কুষাণােত্তর যুগে ভারতঃ কুষাণ সাম্রাজ্যের পতনের ফলে উত্তর এবং উত্তর-পশ্চিম ভারতে এবং অন্ধ্রদের শাসনাবসানের ফলে দক্ষিণ ভারতে বহু সংখ্যক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বাধীন স্থানীয় রাজনৈতিক সত্তার বিকাশ ঘটে। কুষাণ এবং অন্ধ্র শাসনের দুর্বলতার সুযােগ নিয়ে ভারতের প্রায় সর্বত্র স্থানীয় রাজগণ বা কিছু শক্তিশালী উপদল স্বাধীনতা ঘােষণা করলে এই রাজনৈতিক অনৈক্য প্রকাশিত হয়। এভাবে দেখা যায় খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতাব্দী এবং চতুর্থ শতাব্দীর প্রথম দিকে শতাধিক বছর সাম্রাজ্যবাদী কোনাে বৃহৎ শক্তি কর্তৃক ভারত শাসিত হয়নি। ড. ভি.এ. স্মিথ ২২০ বা ২৩০ খ্রিস্টাব্দ হতে পরবর্তী শতাধিক বছরের ভারতের ইতিহাসকে ‘অন্ধকারাচ্ছন্ন অধ্যায়’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। অবশ্য সাম্প্রতিক গবেষণায় কুষাণ ও গুপ্তযুগের (প্রথম চন্দ্রগুপ্ত) অন্তবর্তীকাল সম্পর্কে অনেক নতুন তথ্য প্রকাশিত হওয়ায় এ যুগকে বর্তমানে আর ‘অন্ধকারাচ্ছন্ন’ বলা চলে না। ইদানিং গুপ্ত যুগের সাম্রাজ্যবাদ এবং বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক অগ্রগতিকে কুষাণ যুগের ধারাবাহিকতা হিসেবে উল্লেখ করা হচ্ছে।
কুষাণ শ্রেষ্ঠ কণিষ্কের পর ভারতে স্থানীয়ভাবে যে সকল ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বাধীন রাজ্য গড়ে ওঠে সেগুলাের মধ্যে কোনােটি ছিল অনেকটা রাজতান্ত্রিক এবং কোনােটি প্রজাতান্ত্রিক ধরনের। রাজতান্ত্রিক ধাঁচের রাজ্যগুলাের মধ্যে উল্লেখযােগ্য ছিল নাগ, অহিচ্ছত্র, অযােধ্যা, কৌশাম্বী ইত্যাদি। আর প্রজাতান্ত্রিক ধাঁচের রাজ্যগুলাের মধ্যে অর্জুনয়ন, মালব, যৌধেয় ইত্যাদি উল্লেখযােগ্য ছিল। এছাড়া লিচ্ছবি, শক ইত্যাদি গােষ্ঠী এবং পূর্ব ভারতে (বাংলা এবং পার্শ্ববর্তী অঞ্চল) সমতট, ডবাক, কামরূপ, কর্তৃপুর ইত্যাদি স্থানীয় রাজশক্তির কথা জানা যায়। যাহােক প্রায় ‘দেড়শ’ বছর স্থায়ী ঐক্যহীন বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির অবসান ঘটিয়ে ভারতে আবারাে রাজনৈতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠা করেন পূর্ব ভারতের একটি রাজবংশ। গুপ্ত নামধারী এই রাজবংশের হাতেই প্রাচীন ভারতে সাম্রাজ্যকেন্দ্রিক ইতিহাসের তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ পর্যায় রচিত হয়। কুষাণ সাম্রাজ্যের ভারতীয় অংশ ছিল বহির্ভারতীয় বা মধ্য এশীয় সাম্রাজ্যের অঙ্গমাত্র। রাজ্যজয় ও বাণিজ্যভিত্তিক অর্থনীতি থেকেই এসেছিল কুষাণ সাম্রাজ্যবাদের প্রেরণা। কিন্তু গুপ্ত সাম্রাজ্য চরিত্রগতভাবে ছিল একান্তই ভারতীয়। তাই প্রাচীন ভারতের ইতিহাসে গুপ্ত সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা (আনুমানিক ৩২০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৫৪০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ভারত গুপ্তদের দ্বারা শাসিত হয়) খুবই গুরুত্ববহ।
