• মূলপাতা
  • ইতিহাস
    • ইসলামিক ইতিহাস
    • ভারতবর্ষের ইতিহাস
    • বিশ্ব ইতিহাস
  • বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
  • ধর্ম
    • ইসলাম
    • খ্রিস্টান
    • হিন্দু
    • ইহুদী
    • অন্যান্য ধর্ম
  • নাস্তিকতা
  • রাজনীতি
  • সিনেমা
  • সাহিত্য
    • কবিতা
    • ছোটগল্প
    • উপন্যাস
    • সাহিত্য আলোচনা
  • অন্যান্য
  • ই-ম্যাগাজিন
    • নবজাগরণ (ষাণ্মাসিক) – জীবনানন্দ ১২৫ তম জন্ম সংখ্যা – মননশীল সাহিত্য পত্রিকা
  • Others Language
    • English
    • Urdu
    • Hindi
Saturday, June 21, 2025
নবজাগরণ
  • মূলপাতা
  • ইতিহাস
    • ইসলামিক ইতিহাস
    • ভারতবর্ষের ইতিহাস
    • বিশ্ব ইতিহাস
  • বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
  • ধর্ম
    • ইসলাম
    • খ্রিস্টান
    • হিন্দু
    • ইহুদী
    • অন্যান্য ধর্ম
  • নাস্তিকতা
  • রাজনীতি
  • সিনেমা
  • সাহিত্য
    • কবিতা
    • ছোটগল্প
    • উপন্যাস
    • সাহিত্য আলোচনা
  • অন্যান্য
  • ই-ম্যাগাজিন
    • নবজাগরণ (ষাণ্মাসিক) – জীবনানন্দ ১২৫ তম জন্ম সংখ্যা – মননশীল সাহিত্য পত্রিকা
  • Others Language
    • English
    • Urdu
    • Hindi
No Result
View All Result
নবজাগরণ
  • মূলপাতা
  • ইতিহাস
    • ইসলামিক ইতিহাস
    • ভারতবর্ষের ইতিহাস
    • বিশ্ব ইতিহাস
  • বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
  • ধর্ম
    • ইসলাম
    • খ্রিস্টান
    • হিন্দু
    • ইহুদী
    • অন্যান্য ধর্ম
  • নাস্তিকতা
  • রাজনীতি
  • সিনেমা
  • সাহিত্য
    • কবিতা
    • ছোটগল্প
    • উপন্যাস
    • সাহিত্য আলোচনা
  • অন্যান্য
  • ই-ম্যাগাজিন
    • নবজাগরণ (ষাণ্মাসিক) – জীবনানন্দ ১২৫ তম জন্ম সংখ্যা – মননশীল সাহিত্য পত্রিকা
  • Others Language
    • English
    • Urdu
    • Hindi
No Result
View All Result
নবজাগরণ
No Result
View All Result

কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্যে হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতি ও মানবতার স্বরূপ

আমিনুল ইসলাম by আমিনুল ইসলাম
November 5, 2024
in সাহিত্য আলোচনা
0
কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্যে হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতি ও মানবতার স্বরূপ

চিত্রঃ কাজী নজরুল ইসলাম, Image Source: thedailynewnation

Share on FacebookShare on Twitter

অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারের সন্তান কাজী নজরুল। মাত্র নয় বছর বয়সে পিতাকে হারান। অর্থের অভাবে পড়াশুনা ছেড়ে দিয়ে অল্প বয়স থেকে লােটোর গানের দলে নাম লেখান। এই গ্রাম্য গানগুলাের মধ্যে গ্রাম্য জীবনের সমস্যাবলি, হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতি ও দেশাত্মবােধের স্পষ্ট ছোঁয়া ছিল। এখান থেকেই মুসাফিরের এক দীর্ঘ পরিক্রমা, আর বন্ধুর পথেই তিনি সংগ্রহ করেছিলেন ‘চলার পথের আনন্দ গান’, সম্প্রীতির শিক্ষা। ‘মােসলেম ভারত’ পত্রিকায় (শ্রাবণ, ১৩২৬) কাজী নজরুলের প্রথম কবিতা ‘মুক্তি’ প্রকাশিত হয়। ১৯২০ সালে করাচি থেকে কলকাতায় এসে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির অফিসে মুজফফর আহমেদের সাথে কাজী নজরুল বসবাস শুরু করেন। শুরু হয় নতুন পথের যাত্রা।

কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্যে হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতি ও মানবতার স্বরূপ
চিত্রঃ কাজী নজরুল ইসলাম, Image Source: commons.wikimedia.

মুজাফফর আহমদ শুধু কাজী নজরুলের ব্যক্তিগত বন্ধুই ছিলেন না তিনি ছিলেন ভারতবর্ষের জনগণের বন্ধু এবং ভারতবর্ষে কমিউনিস্ট আন্দোলনের পথিকৃৎ ও বিখ্যাত শ্রমিকনেতা। দীর্ঘকাল তাঁর নিবিড় সংস্পর্শে থেকে ও তার বৈপ্লবিক আদর্শেই কাজী নজরুল নিজস্ব অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে বহুগুণে শাণিয়ে নিতে সক্ষম হন এবং হতদরিদ্র শ্রমজীবী মানুষের সঙ্গে পরিচিতি হবার সুযােগ লাভ করেন। আর এই প্রেক্ষিতেই কাজী নজরুল ‘মানবধর্ম’-র স্বরূপকে পূর্ণরূপে উপলব্ধি করেন। সুতরাং মুজফফর আহমদের রাজনৈতিক আদর্শ কাজী নজরুলের মনােজগতে ছায়া ফেলেছি। আর কাজী নজরুলের জীবনে এর প্রভাব ছিল সূদূরপ্রসারী।

কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্যে হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতি ও মানবতার স্বরূপ
চিত্রঃ মুজাফফর আহমদ, Image Source: commons.wikimedia.

কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থে ‘অগ্নিবীণা’তেই প্রমাণ করলেন, তিনি মুসলমানের নন, তিনি হিন্দুর নন—তিনি সকল মানুষের, সকল ধর্মের। বঙ্কিমচন্দ্র যে হিন্দু জাতীয়তাবাদের জন্ম দিয়েছিলেন, কাজী নজরুল ইসলাম তা দুমড়ে মুচড়ে ভারতীয় জাতীয়তাবাদে রূপান্তর করেন। ঔপনিবেশিক শাসন-পূর্ব ভারতবর্ষে যে সেকুলার পরিবেশের জন্ম হয়েছিল, মুসলমান শাসনের ফলশ্রুতিতে যে সহাবস্থানের দৃষ্টান্ত গড়ে উঠেছিল, কাজী নজরুল তার পুনর্জাগরণ ঘটাতে চেষ্টা করলেন। গােপাল হালদার বলেছেন, ‘বঙ্কিমের সাহিত্য সৃষ্টির ফল এই, শতকরা ৫৪ জন বাঙালি-মুসলমান তাতে ক্ষুব্ধ, তাই বঙ্কিমচন্দ্র বাঙালি জাতীয়তাবাদের সর্বস্বীকৃত স্রষ্টা নন।১ যেমন স্রষ্টা কাজী নজরুল। কাজী নজরুল তার কবিতাতে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে দু’ভাবে লড়াই করে এসেছেন—

এক, কবিতার আঙ্গিক এবং বিষয় নির্বাচনে তিনি সঙ্কীর্ণ গােষ্ঠীগত চিন্তা পরিহার করেছেন।

দুই, সরাসরি সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে কবিতা লিখেছেন।

আমরা যদি শুধুমাত্র ‘অগ্নিবীণা’ কাব্যটিই বিশ্লেষণ করি তাহলে দেখব এই গ্রন্থটি উৎসর্গ করা হয়েছে বারীন্দ্রকুমার ঘােষকে। বারীন্দ্রকুমার হিন্দু কি মুসলমান—এটা কাজী নজরুলের দ্রষ্টব্য ছিল না। কাজী নজরুল একজন বীরকে এই গ্রন্থটি উৎসর্গ করেছিলেন। যিনি যে কোন উপায়েই হােক স্বদেশের স্বাধীনতার জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন। সুতরাং কাজী নজরুলের এই উৎসর্গের মধ্যে তার মানস প্রতিফলন ঘটেছে। তাছাড়া এই কাব্যে হিন্দু-মুসলমান ঐতিহ্য এমন একাকার হয়ে মিশে গেছে যে, কাউকে পৃথক করবার কোনাে উপায় নেই।

কাজী নজরুল সাম্প্রদায়িকতা কাকে বলে বুঝতেন না। যে বালগঙ্গাধর তিলক ‘গণপতি’ এবং ‘শিবাজী’ উৎসবের মত উৎসবের প্রচলন করেছিলেন, মুসলমান শাসক আওরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে কুৎসা এবং শিবাজীর বীরত্ব প্রমাণই যার একমাত্র লক্ষ্য ছিল, সেই তিলকের মৃত্যুতেও কাজী নজরুল ইসলাম অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা জানিয়ে সম্পাদকীয় লিখেছেন। কাজী নজরুলের কাছে এটাই বড় যে, তিলক স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন। কাজী নজরুল বলেছেন, “আমাদের জননী জন্মভূমির বীরবাহু, বড় স্নেহের সন্তান—তিলক আর নাই।

কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্যে হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতি ও মানবতার স্বরূপ
চিত্রঃ বালগঙ্গাধর তিলক, Image Source: english.press24

আজীবন কাজী নজরুলকে লড়তে হয়েছে একদিকে মুসলমান সাম্প্রদায়িক ধর্মান্ধ শক্তিগুলির বিরুদ্ধে অপরদিকে হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা, অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে। এই আক্রমণে কাজী নজরুলের হৃদয় ক্ষতবিক্ষত হলেও তিনি ছিলেন সেই ক্লান্তিহীন ‘চির মহাবিদ্রোহী’। প্রকৃতপথে কাজী নজরুলের জীবন পরিক্রমা আজও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের দিশারি। আর এ কারণেই সমন্বয়ের প্ররে রেজাউল করিম মত প্রকাশ করেন—“ভারতের হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে একটা কমন কালচার সৃষ্টি করিবার প্রয়াস বরাবরই হইয়া আসিয়াছে। প্রথমে ভাষার মাধ্যমে এই চেষ্টা হইয়াছিল। আজ যেমন রবীন্দ্রনাথ ও কাজী নজরুল সকলের শ্রদ্ধা অর্জন করিয়াছেন, মধ্যযুগেও সেইরূপ হিন্দু-মুসলমান লেখক ও কবিগণ সর্বত্র সমানভাবে আদৃত ও সম্মানিত হইতেন।”২

(১)

কাজী কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর সাহিত্য জীবনে যে অসামান্য কাজগুলি করেছেন সেগুলির অন্যতম হল হিন্দু-মুসলমানের সমন্বয় ঘটানাে। অধ্যক্ষ ইব্রাহিম খাঁকে লেখা একটি চিঠিতে কাজী নজরুল স্পষ্ট ভাষায় বলেছিলেন, “আপনারা বিধাস করুন, আমি নেতা হতে আসিনি, আমি এসেছিলাম হিন্দু মুসলমানের সাথে শেক হ্যান্ড করিয়ে দেওয়ার জন্য।”৩

কাজী নজরুলের লেখায় ও আচরণে যে অসাম্প্রদায়িক মনােভাবের পরিচয় পাওয়া যায় তার সমসাময়িক কালে তা দুর্লভ ছিল। তিনি কোন ধর্মের গোঁড়ামিকেই প্রশ্রয় দেননি। তিনি নিজে ইসলাম ধর্মের মানুষ হয়েও ইসলাম ধর্মের গোঁড়ামির বিরুদ্ধে তীব্র ভাষায় আক্রমণ করেছেন। তিনি ধর্ম ও যুক্তির মধ্যে সমন্বয় সাধন করে ধর্মকে সাম্প্রদায়িকতার সংকীর্ণতা থেকে মুক্ত করে উদার পটভূমিকায় আনতে চেয়েছিলেন। তিনি সমন্বয়বাদের এক সুবৃহৎ ছত্রছায়ায় সব সম্প্রদায়ের মানুষকে একত্রিত করার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি জানতেন “হিন্দু-মুসলমানের পরস্পরের অশ্রদ্ধা দূর করতে না পারলে যে এ পােড়া দেশের কিছু হবে না, এ আমিও মানি। এবং আমিও জানি যে, একমাত্র সাহিত্যের ভিতর দিয়েই এ অশ্রদ্ধা দূর করতে পারে।” (অধ্যক্ষ ইব্রাহিম খানকে লেখা চিঠি)

সে সময়ে ভারতীয় উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িক বিরােধের মধ্যে থেকেও কাজী নজরুল অবিচল চিত্তে বাংলা সাহিত্যে অসাম্প্রদায়িক মনােবৃত্তির যে ছাপ রেখে গেছেন তা তুলনাহীন। তিনি ধর্মীয় বা ভৌগলিক সীমার মধ্যে আবদ্ধ কোন জাতীয়তাকেই মেনে নিতে পারেননি। তিনি লিখেছিলেন “আমি এই দেশে এই সমাজে জন্মেছি বলেই শুধু এই দেশেরই এই সমাজেরই নই। আমি সকল দেশের সকল মানুষের। সুন্দরের ধ্যান, তার স্তবগানই আমার উপাসনা, আমার ধর্ম। যে কূলে যে সমাজে, যে ধর্মে যে দেশেই জন্মগ্রহণ করি, সে আমার দৈব। আমি তাকে ছাড়িয়ে উঠতে পেরেছি বলেই কবি।

কেউ বলেন, আমার বাণী যবন, কেউ বলেন, কাফের। আমি বলি ও দুটোর কিছুই নয়। আমি মাত্র হিন্দু-মুসলমানকে এক জায়গায় ধরে এনে হ্যান্ডশেক করাবার চেষ্টা করেছি, গালাগালিকে গলাগলিতে পরিণত করার চেষ্টা করেছি। সে হাতে হাত মিলানাে যদি হাতাহাতির চেয়েও অশােভন হয়ে থাকে, তাহলে ওরা আপনি আলাদা হয়ে যাবে। আমার গাঁট ছড়ার বাঁধন কাটতে তাদের কোনাে বেগ পেতে হবে না। কেননা, একজনের হাতে আছে লাঠি, আর একজনের আস্তিনে আছে ছুরি।৪

কাজী নজরুলের লেখনী স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল ১৯৪২ সালে। তাই তাঁর রচনায় হিন্দু-মুসলমান বিরােধ ও হানাহানির যা কিছু ঘটনার তিনি প্রতিবাদ করেছিলেন সে সবই ১৯৪২-এর আগের ঘটনা, যখন দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্পর্ক ততটা তিক্ত ছিল না, যা কিনা পরবর্তীকালে কলকাতায়, পাঞ্জাবে, খুলনায় ও নােয়াখালিতে ঘটেছিল। তবুও হানাহানির তীব্রতা যত কমই হােক না কেন দুই যুযুধান সম্প্রদায়কে দেখে কাজী নজরুলের বিবেক রক্তাক্তি হয়েছে।

ধর্মের প্রাচীরই যে হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে বিভেদের ব্যবধান গড়ে তুলছে, এটা কাজী নজরুল গভীরভাবে উপলব্ধি করেছিলেন। তাই ধর্মের মূল লক্ষ্য কী হওয়া উচিত সে কথা তিনি বারবার ব্যাখ্যা করেছেন। এখানে একটা কথা আমাদের স্মরণে রাখা প্রয়ােজন, কাজী নজরুলের স্কুল কলেজের আনুষ্ঠানিক শিক্ষা বিশেষ কিছু ছিল না, সে সুযােগ তিনি পাননি, জীবনের বিবিদ্যালয়েই তার যা কিছু পাঠ। তাই নিজস্ব উপলব্ধিতে তিনি তার অন্তরের বিশ্বাসটিকেই লেখনীর মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন। তিনি লেখেন “মানুষ-ধর্মই সবচেয়ে বড়াে ধর্ম। হিন্দু-মুসলমানের মিলনের অন্তরায় বা ফাঁকি কোনখানে তা দেখিয়ে দিয়ে এর গলদ দূর করা এর অন্যতম উদ্দেশ্য। মানুষে মানুষে সেখানে প্রাণের মিল, আদত সত্যের মিল, যার নিজের ধর্মে বিধাস আছে, যে নিজের ধর্মের সত্যকে চিনেছে, সে কখনও অন্য ধর্মকে ঘৃণা করতে পারে না।”৫

কাজী নজরুলের যুগে প্রবল পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় নারীরা ছিল একান্তভাবে অবহেলিতা ও প্রায় ভাষাহীন এক জড়বস্তুর মতােই পুরুষভােগ্য পণ্য। সেই অবলা নারীকে জাগ্রত করতে ‘বাঁধন হারা’ উপন্যাসে যে প্রগতিশীল বিদ্রোহিনী নায়িকার জন্ম দিয়েছিলেন তার নাম তার আচরণের মতােই—সাহসিকা। নায়িকা সাহসিকার মুখে কাজী নজরুল ধর্ম সম্পর্কে তার নিজস্ব অনুভাবনার কথা যেভাবে দিয়েছেন তা অনন্য। তাঁর উপন্যাসের নায়িকা বান্ধবীকে পত্রে লিখছে “ধর্ম সম্পর্কে আমার আর একটু বলবার আছে। আমি তাে পূর্বেই বলেছি যে, সব ধর্মেরই ভিত্তি চিরন্তন সত্যের ‘পর—যে সত্য সৃষ্টির আদিতে ছিল, এখনও রয়েছে এবং অনন্তেও থাকবে। এই সত্যটাকে যখন মানি, তখন আমাকে যে ধর্মে ইচ্ছা ফেলতে পারিস। আমি হিন্দু, আমি মুসলমান, আমি খ্রিস্টান, আমি বৌদ্ধ, আমি ব্রাহ্ম। আমি তাে কোনাে ধর্মের বাইরের (সাময়িক সত্যরূপ) খােলসটা ধরে নেই। গোঁড়া ধার্মিকদের ভুল তাে ওইখানেই। ধর্মের আদত সত্যটা না ধরে এঁরা ধরে আছেন যত সব নৈমিত্তিক বিধি-বিধান। এরা নিজের ধর্মের উপর এমনই অন্ধ অনুরক্ত যে, কেউ এতটুকু নাড়াচাড়া করতে গেলেও ফেঁস করে ছােবল মারতে ছােটেন। কিন্তু এটুকু বােঝেন না তারা যে তাদের ‘ইমান’ বা বিশ্বাস, তাদের ধর্ম কত ছােটো কত নীচ কত হীন যে, তা একটা সামান্য লােকের এতটুকু আঁচড়ের ঘা সইতে পারে না। ধর্ম কি কাচের ঠুনকো -স যে, এইটুতেই ভেঙে যাবে? ধর্ম যে ধর্মেরই মতন সহ্যশীল, কিন্তু এ সব বিড়ালতপস্বীদের কান্ড দেখে তাে তা কিছুতেই মনে করতে পারিনে।…এই সব কারণেই, ভাই আমি এইরকম ভন্ড আস্তিকদের চেয়ে নাস্তিকদের বেশি ভক্ত, বেশি পক্ষপাতী।”৬ নারীদের মুখে একটি স্পর্শকাতর বিষয়ে এমন বৈপ্লবিক ভাবনা-চিন্তার মাধ্যমে নারী জাগৃতির যে সংকল্প কাজী নজরুল নিয়েছিলেন তার থেকে আরাে একধাপ এগিয়ে এসেছিলেন ‘পুতুলের বিয়ে’ নাটকে। এখানে কাজী নজরুল শিশু বয়সে সম্প্রীতির বােধ গড়ে তােলার জন্যে ‘কমলি’ নামে এক শিশু চরিত্রের মুখ দিয়ে তার বন্ধুদের বলিয়েছেন বাবা বলেছেন, হিন্দু-মুসলমান সব সমান। অন্য ধর্মের কাউকে ঘৃণা করলে ভগবান অসন্তুষ্ট হন। ওদের আল্লাও যা, আমাদের ভগবানও তা।৭

(২)

সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ও ঝগড়া আমাদের জাতীয় উদ্দেশ্য সাধনে যে অন্তরায় হয়ে উঠছে সেটা অসাম্প্রদায়িক কাজী নজরুল তার স্বচ্ছ চিন্তার কারণে যতটা পরিষ্কারভাবে বুঝেছিলেন, তেমন ভাবে যদি অন্যেরাও বুঝতে পারত তাহলে সম্ভবত আমরা অনেক আগেই পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্তি পেতে পারতাম। পাইনি তার কারণ, স্বদেশবাসীরা না বুঝলেও কাজী নজরুলের মতােই ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছিল সুচতুর ইংরেজ শাসকেরা। তারা হিন্দু মুসলমানের বিভেদের আগুনটাকে প্রজ্বলিত রাখতে ইন্ধন জুগিয়ে গিয়েছে। কাজী নজরুল দ্বিধাহীন স্বরে জানিয়েছেন “ভারত যে আজও পরাধীন এবং আজও যে স্বাধীনতার পথে তার যাত্রা শুরু হয়নি—শুধু আয়ােজনের ঘটা হচ্ছে এবং ঘটাও ভাঙছে— তার একমাত্র কারণ আমাদের হিন্দু-মুসলমানের পরস্পরের প্রতি হিংসা ও অশ্রদ্ধা। আমরা মুসলমানেরা আমাদেরই প্রতিবেশী হিন্দুর উন্নতি দেখে হিংসা করি, আর হিন্দুরা আমাদের অবনত দেখে আমাদের অশ্রদ্ধা করে। ইংরেজের শাসন সবচেয়ে বড় ক্ষতি করেছে এই যে, তার শিক্ষাদীক্ষার চমক দিয়ে সে আমাদের এমনই চমকিত করে রেখেছে যে, আমাদের এই দুই জাতি কেউ শিক্ষাদীক্ষা সভ্যতার অতীত মহিমার খবর রাখিনে।

