লিখেছেনঃ জাহেদা আহমদ
ভারতীয় উপমহাদেশে স্বদেশচেতনা তথা জাতীয়তাবােধ ইংরেজ আমলেই সর্বপ্রথম পাশ্চাত্য শিক্ষাপ্রাপ্ত ভারতীয় মানসে অঙ্কুরিত হয়েছিল। এই পাশ্চাত্যশিক্ষিত, আলােকপ্রাপ্ত গােষ্ঠীর অন্যতম শীর্ষ ব্যক্তিত্ব হিসেবে বঙ্কিমের আবির্ভাব ও বিকাশের অনুকূল পরিবেশ বৃটিশ সাম্রাজ্যের রাজধানী কলকাতায় গড়ে উঠেছিল। বিদেশী শাসনের ফসল এই শিক্ষিত উচ্চ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মধ্যে কালক্রমে যে স্বাদেশিকতা ও স্বদেশভাবনার উজ্জীবন ঘটে তার অন্যতম মুখপাত্র হয়ে উঠেছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র। খুব স্বাভাবিক ছিল তার এই পরিণতি। বৃটিশপূর্ব আমলে ভারতীয়দের মধ্যে সাজীয়তাবােধের অভাব ছিল বলে বারবার উল্লেখ করেছেন তিনি, তার কার্যকারণ বিশ্লেষণ করেছেন এবং সবশেষে এ থেকে উত্তরণের পথনির্দেশও করেছেন।
সবই ঠিক। কিন্তু যে স্বদেশকে নিয়ে তার এত চিন্তা-ভাবনা, এত উদ্বেগ-আকাঙ্ক্ষা, এত বিচার-বিশ্লেষণ, সেই স্বদেশ তাে কোনাে বিমূর্ত ধারণা নয়, বিশেষ করে একজন লেখকের কাছে। এই স্বদেশ তার লেখনীতে বাণীমূর্তি পেলাে কোন্ রূপে? নানা ধর্ম-বর্ণ ভাষা ও শ্রেণীতে বিভক্ত কোটি কোটি জন অধ্যুষিত বাংলা তথা ভারতের সকল অধিবাসীই কি তার কাছে সমান গুরুত্ব পেয়েছিল? সকল ভারতীয়কে নিয়ে কি গড়ে উঠেছিল তার জাতীয়তাবাদী ভূস্বর্গ? দুঃখের সঙ্গে বলতেই হয়— না, প্রগাঢ় স্বদেশ প্রেমের, গভীর স্বাজাত্যবােধের উদগাতা ও প্রবক্তা এই মনীষীর লেখনীতে এক বিভক্ত, খণ্ডিত ভারতবর্ষের রূপই আমরা প্রত্যক্ষ করি। এক ভাগে ছিল নিম্নশ্রেণার। মানুষ সংখ্যায় তারা অগণিত, অনেকেই ধর্মে অহিন্দু যাদের কথা ইতিপূর্বে প্রকাশিত ‘বঙ্গদেশের কৃষক’ ও ‘সাম্য’ প্রবন্ধে তিনি বিস্তৃতভাবে আলােচনা করেছিলেন। এইসব রমা কৈবর্ত, পরান মণ্ডল, হাসিম শেখ এদের সম্বন্ধে ভালােভাবেই অবহিত ছিলেন তিনি। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের জাঁতাকলে পিষ্ট বাংলার কৃষক জীবনের চিত্র তিনি পর ‘বঙ্গদেশের কৃষক’ প্রবন্ধে যেভাবে তুলে ধরেছেন উনিশ শতকীয় অন্য কোনাে কোকের পক্ষে তা সম্ভব হয়নি। এরপর কিন্তু তারা তার লেখা-লেখিতে ওইভাবে আর ফিরে আসেনি। আর ‘সাম্য’ তাে তিনি ছাপাতেই চাননি দ্বিতীয়বার। নিম্নবর্গীয় এইসব ভারতীয় মানবগােষ্ঠীর দেখা পরবর্তীতে বঙ্কিমের রচনায় আর অনুরূপভাবে পাওয়া যায় না।
অন্য যারা এসেছে, বারবার, ঘুরে ফিরে, তারা ভিন্নজগতের বাসিন্দা। তাদের কেউ বা সামন্ত অধিপতি, কেউ রাজা, মন্ত্রী পরিষদ, কেউ সেনাপতি, জমিদার, ব্রাহ্মণ-পুরােহিত থেকে শুরু করে সাধু-সন্ন্যাসী সেই এমন কি যে ভীরু পলায়নপর বাংলার শেষ স্বাধীন হিন্দু নৃপতি লক্ষ্মণ সেনও আছেন যিনি নিজের প্রাসাদ দ্বারপ্রান্তে যবন সৈন্যের উপস্থিতি টের পেয়ে এঁটোহাতে খিড়কির দুয়ার দিয়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন। আরাে আছে ইংরেজি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালী যারা পাশ্চাত্য শিক্ষার কল্যাণে ক্রমে রাজনৈতিক সচেতনতা খানিকটা হলেও অর্জন করছিল। কিন্তু তার স্বশ্রেণীর এই শেষােক্ত ‘বাবু’ গােষ্ঠী নিয়ে তাঁর কোনাে মােহ ছিল না, এরা সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার যােগ্য বাহন হতে পারে বলে তিনি মনে করেননি। ‘লােক রহস্যে’ এই গােষ্ঠীর চরিত্র বিশ্লেষণ করেছেন তিনি এই বলে, যাঁহার বুদ্ধি বাল্যে পুস্তক-মধ্যে, যৌবনে বােতলমধ্যে, বার্ধক্য গৃহিণীর অঞ্চলে, তিনিই বাবু।… যিনি মিশনারীর নিকট খ্রশ্চিয়ান, কেশবচন্দ্রের নিকট ব্রহ্ম, পিতার নিকট হিন্দু এবং ভিক্ষুকের নিকট নাস্তিক তিনিই বাবু। এই ‘বাবু’ ‘নিজ গৃহে জলখান, বন্ধুগৃহে মদ খান, বেশ্যাগৃহে গালি খান এবং মুনিব সাহেবের গৃহে গলা-ধাক্কা খান তিনিই বাবু। বিধাতা ‘এই অপূর্ব নব্য বাঙ্গালী চরিত্র…. পশুবৃত্তির তিল তিল করিয়া সংগ্রহপূর্বক সৃজন করিয়াছেন।”১
কিন্তু এই অপূর্ব নব্য বাঙালী চরিত্র নিয়ে এমন ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ সত্ত্বেও তাদের অর্থাৎ শিক্ষিত হিন্দু বাঙালীর মধ্যে যে প্রাচীন ভারতীয় আর্য গৌরববোেধ, ব্রাহ্মণ্য অহমিকা এবং হিন্দু পরিচয়জনিত শ্রেষ্ঠত্বাভিমান বিরাজমান ছিল তা থেকে মুক্ত ছিলেন না বঙ্কিম নিজেও। এই আর্যরক্ত অবশ্যই বাঙালী কিংবা ভারতীয় মুসলমানের ধমনীতে প্রবাহিত ছিল না — বঙ্কিমের জাতিগত তথা সম্প্রদায়গত বিভেদরেখা টানা ছিল এখানেও। বঙ্গে ব্রাহ্মণাধিকার প্রবন্ধে তিনি জানাচ্ছেন যে, অষ্টম শতাঞ্জী বাংলাদেশে আর্য ছিল না, একাদশ শতাব্দীতেও আর্য ব্রাহ্মণ এদেশে বিরল ছিল। এতে করে বঙ্কিমনন্দিত বাঙালী ব্রাহ্মণের প্রাচীনত্বের কিছু হানি হলেও আমরা সেই আর্যজাতি সম্ভুতই রহিলাম বাঙ্গালায় যখন আসি না কেন, আমাদের পূর্বপুরুষগণ সেই গৌরবান্বিত আর্য। বরং গৌরবের বৃদ্ধিই হইল। আর্যগণ বাঙ্গালায় তাদশ ৯ মহৎ কীর্তি রাখিয়া যান নাই— আর্য কীর্তিভূমি উত্তর পশ্চিমাঞ্চল। এখন দেখা যাইতে যে আমরা সে কীর্তি ও যশেরও উত্তরাধিকারী।… আমাদের আর একটি কলঙ্কের দিন হইতেছে।… বল্লালের দেড়শত বৎসর পরে মুসলমানগণ বঙ্গ জয় করেন। তখন বঙ্গীয় আর্যগণের সংখ্যা অধিক সহস্র নহে, ইহা অনুমেয়। তখনও তাহারা এদেশে ঔপনিবেশিক মাত্র। সুতরাং সপ্তদশ অশ্বারােহী কর্তৃক বঙ্গজয়ের যে কলঙ্ক, তাহা আর্যদিগের কিছু কমিতেছে বটে।২ ইংরেজ শাসনাধীন বাঙালী বুদ্ধিজীবীর হীনম্মন্যতাবােধ যে কতখানি তীব্র ছিল তার প্রমাণ বঙ্কিমের এই আর্যপ্রেম ভ্রান্তি। বিদেশাগত সপ্তদশ মুসলমান : অশ্বারােহী কর্তৃক বঙ্গবিজয়কে তিনি বারবার মিথ্যা বলে আখ্যায়িত করে বলেছেন, ‘আত্মজাতি গৌরবান্ধ, মিথ্যাবাদী, হিন্দুদ্বেষী মুসলমানের কথা যে বিচার না করিয়া ইতিহাস বলিয়া গ্রহণ করে, সে বাঙ্গালী নয়, কুলাঙ্গার।’৩ আর্যগৌরবদীপ্ত বঙ্কিম ভুলে যান যে বঙ্গবিজয়ী বখতিয়ার খিলজীর মতাে আর্যরাও বহিরাগত আক্রমণকারী হিসেবেই এদেশে এসেছিল উপনিবেশ স্থাপন-উদ্দেশ্যে এদেশ দখলকারী ছিল তারাও। তবে যেহেতু বঙ্কিমপ্রশংসিত আর্যরক্ত বখতিয়ার ও তার অশ্বারােহীদের ধমনীতে প্রবাহিত ছিল না, তদুপরি ধর্মে তারা ছিল মুসলমান, আর্যও নয়, খৃস্টান ইংরেজও নয়। তাই উত্তর ভারতীয় আর্যকেই নিজেদের পূর্বপুরুষ কল্পনা করে নতুন জাতিগঠনের আকাঙ্ক্ষায় উদ্দীপিত হয়ে উঠেছিলেন এই জাতীয়তাবাদী লেখক।
