লিখেছেনঃ রাতুল দত্ত
বেশ কয়েক বছর ধরেই নামার তাবড় তাবড় বিজ্ঞানীদের কপালে চিন্তার বলিরেখা। নিজেদের গবেষণালব্ধ গোপন তথ্য যা-ই ই-মেলে পাঠান, তা-ই আগে থেকে ফাঁস হয়ে যাচ্ছে! রীতিমত তালাচাবি দেওয়া ‘মেলবক্স’ থেকে তথ্য পাচার! নব্বই-এর দশকে পরপর এই ঘটনাই বিজ্ঞানীদের অন্দরমহলে তোলপাড় তুলেছিল। অবশেষে ১৯৯৪ সালে ধরা পড়ল সংগীত নিয়ে পড়াশোনা করা এক ছাত্র। বয়স ১৬। রিচার্ড প্রাইস। ইতিমধ্যে সে কয়েকশো মেলবক্সে ঢুকে তথ্য চুরি করে ফেলেছে। ছড়িয়ে গেছে প্রচুর ভাইরাসও। অবশ্যই তথ্য পাচারের উদ্দেশ্য তার ছিল না। কম্পিউটার নিয়ে নিছক পরীক্ষা নিরীক্ষা করাই ছিল উদ্দেশ্য। মেল হ্যাকিং সম্পর্কে পৃথিবীর মানুষ বিস্তারিত জানল তখন থেকেই।
একটা মজার তথ্য দেওয়া যাক। সমীক্ষায় দেখা গেছে, হ্যাকারদের বেশির ভাগই শহুরে তরুণ-তরুণী। বাড়িতে বা সাইবার কাফেতে গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অনলাইন চ্যাট করতে করতেই হ্যাক করে ফেলেন তাঁরা। তেমনই একজন ‘দ্য লাস্ট বয় অফ সাইবারস্পেস’ হলেন কেভিন মিটনিক। কম্পিউটারে ভাইরাস ছড়ানো এবং চ্যাটিং-এর মাধ্যমে অন্যের ব্যক্তিগত তথ্য, ইমেল অ্যাকাউন্টের পাসওয়ার্ড জেনে নেওয়া ছিল তার নেশা। কম্পিউটারের প্রচণ্ড আসক্তি তাকে হ্যাকারে পরিণত করে। ফেডারেল ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন তাকে ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ মেল হ্যাকার হিসেবে চিহ্নিত করে। গ্রেপ্তারের পর তার মানসিক চিকিৎসা শুরু করে পুলিস, প্রশাসন।
লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দর থেকে ১৯৯৫ সালে ধরা পড়লেন গণিতজ্ঞ ভ্লাদিমির লেভিন। সেন্ট পিটার্সবার্গ টেকনালোজি বিশ্ববিদ্যালয়ের এই স্নাতক হঠাত্র সিটি ব্যাঙ্কে কম্পিউটার হ্যাক করে ১ কোটি মার্কিন ডলার অর্থাৎ প্রায় ৫০ কোটি টাকা তুলে ফেললেন। পরে অবশ্য তিনি ধরা পড়ে যান।
আসলে হ্যাকারদের উদ্দেশ্য হল মৌলিক। এঁরা অন্যের কম্পিউটারের তথ্য বা মেধা সম্পদ চুরিতে বিশেষ বিশ্বাস করে না। বরং এঁরা অনেক বেশি সচেষ্ট থাকে আপনার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বা ক্রেডিট কার্ড নম্বর জানতে, কম্পিউটারের আই এস পি নম্বর জেনে বেআইনি কাজে আপনাকে জড়িয়ে দিতে, শিশুদের অশ্লীল ছবি পাঠাতে। আর উগ্রপন্থী বা রাষ্ট্রদ্রোহীরা চেষ্টা করে সরকারের ওয়েবসাইট হ্যাক করে গোপন তথ্য জেনে নেওয়ার জন্য। হ্যাকিং-এর মূল উদ্দেশ্য হল—লোভ, ক্ষমতা, প্রচার, বদলা, ভয় দেখালো, অ্যাডভেঞ্চার, গোপন