মানুষে-মানুষে অকৃত্রিম মিলনের মধ্যে দিয়ে ভারতবর্ষ মহামানুষের মহা-মিলনভূমি হয়ে উঠুক, এমনটাই চেয়েছিলেন কাজী নজরুল। তার সেই স্বপ্ন যে আজও অধরাই রয়ে গেছে সেকথা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। ভারতে হিন্দু-মুসলমান যতদিন পর্যন্ত না এক মন, এক প্রাণ হয়ে কাজ করতে পারছেন ততদিন এই দেশের পরিপূর্ণ উন্নতির সম্ভাবনা নেই। ভারতবর্ষ হিন্দু-মুসলমানে পারস্পরিক সম্পর্কের অবনতির ক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদের কুশলী ভূমিকার কথা আমরা সকলেই জানি। সাম্রাজ্যবাদী শাসকের মদতপুষ্ট পুরােহিততন্ত্র ও মােল্লাতন্ত্রের হাতে হিন্দু ও মুসলমানের ভবিষ্যৎ সমূহ বিপন্নতার মুখােমুখি হয়েছিল।

অশুভ ব্যাধির প্রকোপ মােটামুটিভাবে বিশ শতকের দ্বিতীয়-তৃতীয় দশক থেকেই প্রবল হয়ে ওঠে। ১৯২৬ খ্রীস্টাব্দের ২ এপ্রিল থেকে কলকাতায় হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে দাঙ্গা-হাঙ্গামার সূত্রপাত হয়। রবীন্দ্রনাথ এই দাঙ্গার ভয়াবহতা দেখে বিচলিত হয়ে উঠেছিলেন। দাঙ্গাকারীরা এতই উন্মত্ত হয়েছিল যে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি আক্রমণে উদ্যত হয়েছিল। অপরাধ, সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর কয়েকটি মুসলমান পরিবারকে ঠাকুর বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছিলেন। এই পরিস্থিতি দেখে কাজী কাজী নজরুল অত্যন্ত ব্যথিত হন। এই পরিস্থিতিতে কৃষ্ণনগরে এক রাজনৈতিক সম্মেলনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। উদ্যোক্তা ছিল কংগ্রেস এবং কৃষক-মজুর পার্টি। সম্মেলনের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছিল ছাত্র ও যুবদের। উদ্দেশ্য ছিল সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ কলুষিত পরিস্থিতির বিরুদ্ধে ছাত্র-যুব সমাজকে সংগঠিত করা। কাজী নজরুল ছিলেন এই সম্মেলনের অন্যতম সংগঠক এবং স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর অধিনায়ক। কাজী নজরুল এই সম্মেলনের উদ্বোধনী সঙ্গীত হিসেবেই গাওয়া ‘কাণ্ডারী হুশিয়ার’ গানটিতে জাতীয় আন্দোলনে হিন্দু-মুসলমান কলহের বিপক্ষে ঘােষণা করেন—

“অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া জানে না সন্তরণ

কাণ্ডারী! আজ দেখিব তােমার মাতৃমুক্তি পণ!

‘হিন্দু না ওরা মুসলিম! ওই জিজ্ঞাসে কোন জন!

কাণ্ডারী! বলাে, ডুবিছে মানুষ সন্তান মাের মা’র!”

কবি যথেষ্ট সচেতনভাবেই জানেন যে, পরস্পর হানাহানির মধ্যে নিজের শক্তি ও সাম্রাজ্যকামী শাসকের সুবিধা হয়। সুতরাং হিন্দু-মুসলমানের ঐক্য বজায় রাখা দরকার। জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে যিনি নেতৃত্বে আছেন তার মনে কোনও বিদ্বেষ পােষণ করা চলবে না। তাকে বুঝতে হবে যে, দেশবাসী সকলেই মায়ের সন্তান, স্বাধীনতা আন্দোলনে সকলের সমান মর্যাদা।

মুক্তি সংগ্রামের সেই বিব্ধ তরঙ্গময় দিনেও কাজী নজরুলের কবি-প্রতিভার বিশালতা সাম্প্রদায়িক ইতিহাস-ঐতিহ্য রীতি-নীতির দেওয়াল ভেঙ্গে হিন্দু ও মুসলিম—দু’টি পরস্পরবিরােধী ধারাকে পাশাপাশি বয়ে নিয়ে চলেছিল। যে রাজনৈতিক, ধর্মীয়, অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রোপটে কাজী নজরুলের আবির্ভাব ঘটেছে, সেক্ষেত্রে অসাম্প্রদায়িক চেতনাসমৃদ্ধ সাহিত্য রচনা করা ছিল অকল্পনীয় ব্যাপার। ধর্মীয় পুনর্জাগরণের দিনগুলােতে উভয় সম্প্রদায়ভুক্ত সমসাময়িক সাহিত্যিকগণ কেবল নিজ নিজ ধর্মীয় ঐতিহ্য উপস্থাপন, ধর্মীয় মাহাত্ম্য বর্ণনা ও নিজস্ব আধিপত্য বিস্তারের প্রচেষ্টায় সচেষ্ট ছিলেন। কিন্তু সেই পরিবেশেই কাজী নজরুল স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে ও বিস্ময়কর নৈপুণ্যে গেয়ে উঠলেন অসাম্প্রদায়িকতা ও সম্মিলনের গান, যা হয়ে উঠেছিল পরাধীনতার বিরুদ্ধে সম্মিলিত আন্দোলন সৃষ্টির হাতিয়ার। যুগবিচারে তার এ ভূমিকা নিঃসন্দেহে বিস্ময়কর, দুঃসাহসী এবং একই সঙ্গে অভূতপূর্বও বটে।

(৩)

কাজী নজরুলের সাহিত্য ক্ষেত্রে প্রবেশের পূর্বে হিন্দু-মুসলিমের মধ্যে সাহিত্যিক বিরােধে যেমন কালি কাগজ খরচ হয়েছে তেমনি মসজিদ-মন্দির নিয়ে দাঙ্গা-হাঙ্গামায় রক্ত খরচও কম হয়নি। রাজনীতির ৰেত্রে বার বার ঐক্য-সম্মেলন করেও দু’টি সম্প্রদায়ের মধ্যে বিদ্বেষ বিরােধ থামানাে যায়নি। রাজনীতি, সাহিত্য, সংস্কৃতির ক্ষেত্রে দু’টি বিরােধী শিবির সারা দেশ জুড়ে গড়ে উঠেছিল। এই বিদ্বেষের অন্ধকারে অনেক মহাপুরুষই পথভ্রষ্ট হয়েছেন। কাজী নজরুল আশ্চর্যভাবে এই পঙ্কিল পরিবেশের বাইরে থাকলেন। কোনাে পক্ষ গ্রহণ করলেন না। সেদিনের সেই হিংসার উন্মুক্ত পরিবেশে এটা যে কতাে শক্ত ব্যাপার ছিল আজ তা বােঝানাে যাবে না।

খেলাফত অসহযােগের স্মরণীয় হিন্দু-মুসলিম মৈত্রী মাত্র দু-তিন বছরের মধ্যেই ধুলিস্মাৎ হয়েছে। ১৯২৬ সালকে সুভাষচন্দ্র বসু ভারতের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বছর বলে উল্লেখ করেছেন। এই সময় রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন ‘ধর্মমােহ’ নামে কবিতা। কাজী নজরুল লিখেছেন ‘হিন্দু-মুসলিম যুদ্ধ’, ‘সব্যসাচী’ প্রভৃতি সংগ্রামী কবিতা। সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে কাজী নজরুল সচেতনভাবেই সংগ্রাম করেছেন।

কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্যে হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতি ও মানবতার স্বরূপ
চিত্রঃ সুভাষচন্দ্র বসু, Image Source: wikisource

লক্ষণীয় বাংলা কাব্যে হিন্দুরা মুসলিম ঐতিহ্যকে আপন করতে পারেনি এবং মুসলমানেরাও হিন্দু ঐতিহ্য গ্রহণ করতে পারেনি। এই দুই বিরােধী সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের হৃদয়গ্রাহী সমন্বয় বাংলা সাহিত্যে কাজী নজরুলের অমর কীর্তি, এই প্রয়াস তিনি সচেতনভাবেই করেছেন। কাজী নজরুলের অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ চেতনা ও চিন্তার অসংখ্য নজির তার সাহিত্যে ছড়িয়ে রয়েছে। এমনি একটি নজির একটি মৃত্যু সংবাদের সঙ্গে জড়িত। সাংবাদিক মতিলাল ঘােষের মৃত্যু সংবাদ পরিবেশনের সঙ্গে সঙ্গে তিনি বলেছেন, ইন্নালিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজেউন। উল্লেখ্য, মুসলমানগণ এই দোয়া অমুসলমানদের মৃত্যুতে উচ্চারণ করেন না। ঐ সংবাদটি আবদুল আজিজ আল-আমান ‘ধূমকেতু কাজী নজরুল’ বইয়ে উদ্ধৃত করেছেন—ঐ দোয়াটি বাদ দিয়ে।৮ সংবাদটি ‘ধূমকেতু’ ১ম বর্ষ ৮ম সংখ্যায় ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের ১২ সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত হয়। শিরােনাম মর্তের মতিলাল স্বর্গে।

ধর্মের কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস, হৃদয়হীন রীতি ও শাসনের প্রতিই তার অবিশ্বাস ছিল। তিনি সকল ধর্মের শাশ্বত ও কল্যাণকর আদর্শগুলাে উপস্থাপিত করতে চেয়েছেন। এতে তার নিজস্ব ধর্মমত, অন্য কোনাে ধর্মমত ব্যবহারের ক্ষেত্রে ব্যাঘাত সৃষ্টি করেনি। বর্তমানকে পুনর্নির্মাণে কাজী নজরুল মুসলিম ইতিহাস ঐতিহ্যকে স্মরণ করেছেন। কিন্তু তাই বলে তিনি অন্য সম্প্রদায়ের কথা বিস্মৃত। হননি। পারস্পরিক সম্ভবানপূর্ণ সহাবস্থানের কথা তিনি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করেছেন। তাই ইসলাম ধর্মের শাশ্বত আদর্শকে তিনি কাব্যের বিষয় করলেও, অন্য ধর্মের আদর্শকে সাম্প্রদায়িক চিন্তায় কখনােই আক্রমণ করেননি। বরং অন্যান্য ধর্মের কল্যাণমুখী আদর্শের প্রতিও তার আস্থা ছিল।

তিনি জাগাতে চেয়েছেন মুসলমানকে, ডাক দিয়েছেন হিন্দুকে। সুতরাং শুধু হিন্দু কিংবা শুধু মুসলিম সমাজে নয়, সমগ্র সমাজজীবনে পরিবর্তনের হাওয়া আনতেই আজীবন তার প্রচেষ্টা সক্রিয় থেকেছে। এটা স্পষ্ট যে, কাজী নজরুল মানস-ধর্মকে কখনােই অস্বীকার করার পক্ষপাতী ছিলেন না। কিন্তু তাই বলে ধর্মের বাহ্যিক আড়ম্বরেও তিনি কখনাে আস্থা স্থাপন করেননি। বরং তার দৃষ্টিতে ধর্ম হল নিয়ম-নীতির সােপান বেয়ে আত্মশুদ্ধির আলােকিত জগতে উত্তরণের উপায়, যা মানুষকে মানুষের কল্যাণে জীবন উৎসর্গ করতে উদ্বুদ্ধ করে ও মানুষকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে নতুন কিছু সৃষ্টি করার প্রেরণায় উজ্জীবিত করে। অর্থাৎ তার আগ্রহ ছিল ধর্মের অন্তরগত সৌন্দর্য ও বােধ সম্বন্ধে জ্ঞান অর্জন করার প্রতি, যে বােধের মাধ্যমে মানুষ আচার-সর্বস্ব ধর্মের নাগপাশ থেকে মুক্ত হয়ে পরিপূর্ণ জীবনের সন্ধান পেতে পারে। তাই কবি ধর্ম রক্ষার নামে বিশৃঙ্খলা ও সংঘাত সৃষ্টির ঘাের বিরােধী ছিলেন। নিজস্ব সম্প্রদায়ের পরিচয়ের পরিপ্রেক্ষিতে ইহলৌকিক ক্ষমতা বৃদ্ধির প্রচেষ্টায় অযাচিত রক্তপাত তাঁর দৃষ্টিতে ক্ষমাহীন অন্যায় বলে বিবেচিত হয়েছে। ধর্ম ও সমাজজীবনে এই নিকর কর্মকাণ্ডের প্রতি তার অবজ্ঞা ও আন্তরিক ঘৃণার পরিচয় সুস্পষ্ট,

“মনু ঋষি অণুসমান বিপুল বিৰ্থে সে বিধির,

বুঝলি না সেই বিধির বিধি, মনুর পায়েই নােয়াস শির।

ওরে মূখ ওরে জড়, শাস্ত্র চেয়ে সত্য বড়,

(তােরা) চিনলি নে তা চিনির বলদ, সার হল তাই শাস্ত্র বওয়া।”

কিংবা

“জাতের চেয়ে মানুষ সত্য অধিক সত্য প্রাণের টান,

প্রাণ-ঘরে সব এক সমান।”

কাজী নজরুল একথা গভীর আস্থার সঙ্গে জানিয়েছিলেন যে, বাঙালি মুসলমানের জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে না পারলে দেশের কল্যাণের পথ ব্যাহত হবে। মুসলমান সম্প্রদায়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেকাংশে হিন্দু সম্প্রদায়েরও আত্মজাগরণ হয়নি বলেই ভারতের স্বাধীনতার পথ অবরুদ্ধ। হিন্দু ও মুসলমান যদি পরস্পরের প্রতি অশ্রদ্ধার মনােভাব বর্জন করতে না পারে তা হলে ভারতের উন্নতি এবং স্বাধীনতা লাভের প্রচেষ্টা সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়ে যাবে। কবি লেখেন –

“মুক্তির লাগি মিলনের লাগি আহুতি যাহারা দিয়েছে প্রাণ,

হিন্দু-মুসলিম চলেছি আমরা গাহিয়া তাদের বিজয় গান।”

(৪)

কাজী নজরুল তাঁর সাহিত্যচর্চায় দুটি সম্প্রদায়কেই আহ্বান করেছেন বারবার। দুটি সম্প্রদায়ের মিলিত শক্তিতেই গড়ে তুলতে চেয়েছেন রুশ-বিপ্লব প্রভাবিত সাম্যবাদী বাংলা। সেই কারণে তিনি তৎকালীন প্রতিবাদী রাজনৈতিক ধারা বঙ্গীয় কৃষক-প্রজা পার্টির সঙ্গে যেমন যুক্ত ছিলেন, তেমনি কংগ্রেসি অধিনীকুমার দত্ত-র অনুরাগী হয়ে উঠেছিলেন। ফজলুল হকের প্রতিও তাঁর সখ্যতা ছিল। কেননা এরা সকলেই তৎকালীন রাজনীতিতে হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের প্রতিভূ হয়ে উঠেছিলেন। আর ছিলেন চিত্তরঞ্জন দাশ। হিন্দু-মুসলমানের মিলন প্রয়াসে পরাধীন ভারতে তার ভূমিকা অবিস্মরণীয়। সেই ভূমিকাকে স্মরণ করেই কাজী নজরুল ইসলাম চিত্তরঞ্জনের যথার্থ মূল্যায়ন প্রসঙ্গে উচ্চারণ করেছেন—

“তােমারে দেখিয়া কাহারাে হৃদয়ে জাগেনিক সন্দেহ

হিন্দু কিংবা মুসলিম তুমি অথবা অন্য কেহ।”

হিন্দুর ছিলে আকবর তুমি মুসলিমের আরংজীব,

যেখানে দেখেছ জীবনের বেদনা, সেখানে দেখেছ শিব।”

কিংবা

“হিন্দু মুসলমানের পরাণে তুমিই বাঁধিলে সেতু।

জানি না আজিকে কি অর্ঘ্য দেবে হিন্দু-মুসলমান

ঈর্ষা পঙ্কে পঙ্কজ হয়ে ফুটুক এদের প্রাণ।”

দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের আকস্মিক মৃত্যু সংবাদে অনেকের মতাে কাজী নজরুল শােকে মুহ্যমান হয়ে পড়েন। কবি তার শােক ব্যক্ত করেন কাব্যের ভাব ব্যঞ্জনায়। কোনও ধর্মীয় রক্ষণশীল রক্তচক্ষু পারে না ভাবপ্রকাশকে স্তব্ধ করতে। পাঠকদের পর্যালােচনার জন্য বিতর্কিত সূত্রগুলি এখানে উল্লেখ্য—

“পয়গম্বর অবতার যুগে জন্মিনি মােরা কেহ,

দেখিনিক মােরা তাদের দেখিনি দেবের জ্যোতিদেহ

কিন্তু যখনি বসিতে পেয়েছি তােমার চরণ তলে।

না জানিতে কিছু না বুঝিতে কিছুনয়ন ঝরেছে জলে।…

ইবরাহিমের মতাে বাচ্চার গালে খঞ্জর দিয়া

কোরবানি দিলে সত্যের নামে, হে মানব নবী হিয়া

ফেরেশতা সাব করিছে সালাম, দেবতা নােয়ায় মাথা

ভগবান বুকে মানবের তরে শ্রেষ্ঠ আসন পাতা।” (ইন্দ্রপতন’)

‘চিত্তনামা’তে তিনটি কবিতা রয়েছে হিন্দু-মুসলমান মিলনের এবং অখন্ড বাংলার প্রতীক চিত্তরঞ্জন দাশের স্মরণে।

কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্যে হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতি ও মানবতার স্বরূপ
চিত্রঃ চিত্তরঞ্জন দাস, Image Source: commons.wikimedia.

সমাজ-জীবনে সাম্য-স্বাধীনতা-উদারতা প্রতিষ্ঠাই ছিল কাজী নজরুলের জীবনের ধ্রুব। ধ্যানমগ্ন কাজী নজরুল মানসেও এ বিষয়ে পূর্ণ সচেতনতা লক্ষণীয়। কাজী নজরুল জানতেন এবং বুঝতেন শােষকশ্রেণিই সচেতনভাবে মানুষের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প ছড়িয়ে দেয়। শােষকের ভিত যাতে সম্মিলিত জনগােষ্ঠীর আঘাতে ভেঙে না যায় তাই তারা সর্বদাই বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদ জিইয়ে রাখে—ধর্মকে শােষণের মৌল শক্তিতে পরিণত করে। এই শােষকশ্রেণির বিরুদ্ধে, এই ভন্ড ধার্মিকদের বিরুদ্ধে, এই নব্য স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে ছিল কাজী নজরুলের আমৃত্যু সংগ্রাম। ১৯৪১ সালে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির রজতজয়ন্তী উৎসবে কবি তাঁর জীবনের লথের কথা ঘােষণা করলেন “হিন্দু-মুসলমানে দিনরাত হানাহানি, জাতিতে জাতিতে বিদ্বেষ, যুদ্ধবিগ্রহ, মানুষের জীবনে একদিকে কঠোর দারিদ্র, ঋণ, অভাব-অন্যদিকে লােভী অসুরের যত্নের ব্যাংকে কোটি কোটি টাকা পাষাণ-স্তুপের মত জমা হয়ে আছে। এই অসাম্য, এই ভেদজ্ঞান দূর করতেই আমি এসেছিলাম। আমার কাব্যে, সঙ্গীতে, কর্মজীবনে, অভেদ-সুন্দর সাম্যকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলাম।”৯

অথচ কাজী নজরুল কে আমরা ব্যবহার করেছি যে যার মতাে করে, নিজের স্বার্থে। কখনও বিদ্রোহী, কখনও ভাবুক প্রেমিক কবি, কখনও গায়ক গীতিকার, কখনও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সেনাপতি, কখনও ধার্মিক, কখনও নাস্তিক-ধর্মদ্রোহীকাফের, কখনও জাতীয়তাবাদী, কখনও আন্তর্জাতিকতাবাদী, যখন যেরকম প্রয়ােজনে লেগেছে ব্যবহার করেছে ব্যক্তি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠান তার স্বার্থে। স্বার্থে আঘাত লাগে এমন লেখা ইংরেজ শাসক থেকে কেউই চাননি। চন্দ্র বিন্দু কাব্যের ‘প্যাক্ট’ কবিতাটি এ প্রসঙ্গে উল্লেখযােগ্য। ভিনদেশী সরকারের কূটকৌশলের কাছে কোন মিলনই সম্ভব নয়। সমস্ত ভালর পেছনেও একটি সুবিধাবাদী সিদ্ধান্ত বিরাজমান। ঔপনিবেশিক সরকারের সঙ্গে যতদিন আপসরফা চলবে ততদিন হিন্দু-মুসলমান ঐক্য কোন ফল বয়ে আনবে না। কাজী নজরুল নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা এবং তৎকালীন ঔপনিবেশিক সমাজের বাস্তবতা দিয়ে এই সত্য আবিষ্কার করেছিলেন। অসৎ রাজনীতিকে ঘৃণার চোখে দেখতেন বলেই তাে লিখতে পারেন—

“বদনা গাড়ুতে করে ঠেলাঠেলি

নব প্যাকটের আশ নাই

মুসলমানের হাতে ছড়ি নাই।

হিন্দুর হাতে বাঁশ নাই।” (প্যাক্ট)

তিনি ঐ কবিতায় আরও লিখলেন,

“বদনা-গাডুতে পুন ঠোকাঠুকি,

রােল উঠিল ‘হা হন্ত!

