ভারতের সঙ্গে ইসলাম ও মুসলমানের সম্পর্ক বহুকালের এবং সেটা প্রায় ৭০০ বছরের। দীর্ঘকাল সহাবস্থানের ফলে উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে যে সাংস্কৃতিক ভাব বিনিময় ঘটেছিল তার মধ্যে বিচ্ছিন্নতার বহু উপাদান থাকলেও এই ভাবধারার মূল স্পিরিট ছিল ঐক্যমূলক। মধ্যযুগীয় এই ভাবধারা বহু পথ মাড়িয়ে উনিশ শতকের প্রথমার্ধে সূচনা করে আধুনিক যুগের। এই আধুনিকতার তিনটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হল—যুক্তিবাদ, চিন্তার স্বাধীনতা ও উদারবাদ। কিন্তু এই আধুনিকতা ছিল বড়ই সীমিত। কেননা “হিন্দু সমাজের উদারতা মানবতা ও সংস্কার-আন্দোলন ধীরে ধীরে হিন্দুধর্মের পুনরভ্যুত্থান আন্দোলনে পরিণত হল। ‘হিন্দু’প্রীতি ক্রমে ‘হিন্দুত্ব’ প্রীতির ভিতর দিয়ে সাম্প্রদায়িকতায় পর্যবসিত হল। রামমােহন-ইয়ংবেঙ্গল-বিদ্যাসাগরের উদারতা ও যুক্তিবাদের যুগ ধীরে ধীরে অস্ত গেল। যুক্তির বদলে এল সেই সনাতন ভক্তি, সংস্কারের বদলে এল কুসংস্কার, উদারতার বদলে সংকীর্ণতা, মানবতার বদলে সাম্প্রদায়িকতা। …মুসলমানবর্জিত তথাকথিত রিনেস্যান্স ও রিফরমেশন আন্দোলনের প্রায়শ্চিত্ত করা হল চরম প্রতিত্রীয়াশীল রিভাইভ্যাল আন্দোলনের সূত্রপাত করে, বিদ্যাবুদ্ধি যুক্তি সব বিসর্জন ও বন্ধক দিয়ে। সেই গুরুবাদ ভক্তিবাদ ও অবতারবাদের অতল অন্ধকারে তলিয়ে গেল ইয়ংবেঙ্গল ও বিদ্যাসাগরযুগের যুক্তিবাদ, স্বাতন্ত্র্যবাদ, যা কিছু ভালাে সব। ‘এজ অফ রিজন’, ‘হিউম্যানিজম’ ও ‘ফিলােজফি অফ এনলাইটেনমেন্ট’-এর উত্তরাধিকারীরা গুরু-অবতারের যুগের পাঁকের মধ্যে মুখ থুবড়ে পড়লেন।”১ বস্তুত ১৮৩৩ সালে রামমােহনের মৃত্যুর পর ব্রাহ্ম সমাজের কাজকর্মের মধ্যে মন্থরতা দেখা দিলেও ১৮৪৩ সালে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের (১৮১৭-১৯০৫) নেতৃত্বে ব্রাহ্ম সমাজের কাজকর্ম নতুনভাবে শুরু হয়। এরপর ব্রাহ্ম সমাজের শাখা বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে স্থাপিত হয়। ঢাকায় ব্রাহ্ম সমাজের শক্তি এত বৃদ্ধি পায় যে, রক্ষণশীল হিন্দুরা সেই শক্তি ও প্রভাবকে খর্ব করার উদ্দেশ্যে হিন্দুধর্ম ‘রক্ষিণী সভা’ প্রতিষ্ঠা করে ঢাকার ব্রাহ্ম সমাজের পত্রিকা ‘বঙ্গবন্ধু’র পালটা পত্রিকা হিসেবে প্রকাশ করেন ‘হিন্দু হিতৈষিণী।২
[১]
দেবেন্দ্রেনাথ বেদকে অভ্রান্ত বলে স্বীকার না করলেও তার মধ্যে হিন্দু সমাজের আচার-অনুষ্ঠান বিষয়ে যে রক্ষণশীলতা ছিল তার বিরুদ্ধে ব্রাহ্ম সমাজের একাংশ ১৮৬৬ সালের ১১ নভেম্বর নিজেদেরকে কেশবচন্দ্র সেনের (১৮৩৮-১৮৮৪) নেতৃত্বে ভারতবর্ষীয় ‘ব্রাহ্ম সমাজ’-এর মধ্যে সংগঠিত করেন। কেশবচন্দ্রের অনুগামীরা সবাই এসে যােগ দিলেন নবগঠিত এই সমাজে। এঁদের মধ্যে উমানাথ গুপ্ত, প্রতাপচন্দ্র মজুমদার, বিজয়কৃষ্ণ গােস্বামী, অঘােরনাথ গুপ্ত, অমৃতলাল বসু, মহেন্দ্রনাথ বসু, গৌরগােবিন্দ রায়, যদুনাথ চক্রবর্তী, কান্তিচন্দ্র মিত্র, হেমচন্দ্র সিংহ, প্রসন্নকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, দুর্গাদাস মুখােপাধ্যায়, মধুসূদন সেন, বৈকুণ্ঠনাথ সেন, আনন্দমােহন বসু, নৃপালচন্দ্র মল্লিক, হরচন্দ্র মজুমদার, ক্ষেত্রমােহন দত্ত, কৃষ্ণদয়াল রায়, কেদারনাথ রায়, কালীকুমার নন্দী, রাজকুমারী বন্দ্যোপাধ্যায়, যদুনাথ ঘােষ, শশিপদ বন্দ্যোপাধ্যায়, রামশঙ্কর সেন, গােপালচন্দ্র সেন, গােপালচন্দ্র মিত্র, লাডলিমােহন মিত্র, আনন্দচন্দ্র গুপ্ত, দুর্গামােহন দাস, ব্রজসুন্দর মিত্র, রসময় বসু, গুরুপ্রসাদ সেন, দীননাথ সেন, গুরুচরণ মহলানবিশ, যজ্ঞের সিংহ, সূর্যকুমার সেন ও গােবিন্দচন্দ্র ঘােষকে পাশে নিয়ে শুরু হল ‘ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্ম সমাজ’-এর পথচলা। দেবেন্দ্রনাথের অনুমতি নিয়ে কেশবচন্দ্ররা তাকে শুধু এই সমাজের সভ্যই করলেন না, ব্রাহ্ম মতবাদ প্রচারের জন্য তার প্রচেষ্টাকে অভিনন্দনও জানালেন।
এরপর থেকে দেবেন্দ্রনাথের নেতৃত্বাধীন ব্রাহ্ম সমাজ পরিচিত হয় ‘আদি ব্রাহ্ম সমাজ’ হিসেবে। কিন্তু উনিশ শতকের সাতের দশকে হিন্দু রক্ষণশীলতা যথেষ্ট শক্তি অর্জন করে এবং তার প্রতিফলন কেশব সেনের নেতৃত্বাধীন ব্রাহ্ম সমাজের মধ্যেও ঘটে। কেশবচন্দ্র নিজে বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে এবং সিভিল ম্যারেজ বিল প্রণয়নের জন্য সংগ্রাম করে তাতে সফল হলেও তাঁর নিজের চিন্তার মধ্যে পরবর্তীকালে অনেক পরিবর্তন আসে। একদিকে তিনি রামকৃষ্ণ পরমহংসের (১৮৩৪-১৮৮৬) ধর্মবিষয়ক চিন্তার দ্বারা আকৃষ্ট হন, কীর্তন ইত্যাদিতে অংশগ্রহণ করেন এবং অন্যদিকে কুচবিহারের মহারাজার পুত্রের সঙ্গে হিন্দুমতে নিজের নাবালিকা কন্যার বিবাহ দেন। এর ফলে ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্ম সমাজের মধ্যে তার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ সৃষ্টি হয় ও বিভক্তি আসে এবং শিবনাথ শাস্ত্রীর (১৮৪৭-১৯১৯) নেতৃত্বে ১৮৭২ সালে গঠিত হয় সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজ। যাইহােক, উনিশ শতকের তিনের দশক থেকে ব্রাহ্মদের সঙ্গে সনাতনপন্থী হিন্দুদের ধর্মীয় বিরােধ থাকলেও ব্রাহ্মরা নিজেদের হিন্দুধর্মের অঙ্গ হিসেবে গণ্য করতেন। কিন্তু কেশবচন্দ্র সেনের অধীনে উন্নতিশীল ব্রাহ্মরা সর্বধর্মের সমন্বয় সাধনে বিধধর্ম প্রচারে সচেষ্ট হলে এবং ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে কেশবচন্দ্রের অনুগামীরা ‘সর্বদ্বারি বিবাহ অনুমােদক আইন’ পাশ করালে আদি ব্রাহ্ম সমাজে এবং হিন্দু সমাজে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়।
কেশবচন্দ্রের যুক্তির সারবত্তা ছিল, কেননা জাতিবর্ণ-ভেদহীন বিবাহ পদ্ধতির মাধ্যমে রক্তের সঙ্গে রত্তের সংযােগে ‘নেশন’ গঠনের পথ সহজ হয়, কিন্তু বাস্তবে বিধধর্মের প্রয়ােগ খুব দুরূহ। কেশবচন্দ্রের বিধর্মের প্রতিষেধক রূপে আদি ব্রাহ্ম সমাজের মধ্যে হিন্দুত্ব তথা জাতীয়তার চেতনা নতুনভাবে আত্মপ্রকাশ করল। উনিশ শতকের জ্ঞানবিচার প্রবাহে প্রাচীন ভারতীয় ঐতিহ্যের আধুনিক পুনর্মূল্যায়নে যিনি সম্ভবত সবচেয়ে বেশি অবদান রেখে গেছেন, তিনি অক্ষয়কুমার দত্ত (১৮২০-১৮৮৬)। খিদিরপুরের একটি মিশনারি স্কুলে এবং তারপর ওরিয়েন্টাল সেমিনারি স্কুলে বছর তিনেক পড়বার পর পিতার মৃত্যু এবং দারিদ্র্যবশত (১৮-১৯ বছর বয়সে) তিনি প্রথাগত শিক্ষা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। কিন্তু তার জ্ঞানার্জনের চেষ্টা সারাজীবনই অব্যাহত ছিল। বিশেষত সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যে তিনি বিশেষ দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের উদ্যোগে ১৮৪০ সালে তিনি ‘তত্ত্ববােধিনী সভা’র সদস্য হন এবং তত্ত্ববােধিনী পাঠশালায় শিক্ষকতা আরম্ভ করেন। এ সময়েই তিনি ব্রাহ্ম সমাজে যােগ দেন। দেবেন্দ্রনাথের প্রধান পৃষ্ঠপােষকতায় ১৮৪৩ সালে তত্ত্ববােধিনী পত্রিকা প্রকাশিত হলে অক্ষয়কুমার তার প্রথম সম্পাদক নিযুক্ত হন, এবং ১২ বছর এ কাজে নিযুক্ত থাকেন। এ সময়ে তিনি মেডিক্যাল কলেজের অন্যতম ছাত্র হিসেবে কিছুদিন বােটানি, ফিজিওলজি, কেমিস্ট্রি এবং প্রাকৃতিক বিজ্ঞান অধ্যয়ন করেন। তাছাড়া তত্ত্ববােধিনী সভা এবং তত্ত্ববােধিনী পত্রিকার মাধ্যমে প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতি সহ নানা বিষয়ে পড়াশােনা ও গবেষণার সুযােগ পান।।
অক্ষয়কুমারের রচিত গ্রন্থগুলিতে একদিকে যেমন ঘটেছে তার বহুমুখী পাণ্ডিত্যের প্রকাশ, অন্যদিকে তেমনি প্রকাশ পেয়েছে তাঁর মূলত জ্ঞানবিচারি চিন্তাভাবনা। সমস্ত গ্রন্থের আলােচনায় আমরা যাব না। তবে প্রসঙ্গত বলি যে, রামায়ণের বিস্তারিত আলােচনা করতে গিয়ে অক্ষয়কুমার দেখিয়েছেন, এটি ছিল উত্তর ভারত থেকে দক্ষিণ ভারতে ক্রমশ আর্য সভ্যতা বিস্তারের মহাকাব্যিক কল্পরূপ মাত্র। তিনি এও দেখিয়েছেন যে, মহাভারতে বহু বিষয় প্রক্ষিপ্ত হতে হতে ক্রমশ এই মহাকাব্য বিপুলায়তন হয়ে দাঁড়ায়। কৃষ্ণের অবতারত্ব এবং ভগবদ্গীতাও ছিল তার মতে, মহাভারতে পরবর্তীকালের সংযােজন। এ বিষয়ে তার সিদ্ধান্ত,
“মহাভারতে শ্রীকৃষ্ণের ঈরত্ব-প্রতিপাদক অনেক স্থলই যে পশ্চাৎ বিনিবেশিত হয়, ইহা একরূপ স্পষ্ট দেখিতে পাওয়া যায়। মহাভারতের মূল উপাখ্যানের সহিত কৃষ্ণপ্রধান ভগবদ্গীতার কোনরূপ সম্বন্ধ নাই। ঘােরতর যুদ্ধ বর্ণনার মধ্যে একখানি পরমার্থ প্রধান সংকলিত দর্শনশাস্ত্র সন্নিবেশিত করা হইয়াছে। প্রকৃত ‘হাটের মধ্যে ব্রহ্মজ্ঞান’।”
পরবর্তীকালে বঙ্কিমচন্দ্র তার ‘কৃষ্ণচরিত্রে’ মহাভারত সম্বন্ধে অনেক আলােচনা করেছেন, যা অক্ষয়কুমারের আলােচনার সঙ্গে হুবহু মিলে যায়। আবার হিন্দু সমাজের অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ চিত্রণে অক্ষয়কুমারের বর্ণনার সঙ্গে ‘আনন্দমঠ’-এর দেশমাতৃকার তিন রূপ বর্ণনার মিল দেখতে পাওয়া যায়। যদিও বঙ্কিমের ধর্মীয়তা অক্ষয়কুমারে এ সময়ে অনুপস্থিত ছিল। ভগবদ্গীতা রচনার প্রকৃত উদ্দেশ্য অক্ষয়কুমারের মতে আধ্যাত্মিকতার নামে মারণযজ্ঞে উৎসাহ দান। তিনি বলেন, “এই প্রবন্ধ রচনার উদ্দেশ্যে কি জান? জীবাত্মার ধ্বংস হয় না, অতএব যত ইচ্ছা নরহত্যা কর, তাহাতে কিছুমাত্র পাতক নাই।” পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথও গীতা রচনার প্রকৃত উদ্দেশ্য সম্বন্ধে একই কথা বলেছেন। প্রায় সবগুলি পুরাণের বিস্তারিত আলােচনা করে অক্ষয়কুমার দেখিয়েছেন যে এগুলি প্রাচীন নয়, অর্বাচীন, প্রায় সবই কাল্পনিক, এবং এক পুরাণ থেকে অন্য পুরাণে অনেক কিছু চালানাে হয়েছে।
