লিখেছেনঃ মুহাম্মাদ আব্দুল আলিম
ক্যাপ্টেন জ্যাক স্প্যারো ওরফে জন ওয়ার্ড বা বার্ডি ইতিহাসের অন্যতম একটি রহস্যময় চরিত্র। তাঁর সমসাময়িকদের কাছে তিনি রবিন হুডের মতো একটি মায়াবী ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তাঁর জীবনের উপর অবলম্বন করে হলিউডের বিখ্যাত ফিল্ম নির্মান সংস্থা ওয়াল্ট ডিজনি প্রোডাকশন ‘জনি ডেপ’ নামক অভিনেতাকে নিয়ে ‘পাইরেটস অফ দ্য ক্যারিবিয়ান’ সিনেমাটা নির্মান করেছেন। সিনেমাটা অনেকগুলি সিরিজে বিভক্ত। শুধু তাই নয় ২০১১ সালে নির্মিত এই উক্ত সিনেমার চতুর্থ সিরিজ অর্থাৎ ‘পাইরেটস অব দ্য ক্যারিবিয়ান: অন স্ট্রেঞ্জার টাইড’ এখন পর্যন্ত হলিউডের সবচেয়ে ব্যয়বহুল সিনেমা। এতে খরচ হয়েছিল আনুমানিক ৩৭৮.৫ মিলিয়ন ডলার। ভারতীয় মূল্যে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা। এটি ব্যবসায়িক দিক অবিশ্বাস্য সফলতা পায়। অর্থাৎ এটি সিনেমার ইতিহাসে অন্যতম ব্যবসাসফল সিনেমা। বক্স অফিসে ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি আয় হয়েছিল। এই সিরিজের সিনেমাহুলোর অভিনয় ছিল অসাধারন মানের। শুটিংও হয়েছিল দুর্গম স্থানে। বিভিন্ন সরঞ্জাম ও কলাকুশলীদের নিয়ে দুর্গম স্থানে শুটিং করা ছিল বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার। চ্যালেঞ্জিং কাজ তারা করেছে এবং সে অনুসারে সফলতাও পেয়েছে অভাবনীয়।
এর তৃতীয় পর্ব অর্থাৎ ‘পাইরেটস অব দ্য ক্যারিবিয়ান: এট ওয়ার্ল্ডস এন্ড’ (২০০৭) খরচ হয়েছিল ৩০০ মিলিয়ন ডলার। ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ২২০০ কোটি টাকা। এটিও ব্যবসায়িক দিক থেকে বেশ লাভও করে। ইতিহাসের অন্যতম ব্যবসাসফল সিনেমা এটি। বক্স অফিসে ১ বিলিয়ন ডলারেরও অধিক আয় হয়েছিল এই সিনেমাটি।
এবার আসুন আমরা দেখি উক্ত রসহ্যময় সামুদ্রিক জলদস্যু ক্যাপ্টেন জ্যাক স্প্র্যারো ওরফে জন ওয়ার্ড কে ছিলেন। ইনসাইড হলিউডের দেওয়া তথ্যমতে, ক্যাপ্টেন জ্যাক স্প্যারোর আসল নাম জ্যাক ওয়ার্ড। তাঁকে জ্যাক বার্ডি নামেও চেনা যেত। পরবর্তীকালে ইসলাম গ্রহণ করে নিজেই নিজের নাম পরিবর্তন করে নতুন নাম রাখেন ইউসুফ রইস।
প্রাথমিক জীবনঃ
জন ওয়ার্ড ওরফে ক্যাপ্টেন জ্যাক স্প্যারোর জন্ম হয় 1553 সালে এক দরিদ্র পরিবারে, দক্ষিণ-পূর্ব ইংল্যান্ডের ক্যান্টের ফ্যাভারশামে। উপকূলীয় অঞ্চলে তিনি জীবনের প্রথম দিকের বছরগুলি ফিশারিগুলিতে কাজ করে জীবন অতিবাহিত করতেন। তরুণ বয়সে মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করলেও জ্যাক স্প্যারো সমুদ্র যাত্রার স্বপ্ন দেখতেন। তাঁর জন্মস্থান সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকায় হওয়ায় এখানে বিভিন্ন সামুদ্রিক নাবিকদের যাতায়াত ছিল। ১৫৮৮ সালে তিনি একটি বেসরকারী কাজ পেয়েছিলেন, ইংল্যান্ডের রানী প্রথম এলিজাবেথের লাইসেন্স নিয়ে স্পেনীয় জাহাজ লুঠ করেন। ইংল্যান্ডের প্রথম জেমস যখন 1603 সালে সিংহাসনে আরোহন করার পরে স্পেনের সাথে যুদ্ধ শেষ হয়েছিল, অনেক জলদস্যু তাদের জীবিকা ছাড়তে অস্বীকার করে এবং লুণ্ঠন চালিয়ে যায়। যারা জলদস্যু বলে বিবেচিত হয়েছিল কারণ তাদের আর বৈধ লাইসেন্স নেই – যাকে বলা হয় মার্ক অফ লেটার – রাষ্ট্র দ্বারা জারি করা হয়েছিল।
