প্রাচীনকালে বাংলার বিভিন্ন অংশ বিভিন্ন নামে পরিচিত ছিল। বঙ্গ, পুণ্ড্র, বরেন্দ্র, রাঢ়, গৌড়, সমতট, হরিকেল, চন্দ্রদ্বীপ, তাম্রলিপ্ত ইত্যাদি ছিল সেকালের বাংলার এক একটি জনপদের নাম। তখন বঙ্গ বলতে ঢাকা, ফরিদপুর ও ময়মনসিংহকে বােঝানাে হত। পুণ্ড্র ছিল উত্তরবঙ্গের বগুড়া, রংপুর, রাজশাহী ও দিনাজপুর অঞ্চল। আবার পুণ্ড্র অঞ্চলেরই একটি অংশকে বরেন্দ্র নামে অভিহিত করা হত, এটি বর্তমানে রাজশাহী জেলায় পড়েছে। ভাগীরথীর পশ্চিম তীর ছিল রাঢ় অঞ্চলভুক্ত। মালদহ, মুর্শিদাবাদ ও পার্ববর্তী এলাকা নিয়ে গৌড় জনপদ গড়ে উঠেছিল। বাংলার দণি-পূর্ব অঞ্চল তথা কুমিল্লা ও নােয়াখালি জেলা ছিল সমতট জনপদের অন্তর্ভুক্ত। সিলেট ও চট্টগ্রাম হরিকেল রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। চন্দ্রদ্বীপ বরিশাল জেলার অন্তর্গত। আর তাম্রলিপ্ত ছিল (বর্তমানে) মেদিনীপুর জেলার অন্তর্ভুক্ত। প্রাচীনকালে এসব জনপদের রাজারা দশ গজ উঁচু ও কুড়ি গজ বিস্তৃত প্রকাণ্ড ‘আল’ নির্মাণ করতেন। বঙ্গের সাথে ‘আল’ প্রত্যয় যােগে ‘বঙ্গাল’ হয়েছে, আর ‘বঙ্গাল’ হতে ‘বাঙ্গাল’। মুসলিম আমলের আগে পর্যন্ত ‘বঙ্গ’ ও ‘বঙ্গাল’ বলতে বাংলার অংশ বিশেষকে বােঝানাে হত। মুসলমান আমলেই চতুর্দশ শতক থেকে সারা বাংলা একত্রীভূত এবং একক শাসনাধীনে এসে বাঙ্গাল নামকরণ হতে কালক্রমে বাংলা নামের উৎপত্তি হয়েছে। সুলতান শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ (১৩৪২-১৩৫৭) ১৩৪২ সালে বাংলার মসনদে আরােহন করে একে একে সাতগাঁও, সােনারগাঁও, বিহার ছাড়িয়ে চম্পারণ, গােরখপুর, কাশী জয় করেন, কামরূপের অংশ বিশেষও দখল করেন এবং ত্রিপুরার উপর প্রভাব বিস্তার করেন। এভাবে ১৩৫২ সালের মধ্যে মােটামুটি প্রায় সারা বাংলা অঞ্চল তার অধীনে আসে এবং দিল্লির সুলতান ফিরােজ তুঘলক (১৩৫১-৮৮) তাকে ১৩৫৩ সালে আক্রমণ করতে এসে বিশেষ সুবিধা করতে না পেরে ফিরে যান। এরপর ইলিয়াস শাহ সর্বপ্রথম সারা বাংলার অধীর হয়ে ‘শাহ-ই-বাঙ্গালা’ এবং ‘সুলতান-ই-বাঙ্গালা’ উপাধি গ্রহণ করেন।১ দিল্লির ঐতিহাসিক শামস-ই-সিরাজ আফিফ ‘বঙ্গালা’ বলতে গােটা বাংলাকে বুঝিয়েছেন। সুলতান ইলিয়াস শাহের সময় হতে ‘বাঙ্গালা’ শব্দের ব্যাপক পরিচিতি ঘটে। ফারসি ‘বাঙ্গালাহ’ হতে পর্তুগীজ লেখকরা ‘বেঙ্গালা’ ও ইংরেজ লেখকরা ‘বেঙ্গল’ করেছেন। মুসলিমদের পূর্বে যারা এই বাংলায় রাজত্ব করতেন সেই সেন রাজাদের২ আমলে ব্রাহ্মণ্যদের ক্ষমতা প্রতিপত্তি ছিল অপরিসীম, তারাই ছিল পণ্ডিত এবং শিক্ষিত শ্রেণি, সেন-দরবারের ভাষাও ছিল সংস্কৃত। সংস্কৃত দেব-ভাষা, এই ভাষায় দেবদেবীর মাহাত্ম্য কীর্তন করা হত। দেব-ভাষা বা দেব গ্রন্থে শূদ্র বা জনগণের কোনাে অধিকার ছিল না। সংস্কৃত ছাড়া অন্য অদেব-ভাষায় দেবদেবীর মাহাত্ম্য কীর্তনের বিরুদ্ধেও ব্রাহ্মণদের কড়া নজর ছিল। এই অবস্থায় অদেব বাংলা ভাষার উৎকর্ষ হওয়া সম্ভব ছিল না। সেন রাজাদের হাত থেকে নিজেদের ধর্ম-সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য বৌদ্ধদের অবলম্বন করতে হয়েছিল নানান কৌশল। চর্যাপদের ভাষা তাই হেঁয়ালির মতাে। তৎকালীন সামাজিক পটভূমি ও জীবনচর্চার সঙ্গে গভীরভাবে পরিচিত ব্যক্তি ছাড়া এর অর্থ উদ্ধার করা অত্যন্ত পরিশ্রম সাধ্য। রাজরােষ থেকে আত্মরক্ষার জন্যই যে এই রকম আলােআঁধারি সান্ধ্যভাষার উৎপত্তি, একথা সহজেই অনুমিত হয়। কিন্তু হঠাৎ বাংলায় মুসলমান শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় অবস্থার। দ্রুত পরিবর্তন হয়। এক্ষেত্রে তুর্কি বীর ইখতিয়ারউদ্দিন মােহাম্মদ বখতিয়ার খিলজি এর বাংলা অভিযান এক যুগসন্ধিক্ষণ বলা চলে।
[১]
ত্রয়ােদশ শতকের প্রারম্ভে মােহাম্মদ বখতিয়ার খিলজি বাংলার উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম অংশে প্রায় ১৩০ বছরের সেন শাসনের (১০৯৬-১২২৫) অবসান ঘটিয়ে বাংলায় মুসলিম শাসনের সূচনা করেন। উল্লেখ্য, তিনটি পর্যায়ে ভারত উপমহাদেশে মুসলিম শাসন বিস্তার লাভ করে। প্রথমত, ৭১২সালে সিন্ধু ও মুলতান বিজয় সম্পন্ন হয় আরবের উমাইয়া খলিফা আল ওয়ালিদের আমলে (৭০৫-১৫) মুহাম্মদ বিন কাসিমের নেতৃত্বে। দ্বিতীয়ত, গজনীর রাজা সবুক্তগীন (৯৭৭-৯৭) ও তার পুত্র সুলতান মাহমুদের (৯৯৭-১০৩০) বারবার ভারত আক্রমণ। মাহমুদ ১৭বার ভারতের বিভিন্ন এলাকা অভিযান করেন। কিন্তু তিনি ভারতে স্থায়ীভাবে সাম্রাজ্য স্থাপনের চেষ্টা করেননি। সবুত্তক্তগীন ও সুলতান মাহমুদ জাতিতে তুর্কি ছিলেন। তৃতীয় পর্যায়ে তুর্কি বীর সুলতান মােহাম্মদ ঘােরীর (১১৮৬-১২০৬) নেতৃত্বে ভারত আক্রান্ত হয়। মােহাম্মদ ঘােরী দিল্লি ও আজমিরে স্বীয় অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন এবং দিল্লিকে রাজধানী করে ভারতে একটি মুসলিম রাজ্য স্থাপন করেন। তিনি দিল্লিতে প্রতিনিধিরূপে কুতুবউদ্দিন আইবককে (১২০৬-১০) শাসক হিসেবে নিযুক্ত করেন। ১২০৬ সালে মােহাম্মদ ঘােরীর মৃত্যুর পর কুতুবউদ্দিন আইবক স্বাধীনতা ঘােষণা করে দিল্লির সিংহাসনে আরােহণ করেন।
বাংলায় মােহাম্মদ বখতিয়ার খিলজির নেতৃত্বে মুসলিম বিজয় মােহাম্মদ ঘােরীর উত্তর ভারত বিজয়েরই অংশবিশেষ।
স্বাভাবিকভাবেই বাংলার সেন সাম্রাজ্য বখতিয়ার খিলজির বিজয়াভিযানের তরঙ্গে আক্রান্ত হয়েছিল। কিন্তু কে এই বখতিয়ার খিলজি? তার সম্পর্কে খুব বেশি তথ্য না পাওয়ায় নানা বিভ্রান্তি তাঁকে নিয়ে। ইতিহাসের বিতর্কিত চরিত্র হিসেবে বিভ্রান্তি তার নাম নিয়েও। বখতিয়ারের আসল নাম কি ? এ নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে—
- ১. বখতিয়ার খিলজি সম্পর্কে সবচেয়ে নির্ভরযােগ্য মূল ফারসি গ্রন্থ মিনহাজ-ই-সিরাজীর ‘তবকাত-ই-নাসিরী’। এটি এশিয়াটিক সােসাইটি অফ বেঙ্গল (কলকাতা) হতে কর্নেল ডব্লিউ এন লিজ কর্তৃক মূল ফারসি ভাষায় সম্পাদিত ও ১৮৬৪-এ প্রকাশিত। এখানে যে নামটি পাওয়া যায় তা হল, ইখতিয়ার-উদ-দীন মােহাম্মদ বখতিয়ার খিলজি।
- ২. আবদুল হাই হাবিবী কান্দাহারী কর্তৃক সম্পাদিত ও কাবুল হতে প্রকাশিত৩ (১৯৬৫, দ্বিতীয় সংস্করণ) এবং আব্দুল্লাহ চুগতাই কর্তৃক সম্পাদিত ও লাহাের হতে প্রকাশিত—এই দু’টি গ্রন্থেও উপরােক্ত নামটি ব্যবহৃত হয়েছে।
- ৩. ভারত-পাক উপমহাদেশের ও ইউরােপের বিভিন্ন স্থানে (সেন্ট পিটার্সবার্গ ইম্পিরিয়াল পাবলিক লাইব্রেরী, ব্রিটিশ মিউজিয়াম, সেন্ট পিটার্সবার্গ ইম্পিরিয়াল একাডেমি অফ সায়েন্স, ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরী, প্যারিসের ন্যাশনাল লাইব্রেরী, হায়লিবারি কলেজ লাইব্রেরী, কর্নেল জি ডব্লিউ হ্যামিলটনের পান্ডুলিপি ও রয়েল এশিয়াটিক সােসাইটির পাণ্ডুলিপি ইত্যাদি) রক্ষিত ১২টি পাণ্ডুলিপি হতে ৭ম-২৩তম তবকাতের (তবকাত-এর অর্থ হল কাহিনি, মিনহাজউদ্দিন সিরাজীর মূল ফারসি গ্রন্থটি ২৩টি তবকাত যুক্ত মূল ফারসি পাঠ থেকে ইংরেজিতে দু-খণ্ডে গ্রন্থটি অনুবাদ করেন এইচ জি র্যাভার্টি (তিনি তার ইংরেজি গ্রন্থে প্রথম ৬টি তবকাতের অনুবাদ করেননি)। এটি ১৮৮১ সালে এশিয়াটিক সােসাইটি অফ বেঙ্গল (কলকাতা) হতে প্রকাশিত হয়। এখানে যে নামটি পাওয়া যায় সেটা হল, ইখতিয়ার-উদ-দীন মােহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি। র্যাভার্টি বলেন যে, অন্য পাণ্ডুলিপিতে বিন শব্দটির সন্ধান না পাওয়া গেলেও বিন (এর অর্থ পুত্র) শব্দটি এখানে অদৃশ্য রয়েছে।৪
- ৪. হেনরি ব্লকম্যান র্যাভার্টির প্রতিবাদ করেন। তিনি বলেন, বিন অর্থাৎ পুত্র শব্দটি উহ্য থাকার কোনাে কারণ থাকতে পারে না। তাছাড়া অদৃশ্য শব্দের উপর ভরসা করে কোনাে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় না বলে তিনি মত প্রকাশ করেন।৫ পরবর্তীতে ব্লকম্যানের যুক্তিকে বেশিরভাগ ঐতিহাসিকরা মান্যতা দিয়ে বলেছেন, নামটি ইখতিয়ার-উদ-দীন মােহাম্মদ বখতিয়ার খিলজি—ইখতিয়ার-উদ-দীন, বখতিয়ার খিলজির পুত্র ছিলেন না। এক্ষেত্রে নামটি সংক্ষেপে হবে বখতিয়ার খিলজি।৬
