বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বিখ্যাত উপন্যাস আনন্দমঠের ‘বন্দেমাতরম’ সঙ্গীত বিতর্কিত। ‘বন্দেমাতরম’ গান যে মুসলিমদের কাছে গ্রহণযােগ্য হবে না তার কারণ আনন্দমঠের সঙ্গে এর সম্পৃক্ততা। গানটি রচনার দুবছর পরে ওই গানের অনুষঙ্গে যে কল্পনাকে বঙ্কিমচন্দ্র আনন্দমঠ উপন্যাসে বিগ্রহের রূপ দেন তা একান্তরূপে হিন্দুত্বের প্রতীক শুধু তাই নয়, অন্য ধর্মের মানুষের পক্ষে তার অক্ষরগত অর্থ বিবাদীও বটে। রমেশচন্দ্র দত্ত ‘Encyclopaedia Britannica’-তে এই গীতের অর্থ নির্দেশ করে হিন্দু আদর্শের কথা লিখেছেন, “The poem, then, is the work of a Hindu idealist who personified Bengal under the form of a purified and spiritual Kali.” fora আনন্দমঠের কেন্দ্রীয় বক্তব্য সম্বন্ধে লিখেছেন, “The general moral of the Ananda Math…is that British rule and British education are to be accepted as the only alternative to Musalman oppression, a moral which Bankim Chandra developed in his Dharmatattwa,…But through the Ananda Math is in form an apology for the loyal acceptance of British rule, it is nonetheless inspired by the ideal of the restoration, sooner or later, of a Hindu Kingdom in India.”
“বাহুতে তুমি মা শক্তি হৃদয়ে তুমি মা ভক্তি/ তােমারই প্রতিমা গড়ি মন্দিরে মন্দিরে/ত্বং হি দুগা দশপ্রহরণধারিণী/ কমলা কমলদলবিহারিণী।” দেশমাতা প্রতিমার রূপ ধরেন এবং ‘দশপ্রহরণধারিণী’ দেবী দুর্গায় রূপান্তরিত হন। জাতীয়তাবাদের উপর অনিবার্যভাবে হিন্দুত্বের রঙ এসে পড়ে। ফলে গীতটি জাতীয় আন্দোলনে প্রবল প্রেরণা সঞ্চার করলেও ভারতের ক্ষেত্রে প্রয়ােজনীয় একটা ধর্মনিরপেক্ষ সাম্রাজ্যবিরােধী আন্দোলন গড়ে তােলার দিকে এই গানের ভূমিকা অনুকূল ছিল না। এই কারণেই নেহরু, গান্ধিজি, মাওলানা আজাদ প্রমুখ নেতারা জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে ‘বন্দেমাতরম’-র বিরােধিতা করেন।
কৃষ্ণ কৃপালানী ‘Bande Mataram and Indian Nationalism’ শিরােনামে ‘Visva Bharati News’-এ একটি (October, 1937) প্রবন্ধ লেখেন। তিনি তাতে লিখেছেন, “My sympathy, at any rate, is with the Mahommedans in this controversy, for I believe that if I were a Mahommedan I should resent the particular garb this song gives to my love of my country. Though one can have no sympathy with the fanaticism of some Bengali Mahommedans who are out to smell idolatory in all literary use of Hindu mythology, still I should say that the spirit of the imagery and invocation employed in this song is more than merely literary and is such that it is unfair to force the monotheistic followers of the Prophet of Arabia to swallow it in the name of Indian Nationalism.” কংগ্রেরসের অহিংস নীতির সঙ্গে বন্দেমাতরম গানের ভাবমূর্তির কোনও সঙ্গতি আছে কিনা প্রবন্ধের শেষে তিনি স্মরণ করিয়ে দিয়ে লিখলেন: “Finally, one would like to ask protagonists of the Congress creed of Non-violence, how far the image of the ten-armed deity, flourishing weapons, represents their creed.” এটি অবশ্য কৃষ্ণ কৃপালনীর ব্যক্তিগত অভিমত। তখন সুভাষচন্দ্রের শরীর অসুস্থ। কলকাতায় দিন দুই থেকে——৯ই অক্টোবর (১৯৩৭) রাত্রে দার্জিলিং মেলে তিনি এক পক্ষকালের জন্য কার্সিয়াং যাত্রা করেন। যাত্রার পূর্বে কলকাতায় আসন্ন ওয়ার্কিং কমিটি ও এ.আই.সি.সি. অধিবেশনের প্রস্তুতির ব্যাপারে সহকর্মীদের সাথে আলােচনা ও প্রয়ােজনীয়। নিদের্শাদি দিয়ে যান। কলকাতা অধিবেশনে ‘বন্দেমাতরম্’ সংগীত নিয়ে যে একটা তুমুল ঝড় উঠবে এ কথা বুঝতে পেরে তিনি চিন্তিত ও উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেন। এই সময় তার রবীন্দ্রনাথের কথা মনে আসে। এই সম্পর্কে তার অভিমতের উপর দেশের লােক যতখানি গুরুত্ব দেবে এমন আর কারও কথায় দেবে না। তাই এই সম্পর্কে তিনি কবিকে তার সুচিন্তিত অভিমত লিখে জানানাের জন্য অনুরােধ করেন। কবি তার জবাবে সুভাষচন্দ্রকে যে পত্রটি লিখেন, সেটি যথাযথভাবে এখানে উদ্ধৃত করা হল—“বন্দেমাতরং গানের কেন্দ্রস্থলে আছে দুর্গার স্তব এ কথা এতই সুস্পষ্ট যে এ নিয়ে তর্ক চলে না। অবশ্য বঙ্কিম এই গানে বাংলা দেশের সঙ্গে দুর্গাকে একাত্ম করে দেখিয়েছেন, কিন্তু স্বদেশের এই দশভুজামূর্তিরূপের যে পূজা সে কোনাে মুসলমান স্বীকার করে নিতে পারে না। এবারে পূজা সংখ্যার বহু সাময়িকপত্রেই দুর্গাপূজার প্রসঙ্গে বন্দেমাতরং গানের শ্লোকাংশ উদ্ধৃত করে দিয়েছে—সহজেই দুর্গার স্তবরূপে একে গ্রহণ করেছে। আনন্দমঠ উপন্যাসটি সাহিত্যের বই, তার মধ্যে এই গানের সুসংগতি আছে। কিন্তু যে রাষ্ট্রভাষা ভারতবর্ষের সকল ধর্ম সম্প্রদায়ের মিলনক্ষেত্র সেখানে এ গান সর্বজনীনভাবে সংগত হােতেই পারে না। বাংলা দেশের একদল মুসলমানের মধ্যে যখন অযথা গোঁড়ামির জেদ দেখতে পাই তখন সেটা আমাদের পক্ষে অসহ্য হয়। তাদের অনুকরণ করে আমরাও যখন অন্যায় আব্দার নিয়ে জেদ ধরি তখন সেটা আমাদের পক্ষে লজ্জার বিষয় হয়ে ওঠে। বস্তুত এতে আমাদের পরাভব।”১
সুভাষচন্দ্রকে এটি কবির ব্যক্তিগত পত্র। সন্দেহ নেই, কবির এই যুক্তি ও বক্তব্য সুভাষচন্দ্র আন্তরিকভাবে সমর্থন করেছিলেন কিন্তু সে কথা স্পষ্ট করে সেই প্রবল উত্তেজনার মধ্যে বলতে গেলে বাঙালি হিন্দুদের মধ্যে যে কি ভয়ঙ্কর প্রতিক্রিয়া হবে সে কথা চিন্তা করে সুভাষচন্দ্র সম্ভবত এই বিতর্কে প্রায় সম্পূর্ণ নীরব থাকেন। বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী সংবাদপত্রগুলি অবশ্য তার জন্য সুভাষচন্দ্রের উপর কিছুটা অখুশিই থাকলেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তখন কলকাতায়। সাংবাদিকদের দারুণ উৎকণ্ঠা, রবীন্দ্রনাথ এ বিষয়ে নীরব কেন, তিনি কী বলেন? রথীন্দ্রনাথ সাংবাদিকদের পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন, দেশের বিশিষ্ট নেতাদের সঙ্গে আলােচনা না হওয়া পর্যন্ত কবি এ বিষয়ে কোনাে বিবৃতি প্রচার করবেন না। সাংবাদিকদের তিনি আরও বলেন যে, বিশ্বভারতীর পত্রিকায় কৃষ্ণ কৃপালানীর প্রবন্ধে বন্দেমাতরম’ সংগীত সম্পর্কে যে অভিমত প্রকাশিত হয়েছে তা বিশ্বভারতীর কিংবা কবির মত নয়।২ বলা বাহুল্য, কৃষ্ণ কৃপালানীর এই প্রবন্ধটি বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী পত্রিকাগুলির উত্মা ও ক্ষোভের সঞ্চার করেছিল।
