ইতিহাসের মিথ্যা কথন শুধু যে ইতিহাসের উদ্দেশ্যকেই খাটো করে তা নয়, বিপন্ন হয় দেশের বহুত্ববাদী আদর্শও। ইতিহাস বিকৃত হলে মাসুল গুণতে হয় জনগণকেই। অন্ধবিশ্বাস আর আবেগ দিয়ে ইতিহাস হয় না। তা যদি হয়, তাহলে সেটা হতে পারে উপন্যাস, ইতিহাস নয়। ইতিহাসের বহু অতিকথা ভিত্তিহীন প্রমাণিত হয় যুগের সঙ্গে সঙ্গে গবেষণার বিকাশ ও নানা অজানা তথ্য উন্মােচনের মধ্য দিয়ে। বহু অভিনব মাত্রা সংযােজিত হয়ে আলােকিত হয় অন্ধকারময় ইতিহাস। মধ্যযুগের ভারত ইতিহাসের ক্ষেত্রে এমনটাই যেন বেশি ঘটেছে। গবেষণালব্ধ ধর্মনিরপেক্ষ ইতিহাসচর্চা উচ্চতর শ্রেণির পাঠ্যসূচির বাইরে অন্তর্ভুক্ত না হওয়ায় সর্বজনপাঠ্য ইতিহাস গ্রন্থের ব্যাপক পাঠক এখনও আগেকার ভুলই আওড়ে চলেছে। আর পক্ষপাতদুষ্ট ইতিহাসের এই পাঠই মৌলবাদী রাজনীতিবিদদের জন্যে উর্বর ক্ষেত্র তৈরি রাখছে, যেখানে তাঁরা হিংসা-বিদ্বেষের বীজ নিয়ত বুনে চলেছেন। যদি এই ধ্বজাধারীরা সংঘ পরিবার পােষিত হন তাহলে তাে আর কথাই নেই। স্বাধীনতার পর হতেই তারা সারা দেশে ‘ভারত ধারণা’কে পুনর্নির্মাণ করে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি হতে একে নতুন রূপ দেওয়ার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।
মােঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব এখন তাদের অন্যতম টার্গেট। এমনকি যারা সরাসরি তথাকথিত হিন্দুত্ববাদী নন। এমন ঐতিহাসিকরা আওরঙ্গজেবকে এই বলে চিহ্নিত করেন যে, তিনি বহু হিন্দু ও জৈন মন্দির ভাঙতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন অসহিষ্ণু ও ক্ষমতালােভী। ইসলাম রক্ষার নামে নিজ ভ্রাতা দারাশিকোহ সহ অন্য ভাইদের হত্যা করেন। বাবাকে বন্দী করেন। মুসলিম নন এমন বিধর্মীদের উপর তিনি জিজিয়া কর বাধ্যতামূলক বসিয়েছিলেন। শিখগুরু তেগবাহাদুরকে খুন করিয়েছেন ইত্যাদি ইত্যাদি। এভাবে পরিপ্রেক্ষিত বাদ দিয়ে সংঘ সমর্থকরা ইতিহাসের চরিত্রের দ্বান্দ্বিক মূল্যায়ন অস্বীকার করে আওরঙ্গজেব সম্পর্কে একপেশে ইতিহাস লিখছে। কিন্তু মনগড়া ইতিহাস লিখলে তাে আর হয় না। নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গি দরকার। দেখতে হবে ঐতিহাসিক চরিত্রের মূল্য নিরুপণে যেন ধর্মীয় বৈষম্যের অনুপ্রবেশ না ঘটে। দেখতে হবে ঐতিহাসিকেরা যে সব তথ্য আমদানি করছেন সেগুলি সত্য বা বিজ্ঞানসম্মত, সর্বোপরি পক্ষপাতশূন্য কিনা। এভাবে বহু অন্ধকারাচ্ছন্ন অধ্যায় ও ঘটনার উপর নিয়ত গবেষকগণ আলাে ফেলছেন। বেরিয়ে আসছে বহু অজানা তথ্য। পুরনাে চিন্তা তাতে নড়ে যাচ্ছে। মেনে নিতে হচ্ছে পছন্দ হচ্ছে না এমন বহু তথ্যই। এভাবেই সংশােধনের মাধ্যমে ইতিহাসের বিশুদ্ধতার ধারা যে বজায় রয়েছে তার সাম্প্রতিক উদাহরণ হল-ইংল্যান্ডের নিউজার্সির রুটগেরন বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশিয়ার। ইতিহাসের অধ্যাপক অড্রে ট্রুস্কে এর ‘আওরঙ্গজেব: দ্য ম্যান অ্যান্ড দ্য মিথ’ নামক গ্রন্থটি। এখানে সম্রাট আওরঙ্গজেবকে নিয়ে নতুন করে জানতে-বুঝতে প্রয়াস চালিয়েছেন ঐতিহাসিক অড্রে ট্রুস্কে।
সম্রাট আওরঙ্গজেবের আমলে মােঘল সাম্রাজ্য সবচেয়ে বেশি প্রায় ৪০ লক্ষ বর্গ কিমি জুড়ে বিস্তৃত ছিল, ছিল বিশ্বের সর্ববৃহৎ অর্থনীতি ও উৎপাদনশীল অঞ্চলও। পাঁচ দশকের শাসনামলে সাম্রাজ্যের ১৬ কোটি বাসিন্দার জীবনে সুখ-শান্তি ও সুশাসন নিশ্চিত করতে ক্ষমতাধর এই সম্রাট যে অনাড়ম্বর ও সাদাসিধে জীবনযাপন করেছেন, তা আজও বিশ্বের শাসকগােষ্ঠীর জন্য অনুকরণীয়। দুঃখের বিষয়, এই সম্রাটকে ইতিহাসে তার প্রাপ্য সম্মান দেওয়া হয়নি। তিনি ভারত ইতিহাসে সাধারণভাবে ধিকৃত ও নিন্দিত। এক্ষেত্রে দেশি-বিদেশি গবেষকগণ যেভাবে গলদঘর্ম করেছেন। তার তুলনায় কম আলােচিত হয়েছে তার সময়ের নানা বৌদ্ধিকচর্চা ও পরধর্মসহিষ্ণুতার মতাে উজ্জ্বল দিকগুলি। আওরঙ্গজেবকে মহৎ দেখাবার জন্য বলছি না। ত্রুটি-বিচ্যুতি, অপরাধগুলিকে মান্যতা দিয়ে একথা বলা যায় তার কাজ সম্পর্কে খােলামনে পর্যালােচনা ও সমালােচনা করা উচিত। আওরঙ্গজেব চরিত্রের অনেক অজানা দিক এখন বেশ কিছু ঐতিহাসিক তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন ও করছেন। ব্রিটিশ ঐতিহাসিক উইলিয়াম ডালরিম্পল ২০১২ সালে প্রকাশিত ‘প্রিন্সেস অ্যান্ড পেইন্টার ইন মুঘল দিল্লি ১৭০৭-১৮৫৭’ গ্রন্থের ভূমিকায় (গ্রন্থটি তিনি যুথিকা শর্মার সঙ্গে সহসম্পাদনা করেছেন) লিখেছেন:
Aurangzeb’s rule was less tyranical than previously thought. He was a pragmatic ruler who frequently patronised Hindu Institution.’
