লিখেছেনঃ সুপ্রিয় দাশগুপ্ত
সিনেমা যন্ত্রযুগের শিল্প। তার জন্ম স্বভাবতই পশ্চিমের ঘরে। যন্ত্রের মধ্য দিয়েই আধুনিক সভ্যতার বিকাশ, আর সেই যন্ত্র হচ্ছে পশ্চিমের সৃষ্টি। আবার পশ্চিমের সঙ্গে যােগাযােগ হয়ে আমাদের দেশে আধুনিক মানসের উদ্ভব। কাজেই আমাদের ঔপনিবেশিক, কৃষিপ্রধান দেশে সিনেমার আমদানিও হয়েছে আধুনিকতার অন্য নানা সরঞ্জামের সঙ্গে, রেলগাড়ি বা রেডিও ও টেলিফোনের মতাে পশ্চিম থেকে। সাহিত্যে, সঙ্গীতে, নৃত্যে, চিত্রকলায় আমাদের একটা বিরাট দেশীয় ঐতিহ্য আছে, কম বেশি তার জের টেনেই আমাদের আজকের শিল্পকলা। কিন্তু আমাদের সিনেমার মধ্যে সে ঐতিহ্য নেই। নির্ভরের অভাবে তার অস্তিত্ব কেবলই টলটলায়মান। সমাজ ও শিল্পকলার সঙ্গে যে সংযােগের মধ্য দিয়ে শিল্পে ক্রমে ক্রমে ঐতিহ্যের বুনিয়াদ গড়ে ওঠে তার পরিচয় আমাদের সিনেমায় এখনাে মেলেনি।
সময়ের মাপকাঠিতে ভারতীয় সিনেমা ইউরােপ আমেরিকার চেয়ে তেমন কিছু, খাটো নয়। ১৯৫০ সালে এদেশী সিনেমার ছত্রিশ বছর পূর্ণ হল, আমেরিকায় তার ইতিহাস মােটামুটি পঞ্চাশের বেশি নয়।
তব পশ্চিমের চলচ্চিত্র-শিল্পে ইতিমধ্যেই একটা বিশিষ্ট ঐতিহ্য গড়ে উঠেছে, আমাদের চলচ্চিত্রে যার একান্ত অভাব। কারণ খুঁজতে গেলে বলতে হয় যে যন্ত্রসভ্যতার সঙ্গে সিনেমার যােগ গভীর হওয়ায় যেদেশে এই যন্ত্রসভ্যতা এখনাে প্রসারিত হয়নি সেদেশে সিনেমার বিকাশও অপরিণত। মাত্র অর্ধশতাব্দীর ইতিহাস সত্ত্বেও পশ্চিমী সিনেমার ঐতিহ্য পশ্চিমী শিল্পকলা ও জীবনের মধ্য থেকে উৎপত্তি লাভ করে বহুদূর এগিয়ে এসেছে। পশ্চিমী চিত্রকলার রচনা, টোন; সঙ্গীতের গতি, হার্মনির নাটকীয়তা; স্থাপত্যের গড়ন; নৃত্যের তাল; কাব্যের ছন্দ ও প্রবাহ; উপন্যাসের বর্ণনাভঙ্গী; ইউরােপীয় শিল্পদষ্টির প্রি-ডাইমেনশানাল চরিত্র -এ সকলের রসায়নেই আধুনিক যুগের নতুন আর্টের সষ্টি।
কিন্তু ভারতীয় সিনেমার সঙ্গে ভারতীয় চিত্রকলার কোনাে যােগ নেই। সঙ্গীত ও নৃত্যের যেটুকু সম্পর্ক সেটুকু অকারণ অপপ্রয়ােগের। আর সাহিত্যের সঙ্গে সম্পর্ক বলতে গেলে বলতে হয় যে বহু শক্তিমান সাহিত্যিক সিনেমায় বাজীমাৎ করতে গিয়ে সাহিত্য আর সিনেমা দুইয়েরই সমূহ সর্বনাশ ঘটিয়েছেন। রুপ ও রীতির দিক থেকে অন্যান্য শিল্পের সঙ্গে এদেশীয় সিনেমার কোনাে যােগ দেখি না। এখানে সেখানে দু’চারটি গান বা