রবীন্দ্রনাথ অবশ্য পূর্বেই তার সেক্রেটারির মারফৎ জওহরলালের কাছে ‘বন্দেমাতরম্’ সঙ্গীত সম্পর্কে তার অভিমত বা বিবৃতিটি পাঠিয়ে দেন। তিনদিন আলােচনার পর কমিটি বন্দেমাতরম্ সম্পর্কে এই মর্মে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে, এই সংগীতের প্রথম অংশটিই কংগ্রেসের সভাসমিতিতে গাওয়া হবে। সিদ্ধান্তটির মর্মার্থ ছিল এইঃ “‘বন্দেমাতরম’ সংগীত সম্পর্কে একটি বিতর্ক উঠিয়াছে; সুতরাং ওয়ার্কিং কমিটি এই সংগীতটির মর্মার্থ ব্যাখ্যা করা আবশ্যক বিবেচনা করছেন। পরলােকগত বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘আনন্দমঠ’ নামক উপন্যাসে এই সঙ্গীতটি আছে, কিন্তু ‘আনন্দমঠ’ রচনার সহিত এই সঙ্গীত রচনার কোনও সম্পর্ক ছিল না। ‘আনন্দমঠ’ রচনার পূর্বেই এই সঙ্গীতটি রচিত হইয়াছিল, পরে ইহা আনন্দমঠের অন্তর্ভুক্ত করা হয়;-বঙ্কিমচন্দ্রের জীবন-চরিত্রেও এই কথা বলা হইয়াছে। সুতরাং ‘বন্দেমাতরম্’ সঙ্গীতের কথা বিবেচনা করিবার সময় ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসের কথা বিবেচনা করা উচিত নয়। ১৮৯৬ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই সংগীতে সুর যােজনা করেন। ব্রিটিশ গভর্ণমেন্ট ‘বন্দেমাতরম’ কথা এবং সঙ্গীতটি রাজদ্রোহকর বিবেচনা করিয়া বলপ্রয়ােগ ও ভীতিপ্রদর্শন করিয়া এটা বন্ধ করিবার চেষ্টা করিয়াছিলেন। ১৯০৬ সালে মি. এ. রসুলের সভাপতিত্বে বরিশালে বঙ্গীয় প্রাদেশিক রাষ্ট্রীয় সম্মেলনের যে বিখ্যাত অধিবেশন আহূত হইয়াছিল, তাতে প্রতিনিধি ও স্বেচ্ছাসেবকগণের উপর পুলিশ অমানুষিকভাবে লাঠি চালায় এবং তাদের ‘বন্দেমাতরম’ ব্যাজগুলি বলপূর্বক কেড়ে নেয়। ‘বন্দেমাতরম’ ধ্বনি করার সময় কয়েকজন প্রতিনিধিকে এমন ভীষণভাবে প্রহার করা হয় যে, সে অচৈতন্য হইয়া পড়ে। তারপর ত্রিশ বছর দেশের সর্বত্র অসংখ্য স্বদেশপ্রেমিক বন্দেমাতরম্ উচ্চারণ করিয়া অতুল আত্মত্যাগ ও দুঃখবরণ করিয়াছেন; ‘বন্দেমাতরম্’ মন্ত্র উচ্চারণ করিতে করিতে অনায়াসে মৃত্যুবরণ করিয়াছেন, এমন বহু নরনারীর দৃষ্টান্তও আছে। এইরূপ এই সঙ্গীত এবং ‘বন্দেমাতরম’ শব্দদ্বয় বিশেষভাবে বাংলাদেশে এবং সাধারণভাবে ভারতবর্ষের সর্বত্র ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধাচরণের প্রতীকস্বরূপ হইয়া দাঁড়াইয়াছে। ‘বন্দেমাতরম’ মন্ত্র শক্তির উৎস হইয়া দাঁড়াইয়াছে। আমাদের দেশবাসী এই মন্ত্রে অপুর্ব প্রেরণা লাভ করেছেন। ইহা একটি বন্দনাগীতি। এই গীতি আমাদিগকে জাতির মুক্তি সংগ্রামের কথা স্মরণ করিয়া দেয়।
‘বন্দেমাতরম’ সঙ্গীতের প্রথম দুইটি কলি ক্রমে অন্যান্য প্রদেশেও বিস্তৃত হয় এবং জাতীয় ভাবের দ্যোতক বলিয়া বিবেচিত হয়। গানের অবশিষ্টাংশ কদাচিৎ গীত হইত, আজও খুব কম লােকে ওটা জানে। প্রথম দুটি কলিতে সুললিত ভাষায় জননী জন্মভূমির সৌন্দর্য এবং তার দান বর্ণনা করা হইয়াছে। এই দুটি কলিতে এমন কিছু নেই, যা ধর্মের দিক থেকে বা অন্য কোনও হিসাবে আপত্তিকর বিবেচিত হইতে পারে। ভারতবর্ষের কোনও শ্রেণী বা সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধাচরণের উদ্দেশ্যে এই সঙ্গীত কদাপি গাওয়া হয় না। এবং কদাপি কেউ এটাকে কোনও সম্প্রদায়ের বলিয়া মনে করে নাই—এই সঙ্গীতে কোন সম্প্রদায়ের মনে আঘাত লাগিতে পারে বলিয়া কেহ মনে করে নাই। বস্তুত এই সঙ্গীতে যে ত্রিশ কোটি লােকের কথা বলা হইয়াছে তাহাতে স্পষ্ট প্রমাণ হয় যে, ভারতবর্ষের সমস্ত অধিবাসীদিগের সম্পর্কে প্রয়ােগই এই সংগীত গান করিবার উদ্দেশ্য ছিল। কিন্তু কংগ্রেস এই সঙ্গীত বা অপর কোনও সঙ্গীত ভারতবর্ষের জাতীয় বলে গ্রহণ করে না। সর্বসাধারণ ভারতবাসী এটা ব্যবহার করে বলে এটার একটি বিশেষ অর্থ দাঁড়াইয়া গিয়াছে এবং এটা জাতীয়তাদ্যোতক হইয়া উঠিয়াছে।
ওয়ার্কিং কমিটির অভিমত এই যে, অতীতের স্মৃতি সুদীর্ঘকালব্যাপী আত্মত্যাগ ও দুঃখবরণের ইতিহাস এবং সর্বসাধারণ কর্তৃক ব্যাপক ব্যবহার এই সঙ্গীতের প্রথম দুইটি কলিকে প্রাণবান ও আমাদের জাতীয় আন্দোলনের সাথে অঙ্গাঙ্গী সম্পর্কে আবদ্ধ করিয়াছে; সুতরাং এই দুটি কলি আমাদের সম্ভ্রম ও সমাদরের বস্তু। এই দুটি কলিতে কাহারও আপত্তি করিবার কিছু নাই। সঙ্গীতের অবশিষ্টাংশ অনেকেই জানে না এবং প্রায় কখনাে গাওয়া হয় না। উহাতে এমন বিষয়ের উল্লেখ রহিয়াছে এবং ধর্মবিষয়ক এমন ভাব বর্ণিত হইয়াছে, যা ভারতবর্ষের অন্যান্য ধর্মসম্প্রদায়ের আদর্শের সহিত সামঞ্জস্যহীন।
‘বন্দেমাতরম্ সঙ্গীতের কোনও কোনও অংশ সম্পর্কে মুসলমান বন্ধুগণ যে আপত্তি উত্থাপন করিয়াছেন, ওয়ার্কিং কমিটি তার যৌক্তিকতা স্বীকার করছেন। মুসলমান বন্ধুদের আপত্তি যতদূর যুক্তিসম্মত, তাহা মানিয়া লইলে ওয়ার্কিং কমিটি এই অভিমত প্রকাশ করিতেছে যে, আমাদের জাতীয় আন্দোলনে এই সংগীত যে স্থান অধিকার করিয়াছে, তাহাই বহুগুণ গুরুত্বপূর্ণ। জাতীয় আন্দোলন সুস্পষ্ট রূপ গ্রহণের পূর্বে এই সঙ্গীত যে একটি ঐতিহাসিক উপন্যাসে স্থান লাভ করিয়াছিল, সেই কথাটা জাতীয় আন্দোলনে এই সঙ্গীতের ব্যবহারের তুলনায় নিতান্ত তুচ্ছ। সমস্ত বিষয় বিবেচনা করিয়া ওয়ার্কিং কমিটি নির্দেশ দিয়াছে যে, জাতীয় সভাসমিতিতে যখনই এই সঙ্গীত গান করা হইবে তখনই যেন শুধু প্রথম কলি দুটি গাওয়া হয়, তবে এই সঙ্গ শীতের উপরেও বা এই সঙ্গীতের পরিবর্তে অন্য কোনও নির্দোষ সংগীত গান করিবার পূর্ণ স্বাধীনতাও উদ্যোক্তাগণের থাকিবে। জাতীয় আন্দোলনে ‘বন্দেমাতরম্ যে স্থান অধিকার করিয়াছে, সেই সম্পর্কে কোনও প্রশ্ন উঠিতে পারে না। কিন্তু অন্যান্য সংগীত সম্পর্কে এই কথা বলা যায় না। গুণাগুণ বিবেচনা না করিয়া লােকে নিজ নিজ অভিরুচি অনুসারে নানা সংগীত গান করিয়াছে। এই সঙ্গীত চয়নের আবশ্যকতা বহুদিন যাবৎ অনুভূত হইতেছে। সুতরাং ওয়ার্কিং কমিটি মৌলানা আজাদ, জওহরলাল নেহরু, সুভাষচন্দ্র বসু ও শ্রীনরেন্দ্রনাথ দেবকে নিয়ে একটি সাব-কমিটি গঠন করিতেছেন। যে সকল প্রচলিত জাতীয় সঙ্গীত এই সাব-কমিটির নিকট প্রেরিত হইবে, তাহারা ঐগুলি বিবেচনা করিবেন। কেহ ইচ্ছা করিলে তাঁহার রচিত সঙ্গীতও তাহাদের নিকট পাঠাইতে পারে। কমিটি যেসব সঙ্গীত জাতীয় সঙ্গীত সংগ্রহ পুস্তকে স্থান লাভের যােগ্য বিবেচনা করিবেন, তাঁহার সেইগুলি ওয়ার্কিং কমিটির নিকট পাঠাইবেন। যে সকল সঙ্গীত সরল হিন্দুস্থানিতে রচিত অথবা হিন্দুস্থানিতে ভাষান্তরিত করা সম্ভব এবং যাহার সুর উদ্দীপনাময়, সাব-কমিটি শুধু ঐ-সকল সংগীতই পরীক্ষার জন্য গ্রহণ করিবেন। সাব-কমিটি কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সহিত পরামর্শ করিবেন ও তাঁহার উপদেশ গ্রহণ করিবেন।
প্রাদেশিক ভাষাসমূহে সংগীত সম্পর্কে অনুরূপ ব্যবস্থা অবলম্বন করিতেও ওয়ার্কিং কমিটি সমস্ত প্রাদেশিক রাষ্ট্রীয় সমিতিসমূহকে নির্দেশ দিয়াছেন।”৩ ‘বন্দেমাতরম’ সঙ্গীত সম্পর্কে ওয়ার্কিং কমিটির এই সিদ্ধান্তে বাংলাদেশের অধিকাংশ হিন্দু বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে প্রবল উত্তেজনা ও ক্ষোভ প্রকাশ পায়। বিশেষ করে বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী সংবাদপত্রগুলি সমগ্র সঙ্গীতটি আবশ্যিক জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে গৃহীত না হওয়ার জন্য উত্মা ও ক্ষোভ প্রকাশ করলেন। ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’ ‘বন্দেমাতরম্ বর্জন’?—এই শিরােনামায় সম্পাদকীয়৪ প্রবন্ধে লিখলেন : “যে বিচার মূঢ়তায় অন্ধ হইয়া কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি সাম্প্রদায়িক সিদ্ধান্তের কঠোর নিন্দা করিয়াও শেষ পর্যন্ত উহা প্রকারান্তরে মঞ্জুর করিতে ইতস্তত করেন নাই এবং যে কর্তৃত্বাভিমানের বশবর্তী হইয়া জনমতের প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও সেই বিজাতীয় সিদ্ধান্ত দেশের উপর দিয়া চাপাইয়া দিতে চেষ্টার ত্রুটি করেন নাই—‘বন্দেমাতরম’ বিরােধী প্রস্তাবের মধ্যে সেই বুদ্ধি-ভ্রংশতাই পুনরায় দেখা যাচ্ছে। আগাগােড়া সাম্প্রদায়িক সিদ্ধান্তের নিন্দা করে শেষ পর্যন্ত প্রকারান্তরে গ্রহণ এবং আগাগােড়া ‘বন্দেমাতরম’ -এর প্রশংসা করিয়া শেষপর্যন্ত উহা বর্জন—এ একই বুদ্ধির ক্রিয়া! উদ্দেশ্য এক—সম্প্রদায়-বিশেষের তুষ্টিসাধন; ফলও একই—সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্রয়দান এবং সাম্প্রদায়িকতাবাদীদের নিকট আত্মসমর্পণ!”
