• মূলপাতা
  • ইতিহাস
    • ইসলামিক ইতিহাস
    • ভারতবর্ষের ইতিহাস
    • বিশ্ব ইতিহাস
  • বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
  • ধর্ম
    • ইসলাম
    • খ্রিস্টান
    • হিন্দু
    • ইহুদী
    • অন্যান্য ধর্ম
  • নাস্তিকতা
  • রাজনীতি
  • সিনেমা
  • সাহিত্য
    • কবিতা
    • ছোটগল্প
    • উপন্যাস
    • সাহিত্য আলোচনা
  • অন্যান্য
  • ই-ম্যাগাজিন
    • নবজাগরণ (ষাণ্মাসিক) – জীবনানন্দ ১২৫ তম জন্ম সংখ্যা – মননশীল সাহিত্য পত্রিকা
  • Others Language
    • English
    • Urdu
    • Hindi
Monday, June 16, 2025
নবজাগরণ
  • মূলপাতা
  • ইতিহাস
    • ইসলামিক ইতিহাস
    • ভারতবর্ষের ইতিহাস
    • বিশ্ব ইতিহাস
  • বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
  • ধর্ম
    • ইসলাম
    • খ্রিস্টান
    • হিন্দু
    • ইহুদী
    • অন্যান্য ধর্ম
  • নাস্তিকতা
  • রাজনীতি
  • সিনেমা
  • সাহিত্য
    • কবিতা
    • ছোটগল্প
    • উপন্যাস
    • সাহিত্য আলোচনা
  • অন্যান্য
  • ই-ম্যাগাজিন
    • নবজাগরণ (ষাণ্মাসিক) – জীবনানন্দ ১২৫ তম জন্ম সংখ্যা – মননশীল সাহিত্য পত্রিকা
  • Others Language
    • English
    • Urdu
    • Hindi
No Result
View All Result
নবজাগরণ
  • মূলপাতা
  • ইতিহাস
    • ইসলামিক ইতিহাস
    • ভারতবর্ষের ইতিহাস
    • বিশ্ব ইতিহাস
  • বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
  • ধর্ম
    • ইসলাম
    • খ্রিস্টান
    • হিন্দু
    • ইহুদী
    • অন্যান্য ধর্ম
  • নাস্তিকতা
  • রাজনীতি
  • সিনেমা
  • সাহিত্য
    • কবিতা
    • ছোটগল্প
    • উপন্যাস
    • সাহিত্য আলোচনা
  • অন্যান্য
  • ই-ম্যাগাজিন
    • নবজাগরণ (ষাণ্মাসিক) – জীবনানন্দ ১২৫ তম জন্ম সংখ্যা – মননশীল সাহিত্য পত্রিকা
  • Others Language
    • English
    • Urdu
    • Hindi
No Result
View All Result
নবজাগরণ
No Result
View All Result

সম্রাট আওরঙ্গজেবের শাসনকাল : (১৬৫৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৭০৭ খ্রিস্টাব্দ)

মুহাম্মাদ আব্দুল আলিম by মুহাম্মাদ আব্দুল আলিম
June 15, 2025
in ভারতবর্ষের ইতিহাস
0
সম্রাট আওরঙ্গজেবের শাসনকাল : (১৬৫৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৭০৭ খ্রিস্টাব্দ)

Image Source: Google

Share on FacebookShare on Twitter

লিখেছেনঃ মুহাম্মাদ আব্দুল আলিম

মুঘল সম্রাট শাহজাহানের পুত্রদের মধ্যে সর্বাধিক শক্তিশালী, বুদ্ধিমান ও রাজনৈতিকভাবে দক্ষ ছিলেন সম্রাট আওরঙ্গজেব। ইতিহাসে তাঁকে নিয়ে যত বিতর্ক, ততটা আর কোনো মুঘল সম্রাটকে নিয়ে হয়নি। একদিকে, কিছু ঐতিহাসিক তাঁকে নির্মম, ধর্মান্ধ ও অত্যাচারী শাসক হিসেবে চিত্রিত করেছেন, অন্যদিকে কিছু গবেষক তাঁর শাসননীতির বাস্তব দিক তুলে ধরে দেখিয়েছেন যে, তিনি ছিলেন অত্যন্ত কঠোর নীতির অনুসারী, কিন্তু তাঁর সিদ্ধান্তগুলো রাজনৈতিক ও সাম্রাজ্যবাদী বাস্তবতার ওপর ভিত্তি করে নেওয়া হয়েছিল, ধর্মীয় বিদ্বেষ থেকে নয়। তাঁর সম্পর্কে প্রচলিত বহু তথ্য উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বিকৃত করা হয়েছে। যেমন, তাঁর প্রকৃত নাম ‘আওরঙ্গজেব’, অথচ তাঁকে বিদ্বেষমূলকভাবে ‘ঔরঙ্গজীব’ বলা হয়েছে, যেখানে ‘জীব’ অর্থ জন্তু বা প্রাণী, যা স্পষ্টতই অপমানসূচক। অথচ ইতিহাসের নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, আওরঙ্গজেব ছিলেন অত্যন্ত সংযত জীবনযাপনে অভ্যস্ত একজন শাসক, যিনি কঠোর পরিশ্রমী এবং নীতির ক্ষেত্রে আপসহীন ছিলেন।

তাঁকে বরাবরই হিন্দু বিদ্বেষী হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। অথচ বাস্তবতা হচ্ছে, আওরঙ্গজেব দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর ভারতবর্ষ শাসন করেছেন, এর মধ্যে ১৬৫৮ সাল থেকে ১৬৮১ সাল পর্যন্ত উত্তর ভারতে এবং ১৬৮১ সাল থেকে ১৭০৭ সালে তাঁর মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত দাক্ষিণাত্যে শাসন করেছেন। যদি তিনি সত্যিই হিন্দুদের নির্মূল করতে চেয়েছিলেন, তাহলে এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে হিন্দুধর্ম নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। আজও ভারতে হিন্দুধর্ম তার শক্তি ও সংস্কৃতি ধরে রেখেছে, যা এই ধারণাকে ভুল প্রমাণ করে যে, আওরঙ্গজেব হিন্দুদের নির্মূল করতে চেয়েছিলেন। আসলে, ব্রিটিশ-পোষিত ইতিহাসবিদরা শুধু সম্রাট আওরঙ্গজেব নন, প্রায় সমস্ত মুসলিম শাসকদের বিরুদ্ধেই একতরফাভাবে হিন্দুদের ওপর নির্যাতনের অভিযোগ এনেছেন। অথচ পৃথিবীর ইতিহাসে এমন কোনো দৃষ্টান্ত নেই, যেখানে মুসলিম শাসকদের শাসনে কোনো জাতি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। অন্যদিকে, ভারতবর্ষে ব্রাহ্মণ্যবাদীদের কঠোর নিপীড়নের ফলে বৌদ্ধধর্ম প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। এটি ঐতিহাসিক সত্য।

সম্রাট আওরঙ্গজেবের শাসনকাল : (১৬৫৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৭০৭ খ্রিস্টাব্দ)
চিত্রঃ মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব, Image Source: Google

সম্রাট আওরঙ্গজেব একজন ধর্মপ্রাণ মুসলমান ছিলেন, কিন্তু তিনি কখনোই ভারতে ইসলামি শাসন প্রতিষ্ঠা করেননি। তিনি কোরান শরিফ নিজে হাতে নকল করতেন, সাধারণ জীবনযাপন করতেন এবং রাজকীয় সম্পদের অপব্যবহার করতেন না। যদিও তিনি ইসলামি আইন মেনে চলতেন, তথাপি তাঁর শাসন আমলে অপরাধীদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির বিধান চালু ছিল, যা ছিল সে যুগের সাধারণ শাসনব্যবস্থার অংশ। সেই সময় আলাদা কোনো স্বাধীন বিচারব্যবস্থা ছিল না। রাজদরবারই ছিল চূড়ান্ত বিচারালয় এবং শাসকই ছিলেন সর্বোচ্চ বিচারপতি। তাই কোনো অপরাধীর জন্য কঠোর শাস্তি ঘোষিত হলে তা এককভাবে আওরঙ্গজেবের নিষ্ঠুরতা হিসেবে গণ্য করা উচিত নয়। যদি এমন হতো যে, সম্রাট আওরঙ্গজেব একমাত্র নিষ্ঠুর শাসক ছিলেন এবং তাঁর শাসনেই অপরাধের কঠোর শাস্তি দেওয়া হতো, তাহলে তা সত্যিই প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারত। কিন্তু সারা পৃথিবীতেই সে সময়ের শাসনব্যবস্থা ছিল একইরকম কঠোর।

সম্রাট আওরঙ্গজেবকে হিন্দু মন্দির ধ্বংসকারী শাসক হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে। কিন্তু গবেষণা বলছে, তাঁর মন্দির ধ্বংসের আদেশ ছিল রাজনৈতিক ও কৌশলগত কারণেই। যেমন, কোনো বিদ্রোহী রাজা যদি রাজমন্দির ব্যবহার করতেন ষড়যন্ত্রের কেন্দ্র হিসেবে, তাহলে তিনি সেই মন্দির ধ্বংসের আদেশ দিতেন। কিন্তু এর মানে এই নয় যে, তিনি হিন্দুদের ধর্মীয়ভাবে নিপীড়ন করতেন। বরং, তাঁর শাসনামলে বহু মন্দির সরকারি অনুদান পেয়েছে, এবং জিজিয়া কর পুনরায় চালু করলেও, বহু হিন্দু উচ্চপদস্থ ব্যক্তি তাঁর সেনাবাহিনীতে এবং প্রশাসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। ঐতিহাসিক প্রমাণ থেকে জানা যায়, সম্রাট আওরঙ্গজেব তাঁর জীবনের প্রথম ২২ বছর কোনো ধর্মীয় কঠোরতা আরোপ করেননি। কিন্তু কিছু বিদ্রোহী গোষ্ঠীর ষড়যন্ত্র এবং দাক্ষিণাত্যে মারাঠাদের বিদ্রোহ তাঁকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করে। রাজপুতদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক কখনো শত্রুতাপূর্ণ, আবার কখনো মৈত্রীপূর্ণ ছিল, যা প্রমাণ করে যে, তিনি কোনও বিশেষ সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে পরিকল্পিতভাবে বিদ্বেষমূলক নীতি গ্রহণ করেননি।

সম্রাট আওরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ জিজিয়া কর পুনরায় আরোপ করা। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, এই কর নতুন কিছু ছিল না। আকবর ব্যতীত অন্যান্য মুসলিম শাসকরাও এই কর আরোপ করেছিলেন, এবং এটি ছিল মূলত একটি সামরিক কর, যা অ-মুসলিমদের ওপর ধার্য হতো। এটি ইসলামের রাজনৈতিক শাসনব্যবস্থার অংশ ছিল, এবং অন্য কোনো ধর্মাবলম্বী রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে এটি ভিন্ন কিছু নয়। আসলে, ইতিহাসকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এমনভাবে রচনা করা হয়েছে যাতে মুসলিম শাসকদের শাসনকালকে অন্ধকারময় ও নিপীড়নমূলক মনে হয়। অথচ সত্য হচ্ছে, আওরঙ্গজেবের শাসনে ভারতবর্ষ সাংস্কৃতিকভাবে বিকশিত হয়েছে, অর্থনৈতিক ও সামরিকভাবে শক্তিশালী ছিল। তাঁর শাসন আমলে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে বহু মানুষ উচ্চপদে অধিষ্ঠিত ছিলেন, এবং প্রশাসনিক দক্ষতায় তিনি ছিলেন অতুলনীয়।

তাহলে প্রশ্ন আসে, কেন সম্রাট আওরঙ্গজেবকে এত ঘৃণার সঙ্গে উপস্থাপন করা হলো? এর পেছনে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকদের একটি সুস্পষ্ট উদ্দেশ্য ছিল—ভারতের ইতিহাসকে এমনভাবে পুনর্লিখন করা, যাতে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি হয় এবং তারা একে অপরের শত্রু হয়ে যায়। ব্রিটিশ ঐতিহাসিকরা এবং তাঁদের দেশীয় অনুসারীরা ইতিহাসকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে আওরঙ্গজেবের নামের সঙ্গে এক অন্ধকারময় অধ্যায় যুক্ত করে দেন, যা তাঁর প্রকৃত শাসন নীতির বিপরীত। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে ইতিহাসের সত্যতা যাচাই করা আমাদের দায়িত্ব। আওরঙ্গজেব ছিলেন কঠোর শাসক, কিন্তু তিনি একজন বিচক্ষণ ও বাস্তববাদী শাসকও ছিলেন। তাঁর শাসনামলে হিন্দু-মুসলমান একসঙ্গে প্রশাসন চালিয়েছে, রাজ্য শাসন করেছে, এবং সামাজিক ভারসাম্য বজায় রেখেছে। ইতিহাসকে নতুন করে বিশ্লেষণ না করলে, সত্য ও মিথ্যার পার্থক্য করা সম্ভব নয়।

সম্রাট আওরঙ্গজেব ইতিহাসের এক বিরল চরিত্র, যাঁর বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি বিতর্ক তৈরি করা হয়েছে। তাঁর নাম উচ্চারণ করলেই কিছু মানুষের মনে এক নির্দয়, ধর্মান্ধ, হিন্দু বিদ্বেষী শাসকের ছবি ভেসে ওঠে। অথচ ইতিহাসের ন্যায়সঙ্গত পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এই অভিযোগগুলোর অধিকাংশই অতিরঞ্জিত, বিকৃত এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। তাঁর বিরুদ্ধে হাজার হাজার মন্দির ধ্বংসের অভিযোগ আনা হয়েছে, অথচ এই তথ্যের নির্ভরযোগ্য ভিত্তি কোথায়? ঐতিহাসিক প্রমাণ বলছে, সম্রাট আওরঙ্গজেব কখনোই নির্বিচারে মন্দির ধ্বংসের নীতি গ্রহণ করেননি। বরং, রাজনীতির স্বার্থে শত্রুপক্ষের কয়েকটি মন্দিরের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, যেমনটি পূর্ববর্তী হিন্দু রাজাদের মধ্যেও প্রচলিত ছিল। অথচ এই একটি বিষয়কে তাঁর বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ হিসেবে দাঁড় করানো হয়েছে। এই শাসক শুধু যুদ্ধ-বিগ্রহে পারদর্শী ছিলেন না, তিনি একজন ধর্মপ্রাণ, সংযমী এবং অত্যন্ত হিসেবী শাসক ছিলেন। ইসলামি শিক্ষায় পারদর্শী এই সম্রাট কোরআন শরিফ নিজ হাতে নকল করেছেন। রাজ্যের অর্থনীতির দিকে নজর দিতে গিয়ে বিলাসিতা ও অপ্রয়োজনীয় ব্যয় থেকে নিজেকে দূরে রেখেছিলেন। তাঁর আমলে কোনো অপ্রয়োজনীয় সৌধ নির্মিত হয়নি, কোনো আড়ম্বরপূর্ণ রাজকীয় বিলাসিতা দেখা যায়নি। অথচ তাঁর পিতা সম্রাট শাহজাহান, যিনি অসামান্য স্থাপত্যের জন্য বিখ্যাত, তাঁর বিলাসিতা রাজ্যের কোষাগার শূন্য করে দিয়েছিল।

