ষষ্ঠ শতাব্দীর প্রথম দিকে গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের পর সারা উত্তর ভারতে আবারাে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্থানীয় রাজশক্তির উদ্ভব হয়। এই অবস্থার প্রভাব বাংলায়ও পড়ে। সমসাময়িক অবস্থার সুযােগে বাংলায় তখন দুটি স্বাধীন সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। এর একটি ছিল প্রাচীন বঙ্গ রাজ্য এবং অপরটি গৌড় রাজ্য। দক্ষিণপূর্ব বাংলা ও পশ্চিম বাংলার দক্ষিণাঞ্চলে ছিল স্বাধীন বঙ্গ রাজ্য ও পশ্চিম ও উত্তর বাংলাব্যাপী ছিল স্বাধীন গৌড় রাজ্য। শশাঙ্ক এই গৌড় রাজ্যেরই অধিপতি ছিলেন।
প্রাপ্ত সাতটি তাম্রশাসন থেকে স্বাধীন বঙ্গ রাজ্য সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায়। গােপচন্দ্র, ধর্মাদিত্য ও সমাচারদেব নামে তিনজন রাজা সম্পর্কে জানা যায় যারা ৫২৫ খ্রি: থেকে ৬০০ খ্রি:-এর মধ্যে রাজত্ব করেছিলেন। ফরিদপুর জেলার কোটালিপাড়া, বর্ধমান জেলার মল্লসারুল এবং বালেশ্বর জেলার জয়রামপুরে তাম্রশাসনগুলাে পাওয়া গেছে। বঙ্গের রাজাগণ ‘মহারাজাধিরাজ’ উপাধি ধারণ করেছিলেন যা তাঁদের সার্বভৌম ক্ষমতারই পরিচায়ক। যাহােক প্রাপ্ত তাম্রশাসনসমূহ থেকে উল্লিখিত তিনজন রাজা ও তাদের রাজ্যের প্রভাব, প্রতিপত্তি ও সমৃদ্ধির পরিচয় পাওয়া যায়। এই বঙ্গ রাজ্যের ধ্বংস বা পতন কি করে হয়েছিল তা জানা যায় না। বহির্শক্তির আক্রমণে অথবা স্বাধীন গৌড় রাজ্যের শক্তিবৃদ্ধিতে বঙ্গের রাজনৈতিক ক্ষমতা খর্ব হতে পারে।
বঙ্গের পর গৌড় রাজ্যের কথায় আসা যাক। গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের পর পরবর্তী ‘গুপ্ত বংশ’ বলে পরিচিত গুপ্ত উপাধিধারী রাজাগণ উত্তর বাংলায়, পশ্চিম বাংলার উত্তরাংশে ও মগধে ক্ষমতা বিস্তার করেছিলেন। বাংলার এ অঞ্চলেই গড়ে উঠেছিল স্বাধীন গৌড় রাজ্য। উত্তর ভারতের ‘মৌখরী’ রাজবংশ এবং পরবর্তী গুপ্ত বংশীয় রাজাদের মধ্যে প্রায় অর্ধ শতাব্দীব্যাপী পুরুষানুক্রমিক বিবাদ চলছিল। এই অবস্থার সুযােগ গ্রহণ করেছিলেন শশাঙ্ক। তিনি ষষ্ঠ শতাব্দীর শেষে বা সপ্তম শতাব্দীর গােড়ার দিকে গৌড় অঞ্চলে ক্ষমতা দখল করেন এবং স্বাধীন সার্বভৌম গৌড় রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন।
শশাঙ্কের ইতিহাসের উৎস