উর্ধ্বে থাকিয়া সঙ্গী-মাতুল

হাসে ছিরকুটি দন্ত!

মসজিদ পানে ছুটিলেন মিত্রা,

মন্দির পানে হিন্দু

আকাশে উঠিল চির-জিজ্ঞাসা,

করুণ চন্দ্র বিন্দু!”

‘ফণীমনসা’র অন্তর্ভুক্ত ‘পথের দিশা’ ও ‘হিন্দু-মুসলিম যুদ্ধ’ কবিতা দু’টিতে তিনি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার আত্মঘাতী রূপকে ফুটিয়ে তুলেছেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি এটাও উপলব্ধি করেছিলেন যে, আমাদের জাতীয় আন্দোলনের দুর্বলতার সুযােগে সুচতুর ইংরেজ শাসক হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে দাঙ্গা-হাঙ্গামা সৃষ্টিতে উস্কানি দিয়ে তাদের শাসন ক্ষমতাকে কায়েম রাখতে চাইছে। ‘পথের দিশা’ কবিতায় স্পষ্টতঃই তিনি বলেছেন—

“চারিদিকে এই গুণ্ডা এবং

বয়েসির আখড়া দিয়ে, রে অগ্রদূত, চলতে কি তুই

পারবি আপন প্রাণ বাঁচিয়ে?”

‘পথের দিশা’ কবিতায় ভন্ডামি আর বদমায়েশির মুখােশও তিনি খুলে দিয়েছেন, পরস্পর আক্রমণকে তিনি নিন্দা করছেন, যারা স্বার্থের জন্যে সুন্দরকে অপমান করে, তাদের জন্যে ‘রুদ্ধ রােষে রুদ্ধ ব্যথায় ফেঁপায় প্রাণে রুব্ধ বাণী। তিনি সংকীর্ণ ধর্মের বেড়াকে বারে বারেই নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছেন।–

“মসজিদ আর মন্দির ঐ শয়তানদের মন্ত্রনাগার

রে অগ্রদূত, ভাঙতে এবার আসছে কি জাঠ কালাপাহাড়?”

‘হিন্দু-মুসলিম যুদ্ধ’ কবিতায় তার মনােভাব আরাে প্রবল হয়ে উঠেছে। তিনি আশা প্রকাশ করেন যে, যদিও পরােক্ষ প্ররােচনায় হিন্দু-মুসলমান, আজ পরস্পর হানাহানিতে লিপ্ত, তবু একদিন এই অশুভ শক্তির বিনাশ ঘটবেই। জাগরিক গণশক্তি এই পশুশক্তির ধ্বংস সাধন করবেই। সে চিনতে সমর্থ হবে তার প্রকৃত শত্রুকে। তার কথায়—

“যে লাঠিতে আজ টুটে গম্বুজ, পড়ে মন্দিরচুড়া,

সেই লাঠি কালি প্রভাতে করিবে শত্রু-দুর্গ গুড়া।

প্রভাতে হবে না ভায়ে ভায়ে রণ,

চিনিবে শত্রু, চিনিবে স্বজন।

করুক কলহ-জেগেছে তাে তবু—বিজয় কেতন উড়া!

ল্যাজে যদি তাের লেগেছে আগুন, স্বর্ণ লঙ্কা পুড়া।”

এবং ‘ফণীমনসা’তেই সংকলিত বিখ্যাত গান ‘অন্তর ন্যাশন্যাল সঙ্গীতে’ কাজী নজরুল  বলেন—

আদি          শৃংখল সনাতন শাস্ত্র আচার

মূল          সর্বনাশের, এরে ভাঙ্গিব এবার!

ভেদি দৈত্য কারা

আয় সর্বহারা!

কেহ         রহিবে না আর পর-পদ আনত।।

তাই তিনি বলেন—

“শােন অত্যাচারী! শােন্ রে সঞ্চয়ী

ছিনু সর্বহারা, হব সর্বজয়ী

ওরে সর্বশেষের এই সংগ্রাম মাঝ

নিজ নিজ অধিকার জুড়ে দাঁড়া সবে আজ!”

‘মন্দির ও মসজিদ’ প্রবন্ধেও কাজী নজরুল সাম্প্রদায়িকতার বিষময় পরিণাম সম্বন্ধে জাতিকে সচেতন করে দেন। প্রবন্ধটি প্রথমে প্রকাশিত হয় ‘গণবাণী’তে ১৯২৬-এর ২৬ আগস্ট সংখ্যায়। পরে প্রবন্ধটি ‘রুদ্রমঙ্গল’ গ্রন্থে সঙ্কলিত হয়। প্রবন্ধটিতে হিন্দুমুসলমান সাম্প্রদায়িক কলহে যে কারাে বিশেষ লাভ নেই, তা প্রকাশ করতে গিয়ে লিখেছেন, “মারাে শালা যবনদের। মারাে শালা কাফেরদের। আবার হিন্দু-মুসলমানী কাণ্ড বাধিয়া গিয়াছে। প্রথমে কথা কাটাকাটি, তারপর মাথা ফাটাফাটি আরম্ভ হইয়া গেল। আল্লার এবং মা কালীর ‘প্রেষ্টিজ’ রক্ষার জন্য যাহারা এতক্ষণ মাতাল হইয়া চিৎকার করিতেছিল, তাহারাই যখন মার খাইয়া পড়িয়া যাইতে লাগিল, দেখিলাম—তখন আর তাহারা আল্লা মিএ বা কালী ঠাকুরাণীর নাম লইতেছে না। হিন্দু মুসলমান পাশাপাশি পড়িয়া থাকিয়া এক ভাষায় আর্তনাদ করিতেছে—বাবাগাে, মাগাে, মাতৃপরিত্যক্ত দুটি ভিন্ন ধর্মের শিশু যেমন করিয়া একস্বরে কঁদিয়া তাদের মাকে ডাকে।

দেখিলাম হত আহতদের ক্রন্দনে মসজিদ টলিল না, মন্দিরের পাষাণ দেবতা সাড়া দিল না। শুধু নির্বোধ মানুষের রক্তে তাহাদের বেদী চির কলঙ্কিত হইয়া রহিল।”১০ যদিও লেখাটি স্বাধীনতার কুড়ি বছর আগে লেখা, অথচ মনে হবে বর্তমান পরিস্থিতিতে লেখা। দিন বদল হলেও মানুষের নিবুদ্ধিতার পরিবর্তন হয়নি, বরং মনে হবে দেশবাসী যেন আরাে বােকা হয়ে গেছে। মহাকাশ বিজ্ঞানের যুগেও তারা মন্দির-মসজিদের অন্ধকার থেকে বার হয়ে আসতে পারেনি। মন্দির-মসজিদ নিয়ে মারামারি করে। হিন্দু-মুসলমান প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন, “একদিন গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আলােচনা হচ্ছিল আমার হিন্দু-মুসলমান সমস্যা নিয়ে। গুরুদেব বললেন, দেখ যে ন্যাজ বাইরের তাকে কাটা যায় কিন্তু ভিতরের ন্যাজকে কাটবে কে?

প্রশ্ন করেছিলাম এই যে ভিতরের ন্যাজ এর উদ্ভব কোথায়? আমার মনে হয় টিকিতে ও দাড়িতে। টিকিপুর ও দাড়িস্থান বুঝি এর আদি জন্মভূমি। পশু সাজবার মানুষের একি আদিম দুরন্ত ইচ্ছা। ন্যাজ গজাল না বলে তারা টিকি ও দাড়ি গজিয়ে যেন সান্ত্বনা পেল।”১১

কাজী কাজী নজরুল গলায় বেঁধে রাস্তায় রাস্তায় গেয়েছেন,

“মানবতাহীন ভারত শ্মশানে দাও মানবতা, হে পরমের।

কি হবে লইয়া মানবতাহীন ত্রিশকোটি এই মানুষ মেষ।”

একই সঙ্গে গেয়েছেন,

“সঙঘশরণ তীর্থযাত্রী-পত্রে এস মােরা যাই

সঙঘ বাধিয়া চলিলে অভয় সে পথে মৃত্যু নাই।”

রবীন্দ্রনাথের ‘ভারততীর্থ’ কবিতার সুরে তিনি গেয়েছেন,

উদার ভারত উদার ভারত,

সকল মানবে দিয়াছ তােমার কোলে স্থান।

পার্শী-জৈন-বৌদ্ধ-হিন্দু-খৃষ্টান-শিখ-মুসলমান।’

অনৈক্য ও অবিধাস, সাম্প্রদায়িকতাকে চাবুক মেরেছেন কয়েকটি ব্যঙ্গ কবিতায় ও গানে। যেমন –

“টিকি আর টুপিতে লেগেছে দ্বন্দ্ব বচন যুদ্ধ ঘাের।

কে বড় কে ছােট চাই মীমাংসা কার আছে কত জোর।।”

আর একটি গানে তিনি সতর্ক করে দিয়ে আবেদন করেছেন,

“পুঁথির বিধান থাক পড়ে তাের,

বিধির বিধান সত্য হােক।

এই খােদার উপর খােদকারী

তাের মানবে না আর সর্বলােক।”

ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধে বিচলিত হয়ে কাজী নজরুল লেখেন—

“কে কাহারে মারে, ঘােচেনি ধন্দ, টুটেনি অন্ধকার,

জানে না আঁধারে। শত্রু ভাবিয়া আত্মীয়ে হানে মার!

উদিবে অরুণ, ঘুচিবে ধন্দ,

ফুটিবে দৃষ্টি, টুটিবে বন্ধ,

হেরিবে মেরেছে আপনার ভায়ে বদ্ধ করিয়া দ্বার!

ভারত-ভাগ্য করেছে আহত ত্রিশূল ও তরবার!”

মানুষের প্রতি গভীর মমত্ববােধ কবিকে হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গায় ব্যথিত করেছে। ‘দাঙ্গা’ কবিতায় তার প্রকাশ লক্ষণীয়—

“এল কুৎসিত ঢাকার দাঙ্গা আবার নাঙ্গা হয়ে

এল হিংসার চিল ও শকুন নখর চঞ্চু লয়ে!

সারা পৃথিবীর শ্মশানের ভূতপ্রেতেরা সর্বনেশে

ঢাকার পক্ষে আখা জ্বালাইতে জুটেছে কি আজ এসে?”

১৯১৯ থেকে ১৯২৯ সাল পর্যন্ত কাজী নজরুলের কবিতায় প্রবন্ধে গানে সাম্প্রদায়িকতা বিরােধিতা খরধার তরবারির মত ঝলসে উঠেছে। একদিকে মানুষের বিবেক বুদ্ধির কাছে আবেদন, আরেক দিকে ব্যঙ্গ-বাক্য বাণে আঘাত করেছেন। তাঁর মত স্পষ্ট ভাষায় সাম্প্রদায়িকতা ও ভেদাভেদের বিরুদ্ধে আক্রমণ করার আর কোন কবি সাহিত্যিক ছিলেন না, একমাত্র রবীন্দ্রনাথ ছাড়া! সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত তাঁদের পথের কবি ছিলেন। এই তিনজনই ধর্মনিরপেক্ষতার অগ্রগামী অভিযাত্রী। তারা কবিতায় গানে প্রবন্ধে কেবল আবেদন করেননি, এমন ভাষা সৃষ্টি ও প্রয়ােগ করতে চেয়েছেন যা হিন্দু মুসলমানের মিলিত ভাষারূপে স্থান লাভ করে।

কাজী নজরুল ইসলাম কেবলমাত্র সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামার ভয়াবহতার কথাই প্রকাশ করেননি—হিন্দু-মুসলমান মৈত্রীর বাণীও প্রচার করেছেন তার রচনায়। মিলন গান কবিতায় তিনি বলেছেন যে, হিন্দু-মুসলমান—এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে বিরােধ থাকার জন্যই দেশের এই দুরবস্থা, দেশ বিদেশীর পদদলিত। যদি এই দুই সম্প্রদায় মিলিত শক্তিতে এগিয়ে আসে, তবে অসাধ্য সাধন হতে পারে। তার ভাষায়

“(তােরা)   করলি কেবল অহরহ।

নীচ কলহের গরল পান।

(আজো)      বুঝলি না হয় নাড়ী-ছেঁড়া

মায়ের পেটের ভায়ের টান।

(ঐ) বিশ্ব ছিড়ে আনতে পারি,

পাই যদি ভাই তােদের প্রাণ।

(তােরা) মেঘ বাদলের বজ্র বিষাণ,

(আর) ঝড়-তুফানের লাল নিশান।।”

হিন্দু-মুসলমান মৈত্রীর কথা তিনি অন্যভাবে ১৯৩১ খ্রীস্টাব্দে প্রকাশিত ‘কুহেলিকা’ উপন্যাসেও ফুটিয়ে তুলেছেন। যদিও উপন্যাসটি বাংলার সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের পটভূমিকায় রচিত, তবু এর অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল হিন্দু বিপ্লববাদীদের সঙ্গে মুসলমান যুবকদের দেশপ্রেমের বর্ণনা। অবশ্য ব্যক্তিগত প্রেম সমস্যা বা নারীতত্ত্ব বিষয়টিও অস্বীকার করা যায় না। উপন্যাসটির নায়ক জাহাঙ্গীর এবং নায়িকা চম্পা। এদের ব্যক্তিগত সমস্যা এই উপন্যাসের অনেকখানি। কিন্তু একে অতিক্রম করে একটা অসাম্প্রদায়িক মনােভাবও বেশ প্রখর হয়ে উঠেছে উপন্যাসটিতে। বােধ হয়, এই সর্বপ্রথম বাংলা উপন্যাস সাহিত্যে অসাম্প্রদায়িক মনােভাব এত প্রবলভাবে প্রকাশিত হয়েছে। অধিনায়ক বজ্ৰপানি বলেছে, “আমার ভারতবর্ষ ইণ্ডিয়া নয়, হিন্দুস্থান নয়, গাছপালার ভারতবর্ষ নয়,—আমার ভারতবর্ষ মানুষের যুগে যুগে পীড়িত মানবাত্মার ক্রন্দন-তীর্থ। কত অসাগরে চড়া পড়ে পড়ে উঠল আমার এই বেদনার ভারতবর্ষ। ওরে, এ ভারতবর্ষ তােদের মন্দিরের ভারতবর্ষ নয়, মুসলমানের মসজিদের ভারতবর্ষ নয়,—এ আমার মানুষের—মহা-মানুষের মহাভারত।”

এই ভারতবর্ষের ছবি কাজী নজরুলের আগে কেউ এত স্পষ্ট করে দেখাতে পারেনি। বঙ্কিমচন্দ্র জাতীয়তাবাদের অগ্রগামী পুরুষ। তাঁর উপন্যাসসমূহ পাঠ করলে কিন্তু দেখা যাবে, যখনই তিনি বিদেশী শাসনের দেশীয় স্বাধীনতাকামীদের সংঘর্ষের চিত্র অঙ্কন করেছেন, তখনই প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে কোন না কোন মুসলমান শাসককে স্বাধীনতাকামীদের প্রতিপক্ষ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘ভারত সঙ্গীত’ গ্রন্থে জনচিত্তকে জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ করবার জন্য এককল্পিত মুসলমান শাসকের বিরুদ্ধে মহারাষ্ট্রীয় এক যুবকের আহ্বানকে রূপায়িত করেছেন। অর্থাৎ হিন্দু-মুসলমানসহ সমস্ত সম্প্রদায়ের ভারতবর্ষ কল্পনা তাদের দৃষ্টিতে ছিল না। এদিক থেকে কাজী নজরুল  নিঃসন্দেহে পথিকৃৎ।

কাজী নজরুল -সম্পাদিত সান্ধ্য ‘দৈনিক যুগবাণীর’ সম্পাদকীয় প্রবন্ধাবলীতে ১৯২০ সালে লিখিত কাজী নজরুল মানসের যথার্থ পরিচয় মেলে। ‘নবযুগ’ প্রবন্ধে তিনি বলেন, “এস ভাই হিন্দু! এস মুসলমান! এস বৌদ্ধ! এস ক্রিশ্চিয়ান! আজ আমরা সব গণ্ডী কাটাইয়া সব সংকীর্ণতা, সব মিথ্যা, সব স্বার্থ চিরতরে পরিহার করিয়া প্রাণ ভরিয়া ভাইকে ভাই বলিয়া ডাকি। আজ আমরা আর কলহ করিব না।”

অন্যত্র, সমকালীন হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতি লক্ষ্য করে তিনি বলেন,

“এস ভাই হিন্দু! এস ভাই মুসলমান! তােমার আমার উপর অনেক দুঃখ ক্লেশ, অনেক ব্যথা বেদনার ঝড় বহিয়া গিয়াছে, আমাদের এ বাঞ্ছিত মিলন বড় দুঃখের, বড় কষ্টের ভাই! খােদা যখন আমাদের জাগাইয়াছেন, তখন আর যেন আমরা না ঘুমাই।”

(৫)

আধুনিক বাংলা গানের পাঁচ প্রধান পুরুষ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১), দ্বিজেন্দ্রলাল রায় (১৮৬৩-১৯১৩), রজনীকান্ত সেন (১৮৬৫-১৯১০), অতুলপ্রসাদ সেন (১৮৭১-১৯৩৪) ও কাজী কাজী নজরুল  ইসলাম। এঁদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রলাল ও রজনীকান্ত দেশপ্রেমমূলক গানে, দ্বিজেন্দ্রলাল ও রজনীকান্ত হাসির গানে, রবীন্দ্রনাথ ও অতুল প্রসাদ আধ্যাত্মিক গানে শিখরস্পর্শী। সর্বকনিষ্ঠ কাজী নজরুল ইসলামের সংগীত-পৃথিবী এঁদের মধ্যে সবচেয়ে পরিব্যাপ্ত তিনি দেশাত্মক গান, হাসির গান, মরমী গান সবই লিখেছেন। এঁদের সঙ্গে কাজী নজরুলের প্রধান পার্থক্যই এই যে, বাংলার প্রধান যে দুই ধর্ম-সম্প্রদায় হিন্দু ও মুসলমান, তাদের ধর্মীয় ও মরমী প্রবণতার আপনস্তর স্পর্শ করেছেন কাজী নজরুল। রবীন্দ্রনাথ ব্রহ্মসংগীত লিখেছেন, কিন্তু হিন্দু ও ইসলাম ধর্ম-নির্ভর গান। রচনা করেননি। মধ্যযুগে সমুখিত হিন্দু সংগীতের ধারা কাজী নজরুল যে-ভাবে আধুনিক কাল পর্যন্ত বহন করে নিয়ে গেছেন তার। কোনাে দৃষ্টান্ত তার অব্যবহিত পূর্বে পরে বা সমকালে নেই, নতুন করে দেখাও যাচ্ছে না। কাজী নজরুল  সমকালীন, বা ঈষৎ পরবর্তী অন্য গীতিকারেরা অজয় ভট্টাচার্য (১৯০৬-৪৩), অনিল ভট্টাচার্য (১৯০৮-৪৪), গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার (১৯২৫-৮৬), জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র (১৯১১-৭৭), তুলসী লাহিড়ী (১৮৯৮-১৯৫৯), দিলীপকুমার রায় (১৮৯৭-১৯৮০), নিশিকান্ত (১৯০৯-৭৩), প্রণব রায় (১৯১১-৭৫), প্রেমেন্দ্র মিত্র (১৯০৪-১৯৮৮), বাণীকুমার (১৯০৭-৭৪), শৈলেন রায় (১৯০৫-৬৩), সজনীকান্ত দাস (১৯০০-৬২), হেমেন্দ্রকুমার রায় (১৮৮৮-১৯৬৩) প্রমুখ—এমন প্রচুরভাবে ধর্মসংগীত রচনা করেননি।