ছবিতে আবহঝঙ্কারের প্রয়ােগের মধ্যেই সিনেমা ও সঙ্গীতের সম্পর্ক শেষ হয় না, সিনেমা হচ্ছে সঙ্গীতের মতাে তালবদ্ধ গতি। ক্যামেরার প্রয়ােগের মধ্যেই কাব্যধর্মী সৃষ্টির অবকাশ আছে। বিখ্যাত ‘রােড টু লাইফ’ ছবিটি যাঁরা দেখেছেন শীতের শেষে বরফ গলে ভেসে আসার অপুর্ব পরিচ্ছেদটি তাঁদের মনে পড়বে। চিত্রধর্মী সষ্টি তাে আছেই, মেক্সিকান ছবি ‘মারিয়া কাণ্ডেলারিয়া’-তে বৃষ্টির মধ্যে টোকা মাথায় দেওয়া লােরেনসাে রাফায়াল-এর অস্পষ্ট হতে হতে মিলিয়ে যাওয়া মতি শ্রেষ্ঠ চীনে ছবির কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। আইজেনস্টাইন-এর ‘ব্যাটলশিপ পােটমকিন’-এ সঙ্গীত, চিত্রকলা, স্থাপত্য -তিনেরই যােগ অতি প্রকট হয়েছে। বিরাট সেতুর ওপর, নিচ আর সামনে দিয়ে যেখানে অগণিত লােক সমুদ্রতীরের দিকে চলেছে সেখানে তিন বিভিন্ন গতির রচনা-নৈপুণ্যে মহৎ চিত্রকলার ব্যাপ্তি, বিশাল সিমফনির মতাে গম্ভীর, সম্পূর্ণ। ইউরােপীয় সিমফনি-সঙ্গীতের আদর্শে এই ছবির তাল ও লয় নির্ধারিত বলে মনে হয়। আলেগ্রো অর্থাৎ দ্রুততালে আরম্ভ : আন্দান্তে বা মন্থর মধ্যভাগ : ঈষৎ ঢিমে আলেগ্রোয় শেষ। শােনা যায় এই ছবির নানা পরিচ্ছেদের উপযােগী সঙ্গীত রচিত হবার পর, সেই সঙ্গীতের ভিত্তিতে দৃশ্যবিভাগ করা হয়েছিল। অথচ এ ছবি নির্বাক, সে যুগে সঙ্গীত বাজানাে হত প্রেক্ষাগৃহের আলাদা অর্কেস্ট্রায়। সম্পাদনার কাজকে এখানে আইজেনস্টাইন তাল ও লয়ের দিক থেকে দেখেছেন ও প্রয়ােগ করেছেন।
চ্যাপলিনের সৃষ্টি আইজেনস্টাইন-এর চেয়েও মহৎ; তাতে অন্যান্য সমস্ত আর্ট আরাে সরলীকৃত হয়ে সিনেমার জমিকে তৈরি করেছে। ফরাসী ছবির সর্বশ্রেষ্ঠ নমুনাগুলি দেখিনি, তব, ককতাে-র ‘লা বেল এ লা বেইত’ দেখে বােঝা যায় কতদুর গীতিধমী, চিত্রধর্মী, এমন কি নৃত্যধর্মী হতে পারে সিনেমা। ‘মসিয়ে ভ্যাস’-তে ক্লদ রেনােয়া-র ক্যামেরার কাজে (ইনিই বাঙলাদেশে এসে পিতৃব্য জা রেনােয়া-র সঙ্গে এবার ‘দি রিভার’ ছবি তুলেছেন) দেখা যায় যে ক্যামেরা শুধু, যন্ত্রদৃষ্টি নয়, ক্যামেরার পশ্চাতে যদি শিল্পীর মন থাকে তবে ক্যামেরা হয়ে উঠতে পারে দিব্যদৃষ্টি। আধুনিক ইতালীয় সিনেমার যেসব বিক্ষিপ্ত স্থিরচিত্র দেখতে পাই তার মধ্যেও এক কাব্যময় বাস্তববােধের আশ্চর্য পরিচয় মেলে।
সমাজের সঙ্গে দেশীয় সিনেমার যােগ যথেষ্ট নিবিড় না হওয়ার জন্য অন্যান্য শিল্পকলার সঙ্গে সম্পর্কও ভারতীয় সিনেমায় অনুপস্থিত। সিনেমা যেন স্বাভাবিক সর্ব-সংযুত শিল্পবিকাশের অঙ্গ নয়, যেন কাঁচি দিয়ে কেটে এনে জুড়ে দেওয়া। দেশের আর্টের খাপি জমিতে একটা অকারণ তালির মতাে।
কিন্তু এ প্রশ্নের মীমাংসা এইখানেই শেষ হবার নয়। যেহেতু যন্ত্রসভ্যতা এদেশে যথেষ্ট ব্যাপ্ত হয়নি, সেহেতু সিনেমা এদেশে অপরিণত থাকতে বাধ্য এমন সরল ব্যাখ্যায় পর্ণচ্ছেদ টানা চলে না। না হলে মেক্সিকো-দেশে ‘মারিয়া কাণ্ডেলারিয়া’-র মতাে ছবির ব্যাখ্যা কোথায়? সিনেমায় দেশের সঙ্গে যােগস্থাপনের প্রয়াস নেই, অন্ধভাবে বিদেশের অনুকরণের মধ্যেই তার অস্তিত্ব, এই হল সব চেয়ে জরুরী ও সব চেয়ে মারাত্মক কথা। কেবল হালের বােঘাই-মার্কা কমেডি নয়, গােটা ভারতীয় সিনেমাটাই অনেকখানি অভারতীয়।
যেহেতু চলচ্চিত্রের প্রথম যুগ থেকে এদেশে মার্কিন ছবিই বিশেষভাবে প্রচলিত তাই আমাদের সিনেমাকারদের ধ্যান-ধারণায় ফিল্ম বলতেই বােঝয় হলিউড। ইংলণ্ডে ভােলা মুষ্টিমেয় আধুনিক ছবি এই অন্ধবিশ্বাসকে মােটেই ঘােচায়নি। ফরাসী, ইতালীয়, জার্মান, রুশ ইত্যাদি নানা সিনেমাশিল্পের পরিচয় তাে প্রায় অজ্ঞাত বললেই হয় এদেশে। এর ফলে সিনেমায় বিভিন্ন দেশের নিজস্ব যে একটি রূপ ও রীতি অভিব্যক্ত হয়েছে তার সম্বন্ধেও কোনাে ধারণা এদেশে জন্মায়নি। শ্রেষ্ঠ ফরাসী ছবি যে একান্তভাবে ফরাসী, কিছুতেই তাকে মার্কিন বলে ভুল করা সম্ভব নয়; আবার প্রথম মহাযুদ্ধ থেকে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ পর্যন্ত জার্মান সিনেমার যে একটি অদ্বিতীয় রূপ আছে যা কেবলই জার্মান, আর কিছু নয় — এই জ্ঞান আমাদের সিনেমা মহলে এখনাে পৌঁছায়নি। তাই ভারতীয় সিনেমায় ভারতীয়তা নেই, বাংলা সিনেমায় বাঙালীয়ানা নেই। অথচ মেক্সিকো ও চেকোশ্লোভাকিয়ার মতাে ক্ষুদ্র দেশেও চলচ্চিত্রের একটা নিজস্ব দেশীয় চেহারা আছে। শুধু, আচারে-বিচারে নয়, স্টাইলে, রীতিতে; বলা যেতে পারে মনের ভঙ্গীতে।