সম্রাট শাহজাহানকে কারাগারে বন্দি করার বিষয়টি সম্রাট আওরঙ্গজেবের নিষ্ঠুরতা বলে চিহ্নিত করা হয়েছে, কিন্তু বাস্তবতা অন্যরকম। শাহজাহানকে কারাগারে নিক্ষেপ করার অর্থ এই নয় যে, তিনি দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থায় দিন কাটিয়েছিলেন। বরং তিনি রাজকীয় প্রাসাদেই ছিলেন, সেখানে ছিল অভিজাত জীবনযাপনের সমস্ত ব্যবস্থা। তাঁর কন্যা রওশন আরা সর্বদা তাঁর সেবা করতেন, এবং সম্রাট আওরঙ্গজেব নিজেও মাঝে মাঝে পিতার সেবা করতেন। আসলে, সম্রাট আওরঙ্গজেব এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন একান্তই রাষ্ট্রের কল্যাণে। সম্রাট শাহজাহান তাঁর বিলাসী প্রকৃতির কারণে রাজকোষ শূন্য করে ফেলেছিলেন, এবং পরিকল্পনা করেছিলেন আরও একটি সৌধ নির্মাণের। যদি এই বিলাসবহুল প্রকল্প বাস্তবায়িত হতো, তাহলে সাম্রাজ্যের অর্থনীতি ধ্বংস হয়ে যেত। আওরঙ্গজেবের বিচক্ষণতা এখানেই প্রকাশ পায়—তিনি এই অপব্যয় রুখে দিয়েছিলেন এবং একটি সুশৃঙ্খল প্রশাসন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

সম্রাট আওরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে আরেকটি বড় অভিযোগ ছিল তাঁর ভ্রাতৃহত্যার। বলা হয়, তিনি তাঁর ভাই দারাশিকোহকে নির্মমভাবে হত্যা করেছিলেন। কিন্তু এই অভিযোগের বাস্তবতা বিচার করলে দেখা যায়, দারা নিজেই সম্রাট আওরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছিলেন এবং নিজেকে সম্রাট ঘোষণা করেছিলেন, যখন শাহজাহান তখনো জীবিত ছিলেন। আওরঙ্গজেবের অনুপস্থিতিতে সেনাদের বিভ্রান্ত করার জন্য তিনি ভুল সংবাদ প্রচার করেছিলেন এবং রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা নষ্ট করেছিলেন। এই ধরনের পরিস্থিতিতে, সম্রাট হিসেবে সম্রাট আওরঙ্গজেবের জন্য দারার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প ছিল না। শুধু দারা নয়, শাহজাহানের অপর দুই পুত্র মুরাদ ও সুজাও সম্রাট আওরঙ্গজেবের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠেন। মুরাদ নিজেকে সম্রাট ঘোষণা করেছিলেন, অথচ তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ অযোগ্য ও বিলাসবিলাসী। সুজাও বাংলার শাসনকর্তা হয়েও নিজেকে স্বাধীন রাজা হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন, এবং সম্রাট আওরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে নেমেছিলেন। এই প্রেক্ষাপটে, সম্রাট আওরঙ্গজেবের ভূমিকা ছিল একজন শক্তিশালী শাসকের, যিনি সাম্রাজ্যের স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়েছিলেন।

দারাশিকোহ ও মুরাদের মৃত্যুর বিষয়টি ইতিহাসে সম্রাট আওরঙ্গজেবের নিষ্ঠুরতার প্রমাণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়, কিন্তু সত্যি বলতে, তাঁদের বিচার একটি আইনানুগ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সম্পন্ন হয়েছিল। মুরাদকে হত্যা করা হয়নি, বরং তিনি বিচারালয়ের রায়ে দোষী সাব্যস্ত হয়ে মৃত্যুদণ্ড পান। দারার বিরুদ্ধেও রাষ্ট্রদ্রোহ, ষড়যন্ত্র ও ধর্মত্যাগের অভিযোগ উঠেছিল, যা বিচারকরা আমলে নিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে রায় দিয়েছিলেন। আসলে, আওরঙ্গজেব সম্পর্কে যে চিত্রটি ইতিহাসে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তা অনেকাংশেই একতরফা ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক ঐতিহাসিকেরা মুসলিম শাসকদের বিশেষ করে আওরঙ্গজেবের চরিত্রকে বিকৃত করে উপস্থাপন করেছিলেন, যাতে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি হয়। তাঁদের মূল উদ্দেশ্য ছিল “বিভক্ত করো, শাসন করো” নীতি বাস্তবায়ন করা, এবং এই নীতির অন্যতম শিকার ছিলেন আওরঙ্গজেব।

সম্রাট আওরঙ্গজেবের শাসনকাল : (১৬৫৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৭০৭ খ্রিস্টাব্দ)
চিত্রঃ দারা শিকোহ, Image Source: Google

বাস্তবে, সম্রাট আওরঙ্গজেব ছিলেন একাধারে ধর্মপ্রাণ মুসলমান, নিরপেক্ষ শাসক এবং বিচক্ষণ রাষ্ট্রনায়ক। তিনি রাজস্ব ব্যবস্থাকে সুসংহত করেছিলেন, বিচারব্যবস্থায় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনেছিলেন, এবং প্রশাসনের দুর্নীতি নির্মূল করেছিলেন। তাঁর শাসনামলে ভারতবর্ষ সামরিকভাবে শক্তিশালী ও অর্থনৈতিকভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠেছিল। তাঁর শাসন নীতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল ব্যক্তিগত সংযম ও কঠোর পরিশ্রম। তিনি বিলাসবহুল জীবনযাপনে বিশ্বাসী ছিলেন না, নিজ হাতে কোরআন নকল করে জীবিকা নির্বাহ করতেন, এবং সরকারি কোষাগারের অর্থ ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করতেন না। এত বড় সাম্রাজ্যের অধিপতি হওয়া সত্ত্বেও, তিনি নিজের জন্য কোনো বিশাল প্রাসাদ নির্মাণ করেননি, কোনো ব্যয়বহুল স্থাপত্য নির্মাণের পরিকল্পনা করেননি।

সম্রাট আওরঙ্গজেব সম্পর্কে প্রচলিত ভুল ধারণাগুলোকে শুধরানো ইতিহাসবিদদের দায়িত্ব। এই শাসককে শুধু ধর্মীয় বিদ্বেষের চশমা দিয়ে দেখা ঠিক নয়। বরং, ইতিহাসের প্রকৃত বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তিনি ছিলেন দক্ষ প্রশাসক, শক্তিশালী রাজনীতিবিদ এবং সময়ের চাহিদা অনুযায়ী কঠোর সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী এক বিচক্ষণ শাসক। ইতিহাসকে ব্যাখ্যা করা উচিত নিরপেক্ষভাবে, বাস্তব দলিল ও প্রমাণের ভিত্তিতে। সম্রাট আওরঙ্গজেবের নামের সঙ্গে যে বিভ্রান্তিকর তথ্য মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে, তা শুধরানো উচিত ইতিহাসের সত্যতা রক্ষার জন্য। তিনি শুধু একজন মুঘল সম্রাট ছিলেন না, তিনি ছিলেন এক সাহসী ও দূরদর্শী শাসক, যাঁর শাসন ভারতবর্ষের ইতিহাসে গভীর প্রভাব ফেলেছিল। সম্রাট শাহজাহানের পুত্রদের মধ্যে পরবর্তী উত্তরাধিকারের প্রশ্নে একটি গভীর সংকট সৃষ্টি হয়েছিল। সম্রাট শাহজাহান নিজে মনে প্রাণে চাইতেন যে, তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র দারাশিকোহই যেন মোগল সিংহাসনের অধিকারী হন। কিন্তু বাস্তবতার নিরিখে বিচার করলে দেখা যায়, দারা মোটেও যোগ্য উত্তরাধিকারী ছিলেন না। তিনি প্রশাসনিক দায়িত্বে অনভিজ্ঞ, যুদ্ধবিদ্যায় অপটু এবং রাজনীতির কূটচালে দুর্বল ছিলেন। তাঁর সবচেয়ে বড় কৌশল ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু সম্প্রদায়কে তুষ্ট রাখা এবং সেই উদ্দেশ্যেই তিনি হিন্দুধর্মের বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠানে গভীরভাবে যুক্ত হয়ে পড়েন।

দারাশিকোহ সংস্কৃত সাহিত্যে পারদর্শী ছিলেন এবং হিন্দুধর্মের প্রতি একধরনের আকর্ষণ অনুভব করতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, হিন্দু ও মুসলমান এই দুই ধর্ম যেন দুই সমান্তরাল স্রোত, যা একই লক্ষ্যে মিলিত হতে পারে। সেই ভাবনা থেকেই তিনি ‘মাজমাউল বাহরাইন’ নামে একটি ধর্মগ্রন্থ রচনা করেন, যেখানে তিনি ইসলামের সঙ্গে হিন্দুধর্মের বিভিন্ন দার্শনিক ঐতিহ্যের সাদৃশ্য তুলে ধরার চেষ্টা করেন। তিনি ফারসি ভাষায় উপনিষদের অনুবাদও করেছিলেন, যা তাঁর ধর্মীয় আকর্ষণের সুস্পষ্ট বহিঃপ্রকাশ। তবে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য কেবল ধর্মীয় উদারতা ও তত্ত্বচর্চা যথেষ্ট নয়, চাই কূটনৈতিক বিচক্ষণতা ও সামরিক দক্ষতা। এই দুই গুণের কোনোটিই দারার মধ্যে ছিল না। হিন্দুদের তুষ্ট করার জন্য তিনি অনেক মন্দির নির্মাণ করেছিলেন, ধর্মীয় অলৌকিক কাহিনির প্রচার করেছিলেন এবং নিজের রাজনৈতিক অবস্থান শক্তিশালী করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বাস্তবে মুসলমানদের একটি বড় অংশ তাঁর এই কর্মকাণ্ডের বিরোধিতা করেছিল। তাঁদের কাছে দারা ছিলেন এক ব্যর্থ কৌশলী, যিনি ক্ষমতার ভার নিতে সম্পূর্ণ অক্ষম।

অপরদিকে সম্রাট আওরঙ্গজেব ছিলেন দৃঢ়চেতা, দূরদর্শী এবং দক্ষ শাসক। তিনি জানতেন যে, শুধু আবেগ দিয়ে রাজ্য শাসন সম্ভব নয়, বরং একটি শক্তিশালী প্রশাসনিক কাঠামো প্রয়োজন। দারাশিকোহের তুলনায় সম্রাট আওরঙ্গজেব ছিলেন শৃঙ্খলাবদ্ধ, ধর্মপরায়ণ এবং আত্মসংযমী। তিনি তাঁর পিতার মতো বিলাসিতা ও অতিরিক্ত ব্যয়ে অভ্যস্ত ছিলেন না। বরং তিনি একান্ত ব্যক্তিগত জীবনেও অত্যন্ত সংযমী ছিলেন। তাঁর আমলে রাজকোষের অপচয় বন্ধ হয় এবং রাষ্ট্রের অর্থনীতি স্থিতিশীলতা লাভ করে। সম্রাট আওরঙ্গজেবের ক্ষমতা গ্রহণ ছিল সময়ের দাবি। সম্রাট শাহজাহান যখন বার্ধক্যজনিত কারণে দুর্বল হয়ে পড়েন, তখন দারাশিকোহ পিতার নাম ব্যবহার করে ক্ষমতা দখলের ষড়যন্ত্র শুরু করেন। একপর্যায়ে তিনি আওরঙ্গজেবকে হত্যা করার চক্রান্ত করেন। পরিস্থিতি ক্রমশ জটিল হয়ে ওঠে এবং আওরঙ্গজেব উপলব্ধি করেন যে, পিতার এই পক্ষপাতমূলক সিদ্ধান্ত তাঁকে রাজনৈতিকভাবে বিপদে ফেলতে পারে। ফলে তিনি রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতার স্বার্থে শাহজাহানকে গৃহবন্দি করার সিদ্ধান্ত নেন। সম্রাট আওরঙ্গজেবের পিতাকে বন্দি করার ঘটনাকে তাঁর নিষ্ঠুরতার প্রমাণ হিসেবে দেখানো হয়, কিন্তু বাস্তবে তা ছিল সম্পূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। সম্রাট শাহজাহানকে বন্দি করা হলেও তাঁর জীবনযাত্রায় কোনো ধরনের কষ্ট দেওয়া হয়নি। তিনি আগ্রা দুর্গের বিলাসবহুল প্রাসাদেই ছিলেন, সেখানে ছিল রাজকীয় ভৃত্যের সেবা-শুশ্রূষা, উন্নতমানের আহার ও পূর্ণ স্বাধীনতা। তাঁর কন্যা রওশন আরা সর্বদা তাঁর সেবায় নিযুক্ত ছিলেন এবং আওরঙ্গজেব নিজেও নিয়মিত পিতার খোঁজখবর নিতেন। অন্যদিকে দারাশিকোহের প্রতি সম্রাট আওরঙ্গজেব কঠোর হতে বাধ্য হন। দারা একসময় নিজেকে সম্রাট ঘোষণা করে আওরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে সামরিক সংঘাতে অবতীর্ণ হন। কিন্তু রাজনীতিতে অনভিজ্ঞতার কারণে তিনি পরাজিত হন এবং বন্দি হন। ইতিহাসের অনেক গবেষক মনে করেন, সম্রাট আওরঙ্গজেব দারাকে হত্যা করেননি, বরং তাঁকে বিচারের মুখোমুখি করেন। দারার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ, ষড়যন্ত্র ও গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগ আনা হয় এবং বিচারক তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেন। এই রায় সম্রাট আওরঙ্গজেব নিজে প্রদান করেননি, এটি ছিল বিচার বিভাগের সিদ্ধান্ত।

শুধু দারা নয়, সম্রাট শাহজাহানের অপর দুই পুত্র—সুজা ও মুরাদও সম্রাট আওরঙ্গজেবের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠেন। সুজা বাংলার শাসনকর্তা ছিলেন এবং পিতার মৃত্যুর গুজব শুনে নিজেকে স্বাধীন রাজা ঘোষণা করেন। মুরাদ গুজরাটের শাসক ছিলেন, কিন্তু তিনি ছিলেন অতিরিক্ত ভোগবিলাসী এবং মদের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকতেন। আওরঙ্গজেব এই দুই প্রতিদ্বন্দ্বীকেও পরাজিত করেন এবং সাম্রাজ্যে স্থিতিশীলতা আনেন।