- ৫. কে কে কানুনগাে এ েত্রে গভীর আলােকপাত করে র্যাভার্টির যুক্তিকে হাস্যকর বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি মুহাম্মদ বখতিয়ার নামকেই বেশি গ্রহণীয় বলে মনে করেন।৭ দীনেশচন্দ্র সেনও এই নামটি গ্রহণ করেছেন।৮
- ৬. সমসাময়িক গ্রন্থ হাসান নিজামির ‘তাজ-উল-মাসির’-এর সাক্ষ অনেক প্রামাণিক। সেখানে স্পষ্টভাবে নাম বলা হয়েছে ইখতিয়ারুদ্দীন মুহম্মদ বখতিয়ার।৯
- ৭. ফখরউদ্দিন ইসামি তাঁর ‘ফুতুহুস সালাতিন’-এ মুহম্মদ বিন বখতিয়ার নামটি ব্যবহার করেছেন।১০
- ৮. গােলাম হুসেন সলীম তার ‘রিয়াজ-উস-সালাতিন’ গ্রন্থে নামটি এক্তিয়ারউদ্দীন মােহাম্মদ বখতিয়ার খিলিজি বলে উল্লেখ করেছেন।১১
- ৯. জন ক্লার্ক মার্শম্যানের কাছে বখতিয়ার খিলজি নামটি গ্রহণীয় হয়েছে।১২
- ১০. নীহাররঞ্জন রায় মুহম্মদ বখতিয়ার খিলজি নামটিই ব্যবহার করেছেন।১৩
- ১১. রমেশচন্দ্র মজুমদার ও সুখময় মুখােপাধ্যায় প্রমুখের কাছে গ্রহণযােগ্য হয়েছে ইখতিয়ারুদ্দীন মুহম্মদ বখতিয়ার খিলজি।১৪
- ১২. রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, মহম্মদ-ই-বখতিয়ার। তিনি লিখেছেন, “…মগধদেশ মুসলমান নায়ক মহম্মদ-ই বখতিয়ার খিলজির আক্রমণে জর্জরিত হইয়া উঠিয়াছিল।”১৫
- ১৩. রজনীকান্ত চক্রবর্তী বলেছেন, ইখতিয়ারউদ্দিন মুহাম্মদ বখতিয়ার খিলজি।১৬
- ১৪. হেনরি ব্লকম্যান ও সৈয়দ এজাজ হুসেন এই দুই ঐতিহাসিক যথাক্রমে মুহাম্মদ বখতিয়ার খিলজি ও মুহাম্মদ বখতিয়ার খিলজি নামকেই গুরুত্ব দিয়েছেন।১৭
- ১৫. আবদুল করিম বহু ভাবনাচিন্তা করে মােহাম্মদ বখতিয়ার খিলজি নামটি গ্রহণ করেছেন।১৮
- ১৬. বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসকার অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বখতিয়ার খিলজি নাম ব্যবহার করেছেন।১৯
- ১৭. এ বি এম হাবিবুল্লাহর কাছে ইখতিয়ারউদ্দীন মুহাম্মদ বখতিয়ার খিলজি নামটি গ্রহণযােগ্য।২০ হাবিবুল্লাহ বলেছেন, নামটির এই সহজ রূপটিই আছে মুদ্রিত পাঠে এবং তবকাত-ই-নাসিরী’র ব্রিটিশ মিউজিয়াম পাণ্ডুলিপি সমূহে। বিন’এর পরিবর্তে মুহাম্মদ ব্যবহার করার ক্ষেত্রে র্যাভার্টির বাতিক রয়েছে বলে তিনি মনে করেন।২১
সুতরাং নামের সামান্য অদলবদল ঘটলেও সমস্ত দিক বিচার বিবেচনা করে মােহাম্মদ বখতিয়ার খিলজি আরও সংক্ষেপে বখতিয়ার খিলজি২২ নামটি লেখা সঠিক ও যুক্তিযুক্ত বলে মনে হয়। আধুনিক ঐতিহাসিক ও পণ্ডিতেরাও তাদের গবেষণা গ্রন্থে বখতিয়ার খিলজি নামটাই ব্যবহার করে থাকেন।
[২]
রাজা লক্ষ্মণ সেনের আমলেই (১১৭৯-১২০৬) মােহাম্মদ বখতিয়ার খিলজি বঙ্গদেশ তথা নদিয়া অভিযান করেন। তবে এ আলােচনার পূর্বে তুর্কি বিজয়পূর্ব বঙ্গদেশের সার্বিক অবস্থা কেমন ছিল সে আলােচনা খুবই প্রাসঙ্গিক পাল যুগের (৭৫০-১১৪৪) শেষের দিক থেকে লক্ষ্মণ সেনের আমল পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় সহায়তায় ব্রাহ্মণ্যবাদীরা বর্ণাশ্রম বহির্ভূত অন্য সমস্ত ধর্মমত বা সম্প্রদায়ের ওপর বিদ্বেষপূর্ণ কার্যক্রম চালিয়ে গেছেন। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, ব্রাহ্মণ্যবাদের পুনরুত্থানের অন্যতম তাত্ত্বিক কুমারিল ভট্ট অষ্টম শতকেই বিধান দিয়েছিলেন যে, বৌদ্ধ মাত্রই বধ্য। সে কারণেই “মাদুরার রাজা অষ্টম শতাব্দীতে কবি ও সাধু সম্বন্দরের সম্মতিক্রমে আট হাজার গোঁড়া জৈন পণ্ডিতকে শূলে চড়াইয়াছিলেন। ‘শঙ্করবিজয়ে’ উল্লিখিত আছে যে, রাজা সুধন্য অসংখ্য জৈন ও বৌদ্ধ পণ্ডিতের মস্তক উলুখলে নিষ্পেশন করিয়া চূর্ণ-বিচূর্ণ করিয়াছিলেন।”২৩ বঙ্গদেশেও এরকম কার্যক্রমের ফলে অন্য ধর্মাবলম্বী বা সম্প্রদায়ের সংগঠনগুলি, বিশেষত বৌদ্ধদের বিহারগুলি রাজানুকূল্য হতে বঞ্চিত হয়ে পড়ল। আবার এই ব্রাহ্মণ্যবাদের পুনরুত্থানের যুগের সমান্তরালে একটি অর্থনৈতিক প্রক্রিয়াও ক্রিয়াশীল ছিল। বৌদ্ধধর্মাবলম্বী গুপ্ত-পাল রাজাদের সময়ে দেশের অর্থনীতির চরম বিকাশ ঘটেছিল। কৃষি ও কুটিরশিল্পজাত উদ্বৃত্ত ভােগ্য পণ্য কেবল উৎপাদনকারী গ্রামের মানুষের মধ্যেই বন্টিত হত না, তা সারা রাজ্যময় বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ছড়িয়ে যেত। দেখা দিয়েছিল বড় বড় নগর আর ধনাঢ্য বণিকদের, যারা সেইসব নগরের অধিবাসীদের কৃষিজাত ও কুটির শিল্পজাত ভােগ্য বস্তুর জোগান দিত। ফলে উদ্ভব হয়েছিল শিল্পদ্রব্য উৎপাদনকারীদের সংঘ, বণিকদের সংঘ এবং বৌদ্ধ বজ্রযানী মূর্তির মন্দির। আর এই শিল্প উৎপাদনকারী ও বণিকদের অধিকাংশই ছিল তৎকালে প্রচলিত বজ্রযানী বৌদ্ধধর্মের মানুষ। তাদের আর্থিক সহায়তাও বৌদ্ধ বিহারগুলিকে পুষ্ট করত। কিন্তু ‘ব্রাহ্মণ্য’ ধর্মের পুনরুত্থানের যুগে অর্থনৈতিক বিকাশ কেবল রুদ্ধ হয়ে গেল তাই নয়, সেটা ক্রমশ সংকুচিত হতে হতে আবার স্বয়ম্ভর গ্রামকেন্দ্রিক অর্থনীতিতে ফিরে গেল। শিল্প-বাণিজ্যের অবসানের ফলে বণিক ও শিল্পোৎপাদকদের সংগঠনগুলিও ভেঙে গেল। রাজানুকূল্য বঞ্চিত বৌদ্ধ বিহারগুলি বণিক শিল্পোৎপাদকদেরও সাহায্যবিহীন হয়ে অবলুপ্তির পথে চলে গেল। বৌদ্ধ মন্দিরগুলিও ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়ে গেল। ফলে রাজ্যের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা, যারা তাদের জীবনচর্চার প্রতিটি পদক্ষেপে বিহারের শ্রমণদের নেতৃত্বে চলত, তারা নেতৃত্বহীন হয়ে পড়ল।
আর্য ব্রাহ্মণ্যবাদীদের এরকম আক্রমণ কেবল ভিন্নধর্মীদের বিরুদ্ধেই পরিচালিত হয়েছিল তা নয়। আনন্দভট্ট রচিত ‘বল্লাল চরিত’-এ আছে যে, রাজা বল্লাল সেন (১১৫৯-১১৭৯) শৈবপন্থাকে ত্যাগ করে বৈষ্ণব পন্থায় দীথিত হয়েছিলেন। ফলে বল্লালের রাজসভার শৈব পুরােহিত কর্মচ্যুত হন এবং একজন বৈষ্ণব পুরােহিত তার স্থানে অভিষিক্ত হন। ওই শৈব রাজপুরােহিতের সঙ্গে বৈষ্ণব রাজপুরােহিতের বিবাদ ঘটে। বৈষ্ণব রাজপুরােহিত বল্লালের কাছে শৈব ধর্মপ্রধানের বিরুদ্ধে অভিযােগ করলে বল্লাল সেই শৈব ধর্মপ্রধানকে তার অধীনস্থ মঠের সমুদয় সন্ন্যাসীসহ দেশ থেকে বিতাড়িত করেন।
লক্ষণীয় যে, দাক্ষিণাত্যে উদ্ভূত শৈব ধর্ম কালক্রমে হিন্দু বর্ণাশ্রম ধর্মের আঙিনায় স্থান পেলেও ঘরে ঢােকার অনুমতি পায়নি। তাই বৈষ্ণব রাজা বল্লাল সেনের সক্রিয় সহায়তায় যদি হিন্দু ধর্মেরই অপর এক সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে এরকম আচরণ হয়ে থাকে, তবে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধর্মমতের অনুসারীদের বিরুদ্ধে তৎকালীন রাজতন্ত্র কোনাে মানসিকতার দ্বারা পরিচালিত হত তা বলার প্রয়ােজন আছে বলে মনে হয় না।
বাংলার কুলজী গ্রন্থ অনুসারে বল্লাল সেন অনেক সমাজসংস্কার মূলক কার্য এবং বাংলায় কৌলীন্য প্রথার প্রবর্তন করেন। সমাজে তিনি গোঁড়া ব্রাহ্মণ্য ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন।২৪ তিনি হিন্দু সমাজকে নতুনভাবে গঠন করে ব্রাহ্মণ, বৈদ্য ও কায়স্থ—এই তিন শ্রেণির মধ্যে কৌলীন্য প্রথার প্রবর্তন করেন। এই কুলীন শ্রেণির লােকদের কিছু কিছু বিশেষ রীতিনীতি মান্য করতে হত। ন্যায়পরায়ণতা, জাতিগত পবিত্রতা, সততা প্রভৃতি সদগুণ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার জন্য এই সকল রীতিনীতি প্রবর্তিত হয়েছিল। কিন্তু আধুনিক গবেষণায় কৌলীন্য প্রথা প্রবর্তনের সঙ্গে বল্লাল সেনের জড়িত থাকার কথা ভ্রান্ত বলে প্রমাণিত হয়েছে।২৫ কারণ সমকালীন সাহিত্য ও সেন লিপিতে এর কোনাে উল্লেখ নেই। উল্লেখ্য যে, তৎকালীন বাংলার বিখ্যাত স্মৃতিশাস্ত্রকার ভট্টভব দেব, হলায়ুধ মিশ্র, অনিরুদ্ধ ভট্ট, জীমূতবাহন প্রভৃতি মনীষী হিন্দু সমাজের বহু বিধান প্রদান করিলেও কৌলীন্য প্রথার কোনাে উল্লেখ তাদের রচিত কোনাে গ্রন্থে নেই। তাছাড়া ব্রাহ্মণদের ভূমিদান সম্পর্কিত সেন লিপিমালার কোথাও কৌলীন্য প্রথা প্রবর্তনের ইঙ্গিতও নেই। সম্ভবত বাংলায় মুসলিম অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবার বহুকাল পরে ব্রাহ্মণেরা এই প্রথা চালু করেছিলেন। কারণ সমাজের উচ্চস্তরভুক্ত ব্রাহ্মণেরা তৎকালীন বাংলার সামাজিক বিধিবিধান প্রবর্তনে সকল সময়েই উদগ্রীব থাকতেন।২৬