রাজেন্দ্রলাল মিত্রের (১৮২৩-১৮৯১) মতাে অক্ষয়কুমারও প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতার জীবনমুখী বস্তুবাদী ঐতিহ্যকে তুলে ধরেছেন। প্রাচীন ভারতে বিধবা বিবাহ, নারীদের বেশি বয়সে বিবাহ এবং বহুবিবাহের অধিকার প্রভৃতি অকাট্য তথ্যপ্রমাণ দিয়ে উপস্থাপিত করেছেন। আবার বহুসংখ্যক সংস্কৃত উদ্ধৃতি দিয়ে দেখিয়েছেন যে, প্রাচীন ভারতে গােমাংস সহ অনেক রকমের মাংসভােজন এবং মদ্যপান ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল। গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা, আয়ুর্বেদ প্রভৃতি প্রাচীন ভারতীয় বিদ্যার জাগতিক উৎকর্ষের দিকেও তিনি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ থাকতে পারে না যে, বিজ্ঞানমনস্ক এবং তথ্যনিষ্ঠ বিশ্লেষণের মাধ্যমে প্রাচীন ভারতীয় ঐতিহ্যের আধুনিক পুনর্মূল্যায়ন করে উনিশ শতকের জ্ঞানবিচার প্রবাহে অক্ষয়কুমার বিশেষ অবদান রেখে গেছেন। এদিক থেকে বিচার করলে সম্ভবত সমকালীন ভারতবর্ষে তার সঙ্গে তুলনীয় আর কেউ ছিলেন না। কিন্তু এসত্ত্বেও সেকালের বহু হিন্দু চিন্তাশীলের মতাে অক্ষয়কুমারও মুসলিম বিদ্বেষ ও ইংরেজ তােষণের শিকার হয়েছিলেন।
অক্ষয়কুমার বারবার ‘হিন্দু জাতি’ শব্দ দুটি ব্যবহার করেছেন এবং এই হিন্দু জাতির অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যই যথাক্রমে তার গর্ব, পরিতাপ ও স্বপ্নের বিষয়বস্তু। হিন্দু জাতির প্রাচীন গৌরবের অবলুপ্তির জন্য তিনি প্রাক্-ব্রিটিশ মুসলিম শাসনকেই দায়ী করেছেন, “সেই হিন্দু এখন এই হিন্দু। তদীয় পূর্ব প্রভাব ও পূর্ব মহিমার ধ্বংসাবশেষও বিদ্যমান নাই। সমস্ত বাষ্পীভূত হইয়া গিয়াছে।…মামুদ শা ও সবুক্তগীন! তােমরা ঐরাবতের পদে লৌহশৃঙ্খল বদ্ধ করিয়াছ। তাহার আর মােচন হইল না। মােগল ও পাঠানকুল! দুর্ধর্ষ যবন-রাজ-কুল! তােমরা ক্রমাগতই তদীয় কঠিন বন্ধনের উপর কঠিনতার বন্ধন সংগঠন করাইয়াছ। তাহার আর পদচারণ ও পার্শ্ব পরিবর্তনেরও সামর্থ্য নাই। যেদিন তােমরা তাহাকে স্পর্শ করিয়াছ, সেই দিন তাহার স্বাধীনতা সুখের মৃত্যু দিবস। জননী ভারতভূমি! সেইদিন তােমার চিরদিনের মত দুর্দিন উপস্থিত হইল।” তার বিচারে হিন্দুজাতিকে তাদের এ দুর্দশা থেকে পরিত্রাণ দিতে পারে একমাত্র ইংরেজ। যদিও ইংরেজ অধিকারে “আমাদের স্বাস্থ্যক্ষয়, বল-ক্ষয়, আয়ুক্ষয় ও ধর্মক্ষয় ঘটিতেছে,” তথাপি “যাহা হউক, ইংলন্ড! তােমরা দয়াপ্রকাশ ব্যতিরেকে আর আমাদের উপায় নাই।..তুমি আমাদের প্রতি নির্দয় নও ইহা প্রসিদ্ধই আছে। তােমার বিদ্যালয়, চিকিৎসালয়, রাজপথ, বাষ্পীয় রথ, অপূর্ব সেতু ইত্যাদি কত বস্তু ও কত ব্যাপার সে বিষয়ে সাক্ষদান করিতেছে। কিন্তু আমাদের সন্নিপাতের তৃষা।…ঘাের রজনী সম্মুখীন দেখিয়া আরও দয়া আরও দয়া বলিয়া তােমার চরণ-সন্নিধানে নিবেদন করিতেছি।”
এরপর নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে এলেন আদি ব্রাহ্ম সমাজের নেতা এবং একদা রামমােহন রায়ের প্রাইভেট সেক্রেটারি নন্দকিশাের বসুর পুত্র রাজনারায়ণ বসু (১৮২৬-১৮৯৯)। ১৮৭২ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর (১২৭৯ সনের ৩১ ভাদ্র) ‘জাতীয় সভার’৩ উদ্যোগে দেবেন্দ্রনাথের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় রাজনারায়ণ ‘হিন্দুধর্মের শ্রেষ্ঠতা’ সম্বন্ধে এক বক্তৃতা দেন।৪ এই বক্তৃতায় তিনি অন্য ধর্মের চেয়ে হিন্দুধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপন্ন করতে সচেষ্ট হন। একই সঙ্গে তিনি বলিষ্ঠ ভাষায় ‘হিন্দু জাতির’ পুনরভ্যুত্থানের আশাও ব্যক্ত করেন। বক্তৃতার শেষে তিনি আবেগরুদ্ধ কণ্ঠে বলেন, “আমার এইরূপ আশা হইতেছে, পূর্বে যেমন হিন্দু জাতি বিদ্যা, বুদ্ধি, সভ্যতার জন্য বিখ্যাত হইয়াছিল, তেমনি পুনরায় সে বিদ্যা, বুদ্ধি, সভ্যতা, ধর্মের জন্য সমস্ত পৃথিবীতে বিখ্যাত হইবে।…আমি দেখিতেছি, আবার আমার সম্মুখে মহাবল পরাক্রান্ত হিন্দু জাতি নিদ্রা হইতে উখিত হইয়া বীরকুন্ডল পুনরায় স্পন্দন করিতেছে এবং দেববিক্রমে উন্নতির পথে ধাবিত হইতে প্রবৃত্ত হইতেছে। আমি দেখিতেছি যে, এই জাতি পুনরায় নবযৌবনান্বিত হইয়া পুনরায় জ্ঞান, ধর্ম ও সভ্যতাতে উজ্জ্বল হইয়া পৃথিবীকে সুশােভিত করিতেছে, হিন্দু জাতির কীর্তি, হিন্দু জাতির গরিমা পৃথিবীময় পুনরায় বিস্তারিত হইতেছে।”৫ ‘ফ্রেন্ড অফ ইন্ডিয়া’ পত্রিকার তৎকালীন সম্পাদক ও লন্ডনের ‘টাইমস পত্রিকার সংবাদদাতা জেমস্ টলেজ তার ইংলিশ রুল অ্যান্ড নেটিভ ওপিনিয়ন ইন ইন্ডিয়া’ (লন্ডন, ১৮৭৮) বইতে রাজনারায়ণের উক্ত বক্তৃতার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করা হয়।
‘ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ’ নীরবে নিঃশব্দে ঘটনাটিকে মেনে নিল না। তাদের মুখপত্র ‘ধর্মতত্ত্ব’ রাজনারায়ণের বক্তব্যের কঠোর সমালােচনা করে বলে—
“সম্প্রতি শ্ৰীযুক্ত রাজনারায়ণ বসু মহাশয় হিন্দু ধর্ম যে সকল ধর্ম অপেক্ষা উৎকৃষ্ট ধর্ম এবং ইহাই যে ব্রাহ্ম ধর্ম এ বিষয়ে একটি বক্তৃতা করিয়াছেন।… বেদ, উপনিষদ পুরাণ ও তন্ত্রে অনেক অমূল্য সত্য লাভ করা যায় এবং হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের জীবন হইতে অনেক শিক্ষা করিবার আছে, কিন্তু তাই বলিয়া হিন্দু ধর্ম সকল ধর্ম অপেক্ষা উৎকৃষ্ট ধর্ম একথা আমরা স্বীকার করিতে পারি না। আমরা জানি ব্রাহ্মধর্ম সৰ্ব্বাপেক্ষা উচ্চ এবং একমাত্র পরিত্রাণের পথ।”৬
হিন্দুধর্মের মাহাত্ম্য কীর্তনের বিরুদ্ধে ‘ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ’ যে প্রতিরােধ গড়ে তােলার চেষ্টা করে, তার ফল তেমন কিছু হয়নি। বরং এর কিছুদিন পর থেকে, কেশবচন্দ্র নিজেই হিন্দু ক্রিয়াকর্মের প্রতি অতিমাত্রায় আসক্ত হয়ে পড়েন এবং তার সাধনপদ্ধতিতেও হিন্দুয়ানির ছাপ প্রকট হয়ে ওঠে। হিন্দুত্ব নিয়ে উচ্ছ্বাস, হিন্দু আচার-অনুষ্ঠান সম্পর্কে বাঙালি সমাজের ক্রমবর্ধমান সন্ত্রম দেখে ‘আদি ব্রাহ্মসমাজে’র সদস্য নবগােপাল মিত্র (১৮৪০-১৮৯৪) মন্তব্য করেন—
“These are the days of supremacy of Hindooism, Babu Rajnarain Bose’s lecture on the superiority of Hindoosim to other prevailing religions, seems to have been in fit time.?৭
শিবনাথ শাস্ত্রী রাজনারায়ণের ওই বিখ্যাত বক্তৃতার প্রতিক্রিয়া সম্বন্ধে তাঁর ‘রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ’ গ্রন্থে লিখেছেন, “আমার স্বর্গীয় মাতুল দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণ মহাশয় তাহার ‘সােমপ্রকাশে’ লিখেছেন যে, হিন্দুধর্ম নির্বাণােন্মুখ হইতেছিলাে, রাজনারায়ণবাবু তাহাকে রক্ষা করিলেন সনাতন ধর্মরক্ষিণী সভার সভাপতি কালীকৃষ্ণ দেব বাহাদুর তাহার অশেষ প্রশংসা করিয়া রাজনারায়ণবাবুকে হিন্দু কূলের শিরােমণি বলিয়া বরণ করিলেন কেহ কেহ তাহাকে কলির ব্যাস বলিয়া সম্বােধন করিতে লাগিলেন সুদূর মাদ্রাজ হইতে ধন্য ধন্য রব আসিতে লাগিল এবং ইংলন্ডে টাইমস্ পত্রিকাতে ঐ বক্তৃতার সারাংশ ও তাঁহার অশেষ প্রশংসা বাহির হইল। রাজনারায়ণবাবু বঙ্গবাসীর চিত্তে অতি উচ্চ স্থান অধিকার করিলেন। কেশববাবুর পক্ষ হইতে আমরা কয়েকজন তদুত্তরে বক্তৃতা করিলাম, কিন্তু সেকথা যেন কাহারও কর্ণে পৌঁছিলাে না বরং কেশববাবুর দলস্থ ব্রাহ্মগণ অহিন্দু বলিয়া হিন্দু সমাজের অবজ্ঞার তলে পড়িলেন। হিন্দু কলেজে প্রশিক্ষিত, কুড়ি বছর বয়সে ব্রাহ্ম ধর্মে দীবিত এবং ব্রাহ্ম সমাজের অগ্রণী নেতা রাজনারায়ণের কণ্ঠে হিন্দু জাতীয়তাবাদের এ হেন জয়গান শুনে ধর্মরক্ষিণী সভা এবং ভারত সভার (১৮৭৬) সদস্যেরা বিপুল উদ্যমে সনাতন হিন্দুধর্ম এবং হিন্দু জাতীয়তাবাদের স্বপক্ষে প্রচারে নেমে পড়েছিলেন।
রাজনারায়ণ নিরাকার ব্রহ্মের উপাসনাকেই হিন্দুধর্মের শ্রেষ্ঠ আদর্শ বলে উল্লেখ করায় সাধারণ শিতি হিন্দুরা খুশি হলেন। কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্রের মতাে হিন্দুরা রাজনারায়ণের প্রশংসা করলেও৮ বক্তৃতাটি একদেশদর্শী বলে অভিহিত করলেন, কেননা হিন্দুধর্মে সাকার ও নিরাকার দুই প্রকার সাধনার প্রচলন আছে। যাই হােক, ব্রাহ্মনেতার হিন্দুধর্মের শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতি হিন্দুত্ব তথা জাতীয়তাবাদকে নতুন রূপ দিল। ওই সময় হতে হিন্দু জাতীয়তাবাদী জাগরণের সূচনা বলে উল্লেখ করা হয়। এই ‘নব হিন্দুবাদ’-এর অন্যতম তাত্ত্বিক৯ রাজনারায়ণ বসু ছিলেন মেদিনীপুরের সরকারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক, তাকে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের জনক’১০ বলে ভূষিত করা হয়ে থাকে।
রাজনারায়ণ বসুর ‘বৃদ্ধ হিন্দুর আশা’ নামক পুস্তিকা ১৮৮৬ সালে প্রকাশিত হয়।১১ এরপরে অর্থাৎ ১৮৮৭ সালের গােড়ায় তা পুস্তকাকারে মলাটবদ্ধ হয়। তবে ঘটনা হল, দেওঘরের স্থায়ী বাসিন্দা হওয়ার পরে ১৮৮০ সাল নাগাদ রাজনারায়ণ এই পুস্তিকা ইংরেজিতে লিখতে শুরু করেছিলেন। কিন্তু প্রথমে এর বাংলা অনুবাদই মুদ্রিত হয়। ইংরেজি অনুবাদ ‘দ্য ওল্ড হিন্দুজ হােপ’ প্রকাশিত হয় ১৮৮৯ সালে। পুস্তিকাটিকে তৎকালীন কয়েকজন ব্যক্তি জাতীয় কংগ্রেস বা মহাধর্মমণ্ডলের ‘মন্ত্রণার অগ্রদূত’ বলে বর্ণনা করেন।১২ রাজনারায়ণ ওইপুস্তিকায় ধর্মের ভিত্তিতে জাতীয়তাবাদী চিন্তাকে সবল করার জন্য একটি সংগঠন গঠনের চেষ্টা করেছিলেন। শিখ, জৈন, বৌদ্ধ, ব্রাহ্মদের হিন্দুধর্মের অঙ্গ হিসেবে স্বীকার করে তিনি ‘মহা-হিন্দু সমিতি’ নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করেন। এই সমিতির উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করে রাজনারায়ণ ওই পুস্তিকায় লেখেন,
“হিন্দুদিগের জাতীয়ভাব উদ্দীপন করা এবং সাধারণত হিন্দু জাতির উন্নতি সাধন করা…।”
‘দেববাণী’ সংস্কৃতের চর্চা করা ছাড়াও ‘গােরক্ষণ ও গাে-জাতির উন্নতিসাধন’ ছিল প্রস্তাবিত এই সমিতির অন্যতম উদ্দেশ্য। ভারতবর্ষে গােহত্যা নিবারণের জন্য আন্দোলন গড়ে তােলাও এই সমিতির কর্তব্য বলে রাজনারায়ণ মনে করতেন। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে দয়ানন্দ সরস্বতী (১৮২৪-১৮৮৩) গােহত্যার বিরুদ্ধে যে আন্দোলন (১৮৭৫) গড়ে তুলেছিলেন রাজনারায়ণের ‘মহাহিন্দু সমিতি’ তাকে বাংলার বুকে টেনে আনেন।
হিন্দুদের জন্য নির্ধারিত ওই মহা-হিন্দু সমিতির পতাকার ব্যাপারে রাজনারায়ণ প্রস্তাব দিয়ে বলেন, ওই পতাকায় ভগবান, মাতৃভূমি ও সনাতন ধর্মের জয় অঙ্কিত করা হবে।১৩ ‘বৃদ্ধ হিন্দুর আশা’ পুস্তিকায় রাজনারায়ণ বসু যে ছক অঙ্কিত করেন, তা ইন্ডিয়ান মিরর’ সহ সমসাময়িক বহু ভারতীয় পত্র-পত্রিকায় পক্ষ পাতিত্বের সঙ্গে আলােচিত হয়। পুস্তিকায় স্পষ্টভাবে বলা হয়, শিখ, জৈন, বৌদ্ধ, ব্রাহ্মদের মহা-হিন্দু সমিতিতে নেওয়া হলেও মুসলিমদের অন্তর্ভুক্ত করা হবে না।১৪ মহা মুসলমান সমিতি গড়তে তাদের স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। তবে রাজনৈতিক বিষয়ে তারা হিন্দুদের সহযােগিতা করবে। হিন্দু ঐক্যের জন্য রাজনারায়ণ জাতিভেদ প্রথাও সমর্থন করেন।১৫ রাজনারায়ণের প্রস্তাবনাটি ছিল,