শাসক হিসেবে সম্রাট আওরঙ্গজেব ছিলেন ব্যতিক্রমী। তিনি কোনো বিলাসবহুল প্রাসাদ নির্মাণ করেননি, মোগল সাম্রাজ্যের ঐতিহ্য অনুযায়ী জাঁকজমকপূর্ণ জীবনযাপন করেননি। বরং তিনি নিজ হাতে কোরআন লিখতেন এবং সেই আয় থেকে নিজের ব্যক্তিগত খরচ পরিচালনা করতেন। মৃত্যুর আগে তাঁর রেখে যাওয়া অর্থ ছিল সামান্য কয়েকটি মুদ্রা, যা তিনি তাঁর দাফনের খরচ বাবদ রেখে গিয়েছিলেন। সম্রাট আওরঙ্গজেবের আমলে কিছু কঠোর ধর্মীয় নীতি অনুসরণ করা হয়েছিল, যার কারণে তাঁকে ধর্মান্ধ বলে আখ্যায়িত করা হয়। কিন্তু বাস্তবে তিনি ছিলেন ধর্মভীরু, ধর্মান্ধ নন। তিনি ইসলামী আইন অনুসারে শাসন পরিচালনা করলেও কখনো জোরপূর্বক ধর্মান্তর চাপিয়ে দেননি। তাঁর রাজত্বকালে বহু হিন্দু মন্দির সংরক্ষিত হয়েছিল, এবং বিভিন্ন প্রশাসনিক পদে হিন্দুদের অধিষ্ঠিত করা হয়েছিল। তাঁর শাসনামলে রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে কঠোরতা ছিল, কিন্তু তা ছিল প্রয়োজনীয়। রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য তিনি মদ্যপান, জুয়া, বিলাসিতা এবং অপ্রয়োজনীয় খরচ নিষিদ্ধ করেন। তিনি হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে শৃঙ্খলা বজায় রাখার চেষ্টা করেন এবং দুর্নীতি নির্মূল করতে কঠোর নীতি গ্রহণ করেন।

একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল, পাঞ্জাবের এক গ্রামে সম্রাট আওরঙ্গজেব নিজে গিয়ে এক ব্রাহ্মণ কন্যাকে এক সেনাধিনায়কের হাত থেকে রক্ষা করেন। তিনি ছদ্মবেশে সেখানে উপস্থিত হয়ে সেই সেনাপতিকে শাস্তি দেন এবং কন্যাটির সম্মান রক্ষা করেন। পরবর্তীকালে সেই গ্রামটি ‘আলমগির’ নামে পরিচিতি লাভ করে। এতদসত্ত্বেও সম্রাট আওরঙ্গজেবকে একপাক্ষিকভাবে একটি কঠোর, ধর্মান্ধ শাসক হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, তিনি ছিলেন এক অনমনীয়, কর্তব্যনিষ্ঠ এবং শৃঙ্খলাবদ্ধ শাসক, যিনি তাঁর সাম্রাজ্যের স্থিতিশীলতা ও প্রশাসনিক দক্ষতা নিশ্চিত করেছিলেন।

আজ ইতিহাসের একাংশ তাঁকে বর্বর, নিষ্ঠুর এবং সাম্প্রদায়িক শাসক হিসেবে উপস্থাপন করতে চায়, অথচ বাস্তবে তিনি ছিলেন এমন একজন শাসক, যিনি কঠোর পরিশ্রম, আত্মসংযম ও প্রশাসনিক বিচক্ষণতার মাধ্যমে তাঁর সাম্রাজ্যকে দীর্ঘদিন ধরে সুসংহত করেছিলেন। আওরঙ্গজেব ছিলেন এমন এক মোগল সম্রাট, যিনি কেবল ক্ষমতার জন্য লড়েননি, বরং নিজের কর্তব্যবোধ থেকেই কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধা করেননি। সম্রাট আওরঙ্গজেবের শাসনকাল ইতিহাসের অন্যতম বিতর্কিত অধ্যায়। তাঁর বিরুদ্ধে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা, হিন্দু মন্দির ধ্বংস, হিন্দুদের উপর কঠোর কর আরোপ এবং প্রশাসন থেকে অমুসলিমদের সরিয়ে দেওয়ার মতো অভিযোগ বারবার উঠে এসেছে। কিন্তু এই সব অভিযোগ কতটা বাস্তব, আর কতটা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত—তা খতিয়ে দেখা জরুরি।

অবশ্যই, সম্রাট আওরঙ্গজেব এক সময় জিজিয়া কর পুনরায় চালু করেছিলেন, যা অমুসলিমদের জন্য একটি বিতর্কিত ব্যবস্থা ছিল। তবে এটাও বাস্তব যে, এটি নতুন কোনো কর ছিল না। এর আগেও বহু মুসলিম শাসক জিজিয়া আরোপ করেছিলেন এবং পরবর্তীকালে তা তুলে নেওয়া হয়েছিল। তবে রাজনৈতিক কারণেই আওরঙ্গজেব এই কর পুনরায় চালু করেছিলেন। তবে তাঁর শাসনকাল জুড়ে দেখা যায়, অনেক সময় তিনি নিজে হিন্দুদের জন্য দান করেছেন, মন্দির পুনর্নির্মাণের নির্দেশ দিয়েছেন এবং ব্রাহ্মণদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছেন।

ইতিহাসে বারবার বলা হয়েছে, সম্রাট আওরঙ্গজেব হিন্দুদের চাকরি থেকে সরিয়ে দিয়েছিলেন এবং মুসলমানদের উচ্চপদে বসিয়েছিলেন। কিন্তু বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায়, তাঁর প্রশাসনে বহু গুরুত্বপূর্ণ পদে হিন্দুরা অধিষ্ঠিত ছিলেন। কানুনগো, রাজস্ব কর্মকর্তা এবং সেনাবাহিনীতে একাধিক হিন্দু কর্মকর্তা ছিলেন, যারা মোগল শাসনের বিভিন্ন পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।

একটি প্রচলিত ধারণা হল, সম্রাট আওরঙ্গজেব অসংখ্য হিন্দু মন্দির ধ্বংস করেছিলেন। অনেক ঐতিহাসিক বলেন, তাঁর নির্দেশে পাঁচ হাজারেরও বেশি মন্দির ধ্বংস করা হয়েছিল, শুধু ১৬৭৯ সালেই নাকি ২০০টির বেশি মন্দির ভাঙা হয়। কিন্তু বাস্তবিকভাবে এই সংখ্যাগুলি নিয়ে মতভেদ রয়েছে। মা-আসির-ই-আলমগির’-এ কিছু বিবরণ থাকলেও, অন্য অনেক সূত্রে দেখা যায় যে, আওরঙ্গজেব বহু মন্দির সংরক্ষণ করেছিলেন। সম্রাটের একটি উল্লেখযোগ্য নির্দেশ ছিল, হিন্দুদের ধর্মীয় স্বাধীনতা রক্ষার জন্য বিশেষ ফরমান জারি করা। একবার বারাণসীতে কিছু মুসলমান অত্যুৎসাহী হয়ে মন্দির ও পূজারীদের উপর আক্রমণ করেছিল। পূজারীরা সম্রাটের কাছে নালিশ জানালে, তিনি অবিলম্বে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন এবং এক ফরমান জারি করে ঘোষণা করেন, “ইসলামি বিধান অনুসারে হিন্দুদের উপাসনালয়গুলির রক্ষণাবেক্ষণ করা হবে। আমাদের কাছে সংবাদ এসেছে যে, কিছু মুসলিম সম্প্রদায়ের লোক বারাণসীতে হিন্দুদের উপাসনায় বাধা দিচ্ছে এবং তাদের পূজার অধিকারে হস্তক্ষেপ করছে। ফলে তাদের মনে দুঃখ ও ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। অতএব, এই ফরমান জারির মাধ্যমে জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে যে, হিন্দুদের উপাসনার ক্ষেত্রে কোনো বাধা সৃষ্টি করা যাবে না এবং তাদের যাতে নির্বিঘ্নে ধর্মচর্চা চালিয়ে যেতে পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে।”

এই আদেশ থেকে বোঝা যায়, সম্রাট আওরঙ্গজেব শুধুমাত্র ধর্মীয় কারণে মন্দির ধ্বংসের পক্ষপাতী ছিলেন না। বরং তিনি চাইতেন, রাষ্ট্রের শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় থাকুক। তাঁর শাসনামলে বেশ কয়েকটি মন্দির সরকারি অর্থে পুনর্নির্মাণ করা হয়েছিল। কাশ্মীরের বিভিন্ন মন্দিরের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য তিনি জমি ও অনুদান দিয়েছিলেন। এমনকি বিখ্যাত বালাজী মন্দির, যার নাম বহু হিন্দু জানেন, সেটিরও পুনর্নির্মাণ তাঁর নির্দেশেই হয়েছিল। এটি চিত্রকূটের রামঘাটের উত্তর দিকে অবস্থিত। মন্দিরের একাংশে খোদাই করা আছে, “সম্রাট আওরঙ্গজেব নির্মিত বালাজী মন্দির”।

একজন শাসকের দৃষ্টিতে তাঁর প্রজারা ধর্মীয় বিভাজনের ভিত্তিতে বিভক্ত নয়। শাসকের চোখে সকলেই তাঁর শাসনাধীনে সমান, এবং রাষ্ট্রের উন্নতির জন্য সকল সম্প্রদায়ের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান জরুরি। আওরঙ্গজেব মুসলিম হলেও, তিনি কখনোই একপাক্ষিকভাবে মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষার জন্য রাষ্ট্র পরিচালনা করেননি। তিনি শিয়াদের বিরুদ্ধে কঠোর ছিলেন, কিন্তু তার মানে এই নয় যে, তিনি কেবলমাত্র সুন্নিদের বিশেষ সুবিধা দিয়েছিলেন। প্রশাসনের ক্ষেত্রে তিনি ধর্মীয় পক্ষপাতিত্ব করতেন না। বরং দক্ষতা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে নিয়োগ করতেন। তাঁর সময়ে হিন্দুরা প্রচুর মন্দির নির্মাণ করছিল। তবে একটি সময়ে এসে তিনি দেখলেন, অপ্রয়োজনীয়ভাবে একই জায়গায় অসংখ্য মন্দির তৈরি হচ্ছে। অনুরূপভাবে মুসলমানরাও প্রচুর ছোট ছোট মসজিদ নির্মাণ করছিল। সম্রাট আওরঙ্গজেব এই বাড়াবাড়িকে সমর্থন করেননি। তিনি মনে করতেন, মসজিদ বা মন্দির যত বেশি হবে, তত বেশি ধর্মীয় বিভাজন ও অস্থিরতা বাড়বে। তাই তিনি এক নির্দেশে বলেন, “পুরনো যা কিছু আছে, তা থাকবে, কিন্তু নতুন করে অপ্রয়োজনীয়ভাবে কোনো মন্দির বা মসজিদ নির্মাণ করা চলবে না।”

সম্রাট আওরঙ্গজেবের শাসনামলে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছিল, যা তাঁর প্রকৃত স্বরূপকে বুঝতে সাহায্য করে। পাঞ্জাবের এক গ্রামে এক মুসলমান সেনাপতি এক ব্রাহ্মণ কন্যাকে বিবাহের প্রস্তাব দিয়েছিল। সেই ব্রাহ্মণ সম্রাটের কাছে গিয়ে আর্তি জানালে, সম্রাট আওরঙ্গজেব নিজে সাধারণ পোশাকে সেখানে উপস্থিত হন। তিনি সেই সেনাপতিকে কঠোর শাস্তি দেন এবং ব্রাহ্মণ কন্যার সম্মান রক্ষা করেন। এরপর থেকে সেই গ্রামটি ‘আলমগির’ নামে পরিচিত হয়।

এইসব তথ্য থেকে বোঝা যায়, আওরঙ্গজেব ছিলেন এক কঠোর শাসক, কিন্তু কট্টর সাম্প্রদায়িক নন। তিনি প্রজাদের অর্থনৈতিক, সামাজিক উন্নতি চাইতেন এবং তাঁর শাসন নীতিতে বাস্তববাদিতা ছিল। অবশ্যই, তাঁর শাসনামলে বিদ্রোহ হয়েছে। কখনো কখনো তিনি কঠোর নীতি গ্রহণ করেছেন, কিন্তু তা রাজনৈতিক কারণেই। হিন্দু রাজাদের বিদ্রোহ দমন করেছেন, আবার অনেক হিন্দু রাজাকে গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগও করেছেন। তাঁর আমলে ব্রিটিশ, পর্তুগিজ ও ডাচরা ভারতে প্রবেশ করতে শুরু করেছিল। ভারত উপমহাদেশে সাম্রাজ্য টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে উঠছিল। কিন্তু এতদসত্ত্বেও আওরঙ্গজেব টানা পঞ্চাশ বছর শাসন করেছেন। যদি তিনি সত্যিই ধর্মীয় কারণে হিন্দু নিধন করতেন, তাহলে তিনি এতদিন ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারতেন না। আওরঙ্গজেব ছিলেন এমন একজন শাসক, যিনি নিজের নীতির প্রতি কঠোর ছিলেন। তিনি কোরআন শরিফ নিজ হাতে লিখতেন এবং সেই অর্থ থেকে নিজের জীবিকা নির্বাহ করতেন। মৃত্যুর সময় তিনি নিজের দাফনের জন্য মাত্র চার টাকা রেখে যান, বাকিটা দান করে দিতে বলেন।

তাঁকে যারা সাম্প্রদায়িক বলে চিহ্নিত করতে চান, তারা তাঁর শাসনব্যবস্থার বাস্তব দিকটি দেখেন না। তিনি ছিলেন একদিক থেকে কঠোর, কিন্তু অন্যদিকে পরধর্মসহিষ্ণু। তিনি ধর্মের নামে কোনো বাড়াবাড়ি পছন্দ করতেন না, রাষ্ট্রের স্বার্থেই তিনি কঠোর সিদ্ধান্ত নিতেন। আজ ইতিহাসের একাংশ তাঁকে হিন্দু নিধনকারী, মন্দির ধ্বংসকারী শাসক হিসেবে দেখাতে চায়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে, তিনি ছিলেন এমন এক শাসক, যিনি নিজের কর্মদক্ষতা ও শৃঙ্খলার জন্য ইতিহাসে অমর হয়ে রয়েছেন। ভারতের ইতিহাসে মুসলিম শাসকদের শাসনকাল নিয়ে নানা বিতর্ক ও অভিযোগের ভিত্তি নির্মিত হয়েছে। বিশেষত, হিন্দু জনগোষ্ঠীর ওপর অত্যাচার এবং মন্দির ধ্বংসের প্রশ্ন বারবার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এসেছে। কিন্তু এই অভিযোগগুলো কতটা বাস্তবসম্মত, আর কতটা কল্পনাপ্রসূত, তা বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন।

একটি মৌলিক প্রশ্ন হল, যদি মুসলিম শাসকরা সত্যিই হিন্দুদের নির্বিচারে হত্যা করতেন, তাহলে আজকের ভারতে হিন্দু জনসংখ্যা মুসলমানদের চারগুণ বেশি কীভাবে? জন্মহার ও জনসংখ্যার ইতিহাস পর্যবেক্ষণ করলে স্পষ্ট হয়ে যায়, যদি কোনো গোষ্ঠীর ওপর সত্যিকারের গণহত্যা বা ব্যাপক দমনপীড়ন চলত, তাহলে সেই গোষ্ঠী নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত। ভারত থেকে বৌদ্ধধর্মের বিলুপ্তি যেমন ব্রাহ্মণ্যবাদী নির্যাতনের ফলে ঘটেছে, তেমনটি মুসলিম শাসকদের দ্বারা হিন্দুদের ক্ষেত্রে ঘটেনি। ভারতবর্ষের মুসলিম শাসনের প্রকৃত ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, শাসকরা ছিলেন সাম্রাজ্যের কল্যাণে নিবেদিত, ধর্মীয় বিদ্বেষ নয়।