বল্লাল সেন একজন সুপণ্ডিত ব্যক্তি ছিলেন। প্রশস্তিকারগণ তাকে ‘বিদ্বমানমণ্ডলীর চক্রবর্তী’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন।২৭ তিনি গুরু অনিরুদ্ধ ভট্টের নিকট বেদ, স্মৃতিশাস্ত্র, পুরাণ প্রভৃতি বিষয় অধ্যয়ন করেছিলেন। তিনি ‘দানসাগর’ ও ‘অদ্ভুতসাগর’ গ্রন্থ দুটি রচনা করেন। কিন্তু ‘অদ্ভুতসাগর’ গ্রন্থটি শেষ করে যেতে পারেননি। তাঁর পুত্র লক্ষ্মণ সেন এই গ্রন্থের রচনা সমাপ্ত করেন। গুরু অনিরুদ্ধ ভট্টের নির্দেশে বল্লাল সেন ‘দানসাগর’ রচনা করেন।
বল্লাল সেনের পর তার পুত্র লক্ষ্মণ সেন সিংহাসনে আরােহন করেন। তার সময়ে সেন সাম্রাজ্যের অভূতপূর্ব উন্নতি ও চরম অবনতি হয়েছিল। লক্ষ্মণ সেনের তাম্রশাসনগুলিতে তার কৃতিত্ব সম্পর্কে অতি স্তুতিবাচক বর্ণনা রয়েছে। এতে বলা হয়েছে যে, তিনি যৌবনে কলিঙ্গ অভিযান করেছিলেন, যুদ্ধে কাশীরাজকে পরাজিত করেছিলেন এবং ভীরু প্রাগজ্যোতিষের রাজা তার বশ্যতা স্বীকার করেছিলেন।২৮ কিন্তু আমরা দেখেছি যে, এই রাজন্যবর্গের বিরুদ্ধে বিজয় সেন ও বল্লাল সেন যুদ্ধাভিযান করেছিলেন। তবে তার তাম্রশাসনে ‘কৌমার কেলী’ কথাটি বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। সুতরাং এই সকল যুদ্ধাভিযান লক্ষ্মণ সেনের যৌবন বয়সে হয়েছিল এবং লক্ষ্মণ সেন এতে অংশগ্রহণ করেছিলেন—এমন ধারণা করা অসঙ্গত নয়। কারণ মিনহাজের বর্ণনায় বখতিয়ার কর্তৃক নদিয়া আক্রমণের সময় লক্ষ্মণ সেনের বয়স প্রায় ৮০ বছর ছিল এবং সম্ভবত ৫৪ বছর বয়সে তিনি রাজক্ষমতা গ্রহণ করেন। সুতরাং পিতা ও পিতামহের রাজত্বকালে তার যৌবনকাল অতিক্রান্ত হয়।২৯ তবে এটাও অসম্ভব নয় যে, বিজয় সেন ও বল্লাল সেনের রাজত্বকালে এই সমস্ত অঞ্চল সম্পূর্ণরূপে বিজিত হয়নি, তাই লক্ষ্মণ সেনকে পুনরায় এই সকল অঞ্চল জয় করতে হয়েছিল।৩০
তবে রাজ্য সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে লক্ষ্মণ সেন কিছুটা সাফল্য অর্জন করেছিলেন। তাঁর পুত্রদ্বয়ের তাম্রশাসনে তাঁর পুরী, কাশী ও প্রয়াগে সমরজয়স্তম্ভ স্থাপনের উল্লেখ আছে।৩১ এই সময় গঙ্গাবংশীর রাজাগণ কলিঙ্গ ও উৎকলে রাজত্ব করতেন। সম্ভবত লক্ষ্মণ সেন তাদের পরাজিত করে পুরী দখল করেন। এছাড়া পশ্চিমে গাহাড়বালদের বিরুদ্ধে তিনি উল্লেখযােগ্য সাফল্য অর্জন করেন। মগধে প্রাপ্ত দু’টি লিপি হতে এর প্রমাণ পাওয়া যায়।৩২ এছাড়া ‘প্রবন্ধকোষ’ ও ‘পুরাতন প্রবন্ধ সংগ্রহ’ প্রভৃতি জৈন গ্রন্থ হতেও এর সমর্থন মিলেছে।৩৩ পালদের পতনে মগধাঞ্চলে গাহাড়বালদের অগ্রগতি সেন সাম্রাজ্যের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বিঘ্ন সৃষ্টি করেছিল। তাদের বিরুদ্ধে বিজয় সেন ও বল্লাল সেন বিশেষ সাফল্য অর্জন করেননি।৩৪ সুতরাং লক্ষ্মণ সেন কর্তৃক পুরী, কাশী ও প্রয়াগে সমরজয়স্তম্ভ স্থাপন অত্যন্ত স্বাভাবিক ছিল।
রাজা লক্ষ্মণ সেনের সভাকবি উমাপতিধর ও শরণ চেদিরাজা (কলচুরি রাজা) ও এক ম্লেচ্ছ রাজার বিরুদ্ধে সম্ভবত তাঁর (লক্ষ্মণ সেন) জয়লাভের কথা বলেছেন।৩৫ তখন রতনপুরের কলচুরি রাজবংশের রাজত্ব চলছিল। কলচুরিদের বিরুদ্ধে সংঘর্ষে লক্ষ্মণ সেনের সাফল্য সভাকবিরা উল্লেখ করলেও মধ্যপ্রদেশে প্রাপ্ত লিপিতে তারই (লক্ষ্মণ সেন) পরাজয়ের উল্লেখ আছে। সুতরাং উভয়পক্ষর সাফল্য দাবি এর ফলাফলকে অনিশ্চিত করেছে।৩৬ ম্লেচ্ছ অর্থাৎ মুসলমান রাজার বিরুদ্ধে জয়লাভের উল্লেখ হতে নীহাররঞ্জন রায় বখতিয়ার খিলজির বিরুদ্ধে লক্ষ্মণ সেনের সাফল্য অনুমান করেছেন।৩৭ আবার জে এম রায় ম্লেচ্ছ বলতে আরাকানের মগদের বুঝিয়েছেন। তাঁর মতে, মগগণ হয়তাে বাংলা আক্রমণ করেছিল এবং লক্ষ্মণ সেন তাদের পরাজিত করেছিলেন।৩৮
বহু সমরবিজেতা লক্ষ্মণ সেন শিল্প, সাহিত্য ও ধর্মচর্চায়ও বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তিনি একজন সুকবি ছিলেন এবং তাঁর রচিত কয়েকটি শ্লোক শ্ৰীধর দাসের ‘সদ্যুতক্তিকর্ণামৃত গ্রন্থে পাওয়া যায়। এছাড়াও তিনি পিতা বল্লাল সেনের অসমাপ্ত ‘অদ্ভুতসাগর’ গ্রন্থটি রচনা শেষ করেন। ধােয়ী, শরণ, জয়দেব, গােবর্ধন, উমাপতিধর তাঁর রাজসভার পঞ্চরত্ন ছিলেন। ব্রাহ্মণসর্বম’ গ্রন্থ রচয়িতা হলায়ুধ মিশ্র লক্ষ্মণ সেনের মন্ত্রী ও ধর্মাধ্যক্ষ ছিলেন। সাহিত্যক্ষেত্র ব্যতীত শিল্প ক্ষেত্রেও বাংলা এই সময় উল্লেখযােগ্য অগ্রগতি লাভ করে। কিন্তু আর্থিক অগ্রগতি?
লক্ষ্মণ সেনের আমলে রাজ্যের আর্থিক দুরবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, গ্রামস্তর পর্যন্ত বেতনভুক রাজস্ব সংগ্রহকারী নিয়ােগের ক্ষমতা তাদের ছিল না। অন্যদিকে সামন্ত ব্যবস্থার মাধ্যমে রাজস্ব ও সেনা সংগ্রহ আর হচ্ছিল না। মনে হয় সামন্ত ব্যবস্থার অবসান ঘটেছিল। সে কারণেই কেবল রাজস্ব আদায়ের জন্য উচ্চবর্ণের পরিবারগুলির মধ্য থেকে বিত্তবানদের নির্বাচিত করে এক একজনকে এক একটি ভৌগােলিক এলাকার রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব দেওয়া হত। এরা আদায়ীকৃত রাজস্বের একটি শতকরা হারে নির্ণীত অংশের অধিকারী হতেন এবং বাকিটা সরকারে জমা দিতেন। এই ব্যবস্থার ফলে মধ্যস্বত্বভােগীরা লাভবান হতেন। বাংলায় জমিদারী প্রথার উদ্ভবের এটাই হল সম্ভাব্য সূত্রপাত। ফলে গ্রামের কৃষক ও অন্যান্য শ্রমজীবীদের কাছ থেকে বেশি বেশি কর আদায়ের জন্য উৎপীড়ন শুরু হল। বলা বাহুল্য যে, তাতে রাজার বা রাজতন্ত্রের প্রত্যক্ষ সমর্থন ছিল। তাই যুগ যুগ ধরে বহমান প্রাগার্য ম্লেচ্ছদের প্রতি ধর্মীয় কারণে অতলান্ত ঘৃণার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল অর্থনৈতিক কারণে বৈরীতা, উৎপীড়ন।
তুর্কি আক্রমণের ঠিক পূর্ব মুহূর্তে রাজ্যের অর্থনৈতিক অবস্থার চরম অবনতিতে কোনও স্থায়ী সৈন্যবাহিনী রাজ্য রক্ষায় নিয়ােজিত ছিল না। বিন্দুমাত্র প্রতিরােধের সম্মুখীন না হয়েই তুর্কি বাহিনীর বঙ্গদেশ বিজয় সে অবস্থাকেই প্রামাণ্য করে।
এক স্থায়ী সৈন্যবাহিনীর অবর্তমানে কায়িক শ্রমে যে সমস্ত মানুষ জীবিকার্জন করত, তথাকথিত ব্রাহ্মণ্য ধর্মের বিচারে সেই সব ম্লেচ্ছ লােকেরাই সক্ষম ছিল অস্ত্র ধারণ করে রাজ্য রক্ষায় এগিয়ে আসতে। কিন্তু পুরুষানুক্রমিকভাবে রাষ্ট্রীয় সাহায্যে আচরিত ধর্মবিদ্বেষে তারা এমনভাবে জর্জরিত হয়েছিল যে, তারা বহু পূর্ব থেকেই এই রাজ্যপাট সম্পর্কে সম্পূর্ণ নিস্পৃহ হয়ে গিয়েছিল। রাষ্ট্রব্যবস্থার যাবতীয় সুবিধাভােগী কায়িক শ্রম বিমুখ উচ্চবর্ণের লােকেরা কি করলেন? বহুদিন ধরে আশঙ্কিত তুর্কি আক্রমণ বাস্তব রূপ গ্রহণের বহু পূর্বেই তথাকার ব্রাহ্মণরা ও বিত্তবান বৈদ্য ও কায়স্থরা তাদের পুঁজিপঞ্জী ও অস্থাবর সম্পদ নিয়ে পূর্ববঙ্গে পলায়ন করেছিলেন। আর সৈন্যহীন ও জনসমর্থনহীন রাজা লক্ষ্মণ সেন রাজপ্রাসাদের দ্বারে তুর্কি সৈন্যের আগমনের অপেক্ষা করছিলেন।
