ভারতের স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়েছিল ১৭৫৭-র ২৩ জুন, পলাশির প্রান্তরে। রবার্ট ক্লাইভ দু’দিন ধরে সৈন্য নিয়ে অবস্থান করলেন পলাশিতে। তারপর দু’শ ইংরেজ ও পাঁচশ দেশীয় সৈন্য নিয়ে বিজয়ীর বেশে প্রবেশ করলেন মুর্শিদাবাদে। মুর্শিদাবাদের অধিবাসীরা নীরবে দাঁড়িয়ে ইতিহাসের এই মােড় পরিবর্তনের ঘটনার সাক্ষী হল। ক্লাইভ নিজেই স্বীকার করেছেন,
“ইচ্ছা করলে মুর্শিদাবাদের জনতা শুধু লাঠি আর পাথর মেরে এই বিজেতাদেরকে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে পারত। লােকেরা নাকি বলাবলিও করছে যে, কোনও অস্ত্র ছাড়া শুধু ইট পাটকেল মেরেই মুর্শিদাবাদের লােকেরা ইংরেজদের ধরাশায়ী করতে পারত।”১
পলাশির বিপর্যয়ের পর বাংলার প্রধান শিল্পনগরী ঢাকা ও মুর্শিদাবাদে দ্রুত ঘনিয়ে এসেছিল অন্ধকার। এসব শহরের জনসংখ্যা কমছিল দ্রুত, আর অন্য দিকে তখন কলকাতায় বইছিল সমৃদ্ধির জোয়ার। লুটেরা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্য, আর তাদের লুণ্ঠনবৃত্তির জুনিয়র পার্টনার এদেশীয় দেওয়ান-বেনিয়ান-গােমস্তাদের উদ্যোগে তখন সুতানুটি-গােবিন্দপুরকলকাতা-চিৎপুর-বিরজি-চক্রবেড়ি গ্রামগুলির ধানক্ষেত ও কলাবাগানের ভিতর থেকে দ্রুত বেড়ে উঠেছিল টাউন কলকাতা। কলকাতার এই উত্থান সম্পর্কে নারায়ণ দত্ত লিখেছেন,
“জন্মের সেই পরমলগ্নেই কলকাতার অস্বাস্থ্যকর জলাভূমির মানুষ এক অসুস্থ খেলায় মেতেছিল। তাতে স্বার্থবুদ্ধিই একমাত্র বুদ্ধি, দুর্নীতিই একমাত্র নীতি, ষড়যন্ত্রে চাপা ফিসফিসানিই একমাত্র আলাপের ভাষা।”২
কিন্তু কাদের নিয়ে জাগল এই কলকাতা? এরা কারা? আবদুল মওদুদ লিখেছেন,
“আঠারাে শতকের মধ্যভাগে কলকাতা ছিল নিঃসন্দেহে বেনিয়ানের শহর—যত দালাল, মুৎসুদ্দি, বেনিয়ান ও দেওয়ান ইংরেজদের বাণিজ্যিক কাজকর্মের মধ্যবর্তীর দল। এই শ্রেণীর লােকেরাই কলকাতাতে সংগঠিত হয়েছিল ইংরেজের অনুগ্রহপুষ্ট ও বশংবদ মধ্যবিত্ত শ্রেণী হিসেবে।”৩
বিনয় ঘােষ দেখিয়েছেন, কলকাতা শহর গড়ে উঠেছিল নাবিক, সৈনিক ও লােফার—এই তিন শ্রেণির ইংরেজের হাতে। তাদের দেওয়ান, বেনিয়ান ও দালালরূপে এদেশীয় একটি নতুন শ্রেণি রাতারাতি কাড়িকাড়ি টাকার মালিক হয়ে ইংরেজদের জুনিয়ার পার্টনার রূপে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ‘টাউন কলকাতার কড়চা’ বইতে বিনয় ঘােষ লিখেছেন, “..ইংরেজ আমলের গােড়ার দিকে, আঠারাে শতকের মধ্যে কলকাতা শহরে যে সমস্ত কৃতি ব্যক্তি তাদের পরিবারের আভিজাত্যের ভিত প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তারা অধিকাংশই তার রসদ (টাকা) সংগ্রহ করেছিলেন বড় বড় ইংরেজ রাজপুরুষ ও ব্যবসায়ীদের দেওয়ানী করে।…তারা যে বিপুল বিত্ত সঞ্চয় করেছিলেন, তা-ই পরবর্তী বংশধরদের বংশ পরম্পরায় আভিজাত্যের খােরাকযুগিয়ে এসেছে…। বেনিয়ানরা…ছিলেন বিদেশী ব্যবসায়ীদের প্রধান পরামর্শদাতা।…আঠারাে শতকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী ও তাদের কোনও কর্মচারীরা এদেশে যখন ব্যবসা-বাণিজ্য করতে আরম্ভ করেন, তখন দেশ ও দেশের মানুষ সম্বন্ধে তাদের কোনও ধারণাই ছিল না বলা চলে। সেই জন্য তাদের ব্যবসায়ের মূলধন নিয়ােগ থেকে আরম্ভ করে পণ্যদ্রব্যের সরবরাহ প্রায় সমস্ত ব্যাপারেই পদে পদে যাদের ওপর নির্ভর করতে হত তারাই হলেন বেনিয়ান। এই বাঙালি বেনিয়ানই প্রথম যুগের ইংরেজ ব্যবসায়ীদের দোভাষী ছিলেন, বাণিজ্য প্রতিনিধি ছিলেন, হিসেব রক্ষক ছিলেন, এমনকি তাদের মহাজনও ছিলেন বলা চলে।”৪
এই শ্রেণির লােকেরাই বাংলার স্বাধীনতা ইংরেজদের হাতে তুলে দেওয়ার সকল আয়ােজন সম্পন্ন করেছিল। ব্যক্তি স্বার্থে এরাই স্বাধীনতার পরিবর্তে পরাধীনতাকে স্বাগত জানিয়েছিল। এ ব্যাপারটাকে খােলামেলাভাবে তুলে ধরে এম. এন. রায় তার ‘India in Transition’ গ্রন্থে, ‘It is historical fact that a large section of Hindu community welcomed the advent of the English Power.’ আর রমেশচন্দ্র মজুমদার লিখেছেন, ‘British could winover political authority without any opposition from the Hindus.’৫
এদেরই অন্যতম ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় ইংরেজদের সাথে সিরাজউদৌল্লার পলাশির লড়াইকে অভিহিত করেছেন ‘দেবাসুর সংগ্রাম’ নামে। হিন্দু শাস্ত্রগ্রন্থসমূহে ‘দেবাসুর’ একটি বহুল ব্যবহৃত শব্দ। প্রাচীনকালে আমাদের পূর্বপুরুষ বঙ্গ-দ্রাবিড়গণ হানাদার আর্যদের আগ্রাসন দীর্ঘদিন রুখে দিতে সমর্থ হয়েছিল। বঙ্গ-দ্রাবিড়দের প্রতিরােধের মুখে বারবার পর্যদস্ত হয়েই আর্যরা এ এলাকার দ্রাবিড় জনগােষ্ঠীকে ‘অসুর’ নামে অভিহিত করেছিল। আর্যরা ‘দেবতা’ আর দ্রাবিড়রা ‘অসুর’। এই ‘অসুর’ পরিচয়েই আমাদের প্রাচীন পূর্বপুরুষগণ দীর্ঘদিন আমাদের কাছে পরিচিত হয়েছেন। সেই ঐতিহ্যের সূত্র ধরেই ভবানীচরণ বাংলার নতুন যুগের প্রতিরােধ সংগ্রামের বীর নায়ক নবাব সিরাজউদৌল্লাকে ‘অসুর’ আখ্যায়িত করেছেন। তাদের চোখে পলাশির ‘দেবতা’ হলাে ইংরেজরা।
ভবানীচরণ সিরাজকে ‘অসুর’ আর ইংরেজকে ‘দেবতা’ বলেই থেমে যাননি। মুখের কথার সাথে বাস্তব কাজের নমুনাও পেশ করেছেন। পলাশী যুদ্ধের ক’দিন পরই তারা পলাশীর ‘দেবাসুর সংগ্রাম’কে উপজীব্য করে বাংলায় শারদীয় দুর্গাপূজা প্রথম চালু করেন। এর আগে বাংলাদেশে শারদীয় দুর্গাপূজার প্রচলন ছিল না। শ্রী রাধারমন রায় কলকাতার ‘দুর্গোৎসব’ নামক এক প্রবন্ধে লিখেছেন, দুর্গাপূজা ‘পলাশী যুদ্ধের বিজয়ােৎসব’ হিসেবেই ১৭৫৭ সালে প্রথম অনুষ্ঠিত হয় নদিয়া ও কলকাতায়। এই উৎসবের আসল উদ্দেশ্য ছিল ‘পলাশী বিজয়ী লর্ড ক্লাইভের সম্বর্ধনা’। রাধারমন রায় লিখেছেন,
“১৭৫৭ সালের ২৩ জুন তারিখে পলাশীর রণাঙ্গনে মীরজাফরের বেইমানির দরুণ ইংরেজ সেনাপতি ক্লাইভের হাতে নবাব সিরাজউদৌল্লার পরাজয় ঘটলে সবচেয়ে যাঁরা উল্লসিত হয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন নদীয়ার কৃষ্ণচন্দ্র আর কলকাতার নবকৃষ্ণ। কোম্পানীর জয়কে তারা হিন্দুদের জয় বলে মনে করলেন। ধূর্ত ক্লাইভও তাদের সেইরকমই বােঝালেন। ক্লাইভের পরামর্শেই তারা পলাশীর যুদ্ধের বিজয় উৎসব করার আয়ােজন করলেন। বসন্তকালীন দুর্গাপূজাকে তারা পেছিয়ে আনলেন শরৎকালে—১৭৫৭ সালেই তারা বহু টাকা খরচ করে শরৎকালীন দুর্গাপুজার মাধ্যমে পলাশীর যুদ্ধের বিজয় উৎসব পালন করলেন। এরপর ফি-বছর শরৎকালে দুর্গাপূজা করে তারা পলাশীর যুদ্ধের স্মারক উৎসব পালন করেছেন আর অন্যান্য হিন্দু জমিদার বা ব্যবসায়ীদেরও তা পালন করতে উৎসাহিত করেছেন।…শােনা যায়, শরৎকালীন দুর্গাপূজা যে বছর প্রবর্তিত হয়েছিল, সেই ১৭৫৭ সালেই কৃষ্ণচন্দ্র এবং নবকৃষ্ণ দু’জনেই লক্ষাধিক টাকা খরচা করেছিলেন।… আগে এদেশে বসন্তকালে চালু ছিল দুর্গাপূজা আর শরৎকালে চালু ছিল নবপত্রিকা পূজো। দুর্গাপূজার সঙ্গে জড়িয়ে ছিল মূর্তির ব্যপার, আর নবপত্রিকা পূজার সঙ্গে জড়িয়ে ছিল ন’টি উদ্ভিদের ব্যাপার। পরে এই দুটি ব্যাপারকে গুলিয়ে একাকার করে ফেলা হয়েছে। ১৭৫৭ সাল থেকে নবপত্রিকা হয়েছেন দুর্গা। তাই শরৎকালে দুর্গাপূজার বােধনের দরকার হয়। আর আগে নবপত্রিকা পূজা করে পরে দুর্গাপূজা করতে হয়।…তাহলে দাঁড়াল এই ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধের বিজয়ােৎসব পালন করার জন্যে বসন্তকালের দুর্গাপূজাকে শরৎকালে নিয়ে এসে নবপত্রিকা পূজার সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছিল। এই কাজ করেছিলেন নদীয়ার কৃষ্ণচন্দ্র এবং কলকাতার নবকৃষ্ণ। আর তাদের উৎসাহিত করেছিলেন ক্লাইভ। ক্লাইভ যে উৎসাহিত করেছিলেন তার প্রমাণ হচ্ছে নবকৃষ্ণের বাড়িতে পূজা অনুষ্ঠানে ক্লাইভের সপারিষদ উপস্থিতি। …নবকৃষ্ণের পুরনাে বাড়ির ঠাকুর দালানটি তৈরি হয়েছিল ১৭৫৭ সালে। খুবই তড়িঘড়ি করে এটি তৈরি করা হয়েছিল। …দুর্গাপূজার চাইতেও ক্লাইভকে তুষ্ট করা ছিল নবকৃষ্ণের কাছে বড় কাজ। …তিনি ভাল করেই জানতেন, সাচ্চা সাহেব ক্লাইভ ধর্মে খ্রীষ্টান, মনে মনে মূর্তিপূজার ঘাের বিরােধী। অতএব স্রেফ দুর্গা ঠাকুর দেখিয়ে ক্লাইভের মন ভরানাে যাবে না, এটা তিনি বুঝেছিলেন। তাই তিনি ক্লাইভের জন্য বাঈজি নাচের, মদ-মাংসের ব্যবস্থা করেছিলেন। তাই একই সময়ে একই উঠোনের একপ্রান্তে তৈরি করেছিলেন ঠাকুর দালান, আর এক প্রান্তে তৈরি করেছিলেন নাচ-ঘর।…নবকৃষ্ণের কাছে দুর্গাঠাকুর ছিলেন উপলক্ষ, ক্লাইভ ঠাকুরই ছিলেন আসল লক্ষ। দুর্গাপুজার নামে তিনি ক্লাইভ পূজা করতে চেয়েছিলেন। কলকাতায় শরৎকালীন দুর্গোৎসব প্রবর্তনের সময় নবকৃষ্ণ সাহেব পূজার যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন, তা পরে উল্লেখযােগ্য হয়ে ওঠে কলকাতার বাবুদের মধ্যে দুর্গাপূজা উপলক্ষ সাহেব পূজা নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা আরম্ভ হওয়ায়।”৬
বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদৌল্লার পরাজয়ে এই উৎসব কেন? এ বিজয় কার বিজয়? তার জবাব ভবানীচরণের জবানীতেই পাওয়া যায়। তার ভাষায়, পলাশির লড়াইয়ের ফলে উঠে এসেছে ‘হর্ষের অমৃত’ আর ‘বিষাদের হলাহল’। হর্ষের অমৃত পান করে কলকাতা হয়েছে ‘নিরুপমা ও সর্বদেশখ্যাতা’। কিন্তু ‘বিষাদের হলাহল’ কাদের ভাগ্যে জুটল সেকথা কিছুই বলেননি ভবানীচরণ। দেবাসুর সংগ্রামে ‘বিষাদের হলাহল’ গিলতে হয়েছিল মুর্শিদাবাদ আর ঢাকা শহরকে। ভবানীচরণ লিখেছেন,
“ধার্মিক, ধর্মাবতার, ধর্ম প্রবর্তক, দুষ্ট নিবারক, সৎ প্রজাপালক, সদ্বিবেচক ইংরেজ কোম্পানী বাহাদুর এই দেশের লােকদের ‘অধিক ধনী হওয়ার অনেক পন্থা’ সৃষ্টি করে দিয়েছিলেন। ইংরেজ তাই দেবতা। ক্লাইভ ‘মা দুর্গার প্রতীক’। এই দেবতার পুজা করেই পলাশী-উত্তর কলকাতাকে কেন্দ্র করে রাতারাতি একটি লুটেরা শ্রেণী রাজা-মহারাজায় পরিণত হয়েছিল।”
কলকাতার নাগরিক সমাজে যে নয়া জমিদার ব্যবসায়ীদের অভিজাতগােষ্ঠী বিলাস-ব্যসনে, আমােদ-ফুর্তিতে খ্যাতিলাভ করেন, ১৮৩৯ সালের সরকারি কাগজপত্রে তাদের নাম-পরিবারের একটি তালিকা পাওয়া যায়। এতে ৮৪টি পরিবারের প্রায় ১০০ জন উনিশ শতকের প্রথম ভাগে কলকাতা শহরে স্বনামধন্য ছিলেন।৭ এই পরিবারগুলি শহর কলকাতার প্রাতঃকালীন গাত্রোত্থানের সাথে যুক্ত। তাদের কয়েকজন হলেন,
- ১) মীরজাফরের নবাবী আমলে ক্লাইভের দেওয়ান নবকৃষ্ণের পুত্র মহারাজা রামকৃষ্ণ বাহাদুর,
- ২) নবকৃষ্ণের ভাতিজা বাবু গােপীমােহন দেব,
- ৩) ক্লাইভের বেনিয়ান লক্ষ্মীকান্ত ধরের উত্তরপুরুষ রাজা রামচন্দ্র রায়,
- ৪) ইস্ট কোম্পানীর লুণ্ঠন-বৃত্তির সহযােগী মল্লিক পরিবার,
- ৫) ওয়ারেন হেস্টিংস-এর রাজস্ব বাের্ডের দেওয়ান গঙ্গাগােবিন্দের নাতি বাবু শ্ৰীনারায়ণ সিংহ,
- ৬) গভর্ণর ভান্সিটার্ট ও জেনারেল স্মিথের দেওয়ান রামচরণ রায়ের উত্তরপুরুয আন্দুলের রায় বংশ,
- (৭) ভেরেলস্ট সাহেবের দেওয়ান ও পরে সন্দীপের জমিদার গােকুলচন্দ্র ঘােষালের প্রতিষ্ঠিত খিদিরপুরের গােকুল পরিবার,
- ৮) হুইলার সাহেবের দেওয়ান দর্পনারায়ণ ঠাকুরের প্রতিষ্ঠিত ঠাকুর পরিবার,
- ৯) ঠাকুর পরিবারের ‘জুনিয়ার ব্রাঞ্চ বা নবীন শাখা’ নামে পরিচিতি এবং কোম্পানী সরকারের এজেন্ট, পরে ২৪ পরগণার কালেক্টর ও নিমক এজেন্টের সেরেস্তাদার থেকে নিমক মহলের দেওয়ান ও স্বল্পকালীন কাস্টমস-সল্ট ওপিয়াম বাের্ডের দেওয়ান দ্বারকানাথ ঠাকুরের (জন্ম ১৭৯৪) পরিবার। কার ট্যাগাের অ্যাণ্ড কোম্পানীর প্রতিষ্ঠাতা দ্বারকানাথের প্রভাব প্রতিপত্তির কোনও প্রতিদ্বন্দ্বী তার সমসাময়িককালে ছিল না। দ্বারকানাথ ঠাকুরের পুত্র দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, আর তারই কনিষ্ঠ পুত্র ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
- ১০) সুতানুটি বাজারের প্রতিষ্ঠাতা শেঠ পরিবার,
- ১১) মেসার্স ফেয়ারলী অ্যান্ড কাং-এর দেওয়ান রামদুলাল দে,
- ১২) ভুলুয়া (নােয়াখালি) ও চট্টগ্রামের নিমক মহলের এজেন্ট হ্যারিস সাহেবের দেওয়ান রামহরি বিধাস,
- ১৩) পাটনার চীফ মি মিডলটন ও স্যার টমাস রামবােল্ড সাহেবের দেওয়ান শান্তিরাম সিংহের প্রতিষ্ঠিত জোড়াসাঁকোর সিংহ পরিবার,
- ১৪) কোম্পানী আমলের কলকাতার দেওয়ান গােবিন্দরামের পরিবার,
- ১৫) কুমারটুলির মিত্র পরিবার,
- ১৬) কোম্পানীর ঠিকাদার গােকুল মিত্রের পরিবার,
- ১৭) পামার কোম্পানীর সরকার গঙ্গা নারায়ণ,
- ১৮) পাল-চৌধুরীর পরিবার,
- ১৯) কুলীন ব্রাহ্মণ ব্যানার্জী পরিবার,
- ২০) ওয়ারেন হেস্টিংস-এর সরকার রামলােচনের প্রতিষ্ঠিত পাথুরিয়াঘাটার ঘােষ পরিবার,
- ২১) ক্লাইভের দেওয়ান কাশিনাথের পরিবার,
- ২২) কোম্পানীর হুগলীর দেওয়ান শ্যামবাজারের বসু পরিবার,
- ২৩) কোম্পানী সৈন্যদের রসদ সরবরাহের ঠিকাদার ও কয়েকজন ইউরােপীয় ব্যবসায়ীর বেনিয়ান এবং মেসার্স মুর হিকি অ্যান্ড কোম্পানীর প্রতিষ্ঠাতা মতিলাল শীলের প্রতিষ্ঠিত কলুটোলার শীল পরিবার,
- ২৪) এককালের লবণের গােলার মুহুরী বিধানাথ মতিলালের পরিবার,
- ২৫) ঠনঠনিয়ার ঘােষ পরিবার,
- ২৬) মেসার্স ভেভিডসন অ্যান্ড কোম্পানীর এককালের কেরানী রসময় দত্তের প্রতিষ্ঠিত রামবাগানের দত্ত পরিবার,
- ২৭) পাটনার কমার্শিয়াল রেসিডেন্সের দেওয়ান বনমালি সরকারের প্রতিষ্ঠিত কুমারটুলির সরকার পরিবার,
- ২৮) আফিমের এজেন্ট হ্যারিসনের দেওয়ান দুর্গাচরণ মুখার্জীর প্রতিষ্ঠিত বাগবাজারের মুখার্জী পরিবার,
- ২৯) বেনিয়ান রামচন্দ্র মিত্রের পরিবার,
- ৩০) বিভিন্ন বিলাতী কোম্পানীর সাথে যুক্ত গঙ্গাধর মিত্রের প্রতিষ্ঠিত নিমতলার মিত্র পরিবার।৮
এই চতুর ব্যবসায়ীদের মধ্যে কয়েকজনের উত্থানের ইতিহাস সংক্ষেপে পর্যালােচনা করলে ব্রিটিশ-সাম্রাজ্যবাদের উপরে এঁদের নির্ভরশীলতা উপলব্ধি করা যাবে। কলকাতা শহরের নব্য অভিজাতশ্রেণির প্রতিষ্ঠাতা যাঁরা, বংশ-পরিচয়ের কিংবা ধনকৌলিন্যের দিক থেকে তারা একসময়ে অজ্ঞাতকুলশীল ও দরিদ্র ছিলেন বললে অত্যুক্তি হয় না। শােভাবাজারের রাজপরিবার, পােস্তার রাজপরিবার, জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবার, সিমলার দে সরকার পরিবার, পাইকপাড়ার সিংহ পরিবার, ঝামাপুকুরের মিত্র লাহা পরিবার, খিদিরপুরের ভূকৈলাসের ঘােষাল পরিবার, হাটখােলার ও রামবাগানের দত্ত পরিবার, বড়বাজারের মল্লিক বংশ প্রভৃতি কলকাতার উচ্চশ্রেণির পরিবার-প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে অধিকাংশই প্রায় অখ্যাত ও অজ্ঞাত। এঁরা এবং এঁদের বংশধররা প্রায় সকলেই ইংরেজদের অধীনে চাকরি করে ও সাহেবদের ঋণ দিয়ে কোম্পানির কাগজ ও অন্যান্য দ্রব্য কেনা-বেচা করে প্রচুর অর্থ উপার্জন করেছেন এবং কোম্পানির অনুগ্রহে গ্রামের জমিদারি ও শহরের ভূসম্পত্তি কিনে কলকাতা শহরের রাজা-মহারাজা অথবা ধনী জমিদাররূপে প্রতিষ্ঠালাভ করেছেন। ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘নববাবুবিলাস ১৮২২-২৩’ গ্রন্থে লিখেছেন,
“ইংরাজ কোম্পানি বাহাদুর অধিক ধনী হওনের অনেক পন্থা করিয়াছেন এই কলিকাতা নামক মহানগর আধুনিক কাল্পনিক বাবুদিগের পিতা কিম্বা জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা আসিয়া স্বর্ণকার বর্ণকার কর্মকার চর্মকার চটকার পটকার মঠকার বেতনােভুক হইয়া কিম্বা রাজের সাজের কাঠের ঘাটের খাটের মঠের ইটের সরদারি চৌকিদারী জুয়াচুরি পােদ্দারি করিয়া…কিঞ্চিৎ অর্থসঙ্গতি করিয়া কোম্পানির কাগজ কিম্বা জমিদারি ক্রয়াধীন বহুতর দিবসাবসানে অধিকতর ধনাঢ্য হইয়াছেন ইহারা অখণ্ড দোর্দণ্ড প্রতাপান্বিত…।”
ইংরেজ কোম্পানির ‘অধিক ধনী হওনের অনেক পন্থা’ অবলম্বন করে কলকাতা শহরে যাঁরা অধিকতর ‘ধনাঢ্য’ হয়েছিলেন, নাগরিক সমাজে তখন তারাই ছিলেন অখণ্ড দোর্দণ্ড প্রতাপান্বিত। তারাই হলেন আমাদের বাংলার স্বনামধন্যদের আদিপুরুষ আধুনিক যুগের প্রথম ‘সিলেব্রিটির’ দল।