তথ্য জেনে নেওয়া, মনে চিন্তার উদ্রেক করা ইত্যাদি। হ্যাক করা যাবে না এমন কম্পিউটার পৃথিবীতে আছে বলে মনে হচ্ছে না। হ্যাকিং-এর সাথে আরও একটি অতি পরিচিত শব্দ আছে—তা হল ফ্র্যাকিং। দুটি আদপে একই। অশান্তি, আশঙ্কা এবং আতঙ্কের পরিবেশ বজায় রাখা। ১৯৮৮ সালে কর্ণেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রবার্ট মরিস-কেও মেলবক্স থেকে তথ্য চুরির অপরাধে ১০ হাজার ডলার জরিমানা দিতে হয়েছিল। আমেরিকায় হ্যাকিং শব্দটি চালু হল সেই সময় থেকেই।
হ্যাকিং-এর ইতিহাস : কীভাবে হ্যাকিং হয় এবং কারা কীভাবে এ কাজে যুক্ত—তা এখনও সাইবার বিশেষজ্ঞদের কাছে পরিষ্কার নয়। যদিও সাতের দশকেই এর সঙ্গে পরিচয় ঘটেছে এবং এখনও নতুন নতুন জিনিস আবিষ্কার হয়ে চলেছে। ১৯৬০ সালে ম্যাসচুজ বিশ্ববিদ্যালয়ে হ্যাকিং বিষয়ে আলোচনা হত বলে জানা যাচ্ছে। তখন অবশ্য কম্পিউটারের মাধ্যমে শর্টকার্ট পদ্ধতি ব্যবহার করাকেই হ্যাকিং বলা হত। ১৯৬৩ সালের ২০ নভেম্বর এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের গবেষণাপত্রে হ্যাকিং শব্দটির উল্লেখ পাওয়া যায়।
এরপর আটের দশক। ফোন হ্যাকারদের দাপট শুরু হল। প্রথমদিকের ফোন হ্যাকারদের (এদের বলে ফ্লেকারস) মধ্যে জন ড্রেপারের নাম উল্লেখযোগ্য। গ্রুপ হ্যাকিংও শুরু হল এই সময়ই। তারা ইলেকট্রনিক বুলেটিন বোর্ড সিস্টেমস ব্যবহার করত। হ্যাকিং নিয়ে প্রথম ম্যাগাজিন ‘২৬০০’ প্রকাশিত হল ১৯৮৪ সালে। কীভাবে হ্যাকার হওয়া যায়, সারা পৃথিবীতে বিশেষ কী কী হ্যাকিং-এর ঘটনা ঘটছে, ইত্যাদি বিষয়ে এটি বিশেষ ম্যাগাজিন। ১৯৮৬ সাল। হ্যাকিং-এর ঘটনায় মূল অভিযুক্ত হলেন আমেরিকার রবার্ট মরিস। ৬ হাজার সরকারি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটের যাবতীয় তথ্য সে হ্যাক করে নিয়েছিল। তিন বছরের জেল এবং ১০ হাজার পাউন্ড জরিমানা হল রবার্টের।
নয়ের দশককে হ্যাকারদের স্বর্গের সময় বলে ধরা হয়। ১৯৯৫ সালে প্রায় ২০ হাজার ক্রেডিট কার্ডের নম্বর চুরি করে নেওয়ার অপরাধে সিরিয়াল কম্পিউটার ক্রিমিনাল কেভিন মিটনিখের ৫ বছরের জেল হল। ২০০০ সালে Denial Of Service (DOS) নামে আর একটি নতুন ধরনের কম্পিউটার আক্রমণের ঘটনা ঘটল। এই বছরই পৃথিবীর সবচেয়ে বডড়ো আক্রমণটি ঘটল অতিপরিচিত ইয়াহু এবং আমাজন সাইটের ওপর। এ বছরই আর একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটল। ওই বছরের মে মাসে পৃথিবীর কয়েক কোটি মানুষের মেলবক্সে ছড়িয়ে পড়েছিল “I LOVE YOU’ ভাইরাস।
কীভাবে করে হ্যাকিং?
