• মূলপাতা
  • ইতিহাস
    • ইসলামিক ইতিহাস
    • ভারতবর্ষের ইতিহাস
    • বিশ্ব ইতিহাস
  • বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
  • ধর্ম
    • ইসলাম
    • খ্রিস্টান
    • হিন্দু
    • ইহুদী
    • অন্যান্য ধর্ম
  • নাস্তিকতা
  • রাজনীতি
  • সিনেমা
  • সাহিত্য
    • কবিতা
    • ছোটগল্প
    • উপন্যাস
    • সাহিত্য আলোচনা
  • অন্যান্য
  • ই-ম্যাগাজিন
    • নবজাগরণ (ষাণ্মাসিক) – জীবনানন্দ ১২৫ তম জন্ম সংখ্যা – মননশীল সাহিত্য পত্রিকা
  • Others Language
    • English
    • Urdu
    • Hindi
Wednesday, June 18, 2025
নবজাগরণ
  • মূলপাতা
  • ইতিহাস
    • ইসলামিক ইতিহাস
    • ভারতবর্ষের ইতিহাস
    • বিশ্ব ইতিহাস
  • বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
  • ধর্ম
    • ইসলাম
    • খ্রিস্টান
    • হিন্দু
    • ইহুদী
    • অন্যান্য ধর্ম
  • নাস্তিকতা
  • রাজনীতি
  • সিনেমা
  • সাহিত্য
    • কবিতা
    • ছোটগল্প
    • উপন্যাস
    • সাহিত্য আলোচনা
  • অন্যান্য
  • ই-ম্যাগাজিন
    • নবজাগরণ (ষাণ্মাসিক) – জীবনানন্দ ১২৫ তম জন্ম সংখ্যা – মননশীল সাহিত্য পত্রিকা
  • Others Language
    • English
    • Urdu
    • Hindi
No Result
View All Result
নবজাগরণ
  • মূলপাতা
  • ইতিহাস
    • ইসলামিক ইতিহাস
    • ভারতবর্ষের ইতিহাস
    • বিশ্ব ইতিহাস
  • বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
  • ধর্ম
    • ইসলাম
    • খ্রিস্টান
    • হিন্দু
    • ইহুদী
    • অন্যান্য ধর্ম
  • নাস্তিকতা
  • রাজনীতি
  • সিনেমা
  • সাহিত্য
    • কবিতা
    • ছোটগল্প
    • উপন্যাস
    • সাহিত্য আলোচনা
  • অন্যান্য
  • ই-ম্যাগাজিন
    • নবজাগরণ (ষাণ্মাসিক) – জীবনানন্দ ১২৫ তম জন্ম সংখ্যা – মননশীল সাহিত্য পত্রিকা
  • Others Language
    • English
    • Urdu
    • Hindi
No Result
View All Result
নবজাগরণ
No Result
View All Result

‘বনলতা সেন’ : কবি ও কাব্য – বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা

অতিথি লেখক by অতিথি লেখক
October 16, 2023
in সাহিত্য আলোচনা
0
বনলতা সেন : কবি ও কাব্য - বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা

Image Source: Google

Share on FacebookShare on Twitter

লিখেছেনঃ ছন্দা ঘোষাল

দুই বিশ্বযুদ্ধ মধ্যবর্তীকালে বাংলা কাব্য জগতে জীবনানন্দের (জন্ম : ১৮৯৯; মৃত্যু : ২২ অক্টোবর, ১৯৫৪) আবির্ভাব। তখন বিশ্ব আন্দোলিত হচ্ছে বিশ্বযুদ্ধের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ ফল স্বরূপ দারিদ্র্য, বেকারত্ব, দুর্ভিক্ষ, মহামারি, সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, পারস্পরিক বিদ্বেষ, হানাহানি তথা সার্বিক অনিশ্চয়তা আর অস্থিরতায়। পূর্ববর্তী যুগের সামাজিক সুস্থিতি, সত্য-শিব-সুন্দরের ধ্যান বিঘ্নিত। স্বভাবতই ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র এবং অধ্যাপক জীবনানন্দ দাশ তাঁর সাহিত্যের (কবিতা এবং কথা) পটভূমি করলেন এই অস্থির, অনিশ্চিত সময়কে। কেননা তখন পাশ্চাত্যের সাহিত্যও আন্দোলিত হচ্ছে বিশ্বব্যাপী এই বিক্ষুব্ধ সময় চেতনার দ্বারা। স্বভাবতই চতুপার্শ্ব এবং পাশ্চাত্য সাহিত্য পাঠের অভিজ্ঞতা তাঁকে অনুপ্রাণিত করলো বাংলা সাহিত্যের এতদিনকার মাধবীবিতান আচ্ছাদিত কোকিল কূজিত কাকনে ভিন্নতর এক কণ্ঠস্বরের প্রবর্তনায়—’কেউ যাহা জানে নাই—কোনো এক বাণী— / আমি বহে আনি; / একদিন শুনেছ সে সুর— / ফুরায়াছে— পুরানো তা কোনো এক নতুন কিছুর / আছে প্রয়োজন / তাই আমি আসিয়াছি, – আমার মতন / আর নাই কেহ। /…/ সকলের পায়ের শব্দের / সুর গেছে অন্ধকারে থেমে; / তারপর আসিয়াছি নেমে আমি / আমার পায়ের শব্দ শোনো’— / নতুন এ-আর সব হারানো পুরানো। (কয়েকটি লাইন / জীবনানন্দ দাশ)

জীবনানন্দ দাশের কবিতায় আরবি-ফারসি শব্দের ব্যবহার/‘বনলতা সেন’ : কবি ও কাব্য - বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা
চিত্রঃ জীবনানন্দ দাশ, Image Source: thedailystar