রাজা রামমােহন জন ডিগবীর দেওয়ান রূপে অর্থোপার্জন করেছেন, তেজারতির কারবারে কোম্পানির কর্মচারীদের চড়া সুদে ঋণ দিয়েছেন, যেমন আরাে দশজন ধনী ‘বাবু’ কলকাতায় বসে লগ্নি-কারবার করতেন, বিলিতি হুণ্ডি ও কোম্পানির কাগজের কেনাবেচা করেছেন এবং এভাবে উপার্জিত অর্থের দ্বারা ক্রমান্বয়ে তিনি বিভিন্ন অঞ্চলের বড় বড় তালুক কিনে কলকাতার সমাজে বড় জমিদার-রূপে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।৯
কলকাতার ঠাকুরবাড়িও এই ইতিহাসের ব্যতিক্রম নন। দশসালা বন্দোবস্তের পূর্বে তারা ভূস্বামীশ্রেণির অন্তর্ভূক্ত ছিলেন না। দ্বারকানাথের প্রপিতামহ দরিদ্র জয়রাম ‘ফোর্ট উইলিয়ম’ নির্মাণের সঙ্গে যুক্ত থেকে বিত্তশালী হয়েছেন এবং জয়রামের পুত্র নীলমণি উড়িষ্যার কালেক্টরের সেরেস্তাদারি করে আরাে সম্পদশালী হয়ে উঠেছেন ও কলকাতায় ভূসম্পত্তি ক্রয় করেছেন। নীলমণির নাতি দ্বারকানাথ পিতামহ-প্রপিতামহের পথ অনুসরণ করেছেন এবং বিভিন্নভাবে প্রভূত অর্থোপার্জনের দ্বারা বাংলা ও উড়িষ্যার বড় বড় জমিদারি ক্রয় করে প্রিন্স-রূপে পরিচিত হয়েছেন। তিনি জমিদারদের ল-এজেন্ট রূপে কাজ করার সঙ্গে সঙ্গে ব্যবসায়ে দালালির কাজ করেছেন ইউরােপের ব্যবসায়ীদের অর্ডার অনুযায়ী নীল এবং সিল্ক কিনে তিনি সেদেশে চালান দিয়েছেন।১০ দ্বারকানাথ চব্বিশ পরগণার কালেক্টর এবং সল্ট-এজেন্ট উডেনের দেওয়ান রূপে ছয় বছর (১৮২৩-২৯ খ্রঃ) কাজ করেছেন এবং তারপরে কাস্টমস্, ‘সল্ট অ্যাণ্ড ওপিয়ম্ বাের্ড’-এর পাঁচ বছর (১৯২৯-৩৪ খ্রীঃ) দেওয়ান ছিলেন।
ঠাকুর পরিবারের আর একজন প্রতিষ্ঠাতা দর্পনারায়ণ ঠাকুর (জয়রামের পুত্র) প্রথমে চন্দননগরের ফরাসীদের কাছে চাকরি করেছেন এবং পরে তিনি সুপ্রীম কাউন্সিলের সদস্য এডওয়ার্ড হুইলারের দেওয়ানি করে যে ধনােপার্জন করেছিলেন, তা দিয়ে তিনি ১৭৯০ সালে নাটোরের রাজার রংপুরের একটি বৃহৎ পরগণা কিনেছিলেন যার বার্ষিক সদর জমা ছিল ৬০,০০০ সিক্কা টাকা। দর্পনারায়ণের পুত্র গােপীমােহন ঠাকুর রাজশাহী, নদীয়া ও যশােহরের রাজাদের কাছ থেকে ১,১১,৬০০ সিক্কা টাকায় জমিদারি কিনেছিলেন। পিতৃসম্পত্তি ছাড়া তার ক্রীত জমিদারির বার্ষিক জমা ছিল ৮৬,৪০৫ সিক্কা টাকা। তাছাড়া তিনি আত্মীয় ও ভৃত্যদের নামে কত জমি কিনেছিলেন তা সঠিকভাবে জানা যায় না। তবে ১৮১৮ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর ‘সমাচার দর্পণ পত্রিকার সংবাদে জানা যায় যে, মৃত্যুকালে তার জমিদারি ও অন্যান্য সম্পত্তির মূল্য ছিল আশি লক্ষ টাকা।১১ নিঃস্ব মতিলাল শীল প্রাথমিক জীবনে প্রয়ােজনীয় দ্রব্যাদি সরবরাহ করে যে অর্থ উপার্জন করেছিলেন, তা দিয়ে তিনি একদিকে যেমন কলকাতার ইউরােপীয় বণিকদের সঙ্গে শিশি-বােতল-কৰ্ক ব্যবসা করেছেন, অন্যদিকে তেমনি কুড়িটি ব্রিটিশ কোম্পানির বেনিয়ান ছিলেন। এই পেশা ছাড়া তিনি জমির দালালি করেও প্রচুর সম্পত্তির মালিক হয়েছিলেন। তাঁর বার্ষিক আয় ছিল তিন লক্ষ ষাট হাজার টাকা। তাছাড়া কান্দি ও পাইকপাড়ার রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা রাধাকান্ত সিংহনবাব সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে চক্রান্তে লিপ্ত হয়ে ব্রিটিশ কোম্পানিকে সরাসরি দলিলপত্র দিয়ে সাহায্য করার জন্য তাকে পুরস্কৃত করা হয়। এই বংশের আর এক প্রতিষ্ঠাতা গঙ্গাগােবিন্দ সিংহ ওয়ারেন হেস্টিংসের গুপ্তচর হিসেবে কাজ করতেন। পরিবর্তে বীরভূমের আমিন, কলকাতার বাের্ড অফ রেভিনিউ-এর দেওয়ান এবং দিনাজপুরের নাবালক রাজার অভিভাবক পদে নিযুক্ত হয়েছিলেন। তার পুত্র প্রাণকৃষ্ণ সিংহকে হেস্টিংস কলকাতার দেওয়ান পদে নিযুক্ত করেছিলেন। পরে তিনি বিশাল জমিদারির মালিক হয়েছিলেন। তার বার্ষিক জমা ছিল চার লক্ষ পঁচাত্তর হাজার চারশ তের সিক্কা টাকা।১২
কাশিম বাজারের রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা কান্তবাবু প্রথম জীবনে এক মুদির দোকানে ও পরে ইংরেজ কুঠিতে মুহুরীর কাজ করতেন। হেস্টিংসকে নানাভাবে সাহায্য করার পুরস্কার স্বরূপ ১৭৭৩ সালে হেস্টিংস গভর্নর হলে তিনি বহু জমিদারি উপহার পান এবং নাটোরের রাজার জমিদারির কিছু অংশ আত্মসাৎ করেন। হেস্টিংসের দাক্ষিণ্যে কান্তবাবুর পুত্র লােকনাথ নন্দী ‘রাজা’ হন। পােস্তার রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা লক্ষ্মীকান্ত ধর প্রথম মারাঠা যুদ্ধের সময়ে কোম্পানিকে সাহায্য করেন, বিনিময়ে কোম্পানি তাঁর দৌহিত্র সুখময় রায়কে মহারাজা উপাধিতে ভূষিত করেন। এই মহারাজা সুখময় কলকাতা হাইকোর্টের প্রথম প্রধান বিচারপতি ইলাইজা ইম্পের দেওয়ানি করেছেন।
তেলেনিপাড়ার ব্যানার্জি পরিবার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনের পরে জমিদার রূপে প্রতিষ্ঠিত হন। নড়াইলের রাজপরিবারের প্রতিষ্ঠাতা কালীশংকর রায় প্রথম জীবনে ছিলেন লাঠিয়াল এবং সেই সূত্রে তিনি মাত্র কয়েকবিঘা জমির মালিক ছিলেন। পরবর্তীকালে রাজশাহীর নাটোর-রাজের দেওয়ান রূপে তিনি বিভিন্ন অঞ্চলে জমি কিনে জমিদার হন। দিনাজপুরের মাণিক পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা মাণিকচাঁদ ছিলেন রংপুরের কালেক্টর জন এলিয়টের দেওয়ান। তাঁর পৌত্র ফুলচাঁদ সহকারি দেওয়ান পদে নিযুক্ত হন। কিছুদিন পরে এলিয়ট মাণিকচাঁদকে দিনাজপুরের রাজার দেওয়ান পদে এবং ফুলচঁাদকে নিজের দেওয়ান পদে নিয়ােগ করেন। এইভাবে তারা এলিয়টের দ্বারা পৃষ্ঠপােষিত হয়ে সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহার করে দিনাজপুরের রাজার জমিদারির একটা বড় অংশ কিনে নিয়েছিলেন।
কৃষ্ণচরণ দত্ত ও তার ভাইপাে অভয়চরণ দত্ত (পরে মিত্র উপাধি গ্রহণ করেন) ইংরেজ আনুকুল্যে কলকাতার অভিজাত মহলে ধনী জমিদার রূপে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিলেন। সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহার করে তারা অগাধ ধনসম্পদের অধিকারী হয়েছিলেন এবং সেই অর্থ তারা ব্যবসায়ে নিয়ােগ করেছিলেন। রানাঘাটের পাল-চৌধুরি পরিবার জমি কিনে জমিদার হওয়ার পূর্বে কলকাতায় লবণের ব্যবসার এজেন্ট ছিলেন। এই পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা দুইভাই কৃষ্ণচন্দ্র পাল ও শম্ভুচন্দ্র পাল প্রথম জীবনে পানের ব্যবসা করতেন। কিন্তু ১৭৯০ সালের মধ্যে লবণের ব্যবসা করে তারা কলকাতার ধনী সমাজে উল্লেখযােগ্য ব্যক্তি রূপে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন। মুর্শিদাবাদের নিত্যানন্দ রায় প্রথম জীবনে ছিলেন তাঁতী। পরবর্তীকালে তিনি কোম্পানির বেনিয়ান হয়ে প্রভূত সম্পদের অধিকারী হয়েছিলেন।
বাগবাজারের মুখার্জি পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা দুর্গাচরণ মুখােপাধ্যায় রাজশাহীর কালেক্টার রুস সাহেবের দেওয়ান ছিলেন। দেওয়ানি করে তিনি প্রচুর সম্পত্তির মালিক হয়েছিলেন। জোড়াসাঁকোর সিংহ পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা শান্তিরাম সিংহ (কালীপ্রসন্ন সিংহের প্রপিতামহ) পাটনার চিফ মিডলটন সাহেবের ও স্যার টমাস রামবােল্টের দেওয়ানি করতেন। কুমােরটুলির মিত্র পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা গােবিন্দরাম মিত্র কলকাতায় ইংরেজের জমিদারি-কাছারির দেওয়ান ছিলেন। জোড়াবাগানের রাধামাধব বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিবার পটুয়ার আফিমের এজেন্সির দেওয়ানি করে সমৃদ্ধিলাভ করেন। জোড়াসাঁকোর ঘােষ পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা অভয়চরণ ঘােষ কোম্পানির দেওয়ানি ও বেনিয়ানি করেছেন। শ্যামবাজারের বসু পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা কৃষ্ণরাম বসু হুগলীতে কোম্পানির দেওয়ান ছিলেন এবং লবণের ব্যবসা করে ভূসম্পত্তির অধিকারী হয়েছেন।১৩