বঙ্কিমের জাতীয়তাবাদ : সর্বভারতীয় নয়, খণ্ডিত ও সাম্প্রদায়িক
তীব্র আবেগমথিত প্রগাঢ় দেশপ্রেম, গভীর স্বাজাত্যবােধ বঙ্কিমচন্দ্রের সুপরিসর সৃজনশীল কর্মকাণ্ডকে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করেছে, বৃটিশ শাসনবিরােধী আন্দোলনে উজ্জা করেছে তার দেশবাসীকে। কিন্তু সকল দেশবাসীকে নয়। ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণী নিবিশে সকল ভারতীয়কে তিনি অন্তর্ভুক্ত করতে পারেননি তার জাতীয়তাবাদী ভূস্বর্গে, তা সংগঠিত রাষ্ট্রচিন্তা ভারতবর্ষে স্বরাজ বলতে হিন্দুরাজ প্রতিষ্ঠাকেই বুঝিয়েছে, হিন্দুরা স্বপ্নদ্রষ্টা হিসেবেই তাঁকে দেখেছে পরবর্তীকালের বৃটিশ-বিরােধী বিপ্লবীরা। সেখানে মুসলমান যেমন অনুপস্থিত, তেমনই অনুপস্থিত সাধারণ মানুষও। অশীন দাশগুপ্তের ভাষায়, ‘স্পষ্টতঃই বঙ্কিম চিন্তায় ভারতবাসী, হিন্দু ও বাঙালী একাকার হয়ে যেত। তিনি একদিকে চেষ্টা করেছিলেন হিন্দুর ইতিহাস খুঁজে বীরত্ব ও আত্মত্যাগের আদর্শ প্রতিষ্ঠা করতে; অন্যদিকে বিরাট ও গুরুত্বপূর্ণ চেষ্টা করেছিলেন হিন্দুকে নতুন করে তার ধর্মের সঙ্গে পরিচয় করাতে। ইংরেজ সাম্রাজ্যের শােষক মূর্তি তার চোখে পড়েও পড়ল না। সেই অর্থে লাঠি-বিশ্বাসী বঙ্কিমচন্দ্রের হাতে লাঠি ওঠেনি।…ভারতবর্ষের সম্প্রদায়গুলির মধ্যে একটিকে তিনি বেছে নিলেন। অন্য সম্প্রদায়গুলির জায়গা হয়েও হল না। মধ্যবিত্তের মন্ত্রগুরু হলেন। নিম্নবিত্তকেও চিনেও চিনলেন না।৪
একই অভিমত প্রকাশ করেছেন আরাে অনেকে যাঁরা বঙ্কিমচন্দ্রের হিন্দু জাতীয়তাবাদী ধ্যান-ধারণা, তার সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি স্বতন্ত্র হিন্দু ধর্ম ও জাতি, যাকে এক কথায় এযুগের ভারতীয় জনতা পার্টির সংজ্ঞায় ‘হিন্দুত্ব’ বলা যায় সেদিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করেছেন। তনিকা সরকারের কথাই ধরি। ইতিহাসের এই অধ্যাপকের কোনাে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব নেই বঙ্কিমের মূল্যায়নে; ‘মুসলমান কৃষক করুণার পাত্র হলেও রাষ্ট্রের অথবা ক্ষমতার অধিকারী কখনােই নয়। হিন্দু কৃষকও নয়। আনন্দমঠে যখই ধারণ গ্রামবাসী যুদ্ধের ভার নিজের হাতে তুলে নিয়েছে তখনই ঘটেছে মহা অনর্থ। রাষ্ট্রবিপ্লব ও রাষ্ট্রস্থাপনের ভার নিতে হবে তাদেরই যারা সমাজের অধিপতি ধর্মগুরু, সেনাপতি, হিন্দুরাজা। এখানেও স্পষ্ট অধিকার ভেদের মাত্রা টানা থাকে।৫
এই পৃথক, স্বতন্ত্র, জাতীয়তাবাদী চেতনার ধারক-বাহক হিসেবে ভারতীয় বর্ণ হিন্দুকেই বঙ্কিম আবাহন করেন তার সাহিত্যভুবনে; ভারতীয় বলতে হিন্দুকেই বুঝিয়েছেন, ভারতীয় জাতিসত্তার নির্মাণে প্রাচীন ভারতের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও গৌরবগাঁথা প্রধান উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। বঙ্কিমের এহেন হিন্দু জাতীয়তাবাদী ধারণার সুস্পষ্ট প্রতিফলন দেখতে পাই ১৮৭০-এর দশকে তার সম্পাদনায় প্রকাশিত বঙ্গদর্শন পত্রিকায় মুদ্রিত ‘ভারতকলঙ্ক’ প্রবন্ধে। ভারতীয় হিন্দুরা সাতশত বৎসর কেন। পরাজিত, পদানত ছিল তার কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে ‘আত্মগরিমাপরবশ পরধর্মদ্বেষী, সত্যভীত মুসলমান লেখকদিগের কথার উপর নির্ভর করেননি তিনি।৬ স্ববিরােধিতার চূড়ান্ত নিদর্শন রেখে পরমুহূর্তেই নিজের বক্তব্যের সমর্থনে সেই ‘মসলমান পুরাবৃত্তের’ই দ্বারস্থ হয়েছেন। দীর্ঘকালব্যাপী পরাধীনতার কারণ অনুসন্ধানে কেন তার এই ব্যাকুলতা?
কারণ নির্দেশ করে লেখক বলছেন, ‘আমি হিন্দু, তুমি হিন্দু, রাম হিন্দু, যদু হিন্দু, আরও লক্ষ লক্ষ হিন্দু আছে। এই লক্ষ লক্ষ হিন্দু মাত্রেরই যাহাতে মঙ্গল, তাহাতেই আমার মঙ্গল। যাহাতে তাহাদের মঙ্গল নাই, আমারও তাহাতে মঙ্গল নাই। অতএব সকল হিন্দুর যাহাতে মঙ্গল হয়, তাহাই আমার কর্তব্য। যাহাতে কোনাে হিন্দুর অমঙ্গল হয়, তাহা আমার অকর্তব্য। সকল হিন্দুরই যদি একরূপ কার্য হইল, তবে সকল হিন্দু কর্তব্য যে একপরামর্শী, একমতাবলম্বী, একত্র মিলিত হইয়া কার্য করে, এই জ্ঞান জাতি প্রতিষ্ঠার প্রথম ভাগ; অর্ধাংশ মাত্র। হিন্দুজাতি ভিন্ন পৃথিবীতে অন্য অনেক জাতি আছে। তাহাদের মঙ্গলমাত্রেই আমাদের মঙ্গল সম্ভব নয়। অনেক স্থানে তাহাদের মঙ্গলে আমাদের অমঙ্গল। সেখানে তাহাদের মঙ্গল যাহাতে না হয়, আমরা তাহাই করিব। ইহাতে পরজাতি পীড়ন করিতে হয়, করিব।… পরজাতির অমঙ্গল সাধন করিয়া আত্মমঙ্গল সাধিতে হয়, তাহাও করিব।”৭
এই ‘পরজাতি’ কারা? ভারতবর্ষের মতাে একটি পরাধীন বহুধাবিভক্ত বিশাল দেশে জাতীয়তাবাদী চেতনার জাগরণের ঊষালগ্নে বঙ্কিমের মতাে একজন শিক্ষিত, সচেতন, সুবিধাভােগী মানুষের এধরনের বক্তব্য অবশ্যই প্রণিধানযােগ্য। হিন্দু ছাড়া তদানীন্তন ভারতে অন্য বড় সম্প্রদায় ছিল মুসলমান। ইংরেজ যে বঙ্কিমের উদ্দিষ্ট ‘পরজাতি’ ছিল না তাতাে বঙ্কিমের একাধিক লেখায়, এমনকি উল্লিখিত প্রবন্ধের শেষে উল্লেখ করেছেন, ‘ইংরাজ ভারতবর্ষের পরমােপকারী। ইংরাজ আমাদের নতুন কথা শিখাইতেছে, যাহা আমরা কখনও জানিতাম না।… তাহার মধ্যে দুইটি স্বাতন্ত্র্যপ্রিয়তা এবং জাতিপ্রতিষ্ঠা (Nationality বা Nation)… ইহা কাহাকে বলে তাহা হিন্দু জানিত না।৮ দেখা যাচ্ছে, ভারতবর্ষের মতাে একটি দেশ যেখানে কবিকল্পনার বিপরীতে আর্য-অনার্য-শক-হুন-দল, পাঠান-মােগল এক দেহে পুরাে লীন হয়ে যায়নি সেদেশে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের ধর্মকেই তৎকালীন অগ্রসর সম্প্রদায় জাতীয়তার ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করেছে। এই প্রক্রিয়ার শুরু যে উনিশ শতকের গােড়া থেকেই তা আমরা আগেই দেখেছি। এই গােষ্ঠীভুক্ত সকলের চোখেই ভারতীয়ত্ব ও হিন্দুত্ব সমার্থক হয়ে গিয়েছিল বলেই তারা আধুনিক উচ্চশিক্ষার জন্য কলকাতায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করে তার নাম দিয়েছিলেন ‘হিন্দু কলেজ’, যেখানে আইন করে নিম্ন হিন্দু ও মুসলমানের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। সে হলাে উনিশ শতকের একেবারে গােড়ার কথা- ১৮১৭ সাল। পরবর্তী পঞ্চাশ বছরে আধুনিক শিক্ষার পরিমাণগত প্রসার বেড়েছে এই বাংলায়, কিন্তু বাঙালী অগ্রসর শিক্ষিত শ্রেণীর মনােজগতে অন্ততঃ এক্ষেত্রে আধুনিকতার ছোঁয়া লাগেনি।