বস্তুত, পাশ্চাত্যে সাহিত্যের পূর্বে চিত্রকলায় দেখা গিয়েছিল পরিবর্তমান সময়ের ঢেউ। মানুষের যাবতীয় আচরণের পেছনে নিহিত থাকে তার মনের ত্রিবিধ স্তরের (ইদ-ইগো-সুপারইগো) ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া-মনোচিকিৎসক সিগমুন্ড ফ্রয়েডের এই সিদ্ধান্ত (The Interpretation of Dreams, 1899) জন্ম দিল সুররিয়ালিজম (পরাবাস্তববাদ)-এর; এর পূর্বেই অবশ্য আমেরিকান মনোচিকিৎসক উইলিয়াম জেমস—মনের গতির প্রকৃতি অনুধাবন করে তাকে Stream of Consciousness বলে অভিহিত করেছিলেন (Principles of Psychology, 1890) এবং এই সূত্রে শিল্প, সাহিত্য ক্ষেত্রে ফরাসী দার্শনিক বেগ (Bergson)-র ডিউরেশন থিওরি (১৮৮৯) এবং মেকানিক্যাল ও সাইকোলজিক্যাল (Pure) সময় বিভাজনের (Creative Evolution, 1907, English Verson, 1911) ধারণাকে যুক্ত করে জন্ম হলো Stream of Consciousness বা চেতনা প্রবাহ রীতির। ইতিমধ্যে ক্যামেরার আবিষ্কার ও সাফল্য পাশ্চাত্যের চিত্রশিল্পীদের কাজের ধারায় আনল পরিবর্তন। কেননা তখন প্রকৃতির হুবহু অনুকরণে আর কোনো কৃতিত্ব নেই বলে শিল্পীরা অনুভব করলেন। বাস্তবিক ক্যামেরার ছবির সমকক্ষ তাঁদের হাতে আঁকা ছবি কখনোই হয়ে উঠবে না—যার প্রভাব তাঁদের পসারেও পড়ছিল অবশ্যম্ভাবি রূপে। ফলে চিত্রশিল্পীরা তাঁদের শিল্পে অভিনবত্ব আনার প্রয়োজনবোধ করলেন। আর সেই তাগিদেই চিত্রশিল্পের ধারায় জন্ম নিল সিম্বলিজম (প্রতীকবাদ), এক্সপ্রেশানইজম (প্রকাশবাদ), ইম্প্রেশনইজম, ইমেজইজম (চিত্রকল্পবাদ), কিউবিজম-এর মতো জাঁর (Genre)। অন্যদিকে যুদ্ধবিধ্বস্ত পৃথিবীতে অমৃতস্য পুত্রাঃ’ মানুষের অস্তিত্ব হলো সবচেয়ে সঙ্কটাপূর্ণ, অতিহীন, তুচ্ছাতিতুচ্ছ। মানবসত্তার এই অবস্থাই জন্ম দিল সাহিত্য ক্ষেত্রে এক্‌জিস্টেসিয়ালিজম (অস্তিত্ববাদ), রিয়ালিজম (বাস্তববাদ), সোসাল রিয়ালিজম (সমাজতান্ত্রিক বাস্তববাদ), অ্যাবসার্ডইজম-এর মতো দর্শন ভিত্তিক মতবাদী আন্দোলনের। বলাবাহুল্য এই সবের দ্বারাই প্রভাবিত হয়েছিল জীবনানন্দের কাব্য জগৎ। তাই জীবনানন্দকে সামগ্রিকভাবে অনুধাবন না করে যাঁরা তাঁর কাব্যজগৎ এবং কবি প্রতিভাকে খণ্ডিত দৃষ্টিতে বিচার করে বলেছিলেন—তিনি পলায়নবাদী কবি, তিনি নির্জনতম কবি, তিনি ক্লান্তির কবি, তিনি মানব বিদ্বেষী, নির্জন প্রকৃতির কবি, তিনি অন্ধকারের কবি—তাঁদের বিচারের সেই ভ্রান্তি বা ত্রুটিকে জীবনানন্দ নিজেই দূরীভূত করেছিলেন তাঁর কাব্যজগতের নিজস্ব মূল্যায়নে—’আমার কবিতাকে বা এ-কাব্যের কবিকে নির্জন বা নির্জনতম আখ্যা দেওয়া হয়েছে; কেউ বলেছেন, এ-কবিতা প্রধানত প্রকৃতির বা প্রধানত ইতিহাস ও সমাজ-চেতনার, অন্যমতে নিশ্চেতনার; কারো মীমাংসায় এ-কাব্য একান্তই প্রতীকী; সম্পূর্ণ অবচেতনার; সুররিয়ালিস্ট। আরো নানারকম আখ্যা চোখে পড়েছে। প্রায় সবই আংশিকভাবে সত্য-কোনো-কোনো কবিতা বা কাব্যের কোনো-কোনো অধ্যায় সম্বন্ধে খাটে; সমগ্র কাব্যের ব্যাখ্যা হিসেবে নয়। (ভূমিকাংশ / জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা, নাভানা কলকাতা)

১৯৪২ সালে কবিতা ভবন থেকে ‘এক পয়সায় একটি’ গ্রন্থমালার অন্তর্ভূক্ত হয়ে প্রকাশিত হয় জীবনানন্দের তৃতীয় কাব্য ‘বনলতা সেন’ (তাঁর অন্যান্য কাব্য-ঝরাপালক, ধূসর পাণ্ডুলিপি, মহাপৃথিবী, সাতটি তারার তিমির, আলোপৃথিবী, রূপসী বাংলা, বেলা অবেলা কালবেলা, মনোবিহঙ্গম, সুদর্শনা); এই সংকলনে মোট কবিতার সংখ্যা ছিল ১২টি। প্রকাশক ছিলেন জীবনানন্দ দাশ, বরিশাল। পরে ১৯৫২ সালে এই গ্রন্থের ২য় সংস্করণ প্রকাশিত হয় সিগনেট প্রেস থেকে; প্রকাশক ছিলেন দিলীপ কুমার গুপ্ত, কলকাতা। মোট কবিতার সংখ্যা ৩০টি। এই সংস্করণের কবিতাগুলি হলো যথাক্রমে—১. বনলতা সেন ২. কুড়িবছর পরে ৩. ঘাস ৪. হাওয়ার রাত ৫. আমি যদি হতাম ৬. হায় চিল ৭. বুনো হাঁস, ৮. শঙ্খমালা ৯. নগ্ন নির্জন হাত ১০. শিকার ১১. হরিণেরা ১২. বিড়াল ১৩. সুদর্শনা ১৪. অন্ধকার ১৫. কমলালেবু ১৬. শ্যামলী ১৭. দুজন ১৮. অবশেষে ১৯. স্বপ্নের ধ্বনিরা ২০. আমাকে তুমি ২১. তুমি ২২. ধানকাটা হয়ে গেছে ২৩. শিরীষের ডালপালা ২৪. হাজার বছর শুধু খেলা করে ২৫. সুরঞ্জনা ২৬. মিতভাষণ ২৭. সবিতা ২৮. সুচেতনা ২৯. অঘ্রাণ প্রান্তরে ৩০. পথ হাঁটা।

