লিখেছেনঃ সুরজিৎ দাশগুপ্ত
নতুন বছর শুরু হওয়ার ঠিক আগে মর্মান্তিক দিল্লি ধর্ষণকাণ্ডের পরে সারা দেশজুড়ে নারীর অধিকার ও অবস্থান নিয়ে অনেক তর্ক-বিতর্ক শুরু হয়েছে। এইসবে ইন্ধন জুগিয়েছে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ, খাপ পঞ্চায়েত প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিদের এবং বিভিন্ন রক্ষণশীল ব্যক্তির নানারকম মন্তব্য। সাধারণভাবে বলতে পারি যে, রক্ষণশীলরা প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতির দোহাই দিয়ে আমাদের বোঝাতে চেয়েছেন যে, সব অবস্থাতেই নারী পুরুষের ইচ্ছাধীন এবং নারীর কোনও স্বাধীন ইচ্ছা, চিন্তা ও জীবন নেই।
এটা তো ঠিকই যে, ভারতের ইতিহাসের এবং জনসংখ্যার বৃহত্তম অংশই হিন্দু বিধিবিধান তথা হিন্দু সংস্কৃতি দিয়ে শাসিত। হিন্দু সংস্কৃতির যেমন একটা আধ্যাত্মিক ও তাত্ত্বিক তেমনই একটা সামাজিক ও দেওয়ানি ক্ষেত্র আছে। শেষোক্ত বিষয়ে সংস্কৃতির যে ধারা চলে আসছিল তাতে ছন্দপতন ঘটে ভারত স্বাধীন হওয়ার পরে সংসদে গৃহীত কতকগুলি আইনে। অবশ্য আইনগুলি প্রচলনের আগেই সংবিধানে স্ত্রী ও পুরুষের সমতা ঘোষণা করেই ভারতীয় সংস্কৃতির একটা ঐতিহ্যের উপর আঘাত হানা হয়। কারণ আমাদের সংস্কৃতি অনুসারে স্ত্রী ও পুরুষের জন্য পৃথক বিধান, পৃথক ব্যবস্থা। অথচ সংবিধানের সমান মূল্য নির্ধারণ করেছে স্ত্রী ও পুরুষের।
সংবিধান গ্রহণের কালে ১৯৫৫ সালের ৫ মে লোকসভায় হিন্দু বিবাহ বিল সংক্রান্ত ভাষণে প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু বলেছিলেন, ‘I I.c. (Hindu law) was not law of the statute book which could be changed at will. It encouraged many kinds of customs to grow up. When they grew up it acknowledged them. In fact, even today in India there are so many varieties of Hindu law… the essential quality of Hindu law in the old times was this dynamic quality. It did not change by decree or statute, but by allowing changes to creep in.’ হিন্দু বিবাহ আইন রচিত ও গৃহীত হয় ১৯৫৫ সালে। তার আগে একাধিক বিবাহ হিন্দু সমাজে ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল অরক্ষণীয়া কুলীন কন্যাদের পরিবারকে সমাজে স্বীকৃতি দেওয়ার শর্ত হিসেবে। অর্থাৎ হিন্দু সংস্কৃতির একটা সামাজিক অঙ্গ ছিল এ ধরনের বহু বিবাহ। কিন্তু ১৯৫৫ সালের হিন্দু আইনের প্রথম ধারাতেই বলা হয়েছে যে এই আইন অনুসারে যে বিবাহ হবে তাতে কোনও পক্ষেরই কোনও জীবিত স্ত্রী বা স্বামী থাকতে পারবে না এবং এই শর্তেই সমস্ত হিন্দু বিবাহ এক-বিবাহ প্রথায় বাঁধা পড়েছে। বিচার বিবেকের যে যুক্তিবুদ্ধি বা মানসিকতা দিয়ে এই এক-বিবাহ প্রথাকে আইনে পরিণত করা হল তাকে সংস্কৃতি বলব না মূল্যবোধ বলব?