উল্লেখ্য, রবীন্দ্রনাথের পরামর্শ মতই গানটির প্রথম দুই স্তবক জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে গৃহীত হয়। আনন্দমঠের বন্দেমাতরমে যে সাম্প্রদায়িক স্পর্শকাতর বিষয়টি রয়েছে সে বিষয়েও বিশ্বকবি সতর্ক করেছেন। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, “বন্দেমাতরম্ সঙ্গীতকে জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে গ্রহণ করা যায় কিনা, দুঃখের বিষয় সেই সম্পর্কে এক প্রশ্ন উঠিয়াছে। আমাকে ঐ বিষয়ে মতামত প্রকাশের সময় মনে করাইয়া দেওয়া হইয়াছে যে, উহার প্রথম প্যারাতে সুর সংযােজনা করার সুযােগ আমারই প্রথম হইয়াছিল। তখনও এই সঙ্গীতের রচয়িতা জীবিত ছিলেন। কলিকাতায় আহূত একটি কংগ্রেসে আমিই প্রথম উহা গান করি। ঐ সঙ্গীতের প্রথম প্যারাতে যে ভক্তি ও কোমলতার ভাব আছে, উহাতে ভারতমাতার যে সুন্দর রূপ বর্ণনা করা হইয়াছে তাহা আমার চিত্ত বিশেষভাবে আকর্ষণ করে। কিন্তু তাহার ফলে আমার পক্ষে ঐ সঙ্গীতের প্রথম প্যারাকে সমগ্র সঙ্গীত হইতে বিচ্ছিন্ন করিয়া দেখিবার কিংবা যে পুস্তকে উহা প্রকাশিত হয় তাহা হইতে বিচ্ছিন্ন করিয়া দেখিবার কোনও অসুবিধা হয় নাই। …আমি অনায়াসে স্বীকার করি যে, বঙ্কিমচন্দ্রের বন্দেমাতরম সঙ্গীতটি যদি উহার অন্যান্য ইতিহাসের সহিত পড়া যায় তাহা হইলে উহার এমন অর্থ করা যায়, যার ফলে মুসলমানদের মনে আঘাত লাগিতে পারে, কিন্তু এই জাতীয় সঙ্গীত যদিও সমগ্র সঙ্গীত হইতে গৃহীত দুইটি প্যারা মাত্র, তথাপি উহা যে সর্বদা কেন সমগ্র সঙ্গীতের কথা স্মরণ করাইয়া দিবে কিংবা যে ইতিহাসের সহিত দৈবক্রমে ইহা জড়িত তাহার কথা স্মরণ করাইয়া দিবে, তাহার যুক্তিসঙ্গত কোন কারণ নাই।”৫
যাই হােক, বাংলার জাতীয়তাবাদী পত্রিকাগুলি এই সুযােগে বা উপলক্ষে রবীন্দ্রনাথকে কটাক্ষ ও শ্লেষ করে লিখতে ছাড়লেন না। ১৬ নভেম্বর ১৯৩৭ ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’ তাদের যৎকিঞ্চিৎ’-এ লিখলেন, “রবীন্দ্রনাথ বন্দেমাতরম্ সঙ্গীতের ব্যবচ্ছেদের সম্মতি দিলেও বাংলার অন্যান্য প্রবীণ সাহিত্যিক স্বর্গগত বঙ্গিমচন্দ্রের অমর রচনার প্রতি এই অসম্মানের প্রতিকারার্থে সমবেত হইয়াছেন ইহা আশার কথা। বঙ্কিমচন্দ্রের রচনায় হস্তক্ষেপ অনুমােদন করিয়া রবীন্দ্রনাথ যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করিয়াছেন, তাহার কুফল যে শেষ পর্যন্ত তাহার উপরে আসিয়াও বর্তাইতে পারে ইহা সম্ভবত তিনি ভাবিয়া দেখেন নাই। টেক্সটবুক কমিটি হইতে তাহার রচনার অংশবিশেষ পরিবর্তন ও পরিবর্জনের জন্য প্রস্তাব করিলে তিনি যে যুক্তি দেখাইয়া প্রবল প্রতিবাদ জানাইয়াছিলেন, বঙ্কিমচন্দ্রের রচনায় হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধেও সেই যুক্তি এবং সেইরূপ প্রতিবাদই তিনি করিবেন আশা করিয়াছিলাম। কিন্তু তিনি না করিলেও বাংলার অন্যান্য বিশিষ্ট সাহিত্যিকেরা সাহিত্যগুরুর সম্মানরক্ষায় সচেষ্ট হইলেও সে চেষ্টা সার্থক হইবে বলিয়া আমরা বিশ্বাস করি।”
বলা বাহুল্য, কবি এসবের কোনাে জবাব দেননি, সে রুচিও তাঁর ছিল না। এসব বাদপ্রতিবাদের পরিণাম কি কবি তা ভালাে করেই জানতেন। পূর্বেই বহু দুঃখেই তিনি প্রমথ চৌধুরীকে লিখেছিলেন (১৮ কার্তিক, ১৩২৮) ও “..আমার মন ম্যাপের গর্তর মধ্যে আর কোনদিন দেবতা খুঁজবে না। বুঝতে পেরেছি এই নিয়ে ঘরে পরে আমাকে ত্যাগ করবে। আমি ঠিক করেছি, যার যা মনের সাধ মিটিয়ে নিক, আমি আর কথা কইব না।”৬
বন্দেমাতরমের ব্যাপারে হিন্দু মধ্যবিত্ত কিভাবে অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছিল তার আভাষ পাই রবীন্দ্রনাথেরই চিঠি থেকে। প্রমথ চৌধুরীকে লেখা বিরক্তিমূলক পূর্বোক্ত চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, “…দেশের কর্তাব্যক্তিদের কাছ থেকে হুকুম আসচে যে ‘সময় খারাপ অতএব বাঁশি রাখ, লাঠি ধর’। যদি তা করি তাহলে কর্তারা খুশি হবেন, কিন্তু আমার এক বাঁশিওয়ালা মিতা আছেন কর্তাদের অনেক উপরে। তিনি আমাকে একেবারে বরখাস্ত করে দেবেন। কর্তারা বলেন, তিনি আবার কে? এক ত আছে ‘বন্দেমাতরম’। তাঁদের গড় করে আমাকে আজ বলতে হচ্ছে- ‘আমার বন্দেমাতরম্ ভুলিয়েচেন ঐ তিনি। আমি দেশ ছাড়া ঘর ছাড়া দলে। আমি ভূগােলের প্রতিমার পাণ্ডাদের যদি আজ মানতে বসি তাহলে আমার জাত যাবে।’ কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে ভূগােলের প্রতিমার পাণ্ডারা শুধু পাণ্ডা নয়, তারা গুণ্ডা—অতএব মার খেতে হবে। তাই সই। মার শুরু হয়েছে। …মরার ভয়ে চঁাদসাগর শিবকে ছেড়ে সাপের দেবতার কাছে হার মেনেছিল, সেইখানেই তার গাল রয়ে গেল। আমি কিন্তু শিবকে ছাড়ব না। আমার শিব সকল জগতের—কিন্তু সাপের দেবতার জায়গা হচ্ছে গর্তের ভিতরে। সেই গর্তের মুখে দুধকলা জোগাবার বায়না যাঁরা নিয়েচেন তারা যে-ফলের লােভ করেন আমি সেই ফলকে বড় মনে করি নে।”৭ এর থেকে পরিষ্কারভাবে বােঝা যায় যে কবি বন্দেমাতরম্ বিশ্বাসীদের স্বাদেশিকতাকে কোনভাবেই সমর্থন করতে পারছেন না। তাছাড়া বন্দেমাতরম্ ধ্বনিকে তিনি মন থেকে মেনে নিতে পারেননি। বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, রবীন্দ্রনাথের ৭০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে দেশবাসীর উদ্দেশ্যে দেওয়া বাণীতে তিনি ‘বন্দেমাতরম’-র পরিবর্তে ‘বন্দেমাতরম’ শ্লোগান গ্রহণের পক্ষে বলেছিলেন।৮ এমন ডাক কার্যকর হবার কথা নয়, হয়ওনি। ক্ষেত্রবিশেষে সন্তানের দেশমাতৃবন্দনা যে ভয়াল রূপ ধারণ করতে পারে রবীন্দ্রনাথ তা দেখতে পেয়েছিলেন। বন্দেমাতরম-র ব্যাপারে শান্ত স্বভাবের কবি বুদ্ধদেব বসুও যে বেশ উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলেন তা বােঝা যায় বুদ্ধদেব বসুকে লেখা রবীন্দ্রনাথের একটি চিঠি থেকে। ওই চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ বলছেন : “ ‘শ্রীহর্ষে’ বন্দেমাতরমপন্থীর পক্ষে তােমার লেখা পড়ে বিস্মিত হয়েছি …তুমি আমাকে গাল দাওনি। কিন্তু তাই যথেষ্ট নয়।”৯
বন্দেমাতরমের বিরুদ্ধে যুক্তি দিয়ে বুদ্ধদেব বসুকে রবীন্দ্রনাথ আরও (২৮-১২-১৯৩৭) লিখেছিলেন, “তর্কটা হচ্ছে এ নিয়ে যে ভারতবর্ষে ন্যাশনাল গান এমন কোনাে গান হওয়া উচিত যাতে একা হিন্দু নয়, হিন্দু মুসলমান খ্রিস্টান—এমনকি ব্রাহ্মও শ্রদ্ধার সঙ্গে ভক্তির সঙ্গে যােগ দিতে পারে। তুমি কি বলতে চাও, ত্বংহি দুর্গা’ ‘কমলা কমলদল বিহারিণী’ ‘বাণী বিদ্যাদায়িনী’ ইত্যাদি হিন্দু দেবী নামধারিণীদের স্তব যাদের প্রতিমা পূজি মন্দিরে মন্দিরে সর্বজাতিক গানে মুসলমানদের গলাধঃকরণ করাতেই হবে। হিন্দুদের পক্ষে ওকালতি হচ্ছে। এগুলি আইডিয়া মাত্র। কিন্তু যাদের ধর্মে প্রতিমা পূজা নিষিদ্ধ তাদের আইডিয়ার দোহাই দেবার কোনাে অর্থই নেই।”১০