বেনিয়ানগিরিতে বা ব্যবসায়ে প্রতিষ্ঠালাভ করে যারা প্রচুর সম্পত্তি করে ভূসম্পত্তি কিনেছিলেন তাদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য হলেন—হৃদয়রাম মুখার্জি, রঘুনাথ ব্যানার্জি, অত্রুর দত্ত, নিমাইচরণ মল্লিক, মনােহর মুখার্জি, বারানসী ঘােষ, রামচন্দ্র মিত্র, বিধানাথ মতিলাল, মদনমােহন দত্ত, বৈষ্ণবচরণ শেঠ, গঙ্গানারায়ণ সরকার, প্রাণকৃষ্ণ লাহা প্রমুখ। নিমাইচরণ মল্লিক ‘ককারেল ট্রেল অ্যাণ্ড কোম্পানি’-র বেনিয়ান ছিলেন। হিকি সাহেবের বেনিয়ান ছিলেন রঘুনাথ ব্যানার্জি ও হৃদয়নাথ ব্যানার্জি। গঙ্গানারায়ণ সরকার ছিলেন পামার কোম্পানির খাজাঞ্চি। বিধানাথ মতিলাল প্রথম জীবনে এক লবণের গােলায় মাসিক আট টাকা বেতনে চাকরি করতেন। পরে বেনিয়ানি করে মৃত্যুকালে নগদ পনের লক্ষ টাকা ও একাধিক বাজারসহ বহু বিষয়সম্পত্তি রেখে যান।১৪
পলাশির যুদ্ধে ইংরেজের জয়লাভের ফলে নবকৃষ্ণ দেবের ভাগ্য খুলে গিয়েছিল আশ্চর্যজনকভাবে। ১৭৫০ সালে মাত্র সতেরাে বছর বয়সে তিনি নিযুক্ত হয়েছিলেন ওয়ারেন হেস্টিংস-এর ফারসি ভাষার মুন্সীর পদে। ১৭৫৭ সালের আগেই তেজারউদ্দিন খানের জায়গায় নবকৃষ্ণকে ইস্ট-ইণ্ডিয়া কোম্পানির মুন্সীর পদে নিয়ােগ করেছিলেন ড্রেক সাহেব। তাই এ সময় নবকৃষ্ণ পরিচিত ছিলেন ‘নব মুন্সী’ নামে। ইংরেজদের তরফে লেখালেখির কাজকর্ম তাকেই করতে হতাে। পলাশির যুদ্ধের সময়েও করতে হয়েছিল। কাজেই পলাশির যুদ্ধে ইংরেজের জয়লাভে তার উল্লসিত হওয়ার কারণ ছিল। একটা বড় কারণ ছিল বেশ বড় অঙ্কের অর্থপ্রাপ্তি।
সিরাজউদ্দৌলার মৃত্যুর পর তাঁর গুপ্ত কোষাগারের সন্ধান পেয়েছিলেন চারজন। তারা হলেন মীরজাফর, আমীর বেগ, রামচাঁদ রায় আর নবকৃষ্ণ। এ সময় প্রায় আট কোটি টাকার সােনাদানা হাতে এসেছিল তাদের। ফলে নবকৃষ্ণ ধনী হয়েছিলেন। হঠাৎ (১৭৫৭-এ নবকৃষ্ণের মাস-মাইনে ছিল ৬০ টাকা মাত্র)। তাই নবকৃষ্ণ ১৭৫৭ সালে শারদীয়া দুর্গোৎসবের মাধ্যমে পালন করলেন পলাশি যুদ্ধের বিজয়-উৎসব। কলকাতায় শারদীয়া দুর্গোৎসবের সূচনা করলেন।
কলকাতার এই ‘বাবু’দের সামাজিক মান-মর্যাদার মাপকাঠি ছিল টাকা। সেই টাকার প্রাপ্তি ঘটেছে ইংরেজদের লুণ্ঠনসহযােগীরূপে। এইভাবেই তারা সারা বাংলার রক্ত শােষণ করে কলকাতায় গড়ে তুলেছিল প্রাচুর্যের পাহাড়। এই কালাে টাকার মালিকদের পরিচয় ছিল ইংরেজদের দেওয়ান, বেনিয়ান, মুৎসুদ্দি, সরকার, কেরানী প্রভৃতি শত নামে। আরাে ছিল কোম্পানির উকিল ও জমিদারির সেরেস্তাদার। ইংরেজরা তাদের পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলতাে ‘ব্ল্যাক জেমিনদার’। দুর্নীতির নানা কানাগলিপথে ব্ল্যাক মানি অর্থাৎ লক্ষ্মী এসে বাসা বেঁধেছিল এদের ঘরে।
অতুল সুর তার ‘৩০০ বছরের কলকাতা পটভূমি ও ইতিকথা’ বইতে ‘বাবু’দের জন্য ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কলিকাতা কমলালয় থেকে উদ্ধৃত করে লিখেছেন, “এরা বনিয়াদী বড় মানুষ নয়, ঠিকাদারী, জুয়াচুরি, পােদ্দারী, পরকীয়া রমণী সংঘটন ইত্যাদি পন্থা অবলম্বন করে বড়লােক হয়েছেন।” এরপরেই অতুল সুর লিখেছেন, “ভবানীচরণ এদের ‘বনিয়াদী বড় মানুষ নয়’ বললেও, এরাই কলকাতা শহরের বনিয়াদী পরিবার সমূহের প্রতিষ্ঠাতা হয়ে দাঁড়ায়।”
এই ‘বাবু’রা যেমন করে ‘বাবু’ হবার পাঠ নিতেন সেকথা অতুল সুর তার বইতে লিখেছেন “যেহেতু ‘নববাবু বিলাস’ হচ্ছে সমসাময়িককালের বাবু কালচারের একখানাবিধস্ত দর্পণ, সেজন্য ওতে বাবুর যে পরিচয় পাওয়া যায়, তা সংক্ষেপে এখানে বিবৃত করা হচ্ছে। বাবুর মােসাহেবরা বাবুকে উপদেশ দিচ্ছে— “শুন, বাবু টাকা থাকিলেই হয় না। ইহার সকল ধারা আছে। আমি অনেক বাবুগিরি করিয়াছি এবং বাবুগিরি জারিজুরি করিয়াছি এবং অনেক বাবুর সহিত ফিরিয়াছি, রাজা গুরুদাস, রাজা ইন্দুনাথ, রাজা লােকনাথ, তনুবাবু, রামহরিবাবু, বেণীমাধববাবু প্রভৃতি ইহাদিগের মজলিস শিখাইয়াছি এবং যেরূপে বাবুগিরি করিতে হয় তাহাও জানাইয়াছি। এক্ষণে বৃদ্ধাবস্থা প্রাপ্ত তথাপি ইচ্ছা হয় তুমি যেরূপে উত্তম বাবু হও এমত শিক্ষা দিই।
প্রথম উপদেশ। যে সকল ভট্টাচার্যরা আসিয়া সর্বদা টাকা দাও, টাকা দাও এই কথা বই আর অন্য কথা বলে না, তাহাদের কথায় কান দিবে না। আমার পিতার শ্রাদ্ধের সময় উহারা যখন কহিল, বাবু শ্রাদ্ধের কি করিব। আমি জিজ্ঞাসা করিলাম যে শ্রাদ্ধের ফল কি? উহারা বলিল, পিতৃলােকের তৃপ্তি হয়। আমি বলিলাম, কোনকালেও শুনি নাই যে মরা গরুতে ঘাস জল খাইয়া থাকে। ভট্টাচার্য শেষে কহিল বাবুজী আর কিছু কর না কর, পিণ্ডদানটা করা আবশ্যক। তাহাতে আমি কহিলাম আজ আমি উত্তম বুদ্ধিমতী পরধার্মিক বকনা পিয়ারীর (‘বেশ্যাপ্রধানা’) নিকট যাইব তাহারা যেরূপ পরামর্শ দিবে সেরূপ করিব। বকনা পিয়ারী আমাকে কহিল, তুমি এক কর্ম কর—এক ব্রাহ্মণকে ফুরাইয়া দাও, শ্রাদ্ধ দশপিণ্ড ব্রাহ্মণ ভােজনাদি যত কর্ম সেই করিবেক। আমিও তাবত কর্ম ফুরাইয়া দিলাম। অতএব নির্বোধ ভট্টাচার্যের আগমন করিলে কদাচ আসিতে আজ্ঞা হয় বসিতে আজ্ঞা হয় এরূপ বাক্য বলিবে না, যদ্যপি কিঞ্চিৎ দিতে হয়, তবে কহিবা সময়ানুসারে আসিবে। এইরূপ মাসেক দুই মাস প্রতারণা করিয়া কিঞ্চিত দিব।
দ্বিতীয় উপদেশ। গাওনা বাজনা কিছু শিক্ষা কর যাহাতে জিউ খুশী থাকিবে এবং যত বারাঙ্গনা আছে তাহাদিগকে বাটীতে মধ্যে মধ্যে যাতায়াত করিয়া ঐ বারাঙ্গনাদিগের সর্বদা ধনাদি দ্বারা তুষ্ট রাখিবে, কিন্তু যবনী বারাঙ্গনা সম্ভোগ করিবে কারণ, তাহারা পেঁয়াজ, রসুন আহার করে সেইহেতু তাহাদিগের সহিত সম্ভোগে যত মজা পাইবে এরূপ অন্য কোন রাঁড়েই পাইবে না। যদি বল যবনী বেশ্যা গমন করিলে পাপ হইবে তাহা কদাচ মনে করিবে না। যাহাদের পূর্বজন্মে অনেক তপস্যা থাকে তাহারাই উত্তম স্ত্রী সম্ভোগ করে। যদি বেশ্যা গমনে পাপ থাকিত, তবে কি উর্বশী, মেনকা, রম্ভা, তিলােত্তমা প্রভৃতি বেশ্যার সৃষ্টি হইত? তারপর পয়ার ছন্দে বললেন— “কর গিয়া বেশ্যাবাজি, যদি বল কর্ম পাজি, মন শুচি হলে পাপ নয়। যাহার যাহাতে রুচি, সেই দ্রব্য তারে শুচি, তার তাতে হয় সুখােদয়। অন্য অন্য সুখের সৃষ্টি, করি বিধি পরে মিষ্টি, করিলেন সুখের সৃজন। বেশ্যাকূচ বিমর্দন, যতনেতে আলিঙ্গন, আর তার শ্রীমুখ চুম্বন। বেশ্যার আলয়ে বসি, এইরূপ দিবানিশি, তুমি বাবু কর আচরণ। ইহাতে অন্যথা কভু, মনে না ভাবিবে বাবু, হইবেক দুঃখ বিমােচন।
তৃতীয় উপদেশ। প্রতি রবিবারে বাগানে যাইবা মৎস্য ধরিবা সকের যাত্রা শুনিবা, নামজাদা বেশ্যা ও বাঈ ইয়ারদিগকে নিমন্ত্রণ করিয়া বাগানে আনাইবা বহুমূল্য বস্ত্র, হার, হীরাকাঙ্গুরীয় ইত্যাদি দিয়া তুষ্ট করিবা। দেখিবে কি মজা হয়।
চতুর্থ উপদেশ। যাহার চারি ‘প’ পরিপূর্ণ হইবে তিনি হাফ বাবু হইবেন। চারি ‘প’ হইতেছে পাশা, পায়রা, পরদার ও পােষাক। ইহার সহিত যাহার চারি ‘খ’ পরিপূর্ণ হইবে তিনি পুরা বাবু হইবেন। চারি ‘খ’ হইতেছে খুশি, খানকী, খানা, খয়রাত।১৫
এরূপ অনেক ‘ক্যালকাটা বাবু’ দুই, চার, পাঁচ টাকা বেতনের কর্মচারী থেকে সে যুগের ধনকুবেরে পরিণত হয়েছিল। রামদুলাল দে প্রথমে কলকাতায় এক ব্যবসায়ীর বাসায় বাবুর্চির কাজ করতেন। তারপর তার চাকুরি জীবন শুরু হয় মাত্র মাসিক ৫ টাকা বেতনে এক ধনী ব্যবসায়ীর পাওনা আদায়কারী সরকার হিসেবে। পরবর্তীকালে তিনি কলকাতার সবচেয়ে ধনাঢ্য বণিকদের অন্যতম হিসেবে পরিচিত হন। তিনি বেশ কয়েকটি জাহাজের মালিক ছিলেন এবং তার মাধ্যমে বেসরকারী পর্যায়ে আমেরিকার সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য চালু হয়েছিল।১৬ ১৮২৫ সালে মৃত্যুর সময় কলকাতা শহরে তিনি রেখে গেছেন উনিশটি বিশাল বাড়ি, আর এক কোটি তেইশ লাখ টাকা।১৭ কলকাতার বিখ্যাত ছাতুবাবু-লাটু বাবুরা ছিলেন তারই সন্তান। আট টাকা বেতনে চাকরি শুরু করে রামকমল সেন মৃত্যুর সময় নগদ রেখে যান দশ লাখ টাকা।১৮