তার বহুবিধ প্রমাণের মধ্যে একটি হলাে কলকাতার ১৮৬৭ সালে সাড়ম্বরে জাতীয় আলার উদ্বোধন, ভারতীয় সমাজে জাতীয়তাবােধের চর্চা ও প্রসারের লক্ষ্যে। প্রথম দু’বছর এটি জাতীয় মেলা নামে অভিহিত হলেও তৃতীয় বছর থেকে এর নামকরণ হয় ‘হিন্দু মেলা’। এই মেলার আয়ােজকদের চেতনায় হিন্দুধর্ম, স্বদেশপ্রেম, স্বাজাত্যবােধ মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল। এতে স্ববিরােধিতার কোনাে আভাস যে থাকতে পারে তা এই আলােকিত ব্যক্তিবর্গ বুঝতেই পারেননি। মােট কথা, শ্রেণী-ধর্ম-ভাষাআঞ্চলিক পরিচয় নির্বিশেষে সকল ভারতীয়কে জাতীয়তাবাদের পতাকাতলে সমবেত করার কোনাে লক্ষ্য তাদের তখনও ছিল না।
এক্ষেত্রে বঙ্কিম ব্যতিক্রম তাে ছিলেনই না বরং তৎকালীন ভারতে জাতীয়তাবােধের সেই উন্মেষ ও ক্রমপ্রসারের যুগে তাঁর মতাে উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব সংখ্যাগুরুর ধর্মকেই স্বদেশচেতনার অপরিহার্য মুখ্য উপাদানরূপে দেখেছেন এবং এই মত প্রতিষ্ঠার কাজে অগ্রণী হয়েছেন। ভারতীয় হিন্দুজাতি সাত শত বৎসর অর্থাৎ পুরাে মধ্যযুগে মুসলমান শাসনাধীন ছিল বিধায় তাদেরকে পরাধীন বলে বারবার উল্লেখ করেছেন তিনি। ভারতের বেলা পৌরাণিক যুগ তথা রামায়ণ-মহাভারতের যুগ এবং বাংলার ইতিহাসে পাল ও সেন আমলকে তিনি গৌরবময় যুগ বলে অভিহিত করেছেন। বঙ্কিমচন্দ্র, বলা বাহুল্য, একা নন এক্ষেত্রে। ভারতীয় মধ্যযুগ (যাকে বৃটিশ ঐতিহাসিকগণ মুসলিম যুগ বলে চিহ্নিত করেছিলেন) সম্বন্ধে বঙ্কিমচন্দ্রের ধারণা ও দৃষ্টিভঙ্গি সামগ্রিকভাবে উনিশ শতকীয় ভারতীয় ইতিহাসতত্ত্বের একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য। তৎকালীন অন্যান্য শিক্ষিত ভারতীয়দের মতাে বঙ্কিমচন্দ্রও মধ্যযুগীয় ভারতকে দেখেছেন হিন্দুবিদ্বেষী, অত্যাচারী গােষ্ঠীর শাসনাধীন একটি দুর্ভাগা দেশ হিসেবে। তপন রায়চৌধুরীর ভাষায়, ‘One of the most dangerous features of this aggressively Hindu orientation was a new tendency to rubbish the rule of Muslim dynasties.’ যদিও এক্ষেত্রে কিছু কিছু ব্যতিক্রম, যেমন পাঠান শাসনাধীন বাংলার গৌরব নিয়ে বঙ্কিমের দ্বিমত ছিল না, তিনি স্বীকার করেছেন ঠিকই। ‘Yet his over-all assessment of this long period of Indian history is decisively negative.’৯ যা চিন্তাভাবনার প্রকাশ তার সৃজনশীল কর্মকাণ্ডে উপন্যাস থেকে শুরু করে প্রবন্ধ, সমালােচনা, সাহিত্য, রসরচনায় ছড়িয়ে রয়েছে। তার ইংরেজী রচনা A Popular Literature for Bengal’ প্রবন্ধে তিনি বলেন, ‘The iron heel of the Mussalman tyrant had set its mark on the shoulders of the nation,’
তপন রায়চৌধুরী আমাদের মনে করিয়ে দিতে ভােলেন না, ‘The continual usa, Jaban (Yavana) with reference to Muslims, expressed the nophobia… Bankim, while evoking the Hindu identity to missed the chance of a dig at the Muslims.’১০
এমন কি ভুদেব – বিবেকানন্দের মতাে উদার সহিষ্ণু বাঙালীরাও মাঝে মধ্যে ‘অত্যাচারী শাসনকালের’ উল্লেখ করেছেন; “Nearly all evaluations of the british presence were coloured by this negative attitude towards Ista role in Indian life.”১১
ইংরেজরা এই ‘অত্যাচারী শাসকদের কবল থেকে ভারতীয় মুক্ত করেছে বলে তাদের প্রতি বঙ্কিম ও তার সমগােত্রীয়দের কৃতজ্ঞতার অন্ত ছিল না। তাই রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ইংরেজ শাসনকে সমর্থন করা বঙ্কিম ও তার সমমনাদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বখতিয়ার খিলজীর বঙ্গবিজয়ের পর থেকে বৃটিশ শাসন প্রতিষ্ঠা লাভ পর্যন্ত এই কালসীমার মধ্যে তার লেখনী বিচরণ করেছে বারবার, ঘুরে ফিরে, ফুটিয়ে তুলেছে হিন্দু বাংলার অবক্ষয়, অধঃপতন এবং পুনরুজ্জীবনের পরিচয়।
‘মৃণালিনী’তে (১৮৬৯) বঙ্কিমচন্দ্রের এই হিন্দুজাতীয়তাবাদ-ভিত্তিক স্বাদেশিকতার প্রথম প্রকাশ দেখতে পাই। সেই বখতিয়ার খিলজী ও তাঁর সতের জন অশ্বারােহী কর্তৃক বঙ্গ বিজয় কাহিনীর অসারত্ব প্রমাণ এই উপন্যাসরচনার অন্যতম লক্ষ্য ছিল। এরপর যতই দিন গিয়েছে ততই প্রচারধর্মী হয়ে উঠেছেন তিনি। মৃণালিনী প্রকাশের তিন বছর পর ১৮৭২ সালে বঙ্কিম বঙ্গদর্শন সাময়িক পত্র সম্পাদনার কাজ শুরু করেন। এতে বিভিন্ন ধরনের রচনায় তার হিন্দুত্ববাদের প্রাসাদ নির্মাণের কাজ অবিশ্রান্ত গতিতে এগিয়ে চলে। দু-একটি উদাহরণ দিই। মিল, ডাব্বিন এবং হিন্দু ধর্ম এই শিরােনামে বঙ্গদর্শনে প্রকাশিত প্রবন্ধে তিনি লেখেন, ‘নব্য বাঙালী’ সম্প্রদায় প্রচলিত হিন্দু-ধমকে উপধর্ম পরিপূর্ণ এক বিষময় ফলের আধারস্বরূপ জানেন। যে পূর্বপুরুষগণ হয় উদ্ভাবন এবং সংস্করণ করিয়াছিলেন, এবং যাঁহারা ইহাতে বিশ্বাস করেন, তাহা আমরা ঘােরর মূর্খ মনে করি। এদিকে আবার সেই পূৰ্ব্বপুরুষগণের প্রণীত দর্শনাদি দেখিয়া তাহাদিগকে মহাত্মা মনে করি। এরূপ মাহাত্ম্য এবং মুর্খতা কি প্রকারে একত্র সংযুক্ত হইল, এ প্রশ্ন একবারও আমাদের মনে উদয় হয় না। বাস্তাবক পৌরাণিক ধর্মে বিশ্বাস কি এরূপ ঘােরর মুর্খতা? যাহা তিন সহস্র বৎসর অবাধে কোটি কোটি মনুষ্যের ভক্তির বিষয় হইয়া আসিতেছে, সৰ্ব্ববিজয়ী বৌদ্ধধর্ম যাহার নিকট পরাভূত হইল, তাহা কি কেবল মূর্খতার ফল? তাহার কি কোন নৈসর্গিক ভিত্তি নাই? না থাকিলে এত বল হইবে কেন? এই ধর্মতত্ত্বের অবিনশ্বরত্ব প্রমাণ করতে গিয়ে তিনি ইউরােপীয় দার্শনিক জন স্টুয়ার্ট মিল ও বৈজ্ঞানিক ডাব্বিন এর (চার্লস ডারউইন?) উপর নির্ভর করেন।১২