তাঁর মতে, আওরঙ্গজেবকে নতুনভাবে পড়া উচিত। তার আমলে একদিকে যেমন কোনও দাঙ্গার ঘটনা ঘটেনি তেমনি তিনি তার সৈন্যদলকে তরবারির জোরে ধর্মান্তকরণ করার নির্দেশ দেননি। রাজমােহন গান্ধী তাঁর ‘পাঞ্জাব: এ হিস্টরি ফ্রম আওরঙ্গজেব টু মাউন্টব্যাটেন’ গ্রন্থে আওরঙ্গজেবের রাজনৈতিক বিচক্ষণতার প্রশংসা করেছেন। বলেছেন, আজকের আধুনিক অর্থে আওরঙ্গজেবকে নিরপেক্ষ বলা যায় না। সেই অর্থে কিন্তু সমান কঠিন অন্য সম্রাটদের বিশেষ করে সম্রাট আকবরকেও নিরপেক্ষ বলা—তাঁরা যতটা অসাম্প্রদায়িক ছিলেন, আওরঙ্গজেবও ততটাই।
ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকার আওরঙ্গজেবকে নিয়ে অসামান্য সব গ্রন্থ লিখেছেন। পরিতাপের বিষয় হল, ঔপনিবেশিক উপমহাদেশের ইতিহাসে সরাসরিভাবে তাঁকে ঘৃণিত ও বিতর্কিত চরিত্র হিসেবে তুলে ধরার অন্যতম প্রতিভূ হয়ে ওঠেন স্বয়ং যদুনাথ সরকারই। তিনি স্বজ্ঞানেই তথ্যকে বিকৃত করার মাধ্যমে উদ্দেশ্যপ্রণােদিতভাবে আওরঙ্গজেবের চরিত্রকে হীনভাবে অঙ্কন করেছেন। এতদিন ধরে আওরঙ্গজেবকে নিয়ে তিনিই শেষকথা বলে এসেছেন। এছাড়া ইলিয়ট ও ডওসনের ‘হিস্টরি অফ ইন্ডিয়া আজ টোল্ড বাই ইটস ওন হিস্টরিয়ানস’, শ্রীরাম শর্মার ‘দ্য রিলিজিয়াস পলিসি অফ দ্য মুঘল এম্পাররস’, এ এল শ্রীবাস্তবের ‘দ্য মুঘল এম্পায়ার প্রভৃতি গ্রন্থে আওরঙ্গজেবের ধর্মনীতিতে হিন্দু-বিদ্বেষকে বিশদভাবে দেখাবার চেষ্টা করা হয়েছে। ইউরােপীয় পর্যটক ও লেখকগণ আরবি-ফারসি গ্রন্থের বক্তব্য ইংরেজিতে অনুবাদ করতে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রে প্রকৃত অর্থ প্রকাশ করতে ব্যর্থ হয়েছেন। ফলে তাঁদের বিবরণগুলি ও গ্রন্থগুলি খুঁটিয়ে ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ হতে বিশ্লেষণ না করে গৃহীত হওয়ায় আওরঙ্গজেব সম্পর্কে বিতর্ক আরও জোরালাে হয়েছে। তাছাড়া যদুনাথ সরকার ও শ্রীরাম শর্মা প্রমুখের মতাে প্রখ্যাত ঐতিহাসিকরাও আকর উপাদানগুলি যথাযথ ব্যবহার না করায় চরম ঐতিহাসিক সত্য বহু ক্ষেত্রে বিকৃত হওয়ার সুযােগ পেয়েছে। দেখা যাচ্ছে, যদুনাথ সরকার প্রমুখ ঐতিহাসিকগণ যেভাবে আওরঙ্গজেবকে উপস্থাপন করেছেন, শাসক ও মানুষ হিসেবে তিনি তার থেকে ছিলেন অনেকটাই আলাদা।
যদুনাথ সরকার প্রমুখ ঐতিহাসিকগণের প্রতি যথােচিত সম্মান জানিয়ে বলা যায় যে, তাঁদের চিত্রিত আওরঙ্গজেব বেশ সাম্প্রদায়িক রঙে রাঙানাে এবং বহু স্থানে বিভ্রান্তি চোখে পড়ার মতাে। শিবলী নােমানী, আতাহার আলি, ইকতিদার আলম খান, ইরফান হাবিব, সতীশচন্দ্র, হরবংশ মুখিয়া, রেখা যােশী, বি এন পাণ্ডে, জ্ঞানচন্দ্র, আর এম ইটন প্রমুখগণের উত্তরসূরি হিসেবে ঐতিহাসিক অড্রে ট্রুস্কে তাঁর ‘আওরঙ্গজেব’-এ অপূর্ব তাত্ত্বিকতায় অকপটভাবে যদুনাথ সরকার প্রমুখ ঐতিহাসিকগণের মিথ্যাচারিতার অকাট্য জবাব দিয়েছেন। ঐতিহাসিক দীপেশ চক্রবর্তীর মতাে ঐতিহাসিকও আওরঙ্গজেব-বিরােধিতার মতাে অস্বস্তিকর বিষয়টি তার ‘দ্য কলিং অফ হিস্টরি: স্যার যদুনাথ সরকার অ্যান্ড হিজ এম্পায়ার অফ টুথ’ গ্রন্থে সুচতুরভাবে এড়িয়ে গেছেন। অথচ আওরঙ্গজেবের সময়েই সম্রাট আকবরের সুল-ই-কুল নীতির বাস্তব প্রয়ােগের প্রকৃষ্ট উদাহরণ লক্ষ্য করা যায়।
আওরঙ্গজেবের শাসনকাল যে ধর্মান্ধতায় আচ্ছন্ন ছিল না, বরং বিদ্যাচর্চায় বিপুল উৎসাহ দান করতাে তার কৌতুহলােদ্দীপক নানা উদাহরণ সব বিধৃত হয়েছে চন্দ্রভান ব্রাহ্মণ বিরচিত ইতিহাসে। চন্দ্রভান ছিলেন মুঘল দরবারে কর্মরত অন্যতম আমলা বা রাজকর্মচারী। তিনি ফারসিতে লিখেছেন—দরবারি স্মৃতিকথা ‘চাহার চমন’ (‘চার বাগান’), বিভিন্ন নামে লেখা বহু ব্যক্তিগত চিঠিপত্র সংকলন এবং ‘মুনসাৎ-ই-ব্রাহ্মণ’ ইত্যাদি গ্রন্থ। চন্দ্রভানের উপলব্ধি: প্রশাসনিক সাফল্য কেবল সামরিক কর্তৃত্বের উপর নির্ভর করে না, তার সঙ্গে থাকে প্রশাসনিক দক্ষতা, গভীর সংবেদনশীলতা আর সর্বোপরি নিঃস্বার্থভাবে জনহিতৈষী কাজ করার মানসিকতা ও কর্ম বিষয়ে তদারকি।
অসাধারণ মুন্সিয়ানায় অড্রে ট্রুস্কে তাঁর ‘আওরঙ্গজেব’ গ্রন্থে মূলত ‘চন্দ্রভানের উপলব্ধি’ গুলি নানা দুষ্প্রাপ্য তথ্য-উপাত্ত দিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করেছেন। বিশ্লেষণ করেছেন শাসক ও তার কর্মচারীর পারস্পরিক সম্পর্ককেও, যে সম্পর্কের উপর নির্ভর করে সাম্রাজ্যের স্থায়ীত্ব।
কর্মচারীদের প্রতিপক্ষপাতশূন্য মনােভাব আওরঙ্গজেবের বহু পাণ্ডুলিপিতে বিস্তৃত হয়েছে, যা খুবই তাৎপর্যবাহী। একদা কোনাে এক ব্যক্তি আওরঙ্গজেবকে এই মর্মে দরখাস্ত করে যে, হিন্দু রাজা ও অন্যান্যরা যারা সরকারি কাজে নিযুক্ত রয়েছে তাদের স্থানে মুসলিম কর্মচারী নিয়ােগ করা হােক। প্রত্যুত্তরে আওরঙ্গজেব বললেন:
“এইসব জাগতিক ব্যাপারের সঙ্গে ধর্মের সম্পর্ক কী?…তােমার জন্য তােমার ধর্ম, আমার জন্য আমার ধর্ম। যদি (তােমাদের কথা মতাে) এই নিয়ম চালু করা হয়, তাহলে আমায় তাে সকল (হিন্দু) রাজা ও তাদের অনুগামীদের ধ্বংস করে ফেলতে হবে।” আর এক চিঠিতে তিনি ঘােষণা করেন: “কারাে ধর্ম নিয়ে আমাদের কি চিন্তা থাকতে পারে? যীশুকে তাঁর ধর্ম অনুসরণ করতে দাও, আর মােজেসকে তার নিজের ধর্ম।”
আসলে আবুল ফজলের সার্বভৌমিকতা তত্ত্বের মূলনীতিগুলি যে মুঘল রাষ্ট্রনীতিতে বিশেষ করে ‘আওরঙ্গজেবের রাষ্ট্রনীতিতেও স্থায়ীভাবে স্থান পেয়েছিল তা আরও প্রমাণিত হয় যদুনাথ সরকারের “আহকাম-ই-আলমগিরি’ গ্রন্থে সংরক্ষিত আওরঙ্গজেবের এমন সব বিভিন্ন উক্তি থেকে।
উল্লেখ্য যে, যদুনাথ সরকারের মতাে জাতীয় ঐতিহাসিক আওরঙ্গজেবের ধর্মনীতির পক্ষপাতদুষ্ট ব্যাখ্যা দেওয়ায় তাঁর আলােচনায় মূল ইতিহাসের অন্যান্য দিক যেমন-অর্থনৈতিক সংকট, জায়গীরদারি সংকট, মনসবদারি সংকট, কৃষি সংকট, অভিজাতদের দল ও রাজনীতি প্রভৃতি বিষয়গুলি উপেক্ষিত হয়েছে। স্বাধীনতার প্রাক্কালে পরাধীন ভারতবর্ষে ১৯৪৩-এ শ্রীরাম শর্মা ব্রিটিশ ঐতিহাসিকদের অনুসরণে তাঁর বিখ্যাত ‘দ্য রিলিজিয়াস পলিসি অফ দ্য মুঘল এম্পাররস’ গ্রন্থটি লেখেন। তখনও পর্যন্ত এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে গবেষণাধর্মী তথ্যনির্ভর বই একটিও ছিল না। সঙ্গত কারণেই শ্ৰী শৰ্মার কাজটি বহু বছর ধরে বিশেষ ক্ষেত্রে আদৃত হয়েছে। বর্তমানে মধ্যযুগের ইতিহাসের প্রখ্যাত গবেষক মহম্মদ আতাহার আলি গ্রন্থটি সমীক্ষা করে বলেছেন, বইটির অন্যান্য অংশের মতাে আওরঙ্গজেব সম্পর্কে আলােচনার শেষে সংযােজিত টীকাগুলিতেও বড় রকমের ভুল ও অসঙ্গতি থেকে গেছে।
শ্রীরাম শর্মা হিন্দু প্রজাদের সঙ্গে আওরঙ্গজেবের ব্যবহারের কথা উল্লেখ করতে গিয়ে হিন্দু মন্দির ধ্বংসের কথা উল্লেখ করেছেন। কিন্তু আধুনিক ঐতিহাসিকগণ আওরঙ্গজেবের ধর্মনীতিকে এক নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁদের মতে, আওরঙ্গজেবের মন্দির ধ্বংসের পিছনে ধর্মের ভূমিকা ছিল গৌণ। তাঁর মন্দির ধ্বংসের কাহিনি কিছু বিক্ষিপ্ত ঘটনার উপর গড়ে উঠেছে বলে মনে করেন পার্সিভ্যাল স্পীয়ার ও সতীশচন্দ্র। ঐতিহাসিক অড্রে ট্রুস্কে এর অভিমতও তাই। এটা ভাবা ভুল যে, মন্দির ধ্বংস করার জন্য কোনাে সাধারণ সরকারি আদেশ বা ফরমান জারি করা হয়েছিল। বিখ্যাত বেনারস ফরমানে তিনি হিন্দুদের ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার সুনিশ্চিত করেন। তবে অপ্রিয় কাজ আওরঙ্গজেব করতে বাধ্য হয়েছেন আইনশৃঙ্খলাগত কারণে, কারও প্রতি বিদ্বেষবশত নয়। অড্রে ট্রুস্কে যথার্থই বলেছেন:
“…আওরঙ্গজেব হিন্দুদের অপছন্দ করতেন বলে তিনি হিন্দু মন্দির ভেঙ্গেছেন, দাবিটিতে বিন্দুমাত্র সারবত্তা নেই। আওরঙ্গজেবের সময়ে উপমহাদেশ জুড়ে কয়েক হাজার হিন্দু মন্দির ছিল, অথচ মাত্র বারাে-চৌদ্দটি কেন ধ্বংস হল কেন? কেন বেশি হল না? …আওরঙ্গজেবের শাসনকালে যদি কেউ নির্মোহ ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে নজর দেন তাহলে তিনি দেখতে পাবেন, তিনি যে কয়েকটা মন্দির ধ্বংস করেছেন, তার অনেক বেশি তিনি রক্ষা করেছেন।” (পৃ. ১০৬-১০৭)।
সেকালে মন্দিরগুলি ব্যবহৃত হত রাষ্ট্রবিরােধী ষড়যন্ত্র রচনার নিরাপদ ঘাঁটি হিসেবে। কোনাে রাষ্ট্রনায়কের পক্ষে যা বরদাস্ত করা সম্ভব নয়। শান্তিভঙ্গের আশঙ্কায় ও বিদ্রোহ দমনের উদ্দেশ্যে সেখানে সেনাবাহিনী পাঠানাে হত। ফলে ধর্মস্থান ভঙ্গ হত বা আক্রান্ত হত যুদ্ধের নিয়মেই।
১৬৫৯ থেকে ১৬৯৯-এর মধ্যে আওরঙ্গজেব এলাহাবাদের সােমেশ্বরনাথ মহাদেব মন্দির, উজ্জয়িনীর মহাকালেরশ্বর মন্দির, চিত্রকুটের বালাজি মন্দির, গুয়াহাটির উমানন্দ মন্দির, মহারাষ্ট্রের নানদেড় জেলার মােহনপুরের দত্তাত্রেয় গুরু মন্দির, পুণের গণপতি মন্দির, আমেদাবাদের শত্রুঞ্জয় জৈন মন্দির, কাশীর জঙ্গমবাড়ীর শিব মন্দির, অযােধ্যার দম্ভধাবন মন্দির, ভারতের প্রাচীনতম নাগেশ্বর মন্দির, আবু পাহাড়ে অবস্থিত মন্দির, জুনাগড়ের মন্দির (গানার), দেরাদুনের গুরুদোয়ারা এবং একাধিক শিখ গুরুদেয়ারা প্রভৃতি ধর্মীয় উপাসনাগার নির্মাণের ক্ষেত্রে ফরমান জারি করে জায়গির দান করেছিলেন। এভাবে বহু বিখ্যাত ধর্মস্থানে তিনি অর্থও দান করেছেন—কখনও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য, কখনও মন্দিরগুলির নির্মাণ কাজ বা মন্দিরগুলির দুরবস্থা ঘােচানাের জন্য। আর এম ইটনের এক তথ্য হতে জানা যায় যে, আওরঙ্গজেবের আমলে (১৬৫৮-১৭০৭) শুধু বাংলাতেই নির্মিত হয়েছিল ৫০টিরও বেশি ইটের বড় বড় নতুন মন্দির। তপন রায়চৌধুরী এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন যে, হুগলি জেলার তারকেশ্বরের মন্দিরের জমিটা খােদ আওরঙ্গজেবেরই দেওয়া। নীতিনিষ্ঠ হিসেবে সম্রাট আওরঙ্গজেব ঠিক করে নিয়েছিলেন, রাষ্ট্রীয় নির্দেশনায় (‘নিশান) কিভাবে অমুসলমান ধর্মীয় সম্প্রদায় ও প্রতিষ্ঠানগুলিকে দেখবেন। একটি কৌতুহলােদ্দীপক নিশান বা রাজাদেশ ভদয়পুরের নাথি থেকে আলােয় এসেছে, যেটি আওরঙ্গজেব মেবারের রাণা রাজসিংহকে পাঠিয়েছিলেন। রাণাকে সহানুভূতির প্রতিশ্রুতি দিয়ে এবং মণ্ডলগড়ের ‘পরগণা’ ইত্যাদির অধিকার পুনরুদ্ধারের স্বীয় সঙ্কল্প জ্ঞাপন করে আওরঙ্গজেব ঘােষণা করেন:
“অনুগতরা (অর্থাৎ রাণা) সহস্র রাজকীয় অনুগ্রহের প্রাপক হইয়াছেন।…মনােযােগ এখন ইহাতে নিবেদিত যে, বিভিন্ন সম্প্রদায় ও পৃথক ধর্মসমূহ শান্তির জগতে বাস করিবে, সমৃদ্ধির দিনযাপন করিবে এবং কেহই। অপরের বিষয়ে হস্তক্ষেপ করিবে না। গগনচুম্বী-গৌরবের অধিকারী এই গােষ্ঠীর (নৃপতিকূল) যে কেহই পরমতঅসহিষ্ণুতার আশ্রয় লহিয়াছেন, বৃহৎ সংখ্যক জনগণের বিরােধ-সংঘাত-ক্ষতির কারণ হইয়াছেন, যাঁহারা বাস্তবিকই ঈশ্বরের নিকট হইতে প্রাপ্ত কর্মর্ভর—প্রকৃতপক্ষে তিনি (সেইরূপ নৃপতি) ইহার দ্বারা ঈশ্বরের সমৃদ্ধশালী সৃষ্টি বিনষ্ট এবং ঈশ্বরের গঠন-বিন্যাসের ভিত্তি ধ্বংস করিতে প্রয়াসী হইয়াছেন, ইহা সেইরূপ অভ্যাস যাহা প্রত্যাখ্যাত ও দূরীভূত হইবার যােগ্য। ঈশ্বরের সম্মতি সাপেক্ষে, যখন সত্য স্বতঃস্ফূর্ত হইবে এবং আন্তরিক অনুগতদের আকাঙ্খা পূর্ণ হইবে। (অর্থাৎ আওরঙ্গজেব সিংহাসন লাভ করলে), ভক্তিমানের নিকট শ্রদ্ধেয় মদীয় পূর্বপুরুষকুল দ্বারা অনুসৃত সম্মতি প্রথা ও প্রতিষ্ঠিত বিধিসমূহ চতুষ্কোণ জন-অধ্যুষিত পৃথিবীর উপর ঔজ্জ্বল্য পাত করিবে।”
