লিখেছেনঃ মুহাম্মাদ আব্দুল আলিম
ইতিহাস ঘেঁটে দেখতে গেলে মুসলিম শাসকদের থেকে হিন্দু রাজারা বেশী মন্দির ধ্বংস করেছিলেন। অনেক হিন্দু রাজা জৈন ও বৌদ্ধদের নির্যাতন করেছেন এবং তাঁদের মন্দির ধুলিস্যাৎ করেছেন। কাশ্মীরের রাজা হর্ষ বহু গুণের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও চার হাজার বৌদ্ধ পুণ্যস্থান ধ্বংস করার পর গর্ব করেছিলেন। কাশ্মীরের ইতিহাসকার কলহনের পিতা চম্পক ছিলেন হর্ষের মন্ত্রী। কলহন তাঁর ‘রাজতরঙ্গিনী’ গ্রন্থে লিখেছেন, গ্রাম নগর বা শহরে এমন একটা মন্দির অবশিষ্ট ছিলনা যার বিগ্রহ ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি তরস্ক হিন্দু রাজা হর্ষ দ্বারা। তবে টাকার জন্যই যে রাজা হর্ষ মন্দির ধ্বংস করেছিলেন তা নয়, বিগ্রহ উঠিয়ে নিয়ে যেতেন। এই ধ্বংসাত্মক কাজ পরিচালনা করার জন্য বিশেষ কর্মচারি তিনি নিয়োগ করেছিলেন। পদটার নাম দিয়েছিলেন দেবোৎপাটনায়ক। তাঁরা বিগ্রহ নিয়ে যেসব জঘন্য কাজ করতেন তা কোন মুসলমান শাসক বা রাজকর্মচারীরাও ভাবতে পারেন নি। ১৫০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে লিখিত পতঞ্জলির ‘মহাভাষ্য’ এবং ৪০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে লিখিত পাণিনির ব্যাকরণ থেকে জানা যায় যে, মৌর্যরা তাঁদের অর্থভাণ্ডার পূরণের জন্য মূল্যবান দেবদেবীর মূর্তি গলিয়ে ফেলতেন। কলহনের ‘রাজতরঙ্গিনী থেকে জানা যায়, একাদশ শতকে কাশ্মীরের হিন্দুরাজা হর্ষ (১০৮৯ – ১১০১) সম্পদের লোভে বহু মন্দির ও দেবায়তন ধ্বংস করে বিখ্যাত হয়ে আছেন। রাজা হর্ষ তাঁর রাজ্যভাণ্ডার পূর্ণ করার জন্য নিজের সাম্রাজ্যের চারটি মন্দির বাদে সব মন্দির লুণ্ঠন করেন। কলহনের লেখা থেকে আরও জানা যায় হিন্দুরাজা হর্ষ কোন গ্রাম, শহর বা নগরে এমন একটি মন্দির অবশিষ্ট ছিল না যার মূর্তিকে তিনি ধ্বংস করেন নি।
ভীম কেশবের মন্দির বিধ্বস্ত করা দিয়ে এই প্রক্রিয়ার সূত্রপাত হয়েছিল। যখন এতেও রাজকোষ পূর্ণ হল না, হর্ষের আদেশে দেব প্রতিমাও লুণ্ঠিত হতে লাগল। দ্বাদশ শতকে পারমার রাজারা গুজরাটে সম্পদের লোভে দাভয় ও ক্যাম্বে অঞ্চলের বহু জৈন মন্দির লুণ্ঠন করেন।
হর্ষ একা নন, ধর্মস্থান লুট এবং ধ্বংস করার জন্য হিন্দু রাজাদের মধ্যে দায়ী আরও কেউ কেউ। রাজপুত পারমার বংশের শাসক সুভাতবর্মন গুজরাট আক্রমনকালে দাভোই এবং ক্যাম্বে-র বহু জৈন মন্দির লুট করেছেন। শৈবদের হাতেও বহু বৌদ্ধ ও জৈন মন্দিরের ক্ষতি হয় বা সেগুলি পরে শিব মন্দিরে রূপান্তরিত হয়েছে। ১০ ও ১১ শতকের চোল বংশের শৈব সম্রাট প্রথম রাজারাজা চোল এবং তাঁর পৌত্র রাজাধিরাজ চোল-এর বিরুদ্ধেও ইতিহাসে অভিযোগ চালুক্য রাজ্যের জৈন মন্দির লুণ্ঠন ও ধ্বংসের। ৬ শতকের