- ১. কেবল হিন্দুরা মহাহিন্দু-সমিতির সভ্য হইতে পারিবেন। যে কেহ হিন্দু-কুলােদ্ভব ব্যক্তি আপনাকে ধর্মেতে হিন্দু বলিয়া পরিচয় দিবেন তিনিও এই সমিতির সভ্য হইতে পারিবেন। হিন্দুরা দুই প্রধান সম্প্রদায়ে বিভক্ত নিরাকারবাদী ও সাকারবাদী।
- ২. হিন্দুদিগের ধর্ম সম্বন্ধীয় স্বত্ব ও অধিকার রক্ষা করা, হিন্দুদিগের জাতীয়ভাব উদ্দীপন করা এবং সাধারণত হিন্দুজাতির উন্নতিসাধন করা মহাহিন্দু সমিতির উদ্দেশ্য। হিন্দুদিগের ধর্ম বিষয়ে স্বত্ব ও অধিকার রক্ষা সমিতির প্রধান উদ্দেশ্য হইবে।
- ৩. আমাদিগের মুসলমান ভ্রাতাদিগের সহিত উক্ত ঐক্য সাধন হইতে পারে না, যেহেতু তাহাদিগের ধর্ম আচার-ব্যবহার, পুরাকালীন প্রবাদ, আমাদিগের ধর্ম, আচার-ব্যবহার পুরাকালীন প্রবাদ হইতে বিভিন্ন। কিন্তু যখন আমরা একদেশবাসী ও এক রাজার অধীন, তখন তাহাদিগের সহিত অন্য ঐক্য না হউক, রাজনৈতিক ঐক্য অবশ্য সাধিত হইতে পারে। ইহার প্রমাণ, সুরেন্দ্রবাবুর কারাগার গমন সময়ে মহারাজনৈতিক আন্দোলন এবং লর্ড রিপনের বিলাত গমন সময়ে তাহার অভিনন্দনে হিন্দু-মুসলমান ঐক্য।…
- ৪. মহা-হিন্দু সমিতির একটি জাতীয় ধ্বজা থাকিবে। তাহাতে ‘ঈশ্বর ও মাতৃভূমি’ এই বাক্য অঙ্কিত থাকিবে। এ বাক্যের নিম্নে একটি পদ্মপুষ্পের প্রতিকৃতি থাকিবে এবং তাহার নিম্নে ‘সনাতন ধর্মের জয়’ এ বাক্যটি অঙ্কিত থাকিবে। পদ্মপুষ্প এদেশে ঈরের সৃজনশক্তি এবং দেবপূজার সাঙ্কেতিক চিহ্নস্বরূপ গণিত হইয়া থাকে। ইহা হিন্দু দেবদেবীর পৌরাণিক ইতিবৃত্তের সহিত সহস্র প্রকারে জড়িত রহিয়াছে।…
- ৫. মহা-হিন্দু সমিতির অধিবেশনে হিন্দু সমাজের সকল প্রকার উন্নতি অর্থাৎ হিন্দুদিগের ধর্ম, শরীর, মন, নীতি, রাজনীতি, কৃষি এবং শিল্প সম্বন্ধীয় উন্নতি বিষয়ক প্রস্তাব বিবেচিত হইবে।…সামাজিক বিষয় আদপে বিতর্কিত হইবে না। যেহেতু উহা হিন্দু সমাজের মধ্যে ঘােরতর বিবাদস্থল হইয়া দাঁড়াইয়াছে। উহা আলােচনা করিতে গেলে সভ্যদিগের মধ্যে মনান্তর উপস্থিত হইবার সম্ভাবনা। সমাজ সংস্কার কাৰ্য্য স্বতন্ত্ররূপে সমাজ সংস্কারকের হস্তে অর্পিত হওয়া কর্তব্য।… কেবল ধর্মসম্বন্ধীয় দুঃখ নিবারণ জন্য এরূপ সমিতি সংস্থাপন করা যে আবশ্যক হইতেছে এমত নহে। দেববাণী সংস্কৃতের চর্চা ভারতবর্ষে এক প্রকার লােপ পাইয়াছে বলিলে হয়। সরস্বতী দেবী এক্ষণে গঙ্গাতীর পরিত্যাগ করিয়া রাইন নদীর উপকূলে অবতীর্ণ হইয়াছে। আমাদিগের যুবকদিগের ক্রমশ শারীরিক অবনতি হইতেছে। আমাদিগের বিদ্যালয় সকলে ধর্ম শিক্ষা না থাকা প্রযুক্ত যুবকদিগের নৈতিক অবনতি হইতেছে। তজ্জন্য এক্ষণকার লােকেরা ক্রমশ সংশয়বাদী, স্বার্থপর ও ইউরােপীয় বিলাসানুরাগী হইতেছে। আমাদিগের দেশের লােকে ক্রমশ পানাসক্ত হইতেছে। ভারতবর্ষে দিন দিন দরিদ্রতার বৃদ্ধি পাইতেছে।… যদি আমাদিগের স্বদেশীয় রাজা থাকিত, তবে এই দুরবস্থার প্রতিকার হইত। যখন তাহা নাই, তখন সাধারণবর্গের সমবেত চেষ্টা দ্বারা তাহা হওয়া কর্তব্য।… চিরকাল পরমুখাপেী হইয়া থাকিলে কি এ কাৰ্য্য কখন সাধিত হইতে পারে? গবর্ণমেন্টের উপর সকল বিষয় এত নির্ভর করেন কেন? আপনারা কি এমন প্রত্যাশা করেন যে, যে অন্ন আপনারা ভক্ষণ করেন, তাহা গবর্ণমেন্ট আপনাদিগের মুখে তুলিয়া দিবেন? তাহারা বিদেশীয় লােক। আপনারা কি প্রত্যাশা করেন যে, তাহারা তাহাদিগের নিজের স্বার্থের প্রতি দৃষ্টি না রাখিয়া কেবল আপনাদিগেরই উপকার করিতে থাকিবেন? এমন নিষ্কাম ধর্ম তাহাদিগের নিকট হইতে কখনই প্রত্যাশা করা যাইতে পারে না।…আমাদিগের সকলেরই এই কথা হৃদয়ে মুদ্রিত করিয়া রাখা কর্তব্য যে, আমরা যতই লইব ততই বাঁচিব, আর যতই ছাঁটিব ততই মরিব।”
[২]
সাম্রাজ্যবাদী ঐতিহাসিকদের ভারতবর্ষের ইতিহাসের সাম্প্রদায়িক ব্যাখ্যার উদ্দেশ্যমূলক মর্মার্থ বাংলার বুদ্ধিজীবীরা অনেকেই অনুধাবন করতে পারেননি। ব্রিটিশ শাসনের মঙ্গলময়তা সম্পর্কে মােহভঙ্গের কালে প্রাচীন ভারতের অনুশাসনগুলি সম্পর্কে স্বাদেশিকতার নামে নতুন মােহ সৃষ্টি হতে লাগল। বঙ্কিমচন্দ্র, চন্দ্রনাথ বসু প্রমুখেরা হিন্দু-বিধবার বৈধব্যের মধ্যে ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার আদর্শ দেখলেন—জাতিভেদ প্রথার কঠোরতার প্রতি আস্থা জ্ঞাপন করলেন। তারা অতীত সামন্ততান্ত্রিক সমাজের সংকীর্ণতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গিগুলিকে স্বাদেশিকতার সঙ্গে অভিন্নরূপে কল্পনা করলেন। রাজনারায়ণ প্রমুখেরা অতীতমুখিনতার সাহায্যে স্বাদেশিকতার প্রচার করলেও সামন্ততান্ত্রিক সমাজের সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গিগুলিকে সযত্নে পরিহার করলেন। এজন্য মহা-হিন্দু সমিতির প্রস্তাবনায় শিখ, জৈন, বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মদের গ্রহণ করা হল। কিন্তু এক জায়গায় উদারপন্থী ও সংকীর্ণতাবাদী হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের খুব মিল ছিল—তা হল উভয়ই প্রাচীন ভারতের স্বার্থগন্ধহীন আধ্যাত্মবাদকে মাত্রাতিরিক্তভাবে গৌরবান্বিত করেছিলেন। এটা আমাদের জাতীয়তাবাদী ভাবধারার বিকাশের পক্ষে ক্ষতিকর হয়েছিল। অধ্যাপক নরহরি কবিরাজ বলেছেন,
“পাশ্চাত্য সভ্যতা মাত্রই বিষয়ানুবর্তিতা আর প্রাচ্য সভ্যতা মাত্রই স্বার্থগন্ধহীন আধ্যাত্মবাদ—এই ধরনের এক অবৈজ্ঞানিক তত্ত্ব প্রচার হতে থাকল। এই তত্ত্বটি স্বাদেশিকতা প্রচারের কাজের দিক থেকে আপাতদৃষ্টিতে কাৰ্য্যকরী হলেও ভবিষ্যতে জাতীয় আন্দোলনের অগ্রগতি পথে অন্তরায় সৃষ্টি করেছিল।”
মহা-হিন্দু সমিতি নিছক ধর্মসভা নয়, রাষ্ট্রসভাও। উনিশ শতকের প্রথমার্ধে রাধাকান্ত দেব (১৭৮৪-১৮৬৭) প্রমুখদের ধর্মসভার লক্ষ ছিল সনাতন হিন্দুধর্মের রক্ষা। পূর্বেই বলা হয়েছে যে, উক্ত শতকের দ্বিতীয়ার্ধে রাজনারায়ণ বসু প্রতিষ্ঠিত মহাহিন্দু সমিতির লক্ষ ছিল ধর্মকে কেন্দ্র করে স্বাদেশিকতার উদ্বোধন। ভারতবর্ষের রাষ্ট্রীয় জীবনে বিশ শতকের গােড়ার দিকে প্রতিষ্ঠিত হিন্দু মহাসভার যে ভূমিকা তার বীজ অনেকাংশে মহা-হিন্দু সমিতির মধ্যে নিহিত ছিল। অন্যভাবে বলতে গেলে আজকাল এই যে হিন্দু মহাসভা নামক সংগঠন সংস্থাপনের মাধ্যমে হিন্দু সমাজে জাগরণ দেখা যাচ্ছে, এই জাগরণের মূল মন্ত্র। ঘােষণা করেছিলেন রাজনারায়ণ তার বৃদ্ধ হিন্দুর আশা’ নামক পূর্বোক্ত পুস্তিকায়।১৬
রাজনারায়ণ অত্যন্ত বেদনা ও উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করেছিলেন যে, অনেক যুবক হিন্দু-সমাজ এমনকী হিন্দু নামটা পর্যন্ত ত্যাগ করতে প্রস্তুত। জাতীয় সংস্কৃতির এই সংকটকালে সংস্কারগুলােকে একটা জাতীয় রূপ দানের জন্য তখন প্রয়ােজন ছিল এমন একটা সমিতির, যা শিথিত যুবকদের মধ্যে জাতীয়তাবােধ সৃষ্টি করবে। জাতীয়তাবােধের চর্চা ছাড়া কোনও জাতি কখনাে মহান হতে পারে না। মূলত এই দৃষ্টিকোণ হতে ১৮৬০ সালে রাজনারায়ণ ‘জাতীয় গৌরব সম্পাদনী সভা’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যা ছিল সনাতনবাদী হিন্দুদের সংগঠন। এই সংগঠনের উদ্দেশ্য ছিল হিন্দুদের মধ্যে দেশপ্রেম সঞ্চারিত করা আর হিন্দুধর্মত্যাগী যুবকদের স্বভূমিতে ফিরিয়ে আনা। বলা যায়, এই সংগঠন থেকেই হিন্দু পুনরুত্থানবাদী ধারা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়। ১৮৬৬ সালে রাজনারায়ণ বসু ‘জাতীয় গৌরবেচ্ছা সঞ্চারিণী সভা সংস্থাপনের প্রস্তাব’ নাম দিয়ে ইংরেজিতে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করেন। এই প্রস্তাবে, “হিন্দু ব্যায়াম, হিন্দু সঙ্গীত, হিন্দু চিকিৎসাবিদ্যা এবং সংস্কৃত ও বাঙ্গলা ভাষায় অনুশীলন, যত পারা যায় বাঙ্গালা শব্দ ব্যবহার করিয়া আমাদিগের কথােপকথনের ভাষার বিশুদ্ধতা সম্পাদন, বাঙ্গলা ভাষায় পরস্পর পত্র লেখা এবং বাঙ্গালীর সভাতে বাঙ্গলায় বক্তৃতা করা, সুরাপানাদি বিদেশীয় অনিষ্ঠকর প্রথা যাহাতে প্রচলিত না হয় তাহার উপায় অবলম্বন করা, হিন্দু শাস্ত্র অবলম্বন করিয়া সমাজ সংস্কার কার্য সম্পাদন করা, স্বদেশীয় সুপ্রথাসকল রক্ষা করা, নমস্কার প্রণামাদি স্বদেশীয় শিষ্টাচার পালন করা, বিদেশীয় ভাষায় নাটকাদি অভিনয় করা ইত্যাদি বিবিধ বিষয় আলােচিত হয়।”১৭
আরও কিছু প্রবন্ধেও রাজনারায়ণ বসুর সনাতনী হিন্দু আন্দোলনের প্রমাণ পাওয়া যায়। তত্ত্ববােধিনী পত্রিকায় প্রকাশিত ‘হিন্দু জাতির ঐক্য সাধন’ শিরােনামে লিখিত এক প্রবন্ধে তিনি বলেন,
“এখন হিন্দুদিগের মধ্যে অনৈক্যের ভাবই প্রধান, হিন্দু জাতি এখনাে অবনত, উন্নতির জন্য এখন বল আবশ্যক। জাতীয় ঐক্য সাধনের জন্য দরকার ধর্মের একতা। এই জন্য প্রয়ােজন একটি সাধারণ হিন্দুধর্ম প্রতিষ্ঠা। এটাই ভারতের প্রাচীন ধর্ম। পূর্ব পুরুষগণ এই ধর্মের সুশীতল ছায়ায় চিরশান্তি লাভ করেছেন। এই ধর্মের সুপ্রচার হলেই ভারতবর্ষীয়দের একমন ও একপ্রাণ হবে।”১৮
রাজনারায়ণ বসুর এই লেখনী ও সাংগঠনিক কার্যক্রম পুরাে হিন্দু সমাজকে অতীতমুখী করে তােলে। বলা যায়, এই সময় থেকেই হিন্দু ভদ্রলােক শ্রেণির মনন-চিন্তায় ভবিষ্যতের এক বলিষ্ঠ ও স্বাধীন হিন্দু জাতির আকাঙ্খাও জাগ্রত হয়।১৯
[৩]
রাজনারায়ণ বসুর ‘জাতীয় গৌরবেচ্ছা সঞ্চারিণী সভা সংস্থাপনের প্রস্তাব পাঠ করে নবগােপাল মিত্রের মনে চৈত্রমেলা বা হিন্দুমেলার ভাবােদয় হয়।২০ রাজনারায়ণের কথাতেই তা সুস্পষ্ট,
“শ্ৰীযুক্ত বাবু নবগােপাল মিত্র মহােদয় আমার প্রণীত জাতীয় গৌরবেচ্ছা সঞ্চারিণী সভার অনুষ্ঠানপত্র পাঠ করাতে হিন্দু মেলার ভাব তাহার মনে প্রথম উদিত হয়। ইহা তিনি আমার নিকট স্পষ্ট স্বীকার করিয়াছেন। এই হিন্দু মেলা সংস্থাপন করিবার পরে উহার অধ্যক্ষতা করিবার জন্য মিত্র মহাশয় ‘জাতীয় সভা’ সংস্থাপন করেন। উহা আমার প্রস্তাবিত ‘জাতীয় গৌরবেচ্ছা সঞ্চারিণী সভা’র আদর্শে গঠিত হইয়াছিল।”২১