1604 সালে জ্যাক স্প্যারোকে রাজার কর্তৃত্বাধীন লিয়নের হুইলপ নামের একটি জাহাজের দেখাশোনা করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। ইংল্যাণ্ডের রাজা প্রথম জেমসের জ্যাককে বন্দী করেন। জোর করে জাহাজের শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ করলে জ্যাক তাঁর সাঙ্গপাঙ্গদের নিয়ে সেখান থেকে পলায়ন করেন এবং পোর্টসমাউথ বন্দর থেকে একটি জাহাজ চুরি করে ভূমধ্যসাগরের অভিমুখে পাড়ি দেন। পরবর্তীতে তাঁরা সেই ভূমধ্যসাগরে জলদস্যু হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন এবং তিনি তাঁর সাথীদের দ্বারা নেতা নির্বাচিত হন। এ সময়েই জন ওয়ার্ডের নাম পরিবর্তিত হয়ে ক্যাপ্টেন জ্যাক স্প্যারোতে রূপান্তরিত হন। তিনি ষষ্টদশ শতাব্দীর শেষের দিকে পালিয়ে তিউনিসিয়া চলে যান। কারণ তিউনিসিয়া ছিল তৎকালীন মুসলিমদের উসমানি খিলাফতের অধীনে। এরপর তিনি মরক্কোর ‘সালা’ অঞ্চলের ‘আবু রাকরাক’ এলাকায় ঘাঁটি স্থাপন করে তিনি তাঁর দস্যুবৃত্তি চালিয়ে যান। তিনি খুব বেশি পাখি ভালবাসতেন সেজন্যই তাঁকে ‘স্প্যারো” নামক পাখির নাম দেয়া হয়। তিউনিসে থাকাকালীন সময়ে ছোট ছোট চড়ুই পাখির প্রতি তাঁর আকর্ষনের জন্য স্থানীয় ব্যক্তিবর্গ তাঁকে ডাকতো জ্যাক ‘আসফুর’ নামে। আরবী ‘আসফুর’ শব্দ থেকেই তাঁর নামের শেষের ‘স্প্যারো’ (চড়ুই) শব্দটি গ্রহণ করা হয়েছে। এছাড়া ইংরেজিতেও ‘স্প্যারো’ অর্থ চড়ুইপাখি। পরবর্তীকালে এই কারণেই তাঁর নাম হয়ে যায় ‘ক্যাপ্টেন জ্যাক স্প্যারো’।
ইসলাম গ্রহণঃ
এক সময় দস্যুবৃত্তি ছেড়ে দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে চেয়েছিলেন ক্যাপ্টেন জ্যাক স্প্যারো। সেজন্য ইংল্যাণ্ডের রাজা প্রথম জেমসের কাছে রাজকীয় ক্ষমার আবেদন প্রেরণ করেন। কিন্তু রাজা প্রথম জেমস তাঁর এই আবেদন প্রত্যাখ্যান করেন ফলে তিনি পুনরায় তিউনিসে ফিরে আসেন। ওসমানী খেলাফতের অধীন আলজেরিয়া অঞ্চলের গর্ভনর জ্যাক স্প্যারোকে আশ্রয় দেন।
১৬০৯ সালে ক্যাপ্টেন জ্যাক স্প্যারো তাঁর জাহাজের সকল নাবিকদের নিয়ে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হন। তিনি নিজেই নিজের নাম পরিববর্তন করে নতুন নাম ইউসুফ রইস রেখেছিলেন এবং ইংল্যাণ্ডে স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও দ্বিতীয়বার বিবাহ করেছিলেন। ইসলাম ধর্ম গ্রহন করার পর তিনি ওসমানী নৌ-বাহিনীতে যোগ দেন এবং খ্রিস্টান অধিকৃত স্পেনের অসংখ্য স্পেনীয় ইহুদি এবং মুসলমান অধিবাসীদেরকে উদ্ধার করেন। তিনি নিজের ইংরেজ স্ত্রীর কাছে অর্থ পাঠাতেন এবং তিনি একজন ইতালিয়ান মহিলাকে বিয়ে করেন। ১৬১২ খ্রিস্টাব্দে ‘অ্যা ক্রিশ্চান