সম্প্রতি নরেন্দ্র মােদির নেতৃত্বে বিজেপি সরকার সিংহাসনে আসীন হওয়ার পরপরই বিনায়ক দামােদর সাভারকর এর মতাে বিতর্কিত ব্যক্তিত্বের জীবনী শিশুপাঠ্যে অন্তর্ভুক্তির প্রয়াস চলছে। গুজরাত ও মধ্যপ্রদেশে বিজেপি সরকারের এই সচেষ্টতা নিয়ে ইতিমধ্যেই বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। আসলে সাভারকরকে মহান জাতীয়তাবাদী হিসেবে তুলে ধরতে চায় বিজেপি। তার ওপর কিছু তথাকথিত বুদ্ধিজীবীও যেভাবে ‘বীর’ সাভারকরের জায়গান গাইছেন তা পড়লে অবাক হতে হয়। তাঁদের কেউ কেউ সাভারকরকে বঙ্কিমচন্দ্র বা বিবেকানন্দের সঙ্গে একাসনে বসানাে যায় বলেও মন্তব্য করছেন। এককথায় সাভারকরকে ঘিরে তাদের মরিয়া প্রয়াস ‘গােয়েবলসীয় অভিসন্ধি’র পর্যায়ে পড়ে। উল্লেখ্য, সাভারকর ১৯৬৬ সালে মুম্বইয়ে ৮৩ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। সে সময়ে বা মৃত্যুর পরেও প্রায় তিন দশক ধরে তাকে নিয়ে বিশেষ তােলপাড় হয়নি, কেউ হইচই করেনি। কিন্তু নয়ের দশক থেকে দেখা গেল সাভারকরকে ‘জাতীয় বীর’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার বিশেষ তােড়জোড় শুরু হয়েছে অর্থাৎ নয়ের দশকের শেষের দিকে যখন কেন্দ্রে ক্ষমতায় বিজেপি’র বাজপেয়ী সরকার এল তখন থেকে তারা সাভারকরকে যেন নতুন করে আবিষ্কার করল। বাজপেয়ীর সময়ে সাভারকরের ছবি টাঙায় ও আন্দামান সেলুলার জেলে গান্ধিজির বাণীর পাশে সাভারকরের বাণী স্থাপন করে। বিজেপি পুনরায় ক্ষমতায় আসার জেরে বিজেপিওয়ালারা ফের সাভারকরকে পুনরুজ্জীবিত করতে চাইছে।
হিন্দুত্ব তত্ত্বের ভিত্তিতে সাভারকর জাতীয়তাবাদের যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন তার পর্যালােচনা করলে দেখা যাবে, হিন্দুত্ব সম্পর্কে তাঁর থিসিসের মূলকথা হল- হিন্দুরা একটি আলাদা জাতি। সাভারকর তার হিন্দুত্ব ‘হু ইজ হিন্দু’ (১৯২৩) বইটিতে সর্বপ্রথম দ্বিজাতিতত্ত্বের প্রবক্তা হিসেবে হিন্দুদের একটি জাতি হিসেবে উল্লেখ করেন ১৯২৩ সালে। এ আর দেশাই মনে করেন, সাভারকরের ‘হিন্দুত্ব’র সংজ্ঞা মেনে নিলে ভারতীয় মুসলমানরা একটা আলাদা জাতি। সাভারকর তার রাজনীতি জীবনের শুরু থেকেই বলে আসছেন হিন্দু-মুসলিম দুটি স্বতন্ত্র জাতি। ‘হিন্দুরাষ্ট্র দর্শন’ নামক গ্রন্থেও তিনি বারবার তা বলেছেন। প্রসঙ্গত বলা প্রয়ােজন, এরকম একটি ধারণা প্রচলিত আছে যে, জিন্নাহ দ্বিজাতিতত্ত্বের প্রবক্তা। জিন্নাহ তাঁর দ্বিজাতিতত্ত্ব প্রচার শুরু করেন ১৯৩৯ সালে ও ১৯৪০ সালে ভারত ভাগের দাবি তােলেন। একই দাবি সাভারকর তুলেছিলেন তারও দেড় দশক আগে। তবে এটা ঠিক যে, সাভারকর দেশভাগের দরকষাকষিতে প্রত্যক্ষ জড়িত ছিলেন না, কিন্তু তার দ্বিজাতিতত্ত্বভিত্তিক রাজনীতি যে দেশভাগের পথকে