এই ইতিহাস তৎকালীন সমস্ত ধনী ব্যক্তিদের। এইভাবে নয়া শােষণের কেন্দ্র রূপে গড়ে উঠেছে কলকাতা। ১৭৭৪ সালে বাংলার গভর্নর ওয়ারেন হেস্টিংস প্রথম গভর্নর জেনারেল হলেন, আর কলকাতা হল সারা ভারতের রাজধানী। নয়া সভ্যতা ও বণিক শক্তির প্রতীক কলকাতা কিন্তু তার সর্বাঙ্গে সামন্ততান্ত্রিক চিহ্ন। যানবাহনে, জীবনযাত্রায়, চরিত্রে, ধর্মে, সংস্কৃতিতে সর্বত্র তার সামন্ত পরিচয় বর্তমান। “এক নবাবী আমল শেষ হল, আর এক নবাবী আমল আরম্ভ হল। গােটা অষ্টাদশ শতাব্দীকেই প্রায়। তাই বলা চলে। ইংরেজ নবাব এবং তাদের প্রসাদপুষ্ট বাঙ্গালী দেওয়ান ও বেনিয়ানদের স্বর্ণযুগ।”১৯ এদের নবাবীয়ানা চলেছিল উনিশ শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত।
এসময় সনাতন হিন্দু ধর্মের ঘােরতর দুর্দিন চলছিল। ধর্ম মানে তখন লােকাচার আর কুসংস্কার। কলকাতার হঠাৎ-ধনী সম্প্রদায় হয়ে উঠলেন তার সতর্ক প্রহরী। অনেক সময়ই তারা মুখে যা বলতেন, কাজে তা করতেন না। মুখে হিন্দু আচারের গুণগান করে, সামনে না হলেও আড়ালে তারা তাকে ভাঙতে দ্বিধা করতেন না। ‘দ্য পার্সিকিউটেড’ নাটকে কৃষ্ণমােহন বন্দ্যোপাধ্যায় সংবাদপত্র-সম্পাদক লালচঁাদের মুখ দিয়ে তাকে উঘাটিত করে দেখিয়েছেন। লালচঁাদ উগ্রপন্থীদের সম্পর্কে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন,
‘Why do they not eat and drink in private ? Why do the fools excite a noise about it? Who does not eat and drink in this age ? Those who are looked upon as examples in virtues indulge in excesses.’২০
প্যারীচাঁদ মিত্র তার মদ খাওয়া বড় দায় জাত থাকার কি উপায়’-এ হেমচন্দ্রের মুখ। দিয়ে একই কথা বলিয়েছেন, এক্ষণে হিন্দুয়ানীর মাহাত্ম বুঝিলাম লুকাইয়া খাইলে পাপ নাই, প্রকাশ্যরূপে খাইলে পাপ কপটতা পূজ্য-সরলতা নিন্দনীয়। জুয়াচুরি ফ্রেবি জুলুম জাল মিথ্যা শপথ এবং পরস্ত্রীহরণ এ সকল কুকৰ্ম্ম বলিয়া ধৰ্ত্তব্য নয়— এসব কৰ্ম্মে হিন্দুয়ানির হানি হয় না…দ্বার বন্ধ করিয়া যবনীয় আহার ও মদ্যপানে উন্মত্ত হইবে—তাহাতে দোষ নাই—তাহাতে অধৰ্ম্ম নাই, কিন্তু অন্য কেহ দ্বার খুলিয়া ঐ আহার ও পান পরিমিতরূপে করিলে জাতিচ্যুত হইবে।২১ বলাবাহুল্য প্যারীচাদের এই উক্তি অতিশয়ােক্তি নয়। হুতােম কলকাতার অনেক প্রকৃত ‘হিন্দু দলপতির’ আসল রূপটি আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন। সহরের অনেক প্রকৃত হিন্দু বুড়াে দলপতির এক একটি রাড় আছে একথা আমরা পূর্বেই বলেছি, এদের মধ্যে কেউ কেউ রাত্তির দশটার পর শ্রীমন্দিরে যান, একেবারে প্রাতঃস্নান করে টিপ তেলক ও ছাপা কেটে, গীতগােবিন্দ ও তসর পরে, হরিনাম কত্তে কত্তে বাড়ি ফেরেন—হঠাৎ লােকে মনে করতে পারে শ্ৰীযুত গঙ্গাস্নান করে এলেন, কেউ কেউ বাড়িতে প্রিয়তমাকে আনান, সমস্ত রাত্তির অতিবাহিত হলে ভােরের সময় বিদায় দিয়ে স্নান করে পুজো কত্তে বসেন।২২ হুতােমের এই অনাবৃত বিবরণ যে অপ্রকৃত নয়, তার সমর্থন সমসাময়িক সংবাদ-সাময়িকপত্রে ছড়িয়ে আছে। ‘জ্ঞানান্বেষণ’ এইসব ‘বিড়াল ব্রহ্মচারির’ আসল রূপটি তুলে ধরে।২৩ উচ্ছৃঙ্খল নাচের তালে তালে এইসব সমাজপতিদের মনও দুলত। সেকালের নামকরা ধনী রূপলাল মল্লিকের বাড়িতে রাসলীলার সময় ‘তায়ফা নর্তকী’দের নাচ দেখে, সুখাদ্য খেয়ে এবং মদিরা পান করে নিমন্ত্রিতরা আমােদিত হয়েছিলেন।
বিশেষ করে ধর্মীয় অনুষ্ঠান উপলক্ষে রক্ষণশীল হিন্দুরা সর্বপ্রকার উদ্ধৃঙ্খলতাকে প্রশ্রয় দিতেন। হিন্দুয়ানি অবাধ ভােগ প্রবৃত্তি চরিতার্থ করার অন্যতম উপায় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ৫ নভেম্বর ১৮৩১-এ ‘সমাচার দর্পণ’ সম্পাদকের কাছে একটি চিঠিতে জনৈক পত্রলেখক চন্দ্রিকাকারের উদ্দেশে লেখেন, চন্দ্রিকা সম্পাদক লিবারালেরদের প্রতি নিত্য বকাবকি করিয়া থাকেন তিনি ধৰ্ম্মসভারও সম্পাদক এবং হিন্দুরদিগকে অন্ধকারাবৃত করিয়া রাখিতে এবং হিন্দুশাস্ত্রের বিধি প্রবল করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছেন তবে যে হিন্দু বাবুরা হিন্দুশাস্ত্রের বিধলঙঘন করিতেছেন তাহাদিগকে তিনি কেন অব্যবহাৰ্য্য না করেন, হইতে পারে যে তাহারা সতীধৰ্ম্ম সংস্থাপনার্থ কিছু ধন দিয়া থাকিবেন ঐ ধনের দ্বারা তাহার চ একেবারে আবৃত হইয়াছে অতএব ধর্মসভা সম্পাদক মহাশয়কে আমি এইক্ষণে জিজ্ঞাসা করি যে বাবু মহাশয়েরা দুর্গোৎসবাদিতে মাংসাদাহরণ করিয়া ইষ্টসিদ্ধ করেন তাহা হিন্দুর বিধানুসারে কিনা। গাে-মাংসের নামশ্রবণে শ্রবণ পিধান করেন এমন অনেক দক্ষিণাচারি বাবুরদিগকে দেখিয়াছি তবে কি নিমিত্ত তাঁহারা দুৰ্গাৰ্চন বাটিতে বিফষ্টেক মটন্ চাপ ও বস মাংস ও ব্রাণ্ডি সাম্পেন সেরি ইত্যাদি নানাপ্রকার মদিরা আনয়ন করেন। অতএব হে প্রিয়ে চন্দ্রিকে আপনি অনুসন্ধান করিয়া দেখুন যে এমত কোন ব্যক্তি কি ধৰ্ম্মর্সভান্তঃপাতি প্রাপ্ত হওয়া যায় না। আপনি কহুন গত দুর্গোৎসব সময়ে কাহার বাটিতে ইউরােপীয় লােকেরদের নিমন্ত্রণ ও নাচ হইয়াছিল তেরেটি বাজারের অতিসুস্বাদু মাংসসকলকে ক্রয় করিয়াছিল। নিমন্ত্রিত ব্যক্তিরদের নিমিত্ত গণ্টরহুপর সাহেবদের স্থানে ভূরি ভূরি খাদ্যসামগ্রী কে আনয়ন করিয়াছিল এবং ইউরােপীয় লােকেদের রুচিজনক ভােজ প্রস্তুত করিতে অত্যন্ত মনােযােগী কে হইল। হরিবােল হরিবােল অতিধাৰ্মিক শিষ্ট বিশিষ্ট ব্যক্তিরদের মধ্যে কি এমত ব্যবহার হইতে পারে।
প্রভাকরের অধ্যক্ষ অথচ সম্পাদক ঐ সভান্তঃপাতী এমত ব্যক্তিরদিগকে যে কিছু কহেন না ইহাতে তাহার অপরাধ নাই। যেহেতুক তৎসক্তেরা পাথুরিঘাটাতে স্ব স্ব বাটিতে তদ্রুপ ভােজনা করাইতেন, তাহা অদ্যাপিও প্রতিবাসি লােকেরদের বিলক্ষণরূপ স্মরণ আছে অনুমান হয় যে তৎপ্রযুক্ত তাহারা মৌনাবলম্বী আছেন।২৪
স্পষ্টত পত্রলেখক এইসব ব্যক্তিদের নাম উল্লেখ করেননি। ৫ অক্টোবর ১৮৩১-এ ‘এ গেস্ট অ্যাট ইচ হাউস’ স্বাক্ষরে জনৈক ব্যক্তি ‘জন বুল’-এর সম্পাদকের কাছে প্রেরিত এক পত্রে, গত দুর্গোৎসবের সময় বিভিন্ন ধনী-গৃহে নাচ-গান ও আমােদপ্রমােদের বিস্তৃত বিবরণ দেন। চিঠিটি ‘ইণ্ডিয়া গেজেট’ পুনর্মুদ্রিত করে ২২ অক্টোবর ১৯৩১। এই চিঠিতে শােভাবাজার রাজবাড়িতে নিমন্ত্রিত এক ভদ্রলােকের লেখা থেকে জানা যায় সকাল থেকেই চিৎপুরের রাস্তায় লােক চলাচল বন্ধ করে দিয়েছিল পুলিশ। শােভাবাজারের মহারাজা নবকৃষ্ণ বাহাদুরের বাড়িতে স্যার চার্লস এবং মিস্টার গেট, মিস্টার স্মিথ, ক্যাপ্টেন সাদারল্যাণ্ড এবং আরাে অনেক ইংরেজ রাজপুরুষ আসবেন দুর্গাপুজোয় বাঈনাচ দেখতে। মহারাজের নাতি শিবকৃষ্ণ, কালীকৃষ্ণ এবং আরও অনেকে প্রাসাদের সামনে উদ্বিগ্ন হয়ে অপো করেছিলেন স্যার চার্লস সদলবলে আসবেন বলে। দশটার সময় তাদের অপেক্ষা করা সার্থক হল। স্যার চার্লস সদলবলে এসে পৌছােলেন। শুরু হল ‘গড সেভ দ্য কিং’ বাজনা। তিনি বাঙ্গনাচের আসরের মাঝখানে এক সােনালি সুন্দর চেয়ারে এসে বসলেন। অন্য সবাই বসলেন যে যার নিজের নিজের বরাদ্দ আসনে। তারপর ‘চ’ মেয়েরা সব এক এক করে এসে তাদের নাচ দেখিয়ে গেল।২৫ চিঠিটি থেকে আরও জানা যায়, এই সময় গােপীমােহন দেব, রাধাকান্ত দেব, আশুতােষ দেব, প্রমথনাথ দেব—এঁরা সবাই দুর্গাপূজার সময় বাড়িতে নাচগানের জমজমাট আসর বসান। সাহেবদের আপ্যায়নের সবরকম ব্যবস্থাও করা হয়,
‘They all observed the Doorgah festival and given their guests an excellent meal (?), for they feasted upon wines and liquors of all kinds, and had enough of eatables.’২৬
বলাবাহুল্য, পত্রোল্লিখিত বিশিষ্ট বাঙালিরা সবাই ছিলেন ‘ধর্মসভা’র উৎসাহী সদস্য এবং সনাতন হিন্দুধর্মের জাগ্রত প্রহরী!