গুপ্তদের ইতিহাসের উপাদান
গুপ্ত সাম্রাজ্যের ইতিহাস জানার জন্য ধর্মভিত্তিক ও সাহিত্যভিত্তিক গ্রন্থাদি, বিদেশীদের বিবরণ, শিলালিপি, মুদ্রা ইত্যাদি উল্লেখযােগ্য উৎস রয়েছে। রাজনৈতিক ইতিহাসের একটি উপাদান হলাে পুরাণ। পুরাণ হতে গুপ্ত সাম্রাজ্য, অন্যান্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজবংশ সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায়। ধর্মশাস্ত্র তথা স্মৃতিশাস্ত্র বিশেষত নারদ, বৃহস্পতি হতে অনেক তথ্য জানা যায়।
দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের প্রধানমন্ত্রী শেখর রচিত ‘কমন্দক-নীতিসার’ গ্রন্থ হতে গুপ্তদের রাষ্ট্রনীতি ও শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায়। এ গ্রন্থে রাজকর্তব্য সম্পর্কে উপদেশ লিপিবদ্ধ করা আছে। গুপ্ত যুগে বেশ কিছু নাটকও রচিত হয়। এ সকল নাটকের মধ্যে কৌমুদী-মহােৎসব’ সে যুগের রাজনৈতিক অবস্থা, গুপ্ত বংশের উত্থান ও উন্নতি এবং মগধ সম্পর্কে তথ্য প্রদান করে। এছাড়া ‘দেবী-চন্দ্র-গুপ্তম’, ‘নাট্যদর্পণ’, ‘মুদ্রারাক্ষস’ ইত্যাদি নাটকেও গুপ্ত যুগ সম্পর্কে তথ্য আছে। ‘মুদ্রারাক্ষস’ নাটকে মৌর্যদের বিস্তারিত তথ্যের পাশাপাশি গুপ্ত আমলের কিছু বিবরণও লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। কালিদাসের রচনাবলীতে গুপ্ত আমলের ইতিহাসের উপাদান পাওয়া যায়।
বিদেশী পর্যটকদের বিবরণ গুপ্তদের ইতিহাস পুনর্গঠন করার ক্ষেত্রে যথেষ্ট সাহায্য করে। বিশেষ করে চৈনিক পর্যটক ফা-হিয়েন, ই-সিং প্রমুখের বর্ণনা গুপ্তদের আর্থ-সামাজিক, শৈল্পিক এবং ধর্মীয় ইতিহাস রচনার কাজে খুবই ‘বিশ্বস্ত উৎস’ হিসেবে গৃহীত হয়েছে।
গুপ্ত যুগের ঐতিহাসিক উপাদানের মধ্যে সবচাইতে নির্ভরযােগ্য হচ্ছে শিলালিপি। এ পর্যন্ত গুপ্তদের প্রায় ৫০টি শিলালিপি ও অন্যান্য লেখ আবিষ্কৃত হয়েছে। এ সকল লিপির মধ্যে সমুদ্রগুপ্তের সভাকবি হরিষেণ। রচিত ‘এলাহাবাদ প্রশস্তি’ বিখ্যাত । এতে গুপ্ত সাম্রাজ্যের বহু তথ্য খােদাই করা আছে। এছাড়া উদয়গিরি গুহালিপি, মথুরা শিলালিপি, এরণ, নালন্দা ও গয়ালিপি, দামােদরপুরলিপি, মান্দাসরলিপি, সারনাথলিপি, গুনাইগড় লিপি, সাঁচী শিলালিপি, মেহরাওয়ালী লৌহস্তম্ভলিপি ইত্যাদি হতে গুপ্ত সম্রাটদের কৃতিত্ব, গৌরবগাঁথা ও ধর্ম সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায়। গুপ্ত সম্রাটদের বহু মুদ্রা আবিষ্কৃত হয়েছে। এসকল মুদ্রা হতে গুপ্তদের রুচি, ব্যক্তিত্ব, ধর্মমত, সমসাময়িক মুদ্রানীতি, অর্থনীতি ইত্যাদি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। স্বভাবতই গুপ্ত মুদ্রাগুলােতে নানা প্রকার বৈচিত্র্য ছিল। সমুদ্রগুপ্ত তাঁর পিতা প্রথম চন্দ্রগুপ্ত এবং মাতা কুমারদেবীর মূর্তি নিজের মুদ্রায় উত্তীর্ণ করেছিলেন। বলাবাহুল্য যে, এ মুদ্রাগুলাে ছিল স্মৃতিমূলক। এছাড়া সমুদ্রগুপ্ত ধনুর্ধর, বীণাবাদক, সিংহশিকারী ইত্যাদি নানাভাবে মুদ্রায় নিজেকে প্রকাশ করেছেন। অশ্বমেধ মুদ্রা, ব্যাঘ্র শিকার, হাতির পিঠে উপবিষ্ট, নানা প্রকারের মূর্তি ইত্যাদিও প্রকাশ করা হয়েছে গুপ্ত মুদ্রায়। গুপ্তদের স্বর্ণ, রৌপ্য উভয় প্রকার মুদ্রা পাওয়া গেছে। তামার কিছু মুদ্রাও পাওয়া গেছে। ইতিহাসের উপাদান হিসেবে এই শিলালিপি ও মুদ্রার গুরুত্ব অনেক বেশি। কেননা এগুলােতে প্রাপ্ত তথ্য সম্পর্কে সন্দেহের অবকাশ খুব একটা থাকে না। কেবল রাজপ্রশস্তি থেকে ইতিহাস পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়।
গুপ্তদের আদি পরিচয় ও বাসস্থান
গুপ্ত বংশের আদি পরিচয় ও বাসস্থান সম্পর্কে নির্ভরযােগ্য তথ্যের অভাব রয়েছে। বৈয়াকরণিক চন্দ্রগােমিনের দেয়া তথ্যের ওপর নির্ভর করে অনেকেই অনুমান করেন যে, গুপ্তরা ছিলেন পাঞ্জাবের ‘জাট’ বংশীয়। কিন্তু এ মতের দুর্বলতা হচ্ছে কয়েকটি তাম্রলিপিতে গুপ্তরা নিজেদেরকে ‘ক্ষত্রিয়’ বলে পরিচয়। দিয়েছেন। আবার গুপ্তদের সঙ্গে যে সকল রাজবংশের বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপিত হয় (যেমন লিচ্ছবি, বাকাটক বা নাগ) তাঁরা ছিলেন ব্রাহ্মণ অথবা ক্ষত্রিয়। শূদ্র জাটদের সাথে তাদের সম্পর্ক তাই অনেকটা অমূলক। এছাড়া গুপ্তদের আদি বাসস্থান সম্পর্কে প্রাপ্ত তথ্যে বাংলা অথবা মগধ অঞ্চলের কথা জানা যায়। এক্ষেত্রেও পাঞ্জাবের সাথে তাদের সম্পর্ক প্রমাণ করা বেশ দুরূহ।
ঐতিহাসিক এ্যালেনের মতে, গুপ্তরা প্রথমে দুপুর অর্থাৎ পাটলিপুত্র নগরের অনতিদূরে একটি অঞ্চলের (মগধ) রাজা ছিলেন। ঐতিহাসিক জয়সােয়ালের মতে, গুপ্তগণের আদি বাস ছিল এলাহাবাদ অঞ্চলে। এ বিষয়ে তৃতীয় মত ব্যক্ত করেছেন ঐতিহাসিক ডি.সি. গাঙ্গুলি। তাঁর মতে, গুপ্তবংশের আদি বাসস্থান ছিল মুর্শিদাবাদ, মগধ নয়। ইৎ-সিং-এর বিবরণের ওপর নির্ভর করে তিনি এই মতবাদ গঠন করেন। ৬৭২ খ্রিস্টাব্দে ইৎ-সিং ভারত ভ্রমণে আসেন। এর পাঁচশাে বছর পূর্বে অর্থাৎ খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীতে চৈনিক পর্যটক হুইলুন নালন্দা পরিদর্শন করেন। সে সময় মহারাজা শ্রীগুপ্ত মি-লি-কিয়া-সি-কিয়া-পাে-নাে (মৃগশিখাবন) নামক স্থানে একটি মন্দির নির্মাণ করেন বলে কিংবদন্তী সূত্রে ই-সিং জানতে পারেন। একই সঙ্গে এই মন্দিরের ব্যয় সংকুলানের জন্য ২৪টি গ্রামও দান করা হয়। মৃগশিখাবনের অবস্থান সম্পর্কে ইৎসিং বলেন, নালন্দার পূর্বদিকে গঙ্গার খাত ধরে ৪০ যােজন বা ২৪০ মাইল দূরে ছিল এই মন্দির। গঙ্গার গতিপথ ধরে চল্লিশ যােজন নালন্দার পূর্বদিকে অগ্রসর হলে মুর্শিদাবাদ বা রাঢ় দেশের অবস্থান। ড. গাঙ্গুলির মতে, শ্রীগুপ্তই হচ্ছেন গুপ্ত সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা এবং বাংলা অঞ্চলেই তাঁর বাসস্থান নির্ধারণ করা যুক্তিযুক্ত। ড. হেমচন্দ্র রায় চৌধুরী নেপালে একটি স্কুপের গায়ে বরেন্দ্রীর মৃগশিখাবন স্থূপ লেখার ভিত্তিতে অনুমান করেন, গুপ্তদের আদি বাসস্থান বাংলার বরেন্দ্র অঞ্চলে বা উত্তরবঙ্গে। আবার গুপ্তদের স্বর্ণমুদ্রার বেশির ভাগ উত্তর প্রদেশে পাওয়া গেছে-এ যুক্তিতে গুপ্তদের আদি বাসস্থান উত্তর প্রদেশ বলেও অনেকেই মত দিয়েছেন।
যাহােক, উপযুক্ত আলােচনা হতে গুপ্তদের আদি পরিচয় ও বাসস্থান সংক্রান্ত সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয়। পুরাণের বিবরণে গুপ্তদের আদি বাসস্থান বা রাজ্য ছিল মগধ এবং গুপ্ত রাজ্যে বাংলাও অন্তর্ভুক্ত ছিল। এ্যালেনও শেষ পর্যন্ত এই মত গ্রহণ করেছেন।এ হতে মনে হয় গুপ্তরা পাটলিপুত্রের নিকটবর্তী কোনাে অঞ্চলে রাজত্ব করতেন এবং ক্রমে তারা নিজ সাম্রাজ্য বাংলা পর্যন্ত বিস্তৃত করেন। পক্ষান্তরে মৃগশিখাবন মন্দিরের উল্লেখ করে বাংলার গুপ্তদের আদি বাসস্থান ছিল বলে যারা মতবাদ দিয়েছেন তা থেকে মনে হয়, গুপ্তরা প্রথমে বাংলায় রাজত্ব শুরু করে পরে মগধে সাম্রাজ্যের বিস্তার ঘটান। সুতরাং গুপ্তবংশের আদি পরিচয় ও বাসস্থান কোথায় ছিল তা আজো এক অমীমাংসিত বিতর্কই রয়ে গেছে।
গুপ্ত সাম্রাজ্যের উদ্ভব ও প্রথম চন্দ্রগুপ্তের সাম্রাজ্যসীমা
মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের পর ভারতের রাজনীতিতে যে বিচ্ছিন্নতা, আঞ্চলিকতার প্রকাশ ও বৈদেশিক শক্তির অনুপ্রবেশ ঘটেছিল তার বিপরীতে কি করে গুপ্ত সাম্রাজ্যের উদ্ভব হলাে তা ঐতিহাসিকদের সামনে এক গভীর জিজ্ঞাসা। গুপ্তদের উত্থানকে ঐতিহাসিক ড. রমেশ চন্দ্র মজুমদার বৈদেশিক আক্রমণ ও বিজাতীয় সংস্কৃতির বিরুদ্ধে এক অভ্যুত্থান হিসেবে উল্লেখ করেছেন। অপর কয়েকজন ঐতিহাসিক গুপ্ত সাম্রাজ্যবাদের উদ্ভব সম্পর্কে ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে গাঙ্গেয় উপত্যকায় শক্তিশূন্যতা এবং গঙ্গা-যমুনা উপত্যকার উর্বরা অঞ্চলের অর্থনৈতিক লাভালাভের প্রশ্নটিকে গুরুত্ব দিয়েছেন। অর্থনৈতিক দিক দিয়ে গঙ্গা-যমুনা উপত্যকা ছিল খুবই উর্বরা। এ অঞ্চলে ছিল প্রাচীন সমৃদ্ধ নগরীগুলাে, ছিল গঙ্গার জলধারা সিঞ্চিত কৃষিক্ষেত্র, গঙ্গাবাহিত বাণিজ্য। এগুলাে হাতে থাকায় গুপ্তদের উত্থান সফল হয়েছে।