শশাঙ্ক সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায় এরকম কিছু উপাদান আমাদের হাতে রয়েছে। এর মধ্যে শশাঙ্কের তাম্রশাসন, মুদ্রা, রােহতাসগড় গিরিগাত্রে প্রাপ্ত সিলের ছাঁচ; ‘আর্যমঞ্জুশ্রীমূলকল্প’ ও বাণভট্টের ‘হর্ষচরিত’ শীর্ষক গ্রন্থ এবং চৈনিক পর্যটক হিউয়েন সাং-এর বিবরণ উল্লেখযােগ্য। শশাঙ্কের ইতিহাসের উৎসসমূহের মধ্যে ‘হর্ষচরিত’ এবং হিউয়েন সাং-এর বর্ণনা থেকে তথ্য নেবার ক্ষেত্রে কিছুটা সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়ােজন। কেননা, এ দুটি উৎসে শশাঙ্ক ‘বিরােধী পক্ষ’ বা ‘শত্রুপক্ষ’ হিসেবে চিত্রিত হয়েছেন।
শশাঙ্কের উত্থান এবং রাজ্যসীমা
শশাঙ্কের উত্থান ঠিক কোন সময়ে হয়েছে তা সুনির্দিষ্ট করে বলা সম্ভব নয়। তবে বিভিন্ন তথ্য প্রমাণ থেকে মনে হয়, ষষ্ঠ শতাব্দীর শেষ দশকে শশাঙ্কের উত্থান ঘটে। এ সময় ভারতবর্ষের সামগ্রিক চিত্রে আমরা দেখতে পাই, অসংখ্য ক্ষুদ্র রাজ্য ও রাজার উপস্থিতি এবং তাদের মধ্যে নৈমিত্তিক কলহ। হুণদের আক্রমণে গুপ্তদের পতনের পর থেকেই এ দৃশ্যের অবতারণা হয়। যাহােক, বাণভট্টসূত্রে জানা যায়, সপ্তম শতাব্দীর শুরুতেই (৬০৬ খ্রিস্টাব্দ) হর্ষবর্ধন শপথ গ্রহণ করেন এবং হর্ষবর্ধনের শপথ গ্রহণের পূর্বে শশাঙ্কের হাতে। রাজ্যবর্ধনের মৃত্যু হয়। এদিকে গঞ্জাম তাম্রশাসনে ৬১৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত উড়িষ্যায় ‘গৌড়াধিপতি’ শশাঙ্কের সদর্প উপস্থিতির কথা উল্লেখ আছে। চৈনিক পর্যটক হিউয়েন সাং ৬৩০ খ্রিস্টাব্দের পর যখন বাংলায় ভ্রমণে আসেন তখন শশাঙ্ক আর বেঁচে নেই। যে কারণে হিউয়েন সাং-এর বিবরণে শশাঙ্কের মৃত্যু সম্পর্কিত ‘কাহিনী’র উল্লেখ পাওয়া যায়। এই বিষয়গুলাে পর্যালােচনা করলে অনুমান করে নিতে কষ্ট হয় না যে, ৬০৬ খ্রিস্টাব্দের পূর্বেই শশাঙ্ক ছিলেন একজন প্রতিষ্ঠিত নৃপতি। ৬১৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি অবশ্যই রাজত্ব করেছেন এবং সম্ভবত ৬৩০ খ্রিস্টাব্দের কিছু আগে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। শশাঙ্কের উত্থানের সময় পশ্চিমে (মালব) পরবর্তী গুপ্তরা শাসন করছিলাে।
উত্তর ভারতে কনৌজকে কেন্দ্র করে মৌখরী রাজবংশ এবং উত্তর প্রদেশের সীমানায় অর্থাৎ পূর্ব পাঞ্জাবে থানেশ্বরকে কেন্দ্র করে পুষ্যভূতি রাজবংশের শাসন চলছিল। এ কথাটি স্পষ্ট যে সপ্তম শতাব্দীর প্রারম্ভে কোন এক সময়ে শশাঙ্ক গৌড় রাজ্যে ক্ষমতাসীন হন। তাঁর রাজধানী ছিল কর্ণসুবর্ণ। বর্তমানে মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুরের ছয় মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত ‘রাঙ্গামাটি’। বাংলার উত্তর ও উত্তর পশ্চিমাংশ শশাঙ্কের রাজ্যাধীন ছিল। দক্ষিণ-পূর্ব বাংলা তাঁর সাম্রাজ্যভুক্ত ছিল কিনা তা সঠিকভাবে