তাছাড়া লক্ষ্মণ সেনের শেষ জীবন সুখের ছিল না, কারণ এই সময় তিনি বিপর্যয়ের সম্মুখীনও হয়েছিলেন। তখন রাষ্ট্রাভ্যন্তরে বি-ব ও বহিরাক্রমণ দেখা দিয়েছিল। সুন্দরবন অঞ্চলের এক মহামালিকের পুত্র বৌদ্ধ নরপতি ডুম্মন পাল বিদ্রোহ ঘােষণা করেন এবং মহারাজাধিরাজ উপাধি ধারণ করে স্বাধীন রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন।৩৯ অপর দিকে প্রায় একই সময়ে মেঘনা নদীর পূর্বপার্ধে দেববংশ নামে এক স্বাধীন রাজবংশের উদ্ভব হয়।৪০ এসবের ফলে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে ভয়াবহ ষড়যন্ত্র, কেন্দ্রীয় শক্তির দুর্বলতা এবং অভ্যন্তরীণ গােলযােগ ও অন্তর্বিরােধের আভাস পাওয়া যায়। এমনই এক সংকটকালে (১২০৪) বঙ্গদেশের নদিয়ায় বখতিয়ারের অভিযান পরিচালিত হয়। যে মুহূর্তে রাজপ্রাসাদের বাইরে তুর্কি সৈন্যের আগমনের সংবাদ পেলেন সঙ্গে সঙ্গে লক্ষ্মণ সেন রাজধানী তুর্কি বাহিনীর হাতে ছেড়ে ‘বঙ্গরাজ্য’ তথা পূর্ববঙ্গে চলে গেলেন।৪১ সেখানে লক্ষ্মণ সেন আরও কয়েক বছর রাজত্ব করেন, এবং এরপরে তাঁর বংশধররা আরও প্রায় দু-দশক রাজত্ব করে গেছেন। বিধরূপ সেনের তাম্রশাসনে সম্ভবত তার দুই পুত্র কুমার সূর্য সেন ও কুমার পুষােত্তম সেনের নামের উল্লেখ আছে কিন্তু তাদের কেউ রাজত্ব করেছিলেন কিনা জানা যায় না। অথচ মিনহাজ যে সময় লক্ষ্মণাবতীতে আসেন (১২৪২) তখনও লক্ষ্মণ সেনের বংশধরগণ পূর্ববঙ্গে রাজত্ব করছিলেন। সুতরাং মনে হয় কেশব সেনের পরেও একাধিক সেন রাজা পূর্ববঙ্গে রাজত্ব করেছিলেন।৪২
[৩]
মােহাম্মদ বখতিয়ার খিলজি থেকে শুরু করে বাংলার ৩০ বছরের প্রায় সমস্ত ঘটনা সমকালীন ইতিহাস প্রণেতা মিনহাজই-সিরাজী৪৩ তাঁর ‘তবকাত-ই-নাসিরী’ নামক গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করে গেছেন। তুর্কি অধিকার সম্পর্কে এটিই সবচেয়ে মানসম্পন্ন গ্রন্থ। মােহাম্মদ বখতিয়ার খিলজির গৌড় বিজয়ের ৩৮ বছর পর (১২৪২) সেই যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী দুই ব্যক্তির৪৪ কাছ থেকে মিনহাজ নিজে এই সমস্ত ঘটনার জবানবন্দি গ্রহণ করেছিলেন। পরে ১২৬০ সালে দিল্লিতে বসে গ্রন্থটি লেখেন। সে কারণে কিছু ‘অতি নিরপেক্ষ’ ইতিহাসবিদ মন্তব্য করেছেন যে, স্বধর্ম প্রীতিতে আচ্ছন্ন মিনহাজ মুসলমানদের বীরত্ব ও সে পরিপ্রেক্ষিতে হিন্দু রাজার ও জনসাধারণের কাপুরুষতাকে চিত্রিত করতে মনগড়া কাহিনি লিপিবদ্ধ করে গেছেন। এই মিনহাজই কিন্তু সেই একই গ্রন্থে এক মুসলমান বাহিনীর কামরূপ আক্রমণ করতে গিয়ে শােচনীয় পরাজয়ের ও প্রায় সমগ্র বাহিনীর নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার কাহিনি পরিবেশন করেছেন তাঁর গ্রন্থে। শুধু তাই নয়, এই মিনহাজই তার ‘তবকাত-ইনাসিরী’তেই আল্লাহর কাছে সকাতর প্রার্থনা করেছেন, আল্লাহ যেন ‘মহান ব্যক্তি৪৫ রাজা লক্ষণ সেনের পরলােকবাস সুখকর করেন। লক্ষ্মণ সেনের দানশীলতা ও বদান্যতার কথা তুলে ধরতেও মিনহাজ কার্পণ্য করেননি। এমনকি তিনি এৰেত্রে লক্ষ্মণ সেনকে দিল্লির সুলতান কুতুবউদ্দিন আইবকের সাথে তুলনা করেছেন। কেউ লক্ষ্মণ সেনের কাছে দানের জন্য হাত বাড়ালে তিনি তাকে লক্ষ কড়ি দান করতেন। মিনহাজ লিখেছেন “বিশ্বস্ত ব্যক্তিরা এই লেখককে জানিয়েছিলেন যে, রাজা লক্ষ্মণ সেন কারও প্রতি কখনাে কোনাে অন্যায় অত্যাচার করেননি এবং যে-কেউ তাঁর নিকট ধন-প্রার্থনা করত তিনি অকাতরে তাকে ধন দান করতেন—যেমন করতেন দিল্লীর সুলতান কুতুবউদ্দিন। লক্ষ্মণ সেন প্রতিদিন অন্তত এক লাখ কড়ি দান করতেন। ঈশ্বর তার প্রাপ্য শাস্তি যেন লাঘব করেন।”৪৬ এরকম মানসিকতাকে কি নিরপেক্ষ ইতিহাসবিদগণ অন্ধ হিন্দু বিদ্বেষের বিকট প্রকাশ বলে মনে করেন?
মিনহাজ-ই-সিরাজী কিছু ভুল তথ্যও দেন। যেমন রাজা লক্ষ্মণ সেন সম্পর্কে। লক্ষ্মণ সেন ৮০ বছর রাজত্ব করেন বলে মিনহাজ উল্লেখ করেছেন। আসলে তা ঠিক নয়। তিনি ২৬ বছর রাজত্ব করেছিলেন। তাছাড়া দিল্লির সালতানাত ঘিরে শুধু রাজনৈতিক সমস্যাবলী এসেছে। কিন্তু সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থা তাঁর গ্রন্থে আসেনি। এ বি এম হাবিবুল্লাহর মতে, মিনহাজ ঘােরি বংশ, ইলতুতমিস, উলুঘ খান ও নাসির উদ-দীন মাহমুদ প্রমুখ পৃষ্ঠপােষকদের কিছু পক্ষপাতিত্ব করেছেন ও তাদের দোষ-ত্রুটি গােপন করেছেন। বিভিন্ন সমালােচনা সত্ত্বেও ভারত ও বাংলায় প্রাথমিক মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার ইতিহাস জানতে হলে ‘তবকাত-ই-নাসিরী’র গুরুত্বকে কোনােভাবেই অস্বীকার করা যায় না। ঐতিহসিক ফিরিস্তা মিনহাজের এই গ্রন্থটিকে ‘অ্যান এক্সিলেন্ট ওয়ার্ক অফ দ্য হায়েস্ট অথরিটি’ বলে গণ্য করেছেন। এলফিনস্টোন এটিকে ‘এ ওয়ার্ক অফ দ্য হায়েস্ট সেলিব্রিটি’ বলে উল্লেখ করেছেন। চার্লস স্টুয়ার্ট তাঁর ‘হিস্টরি অফ বেঙ্গল’ গ্রন্থ রচনায় ‘তবকাত-ই-নাসিরী’কে হুবহু অনুসরণ করেছেন এবং মূল্যবান গ্রন্থ হিসেবে এর ভূয়সী প্রশংসা করেছেন।
[৪]
মােহাম্মদ বখতিয়ার খিলজি ছিলেন জাতিতে তুর্কি এবং বৃত্তিতে ভাগ্যান্বেষী সৈনিক। তিনি ছিলেন আফগানিস্তানের গরমশির বা আধুনিক দশত-ই-মার্গের অধিবাসী। তাঁর বাল্যজীবন সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানা যায় না। তবে মনে হয় দারিদ্র্যের পীড়নে তিনি ১১৯৫ সালে স্বদেশ ত্যাগ করেন এবং স্বীয় কর্মশক্তির উপর নির্ভর করে তাঁর অগণিত দেশবাসীর ন্যায় ভাগ্যান্বেষণে বের হন। গজনীতে সুলতান মােহাম্মদ ঘােরির (১১৮৬-১২০৬) সৈন্যবিভাগে চাকরি প্রার্থী হয়ে তিনি ব্যর্থ হন। খাট, লম্বা হাত ও কুৎসিত চেহারার বখতিয়ার নিশ্চয়ই সেনাধ্যক্ষর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেননি। গজনীতে ব্যর্থ হয়ে বখতিয়ার খিলজি দিল্লিতে আসেন এবং দিল্লির শাসনকর্তা কুতুবউদ্দিন আইবকের (১২০৬-১২১০) দরবারে হাজির হন। এবারও তিনি চাকরি পেতে ব্যর্থ হন। তারপর তিনি বদাউনে যান এবং সেখানকার শাসনকর্তা হিজবরউদ্দিন বখতিয়ারকে নগদ বেতনের চাকরিতে ভর্তি করেন। বখতিয়ারের ন্যায় উচ্চাভিলাষী সামান্য বেতনভােগী সৈনিকের পদে তৃপ্ত থাকতে পারেননি। অল্পকাল পরে তিনি বাউন ত্যাগ করে অযােধ্যায় যান এবং সেখানকার শাসনকর্তা মালিক হুসামউদ্দিন তাকে বর্তমান উত্তরপ্রদেশে মির্জাপুর জেলার পূর্ব-দক্ষিণ কোণে ভাগত ও ভিউলী৪৭ নামক দুইটি পরগণার জায়গির প্রদান করেন। এখানে বখতিয়ার খিলজি তার ভবিষ্যৎ উন্নতির উৎস খুঁজে পান এবং ভাগত ও ভিউলী তার শক্তিকেন্দ্র হয়ে ওঠে।
ভাগত ও ভিউলীতে অবস্থানকালে বখতিয়ার খিলজি অল্প সংখ্যক সৈন্য সংগ্রহ করে পার্ববর্তী হিন্দুরাজ্য আক্রমণ করতে থাকেন। হিন্দু রাজাদের মধ্যে ঐক্য ছিল না, ফলে এই রাজ্যগুলি সহজেই বখতিয়ারের অধিকারে আসে। বখতিয়ারের বীরত্বের কথা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে এবং অনেক ভাগ্যান্বেষী মুসলমান তার সৈন্যদলে যােগদান করেন। ফলে বখতিয়ারের সৈন্যসংখ্যা বৃদ্ধি পায়। এভাবে পার্ববর্তী অঞ্চলে আক্রমণ চালিয়ে একদিন তিনি ২০০ আরােহী সেনা নিয়ে এক প্রাচীরবেষ্টিত দুর্গের মতাে স্থানে আসেন এবং আক্রমণ করেন (আসলে দূর্গটি ছিল উদন্তপুর মহাবিহার— বৌদ্ধ ভিক্ষুদের আবাসস্থল। বখতিয়ার ভুলে দুর্গ ভেবে এটিকে আক্রমণ করেন)। প্রতিপক্ষা রাজা গােবিন্দপাল দেব কোনাে বাধাই দিলেন না। ১২০৩-এ দুর্গ জয়ের পর তিনি দেখলেন যে, দুর্গের অধিবাসীরা সকলেই মুণ্ডিতমস্তক ব্রাহ্মণ৪৮ এবং দুর্গটি বইপত্রে ভরা। জিজ্ঞাসাবাদের পর তিনি জানতে পারলেন যে, তিনি এক বৌদ্ধবিহার জয় করেছেন। এটি ছিল উদন্দ বিহার বা উদন্তপুরী বিহার।৪৯ এই সময় থেকেই মুসলমানেরা ওই স্থানের নাম দিলেন বিহার এবং আজ পর্যন্ত শহরটি বিহার বা বিহার শরিফ নামে পরিচিত। কোনাে কোনাে ঐতিহাসিকের মতে, বখতিয়ার কর্তৃক উদন্তপুরী বিহার অধিকৃত হবার পরই এ অঞ্চল থেকে বৌদ্ধধর্ম বিলুপ্ত হয়। এটি সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ধারণা।