শিলালিপির সাক্ষ্য অনুযায়ী গুপ্তবংশের প্রতিষ্ঠাতার নাম শ্রীগুপ্ত। তিনি কেবল ‘মহারাজ’ উপাধি ব্যবহার করতেন। তিনি সম্ভবত মগধের অন্তর্গত কোনাে ক্ষুদ্র রাজ্যের শাসক ছিলেন। তাঁর উত্তরাধিকারী হন তাঁরই পুত্র ঘটোৎকচ; তিনিও ‘মহারাজ’ উপাধি ব্যবহার করতেন। তাঁরা স্বাধীন নৃপতি নাকি সমান্তরাজ ছিলেন, তা বলা কঠিন। তবে সম্ভবত গুপ্তবংশের তৃতীয় রাজা চন্দ্রগুপ্ত ‘মহারাজাধিরাজ’ উপাধি নিলেই পরে গুপ্তরা সার্বভৌম ক্ষমতা পায়। এই চন্দ্রগুপ্তই গুপ্ত সাম্রাজ্যের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ শাসক প্রথম চন্দ্রগুপ্ত। তাঁর সময়কাল ধরা হয় ৩২০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৩৩৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। তিনি ঘটোৎকচ গুপ্তের পুত্র। তাঁর সিংহাসনে আরােহণের কাল হতে ‘গুপ্ত অব্দ’ প্রচলিত হয়। রাজত্বকাল সংক্ষিপ্ত হলেও তিনি গুপ্তবংশের শক্তি ও মর্যাদা বৃদ্ধি করতে সক্ষম হন। প্রথম চন্দ্রগুপ্ত প্রতিবেশী কোশল রাজ্যের মঘ বংশকে উৎখাত করেন। তিনি কোশল ও কোশাম্বী অধিকার করে বৃদ্ধি করেন তার রাজ্যসীমা। তিনি মগধ রাজ্যও জয় করেন। শক-মুরন্ডদের উৎখাত করে মগধ জয়ের পরই সম্ভবত তিনি বিজয়সূচক ও সার্বভৌম উপাধি গ্রহণ করেন। ড. আর. জি. বসাকের মতে, প্রথম চন্দ্রগুপ্ত উত্তর বাংলা জয় করেছিলেন। অবশ্য এ তথ্য সন্দেহাতীত নয়। তবে তিনি যে উত্তর প্রদেশ ও মগধ জয় করেন তা নিশ্চিত। পাটলিপুত্র ছিল চন্দ্রগুপ্তের রাজধানী। প্রথম চন্দ্রগুপ্ত নিজ সামরিক যােগ্যতা, অসাধারণ কূটনীতি, বৈবাহিক সম্বন্ধ দ্বারা এবং মৃত্যুর পূর্বে উত্তরাধিকারী মনােনীত করে গুপ্ত সাম্রাজ্যের ভিত্তি সুদৃঢ় করে যান। উত্তর প্রদেশের পূর্বভাগ, বিহার এবং পশ্চিম বাংলা পর্যন্ত এলাকায়। তিনি গুপ্তদের আধিপত্য স্থাপন করেন।
‘লিচ্ছবি‘ বংশের সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক
ঐতিহাসিক হেমচন্দ্র রায় চৌধুরী, স্মিথ প্রমুখ প্রথম চন্দ্রগুপ্তের ‘লিচ্ছবি’ রাজকন্যা কুমারদেবীর সাথে বিবাহের ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরােপ করেছেন। তাঁদের মতে, এই বিবাহের পেছনে গভীর কূটকৌশল বুদ্ধির পরিচয় ছিল। অবশ্য এর বিপরীত মতও রয়েছে। ড. রায়চৌধুরী মনে করেন, প্রথম চন্দ্রগুপ্ত ‘লিচ্ছবি’ পরিবারের সাথে বৈবাহিক সম্বন্ধে আবদ্ধ হয়ে নিজের রাজনৈতিক ক্ষমতা, প্রতিপত্তি ও মর্যাদা বৃদ্ধি করেছিলেন। ‘লিচ্ছবি’রা