মােহাম্মদ ইকবালের (১৮৭৭-১৯৩৮) তথাকথিত পৃথক মুসলিম রাষ্ট্র গঠন সংক্রান্ত বক্তৃতার (১৯৩০-র ২৯ ডিসেম্বর) অনেক আগে থেকেই হিন্দু জাতিভিত্তিক পৃথক রাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনা করে যাচ্ছিল আর্য সমাজ ও হিন্দু মহাসভা। পূর্বে অবশ্য হিন্দুজাতি প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৩৮-১৮৯৪) তার নানা বক্তব্য তুলে ধরার পরে যথেষ্ট আবেগের সঙ্গে মহারাষ্ট্রে শিবাজী কর্তৃক হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার উল্লেখ করেন (‘ভারত কলঙ্ক’)। এই সময়ে শিবাজীর আদর্শকে সামনে রেখে ধর্মীয় পুনরুজ্জীবনের এক আন্দোলন মহারাষ্ট্রে যথেষ্ট শক্তিশালী হয়। হিন্দুরাজ প্রতিষ্ঠাকল্পে ১৮৭৯ সালে বাসুদেব বলবন্ত ফাদকে (১৮৪৫-১৮৮৩) ব্রিটিশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘােষণা করে মহারাষ্ট্রের কতকগুলি গ্রামে সশস্ত্র আক্রমণ পরিচালনা করেন। কিন্তু ফাদকের এই সংগ্রাম অচিরেই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। মহারাষ্ট্রে এম জি রানাডে (১৮৪২-১৯০১), আর জি ভান্ডারকর (১৮৩৭-১৯২৫), জি জি আগারকর (১৮৫৬-১৮৯৫) প্রমুখগণ সামাজিক ও ধর্মীয় কুসংস্কারের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন পরিচালনা করেছিলেন তার বিরুদ্ধতা করে বিষ্ণুশাস্ত্রী চিপলাঙ্কার (১৮৫০-১৮৮২) প্রচার করেন যে, স্বাধীনতা হরণকারী ইংরেজ-শাসনই। ভারতের সব ধরনের অনগ্রসরতার জন্য দায়ী, কাজেই ইংরেজ-শাসনের অবসানই প্রথম প্রয়ােজন এবং সে ক্ষেত্রে বর্ণপ্রথা, বাল্যবিবাহ ইত্যাদি সামাজিক সংস্কার কোনাে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে না। কাজেই প্রয়ােজন স্বাধীনতা আন্দোলন, সমাজসংস্কার আন্দোলন নয়।
১৮৮২ সালে চিপলাঙ্কার-এর মৃত্যুর পর বালগঙ্গাধর তিলকই (১৮৫৬-১৯২০) হন মহারাষ্ট্রে ধর্মীয় ও সামাজিক রক্ষণশীলতার সর্বপ্রধান এবং সবথেকে শক্তিশালী প্রতিনিধি। হিন্দুদেরকে একই পতাকাতলে সমবেত এবং ঐক্যবদ্ধ করাকেই তিনি রাজনৈতিক লক্ষ্য হিসেবে ঘােষণা করেন এবং অতীতের গৌরব-চেতনা অন্তরে পুনরুজ্জীবনের উদ্দেশ্যে প্রবর্তন করেন ‘গণেশ উৎসব’ ও ‘শিবাজী উৎসব’। এই ধরনের ধর্মীয় আবেদন মহারাষ্ট্রের রাজনীতি ক্ষেত্রে ধর্মীয় পুনরুজ্জীবন আন্দোলনকে বেশ শক্তিশালী করেছিল।
[১]
গুজরাটে দয়ানন্দ সরস্বতী (১৮২৪-১৮৮৩) ধর্মীয় পুনরুজ্জীবন আন্দোলন শুরু করে ১৮৭৫ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ‘আর্য সমাজ’। আধ্যাত্মিক ও নৈতিক জীবনকে বেদের উপর দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা ছিল তার এই সমাজের মূল লক্ষ্য। দয়ানন্দ বর্ণ এবং অন্য অনেক ধরনের ভেদাভেদের বিরুদ্ধেও আন্দোলন করেন। উত্তর ভারতের পাঞ্জাব, উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান ইত্যাদি অঞ্চলে আর্যসভার শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়। হিন্দুধর্মকে খ্রিস্টান ও ইসলাম ধর্ম থেকে রক্ষার জন্য ‘সত্যার্থপ্রকাশ’ নামক একটি রচনায়। তিনি অন্য ধর্মের যেসব সমালােচনা করেন তার ফলে সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদ কিছুটা বৃদ্ধি লাভ করে। এছাড়া আর্য সমাজ ‘গােরক্ষা সমিতি’ প্রতিষ্ঠা করে গাে-হত্যার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করলে সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতির যথেষ্ট অবনতি ঘটে, এমনকি কয়েক জায়গায় হিন্দু-মুসলমানের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাও সংঘটিত হয়। আর্য সমাজ রাজনীতি অপেক্ষা ধর্মসংস্কারের উপর গুরুত্ব বেশি প্রদান করা সত্ত্বেও দয়ানন্দের সংস্কার আন্দোলনের ফলে ভারতে হিন্দুরাজ প্রতিষ্ঠার চিন্তা শক্তিশালী হয়।
বােম্বাই শহরে আর্য সমাজ প্রতিষ্ঠিত হলেও এই সমাজ বিশেষ জনপ্রিয় ও সক্রিয় হয়ে ওঠে উত্তর-পশ্চিম ভারতে। লালা লাজপত রাই (১৮৬৪-১৯২৮), লালা হংসরাজ (১৮৬৪-১৯৩৮), লাল লালচাঁদ ও লালা মুন্সিরাম ওরফে স্বামী শ্ৰদ্ধানন্দ (১৮৫৬-১৯২৬) প্রমুখ প্রধান প্রধান আর্য সমাজী নেতাগণ ছিলেন বণিক সম্প্রদায়ভুক্ত। এঁদের অধিকাংশই আবার হিন্দু মহাসভারও নেতৃত্বে আসীন ছিলেন বা থাকতেন। তারা চাইতেন আর্য সমাজীদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা। পূর্ব ভারতে যেমন নিম্নবর্গের মানুষ ব্যাপক হারে ইসলাম গ্রহণ করেছে উত্তর-পশ্চিম ভারতে তেমনই নিম্নবর্গের মানুষ দলে দলে শুদ্ধিকরণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আর্যধর্মে তথা হিন্দুধর্মে প্রত্যাবর্তন করেছে। দয়ানন্দ তাঁর ‘সত্যার্থ প্রকাশ’ গ্রন্থে প্রথমে গােমাংস ভক্ষণ অনুমােদন করেছিলেন, কিন্তু পরে ওই বণিক নেতৃত্বের গাে-হত্যা বিরােধী আন্দোলনের চাপে গাে-মাংস খাওয়া নিষিদ্ধ করেছিলেন (১৮৯০-এর দশকে শুরু হওয়া গাে-হত্যা বিরােধী আন্দোলন ছিল প্রকৃতপথে মুসলমানদের বিরুদ্ধে একটি হুমকি স্বরূপ)। বলা যায়, শুদ্ধিকরণ। প্রত্রিয়ার মাধ্যমে আর্যধর্ম দ্রুত হিন্দুধর্মে রূপান্তরিত হচ্ছিল। আর্য সমাজীদের কার্যক্রমও দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছিল। আর্য সমাজীরা হরিসভা ও সনাতন সভার মাধ্যমে সংগঠনকে শক্তিশালী ও বিকশিত করে তুলছিলেন এবং এই উদ্দেশ্যে ১৯০০ সালে দিল্লিতে দ্বারভাঙার মহারাজার সভাপতিত্বে একটি মহাসম্মেলনের আয়ােজন করা হয়েছিল। এই মহাসম্মেলনে ‘ভারত মহামণ্ডল’ নামে এক উগ্রবাদী হিন্দু সংগঠন গঠন করে একদিকে ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে সহযােগিতা ও অন্যদিকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণা করা হয়। এই সম্মেলনের পূর্বে প্রায় লক্ষাধিক হিন্দু বেদ ও গীতার বাণী লিখে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে দিল্লির পথ অতিক্রম করে। ব্রিটিশ সরকারের প্রশাসন নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে।
উপরােক্ত কার্যক্ৰমের অঙ্গ হিসেবে ১৯০৮ সালে আর্য সমাজের বিশিষ্ট জাতীয় নেতা লালা লাজপত রাই প্রতিষ্ঠিত ও সম্পাদিত ‘পাঞ্জাবী’ পত্রিকায় হিন্দুদের কীভাবে দেশ গড়তে হবে তার পরিকল্পনায় আর্য সমাজেরই অপর নেতা লালা লালচাঁদ লিখেছেন,
“And this can only be achieved asserting purely Hindu interest, and not by an Indian propaganda, the consciousness must arise in the mind of each Hindu that he is a Hindu, and not merely an Indian and when it does arise the newly awakened force is bound to bring its results.”
হিন্দুর উপর এই বিশেষ গুরুত্ব আরােপ করার ফলে ভারতীয় জনগণকে অনিবার্যভাবেই মুসলমান, শিখ, খ্রিস্টান প্রভৃতি ধর্মাবলম্বীতে বিভক্ত ও বিচ্ছিন্ন করার নীতি প্রতিষ্ঠা করা হল এবং একই সঙ্গে ভারতকে হিন্দুর দেশ, মুসলমানের দেশ প্রভৃতি নামে ভাগ করার পথ উন্মুক্ত করা হল। অথচ এ সময় (১৮৮৪) সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি (১৮৪৮১৯২৫) অবিভক্ত পাঞ্জাব ও উত্তর ভারতে ভারতীয় জাতিতত্ত্বের প্রচার করছেন। এই প্রচারের ভিত্তি ছিল, ভারত জুড়ে এক ঐক্যবদ্ধ জনমত গঠনের মাধ্যমে সংহত রাষ্ট্রনীতির প্রতিষ্ঠা ও ভারতীয় জনগণের মধ্যে সমন্বয় সাধন করা। উদ্দেশ্য ছিল আরও স্পষ্ট, ভারতীয় হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে মিত্রতা স্থাপন ও ভারতীয় জনগণকে রাষ্ট্রীয় আন্দোলনে সামিল করা।
সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জির ওই সংহতিমূলক জাতীয়তার বিপরীতে সাম্প্রদায়িক স্বাদেশিকতার জয়গান করে লালা লালচাঁদ ‘পাঞ্জাবী’তে লিখেছেন, “The point I wish to urge is that patriotism ought to be communal and not merely geographical.’ রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক বা আর এস এস তার জন্মের (১৯২৫) পর হতে গােটা দেশ জুড়ে ধর্মীয় বিভাজনের রাজনীতির স্বার্থে যে ধর্ম ব্যবসাকে প্রাধান্য দিতে শুরু করল তার সুচনা ঘটিয়েছিল বিগত দশকের প্রথম দিকে পাঞ্জাবে সেখানকার আর্যসমাজীভুক্ত বণিক সম্প্রদায়। এই হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার ফলশ্রুতিতেই পরবর্তী সময়ে ওই অঞ্চলে জন্ম নেয় মুসলিম সাম্প্রদায়িকতার, পরে যা ক্রমশ প্রবল রূপ ধারণ করে।
অন্যত্র লালা লালচাঁদের ঘােষিত ব্রত হল,
‘The idea is to love everything owned by the community.It may be a religion, it may be a tract of country, or it may be a phase of civilisation. But these are mere outward clothes of the inner feeling. This then is the fire I wish to rekindle.১
‘পাঞ্জাবী’ পত্রিকাতে দিনের পর দিন প্রকাশিত এইসব শিক্ষা যে একদিন পাঞ্জাবের মুসলমানরা আয়ত্ত করে পৃথক দেশ দাবি করবে একথা তখন সম্পাদক লালা লাজপত রাই বা লেখক লালা লালচাঁদ কল্পনা করতে পারেননি বলেই মনে হয়। কিন্তু নিজ ধর্ম সম্প্রদায়ের একটি ভৌগােলিক তাে পরিচিতি চাই—এটাই ছিল আর্যসমাজী পাঞ্জাবী’র পুনঃপুনঃ দাবি।