কম্পিউটার নিয়ে যারা সারাক্ষণ ঘাঁটাঘাঁটি করেন, বিভিন্ন সাইটের আনাচে কানাচে যাঁরা নিত্য ঘুরে বেড়ান—তাঁদের কাছে বিষয়টি কিন্তু খুব জটিল নয়। অবশ্যই ই-মেল আই ডি আর ব্যক্তিগত তথ্য বিস্তারিতভাবে জানলেই হল। প্রথমে সংশ্লিষ্ট রেস ওয়েবসাইটটি খুলে user name-এ সেই আই ডি দিয়ে সম্ভাব্য Data Doctor একটি পাসওয়ার্ড দিতে হবে। অবশ্যই সেটি হবে না এবং সঙ্গে Password Recovery সঙ্গে ‘ভুল পাসওয়ার্ড’ নির্দেশ করবে। হ্যাকিং-এর কারিকুরি এখানেই। বহু মানুষ আছেন, যাঁরা নিজের ভালোবাসার জিনিসের নামে পাসওয়ার্ড রাখেন। কেউ ছেলে-মেয়ে, কেউ প্রেমিক-প্রেমিকা, কেউ বা শুধুই ১২৩৪, কেউ পােষা প্রাণীর নামে পাসওয়ার্ড রাখে। হ্যাকারের কাছে এই তথ্যগুলি থাকে। এবং এগুলি দিয়ে পাসওয়ার্ড বসিয়ে মেলবক্স খুলতে চেষ্টা করে। বারবার চেষ্টা করেও না খুলতে পারলে অনেক সময় অন্য ই-মেল আই ডি-ও জানতে চায় কম্পিউটার। হ্যাকারদের কাছে এই বিভিন্ন ধরনের তথ্য থাকে। সেগুলি দিলেই কম্পিউটারের ওই সাইটটি বিকল্প পাসওয়ার্ড দেবে। নিজের পছন্দমত নতুন পাসওয়ার্ডও চাইতে পারে। সাইটে পাসওয়ার্ডটি গৃহীত হলেই খুলে যাবে মেলবক্স। তবে প্রযুক্তিগত জটিলতা তো সবক্ষেত্রেই আছে। সাইবার অপরাধীদের সাফল্য এখানেই।
সাইবার হ্যাকারদের কথা উঠলেই কমপিউটার বিশেষজ্ঞরা যে ৪টি দেশকে চিহ্নিত করেন সেগুলি হল আমেরিকা, ব্রিটেন জার্মানি এবং অবশ্যই ভারত। চিন যতই অস্বীকার করুক, মেল বা ওয়েবসাইট হ্যাকাররা যে দিনের পর দিন বেজিং-এ বসেই নেটওয়ার্ক চালিয়ে যাচ্ছে তার প্রমাণ মিলছে ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার থেকে।
হ্যাকিং-এর বিষয় আলোচনা করতে গেলেই উঠে আসে কয়েকজনের নাম।
রাফায়েল গ্রে : ওয়েলশ-এর বাসিন্দা। বয়স মাত্র ১৯। কিন্তু এর মধ্যেই মাইক্রোসফ্ট-এর প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস-এর ই-মেল আই ডি হ্যাক করে ক্রেডিট কার্ডের যাবতীয় তথ্য জেনে নিয়েছিল সে। পাঠিয়ে দিয়েছিল অন্য একজনের কাছে।
কেডিন মিউনিখ : মোটোরোলা সহ পৃথিবীর বেশ কিছু নামকরা কোম্পানির ওয়েবসাইট হ্যাকিং এবং মেল হ্যাকিং-এর অভিযোগের ভিত্তিতে একে ধরেছিল আমেরিকার ফেডারেল ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন। নেটওয়ার্ক নষ্ট করে দেওয়ার পাশাপাশি সে সফটওয়ার থেকে মেধাসত্ত্ব চুরি করত।