আর-এক শৈব শাসক মিহিরকুল (খ্রীঃ ৫০২ – ৫৪২) বৌদ্ধ বিহার ও স্তুপ ধ্বংস এবং বৌদ্ধ ভিক্ষুদের হত্যা করার প্রতিজ্ঞা করেছিলেন। তিনি ১৬০০টি বৌদ্ধমঠ ধ্বংস করেন এবং হাজার হাজার বৌদ্ধ সন্যাসী ও তাদের গৃহস্থ অনুগামীদের হত্যা করেন। রাজা ক্ষেমগুপ্ত বোদ্ধদের নিগ্রহ করেছিলেন এবং বহু বৌদ্ধ মঠ ও মূর্তি ধ্বংস করেছিলেন। ক্ষেমগুপ্ত শ্রীনগরে বৌদ্ধমন্দির জয়েন্দ্রবিহার ধ্বংস করেন এবং তার থেকে পাওয়া জিনিসপত্র দিয়ে ক্ষেমগৌরীশ্বর নামে একটি মন্দির নির্মাণ করেন। উত্তরপ্রদেশের সুলতানপুর জেলার সাতচল্লিশটি জনশূন্য দুর্গানগরী আসলে বৌদ্ধশহরের ভগ্নাবশেষ। বৌদ্ধদের বিরুদ্ধে চরম জয় পাওয়ার পর ব্রাহ্মণরা এইসব শহর জ্বালিয়ে দিয়েছিল। তিব্বতীয় এক গাথা অনুযায়ী একাদশ শতকের কালচুরি রাজা কর্ণ মগধের বহু বৌদ্ধবিহার ও মন্দির ধ্বংস করেন। ত্রয়োদশ শতকে আলভার (বৈষ্ণব ধর্মের) শাস্ত্রের উল্লেখ অনুযায়ী, বৈষ্ণব কবি ও সন্ত তিরুমানকাই নাগাপত্তনমের স্তুপ থেকে বিরাট এক সোনার বুদ্ধমূর্তি চুরি করে সেটাকে গলিয়ে মন্দির নির্মাণের কাজে লাগিয়েছিলেন।
কান্যকুব্জের রাজা কুমার শিলাদিত্য বৌদ্ধ ধর্মের পৃষ্টপোষক ছিলেন, এই অপরাধে ব্রাহ্মণরা তাঁকে গুপ্তহত্যার চেষ্টা করেছিলেন। হিউয়েঙ সাঙ অযোধ্যা পরিদর্শন করে লিখেছেন, অযোধ্যার শতাধিক বৌদ্ধমঠ ছিল এবং এই মঠগুলিতে প্রায় ৩০০০ বৌদ্ধ শ্রমণ ছিলেন। হিন্দু মন্দির ছিল মাত্র ১০টি। এই বৌদ্ধ বিহারগুলি সেদিন হিন্দুরাই ধ্বংস করেছিলেন।
এছাড়াও শৈব রাজারা হাজার হাজার জৈনকে শূলে চড়িয়ে হত্যা করেছিল। একবার একদিনে ৮০০০ জৈনকে শূলে হত্যা করার কথা তামিল পুরাণেই উল্লিখিত আছে। দাক্ষিণাত্যের কোন কোন মন্দিরে গায়ে এই শূলবিদ্ধকরণ উৎকীর্ণ দেখতে পাওয়া যায়। পাণ্ডে বংশের রাজা সুন্দর হাজার হাজার জৈনকে ভয়াবহ শাস্তি দেন এবং নাক কান কেটে তাদের হত্যা করেন। তাদের অপরাধ ছিল তারা হিন্দুধর্ম গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছিল। রামায়নে লেখা আছে, মান্ধাতা একজন জৈন শ্রমণকে গুরুতর শাস্তি দিয়েছিলেন। বৌদ্ধদের উপরও সাম্প্রদায়িক অত্যাচার চরমে উঠেছিল।
বাংলার কর্ণসুবর্ণের রাজা নরেন্দ্র গুপ্ত তথা শশাঙ্কের (খ্রীঃ ৬১৯ – ৬৩২) আদেশ ছিল সেতুবন্ধ হতে হিমগিরি পর্যন্ত যত বৌদ্ধ আছে – বালক-বৃদ্ধ নির্বিশেষে তাদের হত্যা করতে হবে, যে না করবে তার মৃত্যুদণ্ড হবে। রাজা শশাঙ্ক বৌদ্ধধর্মের মূলোৎপাটনের জন্য এমন কোন প্রচেষ্টা ছিল না যা তিনি করেননি। তিনি বুদ্ধগয়ার যেখানে গৌতমবুদ্ধ জ্ঞানলাভ করেছিলেন সেই পবিত্র বোধিবৃক্ষ কেটে জ্বালিয়ে দেন। তিনি পাটলিপুত্রতে বুদ্ধদেবের পদচিহ্নের নিদর্শন সম্বলিত পাথর খণ্ডটি ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করে