এই বক্তব্যের প্রেরিতে একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, হিন্দুমেলা প্রতিষ্ঠার মূলে ছিল রাজনারায়ণের ভাবনাচিন্তা। বিনয় ঘােষও বলেন,
“লক্ষরুণীয় হল, হিন্দুমেলার প্রেরণা দেন ও প্রবর্তন করেন দু’জন কেশবগােষ্ঠী বিরােধী ‘আদি ব্রাহ্ম’ রাজনারায়ণ বসু ও নবগােপাল মিত্র। শুধু তাই নয়, ব্রাহ্ম সমাজের প্রথম বিভেদকালেই ‘হিন্দু মেলা’ সােৎসাহে প্রবর্তিত হয়। এ শুধু আকস্মিক ঘটনা-সংযােগ নয়। এ ঘটনা-পরম্পরায় তাৎপর্য আছে এবং তার বিশেষ গুত্ব আছে সামাজিক ইতিহাসের দিক দিয়ে। নবীন ব্রাহ্মদের সঙ্গে বিচ্ছেদের পরে প্রবীণ ব্রাহ্মরা যে হিন্দু ধর্মের শ্রেষ্ঠতা প্রতিপাদনে একটু বেশী আগ্রহ প্রকাশ করতে থাকেন তা তাদের পরবর্তী কর্মধারায় পরিস্ফুট হয়ে ওঠে।”২২
নবগােপালেরই প্রচেষ্টায়, রাজনারায়ণের প্রেরণায়, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আর্থিক ও আন্তরিক সাহায্যে এবং সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৪২-১৯২৩), মনমােহন বসু (১৮৩১-১৯১২), আনন্দমােহন বসু (১৮৪৭-১৯০৬), দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৪০-১৯২৬) ও গণেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৪১-১৯৬৯) প্রমুখের উদ্যোগে আর সেকালের বাংলার নেতৃস্থানীয় যেমন-রাজা কমলকৃষ্ণ বাহাদুর, রমানাথ ঠাকুর, কাশীনাথ মিত্র, দুর্গাচরণ লাহা, প্যারীচরণ সরকার, গিরিশচন্দ্র ঘােষ, কৃষ্ণদাস পাল, পণ্ডিত জয়নারায়ণ তর্কালঙ্কার, পণ্ডিত ভারতচন্দ্র শিরােমণি, পণ্ডিত তারানাথ তর্কবাচস্পতি প্রভৃতি ব্যক্তিবর্গের পৃষ্ঠপােষকতায় কলকাতার বেলগাছিয়ায় ডানকান সাহেবের বাগানবাড়িতে (‘বেলগাছিয়া ভিলা’) ১৮৬৭ সালের ১২ এপ্রিল হিন্দুমেলার প্রবর্তন হয়।২৩ হিন্দুমেলা নামকরণের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করে অগ্নিযুগের বিপ্লবী বিপিনচন্দ্র পাল লিখেছেন,
“সেকালের এই ভারতবর্ষটা কেবল হিন্দুরই দেশ, মুসলমান খৃষ্টীয়ান প্রভৃতির এদেশের উপরে কোনও বিশেষ দাওয়াদাবী আছে, ইহা শিথিত সমাজের মনে উদয় হয় না। ইংরাজ যেমন পরদেশী, পঞ্চাশ বৎসর পূৰ্ব্বে এদেশের নব্যশিক্ষিত লােকেরা এদেশের মুসলমান এবং খৃষ্টীয়ানকেও সেইরূপ পরদেশী বলিয়া মনে করিতেন।…আর এই সংকীর্ণ স্বাদেশিকতার প্রেরণাতেই স্বর্গীয় রাজনারায়ণ বসু মহাশয়ের হিন্দুধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপাদক বক্তৃতা লিপিবদ্ধ হয়। সেই সংকীর্ণ স্বাদেশিকতার প্রেরণাতেই মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ব্রাহ্মসমাজকে হিন্দুত্বের গণ্ডীর মধ্যে আবদ্ধ রাখিতে চেষ্টা করিয়াছিলেন এবং তাহারই জন্য কেশবচন্দ্রের ব্রাহ্ম বিবাহবিধির প্রতিবাদ করেন। আর সেই স্বাদেশিকতার আদর্শের প্রেরণাতেই নবগােপাল মিত্র মহাশয় হিন্দু মেলার প্রতিষ্ঠা করেন।”২৪
এখানে লক্ষণীয়, একটা উগ্র ধর্মমত ও সম্প্রদায়গত দম্ভ আত্মপ্রকাশ করতে থাকে। তাই চৈত্রমেলার অপর নাম হয় হিন্দুমেলা—বাঙালি মেলা বা ভারত মেলা বা জাতীয় মেলা নয়। অর্থাৎ পাকাপােক্তভাবে এই শুরু হল হিন্দু ধর্ম ও হিন্দুরাজ পুনঃসংস্থাপনের প্রচেষ্টা ও সূত্রপাত হল বাংলা তথা ভারতবর্ষের ভারী বিপদের। রাজনারায়ণ ও নবগােপালদের এই জাতীয়তার ধারণা ভারতীয় মুসলমানদের বাদ দিয়ে ব্যক্ত হল।
নবগােপালকে প্রভাবিত করেছিল সমসাময়িক ইউরােপ। ইউরােপের নানা অঞ্চলের লােক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রাদেশিক স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে ঐক্যবদ্ধ হয়ে এক একটা জাতি বা নেশন রূপে পরিণত হচ্ছিল, ইটালি ও জার্মানি জাতীয়তার ভিত্তিতে গড়ে উঠেছিল তখন। কিন্তু ভারতে কখনাে সেভাবে নেশন গঠিত হয়নি। নবগােপাল ছিলেন সেই ‘ন্যাশনাল স্পিরিটে’ উদ্দীপিত। তার সংবাদপত্রের নাম ‘ন্যাশনাল পেপার’, কুস্তির আখড়ার নাম ন্যাশনাল জিনেসিয়াম, সভার নাম ন্যাশনাল সােসাইটি। স্বয়ং নবগােপাল মিত্রই হয়ে গেলেন ন্যাশনাল নবগােপাল’, ন্যাশনাল মিত্র। দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর এ প্রসঙ্গে লিখেছেন,
“নবগােপাল একটা ন্যাশনাল ধুয়া তুলিল আমি আগাগােড়া তার মধ্যেই ছিলাম। সে খুব কাজ করিতে পারিত কুস্তি, জিমন্যাস্টিক প্রভৃতির প্রচলন করার চেষ্টা তার খুব ছিল কিন্তু কিরকম কি হওয়া উচিত সেসব পরামর্শ আমার কাছ থেকে লইত।”২৫
হিন্দুমেলা আন্দোলনের পুরােহিতদের অন্যতম ছিলেন আনন্দমােহন বসু। কে এই আনন্দমােহন বসু? তার সম্বন্ধে ‘বােধিনী’ পত্রিকা লিখেছিল,
“নতুন সংবাদ, বাঙ্গালিরা ইংরেজদিগের অপেক্ষা বুদ্ধিতে নিকৃষ্ট নহেন। বাবু রমেশচন্দ্র দত্ত ও বিহারীলাল গুপ্ত নামক দুইটি যুবক সিবিল পরীক্ষায় ইংরেজ ছাত্রদিগকে হারাইয়া প্রথম ও দ্বিতীয় পদ লাভ করিয়াছেন। আমাদিগের বন্ধু বাবু আনন্দমােহন বসু দেড়মাস মাত্র বিলাত গিয়া অঙ্ক পরীক্ষায় প্রথম হইয়াছেন। শ্রদ্ধাস্পদ বাবু কেশবচন্দ্র সেন ইংরেজীতে অনেকগুলাে মনােহর বক্তৃতা করিয়া ইংলন্ডবাসীদিগের হৃদয় আকর্ষণ করিতেছেন।”২৬
আনন্দমােহনের কৃতিত্বের ওপর আলােকপাত করতে গিয়ে ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’২৭ লিখেছিল,
“বাবু আনন্দমােহন বসু দুই মাস কাল কেম্ব্রিজ কলেজে প্রবেশ করিয়াই অঙ্ক শাস্ত্রে সর্বপ্রধান হয়েন ও পাঁচশত টাকার স্কলারশিপ পান। কলেজের শেষে আনন্দমােহন বাবুর বয়স চব্বিশ বৎসর মাত্র। ইহার মধ্যে তিনি কেবল ছাত্রবৃত্তি দ্বারা তের হাজার টাকা উপার্জন করিয়াছেন।”
দেশে ফিরেই আনন্দমােহন স্বদেশবাসীদের কল্যাণ চিন্তায় মগ্ন হলেন। হিন্দুমেলা কয়েক বছর ধরে জনসাধারণের মনে একটা আলােড়ন তুলছিল তা তিনি লক্ষ করলেন। তিনি চাইলেন ওটাকে একটা স্থায়ী সংঘে রূপ দিতে। ছাত্র-যুবরাই নেবে এ ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা। যুবক হিসেবে ছাত্র-যুবদের সহানুভূতি সহজেই আদায় করে নিলেন। ১৮৭৫-র এপ্রিল মাসে প্রতিষ্ঠিত হল প্রেসিডেন্সি কলেজে ‘স্টুডেন্টস অ্যাসােসিয়েশন’ বা ‘ছাত্রসভা’। অমৃতবাজার পত্রিকা এ ঘটনার উপর আলােকপাত করতে গিয়ে লিখল,
“আমরা শুনিলাম বাবু আনন্দমােহন বসুর উদ্যোগে প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্ররা এক সভার অধিবেশন করিয়াছেন। মানসিক শারীরিক এবং আধ্যাত্মিক ধর্মসাধন করা এ সভার উদ্দেশ্য।”২৮
আনন্দমােহন হলেন এ সভার সভাপতি। শুরু হল কাজ। কিছুদিনের মধ্যেই আনন্দমােহন শিক্ষাব্ৰতী সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়কে (১৮৪৮-১৯২৫) টেনে নিলেন নিজেদের মধ্যে ছাত্রসভায়। সুরেন্দ্রনাথ ছাত্রসভায় বক্তৃতা দিয়ে বেড়ালেন। তাঁর বক্তৃতাবলির মধ্যে উল্লেখযােগ্য—‘শিখজাতীর অভ্যুদয়’, ইটালীর অন্যতম উদ্ধারকর্তা ম্যাটসিনি’ এবং ‘মহাপ্রভু চৈতন্যদেব’। তৎকালীন ছাত্র-যুবসমাজ ভীষণভাবে আলােড়িত হল তার বক্তৃতায়। হিন্দুমেলায় স্বদেশপ্রেমের বীজ অঙ্কুরিত হল। উদ্বুদ্ধ হলেন তারা স্বদেশ ও স্বজাতীর সেবায় আত্মােৎসর্গ করতে। যুবক বিপিনচন্দ্র পাল (১৮৫৮-১৯৩২), সুন্দরীমােহন দাস (১৮৫৭-১৯৫০), তারাকিশাের রায়চৌধুরী (সন্তু দাস বাবাজী) প্রমুখ কয়েকজন যুবক হিন্দুরীতি অনুসারে অগ্নিসা করে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলেন— অনাহারে মরব, তবুও ইংরেজের দাসত্ব করব না। ভারতের স্বাধীনতার জন্য প্রাণপাত করব। এদের নেতৃত্বে ছিলেন শিবনাথ শাস্ত্রী (১৮৪৭-১৯১৯)।
যাইহােক, ১৮৬৭ থেকে ১৮৮০ পর্যন্ত ১৪ বছর এই মেলা হয়—প্রথমে চৈত্র সংক্রান্তিতে পরে মাঘ সংক্রান্তিতে। চৈত্র সংক্রান্তিতে (৩১ চৈত্র ১২৭৩, ইং-১৮৬৭) গােড়াপত্তন বলে প্রথমে এটি ‘চৈত্র মেলা’ নামে পরিচিত ছিল। ১৮৭০ সালে মেলার চতুর্থ অধিবেশন থেকে এটি প্রধানত মাঘ সংত্র(ন্তি ও তার পরদিন করে অনুষ্ঠিত হতে থাকে। সেই থেকে এর নাম হয় ‘হিন্দুমেলা’।২৯
সামাজিক ভিত্তিতে হিন্দুদের ঐক্যবদ্ধ করা ছিল হিন্দুমেলার অন্যতম লক্ষ্য৩০ দ্বিতীয় অধিবেশনে (১৮৬৮) সম্পাদক গণেন্দ্রনাথ ঠাকুর চৈত্র মেলার উদ্দেশ্য প্রসঙ্গে বলেন,
“এই মেলার প্রথম উদ্দেশ্য, বৎসরের শেষে হিন্দুজাতিকে একত্রিত করা। এইরূপ একত্র হওয়ার ফলে যদ্যপি আপাততঃ কিছুই দৃষ্টিগােচর হইতেছে না, কিন্তু আমাদের পরস্পরের মিলন ও একত্র হওয়া যে কত আবশ্যক ও তাহা যে আমাদের পক্ষে কত উপকারী তাহা বােধ হয় কাহারও অগােচর নাই। একদিন কোন এক সাধারণ স্থানে একত্রে দেখাশুনা হওয়াতে অনেক মহৎ কর্মসাধন, অনেক উৎসাহ বৃদ্ধি ও স্বদেশের অনুরাগ প্রস্ফুটিত হইতে পারে। যত লােকের জনতা হয় ততই ইহা হিন্দুমেলা ও ইহা হিন্দুদিগেরই জনতা এই মনে হইয়া হৃদয় আনন্দিত ও স্বদেশানুরাগ বর্ধিত হইতে থাকে। আমাদের এই মিলন সাধারণ ধৰ্ম্মকর্মের জন্য নহে, কোন বিষয়সুখের জন্য নহে, কোন আমােদ-প্রমােদের জন্য নহে, ইহা স্বদেশের জন্য—ইহা ভারতভূমির জন্য।
ইহার আরও একটি মহৎ উদ্দেশ্য আছে, সেই উদ্দেশ্য আত্মনির্ভর, এই আত্মনির্ভর ইংরাজ জাতির একটি প্রধান গুণ। আমরা এই গুণের অনুকরণে প্রবৃত্ত হইয়াছি। আপনার চেষ্টায় মহৎ কর্মে প্রবৃত্ত হওয়া এবং তাহা সফল করাকেই আত্মনির্ভর কহে। ভারতবর্ষের এই একটি প্রধান অভাব, আমাদের সকল কর্মেই আমরা রাজপুরুষগণের সাহায্য যাজ্ঞা করি, ইহা কি সাধারণ লজ্জার বিষয় ? কেন আমরা কি মনুষ্য নহি? মানবজন্ম গ্রহণ করিয়া চিরকাল পরের সাহায্যের উপর নির্ভর করা অপেক্ষা লজ্জার বিষয় আর কি আছে অতএব যাহাতে এই আত্মনির্ভর ভারতবর্ষে স্থাপিত হয়—ভারতবর্ষের বদ্ধমূল হয়, তাহা এই মেলার দ্বিতীয় উদ্দেশ্য।”৩১
দেশকে উন্নত করে স্বাধীনতা লাভই ছিল ‘হিন্দু মেলার’র উদ্দেশ্য। কিন্তু তখন সময়টা ছিল এমন বিরুদ্ধ আর শাসনও ছিল এতই ক্ষুদ্র যে ‘স্বাধীনতা লাভ’ কথাটা উচ্চারণ করারই অনেক বাধা ছিল। হিন্দু মেলার দ্বিতীয় অধিবেশনে মনােমােহন বলেছিলেন,
“…সারল্য …আমাদের মূলধন, তদ্বিনিয়মে ঐক্য নামক মহাবীজ ক্রয় করিতে আসিয়াছি। সেই বীজ স্বদেশ ক্ষেত্রে রােপিত হইয়া…একটি মনােহর বৃক্ষ উৎপাদন করিবেক।…তাহার ফলের নাম করিতে এক্ষণে সাহস হয় না, অপর দেশের লােকেরা তাহাকে স্বাধীনতা নাম দিয়া তাহার অমৃতাস্বাদ ভােগ করিয়া থাকে।”
তৃতীয় অধিবেশনে (১৮৬৯) মনােমােহন বসু মেলার সামাজিক তাৎপর্য ব্যাখ্যা করে বলেন.
“সামাজিকতার যে অন্য একটি মহােচ্চ ব্যুৎপত্তি আছে, দুর্ভাগ্যক্রমে আধুনিক হিন্দুজাতি যাহা ভুলিয়া গিয়াছেন, সেই ব্যুৎপত্তিবােধক সামাজিকতাই লক্ষ্য।…তাহাকে পাইবার জন্যই এত প্রয়াস। সে সামাজিকতার অভাবে কোন জাতি, জাতিপদবাচ্য হইতে পারে না—সে সামাজিকতার অভাবে স্বাতন্ত্র আর অনৈক্য, যথেচ্ছাচার আর পরতন্ত্রতা, ইহারাই সমাজরাজ্যের অধিপতি হইয়া সমাজকে উদ্ধৃঙ্খলার হস্তে অৰ্পণ করিয়াছে। অতএব সেই সামাজিকতাকে উদ্ধার করা যে কতদূর আবশ্যক হইয়াছে তাহা বলা যায় না। সে সামাজিকতার অন্য নাম জাতিধর্ম। সেই স্বজাতিধর্ম আমাদিগের অজ্ঞানতারূপ অন্ধকার কারাগারে পরবশ্যতা শৃঙ্খলে আবদ্ধ আছে, তাহাকে মুক্ত করা সৰ্বপ্ৰযত্নে বিধেয়।”৩২
হিন্দুমেলার কর্মসূচিত৩৩ ছিল—
- ১. এই মেলাভুক্ত একটি সাধারণ মণ্ডলী..হিন্দু জাতিকে উপরােক্ত লক্ষ সকল সংসাধনের জন্য এক দলে অধিভুক্ত এবং স্বদেশীয় লােকগণ মধ্যে পরস্পর বিদ্বেষভাব উম্মলন করিয়া উপরােক্ত সাধারণ কার্যে নিয়ােগকরত এই মেলার গৌরব বৃদ্ধি করিবেন।
- ২. প্রত্যেক বৎসর আমাদিগের হিন্দু সমাজের কত দূর উন্নতি হইল এই বিষয়ের তত্ত্বাবধানের জন্য চৈত্র সংক্রান্ততে বৃত্তান্ত পাঠ করা হইবে।
- ৩. অন্যদেশীয় যে সকল ব্যক্তি স্বজাতীয় বিদ্যানুশীলনের উন্নতি সাধনে ব্রতী হইয়াছেন তাহাদিগের উৎসাহ বর্ধন করা হইবে।
- ৪. প্রতি মেলায় ভিন্ন ভিন্ন স্থানে ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণির লােকের পরিশ্রম ও শিল্পজাত দ্রব্য সংগৃহীত হইয়া প্রদর্শিত হইবে।
- ৫. প্রতি মেলায় সঙ্গীত নিপুণ ব্যক্তিগণের উৎসাহ বর্ধন করা হইবে।
- ৬. যাঁহারা মল্লবিদ্যায় সুশিক্ষিত হইয়া খ্যাতিলাভ করিয়াছেন, প্রতি মেলায় তাহাদিগকে একত্র করিয়া উপযুক্ত পারিতােষিক বা সম্মান প্রদর্শন করা হইবে এবং স্বদেশীয় লােক মধ্যে ব্যায়াম প্রচলিত করিতে হইবে। হিন্দুমেলার উপরােক্ত উদ্দেশ্য ও কর্মসূচি বিশ্লেষণ করলে এটা সহজেই অনুমান করা যায় যে, এই সংগঠন পরিচালিত হত হিন্দু পুনরুজ্জীবনবাদী ধারায়। তবে এই হিন্দুমেলায় দেশীয় কুটিরশিল্পজাত দ্রব্যাদি এবং কৃষিজাত দ্রব্যাদি প্রদর্শিত হত। এর সঙ্গে থাকত শিল্প প্রদর্শনী এবং দেশীয় খেলাধুলার প্রতিযােগিতা। মেলায় সাহিত্য ও অন্যান্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়ােজনও থাকত। দেশীয় কুটির শিল্পের পুনরুজ্জীবনের প্রচেষ্টা করে হিন্দুমেলা কার্যত ভারতবর্ষের অর্থনৈতিক স্বাধীনতার দাবীটির পটভূমি রচনা করেছে।
উনিশ শতকের বিশিষ্ট লেখক ভােলানাথ চন্দ্র ‘Mookerjee’s Magazine’-এ হিন্দুমেলার অর্থনৈতিক স্বাধীনতার ভাবেচ্ছা প্রকাশ করেছেন। তিনি লিখেছেন,
‘…Without using any physical force, without incurring any disloyalty, without praying for any legislative succour, it lies quite in our power to regain our lost position. It would be no crime for us to take to the only but most effectual weapon – moral hostility – left us in our last extremity. Let us make use of this potent weapon by resolving to non-consume the goods of England. Let us always remember that the progress of India rests with the people themselves, and that her material prosperity must spring more from their own energy, perseverance and self-reliance than from any modification of the existing laws.’ (দ্র.-যােগেশচন্দ্র বাগল, ‘হিন্দুমেলার ইতিবৃত্ত’)।
হিন্দুমেলার উদ্যোক্তারা সকলেই ছিলেন হিন্দু।৩৪ তঁারা হিন্দুত্ব ও ভারতীয়ত্ব অভিন্ন হিসেবে দেখেছিলেন।
“…মেলার অনুষ্ঠানে যেমন জাতীয়তার সুর ধ্বনিত হয়—শুধু বাংলার নয়, সর্বভারতীয় জাতীয়তার—তেমনি তার হিন্দুত্বের প্রচারও বেশ প্রবল হয়ে ওঠে। এই জাতীয়তার ধারা যেমন পরে ভারত মাতা’ ও ‘জাতীয় কংগ্রেসের মধ্যে হিন্দু বেশ অনেকটা ত্যাগ করে পূর্ণ রাজনৈতিক রূপ ধারণ করে, তেমনি হিন্দুত্বের ধারাটিও ক্রমে প্রবল হয়ে ধর্ম ও সমাজ-সংস্কার ক্ষেত্রে আত্মপ্রকাশ করে। রাজনীতির মধ্যেও হিন্দু ধারার মিলন মিশ্রণ চলতে থাকে। শিক্ষিত বাঙালী মধ্যবিত্তের মন এই দুই ধারায় বিভক্ত হয়ে যায়, যদিও দুটি সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন ধারা নয়, পাশাপাশি প্রবাহিত অথচ বহু শাখা প্রশাখায় মিশ্রিত ধারা। অর্থাৎ জাতীয়তার ধারা হিন্দুত্বের পুনরভ্যুত্থান-ধারার সঙ্গে বরাবরই মিশ্রিত ছিল, যেমন হিন্দুত্ব ছিল জাতীয়তার সঙ্গে।”৩৫
মেলার প্রথম উদ্বোধনী অনুষ্ঠান (১৮৬৭) উপলক্ষে সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘মিলে সব ভারত সন্তান’৩৬ ও গণেন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘লজ্জায় ভারত যশ গাইব কী করে’ নামক সংগীত রচনা করলেন। এই অনুষ্ঠানেই পঠিত হল জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের (১৮৪৯-১৯২৫) ‘জাগ জাগ সবে ভারত সন্তান’ ও মনােমােহন বসুর ‘দিনের দিন সবে দীন’ শীর্ষক কবিতা দুটি। কলকাতা পার্শি বাগানে অনুষ্ঠিত মেলার অষ্টম বর্ষে (১৮৭৪) চোদ্দ বছরের রবীন্দ্রনাথ পাঠ করেন ‘হিন্দুমেলার উপহার’ কবিতা।৩৭ এই সংগীত ও কবিতা সবই হিন্দু ভাবের দ্বারা প্রণােদিত ও হিন্দুর গুণ-গরিমায় পরিপুষ্ট ছিল।৩৮ এগুলাের মধ্যেই নবগােপালের ও তার প্রবর্তিত হিন্দুমেলার অন্তরঙ্গ ভাবের ও আদর্শের পরিচয় পাওয়া যায়। এরপরেই দেশে একই ধরনের জাতীয় সংগীত রচিত হওয়ার জোয়ার বইল। কিন্তু এই জাতীয়তা হিন্দু জাতীয়তাই। হিন্দুমেলাকে কেন্দ্র করে একদিকে যেমন স্বজাতিপ্রেম ও জাতীয়তাবাদী ভাবনা আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মপ্রকাশ করে তেমনি একই সঙ্গে হিন্দুকে একটি জাতি হিসেবে ঘােষণাও করা হয়। সর্বত্রই যেন জাতীয়তাবাদের জন্য অবশ্য প্রয়ােজনীয় ধর্মনিরপেক্ষা দৃষ্টিভঙ্গির অভাব। মেলার সদস্যদের মতামত ও রচনা বাংলায় হিন্দুমুসলমান সম্পর্কের উপর বেশ প্রভাব বিস্তার করে।
‘হিন্দুমেলা’ নামকরণের মধ্যে ভাবীকালের সাম্প্রদায়িক প্রতিক্রিয়ার সম্ভাবনা উপলব্ধি করে ‘আৰ্য্যদর্শন’ পত্রিকায় আধুনিক ভারত’ শীর্ষক প্রবন্ধে মন্তব্য করা হয়েছিল,
“ভারতের সমস্ত অধিবাসী বৎসরে অন্তত একদিনও একত্র মিলিত হইতে পারেন, এমন একটি উপলক্ষ চাই, এমন একটি স্থান চাই। আমরা মেলার অধ্যক্ষদিগের নিকট করজোড়ে এই ভিক্ষা চাই, তাহারা যেন এই মেলাকে কোন সঙ্কীর্ণ ভিত্তির উপর সন্ত্রস্ত না করেন। আমাদিগের ভিক্ষা তঁাহারা যেন এই মেলাকে এখন হইতে হিন্দুমেলা নাম না দিয়া ভারতমেলা নাম দেন। যেন ইহা এখন হইতে ভারতবাসী মাত্রেরই উৎসব স্থল হয়।…আমরা ভারতবর্ষীয় কোন ভ্রাতার বিরুদ্ধে ইহার দ্বার অবরুদ্ধ রাখিব না।”৩৯
‘আধুনিক ভারত’ শীর্ষক প্রবন্ধের মৌলিক স্বচ্ছ দৃষ্টিকোণের ঐতিহ্য থেকে ‘আৰ্য্যদর্শন’ পত্রিকা পরবর্তীকালে কিছুটা বিচ্যুত হয়েছিল। উনিশ শতকের আটের দশকের শুরুতে ‘প্রচার’ ও ‘নবজীবন’ পত্রিকাদ্বয়ে হিন্দুত্বের নব ব্যাখ্যা এবং হিন্দুত্বই মঙ্গলের পথনির্দেশক রূপে অভিহিত হলে ‘আৰ্য্যদর্শনে একটি প্রবন্ধ লেখা হয়। প্রবন্ধটির নাম ‘নবজীবন’ ও প্রচার এবং হিন্দুধর্ম। উন্নতিশীল ব্রাহ্মদের জন্য ব্রাহ্মসমাজ (সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ) হিন্দুসমাজ থেকে আলাদা হয়ে গেলে তার প্রতিক্রিয়ার অগ্নিস্ফুলিঙ্গে নবজীবন ও প্রচারের আবির্ভাব বলে প্রবন্ধটিতে উল্লেখ করা হয়। প্রবন্ধটিতে মন্তব্য করা হয়েছিল,
“..প্রকৃত অদ্বৈতবাদী শঙ্করাচার্য্য হিন্দুধর্মের প্রকৃত মহিমা বুঝাইয়াছিলেন বলিয়াই চণ্ডালের শিষ্যত্ব স্বীকার করিতে কুণ্ঠিত হন না।…যে যেখানে হিন্দু হইতে চাহিয়াছিল, তাহাকেই তিনি হিন্দু করিয়া লইয়াছিলেন।…ব্রাহ্মধর্ম হইতে এক সময়ে আমরা এই আশা করিয়াছিলাম। কিন্তু ব্রাহ্মধর্ম ক্রমশ সঙ্কীর্ণর্ভব ধারণ করায় সে আশা গিয়াছে। এক্ষণে হিন্দুধর্মের বিজনীনভাবে যে মহাপুরুষ আবার ভারতকে অনুপ্রাণিত ও ঘনীভূত করিতে পারিবেন তিনিই আমাদের পূজার পাত্র সন্দেহ নাই। যিনি হিন্দুধর্মের বিধাজনীনভাবে ও বিশাল প্রেমােচ্ছ্বাসে এবং দেশীয় খ্রিস্টান মুসলমান সমাজকে হিন্দু সমাজের কুক্ষিগত করিতে পারিবেন—তিনিই ভারতবাসিমাত্রেরই উপাস্য দেবতা।”
যে ‘আৰ্য্যদর্শনে জাতীয় ঐক্যের জন্য হিন্দুমেলার নাম পরিবর্তন করে ভারতমেলা রাখার প্রস্তাব করা হয়েছিল সেই ‘আৰ্য্যদর্শনে’ খ্রিস্টান ও মুসলমান সমাজকে হিন্দু সমাজের কুক্ষিগত করার স্বপক্ষে মত প্রচার দুঃখজনক।
[৪]
হিন্দুমেলার (১৮৬৭) আগেই স্থাপিত হয়েছিল ‘ন্যাশনাল পেপার’ (১৮৬৫), এরপর স্থাপিত হয় জাতীয় সভা’৪০ ও ‘জাতীয় বিদ্যালয়’ (১৮৭২)। যে মেলা, সভা ও বিদ্যালয়ের কর্মতৎপরতা শুধুমাত্র হিন্দুদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ তাকে ‘জাতীয়’ বলা যায় কিনা, সে প্রণ উঠলে নবগােপাল মিত্র তাঁর ‘ন্যাশনাল পেপার’-এ মন্তব্য করেন যে, হিন্দু নিঃসন্দেহে একটি স্বতন্ত্র জাতি। কাজেই তাদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত কোনাে সভাকে জাতীয় বলা যেতেই পারে।৪১ ‘জাতীয় গৌরবেচ্ছা সঞ্চারিণী সভা, ‘হিন্দুমেলা’, ‘ন্যাশনাল পেপার’ ও ‘জাতীয় সভা’ প্রভৃতিতে হিন্দুধর্ম ও হিন্দু নামের বিবিধ বিষয়ের মাহাত্ম প্রচারের ফলে দেশে হিন্দুনামের যে ব্যাপক প্রচার হয় তার ফলে বিরূপ মন্তব্যের সম্মুখীন হতে হয়। কেউ কেউ বলেন, এই হিন্দুত্ব প্রচারকে ‘জাতীয়’ নাম দেওয়া অসমীচীন।৪২