এমনিভাবে বাঈনাচে বিদেশি রাজপুরুষদের আপ্যায়িত করা হয়েছিল। এর পরের বছর দুর্গাপুজোয় বাবু রূপলাল মল্লিকের বাড়ি বানাচে ছাপানাে নিমন্ত্রণপত্র দিয়ে আমন্ত্রণ করা হয়েছিল বিশিষ্ট লােকেদের তবুও মল্লিক বাড়ির দরােয়ানেরা সকলকেই নাচ দেখাতে ঢুকতে দিয়েছিলেন বলে জনৈক নিমন্ত্রিত ব্যক্তি ক্ষোভপ্রকাশ করে চিঠি (১৭ ফেব্রুয়ারী ১৮৩২) লিখেছিলেন,
“Last evening I paid a visit to Baboo Rooplal Mullick’s ‘nautch’ and was rather surprised to see such a collection of tagrag and bobtails there. As Baboo Rooplal had taken the trouble to cause to be printed tickets of admission, the use of which I cannot perceive, when any person can gain admission without being at all questioned by the constables stationed at the entrance to the house, it is much to be lamented that these ‘nautches’ are kept more select.
I can see no native for allowing so indiscriminate a mixture of people. Surely it cannot be for the interest of those who give these entertainments, to admit all kinds of people without any, the least, distinction. If the givers wish to make upto themselves a name, surly they never can make upto themselves a respectable one, by admitting such a mass of low-lived creatures as they do. It would add much more to their honour, if they were to admit only those who are respectable and sweet to mix in respectable society. Perhaps they do not wish to be considered influenced by the exclusive spirit which unfortunately characterised European society in India-very good. But, I would remind them that there is a medium…a golden medium, which worthy of the attention of all… The spirit of reform is absurd, it ought surely to extend here if these liberal Baboos wish to gain the esteem and admiration of those whose esteem and administration are worth possessing.”
ওই বছর বাবু রূপলাল মল্লিকের বাড়িতে ভাল করে পুজো হলেও অধিকাংশ বাড়িতেই পুজো হয়েছিল নমাে নমাে করে। যাদের বাড়িতে বেশ কয়েকজন বাঈজি আসত তারা যাত্রা, পাঁচালি বা কবিগানের ব্যবস্থা করেই ক্ষান্ত হলেন। এ প্রসঙ্গে ‘সমাচার দর্পণ’-এ লেখা হয়েছিল,
“…হিন্দুদের প্রধান কর্ম যে দুর্গোৎসব তাহারও এ বৎসরে অনেক ন্যূনতা শুনা যাইতেছে। পূর্বে এতন্নগরে এবং অন্যান্য স্থানে দুর্গোৎসবে নৃত্য গীত প্রভৃতি নানারূপ সুখজনক ব্যাপার হইয়াছে। বাইনাচ ও ভাড়ের নাচ দেখিবার নিমিত্তে অনেক ইংরেজ পর্যন্ত নিমন্ত্রণ করিয়া এমত জনতা করিলেন যে অন্যান্য লােকেরা সেইসকল বাড়ী প্রবিষ্ট হইতে কঠিন জ্ঞান করিতেন এ বৎসরে সেই সকল বাড়ীতে ইতর লােকের স্ত্রীলােকেরাও স্বচ্ছন্দে প্রতিমার সম্মুখে দণ্ডায়মান হইয়া দেখিতে পায়।..দুর্গোৎসবে যে আমােদপ্রমােদ পূর্বে ছিল এবৎসরে তাহার অনেক হ্রাস হইয়াছে ইহাতে অনেকে কহেন যে এতদ্দেশীয় লােকেদের ধনশূন্য হওয়াতেই এরূপ ঘটিয়াছে ইহা হইতেও পারে কেননা ধন থাকিলে যেমন মনের স্ফুর্তি থাকে ও আমােদপ্রমােদ করিতে বাচ্ছা হয় দরিদ্র হইলে তাহার কিছুমাত্র থাকে না, সর্বদা পরিবারের ও আপনার ভরণপােষণ এবং অন্নবস্ত্রাদির ভাবনাতেই উদ্বিগ্ন থাকিতে হয়, ধন যে কেমন বস্তু আর তাহা না থাকিলে কিরূপ যাতনা পাইতে হয় তাহা এতদ্দেশীয় প্রায় ভাগ্যবন্ত সন্তানেরা পূর্বে বিচার করেন নাই…।”২৭
দুর্গাপুজোয় দু’হাতে পয়সা খরচ করে জাঁকজমক আমােদপ্রমােদের প্রতিযােগিতায় নামতেন সেকালের নাম করা ধনীরা। কে কতবড় বাঈজি আনতে পারে, আলাের রােশনাই দেখাতে পারে, মদের বন্যা বওয়াতে পারে, দেশি ও বিদেশি সন্ত্রান্ত লােকেদের বাড়ি আনতে পারে তার প্রতিযােগিতায় টেক্কা দেওয়াই ছিল এদের একমাত্র লক্ষজ। এই প্রতিযােগিতা থেকে সরে দাঁড়ালে লােকে বলবে কী! মানসম্মান বংশমর্যাদা বলে একটা কথা আছে তাে! সেসব জলাঞ্জলি দিয়ে সমাজে মুখ দেখাবে কী করে? তাই সেদিন কোনও বাবুই এই প্রতিযােগিতা থেকে সরে দাঁড়াতে পারতেন না। তাতে যদি সর্বস্বান্ত হতে হয় তাও আচ্ছা! কিন্তু বংশের মান। মর্যাদা বিসর্জন দেওয়া যায় না! এমনি ঝুটো সম্মানজ্ঞানের জন্য অনেক সম্ভ্রান্ত পরিবারকে সর্বস্বান্ত হতে হয়েছিল।২৮
দুর্গাপুজোর এই প্রতিযােগিতা প্রসঙ্গে শিবনাথ শাস্ত্রী জানিয়েছেন,
“যে ধনী পূজার সময় প্রতিমা সাজাইতে যত অধিক ব্যয় করিতেন এবং যত অধিক পরিমাণে ইংরাজের খানা দিতে পারিতেন, সমাজ মধ্যে তাঁহার তত প্রশংসা হইত। ধনী গৃহস্থগণ প্রকাশ্যভাবে বারবিলাসিনীগণের সহিত আমােদ প্রমােদ করিতে লজ্জাবােধ করিতেন না।…নিজ ভবনে বাঈজী দিগকে অভ্যর্থনা করিয়া আনা ও তাহাদের নাচ দেওয়া ধনীদের একটা প্রধান গৌরবের বিষয় ছিল। কোন্ ধনী কোন্ প্রসিদ্ধ বাঈজী র জন্য কত সহস্র টাকা ব্যয় করিয়াছেন সেই সংবাদ শহরের ভদ্রলােকদিগের বৈঠকে বৈঠকে ঘুরিত এবং কেহই তাহাকে তত দোষাবহ জ্ঞান করিত না। এমনকি বিদেশিনী ও যবনী কুলটাদিগের সহিত সংসৃষ্ট হওয়া দেশীয় সমাজে প্রাধান্য লাভের একটা উপায় স্বরূপ হইয়া উঠিয়াছিল।”২৯
উল্লেখ্য, বাণিজ্যের স্বার্থে সামন্ততান্ত্রিক সংস্কৃতি ও ধনতান্ত্রিক সভ্যতার সংমিশ্রণে গড়ে উঠেছিল হঠাৎ-শহর কলকাতা, আর ধনােপার্জনের আশায় কোম্পানির সঙ্গে সহযােগিতা করার জন্য সেই কলকাতায় ভীড় করেছিল বাবু নামক এই ‘হঠাৎ রাজার’ দল। “কলকাতা শহরে তখন বিপুলকায় মেদবহুল রাজা-মহারাজা, বেনিয়ান-ইজারাদারদের জীবনযাত্রা ছিল সর্ব ক্ষেত্রে ইংরেজমহাপ্রভুদের অনুগামী। গৃহের আসবাবপত্তরে, দাসদাসীর সমাবেশ, ভােজ-সভার নৃত্যগীত সমারােহে, উৎসব-পার্বণের কৃত্রিম বিলাসে, এদেশীয় সমাজের নব্য প্রধানেরা বিদেশী শাসকদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে লােকচক্ষে সামাজিক মর্যদা-লাভের জন্য তখন অত্যাধিক লালায়িত হয়েছিলেন।”৩০
নবাবী-আমল শেষ হলেও নবাবী সংস্কৃতির অবলুপ্তি তখনাে ঘটেনি। অষ্টাদশ শতকের নবাবী-সংস্কৃতির রূপান্তর ঘটেছে। ঊনিশ শতকের বাবু সংস্কৃতিতে “দেওয়ানি ও বেনিয়ানির অপরিমিত অর্থে বিলাসিতার স্রোত বয়ে গিয়েছে তখন কলকাতার পথে। সাহেবদের বাড়িতে যেমন, তাদের কৃপাশিত বাঙ্গালী রাজা-মহারাজাদের বাড়ীতেও তেমনি ভােজ চলেছে, বাইজী-নাচ চলেছে।”৩১ কুলীনের নয় লক্ষণের মতাে এই বাবুদেরও নয় লক্ষণ নির্দিষ্ট হয়েছিল। এই নয় লক্ষণ হচ্ছে – ‘ঘুড়ী তুড়ী জস দান আখড়া বুলবুলি মুনিয়া গান। অষ্টাহে বনভােজন এই নবধা বাবুর লক্ষণ।৩২
এই হঠাৎ রাজার দল সকালে ‘অখণ্ড দোর্দণ্ড প্রতাপান্বিত অনবরত পণ্ডিত পরিসেবিত’ এবং ‘অপূৰ্ব পােষাক জামাজোড়া ইত্যাদি পরিধানপূৰ্ব্বক পাল্কী বা অপূৰ্ব্ব শকটারােহণে কর্মস্থানে গমন করেন।’৩৩ এবং সন্ধ্যাকালে কুরুচিপূর্ণ বিলাসে-ব্যসনে, কুৎসিত আমােদে-প্রমােদে লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করেন। “এক একজন ছেলেমেয়ের বিবাহে বা বাপমায়ের শ্রাদ্ধে দুই লক্ষ থেকে দশ লক্ষ টাকা ব্যয় করতেন। অনেকে আবার সখ করে বিড়ালের বিয়েতেও এরূপ পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতেন। এ সব উৎসাহে তারা সাহেব মেমদের নিমন্ত্রণ করতেন এবং তাদের আপ্যায়নের জন্য যথেষ্ট পরিমাণে সুরাপান ও নিষিদ্ধ খানাপিনার ব্যবস্থা করতেন।”৩৪ যেমন, ১৮২০ সালে রামরতন মল্লিক জাঁকজমক-সহকারে তাঁর পুত্রের বিবাহ দিয়েছিলেন। সংবাদপত্রের খবর ‘এমন বিবাহ শহর কলিকাতায় কেহ কখনও দেন নাই। এই বিবাহে যেরূপ সমারােহ হইয়াছে ইহাতে অনুমান হয় যে সাত আট লক্ষ টাকার ব্যয় ব্যতিরেকে এমত মহাঘটা হইতে পারে না। এবং সকল লােকেই এ বিবাহের প্রশংসা করিতেছে ও কহিতেছে যে এমন বিবাহ আমরা দেখি নাই।৩৫