মুসলিম শাসকরা শুধুমাত্র ইসলাম প্রচারের জন্য ক্ষমতায় ছিলেন না, বরং সাম্রাজ্যের শৃঙ্খলা ও উন্নয়ন তাঁদের মূল লক্ষ্য ছিল। প্রশাসনিক কাঠামোতে হিন্দুদের অংশগ্রহণ ছিল সুস্পষ্ট, যা প্রমাণ করে যে তাঁরা কেবলমাত্র মুসলমানদের নয়, বরং দক্ষতার ভিত্তিতে যোগ্য ব্যক্তিদের নিয়োগ করতেন। আওরঙ্গজেবের শাসনামলে মহামতি আকবরের তুলনায় হিন্দু কর্মচারীর সংখ্যা বেশি ছিল। এই সময়ে হিন্দু কর্মকর্তা ও সেনাপতির তালিকায় উল্লেখযোগ্য নামগুলি হল—রাজা রামরূপ সিং, কবীর সিং, অর্ঘনাথ সিং, প্রেমদেব সিং, দিলীপ রায়, রসিকলাল ক্রোরী প্রমুখ। রাজস্ব বিভাগ, সামরিক বাহিনী এবং প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে হিন্দুদের নিযুক্ত করা হয়েছিল। এমনকি গুপ্তচর বিভাগেও হিন্দুদের আধিক্য ছিল। আওরঙ্গজেব একটি ফরমান জারি করে ঘোষণা করেছিলেন যে, প্রশাসনিক দপ্তরে হিন্দু কর্মচারী নিয়োগ করা হবে।

সম্রাট আওরঙ্গজেবের শাসনকাল : (১৬৫৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৭০৭ খ্রিস্টাব্দ)
চিত্রঃ সম্রাট শাহজাহান, Image Source: Google

অনেক ঐতিহাসিক বলেন, আওরঙ্গজেব হিন্দু কর্মচারীদের বিশ্বাস করতেন না, কিন্তু যশোবন্ত সিংয়ের ঘটনা এই দাবিকে খণ্ডন করে। যশোবন্ত সিং ছিলেন একাধিকবার বিশ্বাসঘাতকতার দৃষ্টান্ত, কিন্তু তবুও আওরঙ্গজেব তাঁকে গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ করেছিলেন। শিবাজীর পালানোর ঘটনায় রাজপুত সেনাপতি জয়সিংহের দায়িত্ব ছিল তাঁকে নজরে রাখা, কিন্তু আওরঙ্গজেব কখনও তাঁকে শাস্তি দেননি। উদয়পুরের মহারাজা রাজসিংহের পুত্র ভীম সিংও সম্রাট আওরঙ্গজেবের সেনাবাহিনীতে উচ্চপদে ছিলেন। এত গুরুত্বপূর্ণ পদে হিন্দুদের উপস্থিতি প্রমাণ করে যে আওরঙ্গজেব সাম্প্রদায়িক শাসক ছিলেন না। সম্রাট আওরঙ্গজেবের শাসনামলে সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন শিবাজী, যিনি পরবর্তীকালে মারাঠা শক্তির উত্থান ঘটান। মারাঠারা ভারতীয় ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অংশ, কিন্তু তাঁরা কেবল বীরত্বপূর্ণ কর্মকাণ্ডের জন্যই স্মরণীয় নন, তাঁদের দ্বারা সংঘটিত লুণ্ঠনও ইতিহাসে লিপিবদ্ধ আছে। বাংলায় ‘বর্গি’ নামে কুখ্যাত মারাঠা বাহিনী একাধিকবার আক্রমণ চালিয়েছিল। আলিবর্দি খাঁর আমলে বাংলায় বর্গিদের আক্রমণ জনজীবনকে বিপর্যস্ত করে তুলেছিল। তাঁরা শুধু ধন-সম্পদ লুট করেনি, বরং নারীদের অপহরণ, হত্যা এবং গ্রামগুলিকে সম্পূর্ণ পুড়িয়ে দেওয়ার মতো ভয়াবহ তাণ্ডব চালিয়েছিল।

বাংলার ইতিহাসে মারাঠা লুণ্ঠন এক গভীর ক্ষত সৃষ্টি করেছে। ১৭৪২ থেকে ১৭৫১ সালের মধ্যে বাংলায় একাধিকবার বর্গি আক্রমণ চালানো হয়। আলিবর্দি খাঁ একাধিকবার তাঁদের প্রতিহত করেন, কিন্তু তাঁরা বারবার ফিরে আসে। একসময় বাংলার অর্থনীতি এই বর্গি আক্রমণের ফলে ধ্বংসের পথে চলে গিয়েছিল। বাংলার রেশম ও বস্ত্রশিল্প মারাঠা লুটের ফলে বড়সড় ক্ষতির সম্মুখীন হয়। মারাঠাদের নৃশংসতার কথা মানুষের স্মৃতিতে রয়ে গেছে সেই বিখ্যাত ছড়ায়—

“খোকা ঘুমালো পাড়া জুড়ালো বর্গি এলো দেশে

বুলবুলিতে ধান খেয়েছে খাজনা দেব কিসে?”

মারাঠা লুণ্ঠন কেবল বাংলায় সীমাবদ্ধ ছিল না, তারা গোটা ভারত উপমহাদেশ জুড়েই ত্রাস সৃষ্টি করেছিল। শিবাজী ও তাঁর পরবর্তী মারাঠা শাসকরা রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্জন করতে চাইলেও, তাঁদের বাহিনী বিভিন্ন স্থানে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিল। আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর অনেক পরে মারাঠা শক্তি চরমে পৌঁছায়, কিন্তু তাঁদের আগ্রাসন ও লুটতরাজের ফলেই ব্রিটিশরা ভারত দখলের উপযুক্ত পরিবেশ পায়।

এই সব বিশ্লেষণ থেকে স্পষ্ট যে, মুসলিম শাসকরা শুধু ধর্মের ভিত্তিতে শাসন চালাননি, বরং রাজনৈতিক এবং সামরিক বাস্তবতার ভিত্তিতে তাঁদের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তাঁদের শাসনব্যবস্থায় যোগ্যতার ভিত্তিতে নিয়োগ, রাজস্ব ব্যবস্থার স্থায়িত্ব এবং সাম্রাজ্যের কল্যাণ নিশ্চিত করার দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। ইতিহাসের ভুল ব্যাখ্যার ফলে আজ অনেকেই মনে করেন, মুসলিম শাসকরা হিন্দুদের উপর অত্যাচার চালিয়েছিলেন। কিন্তু বাস্তবতা হল, মুসলিম শাসন টিকে ছিল কারণ তা কেবল ধর্মীয় কারণে নয়, বরং প্রশাসনিক দক্ষতার কারণেও। আওরঙ্গজেবের মতো কঠোর শাসকরাও সাম্রাজ্যের স্থায়িত্বের জন্য বাস্তববাদী নীতি গ্রহণ করেছিলেন। ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ও রাজনৈতিক বাস্তবতার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করাই ছিল তাঁদের প্রধান লক্ষ্য।

শিবাজী এবং মারাঠা শক্তি সম্পর্কে ইতিহাসে বহু বিতর্ক রয়েছে। বিশেষত, হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা শিবাজীকে হিন্দু রক্ষাকর্তা হিসেবে তুলে ধরতে চেয়েছেন, যেখানে ঐতিহাসিক সত্য অনেকাংশেই আলাদা। ইতিহাসের নথি ও পর্যালোচনার মাধ্যমে আমরা দেখতে পাই, শিবাজীর আসল পরিচয় ছিল এক লুটেরা, যোদ্ধা এবং রাজনৈতিক কৌশলবিদ, যার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ক্ষমতার বিস্তার। তাঁর লক্ষ্য ছিল একমাত্র মারাঠা স্বার্থ রক্ষা করা, সমগ্র ভারতের হিন্দুদের নয়। শিবাজীর সময়ে মারাঠা সাম্রাজ্যের উত্থান ঘটেছিল, যা মোগল সাম্রাজ্যের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। মারাঠা বাহিনী মূলত গেরিলা যুদ্ধের ওপর নির্ভরশীল ছিল, যেটি তাদের প্রধান শক্তি হিসেবে কাজ করেছিল। ‘হিট অ্যান্ড রান’ কৌশল ব্যবহার করে তারা মোগল বাহিনীকে ক্ষতিগ্রস্ত করত এবং লুটতরাজ চালাত। অথচ অনেক ঐতিহাসিক শিবাজীর এই যুদ্ধ কৌশলকে মহান বলে আখ্যায়িত করেছেন, যা বাস্তবিক অর্থে সাধারণ মানুষের জন্য ভয়ংকর ছিল। শিবাজীর সেনারা শুধুমাত্র মোগল বাহিনীর ওপর হামলা চালাত না, বরং সাধারণ মানুষের বাড়িঘর লুটপাট, অগ্নিসংযোগ এবং গণহত্যাও করত। তাঁর বাহিনীর নৃশংসতা এতটাই বেশি ছিল যে, বাংলার গ্রামবাসীরা আতঙ্কে ভুগত এবং মারাঠাদের আগ্রাসনের কারণে হাজার হাজার মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিল।

চিত্রঃ ছত্রপতি শিবাজী, Image Source: Google

শিবাজীর নিষ্ঠুরতার একটি জ্বলন্ত প্রমাণ হল শায়েস্তা খাঁর সাথে তাঁর আচরণ। শায়েস্তা খাঁ ছিলেন দক্ষ শাসক, যিনি বাংলার জনগণের শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষায় অবদান রেখেছিলেন। কিন্তু শিবাজী তাঁকে কাপুরুষোচিতভাবে অতর্কিতে আক্রমণ করেন। শায়েস্তা খাঁ কোনোভাবে জীবন রক্ষা করলেও, তাঁর পুত্র শিবাজীর হাতে নির্মমভাবে নিহত হন।

শিবাজী মোগল বাহিনীর সেনাপতি আফজল খাঁকে বিশ্বাসভঙ্গের মাধ্যমে হত্যা করেছিলেন। এক ঐতিহাসিক সাক্ষাতে শিবাজী তাঁর পোশাকের নিচে বাঘনখ লুকিয়ে রেখেছিলেন এবং সাক্ষাৎকারের সময় অতর্কিতে আফজল খাঁকে কুপিয়ে হত্যা করেন। এই ঘটনা শিবাজীর রাজনৈতিক চতুরতার নিদর্শন হলেও, একে কোনোভাবেই নৈতিক বা সম্মানজনক বলা যায় না।

মারাঠা বাহিনীর আক্রমণ বাংলার ওপরও ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল। মারাঠারা বাংলায় বারবার হামলা চালিয়ে গ্রামবাসীদের হত্যা করেছিল, সম্পদ লুট করেছিল এবং গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছিল। বাংলার কৃষি ও অর্থনীতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। বাংলা, বিহার ও ওড়িশা অঞ্চলে মারাঠাদের একাধিক হামলা হয়েছিল, যা বাংলার ইতিহাসে এক ভয়াবহ অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হয়। বাংলার মানুষ তখন এক ভয়ঙ্কর দুর্যোগের সম্মুখীন হয়েছিল। শিবাজীর রাজনৈতিক কৌশল এবং তার সামরিক সাফল্য নিয়ে নানা বিতর্ক থাকলেও, এটি নিশ্চিত যে, তিনি ছিলেন ক্ষমতালোভী এবং কখনোই হিন্দু জাতির একক নেতা ছিলেন না। তাঁর যুদ্ধ ছিল কেবল মারাঠা স্বার্থের জন্য, ভারতীয় হিন্দু সমাজের জন্য নয়। তাঁর বাহিনীর কার্যকলাপ সাধারণ মানুষের জন্য অভিশাপ হয়ে উঠেছিল, বিশেষত বাংলার জন্য। অতএব, শিবাজীর ইতিহাস বিশ্লেষণের সময় আমাদের উচিত সত্যনিষ্ঠ থাকা এবং তাঁকে কেবলমাত্র একজন সামরিক নেতা হিসেবেই বিবেচনা করা, ধর্মীয় নায়ক নয়। ইতিহাসকে নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে বিচার করলে দেখা যাবে, শিবাজীর কর্মকাণ্ড আদৌ নৈতিকতা বা মানবিকতার উদাহরণ ছিল না।

শিবাজী মহারাজ, ভারতের ইতিহাসের এক অমর চরিত্র, যিনি মারাঠা জাতির নেতৃত্বে এক অভূতপূর্ব সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। শিবাজীকে নিয়ে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করা হয়েছে, কিন্তু তার লক্ষ্য ছিল মারাঠা সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা ও বিস্তার, যা ভারতবর্ষে শাসনব্যবস্থা, সংস্কৃতি ও জাতীয়তাবোধে এক নতুন দিশা দেখিয়েছিল। সরদেশাই এর মতে, শিবাজী সারা ভারতে হিন্দু সাম্রাজ্য স্থাপন করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু ইতিহাসবিদ যদুনাথ সরকারের মতে—“শিবাজী যে শুধুই মারাঠা জাতির স্রষ্টা ছিলেন এমন নয়, তিনি ছিলেন মধ্যযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিভাবান জাতীয় স্রষ্টা।”

তবে এ মন্তব্য পুরোপুরি সত্য নয়, কারণ শিবাজীর উদ্দেশ্য ছিল মূলত মারাঠা সাম্রাজ্য স্থাপন এবং এর বিস্তার, এবং কখনোই তিনি হিন্দু সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করেননি। মারাঠাদের কাছে ভারত ভূখণ্ডে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা একটি শাশ্বত লক্ষ্য ছিল, তবে তাদের অস্ত্রশস্ত্রের পরিসর ছিল সীমিত। ফলে শিবাজী ও তার সৈন্যরা ঘোড়ায় চড়ে দ্রুত আক্রমণ করে এবং সেই পথে যুদ্ধের কৌশল ব্যবহার করত। মারাঠাদের সম্পর্কে ইতিহাসে অনেকবার বলা হয়েছে যে, তারা নৃশংস ও অত্যধিক লুটপাটের জন্য কুখ্যাত ছিল, কিন্তু যুদ্ধে তাদের পারদর্শিতা ছিল অনস্বীকার্য। ডিউক অব ওয়েলিংটন, স্যার আর্থার ওয়েলেসলি এবং অন্যান্য ইউরোপীয় সেনাপতিরা মারাঠা বাহিনীর সাহসিকতা ও দক্ষতা দেখে বিস্মিত হয়েছেন। আফগানরাও তাদের প্রশংসা করেছে। মারাঠা বাহিনী ছিল ভারতের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশীয় নৌবাহিনী গড়ে তোলার জন্য খ্যাত, এবং বিশেষ করে তারা আরব সাগরে ব্যাপক লুটতরাজ চালিয়ে অন্যদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছিল।