নবগােপালের কাছে জাতীয়তাবাদের ভিত্তি ছিল ‘ঐক্য’। এই ঐক্যের মূল বিভিন্ন জাতির ক্ষেত্রে বিভিন্ন। যেমন গ্রিকদের ক্ষেত্রে পূর্ব-গৌরব আর দেশভক্তি, ইহুদিদের ক্ষেত্রে ‘মুসার আইন’, ইংরেজদের ‘দেশভক্তি’। তেমনি ভারতীয়দের জাতীয় ঐক্যের ভিত্তি ‘হিন্দুধর্ম’ এবং ‘হিন্দু জাতীয়তাবাদ’ শুধু বাংলায় সীমাবদ্ধ নয়, এর ব্যাপ্তি সারা হিন্দুস্থানে। ভৌগােলিক ব্যবধান বা ভাষার প্রভেদ বিভেদের কারণ হতে পারে না। ধর্মের জাতিত্বই হিন্দুর ভবিতব্য। ‘ন্যাশনাল পেপার’-এ নবগােপাল এ বিষয়ে বলেন,
“ঐক্যই জাতির ভিত্তি। নানা সূত্রে ও বিভিন্ন রকমে এই ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হইতে পারে। দেশপ্রেম গ্রিকদের, মােজেসের বাণী ইহুদিদের, খ্যাতি ও স্বাধীনতার আকাঙ্খ রােমের ও স্বাধীনতাপ্রীতি ইংরেজদের জাতীয় ঐক্যের ভিত্তি। সেইরূপ ধর্ম হিন্দুদের জাতীয় ঐক্যের মূল ভিত্তি। হিন্দু জাতি বাংলায় সীমাবদ্ধ নহে—সমগ্র ভারতের যেখানে হিন্দু আছে, তাহাদের লইয়াই হিন্দু জাতি।”৪৩
এভাবে যুক্তিবাদ, ধর্মে উদাসীনতা এবং মানবতাবাদের পরিপন্থী হিন্দু জাতীয়তাবাদের গােড়াপত্তন করে ব্রাহ্ম সমাজ ধর্মসংস্কারের নামে প্রকৃতপৰে বৌদ্ধিকসাংস্কৃতিক নবজাগরণের প্রতিকূল ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকেই স্পষ্ট করে তুলেছিল। এই হিন্দু জাতীয়তাবাদের বিষবৃক্ষ থেকেই পরবর্তীকালে মুসলিম বিচ্ছিন্নতাবাদ, ভারত বিভাজন এবং আরও পরে মৌলবাদী রাজনৈতিক শক্তির বিষফল ফলেছে। নবগােপালের এই তীব্র স্বতন্ত্রবাদী মনােভাব প্রসঙ্গে বদরুদ্দিন উমর বলেন,
“উনিশ শতকের নবগােপাল মিত্র বিশ শতকের কায়েদে আজম জিন্নাহর যথার্থ পূর্বসূরী।”
হিন্দুধর্মে প্রগাঢ় নিষ্ঠা নিয়ে এই আন্দোলনের পুরােধারা এগােতে থাকেন। অবস্থা হিন্দু-মাহাত্ম প্রচারের অনুকূল বিবেচনা করে, কৃষ্ণপ্রসন্ন সেন (১৮৪৯-১৯০২) মুঙ্গের থেকে কলকাতায় চলে আসেন। ১৮৭৫-এর ডিসেম্বর মাসে অ্যালবার্ট হলে ‘ভারতের মূচ্ছাভঙ্গ’ নামে যে জ্বালাময়ী ভাষণটি তিনি দেন, তা শুনে অনেকেই মুগ্ধ হন। তাঁর মতে—শিল্পনৈপুণ্য, চিত্রবিদ্যা, সামরিক বিদ্যা, জ্যোতির্বিদ্যা, পদার্থবিদ্যা, চিকিৎসাবিদ্যা কোনােকিছুতেই ভারতবর্ষ কারও চেয়ে পিছিয়ে নেই। তার মতে,
“বার তিথির ব্যবস্থাপত্র তাহারাই প্রথম আবিষ্কার করেন। যেদিন, দিন-রাত্রি সমান হয়, তাহা টলেমি জন্মিবার বহুদিন পূর্বে আৰ্য জ্যোতির্বিদ মহাত্মাগণ নিরূপণ করিয়া গিয়াছেন। কোপার্নিকাস আসিয়া পৃথিবীর দৈনিক গতি আবিষ্কারপূৰ্ব্বক যখন জ্যোতির্বিদ মণ্ডলীমধ্যে প্রতিপন্ন লাভ করিলেন, তাহার বহুদিন পূৰ্বে আৰ্যজাতি একথার নির্ধারণ করিয়া গিয়াছেন। পৃথিবী কপিত্থর ন্যায় গােলাকার এবং উত্তর-ক্ষিণে কিঞ্চিৎ চাপা। এই ভূগােলতত্ত্ব শিক্ষা দেবার জন্য আজকাল যে গােলক (গ্লোব) নিদর্শন দ্বারা বিদ্যালয়ে ছাত্রদিগকে শিক্ষা দেওয়া হয় তাহাও প্রাচীন আৰ্যপদ্ধতির অনুকরণ মাত্র।”৪৪
বিদ্যুৎ শক্তি ব্যবহারেও প্রাচীন ভারতীয়রা কত দক্ষ ছিলেন, তার প্রমাণ হিসেবে রামায়ণে উল্লিখিত শক্তিশেল-এর কথা তিনি উল্লেখ করেন। সগর্বে তিনি জানান—
“বাণের মধ্যে বৈদ্যুতিকী শক্তির ব্যবহার করিতে এখনও পাশ্চাত্য বিজ্ঞান সামর্থ্য লাভ করে নাই।”৪৫
বিধবার ব্রহ্মচর্য, জাতিভেদ প্রথা, বর্ণাধিকার, সব কিছুকেই এই বক্তৃতায় তিনি দৃঢ়ভাবে সমর্থন করেন। বক্তৃতা শেষে হিন্দুসন্তানদের আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন,
“কে আছ, সােনার ভারতের সােহাগের সন্তান? একবার সমস্ত কুহকজাল ভেদ করিয়া দৈবী শক্তি বলে মহামন্ত্রকে চেতন করিয়া, এই প্ৰসুপ্ত রাজকন্যার অঘাের নিদ্রা-মহামূচ্ছা ভাঙ্গিয়া দাও। রাজনন্দিনী জাগিয়া উঠুক, সপ্তপুরী পুনরুত্থিত হউক। তাহা হইলে সিদ্ধি, সমৃদ্ধি, সৌভাগ্য ভারত-গগনে তারকাস্তবকের ন্যায় ফুটিয়া উঠিবে। আর্যজাতির, আৰ্য্যপ্রকৃতির বিজয় ভেরী নিনাদে প্ৰসুপ্ত জগৎ পুনর্জাগ্রত হইবে।”৪৬
রাজনারায়ণ বসুর মতাে তিনিও ভারতের গৌরব ও সমৃদ্ধি পুনরুদ্ধারের জন্য আর্যজাতির জাগরণ কামনা করেছেন। রাজনারায়ণ বসুর পাণ্ডিত্যপূর্ণ বক্তৃতার মর্ম উপলব্ধি করা অশিতি বা অর্ধশিক্ষিত মানুষের পরে সম্ভব না হলেও, সুবক্তা কৃষ্ণপ্রসন্নর আবেগনির্ভর, অনৈতিহাসিক, অবৈজ্ঞানিক কথার পূর্ণ ভাষণ তাদের মন জয় করে নেয়। ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে ঘুরে ‘পরম পবিত্র ধর্ম’ প্রচারে তাঁর প্রচেষ্টা সেকালে যথেষ্ট সাড়া জাগিয়েছিল।
এই ধরনের প্রচারাভিযান আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে পণ্ডিত শশধর তর্কচূড়ামণির (১৮৫১-১৯২৮) অভিনব ধর্মব্যাখ্যায়। তিনি ১৮৮৪ সালে বারাণসীর আর্যধর্ম প্রচারিণী সভার প্রচারক হিসেবে কলকাতায় আসেন। তিনি হিন্দুধর্মের পক্ষে একটি বলিষ্ঠ বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যাদানের প্রয়াস পান, যদিও বিজ্ঞানের সাথে তার কোনাে যােগাযােগ ছিল না। এমনকী বহুমুখী সংস্কারের বেড়াজালে আবদ্ধ সনাতন হিন্দুধর্মের সাথে বিজ্ঞানের বা যুক্তির কোনাে সম্পর্ক ছিল না। শাস্ত্রে অগাধ আস্থা নিয়ে শশধর তার ধর্মপ্রচার অভিযান শুরু করেন। অধ্যাত্মচিন্তায় উদাসীনতাকে ভারতবাসীর দুরবস্থার মূল কারণ হিসেবে তিনি চিহ্নিত করেন। ভারতের আচার ধর্ম, ভারতের ব্যবহার ধর্ম, ভারতের আহার ধর্ম, ভারতের উপাসনা ধর্ম সমস্ত ভারতের স্বভাবের সঙ্গে গাঁথা।৪৭ —তা থেকে যে কোনােরকম বিচ্যুতিই ভীষণ ক্ষতিকর বলে তিনি মনে করতেন। সম্পূর্ণ মানুষ একমাত্র ভারতেই কেন সম্ভব, তা বিভিন্ন উদাহরণের সাহায্যে তিনি ব্যাখ্যা করেন। কৃষ্ণপ্রসন্নর মতাে তিনিও হিন্দুদের প্রচলিত সমস্ত আচারকে বৈজ্ঞানিক আখ্যা দিয়ে সাধারণ মানুষকে তাক লাগিয়ে দেন। বিভিন্ন সংবাদপত্র, বিশেষ করে ‘বঙ্গবাসী’ তাকে নিয়ে মাতামাতি শুরু করে। কী ধরনের বক্তৃতা তিনি দিতেন, তার বিবরণ। প্রত্যক্ষদর্শী মন্মথকুমার বসুর (১৮৪৮-১৯২৪) স্মৃতিকথায়,
“তিনি শিক্ষা দিতেন যে সকল দেশের ও সকল কালের শাস্ত্র হিন্দু শাস্ত্রের মধ্যে নিহিত আছে। কুশাসনে বসিলে শারীরিক বিদ্যুৎ উত্তমরূপে রথিত হয়, প্রাণায়ামে বৈদ্যুতিক শক্তি বৃদ্ধি হয়। যতরকম নিষেধ বা বিধি আমাদের শাস্ত্রে আছে তাহা সমস্তই মানবের মঙ্গলের জন্য। টিকি রাখা, গণ্ডুষ করা, উপবীত ধারণ ইত্যাদিতে বৈদ্যুতিক শক্তি সঞ্চারিত হয়…বিদ্যুৎ ও আধ্যাত্মিকতা তাহার বক্তৃতার প্রধান স্থান অধিকার করে।”৪৮
সনাতনী ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপাদনের ভিত্তিতে তার প্রচারণা ও সাংগঠনিক কার্যকলাপ পশ্চাৎপদ অবহেলিত সাধারণ হিন্দু মানসে বেশ রেখাপাত করতে সক্ষম হয়। অল্প সময়ের মধ্যে এই আন্দোলন শহর কলকাতা থেকে বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে পড়ে এবং নানাস্থানে নতুন হিন্দু সনাতনবাদী সংগঠন গড়ে উঠতে থাকে।৪৯ তর্কচূড়ামণির দু-জন শিষ্য তার প্রচারিত মতবাদকে এগিয়ে নিয়ে যান। এরা হলেন কৃষ্ণপ্রসন্ন সিংহ ও শিবচন্দ্র বিদ্যার্ণব। বাংলার বিভিন্ন অঞ্চল সফর করে এরা এই প্রচারণা চালান। পরিণতিতে হিন্দু পুনরুত্থানবাদী আন্দোলনটি আস্তে আস্তে জাতীয় রূপ পরিগ্রহ করার দিকে এগিয়ে যায়।
হিন্দু পুনরুত্থানবাদী আন্দোলনে অপর একটি সংগঠন হল জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত ‘সঞ্জীবনী সভা’। রাজনারায়ণ বসু ছিলেন এর সভাপতি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১) ও নবগােপাল মিত্র ছিলেন এর সভ্য। এ বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘আত্মপরিচয়’ এ লিখেছেন,
“জ্যোতিদাদা এক পােড়ােবাড়িতে এক গুপ্ত সভা স্থাপন করেছেন। একটা পােড়ােবাড়িতে তার অধিবেশন, ঋগ্বেদের পুঁথি, মড়ার মাথার খুলি, আর খােলা তলােয়ার নিয়ে তার অনুষ্ঠান, রাজনারায়ণ বসু তার পুরােহিত। সেখানে আমরা ভারত উদ্ধারের দীক্ষা পেলাম।”
এই সকল সংগঠনে সনাতনবাদ, গুরুবাদ ও অবতারবাদকে নতুন প্রলেপে প্রচার করা হত। এগুলাের পরিচালনায় ছিল শহরের উচ্চবিত্ত ধনিক, বণিক, জমিদার ও মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়। দেশের শ্রমিক, কৃষক, গরিব নিম্নশ্রেণির হিন্দু জনসাধারণের মাঝে অত্যন্ত কৌশলে নব্য-হিন্দুবাদের প্রচারণা চালানাে হত। ধর্মপ্রাণ সকল মানুষ তাদের দ্বারা তাড়িত হয়ে এই সকল আন্দোলনের শক্তি জোগাত। ক্রমে ক্রমে সাধারণ হিন্দু সমাজের মাঝে ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি করতে পুনরুত্থানবাদীরা সক্ষম হয়।
