন্তর্ভুক্ত – ঐতিহাসিক ইরফান হাবীব সম্পাদিত, মধ্যকালীন ভারত, খণ্ড – ৩, কে পি বাগচী অ্যান্ড কোম্পানী, কলকাতা, ২০০৮, পৃষ্ঠাঃ ৯২)
আতহার আলি আরও বলেছেন, “আকবরের রাজত্বের শেষের দিকের বছরেও নিয়মিত মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছিল। গো – হত্যা নিষিদ্ধ হলেও এর অর্থ কোন ইসলামীয় প্রথাকে কোনোভাবে খর্ব করা নয়।” (প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা – ৯৩)
সম্রাট আকবর কোন কোন ক্ষেত্রে ইসলামের আদর্শ থেকে সরে পড়েছিলেন তবুও তাঁর বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ অসংগত যে, তিনি ইসলাম ত্যাগ করেছিলেন। কারণ তিনি কখনোই আনুষ্ঠানিকভাবে ইসলামের বিরোধীতা করেন নি এবং জীবনের শেষদিন পর্যন্ত নিজেকে একজন মুসলিম বলেই মনে করতেন। সম্রাটের পুত্র জাহাঙ্গীর বলেছেন, “আমার পিতা এক মুহুর্তের জন্যও আল্লাহকে ভুলে যান নি।” (তুজুক – ই – জাহাঙ্গীরী, এ রজার্গ ও হেনরি রেভারিজ অনুদিত, খণ্ড – ১, পৃষ্ঠা – ৩৭)
জাহাঙ্গীরের এই মতকে সমর্থন করে আবুল ফজল বলেছেন যে, আকবর আত্মপরীক্ষা অথবা আল্লাহর উপাসনায় তাঁর জীবনের প্রতিটি মুহুর্ত অতিবাহিত করতেন। এ ছাড়া সমসাময়িক লেখক নুরুল হক বলেছেন, ১৫৭৮ সাল পর্যন্ত আকবর রীতিমতো ইসলাম ধর্মের পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করতেন। (তবকাত – ই – আকবরী, লেখকঃ নিজামউদিন আহমেদ, অনুবাদঃ ইলিউট ও ডওসন, খণ্ড – ৬, পৃষ্ঠা – ৩৮৯, আরও দেখুন – এ কে এম আব্দুল আলিম, ভারতে মুসলিম রাজত্বের ইতিহাস, মাওলা ব্রাদারস, খণ্ড – ৮, পৃষ্ঠা – ৯৩)
একদিকে যেমন আকবরের ধর্মবিরোধীতার প্রমাণ পাওয়া যায় অন্যদিকে কোন কোন ক্ষেত্রে তাঁর যথেষ্ট গোঁড়ামি ও ইসলামের অনুরাগের প্রমাণও পাওয়া যায়। ১৫৯২ খ্রীষ্টাব্দে রাজা মান সিংহ যখন রাজমহলে একটি হিন্দু মন্দির নির্মাণে উদ্দ্যোগী হয়েছিলেন, তখন আকবর মন্দিরের পরিবর্তে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। ১৫৮২ খ্রীষ্টাব্দের কিছু আগে মক্কার শরিফদের কাছে লেখা চিঠিতে এবং ১৫৫৬ খ্রীষ্টাব্দে বুখারার শাসক আব্দুল্লাহ খানকে লেখা দুটি চিঠিতে সম্রাট আকবর স্পষ্ট ভাষায় লিখেছিলেন যে, তিনি একজন একনিষ্ঠ মুসলিম এবং ইসলামের পৃষ্টপোষক। স্যার টমাস রো – র বক্তব্য থেকেও জানা যায় আকবর একজন মুসলিম হিসাবেই শেষ নিশ্বাস পরিত্যাগ করেন। ডু – বোরিকের ভাষ্য মতে, “১৬০৪ খ্রীষ্টাব্দে ইসলাম সুপ্রতিষ্ঠিত হয়।” তবে পরধর্মসহিষ্ণু আকবর অন্যান্য ধর্ম সম্পর্কে শ্রদ্ধাশীল ছিলে এবং তাদের দ্বারা আকৃষ্ট হয়েছিলেন। রাহুল সংস্কৃত্যায়নের মতে, খ্রীষ্টান সাধুরা বহু বিষয়েই প্রচুর অতিশয়োক্তির সাহায্য নিয়েছেন এবং বাদশাহের কঠোর ইসলাম বিরোধীতাকে অতিরঞ্জিত করে প্রকাশ করেছেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সম্ভবত তাঁদের মনে ইসলামের প্রতি যে ঘৃণা, তা আকবরের নামে প্রকাশ করতে চেয়েছিলেন। (আকবর, রাহুল সংস্কৃত্যায়ন, পৃষ্টাঃ ২৫৬/৫৭)
তাই কিছু ঐতিহাসিক মনে করেন আকবরের বিরুদ্ধে ইসলাম বিচ্যুতির অভিযোগ গ্রহণ করা যায় না।
‘নবজাগরণ’ অ্যান্ড্রোয়েড অ্যাপ্লিকেশনটি প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর টেলিগ্রাম চ্যানেলে জয়েন হতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর ফেসবুক পেজে লাইক করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।