অর্থাৎ ফরমানে আওরঙ্গজেব বলেন, বিভিন্ন ধর্মের মানুষেরা শান্তির ছায়ায় বাস করুক, তারা স্বচ্ছলতায় জীবনযাপন করুক, কেউ যেন কারাের কাজকর্মে ব্যাঘাতসৃষ্টি না করে। আমরা যদি ফরমানটার মূল ভাবনাটা পড়ার চেষ্টা করি তাহলে দেখব, আওরঙ্গজেব বলার চেষ্টা করেছেন, সম্রাট হিসেবে তিনি নানান ধর্মীয় গােষ্ঠীর মধ্যে শান্তি বজায় রাখার কাজে দায়িত্বপ্রাপ্ত। আর সম্রাট যে পূর্বসূরি অনুসৃত রাষ্ট্রনীতি পরিবর্তন করার ইচ্ছা পােষণ করেন না, এটা সেই অঙ্গীকারই। একজন মানুষ যিনি সেই সময়ে ধর্মীয় রণহুঙ্কার দিচ্ছেন, তিনি কি এরূপ ঝংকৃত স্বরে পরমত-অসহিষ্ণুতা বা ধর্মীয় পক্ষপাতের প্রচেষ্টাকে ভৎর্সনা করবেন? এই ঘােষণাকর্মে আওরঙ্গজেব আন্তরিক ছিলেন কিনা তা বিবেচ্য নয়। তাৎপর্যপূর্ণ হল যে, তিনি ধর্মীয় বিতর্ক তীব্র করার পরিবর্তে নিজেকে সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রনীতিক হিসেবে তা এড়াতে উদগ্রীব ছিলেন।
অবশ্য ১৬৭২ সালে আওরঙ্গজেব এক আদেশনামা বলে হিন্দু ও অন্যান্য অমুসলিমদের জমি বা সম্পত্তি দানের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। এর পেছনে হিন্দু বিদ্বেষকে খোঁজা বােধহয় ঠিক নয়, হয়তাে এক্ষেত্রে কোনাে বিশেষ কারণ ছিল। নইলে এই সময়ে কিংবা তার আগে বা পরে আওরঙ্গজেব আবার বহু হিন্দুদের জমি বা সম্পত্তি দান করবেন কেন! এ ধরনের ৪৮টি দানপত্র সংগ্রহ করেছেন ঐতিহাসিক কালীকিঙ্কর দত্ত তার ‘সাম ফরমানাস, সনদস অ্যান্ড পরওয়ানাস’ গ্রন্থে। এই অনুদানগুলি সবই ছিল নিঃশর্ত ও স্থায়ী। গ্রহীতারা ছিলেন হিন্দু সন্ন্যাসী ও তাঁদের শিষ্যরা, বৃদ্ধ হিন্দু সৈনিক ও কানুনগােরা। প্রাপকদের মধ্যে যেমন ছিলেন হতদরিদ্র দুরন মিসরি, তেমনই করমুক্ত ৫৫বিঘা জমির গ্রহীতা লীলা ব্রাহ্মণ। বিনিময়ে এমনকি রাজানুগত্যের শর্তও তিনি দাবি করেননি।
আওরঙ্গজেব ব্যক্তিগতভাবে হিন্দু নেতাদের সঙ্গে যােগাযােগ রাখতেন। উদাহরণস্বরূপ অড্রে ট্রুস্কে তাঁর আলােচ্য গ্রন্থে লিখেছেন যে, ১৬৬১ সালে আওরঙ্গজেব মােহান্ত আনন্দ নাথকে চিঠি লিখে যােগীদের চিকিৎসা ব্যবস্থার কিছু ঔষধের অনুরােধ করেন। ১৬৬০ সালে তিনি পাঞ্জাবের গ্রামে আনন্দ নাথের জায়গিরের পরিমাণ বাড়িয়ে দেন। আমরা অনেকেই জানি না, ১৬৮০ সালে তিনি বৈরাগী শিব মঙ্গলদাস মহারাজের সঙ্গে ধর্ম আলােচনা করে তাকে উপহারে ভরিয়ে দেন। আওরঙ্গজেব একই ধরনের পৃষ্ঠপােষণার নীতি নিয়েছেন জৈন ধার্মিক সংগঠনের ক্ষেত্রেও। তিনি জৈনদের বিশেষ গােষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে থাকা তিনটি তীর্থক্ষেত্র শত্রুঞ্জয়, গিরনার এবং আবু পাহাড়ে জমি দান করেন। ১৬৫০-এর দশকের শেষের দিকে। জৈন সাধু লালা বিজয়কে পােলা (ধর্মস্থান) দান করেন ১৬৮১ সালের আগেই। ১৬৭৯ সালে তাদের জন্যে একটি উপায়ও (বিশ্রামস্থল) দান করেন। আওরঙ্গজেবের জন্যই জৈন সম্প্রদায় নিষ্কর ভূমিও পেয়েছিল। এক ঐতিহাসিক নথি থেকে জানা যায়, একবার দক্ষিণ ভারতের এক হিন্দু রাজার রাজ্য (মল্লারপুর) জয় করার পর আওরঙ্গজেবের সেনাবাহিনীর কেউ কেউ সেখানে মাংস খাওয়ার জন্য গােহত্যা করতে চাইলে তিনি গােহত্যা বন্ধের নির্দেশ দেন পাছে সেখানকার হিন্দু-প্রজারা অসন্তুষ্ট হন। ফরমানে বলা হয় যে, মল্লারপুর গােহত্যা করলে রাজদ্রোহ বলে গণ্য করা হবে।