হিন্দু পুনরুজ্জীবনবাদীদের কাছে জাতি শব্দটির অর্থ কখনই নির্দিষ্ট বা স্পষ্ট ছিল না—বর্ণভেদ অর্থেও তারা জাতি শব্দটা ব্যবহার করেছেন, আবার ইউরােপীয় জনগােষ্ঠী অর্থেও জাতি শব্দটা ব্যবহার করেছেন, আবার আফ্রিকা মহাদেশের বাসিন্দাদের এক বৃহৎ জনসমষ্টিকেও কৃষ্ণ জাতি বলে বর্ণনা করেছেন। তবে সাধারণভাবে তাদের প্রভাবে প্রাগ্রসর উচ্চবর্ণ শিথিত ও প্রধানত সম্পন্ন ভারতীয় হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মনে ‘National pride’ বা জাতিগর্ব সৃষ্টি হয়। কেনেথ জোন্স তার ‘আর্যধর্ম’ গ্রন্থে কীভাবে ধীরে ধীরে হিন্দু জাতিতত্ত্ব গড়ে ওঠে তার সুন্দর ও সুস্পষ্ট বিবরণ পেশ করেছেন। ‘পাঞ্জাবী’ পত্রিকায় ১৯০৮ সালে লালা লালচাঁদ ‘সেলফ-অ্যাবনেগেশন ইন পলিটিক্স’ শিরােনামে ধারাবাহিকভাবে কতকগুলি রচনা প্রকাশ করেন। ‘সেলফ-অ্যাবনেগেশন ইন পলিটিক্স’ ১৯৩৮ সালে পুস্তিকা আকারে প্রকাশিত হয়। ইন্দ্রপ্রকাশ তার ‘হিন্দু মহাসভা’ গ্রন্থে লালা লালাদের রচনাগুলিকে হিন্দু মহাসভার ভিত্তিপ্রস্তর বলে উল্লেখ করেছেন। লালচাঁদ তাঁর ওই পুস্তিকায় কংগ্রেসকে বর্ণনা করেছিলেন হিন্দুদের ‘স্ব-আরােপিত দুর্ভাগ্য’ বলে। তিনি লিখেছিলেন, হিন্দুরা বিগত ২৫ বছর ধরে যে বিষ পান করেছে তার ফলে তারা নিশ্চিহ্ন হতে চলেছে। তারা যদি বিষ ‘ঝেড়ে ফেলতে’ ও ‘শয়তানের’ হাত থেকে মুক্তি পেতে ইচ্ছুক ও তৎপর হয় একমাত্র তাহলেই বাঁচতে পারবে। তিনি অভিযােগ করেছিলেন, কংগ্রেস সরকারের কাছে ‘অসম্ভব’ সব দাবি তুলছে। ফলে সরকার সংগত কারণেই ক্রুব্ধ হচ্ছেন কংগ্রেসের ও হিন্দুদের বিরুদ্ধে। বদলে হিন্দুদের উচিত মুসলমানদের বিরুদ্ধে লড়াইতে তৃতীয় পক্ষকে—সরকারকে নিরপেক্ষ করার জন্যে চেষ্টা করা। হিন্দুদেরও কংগ্রেস ত্যাগ করা ও তার ‘বিলােপ ঘটানাে’ একান্ত প্রয়ােজন। লালচাঁদ ঘােষণা করেছিলেন, ‘আমি প্রথমে হিন্দু, তারপরে ভারতীয়—একথা একজন হিন্দুকে শুধু বিশ্বাস করলেই চলবে না, একে তার দেহ-মনের, তার জীবনের, তার আচরণের অপরিহার্য অংশ করেও তুলতে হবে।৪
লালা লালচাঁদের রচনা থেকে বহু উদ্ধৃতি ব্যবহার করেছেন কেনেথ জোন্স। সমকালে পাঞ্জাবের বণিকগােষ্ঠী ধর্মকে কীভাবে বাজারের পণ্য বানিয়ে মুসলিম মানসকে আহত করেছিল, তার তথ্যনিষ্ঠ বিবরণও আমরা পায় তার ‘আর্যধর্ম’ থেকে। কেনেথের দেওয়া সব থেকে বড়াে তথ্য হল, ১৯২৪ সালে লাজপত রাই-ই প্রথম ধর্মের ভিত্তিতে ভারত ভাগের প্রস্তাব আনেন। তারাচাঁদ৫ ও রমেশচন্দ্র মজুমদারের গ্রন্থেও এর উল্লেখ আছে। ‘পাঞ্জাবী’ পত্রিকাতে প্রতিনিয়ত যে ধরনের উসকানিমূলক লেখা প্রকাশিত হয়, তা ওই অঞ্চলের মুসলিম মানসে বিচ্ছিন্নতার প্রবণতা জাগিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, সে বিচ্ছিন্নতার শিক্ষা পরবর্তীকালে খালিস্তানপন্থী শিখেরাই গ্রহণ করেছিল। উত্তর-পশ্চিম ভারতে পাকিস্তানের তাত্ত্বিক ভিত্তির নির্মাতা কোনও মুসলিম নেতা নন। এই অঞ্চলে পাকিস্তান ও পরবর্তীকালে খালিস্তানের তাত্ত্বিক ভিত্তির প্রকৃত নির্মাতা হলেন হিন্দু মহাসভার নেতা লালা লালচাঁদ। আর্যধর্ম গ্রন্থে কেনেথ মন্তব্য করেছেন,
‘Lal Chand’s letters marked a move from Arya Dharma to Hindu consciousness. They laid the foundation for Hindu politics, as an alternative to the ‘national politics of Congress.’
স্বামী দয়ানন্দের মৃত্যুর (১৮৮৩) পর পাঞ্জাবের জলন্ধরের উকিল লালা মুন্সিরাম আর্য সমাজে যােগ দিয়ে অচিরেই নেতৃত্বে আসীন হন এবং স্বামী শ্ৰদ্ধানন্দ নাম গ্রহণ করেন। আর্য সমাজের শুদ্ধি আন্দোলনে তিনি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯২৩ সালে তিনি আগ্রায় ‘ভারতীয় হিন্দু শুদ্ধিসভা’-র প্রতিষ্ঠা করেন ও তার সভাপতি হন। ১৯০৯ সালে উপেন্দ্রনাথ মুখার্জি হিন্দুদের একটি ‘ডাইং রেস’ বা ‘বিলীয়মান জাতি’ হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। তারই সূত্র ধরে ১৯২৬ সালে হিন্দু পুনরুজ্জীবনের আহ্বান নিয়ে স্বামী শ্ৰদ্ধানন্দ লিখেছিলেন ‘হিন্দু সংগঠন—সেভিয়ার অফ দ্য ডাইং রেস’। এই গ্রন্থে তিনি হিন্দুদের ধর্মসম্প্রদায়গত একত্ববােধ পুনর্জাগরিত করার জন্য দিল্লির জামা মসজিদের পালটা হিসেবে বড়াে বড়াে শহরগুলিতে ২৫,০০০ হিন্দু একত্রিত হতে পারে, এমন ‘হিন্দুরাষ্ট্র’ মন্দির স্থাপনের কথা বললেন। তার প্রস্তাব মতাে সেখানে ধর্মীয়, শারীরিক ও নৈতিক শিক্ষার জন্য দৈনিক গীতা, উপনিষদ, রামায়ণ, মহাভারত পাঠ হবে, স্থানীয় হিন্দুসভার আখড়া স্থাপিত হবে, গােমাতা, সরস্বতী ও ভূমি-মাতার পূজা হবে এবং সবার নজরে পড়ে এমন জায়গায় ভারতমাতার এমন এক বর্ণময় জীবন্ত মানচিত্র অঙ্কিত থাকবে, যার সামনে মাতৃভূমির সমস্ত সন্তান প্রণত হয়ে মাতার হৃতগৌরব পুনরুদ্ধারের প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করবে। ১৯২৬ সালের ডিসেম্বরে এক মুসলিম আততায়ীর হাতে তিনি নিহত হন।
[২]
১৯৩৩ সালে ভাই পরমানন্দ (১৮৭৬-১৯৪৭) হিন্দু মহাসভার আজমির অধিবেশনে সভাপতির ভাষণে হিন্দুস্থানকে হিন্দুদের মাতৃভূমি হিসেবে উল্লেখ করে বলেছিলেন মুসলমান, খ্রিস্টান ও অন্য ধর্মাবলম্বীরা অতিথি মাত্র এবং সে হিসেবেই ভারতে তাদের থাকতে হবে। হিন্দু মহাসভার এখন একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে কাজ করা উচিত বলে তিনি মনে করতেন, যার প্রধান লক্ষ্য হবে জনগণের কাছে হিন্দু জাতীয়তাবাদের বাণী তুলে ধরা এবং রাজনৈতিক পদ্ধতিতেই তার প্রসারের জন্য ব্যবস্থাপক সভা ও ব্যবস্থা পরিষদ দখল করা। হিন্দু জাতীয়তাবাদের ধ্যানধারণা প্রচারের জন্য তিনি ‘সারভেন্টস অফ হিন্দু সােসাইটি’ নামক একটি সংস্থা গঠন ও হিন্দি ভাষায় ‘হিন্দু’ এবং ইংরেজি ভাষায় ‘হিন্দু আউটলুক’ নামে দুটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। তিনি ব্রিটিশ ভারতের সমস্ত প্রদেশ ঘুরে বহু সভা-সমাবেশে বক্তব্য রাখেন। ১৯৩৬ সালে হিন্দু মহাসভার এক বিবৃতিতে বলা হয়েছিল যে, হিন্দুস্থান একমাত্র হিন্দুদের নিজস্ব বাসভূমি এবং তাদের জীবনের লক্ষ্য হল আর্য সংস্কৃতি ও হিন্দুধর্মের বিকাশসাধন। এভাবে এক জাতি, এক ধর্ম, এক ভাষা, এক সংস্কৃতি হিন্দু মহাসভার ঘােষিত লক্ষ্য হয়ে ওঠে। ভাই পরমানন্দ লাহােরে পাকিস্তান প্রস্তাব (১৯৪০) উত্থাপিত হওয়ার দু’বছর আগে ১৯৩৮-এ দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ভাগের কথা বলেন।৭
জাতীয় কংগ্রেসের অভ্যন্তরে হিন্দু ঐতিহ্যবাদী ধারাটিকে শক্তিশালী করার কাজে একটি চাপ সৃষ্টিকারী গােষ্ঠী হিসেবে হিন্দু মহাসভার একটি বড়াে ভূমিকা ছিল। পণ্ডিত মদনমােহন মালব্য (১৮৬১-১৯৬৬) ছিলেন এই গােষ্ঠীর হােতা। তিনি একাধিকবার কংগ্রেসের সভাপতি হয়েছিলেন এবং তিনি বলতেন, প্রত্যেক হিন্দুরই কংগ্রেসকে সমর্থন করা উচিত। ১৯২২ সালে গান্ধীজি অসহযােগ আন্দোলন হঠাৎ প্রত্যাহার করলে হিন্দু মহাসভা আবার সক্রিয় হয়ে ওঠে। ১৯২৩-২৫ সালের মধ্যে বেনারস, বেলগাঁও ও গয়া—হিন্দু মহাসভার তিনটি অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। উল্লেখ্য যে, ১৯১৫ সালে সারা ভারত হিন্দু মহাসভা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই এই সংঘের বক্তব্য ছিল—হিন্দু ও মুসলমান দুই পৃথক জাতি এবং লক্ষ্য ছিল পৃথক হিন্দুরাষ্ট্র গঠন। সংগঠনটির উগ্র হিন্দুত্ববাদী চরিত্র সম্পর্কে কোনও মতান্তর থাকতে পারে না। বরং হিন্দু মহাসভা মুসলিম লিগের চেয়েও আক্রমণাত্মক ছিল। তাই বলা যায়, ১৯০৯ সালে পাঞ্জাব হিন্দু মহাসভা প্রতিষ্ঠা হলে লালা লালচাঁদ ও উপেন্দ্রনাথ মুখার্জি সেখানে হিন্দু সাম্প্রদায়িক মতাদর্শ ও বিভেদমূলক রাজনীতির ভিত্তি স্থাপন করে দ্বিজাতিতত্ত্বের প্রকৃত প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। রমেশচন্দ্র মজুমদার তার ‘Struggle for Freedom’ গ্রন্থে যথার্থভাবেই বলেছেন, সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে দেশভাগ করার কথা ওঠার পিছনে একটা গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বহুলাংশে কাজ করেছে, সেটা ছিল হিন্দু মহাসভা। যাইহােক, ১৯২১ থেকে ১৯২৩ সাল পর্যন্ত দেশের জাতীয় আন্দোলনের পর্যায়ক্রমে এই সংগঠনের নেতারা সংগঠনের শক্তি বৃদ্ধির জন্যে প্রয়ােজনীয় সময়কাল হিসেবে ধরে নেন। আর্য সমাজীদের আন্দোলন এবং তাদের সহমতাবলম্বী বিভিন্ন সংগঠনের সাম্প্রদায়িকতার পক্ষে ধারাবাহিক কার্যকলাপ হিন্দু মহাসভার ক্ষেত্র বিস্তারের জন্যে দরকারি কাজটি ভালােভাবে সম্পন্ন করে দিল। গাে-রক্ষা আন্দোলন সামগ্রিকভাবে হিন্দু মহাসভাকে তাদের উচ্চভাবনার প্রসার ঘটিয়ে সাংগঠনিক বিস্তারের পথটিকে অনেকটাই পরিষ্কার করে দেয়। ১৯২১ থেকে ১৯২৩ সালের মধ্যবর্তী সময়কালে এইসব পরিবেশ পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে হিন্দু মহাসভা ভালাে রকমের শক্তি সঞ্চয় করে নেয়। অসহযােগ আন্দোলনকে কেন্দ্র করে কিছু মুসলিম উলেমা রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। মুসলিম উলেমাদের রাজনীতিতে প্রবেশের বিষয়টাকে যথেষ্ট গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করে উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী নেতারা মুসলিম উলেমাদের রাজনীতিতে প্রবেশের সম্ভাবনা অনুভব করে পরিস্থিতিকে জটিল করে তােলে। এইসব ঘটনাবলির পরিপ্রেক্ষিতে হিন্দু মহাসভা গােটা উত্তর ভারত জুড়েই নানা সাম্প্রদায়িক উসকানি শুরু করে। বিশেষ করে যুক্তপ্রদেশ, দিল্লি, অবিভক্ত পাঞ্জাব এবং বিহারে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার ঘােলা জলেই মাছ ধরতে নামে হিন্দু মহাসভা। বাংলা এবং মাদ্রাজ যেখানে আগে হিন্দু মহাসভার সামান্য কিছু প্রভাব ছিল সেখানেও এই ধরনের সভা সমাবেশ করতে শুরু করে হিন্দু মহাসভা।
