সেন শাসন যুগে ব্রাহ্মণ্যবাদী সমাজ ও রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রকগণ সাধারণ মানুষকে যেভাবে অধিকারচ্যুত করে রেখেছিলেন তাতে সাধারণ মানুষের বিপন্নবােধ করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। রাষ্ট্রযন্ত্র তাদের কোনােরূপ আাস দিতে পারেনি, দিয়েছে ঘৃণা আর অবজ্ঞা। অর্থনৈতিক বিপর্যয় তাদের জীবনকে ওষ্ঠাগত করে তুলেছিল। ফলে বেঁচে থাকার প্রয়ােজনই তাদের নিকট একটি পরিবর্তন কাম্য হয়ে দেখা দিয়েছিল। তাই সেন শাসনে নির্যাতিত বাঙালি ভাগ্য পরিবর্তনকারী শক্তির পরিচয় খুঁজতে যায়নি। সেই বিচারশক্তি তখন তাদের থাকার কথা নয়। শুধু এই প্রেক্ষাপটে বখতিয়ার খিলজি কে মুক্তির অগ্রদূত হিসাবেই তাদের নিকট মনে হয়েছে। ফলে বখতিয়ার স্থানীয় জনগােষ্ঠীর কাছ থেকে কোনাে বাধা পাননি। বরং পেয়েছেন নীরব সমর্থন। দীনেশচন্দ্র সেন লিখেছেন,
“বঙ্গ বিজয়ে জনসাধারণের কোন বিশেষ ক্ষোভের উৎপত্তি করে নাই। মুসলমান আগমনে বঙ্গীয় জনসাধারণ বরঞ্চ কতকটা হৃষ্টই হইয়াছিল। শুধু নব ব্রাহ্মণমণ্ডলী তাঁহাদের অনুগৃহীত দলবল সঙ্গে এবং কৌলীন্য-প্রাপ্ত ভদ্র-সমাজের একটা দল রাজকীয় প্রসাদ লাভ করিয়া রাজাকে অবলম্বন করিয়াছিল। এজন্য বঙ্গ বিজয় এত সহজে হইয়াছিল। দৃঢ়-সঙ্কলিত জাতীয় বাধা অতিক্রম করিয়া পরদেশাগত শত্ৰু কখনই এক রাজ্য দখল করিয়া দীর্ঘকাল স্বীয় শাসন বজায় রাখিতে পারে না। ইংরেদিগকে আমরা যেরূপ বাঙ্গলা দেশ হাতে তুলিয়া দিয়াছিলাম, মুসলমানদিগকেও তাহাই করিয়াছিলাম কিনা, এ সম্বন্ধে সেই আঁধার যুগেও সমগ্র ইতিহাস আমরা জানি না। কিন্তু নিম্নশ্রেণী-দলনকারী ব্রাহ্মণ্যপ্রভাবে। জনসাধারণ যেরূপ আতঙ্কিত হইয়াছিল, মুসলমানাধিকারে যে তাহা হয় নাই, তাহার আভাস নানা দিক হইতে পাওয়া যাইতেছে।
জনসাধারণের একটা প্রধান ভাগ ছিল বৌদ্ধ। বৌদ্ধ নেতৃবর্গ বঙ্গদেশ হইতে দূর সীমান্ত প্রদেশগুলিতে আশ্রয় লইয়াছিল। সুতরাং কর্ণধারহীন তরণীর ন্যায় বৌদ্ধ জনসাধারণ এই ব্রাহ্মণ্য আন্দোলনের জলধিতে টলমল করিতে লাগিল। ব্রাহ্মণগণ জাতি ভেদের বন্ধনী কসিয়া আঁটিতে লাগিলেন, রন্ধনের হাঁড়ি শালগ্রামের মত সিংহাসনে বসাইয়া তাহারা উহাকে ধর্মের প্রধান অবলম্বন স্বরূপ গ্রহণ করিলেন। ব্রাহ্মণের হাঁড়ি ছুঁইতে পারা দরিদ্রের পক্ষে রাজ-সিংহাসনে আরােহণ করা অপেক্ষাও অসম্ভব ব্যাপার হইয়া দাঁড়াইল। এদিকে আচার জিনিষটা নব-কৌলীন্যে একবারে মাথা ডিঙ্গাইয়া উপরে বসিল। যিনি ‘স্বপাক’ খান, তিনি পূণ্যাত্মা। এক জাতির মধ্যেও ছোঁয়াচে রােগ এত কঠোরভাবে নির্বিচারে সকল লােককে আক্রমণ করিল যে, সময়ে সময়ে এক বাড়ীতেই সারি সারি উনুন বসিয়া গেল। উনুনগুলি হােমকুণ্ডের মতই পবিত্র হইল। জনসাধারণের মধ্যে শত সহস্র লােক ‘অনাচরণীয়’ সংজ্ঞা প্রাপ্ত হইয়া উচ্চ শ্রেণীর লােকদিগের পায়ে একটু জল দেওয়ার অধিকার হইতে বঞ্চিত হইল। বৌদ্ধ-ভি ও ভিক্ষিণী ‘নেড়ানেড়ী’ নাম লইয়া ভদ্রপল্লী হইতে বহু দূরে কোনরূপে একটু স্থান লাভ করিল, কিন্তু বিষাক্ত শবের ন্যায় তাহাদের স্পর্শ হিন্দুসমাজে প্রত্যাখ্যাত হইল। ব্রাহ্মণেরা বৌদ্ধ জনসাধারণের নিকট হইতে অত্যাচার করিয়া অর্থ গ্রহণ করিতে লাগিলেন এবং তাহাদিগের গৃহাদি অগ্নিতে পােড়াইয়া ফেলিতে লাগিলেন। আমরা পূৰ্বে এক অধ্যায়ে দেখাইয়াছি এই দুর্দিনে বৌদ্ধগণ (সদ্ধৰ্মীরা) কিরূপ বিপন্ন হইয়া মুসলমান কর্তৃক দেশাধিকার একটা মস্ত বড় সৌভাগ্য মনে করিয়া বরণ করিয়া লইয়াছিল।”৫৬
দীনেশ বাবু আরও বলেছেন,
“…বাঙ্গালার একটা অন্তর্বিরােধ উপস্থিত হইয়াছিল। ইতিহাসে কোথাও একথা নাই যে, সেন রাজত্ব ধ্বংসের প্রাক্কালে মুসলমানদিগের সঙ্গে বাঙ্গালী জাতির রীতিমত কোন যুদ্ধবিগ্রহ হইয়াছে। পরন্তু দেখা যায় যে বঙ্গবিজয়ের পরে বিশেষ করিয়া উত্তর ও পূৰ্বাঞ্চলে সহস্র বৌদ্ধ ও নিম্নশ্রেণীর হিন্দু, নব ব্রাঙ্গণদিগের ঘাের অত্যাচার সহ্য করিতে না পারিয়া ইসলাম ধর্ম গ্রহণ পূর্বক স্বস্তির নির্বাস ফেলিয়াছে।”৫৭
