লিখেছেনঃ মুহাম্মাদ আব্দুল আলিম
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর প্রিয় নতুন বউঠান কাদম্বররী দেবীকে যেসব গ্রন্থ উৎসর্গ করেছিলেন তা ধারাবাহিকভাবে নিচে পেশ করা হল।
১। ভগ্নহৃদয়
(ক) সাময়িক পত্রিকায় প্রকাশকালে :
উপহার
তােমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা।
এ সমুদ্রে আর কভু হবে নাকো পথহারা।
সেথা আমি যাই না কো, তুমি প্রকাশিত থাকো।
আকুল এ আঁখি পরে ঢাল গাে আলােকধারা।
ও মু’খানি সদা মনে
জাগিতেছে সংগােপনে
আঁধার হৃদয় মাঝে দেবীর প্রতিমা পারা।
কখনাে বিপথে যদি
ভ্রমিতে চায় এ হৃদি
অমনি ও মুখ হেরি শরমে সে হয় সারা।
চরণে দিনু তা আনি
এ ভগ্নহৃদয়খানি।
চরণ রঞ্জিবে তব এ হৃদি-শােণিত ধারা।
[ভারতী, কার্তিক ১২৮৭]
(খ) গ্রন্থাকারে প্রকাশকালে :
উপহার
শ্রীমতী হে………..
১
হৃদয়ের বনে বনে সূর্যমুখী শত শত
ওই মুখ পানে চেয়ে ফুটিয়া উঠেছে যত।
বেঁচে থাকে বেঁচে থাক্, শুকায় শুকায়ে যাক্,
ওই মুখপানে তারা চাহিয়া থাকিতে চায়,
বেলা অবসান হবে, মুদিয়া আসিবে যবে
ওই মুখ চেয়ে যেন নীরবে ঝরিয়া যায়!
২
জীবন-সমুদ্রে তব জীবন-তটিনী মাের।
মিশায়েছি একবারে আনন্দে হইয়ে ভাের,
সন্ধ্যার বাতাস লাগি ঊর্মি যত উঠে জাগি,
অথবা তরঙ্গ উঠে ঝটিকায় আকুলিয়া,
জানে বা না জানে কেউ জীবনের প্রতি ঢেউ
মিশিবে—বিরাম পাবে—তােমার চরণে গিয়া।
৩
হয়ত জান না, দেবি, অদৃশ্য বাঁধন দিয়া
নিয়মিত পথে এক ফিরাইছ মাের হিয়া।
গেছি দূরে, গেছি কাছে, সেই আকর্ষণ আছে,
পথ ভ্রষ্ট হইনাক তাহারি অটল বলে,
নহিলে হৃদয় মম ছিন্ন ধূমকেতু সম
দিশাহারা হইত সে অনন্ত আকাশ তলে।
৪
আজ সাগরের তীরে দাঁড়ায়ে তােমার কাছে
পরপারে মেঘাচ্ছন্ন অন্ধকার দেশ আছে;
দিবস ফুরাবে যবে সে দেশে যাইতে হবে,
এ পারে ফেলিয়া যাব আমার তপন শশী,
ফুরাইবে গীত গান। অবসাদে ম্রিয়মাণ,
সুখ শান্তি অবসান কাদিব আঁধারে বসি!
৫
স্নেহের অরুণালােকে খুলিয়া হৃদয় প্রাণ,
এ পারে দাঁড়ায়, দেবি, গাহিনু যে শেষ গান,
তােমারি মনের ছায় সে গান আশ্রয় চায়,
একটি নয়ন জল তাহারে করিও দান।
আজিকে বিদায় তবে। আবার কি দেখা হবে,
পাইয়া স্নেহের আলাে হৃদয় গাহিবে গান?
২। সন্ধ্যা সংগীত
উপহার
(গ্রন্থের সর্বশেষ কবিতা)
ভুলে গেছি, কবে তুমি
ছেলেবেলা একদিন
মরমের কাছে এসেছিলে,
স্নেহময়, ছায়াময়,
সন্ধ্যাময় আঁখি মেলি
একবার শুধু চেয়েছিলে,
স্তরে স্তরে এ হৃদয় হয়ে গেল অনাবৃত
হৃদয়ের দিশি দিশি হয়ে গেল উদ্ঘাটিত,
একে একে শত শত ফুটিতে লাগিল তারা,
তারকা-অরণ্য মাঝে নয়ন হইল হারা!