এরপর ক্রমান্বয়ে যতই দিন গেছে ততই রক্ষণশীল হয়ে উঠেছেন একসময়ের কোত, মিল, হার্বাট স্পেন্সরের অনুরাগী বঙ্কিমচন্দ্র। তারও পরে রক্ষণশীলতা রূপান্তরিত হয়েছে প্রতিক্রিয়াশীলতায়। তাই জীবনের শেষ পর্বে এসে দেখি মধ্যবয়সের রক্ষণশীলতাকে ছাপিয়ে গভীরভাবে ডুবে যাচ্ছেন সনাতন হিন্দুধর্মের নিবিড়, পুঙ্খানুপুঙ্খ আলােচনা ও বিশ্লেষণে। একজন আধুনিক গবেষকের ভাষায় : ‘Bankim devoted the last 12 years of his life (1882-1894) to an elaborate defence of Hinduism and attempted to give Pauranic Hinduism a national basis. This was not something new as to merit the nomenclature neoHinduism. Sri Ramkrishna and Vivekananda also preached the revival of Hinduism, not a new Hinduism. Bankimchandra and Vivekananda had wide differences in their approach. But they were all revivalists, not innovators. …Both Bankimchandra and Vivekananda wanted to protect the citadel of Pauranik Hinduism, not to pull it down… they wanted a Hindu revival to combat the challenge of Christianity and Brahmoism.’১৩
১৮৮২ সাল থেকে শুরু হয়েছিল বঙ্কিমের সনাতন হিন্দুধর্ম নিয়ে এই মাতামাতি। অমলেশ ত্রিপাঠী অবশ্য একজন গভীর অনুরাগী ভক্তের দৃষ্টিতে দেখেছেন বঙ্কিমের এই পরিবর্তনকে। ‘বঙ্কিমের সমস্ত ধ্যানধারণার কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থিত ধর্ম এবং তার স্বরূপ বিশ্লেষণ’১৪ কেন এমন অত্যাবশ্যক হয়ে উঠেছিল বঙ্কিমের কাছে সে ব্যাখ্যা তিনি দিয়েছেন। বঙ্কিমের হৃদয়ে মিল-এর সংশয়ের লেশমাত্র ছিল না বলে পুরুষােত্তম শ্রীকৃষ্ণকে তার ধর্মানুভূতির কেন্দ্রে স্থাপন করতে দ্বিধা করেননি তিনি।১৫ ধর্মবেত্তা বঙ্কিম-মানসে অন্ধবিশ্বাসের স্থান একেবারেই ছিল না বলে রায় দিয়েছেন এই ইতিহাসবিদ। কিন্তু তাই বলে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিকে ধর্মানুশীলন-প্রসূত অব্দটির উপরে বসাতে তিনি রাজী ছিলেন না। তারপর এই ইতিহাসবিদ আরাে এগিয়ে গিয়ে বলেন, বলা বাহুল্য, পশ্চিমের সমাজতাত্ত্বিকদের বুদ্ধি যেখানে পৌঁছায়নি, প্রাচ্যের ঋষির ধ্যানে তা ধরা পড়েছিল। বঙ্কিমের সকল প্রশ্নের উত্তর মিলেছিল মহাভারত ও ভাগবত গীতায়।১৬ ‘অবতারশ্রেষ্ঠ শ্রীকৃষ্ণকে বঙ্কিম অধিষ্ঠিত করলেন ভারতীয় সমাজের নেতৃত্বে- ত্রিপাঠীর ভাষায় ‘ঐতিহাসিক চরিত্র খ্রীষ্ঠ খ্রীষ্টানমাত্রেয় কাছেই পরম গৌরবের ধন। এতােদিনে হিন্দুরাও পেল অনুরূপ এক ঐতিহাসিক চরিত্র – শ্রীকৃষ্ণকে। হিন্দুদের প্রাপ্তি আরও বেশি, কেন না শ্রীকৃষ্ণ বুদ্ধ বা খ্রীষ্টের মতাে সন্ন্যাসী প্রাণময়তার উচ্ছ্বসিত; জীবনমুখী এক গৃহী।…. তিনি ধর্ম সংস্থাপনের জন্য দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনের কাজে সদা তৎপর। শ্রীকৃষ্ণের গুণাবলীর মধ্যে বঙ্কিমচন্দ্রস বেশি গুরুত্ব আরােপ করেছেন তাঁর অতুলনীয় নেতৃ-প্রতিভার উপর, তার মা। জ্ঞান ও সাম্রাজ্য সংগঠনী কুশলতার উপর। শ্রীকৃষ্ণ স্বপ্ন দেখেছিলেন এক ঐক্যবদ্ধ ভারতবর্ষের, আর এই স্বপ্নকে সিদ্ধ করার জন্যই কুরুক্ষেত্রে অগণিত ক্ষুদ্র সামন্ত রাজাকে বিনাশ করে এক সুবিশাল, সংহত ধর্মরাজ্য সৃষ্টি করেছিলেন।১৭
বঙ্কিমচন্দ্রের জাতীয়তাবাদ
এককালের ইহজাগতিক বঙ্কিমের সনাতন হিন্দুধর্ম অভিমুখে ক্রমপ্রত্যাবর্তন উনিশ শতকের শেষার্ধে বাংলা তথা ভারতের জাতীয়তাবাদের ইতিহাসে একটি উল্লেখযােগ্য ঘটনা। বঙ্কিমের চিন্তাজগতে এই দিক-পরিবর্তনের প্রগাঢ় প্রভাব তার সৃজনশীল কর্মকাণ্ডে গভীরভাবে লক্ষণীয়। “প্রথম যৌবনে তিনি কোন বিশেষ ধর্মমতে আবদ্ধ না থাকিয়া নিজেকে কোঁৎপন্থী বা ‘পজিটিভিস্ট’ বলিয়া গণ্য করিতেন। এই মতের ভিত্তি হইল— যাহাতে অধিক সংখ্যক লােকের হিত হয় তাহা সাধন।… ইহা হইতেই তাঁহার মন স্বদেশপ্রেম বা দেশভক্তিতে পরিপ্লুত হয়। জন্মভূমিকে মাতৃজ্ঞানে ভক্তি করার চৰ্য্যায় তিনি নিজেকে অভ্যস্ত করান। স্বদেশবাসীদের এই চৰ্য্যায় উদ্বুদ্ধ করিতেও তিনি প্রয়াসী হন। তাহার জীবিতকালে তিনি মুখ্যতঃ প্রসিদ্ধ ঔপন্যাসিক বলিয়াই পরিচিত ছিলেন, পরবর্তী সময়ে তিনি জাতীয়তা মন্ত্রের উদ্গাতা ঋষি বঙ্কিমরূপেই আখ্যাত হইয়াছেন”।১৮
বলা বাহুল্য, এই ‘জাতীয়তা মন্ত্র’ সম্পূর্ণরূপে পৌরাণিক হিন্দুধর্ম, হিন্দু ঐতিহ্য ও হিন্দু সংস্কৃতির জারকরসে সঞ্জীবিত হয়েই বঙ্কিমের লেখনীতে ধরা দিয়েছিল। ১৮৮০-র দশকে ইংরেজ পাদ্রী তৎকালীন জেনারেল এসেমব্লির (বর্তমানে স্কটিশ চার্চ কলেজ। অধ্যক্ষ ইউলিয়াম হেস্টির সঙ্গে শােভাবাজার রাজবাড়ির এক শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানে বঙ্কিম হিন্দু ধর্ম নিয়ে বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন। এরই সূত্র ধরে তিনি ক্রমশঃ গভার ডুবে গেলেন হিন্দু ধর্ম, দর্শন ও শাস্ত্রের চর্চা ও অনুশীলনে। ১৮৮৪ সালে নবজ ও প্রচার প্রকাশ করে তাতে নিজ মতানুসারে হিন্দুধর্মের মূলতত্ত্বের বিচার বিশ্লেষ আলােচনায় প্রবৃত্ত হলেন তিনি। বঙ্কিম রচনাবলীর সম্পাদক বলছেন, “তৎকালীন পাশ্চাত্য ভাবধারায় পুষ্ট এবং প্রথমজীবনে বিশেষভাবে তাহার পক্ষপাতী হইয়াও, বঙ্কিমচন্দ্র কিরূপে ‘স্বধর্ম’ ফিরিয়া পাইলেন হিন্দুশাস্ত্র গ্রন্থাদির মধ্যে তাহার জিজ্ঞাসার সদত্তর জানিতে পারিলেন সত্যই চমকপ্রদ”।১৯ ধর্মতত্ত্ব গ্রন্থে বঙ্কিম নিজে লিখেছেন, ‘সাহিত্য, বিজ্ঞান, ইতিহাস, দর্শন, দেশী-বিদেশী শাস্ত্র যথাসাধ্য অধ্যয়ন করিয়াছি।’২০ মানবজীবনের সার্থকতা কী এবং কোথায়- এই ছিল বঙ্কিমের জিজ্ঞাস্য। বঙ্কিম রচনাবলীর সম্পাদক যােগেশচন্দ্র বাগলের মতে, দেবী চৌধুরানী, রাজসিংহ, সীতারাম বঙ্কিমচন্দ্রের এই জিজ্ঞাসারই এক একটি পরণতি। সর্বশেষে হিন্দু শাস্ত্রগ্রন্থসার শ্রীমদভাগবতগীতায় তিনি এই জিজ্ঞাসার পূর্ণ উত্তর লাভ করেন। ধর্মতত্ত্ব, কৃষ্ণ, শ্রীমদ্ভাগবতগীতা ও অন্যান্য শাস্ত্রমূলক আলােচনায় তাহার জীবনব্যাপী জিজ্ঞাসা ক্রমে স্ফুর্তি লাভ করে। বঙ্কিমচন্দ্র হিন্দু ধর্মকেই জগতে সম্পূর্ণ ধৰ্ম্ম বলিয়া গণ্য করিতেন।”