১৯২৩ সালে বেনারসে হিন্দু মহাসভার অধিবেশন মদনমােহন মালব্যের সভাপতিত্বে নতুন সমারােহে সম্পন্ন হয়। সভাপতির ভাষণে মদনমােহন হিন্দুদের রক্ষা করার জন্য একটি স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। দৃঢ় সংবদ্ধ একটি হিন্দু সম্প্রদায় গড়ে তােলার জন্য প্রাদেশিক ও স্থানীয় স্তরে শাখা গঠন করার কথাও তিনি বলেন। শুধু তাই নয়, এই অধিবেশনে আর্য সমাজের শুদ্ধিকরণ প্রক্রিয়াকে কর্মসূচির প্রধান অঙ্গ হিসেবে ঘােষণা করা হল ও অপর প্রধান কর্মসূচি হল হিন্দি ভাষার প্রচার ও প্রতিষ্ঠা। এভাবে হিন্দুজাতি, হিন্দুধর্ম ও হিন্দি ভাষা—এই তিনটি বিষয়কে একই সত্তার তিনটি মুখ হিসেবে গ্রহণ করা হল।
বেনারসের এই সভা থেকেই হিন্দু মহাসভাকে আরও জোরদারভাবে কাজে এগােবার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। হিন্দুদের মধ্যে যাতে ভালােভাবে কাজ করা যায় সেই লক্ষেই পুনরুজ্জীবিত করা হয় হিন্দু মহাসভাকে। সংযুক্ত প্রদেশে হিন্দু পুনরুস্থানবাদী চিন্তা-চেতনার প্রসারের ক্ষেত্রে সবথেকে উল্লেখযােগ্য নেতৃত্বে ছিলেন মদনমােহন মালব্য। তিনি হিন্দু মহাসভার পুনর্গঠনের কারণ ব্যাখ্যা করে বলেন, নানা কারণে হিন্দু সমাজের মধ্যে যে নেতিবাচক বিষয়গুলি প্রকট হয়ে উঠছে, যার ফলে এই সমাজে বিভিন্ন প্রকারের অবনতি ঘটছে। সেই অবনতি এবং পতনের হাত থেকে হিন্দু সমাজকে বাঁচাবার উদ্দেশ্য নিয়েই হিন্দু মহাসভাকে আবার জোরদার করে তােলা হবে। এই সংগঠনের প্রভাবে গােটা হিন্দু সমাজেরই উন্নতি ঘটবে। এই অধিবেশনের সভাপতি হিসেবে মদনমােহন মালব্য বলেন, মুসলমানেরা যে নিরাপদে দস্যুবৃত্তি করে চলেছে তা রুখবার জন্যে হিন্দুদের শক্তি সঞ্চয় করতে হবে। হিন্দুরা যদি নিজেদের শক্তিশালী করে গড়ে তােলে তা হলেই মুসলমানদের এই অত্যাচার প্রতিরােধ করা সম্ভব। এইভাবেই একটা সমতা বিধান করে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে ঐক্য স্থাপন করা সম্ভব।১১ গান্ধীজি যে অস্পৃশ্যতা, ছোঁয়াছুঁয়ির সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন, হিন্দু মহাসভা প্রথম থেকেই তার তীব্র বিরােধিতা করতে থাকে। মদনমােহন মালব্য তার এই বক্তৃতায় বর্ণ হিন্দুদের কাছে ছোঁয়াছুঁয়ির বিষয়টি বজায় রাখবার জন্যে আহ্বান জানিয়েছিলেন। বর্ণ হিন্দুদের এইভাবে ছোঁয়াছুঁয়ি বজায় রেখে নিজেদের খাঁটি হিন্দু হিসাবে প্রমাণ করা উচিত, এটাই ছিল মালব্যের বক্তব্য। এই স্পর্শকাতর বিষয়টি ইস্কুল থেকে শুরু করে মন্দির পর্যন্ত বজায় রাখবার কথা বলেন মালব্য। তিনি বলেন, যে সমস্ত হিন্দুদের বলপূর্বক মুসলমান করে দেওয়া হয়েছে তাদের পুনরায় স্বধর্মে ফিরে আসার জন্যে আন্দোলন শুরু হওয়া প্রয়ােজন। বেনারসের ওই সম্মেলনে পুরুষ এবং মহিলা—সকলেরই জন্যে শারীরিক ব্যায়ামের উপদেশ দেওয়া হয়। সক্রিয় মডেলে হিন্দুদের মধ্যে শৌর্যের মানসিকতা ফিরিয়ে নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত এই সভায় নেওয়া হয়। এভাবে হিন্দুদের মধ্যে একটা উগ্রতার মনােভাব সৃষ্টি করে তাদের মধ্যেকার যে ভয়ভীতি রয়েছে, তাকে কাটিয়ে তােলার সিদ্ধান্তও সেখানে নেওয়া হয়। এই ঘটনার মাত্র দু’বছর পরে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের প্রতিষ্ঠার পর যে উগ্রতার ভিত্তিতে হিন্দু সমাজের পুনর্গঠনের বিষয়টির ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরােপ করা হয়েছিল, তার সূচনা কিন্তু হিন্দু মহাসভার ওই বেনারস অধিবেশনেই হয়েছিল। পরবর্তী সভায় হিন্দু মহাসভার এই সক্রিয় মডেলে হিন্দু সমাজের পুনর্গঠনের চিন্তাটিই গ্রহণ করেছিল আরএসএস।
[৩]
১৯২৪ সালে বেলগাঁওয়ে কংগ্রেসের অধিবেশন ও হিন্দু মহাসভার অধিবেশন পাশাপাশি বসল—যেন একই অধিবেশনের দুটি পরিচ্ছেদ। সভাপতিরূপে মদনমােহন মালব্য উদ্দীপনাময় ভাষণে হিন্দু মহাসভার কর্মসূচিকে আরও আগ্রাসী করে তােলার আহ্বান জানান। হিন্দু স্বরাজের জন্যে পরিকল্পনা উত্থাপন করে রাজনৈতিক কর্মসূচিরও মূলসূত্র নির্দেশ করেন তিনি এই অধিবেশন থেকে। শুধু তাই নয়, এই অধিবেশনে বালগঙ্গাধর তিলকের বিশ্বস্ত অনুগামী ড. মুঞ্জে কর্তৃক আনিত হিন্দু সমাজ, হিন্দুধর্ম ও হিন্দি ভাষা বিষয়ক প্রস্তাবটি প্রভুত উদ্দীপনার সাথে গৃহীত হয়। ১৯২৫ সালে মদনমােহন দ্বিজাতিতত্ত্বকে সামনে রেখে আরও তীব্রভাবে হিন্দু সাম্প্রদায়িকতাকে ব্যবহার করা শুরু করলেন। একদিকে জিন্নাহ ও অন্যদিকে গান্ধীজির বিরােধিতা করার জন্য কংগ্রেসের ভেতরেই গঠন করলেন ‘ইন্ডিপেনডেন্ট কংগ্রেস পার্টি’। চিত্তরঞ্জন দাশ হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের (‘বেঙ্গল প্যাক্ট’) যে দিশা দিয়েছিলেন তা বাতিল করে এই পার্টি ঘােষণা করে যে, হিন্দুধর্ম বিপন্ন এবং এই পার্টির কর্মসূচির অন্যতম অঙ্গ ছিল নামাজের সময় মসজিদের সামনে বাজনা বাজানাে। এভাবে হিন্দু মহাসভার সাম্প্রদায়িক কার্যকলাপ বৃদ্ধি পেতে থাকে। ফলে আতঙ্কিত ও সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে কংগ্রেসের মুসলিম নেতৃবৃন্দ, সর্বোপরি ভারতের মুসলিম জনগণ।
১৯২৫-এ গয়ায় হিন্দু মহাসভার অধিবেশনে সভাপতির ভাষণে লালা লাজপত রাই-এর মতাে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব বলেন, অসহযােগ আন্দোলন এবং অহিংস আন্দোলন হিন্দু ঐক্যকে ভীষণভাবে দুর্বল করে দিয়েছে। এই দুর্বলতার প্রভাব আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনেও পড়তে শুরু করেছে। এইভাবে কোনাে কিছুই করা আমাদের পক্ষে শােভনীয় হতে পারে না যার ফলে হিন্দু সমাজ দুর্বল হয়ে যেতে পারে। হিন্দু সমাজকে দুর্বল করার এই ধরনের কোনাে প্রক্রিয়াকে উৎসাহিত করবার আমাদের আদৌ কোনাে প্রয়ােজনীয়তা নেই। অহিংসার আদর্শটা একটা ভ্রান্ত ধারণা মাত্র। এই আদর্শবাদের দ্বারা তাড়িত হয়ে আমাদের পক্ষে আদৌ কোনাে মহৎ কাজ করা সম্ভব হতে পারে না। তিনি অহিংস আন্দোলনের ফলশ্রুতি হিসেবে হিন্দু সমাজে আলস্যের আমদানি ঘটেছে বলে অভিযােগ করেন। লাজপত রাইয়ের মতে, এই আন্দোলনের ফলে হিন্দু সমাজের মধ্যে ভীরুতা একটা দীর্ঘস্থায়ী আসন অধিকার করেছে। তার মতে, এই আন্দোলন হিন্দু সমাজকে দাসত্বের মানসিকতায় নিমজ্জিত করেছে। লাজপত রাই যে অভিযােগগুলি উপস্থাপিত করেছিলেন হিন্দুত্ববাদী নেতাদের মধ্যে জোরদারভাবে পুনরুত্থানবাদের সমর্থকদেরও অহিংস, অসহযােগ আন্দোলন সম্পর্কে এমনটাই ধারণা ছিল।
লালা লাজপত রাই খিলাফত আন্দোলনের প্রতি নির্ভেজাল বিরাগ থেকে একথা ভাবতে শুরু করেন যে, হিন্দু ও মুসলিম একসঙ্গে বসবাস করতে পারে না। তাই তিনি চেয়েছিলেন মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারতের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল ও পূর্বাঞ্চল দেশের অবশিষ্ট অংশ থেকে পৃথক করে দেওয়া উচিত। তিনি ১৯২৫ সালে চিত্তরঞ্জন দাশকে এক পত্রে লেখেন,
“আমি গত ৬ মাসে আমার অধিকাংশ সময় মুসলিম ইতিহাস ও মুসলিম আইনকানুন নিয়ে পড়াশােনা করেছি। অবশেষে আমি এই চিন্তা করতে বাধ্য হয়েছি যে, হিন্দু-মুসলিম ঐক্য সম্ভব নয় ও প্রচলন করাও যাবে না। অসহযােগ আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী মুসলিম নেতাদের আন্তরিকতার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তিনি লেখেন, ওদের ধর্ম এ ধরনের যে কোনও কাজে কার্যকর প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে। এর কি প্রতিকার রয়েছে? আমি ৭ কোটি ভারতীয় মুসলিমদের জন্য মােটেই ভীত নই। কিন্তু আফগানিস্তান, মধ্য-এশিয়া, আরব, মেসােপটেমিয়া ও তুরস্কের আরও ৭ কোটির অধিক সশস্ত্র তাতার অপ্রতিরােধ্য হয়ে উঠবে। আমি হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের প্রয়ােজনীয়তা ও বাঞ্ছনীয়তা সরল ও আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করি। আমি মুসলিম নেতাদের বিশ্বাস করতে সম্পূর্ণভাবে প্রস্তুত, তবে কুরআন ও হাদীসের আদেশ এবং নির্দেশাবলীর কি হবে?”১২