শিবাজী, যে ব্যক্তি এক বিচ্ছিন্ন অঞ্চলের ক্ষুদ্র জমিদার পরিবারের সন্তান ছিলেন, তিনি মারাঠাদের জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ করে এক ঐক্যবদ্ধ জাতি গঠন করেছিলেন। মারাঠা সমাজে ধর্মীয় সহিষ্ণুতা বজায় রাখা এবং সামাজিক ঐক্য রক্ষা করার প্রচেষ্টা ছিল সুস্পষ্ট। শিবাজী তাঁর শাসনকালের মধ্যে ভারতীয় ভূখণ্ডে বহু দুর্গ ও শক্তিশালী নৌ-বাহিনী গড়ে তুলেছিলেন। তিনি এমন এক নেতা ছিলেন, যার নেতৃত্বে মারাঠারা মধ্যযুগের সবচেয়ে শক্তিশালী সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিল। যদিও শিবাজী চিরকালই মোগলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন, তারপরও তার শাসনব্যবস্থায় মোগল বাদশাহদের সঙ্গে নির্দিষ্ট চুক্তি ও সম্পর্ক বজায় রাখার প্রয়াস ছিল। শিবাজী মোগলদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ নেতা হিসেবে ধরা পড়েন, এবং এক সময় তাঁকে শাহী সম্রাট শাহজাহানের থেকে পাঁচ হাজার ঘোড়া উপহার হিসেবে দেওয়া হয়। শিবাজীর অন্যতম কৌশল ছিল একসময় মোগলদের সঙ্গে চুক্তি করে বিজাপুরে আক্রমণ করা। তবে শিবাজী সবসময়ই প্রজ্ঞার সাথে সংকটের সমাধান করতেন এবং তাকে তাঁর ক্ষমতা সঞ্চয় ও বিস্তার করতে বিশেষ কৌশল ব্যবহার করতে হয়েছে।

মারাঠারা মূলত যুদ্ধ কৌশলে নিপুণ ছিল এবং ঘোড়ায় চড়ে দ্রুত আক্রমণ করার প্রক্রিয়া তাদের কাছে ছিল সাধারণ, যা তাদের অসংখ্য যুদ্ধের মধ্যে বিশেষভাবে পরিচিত। এদের মধ্যে কিছু সেনাপতি, যেমন সিন্ধিয়ার সেনাপতি, ব্রিটিশদেরও পিছু হটতে বাধ্য করেছিলেন, আর মারাঠা শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন ও অস্থিরতা পরবর্তীতে তাদের সাম্রাজ্য ভেঙে দিয়েছিল। মারাঠা সমাজের একক বৈশিষ্ট্য ছিল তাদের পরিবারতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা, যেখানে প্রধানত একাধিক প্রভাবশালী পরিবারের সদস্যরা দেশের শাসনে নিয়োজিত ছিলেন। শিবাজীর আত্মবিশ্বাস এবং নেতৃত্বের দক্ষতার কারণে মারাঠারা ভারতীয় ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে। পরবর্তীতে শিবাজী মারা গেলে, তার শাসনব্যবস্থা অনেকাংশে মারাঠা কনফেডারেশন হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল, যেখানে পেশোয়ারা ছিল প্রধান শাসক। তবে শিবাজীর অধীনে মারাঠা সাম্রাজ্য কখনও সেভাবে স্থিতিশীল হতে পারেনি। একে কেন্দ্র করে বিভিন্ন মারাঠা গোষ্ঠীর মধ্যে অবিশ্বাস ও রেষারেষি ছিল, যা পরবর্তীতে তাদের সাম্রাজ্য ভেঙে পড়ার কারণ হয়েছিল। শিবাজী যে কৌশলে মোগল সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন, তা একসময় তাদের শৃঙ্খল ভাঙতে এবং স্বাধীনতার স্বাদ আস্বাদন করতে সহায়তা করেছিল। মারাঠা সাম্রাজ্যের এই ইতিহাস শুধু একটি সামরিক গল্প নয়, এটি একটি রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য যা আজও প্রাসঙ্গিক। শিবাজী ছিলেন একজন অনন্য নেতা, যিনি তাঁর সময়ের বাস্তবতা অনুযায়ী জাতির জন্য এক নতুন পথ তৈরি করেছিলেন।

আওরঙ্গজেব যখন দাক্ষিণাত্যের গভর্নর হিসেবে তার নতুন কর্মস্থলে যোগদান করেছিলেন, তখন তার মনোযোগ ছিল বিজাপুরের শিয়া সুলতানের দিকে, যিনি তার বিরুদ্ধে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। শাহজাহানের অসুস্থতার খবর পেয়ে, তড়িঘড়ি দিল্লির দিকে রওনা দেন আওরঙ্গজেব। এই সময় বিজাপুরের সুলতান মারাঠাদের শায়েস্তা করার জন্য তৎপর হন। তিনি ৫,০০০ ঘোড়সওয়ার ও ৭,০০০ সৈন্য নিয়ে আফজাল খাঁর নেতৃত্বে শিবাজীকে আক্রমণ করতে পাঠান। শিবাজী এই খবর পেয়ে তৎক্ষণাৎ একটি চতুর পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। তিনি আফজাল খাঁকে একটি চিঠি পাঠান, যেখানে শিবাজী তার অতীত কর্মকাণ্ডের জন্য গভীর দুঃখ ও লজ্জা প্রকাশ করেন এবং আফজাল খাঁর মতো দক্ষ সেনাপতির সঙ্গে যুদ্ধ করার বিষয়টি নিয়ে দুঃখিত হন। তিনি এই প্রস্তাব দেন যে, যদি আফজাল খাঁ চান, তিনি আজকেই তার দুর্গটি তুলে দিতে রাজি আছেন। আফজাল খাঁ চিঠি পেয়ে অত্যন্ত খুশি হন এবং শিবাজীকে তার সঙ্গে দেখা করার আমন্ত্রণ জানান।

দুজনের মধ্যে কুশল বিনিময়ের মুহূর্তে শিবাজী নিজেকে ভীষণভাবে অপ্রতিরোধ্য প্রমাণ করে আফজাল খাঁর পেট চিরে দেয়, যেটি একটি ধারালো অস্ত্র দিয়ে কৌশলে সম্পন্ন করা হয়। পরে শিবাজীর সৈন্যরা আফজালের সৈন্যদের ওপর আক্রমণ করে এবং বিজাপুরের সিপাইদের ওপর বিপুল হামলা চালিয়ে তাদের কেটে ফালা ফালা করে।

শিবাজী তখন পরবর্তী পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করতে থাকেন। তিনি মোগল সাম্রাজ্যে এক ঝটিকা আক্রমণ চালিয়ে বড়ো ধরনের লুটপাট শুরু করেন। আওরঙ্গজেবের শাসনকালে তার তৎকালীন জেলা প্রশাসক শায়েস্তা খাঁ (সম্রাট আওরঙ্গজেবের মামা) মারাঠাদের শিক্ষা দেওয়ার জন্য বিজাপুরে উপস্থিত হন এবং মারাঠা এলাকা দখল করে বসেন। কিন্তু শিবাজী আবারও এক নতুন সাহসিকতার পরিচয় দেন। এক গভীর রাতে, শিবাজী কিছু শাগরেদ নিয়ে শায়েস্তা খাঁর বাড়িতে হামলা চালান। শায়েস্তা খাঁ প্রাণে বাঁচলেও তার একটি আঙুল কাটা পড়ে। এরপর শিবাজী সুরাট আক্রমণ করে এবং বিশাল লুটের ভাণ্ডার গড়ে তোলেন, যদিও ব্রিটিশ এবং পর্তুগিজরা লুটের কাজে বাধা দেয়। তখন শিবাজী নিজেকে ‘রাজা’ উপাধি গ্রহণ করেন এবং নিজের মুদ্রা বাজারে ছড়িয়ে দেন। শিবাজী, যিনি আগে কোনো নৌবাহিনী গড়েননি, এবার তলে তলে একটি শক্তিশালী নৌবাহিনী তৈরি করতে শুরু করেন। এই নৌবাহিনীর মাধ্যমে তিনি মক্কাগামী হজযাত্রীদের জাহাজ আক্রমণ করতে থাকেন। আওরঙ্গজেব অত্যন্ত ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন এবং জয়ের সিং ও দলীর খাঁর অধীনে সৈন্য প্রেরণ করেন। কিন্তু শিবাজী চুক্তি করতে বাধ্য হন এবং মোগলদের অধীনে এক চতুর্থাংশ রাজস্ব পেলেও তিনি মারাঠি অধিকৃত এলাকা মোগলদের কাছে ছেড়ে দেন। এরপর, শিবাজী যখন দিল্লি পৌঁছান, তখন তাকে কোনো সম্মান প্রদান না করে, সামান্য ক্যাপ্টেন মেজরের সম্মান দেওয়া হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে শিবাজী মর্মাহত হন। এক পর্যায়ে তিনি মেজর জেনারেল বা গৌরবের যোগ্য সম্মান না পেয়ে তার সম্মানহানির প্রতিবাদে পালিয়ে যান। দিল্লি থেকে পালানোর পর তিনি জয়ের সিংয়ের সাহায্যে গোপনে ফিরে আসেন এবং শিবাজী আবার রায়গড়ের রাজধানীকে নিজের অধিকারী ঘোষণা করেন।

তার শাসনকাল জুড়ে, শিবাজী কখনও ধর্মীয় বিভাজন বা সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করেননি, বরং মারাঠি জাতির স্বার্থে তিনি কখনও পিছু হটেননি। বিশেষ করে, যখন শিবাজীকে হিন্দুবাদী নেতা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, তখন তিনি কখনও এ ধরনের রাজনীতি করতেন না। তবে, তার নিজস্ব জাতিগত ও সাংস্কৃতিক পরিচয় বজায় রেখে মারাঠি জাতির স্বার্থে সর্বদা কাজ করেছেন। আজও মারাঠিদের জাতীয়তাবোধে শিবাজীর বিশেষ স্থান রয়েছে, যা বহু বছর ধরে রাজনীতি, সমাজ এবং ইতিহাসে তার প্রভাবের প্রতীক হয়ে রয়েছে। এর মধ্যেই, শিবাজী যেমন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন, তেমনি তিনি তার সৈন্যদের কৌশল, সাহসিকতা এবং শক্তির মাধ্যমে একটি ঐতিহাসিক সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

সম্রাট আওরঙ্গজেবের শাসনকালে, তার অঙ্গীকারগুলি, বিশেষ করে হিন্দুদের বিরুদ্ধে অত্যাচার ও ধর্মীয় দমন-পীড়নের কারণে তিনি প্রখ্যাত। পাঠ্যবইগুলোতে সম্রাট আওরঙ্গজেবের অত্যাচারের বহু কাহিনী বিবৃত হয়েছে। বলা হয়ে থাকে যে, তিনি গুজরাটের সোমনাথ মন্দির, বারাণসীর বিশ্বনাথ মন্দির এবং মথুরার কেশব রায় মন্দির ধ্বংস করেছিলেন। তার শাসনকালেই মথুরার নাম পরিবর্তন করে ইসলামাবাদ রাখা হয়েছিল। আওরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে আরো অভিযোগ রয়েছে যে, তিনি হিন্দুদের ওপর হিন্দু শুল্ক আরোপ করেছিলেন, আর মুসলিমদের ওপর কর কমিয়ে দিয়েছিলেন। এমনকি তার শাসনে রাজপুতদের ধীরে ধীরে সরকারী পদ থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এছাড়া, তিনি তার ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে শিখ গুরুর জীবনও গ্রহণ করেছিলেন, যার মধ্যে তেগ বাহাদুর ছিলেন অন্যতম। তার মৃত্যুর পর, গুরুর পুত্র গোবিন্দ সিংহের নেতৃত্বে শিখরা দীর্ঘদিন মোগলদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়েছিলেন।

সম্রাট আওরঙ্গজেব, যিনি একটি ধর্মান্ধ ও অত্যাচারী শাসক হিসেবে পরিচিত, তার সময়কালেও ভারতের বহু জাতি-সম্প্রদায়ের মানুষের জীবনে গভীর ছাপ ফেলেছিল। আওরঙ্গজেবের শাসনকালে মোগল সাম্রাজ্য দক্ষিণ ও মধ্য পশ্চিম ভারতকে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য যুদ্ধ পরিচালনা করে। তার নেতৃত্বে মোগল সেনারা দুটি মুসলিম শাসিত রাজ্য, বিজাপুর এবং গোলকুণ্ডা দখল করে। এই যুদ্ধগুলোতে মোগল সেনারা প্রথমবার রকেট এবং গ্রেনেড ব্যবহার শুরু করে, যা একদিকে ছিল ভারতীয় উপমহাদেশের সামন্তবাদী ব্যবস্থার ভাঙনের লক্ষণ, অন্যদিকে উদীয়মান দেশি পুঁজিবাদের সঙ্কেত। ১৬৬৩ সালে, আওরঙ্গজেবের নির্দেশে মোগল সরকার লেহ ও লাদাখে তাদের শক্তি প্রতিষ্ঠা করে। তার রাজত্বের সময় মোগল সাম্রাজ্য তার পিতার শাসনকে ছাড়িয়ে আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। সম্রাট আওরঙ্গজেবের শাসন ছিল সম্রাটের প্রতিকূল, যার লক্ষ্য ছিল সাম্রাজ্য বাঁচিয়ে রাখা এবং তার বিস্তার ঘটানো।

এখনকার মতো ধর্মনিরপেক্ষ সরকার তখনকার সময়ে সম্ভব ছিল না। ষোড়শ শতকে, যখন আওরঙ্গজেব রাজত্ব করছিলেন, তখন ধর্মনিরপেক্ষতা একটি অবাস্তব ধারণা ছিল। রাজা-সম্রাটরা তখন তাদের সভার ধর্মগুরুদের পরামর্শ নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতেন। এ সময় ভারতীয় সমাজও ছিল কঠিন সামন্ততান্ত্রিক কাঠামোর অধীন, যেখানে জনগণ ধীরে ধীরে এই ব্যবস্থা থেকে মুক্তি চেয়েছিল। ব্রাহ্মণ্যবাদ যেভাবে শত শত বছর ধরে ভারতীয় জনগণের ওপর চেপে বসেছিল, সম্রাট আওরঙ্গজেবের মতো মোগল সম্রাটরা সে শাসনব্যবস্থা পরিবর্তন করেনি, বরং সাম্রাজ্য বাঁচানোর জন্য তাদের রাজনীতি চালিয়ে গিয়েছেন।

শিখ গুরু গোবিন্দ সিংহের সঙ্গে সম্রাট আওরঙ্গজেবের দীর্ঘকালীন লড়াই চলেছিল, এবং অনেকেই মনে করেন, এই লড়াইয়ের পেছনে পাহাড়ি রাজ্যের হিন্দু রাজাদের প্ররোচনা ছিল, যারা মোগল সম্রাটের কাছে শিখ গুরুকে পরাস্ত করার আবেদন জানিয়েছিলেন। তবে গুরু গোবিন্দ সিংহের সঙ্গে ছিলেন মুসলমানদেরও একটি বড় অংশ, এবং মোগল সম্রাটের পক্ষেও ছিলেন অনেক হিন্দু। এ পরিস্থিতিতে গুরু গোবিন্দ সিংহ আওরঙ্গজেবকে সমালোচনা করেছিলেন, কেননা তিনি একজন পৌত্তলিক পূজারীকে লক্ষ্য করে সমালোচনা করছেন, যদিও তিনি নিজে পৌত্তলিক ছিলেন না। একই সময়ে, মোগল সম্রাট মহারাষ্ট্রে শিবাজীর বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালান এবং পরে শিবাজীর পুত্রকে হত্যা করেন।