‘জোসেফ ম্যাকেলরয় : ২০০৪ সালে এই নাবালক ছেলেটিই মার্কিন প্রশাসনের চোখে ধুলো দিয়ে জেল থেকে পালিয়ে গিয়েছিল। গোপনতম মার্কিন গবেষণা সংস্থার বেশ কিছু ওয়েবসাইট সে ‘হ্যাক করে নিয়েছিল। জেল হয়েছিল তিন বছরের।
আইনী সহায়তা: বিদেশের মত ভারতেও সাইবার সন্ত্রাসের ঘটনা ক্রমশ বাড়তে থাকায় চিন্তিত কেন্দ্র, রাজ্য। তাই ভারতীয় দন্ডবিধির পাশাপাশি ২০০০ সালের নতুন ভারতীয় তথ্য প্রযুক্তি আইন অনুসারেও দোষী সাব্যস্ত করা হচ্ছে। হ্যাকিং-এর ক্ষেত্রে এই আইনের ১১ নম্বর অধ্যায়ে ৬৫ এবং ৬৬ নম্বর ধারায় প্রয়োজনীয় আইনি সহায়তা ও শাস্তির কথা বলা আছে। আইনের ৬৫ নম্বর ধারায় বলা হচ্ছে, যে কেউ ইচ্ছে করে জেনেশুনে কমপিউটার সোর্স কোড, যে কোন প্রোগ্রামিং নেটওয়ার্ক বা ওয়েবসাইট হ্যাকিং করে নিলে বা এইসব কারণে কোন কমপিউটার ব্যবস্থা ভেঙে পড়তে তাকে দোষী বলে সাব্যস্ত করা হবে। সরকার বা জনসাধারণের কোন ওয়েবসাইট ‘হ্যাক করে তাতে ঢুকে তথ্য মুছে বা পরিবর্তন করে দিলেও তাকে একই আইনে দোষী সাব্যস্ত করা হবে। যে কোন ক্ষেত্রেই সর্বোচ্চ ৩ বছরের জেল বা ২ লক্ষ টাকা পর্যন্ত জরিমানা বা দুই-ই হতে পারে। বারবারা ম্যাকমোহন এবং ববি জনসন।
সিডনির দুই নাবালকের সাইবার সন্ত্রাসের ঘটনাই এখন সেখানকার লোকের মুখে মুখে। ঘরে বসে শুধু ল্যাপটপের সাহায্যে কীভাবে আস্ত একটা ওয়েবসাইট হ্যাক’ বা চুরি করে নেওয়া যায়, তার জলজ্যান্ত উদাহরণ এই ঘটনা। আমেরিকার কয়েকজন হ্যাকারের সঙ্গে যোগাযোগ করে সে প্রায় ১০ লক্ষ কমপিউটার একসাথে নষ্ট করে। দিয়েছিল। হ্যাক করেছিল বেশ কিছু। ওয়েবসাইট। বটনেট’ নামে একটি বিশেষ ধরণের সফটওয়ার তৈরি করে হ্যাকিং-এর কাজটা করেছিল ম্যাকমোহন এবং জনসন। আর দুজনেই কেউই কিন্তু নিজের নামে পরিচয় দিত। ম্যাকমোহনের নাম ছিল আকিল (AKILL)। অস্ট্রেলিয়া পুলিশের ইলেকট্রনিক ক্রাইম সেন্টারের মূল দায়িত্বে থাকা মার্টিন ক্লেনজেসের মতে, ১৮ বছরের কম বয়স্ক কারও এ ধরনের আস্ত কয়েকটা ওয়েবসাইট হ্যাকিং-এর ঘটনায় পুলিশ প্রশাসন তো রীতিমত স্তম্ভিত।
আরও পড়ুন,
সাইবার অপরাধ কত ধরনের ও কিরকমভাবে হয়ে থাকে জেনে নিন