আধুনিক বাংলা গান নামে একটি সংকলনের সম্পাদক কাজী নজরুল ইসলামের হিন্দু বা ইসলামী ধর্মীয় সংগীতের একটিও গ্রহণ -করে আধুনিকতার সামগ্রিক রূপ নির্ধারণ করতেই ব্যর্থ হয়েছেন বলে আমরা মনে করি। তিনি অবশ্য ঐ সংকলনে রবীন্দ্রনাথ বা রজনীকান্তের অচিহিত অনির্দেশিত ঈরীয় সংগীত গ্রহণ করেছেন। বৈষ্ণব ও শাক্ত ভাবার্থক অজস্র গান কাজী নজরুল লিখেছেন। যেমন ইসলামী বাংলা গানের রচয়িতাই তিনি। মুনশী মােহাম্মদ মেহেরুল্লাহ (১৮৬১-১৯০৭) অসামান্য নাত লিখেছেন কাজী নজরুলের। অনেক আগে, গােলাম মােস্তফা (১৮৯৭-১৯৬৪) অসামান্য নাত লিখেছেন কাজী নজরুলের আগে—কিন্তু সামগ্রিকভাবে হামদনাত-ইসলামী গানে কাজী নজরুল ইসলামই স্রষ্টা। কাজী নজরুল ইসলামই বাংলা সংগীতে ইসলামের সঙ্গে নান্দনিকতার— সাংগীতিকতার—প্রথম মিশেল ঘটালেন। ইসলাম ও সনাতন ধর্ম-কেন্দ্রীক সংগীত রচনায় কাজী নজরুল ইসলাম বিংশ শতাব্দীতে এক বিস্ময়।

আধুনিক রােমান্টিক গানে কাজী নজরুল ইসলামের প্রভাব একসময় সর্বব্যাপী হয়ে উঠেছিল অতুল প্রসাদের মরমী বিষাদের বাইরে আর এক বিষাদিত জগৎ কাজী নজরুল সৃষ্টি করেছিলেন চঁাদ-ফুল-পাখি-সমাধি-প্রেমেরক্ষ এর বিপরীতে গণসংগীতের ধারাও তিনি সৃষ্টি করেছিলেন। কাজী নজরুলের রােমান্টিক গানের ধারার ও গণসংগীতের ধারার উত্তরাধিকার হয়েছে কিন্তু ধর্মীয় সাংগীতিক উত্তরাধিকারী তাে নেই-ই। শ্যামাসংগীতে কাজী নজরুল  রামপ্রসাদ সেন (১৭২০-১৭৮১) বা কমলাকান্ত ভট্টাচার্যকে (১৭৮২-?) অতিক্রম যদি না-ও করে থাকেন অন্তত তাদের সমপর্যায়ী। হামদ-নাত-ইসলামী গানে কাজী নজরুল সর্বোচ্চ শিখরে সমাসীন।

কিন্তু কাজী নজরুলের মহত্ত্ব এখানে যে হিন্দু ও মুসলমান এই দুই প্রধান বাঙালি ধর্মসম্প্রদায়কে গভীরে ধারণ করেও, অথবা করেই, তিনি উত্তীর্ণ হয়েছেন অন্য লােকে। সুরের বাইরে, বাণীর দিক থেকে কাজী নজরুল সংগীতের প্রধান উপচার চিত্রকল্প। সুরে এবং চিত্রকল্পেই কাজী নজরুল সংগীতে বিজয় অর্জন করেছেন। একটি ইসলামী গান এবং একটি হিন্দু ভক্তিগীতি আমরা উদ্ধৃত করে দেখাবাে, দুই গানেই প্রযুক্ত হয়েছে চিত্রকল্পের একইরকম করণকৌশল। প্রথমে উদ্ধৃত করছি ইসলামী গান,

“না-ই হল মা জেওড় লেবাস

এই ঈদে আমার।

(আছে) আল্লা আমার মাথার মুকুট,

রসূল গলার হার।।

নামাজ রােজায় ওড়না শাড়ি

ওতেই আমায় মানায় ভারি,

কলমা আমার কপালে টিপ,

নাই তুলনা যার।।

হেরা গুহার হীরার তাবিজ

কোরান বুকে দোলে,

হাদিস ফেকা বাজুবন্দ

দেখে পরান ভােলে।

(আমার) হাতে সােনার চুড়ি যে মা

হাসান হােসেন মা ফাতেমা

(মাের) অঙ্গুলিতে অঙ্গুরী মা

নবীর চার ইয়ার।।”

এরই সঙ্গে মিলিয়ে দেখুন একটি হিন্দু ভক্তি গীতিতে চিত্রকল্প ব্যবহার,

“আমার নয়নে কৃষ্ণ নয়ন-তারা হৃদয়ে মাের রাধা-প্যারী।

আমার প্রেম প্রীতি ভালােবাসা শ্যাম-সােহাগী গােপ-নারী।।

আমার স্নেহে জাগে সদা পিতা নন্দ, মা যশােদা,

ভক্তি আমার শ্রীদাম সুদাম আঁখি-জল যমুনা-বারি।।

আমার সুখের কদম-শাখায় কিশাের হরি বংশী বাজায়,

আমার দুখের তমাল-ছায়ায় লুকিয়ে খেলে বন-বিহারী।।

মুক্ত আমার প্রাণের গােঠে চরায় ধেনু রাখাল কিশাের,

আমার প্রিয়জনে নেয় সে হরি সেই তাে ননী খায় ননীচোর।

কৃষ্ণ রাধা-কথা শুনায়— দেহ ও মন শুকসারী।।”

তিনি একদিকে যেমন বাংলা ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কালী-কীর্তন রচয়িতা, তেমনি অন্যদিকে তিনি বাংলা ইসলামী গানের প্রবর্তক ও কাব্যে আমপারা, মরুভাস্কর প্রভৃতি প্রণেতা। কোন কোন ক্ষেত্রে কালী-কীর্তন ও না’ত রচনায় তিনি প্রায় তুলনীয় চিত্রকল্প রচনা করেছেন। যেমন—তাঁর একটি বিখ্যাত কালী-কীর্তনে আছে—

“আমার কালাে মেয়ের পায়ের নীচে

দেখে যা আলাের নাচন

মায়ের রূপ দেখে দেয় বুক পেতে শিব

যার হাতে মরণ বাঁচন।।

আমার কালাে মেয়ের আঁধার কোলে

শিশু রবি শশী দোলে

মায়ের একটু খানি রূপের ঝলক

ঐ স্নিগ্ধ বিরাট নীল গগন।।”

এবং তার একটি অতি পরিচিত না’তে আছে—

“তােরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে।

মধু পূর্ণিমারই সেথা চাদ দোলে।।।

যেন উষার কোলে রাঙ্গা রবি দোলে।।”

কাজী নজরুল -মানস বিশ্নেষণে এর কোনটিই কম মূল্যবান নয়। কাজী নজরুল মানসে হিন্দু ও মুসলমান বৈপরীত্যের দ্যোতক না হয়ে পরিপূরক হতে পেরেছে তার সাম্যবাদী চিন্তার ফলে।

এই যে অভিন্ন চিত্রকল্প প্রয়ােগ-কুশলতা, এ কিন্তু যান্ত্রিকভাবে নয়—যেমন অনেকে কাজী নজরুল -সংগীত প্রসঙ্গে ভাবেন বা বলেন। এর উৎস যে অভিন্ন কবিহৃদয়—সেখানে বাইরে ছিল ধর্মাচার কিন্তু ভিতরে ছিল এমন এক গভীর ঈধরবােধ, যা আচার-অতিক্রমী। আব্বাসউদ্দিন আহমদ বর্ণনা দিয়েছেন, কী আকস্মিকভাবেই না নির্মিত হয়েছিল গ্রামােফোন রেকর্ডের জন্যে সেই প্রথম অসাধারণ ইসলামী গানটি—ও মন রমজানের ঐ রােজার শেষে এলাে খুশির ঈদ। গ্রামােফোন কোম্পানির অধিকর্তাকে অনেক দিন থেকে বাংলায় ইসলামী গানের জন্যে জপাচ্ছিলেন আব্বাসউদ্দিন, তিনি কিছুতেই রাজি হচ্ছিলেন না। তারপর একদিন যখন সায় দিলেন, আব্বাসউদ্দিন সােল্লাসে কাজী নজরুল কে এসে বলতেই, কাজী নজরুল সংগীত শিক্ষারত ইন্দুবালা দেবীকে যেতে বলে ঐ গানটি লিখলেন ও সুর দিলেন। সন্তোষ সেনগুপ্ত তার একটি অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন, যা এই প্রসঙ্গে জরুরি। সন্তোষ সেনগুপ্ত হঠাৎ একদিন স্টুডিওতে ঢুকে দেখলেন, স্টুডিও আধাে-অন্ধকার, কাজী নজরুল  আর জ্ঞান গােস্বামী দুজনই গাইছেন ‘শ্মশানে জাগিছে শ্যামা’ গানটি—আর দুজনেরই চোখ দিয়ে অঝােরে ধারায় জল পড়ছে। যে-আবেগে কাজী নজরুল লিখেছিলেন ‘ও মন রমজানের ঐ রােজার শেষে এলাে খুশির ঈদ, সেই আবেগ যেমন ছিল হৃদয় থেকে উৎসারিত, তেমনি স্বতােৎসারিত অশ্রুজলই প্রমাণ করে শ্মশানে জাগিছে শ্যামা’র প্রকৃত আবেগ।

বস্তুত মানবতার মহৎ আদর্শে অনুপ্রাণিত কবি কাজী নজরুল ইসলামের কাব্য ভাবনার এক প্রধান অংশ জুড়ে আছে হিন্দুমুসলমান সম্প্রীতি কামনা। মনে রাখা দরকার, সমগ্র আধুনিক বাংলা কাব্যের ইতিহাসে কাজী কাজী নজরুল  ইসলামই একমাত্র কবি যিনি সমান দক্ষতার সঙ্গে হিন্দু ও মুসলমান উভয় ঐতিহ্যকে আপন কাব্যে ব্যবহার করতে সমর্থ হয়েছেন। উভয় ঐতিহ্য থেকে অবলীলাক্রমে তিনি বিষয়, উপমা, রূপক, বাকভঙ্গি প্রভৃতি আহরণ করেছেন। ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় হিন্দু ও মুসলমান উভয় ঐতিহ্য থেকে আহরিত শব্দ, উপমা, রূপক ও বাকভঙ্গি তাই এত অনায়াসে মিশে গেছে। একই নিঃসে কবি তাই উচ্চারণ করেন—

“আমি বেদুঈন, আমি চেঙ্গিস আমি আপনারে ছাড়া করিনা কাহারে কুর্ণিশ।

আমি বজ্র, আমি ঈশান বিষাণে ওঙ্কার,

আমি ইস্রাফিলের শিঙ্গার মহাহুঙ্কার

আমি পিণাক পাণির ডমরু ত্রিশূল, ধর্মরাজের দণ্ড,

আমি চক্র ও মহাশংখ, আমি প্রণদনাদ প্রচণ্ড!”

মানবতার শক্তির জাগরণের অসামান্য কাব্যরূপ তার ‘বিদ্রোহী’ কবিতা সেখানে রণক্লান্ত বিদ্রোহী কেবল তখনই শান্ত হবে—

“যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দনরােল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না

অত্যাচারীর খঙ্গ-কৃপাণ ভীম রণভূমে রণিবে না।”

বিষয়বস্তু হিন্দু বা মুসলিম যাই হােক না কেন মানবতার উচ্চাদর্শ অনুসরণ করার আহ্বান জানায় তার সৃষ্টি। তাঁর কবিতায় ঈশ্বর আল্লা, মন্দির-মসজিদ-গীর্জা, বেদ-কোরান-বাইবেল প্রভৃতি রূপকার্থে ব্যবহৃত। তাঁর দৃষ্টিতে হজরত মােহাম্মদ (সঃ) বিদ্রোহী সাম্যবাদী, কৃষ্ণ স্বৈর শাসকের ত্রাস, খালেদ নিপীড়িত মানুষের সেনাপতি, ইসলামের চতুর্থ খলিফা হজরত ওমর সুবিচার ও মানবতার প্রতীক আর নটরাজ শিব ধ্বংস-সৃষ্টির যুগল স্মরণ। এ-সম্পর্কে কাজী নজরুলের দ্বিধাহীন মনােভাব ব্যক্ত হয়েছে অধ্যক্ষ ইব্রাহিম খানকে লিখিত একটি পত্রে—

“যাঁরা মনে করেন—আমি ইসলামের বিরুদ্ধবাদী বা তার সত্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করছি, তারা অনর্থক এ-ভুল করেন। ইসলামের নামে যে কুসংস্কার মিথ্যা আবর্জনা স্তুপীকৃত হয়ে উঠেছে—তাকে ইসলাম বলে না-মানা কি ইসলামের বিরুদ্ধে অভিযান? এ-ভুল যাঁরা করেন, তারা যেন আমার লেখাগুলাে মন দিয়ে পড়েন দয়া করে—এ ছাড়া আমার কি বলবার থাকতে পারে।

আমার ‘বিদ্রোহী’ পড়ে যারা আমার উপর বিদ্রোহী হয়ে উঠেন, তারা যে হাফেজ রুমীকে শ্রদ্ধা করেন—এও আমার মনে হয় না। আমি ত আমার চেয়ে বিদ্রোহী মনে করি তাদের। এঁরা কি মনে করেন, হিন্দু দেবদেবীর নাম নিলেই সে কাফের হয়ে যাবে? তাহলে মুসলমান কবি দিয়ে বাংলা সাহিত্য সৃষ্টি কোন কালেই সম্ভব হবে না—জৈগুন বিবির পুঁথি ছাড়া।

বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতের দুহিতা না হলেও পালিত কন্যা। কাজেই তাতে হিন্দুর ভাবধারা এত ওতপ্রােতভাবে জড়িত যে, ও বাদ দিলে বাল্লা ভাষার অর্ধেক ফোর্স নষ্ট হয়ে যাবে। ইংরাজী সাহিত্য হতে গ্রীক পুরাণের ভাব বাদ দেওয়ার কথা কেউই ভাবতে পারে না। বাংলা সাহিত্য হিন্দু-মুসলমান উভয়েরই সাহিত্য। এতে হিন্দু দেবদেবীর নাম দেখলে মুসলমানদের রাগ করা যেমন অন্যায়, হিন্দুরও তেমনি মুসলমানদের দৈনন্দিন জীবন-যাপনের মধ্যে নিত্য প্রচলিত মুসলমানী শব্দ তাদের লিখিত সাহিত্যে দেখে ভুরূ-কোঁচকানাে অন্যায়। আমি হিন্দু-মুসলমানের মিলনে পরিপূর্ণ বিশ্বাসী তাই তাদের সংস্কারে আঘাত হানার জন্যই মুসলমানী শব্দ ব্যবহার করি বা হিন্দু দেব-দেবীর নাম নিই। অবশ্য এরজন্য অনেক জায়গায় আমার কাব্যের সৌন্দর্য্য হানি হয়েছে। তবু আমি জেনে শুনেই তা করেছি।”১২

(৬)

জাতির অভিমানকেই কাজী নজরুল পরাধীনতার অন্যতম কারণ বলে মনে করতেন। জাতিতে জাতিতে হানাহানির সুযােগ নিয়েই বিদেশীরা আমাদের পদানত করে রেখেছে একথাই তিনি নানারূপে নানা রসে ব্যক্ত করে মিলনবাণী উচারণ করেছেন। তিনি বিভিন্ন সময়ে বলেছেন—

ক)

“ভাই হয়ে ভাই চিনবি আবার গাইব কি আর এমন গান।

(সে দিন) দুয়ার ভেঙে আসবে জোয়ার মরা গাঙে ডাকবে বান।।

(যত) মাদী তােরা বাঁদী বাচ্চা দাস মহলের খাস গােলামঃ

(হায়) মাকে খুঁজিস? চাকরানী সে, জেলখানাতে ভানছে ধান,

(ওরে) তােরা করিস লাঠালাঠি

(আর) সিন্দু ডাকাত লুঠছে ধান

(তাই) গােবর গাদা মাথায় তােদের কঁঠাল ভেঙে খায় শেয়ান।”

(মিলন গান ভাঙার গান)

(খ)

“শুধু গুণ্ডামী ভণ্ডামী আর গোঁড়ামী ধর্ম নয়,

এই গোঁড়াদের সর্বশাস্ত্রে শয়তানী চেলা কয়।।

এক যে স্রষ্টা সব সৃষ্টির এক সে পরম প্রভু

একের অধিক স্রষ্টা কোনাে যে ধর্ম কহে না কভু।”

(গোঁড়ামী ধর্ম নয় শেষ সওগাত)

(গ) “লােভ আর ভােগ চাহে যারা নাই তাদের ধর্ম জাতি

তাহাদের শুধু এক নাম আছে রাক্ষস বলে খ্যাতি

হউক হিন্দু হােক ত্রীশ্চান হােক সে মুসলমান

ক্ষমা নাই তার, যে আনে তাহার ধরায় অকল্যাণ।”

মানব প্রেমিক কবি মনে করেন ধর্মের ভিত্তিতে মানুষকে ভাগ করা যায় না। একই সৃষ্টিকর্তার আঙিনায় আমরা সবাই মানুষ এবং আমরা একে অপরের ভাই। এমনকি শিশু কিশােরদের মনেও মিলন বিষয়ক গান ছড়িয়ে দিয়েছেন তিনি যা আবাল বৃদ্ধ বণিতার প্রাণে শিহরণ জাগায়, তার মধ্যে একটি গান হল—

“মােরা এক বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু মুসলমান।

মুসলিম তার নয়নমনি হিন্দু তাহার প্রাণ।।

এক সে আকাশ মায়ের কোলে

যেন রবিশশী দোলে

এক রক্তি বুকের তলে, এক সে নাড়ীর টান।।”

আজকের মত বিচ্ছিন্নবাদিতার দিনে, আঞ্চলিকতা, উগ্র জাতীয়তা এবং সাম্প্রদায়িক অসম্প্রীতির দিনে কবির গানগুলি স্মরণীয়। এককালে এই গানগুলি শুনে হিন্দু-মুসলমান বিভেদ ভুলে গিয়েছিল—শত্রুর চক্রান্ত ব্যর্থ করে ভাইয়ে ভাইয়ে এক হয়েছিল। ‘মােরা দুই সহােদর ভাই’ গানটিতে কবি বলেছেন—

“মুসলিম আর হিন্দু মােরা দুই সহােদর ভাই।

একবৃন্তে দুটি কুসুম এক ভারতে ঠাই।।

মুসলিম যার সৃষ্টিরে ভাই হিন্দু সৃষ্টি তারি

মােরা বিবাদ করে করি খােদার উপরে খােদকারি

শাস্তি এত আজ আমাদের হীনদশা এই তাই।।”

ধর্মের দিক থেকে মানুষকে প্রতারিত করছে মৌলবাদীরাও। তারকেরের মােহান্তদের অত্যাচার ও শােষণের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন সেদিন শুরু হয়েছিল তার পুরােভাগে কাজী নজরুল ছিলেন। মােহান্তের মােহ অন্তের গান’-এ ধর্ম ব্যবসায়ীদের মুখােশ খুলে দিয়েছেন। ধর্ম মানুষের ব্যক্তিগত বিধাস অথচ তাকেই পুঁজি করে মৌলবাদীরা নিজেদের মতলব হাসিল করে। ধর্মের দোহাই দিয়ে শােষণ করছে পুরুতরা—

“হায়রে ভজনালয়

তােমার মিনারে চড়িয়া ভণ্ড গাহে স্বার্থের জয়।”

তাই—

“কোথায় চেঙ্গিস গজনী মামুদ, কোথায় কালাপাহাড়?