প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায় যে, হিন্দু সমাজের প্রচলিত সনাতনী প্রথাসমূহ, প্রচলিত ধর্মীয় ও সামাজিক আচরণ-পদ্ধতি শ্রেষ্ঠ প্রতিপাদনের প্রয়াস উনিশ শতকের প্রথমার্ধের সাহিত্য ক্ষেত্রে চলে আসছিল। তবে তা তৎকালীন সামাজিক আন্দোলনে কোনাে প্রভাব সৃষ্টি করতে পারেনি। ১৮৩০ সালের ৩০ জানুয়ারি সংখ্যা সমাচার দর্পণ’ পত্রিকায় প্রকাশিত প্রকাশনা বিষয়ক একটি প্রতিবেদনে দেখা যায় যে, ১৮২৯ সালে বাংলা ভাষায় ছােটো বড়াে মােট ৩৭টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়, এগুলাের অধিকাংশই হিন্দুধর্ম সংক্রান্ত।৫০ এগুলাের মধ্যে উল্লেখযােগ্য কয়েকটি হল কাশীনাথ বসুর লেখা ‘শ্রাদ্ধ মহাত্ম’ ও ‘দর্শন দীপিকা’, রাধামাধবের ‘পাষণ্ড দলন’, হরিনারায়ণ গােস্বামীর ‘হিন্দুধর্ম চন্দ্রোদয়’, গৌরীকান্তের বিপ্ৰভক্তি চন্দ্রিকা’, ‘জ্ঞানর্জন ও মােহনাশক চন্দ্রিকা ইত্যাদি। এই গ্রন্থসমূহ প্রধানত রক্ষণশীল ধনিক, বণিক, জমিদার সম্প্রদায়ের অর্থানুকূল্যে ও পৃষ্ঠপােষকতায় প্রকাশিত হয়। গ্রন্থসমূহ নিতান্ত চর্বিত-চর্বণ, আর সাহিত্যমূল্য বলতে এগুলাের কিছুই নেই। তবু উনিশ শতকের প্রথমার্ধে বহু নন্দিত ও বহুল সমালােচিত সনাতন হিন্দুধর্মের সচল অস্তিত্বের এটি অন্যতম দিক। এগুলাের মধ্য দিয়ে সনাতনী ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব ঘােষণা অব্যাহত ছিল। গ্রন্থ প্রকাশনার পাশাপাশি উক্ত সময়ে প্রকাশিত কমপক্ষে দশটি পত্রিকাও সনাতন হিন্দুধর্মের সপক্ষে অন্ধ প্রচারণা চালায়।৫১
[৫]
উনিশ শতকে ইউরােপের জঙ্গম শক্তির আঘাতে আমাদের জীবনে সীমাবদ্ধ নবজাগরণের সূচনা হলে ‘হিন্দু’ নামাঙ্কিত বহু প্রতিষ্ঠানও আত্মপ্রকাশ করে। ১৮১৭ সালে রামমােহন, ডেভিড হেয়ার, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি হাইড ঈস্টের সহযােগিতায় ও অন্যান্য প্রভাবশালী হিন্দু ব্যক্তিবর্গের উদ্যোগে স্থাপিত হয় হিন্দু কলেজ। এছাড়া উনিশ শতকের প্রথমার্ধে ‘হিন্দু চ্যারিটেবল ইনস্টিটিউশন’, ‘হিন্দু ফ্রি স্কুল’, ‘হিন্দু ফিমেল স্কুল’, ‘হিন্দু বেনিভােলেন্ট স্কুল’, ‘হিন্দু থিয়েটার’ প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। এসব প্রতিষ্ঠানে অহিন্দু ছাত্রদের প্রবেশাধিকার ছিল নাঙ্গ এই সময় একে একে প্রতিষ্ঠিত হয় হিন্দু অবৈতনিক বিদ্যালয়, অ্যাংলাে-হিন্দু স্কুল, হিন্দু, হিতাথী বিদ্যালয় ইত্যাদি। ১৮৫৩-এ স্থাপিত হয় হিন্দু মেট্রোপলিটন কলেজ। ১৮৫৫-এ স্থাপিত হয় হিন্দু স্কুল। বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে হিন্দু সমাজের সংস্কার ও উন্নতি লক্ষ নিয়ে ‘হিন্দু’ নামাঙ্কিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি আত্মপ্রকাশ করেছিল। এই প্রতিষ্ঠানগুলিতে কেবল হিন্দু ছাত্ররাই পড়তে পারত। কিন্তু উনিশ শতকের সাতের দশকের শুরু থেকে ‘হিন্দু’ নামাঙ্কিত এই প্রতিষ্ঠানগুলি জাতীয়তার দ্যোতনা বহন করতে থাকে। উনিশ শতকে অহিন্দু বিশেষ করে মুসলিম প্রতিবেশীদের প্রতি বাঙালি হিন্দু সংস্কারকদের এই উপেক্ষার মনােভাব ইতিহাসে চিহ্নিত। জনৈক ব্রিটিশ লেখক লিখেছেন,
“মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশে বসবাস করেও প্রায় অধিকাংশ বাঙালি হিন্দু সংস্কারকরা ইসলাম ও মুসলিম ঐতিহ্যসমূহকে পুরােপুরিভাবে অবজ্ঞা করেছেন। হিন্দুদের মধ্যে মুসলিম প্রতিবেশীদের জীবনধারা সম্পর্কে এই অজ্ঞতা ও অবজ্ঞা আজও এক মনােযােগ আকর্ষণকারী সামাজিক বাস্তবতা…।৫২
উনিশ শতকীয় হিন্দু বুদ্ধিজীবীদের প্রায় সকলেই (রামমােহনকে ব্যতিক্রম বলা যেতে পারে) ইসলাম সম্পর্কে ছিলেন অজ্ঞ। মােগল শাসন শেষ হওয়ার পর হিন্দু সমাজের সঙ্গে ইসলামের সম্পর্ক ছিল না বললেই চলে। নীরদচন্দ্র চৌধুরী লিখেছেন, “আজকাল হিন্দু-মুসলমান বিরােধের এই বিষম বিপদটা আমি যখন দেখি, তখন আমি মােটেই আশ্চর্য হইনে, কারণ আমরাই ছেলেখেলার মতাে নিজেদের হাতেই পরিশ্রম করে এই সর্ষের বীজ বুনে দিয়েছি। বস্তুত এই বিরােধটা ছিল আমাদের ইতিহাসের অন্তর্গত এবং এড়ানাে ছিল অসম্ভব। ঈশ্বর আমাকে রক্ষা করুন ভারতীয়দের সেই সাধারণ অসাধুতা থেকে, যাঁরা বলেন যে, এ বিরােধ ব্রিটিশেরই সৃষ্টি, যদিও এই বিদেশি শাসকরা এর দ্বারা প্রচুর লাভবান হয়েছিল। বাস্তবিক তারা দেবতা হিসেবে ক্ষমাৰ্হ হতাে, রাজনীতিক জীব মানুষ হিসেবে নয়, যদি তারা আমাদেরই বহু সাধনায় নির্মিত ও আমাদের দ্বারাই তাদের হাতে তুলে দেওয়া এ অস্ত্রটির সুযােগ গ্রহণ না করত।
স্বদেশী আন্দোলনের দৃষ্টিভঙ্গিতে মুসলমানদের দিকে তাকাবার পূর্বেই অতি শৈশবে আমাদের মনমানস চারটি প্রত্যক্ষ দিকে ঐতিহ্যগতভাবে গঠিত হয়ে উঠেছিল। প্রথমত, আমরা স্বভাবতই তাদের দিকে বিরূপ দৃষ্টিতে তাকাতাম, কারণ তারা এক সময় হিন্দুদের ওপর প্রভুত্ব করেছিল। দ্বিতীয়ত, সমকালীন সমাজের অঙ্গ হিসেবে মুসলমানদের আমরা কখনাে চিন্তা করিনি। তৃতীয়, আমাদের বন্ধুত্ব ছিল শুধু অর্থনৈতিক ও সামাজিক মর্যাদায় সমশ্রেণীর মুসলমানদের সঙ্গে। চতুর্থত মুসলমান কৃষক সমাজের ওপর আমাদের দৃষ্টিটা ছিল মিশ্রিত এবং ঘূণাব্যঞ্জক, কারণ তাদের আমরা শুদ্ৰশ্রেণির হিন্দুর মতাে কিংবা অন্য কথায় গরু-ছাগলের মতাে বিবেচনা করতাম। এই চারটির মধ্যে আবার প্রথমটি ছিল প্রত্যক্ষ ও শিক্ষিত মনােবৃত্তিসঙ্গত বাকিগুলাে স্বভাবগত।
আমরা মুসলমানদের সঙ্গে যে ব্যবহার করেছি, তার বিপরীত কিছু করা ছিল আমাদের প্রকৃতিবিরুদ্ধ। আমরা পড়তে শেখার পূর্বেই আমাদের শেখানাে হতাে মুসলমানরা একদা আমাদের শাসন করেছে ও অত্যাচার করেছে, তারা ভারতে এক হাতে কোরান ও অন্য হাতে তরবারি নিয়ে ইসলাম প্রচার করেছে মুসলমান শাসকরা আমাদের নারী হরণ করেছে, আমাদের মন্দির ধ্বংস করেছে, আমাদের পবিত্র স্থানসমূহ অপবিত্র করেছে। আমরা যখন বড় হলাম, তখন পড়েছি রাজপুত মারাঠা ও শিখরা কত বীরবিক্রমে মুসলমানদের সঙ্গে লড়েছে শিখেছি আওরঙ্গজেব আমাদের উপর কী ভীষণ অত্যাচার উৎপীড়ন করেছে। উনিশ শতকী বাংলা সাহিত্যে মুসলমান চিত্রিত হয়েছে শুধু ‘যবন’রূপে বঙ্কিমচন্দ্র চ্যাটার্জি ও রমেশচন্দ্র দত্ত তাদের উপন্যাসসমূহে মুসলমানের শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহকে গৌরবােজ্জ্বল হিসেবে চিত্রিত করেছেন এবং মুসলমানকে চিত্রিত করেছেন ঘৃণ্যভাবে। চ্যাটার্জি তাে ছিলেন প্রত্যক্ষ ও হিংস্রভাবে মুসলিমবিদ্বেষী। আমরা গােগ্রাস সেসব উপন্যাস গলাধকরণ করেছি এবং তাদের মন্ত্রে দীক্ষিত হয়েছি।
আমাদের চারপাশে যেসব মুসলমান দেখেছি তাদের প্রতি আমাদের মনােভাব প্রভাবিত হয়েছে উনিশ শতকী হিন্দু সাহিত্যিকদের প্রত্যক্ষ আক্রমণ কিংবা নীরব সমর্থনের দ্বারা। তাদের নীতি ছিল ঐতিহাসিক মুসলমানের প্রতি ঘৃণাটা মুসলিম সমাজের ওপর প্রচারিত করা। এর ফল হয়েছে অতীতমুখী। সমসাময়িক মুসলমানদের আমরা গণনার মধ্যে আনিনি, হয় তাদের ভুলেছি নয় উপেক্ষা। করেছি। ব্রিটিশ শাসন ইসলামি কালচারের চর্চা করা কিংবা হিন্দুদের সহানুভূতি মুসলমানের প্রতি আকর্ষণ করার বিরুদ্ধ ছিল আর এই পরিস্থিতিতে প্রাচীন হিন্দু সভ্যতার আবিষ্কার কর্মটা জোরদার করা হয়েছিল। এই রেনেসাঁর প্রথম ফল হয়েছিল ভারতীয় হিন্দুকে একেবারেই অ-ইসলামিকরণ ও হিন্দু ঐতিহ্যের পুনরুজ্জীবনকরণ। সারা উনিশ শতকব্যাপী সাধনা চলেছিল ভারতীয় হিন্দু কালচারকে প্রাচীন সংস্কৃতের মৌল ভিত্তিমূলে প্রতিষ্ঠিত করা। যে একটি মাত্র অহিন্দু প্রভাবকে স্বীকৃতি দেওয়া হতাে ও যার আত্তীকরণ করা হতাে, তা হলাে ইউরােপীয় মাত্রা। আধুনিক ভারতের সব চিন্তানায়ক ও সংস্কারকরামমােহন থেকে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত সকলেই জীবনব্যাপী সাধনা করেছেন একটি মাত্র সমন্বয় সাধনের আর সেই সমন্বয়টি হিন্দু ও ইউরােপীয় চিন্তাধারার। ইসলামি ভাবধারা ও ট্রাডিশন তাদের চেতনাবৃত্তকে কখনাে স্পর্শ করেনি।”৫৩
এভাবে উনিশ শতকী নব্যভারতীয় কালচার একটি সুপরিকল্পিত নিজস্ব সীমিত বৃত্ত রচনা করল এবং মুসলিম প্রভাব ও আশাআকাওঁ কে বিশেষভাবেই সে বৃত্তের বাইরে নিক্ষেপ করল। তার সঙ্গে মুসলমানের সম্বন্ধটা দাঁড়ালাে ‘একসটার্নাল প্রােলেটারিয়েট’এর মতাে বাইরে অবস্থান। মুসলমান যদি হিন্দুর এ জগতে প্রবেশের স্পর্ধা করত, তাহলে তাকে ইসলামি মূল্যবােধ ও ট্রাডিশন বিসর্জন দিয়ে আসতে হত।
নীরদচন্দ্র চৌধুরী লিখেছেন,
“সত্য বলতে মিঃ জিন্নাহ বা মুসলিম লিগের বহু পূর্বেই দুই জাতিত্ব-তত্ত্বের সৃষ্টি হয়েছিল, আর এটা শুধু তত্ত্বকথা না, এটা ঐতিহাসিক বাস্তব ঘটনা। সকলেই বর্তমান শতকের (বিশ শতকের) প্রথমে এটির অস্তিত্বের কথা জানত, এমনকি আমরা ছেলেবেলায় স্বদেশী আন্দোলনের পূর্ব থেকেই জানতাম।”৫৪
তথ্যসূত্রঃ
- ১. বিনয় ঘােষ, বাংলার বিদ্বৎ সমাজ, প্রকাশ ভবন, দ্বিতীয় সংস্করণ, কলকাতা, ২০০০, পৃ. ২৭-২৮
- ২. Anil Seal, The Emergence of Indian Nationalism : Competition and Collaboration in the Later Nineteenth Century (Political Change in Modern South Asia), Cambridge University Press, Cambridge, 1971, P. 206.
