লিখেছেনঃ সুরজিৎ দাশগুপ্ত
সেটা ১৯৫২ সালের মে মাস। গরমের ছুটিতে আমি তখন মায়ের কাছে জলপাইগুড়িতে। জানলাম অন্নদাশঙ্কর সপরিবারে এসেছেন দার্জিলিং-এ। আমরা কয়েক বন্ধু জলপাইগুড়ি থেকে চলে গেলাম দার্জিলিঙে। নানা বিষয়ে আলাপ। এক সময় কথা উঠল মাস তিন-চারেক আগে ঢাকার পথে ঘটে যাওয়া ভাষায় জন্যে বাঙালির প্রাণ দেওয়ার ঘটনার অর্থাৎ একুশে ফেব্রুয়ারির কথা। এতক্ষণ অন্নদাশঙ্কর শান্তভাবেই শিল্পসাহিত্য নিয়ে কথা বলছিলেন। কিন্তু একুশে ফেব্রুয়ারির কথা উঠতেই তিনি হঠাৎ উঠে দাঁড়ালেন, একটুখানি উত্তেজনার সঙ্গে বললেন, ‘এই বাহান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবে, এর সুদূরপ্রসারী ফল ফলবে পৃথিবীর ইতিহাসে।’ কী আশ্চর্য ভবিষ্যদ্বাণী!
এই ভবিষ্যদ্বাণী করেই অন্নদাশঙ্কর ক্ষান্ত হননি। একুশে ফেব্রুয়ারির এক বছর পূর্তি যাতে যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে পালন করা যায়, তার যথাযোগ্য আয়োজনও করলেন শান্তিনিকেতনে। বাংলা তখন ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ভাগ হয়ে গেছে বটে, কিন্তু বাঙালিজাতি ও বাংলাভাষা তো ভাগ হয়নি, বাংলা সাহিত্যের অতীত ও ঐতিহ্য, গৌরব ও সৌন্দর্য একই আছে, একই আছে বাংলার আকাশ বাতাস। একইরকম আছে সর্ষে তেলে রাঁধা মাছের বাঙালি রুচি ও স্বাদ। এই বাঙালি অখণ্ডতাকে উদ্যাপন করার জন্য তিনি এক সাহিত্যমেলার আয়োজন করলেন।
সৌভাগ্যক্রমে ১৯৫৩ সালে একুশে ফেব্রুয়ারি আর দোল মানে বসন্তোৎসব একেবারে পিঠোপিঠি এল। ঠিক হল যে পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসবেন কয়েকজন সাহিত্যিক আর পশ্চিম বাংলা থেকে আসবেন কয়েকজন সাহিত্যিক। দু-বাংলার সাহিত্যিকদের মেলামেশার প্রাঙ্গণ হবে শান্তিনিকেতন। আলোচনাচক্র বা সভাসমিতি নয়, আলিঙ্গন ও কোলাকুলি। রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনই বিছিয়ে দিতে পারে এরকম ভালোবাসার আঁচল। স্বভাবতই পূর্ববাংলা থেকে দল বেঁধে অনেক সাহিত্যিকের আগমন সম্ভব ছিল না। কাজি মোতাহের হোসেন, মনসুরউদ্দিন, শামসুর রাহমান প্রমুখ মাত্র। পাঁচজন এসেছিলেন পূর্ববাংলা থেকে করাচিস্থ পাকিস্তান সরকারের বিশেষ অনুমতিতে।
পাকিস্তান সরকার আদৌ কাউকে আসতে দেবেন কি না এ নিয়ে আশঙ্কা ছিল। কিন্তু শান্তিনিকেতন জায়গাটার মাহাত্ম আলাদা। পূর্ববাংলার সাহিত্যিকরা শান্তিনিকেতন ছাড়া কোথাও যেতে পারবেন না এই শর্তে করাচির কর্তারা পূর্ববাংলার সাহিত্যিকদের ভারতে আসতে দিয়েছিলেন। শামসুর রাহমান তার ‘কালের ধূলোয় লেখা’ নামের আত্মজীবনীতে এবং শঙ্খ ঘোষ ‘করুণ রঙিন পথ’ নামের ভ্রমণকথাতে এই সাহিত্যমেলার বিবরণ দিয়েছেন।