বলে রাখা দরকার সিগনেট প্রেস সংকলনই আমাদের এই আলোচনার অভিমুখ। প্রথমেই আলোচনা করা যেতে পারে জীবনানন্দের প্রেম চেতনা বিষয়ে—জীবনানন্দ প্রেমকে দেখেছেন বহুকৌণিকভাবে—উল্টে পাল্টে। কখনো দেখেছেন শাশ্বতের অনুভবে, কখনো বা খণ্ডকালের অনুভবে। ভালোবেসে, ঘৃণা করে—নানা ভাবে তিনি নারীকে অনুভব, আস্বাদ করেছেন—’ভালোবেসে দেখিয়াছি মেয়েমানুষেরে, / অবহেলা ক’রে আমি দেখিয়াছে মেয়েমানুষেরে, / ঘৃণা করে দেখিয়াছি মেয়েমানুষেরে’; (বোধ / ধূসর পাণ্ডুলিপি) ‘বনলতা সেন’ কাব্যের বিবিধ কবিতায় কবি প্রেমকে এভাবে খণ্ড-অখণ্ড অনুভবের সমগ্রতায় অবলোকন করতে চেয়েছেন। যেমন কাব্যের নাম কবিতা বনলতা সেন (প্রথম প্রকাশ, পৌষ ১৩৪২ বঙ্গাব্দ, কবিতা পত্রিকা, সম্পা. বুদ্ধদেব বসু)-এ কবি প্রেমকে খণ্ড-অখণ্ড মিলিয়ে সমগ্রতায় অনুভব করেছেন। তাই যুগ যুগ (হাজার বছর) ধরে প্রেমের অন্বষায় ভ্রাম্যমান পথ শ্ৰাপ্ত যুগ-যন্ত্রণাক্লিষ্ট ক্লান্ত প্রাণ মানুষটিকে যেমন ‘দু’দণ্ডের’ (ক্ষণিকের) শান্তি দেয় বনলতা সেন, তেমনি আবার সমস্ত দিনের শেষে প্রকৃতির বুকে শিশিরের শব্দের মতো সন্ধ্যা নেমে আসার অনুরূপে সমস্ত জীবের জীবনে নীরবে মৃত্যু নেমে এলেও থেকে যায় শুধু গভীর শাশ্বত প্রেমের অনুভূতি—’থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।’ এই প্রেমকেই আবার ‘হায় চিল’ কবিতায় কবি দেখেছেন খণ্ডতার দৃষ্টিতে—’তোমার কান্নার সুরে বেতের ফলের মতো তার ম্লান চোখে মনে আসে; / পৃথিবীর রাঙা রাজকন্যাদের মতো সে যে চলে গেছে রূপ নিয়ে দূরে;’ প্রেমের খণ্ডিত, অপ্রাপনীয় রূপ দেখতে পাওয়া যায় ‘সবিতা’ কবিতায়—‘তোমার মুখের রেখা আজো / মৃত কতো পৌত্তলিক খ্রীস্টান সিন্ধুর / অন্ধকার থেকে এসে নব সূর্যে জাগার মতন; / কতো কাছে—তবু কতো দূর।’ সিন্ধুসারস’কবিতাতেও কবি সিন্ধুসারসের উদ্দেশ্যে ঝরে যাওয়া প্রেমের বিমর্ষতা তুলে ধরে বলেন—‘পৃথিবীর শঙ্খমালা নারী সেই—আর তার প্রেমিকের ম্লান / নিঃসঙ্গ মুখের রূপ, বিশুষ্ক তৃণের মতো প্রাণ, / জানিবে না, কোনোদিন জানিবে না’ নগ্ন নির্জন হাত’–এ কবি তথা প্রেমিক পুরুষের স্বীকারোক্তি—’যে আমাকে চিরদিন ভালোবেসেছে / অথচ যার মুখ আমি কোনোদিন দেখিনি, / সেই নারীর মতো / ফাল্গুন আকাশে অন্ধকার নিবিড় হয়ে উঠছে।/ … / তোমার মুখের রূপ কতো শত শতাব্দী আমি দেখি না, / খুঁজি না / শুধু মানব জীবনেই নয়, প্রকৃতির বুকেও প্রেমের এই খণ্ডতা, ক্ষণিকত্বকে কবি অনুভব করেছেন—’সারারাত চিতাবাঘিনীর হাত থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে-বাঁচিয়ে / … / সুন্দর বাদামী হরিণ এই ভোরের জন্য অপেক্ষা করছিলো।/ … / সাহসে সাধে সৌন্দর্যে হরিণীর পর হরিণীকে চমক লাগিয়ে দেবার জন্য । / একটা অদ্ভুত শব্দ। / নদীর জল মচকাফুলের পাপড়ির মতো লাল। / আগুন জ্বললো আবার —উষ্ণ লাল হরিণের মাংস তৈরি হয়ে এলো।’ ‘শঙ্খমালা’-তেও কবি প্রেমের ঋণ অস্তিত্বের কথা বলেছেন—’কান্তারের পথ ছেড়ে সন্ধ্যার আঁধারে / সে কে এক নারী এসে ডাকিল আমারে, বলিল, তোমারে চাই; … / … / তোমারে খুঁজেছি আমি নির্জন পেঁচার মতো প্রাণে।/ … / কড়ির মতন শাদা মুখ তার, / দুইখানা হাত তার হিম; / চোখে তার হিজল কাঠের রক্তিম / চিতা জ্বলে : / দখিন শিয়রে মাথা শঙ্খমালা যেন পুড়ে যায় / … / এ-পৃথিবী একবার পায়, তারে, পায়নাকো আর।’ প্রেমের ক্ষণিকত্ব দেখি ‘ধান কাটা হয়ে গেছে’-তেও—‘ওইখানে একজন শুয়ে আছে—দিনরাত দেখা হতো কতো কতো দিন, / হৃদয়ের খেলা নিয়ে তার কাছে কয়েছি যে কতো অপরাধ;/ শান্তি তবু : গভীর সবুজ ঘাস ঘাসের ফড়িং / আজ ঢেকে আছে তার চিন্তা আর জিজ্ঞাসার অন্ধকার স্বাদ।’ আবার প্রেমকে জীবনানন্দ চিরন্তন শাশ্বত রূপে দেখেছেন ‘সুরঞ্জনা’-তে—’সুরঞ্জনা’-তে—’সুরঞ্জনা, আজো তুমি আমাদের পৃথিবীতে আছো; / পৃথিবীর বয়সিনী তুমি এক মেয়ের মতন; / … / তুমি সেই অপরূপ সিন্ধু রাত্রি মৃতদের রোল / দেহ দিয়ে ভালোবেসে, তবু আজ ভোরের কল্লোল।’ ‘হাজার বছর শুধু খেলা করে’-তেও দেখি চারিদিকে মৃত সভ্যতা আর মৃত্যু আবহের মধ্যেও অটল অনন্ত রূপে জেগে থাকে প্রেম, প্রেমের অনুভূতি—“হাজার বছর শুধু খেলা করে অন্ধকারে জোনাকির মতো : / চারিদিকে পিরামিড –কাফনের ঘ্রাণ; / শরীরে মমির ঘ্রাণ আমাদের —ঘুচে গেছে জীবনের সব লেনদেন; / ‘মনে আছে?’ শুধালো সে—শুধালাম আমি শুধু, ‘বনলতা সেন’।” একইভাবে ‘হাওয়ার রাত’ কবিতাতেও মৃত্যু আবহের মধ্যেই দেখি জীবনের, প্রেমের চিরন্তন বিজয় স্তম্ভ প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার—যে-রূপসীদের আমি এশিরিয়ায়, মিশরে, বিদিশায় ম’রে যেতে দেখেছি / কাল তারা অতিদূর আকাশের সীমানার কুয়াশায়—কুয়াশায় দীর্ঘ বর্শা হাতে ক’রে / কাতারে কাতারে দাঁড়িয়ে গেছে যেন—/ মৃত্যুকে দলিত করবার জন্য ? / জীবনের গভীর জয় প্রকাশ করবার জন্য ? / প্রেমের ভয়াবহ গম্ভীর স্তম্ভ তুলবার জন?’ ‘বনলতা সেন’-এর মতোই ‘বুনো হাঁস’-এও দেখা যায় পৃথিবীর সব রূপ, রং ঝরে গেলেও অনন্ত রাত্রির বুকে জেগে থাকে শুধু শাশ্বত প্রেমের অনুভূতি—’মনে পড়ে কবেকার পাড়াগাঁর অরুণিমা সান্যালের মুখ; / উড়ুক উড়ুক তারা পউষের জ্যোৎস্নায় নীরবে উড়ুক / কল্পনার হাঁস সব; পৃথিবীর সব ধ্বনি সব রং মুছে গেলে পর / উড়ুক উদ্ভুক তারা হৃদয়ের শব্দহীন জ্যোৎস্নার ভিতর।’