বুঝি গাে সন্ধ্যার কাছে,
শিখেছে সন্ধ্যার মায়া
ওই আঁখি দুটি,
চাহিলে হৃদয় পানে
মরমেতে পড়ে ছায়া,
তারা উঠে ফুটি!
আগে কে জানিত বল
কত কি লুকান ছিল
হৃদয় নিভৃতে,
তােমার নয়ন দিয়া
আমার নিজের হিয়া
পাইিনু দেখিতে!
কখনাে গাওনি তুমি
কেবল নীরবে রহি
শিখায়েছ গান,
স্বপ্নময় শান্তিময়
পূরবী রাগিনী তানে
বাঁধিয়াছ প্রাণ।
আকাশের পানে চাই—
সেই সুরে গান গাই
একেলা বসিয়া।
একে একে সুরগুলি
অনন্তে হারায়ে যায় ।
আঁধারে পশিয়া।
বল দেখি কত দিন আসনি এ শূন্য প্রাণে,
বল দেখি কত দিন চাওনি হৃদয় পানে,
বল দেখি কত দিন শােননি এ মাের গান,
তবে সখি গান-গাওয়া হল বুঝি অবসান।
বল মােরে, বল দেখি
এ আমার গান গুলি
কেন আর ভাল নাহি লাগে,
প্রাণের রাগিনী শুনি
নয়নে জাগে না আভাস
কে সখি কিসের বিরাগে?
যে রাগ শিখাইয়াছিলে
সে কি আমি গেছি ভুলে?
তার সাথে মিলিছে না সুর?
তাই কি আস না প্রাণে,
তাই কি শােন না গান,
তাই সখি, রয়েছ কি দূর!
ভাল সখি, আবার শিখাও,
আর বার মুখপানে চাও,
একবার ফেল অশ্রুজল,
একবার শােন গানগুলি,
তাহলে পুরাণ’ সুর
আবার পড়িবে মনে,
আর কভু যাইব না ভুলি!
সেই পুরাতন চোখে
মাঝে মাঝে চেয়াে সখি
উজলিয়া স্মৃতির মন্দির,
সেই পুরাতন প্রাণে
মাঝে মাঝে এসাে সখি
শূন্য আছে প্রাণের কুটীর।
নহিলে আঁধার মেঘরাশি
হৃদয়ের আলোেক নিভাবে,
একে একে ভুলে যাব সুর,
গান গাওয়া সাঙ্গ হয়ে যাবে।
৩। বিবিধ প্রসঙ্গ।
(গ্রন্থের শেষ রচনা সমাপনে’র শেষ স্তবক)।
আমার পাঠক দিগের মধ্যে একজন লােককে বিশেষ করিয়া আমার এই ভাব গুলি উৎসর্গ করিতেছি। এই ভাবগুলির সহিত তােমাকে আরও কিছু দিলাম, সে তুমিই দেখিতে পাইবে! সেই গঙ্গার ধার মনে পড়ে? সেই নিস্তব্ধ নিশীথ? সেই জ্যোত্সালােক? সেই দুই জনে মিলিয়া কল্পনার রাজ্যে বিচরণ? সেই মৃদু গম্ভীর স্বরে গভীর আলােচনা? সেই দুইজনে স্তব্ধ হইয়া নীরবে বসিয়া থাকা? সেই প্রভাতের বাতাস, সেই সন্ধ্যার ছায়া! একদিন সেই ঘনঘাের বর্ষার মেঘ, শ্রাবণের বর্ষণ, বিদ্যাপতির গান? তাহারা সব চলিয়া গিয়াছে। কিন্তু আমার এই ভাবগুলির মধ্যে তাহাদের ইতিহাস লেখা রহিল। এই লেখাগুলির মধ্যে কিছু দিনের গােটাকতক সুখ দুঃখ লুকাইয়া রাখিলাম, এক একদিন খুলিয়া তুমি তাহাদের স্নেহের চক্ষে দেখিও, তুমি ছাড়া আর কেহ তাহাদিগকে দেখিতে পাইবে না। আমার এই লেখার মধ্যে লেখা রহিল, এক লেখা তুমি আর আমি পড়িব, আর এক লেখা আর সকলে পড়িবে।
৪। ছবি ও গান
উৎসর্গ