বহুলাংশে মসৃণ করতে সহায়ক হয়েছে, তা কোনওভাবেই অস্বীকার করা যায় না। তাহলে তাে দেশভাগের দায় থেকে স্যার সৈয়দ আহমদ খান বা মহম্মদ ইকবালকেও অব্যাহতি দিতে হয়। কারণ, তাঁরাও দেশভাগের দরকষাকষিতে সরাসরি জড়িত ছিলেন না। রমেশচন্দ্র মজুমদার তাঁর ‘স্ট্রাগল ফর ফ্রিডম’ গ্রন্থেযথার্থভাবেই বলেছেন, সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে দেশভাগ করার কথা ওঠার পিছনে একটা গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বহুলাংশে কাজ করেছে। সেটা ছিল হিন্দু মহাসভা। আর এই হিন্দু মহাসভারই তাত্ত্বিক নেতা ছিলেন সাভারকর। অথচ অনেক বুদ্ধিজীবী অনায়াসে বলে ফেলেন, দেশভাগের দায় হিন্দুমহাসভা ও সাভারকরের ওপর চাপে কী করে? দেশভাগ তাে আর ২/১ বছরে সম্ভব নয় বা ২/১ জন নেতার কৃতিত্বও নয়। দেশভাগ আমাদের ধারাবাহিক সাম্প্রদায়িক কার্যকলাপের স্বাভাবিক শেষ পরিণতি- যার জন্য মুসলিম লিগ, কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভা। মূলত সমানভাবে দায়ী। সাভারকরের জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে এরূপ সিদ্ধান্তে আসা অসমীচীন হবে না যে, হিন্দু জাতি, হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দিকটিই তাঁর চিন্তার মধ্যে প্রাধান্য পেয়েছে। এক্ষেত্রে ভেবে দেখা দরকার যে, ভারতের মতাে একটি বহু সংস্কৃতিসম্পন্ন দেশে এই ধরনের ভাবনা সংকীর্ণর্তারই পরিচয় বহন করে। আরও গুরুত্বপূর্ণ দিকটি হল, যে কোনও ব্যক্তির রাজনৈতিক ভাবনা পর্যালােচনা করতে গেলে সমকালীন পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত হওয়া প্রয়ােজন। সাভারকর এবং তাঁর সংগঠন হিন্দু মহাসভা যে সময়ে তাদের মতাদর্শ ব্যক্ত করেছিলেন, সেই সময়টা হল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থার আধিপত্যমূলক শাসনব্যবস্থা। এরূপ শাসনকাঠামােতে কোও বিশেষ সম্প্রদায়ের আদর্শ প্রচারিত করা বা গৌরবান্বিত করার মধ্যে দিয়ে প্রকৃত জাতীয়বাদ গড়ে উঠতে পারেনা। অর্থাৎ যে শক্তিশালী জাতীয়তাবাদী শিখা সাভারকর প্রজ্বলিত করেছিলেন, সেটি ছিল হিন্দু জাতীয়তাবাদ, ভারতীয় জাতীয়তাবাদ নয়। আর সাভারকরের আত্মত্যাগের নমুনা! এটা ঠিক, দেশের মুক্তির জন্য নানা বিপ্লবাত্মক কাজে সাভারকরের দুঃসাহসিক ভূমিকা কোনওভাবেই অস্বীকার করা যায় না। তবে মনে রাখতে হবে সেটা ১৯০২-০৩ থেকে ১৯১০-১১ পর্যন্ত। তারপর থেকে শুধু বিশ্বাসঘাতকতার কাহিনি; কীভাবে ব্রিটিশদের সাহায্য করা যায়। সাভারকরের আন্দামানে বন্দিজীবন শুরু করার পর থেকেই (১৯১১) ব্রিটিশ সরকারের কাছে মুক্তির জন্য ক্ষমাভিক্ষা করতে শুরু করেন। তার ওপর কোনও বিপ্লবাত্মক কাজের জন্য কোনওদিন সাভারকর নিজে পিস্তলের