ভেঙে ফেল ঐ ভজনালয়ের যত তালা দেওয়া দ্বার।”

ধর্ম শােষণব্যবস্থাকে বাঁচিয়ে রাখে। পথে ঘাটে লাল শালু বিছিয়ে মাজার তৈরী করা, ফুটপাতে গাছের তলায় যেখানে সেখানে শনি ঠাকুর, কালী ঠাকুর, মনসা ঠাকুর, হনুমান মন্দির তৈরী করে পয়সা উপার্জন করা শােষণেরই নামান্তর। তাছাড়া পরাধীন জাতির কোনাে ধর্ম থাকতে পারে না—ধর্মাধর্মের বিচারে স্বাধীনতাই প্রথম লক্ষ্য হওয়া উচিত। তিনি বলেছেন, “যার ঘরে বসে কথা কইবার অধিকার নেই, অত্যাচারকে চোখ রাঙাবার যার শক্তি নেই তার আবার ধর্ম কি? …ওরে ভণ্ড তাের আবার ধর্ম কি? যারা তােকে ধর্ম শিখিয়েছে, তারা শত্রু এলে বেদ নিয়ে পড়ে থাকতাে? তারা আগে বাঁচতাে (আমার ধর্ম)। তাই তাঁর কাছে আগে স্বাধীনতা, আগে বাঁচার প্রণ, তারপর ধর্ম।

কাজী নজরুল ধেয়ান ক্ষেত্রে দেখতে পেয়েছেন, হিন্দু-মুসলমানে হানাহানি, জাতিতে-জাতিতে বিদ্বেষ। তাই এই অসাম্য দূর করতে, এই ভেদ জ্ঞান ভেঙ্গে দিতেই এসেছিলেন কবি কাজী কাজী নজরুল  ইসলাম। তিনি এই হিন্দু মুসলমানের দেশ, মন্দির মসজিদের দেশ, সাধু সন্ন্যাসী ও দরবেশের দেশ ভারতবর্ষে দেখতে পেয়েছিলেন অনৈক্যের অমলিন সকরুণ ছবি, ভাইয়ে ভাইয়ে হানাহানির বেদনাকাতর ক্রন্দন ধ্বনি। প্রতিবেশীর প্রতি প্রতিবেশীর অপ্রতিবেশীসুলভ আচরণ। এটা কবিকে পীড়া দেয়, মনকে করে তােলে ব্যাথিত। জাতপাতের নামে যে অন্ধ-সংকীর্ণতা আর বিচারমূঢ়তা সমগ্র ভারতীয় সমাজে শতাব্দী পরম্পরায় আধিপত্য বিস্তার করেছে, কাজী নজরুল তার অবসান চাইলেন। বিদ্রুপের কশাঘাতে দেশবাসীকে সচেতন করে তােলাই তার উদ্দেশ্য। কাজী নজরুল মুসলমানের সঙ্কীর্ণতাকে আঘাতের পাশাপাশি হিন্দু ধর্মের বর্ণ বৈষম্য ছোঁয়া ছুয়ির বিষয়কেও তীব্রভাবে কটাক্ষ করেছেন। ‘জাতের নামে বজ্জাতি’ গান সম্বন্ধে ডক্টর নলিনা সান্যাল বলেছেন,

“১৩৩১ সালের ৩ বৈশাখ তারিখে বহরমপুরে তার বিয়ে হয়েছিল। কবির সাহিত্য ও সঙ্গীতের বন্ধু উমাপদ ভট্টাচার্যের কাকার বাড়ি ছিল ডক্টর সান্যালের শ্বশুড় বাড়ি। পরিবেশটি ছিল গোঁড়া হিন্দুয়ানি। সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানে এ বাড়ির নিমন্ত্রণে ব্রাহ্মণ, বৈদ্য ও কায়স্থকেও আলাদা আলাদা পংক্তিতে খেতে বসতে হত। মুসলমানদের ত তার ত্রিসীমায়ও ঢােকার উপায় ছিল না। শুর বাড়ির সঙ্গে ডক্টর সান্যালের শর্ত ছিল, জাতিভেদ মেনে তার নিমন্ত্রিতদের অপমান করা চলবে না। এমনিতে সঙ্গীত চর্চার জন্য কাজী নজরুল ইসলাম উমাপদ ভট্টাচার্য্যের বাড়িতে যেতেন। কিন্তু সে দিন কাজী নজরুল পবিত্রকুমার গঙ্গোপাধ্যায়কে নিয়ে ডক্টর সান্যালের বিবাহ আসরে উপস্থিত হলেন। কয়েদী কাজী নজরুলের বহরমপুর জেলের সুপারিনটেন্ডেন্ট ও মুর্শিদাবাদের সিভিল সার্জেন পৈতাধারী কায়স্থ নেতা ডাক্তার বসন্তকুমার ভৌমিকও এই আসরে উপস্থিত ছিলেন। বরযাত্রীরা সমবেত নিমন্ত্রিতদের সঙ্গে বসতে যাচ্ছেন দেখতে পেয়ে গোঁড়া হিন্দুর দল উঠে চলে গেলেন। তখন কাজী নজরুল  ইসলাম উমাপদ ভট্টাচার্যের বাড়িতে গিয়ে বেশ কিছুক্ষণ কাটিয়ে আসরে ফিরে এলেন। সঙ্গে ‘জাতের বজ্জাতি’ গানটি। তিনি সমবেত বরযাত্রীদের মাঝে গানটি গাইলেন।”

(যদিও কবিতাটি রচিত হবার অন্যবিধ পটভূমিও চালু আছে। তবে এটি আমাদের প্রতিপাদ্য নয়) ক্ষুব্ধ কাজী নজরুল ধিক্কার জানালেন,

“জাতের নামে বজ্জাতি সব জাত-জালিয়াৎ খেচো জুয়া।

ছুঁলেই তাের জাত যাবে?

জাত ছেলের হাতের নয়তাে মােয়া।…

মানুষ নাই আজ, আছে শুধ জাত-শেয়ালের হুক্কা হুয়া।।

জানিস নাকি ধর্ম সে যে বর্ম সম সহনশীল,

তাকে কি ভাই ভাঙতে পারে ছোঁওয়া-ছুঁয়ির ছােট্ট, টিল।

যে জাত-ধর্ম ঠুনকো এত,

আজ নয় কাল ভাঙবে সে ত ।

যাক না সে জাত জাহান্নামে রইবে মানুষ, নাই পরােয়া।।।

দিন-কানা সব দেখতে পানে দণ্ডে দণ্ডে পলে পলে,

কেমন করে পিষছে তােদের পিশাচ জাতের জাঁতাকলে।

তােরা জাতের চাপে মারলি জাতি,

সুৰ্য্য ত্যাজি নিলি বাতি, তােদের জাত-ভগীরথ

এনেছে জল জাত-বিজাতের জুতাে ধােওয়া।।”

মানুষের স্পর্শে যে মানুষ অশুচি হয় না, অধর্ম হয় না, বরং এই ছোঁয়াছুঁয়ির বিধিনিষেধের ফলে মানবাত্মার মহিমা রুগ্ন হয়, কলঙ্কিত হয়—এটাই কবির বক্তব্য। বিধাতার সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হচ্ছে মানুষ। তার চোখে সবাই সমান। এই জন্য মানুষ সবাই ভাই ভাই। কোন মানুষই তুচ্ছ নয়, ঘৃণ্য নয়, অপাংক্তেয় নয়। তবু যারা মানুষকে ঘৃণা করে দূরে সরিয়ে রাখে তাদের প্রতিই কবির সােচ্চার ঘােষণা,

“বলতে পারিস বিপিতা ভগবানের কোন্ সে জাত?

ছুঁলে পরে কোন্ ছেলে তার অশুচি হন জগন্নাথ?

ভগবানের জাত যদি নাই

তােদের কেন জাতের বালাই।

(তােরা) ছেলের মুখে থুতু দিয়ে মার মুখে দিস ধূপের ধোঁয়া।”

মােহাচ্ছন্ন স্বর্গলােভী ধর্মান্ধদের তিনি বলতে চান—ধর্মের জন্য মানুষ নয়, মানুষের জন্য ধর্ম। আর একথা যদি আমরা বুঝতে পারি তাহলে মানুষে মানুষে ধর্মে-ধর্মে কেন এই হানাহানি? জীবের মধ্যে শিবের সন্ধান করেছেন ভারতের ঋষিগণ। তবে কেন ধর্মধ্বজীরা একথা মনে রাখেন না? ধর্মের নামে যে ফাকিবাজি, দিনান্ধ সেই ধর্মের চাইদের উদ্দেশ্যেই কবির সত্য ইঙ্গিত –

“জাতের চেয়ে মানুষ সত্য অধিক সত্য প্রাণের টান প্রাণঘরে সব এক সমান।”

(৭)

ধর্মের মূল সত্য বােধের জাগ্রত চেতনা নিয়েই কবি কাজী নজরুল হিন্দু ও ইসলাম ধর্মের মধ্যে সমন্বয়ের সূত্র ও ঐক্যের সুর খুঁজে পেয়েছিলেন। আলবেরুনী, দারাশিকোহ প্রমুখের মত তিনি ধর্মের গভীরে ডুবে মিলনামৃত আনবার চেষ্টা করেছিলেন। আর সেই অমৃত পান করে শুধু নিজেই তৃপ্ত হলেন না বরং তাকে সাহিত্যের পাত্রে ফেলে কাব্যে-ছন্দে-সুরে সব মানুষের হৃদয় অন্তঃপুরে পৌঁছে দিতে চেয়েছেন। কারণ তিনি উপলব্ধি করেছিলেন—

“হিন্দু-মুসলমানের অশ্রদ্ধা দূর করতে না পারলে এ পােড়া দেশের কিছু হবে না।”

অন্যায়কে সহ্য করা, প্রশ্রয় দেওয়াও যে পাপ। মানুষ যে কখনও ঘৃণ্য নয়, অবজ্ঞেয় নয়, হেয় নয়, তবে কেন মানুষের কাছে। মানুষের এই লাঞ্ছনা, এই অবমাননা! মানুষ কেন মানুষকে অমানুষের মত দূরে সরিয়ে রাখে! মানুষের মনের এই আঘাত যে সৃষ্টিকর্তার বুকে বাজে। তাই কবি বলেন মানুষের মধ্যে যে অতিমানুষ লুকিয়ে আছে—

“ওরে চণ্ডাল! চমকাও কেন? নহে ও ঘৃণ্য জীব

ওই হতে পারে হরিশচন্দ্র, ওই শ্মশ্বানের শিব!

রাখাল বলিয়া কারে করাে হেলা, ও হেলা কাহারে বাজে

হয়ত গােপনে ব্রজের রাখাল এসেছে রাখাল সাজে!

চাষা বলে করাে ঘৃণা

দেখাে চাষারূপে লুকায়ে জনক বলরাম এলাে কিনা!”

এইভাবে কবি সমস্ত শাস্ত্রপূরাণ মন্থন করে প্রমাণ করেছেন যে, মানব মহিমা সর্বোপরি। চিরবিস্ময় এই সৃষ্টি-রহস্য। কোন মানুষের মধ্যে যে কি অপার শক্তি-রহস্য নিহিত তা মানুষের গম্য-গােচরীভূত নয়। আপাত দৃষ্টিতে যা দেখা যায় তা-ই প্রকৃত সত্য দেখা নয়। অন্তদর্শন দিয়ে তাকে দেখতে হয়। আর সে দৃষ্টি নিয়ে দেখলে সবই অর্থপূর্ণ ও সামঞ্জস্য বিধিবিধান বলে মনে হয়। সাম্যের বন্দনায় কবির কাছে তাই কেউ অপাংক্তেয় নয়। অনর্থকও কিছু নয়—

“সাম্যের গান গাই

যত পাপী তাপী মাের বােন, সব হয় মাের ভাই!”

ভারতীয় সংস্কৃতির প্রকৃত ধারক-বাহক এবং সংস্কারক ঋষি তিনি। মনীষী তিনি। ভারতের হিন্দু-মুসলিম সংস্কৃতি সমন্বয়ের সেতু তিনি। হিন্দু ও মুসলিম তার কাছে সমান প্রিয় সমান মহনীয়—“হিন্দু মুসলমান দুটি ভাই ভারতের দুই আঁখি তারা একই বাগানে দু’টি তরু দেবদারু আর কদম চারা।।” কবির এই উদারতা অনেক মুসলিম যেমন ভাল চোখে দেখেননি, তেমনি অনেক হিন্দুও তাকে ঠিকমত গ্রহণ করতে পারেননি। এই সম্পর্কে কবির অনুযােগ—“যারা আমার নামে অভিযােগ করেন তাদের মত হলুম না বলে তাঁদের কাছে আমার অনুরােধ গানের কবিকে, আকাশের পাখিকে, বনের ফুলকে তারা যেন এক করে দেখেন। আমি এক সমাজে এই দেশে জন্মগ্রহণ করেছি বলেই শুধু এই দেশের এই সমাজের নই আমি সকল কালের সকল দেশের।” কবির আপন ব্যক্তিত্বের অভিব্যক্তিই ঘটেছে এখানে।

ধর্মের নামে ভণ্ডামী ও ধর্মকে মূলধন করে দাঙ্গা লাগিয়ে যারা ফায়দা লুঠতে চায় তাদের বিরুদ্ধেই জেহাদ ঘােষণা করেছেন তিনি তাদের মুখােশ ছিড়ে দিয়েছেন কারণ, তাঁর কাছে সাম্প্রদায়িকতার এই বীভৎস নরমেধ যজ্ঞের নীরব দর্শক হয়ে থাকা নৈতিক অপরাধ বলে মনে হয়েছে। ব্যক্তিগত জীবনে ধর্মকে সামাজিক চেতনার হাতিয়াররূপে ব্যবহার করতে হবে, এ কথা জানতেন বলেই দেশ ও জাতির মঙ্গলের জন্য সামাজিক দায়িত্ব রূপে তিনি তার লেখনীতে ব্যবহার করেছেন। জাত-বিচারকে লক্ষ করেই তিনি ‘জাতের বজ্জাতি’ গান লিখেছিলেন—

“হুঁকোর জল আর ভাতের হাঁড়ি, ভাবলি এতেই জাতির জান

তাই ত বেকুব, করলি তােরা এক জাতিকে একশ-খান।”

এর ফলে—

“(এই) আচার বিচার বড় করে প্রাণ দেবতায় ক্ষুদ্র ভাবা।

(বাবা) এই পাপেই আজ উঠতে বসতে সিঙ্গী মামার খাচ্ছ থাবা।”

কবি সাম্প্রদায়িকতার কুৎসিৎ রূপ দেখেছেন। দেশ ও জাতিকে ভালােবাসতেন বলে জাতির দোষ ত্রুটি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন। জাতিদাঙ্গা হানাহানি বন্ধ করাই তার ব্রত ছিল। কয়েকটি চিঠিতে ও ভাষণে তিনি তার সাহিত্য কর্মের প্রধান ল্যর কথা ব্যক্ত করেছেন।

কাজী নজরুলের ধর্মনিরপেক্ষতায় দুই সমাজের মৌলবাদীরা ক্ষিপ্ত ছিলেন। সাহিত্যিকরা তাঁর সাহিত্যের কাব্য গুণ নিয়ে কথা তুলেছিলেন। আমার কৈফিয়ৎ’ কবিতায় তিনি এই আক্রমণের জবাব দিয়েছেন,

“বন্ধুগাে আর বলিতে পারি না, বড় বিষজ্বালা এই বুকে,

দেখিয়া শুনিয়া ক্ষেপিয়া গিয়াছি, তাই যাহা আসে কই মুখে,

রক্ত ঝরাতে পারিনা ত একা,

তাই লিখে যাই এ রক্ত-লেখা,

বড় কথা বড় ভাব আসে নাক মাথায়, বন্ধু বড়াে দূখে !

অমর-কাব্য তােমরা লিখিও, বন্ধু যাহারা আছ সুখে!…

প্রার্থনা করাে—যারা কেড়ে তেত্রিশ কোটি মুখের গ্রাস

যেন লেখা হয় আমার রক্ত লেখায় তাদের সর্বনাশ!”

(৮)

১৯২২ সালের অক্টোবরে কাজী নজরুলের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘অগ্নিবীণা’ প্রকাশিত হয়। এ গ্রন্থে সংকলিত ১২টি কবিতার মধ্যে শেষ সাতটি কামাল পাশা,আনােয়ার’, ‘রণভেরী’, শাত-ইল-আরব’, ‘খেয়াপারের তরণী’, ‘কোরবাণী’, ‘মােহরর’—মুসলিম আদর্শজাত। প্রথম পাঁচটির মধ্যে তিনটি কবিতা ‘প্রলয়ােল্লাস’, ‘রক্তাম্বরধারিণী মা’, ‘আগমনী’ বিশুদ্ধ হিন্দু আদর্শজাত এবং ‘বিদ্রোহী’ ও ‘ধূমকেতু’ হিন্দু-মুসলিম উভয় ঐতিহ্যের স্বচ্ছন্দ প্রয়ােগযুক্ত, সাম্যবাদী আদর্শজাত। কিন্তু লক্ষণীয় যে, সবগুলাে কবিতাই প্রকৃতপথে কাজী নজরুলের নিজস্ব ভঙ্গির, মানবতার জাগরণের কবিতা। বিষয়বস্তু হিন্দু বা মুসলিম যাই হােক না কেন, মানবতার উদ্বোধনই ছিল কবির বিশেষ লক্ষ্য। ‘প্রলয়ােল্লাস’ কবিতায় শিবের প্রলয় নৃত্যের ছবিটি খুবই স্পষ্টঃ-

“দ্বাদশ রবি বহ্নিজ্বালা ভয়াল তাহার নয়ন-কটায়

দিগন্তরের কঁাদন লুটায় পিঙ্গল তার ত্রস্ত জটায়!

বিন্দু তাহার নয়ন জলে

সপ্ত মহাসিন্ধু দোলে

কপােল তলে বিমায়ের আসন তারি বিপুল বাহুর পর

হাকে ঐ ‘জয় প্রলয়ঙ্কর।”

কিন্তু শিবের প্রলয় নৃত্যের ছবিটি ব্যবহৃত হয়েছে প্রতীকরূপে। তাই কবিতার শেষাংশে কবি তার মূল বক্তব্যটি বলেন—

“ধ্বংস দেখে ভয় কেন তাের প্রলয় নূতন সৃজন বেদন!

আসছেনবীন—জীবনহারা অসুন্দরে করতে ছেদন!”

‘রক্তম্বরধারিমী মা’ কবিতারও একই বক্তব্য। চণ্ডীর প্রলয়ঙ্করী মূর্তি এঁকে কবি শেষ পর্যন্ত বলেন—

“শ্বেতে-শতদল বাসিনী নয় আজ রক্তাম্বরধারিণী মা

ধ্বংসের বুকে হাসুক মা তাের

সৃষ্টির নব পূর্ণিমা।”

‘আগমনী’ কবিতা যে কোন মুসলমান কবির রচনা, তা আগে থেকে না জানা থাকলে, বিশ্বাস করাই কঠিন। হিন্দু পুরাণের মধ্যে তথা হিন্দুশাস্ত্রের মধ্যে কী অভিনিবেশ ছিল কবির তা এই কাব্য পঙক্তিগুলি থেকেই উপলব্ধি করা যায় —

“রণ-রঙ্গিণী জগন্মাতার দেখ মহারণ।

দশদিকে তার দশ হাতে বাজে দশ প্রহরণ

পদতলে লুটে মহিষাসুর

মহামাতা ঐ সিংহবাহিনী জানায় আজিকে বিশ্ববাসীকে

শার্থত নহে দানব শক্তি, পায়ে পিষে যায় শির পশুর!”

হিন্দু-মুসলমানের মিলনের চিত্র অঙ্কন করতে গিয়ে ইসলামের প্রকৃত অর্থ উন্মােচনেও কাজী নজরুল অগ্রণী হয়েছেন কোথাও কোথাও। ইংরেজ আমলে ভারতে এবং বিশেষ করে বাংলার (পূর্বর্তন) মুসলমান সমাজের ইতিহাস পর্যালােচনা করলে দেখা যাবে, তা এক অর্থে অবক্ষয়ের ইতিহাস। এই কারণে ইংরেজরাও দীর্ঘকাল ভারতের মুসলমান সমাজকে সন্দেহের চোখে দেখতেন। এর পট পরিবর্তন হতে থাকল মােটামুটিভাবে বিশ শতকের দ্বিতীয় দশক থেকে। ইউরােপীয় জ্ঞানচর্চা আহরণের জন্য মুসলমান সমাজও ক্রমশ এগিয়ে আসতে লাগলেন। কিন্তু তখন হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে সাংস্কৃতিক বিরাট ব্যবধান সৃষ্টি হয়ে গেছে। চতুর ইংরেজ শাসক এর সুযােগ নিয়ে সাম্প্রদায়িকতার বিষ চড়িয়ে দিতে লাগল। কাজী নজরুল উপলব্ধি করলেন, এই ব্যবধান দূর করতে না পারলে হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের ভিত্তি কখনও সুদৃঢ় হবে না। এই উপলব্ধি থেকেই মুসলমান সমাজের নবজাগরণের জন্য তিনি খালেদ, জগলুল পাশা, আমানুল্লাহ, উমর ফারুক প্রমুখ মুসলমান মনীষীদের স্মরণ করেছেন কয়েকটি কবিতায়। ইসলামের প্রকৃত স্বরূপকে ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন এইসব কবিতার মাধ্যমে।

আসলে কাজী নজরুলের কবিমানসে ধর্ম এক উদারতর ব্যাখ্যার আসনে প্রতিষ্ঠিত—তিনি বহু ধর্ম সম্প্রদায়ে বিভক্ত মানুষকে ধর্মীয় বিভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধ করতে চেয়েছিলেন। তিনি কৃষ্ণ-বুদ্ধ-খ্রীস্ট-হজরত মােহাম্মদকে (সঃ) একাসনে বসিয়েছেন বলে। তাঁর কাব্যে ধর্মীয় ঐতিহ্য বিপ্লবী তাৎপর্য লাভ করেছে। পুঁথি রচয়িতাদের অন্ধ বিধস ভক্তি প্রকটতাকে অতিক্রম করে হিন্দুমুসলিমদের ঐতিহ্যে তিনি আধুনিক সমাজসচেতনতা আরােপ করে সত্যকার বৈপ্লবিক মনােভাবের পরিচয় দিয়েছেন। কাজী নজরুলের দৃষ্টিতে হজরত মােহাম্মদ (সঃ) বিদ্রোহী, সাম্যবাদী খালেদ বিশ্বের মজলুম মানুষের সেনাপতি খলিফা উমর সুবিচার সাম্য ও মানবতার প্রতীক শ্রীকৃষ্ণ অত্যাচারী কংস-কক্ষে কংসহন্তা সব্যসাচী সুঃসাহসী যৌবনধর্মের প্রতীক।

‘উমর ফারুক’ কবিতাটি উমরের পুণ্যময় মহৎ জীবনকে কেন্দ্র করে রচিত। উমর হলেন ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা। তিনি সিরিয়া, মেসােপটেমিয়া, পারস্য, মিশর, প্যালেস্টাইন প্রভৃতি দেশ জয় করেন। তিনি একদিকে যেমন অপরাধীদের ক্ষমা করেননি, তেমনি অন্যদিকে অসুন্দরের বিনাশ করেছেন। শত প্রলােভন, বিলাস, ঐর্য তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি। ইসলামের সত্য-বাণী তার মধ্যে প্রতিফলিত হয়েছে। কাজী নজরুল উমরের জীবনবৃত্তান্ত কবিতায় ফুটিয়ে তুলতে গিয়ে ইসলামের মর্মবাণীকেও ফুটিয়ে তুলেছেন—উমরের কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছে—ইসলাম বলে—সকলে সমান, কে বড় ক্ষুদ্র কেবা।

‘সুর-উন্মেদ’ কবিতায় কাজী নজরুল পৃথিবীর অন্যান্য দেশে ইসলামের জাগরণ লক্ষ্য করে উল্লসিত হয়েছেন। কিন্তু ভারতের মুসলমান সমাজের অনগ্রসরতায় তার হৃদয় ভারাক্রান্ত। প্রার্থনা করেছেন খােদার কাছে, যেন অন্যান্য দেশের মত এ দেশের মুসলমান সমাজেরও জাগরণ ঘটে। তাঁর ভাষায়—“খর রােদে-পােড়া খর্জুর তরু তার বুক ফেটে রিছে তীর। সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা

ভারতের বুকে নাই ধির।

জেগেছে আরব, ইরাণ, তুরাণ

মরক্কো আফগান মেসের!