এখানে বলে রাখা ভাল যে ভারতে মধ্যে মধ্যে অভিন্ন দেওয়ানি আইন প্রণয়ন করার দাবি ওঠে। কিন্তু বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের পৃথক পৃথক দেওয়ানি আইনগুলিকে সংঘবদ্ধ করার বা অভিন্ন আকার দেওয়ার আগে ভাষাভাষী, সম্প্রদায় ও রাজ্যবাসী নির্বিশেষে সমগ্র হিন্দু সমাজের জন্য দায়ভাগ, মিতাক্ষরা ও যৌথ পরিবার সংক্রান্ত আইনের ভেদাভেদ ঘোচানো প্রয়োজন কি না এ বিষয়ে কোনও সদুত্তর অভিন্ন আইনের দাবিদারদের কাছ থেকে পাওয়া যায়নি। তদুপরি স্মর্তব্য যে সংবিধান প্রদত্ত মৌলিক অধিকারগুলির অন্যতম হচ্ছে স্ব স্ব ধর্ম পালনের অধিকার। ওই মৌলিক অধিকার খণ্ডন বা লঙঘন না করে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি প্রণয়ন অসম্ভব।
ফিরে আসি ১৯৫৫ সালের হিন্দু বিবাহ আইনের প্রসঙ্গে। এটা ঠিক যে একজন হিন্দু পরুষের জন্য বহু নারীর সংখ্যানুপাতে স্বাভাবিক অসঙ্গতি থাকলেও কুলীন ও সম্পন্ন হিন্দু পরিবারে বহু বিবাহ এককালে ছিল যথেষ্ট জনপ্রিয় এবং হিন্দু পুরুষের বহু বিবাহের উপর আইনের রাশ টানার ব্যাপারটাতে হিন্দু সংস্কৃতির রক্ষকগণ প্রবল বাধা দিয়েছিলেন। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙেঘর প্রধান গুরু গোলওয়ালকর তো এমন কথাও বলেছিলেন যে এক-বিবাহের পক্ষে আইন প্রবর্তন করলে হিন্দু পুরুষদের সামনে পতিতালয়ের দরজা খুলে দেওয়া হবে। তিনি বোধহয় বিশ্বাস করতেন যে বহু নারীকে ভোগ করাটা পুরুষের জন্মগত অধিকার এবং বহু নারীকে ভোগ করতে না পারলে সে তো বিকল্প পথেই যাবে।
ভারতের সংস্কৃতিতে নারীকে খুবই উচ্চ স্থান দেওয়ার কথা আমরা প্রায়ই শুনি। কিন্তু ঘটনা এই যে স্বর্গবাসিনী দেবীর স্থান যত উঁচুতেই থাকুক না কেন, মর্তবাসিনী নারীর মূল্য দু’টি কারণ দিয়ে নির্ধারিত একটি কারণ সে ভোগের বস্তু আর অন্য কারণটি হল সে পুত্রের জন্মদাত্রী। তাই সে যদি শুধু কন্যা সন্তানই জন্ম দেয়, তাহলে তাকে ত্যাগ করাই বিধেয়। পুত্রার্থে ক্রিয়তে ভাৰ্যা, পুত্র দিতে না পারলে তার সঙ্গে বাস করা কেন? আর সহবাস মানে কী? গৃহসূত্রে বলা হয়েছে সতীনারী পতির উচ্ছিষ্টে প্রাণ ধারণ করে। আর মনুসংহিতাতে বলা হয়েছে যে, নারীর জন্য উপনয়ন হল বিবাহ, গুরুগৃহে বাসই হল তার পতিগৃহে বাস এবং পতিসেবাই হল তার বেদপাঠ। বিয়ের সময় সালংকারা কন্যাকে দান করা হয় সামগ্রী রূপে শুধু বরের উদ্দেশে নয়, বরের কুলের উদ্দেশে। ভারতীয় সংস্কৃতিতে এই ছিল নারীর মূল্য বা স্থান। একবিবাহ প্রথা প্রবর্তন করে সংবিধানসম্মত সংসদ হিন্দু সংস্কৃতিকে কী লঙঘন করেনি? সংবিধানবলে গঠিত সংসদ আরও একটা বিষয়ে ভারতীয় সংস্কৃতিকে লঙঘন করেছে। যদিও প্রায় দেড়শো বছর আগে রামমোহন রায় উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্তব্য পৈতৃক। সম্পত্তিতে কন্যারও অংশ দাবি করেছিলেন তবু ভারতীয় সংস্কৃতির দুর্ভেদ্য দুর্গের প্রাচীরে সে দাবি কোনও দাগ ফেলতে পারেনি। অবশেষে ১৯৫৬ সালে সংসদ প্রবর্তন করল হিন্দু উত্তরাধিকার আইন। এই আইন অনুসারে কোনও ব্যক্তি আপন সম্পত্তির লিখিতভাবে বিলিবন্দোবস্ত না করে যদি মারা যান তা হলে নরনারী ভেদ না করে সে সম্পত্তি তার পুত্র ও কন্যাদের মধ্যে সমানভাবে ভাগ হবে। এই আইনের আর একটি বৈশিষ্ট্য হল ওই সম্পত্তির কারা কারা অংশ পাবে তার বিচার ধর্মীয় সূত্র ধরে হবে না, হবে প্রেম প্রীতি-স্নেহের সূত্র ধরে এবং কারা কারা এই সূত্রে সম্পত্তিটার অংশ পেতে পারে তারও বিশদ তালিকা এই আইনের অঙ্গীভূত।
এখানে এ কথাটাও বলে রাখা ভাল যে সম্প্রতি নারী-ধর্ষণ-নিগ্রহ-কাণ্ডাদি সংঘটনের পরে বিভিন্ন নীতিবাগীশরা নারীদের চালচলন অথবা পোশাক-পরিচ্ছদ সম্বন্ধে যেসব বিরূপ বা বিদ্বেষব্যঞ্জক মতামত ব্যক্ত করেছেন সেসবই, তলিয়ে দেখলে, সংবিধানের সত্তা বিরোধী। ভারতীয় সংবিধানে একই সঙ্গে ভারতীয় সংস্কৃতি র পরিপোষক এবং প্রতিবাদী। ভারতীয় সংবিধানের আগে বোধহয় ১৯৩৫-এর ভারত আইনের ২৯৮ ধারাতেই প্রথম ঘোষিত হয় যে ধর্ম, জন্মস্থান, কুল, বর্ণ ইত্যাদি বিচার করে ব্রিটিশ ভারতে কারও কর্মের কি জীবিকার অথবা সম্পত্তি ক্রয় বা বিক্রয়ের যোগ্যতা বিচার করা হবে না। এই ধারার মধ্যে সমস্ত মানুষকে সমান বলে গ্রহণ : করার জন্য একটা সুস্পষ্ট অভিমুখ দেখতে পাই।
হিন্দু নর-নারী, বিবাহ, উত্তরাধিকার, দত্তক গ্রহণ সংক্রান্ত আইন তথা নিয়মগুলি যারা প্রাচীনকালে রচনা করেছেন তাদের মধ্যে প্রধান হলেন মনু ও যাজ্ঞবল্ক্য এবং তাদের রচিত প্রধান গ্রন্থগুলি হল মনুসংহিতা এবং শতপথব্রাহ্মণ ও বৃহদারণ্যক উপনিষদ। যদিও রাধা ও কৃষ্ণের প্রেমলীলা হিন্দু মানসে গভীর আবেগ জাগায় তবু হিন্দু সমাজে তার দৃষ্টান্ত অনুসরণের পরিণাম মর্মান্তিকই হয় সাধারণত। গন্ধর্ব বিবাহের জন্য কোনও কোনও পঞ্চায়েতে দেওয়া হয় সাংঘাতিক শাস্তির বিধান। নরনারীর প্রেমকে হিন্দু সমাজে সাধারণভাবে সুনজরে দেখা হয় না। এমনকি স্বামী বিবেকানন্দ পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথের রচনায় কামনার প্রকাশ সম্বন্ধে ভগিনী নিবেদিতাকে সাবধান করেছিলেন। কিন্তু কৌতূহলোদ্দীপক যে বৃহদারণ্যক উপনিষদের চতুর্থ অধ্যায়ের জ্যোতি ব্রাহ্মণে যাজ্ঞবল্ক্য বলেছেন যে, প্রেমালিঙ্গনাবদ্ধ নরনারীর যেমন অন্য কিছুর জ্ঞান থাকে না তেমনই ব্রহ্মজ্ঞানে বাহ্য বস্তুর বোধ লুপ্ত হয়।