বিভিন্ন দেশের মন আলাদা, মানুষ আলাদা, জীবন আলাদা; সিনেমায় যদি সেই জীবনের সুষ্ঠ প্রকাশ হয় তবেই তার আলাদা চেহারাটি ফুটে ওঠে। আমাদের সিনেমায় আমাদের দেশীয় জীবনের প্রকাশ নেই, তাই হলিউডের ছাঁচে আমাদের সিনেমার ছবি সরাসরি ঢালাই। আমাদের ছবির বর্ণনাভঙ্গী হলিউডের, কথার, সঙ্গীতের প্রয়ােগ হলিউডী, হাস্যরস হলিউডের গ্যাগ-এর ধাঁচে বাঁধা। দর্শকের প্রতি আবেদনের ঢঙ পর্যন্ত অনেকখানি মার্কিনী। মনে রাখতে হবে যে শ্রেষ্ঠ মার্কিন ছবি বলতে বােঝায় গ্রিফিথ, চ্যাপলিন, মুষ্টিমেয় কয়েকজন পরিচালক, ও ওয়েস্টার্ন এর সমদ্ধ ঐতিহ্য। কিন্তু এর বাইরে যে হলিউড সেটাই আজকাল বাজার চলতি এবং তারই গৎ-এ আমাদের সিনেমাকারদের চিন্তা বাঁধা। মার্কিন মুলক হচ্ছে পথিবীর বৃহত্তম সিনেমাকেন্দ্র, কিন্তু শ্রেষ্ঠতম নয়। বৃহত্তম বলেই সেখানে ফ্যাক্টরীর বাঁধা নিয়মে ছকে-ফেলা, ছাঁচে-ঢালা অসংখ্য ছবি প্রতি বৎসর উদ্গীরণ করতে হয়। আনন্দ পরিবেশনের নির্দিষ্ট নিয়মে বাঁধতে গিয়ে সেখানে আনন্দই বাঁধা পড়ে গেছে। ফলে হলিউডের শতকরা নিরানব্বইখানি ছবিতে প্রাণের কোনাে সাড়া নেই, কেবল আঙ্গিকের নানা মারপ্যাঁচ, সাবজেক্টিভ ক্যামেরা আর ডীপ ফোকাসের কায়দাতেই সিনেমার পরিসমাপ্তি।
তারকা-প্রথার প্রকোপে হলিউডে কোনাে চরিত্রের আর কোনাে নিজস্বতা নেই, তারকার চরিত্রের ফ্রেমেই গল্পের চরিত্রের মজবুত বাঁধাই। ক্লার্ক গেল, ছবিতে জেমস বা চার্লস বা জন যাই হবার চেষ্টা করুন, পর্দায় দেখলেই আপনার মনে হবে এই ক্লার্ক গেল, এল, জেমস বা চার্লস বা জন এল মনে হবে না। তারকার ঠাটঠমকের আড়ালে চাপা পড়েছে সত্যিকার জীবনের শক্তিশালী, অপ্রত্যাশিত সৌন্দর্য। বিজ্ঞাপনের মােহে ফেলে তারকার মুদ্রাদোষগুলি পর্যন্ত লােকের কাছে প্রিয় করে তােলার এক বিচিত্র বিদ্যা হলিউড আয়ত্ত করেছে। বাঙলাদেশেও তাই। আজ পর্যন্ত কোন বাংলা ছবিতে জহর গাঙ্গুলীকে অভিনয় করতে দেখিনি মনে করতে পারি না, অথচ তাকে নতুন ভূমিকায় দেখলেও মনে হয় – কি ক্লান্তিকর। অন্তহীন পুনরাবৃত্তিতে অভিনয়ের সমস্ত রস শুকিয়ে গেছে। তারকার জন্য চরিত্র; তারকামণ্ডলীর জন্য গল্প। অর্থাৎ অমুকের এবং অমুকের বিশেষ বিশেষ মুদ্রাদোষ প্রয়ােগের জন্য বিশেষ বিশেষ ব্যবস্থা। অমুক অভিনেতা বড়লােক হলে তাঁর পাইপ খাবার কায়দাটা মানায় না, কমল মিত্রকে রাগীবাবু, রাধামােহনকে দেশােদ্ধারী এবং জহর গাঙ্গুলীকে ভাঁড় না বানালে বাংলা ছবির রেলগাড়ী লাইনচ্যুত হয়ে যায়। তার পর গেরস্তের বৌ হলে মলিনা, বদমেজাজী ঝি বা শাশুড়ী হলে প্রভা, মাসি পিসি হলে সুপ্রভা আর বৌ হলে রেবা তাে আছেনই। এই তাে গেল ভালাে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের ব্যাপার। সুমিত্রা বা মীরা মিশ্র আর সরকার ইত্যাদিদের বলা যেতে পারে ফেমাস এনিমিটিজ।