ছিল প্রাচীন ও সুপরিচিত জাতিগােষ্ঠী। ‘লিচ্ছবি’ কন্যা কুমারদেবীকে বিবাহ করার পর প্রথম চন্দ্রগুপ্তের ভাগ্যোন্নতি ঘটেছিল এর প্রমাণ তাঁর মুদ্রায় লক্ষ্মীর প্রতিকৃতির নিচে ‘লিচ্ছব্যায়’ লেখা হতে বুঝতে পারা যায়। এই বিবাহের ফলে গুপ্তরা দক্ষিণ বিহারের মহামূল্য স্থানগুলাের ওপর তাদের অধিকার লাভ করেছিলেন। এর ফলে তারা বিপুল সম্পদের অধিকারী হন। উত্তর ভারতের বৃহত্তম শক্তিতে পরিণত হতে এই বৈবাহিক সম্পর্ক দারুণভাবে সাহায্য করেছিল। লিচ্ছবি’ রাজকন্যার সাথে বিবাহকে। স্মরণীয় করে রাখতে যে স্বর্ণমুদ্রা প্রচলন করা হয়েছিল তার একপাশে চন্দ্রগুপ্ত ও কুমারদেবীর ছবি এবং অপরপাশে সিংহের ওপর উপবিষ্ট দেবতার চিত্র অংকন করা হয়। ড. রমেশ চন্দ্র মজুমদার, এ্যালেন প্রমুখ। ঐতিহাসিকের মতে, ‘লিচ্ছবি’ বংশে বিবাহ প্রথম চন্দ্রগুপ্তকে কিছু রাজনৈতিক প্রভাব-প্রতিপত্তি দিলেও কোন সামাজিক বা অর্থনৈতিক সুযােগ-সুবিধা এনে দেয়নি। তাদের মতে, লিচ্ছবি বিবাহের ওপর অযথাই গুরুত্ব আরােপ করা হয়েছে। যাহােক, সমুদ্রগুপ্ত ছিলেন এই বিবাহজাত সন্তান। তিনি মুদ্রায় নিজেকে ‘লিচ্ছবি দৌহিত্র’ বলে পরিচয় দিয়েছেন। সুতরাং লিচ্ছবি’ বংশে বিবাহ যে গুপ্তবংশের জন্য কিছুমাত্র হলেও সৌভাগ্যসূচক ছিল তা নির্দ্বিধায় বলা যেতে পারে।
কুষাণােত্তর যুগে ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যের উদ্ভব দেখা যায়। গাঙ্গেয় উপত্যকায় শক্তিশূন্যতা এবং গঙ্গা-যমুনা উপত্যকার উর্বরাভূমির ওপর ভিত্তি করেই গুপ্ত সাম্রাজ্যের উদ্ভব ঘটে। গুপ্তদের সম্পর্কে নানা ধরনের উপাদান থেকে তথ্য পাওয়া যায়। প্রাপ্ত সাক্ষ্য থেকে মনে হয়, শ্রীগুপ্তই গুপ্ত সাম্রাজ্যের উদ্ভবের অগ্রদূত। তবে তাঁর পৌত্র প্রথম চন্দ্রগুপ্তের রাজত্বকালেই গুপ্ত সাম্রাজ্যের প্রসার ঘটে এবং সাম্রাজ্যবাদী শক্তি হিসেবে গুপ্তদের বিকাশ লক্ষ করা যায়। পাটলিপুত্রকে রাজধানী করে মগধ, উত্তর প্রদেশ ও নিকটবর্তী অঞ্চলে গুপ্ত সাম্রাজ্যের উদ্ভব হয়। প্রথম চন্দ্রগুপ্ত ‘লিচ্ছবি’ রাজকন্যাকে বিয়ে করেন। এই বৈবাহিক সম্পর্ক গুপ্তদের মর্যাদাকে বহুগুণ বৃদ্ধি করে। তাই এ ঘটনাকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য স্বর্ণমুদ্রা প্রকাশ করা হয়েছিল। মৃত্যুর পূর্বে প্রথম চন্দ্রগুপ্ত তাঁর পুত্র সমুদ্রগুপ্তকে উত্তরাধিকারী মনােনীত করে যান।
‘নবজাগরণ’ অ্যান্ড্রোয়েড অ্যাপ্লিকেশনটি প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর টেলিগ্রাম চ্যানেলে জয়েন হতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর ফেসবুক পেজে লাইক করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।