টার্নড তুর্ক’ (A Christian Turn’d Turk) শিরোনামে একটি নাটক ইংরেজ নাট্যকার রবার্ট ডাবর্ন তাঁর ইসলাম ধর্মে রূপান্তর সম্পর্কে লিখেছিলেন। এছাড়া এর পরবর্তীতে তাঁকে নিয়ে আরও অনেক নাটক রচনা করা হয়। ‘ক্যাপ্টেন ওয়ার্ড এবং রেইনবো’ ব্যান্ডটি জ্যাক স্প্যারোর উপর ভিত্তি করে তৈরী করা হয়েছে। থমাস কস্টেইন নামক একজন ঔপন্যাসিক জ্যাক স্প্যারোর জীবন অবলম্বন করে ‘ফর মাই গ্রেট ফলি’ নামে একটি ঐতিহাসিক উপন্যাস রচনা করেন- যেটি প্রকাশিত হয়েছে 1942 সালে। আগেই বলা হয়েছে যে হলিউডের চলচ্চিত্র ‘পাইরেটস অব দি ক্যারেবিয়ান’ এ জনি ডেপ অভিনীত চরিত্রটিও তাঁর জীবনের উপর ভিত্তি করেই নির্মান করা হয়েছে, যদিও ক্যাপ্টেন জ্যাক স্প্যারো ক্যারেবীয় দ্বীপপূঞ্জে গমন করেছিলেন বলে কোন প্রমাণ পাওয়া যায়না।
ক্যাপ্টেন জ্যাক স্প্যারো প্রথম জীবনে প্রচুর পরিমাণে মদ্যপান করতেন। এক মুহূর্তও মদ্যপান না করে থাকতে পারতেন না। বেশিরভাগ সময় মাতাল অবস্থায় কুকুরের সাথে কথা বলে সময় কাটাতেন। কিন্তু ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার পর মদ্যপান একেবারেই ছেড়ে দেন। মধ্যযুগীয় গির্জার অমানবিক অত্যাচার থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ইয়াসমিন সাকলিয়্যাহ নামের এক খ্রীষ্টান যুবতী ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। সেই পলাতকা যুবতীকে ক্যাপ্টেন জ্যাক স্প্যারো বিবাহ করেন।
ষোড়শ শতাব্দীর অন্তিম পর্যায়ে আন্দালুসের মরিস্কো মুসলমানদেরকে স্পেনের খ্রীষ্টানরা অমানবিক নির্যাতন চালায়। মুসলমানদেরকে ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করে খ্রীষ্টধর্ম গ্রহণ করার জন্য জোর দিতে থাকে। খ্রীষ্টান ধর্ম গ্রহণ না করলে তাদের উপর নেমে আসে অত্যাচারের স্ট্রীম রোলার। ফলে হাজার হাজার মরিস্কো মুসলমান স্পেন ত্যাগ করে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে পালিয়ে যেতে থাকে। এইসব নির্যাতিত – নিপীড়িত মুসলমানদের বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়েন ক্যাপ্টেন জ্যাক স্প্যারো। নির্যাতিত মুসলমানদের রক্ষা করার দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন। বর্ণিত আছে, আন্দালুসের সেইসব নির্যাতিত – নিপীড়িত মুসলমানদের রক্ষা করার জন্য তিনি মরক্কোর জলদস্যুদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করেন এবং আন্দালুসি মুসলমানদের হত্যাকারী বুনো খ্রীষ্টানদের সাথে তিনি ও তাঁর জাহাজের মাল্লারা মিলে ভয়ঙ্কর এক গেরিলাযুদ্ধে লিপ্ত হন। ক্যাপ্টেন জ্যাক স্প্র্যারো ও তাঁর সঙ্গীদের কাছে সেইসব খ্রীষ্টানরা চুড়ান্তভাবে পরাজিত হয়। অবস্থা এমন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছায় যে খ্রীষ্টানরা ক্যাপ্টেন জ্যাক স্প্যারোর নাম শুনলেই ভীত ও সন্ত্রস্ত হয়ে যেত। শুধু তাই নয় ক্যাপ্টেন জ্যাক স্প্যারো সারা জীবন মুসলমানদের ত্রাতা অর্থাৎ রক্ষাকর্তা হিসেবেই নিজের জীবন অতিবাহিত করেছিলেন।