চিত্রঃ গুরু গোবিন্দ সিং, Image Source: Google

এগুলো সম্ভবত ব্রিটিশ শাসকদের পরিকল্পনার অংশ ছিল, যারা হিন্দু-মুসলিম বিভাজন তৈরি করতে চেয়েছিলেন এবং ভারতের জনগণের মধ্যে ঘৃণা ছড়ানোর কাজ করেছিলেন। ব্রিটিশরা মোগল সাম্রাজ্যের ইতিহাস বিকৃত করে, বিশেষত আওরঙ্গজেবের শাসনকালে তাঁর সামরিক অভিযানগুলোর রাজনৈতিক দিককে ভুলভাবে উপস্থাপন করেছে। তবে, একথা সত্য যে, আওরঙ্গজেবের সমস্ত সামরিক কর্মকাণ্ড ছিল রাজনীতি এবং সাম্রাজ্য বিস্তার লাভের উদ্দেশ্যে, ধর্মের প্রচারের চেয়ে বেশি কিছু ছিল না। তাঁর মতে, “পিতা যদি কোনো কার্য সম্পন্ন করতে অসমর্থ হয়, তাহলে তাঁর পুত্রকে অবশ্যই সেই অসম্পূর্ণ কাজ সম্পূর্ণ করতে হবে।”

মোগল শাসকদের বিরুদ্ধে ব্রিটিশদের প্রচারণা ছিল দুর্দান্ত। তারা ইতিহাসের পাতায় একেকটি চিত্র এঁকেছিল, যা ভারতীয় জনগণের মধ্যে বিভক্তি তৈরি করার জন্য। এর ফলে, স্কুল-কলেজে আওরঙ্গজেব সম্পর্কে পক্ষপাতদুষ্ট এবং নেতিবাচক শিক্ষাদান করা হত, যাতে নতুন প্রজন্ম তার সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা পায়। এসব কারণে, ব্রিটিশ শাসনের অধীনে ইতিহাসের ভুল পাঠ সঞ্চালিত হয়েছে, যা ভারতের উন্নতির পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

এলাহাবাদের সরবেস্বারি কলেজের অধ্যাপক ও ঐতিহাসিক প্রদীপ কেশরবানি ‘The Times of India’কে বলেছেন, আওরঙ্গজেব সোমেশ্বর মহাদেব মন্দিরের জন্য এক বিশাল অঙ্কের টাকা এবং ভালো জায়গা অনুমোদন করেছিলেন। তাঁর বক্তব্যের সমর্থনে, তিনি কিছু ঐতিহাসিক ঘটনা তুলে ধরেন, যেখানে আওরঙ্গজেব মন্দিরের দেখাশুনা এবং খরচ খরচা দিতেন, এমনকি ভালো জমি দান করেছিলেন। তার মতে, এই ধরনের ঘটনা ‘ধর্মদণ্ড’ নামে একটি ধর্মীয় পিলারে উল্লিখিত রয়েছে। এছাড়া, তিনি আরও জানান যে, বিভিন্ন মন্দির কমিটির কাছে দান করার দলিল রয়েছে যা স্পষ্ট করে আওরঙ্গজেবের ধর্মীয় সহিষ্ণুতা। অতএব, আওরঙ্গজেব ধর্মপ্রাণ হলেও অত্যাচারী ছিলেন না। ব্রিটিশদের ষড়যন্ত্রে এবং তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে, তার বিরুদ্ধে মিথ্যা ইতিহাস রচিত হয়েছিল। পার্সিভ্যাল স্পিয়ার মন্তব্য করেছেন, “আকবরের নীতির সঙ্গে আওরঙ্গজেবের নীতির যে পার্থক্য, তা হল, আওরঙ্গজেব সচেতনভাবে হিন্দুদের প্রতি সহিষ্ণুতা দেখাতেন না এবং তাঁদের কখনো সমমর্যাদা দিতেন না।” তবে, তাঁর ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা আসলে একটি কিংবদন্তী যা কিছু ঘটনার ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে।

গবেষক জাহিরউদ্দিন ফারুকি তাঁর গ্রন্থে আওরঙ্গজেবের ধর্মনীতির ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি উল্লেখ করেন যে, আওরঙ্গজেব হানিফার ইসলামি ব্যাখ্যার অনুরাগী ছিলেন, যার মাধ্যমে মুসলিম রাষ্ট্রে অমুসলিমদের জীবন, ধর্ম এবং সম্পত্তির নিরাপত্তার ব্যবস্থা ছিল। তিনি কোনোদিনই হিন্দু নির্যাতন নীতি অনুসরণ করেননি, বরং বিভিন্ন সময়ে হিন্দুদের নিয়ে রাজস্ব বিভাগে সমতা আনার চেষ্টা করেছিলেন। তাঁর রাজত্বে রাজপুত, সৈয়দ ও মোগলরা উচ্চপদে ছিলেন, এবং অনেক হিন্দু কর্মচারী তার রাজত্বে কাজ করতেন। অতএব, আওরঙ্গজেবের শাসনকালে তার ধর্মনিরপেক্ষতা এবং রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি একটিই ছিল— সাম্রাজ্যকে বাঁচিয়ে রাখা এবং বিস্তার ঘটানো। তিনি কোনো ধরনের ধর্মীয় বিদ্বেষ বা হিন্দু-মুসলিম বিভাজন করতে চাননি। তার সাম্রাজ্য কায়েম ছিল রাজনৈতিক, এবং তিনি যে কাজ করেছেন তা ছিল সাম্রাজ্য রক্ষার প্রয়োজনে।

প্রিয় পাঠক, আপনি হয়তো মনে করেন, সম্রাট আওরঙ্গজেব মুসলিম ছিলেন বলেই তিনি বিধর্মী হিন্দুদের মন্দির ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছেন। কিন্তু, এটি পুরোপুরি সঠিক নয়। মুসলিম শাসকরা শুধুমাত্র মন্দির ভেঙেছেন এমন ধারণা অনেকাংশেই ভুল। মন্দির ভাঙার ঘটনা ইতিহাসের অনেক আগেও ঘটেছিল, এবং শুধু মুসলিম শাসকরা নয়, হিন্দু শাসকরাও এমন কাজ করেছেন। যেকোনো প্রয়োজনবোধে মন্দির, মসজিদ, বা অন্যান্য ধর্মীয় স্থাপনা ধ্বংস করা হতো, যা শুধুমাত্র রাজনৈতিক কিংবা সামরিক পরিস্থিতির সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল, ধর্মের প্রচার বা বিরোধিতার উদ্দেশ্যে নয়।

সম্রাট আওরঙ্গজেব, যিনি একজন নিষ্ঠাবান হানিফি মুসলিম ছিলেন এবং কোরান ও হাদিসের অনুসরণে চলতেন, তিনি মন্দির ধ্বংসের জন্য প্রকৃত কারণ হিসেবে ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেননি। কোরান ও হাদিসে বিধর্মীদের উপাসনাগৃহ ভেঙে দেওয়ার কোনও সুপারিশ নেই। যদি এমন কোনো ধর্মীয় নির্দেশ থাকতো, তবে ভারতে এত এত প্রাচীন মন্দির আজও বিদ্যমান থাকতো না। তাছাড়া, মুসলিম শাসকরা একমাত্র মন্দির ভাঙতেন এমন কথা বলা ঠিক নয়। ইতিহাসে এমন বহু উদাহরণ রয়েছে যেখানে হিন্দু রাজারা অন্য ধর্মের মন্দির ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছেন।

ভারতে হিন্দু রাজা-শাসকরা মন্দির ধ্বংস করার প্রথা চালু রেখেছিলেন। শশাঙ্ক, রাজা হর্ষ, পুষ্যমিত্র, অজাতশত্রু, রাজা সুভাতবর্মন, চন্দ্রগুপ্ত, হর্ষবর্ধন, দ্বিতীয় পুলকেশী, মহেন্দ্রবর্মা, রাজেন্দ্র চোল – এদের শাসনকালে বহু হিন্দু-বৌদ্ধ-জৈন মন্দির ধ্বংস হয়েছে। এমনকি রাজপুত শাসক সুভাতবর্মন গুজরাট আক্রমণকালে বহু জৈন মন্দির লুট করেছেন। চোল বংশের সম্রাট রাজা চোল এবং রাজাধিরাজ চোলের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তারা তাদের রাজ্যের জৈন মন্দির ধ্বংস ও লুট করেছেন। এই ধ্বংসের ইতিহাস মুসলিম শাসনের আগেও বিদ্যমান ছিল। কাশ্মীরের ইতিহাসকার কলহনের পিতা চম্পক তাঁর গ্রন্থ ‘রাজতরঙ্গিনী’তে লিখেছেন যে, রাজা হর্ষ শুধু বৌদ্ধ ধর্মীয় স্থাপনা নয়, এমনকি গ্রাম, নগর বা শহরের প্রতিটি মন্দির আক্রমণ করেছিলেন। তিনি মন্দিরের বিগ্রহ তুলে নিয়ে যেতেন এবং এর জন্য বিশেষ কর্মচারী নিয়োগ করেছিলেন, যাদের নাম ছিল ‘দেবোৎপাটননায়ক’। কলহন এদের কর্মকাণ্ড বর্ণনা করেছেন, যা মুসলিম শাসকদের ক্ষেত্রেও দেখা যায় না। বিভিন্ন সময়ে হিন্দু রাজারা যে মন্দির ধ্বংস ও লুণ্ঠন করেছেন, তা ইতিহাসের অঙ্গ হিসেবে পুরোপুরি তুলে ধরা হয়নি। যেমন, মিহিরকুল, পাণ্ড্য রাজা শ্রীবল্লভ, ললিতাদিত্য, রাজা কপিলেন্দ্র – এরা সকলেই বৌদ্ধ মন্দির ধ্বংস ও লুণ্ঠন করেছেন। এমনকি ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের সময়, এটি মূলত হিন্দু গোষ্ঠীর একটি রাজনৈতিক কাজ ছিল। তবে, আপনি যদি শুধু মুসলিম শাসকদের ক্ষেত্রেই মন্দির ভাঙার অভিযোগ তোলেন, তা একপাক্ষিক হবে। মুসলিম শাসকরা যেমন কখনো কখনো মন্দির ভেঙেছেন, তেমনি হিন্দু শাসকরাও রাজনৈতিক কারণে বা ধর্মীয় বিরোধের জন্য মন্দির ধ্বংস করেছেন। ৬৯৩ সালে চালুক্য রাজা উত্তর ভারতে অভিযান চালিয়ে পরাজিত রাজাদের মন্দির থেকে গঙ্গা ও যমুনার মূর্তি লুণ্ঠন করেছিলেন। সপ্তম শতকে, কাশ্মীরের রাজা ললিতাদিত্য তাদের আক্রমণে পালরাজাদের রাষ্ট্রদেবতা রামস্বামী মন্দির ধ্বংস করেন। এক্ষেত্রে, তেমনই শিখদের নেতৃত্বে, জাঠ গোষ্ঠীও বহু মন্দির ধ্বংস করেছিল।

এখানে প্রশ্ন আসতে পারে, হিন্দুদের কাছে কি মুসলিমদের বিরুদ্ধে ধর্মান্তরিত হওয়ার অভিযোগের কোনো ভিত্তি রয়েছে? প্রকৃতপক্ষে, কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া, এই অভিযোগের বাস্তবতা প্রশ্নবিদ্ধ। মুসলিম শাসনের ১,০০০ বছরের ইতিহাসে, একজন মুসলিম শাসকও ভারতীয়দের জোরপূর্বক মুসলিম করার চেষ্টা করেননি। যদি তা হয়ে থাকতো, তাহলে আজ ভারতীয় মুসলিমদের সংখ্যা এতটা কম না হয়ে হিন্দুদেরই বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকত না। তবে, হিন্দুদের অত্যাচারে বৌদ্ধ ধর্ম হারিয়ে গেছে, আর মুসলিম ধর্মের প্রতি কিছু সমাজের মানুষের ঝোঁক ছিল, এটি একটি অস্বীকার্য সত্য। ভারতে বৌদ্ধদের সংখ্যা কমে যাওয়ার পেছনে হিন্দুদের অত্যাচারের ভূমিকা ছিল। হিন্দুরা বৌদ্ধদের শাস্তি দিয়েছিল, তাদের ধর্মীয় স্থাপনাগুলো ধ্বংস করেছিল, যা ব্রাহ্মণ্যবাদীদের অত্যাচারের অংশ। আজও ভারতের বৌদ্ধ সমাজ প্রায় বিলুপ্তপ্রায়। তেমনি, অনেক শর্তে হিন্দুদের কাছে বৌদ্ধরা ধর্মান্তরিত হয়েছিল এবং মুসলিম ধর্মেও যোগ দিয়েছিল। তবে, ভারতে আজও যেখানে ব্রাহ্মণদের মন্দির রয়েছে, সেখানে এক সময় বৌদ্ধ ধর্মের কেন্দ্র ছিল। অনেক ধর্মীয় স্থান, যেমন অযোধ্যা, কাশী, মথুরা, পুরী, তিরুপতি প্রভৃতিতে বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব ছিল, যেগুলি পরে হিন্দু ধর্মের অন্তর্গত হয়ে যায়।

এটি বলার সময়, সবই রাজনৈতিক ও ধর্মীয় ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের ফলাফল। ভারতীয় ইতিহাসের এই অংশগুলোর গবেষণা প্রয়োজনীয়, যাতে এর আসল কারণ ও প্রভাবগুলো সঠিকভাবে নিরূপণ করা যায়।

সপ্তম শতাব্দীর চৈনিক বৌদ্ধ পর্যটক হিউয়েন সাঙের ভ্রমণবৃত্তান্ত থেকে ভারতের প্রাচীন ধর্মীয় ও সামাজিক অবস্থার অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উঠে আসে। হিউয়েন সাঙ ভারতের বৌদ্ধ ধর্মের প্রসার এবং তার পতনের নানা দিক পর্যালোচনা করেছেন। তবে তিনি বৌদ্ধ ধর্মকে একসময় অনেকাংশে মন্দির ও স্তূপের ধ্বংসের মুখে পরাজিত এবং মৃতপ্রায় একটি সত্তা হিসেবে দেখতে পেয়েছিলেন। চালুক্য শাসনের অধীনে, যাদের বিরুদ্ধে হিউয়েন সাঙ কিছুটা নিরপেক্ষ থেকেও মন্তব্য করেছেন, বৌদ্ধ ধর্ম ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। তার মতে, অন্ধ্র এবং পল্লব শাসকদের উত্থানে গড়ে ওঠা অনেক বৌদ্ধ মন্দির ও স্তূপ পরিত্যক্ত বা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল। এ সময় বৌদ্ধ ধর্মের সমর্থকদের শিব উপাসনার মতো অন্য ধর্মীয় শক্তি দ্বারা আক্রমণ ও নিপীড়ন সহ্য করতে হয়েছিল।