গানটি সম্পর্কে মুসলিম মধ্যবিত্তের যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছিল তা খুবই স্বাভাবিক ছিল। বন্দেমাতরম সম্পর্কে সহনশীল পর্যায়ের প্রতিক্রিয়া ছিল একটি জিজ্ঞাসা, যেমন: বাংলা দেশে সাতকোটি লােকের বাস। তার মধ্যে অর্ধাধিক মুসলমান। এই যে বিশাল বাঙালি জাতি, যার মধ্যে হিন্দু, মুসলমান আছে, তাদের জন্য যে জাতীয় সঙ্গীত রচিত হয়েছে, তা হতে মুসলমান বাদ পড়ল কেন ? খুবই সঙ্গত প্রশ্ন। কিন্তু আক্ষরিক অর্থে যদি ধরা যায় তাহলে মুসলমানরা, যাদের সংখ্যা অর্ধেকেরও অধিক, তারা কিন্তু বাদ পড়েনি, গানে সাত কোটি বাঙালীর এবং তাদের চৌদ্দ কোটি বাহুর কথা পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু এই অন্তর্ভুক্তি বাদ দেওয়ার চাইতেও অগ্রহণযােগ্য। কেননা এতে মুসলমানদেরকে মুসলমান হিসাবে না-দেখিয়ে দেবীর পূজারী হিসাবে, অর্থাৎ হিন্দু হিসাবেই উপস্থিত করা হয়েছে। মুসলমান এতে উৎফুল্ল হবে কেন; তার বিরূপ হবার কথাই, এবং সেটা সে ঠিকই হয়েছে। বাংলার সাত কোটি মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করতে গিয়ে তাদেরকে বরঞ্চ দুই ভাগে ভাগ করে দেওয়াই হয়েছে, একপক্ষে হিন্দু সম্প্রদায়, যারা দেবীর বন্দনা ও পূজা করে, অপরপক্ষে মুসলিম সম্প্রদায় যারা মূর্তিপূজাবিরােধী। সাম্প্রদায়িকতার জন্য পথপ্রশস্ত করার কাজে এভাবে সহায়তা দান করা হয়েছে। সকল বাঙালিকে হিন্দু হিসাবে কল্পনা করাটা কোনাে পরিকল্পনাতেই বৈধ নয়।
এস. এম. আকবরউদ্দীনের বর্তমান বাঙ্গালা সাহিত্যে মুসলমানের স্থান প্রবন্ধটি১১ আল এক্লাম পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। এই প্রবন্ধে আনন্দমঠ সম্পর্কে তার বক্তব্য আসলে সমকালীন মুসলমান সমাজের একাংশের মনােভাবেরই প্রতিফলন। আকবরউদ্দীন প্রথমেই স্বীকার করেছেন যে এমন কথা বলা হয়, বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠ বাঙালি হিন্দুর ভেতরে নবজাগরণের সূচনা করে। ‘বন্দে মাতরম’ গানটি যে নানা জায়গায় গাওয়া হয়, সে কথাও তিনি উল্লেখ করেছেন। যে আনন্দমঠ সাতকোটি বাঙালিকে জাগ্রত করার জন্য লিখিত, সেই বইতে মুসলমানদের কিভাবে দেখানাে হয়েছে, তা তিনি বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন আল এলাম-এর পূর্বোক্ত প্রবন্ধে।
তৃতীয় সংস্করণের বিজ্ঞাপনে বঙ্কিমচন্দ্র জানিয়েছেন, আনন্দমঠ ‘উপন্যাস, ইতিহাস নহে।’ উপন্যাসটি ইতিহাস নয়, তা আকবরউদ্দীন স্বীকার করেছেন, কিন্তু সেই সঙ্গে একথাও বলেছেন ইতিহাসের চেয়ে উপন্যাসের প্রভাব অনেক বেশি। ইতিহাস পড়েন কেবল শিক্ষিত মানুষ, উপন্যাস কিন্তু জাতীয়ভাব নির্মাণ করে। সেই কারণে উপন্যাসের ভেতর দিয়ে জাতীয় বিদ্বেষ বা অন্যকে হেয় করিয়া অঙ্কিত করা কোন মতেই উচিত নহে। আনন্দমঠ আলােচনা প্রসঙ্গে প্রথমেই তিনি ‘বন্দেমাতরম’ গানটি বিশ্লেষণ করেছেন। তাঁর মতে, “আনন্দমঠ’-এ আমার প্রথম আলােচ্য বিষয়ই বঙ্কিমের ‘বন্দেমাতরম’ সঙ্গীত। সমস্ত গানটি লিখার কোন আবশ্যক নাই কারণ তাহা অনেকেই জানেন। এই গানটি ‘সপ্ত কোটি কণ্ঠে’ যাহাতে ‘কল কল নিনাদে’ গীত হয়, তজ্জন্য লিখিত। এই সাত কোটি লােক কোথাকার? নিশ্চয়ই বাঙ্গালা দেশের। তবে এই সকলেই কি হিন্দু? নিশ্চয়ই নহে। অতএব বুঝিলাম, ইহা মুসলমানদের জন্যও লিখিত। কিন্তু জিজ্ঞাসা করি, এই সঙ্গীতে মুসলমানের নামগন্ধও আছে কি? আমাদের লেখকের ভারতমাতা কখনও বা ‘দুর্গা’, কখনও বা ‘কালী’, কখনও বা নবতেজে পূর্ণ এক মহাদেবী; কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্র বােধহয় এটুকু ভুলিয়া যান নাই যে মুসলমানের সঙ্গে দুর্গা, কালী বা কোন প্রকার দেবদেবীর কোনাে সম্বন্ধ নাই। সুতরাং ইহা তাহার জাতীয় সঙ্গীত হইতে পারে না। বিশেষতঃ এই সঙ্গীতে আমরা দেশমাতাকে ‘বহু বল ধারিনীং’, ‘রিপু দল বারিনীং’, ‘দুর্গা দশ প্রহরণধারিনী’, ‘কমলা দল বিহারিনী’ রূপে দেখিতে পাই; আর এই রূপ এমন রূপ যাহা একমাত্র হিন্দুদেরই পূজ্য, কিন্তু মুসলমানের নহে। বরং বিপরীত, মুসলমান এই গানকে জাতীয় সঙ্গীত বলিয়া আদর করিতে পারে সেই সময়, যখন সে তাহার নিজস্ব জাতীয়ত্ব, বৈশিষ্ট্য হারাইয়া সম্পূর্ণ রূপে হিন্দুদের সহিত মিশাইয়া যাইতে পারে। কিন্তু আজও মুসলমানের সে দুর্ভাগ্যের দিন আসে নাই। সুতরাং বঙ্কিম মুসলমানকে—যে মুসলমান বাঙ্গালা দেশের অর্ধেকেরও অধিক সংখ্যক—তাহার এই সঙ্গীত হইতে বাদ দিয়া শুধু যে ভুল করিয়াছেন। তাহা নহে, বরং এটুকুও প্রমাণ করিয়াছেন যে তিনি আমাদের এত হেয় মনে করেন যে যদিও আমরা এদেশে সংখ্যায় অর্ধেকের অধিক, তথাপি নব জাতি গঠনে হিন্দুদের পদানত থাকিতে হইবে।”১২
উপন্যাসটির বিশ্লেষণ শেষে আকবরউদ্দীন বলেছেন, বঙ্কিমচন্দ্রের এই উৎকট পক্ষপাতিত্বদোষের ফল শীঘ্র শেষ হবে না—‘এই জন্য যুগ যুগান্তর কষ্ট করিতে হইবে। ইহাতে হিন্দুকে উন্নত ও মুসলমানকে হেয় করিয়া দুইটি জাতির মধ্যে যে ‘অনল উদধি’ বহাইয়া দেওয়া হইয়াছে…তাহা অবর্ণনীয়।’
আকবরউদ্দীনের এই আশঙ্কা সত্যে পরিণত হয়েছিল। মুসলমান সমাজের এই ক্ষোভ বাড়তে বাড়তে বিশ শতকের তিনের দশকে চরমে ওঠে। তা এসে পৌছয় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় মহলেও। পাঠক্রমে মুসলমান লেখকদের বর্জন এবং পাঠ্যপুস্তকে হিন্দুধর্মের নানা বিষয়ের অন্তর্ভুক্তি, প্রশ্নপত্রে তার প্রভাব, বিশ্ববিদ্যালয়ের মনােগ্রামে পদ্মফুলের মাঝখানে ‘শ্রী’ অক্ষরটির ছাপ, মুসলমান ছাত্রদের প্রতিবাদী করে তােলে বারবার। ১৯৩৬ (১৩৪৩)-এ সারা বছর ধরেই মাসিক মােহাম্মদী, কখনাে সওগাত বা বুলবুল পত্রিকার পাতায় এ নিয়ে তাদের ক্ষুব্ধ কণ্ঠস্বর শােনা গেছে। এই প্রতিবাদ চরমমাত্রায় পৌঁছয় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাৎসরিক প্রতিষ্ঠা দিবসে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পতাকায় ‘শ্রী লক্ষ্মী পদ্ম’-এর ছাপ থাকায়, বিশেষত উদ্বোধন সঙ্গীতরূপে বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বন্দেমাতরম’ -কে বেছে নেওয়ার একেশ্বরবাদী মুসলমান ছাত্ররা ক্ষুব্ধ হন। তাঁরা পৌত্তলিকতার প্রতীক এই দুটি বিষয়ের বদলে অন্য কিছু ‘আমদানি’ করার দাবি জানান। কর্তৃপক্ষ তাদের দাবি গ্রাহ্য না করায় তারা অনুষ্ঠান বয়কট করেন। ফাল্গুন, ১৩৪৩-এর বুলবুল পত্রিকায় ‘বিশ্ববিদ্যালয় সম্বন্ধে নতুন সমস্যা’ প্রবন্ধে ডক্টর মুহাম্মদ এনামুল হক মন্তব্য করেন, যে কোন ইসলাম অভিজ্ঞ ব্যক্তি একথা একবাক্যে স্বীকার করিবেন যে, বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বন্দেমাতরম’ সঙ্গীতটি অনৈস্লামিক। কেননা ইহা আদ্যোপান্ত পৌত্তলিক চিন্তাধারায় পরিপুষ্ট।১৩ এ প্রসঙ্গে তিনি জানান, ছাত্রদের বক্তব্য ছিল বঙ্কিমচন্দ্র গানটি রচনা করেন তার স্বদেশপ্রীতি থেকেই, তার এই স্বদেশপ্রীতির নিন্দা করা যায় না, কিন্তু এতে পৌত্তলিকতার যে পরিমাণ বাড়াবাড়ি, তাতে ইহা পৌত্তলিকতা-বিরােধী মুসলমানদের অপাংক্তেয় হইয়া পড়িয়াছে। যে বন্দেমাতরম সঙ্গীতে দুর্গা-মূর্তিকে কেন্দ্র করিয়া স্বদেশপ্রেম রূপ গ্রহণ করিয়াছে, তাহাকে একেশ্বরবাদী মুসলমান জাতীয় সঙ্গীতরূপে কোনক্রমেই গ্রহণ করিতে পারে না। এই লেখায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে সতর্ক করে দিয়ে বলা হয়েছে তারা মুসলমানদের সাম্প্রদায়িক আখ্যা দিচ্ছেন, মুসলমানদের বােঝার চেষ্টাও করছেন না। কর্তৃপক্ষের এই মনােভাব বজায় থাকলে বুঝতে হবে তারা নিজেরাই সাম্প্রদায়িক। ভবিষ্যতে তাদের সাবধানতা অবলম্বন করতে বাধ্য হবেন।