আওরঙ্গজেবের আমলে সাধারণ রাষ্ট্রীয় নীতি ছিল হিন্দু সংগঠনগুলি আর তাদের কর্মকর্তাদের ভাল রাখা। রাজকর্মচারীদের প্রতিতার লেখা বেশ কয়েকটি ফরমানে স্পষ্ট নির্দেশ দিচ্ছেন, আবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপ থেকে মন্দিরগুলি বাচানাের এবং হিন্দু গােষ্ঠীদের জমি দান এবং হিন্দু ধর্মীয় নেতাদের ভাতা দেওয়ার। আওরঙ্গজেব তার দাদু সম্রাটদের অনুসৃত হিন্দু গােষ্ঠীকে সুযােগ-সুবিধে দেওয়ার প্রথা বহন করে নিয়ে যান নিজের রাজত্বের সময়েও। এই প্রথার উদাহরণ দেখা যায় শৈব জঙ্গম গােষ্ঠীর সঙ্গে তার সম্পর্কে। মােঘল পৃষ্ঠপােষকতা আকবরের সময় থেকে বিকশিত হতে থাকে। আকবর তাদের ১৫৬৫ সালে জমির অধিকার দেন। আওরঙ্গজেবের থেকে বেশ কিছু ফরমান পান জঙ্গম গােষ্ঠী ও অন্যেরা, যেখানে বলা হয়েছে—পূর্বে কোনাে কারণ না দেখিয়ে তাদের যেসব জমি দখল নেওয়া হয়েছিল সেগুলাে ফেরত দেওয়া হােক, স্থানীয় মুসলমান গােষ্ঠীর কবল থেকে তাদের বাঁচানাে হােক এবং বেআইনিভাবে তাদের থেকে যে রাজস্ব আদায় করা হয়েছিল সেগুলি ফিরিয়ে দেওয়া হােক। বাস্তবে তা কার্যকরী হয়েও ছিল। এক্ষেত্রে বলবাে ঐতিহাসিক অড্রে ট্রুস্কে আওরঙ্গজেবের ‘রিলিজিয়াস পলিসি’র যথার্থ ব্যাখ্যাদানে অসম্ভব সফল। তিনি সমালােচকদের বিষপূর্ণ তীরগুলিকে অনায়াসে তথ্যপূর্ণ যুক্তি দিয়ে ফালাফালা করেছেন। এখানেই অড্রে ট্রুস্কে এর বর্তমান গ্রন্থের সার্থকতা।
সম্রাট আওরঙ্গজেব যে বেশ সংস্কৃতিপ্রিয় ছিলেন তার বহু দুর্লভ উদাহরণ অড্রে ট্রুস্কে তার আলােচ্য গ্রন্থে তুলে ধরেছেন। বিশেষ করে সম্রাটের রামায়ণ প্রিয়তার কথা বলতে হয়। ১৬৯০ সালের প্রথম পাদে জনৈক কবি চন্দরমন রামায়ণের ফারসি অনুবাদ ‘নারগিস্তান’ আওরঙ্গজেবকে উপহার দেন। এই দেখে ১৭০৫ সালে অমর সিং তাঁর লেখা ফারসি রামায়ণ ‘অমরপ্রকাশ’ আওরঙ্গজেবের হাতে তুলে দেন। এমনকি তার শেষ জীবনেও মুঘল রাজপরিবারের সঙ্গে উপমহাদেশের মহাকাব্যিক রামের যােগসূত্র আওরঙ্গজেবও ছিন্ন করতে সক্ষম হননি। অড্রে ট্রুস্কে তাঁর অপর গ্রন্থ ‘কালচার অফ এনকাউন্টার্স:সংস্কৃত অ্যাট দ্য মুঘল কোর্ট’ গ্রন্থে বলেছেন, আওরঙ্গজেব সংস্কৃত ভাষা বিদ্বেষী ছিলেন না। তিনি শুধু কোরআন ও হাদিস পড়েছিলেন এমন নয়। তিনি পারস্যের বিখ্যাত কবিরুমি ও সাদিও পাঠ করেছিলেন। ফারসিতে রামায়ণ, মহাভারত পড়েছিলেন এবং এমনকি ব্রজভাষাও রপ্ত করেছিলেন।
তাছাড়া আওরঙ্গজেবের সময়ে ফারসি ভাষায় ভারতীয় মার্গ সংগীতের ওপর সবচেয়ে বেশি গ্রন্থ লেখা হয়। আওরঙ্গজেব নিজে বীণাবাদক ছিলেন। পর্যটক বার্নিয়ের দিল্লিতে তার বাড়ির ছাদ থেকে রাজপ্রাসাদের নহবৎ শুনতেন এবং তার প্রশংসাও করেছেন। পাশাপাশি বলা দরকার যে, দরবারী গান-বাজনা বন্ধ ও গায়কদের ভাতা দিয়ে বিদায় জানানাে হলেও যন্ত্রসংগীত বা নহবৎ অবশ্য চলতে থাকে। দরবারের মহিলারা ও অভিজাতরাও গানের প্রতি তাদের উৎসাহদান অব্যাহত রেখেছিলেন। সুতরাং আওরঙ্গজেব সংগীতের বিরােধী ছিলেন এবং তার আমলে সংগীতকে সমাধিস্থ করা হয় বলে যে অভিযােগ করা হয় তা একেবারেই আওরঙ্গজেবের প্রতি ক্রোধবশত মন্তব্য বলে মনে হয়। তবে অষ্টাদশ শতকে সংগীতের ক্ষেত্রে বেশকিছু তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন লক্ষ্য করা গিয়েছিল মােঘল সম্রাট মহম্মদ শাহের আমলে।