খিলাফত আন্দোলন ও তার সঠিক প্রকৃতি সম্পর্কে লালা লাজপত রাই-এর সমঝদারীতে ভ্রান্তি ঘটে। খিলাফত আন্দোলন কোনও মুসলিম সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার লক্ষে শুরু হয়নি। ওই আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল, বিপদগ্রস্ত ইসলামের পবিত্র স্থান ও প্রতীকের হেফাজত করা। তা ছাড়া তাদের নিজেদের দেশের বিরুদ্ধে গিয়ে অন্য কোনও মুসলিম রাষ্ট্রকে উদ্ধার করার ব্যাপারে ভারতীয় মুসলিমদের কোনও দায় ছিল না। তার চেয়ে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন ঔপনিবেশিক শক্তির দিকে তাক করেছিল। আর ওই ঔপনিবেশিক শক্তি ইসলামের পবিত্র স্থানগুলাের প্রতি হুমকি হয়ে উঠছিল। এই ব্যাপারটি খিলাফত আন্দোলনের তৎপরতা বৃদ্ধি করে। সেই আন্দোলনকে প্যান-ইসলামিজম বলে বর্ণনা করা হয়ে থাকে। ভারতের এক শ্রেণির উলেমার (ধর্মীয় পণ্ডিতবর্গ) মধ্যে এই আন্দোলন দানা বাঁধে। ওই আন্দোলন ঔপনিবেশিক শক্তির প্রতি হুমকিস্বরূপ হয়ে ওঠে। সাধারণ মানুষের মধ্যে ওই আন্দোলনের তেমন কোনও তাৎপর্যপূর্ণ জনপ্রিয়তা লক্ষ্য করা যায়নি। তা ছাড়া কোনও দিক দিয়েই সেই আন্দোলন হিন্দু-বিরােধী ছিল না।
প্রতিবেশী দেশগুলাের মুসলিমদের জনশক্তির সম্পর্কে লালা লাজপত রাই-এর সংখ্যাসূচক বিশ্লেষণ এবং তাদের ধর্মীয় গ্রন্থগুলাের ধারকশক্তিই তাকে এক সরল সমাধান সূত্রের পরামর্শ দানে উদ্বুদ্ধ করে। তাই ১৯২৪ সালেই তার পরামর্শ ছিল “পঞ্জাবকে দুটো প্রদেশে বিভক্ত করা উচিত। ব্যাপক মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ পশ্চিম পাঞ্জাব মুসলিম শাসিত প্রদেশ এবং বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু-শিখ অধ্যুষিত পূর্ব পাঞ্জাব অমুসলিম শাসিত প্রদেশ হবে। বাংলা যদি মি. দাশের চুক্তি মেনে নিতে রাজি থাকে, তাহলে আমি নিশ্চয়ই তাদের (বাঙালি) ওই একই পরামর্শ দেব না। আমার করার কিছুই নেই—আমার স্কিমে মুসলিমদের চারটি প্রদেশ থাকবে ১) পাঠান প্রদেশ অথবা উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত ২) পশ্চিম পাঞ্জাব ৩) সিন্ধু এবং ৪) পূর্ববঙ্গ। এর অর্থই হল ভারতের অঙ্গচ্ছেদ এবং তা হল মুসলিম বিমুক্ত ভারত।”১৩
[৪]
পুরুষােত্তমদাস ট্যান্ডনের (১৮৮২-১৯৬২) অতীতের রাজনৈতিক জীবনেও হিন্দু ধারাবাহিকতাবাদী স্রোতের সঙ্গে একটা অভিন্ন অবস্থান বজায় ছিল। ১৯৪৭ সালের পরবর্তী সময় থেকে তিনি তাে প্রায় সরাসরি হিন্দু ধারাবাহিকতাবাদীদের স্রোতের সঙ্গেই গা মিলিয়ে চলছিলেন। ট্যান্ডন তার রাজনৈতিক জীবন শুরু করেছিলেন এলাহাবাদে মদনমােহন মালব্যের রাজনৈতিক উত্থানকে ঘিরে। মালব্যের মাধ্যমেই ১৯১৪ সালে হিন্দি সাহিত্য সম্মেলনে ট্যান্ডন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। এই হিন্দি সাহিত্য সম্মেলন নামক মারাত্মক প্রতিক্রিয়াশীল সংগঠনটি মদনমােহন মালব্যই প্রতিষ্ঠা করেন ১৯১০ সালে। এই সংগঠনটি হিন্দি ভাষাকে প্রয়ােগের নাম করে ভাষাভিত্তিক সাম্প্রদায়িকতাকে উৎসাহ দিত। মহাত্মা গান্ধীও প্রথম জীবনে এই সংগঠনের সদস্য ছিলেন। তবে এই সংগঠনকে উপলক্ষ্য করে হিন্দি ভাষা হিন্দু এবং মুসলমান উভয় সম্প্রদায়েরই পরিচিতি ভাষা—এমনটাই ছিল মহাত্মার বক্তব্য। তবে এই হিন্দি ভাষাকে কেন্দ্র করে কোনাে আন্দোলন করার পরিকল্পনার সঙ্গে গান্ধীজি সহমত পােষণ করতে পারেননি এবং ১৯৪৫ সালে তিনি এই সংগঠন থেকে পদত্যাগ করেছিলেন। এই সংগঠনটির পরিচালনা ছিল ট্যান্ডনের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। ট্যান্ডন কিন্তু শেঠ গােবিন্দ দাসের মতাে উত্তরাধিকারবাদী হিন্দু জাতীয়তাবাদী মানসিকতা নিয়েই তার যাবতীয় কাজকর্ম করেছিলেন।১৪ আর্য সমাজীদের দ্বারা সৃষ্ট পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্কের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন ট্যান্ডন। যুক্তপ্রদেশে ১৯২৫ সালে এই ব্যাঙ্কের একটি শাখা খােলা হয় ট্যান্ডনের উদ্যোগে। তিনি নিজে ব্যাঙ্কের সংশ্লিষ্ট শাখাটির সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন ১৯২৭ থেকে ১৯২৯ সাল পর্যন্ত। কংগ্রেসের মধ্যে এই ধরনের প্রতিক্রিয়াশীল সাম্প্রদায়িক চিন্তার অন্যতম উত্তরাধিকারী ছিলেন চক্রবর্তী রাজাগােপালাচারীও (১৮৭৮-১৯৭২)। কংগ্রেসের মধ্যেকার এই একাংশের প্রতিক্রিয়াশীলতা এবং প্রকাশ্যে হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার প্রতি ঝোক হিন্দু মহাসভাকে বিশেষভাবে সাহায্য করেছিল।
হিন্দু মহাসভার অন্যতম নেতা লালা হরদয়াল (১৮৮৪-১৯৩৯) লাহােরের ‘প্রতাপ’ পত্রিকায় ১৯২৫ সালে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে উগ্র ভাষায় ঘােষণা করেছিলেন, জাতি হিসেবে হিন্দুদের গড়ে তােলার জন্য প্রয়ােজন হিন্দু সংগঠন, হিন্দু রাজ, হিন্দুস্থানের মুসলমানদের হিন্দুধর্মে দীক্ষা দান ও ভবিষ্যতে বিপদের হাত থেকে হিন্দুদের রক্ষার জন্য আফগানিস্তান ও পাশের দেশগুলি জয় করে সেইসব দেশের মানুষদের হিন্দুধর্মে দীক্ষা দান। এর পরে পরেই মুসলিম লিগের বার্ষিক অধিবেশনে সভাপতি। আবদুর রহিম তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেছিলেন যে, হিন্দুদের আগ্রাসী মনােভাবের মুখে দাঁড়িয়ে মুসলমানদের আত্মরক্ষার জন্য মুসলিম লিগের প্রয়ােজনীয়তা অনেক বেশি বেড়ে গেছে। ধর্মীয় স্পর্ধা ও প্রতি স্পর্ধার এই দ্বন্দ্বমুখর প্রেক্ষিতেই কেশব বলিরাম হেডগেওয়ার (১৮৮৯-১৯৪০) জাতীয় কংগ্রেস ত্যাগ করে নাগপুরে উগ্র হিন্দুত্বের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে ১৯২৫-এর বিজয়া দশমীতে হিন্দু জাতীয়তাবাদী বাহিনী গড়ে তােলার লক্ষেই রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস) প্রতিষ্ঠা করেন।
‘হিন্দুত্ব’-এর মতাদর্শ নির্মাণের জন্য বিশেষ সাংগঠনিক তৎপরতার মূল শিকড়টি ছিল আরএসএস-এর রাজনৈতিক কার্যকলাপের মধ্যে প্রােথিত, তার সূত্রপাত ঘটে ১৯২০-র দশকে। আরএসএস-এর মূল সংগঠনকে কেন্দ্র করেই ‘হিন্দুত্ব’র প্রবত্তারা হিন্দু মহাসভার কাছে আসেন। ওই কেন্দ্রকে ঘিরেই ক্রমশ গড়ে ওঠে ভারতীয় জনসংঘ, তারপরে বি.জে.পি. এবং আরেকটি পর্যায়ে বিশ্বহিন্দু পরিষদ ও সংঘ পরিবারের অন্যান্য শাখা সংগঠন। ১৯২৩ সালে বিনায়ক দামােদর সাভারকরের (১৮৮৩-১৯৬৬) ‘হিন্দুত্ব হু ইজ আ হিন্দু’ পুস্তিকায় আধুনিক ‘হিন্দুত্ব’ প্রথম সংজ্ঞা লাভ করেছিল,
“হিন্দু এমন মানুষ যিনি সিন্ধু থেকে সাগর পর্যন্ত বিস্তৃত ভারতবর্ষকে নিজের পিতৃভূমি ও পূণ্যভূমি এবং তাঁর ধর্মের জন্মস্থান বলে মনে করেন।”
হিন্দুত্বের সাংগঠনিক স্বরূপ প্রথম প্রকাশ পায় আর.এস.এস. প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। এই কাজে হেডগেওয়ারকে সহযােগিতা করেছিলেন বি এস মুঞ্জে (১৮৭২-১৯৪৮), এল ভি পরাঞ্জপে (১৮৭৭-১৯৫৮), ডা. বি বি তালকার এবং ভি ডি সাভারকরের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা গণেশ দামােদর সাভারকর (১৮৭৯-১৯৪৫)। পরবর্তী সময়ে উপরােক্ত ব্যক্তিদের নাম আরএসএস-এর সরকারি। প্রচার পুস্তিকায় বিশেষ আর দেখা যায় না। এর থেকে অনুমান করা হয় উপরােক্ত ব্যক্তিরা হিন্দু মহাসভার সদস্য ছিলেন বলেই এ ধরনের উদাসিনতার শিকার হয়েছিলেন। কারণ হিন্দু মহাসভার সঙ্গে আরএসএস-এর সম্পর্ক খুব উষ্ণ ছিল না। ব্যাখ্যাটি অসম্পূর্ণ, পুরাে সত্য তুলে ধরে না। আসল ব্যাখ্যাটি হল ১৯২৯-র নভেম্বর মাসে হেডগেওয়ার নিজেকে ঘােষণা করলেন। ‘সরসংঘ চালক’ হিসেবে (কেউ কেউ বলেন, প্রবীণ সেবকরা সবাই তাকে একবাক্যে প্রধান হিসেবে স্বীকার করে নেন)। ‘সরসংঘ চালক’-এর সর্বোচ্চ ক্ষামতা থাকবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার। তিনি সমস্ত কর্মকর্তা নিয়ােগ করবেন এবং ব্যক্তিগতভাবে আরএসএসএর কাজের উপর খবরদারি করবেন এবং এই পদে আজীবন আসীন থাকবেন। যদি তাই হয় তাহলে হেডগেওয়ারেরই কৃতিত্ব একমাত্র আরএসএস-এর প্রচার পুস্তিকায় স্থান পাবে—অন্য কারাে নয়। মনে রাখা প্রয়ােজন তার উত্তরাধিকার মাধব সদাশিব গােলওয়ালকর তাকে ‘অবতার’ বলে ঘােষণা করেছিলেন এবং নাগপুরের হেডগেওয়ারের সমাধি মন্দিরে স্বয়ংসবেকদের তীর্থযাত্রায়। যাওয়া এক অবশ্য কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। তাছাড়া মুঞ্জে, সাভারকর এঁরা সবাই চেয়েছিলেন আরএসএস হিন্দু মহাসভার স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী হিসেবে কাজ করুক, কিন্তু তাতে হেডগেওয়ারের সায় ছিল না। বড়জোর আর.এস.এস. সহযােগী হিসেবে কাজ করতে প্রস্তুত ছিল এবং সে কাজ তারা করেও ছিল ১৯২৭ সালের ডিসেম্বর মাসে আমেদাবাদে হিন্দু মহাসভার অধিবেশনে খাকি। পােশাক পরিহিত স্বয়ংসেবক বাহিনী পাঠিয়ে।
এরপরের পর্যায়ে ১৯২৭ সালে, আরএসএস-এর ব্যাপ্তির সুযােগ আসে নাগপুরের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে। ১৯৩০-এর দশকে হিন্দু মহাসভার সাথে যােগাযােগ আরএসএসকে সাহায্য করেছিল উত্তর ভারতের হিন্দিভাষী অঞ্চলে অনুপ্রবেশ করতে। হিন্দু মহাসভার নেতা শ্যামাপ্রসাদ মুখােপাধ্যায় ১৯৪০ সালে লাহােরে আরএসএস-এর শাখায় বক্তৃতা করতে গিয়ে বলেছিলেন যে, ‘ওই শাখা সংগঠন ভারতের মেঘলা আকাশে একমাত্র রূপােলী আলাে’। ১৯৩৭ থেকে ১৯৪০-এর মধ্যে উত্তর ভারতে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের অবনতির প্রোপটে ‘হিন্দুত্ব’ তার সাংগঠনিক শক্তি প্রসারিত করেছিল। ১৯৩৮ সালে সারা দেশে ৪০০টি আরএসএস শাখা ও ৪০,০০০ সদস্য নথিভুক্ত ছিল। লক্ষণীয় বিষয়, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘে ভরতি করার জন্য জোর দেওয়া হয়েছিল ব্যবসায়ী, দোকানদার, মধ্যবিত্ত করণিক ও স্কুল-কলেজের ছাত্রদের উপর।
আরএসএস-এর লক্ষ্য ছিল জনগণকে এমন এক আঙ্গিক দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে তােলা, যার মূলকথা হল—ভারতবর্ষে হিন্দুরাই একমাত্র জাতি, হিন্দুত্বই হল রাষ্ট্রীয়ত্ব বা জাতীয়তা ও কেবল হিন্দুরাই হিন্দুস্থানের মুত্তি আনতে ও হিন্দু সংস্কৃতিকে রক্ষা করতে সক্ষম। আরএসএস-এর জন্মলগ্ন থেকেই প্রচারকদের কাঙ্খিত হিন্দুরাষ্ট্রের প্রতীক রাম। একই প্রতীকী উদ্দেশ্যে ‘ভাগওয়া ঝাণ্ডা’ বা ‘গেরুয়া পতাকা’ গ্রহণ করা হয়। পরে প্রচারকদের ইউনিফর্ম হিসেবে নির্দিষ্ট করা হয়েছিল খাকি হাফ প্যান্ট। সংগঠনটির আদর্শ স্বাধীনতাকামী ঐক্যবদ্ধ ভারত নয়, তার লক্ষ্য একটি হিন্দু রাষ্ট্র কারণ ‘হিন্দুত্ব’-এর তত্ত্ব অনুযায়ী ভারতীয় জাতি শুধু হিন্দুরাই গঠন করতে পারে। যখন কল্পবিলাসীরা জাতীয় রাজনৈতিক আকাশ ছাড়িয়ে কি ঘটতে চলেছে তা দেখতে চাইছে না, তখন বাস্তববাদী হিসেবে হেডগেওয়ার কোনওরকম স্বপ্নবিলাসী হতে রাজী ছিলেন না। তিনি বলেন,
“সত্য প্রকাশ হয়ে পড়েছে। একমাত্র হিন্দুস্তানকে মুক্ত করবে হিন্দুরা এবং তারাই হিন্দু সংস্কৃতিকে রক্ষা করতে পারে। তথ্যভিত্তিক যুক্তির হাত থেকে কারুর রেহাই নেই। দেশ মাতৃকাকে সম্পূর্ণ ভালবাসা ও ব্যক্তিগত চরিত্রকে ভিত্তি করে হিন্দু তরুণদের সংগঠিত করতে হবে। অন্য কোনও পথ নেই। রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ গঠনের মধ্য দিয়ে মহান আত্মার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।”
আর এস এস প্রতিষ্ঠার অন্তর্নিহিত রাজনৈতিক তাগিদ এসেছিল তিনটি জরুরি কারণ থেকে যা ধরা পড়ে হেডগেওয়ারের একটি লেখা থেকে “মহাত্মা গান্ধীর অসহযােগ আন্দোলনের ফলে দেশে উৎসাহ ক্রমে শীতল হয়ে যাচ্ছিল এবং এই আন্দোলনসৃষ্ট অশুভ শক্তিগুলি সমাজ-জীবনে বিপজ্জনকভাবে মাথা চাড়া দিচ্ছিল।…ব্রাহ্মণ-অব্রাহ্মণ সংঘর্ষ খােলাখুলি হতে থাকে। …অসহযােগের দুগ্ধপান করে বেড়ে ওঠা যবন-সর্প তার বিষাক্ত নিঃর্বাস দিয়ে দেশে দাঙ্গার প্ররােচনা দিচ্ছিল।” লেখাটি পড়লেই বুঝতে পারা যায় যে, ‘হিন্দুত্ব’ও আরএসএস-এর উৎপত্তির সূত্রপাত ইংরেজ শাসকদের বিরােধিতার তাগিদে নয়। বরং ভারতীয় জাতীয়তাবাদের ইতিহাসে হিন্দু-মুসলমানের ব্রিটিশ-বিরােধী ঐক্যের উল্লেখযােগ্য ঘটনা অসহযােগ আন্দোলনকেই আর.এস.এস.এর শীর্ষস্থানীয় নেতা হেডগেওয়ার তার প্রাথমিক আক্রমণের লক্ষ্য হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন।
আর.এস.এস.-এর বয়ান অথবা হেডগেওয়ারের বক্তব্য যদি পর্যালােচনা করা যায় তাহলে দেখা যাবে এতে আছে অর্ধসত্য এবং জাতি বিদ্বেষ এবং জাতীয় আন্দোলনের প্রতি অবজ্ঞা। হেডগেওয়ারের মতে, গান্ধীজির নেতৃত্বে অসহযােগ আন্দোলন। ‘যবনরূপ সর্প’ অর্থাৎ মুসলমানদের শক্তি বৃদ্ধিতে সাহায্য করেছে এবং খিলাফতের অস্তিত্ব বিলােপের সঙ্গে সঙ্গে তারা স্বাধীনতার আন্দোলন থেকে সরে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু একথা সবাই জানে মুসলমানরা নয় গান্ধীজি হঠাৎ চৌরিচৌরায় পুলিশ ফাঁড়ি আক্রমণের ঘটনাকে (১৯২২) কেন্দ্র করে অসহযােগ আন্দোলন প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন। গান্ধীজির কথায়, আন্দোলনে হিংসার ছোঁয়া লেগেছে। সরকারি বয়ানে হেডগেওয়ারের বক্তব্য অনুযায়ী দাবি করা হয়েছে ভারতে হিন্দুরাই হল ‘নেশন’। এ ধরনের ধারণা গড়ে উঠেছে প্রাচ্য পণ্ডিতদের—যাঁদের অধিকাংশই ছিলেন ইউরােপীয়, ‘ওরিয়েন্টালিস্ট’ বলে। পরিচিত—জ্ঞানচর্চাকে ভিত্তি করে এঁরা একটা মিথ তৈরি করে দিয়ে গেছেন—আর্যদের উৎপত্তি, বৈদিক বিশুদ্ধতা ও মুসলমানদের অত্যাচার সম্পর্কে। এইসব মিথকে ভাঙার পরিবর্তে আরও জোরদার করেছেন উচ্চবর্ণীয় হিন্দুরা—ফলে অতীত গৌরব এক সুখকর স্মৃতি বা নষ্টালজিয়া হয়ে দাঁড়িয়েছে।১৫ এই ধরনের পুনরুত্থানের সঙ্গে জাতীয়তার কোনও যােগ নেই। গ্রামসি বলেছেন, ‘নেশন’ অর্থহীন হয়ে পড়ে যদি তা ‘দ্য পিপল’কে অন্তর্ভুক্ত না করে। আর হেডগেওয়ারের কল্পিত ‘নেশন’-এ হিন্দু ছাড়া অন্য কারাের স্থান নেই। আবার মালাবারের মােপালা বিদ্রোহ হিন্দু বিদ্বেষী দাঙ্গা ছিল না, এটি প্রধানত অনুষ্ঠিত হয়েছিল অত্যাচারী জমিদারদের বিরুদ্ধে কৃষক বিদ্রোহ হিসেবে।১৬ যাইহােক, পূর্বোক্ত সরকারি বয়ান একটা বিষয় পরিষ্কার করে দিয়েছে যে, হেডগেওয়ারের আরএসএস তৈরীর পেছনে অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল তরুণ ‘হিন্দুদের হিন্দুত্ব’ বােধে উদ্বুদ্ধ করে ঐক্যবদ্ধ করা। তারা ‘যবনরূপ সর্প’ সম্পর্কে সচেতন থেকে যদি সংগঠিত ও ঐক্যবদ্ধ হয় তবেই হিন্দুস্থানকে মুক্ত করতে পারবে। গান্ধী-মার্কা কোনও জাতীয় আন্দোলনে যােগ দেওয়া চলবে না। হেডগেওয়ার নিজে আইন অমান্য আন্দোলনে যােগ দিয়েছিলেন ব্যক্তিগত সত্যাগ্রহী হিসেবে, সংঘকে যােগদানের অনুমতি দেননি। এ কারণে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে আর এস এস-এর সংগঠন হিসেবে অবদান নেই।১৭
[৫]
১৯৪০ সালে হেডগেওয়ারের মৃত্যুর পর আর এস এস-এর প্রধান হন মাধব সদাশিব গােলওয়ালকর (১৯০৬-১৯৭৩)। হেডগেওয়ার ছিলেন মূলত একজন হিন্দু পুনরুজ্জীবনবাদী সংগঠক, আর গােলওয়ালকর সেই সংগঠনকে হিন্দু-হিন্দুত্ব-হিন্দুরাষ্ট্রের এক সামগ্রিক জাতীয়তাবাদী তত্ত্ব-কাঠামােই সংবদ্ধ করে মতাদর্শগতভাবে আরও উগ্রতা দান করেন। তার সময়ে আরএসএস দেশের সবচেয়ে শক্তিশালী ও প্রভাবশালী হিন্দুধর্মীয় সাম্প্রদায়িক সংগঠনে পরিণত হয়েছিল। ১৯৩৯ সালে প্রকাশিত ‘উই অর আওয়ার নেশনহুড ডিফাইনড’ গ্রন্থে১৮ গােলওয়ালকর জাতিকে যে পাঁচটি স্বতন্ত্র ঐক্যের সমন্বয়ে গঠিত এক অবিভাজ্য ঐকিক সত্তা হিসেবে উপস্থাপন করেছেন তা কার্যত হিন্দুভূমি-হিন্দুধর্ম-হিন্দুভাষা-হিন্দু সংস্কৃতিসম্পন্ন এক নৃগােষ্ঠীগত ঐক্যের ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত। জাতীয় সংহতি সাধনে ধর্মনিরপেক্ষতার পথ তার পথ নয় আদৌ—তার পথ দ্বিজাতিতত্ত্বজনিত বিভেদমূলক পথ। ‘স্বরাজ’ শব্দটির ‘স্ব’ বা ‘আমরা’র (‘উই’) অর্থ অনুসন্ধানের শেষে ‘উই’ গ্রন্থে জাতীয়ত্বের যে সংজ্ঞায় গােলওয়ালকর উপনীত হয়েছিলেন, সেই অনুযায়ী স্ব’-এর অর্থ হিন্দু ও ‘স্বরাজ’-এর অর্থ হিন্দুরাজ বা হিন্দুরাষ্ট্র।
‘উই’ গ্রন্থটি গণতন্ত্র ও সংখ্যালঘুদের সম্বন্ধে আরএসএস নেতৃত্বের মনােভাব ঠিক কেমন, সে বিষয়ে প্রচুর উপাদান সমৃদ্ধ। এই গ্রন্থে হিটলারের নাৎসি সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদের প্রশংসা করতে গিয়ে গােলওয়ালকর বলেছেন,
“জার্মানির জাতিগত গর্ব আজ একটা আলােচনার বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছে। জাতি এবং তার সংস্কৃতির বিশুদ্ধতা রক্ষা করার জন্য দেশ থেকে সেমিটিক জাতিগুলিকে, অর্থাৎ ইহুদিদের সাফ করে দিয়ে সারা পৃথিবীকে কাপিয়ে দিয়েছে জার্মানরা। জাতিবর্গের চরম প্রকাশ দেখা গেছে। সেখানে জার্মানি আরও দেখিয়ে দিয়েছে মূলগত পার্থক্যবিশিষ্ট বিভিন্ন জাতি ও সংস্কৃতির পক্ষে একটি একীভূত সমগ্র হিসেবে একাত্মীভূত হওয়া কতখানি অসম্ভব। এ এমন এক শিক্ষা যা আমাদের হিন্দুস্থানের পক্ষে শেখা ও তা কাজে লাগিয়ে লাভবান হওয়া উচিত।”১৯
গােলওয়ালকরের রচনায় একটি অনুচ্ছেদ আছে যেখানে তিনি ব্রিটিশ-বিরােধী ভারতীয় জাতীয়তাবাদেরও সমালােচনা করেছেন,
“ব্রিটিশ-বিরােধিতার সঙ্গে দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদকে সমার্থক করে দেখা হয়েছে। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম, তার নেতৃবর্গ এবং সাধারণ মানুষের উপরে এই প্রতিক্রিয়াশীল মতের প্রভাব সর্বনাশা হয়েছে।”