১৪ এই মাসের মাসিক মােহাম্মদীতেও মুসলমান ছাত্রদের দ্বারা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা দিবস বর্জনের ব্যাপারটি আলােচিত হয়। ‘বন্দেমাতরম’ গানটির বিষয়ে ছাত্রদের সমর্থনে সমালােচক লেখেন, “বাঙ্গালার মুসলমান ছাত্রমণ্ডলী সমবেতভাবে এই উৎসব বর্জন…করিতে বাধ্য হইয়াছেন…। এই বর্জনের কারণ : মুসলমানদের দাবি সম্বন্ধে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অনমনীয় ভেদে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এবার স্থির করেন যে, উৎসবে জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে ‘বন্দেমাতরম গীত হইবে.. মুসলমান ছাত্রগণ আপত্তি উত্থাপন করেন : যেহেতু ‘বন্দেমাতরম’ সঙ্গীতে বাংলাদেশের প্রতীকরূপে দুর্গাদেবীর বন্দনা করা হইয়াছে … তাই ইহা মুসলমান ধর্মভাব-বিরােধী। নিজেদের ধর্মবিশ্বাসকে জবাই না করিয়া মুসলমান ছাত্রগণ বন্দেমাতরম’ গান …বরণ করিয়া লইতে পারে না। এমত অবস্থায় মুসলমান ছাত্রদের প্রস্তাব এই যে, ‘বন্দেমাতরম’ এর পরিবর্তে পৌত্তলিক ভাবশূণ্য অন্য একটি জাতীয় সঙ্গীত বাছিয়া লওয়া হউক…। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ মুসলমান ছাত্রদের এই প্রস্তাব গ্রহণযােগ্য মনে করিতে পারেন নাই। শুধু তাই নয়, এই প্রস্তাবকে তারা সাম্প্রদায়িক আখ্যা দিয়া নিজেদের পূর্ব সিদ্ধান্ত বহাল রাখিলেন।”১৫
হিন্দুরা যে মুসলমানদের মনােভাব বােঝার চেষ্টা করছেন না, উল্টে তারা মুসলমানদের সাম্প্রদায়িক ভাবছেন, কোন কোন ‘হিন্দু সংবাদপত্র’ও এটিকে সমর্থন করছেন, এটি বেদনার। একথা মনে করে বুলবুল পত্রিকার সম্পাদক, ফাল্গুন, ১৩৪৩-এ তাঁর ‘বন্দেমাতরম’ সঙ্গীত শীর্ষক লেখায় দুঃখের সঙ্গে বলেন, “পরাধীন ভারতের সবচেয়ে বড় বিড়ম্বনা এই যে, হিন্দুমুসলমান এতদিন এক সঙ্গে বাস করিয়াও পরস্পর পরস্পরকে এখনাে বঝিতে পারিল না। কিছুদিন হইতে বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বন্দেমাতরম’ সঙ্গীতকে ভারতের জাতীয় সঙ্গীত বলিয়া চালাইয়া দেওয়ার চেষ্টা কোন কোন হিন্দু নেতা করিয়াছিলেন… সম্প্রতি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা দিবসে উদ্বোধন সঙ্গীতরূপে এই গানটি গীত হইবে স্থির হয়।”১৬ কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তে মুসলমান ছাত্রদের অনুষ্ঠান বর্জনের উল্লেখ করে ক্ষুব্ধ স্বরে সমালােচক বলেন, “নিতান্ত সাম্প্রদায়িক এবং পৌত্তলিক ভাবপুর্ণ ‘বন্দেমাতরম’ সঙ্গীতকে যাঁহারা বিশ্ববিদ্যালয়ের বা কংগ্রেসের উদ্বোধন সঙ্গীতরূপে ব্যবহার করতে চান—তাহারাই বলেন মুসলমান ছাত্রদের সাম্প্রদায়িক।”১৭
আরও স্পষ্ট ভাষায় ক্ষোভ জানিয়ে তিনি বলেন, “মুসলমানেরা মনে করে বঙ্কিমচন্দ্রের মুসলিম-বিদ্বেষের প্রতীক ‘আনন্দমঠ’—আর ‘আনন্দমঠ’ তথা বঙ্কিম-সাহিত্যের পৌত্তলিকতা ও সাম্প্রদায়িকতার প্রতীক ‘বন্দেমাতরম’ সঙ্গীত। এ সত্বেও ‘বন্দেমাতরম’ গান মুসলমান সমাজ জাতীয় সঙ্গীত বলিয়া গ্রহণ করিবে, এ যাঁরা আশা করেন তাদের বুদ্ধির প্রশংসা করিতে পারি না।”১৮ বুলবুল সম্পাদকের মতে, এটা বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য যে, এখানে এখন বঙ্কিমচন্দ্রেরই যুগ চলছে। এই যুগের অবসান না হলে দেশের সত্যিকারের জাতীয়তা গড়িয়া উঠা সম্ভব নয় বলেই তারা মনে করেন।১৯
১৯৩৭-এ মুসলিম লিগের অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয় লক্ষ্ণৌতে। সেখানে ‘বন্দেমাতরম’ গানটিকে জাতীয়তার ক্ষেত্র থেকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে মাসিক মােহাম্মদী পত্রিকার সম্পাদক ‘বন্দেমাতরম’ নামে একটি প্রবন্ধ২০ লেখেন। তাতে তিনি লেখেন, “ভারতের জাতীয়তার ক্ষেত্র হইতে ‘বন্দেমাতরম’ -এর বহিষ্কার উদ্দেশ্য ভারতীয় মুসলমান বিশেষ করিয়া বাঙ্গলার মুসলমান বহুদিন হইতেই আন্দোলন করিয়া আসিতেছিলেন। কিন্তু সে বিক্ষিপ্ত আন্দোলন, দেশে এতদিন বিশেষ সাড়া জাগাইতে পারে নাই। কিন্তু এইবার এই আন্দোলনে বাঙ্গলার নেতৃত্বে সারা ভারতের মুসলমান মানিয়া লইয়াছেন। সকলের সমবেত আন্দোলনের ফলে লক্ষ্ণৌ-লিগ অধিবেশনে ‘বন্দেমাতরমে’র বহিষ্কারের প্রস্তাব গৃহীত হইয়াছে। তাছাড়া কংগ্রেস প্রদেশগুলিতে ‘বন্দেমাতরম’ ধ্বনি এবং সঙ্গীত আইন পরিষদে, স্কুলে-কলেজে, স্বায়ত্ত শাসিত প্রতিষ্ঠানসমূহে যেভাবে জাতি ধর্মনির্বিশেষে সকলের পক্ষে বাধ্যতামূলক করার চরম স্বেচ্ছাচার অনুষ্ঠিত হইয়া চলিয়াছে, তাহাতে ভারতের মুসলমানদের ধৈর্যের সীমা অতিক্রম করিয়াছে। মুসলমানের বিরুদ্ধে এইসুস্পষ্ট পৌত্তলিকতাপূর্ণ হিন্দু যুদ্ধনিনাদে বাধ্যতামূলক করার চেষ্টার ভিতরে যে জঘন্য সাম্প্রদায়িক জবরদস্তি বিদ্যমান, প্রাণ থাকিতে কোন সত্যকার মুসলমান তাহা বরণ করিয়া লইতে পারে না। মুসলিম লিগ এই কথা হিন্দু-ভারতকে স্পষ্টভাবে জানাইয়া দিয়া ভারতীয় জাতীয়তার মহৎ উপকার করিয়াছে।”২১
মুসলিম লিগপন্থী লেখক শিল্পীরাও তাদের সমস্ত আক্রোশ আনন্দমঠ-এর ওপর উদগিরণ করতে শুরু করেন। আনন্দমঠ-এর বিরুদ্ধে এই জেহাদের নেতৃত্ব দেন সেকালের মুসলমান সমাজের যথেষ্ট মান্য ব্যক্তি মাওলানা আকরাম খাঁ। প্রকাশ্য জনসভায় তিনি এই বইটির বিরুদ্ধে বিষােদ্গার করে লিগপন্থী মুসলমানদের উত্তেজিত করতে শুরু করেন। এই উত্তেজনার চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ ঘটে লিগপন্থী কবি সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীদের সমাবেশে। নিজেদের ক্ষোভ মেটাতে কলকাতার প্রকাশ্য স্থানে লিগপন্থীরা আনন্দমঠ-কে অগ্নিদগ্ধ করেন (১৯৩৭)। এই অনল প্রবাহকে কেন্দ্র করে শােনা যেতে থাকে মুসলমান কবি সাহিত্যিকদের একাংশের উল্লাস। এর প্রতিক্রিয়া হিন্দু সমাজে যে দেখা যাবে তা বলা বাহুল্য। কিন্তু মুসলমান সমাজেরও শুভ বুদ্ধি সম্পন্ন কিছু মানুষ আনন্দমঠ সম্পর্কে স্বজাতির এই আচরণে বেদনা বােধ করেন। এঁদেরই একজন রেজাউল করিম। বঙ্কিমচন্দ্র ও বঙ্কিম-সাহিত্যের সঙ্গে মুসলমান সমাজের সম্পর্ক নিয়ে বেশ ক’টি প্রবন্ধ লেখেন তিনি। ‘আনন্দমঠের বহ্নি উৎসব’ প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয় আনন্দবাজার পত্রিকায় (১৯.৯.১৯৩৭)। পরে এগুলি একত্রিত হয়ে ‘বঙ্কিমচন্দ্র ও মুসলমান সমাজ’ নামে ১৯৪৪-এ বই হয়ে বেরােয়।
এতে বঙ্কিম-সাহিত্য, বিশেষ করে আনন্দমঠ ও ‘বন্দেমাতরম’ সম্পর্কে মুসলমান সমাজের একাংশের প্রতিক্রিয়াকে অপ্রয়ােজনীয় ও অবাঞ্ছনীয় বলে অভিহিত করেন লেখক। আনন্দমঠ যে মুসলমানের প্রতি বিদ্বেষ প্রচারের জন্য পরিকল্পিত নয়, তা রেজাউল করিম নানাভাবে বােঝাতে চেষ্টা করেন। অনেক মুসলমান সাহিত্যিক বঙ্কিম-সাহিত্যে মুসলিম বিদ্বেষের প্রচুর প্রমাণ পেলেও, রেজাউল করিম পর্যালােচনা করে দেখাতে চেষ্টা করেছেন বঙ্কিমচন্দ্র মুসলিম বিদ্বেষী ছিলেন—এই অভিযােগ কতখানি অসত্য। তিনি প্রশ্ন করেছেন, আনন্দমঠ হিন্দুকে মুসলিম বিদ্বেষী করে তুলেছে, না জাতীয়তার আদর্শে উদ্বুদ্ধ হওয়ার প্রেরণা জুগিয়েছে! আনন্দমঠ পাঠ করে তার আদর্শে অনেকেই দল গড়ে তুলতে চেয়েছেন কিন্তু সেই সব দলে মুসলিম বিদ্বেষের কোন চিহ্ন ছিল না। তার মতে, “আনন্দমঠ হিন্দুকে মুসলিম বিতাড়নের আদর্শে দীক্ষিত করে নাই, দীক্ষিত করিয়াছে স্বদেশ মন্ত্রে।”২২