এয় খােদা! এই জাগরণ রােখে

এ মেষের দেশও জাগাও ফের।”

এ জাগরণ নিঃসন্দেহে মানবতার ভাবতীর্থে–সাম্প্রদায়িকতার অনেক উর্ধে। কাজী নজরুল মানসে এই অসাম্প্রদায়িক মনােভাবের প্রসার মূলত তাঁর সাম্যবাদী চেতনা থেকেই উৎসারিত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে স্মরণীয় যে, কাজী নজরুলের সাম্যবাদী চেতনা মার্কসীয় দর্শনজাত নয়। যদিও মুজফ্ফর আহমদ-এর মত ব্যক্তির সাহচর্য তিনি পেয়েছিলেন এবং রুশ বিপ্লবের সাফল্যমণ্ডিত ঘটনাবলী তার মনে প্রভাব বিস্তার করেছিল। আসলে তার সাম্যবাদ তার হৃদয়েরই প্রেরণালব্ধ জিনিস।

ভারতীয় ‘সােহম তত্ত্বে’বা ইসলামের ‘সূফী মতবাদে যে মানবতাবােধের প্রসারণ লক্ষ্য করা যায়, কাজী নজরুলের কাব্যেও তারই প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। এরই কার্যকারণ পরিণাম হিসেবে কাজী নজরুল  মানব সমাজে কোন ভেদাভেদকে স্বীকার করেননি। ধনীদরিদ্রের ব্যবধান, নারীপুরুষের ব্যবধান চেয়েছেন ঘােচাতে। স্বীকার করেননি হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খৃস্টানের মধ্যে ব্যবধান। বস্তুত তিনি মানুষকে বড় করে দেখেছেন আজীবন। তিনি চেয়েছেন মানুষের কল্যাণ। বিদ্রোহের জন্য মানুষের প্রতি ছিল তার উদাত্ত আহ্বান-

“গাহি সাম্যের জয়গান

যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা ব্যবধান,

যেখানে মিশেছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম-ত্রীশ্চান।

গাহি সাম্যের গান! কে তুমি?

পার্সী? জৈন? ইহুদী? সাঁওতাল, ভীল, গারাে? কনফুসিয়াস?

চার্বাক-চেলা? ব’লে যাও, বলাে আরাে! গাহি সাম্যের গান।

মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান্

নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্মজাতি,

সব দেশে সব কালে ঘরে-ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি।”

তিনি নিপীড়িত তথা সমগ্র মানবজাতিকে ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণিহীন সমাজ গড়ে তােলার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। কাজী নজরুলের পরিকল্পিত সাম্য-রাজ্যে সব মানুষ সমান, তাদের মধ্যে আর্থিক বৈষম্য নেই, ধর্মীয় ব্যবধান নেই, বর্ণের বিভেদ নেই—

“গাহি সাম্যের গান—

বুকে বুকে হেথা তাজা সুখ ফোটে, মুখে মুখে তাজা প্রাণ।

বন্ধু, এখানে রাজা-প্রজা নাই, নাই দরিদ্র ধনী,

হেথা পায় নাক’ কেহ রোধ ঘাঁটা কেহ দুধ-সর-ননী।

অৰ-চরণে, মােটর চাকায় প্রণমে না হেথা কেহ,

ঘৃণা জাগে নাক সাদাদের মনে দেখে হেথা কালা দেহ।

নাইকো পাইক-বরকন্দাজ, নাই পুলিশের ডর।

এই যে স্বর্গ, এই সে বেহেস্ত, এখানে বিভেদ নাই,

যত হাতাহাতি হাতে হাতে রেখে মিলিয়াছি ভাই ভাই।

নাইকো এখানে ধর্মের ভেদ, শাস্ত্রের কোলাহল,

পাদরী-পুরুত-মােল্লা-ভিরু এক সে খায় জল।”

কাজী নজরুলের সাহিত্যে গণচেতনা ও প্রেমের পাশাপাশি যে দিকটি ধ্বনিত হয়েছে তা হল, সর্বশ্রেণীর মানুষের প্রতি গভীর মমত্ববােধ। ‘অগ্রনায়ক’ কাব্যের ‘ট্রেড শাে’ কবিতায় হিন্দু-মুসলমানের মিলন-বন্দনা কবির চেতনায় প্রতিধ্বনিতঃ-

“হিন্দু মুসলমানের এমন মিলন

দেখিনি আর, বিড়িওলা আর অফিসের বাবু।

হয়ে গেছে একাকার। টিকিতে দাড়িতে জড়াজড়ি হয়,

ছড়াছড়ি পান বিড়ি, কোর্ট প্যান্ট লুঙ্গি ধুতি ঠাসাঠাসি

সারা ফুটপাত সিঁড়ি।”

‘অগ্রনায়ক কাব্যের ‘রবিহারা’, ‘তীর্থপথিক’, ‘দেশপ্রিয় যতীন্দ্রমােহনের তিরােধান’, ‘গৃহ-মঙ্গল’ কবিতায় কবির মাঙ্গলিক গীতির সুর সর্বত্র ধ্বনিত। সঙ্কীর্ণ চিত্তবৃত্তির পরিবর্তে তিনি উদার মনােভাব নিয়ে শ্রদ্ধার প্রদীপ জ্বালিয়েছেন।

ধর্মকে কাজী নজরুল দেখেছেন আনুভূমিক প্রকাশের শুভ্র আদর্শময় দিক হিসাবে। ধর্মভ্রষ্ট অর্থে তার কাছে আদর্শহীনতা ও হৃদয়ের ব্যভিচার। ‘শেষ সওগাত’ কাব্যের ‘গোঁড়ামি ধর্ম নয়’ কবিতায় কবির এই মনােভাবের স্বাক্ষর মুদ্রিতঃ-

“শুধু গুণ্ডামী ভণ্ডামী আর গোঁড়ামি ধর্ম নয়,

এই গোঁড়াদেরে সর্বশাস্ত্রে শয়তানী চেলা কয়।

এক যে স্রষ্টা সব সৃষ্টির এক সে পরম প্রভু,

একের অধিক সৃষ্টী কোন সে ধর্ম কহে না কভু।”

বিংশ শতাব্দীর ঔপনিবেশিক সমাজব্যবস্থায় ভারতীয় আবহাওয়ায় কাজী নজরুল – মানস লালিত পালিত ও বর্ধিত। এখানে ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক চেতনা রাজনৈতিক চেতনা অপেক্ষা প্রবল। তাই সামাজিক বিভেদ দূর করার জন্য তিনি ধর্মকে যুক্তি দিয়ে বিচার করেছেন। এখানে সমগ্র ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর সমাজ-সংস্কার প্রয়াস মূলত যুক্তিশীল ধর্মপ্রবণতার ছকে বাঁধা। এই যুক্তিশীল ধর্মপ্রবণতাকে—কাজী আবদুল ওদুদ, অধ্যাপক মুহম্মদ আবদুল হাই ও ডঃ অরবিন্দ পােদ্দার—ভারতীয় সুফী-সাধক ও ঋষিদের শিক্ষাজাত বলতে চেয়েছেন। মধ্যযুগের সুফী ও ঋষিগণ ছিলেন নির্বিরােধ, পলায়নী মনােবৃত্তিসম্পন্ন। তাদের চিন্তাধারা ঈশ্বর, পরকাল, আত্মা, অদৃষ্টের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। আজও পাক-ভারতীয় বহু হিন্দু মুসলিম বুদ্ধিজীবী ধর্মনিরপেক্ষ চিন্তায় অক্ষম। যে বিবেকানন্দ ও গান্ধীকে কাজী নজরুল  শ্রদ্ধা করেছেন তারাও সামাজিক-সমস্যা সমাধানে ধর্মনিরপেক্ষ মানসিকতার পরিচয় দিতে পারেননি। প্রাচ্য তথা ভারতবাসী নাকি incorrigibly religions’ (সংশােধনাতীতভাবে ধর্মপরায়ণ)। ই এফ এভুজ ও গিরিজা মুখার্জী তাঁদের ‘দ্য রাইজ অ্যান্ড গ্রোথ অফ দ্য কংগ্রেস ইন ইন্ডিয়া’ নামক বইতে বলেন,

“..in India more than any other country we have always to notice those movements which spring directly out of the religious spirit of the people. One writer has even said that Indians are “incorrigibly religious.”

তাই সাম্প্রদায়িক মনােবৃত্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে গিয়ে কাজী নজরুল ধর্মের উদারতর ব্যাখ্যার আশ্রয় নিয়েছেন। তাঁর কাব্যে যে সাম্যবাদ, গণতান্ত্রিকতা, মানবতাবােধ উদার মানসিকতা ও সংগ্রামী চেতনা দেখি তা মধ্যযুগের ভারতীয় সুফী বা ঋষিরা কল্পনা করতে পারেন না।

ধর্মান্ধ মানুষ সমাজ-জীবনে হঠাৎ বিপ্লবী কর্মপন্থা গ্রহণ করতে সঙ্কুচিত হয়। তাই কাজী নজরুল সময় সময় ধর্মীয় মনােবৃত্তিকে আঘাত করেও ধর্ম ও যুক্তির মধ্যে সমন্বয় সাধন করার চেষ্টা করেছেন। ধর্মের উদার ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি সংস্কারান্ধ জনচিত্তকে আলােকিত করার চেষ্টা করেছেন। ধর্মের নৈতিক শিক্ষা মানুষের চিরকালের শ্রদ্ধেয় সম্পদ। প্রকৃতপক্ষে সাম্যবাদী চিন্তা তার মানসলােকে সম্প্রদায়িক-নিরপেক্ষ মানবসত্তার জন্ম দিয়েছে— হিন্দু-মুসলমান বৈপরীত্যের দ্যোতক না হয়ে তার চেতনায় হতে পেরেছে জাতিসত্তার পরিপূরক দুই প্রান্ত। তাই প্রকৃত সাম্যবাদীর মতাে তিনি বলেন—

“কাটায়ে উঠেছি ধর্ম-আফিম নেশা

ধ্বংস করেছি ধর্মযাজকী পেশা,

 ভাঙি মন্দির, ভাঙি মসজিদ,

ভাঙিয়া গির্জা গাহি সঙ্গীত,

এক মানবের একই রক্ত মেশা।

কে শুনিবে আর ভজনালয়ের হ্রেষা।”

এই সাম্প্রদায়িক চেতনা তাকে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে প্রয়াসী, এই কারণে তিনি হিন্দু-মুসলমান উভয় ধর্মের সঙ্কীর্ণতাকে আঘাত করতে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠিত হননি। কাজী নজরুল ধর্মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেননি, বিদ্রোহ করেছেন ধর্মব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে। একালে যেমন, সেকালেও তেমনি, ধর্মকে শােষণের অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। তাই ভন্ড মােল্লামৌলভী আর পুরােহিতের বিরুদ্ধে সংগ্রামে তিনি ছিলেন সােচ্চার। তিনি লিখেছেন, “হিন্দুত্ব মুসলমানত্ব দুই সওয়া যায়, কিন্তু তাদের টিকিত্ব দাড়িত্ব অসহ্য, কেননা ঐ দুটোই মারামারি বাধায়। টিকিত্ব হিন্দুত্ব নয়, ওটা হয়ত পন্ডিত্ব। তেমনি দাড়িত্ব ইসলামত্ব নয়, ওটা মােল্লাত্ব। এই দুই ‘ত্ব’ মার্কা চুলের গােছা নিয়েই আজ এত চুলােচুলি। আজ যে মারামারিটা বেঁধেছে সেটাও এই পন্ডিত-মােল্লায় মারামারি, হিন্দু-মুসলমানের মারামারি নয়।…অবতার পয়গম্বর কেউ বলেননি, আমি হিন্দুর জন্য এসেছি, আমি মুসলমানের জন্য এসেছি, আলাের মতাে, সকলের জন্য। কিন্তু কৃষ্ণের ভক্তেরা বললে, কৃষন হিন্দুর মুহম্মদের ভক্তেরা বললে, মুহম্মদ মুসলমানদের খ্রীষ্টের শিষ্যেরা বললে, খ্রীষ্ট ত্রীশ্চানদের। কৃষ্ণ-মুহম্মদ-খ্রীষ্ট হয়ে উঠলেন জাতীয় সম্পত্তি। আর এই সম্পত্তি নিয়েই যত বিপত্তি। আলাে নিয়ে কখনাে ঝগড়া করে না মানুষে, কিন্তু গরু-ছাগল নিয়ে করে।”১৩ ‘সর্বহারা কাব্যের ‘আমার কৈফিয়ত’ কবিতায়ও তার স্বাক্ষর বিধৃত—

“মৌ-লােভী যত মৌলবী আর মােল-লারা কন হাত নেড়ে,

দেবদেবী নাম মুখে আনে সবে দাও পাজিটার জাত মেরে!

ফতােয়া দিলাম-কাফের কাজীও, যদিও শহীদ হইতে রাজীও!

‘আমপারা’ পড়া হামবড়া মােরা এখনাে বেড়াই জাত মেরে!

হিন্দুরা ভাবে, পার্সী শব্দে কবিতা লেখে, ও পাত নেড়ে।”

ধর্মের নামে হীনম্মন্যতার প্রতি কাজী নজরুল ছিলেন খড়গহস্ত। ধর্মীয় সঙ্কীর্ণতাকে অধর্মের দৃষ্টিতে দেখে তার স্বরূপ উদঘাটনে প্রয়াসী হয়েছেন। ধর্ম মানুষের মনের ওপর যে সঙ্কীর্ণতার পরিধি গড়ে তুলেছে তার ওপর আঘাত করে তিনি মানুষকে প্রকৃত ধর্ম সাধনায় রত হতে আহ্বান জানিয়েছেন। ‘সন্ধ্যা’ কাব্যের ‘শরৎচন্দ্র’ কবিতার উদ্ধৃতি দিলেই কাজী নজরুলের এই মনােভাব স্পষ্ট হবে—

“ধর্মের নামে যুধিষ্ঠির

ইতি গজে’র করুন ভান! সব্যসাচী গাে, ধর ধনুক —

হার প্রখর অগ্নিবীণা ! পথের দাবী’র অসম্মান

হে দুর্জয়, কর গাে ক্ষয় ! দেখাও স্বর্গ তব বিভায়

এই ধুলাের উর্ধে নয়।”

কাজী নজরুল কবিতার মধ্য দিয়ে বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়কে সমসারিতে অধিষ্ঠিত করে সবার মধ্যে মনুষ্যত্ব ও মানবতার উদ্বোধন কামনা করেছেন। অন্যদিকে ধর্মীয় সঙ্কীর্ণতা পরিহার করে মানুষের শুদ্ধতম হৃদয়ের প্রকাশের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। তার কবিতায় মুসলিম ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে হিন্দু ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি সমান প্রাধান্য পেয়েছে। কাজী নজরুল  ছাড়া অন্য কোন কবি হিন্দু ও মুসলিম সংস্কৃতির সংমিশ্রনে অগ্রসর হননি। তিনি কাবা, হজরত আবুবকর, ওসমান, মসজিদের পাশাপাশি অন্তর্ভুক্ত করেছেন হিন্দুদের বিভিন্ন দেব-দেবী ও পৌরাণিক চিত্রকল্প। এছাড়া কাব্য, উপন্যাস, নাটিকায় অসংখ্য হিন্দু চরিত্র অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। বৈশিষ্ট্যের অনুসঙ্গে। অন্যদিকে কবিতায় রূপক, উপমা ও চিত্রকল্পে হিন্দু-পুরান অবশ্যম্ভাবী উপাদান হিসাবে তাঁর কাব্যে অন্তর্ভুক্ত। সাম্প্রদায়িকতার সঙ্কীর্ণ আবরণ দূরে সরিয়ে তিনি মানুষকে সমবেত করেছেন মহামানবের তীর্থধামে। প্রার্থনা কবিতায় হিন্দুমুসলমানের মিলিত ধর্মীয় অনুভব প্রকাশিত—

“পূর্ণ পরম আল্লাহ! হে পূর্ণ

করুন ভগবান!

আমাদের নিত্যবন্ধু!

আমাদের সর্বদেহ তােমার মতই

সুন্দর করে দাও।”

আসলে কাজী নজরুল তাঁর সাহিত্যে হিন্দু ও ইলাম ধর্ম, সভ্যতা, সংস্কৃতি, সাহিত্য, দর্শন, দেশাত্মবােধ, স্বাধীনতা-সংগ্রামচিন্তা, ভারতীয়ত্ব এবং বাঙালিয়ানাকে এমন ঐক্যসূত্রে বেঁধে তুলেছেন যার কোন তুলনা আমাদের দেশে নেই। তিনি যেন এক দেবদূত যিনি হিন্দু-মুসলমান-খ্রিস্টান, জৈন-বৌদ্ধ-শিখ ও পারসিক ধর্মসম্প্রদায় নির্বিশেষে সকল মানুষের অন্তরে প্রবেশ করে তাদের অন্তর্জীবনের ব্যাথাবেদনাকে ও বহির্জীবনের সমস্যাকে প্রীতি দিয়ে, সমবেদনা দিয়ে ও আন্তরিক স্পর্শ দিয়ে অনুভব করে তা দূরীভূত করার চেষ্টা করেছেন। কবি সত্যেন্দ্রনাথের অনুরাগী ভাবশিষ্য কাজী নজরুল ও বলতে চেয়েছেন যে, “জগৎ জুড়িয়া আছে এক জাতি সে জাতির নাম মানুষ জাতি। এক পৃথিবীর স্তন্যে লালিত, একই রবি শশী মােদের সাথী।” তিনি সর্ব বিশ্বমানব সমাজের উদ্দেশ্যে আরও লিখেছেন—

“আদম দাউদ ঈশা মুসা ইব্রাহিম মােহাম্মদ

কৃষ্ণ বুদ্ধ নানক কবির, বিশ্বের সম্পদ,

আমাদেরই এঁরা পিতা-পিতামহ, এই আমাদের মাঝে

তাদেরি রক্ত কম-বেশী করে প্রতি ধমনীতে রাজে!”