যাইহােক, যখন বখতিয়ার রাজপুরীতে প্রবেশ করলেন রাজা লক্ষ্মণ সেন সে-সময়ে মধ্যাহ্নভােজে ব্যস্ত ছিলেন। খবর শুনে তিনি পশ্চাৎ দ্বার দিয়ে পলায়ন করেন এবং নৌপথে বিক্রমপুরে গিয়ে আশ্রয় নেন।
মিনহাজ লিখেছেন,
“তখন দ্বিপ্রহরে রায় লখমনিয়া আহারে বসিয়াছিলেন, সম্মুখে স্বর্ণ ও রৌপ্য পাত্রে থরে থরে সুখাদ্য সজ্জিত ছিল। হঠাৎ প্রাসাদতােরণের দিক হইতে আর্তনাদ শােনা গেল। তখন রায় বুঝিতে পারিলেন কী ঘটিতেছে। বখতিয়ার তােরণ দিয়া দ্রুত বেগে প্রাসাদের ভিতরে প্রবেশ করিলেন এবং প্রায় সকলকেই তরবারির আঘাতে বধ করিলেন। রায় তখন নগ্নপদে প্রাসাদের পিছন দুয়ার দিয়া পলায়ন করিলেন, সঙ্গে গেল যাবতীয় সজ্জিত ধনরত্ন, স্ত্রীলােক, এবং উচ্চ রাজকর্মচারীরা।”৫৮
[৭]
এই বর্ণনার উপর নির্ভর করে যুক্তিতর্কের মাধ্যমে আধুনিক ঐতিহাসিকগণ বখতিয়ার কর্তৃক নদিয়া জয়ের ইতিহাস পুনর্গঠন করে থাকেন। মিনহাজের বর্ণনার উপর ভর করেই আমাদের দেশে প্রচলিত আছে যে, ১৮ জন অর্থারােহী সেনা নিয়ে বখতিয়ার বাংলায় মুসলিম অধিকার প্রতিষ্ঠার সূচনা করেছিলেন। মিনহাজ পরিষ্কার বলেছেন যে, বখতিয়ার বঙ্গদেশ আক্রমণকালে এত ক্ষিপ্রতার সঙ্গে অগ্রসর হয়েছিলেন যে, মাত্র ১৮ জন অারােহী তার সঙ্গে তাল রেখে চলতে পেরেছিল এবং তিনি যখন নদিয়া পৌঁছান, তখন অন্যান্য সৈন্যরা পিছনে ছিল এবং মূল বাহিনী এসে পড়লে নদিয়া বখতিয়ারের হস্তগত হয়।৫৯ অথচ আসন্ন প্রতিরােধে রাজা লক্ষ্মণ সেন কর্তৃক গৃহীত কোনাে ব্যবস্থার কথা বলা হয়নি। অন্যদিকে মিনহাজ বখতিয়ারের নদিয়া বিজয়ের প্রায় ৩৮ বছর পর এই তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন। তাই এমন কাহিনির নির্ভরযােগ্যতা নিয়ে প্রগ্ন ওঠা স্বাভাবিক। অবশ্য ইসামির ‘ফুতুহুস সালাতিন’ গ্রন্থেও৬০ বখতিয়ারের নদিয়া বিজয়ের অনুরূপ কাহিনি লিপিবদ্ধ হয়েছে।৬১ ‘ফুতুহুস সালাতিন’-এ বর্ণিত এই কাহিনির কিছু অংশ আমরা তুলে ধরলাম,
“আমি শুনিয়াছি মুহম্মদ-বিন-বখতিয়ার পৃথিবীর এক প্রান্ত হইতে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত বণিকের মতাে বেড়াইতেন। মুহম্মদ এদেশে প্রবেশ করিলে রায় লখমনিয়ার কাছে সংবাদ পৌঁছিল যে, সীমান্তের এক বণিক বহু মুল্যবান বস্ত্র বিক্রয়ের জন্য আসিয়াছে। বহু তাতার দেশীয় অর্থ, মূল্যবান চীনা রেশম বস্ত্র বিক্রয়ের জন্য তাহার কাছে ছিল। সংবাদ পাইয়া লখমনিয়া অবিলম্বে প্রাসাদ হইতে নামিয়া আসিলেন। তাহার ইচ্ছা, নানা দেশের মূল্যবান বস্তু কিনিয়া লন। হতভাগ্য রাজা বিধাসঘাতক পৃথিবীর কথা জানিতেন না, ইহার অন্তরে যে আরাে এক ব্যাপার লুকাইয়া আছে তাহা তিনি কেমন করিয়া জানিবেন? যাহা হউক, প্রাসাদ হইতে নামিয়া তিনি বস্তুগুলি দেখিবার জন্য বণিকের কাছে গেলেন। আমি শুনিয়াছি, তিনি বণিকের কাছে উপস্থিত হইলে মুহম্মদ তাঁহার সম্মুখে চমৎকার দ্রব্যসম্ভার বিছাইয়া দিলেন। ক্রমেই তঁাহার লােকজন জমা হইতেছিল। পূর্ব-নির্দেশ অনুসারে মুহম্মদ ইঙ্গিত করিলে তাহার সঙ্গীরা চারিদিক হইতে রাজাকে ঘিরিয়া ধরিল এবং দলবদ্ধভাবে হিন্দুদের আক্রমণ করিতে লাগিল। তুর্কী সেনারা তাহাদের উপরে চড়াও হইলে তাহারা ছিন্নভিন্ন হইয়া গেল। যাহারা ঘেরিয়াছিল তাহারা তুরস্ক সেনাদের সঙ্গে সংঘর্ষে প্রবৃত্ত হইল। আরাে কিছুক্ষণ যুদ্ধ চলিতে লাগিল। অতঃপর বীর তুরস্ক সেনারা ঝড়ের বেগে হিন্দুদের আক্রমণ করিল। বেশ কিছু হিন্দু অবারােহী বধ করিল। রায়কে গ্রেফতার করিয়া বখতিয়ারের সম্মুখে আনা হইল অতঃপর বখতিয়ার সমস্ত অঞ্চলের বাদশাহ হইলেন। তাঁহার রাজধানী দিল্লী হইতে পৃথক হইল।”৬২
দুই গ্রন্থের ঘটনায় সাধারণভাবে মিল থাকায় আদি বা মিনহাজের বিবরণ সত্য বলে গৃহীত হয়েছে।
[৮]