এইভাবে আলোচ্য কবিতাবলীতে দেখা যায় প্রেম চেতনার পাশাপাশি কবির বিশিষ্ট মৃত্যু এবং ইতিহাস ও ভূগোল চেতনা ও অঙ্গাঙ্গীভাবে সন্নিবিষ্ট রয়েছে।

বাস্তবিক কবি জীবনানন্দ বিশ্বযুদ্ধোত্তর সমাজের নানা বিকার, অবক্ষয়, মূল্যবোধহীনতা, অসাম্য দেখে জীবন যন্ত্রণার প্রশমন ঘটাতে বারেবারে নিজের কবি মানসকে নিয়ে গেছেন ইতিহাসের বর্ণোজ্জ্বল পাতায়; প্রেম, প্রকৃতি আর মৃত্যুর আশ্রয়ে। তাই আর এক মহত্তর মূল্যবোধে ভরপুর, স্থির প্রত্যয়ী প্রত্যাশিত পৃথিবীর আকাঙ্ক্ষা করেন বলেই কবি সমসাময়িক যুদ্ধ-বিধ্বস্ত, মূল্যবোধহীন অবক্ষয়িত যন্ত্রণা, ক্লান্তি, ক্লিষ্ট পৃথিবী থেকে মুক্তি চেয়ে বলেন–‘ধানসিড়ি নদীর কিনারে আমি শুয়ে ছিলাম—পউষের রাতে—/কোনোদিন জাগবো না জেনে—/কোনোদিন জাগবো না আমি—কোনোদিন আর।’ (অন্ধকার)

আবার পাশ্চাত্য শিল্প-সাহিত্যের বিশেষ জাঁর সুররিয়ালিজম, এজিস্টসিয়ালিজম, ইমপ্রেসানিজমের-ও প্রকাশ দেখা যায় ‘বনলতা সেন’-এর কয়েকটি কবিতায়। যেমন সুররিয়ালিজম বা পরাবাস্তববাদের প্রকাশ দেখি—‘হাওয়ার রাত’, ‘বিড়াল’ প্রভৃতি কবিতায়। স্বপ্নতত্ত্ব ব্যাখ্যা (The Interpreatation of dreams, 1899) করতে গিয়ে মনোচিকিৎসক সিগমুন্ড ফ্রয়েড মনের তিনটি স্তরের (ইদ্-ইগো-সুপারইগো) কথা বলেছিলেন। মনের অপরিশুদ্ধ (innate) স্তর হলো ইদ। এই স্তরেই অবস্থান করে মানবের লিবিডো তথা প্রবৃত্তিসমূহ। ইগো ইদ-কে নিয়মের শেকলে বেঁধে রাখে; আর সুপার ইগো তার ওপর সামাজিক, রাষ্ট্রিক অনুশাসন চাপিয়ে তাকে নীতিনিষ্ঠ পরিশুদ্ধ করে তোলে। তার ফলে ইদ-এর স্বাভাবিক প্রকাশ ব্যাহত, অবদমিত হয় অধিশাস্তা বা সুপার ইগোর স্তরে (The Ego And the ID, 1923, Freud)। আর এই অবদমনই কোনো কোনো ক্ষেত্রে জন্ম দেয় মানসিক বিশৃঙ্খলার—যা প্রথাসিদ্ধ সমাজ মানসের কাছে বিকার ও অপ্রকৃতিস্থতা বলে প্রতীয়মান হয়। সেই কারণেই কোন কোন ব্যক্তির আচরণে যেমন অসংলগ্নতা দেখা দেয় তেমনি স্বপ্নলোকেও নানা অসংলগ্ন, অসম্ভব, উদ্ভট দৃশ্যের যাওয়া-আসা চলে। ফ্রয়েডের এই তত্ত্বের নিরিখেই ইউরোপে চিত্রশিল্প এবং সাহিত্যে দেখা দেয় সুররিয়ালিস্টিক চিন্তা চেতনা। বাংলা কবিতায় জীবনানন্দ হলেন এই ধারার পথিকৃৎ। তাঁর ‘হাওয়ার রাত’ কবিতায় স্বপ্নলোকের এরকম কিছু আপাত অ্যাবসর্ড, অসংলগ্ন দৃশ্যের সন্ধান মেলে—

(১) ‘গভীর হাওয়ার রাত ছিলো কাল… / সারারাত বিস্তীর্ণ হাওয়া আমার মশারিতে খেলেছে; / মশারিটা ফুলে উঠেছে কখনো মৌসুমী সমুদ্রের পেটের মতো, / কখনো বিছানা ছিঁড়ে / নক্ষত্রের দিকে উড়ে যেতে চেয়েছে; / এক-একবার মনে হচ্ছিলো আমার—আধো ঘুমের ভিতর হয়তো—/মাথার উপরে মশারি নেই আমার, / স্বাতি তারার কোল ঘেঁষে নীল হাওয়ার সমুদ্রে শাদা বকের মতো উড়ছে সে!’

(২) সমস্ত মৃত নক্ষত্রেরা কাল জেগে উঠেছিলো—আকাশে এক তিল / ফাঁক ছিলো না; / পৃথিবীর সমস্ত ধূসর প্রিয় মৃতদের মুখও সেই নক্ষত্রের ভিতর দেখেছি আমি;

(৩) যে-রূপসীদের আমি এশিরিয়ায়, মিশরে, বিদিশায় মরে যেতে দেখেছি / কাল তারা অতিদূর আকাশের সীমানার কুয়াশায় কুয়াশায় দীর্ঘ বর্শা হাতে করে / কাতারে কাতারে দাঁড়িয়ে গেছে যেন—

(৪) আমার হৃদয় পৃথিবী ছিঁড়ে উড়ে গেল, / নীল হাওয়ার সমুদ্রে স্ফীত মাতাল বেলুনের মতো গেল উড়ে, / একটা দূর নক্ষত্রের মাস্তুলকে তারায় তারায় উড়িয়ে নিয়ে চললো / একটা দুরন্ত শকুনের মতো।

অনুরূপ ‘বিড়াল’ কবিতায়—’সারাদিন একটা বিড়ালের সঙ্গে ঘুরে-ফিরে কেবলই আমার দেখা হয় : / … / সারাদিন সূর্যের পিছনে-পিছনে চলছে সে। / একবার তাকে দেখা যায়, / একবার হারিয়ে যায় কোথায়।/ হেমন্তের সন্ধ্যায় জাফরান-রঙের সূর্যের নরম শরীরে / শাদা থাবা বুলিয়ে-বুলিয়ে খেলা করতে দেখলাম তাকে; / তারপর অন্ধকারকে ছোটো ছোটো বলের মতো থাবা দিয়ে লুফে আনলো সে, / সমস্ত পৃথিবীর ভিতর ছড়িয়ে দিলো।’ পাশ্চাত্যের আর এক সাহিত্য আন্দোলন—অস্তিত্ববাদী সাহিত্য আন্দোলন বা একাজিস্টেনসিয়ালিজম। পাশ্চাত্য দর্শনে কিয়ের্কগার্ড যার প্রণেতা ছিলেন। এরপর পাশ্চাত্যের চিত্রশিল্প এবং সাহিত্যে এই দর্শনের প্রভাব পড়ে। অস্তিত্ববাদীরা বিশৃঙ্খল বিশ্বে একদা ‘অমৃতস্য পুত্রাঃ’ মানুষের অস্তিত্বকে দেখলেন অত্যন্ত হীন, ঘৃণ্য, তুচ্ছাতিতুচ্ছ কীটের তুল্য রূপে। যুদ্ধ বিধ্বস্ত পৃথিবীতে ব্রহ্মাণ্ড এঁদের কাছে আর সত্য-শিব-সুন্দরের আধার নয়। এঁরা তাই সামাজিক-রাষ্ট্রিক সকল অনুশাসন মুক্ত ব্যক্তির স্বাধীন একক (individual) অস্তিত্বের জয় ঘোষণা করেন। ফ্রাঞ্জ কাফ্ফা, অ্যালবার্ট কামু-র হাতে বিশ্বযুদ্ধকালীন সাহিত্যে (The Metamorphosis, Kafka, 1915, The Myth of Sisphyus, Camus, 1942) অস্তিত্ববাদের সফল প্রয়োগ ঘটে। অন্যদিকে ভ্যান গগ, এডভার্ড মুখ (Munch), পল সেজান (Cezanne)-এর হাতে চিত্রশিল্পে অস্তিত্ববাদের সকল প্রয়োগ ঘটে। সেজানের ‘The Card players’ এবং মুখ-এর ‘The Scream’ (চিৎকার) বিখ্যাত অস্তিত্ববাদী চিত্র। জীবনানন্দের ‘বনলতা সেন’ কাব্যের ‘অন্ধকার’ কবিতায় এই ধারার চিন্তা-চেতনার প্রকাশ লক্ষ করা যায়। তাই ভোরের আলোর আগমনকে তাঁর আর ঊষার ফুলদোলা বলে মনে হয় না, মনে হয় মূর্খ উচ্ছ্বাস আর নিজেকে তথা পৃথিবীর মনুষ্যকুলকে মনে হয় তুচ্ছ ঘৃণ্য জীব। দিনের আলোকিত, কর্মমুখর পৃথিবীকে তাঁর মনে হয় ‘শত শত শূকরের চীৎকার’, ‘শত শত শূকরীর প্রসব বেদনার আড়ম্বর’। তাই নিজেকে পৃথিবীর তুচ্ছ এক জীব বলে উপলব্ধি করার সাথে সাথেই তাঁর ‘…সমস্ত হৃদয় ঘৃণায়-বেদনায়-আক্রোশে ভরে গিয়েছে; / সূর্যের রৌদ্রে আক্রান্ত এই পৃথিবী যেন কোটি কোটি শুয়োরের-আর্তনাদে উৎসব শুরু করেছে।’ সেই কারণেই দিনের আলো নয়, রাতের অন্ধকার-ই কবির কাম্য। আর তাই তাঁর একান্ত চাওয়া—’হৃদয়ের অবিরল অন্ধকারের ভিতর সূর্যকে ডুবিয়ে ফেলে / আবার ঘুমোতে চেয়েছি আমি, / অন্ধকারের স্তনের ভিতর যোনির ভিতর / অনন্ত মৃত্যুর মতো মিশে / থাকতে চেয়েছি।’ (অন্ধকার)