দেন। বহু বৌদ্ধভিক্ষুকে তিনি দেশত্যাগ করতে বাধ্য করেন। রাজা শশাঙ্ক শুধুমাত্র বোধিবৃক্ষ পুড়িয়ে ফেলেছিলেন তা নয় তিনি বুদ্ধ মূর্তিকে মন্দির থেকে সরিয়ে সেখানে শিবমূর্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং কুসীনারার এক বিহার থেকে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের তাড়িয়ে বৌদ্ধধর্মকে উচ্ছেদ করার চেষ্টা করেছিলেন আর পাটলিপুত্রে গৌতম বুদ্ধের পায়ের চিহ্ন দেওয়া পাথরখণ্ডকে গঙ্গার জলে নিক্ষেপ করেছিলেন।
অষ্টম শতকে হিন্দুধর্মের পূনরুত্থানকালে দক্ষিণভারতীয় ভাষাবিদ্ কুমারিল ভট্টও বৌদ্ধ নির্যাতনের স্বপক্ষের রীতিমতো শাস্ত্রীয় নির্দেশ জারি করেছিলেন। তিনি প্রচার করতেন ‘বৌদ্ধ মাত্রই বধ্য’। রাজা সুধন্বা অসংখ্য জৈন ও বৌদ্ধ পণ্ডিতের মস্তক উলুখড়ে নিক্ষেপ করে ঘোটনদণ্ডে নিষ্পেশণ করে তাদের দুষ্টমতি চূর্ণ করেছিলেন। অষ্টম শতকেই গাড়োয়ালের হিন্দুরাজা তিব্বতের রাজা লামা ইয়োসীহোতকে বৌদ্ধধর্ম ত্যাগ করাবার চেষ্টা করেন, ব্যর্থ হলে তাঁকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেন। সপ্তম শতকে কুমায়ুনে রীতিমত বৌদ্ধধর্ম প্রতিষ্ঠালাভ করেছিল, অথচ শঙ্করাচার্যের আন্দোলনে সেখানে একটিও বৌদ্ধ মন্দির অবশিষ্ট রাখেনি।
খ্রীষ্টপূর্ব ২য় শতকে লিখিত ‘দিব্যদান’ পুস্তক থেকে জানা যায়, পুষ্যমিত্র শুঙ্গ একজন বৌদ্ধ নির্যাতনকারী হিসাবে যথেষ্ট খ্যাতিলাভ বা কুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন। সম্রাট অশোকের নির্মিত ৮৪০০০ বৌদ্ধস্তুব তিনি ধ্বংস করেছিলেন। এর পরেই ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল মগধের বৌদ্ধ কেন্দ্রসমূহ। তিনি বৌদ্ধ মঠ মন্দির ধ্বংস করে পুড়িয়ে হত্যা করেছিলেন বহু সন্যাসীকে। আর এইভাবে তিনি শাকল অর্থাৎ শিয়ালকোট পর্যন্ত অভিযান করেন।
বুদ্ধের জন্মস্থান কপিলাবস্তুতেই কোশলের হিন্দুরাজা বিরুধক অসংখ্য নিরীহ শান্তিপ্রিয় বৌদ্ধধর্মাবলম্বীকে হত্যা করেন। হত্যাযজ্ঞ সমাপন করে কপিলাবস্তু থেকে ৫০০ বৌদ্ধ যুবতী রমণীকে তিনি নিজ আলয়ে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। তারা দৃঢ়ভাবে এর বিরুদ্ধতা করায় কোশলরাজ নৃশংসভাবে এই ৫০০ রমণীকে হত্যা করেন।
মায়াবতী মহাবিহার ধ্বংস হয় ব্রাহ্মণ্যবাদীদের হাতে। ভোজবর্মার বেলালিপি থেকে জানা যায়, বিষ্ণুভক্ত জাতবর্মা সোমপুরের মহাবিহার ধ্বংস করেছিলেন।