এর পরেও আমাদের ভারতীয় পরিচালকেরা আত্মপ্রশংসার সুযােগ পেলেই বলেন ‘আমার ঐ সিকোয়েন্সটা কিন্তু হলিউডের ছবির চেয়ে কিছু কম নয়।’ বলতে গেলে আজকের মাদ্রাজ-বােম্বাইয়ের ছবি মেট্রোগােল্ডউইন মেয়ারের নাচগানের চেয়ে কম কিসে? নিখুঁত ফর্মােয় হলিউডের কার্বন কপি করতে পেরেছে আমাদের দেশ এটা হয়তাে অনেকের কাছে গৌরবের বিষয়। কিন্তু শিক্ষিত লােকের মনে হতে পারে যে জেমিনীর ‘নিশান’ ও আমাদের ‘অভিমান’-এ হলিউড অনেকখানি আছে, আমাদের দেশ নেই। বাঙলাদেশের মাঠঘাট বাংলা ছবি থেকে নির্বাসিত। আমাদের চলচ্চিত্রে স্টুডিওর কাঁচা রঙের গন্ধের গুমােট। দেশজোড়া খােলা হাওয়া আর নীল আকাশ সেখান থেকে অনুপস্থিত। হলিউডের মতােই আমাদের ছবিতে চওড়া সিড়ি, মােটা থাম আর ঢালাও সােফাসেটির একটা মায়াজগৎ সৃষ্টি করবার চেষ্টা চলছে যার মধ্যে লােক সত্যকার জীবন থেকে দুদণ্ড পালিয়ে বাঁচতে পারে। অবশ্য সব আর্টেই জীবন থেকে খানিকটা সরে-আসা আছে, কেননা আর্ট জীবন নয়; কিন্তু সেই বাইরের সরে-আসার মধ্য দিয়ে অন্তরে একটা কাছে-আসাই সংঘটিত হয়। জীবনের অবান্তরতা-বহুল বাহ্য চেহারাটা সরে গিয়ে তার একটা মৌলিক, প্রচ্ছন্ন রূপ বেরিয়ে আসে। বাঙলার নদী, খাল-বিল, চর, ক্ষেত, রেললাইন, মানুষ আর মানুষের জীবনযাত্রাকে নিয়ে যদি সিনেমা হয় তবে তাতে কি লােকের মন মতি পাবে না? নিশ্চয়ই পাবে। সিনেমা লােকায়ত শিল্প, লােকের জীবনকে আশ্রয় করলে লােকের মনে সে আরাে বেশি আনন্দ সঞ্চার করতে পারবে। প্রাত্যহিক, সত্যকার জীবনের যে অনুভূতির মধ্য দিয়ে বাংলার কথাসাহিত্য গড়ে উঠেছে, গুণী সাহিত্যিকের সাহচর্য সত্ত্বেও তার স্পর্শ বাংলা ছবিতে লাগছে না। ‘চণ্ডীদাস’-এ বাঙলীয়ানার যে সুরটুকু ছিল তাও আজ চাপা পড়ে গেছে বক্স-অফিসের নকলিয়ানার তলায়। এখনকার গল্পে চাই শুধু, এক দেশােদ্ধারী পুত্র, একটি অকারণ তরুণী, একটি জড়ভরত পিসতুতাে ভাই, একটি জমিদার বাবা, একটি বিশাল সিড়ি, দু’টি বিলিতি বৈঠকখানা, পর্দায়-আঁকা মেঘের মধ্যে বসানাে একটি কুঁড়েঘর, আর খ্যাংরাকাঠিতে বাঁধা কিছু, লতাপাতা। হাস্যরসে হলিউডের প্রকোপের একটি বিচিত্র নমুনা দিই। ‘চন্দ্রশেখর’ ছবিতে প্রতাপের অনুপস্থিতিতে তার চেয়ারে বসে চাকর যখন তার