আগেই বলেছি, এই সাহিত্যমেলা আয়োজিত হয়েছিল বাহান্নর একুশে ফেব্রুয়ারির এক বছর পূর্তিতে। পূর্ববাংলার বাইরে সেই প্রথম অমর একুশে উদ্যাপন করা হল, যাঁর আবেগে ও কল্পনায় তিনি অন্নদাশঙ্কর রায়। সেই যে দার্জিলিঙে তিনি বলেছিলেন একুশে ফেব্রুয়ারির ফল একদিন দেখব পৃথিবীর ইতিহাসে, তার ফল ফলল উনিশশো তেপান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি। সেই একুশে থেকেই বাঙালি জাতীয়তাবাদের জন্ম, তার থেকেই বাংলাদেশের স্বাধীন দেশরূপে জন্ম, তার থেকেই রাষ্ট্রসঙেঘ স্বীকৃত অন্যতম ভাষারূপে বাংলাভাষার গৌরব, যে গৌরব ভারতের অন্য কোনও ভাষার নেই, এবং অবশেষে একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তজাতিক মাতৃভাষা দিবসরূপে স্বীকৃতি।
বাংলাভাষা ও বাংলাদেশের ঐতিহ্য, জীবন ও সংস্কৃতির সঙ্গে অন্নদাশঙ্করের জীবনও অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। প্রথম পঁচিশ ছাব্বিশ বছরের প্রায় সবটাই তার কেটেছে বাংলার বাইরে—কখনও ওড়িশায়, কখনও বিহারে, কখনও বিলেতে। আই সি এস পরীক্ষায় সারা ভারতের মধ্যে প্রথম হয়ে বিলেতে গিয়ে প্রশিক্ষণ নেওয়ার ফাঁকে ফাঁকে তার ইউরোপে ভ্রমণ। সেই ভ্রমণকালে ‘পথে প্রবাসে’ নামে বৃত্তান্ত লিখে বাংলাসাহিত্যের জগতে তার নাটকীয় আবির্ভাব। দেশে ফেরার সময় হলে তাকে জিজ্ঞেস করা হয় যে তিনি কর্মক্ষেত্র হিসেবে কোন্ প্রদেশ চান। তখন তিনি বাংলাই চাইলেন। কারণ উড়িয়া সাহিত্যিকরূপে ইতিমধ্যেই বিখ্যাত হয়ে থাকলেও তিনি চাইছিলেন রবীন্দ্রনাথের উত্তরসাধকরূপে স্বীকৃতি। তার মানে বাঙালি সাহিত্যিকরূপে খ্যাতি। সেই জন্যে বাংলাদেশেই তার বাস করা চাই। কর্মজীবনের শুরুতে সেদিন তিনি বাংলাদেশ বলতে বর্তমান বাংলাদেশ নয়, এক অখণ্ড অবিভক্ত বাংলাকেই বুঝেছিলেন। সে বাংলা ছিল তার অর্জন করা বাংলা। তাঁর ধ্যানের বাংলা। সেই বাংলাকে ভেঙে যখন দু’ভাগ করা হল, তখন স্বভাবতই তার বুকও ভেঙে গেল ব্যথায়। সেই বুকভাঙা ব্যথাই অনবদ্য ভাষা পেয়েছে তার সেই ‘তেলের শিশি ভাঙল বলে খুকুর পরে রাগ করো’ ছড়াটিতে। তা এখন এক প্রবাদে পরিণত।
অন্নদাশঙ্কর বাঙালি সাহিত্যিক হিসেবে নিজেকে প্রথম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘পথে প্রবাসে’ ভ্রমণকথাতে। তারপরেই তিনি মনোনিবেশ করলেন উপন্যাস রচনায়। বাংলা সাহিত্যে এক অবিশ্বাস্য অভিনব সংকল্প। ছ’খণ্ডে সম্পূর্ণ উপন্যাসটির নাম ‘সত্যাসত্য’, তবে প্রতি খণ্ডের ‘যার যেথা দেশ’, ‘অজ্ঞাতবাস’ প্রভৃতি নাম আছে। ঘটনাস্থল ভারতবর্ষ থেকে ইংল্যান্ড পর্যন্ত বিস্তৃত। পাত্রপাত্রী পৃথিবীর নানা দেশের মানুষ। অনেক সাধারণ মানুষ এই উপন্যাসে প্রবেশ পেলেও মূলত দুই মহাযুদ্ধের মধ্যবর্তী মন্দার পর্বে বিশ্বসঙ্কট সম্বন্ধে জিজ্ঞাসু, সচেতন ও সক্রিয়। মূলত এক মনীষী সমাজই এই উপন্যাসে উপস্থাপিত হয়েছে। এখান থেকেই বাংলায় মননশীল উপন্যাস ধারার সূচনা। অন্নদাশঙ্কর নিজে যে ধারার পুনরাচরণ করেছেন ‘ক্রান্তদর্শী’ নামের