হিউয়েন সাঙ তার বাংলা ভ্রমণে বাংলার শাসক শশাঙ্ককে বিশেষভাবে আক্রমণ করেছেন। তিনি শশাঙ্ককে ‘বিষাক্ত গৌড় সাপ’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন, কারণ শশাঙ্ক বাংলার বৌদ্ধ মন্দিরগুলো ধ্বংস করেছিলেন এবং একে একে বৌদ্ধ সন্তদের শিরোস্কার প্রদান করার মাধ্যমে হুমকি জারি করেছিলেন। শশাঙ্ক শুধু মন্দির ধ্বংসই করেননি, বরং বৌদ্ধদের বিরুদ্ধে তার নিপীড়ন ছিল অত্যন্ত ঘৃণিত। তিনি বুদ্ধগয়ার বোধিবৃক্ষও কেটে ফেলেন এবং সেখানে শিবলিঙ্গ স্থাপন করেন, যা বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি তার গভীর বৈরিতার প্রমাণ। ব্রাহ্মণ্যবাদী আখ্যানগুলো পর্যালোচনা করলেই স্পষ্ট হয়, কিভাবে বৌদ্ধদের প্রতি অবর্ণনীয় শ্লেষ ও বর্বরতা ছিল। এর মধ্যে এক উজ্জ্বল উদাহরণ হলো অষ্টম শতাব্দীর বিখ্যাত ব্রাহ্মণ্যবাদী দার্শনিক শঙ্করাচার্যের মন্তব্য, যেখানে তিনি বুদ্ধকে ‘জনতার শত্রু’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। এমনকি বৌদ্ধদের ধ্বংস এবং তাদের থেকে শিক্ষা চুরি করে নিজেদের ধর্মের মোহর লাগিয়ে প্রচার করার কাজ ব্রাহ্মণ্য ধর্মের অঙ্গ হিসেবে পরিণত হয়েছিল।

এখানে কিছু উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে যেখানে ব্রাহ্মণ্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গি বৌদ্ধ ধর্মের আচার-প্রচলন গ্রহণ করেছে, যা পরে তাদের নিজেদের ধর্মীয় আচরণের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রথম উদাহরণটি হলো ‘গুরু পূর্ণিমা’। বৌদ্ধ ধর্মে আষাঢ়ী পূর্ণিমার দিনটি গুরু পূর্ণিমা হিসেবে পালন করা হতো, কারণ এটি ছিল সেই দিন, যখন গৌতম বুদ্ধ প্রথমবার পাঁচ ঋষি বা পরিব্রাজককে দীক্ষা দিয়েছিলেন। পরে এই অনুষ্ঠানটি ব্রাহ্মণ্য ধর্মের টীকাদাররা নিজেদের মধ্যে গড়ে তুলে, এবং ‘গুরু পূর্ণিমা’ হিসেবে প্রচলিত হয়ে ওঠে।

কুম্ভমেলার ইতিহাসও একইভাবে ব্রাহ্মণ্যবাদীদের দ্বারা গ্রহণ করা হয়েছিল। মূলত, কুম্ভমেলা শুরু করেছিলেন বৌদ্ধ সম্রাট হর্ষবর্ধন, যার উদ্দেশ্য ছিল বুদ্ধের বিচারধারা এবং শিক্ষা সর্বসাধারণের কাছে পৌঁছে দেওয়া। তবে, বৌদ্ধধর্মের পতনের পর ব্রাহ্মণরা এই মেলা তাদের নিজস্ব ধর্মীয় আচার হিসেবে প্রচলিত করতে শুরু করেন, যেখানে ভক্তরা বিশাল আকারে সমবেত হন। ব্রাহ্মণ্যবাদীরা বৌদ্ধ ধর্মের অনেক মূল্যবান ধারণা গ্রহণ করে নিজেদের ধর্মীয় পরিপ্রেক্ষিতে আনার চেষ্টা করেছেন। উদাহরণস্বরূপ, ‘চারধাম যাত্রা’। বৌদ্ধ ধর্মে চারটি পুণ্যস্থান, যেমন লুম্বিনী, বুদ্ধগয়া, সারনাথ এবং কুশীনগর, ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বৌদ্ধ ভিক্ষুরা জীবনে একবার অন্তত এই চারটি পুণ্যস্থানে যাত্রা করার জন্য অনুপ্রাণিত হতেন। তবে, ব্রাহ্মণ্যবাদীরা এই ধারণা গ্রহণ করে তাদের নিজস্ব ধর্মীয় স্থানগুলিকে ‘চার ধাম’ হিসেবে পরিবর্তিত করে এবং চার ধাম যাত্রার প্রথা চালু করে। এছাড়া, বৌদ্ধ ধর্মের ‘জাতককথা’ ব্রাহ্মণ্যবাদীরা নিজেদের ধর্মে আত্মসাৎ করে ফেলেছে। জাতককথাগুলো ছিল বৌদ্ধ ধর্মের অন্তর্গত একটি শিক্ষা ব্যবস্থা, যেখানে বুদ্ধের বোধিসত্ত্বের দশ পরমী অনুশীলন বর্ণিত হয়েছিল। পরবর্তীকালে, ব্রাহ্মণ্যরা জাতককথাগুলো নিজেদের সংস্করণে রূপান্তরিত করে, যা তারা রামায়ণ এবং মহাভারতের কাহিনির সঙ্গে যুক্ত করে তাদের সংস্কৃতিতে গ্রহণ করে। এইভাবে, বৌদ্ধধর্ম এবং তার বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠানকে ব্রাহ্মণ্যবাদীরা নিজেদের ধর্মের অংশ হিসেবে পরিবর্তিত করেছেন। এমনকি বিজয়া দশমী বা দশহরা উদযাপনও বৌদ্ধ সম্রাট অশোকের সময়কাল থেকে শুরুর পরিবর্তে, ব্রাহ্মণ্যবাদীরা রামায়ণের রাম-রাবণের কাহিনি যুক্ত করে দশহরা উৎসব উদযাপন করতে শুরু করেন।

ব্রাহ্মণ্যবাদীরা বৌদ্ধ ধর্মের অনেক বিষয় চুরি করেছে, কিন্তু মুসলিম শাসকদের বিরুদ্ধে তেমন কোনো কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি। বৌদ্ধরা অহিংসায় বিশ্বাসী ছিলেন এবং প্রাণী হত্যা করা তাদের পক্ষে নিষিদ্ধ ছিল, তাই তারা ব্রাহ্মণ্যবাদীদের বিরুদ্ধে পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেননি। মুসলিম শাসকদের বিরুদ্ধে বৌদ্ধদের আন্দোলন ছিল দুর্বল, কারণ মুসলিম শাসকরা ছিলেন দক্ষ যুদ্ধবিদ্যা এবং শাসন ব্যবস্থার ক্ষেত্রে অত্যন্ত নিষ্ঠুর। বিপরীতে, হিন্দুরা মুসলিম শাসকদের কাছে আত্মসমর্পণ করে চাকরি বা অন্যান্য সুবিধা গ্রহণ করতে শুরু করেছিল। মুসলিম শাসনামলে ভারতের রাজনৈতিক চিত্র ছিল এমন, যেখানে ব্রাহ্মণ্যবাদীরা তাদের প্রভাব বজায় রেখেছিল, কিন্তু এক্ষেত্রে মুসলিম শাসকরা ব্রাহ্মণ্যবাদী শক্তির বিপরীতে কার্যকর প্রতিবাদ করতে সক্ষম হয়নি। বৌদ্ধদের মতো হিন্দুরাও ব্রাহ্মণ্যবাদী অত্যাচারের শিকার হয়ে হারিয়ে গিয়েছিল। এভাবে ভারতীয় ইতিহাসে বৌদ্ধ ধর্মের ধ্বংসের একটি বড় কারণ ছিল ব্রাহ্মণ্যবাদীদের অত্যাচার এবং মুসলিম শাসকদের বিরুদ্ধেও তাদের অসম্পূর্ণ প্রতিরোধ ব্যবস্থা।

চার্বাক দর্শন ছিল ব্রাহ্মণ্যবাদের বিপরীতে এক মৌলিক দর্শন, যা মূলত নিরীশ্বরবাদী ও বস্তুবাদী ছিল। এটি এমন একটি দর্শন, যা ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিক বিশ্বাসের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে মানবজীবনের বাস্তবতা এবং যুক্তির পক্ষে ছিল। চার্বাক দর্শন অনুযায়ী, জীবন ও জগতের কোনো কিছুই অদৃশ্য বা অতীন্দ্রিয় নয়, সব কিছুই নিতান্তই দেহগত ও বস্তুগত। দেবগুরু বৃহস্পতি, যিনি চার্বাক দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে পরিচিত, তাঁর নামের সঙ্গে এ দর্শনের পরিচয় একাকার হয়ে গেছে। চার্বাকরা বেদকে অস্বীকার করতেন এবং এটিকে ব্রাহ্মণদের এক রকম ভণ্ডামি হিসেবে চিহ্নিত করতেন। তাঁদের মতে, বেদ অপৌরুষেয় নয়, কারণ যদি বেদের স্রষ্টাকে কেউ স্মরণ করতে না পারে, তবে এটি প্রমাণিত হয় না যে, সেই বস্তুটি চিরস্থায়ী বা অমর। তারা বলতেন, “যেহেতু বেদকে সৃষ্টি করার কোনো সঠিক ব্যক্তি নেই, তাই এটি কোনো মৌলিক সত্য নয়।” বেদকে তারা ‘ধূর্ত এবং ভণ্ড ব্রাহ্মণের সৃষ্টি’ বলেই মনে করতেন, যা কেবল তাঁদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য তৈরি। তাদের যুক্তি ছিল, যদি বেদে সত্যি সত্যি যজ্ঞের মাধ্যমে পশুবলি দিলে সেই পশু স্বর্গে যায়, তবে ব্রাহ্মণরা কেন নিজেদের বৃদ্ধ পিতামাতাকে বলি দিতেন না, কারণ তাদের জীবনটাই তো স্বর্গ লাভের জন্য।

চার্বাক দর্শনের আরো একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল দেহাত্মবাদ। তারা বিশ্বাস করতেন, জীবন ও মৃত্যুর মধ্যে কোনো আত্মা বা অমর সত্তা নেই, বরং সব কিছু দেহগত এবং কেবলমাত্র মৃত্যুর পর দেহই মৌলিক উপাদানে পরিণত হয়ে যায়। যেহেতু আত্মা কখনোই প্রত্যক্ষ হতে পারে না, তাই ঈশ্বরের অস্তিত্বও তারা অস্বীকার করতেন। চার্বাকরা বলতেন, “যে কিছু অতীন্দ্রিয়, তা একেবারেই অসৎ, কারণ প্রত্যক্ষদৃষ্টিতে যা কিছু উপলব্ধি করা যায় না, তা অবিশ্বাস্য।”

চার্বাক দর্শন ছিল এমন এক বিপ্লবী চিন্তা, যা প্রাচীন ভারতের ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক দৃষ্টিভঙ্গি চ্যালেঞ্জ করেছিল। তাদের মতে, জগতের সব কিছুই মাত্র মৌলিক উপাদানের সমন্বয়ে গঠিত, এবং মৃত্যুর পর মৃতদেহ সেই মৌলিক উপাদানে বিলীন হয়ে যায়। এমন এক ধারণা যা মানুষ তার দৈনন্দিন জীবনের পর্যবেক্ষণ থেকে ধারণা করতে পেরেছিল—মৃতদেহ পচে গলে মাটিতে মিশে যায়, অথবা আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায়। তারা বলতেন, ঈশ্বরের অস্তিত্বও অতীন্দ্রিয় ধোঁকা ছাড়া কিছুই নয়। ঈশ্বর প্রকল্পের মাধ্যমে ভণ্ড ও ধূর্ত ব্রাহ্মণরা অজ্ঞ জনসাধারণকে প্রতারিত করে নিজেদের জীবিকা নির্বাহ করত। চার্বাক দর্শনের তত্ত্ব ব্রাহ্মণ্যবাদীদের কাছে ছিল এক গুরুতর হুমকি। ব্রাহ্মণদের বিরোধিতা করলে সমাজে এক বিপ্লবী পরিবর্তন আসতে পারত, এবং এই কারণেই ব্রাহ্মণ্যবাদীরা তাদের পুথিপত্রগুলো ধ্বংস করতে চেয়েছিল। রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণসহ বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে চার্বাকদের নিন্দা করা হয়েছে। মহাভারতে চার্বাকের নাম একটি দুরাত্মা চরিত্রের সাথে যুক্ত, যার নাম দুর্যোধনের সঙ্গে সম্পর্কিত। আর এই চরিত্রের মাধ্যমে তারা চার্বাক দর্শনকে ঘৃণ্য ও নিন্দনীয় হিসেবে চিত্রিত করেছে। তবে, এক সময়ের মতো, এই দর্শন বিপদজনক হিসেবে তুলে ধরেছিল, কারণ এটি ভাববাদী দর্শনকে চ্যালেঞ্জ করেছিল। অবশ্যই, চার্বাকদের দর্শন যে সময়ের সীমানায় ছিল, তখন তাদের পরিণতি ছিল অত্যন্ত নিষ্ঠুর। তাঁদের বর্ণনা বহু সময়ে অবমাননাকরভাবে প্রকাশিত হয়েছে, বিশেষ করে ধর্মীয় গ্রন্থে। শঙ্করাচার্য যেমন ভাববাদী দৃষ্টিভঙ্গির পক্ষে দাঁড়িয়ে চার্বাকদের “লোকায়ত” বা সাধারণ জনগণের দর্শন হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন। এর উদ্দেশ্য ছিল, যাতে সাধারণ মানুষ এই দর্শনকে ‘নিম্ন’ বা ‘অশুচি’ হিসেবে গন্য করে।

ব্রাহ্মণ্যবাদীদের প্রচারণার কারণে, সাধারণ মানুষ দ্রুত এই দর্শনকে অস্বীকার করতে শুরু করে। এটি শেষ পর্যন্ত মানুষের মধ্যে চার্বাক দর্শন সম্পর্কে এক ধরনের ভয় এবং ঘৃণা সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিল। “চার্বাক” শব্দটিও সাধারণ মানুষের কাছে হয়ে ওঠে এক ধরনের গালাগাল বা অপমান। এমনকি আনন্দবাজার পত্রিকায় চিরদীপ উপাধ্যায়ের লেখায়ও দেখা যায়, কীভাবে পরবর্তী যুগে চার্বাকদের দর্শন এক নীতিহীন এবং বিকৃত মতবাদ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এখন, মুসলিম শাসকদের যুগে মন্দির ভাঙার যে বিষয়টি উল্লেখ করা হয়, সেটাও বেশ জটিল। মন্দির ভাঙার প্রেক্ষাপট সামরিক, রাজনৈতিক এবং ধনসম্পদে লুণ্ঠনের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। মুসলিম শাসকরা মন্দির ভেঙেছেন, কিন্তু এর পেছনে যে শুধু ধর্মবিদ্বেষ ছিল তা নয়, বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এটি সামরিক আক্রমণের অংশ ছিল। মন্দিরগুলোতে প্রচুর ধনরত্ন জমা থাকত, যা কখনো ব্যাঙ্কের মত ব্যবস্থাপনায় ছিল না, তাই মন্দিরে মজুত রাখা হতো। এটি এক ধরনের রাজনৈতিক ও সামরিক কৌশল ছিল, যেখানে ধনসম্পদ লুণ্ঠন করা ছিল প্রধান লক্ষ্য। তবে মুসলিম শাসকরা মন্দির ভেঙেছিলেন বা মসজিদে রূপান্তর করেছিলেন এমন কিছু উদাহরণ পাওয়া যায়, তবে এসব ঘটনা অবশ্যই ইতিহাসের একটি অংশ, যা শুধুমাত্র ধর্মীয় উদ্দেশ্যে নয়, বরং রাজনৈতিক ও সামরিক প্রয়োজনে ঘটেছিল। এই কারণে, মুসলিম শাসকদের বিরুদ্ধে ধর্মীয় বিদ্বেষ তৈরি করার চেষ্টা ছিল।