ঘােড়া টেপেননি, যা ক্ষুদিরাম, সূর্য সেন, মদনলাল, ভগৎ সিং, আবদুল্লাহ, শের আলি প্রমুখ বিপ্লবীরা সর্বদা করেছেন। সাভারকর কখনও তা করেননি – অপরকে দিয়ে করিয়েছেন। তাঁর বিরুদ্ধে কোনও অভিযােগ প্রমাণিত হতে পারে এমন সব সাক্ষ্যপ্রমাণ তিনি নিজহাতে মুছে দিতেন। তাই কোনও মামলাতেই তিনি সরাসরি হত্যার অভিযােগে অভিযুক্ত হননি। তাছাড়া, ১৯০৯ সালে প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ ১৮৫৭ নামে সাভারকর একখানা ছোট বই লিখে ব্রিটিশ বিরােধী লড়াইয়ে মানুষকে প্রাণিত করার চেষ্টা করেন। কিন্তু সে বইয়ের মধ্যেও যে উগ্রতা ও জাতিবিদ্বেষ প্রচার করা হয় তাও বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়।
এই উগ্রতা ছিল তার বাল্যজাত। সাভারকরের বয়স যখন ১০ বছর তখন একটি মসজিদ আক্রমণ করে তিনি পরবর্তীকালে যাকে দেশসেবা বলেছেন, তার প্রথম পাঠ নেন। সাভারকরের স্মৃতিচারণা উদ্ধৃত করা যায় “We vandalished the mosque to our heart’s content and raised the flag of our bravery on it. We followed the war strategy of Shivaji completly and ran away from the site after ac| complishing our task.” শুধু তাই নয়, ব্রিটিশ শাসিত ভারতে স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থাকবেন না, এই শর্তে মুচলেকা দিয়ে জেল থেকে ছাড়া পেয়েছিলেন সাভারকর। এক ক্ষমাপত্রে (১৯১১ সালে) তিনি লেখেন, “অনুতপ্ত পুত্র পিতৃ-মাতৃসদৃশ সরকারের দরজা ছাড়া আর কোথা ফিরতে পারে।” ১৯৩৩-এর ১৪ নভেম্বর এক আবেদনপত্রে তিনি লেখেন, “ভারতের প্রতিরক্ষা ও ইল্যান্ডের বিজয়ের জন্য আমরা সেনাবাহিনীতে স্বেচ্ছাসৈনিক হিসেবে নিজেদের উৎসর্গ করব। অতএব আমাদের মুক্তি দিন…।” অর্থাৎ নিজের মুক্তির জন্য বিপ্লবীসত্তা সম্পূর্ণ বিসর্জন দিতেও তিনি পিছপা ছিলেন না। এরপর সাভারকর যা করেছেন তা ব্রিটিশ সরকারের দালালি বললেও কম বলা হবে—
১) ১৯৩৯ সাভারকর আসন্ন জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে নিঃশর্ত সহযােগিতার আশ্বাস দেন।
২) ৭ অক্টোবর ১৯৩৯ সালে রাষ্ট্রসচিব লর্ড জেটল্যান্ডকে একটি রিপাের্ট পাঠান ভাইসরয় লিনলিথগাে। তাতে বলা হয়, সাভারকর ব্রিটিশ সরকারের বন্ধুর মতাে।
৩) সাভারকর ভারতের সাম্রাজ্যবাদ বিরােধী আন্দোলনকে নির্বোধ ও মূর্খের প্রচেষ্টা মাত্র বলে উল্লেখ করেন।
৪) ১৯৪২-এর আগস্ট আন্দোলনের সময় সাভারকর স্থানীয় নির্বাচিত সংস্থা ও প্রাদেশিক আইনসভার হিন্দু মহাসভার সদস্যদের নির্দেশ দেন, তাঁরা এবং সরকারি কর্মীরা যেন নিজেদের পদ বজায় রেখে নিয়মিত কাজে যােগ দেন। এই সময় তার যুদ্ধকালীন স্লোগান ছিল ‘রাজনীতির হিন্দুত্বকরণ ও হিন্দুত্বের সামরিকীকরণ’, যা সাধারণভাবে ছিল ব্রিটিশের সঙ্গে সহযােগিতা ও মুসলিম বিরােধী প্রচারের সংমিশ্রণ। এই সময় মুসলিম লীগও ব্রিটিশের সঙ্গে সহায়তা ও তীব্র সাম্প্রদায়িক প্রচার চালিয়ে যাচ্ছিল।