জানা যায় না। এ কারণে শশাঙ্ক সমগ্র বাংলার অধিপতি ছিলেন- এ ধরনের মন্তব্য যুক্তিযুক্ত নয়। শশাঙ্কের রাজত্বের প্রথম হতেই মগধ বা দক্ষিণ বিহার অঞ্চল তার অধিকারে ছিল। ৬১৯ খ্রিস্টাব্দের গঞ্জাম তাম্রশাসন হতে প্রমাণ হয় শশাঙ্কের রাজ্য দক্ষিণে উড়িষ্যার চিল্কা হ্রদ পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেছিল।
উত্তর ভারতীয় রাজনীতিতে শশাঙ্কের হস্তক্ষেপ
উত্তর ভারতের রাজনীতিতে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ গ্রহণ শশাঙ্কের শাসনামলের এক উল্লেখযােগ্য অধ্যায়। উত্তর ভারতে শশাঙ্কের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন তৎকালীন ভারতের শক্তিশালী সম্রাট হর্ষবর্ধন। যাহােক, শশাঙ্কের উত্থানের পূর্বে উত্তর ভারতের রাজনীতির প্রধান বৈশিষ্ট্য এই যে, ‘মৌখরী’ রাজবংশ পূর্ব ও পশ্চিমে সাম্রাজ্য বিস্তারের আগ্রাসী অভিলাষে লিপ্ত। তারা সমসাময়িক অপর শক্তি ‘পুষ্যভূতি’ রাজবংশের সাথে বৈবাহিক সম্পর্কের মধ্যদিয়ে জোট’ গড়ে তুলেছিল। এদিকে শশাঙ্ক এই জোটের বিরুদ্ধে স্বরাজ্য দৃঢ়ভাবে সংরক্ষণ করার জন্যই প্রধানত উত্তর ভারতের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করেন। গৌড়-মগধের পরবর্তী গুপ্তবংশীয় রাজাদের সাথে মৌখরীরাজাদের বংশানুক্রমিক শত্রুতা ছিল। গৌড়-মগধের অধিকর্তা শশাঙ্ককে এই শত্রুতার জের টানতে হয়। তাছাড়া সমসাময়িক সময়ের কনৌজের মৌখরী রাজা গ্রহবর্মণ পুষ্যভূতি রাজা প্রভাকরবর্ধনের কন্যা রাজ্যশ্রীকে বিবাহের মাধ্যমে বন্ধুত্ব স্থাপন করেন। শশাঙ্ক ধারণা করেন, এই বন্ধুত্ব তাঁর জন্য বিপদ বয়ে আনতে পারে। ফলে তিনিও কূটনৈতিক কৌশলে মালবরাজ দেবগুপ্তের সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্ক সৃষ্টি করেন। এরপর ‘সর্বভারতীয়’ শক্তির বিরুদ্ধে শশাঙ্ক বাংলার শক্তি প্রদর্শনে অগ্রসর হন।
উত্তর ভারতীয় রাজনীতিতে শশাঙ্কের জড়িত হবার পেছনে মােটামুটিভাবে দুটি বিশেষ কারণের উল্লেখ করা যায়। প্রথমত, পরবর্তী গুপ্ত রাজাদের সাথে মৌখরীদের দ্বন্দ্বে গৌড়াধিপতি শশাঙ্কও জড়িত হয়ে পড়েন। কেননা অনেকেই মনে করেন শশাঙ্ক গুপ্ত রাজাদেরই কোন সামন্তরাজা বা প্রতিনিধি ছিলেন। তাই । উত্তরাধিকার সূত্রেই হয়তাে তিনি মৌখরীদের শত্রু ছিলেন। দ্বিতীয়ত, পরস্পর বিরােধী দুটি জোট গড়ে ওঠায় উত্তর ভারতের রাজনীতি বেশ জটিল আকার ধারণ করে। এর মধ্যে একটি জোটের উচ্চাকাঙ্ক্ষী প্রতিনিধি হিসেবে শশাঙ্ক নিজেকে ‘সর্বভারতীয়’ রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে জড়িয়ে ফেলেন। মৌখরী এবং পুষ্যভূতিদের। জোটের বিরুদ্ধে শশাঙ্ক মালবের দেবগুপ্তকে সঙ্গে নিয়ে এভাবেই মৈত্রী জোট গড়ে তােলেন।
পুষ্যভূতি ও মৌখরী মিত্রশক্তির আক্রমণের পূর্বেই থানেশ্বর রাজ প্রভাকরবর্ধনের অসুস্থতার সুযােগে মালবরাজ দেবগুপ্ত মৌখরীরাজ গ্রহবর্মণকে আক্রমণ করেন এবং তাঁর স্ত্রী রাজ্যশ্রীকে কনৌজে বন্দি করেন। এ যুদ্ধে গ্রহবর্মণকে পরাজিত করার সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে দেবগুপ্ত শশাঙ্কের আক্রমণের জন্য অপেক্ষা না করেই পরবর্তী পর্যায়ে থানেশ্বর রাজ্য আক্রমণ করার প্রস্তুতি নিতে থাকেন। এদিকে প্রভাকরবর্ধনের মৃত্যুর পর থানেশ্বর সিংহাসনে আরােহণ করেন রাজ্যবর্ধন। রাজ্যবর্ধন গ্রহবর্মণের পরাজয়ের সংবাদ পেয়ে বিচলিত হন এবং নিজ ভগ্নী রাজ্যশ্রীকে উদ্ধার করার জন্য সসৈন্যে কনৌজের দিকে যাত্রা করেন। পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ বেশ অস্পষ্ট। তবে প্রাপ্ত উৎস বিশেষণ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, রাজ্যবর্ধন দেবগুপ্তকে পরাজিত ও নিহত করেন। কিড় কনৌজের ওপর তিনি নিজ প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠায় সম্ভবত ব্যর্থ হন এবং ভগ্নী রাজ্যশ্রীকেও উদ্ধার করতে তেমন একটা সাফল্য পাননি। শশাঙ্ক সম্ভবত আগেই সসৈন্যে কনৌজ পৌঁছেছিলেন দেবগুপ্তের সাহায্যের জন্য। শশাঙ্ক এবং রাজ্যবর্ধনের মধ্যে সরাসরি কোন যুদ্ধ হয়েছিল কিনা তা জানা যায় না। তবে শশাঙ্ক যে রাজ্যবর্ধনকে হত্যা করেছিলেন তার কিছু ইঙ্গিত রয়েছে। এ সম্পর্কে সমসাময়িক সূত্রগুলােতে ভিন্ন ভিন্ন ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায়।
বাণভট্ট এবং হিউয়েন সাং উভয়েই তাঁদের লেখনিতে রাজ্যবর্ধনকে হত্যা করার পেছনে শশাঙ্কের ষড়যন্ত্র এবং বিশ্বাসঘাতকতা সক্রিয় ছিল বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন। বস্তুতপক্ষে বিষয়টি বেশ ঘােলাটে। বাণভট্ট হর্ষচরিতে লিখেছেন যে, গৌড়ের রাজার মিথ্যা উপাচারে আশ্বস্ত হয়ে নিরস্ত্র রাজ্যবর্ধন একাকী গৌড়ের রাজার ভবনে গমন করেন এবং তৎকর্তৃক নিহত হন। রাজ্যবর্ধন নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে শত্রুর কাছে কেন গিয়েছিলেন তার ব্যাখ্যা বাণভট্টের কাছ থেকে পাওয়া যায় না। অবশ্য হর্ষচরিতের টীকাকার চতুর্দশ শতাব্দীর শংকর, শশাঙ্ক কর্তৃক নিজ কন্যাকে রাজ্যবর্ধনের কাছে বিবাহের প্রলােভনের কথা উল্লেখ করে এর একটি ব্যাখ্যা দেবার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু প্রশ্ন আসে, প্রায় সাতশত বছর পর এ ধরনের প্রলােভনের কথা শংকর পেলেন কোথায়? হিউয়েন সাং-এর বিবরণের এক স্থানে পাওয়া যায়, শশাঙ্কের মন্ত্রীগণ রাজ্যবর্ধনকে এক সভায় আমন্ত্রণ করে হত্যা করেন। অন্যত্র তিনি লিখেছেন, রাজ্যবর্ধনের মন্ত্রীগণের দোষেই রাজ্যবর্ধন শত্রুর হাতে নিহত হয়েছেন। তৃতীয় একটি উৎস হিসেবে হর্ষবর্ধনের একটি শিলালিপিতে প্রাপ্ত তথ্যকে গ্রহণ করা যেতে পারে। এতে বলা হয়েছে, ‘সত্যানুরােধে (সত্যকে প্রতিষ্ঠা করার জন্যে বা প্রতিজ্ঞা রক্ষাকল্পে) রাজ্যবর্ধন শত্ৰুভবনে প্রাণত্যাগ করেছিলেন। এই তিনটি তথ্যের ওপর ভিত্তি করে অনেকে বলার চেষ্টা করেন যে, শশাঙ্ক একজন বিশ্বাসঘাতক’। কিন্তু মনে রাখা দরকার, বাণভট্ট ও হিউয়েন সাং কেউই শশাঙ্কের স্বপক্ষীয় নয়। সুতরাং তাদের উক্তি সর্বাংশে গ্রহণযােগ্যও নয়। তাছাড়া উক্তিগুলাের মধ্যে অস্পষ্টতা রয়েছে। আধুনিক ঐতিহাসিকদের অনুমান, কনৌজের দিকে অগ্রসর হবার পথে রাজ্যবর্ধন শশাঙ্কের সাথে সম্মুখযুদ্ধেও পরাজিত হতে পারেন। অথবা তার মন্ত্রীবর্গের ষড়যন্ত্রে তিনি মৃত্যুবরণ করেছিলেন এমনও মনে করা যেতে পারে। রাজ্যবর্ধনের এই পরাজয়’ ও ‘মৃত্যুর বিষয়টি তাঁর স্বপক্ষীয় লেখকরা হয়তাে কৌশলে এড়িয়ে গেছেন। তবে ঘটনা যাই হােক না কেন, রাজ্যবর্ধনের মৃত্যু সংক্রান্ত ঘটনার সাথে যে কোন ভাবেই হােক শশাঙ্ক যে জড়িত ছিলেন তাতে কোন সন্দেহ নেই। এ থেকে অনুমান করা যায় প্রাচীন বাংলার একজন নৃপতি হিসেবে শশাঙ্ক ছিলেন বেশ বুদ্ধিমান ও শক্তিশালী।
হর্ষবর্ধনের বিরুদ্ধে শশাঙ্ক
প্রাচীন ভারতে হর্ষবর্ধনকে বলা হয় তৃতীয় সাম্রাজ্যবাদী পুরুষ। এই শক্তিশালী সম্রাটের বিরুদ্ধেও শশাঙ্কের নেতৃত্বে বাংলার স্বাধীন অস্তিত্ব অক্ষুন্ন ছিল। শশাঙ্কের ইতিহাসে সবচাইতে বড় ঘটনা সম্ভবত এটাই। যাহােক, শশাঙ্কের সাথে হর্ষবর্ধনের কোন যুদ্ধ হয়েছিল কি না তা নিশ্চিত করে জানার উপায় নেই। ‘আমঞ্জুশ্রীমূলকল্প’ গ্রন্থে এ বিষয়ে সামান্য কিছু উল্লেখ আছে। গ্রন্থটি ঐতিহাসিক গ্রন্থ হিসেবে স্বীকৃত নয়। এটি কেবল বৌদ্ধ ধর্ম ও ধর্মাবলম্বীদের সম্বন্ধে কিছু কিংবদন্তীর সমাহার। তদুপরি এ গ্রন্থে রয়েছে আদ্যক্ষরজনিত সমস্যা। অর্থাৎ এতে উল্লিখিত সব নামই হয় নামের প্রথম অক্ষর বা সমার্থক শব্দ দ্বারা। লেখা। যেমন- রাজা ‘সােম’ সম্ভবত শশাঙ্ক এবং তার শত্রু রাজা ‘হ’ ও তাঁর জ্যেষ্ঠভ্রাতা রাজা ‘র’ সম্ভবত যথাক্রমে হর্ষবর্ধন ও রাজ্যবর্ধন। এ গ্রন্থে হর্ষবর্ধন কর্তৃক শশাঙ্কের পরাজয়ের ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে। কিন্তু ‘আর্যমঞ্জুশ্রীমূলকল্প’ গ্রন্থের বর্ণনা এ কারণেই গ্রহণযােগ্য নয় যে- শশাঙ্ক সত্যিই পরাজিত হলে বাণভট্ট বা হিউয়েন সাং অবশ্যই তা উল্লেখ করতেন। সবচেয়ে বড় কথা হলাে ৬১৯ খ্রিস্টাব্দের গঞ্জম লিপি থেকে প্রমাণ হয় শশাঙ্ক ততােদিন পর্যন্ত নিজ রাজ্যে অক্ষুন্ন ছিলেন। সুতরাং হর্ষবর্ধন শশাঙ্কের রাজ্য আক্রমণ করে হয়তাে কিছু সাফল্য অর্জন করেছিলেন; কিন্তু তাঁকে প্রত্যাবর্তন করতে হয়েছিল। আর হিউয়েন সাং-এর বিবরণ হতে মনে হয় শশাঙ্ক ৬৩০ খ্রিস্টাব্দের পূর্ব পর্যন্তও নিজ রাজ্যে বিরাজমান ছিলেন। যে হর্ষবর্ধন উত্তর ভারতব্যাপী বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন; যিনি ক্ষমতায় বসেই তাঁর ভ্রাতৃহন্তাকারী শশাঙ্কের বিরুদ্ধে প্রতিশােধ নেবার জন্যে পৃথিবীকে গৌড়শূন্য করবেন বলে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন; যিনি কামরূপের ভাস্কর বর্মণের সাথে শশাঙ্কের বিরুদ্ধে মিত্রতা গড়ে তুলে তাঁকে বিপর্যস্ত করতে চেয়েছিলেন; সেই হর্ষবর্ধন শশাঙ্কের জীবদ্দশায় সম্ভবত উল্লেখযােগ্য তেমন কিছুই করতে পারেন নি। উভয়দিকে শলুবেষ্টিত হয়েও শশাঙ্ক আমৃত্যু গৌড়রাজ্য তথা বাংলার স্বাধীন সত্তা অক্ষুন্ন রাখতে সমর্থ হন। কেননা আমরা দেখি যে, শশাঙ্কের মৃত্যুর পরই ভাস্করবর্মণ এবং হিউয়েন সাং বাংলায় প্রবেশ করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
শশাঙ্কের ধর্মমত
শশাঙ্ক শৈব ছিলেন। তাঁর মুদ্রায় শিবের মূর্তি উত্তীর্ণ করা হতাে। হিউয়েন সাং শশাঙ্কের বৌদ্ধ বিদ্বেষ ও বৌদ্ধদের ওপর অত্যাচারের নানান কাহিনী লিপিবদ্ধ করেছেন। বাণভট্ট শশাঙ্ককে ‘গৌড়াধম’, ‘গৌড়ভুজঙ্গ’ ইত্যাদি আখ্যা দিয়েছেন। শশাঙ্ক শৈব ধর্মের পৃষ্ঠপােষক ছিলেন। এটা হয়তাে বৌদ্ধ ধর্মের প্রসার কিছুটা রােধ করেছিল। তাই অনেকেই মনে করেন, শশাঙ্কের বৌদ্ধ নির্যাতনের কাহিনীর মধ্যে অতিশয়ােক্তি আছে। কেননা হিউয়েন সাং বাংলায় বৌদ্ধ সংস্কৃতির যে বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন তা থেকে প্রমাণ করা মুশকিল যে, শশাঙ্ক ব্যাপকভাবে বৌদ্ধ নিধন করেছিলেন। শশাঙ্কের মৃত্যু প্রসঙ্গে হিউয়েন সাং বলেন, ‘৬৩০ খ্রিস্টাব্দের অল্পকাল পূর্বে শশাঙ্ক গয়ার বােধিবৃক্ষ ছেদন করেছিলেন এবং নিকটবর্তী মন্দির হতে বুদ্ধ মূর্তি সরিয়েছিলেন। এর ফলে শশাঙ্কের সারা দেহে ক্ষত হয়, মাংস পঁচে যায় এবং তাঁর মৃত্যু হয়।’ এ বিবরণ ‘বিদ্বেষপ্রসূত’ বলেই মনে হয় এবং এর ভিত্তিতে শশাঙ্ককে সম্পূর্ণভাবে বৌদ্ধ বিদ্বেষী বা সাম্প্রদায়িক মনে করা যুক্তিযুক্ত হবে না।