এই মানবতাবােধ থেকেই কাজী নজরুল হিন্দু-মুসলমান মৈত্রীর বাণী প্রচার করেছেন। কবির মতে, শাস্ত্র না ঘেটে ডুব দাও সখা, সত্যসিন্ধু জলে’ কেননা—

“মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান

নাই দেশ কাল পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্মর্জাতি

সব দেশে সব কালে ঘরে ঘরে তিনি মানুষের জাতি।”

(৯)

বিদায় ভাষণে হযরত মােহাম্মদ (সঃ) যে ভাষণ দান করেন সেই ভাষণেই সুস্পষ্টভাবে তিনি ধর্মীয় সম্প্রদায় নির্বিশেষে নির্যাতিত মানুষের প্রতি সকল অবিচার ও অত্যাচার ধ্বংস করার আমন্ত্রণ জানান। তার অভিভাষণেই শ্রেণিবৈষম্য, বর্ণবৈষম্য, শােষণ, নিপীড়ন ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে বৈপ্লবিক বাণী উচ্চারণ করেন। মানুষকে পূর্ণ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করার এই আদর্শ কাজী নজরুল কে অনুপ্রাণিত করেছিল এবং কাজী নজরুল  তার অনেক কবিতায় সেই আদর্শের বাণী প্রচার করেছেন। এখানে দু-একটি উদ্ধৃতি দেওয়া যেতে পারে,

১)

“ধর্মের পথে শহীদ যাহারা, আমরা সেই সে জাতি৷

সাম্যমেত্রী এনেছি আমরা বিধে করেছি জ্ঞাতি

আমরা সেই সে জাতি।।

পাপবিদগ্ধ তৃষিত ধরার লাগিয়া আনিল যারা

মরুর তপ্ত বক্ষে নিঙাড়ি শীতল শান্তিধারা

উচ্চ-নীচের ভেদ ভাঙি নিল সবারে বক্ষে পাতি ।।

নারীরে প্রথম দিয়াছি মুক্তি নর-সম, অধিকার

মানুষের গড়া প্রাচীর ভাঙিয়া করিয়াছি একাকার

আঁধার রাতির বােরকা উতারি’ এনেছি আমার ভাতি।।”

২)

“ইসলাম বলে, সকলের তরে মােরা সবাই,

সুখ-দুখ সম-ভাগ করে নেব সকলে ভাই,

নাই অধিকার সঞ্চয়ের!

কারাে আঁখি-জলে কারাে ঝড়ে কিরে জ্বালিয়ে দীপ।

দু’জনার হবে বুলন্দনসিব, লাখে লাখে হল ব-নসিব?

এ নহে বিধান ইসলামের।।”

কবি কাজী নজরুল যে মনে-প্রাণে কত বড় সাম্যবাদী-আদর্শে অনুপ্রাণিত কবি ছিলেন তা উপরিউক্ত কবি-বচনেই বােঝা যায়। মানুষের হৃদয়কে তিনি দেবতার পীঠস্থান ও পুণ্যভূমি বলে মনে করতেন বলেই হৃদয়ের মধ্যে তিনি সবকিছুরই অবস্থান দেখেন। এই সর্বধর্ম সমন্বয়ের ভাবনা সাম্যবাদীদের আদর্শ ধর্ম। মানুষের হৃদয়ে এভাবে সবকিছু অধিষ্ঠানের কথা বলে পরােক্ষ কবি কাজী নজরুল তার আন্তর্জাতিক সাম্যবাদের জ্বলন্ত ছবিটিকেই ফুটিয়ে তুলেছেন। হৃদয়ের সাধনাই হলাে আসল সাধনা। হৃদয়ই তাে দেয় মানুষে-মানুষে ভেদাভেদ মুক্তির সন্ধান, অমােঘ প্রেম-প্রীতি-ভালােবাসার মিলনের অমৃতবাণী। কবি কাজী নজরুল দীপ্তকণ্ঠে তাই বলতে দ্বিধা করেন না আমাদের এ কথা বলতে,

“এই রণ-ভূমে বাঁশরী কিশাের গাহিলেন মহাগীত,

এই মাঠে হ’ল মেঘের রাখাল নবীরা খােদার মিতা।

এই হৃদয়ের ধ্যান-গুহা-মাঝে বসিয়া শাক্যমুনি

ত্যাজিল রাজ্য মানবের মহা-বেদনার ডাক শুনি।

এই কন্দরে আরব-দুলাল শুনিতেন আহ্বান,

এইখানে বসি’ গাহিলেন তিনি কোরানের সাম-গান !

মিথ্যা শুনিনি ভাই,

এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোনাে মন্দির-কাবা নাই!”

‘কোরাণ-পুরাণ-বেদ-বেদান্ত-বাইবেল-ত্রিপিটক-জেন্দাবেস্তা-গ্রন্থসাহেব’ সমস্ত কিছুকে করায়ত্ত করে কবি এক মহাসমন্বয়ের বাণী শুনিয়েছেন। মানুষের হৃদয়ই সর্বশ্রেষ্ঠ তীর্থত্রে—

“এই হৃদয়ই সে নীলাচল, কাশী, মথুরা, বৃন্দাবন,

বুদ্ধগয়া এ, জেরুজালেম এ, মদিনা, কাবা-ভবন,

মসজিদ এই, মন্দির এই, গীর্জা এই হৃদয়।”

তিনি মানুষের মুক্তির জন্য আজীবন সংগ্রাম করেছেন। তার জন্য কবিতা আর সংগ্রাম একই অর্থবােধক। হিন্দুর মুক্তি কাকে বলে, মুসলমানের মুক্তি কাকে বলে সে সব তিনি বুঝতেন না। তিনি বুঝতেন, এদেশ স্বাধীন হবে, মাটির পৃথিবীর মানুষের মধ্যে বৈষম্য কমে যাবে। মানুষ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জীব হিসাবে নিজেকে প্রমাণ করবে। মানবিকতার সুপ্তবীজ জীবন যাপনের প্রতিটি ধারার সঙ্গে তার ভাবলােকে এমন স্থায়ী আসন করে নিয়েছিল যে, হিন্দু-মুসলমানের ঐক্যের মাধ্যমে জাতি ও দেশের মুক্তি আ০সতে পারে—এই বিশ্বাসে তিনি সবসময় অবিচল ছিলেন। ১৩৩৩ সনের ৯ আধিনে রচিত হয়েছে ব্যঙ্গ-বিব্ধমূলক কবিতা ‘হিন্দু-মুসলিম যুদ্ধ’। এই কবিতার রাজনৈতিক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষিতেও রয়েছে উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যকার রক্তাক্তি হাঙ্গামার কথা। ব্যঙ্গ-বিদ্রুপে ঠাসা এই কবিতা তার মানবিক গুণাবলীর কেবল পরিচয় বহন করছে না, হিন্দু-মুসলিম বিরােধ তাদের পরাধীনতাকেও দীর্ঘায়িত করছে—

“মাভৈঃ মাভৈঃ এতদিনে বুঝি জাগিল ভারত প্রাণ,

সজীব হইয়া হইয়া উঠিয়াছে আজ শ্মশান গােরস্থান!

ছিল যার চির-মরণ-আহত, উঠিয়াছে জাগি’ ব্যথা-জাগ্রত,

খালেদ আবার ধরিয়াছে অসি, অৰ্জুর্ণ ছােড়ে বাণ।

জেগেছে ভারত, ধরিয়াছে লাঠি হিন্দু-মুসলমান!”

মরিছে হিন্দু, মরে মুসলিম এ উহার ঘায়ে আজ,

বেঁচে আছে যারা মরিতেছে তারা, এ-মরণে নাহি লাজ।

তােদেরি আঘাতে টুটেছে তােদের মন্দির-মসজিদ,

পরাধীনদের কলুষিত করে উঠেছিল যার ভিত।

হেরিবে মেরেছে আপনার ভায়ে বদ্ধ করিয়া দ্বার।

ভারত-ভাগ্য করেছে আহত ত্রিশূল ও তরবার।।।

করুক কলহ-জেগেছে তাে তবু-বিজয়-কেতন উড়া।

ল্যাজে তাের যদি লেগেছে আগুন, স্বর্ণলঙ্কা পুড়া!”

এই কবিতায় যে শ্লেষ ও তির্যক ব্যঙ্গ দৃষ্টিকোণটি কাজী নজরুল ব্যবহার করেছেন, তার প্রেক্ষাপটেও আছে ঔপনিবেশক শাসন নির্যাতন আর বিভেদ রচনার ইংরেজদের কূটকৌশল। সমসাময়িক বিষয় হলেও এই কবিতার অন্তনিহিত বাস্তবতা লুকিয়ে আছে। লর্ড ক্লাইভের চতুর সাম্রাজ্যবাদী প্রশাসন ক্রিয়ার মধ্যে। হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যেকার সহাবস্থান, সহমর্মিতা ও সাম্প্রদায়িকতাবিমুখ সামাজিক পরিবেশকে কলুষিত করে তােলে ক্লাইভ। দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে এই বিষ ঢুকিয়ে দিয়ে দুই ধর্মের মানুষদের পরস্পরকে সম্মুখ সমরে প্রতিস্থাপন করে। অবিবাস থেকেই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে মানসিক বিভেদ ও দাঙ্গা পরিস্থিতির সূচনা হয়। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের মাধ্যমে এর সূচনা এবং ১৯১১ সালের ডিসেম্বরে বঙ্গভঙ্গরদ করে এর সূচীমুখকে বিস্ফোরণমুখ সন্দেহে মুড়িয়ে দেওয়া হয়। ১৯১৪ সালে প্রথম মহাসমরের কারণে জাতীয়তাবাদী রাজনীতিকদের টোপ গিলিয়ে সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ সরকার সেই যুদ্ধে ভারতীয় রাজনীতিকদের সমর্থন আদায় করে নেয়। এদিকে হিন্দু ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায়কে একটি রাজনৈতিক প্যাক্টের মধ্যে ঐক্যবদ্ধ করা গেলেও কিছু কংগ্রেসী গোঁড়া নেতার একদেশদর্শী নীতি ও গােয়ার্তুমির ফলে সেই প্যাক্ট ভেঙ্গে যায়। পুনরায় দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে সন্দেহ দানা বাঁধে এবং পরস্পর সাম্প্রদায়িক হানাহানি, রক্তারক্তি আর বিরােধে পরাধীনতার -নিকে আপনাপনা সম্প্রদায়ের অঙ্গীভূত করে নেয়। কেন না, তারা প্রকৃত শত্রু ইংরেজদের ভেদ-নীতি উপলব্ধি করতে পারছে না।

কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্যে হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতি ও মানবতার স্বরূপ
চিত্রঃ লর্ড ক্লাইভ, Image Source: alamy

‘পথের দিশা’ কবিতায় সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের নেপথ্য কারণ কবির অনুভবে ধরা দিয়েছিল,

“জাতির পরাণ সিন্ধু মথি স্বার্থলােভী পিশাচ যারা

সুধার পাত্র লক্ষ্মীলাভের করতেছে ভাগ-বাঁটোয়ারা,

বিষ যখন আজ উঠল শেষে তখন কারুর পাইনে দিশা,

বিষের জ্বালায় বিপুড়ে, স্বর্গে তারা মেটান তৃষা!”

ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গার হানাহানির মধ্যে ভবিষ্যতের আশার আলাে কবি দেখতে পান। অজ্ঞতার অন্ধকার দূর হলেই সচেতন মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে প্রকৃত শত্রুর বিরুদ্ধে উৎসাহিত করা যায়।

হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে বন্ধুত্বসুলভ সদ্ভাব সৃষ্টি করাই তার একমাত্র আকাঙ্খা। তাঁর বাসনা ছিল উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রীতির বন্ধন তৈরী করা। কিন্তু বাস্তব জীবনে এর বিপরীত চিত্র তার মনে বিব্ধ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। তবে উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সংঘাত-সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে উঠলেও, তার এ ধরনের আকাঙ্খার অপমৃত্যু ঘটেনি। বরং মৃত্যুর বিভীষিকাময় ময়দানে দাঁড়িয়েও তার মন নতুন স্বপ্ন-রচনায় তৎপর থেকেছে। তাইতাে পরাধীনতার শৃঙ্খল মুক্তির লক্ষে হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায় তাদের নিজ নিজ ভুল সংশােধনের মাধ্যমে, আবার সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে,—এ প্রত্যাশা থেকে তিনি এক মুহূর্তের জন্যও নিজেকে দূরে রাখতে পারেননি।

“যে লাঠিতে আজ টুটে গম্বুজ, পড়ে মন্দির চূড়া,

সেই লাঠি কালি প্রভাতে করিবে শত্রু-দুর্গ গুড়া !

প্রভাতে হবে না ভায়ে ভায়ে রণ,

চিনিবে শত্ৰু, চিনিবে স্বজন।

করুক কলহ—জেগেছে তাে তবু—বিজয় কেতন-উড়া!

ল্যাজে তাের যদি লেগেছে আগুন, স্বর্ণলঙ্কা পুড়া!”

(‘ফণিমনসা’ ‘হিন্দু-মুসলিম যুদ্ধ’) কবির মধ্যে অসাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনার যে বিকাশ, তার পিছনে সবচেয়ে বেশি কার্যকর ভূমিকা রেখেছে পরাধীন দেশমাতৃকার মুক্ত-চিন্তা। তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন, হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে বিরাজিত সম্প্রদায়গত বিরােধ ও কলহবিবাদ মুক্তি আন্দোলনের পথকে দীর্ঘায়িত করছে। এই বােধ থেকেই তার হৃদয়ে উৎসারিত উচ্চারণ ভারতবাসীকে জাগরিত করার অভিপ্রায়ে মুখরিত হয়েছে। হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সম্প্রীতি সৃষ্টি এবং এ সম্প্রীতিকে সুদৃঢ় রূপ দেওয়ার জন্য তার মধ্যে যে অসাম্প্রদায়িক মনােভাবের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়, তার উৎসও মূলত তার নিখাদ দেশাত্মবােধ—

“বিশ্ব ছিড়ে আনতে পারি, পাই যদি ভাই তােদের প্রাণ।

মেঘ-বাদলের বজ্র বিষাণ (আর) ঝড়-তুফানের লাল নিশান।।”

(‘ভাঙার গান’ ‘মিলন-গান’) আমরা দেখি, অসহযােগ আন্দোলন বস্ত্রশিল্পে স্বাবলম্বী হওয়ার যে মন্ত্র এ দেশীয় মানুষের অন্তরে ছড়িয়ে দিয়েছিল, তারই সমর্থনে রচিত হয়েছে কাজী নজরুলের ‘চরকার গান’ কবিতা। অবশ্য তাঁর পূর্বসূরী কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত (১৮৮২-১৯২২)-ও এ বিষয়ে কবিতা রচনা করেছেন। সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের সে কবিতা জাতিকে আত্মপ্রতিষ্ঠার সংগ্রামে উজ্জীবিত করার আবেদন সংবলিত। কাজী নজরুলের কবিতায় সেই সুর ধ্বনিত হলেও তার কবিমন আরও এক ধাপ এগিয়ে গিয়েছে। তাই তিনি বেশি করে অনুভব করেছেন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কথা। হিন্দু-মুসলমানের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আত্মপ্রতিষ্ঠা ও স্বাধীনতার সংগ্রাম যে বেগবান হতে পারে, একথা তিনি অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। তার ‘চিরকার গান’-এ ধ্বনিত হয়েছে নতুন দিনের নতুন আশার বাণী এবং অনাগত ভবিষ্যতের সুর-সঙ্গীত। সে সঙ্গীতের মূলমন্ত্র হল হিন্দু-মুসলমানের সম্মিলিত প্রচেষ্টা ও সম্প্রীতিপূর্ণ সহাবস্থান—

“হিন্দু-মুসলিম দুই সােদর,

তাদের মিলন-সূত্র ডাের রে

রচলি চক্রে তাের,

তুই ঘাের ঘাের ঘাের।”

জাতিগতভাবে আমরা যদি নিজেদের সংশােধন করার চেষ্টা না করি, নিজেদের মধ্যে ভেদাভেদের পরিমণ্ডল আমরা যদি ক্রমাগত জিইয়ে রাখি, তাহলে নিজেদের উন্নত করব কিভাবে? সাম্রাজ্যবাদ তার সঙ্কটের দিনে এই উপমহাদেশে যে অস্থিরতা তৈরি করে ঘােলাজলে মাছ ধরতে চেয়েছিল তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে হিন্দু ও মুসলমানকে সর্তক করে কাজী নজরুল লিখেছিলেন,

“ঘর সামলে নে এই বাে তােরা ওরে ও হিন্দু-মুসলিম!

আল্লা ও হরি পালিয়ে যাবে না, সুযােগ পালালে মেলা কঠিন!

ধর্ম-কলহ রাখ দু’দিন!

নখ ও দন্ত থাকুক বাঁচিয়া

গভূষ ফের করিবি কঁচিয়া,

আসিবে না ফিরে এই সুদিন!

বদনা-গাড়ুতে, কেন ঠোকাঠুকি, কাছা কোঁচা

টেনে শক্তি ক্ষীণ,

সিংহ যখন পঙ্ক-লীন।…

আল্লা ও হরি পালিয়ে যাবে না,

সুযােগ পালালে মেলা কঠিন।

ধর্ম-কলহ রাখ দু’দিন।

শত্রুর গােরে গলাগলি কর আবার হিন্দু-মুসলমান।

বাজাও শঙ্খ, দাও আজান।”

(‘ফণি-মনসা’ ‘যা শত্রু পরে পরে’)। হিন্দু-মুসলমানের বিভেদ যে দেশের জন্য কত ক্ষতিকর তা তিনি বুঝেছিলেন বলেই গাইতে পেরেছিলেন,

“ভারতের দুই নয়নতারা হিন্দু-মুসলমান।

দেশ জননীর সমান প্রিয় যুগল সন্তান।।

তাই ত মায়ের কোল নিয়ে ভাই ভা’য়ে বাধে লড়াই

এই কলহের হবেই হবে মধুর অবসান।

এক দেশেরই অন্নজলে এক দেহ এক প্রাণ।..

বিবাদ করে এনেছি ভাই অনেক অকল্যাণ,

মিলনে আজ উঠুক জেগে নব-হিন্দুস্থান! জেগে উঠুক হিন্দুস্থান।।”

আমরা আগেই দেখেছি, ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে লড়লেও কাজী নজরুল বা তার সাহিত্য ইসলাম-বিরুদ্ধ ছিল না। তবে তিনি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অবশ্যই ছিলেন। কাজী নজরুল বলেছেন, ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ বলা ঠিক হয় না, বলা উচিত আল্লাহ জিন্দাবাদ।’ উক্তিটি ‘শেষ সওগাত’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত ‘এক আল্লাহ জিন্দাবাদ’ কবিতায় করা হয়েছে। ওই কবিতার শুরুতেই আছে।

“উহার প্রচার করুক হিংসা বিদ্বেষ আর নিন্দাবাদ

আমরা বলিব, সাম্য, শান্তি, এক আল্লাহ জিন্দাবাদ।”

এ কবিতায় তিনি আরও বলেছেন,

“দাঙ্গা বাধায়ে লুট করে যারা, লােভী তারা গুণ্ডাদল

তারা দেখিবে না আল্লার পথ চিরনির্ভয় সুনির্মল। …

তাড়াবে ওদের দেশ হতে মেরে আল্লার অনাগত সেনা,

এরাই বৈশ্য, ফসল শস্য লুটে খায়, এরা চিরচেনা।”

কবি তার অসাধারণ অন্তদৃষ্টির সাহায্যে বুঝেছিলেন পাকিস্তানে মূলত বৈশ্যদেরই রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে এবং তারা সেখানে ফসল শস্য লুটে’ খাবে। শেষ সওগাতে অন্তর্ভুক্ত এর পরের কবিতা ‘গোঁড়ামি ধর্ম নয়’তে বিষয়টি আরও স্পষ্ট ও বিস্তৃতভাবে ব্যাখ্যাত হয়েছে। এ কবিতার নিম্নোবৃত অংশ পড়লেই বােঝা যায় কবির দৃষ্টিভঙ্গিটি কী ছিল এবং কেন তিনি পাকিস্তানকে সমর্থন করেননি,

“কেন কেহ হয় চিরদরিদ্র, কেহ চিরধনী হয়,

কেন কেউ অভিশপ্ত, কাহারও জীবন শান্তিময়?

কোন্ শাস্ত্রী বা মৌলানা, বলাে জেনেছে তাহার ভেদ’?