আজকের ভারতে যখন সাম্প্রদায়িক অস্থিরতা ও অসহিষ্ণুতা বৃদ্ধি পেয়েছে, তখন এক মুসলিম যুবক ইয়াসিন পাঠানের মতো ব্যক্তির উদাহরণ অনেক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। ইয়াসিন পাঠান, একজন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি হিসেবে, পাথরা গ্রামে হিন্দু মন্দিরগুলির সংরক্ষণে তার জীবনের বেশিরভাগ সময় ব্যয় করছেন। তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রম এবং সংগ্রামের ফলে, তিনি প্রতিকূলতা সত্ত্বেও ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সংরক্ষণে এক বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। এভাবে, ভারতীয় ইতিহাসের নানা দৃষ্টিভঙ্গি, দর্শন এবং ধর্মীয় জিজ্ঞাসা আমাদের সামনে এক অদম্য প্রমাণ রেখেছে—যেখানে চিন্তা ও বিশ্বাসের পরিসরে বৈচিত্র্য এবং সংঘর্ষ ছিল।

পাথরা গ্রামে শতকরা ৯৯% মানুষ তাঁদের বাসস্থান নির্মাণে ব্যবহৃত করেছেন মন্দিরের পুরোনো ইট। ১৯৮৩ সালে, স্থানীয় এক রাজনৈতিক নেতা, প্রাচীন দুর্গা মণ্ডপের পাথরগুলি বিক্রি করার পরিকল্পনা করেন। তিনি পশ্চিম মেদিনীপুরের মাওয়া নামক স্থানে একটি কালি মন্দির নির্মাণের জন্য সেগুলি গোপনে পাচার করার চেষ্টা করেন। কিন্তু যখন ঘটনাটি প্রকাশ্যে আসে, তখন ইয়াসিন পাঠান কঠোর প্রতিবাদ জানিয়ে আন্দোলন শুরু করেন। ইয়াসিন পাঠানের অনবদ্য লড়াইয়ের ফলস্বরূপ ১৯৯১ সালে তিনি পাথরা পুরাতত্ত্ব সংরক্ষণ কমিটি গঠন করেন, যাতে হিন্দু, মুসলিম, এবং আদিবাসী জনগণ একত্র হয়ে ঐতিহ্য রক্ষার কাজ করেন। তাঁর প্রচেষ্টার জন্য ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ড. শঙ্কর দয়াল শর্মা তাকে ‘সন্ত কবির’ পুরস্কারে ভূষিত করেন। ইয়াসিনের অবদানকে সম্মান জানিয়ে তৎকালীন পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান প্রণব মুখার্জি পাথরা পুরাতত্ত্ব সংরক্ষণ কমিটিকে ২০ লাখ টাকা দেন। ২০০৩ সালে ‘আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া’ পাথরা অঞ্চলে ৩৪টি মন্দির এবং ২৫ বিঘা জমি অধিগ্রহণ করে, এবং ঐতিহাসিক এই স্থানটির সংরক্ষণ প্রক্রিয়া শুরু হয়। ২০১৪ সালে, ইয়াসিন পাঠান কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে তাঁর রাষ্ট্রপতি পুরস্কার ফেরত দেওয়ার আবেদন জানান, কারণ তিনি মনে করেছিলেন যে সরকার পাথরার পুরাতত্ত্ব যথাযথভাবে সংরক্ষণ করছে না। তবে তাঁর আবেদন সরাসরি খারিজ করে দেওয়া হয় এবং তাঁকে আশ্বস্ত করা হয় যে, মন্দিরগুলির সংরক্ষণ ও জমি অধিগ্রহণের কাজ নিশ্চিতভাবে হবে। আজ পাথরা একটি ঐতিহাসিক নিদর্শন এবং পর্যটন কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। ইয়াসিন পাঠানের দীর্ঘ ২৫ বছরের সংগ্রামের ফলে এটি ভারতের ইতিহাসের মানচিত্রে স্থান পেয়েছে। তাঁর এই সংগ্রামের জন্য পাথরা আজ একটি প্রতীক, যেখানে ইতিহাস এবং ঐতিহ্য রক্ষার লড়াইয়ের ফলস্বরূপ এক নতুন আশার আলো দেখা দিয়েছে। অন্যদিকে, আওরঙ্গজেবের শাসনকাল নিয়ে বিতর্ক অনেকদিন ধরেই চলে আসছে। অনেকে তাঁর শাসনকে অসহনশীল এবং ধর্মীয় বিদ্বেষী হিসেবে চিত্রিত করেছেন, কিন্তু তাঁর শাসনব্যবস্থায় কিছু বৈশিষ্ট্য এমন ছিল, যা শাসক হিসেবে তাঁর আদর্শের বিরোধিতা করে না। মোগল সাম্রাজ্যের সর্বোচ্চ বিস্তার লাভের সময়ও তাঁর শাসনকালে অনেক মন্দির নির্মাণ করা হয়েছিল, যা প্রায়ই ইতিহাসের পাতায় উল্লেখিত হয়নি। ইংরেজ ইতিহাসবিদরা তাঁর শাসনকে নেতিবাচকভাবে চিত্রিত করেছিলেন, যাতে তারা নিজেদের উপনিবেশবাদী শাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারে। তবে, তাঁর শাসনকালে বহু হিন্দু মন্দির সংরক্ষণ করা হয়েছিল এবং বহু হিন্দু তাঁর প্রশাসনে উচ্চ পদে নিযুক্ত ছিলেন।

অড্রে ট্রুশকের মতে, “Aurangzeb protected more Hindu temples than he destroyed. He employed more Hindus in his imperial administration than any prior Mughal ruler by a fair margin.” এই বিশ্লেষণে, ট্রুশক বোঝাতে চেয়েছেন যে আওরঙ্গজেবের শাসনকালে মন্দির ভাঙা হলেও, অনেক বেশি মন্দির রক্ষা করা হয়েছিল এবং হিন্দুদের জন্য তাঁর প্রশাসনে সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছিল। তিনি আরও বলেন, “Aurangzeb was not a modern man, and so it should be unsurprising that modern standards of bigotry do not advance our historical understanding of this Mughal king.”

অধিকারী এবং দার্শনিকদের মধ্যে আওরঙ্গজেবের চরিত্রের মূল্যায়ন সবসময় বিতর্কের বিষয় ছিল। তিনি আকবরের মত উদার শাসক ছিলেন না, তবে তিনি ছিলেন এক দৃঢ় নীতি নির্ধারক। তাঁর শাসনামলে বহু প্রতিরোধ গড়ে উঠেছিল—শিবাজী, জাঠ, শিখ এবং অন্যান্য বিদ্রোহী গোষ্ঠীরা মোগল সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল। শিবাজীর বিরুদ্ধে তাঁর রাজনৈতিক পরিকল্পনা অনেকটা ব্যর্থ হয়েছিল এবং মারাঠা শক্তি, বিজাপুর ও গোলকুণ্ডার সাথে মিলিত হয়ে মোগল সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে বৃহৎ প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। অন্যদিকে, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি আসার পর মোগল সাম্রাজ্যের পতন শুরু হয়। পারস্য সম্রাট নাদির শাহ ১৭৩৮ সালে ভারত আক্রমণ করে বিশাল ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিলেন, যার ফলে দুই লক্ষেরও বেশি মানুষ মারা যায় এবং বিপুল পরিমাণ সম্পদ লুণ্ঠিত হয়। নাদির শাহের এই হামলাকে ইতিহাসের এক অন্ধকার অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।

সম্রাট আওরঙ্গজেবের শাসনকালে ভারতীয় সমাজে এক অদ্ভুত শান্তি ও অস্থিরতার মিশ্রণ দেখা যায়। তাঁর মৃত্যুর পর মোগল সাম্রাজ্যের পতন ঘটলেও, তাঁর শাসনকালে প্রচুর সংস্কার ও উন্নতি হয়েছিল। তাঁর শাসনকাল পরবর্তী ভারতীয় ইতিহাসে পরাজয়ের মধ্যেও, তাঁর রাজনৈতিক ক্ষমতা এবং শাসন ব্যবস্থার বিশাল প্রভাব বিস্তার করেছে।

Post Views: 116
Tags: AurangzebAurangzeb’s ReignIndia under MughalsIndian HistoryIslamic Rule in IndiaMedieval IndiaMughal EmpireSouth Asian Historyইতিহাসচর্চাধর্ম ও রাজনীতিমুঘল ইতিহাসমুঘল সাম্রাজ্যরাজনীতির ইতিহাসশাসনকালসম্রাট আকবরসম্রাট ঔরঙ্গজেব
ADVERTISEMENT

Related Posts

বিদ্যাসাগরের প্রতি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বিদ্বেষ ও বিরোধীতা
ভারতবর্ষের ইতিহাস

বিদ্যাসাগরের প্রতি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বিদ্বেষ ও বিরোধীতা

একজন বিদ্যার সাগর, আর একজন সাহিত্যের সম্রাট। উভয়েই উনিশ শতকের বিখ্যাত মনীষী ও লেখক এবং পরস্পরের সমকালীন। উনিশ শতকের...

by কামরুজ্জামান
November 13, 2024
মন্দির ধ্বংস এবং ইন্দো-মুসলিম রাষ্ট্রসমূহ
ভারতবর্ষের ইতিহাস

মন্দির ধ্বংস এবং ভারতে মুসলিম শাসনের ইতিবৃত্ত

লিখেছেনঃ রিচার্ড এম. ইটন সম্প্রতি, বিশেষ করে ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর, দক্ষিণ এশিয়ার মন্দির এবং মসজিদের রাজনৈতিক...

by অতিথি লেখক
November 12, 2024
প্রকৃতি, নান্দনিক চৈতন্য ও মরমিবাদ: বাংলার আরবি-ফার্সি শিলালিপির আধ্যাত্মিক দিক
ইসলামিক ইতিহাস

প্রকৃতি, নান্দনিক চৈতন্য ও মরমিবাদ: বাংলার আরবি-ফার্সি শিলালিপির আধ্যাত্মিক দিক

চিত্র ৪.১ (শিলালিপি নং): পাণ্ডুয়ার শায়খ নূর কুতব আল আলমের সমাধিফলকে ব্যবহৃত সাতটি আধ্যাত্মিক উপাধি...

by মুহাম্মাদ ইউসুফ সিদ্দিক
November 7, 2024
সিন্ধু-সভ্যতার অস্তিত্ব সম্পর্কে নতুন ও রোমাঞ্চকর তথ্য উন্মোচন
ভারতবর্ষের ইতিহাস

সিন্ধু সভ্যতার অস্তিত্ব সম্পর্কে নতুন ও রোমাঞ্চকর তথ্য উন্মোচন

মোহেন্-জো-দড়ো—হরপ্পার তথাকথিত সিন্ধু সভ্যতা সম্পর্কে ভারতের মানুষের গর্ববোধের শেষ নেই। ঐ সভ্যতার ‘আবিষ্কার’-এর সঙ্গে সঙ্গে ভারতীয় সভ্যতার বয়স এক...

by বিবস্বান আর্য
November 8, 2024

POPULAR POSTS

  • সুলতান মাহমুদ

    সুলতান মাহমুদের ভারত অভিযান ও সোমনাথ মন্দির প্রসঙ্গ (১ম পর্ব)

    181 shares
    Share 181 Tweet 0
  • বাউরী সম্প্রদায়ের উৎপত্তির ইতিহাস ও ঐতিহাসিক পর্যালোচনা

    0 shares
    Share 0 Tweet 0
  • আর্যদের ভারত আগমন, বিস্তার, সমাজ ও সভ্যতা: এক ঐতিহাসিক পর্যবেক্ষণ

    0 shares
    Share 0 Tweet 0
  • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে বৌদি কাদম্বরী দেবীর সম্পর্ক আদৌ কি প্রেমের ছিল?

    0 shares
    Share 0 Tweet 0
  • হিন্দু পদবীর উৎপত্তির ইতিহাস, বিবর্তন ও ক্রমবিকাশঃ বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা

    0 shares
    Share 0 Tweet 0

Facebook Page

নবজাগরণ

ADVERTISEMENT
নবজাগরণ

'Nobojagaran' is a website of its kind where you can gather knowledge on all the unknown facts of the world. We human beings always have a thirst for knowledge. Nobojagaran takes its first steps to quench this thirst of ours. We are now in the era of digital world, where we get almost anything online. So how about a bit of knowlyfrom online?

Connect With Us

No Result
View All Result

Categories

  • English (9)
  • অন্যান্য (11)
  • ইসলাম (26)
  • ইসলামিক ইতিহাস (22)
  • ইহুদী (1)
  • কবিতা (37)
  • খ্রিস্টান (6)
  • ছোটগল্প (6)
  • নাস্তিকতা (18)
  • বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি (24)
  • বিশ্ব ইতিহাস (24)
  • ভারতবর্ষের ইতিহাস (195)
  • রাজনীতি (38)
  • সাহিত্য আলোচনা (68)
  • সিনেমা (17)
  • হিন্দু (16)

Pages

  • Cart
  • Checkout
  • Checkout
    • Confirmation
    • Order History
    • Receipt
    • Transaction Failed
  • Contact
  • Donation to Nobojagaran
  • Homepage
  • Order Confirmation
  • Order Failed
  • Privacy Policy
  • Purchases
  • Services
  • লেখা পাঠানোর নিয়ম
  • হোম
No Result
View All Result
  • মূলপাতা
  • ইতিহাস
    • ইসলামিক ইতিহাস
    • ভারতবর্ষের ইতিহাস
    • বিশ্ব ইতিহাস
  • বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
  • ধর্ম
    • ইসলাম
    • খ্রিস্টান
    • হিন্দু
    • ইহুদী
    • অন্যান্য ধর্ম
  • নাস্তিকতা
  • রাজনীতি
  • সিনেমা
  • সাহিত্য
    • কবিতা
    • ছোটগল্প
    • উপন্যাস
    • সাহিত্য আলোচনা
  • অন্যান্য
  • ই-ম্যাগাজিন
    • নবজাগরণ (ষাণ্মাসিক) – জীবনানন্দ ১২৫ তম জন্ম সংখ্যা – মননশীল সাহিত্য পত্রিকা
  • Others Language
    • English
    • Urdu
    • Hindi

©Nobojagaran 2020 | Designed & Developed with ❤️ by Adozeal

Login to your account below

Forgotten Password?

Fill the forms bellow to register

All fields are required. Log In

Retrieve your password

Please enter your username or email address to reset your password.

Log In
Don't have an account yet? Register Now
1
Powered by Joinchat
Hi, how can I help you?
Open chat
wpDiscuz
0
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x
| Reply