একাদশ-দ্বাদশ শতাব্দীতে বাংলার বর্মণ-সেনবংশীয় নৃপতিদের রাজত্বকালে বৌদ্ধধর্ম যে অত্যন্ত বিপন্ন হয়েছিল এবং দ্বাদশ শতাব্দীতে সেন-রাজাদের সময়ে বৌদ্ধধর্ম যে এদেশ থেকে প্রায় বিলুপ্ত হয়েছিল এবং কুমিল্লা জেলার সীমাবদ্ধ অঞ্চল ছাড়া এ ধর্মের অস্তিত্ব যে গােটা বাংলার আর কোথাও ছিল না সেই তথ্য প্রামাণ্য ইতিহাস থেকেই পাওয়া যায়। এর পরে ১২০৪ কি ১২০৫ খ্রিস্টাব্দে বাংলায় মােহাম্মদ বখতিয়ারের নেতৃত্বে তুর্কি অধিকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরে বরেন্দ্র ও রাঢ় অঞ্চলে যে বৌদ্ধদের কোনাে অস্তিত্ব ছিল না সেই প্রমাণও পাওয়া যায়। বাংলার অবশিষ্ট অংশে যে বিশেষ কোনাে পরিবর্তন হয়নি প্রামাণ্য ইতিহাস থেকে সেই তথ্যও পাওয়া যায়।
এই তথ্যের পরিপ্রেক্ষিতে নিঃসংশয়ে ধরে নেওয়া যেতে পারে যে, দ্বাদশ শতাব্দীতে রাঢ় ও বরেন্দ্র অঞ্চলে (উত্তরবঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গ) বৌদ্ধ ধর্মের কোনাে অস্তিত্ব ছিল না। প্রামাণ্য ইতিহাস থেকে আরও জানা যায় যে, চতুর্দশ শতাব্দীর মধ্যেই পূর্ব বঙ্গের সর্বত্র এবং পঞ্চদশ শতাব্দীর মধ্যে সমগ্র বাংলার তুর্কি মুসলমানের অধিকার প্রতিষ্ঠার পর চট্টগ্রামে অতি সীমিত সংখ্যক বড়ুয়া উপাধিধারী বৌদ্ধ ছাড়া দেশে আর কোথাও বৌদ্ধ ধর্মের অস্তিত্ব ছিল না।
উল্লেখ্য যে, এই উপমহাদেশের ধর্ম ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে বাঙালির তিনটি অবদানের কথা সবাই বেশ শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে থাকেন। এগুলি হচ্ছে ঊনবিংশ-বিংশ শতাব্দীতে রাজা রামমােহন রায় কর্তৃক প্রবর্তিত ব্রাহ্মধর্ম, পঞ্চদশ-ষােড়শ শতাব্দীতে শ্রীচৈতন্যদেব (১৪৮৬-১৫৩৩) কর্তৃক প্রচারিত বৈষ্ণবধর্ম এবং পালযুগের শেষদিকে প্রবর্তিত নাথধর্ম।
পালদের পরে এদেশে বর্মন ও সেনদের আবির্ভাব ঘটে। এই উভয় রাজবংশই যে ঘাের বৌদ্ধধর্ম বিরােধী ছিল সে-সম্বন্ধে প্রমাণের অভাব নেই। এঁদের রাজত্বকালে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ থেকে বৌদ্ধধর্মের প্রায় বিলুপ্তি ঘটে। উদন্তপুর ও বিক্রমশীল বিহারের অস্তিত্ব থেকে বিহার প্রদেশের কোনাে কোনাে অঞ্চলে বৌদ্ধধর্ম তখনও টিকে ছিল বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। বাংলার পূর্বাঞ্চলে বর্মন-সেনদের অধিকার তেমন প্রতিষ্ঠিত হয়নি বলে কিছু বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী লােকের অস্তিত্ব সেখানে ছিল বলে জানা যায়। এখানে-ওখানে ছিটেফোটা কিছুসংখ্যক বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী লােকের কথা বাদ দিলে গােটা বাংলায় এদের সংখ্যা যে অতি নগণ্য ছিল, তাতে কোনাে সন্দেহের অবকাশ নেই।
তাছাড়া বিদ্যাধরের একটি শিলালিপি (১২১৯) থেকে জানা যায় যে, বখতিয়ার বৌদ্ধধর্মের ওপর হস্তক্ষেপ করেননি। বৌদ্ধভিদের ওপর ভুলক্রমে প্রথমের দিকে অত্যাচার করা হলেও অভিযানের সময় বিহারটির অভ্যন্তরে অবস্থানরত সকলেই নিহত হয়েছিলেন বলে অনুমান করা হয়। পরবর্তীতে কোনাে নির্যাতনও করা হয়নি৫০ এবং বিহারে বৌদ্ধধর্মের প্রভাব ১২১৯ পর্যন্ত বলবৎ ছিল। তাছাড়া উদন্তপুরী বিহারের সকল পুস্তকাদি নষ্ট করা হয়েছিল বলে রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় যে উক্তি করেছেন তার স্বপক্ষে কোনাে প্রমাণ নেই।৫১ মিনহাজ তাঁর গ্রন্থে পুস্তক পােড়ানাে বা নষ্ট করার প্রসঙ্গ নিয়ে কোনাে কথা লেখেননি। ষােড়শ-সপ্তদশ শতকের তিব্বতী ঐতিহাসিক ও পর্যটক বৌদ্ধ লামা তারনাথের (১৫৭৩-) মতে, বখতিয়ার এ সময় বিক্রমশীলার মঠও অধিকার করেন ও উদন্তপুরে একটি দুর্গ নির্মাণ করেন।৫২ কিন্তু নতুন করে সেখানে দুর্গ নির্মাণের প্রয়ােজন হয়ে পড়ল কেন, যখন সেখানে দুর্গ বর্তমান ছিলই। ধ্বংস হয়ে যাওয়া দুর্গের পুনর্নির্মাণ বা সংস্কারের স্বার্থে হয়ত এক্ষেত্রে এটা করা হয়ে থাকতে পারে।
[৫]
বিহার জয়ের পর বখতিয়ার খিলজি অনেক ধনরত্নসহ কুতুবউদ্দিন আইবকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যান। কুতুবউদ্দিন তাঁর সাহসিকতার পরীক্ষা নিলে সেখানে তিনি সসম্মানে উত্তীর্ণ হয়ে পুরস্কৃত হন এবং সেন রাজের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানের নির্দেশ লাভ করেন। এরপর বখতিয়ার খিলজি বিহার ফিরে আসেন। অধিক সৈন্য সংগ্রহ করে পরের বছর নদিয়া আক্রমণ করেন। এই সময়ে বাংলার রাজা লক্ষ্মণ সেন নদীয়ার নবদ্বীপে অবস্থান করেছিলেন। বখতিয়ার কর্তৃক বিহার জয়ের পর সেন সাম্রাজ্যে গভীর ভীতি বিদ্যমান ছিল। মিনহাজ লিখেছেন,
“বিহার জয়ের পর বখতিয়ার দিল্লীর সুলতান কুতুবউদ্দিন আইবকের দ্বারা সম্মানিত হইলেন, কিন্তু আমীর-ওমরাহ ঈর্ষান্বিত হইয়া তাহার নিন্দাবাদ করিতে লাগিলেন, ব্যঙ্গ বিদ্রুপও বাদ গেল না। ব্যাপার এতদূর গড়াইল যে শেষ পর্যন্ত তাঁহাকে হাতীর সঙ্গে যুদ্ধ করিয়া শারীরিক বলের পরিচয় দিতে হইল। ইহার ফলে তিনি সুলতানের নিকট আরও খেলাত ও সম্মান লাভ করিলেন। সুলতানের আদেশে প্রতিকূল অভিজাতবর্গ বাধ্য হইয়া তাহাকে নানা উপহার দিলেন, কিন্তু সে সমস্ত উপহার বখতিয়ার জনসাধারণের মধ্যে বিলাইয়া দিলেন কেবল সুলতান প্রদত্ত বাদশাহি পােষাক সঙ্গে লইয়া বিহারের দিকে ‘রাহী’ হইলেন। গৌড় (লক্ষ্মণাবতী), বাংলা (পূর্ববাংলা) ও বিহারের নানা অঞ্চলের কাফেরদের হৃদয়ে তাদের প্রতি বিশেষ ভীতি সঞ্চারিত হইল। তাহার বীরত্বের সংবাদ রায় লখমনিয়ার (অর্থাৎ রাজা লক্ষ্মণ সেন) কাছেও পৌঁছাইল।”৫৩
‘তবকাত-ই-নাসিরী’ গ্রন্থে বলা হয়েছে যে, কতিপয় দৈবজ্ঞ ব্রাহ্মণ ও পরামর্শদাতা রাজা লক্ষ্মণ সেনের সম্মুখে উপস্থিত হয়ে তাকে জানান যে, প্রাচীন ঋষিদের লিখিত গ্রন্থে এরূপ ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে যে, এ দেশ তুর্কিদের (মুসলমানদের) হস্তগত হবে এবং যখন সে সময় আসবে, তখনকার রাজা ও তার প্রজামণ্ডলীর পক্ষে অন্যত্র পলায়ন ব্যতীত গত্যন্তর থাকবে না। কারণ তা হলেই ম্লেচ্ছদের অত্যাচার থেকে তারা বাঁচতে পারবে। রাজা তখন গণকারদের কাছে জানতে চাইলেন— মুসলিম বাহিনীর সেনাপতিকে যাতে নির্ভুলভাবে চেনা যায়, সেইমতাে কোনাে চিহ্নের কথা প্রাচীন গ্রন্থাদিতে লেখা আছে কিনা? গণৎকারেরা জানাল যে, ওই সেনাপতি সােজাভাবে দাঁড়িয়ে নিজের দু’হাত দু’পাশে ঝুলিয়ে দিলে তার অঙ্গুলিগুলাে হাঁটুর নিম্ন পর্যন্ত প্রসারিত হবে। এ উত্তরপ্রাপ্তির পর লক্ষ্মণ সেন কতিপয় বিশ্বস্ত লােককে অনুসন্ধানের জন্য প্রেরণ করলেন এবং তাঁরা মােহাম্মদ বখতিয়ারের মধ্যে কথিত বৈশিষ্ট্য লক্ষ করে রাজার কাছে ফিরে এসে তা জানালেন।
রাজার কাছে উপরিউক্ত লােকেরা যে বিবরণী পেশ করলেন, তা জানতে পেরে পূর্বের বর্ণনা মতাে রাজ্যের ব্রাহ্মণ সম্প্রদায় বিশিষ্ট নাগরিকগণ ও ভূস্বামীদের মধ্যে বিরাট সন্ত্রাসের সৃষ্টি হল। তারা তাড়াতাড়ি পূর্ববঙ্গে ও কামরূপের দিকে পলায়ন করলেন। রাজা লক্ষ্মণ সেন তবুও নদিয়া ত্যাগ করেননি।