গাধার মতন বয়েছে ইহারা শাস্ত্র কোরান বেদ!…

যাহারা গুণ্ডা, ভণ্ড তারাই ধর্মের আবরণে

স্বার্থের লােভে খ্যাপাইয়া তােলে অজ্ঞান জনগণে

জাতিতে জাতিতে ধর্মে ধর্মে বিদ্বেষ এরা আনি

আপনার পেট ভরায়, তখত চায় এরা শয়তানি।

ধর্ম-আন্দোলনের ছদ্মবেশে এরা কুৎসিত,

বলে, এরা, হয়ে মন্ত্রী, করিবে স্বধর্মীদের হিত।

ধর্ম জাতির নাম লয়ে এরা বিষাক্ত করে দেশ,

এরা বিষাক্ত সাপ, ইহাদের মেরে কর সব শেষ।

নাই পরমতসহিষ্ণুতা সে কভু নহে ধার্মিক,

এরা রাক্ষস-গােষ্ঠী ভীষণ অসুর-দৈত্যাধিক।

উৎপীড়ন যে করে, নাই তার কোনও ধর্ম জাতি,

জ্যোতির্ময়ের আড়াল করেছে, এরা আঁধারের সাথি…

মােরা দরিদ্র কাঙাল নির্যাতিত ও সর্বহারা,

মােদের ভ্রান্ত দ্বন্দ্বের পথে নিতে চায় আজ যারা

আনে অশান্তি উৎপাত আর খোঁজে স্বার্থের দাঁও,

কোরানে আল্লা এদেরই কন-শাখামৃগ হয়ে যাও।”

(১০)

কাজী নজরুল শুধু হিন্দু-মুসলমানের মিলনের সাহিত্য রচনা করেননি (যে কথাটি সব সময়ই বলা হয়, কিন্তু যা সাধারণত বলা হয় না তা হচ্ছে এই যে), তিনি প্রথম থেকেই মুসলিম ঐতিহ্যভিত্তিক এবং হিন্দু ঐতিহ্যভিত্তিক কবিতা লিখে আসছেন। ‘মােসলেম ভারত’ পত্রিকায় যখন তিনি মুসলিম ঐতিহ্যভিত্তিক কবিতা লিখছেন, তখনই হিন্দু ঐতিহ্যভিত্তিক কবিতা লিখছেন ‘উপাসনা’ পত্রিকায়। এই সবই তিরিশের দশকের ঘটনা—যখন তিনি একই সঙ্গে ইসলামি গান এবং শ্যামা সংগীত (বা অন্য হিন্দু ঐতিহ্যভিত্তিক গান) লিখেছেন অঝােরে। সেই লেটোদলের যুগ থেকে শেষ পর্যন্ত কাজী নজরুলের একটি আবহমানতা ছিল— তার পূর্বেকার সৃষ্টিশীলতায় ছিল এক ছেদহীন বিদ্বেষহীন ধারাবাহিকতা।

মানুষের পরিচয় সম্পর্কে তার মধ্যে কোনও দলীয় চেতনার বেড়া ছিল না। তার মানবাত্মায় মানুষ আমার ভাই’ এই চিন্তাই মূর্ত হয়ে উঠেছিল। কবি এখানেই থেমে যাননি। বরং বিধের সকল দেশের সকল মানবের মহামিলনের মােহনায় দাঁড়িয়ে সকলকে এক হতে বাঁশী বাজিয়েছেন ‘কুলি মজুর’ কবিতায় এভাবে,

“সকল কালের সকল দেশের সকল মানুষ আসি।

এক মােহনায় দাঁড়াইয়া শুন এক মিলনের বাঁশী।

এক জনে দিলে ব্যথা

সমান হইয়া বাজে সে বেদনা সকলের বুকে হেথা।।

একের অসম্মান।

নিখিলের মানব-জাতির লজ্জা—সকলের অপমান!”

এতেই বােঝা যায় যে, কবি মনে করতেন দুর্বলতম ও প্রবলতম মানুষের সমান অধিকার থাকবে। সংস্কারের মধ্যে যারা বন্দী তাদের চিন্তাধারা ও উপলব্ধির সঙ্গে কাজী নজরুল কোনদিনই একাত্ম হতে পারেননি। আরও বিস্মিত হতে হয় যখন দেখি কবি জেলে যান কবিতা লিখে রাষ্ট্রদ্রোহিতার জন্য, আর সে কবিতা হিন্দু বাঙালির সবচেয়ে জনপ্রিয় দেবী দুর্গাকে নিয়ে। কবিতার নামও অনুরূপ, কিন্তু বিষয়বস্তু শাসকশ্রেণিকে আতঙ্কিত করে,

“আর কতকাল থাকবি বেটি মাটি ঢেলার মূর্তি আড়াল,

স্বর্গ যে আজ জয় করেছে, অত্যাচারী শক্তি চাড়াল

দেব শিশুদের মারছে চাবুক, বীর যুবাদের দিচ্ছে ফাঁসি

এর পরেও এলিনে মা, আসবি কখন সর্বনাশী ?”

(‘আনন্দময়ীর আগমন’)

মনের উদারতা ধর্ম-নিরপক্ষ তার ব্যাপ্তি কতদূর প্রসারিত হলে সম্পূর্ণ বিপরীত ধর্মীয় আবেগকে স্বাধীনতার আহ্বানে পরিণত করতে পারেন, বিশেষত যখন বাঙালি মুসলমান সমাজ, দেশমাতৃকাকে মাতৃরূপে, দেবীরূপে বন্দনা করাকে শুধু আপত্তির কারণ হিসাবে দেখেননি দেখেছেন ধর্ম বিরােধীরূপে। তখন হিন্দু বাঙালি নন্দিত দেবী দুর্গাকে দিয়ে নিন্দিত অত্যাচারী ইংরেজ অসুরকে দমনের (বধ করার) আহ্বান করেন, তখন তিনি মুসলমান সম্প্রদায়ের কাছে হন ধর্মদ্রোহী, ইংরেজ শাসকের কাছে চিরদ্রোহী হলেও হিন্দুর কাছে ধার্মিক এমন আখ্যা তিনি পান না। প্রকৃতপথে তার ভাবনার ঘেরাটোপে ঘুরে মরতে হয় বারবার। কী ভেবেছিলেন সর্বধর্ম সমন্বয়ের কথা? আমরা কি তাঁকে নাস্তিক এই মূল্যায়নে ভূষিত করব না তিনি একজন প্রকৃত সমাজবিপ্লবী যার মধ্য দিয়ে মূর্ত হয় আমরা এই বিশ্বের মাঝে গড়ব ‘রঙমহল’, এক নতুন সমাজ!

১৯২৯ সালে ১৫ই ডিসেম্বর এলবার্ট হলে (বর্তমান কফি হাউস) তিনি বলেছিলেন, “বিংশ শতাব্দীর অসম্ভবের সম্ভাবনার যুগে আমি জন্মগ্রহণ করেছি। এরই অভিযান সেনাদলের তুর্য-বাদকের একজন আমি—এই হােক আমার সব চেয়ে বড় পরিচয়। আমি জানি, এই পথযাত্রার পাকে পাকে বাঁকে বাঁকে কুটিল-ফণা ভুজঙ্গ প্রখর দর্শন শার্দুল পশুরাজের ভুকুটি। এবং তাদের নখর দংশনের ক্ষত আজো আমার অঙ্গে অঙ্গে। তবু ওই আমার পথ, ওই আমার গতি, ওই আমার ধ্রুব।”

১৯১৯ সালে এক। আনুষ্ঠানিক অভিনন্দনের উত্তরে তিনি বলেছিলেন, “আমি শুধু সুন্দরের হাতে বীণা, পায়ে পদ্মফুলই দেখিনি, তার চোখে চোখভরা জলও দেখেছি। শ্মশানের পথে, গােরস্থানের পথে, তঁাকে ক্ষুধাদীর্ণ মূর্তিতে, ব্যথিত পায়ে চলে যেতে দেখেছি। যুদ্ধ-ভূমিতে তাকে দেখেছি, কারাগারের অন্ধকূপে তাঁকে দেখেছি, ফাঁসির মঞ্চে তাঁকে দেখেছি। আমার গানে সেই সুন্দরকে রূপে রূপে অপরূপ করে দেখার স্তব-স্তুতি।”

 

কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্যে হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতি ও মানবতার স্বরূপ
চিত্রঃ বৃদ্ধ অবস্থায় কাজী নজরুল ইসলাম, Image Source: kavishala

যতক্ষণ অসুস্থ অচেতন হননি এই ধ্রুব বির্বাস নিয়ে কাব্য ও সঙ্গীত সাধনা করেছেন। এই বিশ্বাসে ‘পাকিস্তান’ দাবির অন্যতম প্রস্তাবক এ.কে ফজলুল হকের পত্রিকা ‘নবপর্যায় নবযুগ’-এর সম্পাদকের চাকরীর তােয়াক্কা না করে সম্পাদকীয় লিখেছিলেন পাকিস্তান না ফাকিস্থান। তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে মত প্রকাশ করেছিলেন—কেবল ধর্মের পরিচয়ে জাতির পরিচয় হয় না। সেদিন শহরে মুসলমানদের হুজুগের বিরুদ্ধে তিনি মত প্রকাশ করেছিলেন। ধর্মনিরপেক্ষে জাতীয়তাবােধকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছিলেন। অবশ্য তার জন্য তার উপর চাপ এসেছিল, অসুস্থ হয়ে পড়লে চিকিৎসার ব্যবস্থা হয়নি। আর্থিক সহায়তা পাননি। অথচ ভাগ্যের এমনি পরিহাস তাঁর মৃত্যু হয়েছে বাংলাদেশের নাগরিকরূপে। অবশ্য এই নাগরিকত্ব চাপানাে হয়েছে তাঁর অজ্ঞানে। ধর্মের ভিত্তিতে বিভক্ত ইসলামিক রাষ্ট্রের তিনি জাতীয় কবি ঘােষিত হয়েছিলেন, তাও তার অচেতন অবস্থায়। তাসত্ত্বেও ধর্মনিরপেক্ষতায় এবং বাঙালির জাতি চেতনায় কাজী কাজী নজরুলের নাম সর্বদা উল্লেখ্য হয়ে থাকবে। ধর্মের বন্ধন থেকে জীবনকে মুক্ত রাখার তিনি দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবেন। দুই বাংলার সাংস্কৃতিক সেতুবন্ধন হয়ে জনমনে জীবিত থাকবেন। তিনি ‘ধূমকেতু’ নিয়ে বাংলার সাহিত্য-গগনে উদয় হয়েছিলেন, লাঙ্গল’ ধরেছিলেন সাম্রাজ্যবাদী শৃঙ্খলমুক্ত প্রকৃত স্বাধীনতার জন্য ক্ষেত্র প্রস্তুতে, কৃষক শ্রমিকদের সঙ্ঘবদ্ধ করে শােষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষে। যুক্ত বাংলায় শ্রমিক পার্টি গঠনে, অর্থাৎ কমিউনিস্ট পার্টি গঠনের উদ্যোক্তাদের তিনিও একজন। বাঙালি এবং বাংলা সাহিত্য অবশ্যই এই ঋণ স্বীকার করবে। তার ধর্মনিরপেক্ষে ভাবমূর্তি প্রেরণা হয়ে থাকবে। প্রখ্যাত ছড়াকার অন্নদাশংকর রায় তাই লিখেছেন—

“ভুল হয়ে গেছে বিলকুল

আর সব কিছু ভাগ হয়ে গেছে

ভাগ হয়নিকো কাজী নজরুল।

এই ভুলটুকু বেঁচে থাক,

বাঙালী বলতে একজন আছে

দুর্গতি তার ঘুচে যাক।”

বাংলার বৌদ্ধিক-সাংস্কৃতিক-সাহিত্যিক জীবনে চির উন্নতশির কাজী নজরুল এক বিরল দৃশ্য ধূমকেতুর মতােই তুলনাহীন। শিবনারায়ণ রায় কাজী নজরুল সম্পর্কে লিখেছেন “হিন্দু এবং মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের উগ্র ইংরেজ-বিদ্বেষীরা পর্যন্ত আপন আপন জীর্ণ আচার-অনুষ্ঠান ধ্যান-ধারণাকে প্রবল গোঁড়ামির সঙ্গে আঁকড়ে ধরে পরস্পরের মধ্যে বিভেদবুদ্ধি আর বিদ্বেষবােধ বাড়িয়ে তুলেছিল। এই আশ্চর্য মানুষটি কিন্তু বিনা চেষ্টায় নির্দ্বিধায় এই জীর্ণ সঙ্কীর্ণ আত্মঘাতী বিভেদকে এক জায়গায় ঝেড়ে ফেলে দিয়ে ঘােষণা করলেন সেই জগতের বাণী যেখানে মানুষ হিসেবেই মানুষের মুখ্য পরিচয়। ধর্মীয় গোঁড়ামি মনুষ্যত্ব প্রতিষ্ঠার পথে বাধা বলেই তা অবশ্য বর্জনীয়। নিজের মনকে এমন সম্পূর্ণভাবে সাম্প্রদায়িক সঙ্কীর্ণতার প্রভাব থেকে মুক্ত করে সাহিত্যজীবনে প্রবেশ করেছিলেন এমন আরেকটি লােক আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে নিতান্তই দুর্লভ।”১৪

 

তথ্যসূত্রঃ

  • ১. গােপাল হালদার, বঙ্কিম সমস্যা বাঙলা সাহিত্যে মানব স্বীকৃতি, কলকাতা, ১৩৬৩, পৃ. ৬০-৬১।
  • ২. রেজাউল করিম, ভারতীয় মুসলমানের উপর হিন্দু প্রভাব, বঙ্গদর্পণ, ১ম খন্ড, কলকাতা, পৃ. ৩০১।
  • ৩. অধ্যক্ষ ইব্রাহিম খান সাহেবকে লেখা চিঠি দেখুন-আবদুল কাদির সম্পাদিত, কাজী নজরুল রচনা সম্ভার, ঢাকা, ১৯৬৯।
  • ৪. কলকাতার এলবার্ট হলে ১৫ ডিসেম্বর ১৯২৯ খ্রিঃ ‘কাজী নজরুল সম্বর্ধনা সমিতি’র সভায় প্রদত্ত ভাষণ।
  • ৫. “আমার পথ’, ‘ধূমকেতু’তে প্রকাশিত সম্পাদকীয়, ২৬ শ্রাবণ ১৩২৯।
  • ৬. বাংলা সাহিত্যে প্রথম পত্রোপন্যাস ‘বাঁধন হারা’ মােসলেম ভারত, ১৩২৭ বৈশাখ, বর্ষ-১, সংখ্যা-১।
  • ৭. পুতুলের বিয়ে, ডি. এম. লাইব্রেরি, কলকাতা, ১৩৪০।
  • ৮. আবদুল আজিজ আল-আমান, ধূমকেতু কাজী নজরুল, হরফ প্রকাশনী, কলকাতা, পৃঃ ৭৫।
  • ৯. কাজী কাজী নজরুল  ইসলাম, অভিভাষণ, বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির রজত জয়ন্তী ১৯৪১।
  • ১০. গণবাণী, মন্দির মসজিদ, ২৬ শে আগস্ট ১৯২৭।।
  • ১১. গণবাণী, ২রা সেপ্টেম্বর ১৯২৬।
  • ১২. ইব্রাহিম খাঁকে লিখিত পত্র দেখুন-আব্দুল কাদির সম্পাদিত, কাজী নজরুল রচনা সম্ভার, ঢাকা, ১৯৬৯ সওগাত, পৌষ ১৩৩৪, পৃঃ ৫৪।।
  • ১৩. আব্দুল কাদির সম্পাদিত, কাজী নজরুল  রচনাবলী, প্রথম খণ্ড, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ১৯৮৩, পৃঃ ৭০৭।
  • ১৪. শিবনারায়ণ রায়, সম্পাদকীয়, কাজী নজরুল  সংখ্যা, জিজ্ঞাসা, দ্বাবিংশবর্ষ।

‘নবজাগরণ’ অ্যান্ড্রোয়েড অ্যাপ্লিকেশনটি প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।

‘নবজাগরণ’ এর টেলিগ্রাম চ্যানেলে জয়েন হতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।

‘নবজাগরণ’ এর ফেসবুক পেজে লাইক করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।

Post Views: 10,991
Tags: কাজী নজরুল ইসলামকাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্যে হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতি ও মানবতার স্বরূপনজরুলনজরুল ইসলামবাংলা সাহিত্যবাংলা সাহিত্যের ইতিহাসবিদ্রোহী কবিবিদ্রোহী কবি নজরুলহিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতি ও মানবতার স্বরূপ
ADVERTISEMENT

Related Posts

নজরুল ইসলামের উপন্যাসে মানবতাবাদ
সাহিত্য আলোচনা

নজরুল ইসলামের উপন্যাসে মানবতাবাদ

লিখেছেনঃ মুহাম্মাদ আব্দুল আলিম মহৎ ঔপন্যাসিক মাত্রই মানবতার পথপ্রদর্শক। সাহিত্য মানেই মানুষের কথা, তার জীবনযাপন, আনন্দ-বেদনা, প্রেম-সংঘর্ষ, বিশ্বাস-অবিশ্বাসের এক...

by মুহাম্মাদ আব্দুল আলিম
March 29, 2025
বনলতা সেন ও জীবনানন্দ দাশের নায়িকারা
সাহিত্য আলোচনা

বনলতা সেন ও জীবনানন্দ দাশের নায়িকারা

লিখেছেনঃ আহমদ রফিক শ-পাঁচেক বছর আগে চিত্রশিল্পের অন্যতম ‘গ্রেট মাস্টার’ লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির আঁকা আবক্ষ নারীপ্রতিকৃতি ‘মোনালিজা’কে নিয়ে ইতালি-প্যারিস...

by অতিথি লেখক
November 19, 2024
কাজি নজরুল ইসলাম ও আন্তর্জাতিকতা
সাহিত্য আলোচনা

কাজি নজরুল ইসলাম ও আন্তর্জাতিকতা

লিখেছেনঃ সুমিতা চক্রবর্তী কাজি নজরুল ইসলামকে অনেক ভাবেই আমরা চিনি। তিনি উৎপীড়িতের পক্ষে দাঁড়ানো একজন সাহিত্যিক; তিনি অসাম্প্রদায়িক মনের...

by অতিথি লেখক
November 5, 2024
জীবনানন্দ দাশের নারীপ্রেমঃ বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা
সাহিত্য আলোচনা

জীবনানন্দ দাশের নারীপ্রেমঃ বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা

লিখেছেনঃ বাসন্তীকুমার মুখখাপাধ্যায় জীবনানন্দ যেমন প্রকৃতির বেদনার আঘাতের ও হিংস্রতার দিকটি সম্বন্ধে সম্পূর্ণ সচেতন থেকেও প্রকৃতিলীন জীবনে আস্থা স্থাপন...

by নবজাগরণ
November 7, 2024

POPULAR POSTS

  • সুলতান মাহমুদ

    সুলতান মাহমুদের ভারত অভিযান ও সোমনাথ মন্দির প্রসঙ্গ (১ম পর্ব)

    181 shares
    Share 181 Tweet 0
  • বাউরী সম্প্রদায়ের উৎপত্তির ইতিহাস ও ঐতিহাসিক পর্যালোচনা

    0 shares
    Share 0 Tweet 0
  • আর্যদের ভারত আগমন, বিস্তার, সমাজ ও সভ্যতা: এক ঐতিহাসিক পর্যবেক্ষণ

    0 shares
    Share 0 Tweet 0
  • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে বৌদি কাদম্বরী দেবীর সম্পর্ক আদৌ কি প্রেমের ছিল?

    0 shares
    Share 0 Tweet 0
  • হিন্দু পদবীর উৎপত্তির ইতিহাস, বিবর্তন ও ক্রমবিকাশঃ বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা

    0 shares
    Share 0 Tweet 0

Facebook Page

নবজাগরণ

ADVERTISEMENT
নবজাগরণ

'Nobojagaran' is a website of its kind where you can gather knowledge on all the unknown facts of the world. We human beings always have a thirst for knowledge. Nobojagaran takes its first steps to quench this thirst of ours. We are now in the era of digital world, where we get almost anything online. So how about a bit of knowlyfrom online?

Connect With Us

No Result
View All Result

Categories

  • English (9)
  • অন্যান্য (11)
  • ইসলাম (27)
  • ইসলামিক ইতিহাস (23)
  • ইহুদী (2)
  • কবিতা (37)
  • খ্রিস্টান (6)
  • ছোটগল্প (6)
  • নাস্তিকতা (18)
  • বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি (24)
  • বিশ্ব ইতিহাস (24)
  • ভারতবর্ষের ইতিহাস (195)
  • রাজনীতি (38)
  • সাহিত্য আলোচনা (68)
  • সিনেমা (17)
  • হিন্দু (16)

Pages

  • Cart
  • Checkout
  • Checkout
    • Confirmation
    • Order History
    • Receipt
    • Transaction Failed
  • Contact
  • Donation to Nobojagaran
  • Homepage
  • Order Confirmation
  • Order Failed
  • Privacy Policy
  • Purchases
  • Services
  • লেখা পাঠানোর নিয়ম
  • হোম
No Result
View All Result
  • মূলপাতা
  • ইতিহাস
    • ইসলামিক ইতিহাস
    • ভারতবর্ষের ইতিহাস
    • বিশ্ব ইতিহাস
  • বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
  • ধর্ম
    • ইসলাম
    • খ্রিস্টান
    • হিন্দু
    • ইহুদী
    • অন্যান্য ধর্ম
  • নাস্তিকতা
  • রাজনীতি
  • সিনেমা
  • সাহিত্য
    • কবিতা
    • ছোটগল্প
    • উপন্যাস
    • সাহিত্য আলোচনা
  • অন্যান্য
  • ই-ম্যাগাজিন
    • নবজাগরণ (ষাণ্মাসিক) – জীবনানন্দ ১২৫ তম জন্ম সংখ্যা – মননশীল সাহিত্য পত্রিকা
  • Others Language
    • English
    • Urdu
    • Hindi

©Nobojagaran 2020 | Designed & Developed with ❤️ by Adozeal

Login to your account below

Forgotten Password?

Fill the forms bellow to register

All fields are required. Log In

Retrieve your password

Please enter your username or email address to reset your password.

Log In
Don't have an account yet? Register Now
1
Powered by Joinchat
Hi, how can I help you?
Open chat
wpDiscuz
0
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x
| Reply