যাবতীয় তথ্য এই সংগঠনের সংহতিনাশক কার্যকলাপের প্রমাণ দেয় এবং দেখিয়ে দেয় যে, এই সংগঠন ও তার নেতারা কখনােই স্বাধীনতা সংগ্রামের অংশীদার ছিলেন না। হিন্দুরাষ্ট্রের চরম স্বতন্ত্রবাদী ধুয়াে তুলে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে ভারতীয় জনগণের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের সংহতি নষ্ট করার লাগাতার প্রচেষ্টাই ছিল আরএসএসের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ অবদান। স্বাধীনতা সংগ্রামের সমগ্র পর্যায়ে আরএসএস অত্যন্ত সন্দেহজনক ভুমিকাই পালন করেছিল। এই আন্দোলনগুলির মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য ১৯৪২-এর ‘ভারত ছাড়াে আন্দোলন’, আজাদ হিন্দ ফৌজের সংগ্রাম, আজাদ হিন্দ ফৌজের বিচার এবং বােম্বাইয়ের নৌ-বিদ্রোহকে ঘিরে ১৯৪৫ সালের গণঅভুত্থান। ব্রিটিশ-বিরােধী আন্দোলন থেকে দূরে থাকার ফলে মুসলিম লিগের মত তাদেরও যুদ্ধকালীন ব্রিটিশ নির্যাতনের সম্মুখীন হতে হয়নি। সেই অবসরে আরএসএস এবং সংঘ পরিবার তাদের সংগঠনের বৃদ্ধি ঘটাতে সক্ষম হয়েছিল দ্রুত হারে। যুদ্ধের সময় ঠিকেদারি ও নানা বাড়তি মুনাফার সুযােগ এসেছিল ভারতীয় শিল্পপতি ও ব্যবসায়ী শ্রেণির কাছে এবং ওই শ্রেণিই ১৯৪০-এর দশকে আর এস এস-এর সামাজিক ভিত্তি তৈরি করে দিয়েছিল। ১৯৪৬-৪৭ সালের সাম্প্রদায়িক বীভৎসতার দিনগুলিতে দাঙ্গায় প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ এবং তীব্র সাম্প্রদায়িক প্রচারের মাধ্যমে আর.এস.এস. বহু হিন্দুর মনে মুসলমানদের সম্পর্কে একটা ভয়ের মানসিকতা ঢুকিয়ে দিয়েছিল। এই সময় কংগ্রেস হাইকম্যান্ডের একাংশ, বিশেষ করে বল্লভভাই প্যাটেল আর.এস.এস-এর প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন হয়ে পড়েছিলেন।
গােলওয়ালকর তার ‘হিন্দুরাষ্ট্র’র ধারণাকে যে হিটলারের সর্বগ্রাসী ও ফ্যাসিস্ত ধরনের অনুসরণে গড়ে তুলেছিলেন তা স্পষ্ট হয়ে যায় ‘উই’ গ্রন্থেরই এই বক্তব্য থেকে “এইসব প্রাচীন রাষ্ট্রগুলি কীভাবে তাদের সংখ্যালঘু সমস্যার সমাধান করেছে, তা অবশ্যই মনে রাখতে হবে। নিজেদের রাষ্ট্রকাঠামােয় কোনও পৃথক উপাদানকে স্বীকৃতি দিতে রাজি হয়নি তারা। দেশের বৃহত্তম জনসংখ্যা বা রাষ্ট্রীয় জাতির মধ্যে একাত্মীভূত হতে হয়েছে বহিরাগত অভিবাসীদের, গ্রহণ করতে হয়েছে তাদের সংস্কৃতি ও ভাষা, অংশীদার হতে হয়েছে। তাদের আশা-আকাঙার, নিজেদের পৃথক অস্তিত্বের কথা সম্পূর্ণভাবে ভুলতে হয়েছে, ভুলতে হয়েছে তাদের বিদেশী উৎসের কথা। তা না করলে নিছক বহিরাগত হিসেবেই থাকতে হবে তাদের, রাষ্ট্রের সমস্ত বিধি-নিয়ম মেনে চলতে হবে, রাষ্ট্রের অধীনস্থ হয়ে থাকতে হবে, কোনও বিশেষ সুরক্ষা পাবে না, কোনও সুবিধা বা অধিকারের তাে প্রশ্নই ওঠে না। বহিরাগতদের জন্য মাত্র দুটি পথই খােলা আছে—হয় রাষ্ট্রীয় জাতির সঙ্গে মিশে যেতে হবে এবং তাদের সংস্কৃতি গ্রহণ করতে হবে, অথবা রাষ্ট্রীয় জাতি যতদিন চাইবে, ততদিন তাদের করুণার উপর নির্ভর করে বেঁচে থাকা এবং রাষ্ট্রীয় জাতি যখনই চাইবে, তখনই দেশ ছেড়ে চলে যাওয়া। সংখ্যালঘু সমস্যা সম্বন্ধে এটিই একমাত্র যুক্তিনিষ্ঠ দৃষ্টিভঙ্গি। এটিই একমাত্র যৌক্তিক ও সঠিক সমাধান। নিজেদের রাষ্ট্রকাঠামােয় রাষ্ট্রের মধ্যে রাষ্ট্র সৃষ্টির মতাে কর্কটরােগতুল্য বিপদ থেকে জাতিকে নিরাপদ রাখার এটাই একমাত্র উপায়।”২০
শেষপর্যন্ত হিটলারের পদাঙ্ক অনুসরণ করে সংখ্যালঘু সমস্যার সমাধানে পৌঁছেছেন গােলওয়ালকর,
“প্রাচীন জাতিগুলির গভীর অভিজ্ঞতার দ্বারা সমর্থিত দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায় যে, হিন্দুস্থানে বসবাসকারী বিদেশি জাতিগুলিকে অবশ্যই হিন্দু সংস্কৃতি ও ভাষা শিখতে হবে, হিন্দুধর্মকে সম্মান ও শ্রদ্ধা করতে শিখতে হবে, হিন্দু জাতি ও সংস্কৃতি অর্থাৎ হিন্দু রাষ্ট্রের ধারণাকে মহিমান্বিত করা ছাড়া অন্য কোনও ধারণাকে উৎসাহিত করা চলবে না এবং হিন্দু জাতির মধ্যে নিজেদের পৃথক অস্তিত্বকে অবশ্যই মিশিয়ে দিতে হবে, অন্যথায় এই দেশে থাকতে হলে তাদের পুরােপুরি হিন্দুদের পদানত হয়ে থাকতে হবে, কোনও কিছু দাবি করা চলবে না, কোনও সুযােগসুবিধা পাবে না, কোনও অগ্রাধিকারমূলক আচরণ বা নাগরিক অধিকার পাওয়ার তাে প্রশ্নই ওঠে না। এছাড়া আর কোনও পথ খােলা নেই তাদের জন্য। আমাদের দেশ এক সুপ্রাচীন দেশ। অন্যান্য সুপ্রাচীন দেশগুলির মতােই আমাদেরও যেসব বিদেশি জাতি আমাদের দেশে বসবাস করতে এসেছে, তাদের সঙ্গে একইরকম আচরণ করা উচিত।”২১
প্রশ্ন হল, বহুধর্মী ভারতবর্ষে জাতীয় ঐক্য গড়ে উঠবে কোন পথে? মুসলিম ও খ্রিস্টান ধর্মের এক ঈশ্বর, এক অবতার ও একই ধর্মগ্রন্থে বিশ্বাসকে ভারতবর্ষের হিন্দু-সংস্কৃতির সঙ্গে সাযুজ্যহীন বলে নিন্দা করে গােলওয়ালকর উদারতার ছদ্ম। আবরণে তার অঙ্গীভবন ও সাঙ্গীকরণের কঠিন ফরমানটি জারি করেন। তিনি বলেছিলেন, ভারতভূমির অন্তরে নিবিষ্ট হয়ে আছে সকল ধর্মবিশ্বাসের প্রতি ভালােবাসা ও শ্রদ্ধা। তাই অন্য ধর্মবিাসের প্রতি অসহিষ্ণু কেউ এদেশের সন্তান হতে পারে না।
এদেশের ঐতিহ্য একথা বলে না যে, উপাসনা-পদ্ধতি পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গেই এদেশের কোনাে সন্তান বিদেশি হয়ে গেল। সেক্ষেত্রে একমাত্র যে-পথে ভারতবর্ষে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সমস্যার সমাধান ও জাতীয় ঐক্য গড়ে তােলা সম্ভব, তা হল অঙ্গীভবন ও সাঙ্গীকরণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে হিন্দুত্বায়নের পবিত্র পথ। মুসলমান ও খ্রিস্টান-সহ নাগরিকদের কাছে তাই তার আহ্বান তারা যেন ধর্মীয় সংখ্যালঘুত্বের বােধ ও বিদেশি মানসিকতা ঝেড়ে ফেলে এই দেশের সাধারণ জাতীয় প্রবাহ তথা হিন্দুত্ব-প্রবাহের মধ্যে মিশে যেতে সচেষ্ট হন।
তার মানে গােলওয়ালকর স্বীকার করেন না, ভারত বহু সংস্কৃতির মিলনে মিশ্রণে সমৃদ্ধ। মানতে চান না, বৈচিত্র্য সত্বেও ঐক্যই ভারতের বৈশিষ্ট্য। ধর্মীয় সত্ত্বা ছাপিয়ে ভারতীয়দের মধ্যে এক সাংস্কৃতিক মিলন আছে—মানতে চান না তাও। তার কাছে যা কিছু অহিন্দু তা ভারতীয় নয়। তাহলে ভারতের সংস্কৃতিতে মুসলিমদের কোনও অবদান নেই? ভারতের সংস্কৃতি মধ্যযুগে তাে বটেই বর্তমানেও প্রতিনিয়ত নতুন নতুন মুসলিম সমাজ ও ব্যক্তিগতভাবে মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের অবদানে উন্নত হচ্ছে না? ভারতীয় সংগীত, সাহিত্য, স্থাপত্য, শিল্পকলা, চিত্রকলা, সিনেমা কখনও কি মুসলিমদের বাদ দিয়ে ভাবা যায়? মুসলিম রাজা-বাদশাহরা ইংরেজদের মতাে আমাদের দেশের সম্পদকে লুণ্ঠন করে বিদেশে নিয়ে যায়নি। তারা এদেশে এসেছে, এখানেই থেকে গিয়েছে এবং ভারতীয় সভ্যতার অঙ্গীভূত হয়েছে—একদিন যেমনটা হয়েছিল আর্য, অনার্য, দ্রাবিড়, চীন, শক, হুন, প্রভৃতি জনগােষ্ঠী।
গােলওয়ালকরের কাছে জিজ্ঞাসা—আমাদের জাতীয় প্রতীক অশােকস্তম্ভের ভবিষ্যৎ কী হবে? এটা তাে বৌদ্ধ সংস্কৃতির অঙ্গ। তা ছাড়া যে খেলাধুলা ভারতবাসীর কাছে খুবই জনপ্রিয়, যেমন ক্রিকেট, ফুটবল, ভলিবল, ব্যাটমিন্টন, টেনিস ইত্যাদি কোনােটাই হিন্দু সংস্কৃতির মধ্যে পড়ে না, সবই অহিন্দু-প্রসূত। তবে মহাভারত বা অন্যান্য পৌরাণিক গ্রন্থে পাশাখেলা, সােজা কথায় জুয়া খেলার উল্লেখ আছে। গােলওয়ালকরের হিন্দুরাষ্ট্রে জুয়া খেলা আর বেআইনি থাকবে মনে হয় না, জাতীয় খেলারও মর্যাদা পেতে পারে।
এমনকী ‘হিন্দু’ নামটিও স্বদেশীয় নয়, বিদেশি।২২ ‘দ্য হিন্দু ভিউ অফ লাইফ গ্রন্থে রাধাকৃষ্ণন এই মত ব্যক্ত করেছেন যে, স্থানবাচক শব্দ থেকে জাতিবাচক ‘হিন্দু’ শব্দটি এসেছে। তিনি সুস্পষ্টভাবে জানিয়েছেন যে, বিদেশিদের দ্বারাই ‘হিন্দু’ শব্দটির অথান্তর ঘটেছে। তা ছাড়া মুসলিমদের আগে কেউ কোথাও ধর্মবাচক শব্দ হিসেবে ‘হিন্দু’ শব্দটি প্রয়ােগ করেছেন, এমন কোনও দৃষ্টান্ত দেখতে পাওয়া যায় না। প্রাচীন ভারতের ইতিহাস বিশেষজ্ঞ রমিলা থাপার ঠিকই বলেছেন যে, প্রাক-ইসলামিক সমস্ত ধর্মকেই তাদের মধ্যে প্রভূত পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও হিন্দু শব্দটির অন্তর্গত ধরা হত। আবার নানা বিশ্বাস ও নানা দর্শনও এর মধ্যে ছিল।২৩ আরও একটি লেখায় রমিলা থাপার জানিয়েছেন যে, হিন্দু শব্দটি প্রাচীন উপাদানে নেই। তাঁর ভাষায়,
‘The idea of a single Hindu community conditioned by a common religious belief, social norms and religious practices, all extending across every religion and including all castes, is not reflected in the early sources.’২৪
তাই “আজ যে হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে নানা জাতপাত, নানা ধরনের ধর্মবিশ্বাস, হাজার-হাজার পূজা-আর্চা রীতিনীতি রয়েছে, তাদের ধমনীর মধ্যে কি বিশুদ্ধ আর্য রক্ত প্রবাহিত? বরং ইতিহাসে পাই অনার্যদের সংঘাত ও মিলন, সংমিশ্রণ ও সমন্বয়। বৈদিক যুগ শুরু হওয়ার তিন হাজার চারশাে নব্বই (১৫০০+১৯৯০) বছর পরে বিশুদ্ধ আর্যতত্ত্ব ও তাদের উত্তরসূরী হিসেবে হিন্দু সম্প্রদায়কে তুলে ধরা ইতিহাসসম্মত কি?”২৫
[৬]