বোঝাই যাচ্ছে যে সংবিধান রচনার কালে রচয়িতাগণ শত শত শতাব্দীর ভারতীয় সংস্কৃতি র কিছু কিছু বিষয়ে, বিশেষত নরনারীর মর্যাদা ও সম্পর্ক সংক্রান্ত বিষয়ে, অনেকগুলি মৌলিক পরিবর্তন ও সংশোধন সাধন করেছেন। স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে যে কোন্ বিচারবুদ্ধি অনুসারে পুরুষদের সমান মূল্য মহিলাদেরও দেওয়া হয়েছিল? কোনও কোনও মাননীয় ব্যক্তি এটাকে পাশ্চাত্যের অনুসরণ বলে নিজেদের অজ্ঞতার পরিচয় দিয়েছেন। কারণ ভারতীয় সংবিধানে নারীকে যে মর্যাদা দেওয়া হয়েছে তা পশ্চিমের কোনও রাষ্ট্রব্যবস্থা ১৯৫০ সালের আগে পর্যন্ত কার্যত স্বীকৃত বা আইনত গৃহীত হয়েছে বলে জানি না। আসলে এখানে পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত ভারতীয় ব্যক্তিবিশেষের আধুনিক মূল্যবোধটাই কাজ করেছে বলে মনে হয়।
কাকে বলে মূল্যবোধ? এ প্রশ্নের এক কথায় উত্তর দেওয়া কঠিন। যেমন সমাজে বহুকাল ধরে প্রচলিত আচারপ্রথা রীতিনীতি পরম্পরা ক্রমে পরিণত হয় সংস্কৃতি তে তেমনইভাবে কি কালোপযোগী সংবেদনশীল ব্যক্তির উচিত-অনুচিত বিচারের প্রতিভাই বিশেষ প্রেক্ষিতে রূপান্তরিত হয় মূল্যবোধে? কিংবা বলা যায় কি যে, মূল্যবোধ হল সেই প্রেরণা যা সংস্কৃতিকে শোধন করে?
সুরজিৎ দাশগুপ্তের আরও কয়েকটি লেখা পড়ুন,
১) ভারতের ঔপনিবেশিক জাতীয়তাবাদ থেকে উত্তর-ঔপনিবেশিক জাতীয়তাবাদ
২) আধুনিক ভারতের জনক মহাত্মা রামমোহন
৩) নবাব সিরাজউদ্দৌল্লাহ : বিশ্ব-ইতিহাসের শিকার
৫) বিশ্বশান্তির ধর্ম নিয়ে রাধানগর থেকে ব্রিস্টল
৬) ভাষা মানে জনগোষ্ঠীর আবেগ ও আত্মা
৭) তেলেঙ্গানা থেকে গোর্খাল্যাণ্ড
৮) আমাদের এক দেশ, আমরা এক জাতি
৯) ভারতের ঔপনিবেশিক জাতীয়তাবাদ থেকে উত্তর-ঔপনিবেশিক জাতীয়তাবাদ
১০) মহাত্মা গান্ধীর সন্ধান – ইতিহাসের একটি অধ্যায়ের পূনর্মূল্যায়ন
১১) সতীদাহ প্রথার মর্মান্তিক ইতিহাস: দু’শতাব্দী আগে ও এখন
১২) এন্ড্রুজ ও রবীন্দ্রনাথঃ আধুনিক যুগের দুই মহৎ ব্যক্তিত্বের সংলাপ ও সংযোগ
১৪) বাংলাভাষা – ভাষার জন্য প্রাণ দিতে জানে যারা
১৫) স্বাধীন বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু