লিখেছেনঃ মুহাম্মাদ আব্দুল আলিম
মোপলারা ছিল মালাবারের এক মুসলমান সম্প্রদায়। মোপলাদের সব থেকে বড় দোষ ছিল তারা বরাবরই কট্টর ব্রিটিশ বিরোধী। এই মোপলারা ছোট বড় সব মিলিয়ে অসংখ্য বিদ্রোহ ও বিপ্লবের সৃষ্টি করেছে। ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের পর মোট পাঁচটি বিদ্রোহ ভয়ঙ্কর রুপ ধারণ করেছিল। সেই বিদ্রোহগুলি হয়েছিল যথাক্রমে ১৮৭৩ সালে, ১৮৮৫ সালে, ১৮৯৪ সালে, ১৮৯৬ সালে এবং ১৯২১ সালে।
এই মোপলা বিদ্রোহ এর বিপ্লবীরা ছিলেন প্রত্যেকেই মুসলমান। আর যেহেতু সেখানকার রাজা-মহারাজা-জমিদার ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সহযোগিতা ও সমর্থন করে আসছিলেন সেজন্য বিপ্লবী মোপলা বাহিনীরা বুর্যোয়াশ্রেণী হিন্দুদের শত্রু বলে মনে করত। সমাজের নিম্নশ্রেণীর উপেক্ষিত ও শোষিত অমুসলমানরা প্রতিবারই মোপলা বিপ্লবীদের দলে যোগদান করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিল কিন্তু সমাজের ধনী মধ্যবিত্তদের কুকৌশলে সেইসব অমুসলমানদের বোঝানো হয়েছিল যে এই মোপলা বিদ্রোহ আসলে হিন্দু-মুসলমানের সাম্প্রদায়িক লড়াই। ফলে বহু অমুসলমান এই বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করার আন্তরিক ইচ্ছা থাকলেও নেতৃস্থানীয় ধনী মধ্যবিত্ত ইংরেজদের পদলেহীদের অপপ্রচারে তারা অংশগ্রহণ করতে পারেনি। মোপলা বাহিনীরা মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলন ও মাওলানা মুহাম্মাদ আলীর খেলাফত আন্দোলনে রক্ত দিয়ে সহযোগিতা করেছিল। এই মোপলাদের প্রধান শত্রু ছিল পুলিশ, সামরিক বাহিনী, জমিদার ও মহাজন শ্রেণীর লোকেরা। ঐতিহাসিক V.C Smith মোপলা অভ্যুত্থানের সাম্প্রদায়িক চরিত্রের ঐতিহাসিক সত্যকে তুলে ধরেছেন। তিনি লিখেছেন, মোপলারা সেই পুলিশ ও সামরিক বাহিনীকে, সেই জমিদার ও মহাজনকে আক্রমন করেছিলেন যাঁরা দীর্ঘদীন তাঁদের পদানত রেখে পিষ্ট রেখেছিলেন। (They attacked the police and the military who were there to keep them oppressed, they attacked their landlords and money lenders, they attacked every one in sight. For a short time, they were in a fiery possession of a considerable area. The mophlahs were bitter, bitterly anti-hindu, bitterely anti-British, butterly against the world theat gave only missing. The ardour was ardour of an oppressed class rising against its enemies, the ardour of religious fanatism destroying sin and establishing a kingdom of god.” (Modern Islam in India, W.C. Smith)
এই প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক সুরজিৎ দাশগুপ্ত লিখেছেন,
“তারা (মোপলারা) দেখেছিল যে ইংরেজদের বিরুদ্ধে তাদের সংগ্রাম হিন্দু ধর্মাবলম্বী প্রতিবেশীরা তাদের সমর্থন করেনি, সাহায্য দেয়নি, এমনকি নিরপেক্ষও থাকেনি, বরং সর্বপ্রকার ইংরেজদেরই সাহায্য করেছে এবং পুলিশ ও সৈন্যবাহিনী তাদের দমনে এগিয়ে তারা হিন্দু ধর্মাবলম্বী। স্বাভাবিক কারণেই অশিক্ষিত দরিদ্র নিপীড়িত মোপলারা এক করে ফেলেছিল ইংরেজ ও হিন্দুকে।” (ভারতবর্ষ ও ইসলাম, পৃষ্ঠা-২৪৫/২৪৬)
ইংরেজ সরকার মোপলাদেরকে কোন সভা-সমিতি ও সম্মেলন করতে দিত না, কারণ ইংরেজ সরকার তা মোপলাদের জন্য কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ঘোষনা করেছিল । তবুও ইংরেজ সরকার মোপলাদের বিদ্রোহ দমন করতে সমর্থ হয়নি। ফলস্বরুপ মোপলা বাহিনীরা ১৯২১ খ্রীষ্ঠাব্দে মালাবারকে স্বাধীন বলে ঘোষনা করে এবং স্বাধীনতার পতাকা উড়িয়ে দেন। ফলে ইংরেজ সৈন্যদের সঙ্গে মুসলমান মোপলা বাহিনীদের ভয়াবহ সংগ্রাম শুরু হয়। বিশিষ্ট ঐতিহাসিক গোলাম আহমদ মোর্তাজা লিখেছেন,
“একদিকে শোষক ও শাসক ইংরেজ ও তাদের ধামাধরা স্তাবকের দল, অন্য দিকে শাসিত শোষিত মৃত্যু পথযাত্রী বিপ্লবী দল। ইংরেজ সৈন্যদের হাতে হাতে ওয়ালুভানাদ ও এরনাদ নামক দুটি স্থান ছিনিয়ে নেওয়া হলে যুদ্ধ আরো জোরদার হয়।” (চেপে রাখা ইতিহাস, পৃষ্ঠা-২৪৭)
এই সময় মালাবার এলাকার বাইরে চিঠিপত্র টেলিগ্রাম ইত্যাদির যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধ রাখা হয়। আর বাইরে থেকে যেসব চিঠি পত্র আসত তা পরীক্ষা করে বিলি করা হত। সামান্য সন্দেহযুক্ত হলে তা নষ্ট করে দেওয়া হোত। তবে সরকারী খবরাখবর আদান প্রদানে কোন বাধাবিপত্তি ছিল না বরং তা অব্যাহত ছিল। ইংরেজ পদলেহী কিছু ভারতীয় নেতাদের মোপলা বাহিনীরা হত্যা করে। চালাক ব্রিটিশ বাহিনী সেটাকে ‘মুসলমান কর্তৃক হিন্দু আক্রান্ত’ বলে অপপ্রচার করে। স্বভাবতই মোপলাদের হাতে নিহত ভারতীয় নেতারা হিন্দু ছিল তা না হলে ব্রিটিশ সরকার এটাকে ‘মুসলমান কর্তৃক হিন্দু আক্রান্ত’ বলে প্রচার করে সাফল্য লাভ করত না।
মোপলা অভ্যুত্থান নিয়ে পরস্পরবিরোধী মতামত ঐতিহাসিকরা ব্যাক্ত করেছেন। আমেদাবাদের কংগ্রেস অধিবেশনে যে বিবরণ প্রকাশিত হয় তাতে বলা হয়েছে The Moplah disturbance was not due to the Non-Co operation or the khilafat Movement. এই বিবরণ অনুযায়ী যে তথ্য পাওয়া যায় তাতে জানা যায় অসহযোগ ও খিলাফত আন্দোলনের নেতাদের দাঙ্গাহাঙ্গামা ধরার ৬ মাস পূর্ব থেকে ওখানে যেতে দেওয়া হয়নি। মহাত্মা গান্ধীকে যদি মালাবার উপকুলে যেতে দেওয়া হত এবং মাওলানা ইয়াকুব মত অসহযোগ আন্দোলনের নেতাদের সহায়তা যদি মাদ্রাস সরকার নিতেন তাহলে এই অপ্রিয় দাঙ্গাহাঙ্গামা এখানে ঘটত না।” (উপমহাদেশের মুসলমান, খণ্ড-১, পৃষ্ঠা-১৫, এম মনিরুজ্জামান)
ঐতিহাসিক গোলাম আহমাদ মোর্তাজা লিখেছেন,
“ইংরেজ এ সমস্ত কুকীর্তি সরকারীভাবে গোপন রাখার চেষ্টা করা হলেও কিন্তু ভারতীয় নেতৃমহলে পৌঁছে যায়। সঙ্গে সঙ্গে গান্ধিজী, মাওলানা মহাম্মদ আলী ও মাওলানা শাওকত আলী মোপলা হত্যা এবং নকল সাম্প্রদায়িকতার খেলা বন্ধ করতে মালাবারে প্রবেশ করতে উদ্যত হলে উদ্ধত ইংরেজ তাদের মালাবারে ঢুকতে না দিয়ে ফিরিয়ে দেয় এবং জানিয়ে দেওয়া হয়, কাউকে এখন মালাবারে ঢুকতে না দেওয়ার আইন চালু রয়েছে ।” (চেপে রাখা ইতিহাস, পৃষ্ঠা-২৪৭)
ঐতিহাসিক গোলাম আহমদ মোর্তাজা মোপলা বিদ্রোহ এর বাহিনীদের লোমহর্ষক ইতিহাস বর্ণনা করতে গিয়ে লিখেছেন,
“এইবার বৃটিশ সরকার মালাবারে হাজার হাজার সৈন্য, নানা ধরণের ট্যঙ্ক, কামান, বোমা, কতকগুলো গানবোট এবং রণতরী নিয়ে আসে । তার আগে ইংরেজী কায়দায় অপপ্রচার হয়েই ছিল । সুতরাং হিন্দুরা বিপ্লবী মুসলমানদের তাদের শত্রু মনে করে লড়াইয়ে নেমে পড়েন। একদিকে ইংরেজ শক্তি তো আছেই, অন্য দিকে বাড়িতে পল্লীতে হিন্দু-মুসলমান ভাই ভাই এ লড়াই এক বিভৎস রুপ নিল। যুদ্ধ চলল এক মাস। তারপর একদিন ইংরেজরা আকাশ হতে গোলা বর্ষন, রণতরী হতে শেল বর্ষন, ট্যাঙ্ক ও কামান হতে গোলা বর্ষন করে মোপলাদের ঘরবাড়ি, দোকানপাট, ভস্মস্তুপে পরিণত করে। যুদ্ধ শেষে মোপলা বাহিনীর দশ হাজার পুরুষ-নারীর মৃতদেহ পাওয়া যায়। আর জীবন্ত যাদের পাওয়া যায় তাদের বন্দী করে ‘বিচারের’ জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। বিচারের পূর্বেই অনেক পুরুষ ও শিশুকে হত্যা করে এবং নারীদের উপর লজ্জাকর পাপাচার করা হয়। বাকী বেঁচে থাকা আসামীদের বিচার-ফল এই দাঁড়াই – এক হাজার জনের ফাঁসী, দুই হাজার জনের দ্বীপান্তর সেই আন্দামানে শ্রমসহ নির্বাসন আর আট হাজার লোকের পাঁচ হতে দশ বছর সশ্রম কারাদণ্ড । শাস্তির কি সুষম পরিবেশ।” (ঐ গ্রন্থ, পৃষ্ঠা-২৪৭/২৪৮)
তিনি আরও লিখেছেন,
“এই অত্যাচারের ইতিহাসে আর একটি মর্মন্তুদ ঘটনা ঘটে। জীবন্ত বিপ্লবীদের মধ্যে যাঁরা শিক্ষিত ও নেতৃস্থানীয় ছিলেন তাঁদের মধ্যে বাছাই করা আশি জনকে ট্রেনের একটা ছোট্ট কামরায় দরজা জানালা বন্ধ করে কালিকটে নিয়ে যাওয়া হয়। পথে তৃষ্ণায় কাতর হয়ে বন্দী বিপ্লবীরা জলের জন্য চিৎকার করেন এবং জলভিক্ষা চান। কিন্তু সে আর্তনাদে নিষ্ঠুরদের প্রাণ বিগলিত হয়নি। যখন ট্রেন কালিকটে পৌঁছালো তখন দেখা গেল অধিকাংশই শহীদ হয়েছেন। আরও দেখা গেল, একজন অপর জনের জিভ চুষে পিপাসা মেটাবার চেষ্টা করছেন। কিন্তু সেই শুষ্ক রসনা ততটুকু রস দিতে পারেনি যা তাঁদের বাঁচাতে পারতো। যাইহোক, এতবড় একটা কাণ্ড ঘটবার পরও তখনকার ভারতীয় নেতারা সবাই যেন চেপে গেলেন ব্যাপারটা। মুসলমানদের মনে বেদনা সৃষ্টির অন্যতম একটা কারণ বলা যায়। খেলাফত কমিটির নেতা মাওলানা মহাম্মাদ আলী এটা নিয়ে হৈ চৈ করতে গিয়ে বাধা পেয়ে খুব আঘাত পান এবং কংগ্রেসের উপর আস্থা হারান । (ঐ গ্রন্থ, পৃষ্ঠা-২৪৮)
যাইহোক ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে মুসলমান মোপলা বাহিনীদের অবদান ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই মোপলা বাহিনীদের আন্দোলনের দ্বারা অনুপ্রাণীত হয়ে পরবর্তীকালে বিপ্লবীরা ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় তাঁর ‘Indian Struggle for Freedom’ গ্রন্থে এবং রমেশন্দ্র মজুমদার তাঁর ‘Struggle for Freedom’ গ্রন্থের জন্য Indian Annual Register’ থেকে তথ্য গ্রহণ করেছেন সে তথ্য থেকে জানা যায় গান্ধিজী এবং আলী ভ্রাতাদের অনুপ্রেরণায় মোপলারা উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন এবং তাঁদের অভ্যুত্থানের পিছনে অসহযোগ ও খিলাফত আন্দোলনের প্রভাব ছিল ।