উদ্দেশে গালি পাড়তে শুরু করে তখন দেখা যায় প্রতাপ চুপি চুপি পিছন থেকে এসে উপস্থিত হয়ে তার কথার উত্তর দিচ্ছে। চাকর প্রথমে খেয়াল করে না, উত্তর প্রত্যুত্তর চালাতে থাকে যেন আপন মনেই, তারপর হঠাৎ তার খেয়াল হয়, চেয়ার থেকে লাফিয়ে ওঠে। এটা হলিউডের একটা আদ্যিকালের পুরােনাে কায়দা, যাকে ওরা বলে ‘গ্যাগ’। সমালােচকদের মতে এই গ্যাগগুলিতেই হলিউডকে নিতান্ত খেলাে করে দিয়েছে, আর আমাদের পরিচালকেরা যখন খেয়ালমাফিক বাছাই করে যে কোনাে মার্কিন ছবি দেখতে যান তখন মনে হয় অন্ধকারে বসেই তারা যেন খাতা পেনসিলে নােট করে নেন প্রত্যেকটি গ্যাগ-এর কায়দা। অমুক কায়দাটা কোথায় লাগানাে যায়, অমুক শটটা চুরি করে চালানাে যায় কিনা, অমুক ‘মিউজিক’টা মেরে দিলেই ঝড়ের সিনটা মিটে যায় এমন সব চিন্তায় তাদের মস্তিষ্ক সচল থাকে। হলিউডের বাইরের ছবি দেখতে তাদের আগ্রহ নেই কেননা সেখানে এজাতীয় নােটবই প্রায় অচল। হলিউডের যে ছাঁচে-ঢালাই করার দিক, যেটা তার সব চেয়ে নিকৃষ্ট দিক, সেদিকেই আমাদের পরিচালকদের নেকনজর। দেশী ছবিতে আবহ-সঙ্গীতের মধ্যে তার পরিচয় সবচেয়ে স্পষ্ট। চরম অস্বাভাবিকতার মধ্যে আবহ-সঙ্গীতকে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত জিইয়ে রাখা হয়। আর সে সঙ্গীত বাজানাে হয় বিদেশী যন্ত্রে, হার্মনি-র সাহায্যে, দেশী সরের বিদেশী অর্কেস্ট্রায়। ভারতীয় সঙ্গীতকে হলিউডী ফিল্ম-সঙ্গীতে পরিণত করার এই যে হাস্যকর ও একান্ত করণ প্রয়াস এর মূলেও ভারতীয়তার অভাব, অনুকরণের প্রবৃত্তি।
অথচ অনুকরণ না হলেও বিদেশীরীতির অনুসরণ, বিশেষত অনেকখানি অনুধাবনের কাজ আমাদের দেশে সিনেমা-সৃষ্টির অঙ্গ হতে বাধ্য। কিন্তু হলিউডের অনুসরণ আমাদের পক্ষে একাধিক কারণে মারাত্মক। প্রথম হচ্ছে এই যে হলিউডের ফিল্ম-শিল্প মার্কিন মােটর-শিল্পের মতােই বৃহৎ ও যন্ত্রগত, নানা আধুনিক সুযােগ-সুবিধায় সমৃদ্ধ। সারা পৃথিবীই তার ক্ষেত্র। আমাদের চলচ্চিত্রের বাজার, যন্ত্রগত সুবিধাদি, ছবি তােলার পজি হলিউডের সিকির সিকিও নয়। বিরাট দশমহলা প্রাসাদে স্থাপত্যের যে ঢঙ গ্রাহ্য, চার কাঠা জমির একতলা বাড়িতে সেই ঢঙ মানায় না। অথচ চার কাঠা জমির উপর একতলা বাড়িও সুন্দর হতে কোনাে বাধা নেই। হলিউডের নকল করতে গিয়ে বাংলা ছবি নিজের খেই হারিয়ে ফেলেছে। হলিউডের মতােই এদেশেও ‘আউটডাের’ বলতে বােঝায় শাদা মেঘ আর যাকে বলে ‘সিনারী’। ইতালীয় ছবির মতাে জুতাে-পালিশওয়ালা ছেলের বা সাধারণ চাষীর দৈনিক ইতিহাস যেন আমাদের জন্য নয়, বিরাট শ্রমশিল্পের দেশ আমেরিকার রীতিনীতিই আমাদের কৃষিপ্রধান দেশের পক্ষে যথাযথ।