২১ কারণ, তাঁর মতে “ধৰ্ম্ম যদি যথার্থ সুখের উপায় হয় তবে মনুষ্যজীবনের সৰ্বাংশই ধৰ্ম্ম কর্তৃক শাসিত হওয়া উচিত। ইহাই হিন্দুধর্মের প্রকৃত মৰ্ম্ম। অন্য ধর্মে তাহা হয় না, এজন্য অন্য ধর্ম অসম্পূর্ণ; কেবল হিন্দুধর্ম সম্পূর্ণ ধৰ্ম্ম। অন্য জাতির বিশ্বাস যে কেবল ঈশ্বর ও পরকাল লইয়াই ধৰ্ম্ম। হিন্দুর কাছে ইহকাল, পরকাল, ঈশ্বর, মনুষ্য, সমস্ত জীব, সমস্ত জগৎ— সকল লইয়া ধৰ্ম্ম। এমন সৰ্ব্বব্যাপী, সৰ্ব্বসুখময়, পবিত্র ধর্ম কি আর আছে?”২২ এটা কোনাে আকস্মিক ব্যাপার নয়, পরবর্তীকালে দার্শনিক হীরেন্দ্রনাথ দত্ত (১৮৬৮-১৯১৯) দার্শনিক বঙ্কিমচন্দ্র শিরােনামে একটি বই লিখেছিলেন যাতে তিনি বঙ্কিমের চিন্তাজগতের বিবর্তনের একটি বিশ্লেষণমূলক পরিচয় দিয়েছিলেন। হীরেন্দ্রনাথ দত্ত ১৯১৫ সালে মদনমােহন মালব্যের সঙ্গে যৌথভাবে হিন্দুমহাসভা নামক ঘােরতর সাম্প্রদায়িক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন।
সুপণ্ডিত দার্শনিক হীরেন্দ্রনাথ দত্ত (কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্তের পিতা) হিন্দুত্বের উদ্গাতারূপে বঙ্কিমের বন্দনায় একলা পথিক ছিলেন না। নীরদচন্দ্র চৌধুরী ১৯৫১ সালে প্রকাশিত তাঁর The Autobiography of an Unknown Indian গ্রন্থে বঙ্কিমকে ‘creator of Hindu nationalism’ বলে আখ্যায়িত করে বলছেন মানবতাবাদের (humanism) চুড়ান্ত প্রকাশ ঘটেছিল বঙ্কিমচন্দ্রে, যদিও তিনি কখনাে ব্যাখ্যা করেন কীভাবে হিন্দু জাতীয়তাবাদের একজন প্রবক্তাকে humanist অভিধায় চিহ্নিত করা। যায়। চৌধুরী অবশ্য এর খানিক পরেই বঙ্কিমচন্দ্রকে “One of the most assiduois preachars of religious culture” বলে স্বীকার করে নিয়েছেন।২৩ তবে, humanism এবং religious nationalism এক সঙ্গে একই ব্যক্তির চরিত্রবৈশিষ্ট্য যে হতে পারে না তা নীরদ চৌধুরীর মতাে তীক্ষ্ণদৃষ্টি ব্যক্তির দৃষ্টি পুরােপুরি এড়িয়ে যেতে পারেনি। প্রকারান্তরে সেকথাই বলেন তিনি ..Towards the end of the centum, the Hindu counter-reformation swung to the opposite pole of ará tesqueness. From Sanskrit scholasticism it passed to scientific cian trap. …Even so great an intellectual as Banim Chandra Chatteria was not immune from this infection. Very discreet indications of his flirtation with the old dame trying to pass off as mondaine are oc. casionally to be found in his writings.২৪
উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে যে হিন্দু পুনরুজ্জীবনবাদ বাংলার শিক্ষিত হিন্দুসমাজে ক্রমশঃ দুকূলপ্লাবী স্রেতে পরিণত হয়েছিল হীরেন্দ্রনাথ দত্ত সেই স্রোতেরই একজন। বঙ্কিম সেই সুপ্রচীন হিন্দুধর্মেরই পতাকাবাহী; “আমার সব কথাই পুরাতন। নূতনে আমার নিজের বড় অবিশ্বাস। বিশেষ আমি ধৰ্ম্মব্যাখ্যায় প্রবৃত্ত। পুরাতন, নূতন নহে। আমি নূতন ধৰ্ম্ম কোথায় পাইব?… হিন্দুধর্মের যাহা স্থলভাগ, ইউরােপ হাতড়াইয়া হাতড়াইয়া তাহার একটু আধটু ছুঁইতে পারিতেছেন, হিন্দুধর্মের শ্রেষ্ঠতার ইহা সামান্য প্রমাণ নহে।”২৫ কতটা ব্রাহ্মণ্যবাদী হলে বঙ্কিমের মতাে তীক্ষবুদ্ধি, প্রথম বাঙালী গ্রাজুয়েট লিখতে পারেন, “পৃথিবীতে যত জাতি উৎপন্ন হইয়াছে, প্রাচীন ভারতের ব্রাহ্মণদিগের মতাে প্রতিভাশালী, ক্ষমতাশালী জ্ঞানী ও ধার্মিক কোন জাতিই নহে। প্রাচীন এথেন্স বা রােম, মধ্যকালের ইতালি, আধুনিক জার্মানী বা ইংলণ্ডবাসী— কেহই তেমন প্রতিভাশালী ব ক্ষমতাশালী ছিলেন না; রােমক ধর্মযাজক, বৌদ্ধ ভিক্ষু বা অপর কোন সম্প্রদায়ের লােক তেমন জ্ঞানী বা ধার্মিক ছিল না।”২৬
এমনি করে তার ধর্মবাদিতার যুগে প্রচলিত হিন্দুধর্মের জয়গানে মুখরিত হয়ে উঠেছেন তিনি। এই ধর্মের প্রায় সবকিছুই অনুকরণীয়, অনুসরণীয় তার অবতারবাদ, তার পৌত্তলিকতা সব কিছুরই সপক্ষে যুক্তি ও লেখনী চালনা করেছেন বঙ্কিম। “…প্রকৃত হিন্দুধর্মে বহু দেব-দেবীর স্থান ছিল না; উপাস্যকে বহু দেবদেবীরূপে কল্পনা করা মানব সমাজের সেই আদিম অবস্থারই বৈশিষ্ট্য যখন কুসংস্কার প্রভাবিত হয়ে প্রাণ বা বস্তুকে দেবসত্তা দান করা হতাে।২৭ ‘হিন্দুধর্মে ঈশ্বর ভিন্ন দেবতা নাই’ একথাও লিখেছেন বঙ্কিম অকপটে।২৮ তারপরে সম্ভবতঃ মনে পড়েছে কঠোর একেশ্বরবাদ প্রতিবেশী মুসলমান সম্প্রদায়ের কথা। ফলে মিল ও কোৎ এর তত্ত্ব প্রয়ােগ করোহ বিশ্লেষণ করে দেখালেন যে, নিরাকার নির্গুণ ব্রহ্ম উপাসনা হিন্দুধর্মের শেষ কথা নয়। “এই ধৰ্ম্ম অতিবিশুদ্ধ কিন্তু অসম্পূর্ণ।… সগুণ ঈশ্বরের উপাসনাই ধর্মের মূল, কেননা, তিনিই আমাদের আদর্শ হইতে পারেন। যাঁহাকে ‘Impersonal God’ বলি, তাহার উপাসনা নিফল; যাহাকে ‘Personal God’ বলি, তাহার উপাসনাই সফল।”২৯
মুর্তিপূজা হিন্দুধর্মের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ নয় বলে স্বীকার করে নিয়েও এর মধ্যে নিন্দনীয় কিছু দেখেননি বা এর কোনাে পরিবর্তনের প্রয়ােজন আছে বলে মনে করেননি। তার দাবী একেশ্বরবাদ নিম্ন সংস্কৃতিরই পরিচায়ক, ‘A pure monotheism is not to be found among the most cultured nations of the earth… If it is to be found at all, it will be found in the spheres of lower culture, among Mahomedans, for instance.৩০ প্রতিবেশী একেশ্বরবাদী মুসলমান সম্প্রদায়ের প্রতি বঙ্কিম কতখানি অনুদার, বিরূপ মনােভাবাপন্ন ছিলেন তার এহেন মন্তব্য সেকথা আমাদের পুনরায় মনে করিয়ে দেয়। তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের পণ্ডিতেরা বঙ্কিমের এহেন বিশ্লেষণের সঙ্গে একমত হবেন না বলে ধরে নেয়া যায়। অপরদিকে রামমােহন দেবেন্দ্রনাথ যে অবতারবাদের সমালােচনা করেছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র তাও নাকচ করে দিয়ে শ্রীকৃষ্ণকে ‘অবতারশ্রেষ্ঠ’ বলে ভবিষ্যৎ ভারতীয় হিন্দুরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা কর্ণধাররূপে কল্পনা করেছেন। প্রচারে কৃষ্ণচরিত্র ধারাবাহিকভাবে ১৮৮৬ সালে প্রথম ভাগ এবং ১৮৯২ সালে সম্পূর্ণ প্রকাশিত হয়। ‘কৃষ্ণচরিত্র’ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, বঙ্গদেশ যদি অসাড় প্রাণহীন না হইত তবে কৃষ্ণচরিত্রে বর্তমান পতিত হিন্দুসমাজ ও বিকৃত হিন্দুধর্মের উপর যে অস্ত্রাঘাত আছে সে আঘাতে “বেদনাবােধ এবং কথঞ্চিৎ চেতনালাভ করিত।”