পাশ্চাত্যের ইম্প্রেশনিস্ট চিত্রশিল্পীরা তাঁদের শিল্পকলায় বিশেষ প্রাধান্য দিয়েছিলেন ‘আলো’-কে। এই ধারার উল্লেখযোগ্য শিল্পী ছিলেন ক্লদ মনে, এডওয়ার্ড মানে (Manet), অগাস্ট রেনোয়া, পল সেজান প্রমুখ। ক্লদ মনে (Monet) -র আঁকা একটি বিখ্যাত ছবি ছিল ‘The Water lily Pond’ (পদ্মপুকুর)। দিনের বিভিন্ন সময়ে সূর্যের আলোর তারতম্যে পদ্মপুকুরের রূপ কীভাবে বদলে যাচ্ছে—তাই ছিল এ ছবির বিষয়। তাঁর অন্যতম বিখ্যাত ইম্প্রেশনিস্ট ছবি ‘Sunrise’ (সুর্যোদয়)। এডওয়ার্ড মানের বিখ্যাত ইম্প্রেশনিস্ট ছবি ছিল ‘এক পানশালা’ (A Bar at the Folies Berger)। জীবনানন্দের বেশ কিছু কবিতায় ইম্প্রেশনিস্ট চিত্রশিল্পের প্রভাব অনুভব করা যায়। যেমন—’বনলতা সেন’ কাব্যের ‘শিকার’, ‘ঘাস’, ‘সিন্ধু সারস’, ‘তোমাকে’, ‘আমাকে তুমি’ প্রভৃতি কবিতা।

‘আমাকে তুমি’ কবিতায় জীবনানন্দ দুপুরবেলার সূর্যের তীব্র আলোয় প্রকৃতির রূপ অবলোকন করে লিখেছেন— ‘দুপুরবেলার জনবিরল গভীর বাতাস / দূর শুন্যে চিলের পাটাকিলে ডানার ভিতর অস্পষ্ট হয়ে হারিয়ে যায়; / … / খররৌদ্রে পা ছাড়িয়ে বর্ষীয়সী রূপসীর মতো ধান ভানে – / … / এই দুপুরের বাতাস। ‘তোমাকে’ কবিতায় তিনি প্রকৃতির রূপ পর্যবেক্ষণ করেছেন দিনের বিভিন্ন প্রহরে – ‘একদিন মনে হ’তো জলের মতন তুমি। / সকালবেলার রোদে তোমার মুখের থেকে বিভা / অথবা দুপুরবেলা বিকেলের আসা আলোয়— / চেয়ে আছে—চ’লে যায়—জলের প্রতিভা । / … / নির্জন জলের রং তাকায়ে রয়েছে; / স্থানান্তরিত হ’য়ে দিবসের আলোর ভিতরে / নিজের মুখের ঠাণ্ডা জলরেখা নিয়ে / পুনরায় শ্যাম পরগাছা সৃষ্টি ক’রে; / … / এক পৃথিবীর আলো সব দিকে নিভে যায় ব’লে / রঙিন সাপকে তার বুকের ভিতরে টেনে নেয়; / অপরাহ্নে আকাশের রং ফিকে হ’লে।’ ‘ঘাস’ কবিতায় অবলোকন করেন—’কচি লেবুপাতার মতো নরম সবুজ আলোয়, / পৃথিবী ভরে গিয়েছে এই ভোরের বেলা;’ আবার দিনের বিভিন্ন প্রহরে সূর্যের আলোর তারতম্যে প্রকৃতির বিভিন্ন উপকরণের রূপ কীভাবে বদলে যাচ্ছে তা একজন প্রকৃত ইম্প্রেশনিস্ট চিত্রশিল্পীর মতোই পর্যবেক্ষণ করেছেন জীবনানন্দ ‘শিকার’ কবিতায়—’ভোর; / আকাশের রং ঘাসফড়িঙের দেহের কোমল নীল / চারিদিকে পেয়ারা ও নোনার গাছ টিয়ার পালকের মতো সবুজ।/ … / হিমের রাতে শরীর ‘উম্’ রাখবার জন্য দেশোয়ালীরা / সারারাত মাঠে আগুন জ্বেলেছে— / মোরগ ফুলের মতো লাল আগুন; / শুকনো অশ্বত্থপাতা দুমড়ে এখনও আগুন জ্বলছে তাদের; / সূর্যের আলোয় তার রং কুঙ্কুমের মতো নেই আর; / হ’য়ে গেছে রোগা শালিকের হৃদয়ের বিবর্ণ ইচ্ছার মতো।/ সকালের আলোয় টলমল শিশিরের চারিদিকের বন ও আকাশ ময়ুরের / সবুজ নীল ডানার মতো ঝিলমিল করছে।’ ‘সিন্ধু সারস’-এও তিনি দ্বিপ্রহরের আলোর তীব্রতায় দেখেছেন এবং এঁকেছেন সিন্ধুসারসের ছবি নিপুণ চিত্রশিল্পীর তুলির টানে—’রৌদ্রে ঝিলমিল করে সাদা ডানা ফেনা-শিশুদের পাশে / হোলিওট্রোপের মতো দুপুরের অসীম আকাশ । / ঝিক্‌মিক্‌ করে রৌদ্রে বরফের মতো শাদা ডানা, / … /

