মারাকাত বালাদ আশ শুহুদা (শহীদের রাজপথ)। ১০- ই অক্টোবর ৭৩২ খ্রিষ্টাব্দ, বর্তমান দক্ষিণ- পশ্চিম ফ্রান্সের ত্যুর ও পয়তিয়ার শহর দুটির মধ্যবর্তী এলাকায় এক বিশাল নির্ণায়ক যুদ্ধ হয়েছিল। মুসলিম বিজয়ের ঘনঘটার বিপরীতে এখানে মুসলিমদের শুধু পরাজয়ই হয়নি, প্রচুর মুসলিম শাহাদাত অর্জন করেছিলেন। মুসলিমদের শুধু পরাজয়ই হয়নি অ্যাকুইটেনরাজ, ফ্রাঙ্কজাতির চার্লস মার্টেল এর বাহিনী মুসলিম বাহিনীর ২০ হাজারের ১২০০০ কে শহীদ করেছিল। তাই এই যুদ্ধকে আরবিতে বলা হয় মারাকাত বালাদ আশ শুহুদা। ঐতিহাসিকরা এই যুদ্ধের ফলাফল হিসেবে মনে করেন, সমস্ত ইউরোপ ইসলামের পদানত হওয়া থেকে বেঁচে গিয়েছিল। এই যুদ্ধের বীরগাথা পরবর্তীকালে স্পেন পুণর্বিজয়ে ক্যাথলিকদের অনুপ্রাণিত করেছিল।
একাদশ শতকে মুসলিম দুনিয়ার ঠাসবুনোট চরিত্রটি অনেকটাই নষ্ট হয়ে যায়। মিশরে ফাতেমিদের উত্থান এবং নিজেদের বাগদাদ কেন্দ্রিক আব্বাসীয়দের প্রতিদ্বন্দ্বী রূপে প্রতিষ্ঠা স্পেন (টলেডো অধিকার ১০৮৩ খ্রিস্টাব্দে) সিসিলি (নোটো ১০৯১) ও বাইজান্টীয়দের (১০২৫ খ্রি. থেকে বিজয় শুরু) মুসলিমদের বিরুদ্ধে কয়েকটি সাফল্য অর্জনে সহায়তা দান করে। কিন্তু প্রবল সেলজুক তুর্কিদের উত্থান পূর্বদিকে খ্রিস্টান বিজয়রথকে অনেকটাই আটকে দিয়ে বরং বাইজান্টিয়াম সাম্রাজ্যে হামলা করতে থাকে। সেলজুকরা বাইজান্টিয়াম সাম্রাজ্যে কয়েকটি বিজয় লাভও করে। এই সময়ে বিপদ বুঝে মতবিরোধ (বাইজান্টীয়রা ছিল গ্রিক অর্থডক্স) থাকা সত্ত্বেও রোমান ক্যাথালিক পোপ আরবান ২ কে মুসলিম সাম্রাজ্য আক্রমণে আহ্বান করেন। পোপ মুসলিমদের হাত থেকে জেরুজালেম উদ্ধারের একটি উন্মদনা তৈরি করেন। ১০৯৫ খ্রিস্টাব্দে রোমান ক্যাথলিক বিশাল বাহিনী পূর্ব দিকে অগ্রসর হয়। এই বাহিনীর অজ্ঞতার ফলেই আহ্বানকারী অর্থডক্স বাইজান্টিয়াম সাম্রাজ্যও আক্রান্ত হয়। অ্যান্টিয়ক হয়ে জেরুজালেম পর্যন্ত পৌঁছাতে সময় লাগে ১০৯৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত।
জেরুজালেমে গনহত্যার বিবরণ আমরা জানি। এই গনহত্যার মূল হোতা ছিল ফ্রাঙ্ক বাহিনী। এদের সঙ্গে ছিল স্বল্প সংখ্যক হাঙ্গেরি, জার্মান ও স্পেনীয় বাহিনী। বস্তুত ২০০ বছরের সমস্ত ক্রুসেড যুদ্ধে ফরাসি নাইট যোদ্ধারা নেতৃত্ব দিয়েছিল। তারা বিজিত দেশগুলিতে ফরাসি ভাষা আনয়ন করেছিল। তাই আরবরা ক্রুসেড যোদ্ধাদের প্রায় পাইকারি হারে বলত ফ্রানজি। এই ফ্রানজি থেকেই পরবর্তীকালে সমস্ত ইউরোপীয়দের বলা হত ফিরিঙ্গি।