বঙ্গদেশ অভিযানকালে বখতিয়ার ঝাড়খণ্ড অরণ্য অঞ্চলের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়ে নদিয়া পৌঁছান। অর্থ বিক্রেতার বেশে বখতিয়ার সরাসরি চলে গেলেন রাজপুরীতে। অর্থ বিক্রেতাদের এভাবে রাজপুরীতে এসে ঘােড়া বিক্রি করা নতুন নয়। তাই দ্বারক্ষীরা বাধা দেননি। ভিতরে ঢুকে স্বমূর্তি ধারণ করলেন বখতিয়ার। অপ্রস্তুত প্রাসাদরীদের সহজেই পরাস্ত করলেন। চারদিকে শােরগােল পড়ে গেল। খবর রটে গেল লক্ষ্মণ সেন পরাস্ত, রাজপুরী তুর্কি সৈন্যদের হাতে অধিকৃত। নদিয়ার পতন ঘটল সহজেই। মূল কাহিনি আমরা এখানে উদ্ধার করতে পারি, “ইতিমধ্যে বখতিয়ারের শৌর্যবীর্যের কথা রায় লখমনিয়ার কানেও পৌঁছাইল। জ্যোতিষী-দৈবজ্ঞ ও পারিষদবর্গ তাহার সহিত সাক্ষাৎ করিয়া বলিলেন, ‘ব্রাহ্মণদের রচিত প্রাচীন গ্রন্থে আছে যে, এদেশ তুরস্কের হস্তগত হইবে। সেই দুঃসময় এইবার ঘনাইয়া আসিতেছে। ইহারা বিহার দখল করিয়াছে, পরবর্তী বৎসরেই এদেশ আক্রমণ করিবে। যদি রায় সমস্ত লােকজনের সহিত নিরাপদ স্থানে প্রস্থান করেন, তাহা হইলে আমরা তুরুস্কের কবল হইতে রক্ষা পাইব।’ রায় বলিলেন, ‘কে আমাদের দেশ অধিকার করিবে, তােমাদের শাস্ত্রগ্রন্থে তাহার সম্বন্ধে কোনাে নির্দেশ আছে কি? তাহারা বলিল, ‘শাস্ত্রে এইরূপ উল্লেখ আছে—যখন সেই বীরপুরুষ দণ্ডায়মান হয় এবং দুই হাত ঝুলাইয়া দেয়, তখন হাত দুইখানি তাহার হাঁটু ছাড়াইয়া যায়। রায় বলিলেন,
“তাহা যথার্থ কিনা দেখিবার জন্য বরং কাহাকেও পাঠাইয়া দাও, যে গুপ্তভাবে সরেজমিনে গিয়া সেই বীরের লক্ষ্মণ দেখিয়া আসুক। তাহার কথামত বিস্ত লােককে পাঠাইয়া দেওয়া হইল। সন্ধান করিয়া ফিরিয়া আসিয়া সে বখতিয়ারের শরীরের বর্ণনা দিল। যখন শাস্ত্রের সঙ্গে তাহার মিল হইল তখন ব্রাহ্মণ ও অন্যান্য অধিবাসীরা নবদ্বীপ ত্যাগ করিয়া..পূর্ববাংলা এবং কামরূপের দিকে পলায়ন করিল। কিন্তু রায় রাজধানী ছাড়িতে চাহিলেন না। তাহার পরের বৎসর বখতিয়ার পূর্বদেশে অভিযান করিলেন এবং সেই উদ্দেশ্যে সেনা সংগ্রহ করিতে লাগিলেন, তারপর বিহার হইতে বাহির হইয়া সহসা নদীয়া শহরে হানা দিলেন। এত দ্রুতবেগে ধাবিত হইলেন যে, আঠারাে জন অনুচর ভিন্ন অন্য সেনারা তাঁহার পিছনে পড়িয়া রহিল। নগরীর তােরণদ্বারে উপনীত হইয়া বখতিয়ার কাহাকেও কিছু বলিলেন না, ধীরে ধীরে শহরের মধ্য দিয়া চলিলেন এবং এমন ধীরস্থির ‘গদাই লস্করী’ চালে চলিতে লাগিলেন যে, নগরবাসীরা মনে করিল বােধ হয় অর্থবিক্রেতা বণিকেরা আসিয়াছে। তাহারা মনেও করিতে পারে নাই যে, এই সেই দীর্ঘ প্রলম্বিত-বাহু বখতিয়ার। ক্রমে তিনি প্রাসাদের দ্বারে উপস্থিত হইলেন এবং তরবারি বাহির করিয়া সদলবলে কাফেরদিগকে হত্যা শুরু করিলেন।”৫৪
[৬]
‘তবকাত-ই-নাসিরী’-তে এভাবেই বর্ণনা করা হয়েছে নদিয়া বিজয়ের কাহিনি। মনে হয় সমস্ত বর্ণনার মধ্যে কোথায় যেন একটা বিরাট ফাঁক থেকে গেছে এবং তা সমূহ বর্ণনাকে রহস্যময় ও প্রায় অবিধাস্য করে তুলেছে। আসলে কাহিনির সরল বর্ণনার ভিতর যে প্র থেকে যায় তার সমাধানের ভিতর ইতিহাসের আরেকটি সত্য লুকিয়ে আছে। যত বীরত্ব আর সমরকুশলতাই থাক বখতিয়ার খিলজি বাহিরাগত, ভিন্ন ধর্ম ও সংস্কৃতির ধারক—আক্রমণকারী। তাকে প্রতিহত করতে লক্ষ্মণ সেনের সৈন্যবাহিনী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষদের কেউ এগিয়ে না আসার পিছনে নিশ্চয়ই তাৎপর্য রয়েছে।
ইতিপূর্বের আলােচনায় মুসলমানদের সহজ বিজয়ের পিছনে প্রাচীন বাংলার সমাজিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক জীবনের বিশৃঙ্খলতার প্রসঙ্গ নিয়ে আলােচনা করা হয়েছে। বখতিয়ার খিলজির বিরুদ্ধে প্রতিরােধ গড়ে না তােলার পিছনে একই যুক্তি ক্রমে স্পষ্ট হতে থাকে।
সেন শাসন যুগে ব্রাহ্মণরা যে শুধু সামাজিক-রাজনৈতিক ও ধর্মীয় ক্ষেত্রে আধিপত্য বিস্তার করে রেখেছিল তাই নয়, মুসলিম আগমনের পূর্বে শাস্ত্রজ্ঞান চর্চায়ও তাদের একাধিপত্য ছিল। আর সে কারণেই যে কোনাে প্রকার জ্ঞানের ক্ষেত্রে নিম্নবর্ণের হিন্দুদের প্রবেশাধিকার ছিল নিষিদ্ধ। পরবর্তীকালে বিকশিত মুসলিম সমাজের পাশাপাশি যে হিন্দু সমাজের অস্তিত্ব ছিল, সেখানেও এই রক্ষণশীলতার প্রভাব স্পষ্ট লক্ষ করা যায়। এ জন্যই শ্রীচৈতন্য যখন শাস্ত্রচর্চায় সাধারণ শ্রেণির অধিকারকে স্বীকার করে নেন, তখন তাঁর মতবাদ প্রচারে ব্রাহ্মণদের ক্ষুব্ধ হতে দেখা যায়। এর বাস্তব চিত্র সমকালীন সাহিত্যে বিস্তর রয়েছে।
বাংলায় ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতি সর্বদাই অন্তঃজ শ্রেণিকে অস্পৃশ্য করে রেখেছিল। তাদের ধর্মাচরণের অধিকার ছিল না। সমাজেও কোনােরকম তারা প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারেনি। তাই তাদের কাছে মুসলিম বিজয় ধর্মের নব অভ্যুত্থান মনে হওয়াই স্বাভাবিক ছিল। অন্তত অপেক্ষাকৃত ভাল আশ্রয়ের হাতছানি তারা অনুভব করতে পারে। বৈদিক ব্রাহ্মণরা শুধু সামাজিক বিধান আরােপ করেই সাধারণ শ্রেণির জনগােষ্ঠীকে কোণঠাসা করে রাখেনি, বরং তার প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপের মাধ্যমেও এদের জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছিল। সাধারণ হিন্দু ও বৌদ্ধদের সহায়-সম্পত্তি কেড়ে নিলে বা তাদের হত্যা করলেও ব্রাহ্মণদের কোনাে দণ্ডভােগ করতে হত না। ব্রাহ্মণদের এই বৈষম্যমূলক সমাজ বিধান এবং হিংসাত্মক আচরণ অবহেলিত শ্রেণিকে বিব্ধ করে তুলেছিল। শুধু তাই নয়, বখতিয়ার খিলজির অভিযানের পূর্বে সেন শাসকদের দৃষ্টিভঙ্গিও গণমানসে শাসক সম্প্রদায়ের প্রতি বীতশ্রদ্ধ করে তুলেছিল। কারণ লক্ষ্মণ সেনের সময় সেন রাজার স্বৈরাচারী চরিত্র ফুটে ওঠে। শেখ শুভােদয়া’র কাহিনি অনুযায়ী লক্ষ্মণ সেনের মহিষী বল্লভা ও রাজ শ্যালক কুমার দত্ত কর্তৃক সাধারণ মানুষের প্রতি অত্যাচারের কথা বর্ণিত হয়েছে। ওই অত্যাচারের মাত্রা এত বেশি ছিল যে, সাধারণ মানুষের সঙ্গে রাজসভার অমাত্যরাও ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল।
এ প্রসঙ্গে অন্য একটি বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি দেওয়ার আছে। প্রাচীনকাল থেকেই সাধারণ হিন্দু ও বৌদ্ধ জনগােষ্ঠী উত্তর ও দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গে শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান করে আসছিল। বর্ণ হিন্দুদের মূল আস্তানা ছিল পশ্চিমবঙ্গে। কিন্তু সেন রাজত্বকালে উত্তর ও দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় রক্ষণশীল ব্রাহ্মণদের দাপটে সাধারণ বাঙালির মধ্যে নৈরাজ্য দেখা দেয়। বাংলার এই দুই অঞ্চলে তাই মুসলিম ধর্ম প্রচারকদের প্রাথমিক সাফল্য ছিল উল্লেখযােগ্য। এ কে এম যাকারিয়া লিখেছেন, “এই সিদ্ধান্তের পিছনে কোনাে প্রত্যক্ষ প্রমাণ না থাকলেও পরােক্ষ প্রমাণের অভাব নেই। বৌদ্ধ ও নাথ ধর্মাবলম্বীরা যে বিহার রাজ্য ও বাংলার উত্তরাঞ্চলে অধিক সংখ্যায় ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন, সেই অঞ্চলের ‘জোলা’ মুসলমানের আধিক্যই তা প্রমাণ করে। এদেরকে জোর করে ধর্মান্তরিত করা হয়েছিল, এমন ধারণা অমূলক। যদি তাই হতাে, তবে হিন্দু অধিবাসীদেরও বাদ পড়ার কথা নয়। এবং উত্তর ও মধ্যভারতে যেখানে মুসলিম রাজশক্তি অধিককাল ধরে এবং অধিক দাপটের সঙ্গে রাজত্ব করেছে সেখানেই মুসলমানের সংখ্যা অধিক হওয়ার কথা। তা হয়নি। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতা হয়েছে বাংলায় এবং তন্তুবায়ী নাথ ও বৌদ্ধদের থেকে ধর্মান্তরিত ‘জোলা’ মুসলমানের আধিক্য হয়েছে বিহারে ও উত্তরবঙ্গে। উত্তরাঞ্চলে বৌদ্ধ ও নাথেরা খুব সম্ভব নানা কারণে স্বেচ্ছায় ইসলাম গ্রহণ করেছেন এবং এর মূলে প্রথম বঙ্গবিজয়ী তুর্কি মুসলিম মােহাম্মদ বখতিয়ারের সঙ্গে তাদের যােগসাজশের কথা খুবই সম্ভাব্য ঘটনা বলে মনে হয়।”৫৫
বখতিয়ার খিলজির বাংলা অভিযান ইতিহাসের পুনর্নির্মাণ [পর্ব ২]
তথ্যসূত্রঃ
- ১. দিল্লির ঐতিহাসিক শামস-ই-সিরাজ আফিফ ইলিয়াস শাহকে এই উপাধিতে ভূষিত করেন। দেখুন-শামস-ই-সিরাজ আফিফ তারিখ-ই-ফিরােজশাহী, বিলায়েত হুসেন সম্পাদিত, কলকাতা, ১৮৯০, পৃ. ১১৪-১১৮।