৩১ অপর একজন আধুনিক গবেষকের দৃষ্টিতে ‘কৃষ্ণচরিত্রের কৃষ্ণ যেন মহম্মদের চরিত্রের ছায়ায় আঁকা; এক অতি কুশলী রাষ্ট্রনেতা, এক অসাধারণ লােকনায়ক, এক বীর সেনাপতি।৩২ – হ্যাঁ, হিন্দুপ্রধান ভারতবর্ষে একটা ঐক্যবদ্ধ সুসংহত, হিন্দু জাতীয়তাবাদভিত্তিক হিন্দু রাষ্ট্রের স্বপ্নদ্রষ্টা হিসেবেই আমরা বঙ্কিমকে পাই, বিশেষ করে তার জীবনের শেষ দশকটিতে। অন্য কোনাে জাতীয়তাবাদ, অন্য কোনাে রাষ্ট্রের কল্পনা তাঁর চিন্তায় বা লেখনীতে ঠাই পায়নি। ধর্মনির্বিশেষে সকল ভারতীয়কে নিয়ে সংগঠিত রাষ্ট্রচিন্তা যার কথা ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস বলে আসছিল সেই ১৮৮৫ সালে তার প্রতিষ্ঠাকাল। থেকে সেই জাতীয় রাষ্ট্র চিন্তাকে পাত্তা দেননি বঙ্কিম। স্বাধীনতার সংজ্ঞা দিলেন তিনি। এই বলে, সমাজের যে অবস্থা ধর্মের অনুকুল তাহাকে স্বাধীনতা বলা যায়।’ ভাৰ আকাঙ্ক্ষিত সেই স্বাধীন ধর্মরাষ্ট্রের নাগরিকবৃন্দ ইতিহাসের নানা কালপর্বে কিভাবে এগিয়েছে, গড়ে তুলেছে উদ্দীপনাময় জয়ের অথবা সম্মানজনক পরাজয়ের গৌরবগাঁথা তার চিত্র তিনি অঙ্কিত করেছেন তার ইতিহাসনির্ভর উপন্যাসসমূহে। বঙ্কিমের লেখনী এধরনের উপন্যাসে উদ্দেশ্যমূলক হয়ে ওঠে নতুন ইতিহাস অনুসন্ধান ও নির্মাণের লক্ষ্যে। মৃণালিনীতে এই উদ্যোগের সূচনা তা আগেই দেখেছি। এই উদ্যম আরাে শক্তিশালী হয় রাজসিংহ, আনন্দমঠ, দেবী চৌধুরানী ও সীতারাম-এ।
হিন্দুগৌরব কীর্তন- যে যুদ্ধজয়েই থােক অথবা বীরত্বব্যঞ্জক মহিমান্বিত পরাজয়েই হােক তিনি করতে চেয়েছেন সেইসব রণক্ষেত্রে যেখানে হিন্দু ও মুসলমান পরস্পরের প্রতিপক্ষ। বঙ্কিম যদিও এই দ্বন্দ্বকে দুই ধর্মীয় সম্প্রদায়ের দ্বন্দ্ব হিসেবে দেখিয়েছেন কিন্তু বাস্তবে কি তাই ছিল ষােলাে আনা? নাকি দ্বন্দ্বগুলাে যতটা না ধর্মীয় ছিল তার চেয়ে অনেক বেশী ছিল রাজনৈতিক আধিপত্য ও ক্ষমতার লড়াই? এসব লড়াইয়ে হিন্দুর হারজিত যাই হােক না কেন বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই হিন্দুর ঐক্যবােধ, বীরত্ব ও আত্মােৎসর্গের দৃষ্টান্ত মহিমান্বিত হয়ে ফুটে উঠেছে। এই দেশাত্মবােধ লেখকের নিখাদ হিন্দুরাষ্ট্রবাদী অনুপ্রেরণা ও চিন্তার উৎসজাত। এতে যেমন মুসলমান অনুপস্থিত, তেমনই অনুপস্থিত অপরাপর সাধারণ মানুষ।
বঙ্কিমের এসব স্বদেশীধারার উপন্যাস প্রসঙ্গে বঙ্কিম রচনাবলীর সম্পাদক বলেন, “স্বদেশবাসীর মনে স্বদেশ প্রেম ব দেশভক্তি উদ্রেক করার জন্য রাজসিংহ (ক্ষুদ্রাকারে ১৮৮২ সালে এবং বৃহত্তর সংস্করণ ১৮৯৩ সালে), আনন্দমঠ (১৮৮২), দেবী চৌধুরানী (১৮৮৪) এবং সীতারাম (১৮৮৭) প্রকাশিত করিলেন।…. তাঁহার জীবিতকালে তিনি মুখ্যতঃ প্রসিদ্ধ ঔপন্যাসিক বলিয়াই পরিচিত ছিলেন, পরবর্তী সময়ে তিনি জাতীয়তা মন্ত্রের উদ্গাতা ঋষি বঙ্কিম রূপেই আখ্যাত হইয়াছেন।”৩৩ পরবর্তীকালে, বঙ্কিমচন্দ্রের মৃত্যুর এক দশকের মধ্যেই বাংলায় স্বদেশী আন্দোলনের যে বিপুল ঢেউ দেখা দিয়েছিল, তাতে অনুপ্রেরণার অন্যতম উৎস ছিলেন এই ‘ঋষি’ বঙ্কিম। স্বদেশী নেতা অরবিন্দের ভাষায় The earlier Bankim was only a poet and stylist- the later Bankim was a seer and nationbuilder’.৩৪
যাদের নিয়ে বঙ্কিমের এই জাতি নির্মাণের স্বপ্ন ও উদ্যোগ তারা অবশ্যই হিন্দু সে কথা বারবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন তিনি। রাজসিংহের চতুর্থ সংস্করণের বিজ্ঞাপনে হিন্দুদের বীরত্বগাথা কীর্তিকলাপ নিয়ে লেখার সমস্যা ও সম্ভাবনা সম্পর্কে বঙ্কিমের জবানী, “রাজপুতগণের বীর্য অধিকতর হইলেও, এদেশে তেমন সুপরিচিত নহে। তাহা সুপরিচিত করিবার যথার্থ উপায়, ইতিহাস। কিন্তু ইতিহাস লিখিবার পক্ষে অনেক বিঘ্ন। প্রকৃত ঐতিহাসিক ঘটনা কি, তাহা স্থির করা দুঃসাধ্য। মুসলমান ইতিহাস লেখকেরা অত্যন্ত স্বজাতি পক্ষপাতী; হিন্দুদ্বেষক। হিন্দুদিগের গৌরবের কথা প্রায় লুকাইয়া রাখেনবিশেষতঃ মুসলমানদিগের চিরশত্রু রাজপুতদিগের কথা … এই উনবিংশ শতাব্দীতে হিন্দুদিগের বাহুবলের কোন চিহ্ন দেখা যায় না। ইংরেজ সাম্রাজ্যে হিন্দুর বাহুবল লুপ্ত হইয়াছে। কিন্তু তাহার পূর্বে কখনও লুপ্ত হয় নাই। হিন্দুদিগের বাহুবলই আমার প্রতিপাদ্য।”৩৫
কিন্তু না, কেবল বাহুবল নিয়েই বঙ্কিমের লেখনী থেমে যায়নি। হিন্দু জাতীয়তাবাদের আকৃতি-প্রকৃতি নির্মাণে তিনি ক্রমশঃ আরাে এগিয়েছেন। রাজসিংহ পেরিয়ে আনন্দমঠে এসে তাঁর সম্প্রদায়ভিত্তিক স্বদেশ-স্বজাতি ভাবনা আরাে সুনির্দিষ্ট অবয়ব ধারণ করে। এর প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় আনন্দমঠ রচনার প্রাক্কালে অর্থাৎ উনিশ শতকের ৭০/৮০-র দশকে শিক্ষিত বাঙালী মানসে জাতীয়তাবােধের তাপ সঞ্চারিত হচ্ছিল, ইংরেজ রাজশক্তির বেশ কিছু পদক্ষেপের কারণে। সিভিল সার্ভিস বিধি, দেশীয় প্রেস অর্ডিন্যান্স, অস্ত্র আইন, ইলবার্ট বিল ইত্যাদির প্রতিবাদে মূলতঃ শিক্ষিত বাঙালী হিন্দুরা ভারতব্যাপী প্রতিবাদে সংগঠিত হতে শুরু করেন। বৃটিশ সাম্রাজ্যের রাজধানী তখন কলকাতা স্বভাবতঃই এই নগরী নাগরিক প্রতিবাদেরও কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে। এই পরিস্থিতির হাল ধরতে চাইলেন বঙ্কিম।