বখতিয়ারের ‘বঙ্গজয়ের ইতিহাস পুনর্গঠনে কয়েকটি প্রা দেখা দেয়। উল্লেখ্য যে, সাধারণভাবে বখতিয়ারের নদিয়া ও লখনৌতি বিজয় বঙ্গবিজয় নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে। কিন্তু নদিয়া তাে আর বঙ্গ নয়। তাই ইতিহাসের বাস্তবতা দিয়ে। বিচার করলে বলা যায় যে, বখতিয়ার কোনােকালেই বঙ্গ জয় করেননি। তাহলে এমন একটি সিদ্ধান্ত দীর্ঘদিন ধরে ইতিহাস গ্রন্থের পাতায় লেখা রইল কেন? হয়তাে এ কারণে যে বখতিয়ার খিলজি অধিকৃত অঞ্চল পরবর্তী সময়ে গঠিত বাংলা নামের দেশটির অন্তর্গত ছিল। কিন্তু পরে ঘটে যাওয়া ঘটনা দিয়ে কি আগে ঘটে যাওয়া ঘটনাকে মূল্যায়ন করা যায় বা যুক্ত করা যায়? পরবর্তীকালে গঠিত বাংলার কতটুকু অঞ্চল বখতিয়ারের অধিকারে এসেছিল? ইতিহাসের সূত্র থেকে জানা যায়, বখতিয়ার প্রথম অধিকার করেছিলেন লক্ষ্মণ সেনের ‘ধর্মীয় রাজধানী’ নবদ্বীপ বা নদীয়া, এর অবস্থান বাংলার পশ্চিম সীমানায়। ১২০৪ খ্রিস্টাব্দের দিকে তিনি নদিয়া দখল করেন। পরের বছর গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক কেন্দ্র লক্ষ্মণাবতী বা লখনৌতি অধিকার করে সেখানে রাজধানী স্থাপন করেন। এর অবস্থান পরবর্তী সময়ের স্বাধীন সুলতানি বাংলার উত্তর সীমানায়। এরপর তিনি রাজধানী পরিবর্তন করে চলে আসেন আজকের দিনাজপুরের কাছাকাছি দেবীকোট বা দেবকোটে।
বখতিয়ার যে অঞ্চলসমূহে নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তা পরবর্তীকালে গঠিত স্বাধীন সুলতানি বাংলার অংশ ছিল। কিন্তু এই স্বাধীন সুলতানি বাংলা গঠিত হয় ১৩৫২ খ্রিস্টাব্দে।৬৩ তাই ১৩৫২ খ্রিস্টাব্দে যে ঘটনা ঘটেছিল তা দিয়ে ১২০৪ খ্রিস্টাব্দের ঘটনাকে সনাক্ত করা যায় না। তাই সময়ের বিবেচনায় বখতিয়ারের বিজয় স্বাধীন সুলতানি যুগের সার্বভৌম বাংলার একটি অংশ নয় বলে তাকে ‘বঙ্গবিজেতা’ বলা যায় না। অবশ্য বাংলার প্রাচীন ইতিহাস থেকে জানা যায়, প্রাচীনকালে এদেশ কতগুলাে রাজ্য বা জনপদে বিভক্ত ছিল। এমনি এক জনপদের নাম ‘বঙ্গ’। যদি বখতিয়ার এই ‘বঙ্গের’ সীমারেখার ভেতর তার বিজয় পতাকা টাঙিয়ে থাকেন তবে এর প্রাচীন নামের সূত্রে তাঁকে বঙ্গ বিজেতা বলা যেত। কিন্তু বখতিয়ারের অধিকৃত অঞ্চল ‘বঙ্গ’ জনপদের ভেতর ছিল না। জনপদের সীমা ছিল ঢাকা, ফরিদপুর হয়ে খুলনা পর্যন্ত। এসব বিবেচনায় বখতিয়ার খিলজিকে ‘বঙ্গবিজেতা’ বলা ইতিহাসের কালিক বিচার ও ভৌগােলিক অবস্থান বিবেচনাকে বিভ্রান্তিতে ফেলে দেবে— এটা নদিয়া ও লখনৌতি বিজয় হিসেবে চিহ্নিত হওয়াই সমীচিন।
দ্বিতীয় প্রেক্ষাপট হচ্ছে যে, রাজা লক্ষ্মণ সেন বখতিয়ারের আক্রমণকালে বঙ্গদেশের নদিয়ায় অবস্থান করছিলেন এবং মিনহাজ নদিয়াকে রাজধানী বলেছেন। কিন্তু সেন যুগের তাম্রশাসনসমূহ থেকে এই কথা স্পষ্ট যে, তাদের রাজধানী ছিল ঢাকা জেলার বিক্রমপুর। এক্ষেত্রে রাজা লক্ষ্মণ সেন যে স্থানে অবস্থান করেন, সেই নদিয়া সাময়িক রাজধানী বা দ্বিতীয় রাজধানী হতে পারে। নদিয়া ছিল ভাগীরথী নদীতীরের পবিত্র তীর্থস্থান। এমনও হতে পারে যে, বৃদ্ধ বয়সে রাজা লক্ষ্মণ সেন সপারিষদ পবিত্র তীর্থস্থান নদিয়ায় পুণ্যলাভের উদ্দেশ্যে অবস্থান করছিলেন।৬৪ কেউ কেউ বলেন, সুন্দরবনের খাঁড়ি অঞ্চলের বিদ্রোহী বৌদ্ধ নরপতি ডুম্মন পালের বিদ্রোহ দমনের জন্য রাজা লক্ষ্মণ নদিয়ায় যান এবং সেখানে শিবির স্থাপন। করেন। ডুম্মন পালকে দমন করা সম্ভব হয় কিনা তা জানা যায় না। তবে নদিয়ায় লক্ষ্মণ সেনকে বেশ কিছুকাল এজন্য অর্থাৎ রাজনৈতিক কারণে অবস্থান করতে হয় বলে অনুমান করা যায়। সেই জন্যই হয়তাে লক্ষ্মণ সেন নদিয়াকে দ্বিতীয় রাজধানী রূপে গড়ে তুলেছিলেন। শেষ পর্যন্ত লক্ষ্মণ সেনের নদিয়ায় থাকা অবস্থায় বখতিয়ার নদিয়ার বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেন।
গবেষক এ কে এম যাকারিয়া প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন, বখতিয়ার যে নদিয়া জয় করেন তা ভাগীরথী নদীতীরের নদিয়া নয় বরং তা উত্তরবঙ্গের নওদা, লখনৌতি বা গৌড়ের নিকটে।৬৫ কিন্তু সুখময় মুখােপাধ্যায় বিস্তারিত আলােচনা করে দেখিয়েছেন যে, যাকারিয়া সাহেবের মত গ্রহণযােগ্য নয়। বখতিয়ার বিহার হতে আসেন, তারপর বিহার হতে নওদা বা লখনৌতি বা গৌড়। এই পথে এলে কোনাে না কোনাে খরস্রোতা নদী (কুশীগণ্ডক) পার হওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। বখতিয়ারের নৌবাহিনী ছিল না। তাছাড়া বখতিয়ারের তুর্কি বাহিনী জলযুদ্ধে অনভিজ্ঞ ছিল। সুতরাং বখতিয়ারের পথে কোনােভাবেই বিহার হতে উত্তরবঙ্গে আসা সম্ভব ছিল না।৬৬ স্বভাবতই সিদ্ধান্তে আসতে হয় যে, বখতিয়ার যে নদিয়া জয় করেন তা ভাগীরথী নদীতীরের নদিয়া, উত্তরবঙ্গের কোনাে স্থান নয়।৬৭
তৃতীয় সমস্যাটি হচ্ছে যে, সুদক্ষ যােদ্ধা রাজা লক্ষ্মণ সেন আসন্ন মুসলমান আক্রমণ সম্বন্ধে সম্পূর্ণ সজাগ ছিলেন, এমনকি ব্রাহ্মণদের দেওয়া পলায়ন করার উপদেশ উপেক্ষা করেও তিনি নদিয়ায় অবস্থান করছিলেন। সুতরাং তিনি কি তার সাম্রাজ্য সংরক্ষণের কোনাে ব্যবস্থাই গ্রহণ করেননি? এ প্রসঙ্গে যুক্তি প্রদর্শন করা যায়। পশ্চিম দিক থেকে বাংলায় প্রবেশের স্বাভাবিক পথ ছিল রাজমহলের নিকটবর্তী তেলিয়াগড় গিরিপথ। তেলিয়াগড়ের দক্ষিণে বাংলার পশ্চিম সীমান্তব্যাপী অঞ্চল ছিল জঙ্গলাকীর্ণ। মিনহাজ এই জঙ্গলাকীর্ণ এলাকাকেই ঝাড়খণ্ড নামে অভিহিত করেছেন। তেলিয়াগড়ের উত্তরপশ্চিমে ছিল খরস্রোতা নদী, প্রবেশের জন্য অযােগ্য। সুতরাং বাংলার রাজার পথে তেলিয়াগড় গিরিপথ সংরক্ষণ করাই স্বাভাবিক এবং লক্ষ্মণ সেন হয়তাে তা দুর্ভেদ্য করেছিলেন, কিন্তু বখতিয়ার দুর্গম অরণ্য অঞ্চলের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়ে সেন রাজার প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা সম্পূর্ণ বানচাল করে দিয়েছিলেন। অরণ্যের পথে বিশাল অর্থবাহিনী পরিচালনা করা সহজ নয়। তাই বখতিয়ার তার বাহিনীকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে ভাগ করলেন। ১৮ সৈন্যের প্রথম দলের অগ্রভাগে ছিলেন বখতিয়ার নিজেই। বখতিয়ার যখন নদিয়ার প্রাসাদে বিনা বাধায় নীরবে প্রবেশ করলেন তখন রাজা লক্ষ্মণ সেনের পক্ষে ভাবা খুবই স্বাভাবিক যে, তেলিয়াগড়ের দুর্ভেদ্য প্রতিরক্ষা ভেদ করেই মুসলমানগণ নদিয়ায় এসেছে অর্থাৎ তেলিয়াগড় শত্রুদের কজায় চলে গেছে। এবং তার সেনাবাহিনী পরাজিত হয়েছে সুতরাং পলায়ন করা ছাড়া কোনাে উপায় নেই। ঝাড়খণ্ড অরণ্যাঞ্চলের ভিতর দিয়ে কোনাে আক্রমণকারী বাহিনী আসতে পারে, তা হয়তাে কল্পনাতীত ছিল। এই ব্যাখ্যা মেনে নিলে স্বীকার করতে হয় যে, বখতিয়ার সেন রাজার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এড়িয়ে দুর্গম অরণ্যাঞ্চল দিয়ে আক্রমণ চালিয়ে নদিয়ায় উপস্থিত হয়ে লক্ষ্মণ সেনকে হতবাক করে দিয়েছিলেন। হঠাৎ আক্রমণে লক্ষ্মণ সেন ঘটনা সম্পূর্ণ অনুধাবন না করে দূর প্রান্তে পলায়ন করলেন। এভাবে লক্ষ্মণ সেনের পলায়ন ও অতি সহজে বখতিয়ারের নদিয়া জয় আমাদের নিকট স্বাভাবিক ভাবেই হয়তাে বােধগম্য হয়ে ওঠে। কিন্তু ঐতিহাসিকদের এই সমস্ত ব্যাখ্যা ছাড়াও বলতে হয় যে, লক্ষ্মণ সেনের গুপ্তচর বাহিনী মােটেই দক্ষ ছিল না। তিনি শত্রুর গতিবিধির খোঁজ খবর রাখতে ব্যর্থ হয়েছেন। কিংবা তার গুপ্তচর বাহিনী তাকে সঠিক খবর সঠিক সময়ে দিতে পারেনি।
অথচ অনেক হিন্দু পণ্ডিত৬৮ একসময়ে নানা যুক্তির অবতারণার মাধ্যমে সন্দেহমূলক মন্তব্য প্রকাশ করে মিনহাজের বিবরণকে কল্পকাহিনি বলে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। যাহােক, সেনরাজের কথিত কাপুরুষতার পক্ষে যুক্তি উত্থাপনের প্রয়ােজন আছে বলে মনে হয় না কারণ তিনি যদি সত্যিই কাপুরুষ হয়ে থাকেন, তথাপি তার আচরণ থেকে বাঙালি জাতির চরিত্র-চিত্রণ হবে ঐতিহাসিক সত্যের অপলাপ। ত্বরিত, কিংবা অনুদার সমালােচকের ভাষায়, লজ্জাজনক পলায়ন আরাে মহত্তর ব্যক্তি বা বীর পুরুষের ভাগেও ঘটেছে। রাজপুত হঠকারিতার মধ্যে একটি ভাবপ্রবণতার বিষয় রয়েছে, কিন্তু তা আদৌ বাস্তব বুদ্ধির পরিচয় বহন করে না। তাই বলে কাহিনীটি অবাস্তব বলে সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাখ্যান করা যায় না। হিন্দু বিবরণীতে নদিয়া বা নবদ্বীপকে সেন রাজধানী বলে উল্লেখিত হয়নি, কিংবা ‘রায়’ লখমানিয়াকে বহু পূর্বে মৃত লক্ষ্মণ সেন বলে ধরে নেওয়া যায় না বলে ব্যানার্জি মহাশয় যে যুক্তি প্রদর্শন করেছেন তা ঐতিহাসিক সত্যকে নেতিবাচক যুক্তির উপর প্রতিষ্ঠার সামিল। কারণ নদিয়া আক্রমণের পর বখতিয়ার যে সেন রাজ্যের কিয়দংশ অধিকার করেছিলেন তা অবিসংবাদিত সত্য।”৬৯ এটাও সত্য যে, মিনহাজের বিবরণকে আক্ষরিক অর্থে একেবারে ঠিক বলে দাবি করা যায় না। তবে আধুনিক গবেষণার ফলাফল কিছুপণ্ডিতগণ বিশেষ করে রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের যুক্তি সমূহও সমর্থন করে না।