জেরুজালেম দখলের পর সংখ্যাগুরু ফরাসিরা মুসলিম, ইহুদি ও অর্থোডক্স খ্রিস্টানদের রক্তের নদী বইয়ে দিয়েছিল। এই ইতিহাস কমবেশী আমরা সবাই জানি। অন নাসির সালাহউদ্দিন ইউসুফ ইবন আইউব। পাশ্চাত্য যাঁকে মহান সালাদিন নামে ডাকে সেই সালাদিন হিত্তিনের যুদ্ধে (৪ জুলাই ১১৮৭) জেরুজালেম পুনর্বিজয়ের পর একজনকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন তার নাম রেমন্ড। এই রেমন্ড ছিলেন ফরাসি জাতীয় এবং বার বার নবী করীম (সোয়াল্লাল্লাহু আলাইহেস সালাম) এর শানে বেয়াদবি করত এবং বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে মক্কাগামী হজযাত্রীদের জাহাজ লুট করেছিল। সালাদিন প্রতিজ্ঞা করেছিলেন রেমন্ডকে ধরতে পারলে মৃত্যুদণ্ড দেবেন। জেরুজালেম বিজয়ের পর ইউরোপীয় ঐতিহাসিকদের নিকট মহান সালাদিন, রেমন্ড ধরা পড়লে তাকে তৎক্ষণাৎ মৃত্যুদণ্ড দেন।
এরপর খ্রিস্টান ক্রুসেডার বাহিনীর সাহস হয়নি মুসলিমদের পরাক্রমের সামনে মাথা তুলে দাঁড়াতে। সুযোগ পায়, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর, ততদিন ৭০০ বছরেরও বেশি অতিক্রান্ত। ক্রুসেডাররা চেষ্টা করেছিল মোঙ্গলদের মাধ্যমে মুসলিমদের ধ্বংস করার। ১২৬০-এ আইন জালুত প্রান্তরে সে দূরাশাও মামলুকদের হাতে নির্মূল হয়।
১৯২০-তে গোপন সাইকস পিকো চুক্তির অঙ্গ হিসাবে ফ্রান্স অখন্ড সিরিয়া দখল করে বেঁচেখুচে খুঁজছে থাকা মারুনীয় খ্রিষ্টানদের জন্য লেবানন দেশটি তৈরি করে আর এমন কৌশল করে যাতে বাকি সিরিয়ার উপর সংখ্যালঘু নুসাইরিদের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা হয়। এর কুফল এখন সমস্ত এলাকা জুড়ে ফলছে।
ফ্রান্স আলজেরিয়া দখল করে ১৮৩০-এ। আলজেরিয়া স্বাধীনতা পায় ১৯৬২-তে।
১৫ অক্টোবর, ১৯৫৭ সালে আলজেরিয়ায় ক্রুসেডার ফ্রান্সের ঔপনিবেশিকতার সময়কালে শহিদা জুলেখা শায়িব নামক এক আলজেরীয় ভাগ্যবিড়ম্বিতা নারীর করুন কাহিনি।
.
ফরাসিরা তাকে গ্রেফতার করার পর প্রথমে গণধর্ষণ করে। নোঙরে হাত বেঁধে, সামরিক গাড়ির পেছনে বসিয়ে বেদনাবিধুর এই দৃশ্যটা ক্যামেরেবন্দি করে রাখে।
এই গাড়িতে বেঁধেই, প্রকাশ্যে জনসম্মুখে জুলেখা শায়িবকে আলজেরিয়ার পথে পথে টেনে হেঁচড়ানো হয়। ঘোষণা করা হয়- যারাই ফ্রান্সের বিরোধিতা করবে, তার পরিণতি এমন হবে; এতে সে নারী হোক বা পুরুষ!