বিদেশের থেকে শিখতে গেলে এদেশের সিনেমাকারদের তাকানাে উচিত ফরাসী দেশের দিকে, এমন কি মেক্সিকো বা চেকোস্লোভাকিয়ার দিকে, হলিউডের দিকে নয়। এদেশের বহু, পরিচালক টাকা-পয়সার ও যন্ত্রপাতির কমতির নজীর দেখিয়ে নানান সাফাই গান। কিন্তু ‘ওপেন সিটি’, ‘পাইসান’ ইত্যাদির স্রষ্টা রসেলিনী অনেক সময় শীতকালে নিজের কোট বাঁধা দিয়ে এক রােল ফিল্ম কিনেছেন (চোরাবাজারে), হােটেলের পিছনের দরজা দিয়ে পালিয়েছেন পাওনাদারের তাড়ায়, রাস্তাঘাটে ঘরে ঘরে বহুদিনের অকথ্য কষ্ট সহ্য করে তাঁর এক একটি ছবি তুলেছেন। ডি সিকা বা লাতুয়াদা বা লকিনাে ভিসকোন্তি-র ইতিহাসও বােধ করি এই রকমই। অথচ শােনা যায় তাঁদের ছবিতে যুদ্ধােত্তর ইতালীর জীবন মূর্ত হয়ে আমাদের সাধের হলিউডকে স্তম্ভিত করেছে, ডলার অর্জন করেছে প্রচুর পরিমাণে। অর্থাৎ ভালাে হওয়া সত্ত্বেও তাঁদের ছবি বক্স-অফিসের অভিনন্দন লাভ করেছে। রাশিয়ার দারুণ দুদিনে, যুদ্ধ, মহামারী ও দুর্ভিক্ষের মধ্যে সাবেকী সামান্য যন্ত্রপাতি নিয়ে আইজেনস্টাইন তাঁর প্রথম ছবি তুলেছিলেন। ১৯২৫-এ নির্মিত সেই ছবি ‘ব্যাটলশিপ পােটেমকিন’ এখনাে পথিবীর সর্বত্র সিনেমাশিক্ষাথীদের দেখানাে হয়। রাশিয়ার জনসাধারণই এই ছবির নায়ক, তাদেরই জীবনের এক বিশাল রূপ এই ছবিতে প্রতিভাত হয়েছে।
ভারতীয় সিনেমাকারেরা যদি হলিউড-এর নকল থেকে মুখ ফিরিয়ে নিজের দেশকে যথার্থভাবে প্রকাশ করতে চেষ্টিত না হন তবে বিদেশী বিতাড়ন করে, আইন বানিয়ে, এদেশেই কাঁচা ফিল্ম উৎপাদন করেও তাঁরা ভারতীয় ছবিকে আন্তর্জাতিক স্তরে উন্নীত করতে পারবেন না। হিন্দীতে অনুদিত বিদেশী ছবির হাত থেকে তাহলে দেশী দর্শককে কিছুতেই ফেরানাে যাবে না, বােম্বাই-এর গণিকাবৃত্তি থেকে মুক্ত করা যাবে না বাংলা ছবিকে। সচেতনভাবে হলিউড-এর নাগপাশ থেকে মুক্ত হয়ে যেদিন এদেশের ছবি নিজস্ব ভারতীয় বক্তব্য ও স্টাইলকে খুঁজে পাবে সেদিনই সত্যকার সিনেমার সুত্রপাত হবে ভারতবর্ষে।
সেন্সরের কাঁচি
ছবি; জিপসি মেয়ে। ভাষা: বাংলা। প্রযােজক : নিউ ইন্ডিয়া থিয়েটার্স।