উপন্যাসে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের শুরু থেকে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের গতিপ্রকৃতি, দেশভাগের দাবি উত্থাপন, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পর দাঙ্গা, স্বাধীনতা আর দেশভাগ, সবশেষে গান্ধি নিধন, এইসবের প্রেক্ষিতে বাংলার কয়েকজন বুদ্ধিজীবীর জীবন ও জীবিকার কৌতূহলোদ্দীপক কাহিনি ক্রান্তদর্শী। ‘সত্যাসত্য’ ও ‘ক্রান্তদর্শী’ এই দুটি এপিক উপন্যাসের ‘রচনাবলি’ বাইরে দুটি নিজ নামে পৃথক পৃথক উপন্যাসরূপেও প্রকাশিত হওয়া উচিত।
মহাকাব্যিক উপন্যাসের পাশাপাশি অন্নদাশঙ্কর বৈষ্ণব প্রেমরসে ভরপুর ‘রত্ন ও শ্রীমতি’, চিরতারুণ্যের প্রেমপিপাসা নিয়ে ‘কন্যা’, আবার পুরুষতন্ত্রের প্রতিবাদে ‘না’ প্রভৃতি বহু উপন্যাস লিখেছেন— সেগুলি কোনও না কোনও ভাবনায় কথাশিল্পিক অভিব্যক্তি। ছোটগল্পেও অন্নদাশঙ্কর নতুন রূপ ও সংজ্ঞার সন্ধানী যা বাংলা ছোটগল্পের মূলধারার বাইরে এক স্বতন্ত্র ধারায় প্রবাহিত। তবে অন্নদাশঙ্করের যে সাহিত্যকৃতি সবচেয়ে জনপ্রিয় সেটি হল ছড়া। বাংলা ছেলেভোলাননা ও ঘুমপাড়ানো ছড়াকে তিনি। বড়দের হুঁশ জাগানোর ছড়াতে পরিণত করেছেন। আবার সেইসঙ্গে ইঁদুর-বিড়ালকুকুর-ছাগল প্রভৃতি ইতরপ্ৰাণীকে সমাদরের সঙ্গে বাংলা সাহিত্যের আসরে ডেকে এনেছেন। তার সৃষ্টিশীল সাহিত্যের এক প্রান্তে রয়েছে বিদগ্ধ সমাজ আর অন্য প্রান্তে জনপদ সমাজ। বাংলা সাহিত্যে আর কার এই বিপুল বিস্তার আছে?
একই সঙ্গে অন্নদাশঙ্কর বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে বাঙালি বিবেক বলে পরিচিত। যখনই সমকালের বিশ্বে কোনও ঘটনা সংবাদপত্রে আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠে তখনই ভাবুক বাঙালি জানতে চান যে এ বিষয়ে অন্নদাশঙ্করের বক্তব্য তথা বিচার কী! ‘আর্ট’ নিয়ে, ‘বাংলার রেনেসাঁস’ নিয়ে, সাহিত্যে সংকট’ নিয়ে, বাংলাদেশের উদয় ও বিজয় নিয়ে তার পৃথক পৃথক চিন্তা ও গ্রন্থ আছে, এমনকি আমার ‘ভালোবাসার দেশ’ নামে বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত গ্রন্থও আছে, তবু ‘বিবেকী শিল্পী’ কিংবা ‘শতাব্দীর অতন্দ্র প্রহরী’ পরিচয়গুলোই যেন তার অন্য সব পরিচয়কে ছাপিয়ে উঠতে চায়। হয়তো একথা বুঝেই রবীন্দ্রনাথ তার শেষ পঁচিশে বৈশাখের কবিতাটি ভঁর অন্তিম আশীবাদ রূপে অন্নদাশঙ্করকে পাঠিয়েছিলেন। এজন্যেই অন্নদাশঙ্করের একান্ত তত্ত্বাবধানে সংকলিত প্রবন্ধ গ্রন্থটিরও পুনঃপ্রকাশ আবশ্যক। (গ্রন্থটি সম্প্রতি প. ব. বাংলা আকাদেমি প্রকাশ করেছে।)
‘নবজাগরণ’ অ্যান্ড্রোয়েড অ্যাপ্লিকেশনটি প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর টেলিগ্রাম চ্যানেলে জয়েন হতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর ফেসবুক পেজে লাইক করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।