টানা ১০ দিন জুলেখা শায়িবকে অবর্ণনীয় নির্যাতন করার পর ২৫ অক্টোবর, ১৯৫৭, হেলিকপ্টারে উঠিয়ে, শূন্য থেকে মাটিতে নিক্ষেপ করে শহিদ করা হয়। মাটিতে পড়েই দেহ থেঁতলে যায়। কিন্তু তার লাশের খবর কেউ বলতে পারেনি।
১৯৮৪ সালে স্থানীয় এক কৃষকের মনে পড়ে- ২৭ বছর আগে, রাস্তের পাশে একজন নারীর থেঁতলানো লাশ পেয়ে সে দাফন করেছিল। লোকজনকে সে ওই জায়গা দেখালে, লোকেরা সেই জায়গাটা খুঁড়ে কিছুক্ষণ পরই এক মানুষের কঙ্কাল বার করে। এটাই ছিল শহিদা জুলেখা শায়িবের কঙ্কাল।
ফরাসি গোলযোগ
ফ্রান্সে যা ঘটছে তা নির্বাচনের পূর্বে সংখ্যালঘুর উপর অত্যাচার ছাড়া কিছু নয়।
জানুয়ারী (২০২০) মাস থেকে সমস্ত ফ্রান্স জুড়ে ৭৩ টি মসজিদ ও ব্যক্তিগত ভাবে পরিচালিত মাদ্রাসা ফরাসি সরকারি কর্তৃপক্ষ বন্ধ করে দিয়েছে। অজুহাত কট্টর ইসলামপন্থার বিরুদ্ধে লড়াই। গত মঙ্গলবার ১৩ অক্টোবর এক সংবাদিক সম্মেলনে ফ্রান্সের আভ্যন্তরীণ মন্ত্রী জেরাল্ড ডার্মানান এই কথা বলেছেন।
এ ছাড়াও মন্ত্রী বলেছেন কয়েকশো বিদেশীকে ফ্রান্স থেকে বিতাড়িত করা হবে। “আমরা নিশ্চিত ভাবে ২৩১ জন বিদেশিকে দেশ থেকে বিতাড়িত করব যারা অবৈধভাবে অবস্থান করছে। এর মধ্যে রয়েছে ১৮০ জন জেলবন্দি।”
আসলে পরিবেশ বহুদিন ধরেই উত্তপ্ত হয়ে আসছিল। সেপ্টেম্বরের ২০ তারিখে কোভিড নিয়ে পার্লামেন্টারি বৈঠকের সময় এক হিজাব পরিহিতা ছাত্রী মরিয়াম প্যুজো এক ছাত্র ইউনিয়নের প্রতিনিধিত্ব করার সময় দক্ষিণপন্থী দলের এমপিরা বৈঠক বয়কট করে। কারণ, হেজাব পরিহিতার সঙ্গে তারা বৈঠক করবে না। এক হিজাব পরিহিত মহিলাকে তাঁর ৩ ও ১২বছরের সন্তানের সামনে ১ বৃদ্ধ ছুরিকাঘাত করে। আততায়ী ভান করেছিল সে যেন মহিলাটিকে কিছু জিজ্ঞাসা করতে আসছে। সুরি লা কোমটাল গ্রামে এ ঘটনা ঘটেছে।
শ্রেণিকক্ষে কার্টুন শো করা এবং তার পরিনামে শিক্ষককে হত্যা এবং পাল্টা আততায়ীকে হত্যা ফ্রান্সের রাজনৈতিক বিতন্ডা উচ্চমার্গে তুলে দিয়েছে।
যদিও ফ্রান্সে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন ২০২২-এ। তাই অনেকেই বলতে চাইছেন ইসলাম বিরোধী বা ভীতির প্রকাশ কোনো নির্বাচন কেন্দ্রিক নয় যা দুই বছর পরে ঘটতে চলেছে।
কিন্তু ডকুমেন্টিং অপ্রেশন এগেনস্ট মুসলিমস (DOAM) বেশকিছু অত্যাচারের ঘটনা ২০১৫-তেও লিপিবন্ধ করেছে। ২০১৬,১৭,১৮ বা ২০১৯-এও ফ্রান্সে ইসলাম ভীতির কোন ঘটনা ঘটেনি।
২০১৫-র কয়েকটা ঘটনা বলি যার ২ বছর পর ২০১৭- ফ্রান্সের রাস্ট্রপতি নির্বাচন ছিল।
ডিসেম্বর ২১, ২০১৫ প্যারিস এয়ারপোর্টের দুই মুসলিম কর্মচারীর দিকে বন্দুকের গুলি করা হয়, কারণ তাদের দাড়ি বেশ লম্বা হয়েছিল। ডিসেম্বর ২, প্যারিসের ২ টি মসজিদে তালা মেরে দেওয়া হয়, অভিযোগ কট্টরপন্থা। নভেম্বর ১২, হিজাব পরিহিতা এক মুসলিম নারীকে বাক্স কাটার ছুরি দিয়ে আক্রমণ করা হয়। বিশাল মিছিল করে স্লোগান দেওয়া হয় ‘মুসলিমদের বার করে দাও’। এক শহরের কট্টরপন্থী মেয়র ঘোষণা করে তার শহরে প্রাচ্যের কাবাব হাউজ করতে দেওয়া হবে না। কারণ, তা আমাদের সংস্কৃতির বিপরীত। সরকারের কাছে জানতে চাওয়া হয় হিজাব নিষেধাজ্ঞার বেশ কয়েক বছর পরও অকৃতকার্যতার কারণ কি?