সেন্সরের নির্দেশ : ১নং রিল : প্রথম দৃশ্যে নায়ক যেখানে মাতাল অবস্থায় একটি ল্যাম্পপােস্টকে আলিঙ্গন করে সিগারেট খেতে অনুরােধ করছে, সেই অংশটক বাদ দিন।
২ ও ৩নং রিল : ছবির গােড়ার দিকে অত্যধিক মাতলামাের দৃশ্যগুলি সংক্ষিপ্ত করুন।
৬নং রিল : প্রেমের দৃশ্যটিকে সংক্ষিপ্ত করন এবং যেখানে নায়ক ও নায়িকা মাটিতে শায়িত এবং নায়িকা নায়কের দেহের উপরে এলায়িত অবস্থায় রয়েছে সেই অংশটুকু সম্পূর্ণ বাদ দিন।
৮নং রিল : ইঙ্গিতপর্ণ জিপসি-নাচগুলিকে যথাসম্ভব ছাঁটাই করুন।
৯নং রিল : জিপসিদের আড্ডায় জিপসি মেয়েটির ব্যভিচারের ইঙ্গিতপর্ণ দৃশ্যটি বাদ দিন।
১১ ও ১৪নং রিল : ছবিতে যেখানেই কলকাতার পুলিশ অফিসার ও পুলিশ দেখানাে হয়েছে সেখানে আসল পুলিশের বদলে নকল পুলিশ দিয়ে অভিনয় করান এবং পুলিশের কণ্ঠস্বরও ‘ডাব’ করুন।
ছবি : সাউথ সি সিনার। ভাষা : ইংরিজি। প্রযােজক : উনিভার্সাল।
সেন্সরের নির্দেশ : (ক) যেখানে নায়িকা খেলাচ্ছলে জল ছিটোতে ছিটোতে তার স্কার্টটাকে একটু বেশি তুলে ফেলেছে, সেই অংশটুকু বাদ দিন।
(খ) যে দশ্যে একজন ‘ক্যাফে’র মালিক একটি জাভানী চাকরাণীকে চড় মারছে বলে দেখানাে হয়েছে সেটিকে বাদ দিন।
ছবি : তারা। ভাষা : হিল। প্রযােজক : আর. ডি. পরীঞ্জা।
সেন্সরের নির্দেশ : ভিখিরী মেয়ের গাওয়া প্রথম গানের প্রথম চরণটি, যাতে বলা হয়েছে ‘কলকাতা থেকে ধুতি-পরা বাঙালীবাবুরা এসেছে পান চিবােতে চিবােতে, পকেট তাদের খালি’, বাদ দিন।
ছবি : রেড সুজ। ভাষা : ইংরিজি। প্রযােজক : ঈগল-লায়ন।
সেন্সরের নির্দেশ : ১২নং রিল : ঘােড়াগাড়ির দৃশ্যটি, যেখানে জুলিয়ান ক্লাস্টার ও ভিকি পেজ এক সঙ্গে শুয়ে আছে, সংক্ষিপ্ত করুন। আর যেখানে তাদের আলিঙ্গনাবদ্ধ দেখা যায় সেট বাদ দিন।
১৬নং রিল : জুলিয়ান যে দৃশ্যে পেজের বুকের উপর হাত রেখেছে সেই দৃশ্যটি বাদ দিন।
ছবি : খিড়কী। ভাষা : হিন্দী। প্রযােজক : অরবিন্দ-আনন্দ।
সেন্সরের নির্দেশ : গান্ধীনৃত্য এবং ‘জয় বােলাে মহাত্মা গান্ধী কো’ গানটি বাদ দিন।
সিনেমা সম্পর্কে আরও জানতে পড়ুন
১) সাড়া জাগানো তুর্কী ওয়েব সিরিজ “দিরিলিস আরতুগ্রুল” কেন একাধিক রাষ্ট্রে বাজেয়াপ্ত করা হল?
২) ক্যাপ্টেন জ্যাক স্প্যারো এক রহস্যময় সামুদ্রিক জলদস্যুর ব্যক্তিগত জীবনের কাহিনী
৩) সিনেমার চিত্রনাট্য – ইতিহাস, বিবর্তন ও ক্রমবিকাশ