এছাড়াও পল্লব রাজবংশের হিন্দু রাজা প্রথম নরসিংহবর্মণ (৬৩০ – ৬৬৮) চালুক্যদের রাষ্ট্রদেবতা মন্দিরের মূল বিগ্রহ গণেশ মূর্তি ৬৪২ খ্রীষ্টাব্দের লুণ্ঠন করেন। চালুক্য রাজা ৬৯৩ খ্রীষ্টাব্দের উত্তর ভারতে অভিযান চালিয়ে পরাজিত রাজাদের মন্দির থেকে গঙ্গা ও যমুনার দেবীমূর্তি লুণ্ঠন করেন। অষ্টম শতকে কাশ্মীর রাজ ললিতাদিত্যের (৬৯৯ – ৭৩৬) রাজ্যে হানা দিয়ে পাল রাজারা কাশ্মীরে রাজাদের রাষ্ট্রদেবতা রামস্বামী নামক বিষ্ণু মূর্তিকে ভেঙ্গে দেন। অষ্টম শতকে পাণ্ডা রাজা শ্রীবল্লভ সিংহল আক্রমণ করে তাঁর রাজধানীতে একটি সোনার বুদ্ধমূর্তি লুণ্ঠন করে নিয়ে যান। দশম শতকের মাঝামাঝি ওই বিষ্ণুমূর্তি আবার ছিনিয়ে নেন চান্দেলা রাজ যশোবর্মন এবং সেটাকে খাজুরাহের লক্ষ্ণণ মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করেন। একাদশ শতকের প্রথম দিকে চোল রাজা রাজেন্দ্র (১০১৪ – ১০৪২) বিভিন্ন রাজমন্দির থেকে বিভিন্ন দেবমূর্তি লুট করেন। একাদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে চোল রাজাধিরাজ (১০১৮ – ১০৫৪) চালুক্য রাজাকে যুদ্ধে পরাজিত করে চালুক্য রাজবংশের রাষ্ট্রদেবতা দ্বারপালিকা বিগ্রহ বিধ্বস্ত ও মন্দির পুড়িয়ে দেন। ওড়িশার সূর্যবংশী গজপতি বংশের রাজা কপিনেন্দ্র ১৪৬০ খ্রীষ্টাব্দে তামিল রাজাদের রাজত্বে যুদ্ধাভিযান চালিয়ে বহু শৈব ও বৈষ্ণব মন্দির বিধ্বস্ত করেন। দশম শতকের গোড়ার দিকে রাষ্ট্রকুট রাজা তৃতীয় ইন্দ্র তাঁর শত্রুপক্ষীয় প্রতিহার রাজার রাষ্ট্রদেবতার কলাপ্রিয় মন্দির ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিয়ে নিজেই বিস্তারিতভাবে তার বিবরণ দেন। শংকরবর্মণ (৮৮৩ – ৯০২) ৬৪টি মন্দির লুট করেছিলেন। রাজা কলশ (১০৬৩ – ১০৮৯) সূর্যমূর্তি ধ্বংস করেন এবং বৌদ্ধমঠ থেকে বহু মূর্তি নিয়ে চলে যান।
সুতরাং ইতিহাস পাঠ করলে দেখা যায় হিন্দু শাসকদের মত মুসলিম শাসকরা পাইকারি হারে হিন্দু মন্দির ধ্বংস করেন নি। ঐতিহাসিক এম ইটনের মতে মুসলিম শাসন শুরু হওয়া থেকে পতন পর্যন্ত সর্বমোট ৮২টি মন্দির ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল। এইসব মন্দিরগুলি মুসলিম শাসকেরা ধ্বংস করার জন্য কোনো অভিযান চালান নি। বরং স্থানীয় হিন্দু শাসকদের সঙ্গে যুদ্ধ চলার সময় গোলাবর্ষণে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল। আর কিছু মন্দির সম্রাটবিরোধী রাজনৈতিক আখড়ায় পরিণত হয়েছিল যেগুলিকে তৎকালীন সম্রাটরা ধ্বংস করেন। এসবের মধ্যে হিন্দু বিরোধীতার কোনো কারণ ছিল না। সম্রাট বিরোধী কার্যকলাপের জন্য অনেক মসজিদও ধ্বংস করা হয়েছিল।
সম্রাট আওরঙ্গজেব ও মন্দির ধ্বংসের অজানা ও রোমাঞ্চকর ইতিহাস
‘নবজাগরণ’ অ্যান্ড্রোয়েড অ্যাপ্লিকেশনটি প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর টেলিগ্রাম চ্যানেলে জয়েন হতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর ফেসবুক পেজে লাইক করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।