গঙ্গাগােবিন্দ সিংহ তার মায়ের শ্রাদ্ধে ২০ লক্ষ টাকা ব্যয় করেছিলেন। তার নাতি লালা বাবুর ‘অন্নপ্রাশন’ উপলক্ষে সােনার পাতে আমন্ত্রণ ছেপে বিলি করা হয়েছিল। এ উপলক্ষে তার ঘরে ‘পুরাণ’ পাঠ করে গঙ্গাধর শ্রীমানী নামক জনৈক ব্রাহ্মণ পারিতােষিক পেয়েছিল হাতী, ঘােড়া ও সুসজ্জিত পাল্কি। আশুতােষ দেবের মায়ের শ্রাদ্ধ আর দ্বারকানাথ ঠাকুরের বাপের শ্রাদ্ধ সেকালের কলকাতার বাবু-বিলাসের একেকটি উল্লেখযােগ্য ঘটনা। সারা বাংলায় তখন চলছিল ইংরেজ ও তাদের কোলাবােরেটর এই কলকাতা-বাবুদের লুণ্ঠন-শােষণ। ইজারা চুক্তি, সূর্যাস্ত আইন, ব্যবসায়ের নামে লুটপাট প্রভৃতির ফলে একদা-সমৃদ্ধ পল্লীবাংলায় নরকের আগুন জ্বলছিল। উপর্যুপরি দুর্ভিক্ষ পল্লী বাংলার প্রতি ষােল জনে পাঁচ জন লােক মারা গিয়েছিল। বাংলার পুরনাে শহরগুলি জঙ্গলাকীর্ণ হয়ে পড়েছিল। মানুষ মানুষের মাংস খেয়ে ক্ষুধার জ্বালা নিবারণ করছিল। দেশের শিল্প-অর্থনীতি, ব্যবসা বাণিজ্যের বাস নিংড়ে নিয়ে কোটি মানুষের রক্ত পান করে কলকাতায় তখন চলছিল এই প্রমত্ত বাবু-বিলাস।
বিলাসের আরাে কিছু দৃষ্টান্ত তুলে ধরা যায়। রাজা নবকৃষ্ণ মায়ের শ্রাদ্ধে ব্যয় করেছিলেন ৯ লক্ষ টাকা। রাজা গােপীমােহন দেবের স্ত্রীর শ্রাদ্ধ এমন জাঁকজমক-সহকারে করা হয়েছিল যে, দশ হাজারের বেশি দরিদ্র মানুষ ও ব্রাহ্মণ রাজার কাছ থেকে নগদ অর্থ পেয়েছিলেন এবং যখন অর্থ বিতরণ করা হচ্ছিল, তখন এমন ভীড় হয়েছিল যে, সেই ভীড়ের চাপে চৌদ্দ জন মারা গিয়েছিলেন এবং আহতের সংখ্যা ছিল অসংখ্য যদিও সেই ভীড় সামলানাের জন্য রাজার কর্মচারীরা বিশেষ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন। গােপীমােহন দেবের মাতৃশ্রাদ্ধে তিন লক্ষ টাকা ব্যয় করা হয়েছিল। গােপীমােহন ঠাকুরের শ্রাদ্ধে তিন লক্ষ টাকা ব্যয় করা হয়েছিল। এই অনুষ্ঠানে দু’লক্ষর বেশি জনসমাগম ঘটেছিল এবং ১০৬ টি বাড়িতে তাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। আমােদ-ফুর্তির জন্য নদীয়ার রাজা ঈশ্বরচন্দ্র ১৮৩০ সালে বানরের বিয়েতে এক লক্ষ টাকা ব্যয় করেছিলেন। কেবলমাত্র আনন্দ-উৎসবে নয়, নব বাবুরা নবাবী চালে তীর্থযাত্রা করেছেন। কান্দির জমিদার ১৮২২-এর জুলাই মাসে যখন কাশী ও গয়ায় তীর্থযাত্রা করেছিলেন, তখন তার সঙ্গে ছিল পরিবারের সকলে ও অন্যান্য আত্মীয়স্বজন, শিক্ষক পণ্ডিত পুরােহিত বন্ধু-বান্ধব বৈষ্ণব-বৈষ্ণবী বিভিন্ন শ্রেণির কর্মচারীসহ সাত-আটশ জন। এঁদের জন্য ২৮টি বিলাসবহুল বড় বড় বজরার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এইভাবে পারিবারিক ও সামাজিক অনুষ্ঠান, বিয়ে, অন্নপ্রাশন, শ্রাদ্ধ এমনকি গৃহপ্রবেশের মত মামুলি উপলক্ষকে অবলম্বন করে তারা আভিজাত্যের প্রতিযােগিতায় লিপ্ত ছিল।
উৎসবে-বিলাসিতায় নয়া ভূস্বামীশ্রেণির অপরিমিত অর্থ ব্যয় লক্ষ করে একথা বলা যায়,
“এই নতুন জমিদার বা অভিজাত শ্রেণীর প্রাধান্য প্রতিষ্ঠায় এসবই ছিলাে একটা প্রক্রিয়া বিশেষ। প্রথমত, পুরাতন আভিজাত্যের ধ্বংসের উপর স্থাপিত হয়েছে। এক নতুন আভিজাত্য। যেসব নতুন জমিদার হয়েছে তারা সহজে সামাজিক স্বীকৃতি পায়নি। কয়েকযুগ ধরে তারা সমাজে পরিগণিত ছিল লাটদার, নিলামদার হিসেবে, জমিদার হিসেবে নয়। সামাজিক স্বীকৃতি-লাভের জন্য নব্য জমিদারের কয়েক যুগ ধরে প্রচুর দান-খয়রাত ও ব্রাহ্মণ-ভােজন করাতে হয়েছে, ঘাটে, মন্দির-মসজিদ নির্মাণ করতে হয়েছে, বিয়ে-শাদী, শ্রাদ্ধ, পূজাপার্বণে ঢের খরচ করতে হয়েছে।”৩৬
এই কালাে টাকার মালিকদের পরিচয় ছিল ‘চতুর ও বুদ্ধিমান’, ‘শঠ ও প্রবঞ্চক’, এবং হাজার রকম প্রতারণা-কৌশলের উদ্ভাবক’রূপে। টাকা-পয়সা উপার্জনে তারা যে অভিনব ব্যবসায়িক কৌশলের অবলম্বন করত তা প্রকাশ্য দস্যুতা ছাড়া কিছুই নয়। অন্যদিকে সেই লুণ্ঠিত সম্পদ খরচ করার ব্যাপারেও তারা ছিল বেহিসেবী। নানা প্রকার ‘বাবুবিলাস’ তখনকার কলকাতায় চালু হয়েছিল। বাঈজি-চর্চা থেকে শুরু করে বুলবুলির লড়াই, টিকটিকির নাচ পর্যন্ত অনেক কিছুই ছিল তাদের বিকৃত রুচির তৃপ্তি সাধনের উপাদান। “তখন মিথ্যা, প্রবঞ্চনা, উৎকোচ, জাল, জুয়াচুরী প্রভৃতির দ্বারা সঞ্চয় করিয়া ধনী হওয়া কিছুই লজ্জার বিষয় ছিল না। বরং কোনও সুহৃদগােষ্ঠীতে পাঁচজন লােক একত্র বসিলে এরূপ ব্যক্তিদিগের কৌশল ও বুদ্ধিমত্তার প্রশংসা হইত। ..ধনী গৃহস্থগণ প্রকাশ্যভাবে বারবিলাসিনীদিগের সহিত আমােদ প্রমােদ করিতে লজ্জাবােধ করিতেন না। তখন উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল ও মধ্য ভারতবর্ষ এক শ্রেণীর গায়িকা ও নর্তকী শহরে আসিত, তাহারা বাঈজী এই সম্ভ্রান্ত নামে উক্ত হইত। নিজ ভবনে বাঈজী দিগকে অভ্যর্থনা করিয়া আনা ও তাহাদের নাচ দেওয়া ধনীদের একটা প্রধান গৌরবের বিষয় ছিল। কোন্ ধনী কোন্ প্রসিদ্ধ বাঈজী র জন্য কত টাকা ব্যয় করিয়াছেন সেই সংবাদ শহরের ভদ্রলােকদিগের বৈঠকে বৈঠকে ঘুরিত এবং কেহই তাহাকে তত দোষাবহ জ্ঞান করিত না। এমনকি বিদেশিনী ও যবনী কুলটাদিগের সহিত সংসৃষ্ট হওয়া দেশীয় সমাজে প্রাধান্য লাভের একটা প্রধান উপায় স্বরূপ হইয়া উঠিয়াছিল।…এই বাবুরা দিনে ঘুমাইয়া, ঘুড়ি উড়াইয়া, বুলবুলির লড়াই দেখিয়া, সেতার এসরাজ বীণ প্রভৃতি বাজাইয়া, কবি, হাপ আকড়াই, পাঁচালি প্রভৃতি শুনিয়া, রাত্রে বারাঙ্গানাদিগের আলয়ে আলয়ে গীতবাদ্য ও আমােদ করিয়া কাল কাটাইত এবং খড়দহের মেলা ও মাহেশের স্নানযাত্রা প্রভৃতির সময়ে কলিকাতা হইতে বারাঙ্গনাদিগকে লইয়া দলে দলে নৌকাযােগে আমােদ করিতে যাইত।”৩৭ আবার “কোন কোন স্থানে সন্দেশের মজলিশ অর্থাৎ গােল্লা বিচাইয়া তাহার উপর বসিয়া বৈঠকী সঙ্গীত হইত। কোন কোন স্থানে মানুষ পীর সভা অর্থাৎ বৃহৎ বৃহৎ খাঁচার ভিতর মানুষ পীস্বরূপ থাকিতেন—সভায় আনীত হইলে কেহ কাক, কেহ কাদা খোঁচা, কেহ সারস, কেহ বক এইরূপ নানা পীর প্রকৃতি দেখাইতেন ও মধ্যে মধ্যে গান করিতেন যথা ‘কুরুড় কিং ল্যাক জ্যাকসন, গুলবর জ্যাকসন, আলিপুরি জ্যাকসন, কুরুড়।”৩৮ এই জাতীয় আমােদ-অনুষ্ঠানে ডেভিড হেয়ার, লর্ড অকল্যাণ্ডের বােন মিস ইডেন, ফ্যানি পার্ক প্রমুখ সেকালের বিশিষ্ট ইংরেজ পুরুষ ও মহিলারা যােগ দিতেন।
কোন কোন সময় পাঁচালিও চলত। পাঁচালির অধিকাংশই গীত হত, আর কোনাে কোনাে অংশ দ্রুত আবৃত্তি করে অথবা বিশেষ ঢং-এ ছড়া কেটে পরিবেশিত হতাে। এর কিছু কিছু অঙ্গ—যেমন ‘নলিনী-ভ্রমর’—এতে লৌকিক রসালােচনার সুযােগ নিয়ে সম-সাময়িক সমাজের ঘটনার অবতারণা করেছিলেন দাশু রায় তাঁর পাঁচালীতে। ‘নলিনী-ভ্রমর’-এর এক অংশে—“দৈবে এক রাত্রে নৌকা যাচ্ছে গঙ্গা বেয়ে যাচ্ছে কাশী, দক্ষিণদেশী যত ছেনাল মেয়ে”—সে যুগের কলকাতার সমস্ত বেশ্যাপল্লী ও বারবনিতাদের এক বিচিত্র হাস্যোদ্দীপক তালিকা পাওয়া যায়। বা সীতা-অন্বেষণে এই পঙক্তি —