জাতির প্রকাশ ধর্ম দিয়ে হয় না। ধর্মের ভিত্তিতে জাতিভেদ কোনও বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব নয়। একই জাতির মধ্যে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষ থাকতে পারে। যেমন বাঙালি বা মালয়ালী বা তামিল—তারা হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ যাই হােক না কেন জাতিতে এক। একই হিন্দু ধর্মের মধ্যে বাঙালি জাতি, ওড়িয়া জাতি, তামিল জাতি, এমনকি নেপালের নেপালী জাতি আছে। ধর্মে খ্রিস্টান অথচ জাতিতে পৃথক যেমন ইংরেজ, আমেরিকান, জার্মান ইত্যাদি। মুসলিমদের মধ্যেও বাঙালি, ওড়িয়া, তামিল প্রভৃতি জাতি আছে। ধর্মের ভিত্তিতে জাতিভেদ স্থির করা গােলওয়ালকরের ইচ্ছাকৃত একটা ভয়ঙ্কর ভুল। আর সেই কারণেই হিন্দুজাতি বা ‘হিন্দুরাষ্ট্র’র তত্ত্বটি একটি নিপাট বুজরুকি, কেননা হিন্দুরা কোনও জাতি নয়। ভারতের কিরাত ও নিষাদ ভূমিপুত্রদের সঙ্গে ভূমধ্যসাগরীয় দ্রাবিড়, নর্ডিক, আলপিনয়েড ও আর্মেনয়েডদের দ্রবণে উদ্ভূত এক মিশ্র জাতি। তাই ভারতের মধ্যে বিশুদ্ধ ‘হিন্দু’ সংস্কৃতির অনুসন্ধান করতে গেলে গােলওয়ালকরকে গলদঘর্ম হতে হবে। আসলে হিন্দু জাতি, হিন্দুরাষ্ট্র, হিন্দু সংস্কৃতি ইত্যাদির নামে গােলওয়ালকর আমাদের হাজার হাজার বছর পিছনে ঠেলে নিয়ে যেতে চান। তার ক্ষমতা নেই নতুন করে ভারতীয় সভ্যতাকে তথাকথিত হিন্দু সভ্যতায় রূপান্তরিত করা। তা করতে গেলে নিজেদের উত্তরাধিকারকেই অস্বীকার করতে হবে। আগে ‘মানুষ’ না হলে যেমন হিন্দু বা মুসলিম কিছুই হওয়া যায় না, হলেও তাতে কিছু আসে যায় না, তেমনই আগে ভারতীয় না হলে ‘হিন্দু’ হওয়া অর্থহীন।
অথচ হিন্দু আধিপত্যের অধীনেই যে জাতীয় ঐক্য গড়ে উঠবে, সেকথাটিও স্পষ্ট করে দিয়ে গােলওয়ালকর বলেছিলেন, এজন্য কোনাে বিশেষ আনুকূল্য তাে দূরের কথা, হিন্দুরাষ্ট্রের কাছে মুসলমান-খ্রিস্টানদের কোনাে বিশেষ দাবি, কোনাে বিশেষ অধিকার, এমনকী নাগরিকত্বের অধিকারও গ্রাহ্য হবে না। ধর্মান্তরিত মুসলমান ও খ্রিস্টানদের সম্বন্ধে কঠোরতম মনােভাব নিয়ে তিনি এই অভিমতও ব্যক্ত করেছিলেন যে, এই দেশে জন্মেও তারা নিজেদের এই দেশের সন্তান বলে মনে করে না। তাই জাতীয় সংকটের সময় এদের জেলে পুরে রাখা উচিত। সর্বোপরি, তিনি এমন অভিমত প্রকাশেও কুণ্ঠিত হননি যে, জার্মানিতে ইহুদিরা তাদের দৃঢ়প্রােথিত স্বাতন্ত্র্যবােধের কারণে পরিপূর্ণভাবে জার্মান জাতির অঙ্গীভূত হতে না পারায় যেভাবে জার্মান আত্মগরিমার নির্মম আঘাতে তাদের নিশ্চিহ্ন হতে হয়েছিল, তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে হিন্দুস্থান উপকৃত হতে পারে।
আসলে আমাদের দেশে ‘জাতীয়তাবাদ’ চেতনাটির জন্ম হয়েছে হিন্দু চেতনার গহ্বরে, সেই চেতনার কল্পলােকে আরােহন করেই জাতীয়তাবাদ এই দেশে বিস্তার লাভ করেছে। উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে ‘নেশন’ শব্দটি আমাদের দেশে খুবই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে, এর কারণ অবশ্যই সেই সময় ইতালি ও জার্মানিতে রাজনীতিভিত্তিক ‘নেশন’ গঠনের দাবি ক্রমশ জোরালাে হয়ে উঠছিল। ভারতে কিন্তু ন্যাশনালিজম বা জাতীয়তাবাদ কেবলমাত্র রাজনীতিকে আশ্রয় করে গড়ে উঠল না। এই জাতীয়তাবাদ তার জন্মের সময় থেকেই ধর্মের ক্ষেত্রেও আশ্রয় খুঁজতে শুরু করে। আর ক্রমে ক্রমেই ‘নেশন’ শব্দটি হিন্দুদের কাছে হয়ে উঠল জাতি গঠনের নতুন এক সূত্র। ধর্মবিশ্বাসের ভিত্তিতে জাতি গঠনের এই অশুভ প্রক্রিয়ার সূচনা উনিশ শতকের প্রারম্ভিক পর্বে ঘটলেও কালের আবর্তে তা বিষবৃষ্ণ হয়ে ওঠে, যাতে জলসিঞ্চন করেন বিশ শতকের রাজনীতিকগণ। শুরু হয় হিন্দুত্ব-রঞ্জিত দেশবন্দনা আর ধর্মকেন্দ্রিক রাজনীতির আস্ফালন। ‘হিন্দু আইডেনটিটি’ অবশেষে ‘হিন্দুজাতি’র রূপ পরিগ্রহ করে। এরই সমান্তরালে বেড়ে ওঠে ‘মুসলিম আইডেনটিটি’। ‘হিন্দুরাষ্ট্র’ তত্ত্বের জবাব ‘পাকিস্তান’।
তথ্যসূত্রঃ
- ১. উদ্ধৃত- সুরজিৎ দাশগুপ্ত, ভারতবর্ষ ও ইসলাম, ডি এম লাইব্রেরী, কলকাতা, ১৯৯১, পৃ. ২৫৩-৫৪। .
- ২. Kenneth W. Jones, Arya Dharma—Hindu Consciousness in Nineteenth Century Punjab, Manohar Book Service, New Delhi, 1976.
- ৩. Indra Prakash, A Review of The History and Works of the Hindu Mahasabha and The Hindu Sanghatan Movement 1938, Facsimile Publisher, New Delhi, Reprint 2015.
- ৪. লালা লালাদ, সেলফ অ্যাবনেগেশন ইন পলিটিক্স, লাহাের, ১৯৩৮।
- ৫. তারাচঁাদ, হিস্টরি অফ ফ্রিডম মুভমেন্ট ইন ইন্ডিয়া, খণ্ড-৪, প্রকাশনা বিভাগ তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রক, ভারত সরকার, নিউ দিল্লি, ১৯৯২, পৃ. ৩১৮।
- ৬. রমেশচন্দ্র মজুমদার সম্পাদিত, স্ট্রাগল ফর ফ্রিডম, ভারতীয় বিদ্যাভবন, বম্বে, ১৯৬৯, পৃ. ৫৩৮। ১৯২৩ সালে হিন্দু মহাসভার বেনারস অধিবেশনের পরে সনাতনী হিন্দুরা নতুন ভাবাবেগে উদ্বুদ্ধ হল। ফলে উত্তর-পশ্চিম থেকে দণিপশ্চিম ভারতে মুসলিম বিরােধী সাহিত্যের প্রকাশ শুরু হল। ১৯২৪ সালের সেপ্টেম্বরে কোহটের সনাতন ধর্মসভা সাংঘাতিক মুসলিম বিদ্বেষমূলক একটি পুস্তিকা প্রকাশ করে। এই মুসলিম বিরােধী সাহিত্যের প্রকাশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে ভয়ংকর প্রতিক্রিয়াকে অনিবার্য করে তুলল। ভয়ংকর সাম্প্রদায়িক কাণ্ড ঘটল কোহটে। লালা লাজপত রাই হিন্দু প্ররােচনার কথা স্বীকার করে বলেন যে, হিন্দু ও মুসলমানের যদি পৃথক পৃথক দেশ না থাকে তাহলে এরকম ঘটনা আবার ঘটতে পারে। এই উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে ১৯২৪ সালে লাহােরে মুসলিম লিগের অধিবেশন বসে জিন্নাহর সভাপতিত্বে। লালা লাজপতের পরামর্শকে বিশেষ ইঙ্গিতপূর্ণ ভেবে মুসলিম লিগও স্বায়ত্ত্বশাসনের ভিত্তিতে প্রদেশ বিভক্তিকরণের দাবি উত্থাপন করে এই অধিবেশনে। অর্থাৎ এক অর্থে প্রদেশগুলি হিন্দু প্রাধান্য যুক্ত প্রদেশ ও মুসলিম প্রাধান্য যুক্ত প্রদেশে বিভক্ত হবে আর জাতীয় সংহতির প্রতীক হিসেবে অবলম্বিত হবে যুক্তরাষ্ট্রীয় কেন্দ্রীয় শাসন পদ্ধতি। বলা বাহুল্য, লালা লাজপত রায়ের ভাবনাকে অনুসরণ করে বলা যায়, এটা দেশ ভাগের বিষয়ে প্রাথমিক জল্পনা-কল্পনা। (দেখুন- সুরজিৎ দাশগুপ্ত, প্রাগুত্ত(, পৃ. ২৫৭)।
- ৭. Asghar Ali Engineer, Communalism in India: A Historical and Empirical Study, S.Chand & Company Ltd, Mumbai, 1996, P. 83.
- ৮. হিন্দু মহাসভার জন্মবৃত্তান্ত বেশ রহস্যপূর্ণ। ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার বলেছেন, হিন্দু মহাসভার জন্ম ও বিকাশের ইতিহাস অস্পষ্ট। মুসলিম লিগ সৃষ্টির (১৯০৬) অনেক আগে ১৮৮২ সালে পাঞ্জাব প্রবাসী বাঙালি নবীনচন্দ্র রায়ের পৃষ্ঠপােষকতায় ও প্রত্যক্ষ্য সহযােগিতায় লাহােরে ‘হিন্দুসভা’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। নবীনচন্দ্র ছিলেন তার প্রথম সম্পাদক। (দেখুন-সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান, কলকাতা, ২০০১, পৃ. ২৪৫)। আমেরিকার চিকাগাে ধর্মসভায় স্বামী বিবেকানন্দের গগণচুম্বী সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয়ে ১৮৯৫ সালে রিদ্বারে কোনাে একটি ধর্মীয় মেলাকে উপলক্ষ্য করে অল ইন্ডিয়া হিন্দু কনফারেন্সের ধারার প্রবর্তন হয়। এই সংস্থাটির নামকরণের সঙ্গে খ্রিস্টান মৌলবাদী সংগঠন নায়েগ্রা বাইবেল কনফারেন্সের নামের আশ্চর্যজনক মিল রয়েছে। তারপর ১৮৯৬-এ হিন্দু মহাসভা নামকরণ হয়। মতান্তরে পাঞ্জাব হিন্দুসভা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯০৯ সালে, উপেন্দ্রনাথ মুখার্জি ও লালা লালচাঁদ ছিলেন তার নেতা। ১৯১৫ সালে সারা ভারত হিন্দু মহাসভা নামে সংঘ প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯১৫ সালের এপ্রিল মাসে কাশিমবাজারের মহারাজা মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দীর সভাপতিত্বে সারা ভারত হিন্দু মহাসভার প্রথম অধিবেশন হয়। (হিন্দু মহাসভার গঠন এবং প্রাথমিক বিস্তার সম্পর্কে বিস্তারিত তথের জন্যে উৎসাহী পাঠক দেখুন- Richard Gordon,The Hindu Mahasabha and the Indian National Congress, 1915-1926, Modern Asian Studies Vol. 9, No.2, Cambridge University Press,1975, P. 145-203). কাগজে-কলমে হিন্দু মহাসভার পুনঃ প্রতিষ্ঠা হয় ১৯২৩ সালের ১৮ আগস্ট বেনারস অধিবেশনের মধ্যে দিয়ে। তারপরে বেশ কিছুকাল বিভিন্ন ভাবে এই সংগঠনটি কাজ করে। বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়েই এই সংগঠনের সদর দপ্তর প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রথমেই এই সংগঠন কংগ্রেসের আদলে গােটা দেশকে ২৩টি ভাষাভিত্তিক অঞ্চলে ভাগ করে। ১৯২৪ সালে হিন্দু মহাসভা পুনর্গঠিত হওয়ার আগে এই সংগঠনের মাত্র ৯টি প্রাদেশিক শাখা ছিল এবং ৩৬২টি স্থানীয় শাখা ছিল। এই স্থানীয় শাখাগুলির ৮০ শতাংশই ছিল পাঞ্জাবের সংযুক্ত প্রদেশে এবং বিহারে। (বিস্তারিত তথ্যের জন্যে দেখুন-Richard Gordon, ibid, P. 173).