এরপরেও কথা থেকে যায়। আশি বছরের বৃদ্ধ রাজা লক্ষ্মণ সেন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছিলেন এটা না হয় মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু যেখানে লক্ষ্মণ সেনের মতাে একজন বিচক্ষণ রাজা আছেন, সেই নদিয়ার রাজপুরীতে কোনাে সৈন্যদল থাকবে না তা কল্পনা করা যায় না। অবশ্য পরবর্তীকালে ইতিহাসে এরকম দু-একটি কাহিনি ঘটেছিল। যেমন শের শাহ যখন গৌড় অভিযান করেছিলেন তখন তৃতীয় মাহমুদ শাহ দুর্গের মধ্যে দরজা বন্ধ করে বসেছিলেন। এখানে শহরের দরজা উন্মুক্ত ছিল। গৌড়ের মত দুর্ভেদ্য প্রাচীর বা দুর্গ নদিয়াতে অবশ্য ছিল না। ছিল না কোনাে মৃত্তিকা নির্মিত প্রতিরক্ষা-প্রাচীর বা সেই প্রাচীরের বাইরে অবস্থিত পরিখা। স্যার যদুনাথ সরকার বলতে চেয়েছেন যে, সেখানে একটি বাঁশের বেড়া ছিল। এদেশে দুর্গ নির্মাণে মাটির তৈরি দেওয়াল ছিল চিরাচরিত প্রথা। কালেভদ্রে দু-চারটি পাকা দেওয়াল যে না হতাে, তা নয়। তবে সেগুলির সংখ্যা ছিল অত্যন্ত সীমাবদ্ধ। এদেশের বেশিরভাগ দুর্গের চারিদিকে নির্মিত হতাে সুউচ্চ মাটির প্রাচীর। প্রাচীন বৌদ্ধ ও হিন্দু যুগের শত শত মাটির দুর্গ আজও বাংলার সর্বত্রই দেখা যায়। একমাত্র দিনাজপুর জেলাতেই সে যুগের ৫০টারও অধিক মাটির দুর্গ আজও টিকে আছে। মাটির দুর্গ নির্মাণ ছিল অতি সহজ এবং সবচেয়ে কম খরচে তা করা যেত। সে তুলনায় পাকা দুর্গ বা বাঁশের বেড়া নির্মাণ ছিল অধিক ব্যয় ও সময়সাপেক্ষ স্থায়ী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা হিসাবে বাঁশের বেড়া ছিল অত্যন্ত বিপজ্জনক ব্যবস্থা। সুষ্ঠু পরিখাবেষ্টিত মাটির দেওয়াল তখনকার দিনে ছিল দুর্ভেদ্য। এ সমস্ত কারণে স্যার যদুনাথ কর্তৃক উল্লিখিত বাঁশের বেড়ার কথাটিকে কেউ যদি হাস্যকর বলে তবে সেটিকে খুব দূষণীয় হয়ত বলা যাবে না।
মহারাজা লক্ষ্মণ সেন যে নগরীতে তার পরিবার-পরিজন, ধনরত্ন, সৈন্যবাহিনী, হস্তীবাহিনী প্রভৃতি নিয়ে বাস করছিলেন, সে নগরীতে কোনাে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা করবেন না, তা কল্পনাতীত। আর কিছু না করলেও সেই নগরীর চারদিকে একটি পরিখা অন্তত খনন করার কথা। অথচ সারা নবদ্বীপ শহরে কোথাও কোনাে পরিখার চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায় না। এ সম্বন্ধে ভিন্নমত পােষণ করে সুখময় মুখােপাধ্যায় বলেন,
“নবদ্বীপে পুরানাে জলের খাত বা নালা এখন দেখা যায়। তবে সেগুলি পরিখা না ভাগীরথীর পুরােনাে খাত তা বলা যায় না।”৭০
নদী বা প্রাকৃতিক নালার খাত প্রকৃতির খেয়াল-খুশি মতে সৃষ্টি, তাতে কোনাে পূর্ব পরিকল্পিত বা আগে থেকেই নির্দিষ্ট কোনাে গতিধারা থাকে না। কারণ প্রকৃতি আপন গতিতেই চলে এবং সেই গতি সহজাত। আর পরিখা পূর্ব-পরিকল্পনা হিসাবে মানুষ কর্তৃক সৃষ্ট। ধ্বংসপ্রাপ্ত হলেও পূর্ব পরিকল্পনার ছাপ তাতে থেকেই যায়। নদী বা পরিখার খাতের মধ্যে পার্থক্য বােঝার জন্য কোনাে বিশেষজ্ঞের প্রয়ােজন আছে বলে তাে মনে হয় না।