২০১৫ ও ২০২০-র পরপর ঘটে যাওয়া আক্রমণ নিছকই ইসলাম ভীতির কারণে নয়। বরং তা পরিকল্পিত। ২০১৭-র প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ছিল পাখির চোখ এখন ২০২২-এর নির্বাচনকে পাখির চোখ করা হয়েছে। তাহলে কি গণতন্ত্র সংখ্যালঘু ও দুর্বলের উপর অত্যাচারের আরেকটি নাম? আমরা ভারতীয় ঘরপোড়া গরু।
দুই মুসলিম মহিলাকে আইফেল টাওয়ারের নিচে ছুরিকাঘাত করা হয়েছে। একজন আশঙ্কাজনক, যাঁকে ৬ বার ছুরিকাঘাত করা হয়েছে।
তবে এই কান্ডের জন্য পুলিশকে গুলি চালাতে হয় নি, মেরে ফেলতে হয়নি আতাতায়ীকে। যেমন তৎক্ষণাৎ পুলিশের গুলিতে প্রাণ দিতে হয়েছিল শিক্ষকের শিরশ্ছেদকারীকে। আততায়ী পুলিশ হেফাজতে।
পুলিশ, মিডিয়া এবং জনসাধারণ বলতে শুরু করেছে একটি জাতী বিভেদকারী ঘটনা। কারণ, ছুরিকাঘাত করার সময় বারবার বলেছিল, ‘নোংরা আরব’ অর্থাৎ এটি কোন সন্ত্রাসী ঘটনা নয়।
কয়েকটি মাত্র ইউরোপীয় সংবাদ সংস্থা খবরটি দিয়েছে এবং বলা হয়েছে দুই ইউরোপীয় শ্বেতকায় মহিলা ঘটনাটি ঘটিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী ম্যাঁক্রো আহতদের দেখতে যাওয়ার প্রয়োজন বোধ করেননি। এখানে খ্রিস্টান সন্ত্রাস কথাটি দূরে থাক, শ্বেতকায় প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়নি, খ্রিস্টান প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার কথাও বলা হয়নি, বলা হয়নি এর জন্য সমস্ত শ্বেতকায় বা সমস্ত খ্রিস্টান দায়ী।
১৯৯০-এ আলজেরিয়ার সাধারণ নির্বাচনে ইসলামি স্যালভেসন পার্টির জিতে আসার সমস্ত রাস্তা রোধ করে আলজেরিয়ার সেনাবাহিনী। অঙ্গুলিহেলনে ছিল ফ্রান্সের সরকার। সাম্প্রতিক লিবিয়ায় গাদ্দাফিকে হটান ও গৃহযুদ্ধের মূল হোতা ফ্রান্স। সাব সাহারান আফ্রিকায় উপনিবেশ গুলিতে তাদের বিনিময় কারেন্সি রূপে এখনও পর্যন্ত ফ্রাঁকেই রেখে দিয়েছে। আর এই বিনিময় প্রথাকে যেই ভাঙতে চাই তাদেরই গদি উল্টে যায়। অর্থাৎ ফ্রান্স অফ্রিকায় তার প্রাক্তন উপনিবেশ গুলিতে না থেকেও রাজনৈতিক ও আর্থিক ক্ষমতা ভোগ করে।
প্যারিসে এক গণহত্যায় ৪৫ হাজার আলজেরীয়কে মারা হয়। তারই এক ঝলক।
ফ্রান্স ও ফ্রাঙ্ক জাতি এমনই…!
.
লিখেছেনঃ চৌধুরী আতিকুর রহমান
‘নবজাগরণ’ অ্যান্ড্রোয়েড অ্যাপ্লিকেশনটি প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর টেলিগ্রাম চ্যানেলে জয়েন হতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর ফেসবুক পেজে লাইক করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।