- ২. সেন রাজাগণ দক্ষিণ ভারতের কর্ণাটক থেকে বাংলায় এসেছিলেন। কিন্তু তারা কিভাবে ও কি কারণে বাংলায় আগমন করেছিলেন—এটা আজও প্রন চিহ্নিত। তবে সেন রাজবংশের প্রথম ঐতিহাসিক পুরুষ সামন্ত সেনই সর্বপ্রথম বাংলায় আসেন। তাঁর পুত্র হেমন্ত সেন থেকে বংশানুক্রমে অধঃস্তন কয়েক পুরুষ বাংলায় রাজত্ব করেছেন— বিজয় সেন (১০৯৬-১১৫৯), বল্লাল সেন (১১৫৯-১১৭৯), লক্ষ্মণ সেন (১১৭৯-১২০৬), বিরূপ সেন (১২০৬১২২০), কেশব সেন (১২২০-১২২৩/২৫)। মােটামুটিভাবে ১০৯৬ থেকে ১২২৫, মােট ১৩০ বছরের শাসন সেন রাজবংশের।
- ৩. মিনহাজ-ই-সিরাজী তবকাত-ই-নাসিরী (ফারসি), আবদুল হাই হাবিবী সম্পাদিত, কাবুল, ১৯৬৫, দ্বিতীয় সংস্করণ। হাবিবী ছিলেন আফগানিস্তানের প্রখ্যাত পণ্ডিত। তিনি আফগানিস্তান ইতিহাস সমিতির সভাপতি ছিলেন। ২৩টি তবকাত সম্পন্ন ‘তবকাত-ই-নাসিরী’র প্রথম ৬ তবকাতের সম্পূর্ণ পাঠের অনুবাদ র্যাভার্টি তাঁর গ্রন্থে দেননি। কিন্তু ঐতিহাসিক হাবিবী তাঁর গ্রন্থে সেই ৬টি তবকাতের সম্পূর্ণ পাঠও তুলে ধরেছেন। বাকি ১৭টি তবকাতের সম্পূর্ণ পাঠও যে তিনি তাঁর গ্রন্থে দিয়েছেন তা বলাই যায়। সিরাজীর অতি মূল্যবান এই বৃহৎ গ্রন্থের সম্পূর্ণ মূল ফারসি পাঠ পাঠক সমাজের কাছে সম্পাদক হাবিবী তুলে ধরে এই উপমহাদেশে ইতিহাস চর্চা ও গবেষণার ক্ষেত্রে যে অবিস্মরণীয় অবদান রেখেছেন তা সত্যিই প্রশংসনীয়। দেখুন-মীনহাজ-ই-সিরাজ তবকাত-ই-নাসিরী, বাংলা অনুবাদ ও সম্পাদনাএ কে এম যাকারিয়া, সােপান পাবলিশার, কলকাতা, ২০১৪, উপক্রমিকা দ্রষ্টব্য, পৃ. ১৬। এ কে এম যাকারিয়া তার গ্রন্থে হাবিবী কৃত সিরাজীর ফারসি গ্রন্থের শুধুমাত্র তিনটি তবকাতের বাংলা অনুবাদ ও সম্পাদনা করেছেন। এই তিনটি হচ্ছে ২০, ২১ ও ২২ তবকাত।
- ৪. আবদুল করিম, বাংলার ইতিহাস সুলতানি আমল, জাতীয় সাহিত্য প্রকাশ, প্রথম প্রকাশ, ঢাকা, ২০০৭, পৃ. ৮৬।
- ৫. আবদুল করিম, প্রাগুক্ত, পৃ. ৮৬।
- ৬. আবদুল করিম, প্রাগুক্ত, পৃ. ৮৬।
- ৭. যদুনাথ সরকার সম্পাদিত, হিস্টরি অফ বেঙ্গল, খণ্ড-২, ঢাকা বির্ববিদ্যালয়, ঢাকা, ১৯৭২, পৃ. ৩০-৩১।
- ৮. দীনেশচন্দ্র সেন, বৃহৎ বঙ্গ, খণ্ড-১, দে’জ পাবলিশিং হাউস, কলকাতা, ১৯৯৩, পৃ. ৫২৬ ও ৫৪১।
- ৯. হাসান নিজামি তাজ-উল-মাসির, দেখুন-ইলিয়ট ও ডওসন সম্পাদিত, হিস্টরি অফ ইন্ডিয়া অ্যাজ টোল্ড বাই ইটস্ ওন হিস্টরিয়ান, খণ্ড-৩, লন্ডন, ১৮৬৭ পুনর্মুদ্রণ, নিউদিল্লি, ১৯৮১।
- ১০. ফখরউদ্দিন ইসামি ফুতুহুস সালাতিন, আগা মাহদি হােসেন সম্পাদিত, আগ্রা, ১৯৩৮ এ এস উষা সম্পাদিত, মাদ্রাজ, ১৯৫৮
- ১১. গােলাম হুসেন সলীম রিয়াজ-উস-সালাতিন (বাংলার ইতিহাস), রামপ্রাণ গুপ্ত কর্তৃক অনুদিত ও সম্পাদিত, সােপান পাবলিশার, নতুন সংস্করণ, কলকাতা, ২০১১, পৃ. ৫৭ আবদুস সালাম কৃত ইংরেজি অনুবাদ, কলকাতা, ১৯০৪, পুনর্মুদ্রণ, দিল্লি, ১৯৭৫ আকবরউদ্দিন অনুদিত, ঢাকা, ২০০৮।
- ১২. জন ক্লার্ক মার্শম্যান বঙ্গদেশের পুরাবৃত্ত, ফণী পাল সম্পাদিত, বলাকা, কলকাতা, ২০১৩, পৃ. ২৫।
- ১৩. নীহাররঞ্জন রায়, বাঙালির ইতিহাস, আদিপর্ব, দে’জ পাবলিশিং হাউস, ৭ম সংস্করণ, কলকাতা, ১৪১৬, পৃ. ৪০৯।
- ১৪. রমেশচন্দ্র মজুমদার, বাংলাদেশের ইতিহাস, মধ্যযুগ, জেনারেল প্রিন্টার্স অ্যান্ড পাবলিশার্স, কলকাতা, ১৯৮৭, পৃ. ১, সুখময় মুখােপাধ্যায়, বাংলায় মুসলিম অধিকারের আদিপর্ব, সাহিত্যলােক, কলকাতা, ১৯৮৮, পৃ. ১-২ সুখময় মুখােপাধ্যায়, বাংলার ইতিহাস, খান ব্রাদার্স অ্যান্ড কোম্পানি, ৫ম পুনর্মুদ্রণ, ঢাকা, ২০১৫, পৃ. ৩।
- ১৫. রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, বাঙ্গালার ইতিহাস, অখণ্ড সংস্করণ, ১ম অধ্যায়, দে’জ পাবলিশিং হাউস, কলকাতা, ২০১৪, পৃ. ২১৮। মহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি নামটি ব্যবহার করেছেন প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ডি ডি কোশাম্বী। দেখুন-ডি ডি কোশাম্বী, অ্যান ইন্ট্রোডাকশান টু দ্য স্টাডি অফ ইন্ডিয়ান হিস্টরি, বাংলা অনুবাদ- গৌতম মিত্র, কে পি বাগচী অ্যান্ড কোম্পানি, তৃতীয় মুদ্রণ, কলকাতা, ২০১৩, পৃ. ৩১৩।
- ১৬. রজনীকান্ত চক্রবর্তী, গৌড়ের ইতিহাস, দে’জ পাবলিশিং হাউস, কলকাতা, ২০০৯, পৃ. ১৭৫।
- ১৭. হেনরি ব্লকম্যান, কন্ট্রিবিউশন টু দ্য জিওগ্রাফি অ্যান্ড দ্য হিস্টরি অফ বেঙ্গল, এশিয়াটিক সােসাইটি, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ, ১৯৬৮,পুনর্মুদ্রণ, ২০০৩, পৃ. ৩৮ সৈয়দ এজাজ হােসেন, দ্য বেঙ্গল সুলতানেট, মনােহর পাবলিকেশন, দিল্লি, ২০০৩, পৃ. ২।
- ১৮. আবদুল করিম, প্রাগুক্ত, পৃ. ৮৬-৮৭।
- ১৯. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, বখতিয়ারের নবদ্বীপ জয় দেখুন-ভবতােষ দত্ত সম্পাদিত, ইতিহাস ও সংস্কৃতি, দে’জ পাবলিশিং হাউস, পুনর্মুদ্রণ, কলকাতা, ২০১৩, পৃ. ৬৭। দীনেশচন্দ্র সেন বক্তিয়ার খিলজি নামটি ব্যবহার করেছেন। দেখুন- দীনেশচন্দ্র সেন, বৃহৎ বঙ্গ, খণ্ড-১, দেজ পাবলিশিং হাউস, কলকাতা, ১৯৯৯, পৃ. ৫৩৫।
- ২০. এ বি এম হাবিবুল্লাহ, দ্য ফাউন্ডেশন অফ মুসলিম রুল ইন ইন্ডিয়া, ভারতে মুসলিম শাসনের বুনিয়াদ, বাংলা অনুবাদ লতিফুর রহমান, বাংলা একাডেমি, প্রথম প্রকাশ, ঢাকা, ২০০৪, পৃ. ৪৬।
- ২১. এ বি এম হাবিবুল্লাহ, প্রাগুক্ত, টীকা, পৃ. ৫৭।
- ২২. খিলজি, খিলিজি, না খিলজি—কোনটা আমরা গ্রহণ করব? খিলজি বলতে একটি বিশেষ উপজাতিকে বােঝায় আর বখতিয়ার ছিলেন সেই উপজাতিরই মানুষ। বেশিরভাগ ঐতিহাসিক যেহেতু খিলজি-র প্রতি সহমত পােষণ করেন, সেহেতু খিলজি লেখা সঠিক মনে হয়।
- ২৩. দীনেশচন্দ্র সেন, প্রাচীন বাঙ্গালা সাহিত্যে মুসলমানের অবদান, করুণা প্রকাশনী, কলকাতা, ১৯৯৫, পৃ. ১২-১৪।
- ২৪. রমেশচন্দ্র মজুমদার সম্পাদিত, হিস্টরি অফ বেঙ্গল, খণ্ড-১, ঢাকা বিথবিদ্যালয়, ঢাকা, ১৯৪৩, পৃ. ২১৬।
- ২৫. এ এম চৌধুরি, ডাইন্যাস্টিক হিস্টরি অফ বেঙ্গল ৭৫০-১২০০, এশিয়াটিক সােসাইটি, ঢাকা, ১৯৬৭, পৃ. ২৩৫।
- ২৬. এ এম চৌধুরি, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৯০।
- ২৭. ইনসূক্রিপশনস্ অফ বেঙ্গল, খণ্ড-৩, শ্লোক নং- ৮, মাধাইনগর তাম্রশাসন, পৃ. ১১৪।
- ২৮. ইনসূক্রিপশনস্ অফ বেঙ্গল, খণ্ড ৩, শ্লোক নং- ৮, মাধাইনগর তাম্রশাসন, পৃ. ১১৪।
- ২৯. এ এম চৌধুরি, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৩৮-৩৯।
- ৩০. রমেশচন্দ্র মজুমদার সম্পাদিত, প্রাগুক্ত, পৃ. ২২০।
- ৩১. ইনসূক্রিপশনস্ অফ বেঙ্গল, খণ্ড-৩, শ্লোক নং-১৩, ইদিলপুর তাম্রশাসন ও সাহিত্য পরিষদ তাম্র শাসন, পৃ. ১২৭ ২৮, ১৪০-৪৪
- ৩২. সুনীল চট্টোপাধ্যায়, প্রাচীন ভারতের ইতিহাস, খণ্ড-২, দ্বিতীয় মুদ্রণ, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদ, কলকাতা, ১৯৮৭, পৃ. ৩৭৩।
- ৩৩. এ এম চৌধুরি, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৪৪।
- ৩৪. রমেশচন্দ্র মজুমদার, বাংলাদেশের ইতিহাস, খণ্ড-১, জেনারেল প্রিন্টার্স অ্যান্ড পাবলিশার্স, কলকাতা, ১৯৮১, পৃ. ১৩৪।
- ৩৫. সুরেশচন্দ্র ব্যানার্জী সম্পাদিত, শ্রীধর দাস সদ্যক্তিকর্ণামৃত, ফার্মা কে এল এম, কলকাতা, ১৯৬৫, ৫/১৮/৩ ও ৩/১৫/৪।।
- ৩৬. রমেশচন্দ্র মজুমদার সম্পাদিত, প্রাগুক্ত, পৃ. ২২১-২২।
- ৩৭. নীহাররঞ্জন রায়, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪০৯।
- ৩৮. যতীন্দ্রমােহন রায়, ঢাকার ইতিহাস, খন্ড-২, ঢাকা, ১৩৩৫, পৃ. ৩৬৬।
- ৩৯. এপিগ্রাফিয়া ইণ্ডিকা, খণ্ড-৩০, পৃ. ৪২-৪৬।
- ৪০. এপিগ্রাফিয়া, খণ্ড-২৭, পৃ. ১৮২-৯১।
- ৪১. মিনহাজ-ই-সিরাজী তবকাত-ই-নাসিরী, এইচ জি র্যাভার্টি অনূদিত, খণ্ড-১, ওরিয়েন্টাল বুকস্, পুনর্মুদ্রণ, নিউ দিল্লি, ১৯৭০, পৃ. ৫৫৮ আরও দেখুন-মিনহাজ-ই-সিরাজী তবকাত-ই-নাসিরী, এ কে এম যাকারিয়া অনুদিত ও সম্পাদিত, প্রাগুক্ত, পৃ. ২১৪।
- ৪২. ইনসূক্রিপশনস্ অফ বেঙ্গল, খণ্ড-৩, শ্লোক নং-১৩, সাহিত্য পরিষদ তাম্রশাসন, কলকাতা, পৃ. ১৪২।