রেজাউল করিম লিখেছেন, আনন্দমঠ প্রকাশের বছর তিনেক পরে জাতীয় কংগ্রেস-এর প্রতিষ্ঠা। কংগ্রেসের উদ্যোক্তাদের অনেকেই আনন্দমঠ পাঠ করেছিলেন। তারা কিন্তু হিন্দুর স্বার্থ আলাদাভাবে রক্ষার জন্য উন্মাদ হয় ওঠেনি। যে কংগ্রেস তারা প্রতিষ্ঠা করেন, তা ছিল ভারতের সকল সম্প্রদায়ের জাতীয় স্বার্থ রক্ষার প্রতিষ্ঠান। আনন্দমঠ প্রকাশের পর বেশ কয়েক বছর পর্যন্ত এর মুসলিম-বিদ্বেষের দিকটি বড় হয়ে ওঠেনি। বঙ্কিমসাহিত্যেও মুসলিম বিদ্বেষের গন্ধ কেউ বিশেষ খুঁজে পাননি। পরবর্তীকালে এর প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে তিনি বলেছেন, “আজ আমাদের একদল নেতা হঠাৎ তাহার সন্ধান পাইয়া ত্রস্ত ও আতঙ্কিত হইয়া উঠিলেন, তাই আনন্দমঠ-এর বহ্নি উৎসব হইতে লাগিল। বঙ্কিম-সাহিত্য এই যে মুসলিম বিদ্বেষের সন্ধান লাভ,ইহা নতুন ও আনকোরা কথা। বাস্তবতার সহিত ইহার কোন সংস্রব নাই। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্য এইরূপ করা হইয়াছে।”২৩
বঙ্কিমচন্দ্রের পক্ষ সমর্থন করতে গিয়েও রেজাউল করিম স্বীকার করেছেন স্থূল দৃষ্টিতে রাজসিংহ ও আনন্দমঠ পড়লে মনে হতে পারে তিনি মুসলমান বিদ্বেষী। কিন্তু তার সমস্ত রচনা নিরপেক্ষভাবে পাঠ করলে বােঝা যায় এই ধারনা কত ভুল। বঙ্কিমচন্দ্র যে মুসলমান বিদ্বেষী ছিলেন না তা তঁার ‘বাঙ্গালার ইতিহাস’ প্রবন্ধ অবলম্বনে তিনি দেখাতে চেষ্টা করেছেন। এই প্রবন্ধে পাঠান আমলের বাংলার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন বঙ্কিমচন্দ্র। যে সব উপন্যাসে বঙ্কিমচন্দ্র স্বদেশপ্রেম, দেশ উদ্ধারের সংকল্পের কথা বলেছেন, সেই সব রাজনৈতিক উপন্যাসেই মুসলমানদের সম্পর্কে কিছু অশােভন উক্তি স্থান পেয়েছে। আনন্দমঠ-এর সমালােচকের মুখ মুসলমানদের সম্পর্কে কটুক্তিকে এই উপন্যাসের মর্মকথা হিসাবে ধরাটা যে ঠিক নয়, তা তিনি দেখিয়েছেন।
যাইহােক, বন্দেমাতরমকে জাতীয় সঙ্গীতের মর্যাদা পরাধীন ভারতে দিয়েছিল কংগ্রেস মুসলিমরা তা পরিত্যাগের ডাক দেয়, বিশেষ করে তারা দেবী দুর্গার বন্দনায় আপত্তি তােলে। এই আপত্তির কারণ প্রসঙ্গে গােপাল হালদার রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সহমত পােষণ করে বলেছেন, “ত্বং হি দুর্গা দশপ্রহরণধারিণী’ প্রভৃতি কথা সহজে যত হিন্দুর আবেগ-অভিনন্দন লাভ করুক, মুসলমানদের নিকট অস্বস্তিকর হয়। মুসলমানদের নিকট পূর্ণাঙ্গ ‘বন্দেমাতরম’ জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে এই জন্যই অরুচিকর (আনন্দমঠে যবনের বিরুদ্ধে তা সংগ্রাম সঙ্গীত; কী করে মুসলমানকে এ সঙ্গীত তৃপ্ত করবে?)।…বঙ্কিম নির্বোধ নন। তাঁর যুগে তিনি শ্রেষ্ঠ প্রতিভা। অন্যেরা না বুঝুন, তার তাে বুঝবার কথা, আদর্শের দিক থেকে তার স্বদেশপ্রীতি যত মহান হােক, তা বড় বেশী রকমের ধর্মাশ্রয়ী ও হিন্দুধর্মাশ্রয়ী। কার্যত এই বহু ধর্মের দেশে ধর্মাশ্রিত স্বদেশপ্রীতি এক জাতীয়তার পথে বিদ্যোৎপাদন করে। …কোনাে গােষ্ঠীর সংস্কৃতির একপেশে গৌরবমহিমা ঘােষণা ভারতবর্ষের সম্মিলিত সংস্কৃতির মূলরূপকে পরােক্ষে আচ্ছন্ন করে।”২৪
কবি জসীমউদ্দীন কিছুদিন রবীন্দ্রনাথ ও ঠাকুরবাড়ির সান্নিধ্যে এসেছিলেন এবং তিনিও সেকালের বিতর্কিত বন্দেমাতরম গানের উপর কবিগুরুর উদার অভিমতের উল্লেখ করেছেন: “একদিন বন্দেমাতরম্ গানটি লইয়া কবির সঙ্গে আলােচনা হইল। কবি বলিলেন, বন্দেমাতরম গানটি যেভাবে আছে তােমরা মুসলমানেরা এজন্য আপত্তি করতে পার। কারণ এখানে তােমাদের ধর্মমত ক্ষুন্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে।” জসীমউদ্দীন আরও বলেছেন: “সেই সময়ে একদিন বন্ধুবর সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে বলিলাম, “রবীন্দ্রনাথ নিজে স্বীকার করেছেন বন্দেমাতরম্ গানে মুসলমানদের আপত্তির কারণ আছে। আজ সারা দেশ এই গান নিয়ে একটা বিরাট সাম্প্রদায়িক কলহের সম্মুখীন হচ্ছে, এখন তাে কবি একটি কথাও বলেছেন না। সৌমেন্দ্রনাথ বলিলেন, ‘জহরলাল নেহেরু গানটি রবীন্দ্রনাথের কাছে পাঠিয়ে ছিলেন। কবির পরামর্শের ফলে এই গানে তােমাদের আপত্তিজনক অংশটি কংগ্রেসের কোন অনুষ্ঠানে আর গীত হবে না।”২৫
প্রসঙ্গত স্মর্তব্য যে, বন্দেমাতরমকে নিয়ে সমস্যার ব্যাপারে সুভাষচন্দ্র সম্পূর্ণভাবে সচেতন ছিলেন। আর সেজন্যই আজাদ হিন্দ বাহিনীর মার্চ-সঙ্গীত হিসেবে তিনি ওই সঙ্গ ীতকে ব্যবহার করতে রাজি হননি, ‘কদম কদম বাড়ায়ে যা’ নামে নতুন একটি গান তৈরি করিয়ে নিয়েছেন।
তাছাড়া, শুধু বন্দেমাতরম নয়, আনন্দমঠের সন্তান সেনাদের মুখে আরােপিত মুসলমানদের উদ্দেশ্যে কিছু অন্যায় উক্তি এবং অসংযত কটাক্ষও তাদের ক্ষোভের উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছিল, যেটা পূর্বেই বলা হয়েছে। সমালােচক রেজাউল করীম এ প্রসঙ্গে বলেন, উপন্যাসে বর্ণিত সংলাপ ‘অনেক সময় লেখকের নিজের কথা হয় না।’ অতএব আনন্দমঠে মুসলমানদের সম্পর্কে যে বিরূপ উক্তি ও অশােভন মন্তব্য করা হয়েছে তাহাও লেখকের নিজের কথা নয়’ এ যে কোনও যুক্তি নয় তা বলাই বাহুল্য। কারণ উপন্যাসের চরিত্রের স্রষ্টা যেমন ঔপন্যাসিক, তাঁর সংলাপ, রাগ-অনুরাগ, গালাগালিরও স্রষ্টা তিনিই, অপর কোনাে ব্যক্তি নন। চরিত্রের মধ্যে লেখক নিজের ধ্যান-ধারণা-বক্তব্য-আদর্শ ব্যক্ত করেন। অতএব ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসে মুসলমানদের প্রতি যে অন্যায়-অসংগত উক্তি উচ্চারিত হয়েছে তাঁর দায় ভার বহন করতে হবে বঙ্কিমচন্দ্রকেই।
আনন্দমঠে সাম্প্রদায়িকতার নগ্নমূর্তি অতি উৎকটভাবে প্রকটিত হয়েছে। বঙ্কিমচন্দ্রকে স্বাধীনতার মন্ত্রগুরুরূপে যে সম্মান দেওয়া হয়, সে সম্মান তাঁর প্রাপ্য কিনা আজ সেটা সন্দেহের বিষয়। বিপানচন্দ্র ‘আধুনিক ভারত ও সাম্প্রদায়িকতাবাদ’ গ্রন্থে সরাসরি উল্লেখ করেছেন যে, বঙ্কিমচন্দ্রের কিছু ঐতিহাসিক উপন্যাস সাম্প্রদায়িকতার রূপ নিয়েছিল। তিনি বলেছেন, “বঙ্কিম মুসলিমদের বিদেশি হিসাবে দেখিয়েছিলেন এবং জাতীয়তাবাদ বা ভারতীয়ত্ব বা দেশজ সবকিছুর হিন্দুদের সঙ্গে অভিন্নরূপ কল্পনা করেছিলেন…বঙ্কিম ও তাঁর মতাে অন্য লেখকরা সচরাচর মুসলিমদের অত্যাচারী ও লম্পট স্বৈরতন্ত্রীর ভূমিকায় ফেলতেন আর হিন্দুদের চরিত্র অঙ্কন করতেন হয় স্বাধীনতাসহ ইতিবাচক মূল্যবােধের জন্য সংগ্রামরত বীর, অথবা, মুসলিম শাসকদের সঙ্গে সংহতি দেখালে, বিশ্বাসঘাতক ও দেশদ্রোহীরূপে। এই ধরনের সাহিত্য, যার মধ্যে মুসলিম স্বৈরতন্ত্রের তত্ত্ব ধারাবাহিকভাবে উপস্থিত থাকত, তা অনিবার্যভাবে শিক্ষিত মুসলিমদের মধ্যে বিক্ষোভ সৃষ্টি করত এবং বিকাশমান জাতীয় আন্দোলন থেকে তাঁদের বিচ্ছিন্ন করার প্রবণতা দেখাত। …তাঁকে একেবারে ভুল কারণবশতঃই মহান জাতীয়তাবাদী লেখক আখ্যা দেওয়া হল। তাঁর ঐতিহাসিক উপন্যাসগুলিকে ইতিহাসের প্রকৃত উপলব্ধির ভিত্তিতে রচিত খাঁটি ঐতিহাসিক উপন্যাস হিসাবে সম্বর্ধনা দেওয়া হল। তাঁর ভূমিকা নিজের যুগে ও নিজের লেখার নিরিখে যত না প্রতিক্রিয়াশীল ও সাম্প্রদায়িক ছিল, তার থেকে বেশি হল তাঁর লেখার সাম্প্রদায়িক অংশগুলিকে উৎকট স্বাদেশিকতা ও সাম্প্রদায়িকতার পক্ষ গ্রহণ করে তাঁকে অহেতুক গুরুত্ব দেওয়া।”২৬
অনুরূপ বক্তব্য সাহিত্য সমালােচক নারায়ণ চৌধুরীরও। তিনি বলেছেন, “ভারতবর্ষের রাজনীতিতে পরবর্তীকালে হিন্দু-মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে যে দুস্তর পার্থক্য সূচিত হয়েছিল তার বীজ রােপণকারীদের মধ্যে বঙ্কিম একজন, একথা বললে মােটেই বাড়িয়ে বলা হয় না। এক্ষেত্রে বঙ্কিমের ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাস ক্ষতিকর ভূমিকা পালন করেছিল বলেই আমাদের ধারণা। বইখানা রীতিমত সাম্প্রদায়িকঙ্গ মুসলমান সম্প্রদায়ের প্রতি এই উপন্যাসে যে পরিকল্পিত বিদ্বেষ প্রচার করা হয়েছে তা দাস্য মনােভাবপ্রসূত তথা স্বার্থপ্রণােদিত ইংরেজ ভজনার দোষকেও ছাড়িয়ে গেছে।”২৭