উনিশ শতকে ‘হিন্দু সম্প্রদায়ের ইংরেজ সহযােগী চরিত সবচেয়ে প্রকট’ হয়েছিল বঙ্কিমের মধ্যে। আবার হিন্দু জাতীয়তাবাদের উদ্দীপক, ‘বন্দেমাতরম’ মন্ত্রের রচয়িতাও তিনি। আমরা ইতিপূর্বে দেখেছি ‘বঙ্কিমচন্দ্র’ ইংরেজকে ভারতের মিত্র, ‘পরমােপকারী’ রূপে অভিহিত করেছেন। অপরদিকে বিশ শতকে বৃটিশবিরােধী স্বদেশী আন্দোলনকারীদের লড়াকু সঙ্গীত হিসেবেও ব্যবহৃত হয়েছে তার এই ‘বন্দেমাতরম’ গান। ছাপার অক্ষরে এ গানের প্রথম আত্মপ্রকাশ দেখা যায় আনন্দমঠ উপন্যাসে। কী ছিল বঙ্কিমের বক্তব্য, এই উপন্যাসে? আমরা জানি বিশ শতকের ঔপনিবেশিক বৃটিশবিরােধী স্বদেশী আন্দোলনকারীদের এক হাতে গীতা থাকলে অন্য হাতে শােভা পেতাে বঙ্কিমের ওই আনন্দমঠ। বাংলায় ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের পটভূমিকায় ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহের ঘটনা অবলম্বনে বঙ্কিম আনন্দমঠ লিখেছিলেন। ইতিহাস সাক্ষী, আসল ফকির-সন্ন্যাসী আন্দোলন ছিল ইংরেজদের বিরুদ্ধে একটা যৌথ আলো। কিন্তু উপন্যাসে সন্ন্যাসীরা ইংরেজের মিত্রপক্ষ, এদের উভয়ের শত্রু হল মুসলমাণ শাসকবর্গ; সন্ন্যাসীরা আছে ফকিররা উধাও। উপন্যাসটির শেষ পরিচ্ছেদে দেখি যবনবিদ্বেষী সত্যানন্দ ঠাকুর বলছেন, মুসলমান রাজ্য ধ্বংস হইয়াছে, কিন্তু তিন স্থাপিত হয় নাই- এখনও কলিকাতায় ইংরেজ প্রবল। তদুত্তরে মহাপরুষ অভয় দিচ্ছেন, ইংরেজ রাজ্যে প্রজা সুখী হইবে- নিষ্কণ্টকে ধর্মাচরণ করিবে। শত্রু কে? শত্রু আর নাই। ইংরেজ মিত্ররাজা। আর ইংরেজের সঙ্গে যুদ্ধে শেষ জয়ী হয়, এ শক্তি কাহারও নাই। কাজেই একাধিক দৃষ্টিকোণ থেকেই বৃটিশ শাসন ভারতীয় শিক্ষিত হিন্দুর জন্য আশীর্বাদ হয়েই দেখা দিয়েছিল বিদেশী ঔপনিবেশিক শাসন সম্বন্ধে বঙ্কিমের চূড়ান্ত মূল্যায়ন ছিল এটাই।
বঙ্কিমের পরবর্তী তার স্বশ্রেণীর প্রজন্ম কিন্তু আনন্দমঠকে শাসকগােষ্ঠীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহের অন্যতম উদ্দীপক সঞ্জীবনী মন্ত্র হিসেবে গ্রহণ করেছে সােৎসাহে। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ প্রকাশিত বঙ্কিম রচনাবলীর সম্পাদকদ্বয় বলেন, “ইতিহাস ছাড়াও অন্য নানা কারণে ‘আনন্দমঠে’র প্রসিদ্ধি। এই উপন্যাস এবং ইহার অন্তর্গত ‘বন্দেমাতরম’ সঙ্গীত সম্বন্ধে স্বদেশে ও বিদেশে যত আলােচনা হইয়াছে, বঙ্কিমচন্দ্রের অন্য কোন রচনা লইয়া তত আলােচনা হয় নাই। পরবর্তীকালে বঙ্গদেশে এবং পরে সমগ্র ভারতবর্ষে যে স্বদেশী আন্দোলনের বন্যা দেশের আপামর সাধারণকে চঞ্চল এবং শাসক সম্প্রদায়কে ব্যতিব্যস্ত করিয়াছিল, সরকারী এবং বেসরকারী সকল সমালােচক, সন্তান-বিদ্রোহের সহিত তাহার যােগসূত্র খুঁজিয়া বাহির করিয়াছেন, এই কারণে ‘আনন্দমঠ ও ‘বন্দেমাতরমে’র কম দুর্গতি হয় নাই।”৩৬
আরেকজন প্রখ্যাত বাঙালী সাহিত্যিক, ঐতিহাসিক ও উচ্চপদস্থ বৃটিশ রাজকর্মচারী রমেশচন্দ্র দত্ত (১৮৪৮-১৯০৯) এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকায় ‘বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়’ শীর্ষক আলােচনা নিবন্ধে লিখেছেন, “The general moral of the Ananda Math… is that British rule and British education are to be accepted as the only alternative to Mussulman oppression, a moral which Bankim Chandra developed in his Dharmatattwa,… 5 though the Ananda Math is in form an apology for the loyal acceps tance of British rule, it is nonetheless inspired by the ideal of restoration, sooner or later, of a Hindu Kingdom in India. This especially evident in the oceasional verses in the book, of which Bande Mataram is the most famous”.৩৭
এই প্রসঙ্গে অন্যধর্মের প্রতি বঙ্কিমের কী মনােভাব ছিল তা একটু বিবেচনা করা যায়। বিষয়টি উপেক্ষণীয় নয় মােটেই বিশেষ করে বিশ শতকে এবং এই একবিংশ শতাব্দীতেও ভরতে সাম্প্রদায়িক বিরােধ ও হানাহানি এবং উগ্র সাম্প্রদায়িক বলে চিহ্নিত ভারতীয় জনতা পার্টির রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার প্রেক্ষাপটে। অস্বীকার করার কোনাে উপায় নেই যে, সাধারণভাবে ইসলাম ও মুসলমান সম্প্রদায়ের প্রতি বঙ্কিমের মনােভাব ছিল বিদ্বেষপূর্ণ, কঠোর, অনুদার ও অসহনশীল। তার রচনাবলী বিশেষ করে রাজসিংহ, আনন্দমঠ, দেবী চৌধুরানী ও সীতারাম অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিতে দেখলে তার মুসলিম বিদ্বেষ ধরা পড়বে। সে যুগে সাম্প্রদায়িকতার বিষবৃক্ষে জলসিঞ্চন বঙ্কিম করেছেন সােৎসাহে, অতি উদারহস্তে যেমন তার ধর্মবাদির দ্বারা তেমনি তাঁর ভ্রান্ত ইতিহাস চর্চার দ্বারা। অনেক লেখক-সমালােচক-পণ্ডিতবর্গ আছেন যারা বঙ্কিমের এই মূল্যায়ন মানতে রাজী নন। যেমন অমলেশ ত্রিপাঠী বলেছেন, বঙ্কিমের আক্রমণের লক্ষ্য সৎ মুসলমান কখনাে ছিল না, বরং উৎপীড়ক অধঃপতিত মুসলমান শাসকদেরই তিনি তীব্র সমালােচনা করেছেন। ত্রিপাঠীর ভাষায় বঙ্কিমের এ জাতীয় সমালােচনা –
“খণ্ডিত মূল্যায়নের ফল। বঙ্কিমচন্দ্রের লেখনী কখনােই সৎ মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করেনি। তাঁর রচনায় নিন্দিত হয়েছিলেন কেবলমাত্র অত্যাচারী বা অপদার্থ মুসলমান শাসকবর্গ।… আনন্দমঠের পরিপ্রেক্ষিতে রয়েছে ক্রৈব্যগ্রস্ত নবাব। আর একথাটা ভােলাও অনুচিত যে অক্ষম ও ব্যর্থ হিন্দু শাসকবর্গের প্রতি তিনি নির্মমতর। হিন্দু দেশনায়কদের ব্যক্তিগত সঙ্কীর্ণতা এবং অসাফল্যের জন্য কতবার যে হিন্দু রাজ্য প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন বিলীন হয়ে গেছে তা বঙ্কিমচন্দ্রের পক্ষে ভােলা সম্ভব ছিল না।… শুধুমাত্র মুসলমান হওয়ার অপরাধে কেউ কখনাে তার দ্বারা আক্রান্ত হননি।”৩৮
কাজী আব্দুল ওদুদ বঙ্কিমচন্দ্র সম্বন্ধে ১৯৩৮ সালে লেখা একটি প্রবন্ধে বঙ্কিমের মুসলিম বিদ্বেষী মনাের্ভাবের কথা অস্বীকার করে বলেছেন বঙ্কিমচন্দ্রের চিন্তাভাবনা লেখালেখির মূল প্রতিপাদ্য ছিল হিন্দুত্ব নয়, মানবিকতা। উদাহরণস্বরূপ তাঁর ‘ভারতবর্ষের স্বাধীনতা এবং পরাধীনতা’ শীর্ষক প্রবন্ধে বঙ্কিম যেভাবে বাদশাহ নবাবদের আমল স্বতন্ত্র ও স্বাধীন বলে ইতিবাচক বিশ্লেষণ করেছেন তাতে বঙ্কিমকে সত্যিকার মুসলিম বিদ্বেষী বা সম্প্রদায়িক বল যায় কি? আব্দুল ওদুদের এই প্রশ্নের জবাবে সুরজিৎ দাশগুপ্ত বলেন, কিন্তু ঘটনা এই যে তার প্রকৃত অভিপ্রায় যা-ই থাকুক না কেন, তাঁর বৃহত্তর গুণমুগ্ধসমাজ তাঁর রচনাবলী থেকে হিন্দুত্বের আগ্রাসন ও আস্ফালনগুলিকে বরণ করেছে এবং সােৎসাহে বর্জন করেছে তার মানবিকতাকে, যেমন করেছে আনন্দমঠে ঘােষিত ইংরেজের প্রতি আনুগত্যকে অথবা কপালকুণ্ডলা বিষবৃক্ষের শিল্পগুণকে।.. ‘বদেমাতরম’ শিল্পগুণে যতই সমৃদ্ধ হােক আসলে গানটি দেবী দুর্গারই প্রশস্তি। ধর্মীয় প্রসঙ্গে উদাসীনতা অথবা অনন্যসাধারণ উদারতা ছাড়া কোনও অহিন্দুর পক্ষে ‘বন্দেমাতরম’ গানটিকে সমাদর করা কি সম্ভব? মুষ্টিমেয় কয়েকজন বুদ্ধিজীবীর কাছে বঙ্কিমচন্দ্রের যে পরিচয়ই গ্রাহ্য হােক না কেন, বৃহত্তর হিন্দু জনসাধারণের পক্ষেও তিনি যা মুসলিম জনসাধারণের পক্ষেও তিনি তা-ই হিন্দু জাতীয়তাবাদের অন্যতম প্রধান প্রবক্তা।৩৯