কলরব ক’রে উড়ে যায় / শত স্নিগ্ধ সূর্য ওরা শাশ্বত সূর্যের তীব্রতায়।’ এছাড়া ‘পাখির নীড়ের মতো চোখ…’ (পাখির নীড়ে যে গভীর শান্তির আশ্রয়, বনলতার চোখে সেই আশ্রয়ের আহ্বান), ‘চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা’ (কালগত ব্যবধানে সুদূর অতীতের বিদিশা নগরী আজ যেন অস্পষ্ট অন্ধকার, তার প্রাচুর্য যেমন কল্পনার বিষয়, বনলতার চুলের বর্ণ, গভীরতাও তাই); ‘মুখ তার শ্রাবন্তীর কারুকার্য’(বৌদ্ধ যুগ সেই যুগ, যে যুগের মূল ধর্মই ছিল শান্তি, মৈত্রী, ভালোবাসা; এই বৌদ্ধযুগেই শ্রাবস্তী নগরী শিল্প-সৌকর্যে চরমোৎকর্ষ লাভ করেছিল। তাই বনলতার মুখশ্রীকে শ্রাবস্তীর শিল্প-কলার সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে—যার মধ্যে শুধু অপরূপ সুষমা নয়, ভালোবাসা, শান্তিও নিহিত আছে।); ‘হাল ভেঙে যে নাবিক হারায়াছে দিশা / … দারুচিনি দ্বীপের ভিতর’ (দারুচিনি-র যে সৌরভ, মিষ্টত্ব আছে, বনলতার প্রেমেও আছে সেরকম মিষ্টত্ব, সুরভি); ‘কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবেসে’ (হৃদয়কে রক্তাক্ত, যন্ত্রণা দগ্ধ করে কেউ বিস্মৃত বেদনাকে পুনরজ্জীবিত করতে চায় না); ‘কড়ির মতন শাদা মুখ তার’ (রক্তশূন্য ফ্যাকাশে মৃত মুখ); ‘দেহ তার বিমর্ষ পাখির রঙে ভরা’ (যুদ্ধ ক্লিষ্ট অবক্ষয়িত অসুস্থ সময়ে ভেতরের গভীর গভীরতর অসুখে দেহ লাবণ্যহীন, বিবর্ণ, খসখসে); ‘নদীর জল মচকা ফুলের পাপড়ির মতো লাল’ (শিকারীর গুলিতে নিহত হরিণের চাপ চাপ রক্তে নদীর জল স্তরে স্তরে লাল) – অনুরূপ ইমেজ বা চিত্রকল্পের মুহুর্মুহু সাক্ষাৎ মেলে জীবনানন্দের কবিতাবলীতে।

আবার ফবিস্ট চিত্রশিল্পীদের মতো চড়া হলুদ রঙের বহুল ব্যবহারও জীবনানন্দের কবিতায় পাওয়া যায়। এছাড়াও যুদ্ধবিধ্বস্ত অসুস্থ বন্ধ্যা পৃথিবী এবং জীবনের নৈরাশ্য, অবক্ষয়িত মৃত রূপকে তুলে ধরতে তিনি অন্ধকার,ধূসর, বিমর্ষ, বিবর্ণ—এই চিত্রকল্পনাগুলি বারংবার ব্যবহার করেছেন।

এছাড়া ইংরেজ কবি কিটস্-এর মতো জীবনানন্দও ছিলেন অত্যন্ত Sensuous বা ইন্দ্রিয়ঘন কবি। এক ইন্দ্রিয় দিয়ে তিনি আরেক ইন্দ্রিয়ের অনুভব পেতেন। যেমন—ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল (বনলতা সেন); এই ঘাসের ঘ্রাণ হরিৎ মদের মতো / গেলাসে গেলাসে পান করি। (ঘাস); হলুদ পাতার গন্ধে ভরে ওঠে অবিচল শালিকের মন। (সিন্ধু সারস); পৃথিবীর নরম অঘ্রাণ (সিন্ধু সারস); শরীরে ঘুমের ঘ্রাণ আমাদের (হাজার বছর শুধু খেলা করে); দিগন্ত-প্লাবিত বলীয়ান রৌদ্রের আঘ্রাণে, (হাওয়ার রাত); রোগা শালিকের হৃদয়ে বিবর্ণ ইচ্ছার মতো। (শিকার)।

তাই ওপরের আলোচনার নিরিখে বলাই যায় যে কোনো একটি নয়, আধুনিক সবকটি চিন্তা এবং প্রকাশের সমন্বিত প্রকাশেই জীবনানন্দের কবিসত্তা এবং কবিতার সমগ্রতা।

গ্রন্থপঞ্জি :

  • ১) বনলতা সেন, জীবনানন্দ দাশ, সিগনেট প্রেস, কলকাতা, ১৯৫৪
  • ২) জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা, নাভানা; ১৯৫৪
  • ৩) জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা: (সম্পা.) অমিতানন্দ দাশ, নিউ স্ক্রিপ্ট, কলকাতা, ২০১০
  • ৪) আমার কালের কয়েকজন কবি, জগদীশ ভট্টাচার্য, ভারবি, কলকাতা, ১৯৯৫
  • ৫) সাহিত্যের রূপ-রীতি ও অন্যান্য প্রসঙ্গ, কুন্তল চট্টোপাধ্যায়, রত্নাবলী, কলকাতা, ২০০৭

লেখক পরিচিতি : অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়। প্রকাশিত গ্রন্থ : ১। লোকসংস্কৃতি বিচিত্রা ২। টুসুর কথা ৩। ঝাড়খণ্ডী বাংলার ঝাড়গাঁয়ী রূপ ৪। বাঙাল ৫। লোকভাষা-লোকসংস্কৃতি ও অবিভক্ত মেদিনীপুর—প্রভৃতি।