গত বৎসরকার বসন্তের ফুল লইয়া এ বৎসরকার বসন্তে মালা গাঁথিলাম। যাঁহার নয়ন কিরণে প্রতিদিন প্রভাতে এই ফুলগুলি একটি একটি করিয়া ফুটিয়া উঠিত, তাহারি চরণে ইহাদিগকে উৎসর্গ করিলাম।
৫। প্রকৃতির প্রতিশােধ
উৎসর্গ। তােমাকে দিলাম।
৬। শৈশব সংগীত।
উপহার
এ কবিতাগুলিও তােমাকে দিলাম। বহুকাল হইল, তােমার কাছে বসিয়াই লিখিতাম, তােমাকেই শুনাইতাম। সেই সমস্ত স্নেহের স্মৃতি ইহাদের মধ্যে বিরাজ করিতেছে। তাই মনে হইতেছে তুমি যেখানেই থাক না কেন, এ লেখাগুলি তােমার চোখে পড়িবেই।
৭। ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী
এ উৎসর্গ ভানু সিংহের কবিতাগুলি ছাপাইতে তুমি আমাকে অনেকবার অনুরােধ করিয়াছিলে। তখন সে অনুরােধ পালন করি নাই। আজ ছাপাইয়াছি, আজ তুমি আর দেখিতে পাইলে না।
৮। মানসী
উপহার
নিভৃত এ চিত্ত মাঝে
নিমেষে নিমেষে বাজে।
জগতের তরঙ্গ-আঘাত,
ধ্বনিত হৃদয়ে তাই
মুহূর্ত বিরাম নাই
নিদ্রাহীন সারা দিন রাত।
•••••••••••••••••••••
চিরজীবন তাই
আর কিছু কাজ নাই
রচি শুধু শুধু অসীমরে সীমা;
আশা দিয়ে ভাষা দিয়ে
তাহে ভালবাসা দিয়ে
গড়ে তুলি মানসী প্রতিমা।
বাহিরে পাঠায় বিশ্ব
কত গন্ধ গান দৃশ্য—
সঙ্গীহারা সৌন্দর্যের বেশে,
বিরহী সে ঘুরে ঘুরে
ব্যথা ভরা কত সুরে
কাঁদে হৃদয়ের দ্বারে এসে।
•••••••••••••••••••••
অন্তরে বাহিরে সেই
ব্যকুলিত মিলনেই
কবির একান্ত সুখখাচ্ছাস
সেই আনন্দ মুহুর্তগুলি
তব করে দিনু তুলি
সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাণের প্রকাশ।
৯। চৈতালি
উৎসর্গ
আজি মাের দ্রাক্ষা কুঞ্জবনে,
কেন গুচ্ছ গুচ্ছ ধরিয়াছে ফল।
পরিপূর্ণ বেদনায় ভরে।
মুহূর্তেই বুঝি ফেটে পড়ে,
বসন্তের দুরন্ত বাতাসে।
নুয়ে বুঝি নমিবে ভূতল,
রস ভরে অসহ উচ্ছ্বাসে।
থরে থরে ফলিয়াছে ফল।
•••••••••••••••••••••
শুক্তিরক্ত নখরে বিক্ষত
ছিন্ন করি ফেল বৃন্তগুলি,
সুখাবেশে বসি লতামূলে
সারাবেলা অলস অঙ্গুলে
বৃথা কাজে যেন অন্য মনে।
খেলাচ্ছলে লহ তুলি তুলি
তব ওষ্ঠে দশন-দংশনে
টুটে যাক পূর্ণ ফলগুলি।
১০। কাব্যগ্রন্থ
আমারে কর তােমার বীণা,
লহগাে লহ তুলে!
উঠিবে বাজি তন্ত্রীরাজি
মােহন অঙ্গুলে!
কোমল তব কমল করে
পরশ কর পরাণ পরে,
উঠিবে হিয়া গুঞ্জরিয়া
তর শ্রবণমূলে!
কখনাে সুখে কখনাে দুখে
কঁদিবে চাহি তােমার মুখে,
চরণে পড়ি রবে নীরবে
রহিবে যবে ভুলে!
কেহ না জানে কি নব তানে
উঠিবে গীত শূন্য পানে
আনন্দের বারতা যাবে
অনন্তের কূলে!
(কৃতজ্ঞতাঃ জগদীশ ভট্টাচার্যের কবিমানসী—প্রথম খন্ড)
‘নবজাগরণ’ অ্যান্ড্রোয়েড অ্যাপ্লিকেশনটি প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।