আওরঙ্গজেবের নাকি মানবিক গুণের অভাব ছিল। এহেন মিথ্যা অভিযােগ আওরঙ্গজেবের ভাষায় খণ্ডন করা যায়। আওরঙ্গজেব বলেন,
“নিজের জন্য নয়, অন্যের জন্য পরিশ্রম করতে আমি আল্লাহ কর্তৃক প্রেরিত হয়েছি, আমার প্রজাদের সুখের সঙ্গে আমার যে সুখ সম্পর্কিত নয়, সেই সুখের জন্য চিন্তা না করাই আমার কর্তব্য।” তিনি বলতেন: “সম্রাটের উপর যে গুরুদায়িত্ব ন্যস্ত হয়েছে—দেশের দুর্দিন ও বিপদের সময়ে, তার নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে আবশ্যকবােধে তাকে অসি হাতে প্রজাদের রক্ষার্থে মৃত্যুবরণ করতেও প্রস্তুত থাকতে হবে।”
কাফি খানের বর্ণনায় জানা যায়, আওরঙ্গজেব একবার একপত্রে পিতা বাদশাহ শাহজাহানকে জানিয়েছিলেন যে, সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য জনসাধারণের হিফাজত করা। আত্মকর্তৃত্ব ও স্বেচ্ছাচারিতার জন্য নয়। একটি ফরমানে আওরঙ্গ জেব ঘােষণা করেন,
“একজন সম্রাটের প্রধান ইচ্ছা এবং কর্তব্য হচ্ছে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি এবং কৃষক ও জনসাধারণের যারা সৃষ্টিকর্তার মহান সৃষ্টি ও আস্থার স্থল—তাদের সার্বিক উন্নতি সাধন করা।”
আওরঙ্গজেবের হিন্দুনীতিকে মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের জন্য দায়ী করা অনৈতিহাসিক। ধর্মনিরপেক্ষতার বাতাবরণে পুষ্ট আধুনিক মানসিকতায় আওরঙ্গজেবের ধর্মনীতির কোনও কোনও অংশ যতই এ মনে হােক না কেন, বাস্তবধর্মী ইতিহাসের দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করবার সময় কার্য ও কারণের ব্যবধানকে গুলয়ে ফেলা উচিত নয়। মুঘল সাম্রাজ্য ভেঙে পড়ার কারণ হল সামাজিক অবক্ষয় অর্থাৎ এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল যখন সমাজ আর আর্থিক দিক থেকে অগ্রসর হতে পারছিল না। বলা যায় যে, মুঘল সাম্রাজ্য পতনের জন্য দায়ী আঠারাে শতকের পরিবেশ। আরও বলা যায় যে, ১৭০৭ সালে সম্রাট আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর থেকে ১৮৫৮ পর্যন্ত প্রায় দেড়শ বছর মােঘল সাম্রাজ্য টিকেছিল। এবং ১৭০৭ সালে মােঘল সাম্রাজ্যে পতন ঘটেনি—এই প্রচার উদ্দেশ্যপ্রণােদিত। অড্রে ট্রুস্কে স্পষ্টতই বলেছেন, মুঘল সাম্রাজ্যের যে পতনের বীজ যদুনাথ দেখেছেন আওরঙ্গজেবের কর্মকাণ্ডের মধ্যে, তা মূলত ঔপনিবেশিক ইতিহাসকারদের তাত্ত্বিকতা।
যদুনাথ সরকার থেকে শুরু করে সাম্প্রতিককাল পর্যন্ত অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন যে, আওরঙ্গজেবের রাজপুত নীতি ছিল সংকীর্ণ ধর্মীয় গোঁড়ামির নিদর্শন এবং এখানেই তিনি আকবরের রাজপুত নীতি থেকে সরে এসেছিলেন। প্রকৃত ঘটনা হল, আওরঙ্গজেব সিংহাসনের উত্তরাধিকার পাবার ক্ষেত্রে রাজপুত ও হিন্দুদের সহযােগিতা পেয়েছিলেন। জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা দারাশিকো সাহিত্য শিল্পকলায় পারদর্শী হলেও ভাল সেনানায়ক ছিলেন না। তিনি রাজপুত রাজা জয়সিংহকে ‘দক্ষিণী বাঁদর’ বলে অভিহিত করে রাজপুতদের রােষের পাত্র হন। ইতিহাস ঘাঁটলে বােঝা যাবে রাজপুতরা আওরঙ্গজেবকে সিংহাসনে বসতে প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষভাবে সহযােগিতা করেন। এমনকি দলপত বুন্দেলা আওরঙ্গজেবকে সামুগড়ের যুদ্ধে যেতে চম্বার নদী পারাপারের ক্ষেত্রে খেয়ার ব্যবস্থা করেন। এই যুদ্ধে আওরঙ্গজেব জয়লাভ করেন। অপরদিকে তার দাক্ষিণাত্য নীতিও সফল হয়েছিল বলা যায়। আকবর, জাহাঙ্গীর ও শাহজাহান যা পারেননি, আওরঙ্গজেব তা পেরেছিলেন। অর্থাৎ সুদূর দাক্ষিণাত্য পর্যন্ত মুঘল সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি ঘটেছিল আওরঙ্গজেবের সময়েই। প্রভা দীক্ষিত তাঁর ‘কমিউনালিজম: এ স্ট্রাগল ফর পাওয়ার’ গ্রন্থে লিখেছেন,