শশাঙ্কের কৃতিত্ব
আধুনিক ঐতিহাসিকদের অনেকেই শশাঙ্ককে বাংলার প্রথম ‘গুরুত্বপূর্ণ নৃপতি’ হিসেবে আখ্যা দিতে চান। এর স্বপক্ষে যথেষ্ট যুক্তিও দেয়া যেতে পারে। ড. রমেশ চন্দ্র মজুমদার বলেন, “শশাঙ্ক তার রাজ্য জয় দ্বারা যে নীতির পত্তন করেন তা অনুসরণ করে পাল রাজারা বিশাল এক সাম্রাজ্য স্থাপন করেন।” বাস্তবিকই শশাঙ্কই প্রথম রাজব্যক্তিত্ব যিনি বাংলার গৌরবময় অম্লিত্বের সংবাদ সর্বভারতে ছড়িয়ে দেন। সর্বভারতীয় শক্তির বিরুদ্ধে বাংলার স্বাধীন সার্বভৌম সত্তার প্রকাশ এবং বাংলার স্বাধীন অস্তিত্ব অক্ষুন্ন রাখার কৃতিত্ব। শশাঙ্কের নেতৃত্বেই ঘটেছে। এ পর্যন্ত প্রাপ্ত সাক্ষ্য প্রমাণে দেখা যায়, শশাঙ্কই বাংলার প্রথম নৃপতি যার ভূমিদান করার মতাে এবং মুদ্রা প্রকাশ করার মতাে ক্ষমতা ছিল। তিনি বাংলার শক্তি নিয়ে উত্তর ভারতের। রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করেন এবং কিছু সাফল্যও ছিনিয়ে আনেন। এভাবে সপ্তম শতাব্দীর বাংলার ইতিহাসে শশাঙ্ক, বলা যায় অনেকটা আকস্মিকভাবেই কৃতিত্বের আলাে ছড়িয়ে দেন। সার্বিক বিচারে তাই তাঁকে বাংলার প্রথম ‘গুরুত্বপুর্ণ নৃপতি’ হিসাব মেনে নেয়া যেতে পারে।
বাংলার প্রথম গুরুত্বপূর্ণ নৃপতি শশাঙ্ক সপ্তম শতাব্দীর প্রথমার্ধের শাসক। গুপ্ত শাসনের পর বাংলার গৌড় রাজ্যের তিনি অধিপতি হন। তাঁর রাজ্যসীমা দক্ষিণে উড়িষ্যার চিল্কা হ্রদ পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল। মৌখরী এবং ‘পুষ্যভূতি’ বংশের বিরুদ্ধে তিনি বাংলার স্বাধীন সত্তা অক্ষুন্ন রাখতে সক্ষম হন। এমনকি উত্তর ভারতীয় রাজনীতিতে হস্তক্ষেপের মাধ্যমে তিনি বাংলার পক্ষে কিছু সাফল্যও অর্জন করেন। মালবরাজ দেবগুপ্তের সঙ্গে মৈত্রী স্থাপন এবংকূটনৈতিক দক্ষতায় তিনি নিজের অবস্থানকে সুদৃঢ় করেন। শশাঙ্কই বাংলার প্রথম নৃপতি যার ভূমিদান করার মতাে এবং মুদ্রা প্রকাশ করার মতাে স্বাধীন ক্ষমতা ছিল। রাজ্যবর্ধনের হত্যাকান্ডের সাথে তাঁর সম্পৃক্ত থাকার বেশ কিছু পরােক্ষ প্রমাণ পাওয়া যায় যা শশাঙ্কের কৃতিত্বকেই নির্দেশ করে। বাংলার সদর্প রাজনৈতিক অস্তিত্বের সংবাদ সর্বভারতে প্রচার করার গৌরবে শশাঙ্ক মহিমান্বিত।
‘নবজাগরণ’ অ্যান্ড্রোয়েড অ্যাপ্লিকেশনটি প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর টেলিগ্রাম চ্যানেলে জয়েন হতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর ফেসবুক পেজে লাইক করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।