ঐতিহাসিক কে কে কানুনগো নদিয়াতে বাঁশের প্রাচীরের অস্তিত্বের কথা বলেছেন। এছাড়াও বলা যায় যে, নদিয়ার রাজপ্রাসাদের সামনে কয়েকজন ছাড়া কোনাে প্রহরী ছিল না। কেননা তারা মাত্র ১৮ জন অবারােহী সেনাকে পরাজিত করতে পারেনি। বখতিয়ার নদিয়া আক্রমণ করতে আসছে যখন এটা জানা যাচ্ছে, তখন পঞ্চাশজন প্রাসাদ প্রহরীও ছিল না এটা ভাবা কঠিন। যদি মিনহাজের নদিয়া বিবরণ পুরােপুরি মেনে নিতে হয় তাহলে বলতে হবে যে, এক বছর পূর্ব হতে বখতিয়ার সমূহ খোঁজখবর নিয়েই নদিয়ায় এসেছিলেন। ঐতিহাসিক এ বি এম হাবিবুল্লাহ ও নীহাররঞ্জন রায় লিখেছেন, বৌদ্ধরা নাকি বখতিয়ারকে নদিয়া আক্রমণের পথ ও অপরাপর সংবাদ দিয়েছিল। বৌদ্ধরা হয়তাে সেন রাজবংশের বিরােধিতা করবে, এটার মধ্যে অস্বাভাবিকতা নেই, কিন্তু তারা বিদেশি ও অপরিচিত বখতিয়ার ও তার সেনাদলকে নদিয়া তথা বাংলা বিজয়ে সাহায্য করবে এটা কষ্ট ভাবনা।৭১ বিশেষ করে যখন বখতিয়ার ইতিমধ্যেই বিহার জয় করেছেন বৌদ্ধদেরই পরাস্ত করে। আসলে তৃতীয় মাহমুদ শাহের মতাে লক্ষ্মণ সেনও নিশ্চিত ছিলেন যে, বখতিয়ারের মতাে কোনাে শত্রুপক্ষ নদিয়ায় অনুপ্রবেশ করতে পারে না। যাই হােক, যিনি প্রাসাদ সুরক্ষিত করলেন না তিনি আবার পলায়নের জন্য সুব্যবস্থারও পরিকল্পনা করে রাখলেন এটা আশ্চর্য ছাড়া আর কি হতে পারে—এমনকি ভাগীরথীর ঘাটে লক্ষ্মণ সেনের নৌকা বাঁধা ছিল ও মাঝিমাল্লারাও প্রস্তুত ছিল।
তাছাড়া ইতিপূর্বে বাঙালির স্বাধীকার রক্ষার জন্য সংগ্রাম করার সহজাত প্রবণতার কথা তাে অবিদিত নয়। কিন্তু এবার তুর্কি আক্রমণের সময় বাঙালির সে সংগ্রামী চেতনা কোথায় গেল? তুর্কিরা তাে বিদেশি-ভিন্ন ধর্ম ও সংস্কৃতির মানুষ। তারা এদেশ গ্রাস করতে এল। রাজশক্তি না হয় পরাভব মেনে নিয়েছিল, কিন্তু সাধারণ মানুষের মধ্য থেকে কোনাে প্রতিবাদপ্রতিরােধ এল না কেন? আসলে এর উত্তর খুঁজতে হবে সেন যুগের সামাজিক-রাজনৈতিক-আর্থিক বাস্তবতার ভেতর। সকল সূত্র মতে, তখনকার বাংলার শক্তি ও সংহতির উপাদান খুব কমই বিদ্যমান ছিল। সে সময়ে সেন দরবারে অন্তর্কলহ মাথাচাড়া দিয়ে উঠছিল যার প্রভাব সেনাবাহিনীর উপর পড়েছিল। সেন সাম্রাজ্য যে ১৩ শতকের প্রারম্ভে দুর্বল হয়েছিল এবং শাসন যন্ত্র শিথিল হয়ে পড়েছিল সেটা নিঃসন্দেহ। এ বিষয়ে পূর্বেই আলােকপাত করা হয়েছে। সেন রাজাগণ বাংলার সাধারণ হিন্দু ও অন্তঃজ শ্রেণির মানুষদের অধিকার-বঞ্চিত ও অস্পৃশ্য করে রেখেছিল। বিপন্ন মানুষদের কাছে তখন রাজনৈতিক পরিবর্তন প্রত্যাশিত হওয়ারই কথা। জীবন যখন ওষ্ঠাগত তখন জীবন বাঁচানাের দাওয়াই সবচেয়ে বড়। দুঃশাসন থেকে মুক্তি পাওয়াটাই ছিল বড় ব্যাপার। প্রভু পরিবর্তন করে ক্ষমতা দখল করছে কারা এ সময় তা বিবেচ্য হওয়ার কথা নয়। এই বাস্তবতাই আনুকূল্য দিয়েছে বখতিয়ার খিলজিকে। প্রত্যক্ষ পরােক্ষ কোনাে প্রতিরােধের মােকাবিলা করতে হয়নি তাঁকে। যদুনাথ সরকার তার সম্পাদনায় ‘হিস্টরি অব বেঙ্গল’-এ (খণ্ড-২) একটা প্রতিরােধের আভাস দিয়েছেন এবং বলেছেন যে, বখতিয়ার আশেপাশের এলাকা ছারখার করে দিলে নদিয়া জেতা সহজ হয়ে যায়। কিন্তু সমসাময়িক কোনাে সূত্রেই এরকম কোনাে ঘটনার কথা পাওয়া যায় না। নদিয়ার অর্থ দিয়ে বখতিয়ার সেখানে মসজিদ, মাদ্রাসা ও খানকা তৈরি করে মুসলিম সমাজের প্রতিষ্ঠা করেন। অবশ্য যদুনাথ সরকার বলেছেন যে, এর জন্য তিনি বহু হিন্দু মন্দির ধ্বংস করেছিলেন, যদিও এর প্রমাণ কিছু পাওয়া যায় না। পঞ্চদশ শতকের শেষে বা ষষ্ঠদশ শতকের গােড়ার গৌড়ে কয়েকটি সৌধে হিন্দু মন্দিরের ভাঙা অংশ লাগানাে হয়েছে দেখা যায়। কিন্তু সেগুলাে নেবার জন্য মন্দির ভাঙা হয়েছিল কিনা বা ওইগুলিই বখতিয়ারের সময়ের ভাঙা মন্দিরের অংশ কিনা বলা যায় না। বলা দরকার যে, বখতিয়রের সময়ে লক্ষ্মণাবতীর কিছু অংশ নদীর ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। প্রায় চল্লিশ বছর পরে মিনহাজ এখানে এসে দেখেছেন যে লক্ষ্মণাবতী রাজ্যের মাঝখান দিয়ে নদী বয়ে যাচ্ছে। তার আগেই অবশ্য ১২২৭ সালে বড় বাঁধ তৈরি করে শহরকে রক্ষা করার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
[৯]
বখতিয়ার কর্তৃক বঙ্গদেশ তথা নদিয়া জয়ের সঠিক তারিখ নির্ধারণ কষ্টসাধ্য ব্যাপার। কারণ মিনহাজের বর্ণনায় এই ঘটনার কোনাে তারিখ দেওয়া হয়নি। ইসামিও নদিয়া জয়ের তারিখ উল্লেখ করেননি। মিনহাজ বখতিয়ারের জীবনের মাত্র দুইটি তারিখ উল্লেখ করেছেন দিল্লিতে কুতুবউদ্দিন আইবকের দরবারে উপস্থিত হওয়ার এবং তার মৃত্যুর। ফলে ঐতিহাসিকগণ বিভিন্ন সূত্র থেকে এই ঘটনার তারিখ নির্ধারণ করতে চেষ্টা করেছেন। ১১৯৪ সাল থেকে ১২০৪-র মধ্যে ঐতিহাসিকগণ বিভিন্ন তারিখ নির্দেশ করেছেন—