Post Views: 4,560
Tags: ‘বনলতা সেন’ : কবি ও কাব্যBanalata SenJibananda Dassurialismজীবনানন্দজীবনানন্দ দাশবনলতা সেন
ADVERTISEMENT

Related Posts

নজরুল ইসলামের উপন্যাসে মানবতাবাদ
সাহিত্য আলোচনা

নজরুল ইসলামের উপন্যাসে মানবতাবাদ

লিখেছেনঃ মুহাম্মাদ আব্দুল আলিম মহৎ ঔপন্যাসিক মাত্রই মানবতার পথপ্রদর্শক। সাহিত্য মানেই মানুষের কথা, তার জীবনযাপন, আনন্দ-বেদনা, প্রেম-সংঘর্ষ, বিশ্বাস-অবিশ্বাসের এক...

by মুহাম্মাদ আব্দুল আলিম
March 29, 2025
বনলতা সেন ও জীবনানন্দ দাশের নায়িকারা
সাহিত্য আলোচনা

বনলতা সেন ও জীবনানন্দ দাশের নায়িকারা

লিখেছেনঃ আহমদ রফিক শ-পাঁচেক বছর আগে চিত্রশিল্পের অন্যতম ‘গ্রেট মাস্টার’ লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির আঁকা আবক্ষ নারীপ্রতিকৃতি ‘মোনালিজা’কে নিয়ে ইতালি-প্যারিস...

by অতিথি লেখক
November 19, 2024
কাজি নজরুল ইসলাম ও আন্তর্জাতিকতা
সাহিত্য আলোচনা

কাজি নজরুল ইসলাম ও আন্তর্জাতিকতা

লিখেছেনঃ সুমিতা চক্রবর্তী কাজি নজরুল ইসলামকে অনেক ভাবেই আমরা চিনি। তিনি উৎপীড়িতের পক্ষে দাঁড়ানো একজন সাহিত্যিক; তিনি অসাম্প্রদায়িক মনের...

by অতিথি লেখক
November 5, 2024
জীবনানন্দ দাশের নারীপ্রেমঃ বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা
সাহিত্য আলোচনা

জীবনানন্দ দাশের নারীপ্রেমঃ বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা

লিখেছেনঃ বাসন্তীকুমার মুখখাপাধ্যায় জীবনানন্দ যেমন প্রকৃতির বেদনার আঘাতের ও হিংস্রতার দিকটি সম্বন্ধে সম্পূর্ণ সচেতন থেকেও প্রকৃতিলীন জীবনে আস্থা স্থাপন...

by নবজাগরণ
November 7, 2024

POPULAR POSTS

  • সুলতান মাহমুদ

    সুলতান মাহমুদের ভারত অভিযান ও সোমনাথ মন্দির প্রসঙ্গ (১ম পর্ব)

    181 shares
    Share 181 Tweet 0
  • বাউরী সম্প্রদায়ের উৎপত্তির ইতিহাস ও ঐতিহাসিক পর্যালোচনা

    0 shares
    Share 0 Tweet 0
  • আর্যদের ভারত আগমন, বিস্তার, সমাজ ও সভ্যতা: এক ঐতিহাসিক পর্যবেক্ষণ

    0 shares
    Share 0 Tweet 0
  • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে বৌদি কাদম্বরী দেবীর সম্পর্ক আদৌ কি প্রেমের ছিল?

    0 shares
    Share 0 Tweet 0
  • হিন্দু পদবীর উৎপত্তির ইতিহাস, বিবর্তন ও ক্রমবিকাশঃ বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা

    0 shares
    Share 0 Tweet 0

Facebook Page

নবজাগরণ

ADVERTISEMENT
নবজাগরণ

'Nobojagaran' is a website of its kind where you can gather knowledge on all the unknown facts of the world. We human beings always have a thirst for knowledge. Nobojagaran takes its first steps to quench this thirst of ours. We are now in the era of digital world, where we get almost anything online. So how about a bit of knowlyfrom online?

Connect With Us

No Result
View All Result

Categories

  • English (9)
  • অন্যান্য (11)
  • ইসলাম (26)
  • ইসলামিক ইতিহাস (22)
  • ইহুদী (1)
  • কবিতা (37)
  • খ্রিস্টান (6)
  • ছোটগল্প (6)
  • নাস্তিকতা (18)
  • বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি (24)
  • বিশ্ব ইতিহাস (24)
  • ভারতবর্ষের ইতিহাস (195)
  • রাজনীতি (38)
  • সাহিত্য আলোচনা (68)
  • সিনেমা (17)
  • হিন্দু (16)

Pages

  • Cart
  • Checkout
  • Checkout
    • Confirmation
    • Order History
    • Receipt
    • Transaction Failed
  • Contact
  • Donation to Nobojagaran
  • Homepage
  • Order Confirmation
  • Order Failed
  • Privacy Policy
  • Purchases
  • Services
  • লেখা পাঠানোর নিয়ম
  • হোম
No Result
View All Result
  • মূলপাতা
  • ইতিহাস
    • ইসলামিক ইতিহাস
    • ভারতবর্ষের ইতিহাস
    • বিশ্ব ইতিহাস
  • বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
  • ধর্ম
    • ইসলাম
    • খ্রিস্টান
    • হিন্দু
    • ইহুদী
    • অন্যান্য ধর্ম
  • নাস্তিকতা
  • রাজনীতি
  • সিনেমা
  • সাহিত্য
    • কবিতা
    • ছোটগল্প
    • উপন্যাস
    • সাহিত্য আলোচনা
  • অন্যান্য
  • ই-ম্যাগাজিন
    • নবজাগরণ (ষাণ্মাসিক) – জীবনানন্দ ১২৫ তম জন্ম সংখ্যা – মননশীল সাহিত্য পত্রিকা
  • Others Language
    • English
    • Urdu
    • Hindi

©Nobojagaran 2020 | Designed & Developed with ❤️ by Adozeal

Login to your account below

Forgotten Password?

Fill the forms bellow to register

All fields are required. Log In

Retrieve your password

Please enter your username or email address to reset your password.

Log In
Don't have an account yet? Register Now
1
Powered by Joinchat
Hi, how can I help you?
Open chat
wpDiscuz
0
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x
| Reply