৫) তিনি ভারতের ত্রিবর্ণরঞ্জিত জাতীয় পতাকার বিরােধী ছিলেন। সাভারকর মনে করতেন গেরুয়া পতাকাই ভারতের জাতীয় পতাকা। শুধু কি তাই? গান্ধি হত্যার সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন। ফলস্বরূপ সাভারকরকে ২ বছর জেলে থাকতে হয়। সাভারকর সহ ৮ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল। কয়েকজনের ফাঁসি হয়। সাভারকর সহ বাকিরা ছাড়া পেয়ে যান। এটা ঠিক যে, সাভারকর গান্ধি হত্যার দায় থেকে অব্যাহতি পেয়েছিলেন। আসলে সাভারকর সম্পর্কে দিল্লি স্পেশাল আদালতের রায় আইন বিশেষজ্ঞ মহলে বিতর্কিত। তাঁদের মতে, সাভারকরকে দোষী সাব্যস্ত করার যথেষ্ট প্রমাণ আদালতের হাতে ছিল। কিন্তু আদালত সেগুলােকে সুষ্ঠুভাবে ব্যবহার করেনি বা করতে পারেনি। উল্লেখ করা যেতে পারে, পুলিশ মহলে গান্ধিঘাতক নাথুরাম গডসের সঙ্গে সাভারকরের নিবিড় ঘনিষ্ঠতা এতটাই সুপরিজ্ঞাত ছিল যে, হত্যাকাণ্ডের পরদিনই সাভারকারের বাসভবনে পুলিশি তল্লাশি হয়। গান্ধি হত্যার ১৩ দিন আগে সাভারকরের বাড়ি গিয়ে তাঁর আশীর্বাদ নিয়েছিলেন গডসে। সাভারকর গডসেকে বলেছিলেন, বিজয়ী হয়ে ফিরে এসাে। কাপুর কমিশন, এমনকি তখনকার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার প্যাটেলও সাভারকরকে গান্ধিহত্যা ষড়যন্ত্রের অন্যতম একজন বলে মনে করতেন।
এহেন সাভারকরকে মহান দেশপ্রেমিক বলে প্রতিপন্ন করাটা কি এতই সহজ! অতীতের কিছু বিপ্লবাত্মক কাজের কথা উল্লেখ করেও সাভারকরের মতাে ইংরেজ সরকারের বলিষ্ঠতম প্রবক্তাকে কোনওভাবেই তােল্লা দেওয়া যায় না। তাহলে তাে জিন্নাকে ‘দেশপ্রেমিক’ বলে প্রচার চালাতে হয়। আমাদের দেশের বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ভিত্তিই হল ধর্মনিরপেক্ষতা। কোনও ধর্মীয় রাষ্ট্রে সংসদীয় গণতন্ত্র থাকে না। সাভারকরের তত্ত্ব অনুসারে এই দেশ হিন্দুরাষ্ট্র হলে এখানে সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রবর্তিত হত না, যেমন হয়নি পাকিস্তানে। অথচ পূর্বের বিজেপি সরকারের আমলে লােকসভার সেন্ট্রাল হলে সাভারকরের একটি তৈলচিত্র স্থাপন করা হয়েছিল। দেশবন্ধু, বিশ্বকবি, জাতির জনকের ছবির পাশে সাভারকর, জাতির জনকের বাণীর পাশে সাভারকরের বাণী, ইতিহাসের মর্মান্তিক পরিহাস বৈকি! আর এখন শিশুপাঠ্যে সাভারকরের জীবনী! হতেই পারেন সাভারকর বিজেপির ভাবাদর্শের দিশারী। তাতে দেশ বা জাতির কী যায় আসে? দল আর দেশ কি এক? চাইলেই কি ক্ষুদিরাম, ভগৎ সিং, আসফাকউল্লা, সূর্য সেন, রামমােহন, রবীন্দ্রনাথ, গান্ধির সমার্থক হয়ে ওঠা যায়?