- ১. ঐতিহাসিক চার্লস স্টুয়ার্ট ও এডওয়ার্ড টমাস নদিয়া অভিযানের তারিখ ১২০৩-১২০৪-এর মধ্যে নির্ধারণ করেছেন।৭২
- ২. মেজর র্যাভার্টি ও হেনরি ব্লকম্যান বলেছেন যথাক্রমে ১১৯৪ ও ১১৯৮-৯৯ সালকে।৭৩
- ৩. মার্শম্যান ও রজনীকান্ত চক্রবর্তী বলেছেন ১২০৩ সাল।
- ৪. মনমােহন চক্রবর্তী, রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, নলিনীকান্ত ভট্টশালী প্রমুখ ঐতিহাসিকেরা হিন্দু ও বৌদ্ধ সূত্রের সাহায্যে এই তারিখ নির্ধারণে সচেষ্ট হন। তারা সকলেই ১১৯৯-১২০০ সালের মধ্যে বখতিয়ার কর্তৃক নদিয়া আক্রমণের তারিখ নির্দেশ করেন।
- ৫. রমেশচন্দ্র মজুমদার, সুখময় মুখােপাধ্যায় ও আর এম ইটন বলেছেন ১২০৪ সাল।
- ৬. ঐতিহাসিক নীহাররঞ্জন রায় বলেছেন ১২০১ সাল।৭৪
- ৭. আহমদ হাসান দানি বহুমত বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন যে, ১২০৪ সালের আগে নদিয়া অভিযান হতে পারে না।৭৫
- ৮. কালিকারঞ্জন কানুনগাে ১২০০ সালকেই নদিয়া আক্রমণের তারিখ হিসেবে নির্ধারণ করেন।
- ৯. হাসান নিজামির ‘তাজ-উল-মাসির’-এ বখতিয়ারের বিহার জয়ের তারিখ বলা হয়েছে ১২০৩-এর মার্চ মাস।৭৬ মিনহাজ পরিষ্কারভাবে বলেছেন, পরের বছর অর্থাৎ বিহার জয়ের পরের বছর বখতিয়ার নদিয়া জয় করেন। সুতরাং এই হিসেব অনুসারে ১২০৪ সালকে নদিয়া অভিযানের তারিখ বলে ধরা যায়।
- ১০. লক্ষ্মণ সেনের সভাকবি হলায়ুধ মিশ্রর নামে প্রচারিত ‘শেখ শুভােদয়া’ গ্রন্থে এইভাবে সালের উল্লেখ আছে। ‘চতুর্বিংশােত্তরে শাকে সহকৈশতাধিকে।/বেহারপাটনাৎ পূর্ব তুরস্ক সমুপাগতঃ।’ অর্থাৎ ১১২৪ শকাব্দে (১২০২) তুরস্ক সেনা বেহার-পাটনা হতে পূর্বদিকে উপস্থিত হয়েছিল।
- ১১. ঐতিহাসিক এ বি এম হাবিবুল্লাহ লিখেছেন, বিহারে সাফল্য লাভের (১২০৩) এক বছর পর অর্থাৎ মােটামুটি ১২০৪-৫ সালে বখতিয়ার দ্বিতীয় অভিযানে অর্থাৎ নদিয়া অভিযানে বের হন।৭৭
- ১২. ঐতিহাসিক অতুলচন্দ্র রায় নদিয়া জয়ের তারিখ বলতে ১২০৪ সালকেই গুরুত্ব দিয়েছেন।৭৮ ঐতিহাসিক আবদুল করিম তার বাংলার ইতিহাস সুলতানি আমল’-এ এ বিষয় নিয়ে বিস্তারিত আলােচনা করেছেন।৭৯
১৯০৫ সালের মে মাসে মুদ্রিত একটি স্বর্ণমুদ্রা পাওয়া গিয়েছে যেটি রাজশাহীর বরেন্দ্র মিউজিয়ামে রক্ষিত আছে। এটি নদিয়া বা গৌড় বিজয়ের স্মারক মুদ্রা, কারণ এর মধ্যে ‘গৌড়বিজয়’ কথাটা লেখা আছে। মুইজ-উদ-দীন মােহাম্মদ সাম অর্থাৎ মােহাম্মদ ঘােরির নামে করা হলেও মুদ্রা বিশেষজ্ঞ পরমেধারীলাল গুপ্ত এটিকে বখতিয়ার খিলজির মুদ্রা বলে বিশেষভাবে সনাক্ত করেছেন। সেক্ষেত্রে আবদুল করিম সঠিকভাবেই নদীয়া বা গৌড় বিজয় ধরেছেন ১২০৪ সালের শেষ দিকে বা ১২০৫ সালের প্রথম দিকে।৮০ ঐতিহাসিক এ এম চৌধুরী আবদুল করিমের এই তারিখের প্রতি সহমত পােষণ করেন।৮১ পরমেধারীলাল গুপ্ত ও অনিরুদ্ধ রায়ও এ বিষয়ে আবদুল করিমের সঙ্গে একমত।৮২
মিনহাজের বর্ণনায় দেখা যায় যে, সমস্ত সৈন্যের উপস্থিতিতে বখতিয়ার তিনদিন ধরে নদিয়ায় অভিযান চালান এবং বিপুল ধন-সম্পত্তি হস্তগত করেন। তারপর বখতিয়ার নদিয়া ত্যাগ করে উত্তরবঙ্গের লক্ষ্মণাবতীর (গৌড়) দিকে যান। এই লক্ষ্মণাবতীই মুসলমান আমলে লখনৌতি নামে পরিচিত হয়। পরে বখতিয়ার চলে আসেন দিনাজপুরের দেবকোটে।
[১০]
গৌড় জয়ের পর বখতিয়ার আরও পূর্বদিকে অগ্রসর হয়ে বরেন্দ্র বা উত্তর বাংলায় নিজ অধিকার বিস্তার করেছিলেন। বখতিয়ার নব প্রতিষ্ঠিত রাজ্যের সুশাসনের ব্যবস্থা করেন। অধিকৃত এলাকাকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করে প্রত্যেক ভাগে একজন করে সেনাপতিকে শাসনভার অর্পণ করেন। বখতিয়ারের সেনাধ্যক্ষদের মধ্যে তিনজনের নাম পাওয়া যায়। তাদের মধ্যে আলি মর্দান খিলজি ‘বরসৌলে’র এবং হুসামউদ্দিন ইওজ খিলজি ‘গঙ্গতরী’র শাসনকর্তা নিযুক্ত হন। ‘বরসৌল’কে বর্তমান দিনাজপুর জেলার অন্তর্গত ঘােড়াঘাট এলাকা বলে নির্দেশ করা হয়। এই স্থানটি বগুড়া, রংপুর ও দিনাজপুর এই তিনটি জেলার মিলনস্থল। ‘গঙ্গতরী’র সঠিক নির্দের্শকরণ সম্ভব নয়। তবে কে কে কানুনগাের মতে, ‘গঙ্গতরী’ ‘আইন-ইআকবরী’র তান্ডা সরকারের ‘গণকরা’ মহলের সঙ্গে অভিন্ন বলা যেতে পারে। মুহাম্মদ শীরান খিলজি নামক অপর সেনাধ্যক্ষের শাসনভার ছিল খুব সম্ভবত লখনৌতির দক্ষিণে পদ্মার তীরবর্তী অঞ্চলে।৮৩ এই অঞ্চল সম্ভবত সন্তোষ-মাসেদা বলে অনিরুদ্ধ রায় উল্লেখ করেছেন।৮৪ এই সন্তোষ-মাসেদাকে বগুড়া জেলার মাহিগঞ্জের সঙ্গে অভিন্ন মনে করা হয়।৮৫