- ৯. অধ্যাপক গৌতম রায় এ বিষয়ে যথার্থই লিখেছেন যে, “কংগ্রেসের ভেতরের হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের আচরণ দেখে জিন্না ক্রমশ নিশ্চিত হন যে, কংগ্রেসে গান্ধীযুগের অবসানের পর ভারতের মুসলমানদের হিন্দুদের দয়ার ওপর বাস করতে হবে। এ সবেরই ফলশ্রুতি হিসাবে জিন্না বাধ্য হন দ্বিজাতিতত্ত্বের কোণে গিয়ে আশ্রয় নিতে। হিন্দু জাতিতত্ত্বের প্রবক্তরাই দ্বিজাতিতত্ত্বের প্রকৃত স্রষ্টা।” (গৌতম রায়, হিন্দুরাই দ্বিজাতিতত্ত্বের প্রকৃত স্রষ্টা, অন্তর্ভুক্ত- গৌতম রায়, আর এস এস ও হিন্দুত্বের স্বরূপ, পরিবেশক- মল্লিক ব্রাদার্স, কলকাতা, ২০০৩)। দ্বিজাতিতত্ত্বের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা ও দেশভাগের পরিকল্পনাকারী হিসেবে হিন্দু সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিবর্তন সম্পর্কে জানতে উৎসুক পাঠক দেখতে পারেন Thomas Blom, Democracy and Hindu Nationalism in Modern India, Oxford University Press, New Delhi, 2001; Christrophe Jaffrelot (ed.), Hindu Nationalism: A Reader, Permanent Black, Delhi, 2007; Katharine Adeney and Lawrence Saez (eds), Coalition Politics and Hindu Nationalism, Routledge, London, 2005; John Zavos, The Emergence of Hindu Nationalism in India, Oxford University Press, New Delhi, 2002 ;Veer Van der Peter, Religious Nationalism, Hindus and Muslims in India, University of California Press, Berkley, 1994. আরও দেখতে পারেন পারেন- বি ডি গ্রাহাম, হিন্দু ন্যাশনালিজম অ্যান্ড ইন্ডিয়ান পলিটিক্স দ্য ওরিজিন অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট অফ দ্য ভারতীয় জনসংঘ, কেমব্রিজ, ১৯৯০ এবং শ্যামাপ্রসাদ বসু, হিন্দু জাতীয়তাবাদ একটি ইতিবৃত্ত, এন ই পাবলিশার্স, কলকাতা, ২০০৬। এক্ষেত্রে অধ্যাপক গৌতম রায়ের এই ৩ টি বইও ভীষণ কার্যকরী—আর এস এস ও বর্তমান ভারত, শব্দের মিছিল প্রকাশনা, মেদিনীপুর শহর, ২০১৭ হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার বিবর্তন, পত্ৰভারতী, কলকাতা, ২০০৭ ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম হিন্দুত্ববাদীদের ভূমিকা, যুবশক্তির প্রকাশন, কলকাতা, ২০০৫।
- ১০. ‘লীডার’ পত্রিকা ২৩ -০৭-১৯২৩, এলাহাবাদ।
- ১১. ‘লীডার’ পত্রিকা, ২৩ -০৭-১৯২৩, এলাহাবাদ।
- ১২. ‘দ্য পিপল’ পত্রিকা ১৩-০৪-১৯২৯, লালা লাজপত রাই সংখ্যা।
- ১৩. ট্রিবিউন পত্রিকা ডিসেম্বর ১৯২৪, পাঞ্জাব। আরও দেখুন- ভি সি জোশী সম্পাদিত, লালা লাজপত রাই স্পিচেস অ্যান্ড রাইটিংস, ভলিউম-২ (১৯২০-২৮), নয়াদিল্লি, ১৯৬৬, পৃ. ২১২-২১৩। বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে মুসলিমদের কাছ থেকে নিজেদের সরিয়ে নিতে ১৯২৪ সালে লালা লাজপত রাই (১৮৬৪-১৯২৮) যখন দেশ বিভাজনের কথা ভাবছেন তখন বাংলার অন্যতম সম্মানিত লেখক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৭৬-১৯৩৮) মুসলিমদের উপর ঘৃণার স্থূপ চাপিয়ে দেন। তিনি লেখেন “মুসলিমরা যদি-বা কখনও বলে থাকে যে তারা হিন্দুদের সঙ্গে বসবাস করবে, তবে তা কার্যত তামাসা। ভারতে মুসলিমরা এসেছে লুঠতরাজ করতে, সাম্রাজ্য স্থাপনে নয়। তারা শুধুমাত্র লুণ্ঠনে ক্ষান্ত হয়নি। তারা মন্দির ধ্বংস করে। তারা প্রতিমা ভাঙ্গে ও নারীদের ধর্ষণ করে। অন্য ধর্মের প্রতি তাদের অসম্মান প্রদর্শন ও মানবতার প্রতি আঘাত প্রদান অকল্পনীয়।” (হরিপদ ঘােষ সম্পাদিত, শরৎ রচনা সমগ্র, কলকাতা, ১৯৮৯, পৃ. ১১১)।
- ১৪. J. Dasgupta, Language Conflict and National Development, Berkely, University of California Press, 1970, P. 112-122, 219.
- ১৫. হরপ্পার সভ্যতাকে বৈদিক বলেও সংঘ পরিবারের পক্ষ্য হতে দাবি করা হয়েছে। যদিও এ ধরনের দাবিকে বহু পূর্বেই নস্যাৎ করে দিয়েছেন খ্যাতনামা ভারতত্ত্ববিদ মাইকেল উইটজেল এবং ইতিহাসবিদ ষ্টিভ ফারমান। (দ্র.-টাইমস অব ইন্ডিয়া ২৮-১০-২০০০)।
- ১৬. মালাবার অঞ্চলের মােপলাদের অভ্যুত্থানের সাম্প্রদায়িক চরিত্র নিয়ে একটা প্রর্ণ ওঠে। ঐতিহাসিকদের অনেকে মােপলারা হিন্দুদের উপর অমানুষিক অত্যাচার করেছেন বলে মন্তব্য করেছেন। মােপলাদের সাম্প্রদায়িক চরিত্র প্রচারে ব্রিটিশ সরকার, ব্রিটিশ সংবাদপত্রগুলি ও ব্রিটিশের সমর্থক ভারতীয় বুদ্ধিজীবীও প্রচণ্ড আগ্রহ দেখিয়েছে। গান্ধীজি মােপলাদের সম্বন্ধে ‘ঈশ্বরভীত’ ও ‘সাহসী’ শব্দ দুটি ব্যবহার করেছেন। তবু তিনিও মােপলা অভ্যুত্থানের সাম্প্রদায়িক চরিত্রকে মেনে নিয়েছেন। কিন্তু বস্তুগতভাবে বিচার বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে, মােপলা অভ্যুত্থানের সাম্প্রদায়িক উদ্দেশ্য বহুলাংশে অতিরঞ্জিত। তাই আহমেদাবাদে অনুষ্ঠিত কংগ্রেস অধিবেশন মােপলা বিদ্রোহের সাম্প্রদায়িক চরিত্রকে উপেক্ষা করেছে, কারণ এই বিদ্রোহের ভিত্তি সাম্প্রদায়িকতা ছিল না, তার উদয় হয় পরে এবং সেটাও বহুলাংশে আরােপিত। এর মূল লক্ষ্য ছিল স্বরাজ।
- ১৭. স্বাধীনতা সংগ্রামের বিভিন্ন পর্যায় সম্বন্ধে এম এস গােলওয়ালকরের নিম্নলিখিত বত্ত(ব্যটি পড়লে যে কোনও দেশপ্রেমিক মানুষ চমকে উঠবেন “সর্বদা প্রাত্যহিক কাজকর্মে যুক্ত থাকার অন্য একটি কারণও আছে। দেশে মাঝে মধ্যেই যেসব ঘটনা ঘটছে, তাতে মন কিছুটা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। ১৯৪২ সালে এরকমই বিক্ষোভ দেখা দিয়েছিল। তার আগে ছিল ১৯৩০-৩১-এর আন্দোলন। সেই সময় অনেকেই ডক্টরজির সঙ্গে (ডক্টরজি হচ্ছেন ডঃ হেডগেওয়ার, আর এস এসের প্রতিষ্ঠাতা) দেখা করতে যান। তারা ডক্টরজিকে বলেন, এই আন্দোলনের সূত্রেই স্বাধীনতা আসবে, এই অবস্থায় সংঘ (আর এস এস) পিছিয়ে থাকলে চলবে না। সেই সময় জনৈক ভদ্রলােক ডক্টরজিকে বলেন যে, তিনি। জেলে যেতে প্রস্তুত। ডক্টরজি বলেন, “অবশ্যই যান। কিন্তু তারপর আপনার পরিবারের দেখাশােনা করবে কে? ভদ্রলােক উত্তর দেন, ‘দু-বছর সংসার চালানাের মতাে সংস্থান আমি করে রেখেছি, প্রয়ােজন হলে জরিমানার টাকা দেওয়ারও ব্যবস্থা করেছি। তখন ডক্টরজি তাকে বলেন, যদি সব ব্যবস্থা করাই থাকে, তাহলে আসুন, সংঘের জন্য দু’বছর কাজ করুন। বাড়ি ফেরার পর সেই ভদ্রলােক জেলেও যাননি, সংঘের জন্যও কাজ করতে আসেননি।” (এম এস গােলওয়ালকর, শ্রীগুরুজি সমগর দর্শন গােলওয়ালকরের রচনা সমগ্র, খণ্ড-৪, ভারতীয় বিচার সাধনা, নাগপুর, পৃ. ৩৯-৪০)। এই ঘটনা থেকে স্পষ্ট বােঝা যায়, সৎ দেশপ্রেমিকদের স্বাধীনতা সংগ্রামের লক্ষ্য থেকে সরিয়ে এনে নিরুৎসাহিত করার কাজেই সচেষ্ট ছিল আর এস এস নেতৃত্ব।
- ১৮. এম এস গােলওয়ালকর, উই আর আওয়ার নেশনহুড ডিফাইনড, ভারত পাবলিকেশন, নাগপুর, ১৯৩৯।
- ১৯. এম এস গােলওয়ালকর, উই, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৫।
- ২০. এম এস গােলওয়ালকর, উই, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৭।
- ২১. এম এস গােলওয়ালকর, উই, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৭-৪৮। গােলওয়ালকর আরও বলেছেন “প্রাচীন হিন্দু জাতিই হিন্দুস্থানে বর্তমান এবং বর্তমান থাকা উচিৎ, হিন্দু জাতি ছাড়া আর কিছুই নয়।…এতদিন পর্যন্ত, যেভাবেই হােক, যেহেতু তারা (মুসলিম ও অন্যান্য অ-হিন্দুরা) তাদের জাতিগত, ধর্মগত ও সংস্কৃতিগত পার্থক্য বজায় রেখেছে, তারা বিদেশী ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না।…এই দেশে হিন্দুরাই প্রকৃত জাতি, এবং মুসলিম ও অন্যান্যরা, দেশদ্রোহী যদি নাও হয়, অন্তত জাতি-বহির্ভূত।” (এম এস গােলওয়ালকর, উই, প্রাগুক্ত, পৃ. ৬২)।
- ২২. আর্যগণ ভারতে আসার পর ঋগ্বেদ রচনা করেন এবং ক্রমে অন্য তিন বেদ ও অন্যান্য বৈদিক সাহিত্য রচিত হয়। অথচ এই সমস্ত সাহিত্যে সেই ‘হিন্দু শব্দটির কোনও উল্লেখ নেই। উপনিষদ, প্রাচীন সংস্কৃত ও পালি গ্রন্থসমূহেও ‘হিন্দু শব্দের উল্লেখ নেই। জওহরলাল নেহেরু তাঁর ‘ডিসরি অফ ইন্ডিয়া’ গ্রন্থে লিখেছেন, “আমাদের প্রাচীন সাহিত্যে ‘হিন্দু’ শব্দটি একেবারেই পাওয়া যায় না। আমি শুনেছি ভারতীয় পুস্তকের মধ্যে খ্রিষ্টীয় অষ্টম শতাব্দীর একটি তান্ত্রিক গ্রন্থে এই শব্দের সর্বপ্রথম উল্লেখ পাওয়া যায়। সেখানে হিন্দু বলতে একটি জাতিকে বােঝানাে হয়েছে, কোনও ধর্মাবলম্বী লােক সম্প্রদায় নয়।”
- ২৩. রমিলা থাপার, ইমাজিনড রিলিজিয়াস কমিউনিটিজ অ্যানসিয়েন্ট হিস্টরি অ্যান্ড দ্য মডার্ন সার্চ ফর এ হিন্দু। আইডেনটিটি, মডার্ন এশিয়ান স্টাডিজ, ২৩বর্ষ, ২য় সংখ্যা, ১৯৮৯, পৃ. ২০৯-২৩১।
- ২৪. রমিলা থাপার, কমিউনালিজম অ্যান্ড দ্য হিস্টরিক্যাল লিগ্যাসি সাম ফ্যাক্টস, সােস্যাল-সায়েন্টিস্ট, জুন-জুলাই, ১৯৯০, পৃ. ১২।
- ২৫. জি ডি সােনথাইমার ও এইচ কুলকে সম্পাদিত, হিন্দুইজম রিকনসিডার্ড, মনােহর পাবলিকেশন, নতুন দিল্লি, ১৯৯৭ আরও দেখুন-গৌতম নিয়ােগী, ইতিহাস ও সায়িকতা, পুস্তক বিপণি, কলকাতা, ১৯৯১, পৃ. ২০২১।
‘নবজাগরণ’ অ্যান্ড্রোয়েড অ্যাপ্লিকেশনটি প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর টেলিগ্রাম চ্যানেলে জয়েন হতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর ফেসবুক পেজে লাইক করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।