আনন্দমঠের মতাে দেবী চৌধুরানী এবং সীতারামেও হিন্দুধর্মের পুনরুজ্জীবনের বিষয় ঘুরে ফিরে এসেছে, হিন্দুধর্মের শ্রেষ্ঠত্বের ব্যাপারটিও উচ্চারিত হয়েছে, বিশেষ করে সীতারাম-এ। বঙ্কিমসৃষ্ট সীতারামের হিন্দুরাজ্যে মুসলমানদের কোনাে স্থান ছিল না। বঙ্কিমের অসহিষ্ণু মনােভাবই প্রতিফলিত হয়েছে তাঁর এইসব নায়কদের আচরণে। এবং এ মনােভাব তার শুধু একার ছিল না। এদিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করেছেন আরেক গবেষক, “There is no need to play down Bankim’s communalism. This was a general attitude of the leading men of the 19th century. Their nationalism was Hindu nationalism and they preferred British rule of law to Muslim tyranny. If we keep this in mind, we can easily show how the author of Bandemataram could be a strong Hindu revivalist.৪০
ব্যক্তি জীবনে ধর্মের প্রয়ােজনীতাকে বঙ্কিম গুরুত্ব দিতে শুরু করেন তাঁর সাহিত্য জীবনের মধ্যগগনে। রাজসিংহ উপন্যাসে উপসংহারে তিনি বলেন, “অন্যান্য গুণের সহিত যাহার ধর্ম আছে হিন্দু হৌক, মুসলমান হৌক, সেই শ্রেষ্ঠ। অন্যান্য গুণ থাকিতেও যাহার ধর্ম নাই, হিন্দু হৌক, মুসলমান হৌক সেই নিকৃষ্ট।” কিন্তু ওখানেই তিনি থেমে থাকেননি ক্রমে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন ধর্মভিত্তিক হিন্দু রাজ্যের, হিন্দু প্রাধান্যের হিন্দু রাষ্ট্রের। তার এই হিন্দুত্ববাদিতা ক্রমে রূপ নিল হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার। দ্বিজাতিতত্ত্বের প্রথম যুগের প্রবক্তায় রূপান্তরিত হন এই সুশিক্ষিত লেখক-চিন্তাবিদ। একজন বিদেশী গবেষকের দৃষ্টিতে ধরা পড়ে তার এই রূপ, ‘Bankim Chandra understood that essential to nationalism was the close identification of the individual with a prarticular community from other communities.’
যে-দ্বিজাতিতত্ত্ব পরবর্তীকালে ভারতবিভাজনকে অবশ্যম্ভাবী করে তুলেছিল তার উনিশ শতকীয় প্রেক্ষাপট তৈরীতে বঙ্কিমচন্দ্র ও তাঁর সমমনা সুশিক্ষিত উচ্চ ও মধ্যবিত্ত হিন্দ শ্রেণীর অসহিষ্ণু তৎপরতা কম দায়ী নয়। এ পথের পথিক তিনি একা ছিলেন না। তাঁর সঙ্গী ছিলেন রঙ্গলাল, হেমচন্দ্র, নবীনচন্দ্র, অক্ষয়কুমার দত্ত, ভূদেবচন্দ্র— সকলেই ছিলেন কম বেশি যবন-বিরােধী। উজ্জ্বল ব্যতিক্রম হিসেবে পাই কেবল বিদ্যাসাগর ও মধুসুদনকে। আর ব্যতিক্রম তাে নিয়মকেই প্রমাণ করে।
উল্লেখপঞ্জী
- ১. বঙ্কিম রচনাবলী, বিবিধ প্রবন্ধ ১ম খণ্ড, ‘অনুকরণ’, পৃ. ২০০
- ২. ‘বঙ্গে ব্রাহ্মণাধিকার’, বিবিধপ্রবন্ধ, বঙ্কিম রচনাবলী, ২য় খণ্ড, পৃ. ৩২৬
- ৩. ‘বাঙ্গালার ইতিহস সম্বন্ধে কয়েকটি কথা’, বিবিধ প্রবন্ধ, বঙ্কিম রচনাবলী, ২য় খণ্ড, কি পৃ. ৩৩৬
- ৪. অশীন দাশগুপ্ত : ‘বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও নিবারণ চক্রবর্তী’, প্রবন্ধ সমগ্র, – কলকাতা, ২০০১, পৃ. ১৪৭-১৪৮
- ৫. তনিকা সরকার : ‘বন্দেমাতরম্ বনাম জন-গণ-মন’, আধুনিকতার দু-একদিক, ধর্ম সাহিত্য ও রাজনীতি, কলকাত, ২০০১, পৃ. ১০
- ৬. “ভারতকলঙ্ক”, বিবিধ প্রবন্ধ, বঙ্কিম রচনাবলী, ২য় খণ্ড, পৃ. ২৩৫
- ৭. ঐ. পৃ. ২৩৯,
- ৮. ঐ. পূ. ২৪১
- ৯. Tapan Raychoudhuri : Europe Reconsidered : Perceptions of the West in Nineteenth Century Bengal, Oxform University Press, India, 1988, p. 188.
- ১০, ঐ, পৃ. ১২
- ১১. ঐ
- ১২. বঙ্কিম রচনাবলী, ২য় খণ্ড, ভূমিকা, সাহিত্য প্রসঙ্গ, পৃ, ২১-২২
- ১৩. Kamal Kumar Ghatak : Hindu Revivalism in Bengal, Rammohan to Ramkrishna, Calcutta, 1991, pp. 60-61
- ১৪. অমলেশ ত্রিপাঠী : ভারতের মুক্তি সংগ্রামে চরমপন্থীপর্ব, কলকাতা ১৯৮৭, পৃ. ২২
- ১৫. ঐ, পৃ. ২৩
- ১৬. ঐ, পৃ. ২৩
- ১৭. ঐ, পৃ. ২৩
- ১৮. যােগেশচন্দ্র বাগল, বঙ্কিম রচনাবলী, প্রথম খণ্ড, পৃ. ১৯
- ১৯. বঙ্কিম রচনাবলী, ২য় খণ্ড, পৃ. ১৫
- ২০. বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, ধৰ্ম্মতত্ত্ব, একাদশ অধ্যায়, ঈশ্বরের ভক্তি
- ২১. বঙ্কিম রচনাবলী, ২য় খণ্ড পৃ. ১৫
- ২২. ঐ, ধর্মতত্ত্ব, পঞ্চম অধ্যায়, অনুশীলন
- ২৩. Nirad C. Chaudhuri, The Autobiography of an Unknown Indian, London, 1951, p. 187-188।
- ২৪. ibid, p. 203-204
- ২৫. বঙ্কিম রচনাবলী, ২য় খণ্ড, ধর্মতত্ত্ব, পঞ্চম অধ্যায়, পৃ. ৫৯৫-৫৯৬।
- ২৬. ঐ, ২য় খণ্ড, ধর্মতত্ত্ব, দশম অধ্যায়, পৃ. ৬১৮।
- ২৭. অমলেশ ত্রিপাঠী, ভারতের মুক্তি সংগ্রামে চরমপন্থীপর্ব, কলকাতা, ১৯৮৭, পৃ. ২৫
- ২৮, বঙ্কিম রচনাবলী, ২য় খণ্ড, পৃ. ৮২০
- ২৯. বঙ্কিম রচনাবলী, ২য় খণ্ড, ধর্মতত্ত্ব, চতুর্থ অধ্যায়, পৃ. ৫৯৩
- ৩০, English Writings of Bankimchandra Chatterjee, Calcutta, 1940, p. 45
- ৩১. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, আধুনিক সাহিত্য, বঙ্কিমচন্দ্র, ১৮৯৪
- ৩২. তনিকা সরকার, আধুনিকতার দু-এক দিক : ধর্ম, সাহিত্য ও রাজনীতি, কলকাতা, ২০০১, পৃ. ১১
- ৩৩. বঙ্কিম রচনাবলী, প্রথম খণ্ড, পৃ. ১৯
- ৩৪. প্রগুক্ত, পৃ. ১১২
- ৩৫. বঙ্কিম রচনাবলী, প্রথম খণ্ড, পৃ. ২।
- ৩৬, বঙ্কিম রচনাবলী, প্রথম খণ্ড, পৃ. ২৯
- ৩৭. এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা, একাদশ সংস্করণ, ষষ্ঠ খণ্ড, পৃ. ৯-১০
- ৩৮. সুরজিৎ দাপ্ত, প্রাগুক্ত, ১৪০৯ পৃ, ৩৬-৩৭
- ৩৯. Kamal Kumar Ghatak, Hindu Revivalism in Bengal : Rammohan Rarnkrishna, Calcutta, 1991, p. 69
- ৪০. C.H, Heimsath, Indian Nationalism and Hindu Social Reform, Prince 1964, p. 138.