- ৩. ১৮৭০ সালে জাতীয় সভা’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। চৈত্রমেলা বা হিন্দুমেলা ছিল বাৎসরিক তিন-চার দিনের, তাই সারা বছর ধরে মেলার আদর্শ প্রচারের জন্য জাতীয় সভার প্রতিষ্ঠা হয়। এই সভার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল হিন্দুদের মধ্যে ঐক্য ও জাতীয় ভাব সঞ্চার করা। প্রতি মাসে জাতীয় সভার একটি করে অধিবেশন বসত এবং সেই উপলক্ষে বক্তৃতা দানের ব্যবস্থা ছিল।
- ৪. ন্যাশনাল পেপার ১৫-০৯-১৮৭২।
- ৫. দেখুন-অজিতকুমার চক্রবর্তী, ‘রাজনারায়ণ বসু’, প্রবাসী অগ্রহায়ণ ১৩২৪, পৃ. ১৬৬। আরও দেখুন-বঙ্কিম রচনাবলী, খণ্ড ২, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা, মুদ্রণ ১৩৯৫, প্রাপ্ত গ্রন্থের সংক্ষিপ্ত সমালােচনা, পৃ. ৮৭৫।
- ৬. কলিকাতা ব্রাহ্ম সমাজের নূতন মত, ধর্মতত্ত্ব ১৬ আথিন ১৭৯৪ শক।
- ৭. ন্যাশনাল পেপার ৩০-০৪-১৮৭৩।
- ৮. বঙ্কিমচন্দ্রের সম্পাদিত ‘বঙ্গদর্শন’-এ রাজনারায়ণের বক্তৃতার সমালােচনা প্রকাশিত হয়। বঙ্কিমচন্দ্র রাজনারায়ণের সাধু উদ্দেশ্যের প্রশংসা করে লেখেন, “রাজনারায়ণবাবুর লেখনীর উপর পুষ্পচন্দন বৃষ্টি হউক। এই মহাগীত ভারতের সর্বত্র গীত হউক। হিমালয় কন্দরে প্রতিধ্বনিত হউক। গঙ্গা যমুনা সিন্ধু নর্মদা গােদাবরী তটে বৃক্ষে বৃক্ষে মর্মরিত হউক। পূর্ব-পশ্চিম সাগরের গম্ভীর গর্জনে মন্দ্রীভূত হউক। এই বিংশতি কোটি ভারতবাসীর হৃদয়যন্ত্র ইহার সঙ্গে বাজিতে থাকুক।” (বঙ্কিম রচনাবলী, খণ্ড-২, প্রাগুক্ত, পৃ. ৮৭৬)।
- ৯. রাজনারায়ণের সমকালে হিন্দুধর্ম ও হিন্দু সংস্কৃতি নানাদিক থেকে নানাভাবে আক্রান্ত হচ্ছিল এবং শিথিত বাঙালি হিন্দুদের মধ্যে হিন্দুধর্ম নিন্দিত হচ্ছিল। রাজনারায়ণ হিন্দুধর্ম রক্ষা ও জাতীয় ভাব প্রচার-প্রসারে আত্মনিয়ােগ করেন। প্রাচীন ভারত ছিল হিন্দু ভারত। স্বাভাবিকভাবেই রাজনারায়ণের প্রচারিত জাতীয়তাবাদ ছিল হিন্দু জাতীয়তাবাদ। কিন্তু তাঁর ‘হিন্দুভাব’ কোনাে সাম্প্রদায়িকতা দোষে দুষ্ট ছিল না। হিন্দু শব্দটিকে তিনি সংকীর্ণ অর্থেও ব্যবহার করেননি। তবে এটা বলা অসঙ্গত নয় যে, তার জাতীয়তায় মুসলমানরা স্থান পায়নি। নিখিল সুর লিখেছেন, “রাজনারায়ণ বসুর চিন্তার মধ্যে অনেক অসম্পূর্ণতা ছিল সত্য। তার জাতীয় চিন্তায় ভারতীয় নয়, শুধু বাঙালি স্থান পেয়েছিল। হিন্দু ধর্মের গৌরব পুনরুদ্ধারের পরিকল্পনা করতে গিয়ে তিনি ভারতীয় মুসলমানদের গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারেননি।” (নিখিল সুর, ভারতীয় জাতীয়তাবাদের পটভূমি, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদ, কলকাতা, ২০১২, পৃ. ১১০-১১১)
- ১০. রাজনারায়ণ বসু সম্পর্কে ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকারের উক্তি, “Babu Rajnarain Bose, a man of the most striking and remarkable personality and one who realised in his life the nationalistic aspirations of our country long before they found any definite or articulate expression among any considerable body of men. He was called in his time the grand-father of Indian Nationalism’ and right well did he deserve that name.” (যদুনাথ সরকার, ‘রাজনারায়ণ বসু’, মডার্ণ রিভিউ এপ্রিল ১৯০৯)।
- ১১. নবজীবন শ্রাবণ ১২৯৩, ইং-১৮৮৬।
- ১২. কে কে ঘটক, হিন্দু রিভাইভালিজম ইন বেঙ্গল রামমােহন টু রামকৃষ্ণ, মিনার্ভা, কলকাতা, ১৯৯১, পৃ. ৩৪-৩৫।
- ১৩. কে কে ঘটক, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৪-৪৫।
- ১৪. কে কে ঘটক, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৭-৪৮। রাজনারায়ণ বসু বলেন, “যাঁহারা মুসলমান ধর্ম অথবা খৃষ্টীয় ধর্ম পরিত্যাগ করিয়া হিন্দুধর্ম অবলম্বন করিয়াছেন, তাঁহারাও সভ্য (মহাহিন্দু সমিতির) হইতে পারিবেন।” অর্থাৎ মুসলমান বা খ্রিস্টান ওই সমিতির সদস্য হতে পারবেন না।
- ১৫. দেখুন- অমলেন্দু দে, বাঙালী বুদ্ধিজীবী ও বিচ্ছিন্নতাবাদ, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদ, কলকাতা, ১৯৯১, পৃ. ২১১-২১২।
- ১৬. ক্ষিতীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রাজনারায়ণ বসুর উদারতা, দেখুন-বঙ্গলক্ষ্মী আষাঢ় ১৩৪২, পৃ. ৪৭৩-৭৪।
- ১৭. যােগেশচন্দ্র বাগল, হিন্দুমেলার ইতিবৃত্ত, মৈত্রী প্রকাশন, কলকাতা, ১৩৭৫, পৃ. ২।
- ১৮. বিনয় ঘােষ, সাময়িকপত্রে বাংলার সমাজচিত্র ১৮৪০-১৯০৫, খণ্ড-১, কলকাতা, ১৯৬২, পৃ. ৩৩৯-৪০।
- ১৯. শুভংকর মুখােপাধ্যায়, সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা আনন্দমঠ বিতর্ক, মধ্যাহ্ন, বিশেষ সমাজতাত্ত্বিক সংখ্যা, কলকাতা, ১৯৮৬, পৃ. ৩৫।
- ২০. রাজনারায়ণ বসুর আত্মচরিত, চিরায়ত প্রকাশন, কলকাতা, ১৪২০, পৃ. ৬৩। আরও দেখুন- যােগেশচন্দ্র বাগল, মুক্তির সন্ধানে ভারত, বিবেকানন্দ বুক স্টোর সংস্করণ, কলকাতা, ২০১৩, পৃ. ৮২।
- ২১. রাজনারায়ণ বসুর আত্মচরিত, কুন্তলীন প্রেস, কলকাতা, ১৯০৯, পৃ. ২০৮, সুনীল দাস সম্পাদিত, মনােমােহন বসুর অপ্রকাশিত ডায়েরি, সাহিত্যলােক, প্রথম প্রকাশ, কলকাতা, ১৯৮১, পৃ. ১৬৭।
- ২২. বিনয় ঘােষ, বাংলার সামাজিক ইতিহাসের ধারা, পাঠভবন, কলকাতা, ১৯৭০, পৃ. ৩০০।
- ২৩. প্রভাতকুমার মুখােপাধ্যায়, রবীন্দ্র জীবনী ও রবীন্দ্র-সাহিত্য প্রবেশক, খণ্ড-১, দ্বিতীয় সংস্করণ, বিভারতী, কলকাতা, ১৩৫৩, পৃ. ৪৬।
- ২৪. বিপিনচন্দ্র পাল, নবযুগের বাংলা, চিরায়ত প্রকাশন, কলকাতা, ২০১২, পৃ. ১০৩১০৪। আরও দেখুন- প্রভাতকুমার মুখােপাধ্যায়, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৭।
- ২৫. বিপিনবিহারী গুপ্ত, পুরাতন প্রসঙ্গ, কলকাতা, ১৯৬৭, পৃ. ২০৬।
- ২৬. বােধিনী শ্রাবণ ১২৭৭।
- ২৭. অমৃতবাজার পত্রিকা ১৪-০৯-১৮৭০।
- ২৮. অমৃতবাজার পত্রিকা ২৯-০৪-১৮৯৫।
- ২৯. অর্ণব নাগ সম্পাদিত, রাজনারায়ণ প্রবন্ধ সংকলন, ইনস্টিটিউট অফ সােস্যাল অ্যান্ড কালচারাল স্টাডিজ, কলকাতা, ২০১৬, পৃ. ১২।
- ৩০. নিখিল সুর, প্রাগুক্ত, পৃ. ১১১।
- ৩১. যােগেশচন্দ্র বাগল, মুক্তির সন্ধানে ভারত, প্রাগুক্ত, পৃ. ৮৪-৮৫।
- ৩২. যােগেশচন্দ্র বাগল, মুত্তির সন্ধানে ভারত, প্রাগুক্ত, পৃ. ৯০-৯১।
- ৩৩. কমল চৌধুরী সম্পাদিত, বঙ্গভঙ্গ ও সমকালীন বঙ্গসমাজ, দে’জ পাবলিশিং হাউস, কলকাতা, ২০০৫, পৃ. ২৩-২৪।
- ৩৪. বিপিনচন্দ্র পাল, প্রাগুক্ত, পৃ. ১০৪।
- ৩৫. বিনয় ঘােষ, বাংলার সামাজিক ইতিহাসের ধারা, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩০১। একথা অবশ্য স্বীকার্য যে তৎকালের বেশিরভাগ জাতীয়তা ও হিন্দুত্বকে অভিন্ন বলে মনে করতেন। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার মন্তব্য করেছেন, “প্রত্যক্ষ বা পরাে, প্রকাশ্যে বা অপ্রকাশ্যে, হিন্দুধর্ম যে এদেশে জাতীয়তার মূল ভিত্তি, এই ধারণার প্রভাব বরাবরই ছিল এবং এখনও আছে। এই সত্য অপ্রিয় হইলেও অস্বীকার করা কঠিন।” (রমেশচন্দ্র মজুমদার, বাংলাদেশের ইতিহাস, খণ্ড-৩, জেনারেল প্রিন্টার্স অ্যান্ড পাবলিকেশন প্রাইভেট লিমিটেড, দ্বিতীয় সংস্করণ, কলকাতা, ১৩৮১, পৃ. ৫৩২)। শ্রী মজুমদার এও বলেছেন যে, “তবে কেবলমাত্র হিন্দু নহে, মুসলমানেরাও যে প্রথম হইতে নিজেদের একটি পৃথক জাতি বলিয়া মনে করিত ওয়াহাবী আন্দোলনই তাহার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। উনিশ শতকের শেষার্ধে যে এই দ্বিজাতিতত্ত্বমূলক রাজনীতি প্রভাবশালী হইয়াছিল তাহার মূলে ছিল উভয় সম্প্রদায়ের সাহিত্য, ঐতিহ্য ও কতক পরিমাণে মুসলমানের রাজনীতিক স্বার্থ।” (রমেশচন্দ্র মজুমদার, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫৩২-৩৩)।
- ৩৬. যােগেশচন্দ্র বাগল, হিন্দুমেলার ইতিবৃত্ত, প্রাগুক্ত, পৃ. ১১২-১১৩।
- ৩৭. রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনস্মৃতি’তে বাল্যকালের কথা প্রসঙ্গে হিন্দুমেলার উল্লেখ করেছেন, “…আমাদের পরিবারের হৃদয়ের মধ্যে একটা স্বদেশাভিমান স্থির দীপ্তিতে জাগিতেছিল। স্বদেশের প্রতি পিতৃদেবের যে একটি আন্তরিক শ্রদ্ধা তাহার জীবনের সকল প্রকার বিবের মধ্যেও অগ্নে ছিল, তাহাই আমাদের পরিবারস্থ সকলের মধ্যে একটি প্রবল স্বদেশপ্রেম সঞ্চার করিয়া রাখিয়াছিল। বস্তুত সে সময়টা স্বদেশপ্রেমের সময় নয়—তখন শিক্ষিত লােকে দেশের ভাষা এবং দেশের ভাব উভয়কেই দূরে ঠেকাইয়া রাখিয়াছিলেন। আমাদের বাড়িতে দাদারা চিরকাল মাতৃভাষার চর্চা করিয়া আসিয়াছেন।… আমাদের বাড়ির সাহায্যে হিন্দু-মেলা বলিয়া একটি মেলা সৃষ্টি হইয়াছিল। …ভারতবর্ষকে স্বদেশ বলিয়া ভক্তির সহিত উপলব্ধির চেষ্টা সেই প্রথম হয়। মেজদাদা সেই সময়ে বিখ্যাত জাতীয় সঙ্গীত ‘মিলে সব ভারত-সন্তান রচনা করিয়াছিলেন। এই মেলায় দেশের স্তবগান গীত, দেশানুরাগের কবিতা পঠিত, দেশী শিল্প, ব্যায়াম প্রভৃতি প্রদর্শিত ও দেশী গুণী লােক পুরস্কৃত হইত।… ছেলেবেলায় রাজনারায়ণ বাবুর সঙ্গে যখন আমাদের পরিচয় ছিল, তখন সকল দিক্ হইতে তাঁহাকে বুঝিবার শক্তি আমাদের ছিল না।…দেশের উন্নতিসাধন করিবার জন্য তিনি সর্বদাই কতােরকম সাধ্য ও অসাধ্য –্যা করিতেন তাহার আর অন্ত নাই। …এদিকে তিনি মাটির মানুষ, কিন্তু তেজে একেবারে পরিপূর্ণ ছিলেন। দেশের প্রতি তাঁহার যে প্রথম অনুরাগ, সে তাহার সেই তেজের জিনিস। দেশের সমস্ত খবৰ্ত দীনতা অপমানকে তিনি দগ্ধ করিয়া ফেলিতে চাহিতেন। তাহার দুই চ, জ্বলিতে থাকিত, তাহার হৃদয় দীপ্ত হইয়া উঠিত, উৎসাহের সঙ্গে হাত নাড়িয়া আমাদের সঙ্গে মিলিয়া তিনি (গান) ধরিতেন… এক সূত্রে বাঁধিয়াছি সহস্রটি মন, / এক কার্যে সঁপিয়াছি সহস্র জীবন।”
- ৩৮. বিপিনচন্দ্র পাল, প্রাগুক্ত, পৃ. ১০৪।
- ৩৯. আধুনিক ভারত’, আৰ্য্যদর্শন মাঘ ১২৮৩।
- ৪০. ১৮৭০ সালে হিন্দু মেলার চতুর্থ বছরের অনুষ্ঠানের পর হতেই ‘ন্যাশনাল সােসাইটি’ বা জাতীয় সভার কাজ শুরু হয়। জাতীয় সভা প্রকৃতপথে হিন্দু মেলারই একটি অঙ্গ। যােগেশচন্দ্র বাগল লিখেছেন, “জাতীয় সভা। হিন্দু মেলার স্বাক্ষরকারীগণ। কর্তৃক এই সভা প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে। হিন্দু জাতির সর্বশ্রেণির মধ্যে জাতীয় ভাবের বর্ধন এবং তাঁহাদের স্বাবলম্বিত যত্ন দ্বারা বিবিধ উন্নতি সাধন করাই এই সভার মূল উদ্দেশ্য। অন্যূন এক মুদ্রা বার্ষিক দান করিলেই হিন্দু নামধারী মাত্রেই এই সভার সভ্য পদের অধিকারী হইবেন।” (দেখুন- যােগেশচন্দ্র বাগল, হিন্দু মেলার ইতিবৃত্ত, প্রাগুক্ত, পৃ. ৮৩-৮৫)।
- ৪১. রমেশচন্দ্র মজুমদার, বাংলাদেশের ইতিহাস, খণ্ড-৩, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫৩২।
- ৪২. রমেশচন্দ্র মজুমদার, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫৩২।
- ৪৩. উদ্ধৃত- বি বি মজুমদার, হিস্টরি অফ পলিটিক্যাল থট ফ্রম রামমােহন টু দয়ানন্দ (১৯২১-৮৪), কলকাতা ইউনিভার্সিটি, কলকাতা, ১৯৩৪, পৃ. ২৯৩-৯৪।
- ৪৪. স্বামী কৃষানন্দ, পরিব্রাজকের বক্তৃতা, কলকাতা, ১৯৫৭, পৃ. ১৭।
- ৪৫. স্বামী কৃষ্ণনিন্দ, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৮। ৪৬. স্বামী কৃষানন্দ, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩১।
- ৪৭. পণ্ডিত শশধর তর্কচূড়ামণি, ধর্মব্যাখ্যা, খণ্ড-১, কলকাতা, ১৮০৬ শক, পৃ. ৪। মন্মথকুমার বসু রচিত ও বীরেন্দ্রকুমার বসু সম্পাদিত, স্মৃতিকথা, কলকাতা, ১৩৫৫, পৃ. ১৭০।
- ৪৯. অমিতাভ মুখােপাধ্যায়, উনিশ শতকের সমাজ ও সংস্কৃতি, কলকাতা, ১৯৮৯, পৃ. ১১৮।
- ৫০. ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, সংবাদপত্রে সেকালের কথা, খণ্ড-১ (১৮১৮-১৮৩০), বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ, কলকাতা, ১৯৪৫, পৃ. ৯৬।
- ৫১. গোঁড়া হিন্দুবাদী আন্দোলনের ধারক, বাহক ও প্রচারক এই পত্রিকাগুলি হল—সমাচার চন্দ্রিকা, সংবাদ তিমিরনাশক (১৮২৩), সংবাদ রত্নাকর (১৮৩১), সংবাদ রত্নাবলী (১৮৩২), নিত্যধর্মানুরঞ্জিকা (১৮৪৬), মহানবমী (১৮৪৭), হিন্দুধর্ম চন্দ্রোদয় (১৮৪৭), হিন্দুবন্ধু (১৮৪৭), ধর্মমর্ম প্রকাশিকা (১৮৫০), ধর্মরাজ (১৮৫৩) ইত্যাদি। আর ডিরােজিওর শিষ্যদের তৃতীয় মুখপত্রের নাম ‘হিন্দু পাইওনিয়ার।
- ৫২. দ্রষ্টব্য-কন্ট্রিবিউশন টু ইন্ডিয়ান সােসিওলজি (এন.এস), খণ্ড-২, সেজ পাবলিকেশন, নয়াদিল্লি, ১৯৯৮, পৃ. ৩২।
- ৫৩. নীরদচন্দ্র চৌধুরী, অ্যান অটোবায়ােগ্রাফি অফ অ্যান আননােন ইন্ডিয়ান, জয়কো পাবলিশিং হাউস, বম্বে, ১৯৭৬, পৃ. ১৯৬।
- ৫৪. নীরদচন্দ্র চৌধুরী, প্রাগুক্ত, পৃ. ২২৯-৩১।
‘নবজাগরণ’ অ্যান্ড্রোয়েড অ্যাপ্লিকেশনটি প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর টেলিগ্রাম চ্যানেলে জয়েন হতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর ফেসবুক পেজে লাইক করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।