“…হিন্দুধর্ম ধ্বংস করার জন্য দীর্ঘ ২৫ বছর কাল দাক্ষিণাত্যে কাটাননি আওরঙ্গজেব। প্রধান উদ্দেশ্য ছিল, হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে দাক্ষিণাত্যের সমস্ত শাসকের স্ব-শাসনকে ধ্বংস করে দক্ষিণ ভারতকে মুঘল সাম্রাজ্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ করে তােলা।”
ফলে দক্ষিণ ভারত পরবর্তীতে সহজেই ভারত-সাম্রাজ্যের বিশেষ অঙ্গ হিসেবে পরিগণিত হয়েছিল।
আওরঙ্গজেবের ব্যক্তিগত ধর্মীয় বিশ্বাসের উপর নির্ভর করে তার সামগ্রিক ধর্মীয় নীতি সম্পর্কে বাঁধাধরা ছকে কোনাে সিদ্ধান্তে আসা যায় না। কিন্তু তাই বলে তিনি মানবীয় দুর্বলতার ঊর্ধ্বে ছিলেন একথা বলাও অতিরঞ্জিত হবে। তবে স্বীকার করতেই হবে যে, তিনি সচেতনভাবেই ধর্মীয় সহনশীলতায় বিশ্বাসী ছিলেন। তাই প্রশ্ন হল, সম্রাট আওরঙ্গজেবের রাজত্বকালে ধর্মীয় সহিষ্ণুতার যে বিশাল দিকগুলি রয়েছে তা কেন উপেক্ষা করা হবে? আমাদের পাঠ্যপুস্তকে ওই দিকগুলিকে কেন বেশি গুরুত্ব দেওয়া হবে না? কেন তাঁর নেতিবাচক দিকগুলিকে বাড়িয়ে দেখান হবে? কেন ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিকগুলির মধ্যে একটা সামঞ্জস্য থাকবে না? তাহলে আমরা কি আওরঙ্গজেবের ইতিহাসকে হিন্দুদের জন্য একরকম আর মুসলমানদের জন্য অন্যরকম মানদণ্ডে দেখব? আর এই দুরকম মানদণ্ড কি ভারতীয় জনগণের মনে সাম্প্রদায়িক বিভেদ সৃষ্টি ও বর্ধন করবে না?
প্রকৃত ইতিহাসচর্চার গুরুত্ব ঠিক এখানেই। ইতিহাস আছে বলেই তাে ইতিহাসকে মেনে নেওয়া হয়। কিন্তু কালের দুর্ভাগ্যজনক চক্রান্তে সে ইতিহাসকেও বিকৃত হতে হয়। তবে সত্যের তেজক্রিয়তা চিরদিন চেপে রাখা যায় না, একদিন সে নিজের অস্তিত্ব নিয়ে মাথা তুলে উঠেই। গ্রিক শব্দ ‘হিস্টোরিয়া থেকে ‘হিস্টরি’ কথাটার উৎপত্তি। ইংরেজিতে যার ব্যাখ্যা হয় searching after truth. কালের জটিলতা কাটিয়ে সেই truth বা সত্যকে গবেষণার মধ্য দিয়ে তুলে ধরেন ঐতিহাসিকেরা। জড়তাজড়িত ইতিহাসের আওরঙ্গজেব পাঠকদের কাছে যেমন, আজকের আওরঙ্গজেব সে জড়তা কাটিয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন, কলঙ্কমুক্ত চরিত্রের অধিকারী—অড্রে ট্রুস্কে গবেষণার গৌরব এখানেই। অড্রে ট্রুস্কে তাই স্পষ্টত বলেছেন যে, ইতিহাসচর্চা যে কোনাে দেশের জাতি গঠনের ক্ষেত্রে, তার সাংস্কৃতিক চেতনা নির্মাণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সেই ইতিহাসের চরিত্ররা কেবল একটি ব্যক্তি নয়, সমকালের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের প্রতীকে পরিণত হন। আর সেভাবেই আওরঙ্গজেবের রাজত্বকে দেখতে হবে। ইতিহাসের যাঁরা চরিত্র তাদের ইতিহাস রচনায় সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি যেভাবেই আসুক না কেন তা পরিত্যাগ করতে হবে। সবশেষে ঐতিহাসিক অড্রে ট্রুস্কে কে ধন্যবাদ জানাতেই হবে, এমন বই আমাদের উপহার দেওয়ার জন্য। আর সবিশেষ কৃতজ্ঞতা জানায় আত্মজা পাবলিশার্স ও বাংলা আনুবাদক বিশ্বেন্দু নন্দকে।
[সৌজন্যেঃ দৈনিক পুবের কলম]
‘নবজাগরণ’ অ্যান্ড্রোয়েড অ্যাপ্লিকেশনটি প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর টেলিগ্রাম চ্যানেলে জয়েন হতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর ফেসবুক পেজে লাইক করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।