- ৪৩. মধ্যযুগের বিশেষ করে সুলতানি আমলের ঐতিহাসিকের মধ্যে মিনহাজ-ই-সিরাজী (১১৯৩-) ছিলেন প্রথম সারির ঐতিহাসিক। তার জন্মস্থান ঘুর প্রদেশের জুরজান এলাকা। পিতা ছিলেন সিরাজউদ্দিন মুহাম্মদ। প্রপিতামহ আবদুল খালেক ছিলেন সুবত্তা ও পণ্ডিত। মিনহাজের মাতা ছিলেন রাজ পরিবারের। পিতৃ-মাতৃ উভয় দিক থেকে মিনহাজ নীল রক্তের অধিকারী ছিলেন। এমনি পরিবেশের মধ্যে তিনি জ্ঞানার্জন থেকে শুরু করে রাজনীতি ও কূটনীতি সম্পর্কে বাস্তব অভিজ্ঞতা লাভ করেন। ১২২৭ সালে তিনি সিন্ধু হয়ে মুলতানে আসেন। গভীর পাণ্ডিত্য ও বাগ্মীতার জন্য মূলতানের শাসক নাসিরুদ্দিন কুবাচা তাকে ফিরােজিয়া কলেজের অধ্যক্ষ করেন। এরপর দিল্লির সুলতান ইলতুতমিস। নাসিরুদ্দিন কুবাচার বিদ্রোহ দমন করে পরাস্ত করলে মিনহাজ ইলতুতমিসের আনুগত্য স্বীকার করে দিল্লিতে আসেন। ১২৩৭ সালে তাঁকে দিল্লির নাসিরিয়া কলেজের অধ্যক্ষের পদ প্রদান করা হয়। ১২৪১ সালে তিনি দিল্লির প্রধান বিচারকের পদপ্রাপ্ত হন। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেও নিজেকে তিনি মূলত ইতিহাস চর্চায় নিয়ােজিত রাখেন। ‘তবকাত-ই-নাসিরী’ তার বিখ্যাত রচনা। মিনহাজউদ্দিন তার এই ইতিহাস গ্রন্থকে দিল্লির সুলতান নাসিরুদ্দিন মাহমুদের (১২৪৬-৬৬) নামে উৎসর্গ করে নামকরণ করেন নাসিরুদ্দিন মাহমুদ বাংলার শাসক ছিলেন। তিনি ১২২৬২৯ পর্যন্ত রাজত্ব করেছিলেন। একই নামের জন্য অনেকে বিভ্রান্তিতে পড়ে যান)। মিনহাজউদ্দিন আদি মানব হযরত আদম (আঃ) থেকে শুরু করে নাসিরুদ্দিন মাহমুদের রাজত্বকালের ১৪ বছর অর্থাৎ ১২৬০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ইতিহাস এই গ্রন্থে তুলে ধরেছেন। মিনহাজ দিল্লির সুলতানি শাসনের সাথে সরাসরি জড়িত থাকার সুবাদে অনেক ঘটনা নিজে দেখেছেন। আবার তথ্য সংগ্রহের জন্য উচ্চ গােয়ালিয়র, দিল্লি ও বাংলা ভ্রমণ করে সেখান থেকে তথ্য সংগ্রহ করে তার বইয়ে লিখেছেন। তিনি বাংলার শাসক তুঘরিল তুঘান খানের (১২৩৪-১২৪৫) অধীনে কাজ করার সময়ে অর্থাৎ বখতিয়ার খিলজির নদিয়া বিজয়ের ৩৮ বছর পর বা ১২৪২এ প্রথম বাংলায় আসেন দুই বছরের (১২৪২-১২৪৪) জন্য এবং বখতিয়ার সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে সর্বপ্রথম তার ‘তবকাত-ই-নাসিরী’তে’ তা লিপিবদ্ধ করেন। তিনি দিল্লির সুলতানি আমলের সুলতানদের এবং বাংলার খিলজি মালিকদের ধারাবাহিক ইতিহাস রচনা করেন। তিনি ঘটনার সন, তারিখ নির্ভুলভাবে দিয়েছেন। ভারতে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠায় ঐতিহাসিক মিনহাজ-ই-সিরাজী ‘তবকাত-ই-নাসিরী’ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উৎস। ২০, ২১ ও ২২ নং তবকতে ভারতে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার ইতিহাস ও বাংলায় মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার ইতিহাস বর্ণনা করা হয়েছে। মােহাম্মদ ঘােরি ও তার ত্রীতদাসদের কথা দিয়ে মিনহাজ লেখা শুরু করেছেন। তারপর দিল্লির সুলতান কুতুবউদ্দিন আইবকের কথা এসেছে। মিনহাজ কুতুবউদ্দিন আইবকের খুবই প্রশংসা করেছেন। বলেছেন কুতুবউদ্দিন আইবক লক্ষ লক্ষ টাকা দান করতেন। খুবই সংক্ষিপ্তভাবে কুতুবউদ্দিন আইবকের ইতিহাস বর্ণনা করা হয়েছে। কুতুবউদ্দিন আইবকের মৃত্যুর পর আরাম শাহের সিংহাসনে আরােহণের কথা বলা হয়েছে। দরবারের অমাত্যরা আরাম শাহকে সিংহাসনে বসায়, তাও মিনহাজ উল্লেখ করেছেন। মিনহাজ মােহাম্মদ ঘােরির সাথে পৃথ্বিরাজ চৌহানের ১১৯১ খ্রিস্টাব্দের তরাইনের প্রথম যুদ্ধও ‘তবকাত-ই-নাসিরী’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। ভারতে মুসলিম শাসনের পূর্ণাঙ্গ বুনিয়াদ তিনি নিজের বাস্তব অভিজ্ঞতার আলােকে বর্ণনা করেছেন। মােহাম্মদ ঘােরি কর্তৃক দাসত্ব থেকে কুতুবউদ্দিন আইবকের মুক্তি লাভ তিনি বর্ণনা করেছেন। মিনহাজ সুলতান ইলতুৎমিস সম্পর্কে আলােচনা করেছেন। তার সময়ে প্রভাবশালী ২৫ জন অমাত্য সম্পর্কে আলােচনা করেছেন। সুলতান ইলতুতমিসের দূরদর্শিতা, প্রজ্ঞার কথা মিনহাজ বলেছেন। দিল্লির সিংহাসনে একমাত্র নারী সুলতান রাজিয়া সম্পর্কে মিনহাজ বলেছেন। ইলতুতমিস তার কন্যা রাজিয়া সম্পর্কে বলেছেন, “আমার পুত্রগণ ভােগ বিলাস ও যৌবনের (প্রমত্ততায়) মগ্ন এবং রাজ্য শাসন করার ক্ষমতা কারাের নেই। তাদের দ্বারা রাজ্য শাসন করা সম্ভব হবে না। আমার মৃত্যুর পর আপনারা উপলব্ধি করবেন যে, রাজ্যের উত্তরাধিকারী তারা কেউ তার (আমার কন্যার) চেয়ে যােগ্যতম হবে না।”
- ৪৪. নিজামউদ্দিন ও সামসামউদ্দিন সম্পর্কে এরা ভাই ছিলেন। ওরা মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা জহিরউদ্দিন মােহাম্মদ বাবরের পিতৃভূমি মধ্য এশিয়ার ফরঘনা থেকে এসেছিলেন। এরা যথেষ্ট শিক্ষিত ছিলেন এবং বখতিয়ারের সৈন্যদলে চাকরি করতেন। দেখুন-মিনহাজ-ই-সিরাজী তবকাত-ই-নাসিরী, এ কে এম যাকারিয়া অনূদিত ও সম্পাদিত, প্রাগুক্ত, পৃ. ২১২।
- ৪৫. মিনহাজ-ই-সিরাজী তবকাত-ই-নাসিরী, এ কে এম যাকারিয়া অনূদিত ও সম্পাদিত, প্রাগুক্ত, পৃ. ২১২।
- ৪৬. মিনহাজ-ই-সিরাজী তবকাত-ই-নাসিরী, এ কে এম যাকারিয়া অনূদিত ও সম্পাদিত, প্রাগুক্ত, পৃ. ২১৩।
- ৪৭. মুদ্রিত পাঠে সাহলাত ও সাহলি আছে, কিন্তু র্যাভার্টির উচ্চারণই সাধারণভাবে গ্রহণ করা হয়েছে। দেখুন-এইচ হােদিওয়ালা, স্টাডিজ ইন ইন্দো-মুসলিম হিস্টরি, বম্বে, ১৯৩৯, পৃ. ২০৬।
- ৪৮. মিনহাজ-ই-সিরাজী তবকাত-ই-নাসিরী, র্যাভার্টি অনূদিত, প্রাগুক্ত, পৃ. ৬১। আরও দেখুন- মিনহাজ-ই-সিরাজী তবকাত-ই-নাসিরী, এ কে এম যাকারিয়া অনুদিত ও সম্পাদিত, প্রাগুক্ত, পৃ. ২১২। বিহারে অবস্থানকারী মুন্ডিত মস্তক অধিবাসীদের ব্রাহ্মণ বলে অভিহিত করলেও এরা যে প্রকৃতপক্ষে বৌদ্ধভি, বা শ্রমণ ছিলেন তা মিনহাজের বর্ণনাই তা প্রমাণ করে। পরে তিব্বত অভিযানের সময় ওই অঞ্চলের অধিবাসীদেরও মিনহাজ ভুল করে ব্রাহ্মণ বলে অভিহিত করেছেন।
- ৪৯. বখতিয়ারের বিহার জয়ের (১২০৩) পূর্বেও উদন্তপুরী হামলার শিকার হয়েছিল। উদন্তপুরীর উপর প্রাথমিক হামলার একটি বিবরণ সম্পর্কে ষােড়শ-সপ্তদশ শতকের তিব্বতী ঐতিহাসিক ও পর্যটক বৌদ্ধ লামা তারনাথ বলেছেন যে, ৫০০ সৈনিকের একটি তুরস্ক বাহিনীকে পরাজিত করা হয়েছিল। দেখুন-জে এন সমাদ্দার, গ্লোরেজ অফ মগধ, পাটনা, ১৩১-৩২। আরও দেখুন-প্রসিডিংস অফ দ্য ইন্ডিয়ান হিস্টরিক্যাল রেকর্ডস কমিশন, ১৯৪২-এ এস সি সরকার রচিত ‘সাম টিবেটান রেফারেন্সেস টু মুসলিম অ্যাডভান্স ইন বিহার অ্যান্ড বেঙ্গল’।
- ৫০. সুখময় মুখােপাধ্যায় এ বিষয়ে সহমত পােষণ করেন। দেখুন-সুখময় মুখােপাধ্যায়, বাংলার ইতিহাস, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৪৮।
- ৫১. এইচ সি রায়, ডাইন্যাস্টিক হিস্টরি অফ নর্দার্ন ইন্ডিয়া, খণ্ড-১, কলকাতা বিবিদ্যালয়, পৃ. ৩২২।
- ৫২. ইন্ডিয়ান অ্যান্টিকুয়েরি, খণ্ড-৪, পৃ. ৩৬৬-৬৭।
- ৫৩. মিনহাজ-ই-সিরাজী তবকাত-ই-নাসিরী, র্যাভার্টি অনূদিত, প্রাগুৰ্ত্ত, পৃ. ৫৫৪। আরও দেখুন- মিনহাজ-ই-সিরাজী তবকাত-ই-নাসিরী, এ কে এম যাকারিয়া অনূদিত ও সম্পাদিত, প্রাগুৰ্ত্ত, পৃ. ২১২।
- ৫৪. মিনহাজ-ই-সিরাজী তবকাত-ই-নাসিরী, র্যাভার্টি অনূদিত, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫৫৬-৫৭৬।
- ৫৫. মিনহাজ-ই-সিরাজী তবকাত-ই-নাসিরী, এ কে এম যাকারিয়া সম্পাদিত, প্রাগুক্ত, পৃ. ৬৬।
‘নবজাগরণ’ অ্যান্ড্রোয়েড অ্যাপ্লিকেশনটি প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর টেলিগ্রাম চ্যানেলে জয়েন হতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর ফেসবুক পেজে লাইক করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।