আনন্দমঠ ও বন্দেমাতরম নিয়ে আনন্দবাজারের কলামিস্ট অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়ের বক্তব্যও খুব পরিষ্কার। তিনি বলেন: “টেলিভিশনের স্টার নিউজ-এর পরিবেশকরা আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন মাওলানা ওয়াহিউদ্দিন খানকে। ধর্মশাস্ত্রের বিশেষজ্ঞ তিনি। পরিবেশকরা প্রশ্ন করেছিলেন, ‘বন্দেমাতরম’ কি ইসলামি আদর্শের বিরােধী? এ গান নিয়ে কি রাজনৈতিক বিতর্ক বাঁধানাে হচ্ছে? এ সব প্রশ্নে নিহিত সাংবাদিকসুলভ প্ররােচনাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে শান্ত কণ্ঠে প্রবীণ মানুষটি যা বললেন তার মর্মার্থঃ আদর্শের কথা থাক, কাজের কথা বলি। বন্দেমাতরম্ এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে উত্তরপ্রদেশের মুসলমান পড়ুয়ারা প্রাথমিক স্কুল বয়কট করার উপায় তাদের নেই, লেখাপড়া তাে করতেই হবে। বাধ্য হয়েই তারা স্কুলে যাবে। কিন্তু তাদের মনে, একটা পাপবােধ জন্ম নেবে, তারা নিজেদের অপরাধী মনে করবে।
শেষ কথাটি শুনে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসেছিলাম। এভাবে তাে কখনও ভাবিনি। ভাবা উচিত ছিল, কিন্তু আসলে এভাবে ভাবতে শিখিনি। শহুরে হিন্দু বাঙালির ঘরে, তদুপরি উচ্চবর্ণে জন্মানাের এটাই অভিশাপ। বিচ্ছিন্নতার অভিশাপ। চিন্তায় ও অনুভূতিতে নিজের গন্ডির বাইরে যেতে না পারার অভিশাপ। সংখ্যাগরিষ্ঠের অনুশাসন কীভাবে সংখ্যালঘুর মনে তীব্র অভিঘাত সৃষ্টি করতে পারে, তা অনুভব করার সাধ্য কোথায়? সমাজবিজ্ঞানী রামচন্দ্র গুহ পশ্চিমবঙ্গের বাঙালির প্রশংসা করেছেন, কারণ স্বাধীনতার পরে আমরা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অসামান্য ইতিহাস সৃষ্টি করেছি, বড় দাঙ্গা হতেই দিইনি। (হােয়্যার ফেইদ ইজ উইদাউট ফিয়ার, দ্য টেলিগ্রাফ, ১৯ নভেম্বর, ১৯৯৮)। প্রশংসা শুনতে ভালই লাগে, অস্বস্তিও হয়। যে অমিত আত্মকেন্দ্রিক ঔদাসীন্যের বশ আমরা, তা দিয়ে সহাবস্থান হতে পারে, কিন্তু যার মন বুঝতে পারি না, তার সঙ্গে সম্প্রীতি? সম্যক্ প্রীতি? ঔদাসীন্য মজ্জাগত বলেই না প্রবীণ মুসলমান মানুষটি বলে দিলে তবে খেয়াল হয়—তাই তাে, আগেই ভাবা উচিত ছিল বটে!
এখানেই ভারতীয় জনতা পার্টির সুবিধে। ওঁরা আমাদের এই মানসিক দূরত্বকে কাজে লাগিয়ে ‘জাতীয়তাবােধ জাগ্রত করা’র ছল করতে পারেন। ‘যারা বন্দেমাতরমের বিরােধিতা করে তারা জাতীয়তাবিরােধী’—বলেছেন উত্তরপ্রদেশের মৌল-শিক্ষামন্ত্রী রবীন্দ্র শুক্ল। আমরা প্রতিধ্বনি তুলেছি, “বন্দেমাতরমকে অস্বীকার করা, স্বাধীনতা আন্দোলনকে অস্বীকার করা, মুক্তির মন্দির-সােপানতলে যাঁরা প্রাণ দিয়েছেন তাদের অস্বীকার করা। আমরা ছােটবেলা থেকেই এভাবে ভাবতে অভ্যস্ত হয়েছি, সবিতাব্রত দত্ত তার দিল্লি-থেকে বর্মা নিনাদে ‘বন্দেমাতরম’ বলে দম ধরলে চোখের জল সামলাতে পারিনি। আমাদের মনে পড়েছে সেই দৃশ্য—ভবানন্দ বন্দেমাতরম্ গান গাইলেন এবং মহেন্দ্র দেখিল দস্যু গায়িতে গায়িতে কাদিতে লাগিল। (আনন্দমঠ, প্রথম খন্ড, দশম পরিচ্ছেদ)। আমরা ভবানন্দের সন্তান।
ভাবের ঘরে চুরি না করে একবার আনন্দমঠের ওই পাতাগুলি যদি উল্টে যাই। বন্দেমাতরম সঙ্গীতের দ্বিতীয় অংশে দেশমাতৃকা যখন সরাসরি দশপ্রহরণধারিনী দুর্গায় রূপান্তরিত হন? গানের পরেই ভবানন্দ যখন সন্তানদের আদর্শ মহেন্দ্রকে বােঝাতে থাকেন, মুসলমান রাজশক্তির বিরুদ্ধে তার বিষােদগার তখন মসৃণভাবে ‘মুসলমান চরিত্র’রই অবমাননায় পর্যবসিত হয়? মহেন্দ্র প্রশ্ন করেন, ‘তবে ইংরেজ-মুসলমানে এত তফাৎ কেন?’ ভবানন্দ সহজ করে বুঝিয়ে দেন, ‘ধর, এক ইংরেজ প্রাণ গেলেও পলায় না, মুসলমান গা ঘামিলে পলায়—শরবৎ খুঁজিয়া বেড়ায় …’। এই প্রশ্নোত্তর পাঠ করে আমরা কি বেমালুম বলতে পারব যে বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠ নিয়ে, আনন্দমঠের বন্দেমাতরম্ নিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতার দিক থেকে কোনও সমস্যা নেই?
সত্য এই যে, আমাদের জাতীয়তাবাদ হিন্দুত্বের অভিমানে জারিত। বিশেষ জাতীয়তার ধারণার সঙ্গে নির্বিশেষ ধর্মনিরপেক্ষতাকে মেলাতে গেলে তাই নানান বিপাকে পড়তে হয়। বন্দেমাতরম্, আনন্দমঠ, বঙ্কিমচন্দ্র সম্পর্কে দ্বিধাহীন সিদ্ধান্ত করা যায় না, সব দিক বাঁচিয়ে বলতে হয়—ধর্মনিরপেক্ষতাকে যুগের প্রেক্ষিতে বিচার করতে হবে, তিনি কোন সময়ে দাঁড়িয়ে কোন উদ্দেশ্যে আনন্দমঠ লিখেছিলেন, বন্দেমাতরম বেঁধেছিলেন তা মনে রাখতে হবে, শাসক মসলমান আর প্রজা মসলমানের মধ্যে, আওরঙ্গজেব ও হাসিম শেখের মধ্যে তিনি যে প্রভেদ করেছিলেন তার গুরুত্ব বুঝতে হবে।
সত্য কথা। কিন্তু সেই সত্য আমাদের বেশি দূরে নিয়ে যায় না। আমরা বুঝতে পারি, ভারতীয় জনতা পার্টি তথা তার পশ্চাদ্বর্তী রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ বন্দেমাতরমকে রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য ব্যবহার করতে চাইছে, জোর করে এই গান গাওয়ালে মুসলিম মানসে তীব্র প্রতিক্রিয়া হবে বলেই জোর করে গাওয়াতে চাইছে, এ গান তাদের কাছে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির প্রকরণ মাত্র। কিন্তু সব বুঝেও আমরা এই দুরভিসন্ধির দ্বিধাহীন প্রতিবাদ করতে পারি না, জাতীয়তাবাদের ভূত কণ্ঠরােধ করে, ভবানন্দের উত্তরাধিকার কাঁধে চেপে থাকে। সেটা জানে বলেই সংঘ পরিবার উত্তরপ্রদেশের প্রাথমিক স্কুলে বন্দেমাতরম্ গাওয়ানাের জেদ ধরে, প্রতিবাদ করলেই যাতে তারা দুয়াে দিতে পারে—‘ওই জন্যেই তাে বলি, তােমরা হলে মেকি ধর্মনিরপেক্ষ আমরাই আসল।‘…
হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিকদের বন্দেমাতরম্ অভিযানের মৌলিক অন্যায় ঠিক এখানেহ, সম্পূর্ণ অবান্তর একটি দাবিতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের পড়ুয়াদের ওপর এমন এক আচার চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে, যা সেই সম্প্রদায়ের অবাঞ্ছিত। কেন অবাঞ্ছিত, সেই কৈফিয়ত দেওয়ার দায় মুসলমান সম্প্রদায়ের নয়, তারা শুধু নিজেদের ব্যাপারে স্বাধিকার চাইছেন। কৈফিয়ত দেবার দায় তাদের, যাঁরা জাতীয়তাবাদের মােড়কে সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদ চাপিয়ে দিতে তৎপর। সংখ্যাগরিষ্ঠের সাম্প্রদায়িকতা যে জাতীয়তাবাদের ভেক ধরে আসে সে কথা অজানা ছিল না। কিছুটা অজানা ছিল এই নির্মম সত্য যে কত সহজে ভেক দেখে বিভ্রান্ত হই, ভাবি—সত্যিই তাে দেশমাতৃকার বন্দনায় আপত্তি কীসের, ভাবতে ভুলে যাই, কোন প্রেক্ষাপটে কারা সে বন্দনার ইজারা নিয়েছে। ভুলে যাই, কারা আমরা সংখ্যাগরিষ্ঠতার নিরাপত্তায় লালিত। আমাদের জাতীয়তাবাদের দাবি ‘ওদের মনে কোন বিপন্নতা, কোন অপরাধবােধ সৃষ্টি করে তা নিয়ে মাথা ঘামানাের দরকার কী? এই জাতীয়তা নিয়ে আমাদের তাে কোনও অপরাধবােধ নেই! বন্দেমাতরম্।”২৮
তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, একটা মুসলিম বিরােধী কাহিনীর পটভূমিকায় গানটি রচিত হয়েছে এবং রাজনীতির মধ্যে ধর্ম ও সম্প্রদায়বােধ বঙ্গভঙ্গবিরােধী আন্দোলনের সময় থেকেই হিন্দু নেতারা কখনও পরােক্ষভাবে, কখনও প্রত্যক্ষভাবে জিইয়ে রেখেছেন। আনন্দমঠের উপর তরবারী রেখে শপথ গ্রহণ, চন্ডীপাঠ, গীতাপাঠ, কালীপূজা ইত্যাদি ধর্মীয় আচার আচরণের উপর বেশী করে জোর দেওয়া হয়েছিল। ফলে মুসলিমরা আন্দোলন থেকে সরে যেতে বাধ্য হয়েছিল।
স্বদেশী আন্দোলনে শিবাজী ও গণপতি উৎসবের প্রচলন মহারাষ্ট্রে শুরু হয়—কারিগর ছিলেন বালগঙ্গাধর তিলক। এই সময় বাংলার বিপ্লবীরা দুর্গাপূজা, কালীপূজা ইত্যাদি করতে শুরু করে দিলেন। স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রসার না করে তাঁরা হিন্দু পুনরুজ্জীবনবাদকে বিশেষ গুরুত্ব দিলেন। এর ফলে জাতীয়তবাদী আন্দোলন কোন ধারায় প্রবাহিত হতে শুরু করল সে সম্পর্কে ই এম এস নাম্বুদ্রিপাদ তাঁর গ্রন্থে বলেছেন, “হিন্দু ভাবানুষঙ্গী পন্থাপদ্ধতিতে, হিন্দু ধ্যানধারণাসম্পৃক্ত ভাষা ব্যবহার করে আন্দোলনের প্রচারাভিযান চলল, প্রতীক তৈরী হলাে, সাহিত্যাদি রচিত হলাে। তাই তাদের এমন সব আন্দোলনের কার্যক্রমের পরিকল্পনা করতে হলাে—যাতে জনগণকে জাগিয়ে তােলা যাবে একদিকে বিদেশী-শাসকদের বিরুদ্ধে আর অন্যদিকে মুসলিম ও অন্য আর সব অহিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষদেরও বিরুদ্ধে।”২৯
শিবাজী, রাণাপ্রতাপ যারা আঞ্চলিক নেতা ছিলেন তাঁদের জাতীয় নেতায় পরিণত করার ফল ভালাে হয়নি। বিপানচন্দ্র তাই বলেছেন, “কী হিসেবে তারা জাতীয় নায়ক এবং তাদের সংগ্রাম কি অর্থে ‘জাতীয় সংগ্রাম? তারা বিদেশীদের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত ছিলেন বলে? কী অর্থে মুঘলরা বিদেশী? কারণ তারা মুসলমান ছিলেন। রাণাপ্রতাপ, শিবাজী ও গুরুগােবিন্দ সিংহের ‘জাতীয়তাবাদের’ ঐক্যসূত্র কী ছিল? তারা হিন্দু বা অমুসলমান ছিলেন। এভাবে মহাপুরুষ পুরাণগুলি স্বতঃস্ফূর্তভাবে সাম্প্রদায়িকতার সৃষ্টি করেছিলাে।”৩০
শিবাজী উৎসবের প্রতিবাদে মুসলিমরাও তােড়জোড় শুরু করে ঔরঙ্গজেব উৎসব নিয়ে। অথচ ঔরঙ্গজেব বা শিবাজী কেউই জাতীয় নেতা নন, তারা এক এক সম্প্রদায়ের নেতা হতে পারেন। রবীন্দ্রনাথও ওই উন্মাদনার মধ্যে শিবাজীকে নিয়ে কবিতা লিখে ফেললেন, অপরদিকে এই কবিতায় উৎসাহিত হয়ে হুমায়ুন কবিরও আকবরের উপর কবিতা লিখলেন। বালগঙ্গাধর তিলকের সঙ্গে। বাংলার অরবিন্দ, বিপিনচন্দ্র, ব্রহ্মবান্ধব প্রমুখ নেতারা হাত মেলালেন। বাংলায় শিবাজীপূজা রীতিমত শুরু হয়ে গেল। আর আন্দোলনের ধর্মীয় রূপ দেখে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ আন্দোলন থেকে সরে দাঁড়ালেন। রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীকে লেখা চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ নিজের ভুলের কথা অকপটে স্বীকার করেন, “উন্মাদনায় যােগ দিলে কিয়ৎ পরিমাণে অবসাদ ভােগ করিতেই হয়। আমি তাই ঠিক করিয়াছি যে, অগ্নিকান্ডের আয়ােজনে উন্মত্ত না হইয়া যতদিন আয়ু আছে, আমার এই প্রদীপটিকে জ্বালিয়া পথের ধারে বসিয়া থাকিব।”৩১
এই পরিবেশে আনন্দমঠের প্রসঙ্গও উঠে আসে। কেননা এই উপন্যাসে ইতিহাসের বিকৃত ও অসত্য কথনের ব্যবহার এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যময়তা বিশেষভাবে প্রকট। সেই সঙ্গে সাম্প্রদায়িক স্পর্শকাতরতা বিষয়গুলিও প্রত্যক্ষভাবে উল্লেখিত। তাই কেউ কেউ মনে করেন, সর্বনাশা দ্বিজাতিতত্ত্বের বীজ প্রথম যদি কোনও উপন্যাসে উগ্রভাবে উপ্ত হয়ে থাকে সেটা হল এই আনন্দমঠ। আর তার উদগত বিষাঙ্কুর পরে ছড়িয়ে পড়ে সারা বাংলায় সারা ভারতে। স্যার সৈয়দ আহমদ খান, স্যার আমির আলি, ঢাকার নবাব আব্দুল গনি, মহম্মদ ইকবাল, সবশেষে মহম্মদ আলি জিন্না প্রচারিত মুসলিম সাম্প্রদায়িকতাবাদ একটা তত্ত্ব হিসেবে যদি কোনও বই বা উপন্যাস থেকে তার প্রাথমিক রসদ সংগ্রহ করে থাকে তাহলে সে বইটি হল আনন্দমঠ। অবশ্য শুধু আনন্দমঠ সহ কয়েকটি উপন্যাস দিয়েই বঙ্কিমচন্দ্রের প্রতিভার মহত্ব ও বিরাটত্ব পরিমাপ করা অসম্ভব সম্ভব নয় বঙ্কিমচন্দ্রের অখন্ড মানসিকতার চূড়ান্ত বিচারও। তবে আজকে যখন ভারতে উগ্র প্রাদেশিকতা ও ধর্মীয় মৌলবাদ তথা সাম্প্রদায়িকতার করাল আগ্রাসন প্রবল হয়ে উঠছে প্রতিনিয়ত তখন আমাদের আরও বেশী করে সচেতন হওয়া বাঞ্ছনীয় নয় কি?
তথ্যসূত্রঃ
১. নেপাল মজুমদার, ভারতে জাতীয়তা ও আন্তর্জাতিকতা এবং রবীন্দ্রনাথ, খণ্ড-৪, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, ১৯৯১, পৃ. ১৯১।
২. আনন্দবাজার পত্রিকা, ৮ই কার্তিক ১৩৪৪, কলকাতা।
৩. আনন্দবাজার পত্রিকা, ১২ই কার্তিক ১৩৪৪; ২৯আগষ্ট, ১৯৩৭, কলকাতা।
৪. আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৩ কার্তিক, ১৩৪৪, কলকাতা।
৫. আনন্দবাজার পত্রিকা ৩০-১০-১৯৩৭, কলকাতা।
৬. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, চিঠিপত্র, খণ্ড-৫, পত্র-৮৭, পৃ. ২৭১।
৭. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, চিঠিপত্র, খণ্ড-৫, পত্র-৮৭, পৃ. ২৭০।
৮. নেপাল মজুমদার, প্রাগুক্ত, পৃ.১৯০।
৯. বুদ্ধদেব বসু, রচনা সংগ্রহ, খণ্ড-৩, কলকাতা, পৃ. ৫৯০।
১০. বুদ্ধদেব বসু, রচনা সংগ্রহ, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫৯০-৫৯১।
১১. এস এম আকবরউদ্দিন, বর্তমান বাঙ্গালা সাহিত্যে মুসলমানের স্থান’, আল এসলাম, দ্বিতীয় বর্ষ, দশম সংখ্যা, মাঘ ১৩২৩।
১২. এস এম আকবরউদ্দিন, প্রাগুক্ত, আল এসলাম, ফাল্গুন-চৈত্র ১৩২৩।
১৩. মুহাম্মদ এনামুল হক, বিশ্ববিদ্যালয় সম্বন্ধে নতুন সমস্যা’, বুলবুল, ফাল্গুন ১৩৪৩।
১৪. মুহাম্মদ এনামুল হক, প্রাগুক্ত, বুলবুল, ফাল্গুন ১৩৪৩।
১৫. মুস্তফা নুর উল ইসলাম, সাময়িক পত্রে জীবন ও জনমত, ২য় খন্ড, ঢাকা, ২০০৫, পৃ. ১৭।
১৬. ‘বন্দেমাতরম’, বুলবুল, ফাল্গুন, ১৩৪৩।
১৭. ‘বন্দেমাতরম’, বুলবুল, ফাল্গুন, ১৩৪৩।
১৮. ‘বন্দেমাতরম’, বুলবুল, ফাল্গুন, ১৩৪৩।
১৯. ‘বন্দেমাতরম, বুলবুল, ফাল্গুন, ১৩৪৩।
২০. ‘বন্দেমাতরম’, মাসিক মােহাম্মদী, কার্তিক ১৩৪৪।
২১. ‘বন্দেমাতরম’, মাসিক মােহাম্মদী, কার্তিক ১৩৪৪।
২২. রেজাউল করিম, বঙ্কিমচন্দ্র ও মুসলমান সমাজ, ইন্ডিয়ান অ্যাসােসিয়েটেড পাবলিশিং কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, ১৩৬১, পৃ. ৩।
২৩. রেজাউল করিম, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫-৬।
২৪. গােপাল হালদার, বাংলা সাহিত্য ও মানব স্বীকৃতি, কলকাতা,পৃ. ৪৭।
২৫. জসীমউদ্দীন, ঠাকুরবাড়ির আঙিনায়, স্টুডেন্টস ওয়েজ, ঢাকা, পৃ. ২৬-২৭।
২৬. বিপানচন্দ্র আধুনিক ভারত ও সাম্প্রদায়িকতাবাদ, কে পি বাগচি, কলকাতা, ১৯৮৯, পৃ. ১৪৬-১৪৭।
২৭. নারায়ণ চৌধুরী, দশ দিকপাল লেখক, বঙ্কিমচন্দ্র অধ্যায়, কলকাতা, পৃ. ১৯।
২৮. অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়, বন্দেমাতরম্ বনাম গণতন্ত্র (নিবন্ধ), আনন্দবাজার ২৪-১১ ৯৮।
২৯. ই এম এস নাম্বুদ্রিপাদ, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস, ২য় খন্ড, এন বি এ, কলকাতা, পৃ. ১৩২।
৩০. রােমিলা থাপার-হরবংশ মুখিয়া-বিপানচন্দ্র, সাম্প্রদায়িকতা ও ভারত-ইতিহাস রচনা, কে পি বাগচী অ্যান্ড কোম্পানি, কলকাতা, ১৯৭৬, পৃ. ৭৭।
৩১. দ্রঃ- আজাহারউদ্দিন খান, বঙ্কিমচন্দ্র—অন্য ভাবনায়, সৃজন, ঘাটাল, ২০০৪, পৃ.৫১।