তিনি খুবই বুদ্ধিমান ছিলেন। তাঁর সামুদ্রিক জ্ঞান, বুদ্ধি ও রহস্য দেখে সহকর্মী মাল্লারা হতবাক হয়ে যেত। সত্যিকার অর্থেই তিনি একজন যোগ্যতাসম্পন্ন সামুদ্রিক ক্যাপ্টেন ছিলেন। মধ্যযুগে সারা বিশ্বের মধ্যে তিনিই ছিলেন একজন সাগরসম্রাট।
মধ্যযুগের নামকরা এই দুর্ধর্ষ বীরের জীবন অবলম্বন করে বেরিয়েছে অনেক নামকরা সিনেমা, কার্টুন, উপন্যাস নাটক ও বিভিন্ন সিরিজ। কিন্তু উক্ত সিনেমার নির্মাতা, পরিচালকরা ও চিত্রনাট্যকার ক্যাপ্টেন জ্যাক স্প্যারোর প্রকৃত পরিচয় প্রকাশ করেনি!
১৬১২ এর পরে ক্যাপ্টেন জ্যাক স্প্যারো দস্যুবৃত্তি ত্যাগ করেন এবং নেভিতে প্রশিক্ষক হিসাবে নির্বাচিত হন। তিনি তাঁর দস্যুবৃত্তি দ্বারা প্রচুর অর্থ উপার্জন করেছিলেন। শেষ জীবনটা তিনি সুখে স্বাচ্ছন্দে অতিবাহিত করেছিলেন। ৭০ বছর বয়সে তিউনিসে ইতিহাসের এই কিংবদন্তী সমুদ্রসম্রাট প্লেগ রোগে আক্রান্ত হয়ে জীবনের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
Reference:
- https://en.wikipedia.org/
- https://www.worldbulletin.net/
- https://www.historyextra.com/
- Pirates of Barbary, Corsairs, Conquests and Captivity in the Seventeenth-Century Mediterranean, Adrian Tinniswood, p 48
- Frontispiece from William Lithgow, ‘The Totall Discourse of the Rare Adventures and Painefull Peregrinations of long Nineteene Years Travayles from Scotland’, London, 1632, National Library of Scotland.
- Barbary Pirate: The Life and Crimes of John Ward, p. 199
- James I, A Proclomation against Pirats[sic], January 8, 1609.
- The Totall Discourse of the Rare Adventures and painefull Peregrinations of long Nineteene Years Travayles from Scotland, 359.
- Pirates of Barbary, Corsairs, Conquests and Captivity in the Seventeenth-Century Mediterranean, Adrian Tinniswood, p. 59.
- Kilij – Ottoman sword.
- Simon the Dancer, also known as Simon Danseker, was a companion of Captain Jack Birdy, and equally infamous. He would later turn on the Barbary Corsairs in favor of the royal families of Europe. His betrayal ended up in his doom at the hand of Uthman Dey’s son and heir, Yusuf Dey, who scolded him before a Janissary executed him. Pirates of Barbary, Corsairs, Conquests and Captivity in the Seventeenth-Century Mediterranean, Adrian Tinniswood, pp.64-65.
- Bibliotheca nautica: Books, prints and manuscripts relating to naval battles and the science of naval warfare, shipbuilding and the art of navigation, pirates, buccaneers, and privateers, shipwrecks and disasters at sea, p. 54.
সিনেমা সংক্রান্ত পরের আর্টিকেলঃ দিরিলিস আরতুগ্রুল