“সতীদের অন্ন জোটে না বেশ্যাদের জড়ােয়া গহনা।
…
সৃষ্টি সব সৃষ্টি ছাড়া
বাজিয়ে জড়ােয়া গহনা
পণ্ডিতে চণ্ডী পড়ে
দক্ষিণা পান চারটি আনা।”৩৯
পণ্য বেচাকেনার সমাজে, নতুন মূল্যবােধের আবহাওয়ায় অনুগত স্ত্রীর থেকে বেশ্যার মূল্য বেশি, চণ্ডীপাঠ থেকে বাজনাদারের চাহিদা বেশি। গান-বাজনা আর লােক-শিল্পীদের বিনােদন পরিবেশনের শৌখিন নেশা থাকছে না, আকর্ষণীয় অর্থাগমের পেশাতে পরিণত হচ্ছিল উনিশ শতকের মধ্য থেকেই। ওই শতকের শুরুতে কেষ্টা মুচি, ভােলা ময়লারা নিজেদের জাত-ব্যবসা অনুসরণ করতেন এবং অবসর সময়ে গান গাইতেন। কিন্তু পরবর্তী যুগে গােপাল উড়ের যাত্রা আর শখের ছিল না যাত্রা হইতে গােপালের জীবিকা নির্বাহ হইত। গােপালের সমসাময়িক পাঁচালীকার দাশু রায়কে,
“প্রথমে লােকে…তিনটি মাত্র টাকা দিয়ে পাঁচালীর গান করাইত, শেষে শত মূদ্রা দিতে স্বীকৃত হইলেও সেই দাশরথী তাহাদের দুপ্রাপ্য হইয়াছিলেন।”৪০
সন্ধ্যা হলেই নগর কলকাতাকে নাগর-কলকাতা বলে মনে হত। তত্ত্ববেধিনী পত্রিকায়৪১ বলা হয়েছে,
“সন্ধ্যার পর নগর মধ্যে পাপের মহােৎসব উপস্থিত কোন স্থানে বহু ব্যক্তি দলবদ্ধ হইয়া গণিকার গৃহে প্রবেশ করিতেছে, কুত্রাপি কোন বাবুর কদাচারের সাক্ষী স্বরূপ অর্থ যান তঁাহার রক্ষিতা বেশ্যা দ্বারে স্থাপিত রহিয়াছে কোন কোন বেশ্যার আলয় হইতে মাদকোন্মত্ত সমূহ লম্পটের উল্লাস কোলাহল ধ্বনিত হইতেছে, কুত্রাপি গণিকার অধিকার জন্য বিমােহিত পুরুষেরা বিবাদ কলহ সংগ্রামে প্রাণপণে প্রবৃত্ত হইতেছে।”৪২
বাঈজী কালচার এবং সেকালের কলকাতার ‘বাবু’ সম্প্রদায় [পর্ব ২]
তথ্যসূত্র :
- ১. ভােলানাথ চন্দ্র, ট্রাভেল অফ এ হিন্দু, লন্ডন, ১৮৬৯, পৃ. ৬৮।
- ২. নারায়ণ দত্ত, জন কোম্পানীর বাঙালি কর্মচারী, কলকাতা, ১৯৭৩, পৃ. ১৩।
- ৩. আবদুল মওদুদ, মধ্যবিত্ত সমাজের বিকাশ সংস্কৃতির রূপান্তর, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ঢাকা ১৯৮২, পৃ. ২৮২।
- ৪. বিনয় ঘােষ, টাউন কলকাতার কড়চা, বিহার সাহিত্য ভবন, কলকাতা, ১৯৬১, পৃ. ৯০-৯১।
- ৫. Ramesh Chandra Majumdar, British Paramountcy and India Rennaisance, Part- II, Calcutta, P. 4.
- ৬. রাধারমন রায়, কলকাতা বিচিত্রা, দেব সাহিত্য কুটীর, কলকাতা, ১৯৯১, পৃ. ২৩৫-২৮৩।
- ৭. বিনয় ঘােষ, মেট্রোপলিটন মন মধ্যবিত্ত বিদ্রোহ, ওরিয়েন্ট লংম্যান, ৫ম মুদ্রণ, কলকাতা, ১৯৯৯, পৃ. ৮৭।
- ৮. বিনয় ঘােষ, টাউন কলকাতার কড়চা, বিহার সাহিত্য ভবন, কলকাতা, ১৯৬১, পৃ. ৭৭-৮৮।
- ৯. প্রভাতকুমার মুখােপাধ্যায়, রামমােহন ও তৎকালীন সমাজ ও সাহিত্য, কলকাতা, ১৯৭২, পৃ. ৭৫।
- ১০. কিশােরীচাদ মিত্র, দ্বারকানাথ ঠাকুর দ্বিজেন্দ্রলাল নাথ কর্তৃক ‘মেমােয়ার অফ দ্বারকানাথ টেগাের’ গ্রন্থের অনুবাদ, কলকাতা, পৃ. ১০।
- ১১. ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, সংবাদপত্রে সেকালের কথা, ১ম খণ্ড, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ, কলকাতা, পৃ. ১৯২।
- ১২. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, দ্য পার্মানেন্ট সেটেলমেন্ট ইন বেঙ্গল ১৭৯০-১৮১৯ আরাে দেখুন-সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, বাংলার ইতিহাস ঔপনিবেশিক শাসন কাঠামাে, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ১৯৮৯ পৃ. ১৭৩।
- ১৩. বিনয় ঘােষ, কলকাতা শহরের ইতিবৃত্ত, বাক সাহিত্য, কলকাতা, ১৯৯১, পৃ. ৪৬৮-৭৮।
- ১৪. বিনয় ঘােষ, কলকাতা শহরের ইতিবৃত্ত, বাক সাহিত্য, কলকাতা, ১৯৯১, পৃ. ১৩৩।
- ১৫. অতুল সুর, ৩০০ বছরের কলকাতা পটভূমি ও ইতিকথা, কলকাতা, পৃ. ৩৩-৩৫।
- ১৬. Girish Chunder Ghose, A Lecture on the life of Ramdulal Dey, The Bengali Million
- aire etc, Belur 1886.
- ১৭. স্বপন বসু, বাংলায় নবচেতনার ইতিহাস, পুস্তক বিপণি, কলকাতা, ২০০০, পৃ. ২২।
- ১৮. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, সূর্যাস্ত আইনের সামাজিক তাৎপর্য, ঢাকা বিথবিদ্যালয় পত্রিকা, আষাঢ় ১৩৮৫।
- ১৯. বিনয় ঘােষ, বিদ্যাসাগর ও বাঙালি সমাজ, ওরিয়েন্ট লংম্যান, কলকাতা, ১৯৮৪, পৃ. ৬।।
- ২০.K.M. Banerjee, The Persecuted, Act 3, Scene 1.
- ২১. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত, প্যারিচঁাদ রচনাবলী, কলকাতা, পৃ. ১৭৩।
- ২২. কালীপ্রসন্ন সিংহ, হুতােম প্যাচার নকশা, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ, কলকাতা, পৃ. ৯৪।
- ২৩. ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, সংবাদপত্রে সেকালের কথা, দ্বিতীয় খণ্ড, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ, কলকাতা, পৃ. ২৬৭-৬৯।
- ২৪. সমাচার দর্পণ, ৫ নভেম্বর ১৮৩১।
- ২৫. দেখুন- বিধানাথ জোয়ারদার, অন্য কলকাতা, আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা, ২০১১, পৃ. ৯৯।
- ২৬. The India Gazette, 22 October 1831.
- ২৭. সমাচার দর্পণ, ১৩ অক্টোবর, ১৮৩২।
- ২৮. দেখুন- বিধানাথ জোয়ারদার, অন্য কলকাতা, আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা, ২০১১, পৃ. ৯৯-১০১।
- ২৯. শিবনাথ শাস্ত্রী, আত্মচরিত, কলকাতা, ১৯৫৭, পৃ. ৫৫-৫৬।
- ৩০. বিনয় ঘােষ, বিদ্রোহী ডিরােজিও, প্রথম সংস্করণ, কলকাতা, ১৯৬১, পৃ. ৪৪।
- ৩১. বিনয় ঘােষ, বিদ্যাসাগর ও বাঙালি সমাজ, ওরিয়েন্ট লংম্যান, কলকাতা, ১৯৮৪, পৃ. ২৫।
- ৩২. ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, সংবাদপত্রে সেকালের কথা, ১ম খণ্ড, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ, কলকাতা, পৃ. ৯৬।
- ৩৩. বিনয় ঘােষ, বিদ্যাসাগর ও বাঙালি সমাজ, ওরিয়েন্ট লংম্যান, কলকাতা, ১৯৮৪, পৃ. ২৯৮।
- ৩৪. অতুল সুর, কলকাতা পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস, কলকাতা, পৃ. ১৮৫।
- ৩৫. ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, সংবাদপত্রে সেকালের কথা, ১ম খণ্ড, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ, কলকাতা, পৃ. ২৩৯।
- ৩৬. আবুল কাশেম চৌধুরী, বাংলা সাহিত্যে সামাজিক নক্শা পটভূমি ও প্রতিষ্ঠা, ১৮২০-১৮৪৮, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ১৯৮২, পৃ. ৯১।
- ৩৭. শিবনাথ শাস্ত্রী, রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ, বিধবাণী, কলকাতা, ১৯৮৩, পৃ. ৫৬।
- ৩৮. প্যারীচাঁদ মিত্র, ডেভিড হেয়ারের জীবনচরিত অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত, প্যারীচাদ রচনাবলী, কলকাতা, পৃ. ৪৫৯।
- ৩৯. হরিপদ চক্রবর্তী, বিকোষ, ৪র্থ ভাগ, ১৩০০, কলকাতা, পৃ. ৩৭৫।
- ৪০. সুমন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়, বাঈ নাচ বনাম খেমটা নাচ দেখুন- উনিশ শতকের কলকাতা ও সরস্বতীর ইতর সন্তান, অনুষ্টুপ, কলকাতা, ২০০৮, পৃ. ৭৯।
- ৪১. ‘তত্ত্ববেধিনী পত্রিকা’, ১ শ্রাবণ ১৭৬৮ শকাব্দ, ১৮৪৬ খ্রীঃ, ৩৬ সংখ্যা।
- ৪২. বিনয় ঘােষ, সাময়িকপত্রে বাংলার সমাজচিত্র, ২য় খণ্ড, প্যাপিরাস, কলকাতা, ১৯৭৮, পৃ. ১০১।
‘নবজাগরণ’ অ্যান্ড্রোয়েড অ্যাপ্লিকেশনটি প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর টেলিগ্রাম চ্যানেলে জয়েন হতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর ফেসবুক পেজে লাইক করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।