বখতিয়ার কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত বাংলায় মুসলমান রাজ্যের সঠিক সীমা সমসাময়িক সূত্রে স্পষ্ট উল্লেখ না থাকলেও প্রায় নিশ্চিত করে বলা যায় যে, বখতিয়ারের রাজ্য পূর্বে তিস্তা ও করতােয়া নদী, দক্ষিণে পদ্মা নদী, উত্তরে দিনাজপুর জেলার দেবকোট হয়ে রংপুর শহর পর্যন্ত এবং পশ্চিমে বখতিয়ারের পূর্ব অধিকৃত বিহার পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এই সাম্রাজ্যকে ছােটো কোনােভাবেই বলা যায় না বা লুটতরাজের জন্য করা এটাও বলা যায় না। এর মধ্যে লক্ষ্মণাবতী সরকার ছাড়া অন্য ছয়টি সরকারের প্রতিটি মহাল বখতিয়ারের দখলে ছিল। এই ছটি সরকার হল—তান্ডা (রাজমহল, সাঁওতাল পরগণা, মুর্শিদাবাদ), পূর্ণিয়া (উত্তর বিহার), পিঞ্জরা (দিনাজপুর), তাজপুর (পূর্ণিয়ার পূর্ব প্রান্ত), ঘােড়াঘাট (কোচবিহারের দক্ষিণ অংশ-তিস্তা হতে ব্রহ্মপুত্র) ও বারবকাবাদ (রাজশাহী)। এই সরকারগুলাের নাম তােডরমলের রাজস্ব তালিকায় সুবে বাংলার অন্তর্গত।
বিন্ধ্য পর্বতের পাদদেশ থেকে মির্জাপুর জেলা, গঙ্গার দক্ষিণ তীর ধরে রাজমহল পাহাড় পর্যন্ত দক্ষিণ বিহারের বিস্তৃত অঞ্চলে বখতিয়ার খিলজির প্রাধান্য ছিল সর্বাধিক। এছাড়া সম্ভবত গঙ্গার উত্তরে নদী তীরবর্তী অঞ্চলগুলােতে গণ্ডকের মােহনা থেকে কোশী পর্যন্ত তার প্রভাব বিস্তৃত হয়েছিল। দিল্লির সাথে বখতিয়ার খিলজির সম্পর্ক কী ছিল তা সঠিক করে বলা সম্ভব নয়। বখতিয়ার খিলজি সুলতান ঘােরির অনুগত ছিলেন এবং বাংলা ঘােরি সাম্রাজ্যের অংশ ছিল। তবকাত-ই-নাসিরী হতে জানা যায়, বখতিয়ার সুলতান ঘােরির প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। তিনি বিহার জয়ের পর উপঢৌকনসহ কুতুবউদ্দিনের সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং নদিয়া জয়ের পরও তাকে ধনরত্ন পাঠিয়েছিলেন। বখতিয়ার কার নামে খুতবা পাঠ করেছিলেন বা মুদ্রা কার নামে প্রচলন করেছিলেন তা জানা যায় না। তবে একথা স্পষ্ট যে, তিনি বাংলা জয় করেছিলেন নিজ প্রেরণায়, কেউ তাকে জয়ের জন্য প্রেরণ করেননি। লখনৌতিতে অভ্যন্তরীণ শাসনের ব্যাপারে বখতিয়ার সম্পূর্ণই স্বাধীন ছিলেন বলে মনে হয়। বখতিয়ার জীবিত থাকাকালীন কুতুবউদ্দিন লখনৌতির কোনাে ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করেননি। সুতরাং বখতিয়ার বাংলা জয়, বিজিত রাজ্যে শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন ও যুদ্ধবিগ্রহ স্বাধীনভাবে করেছিলেন। দিল্লির অধীনতা না হলেও দিল্লির সাথে একটা সমঝােতা হয়েছিল বলে ধরা যেতে পারে।
[১১]
বখতিয়ার খিলজির জীবনের শেষ কাজ তিব্বত আক্রমণ। বাংলার বৃহদংশ তার রাজ্যের বাইরে ছিল। ওইসব অঞ্চল জয়ের চেষ্টা না করে সুদূর দুর্গম পার্বত্যাঞ্চল তিব্বত আক্রমণ করার কারণ সহজে অনুধাবন করা যায় না। হয়তাে বখতিয়ার তার দুঃসাহসিক কর্মপ্রীতি দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন, বা হয়তাে তুর্কিস্থানের সঙ্গে সােজা যােগাযােগ স্থাপনের উদ্দেশ্যেই তিনি তিব্বত আক্রমণ করতে প্রয়াসী হয়েছিলেন। তৃতীয়ত, তিব্বতের ধনসম্পদের কাহিনি বখতিয়ারকে তিব্বত অভিযানে প্রলুব্ধ করেছিল। চতুর্থত, মুসলিম রাজ্যের সীমা সম্প্রসারণ তাঁর এ অভিযানের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল। তাছাড়া শুধু গৌড় বিজেতা হিসেবে বখতিয়ার নিজেকে সন্তুষ্ট রাখতে পারেননি।
বখতিয়ার খিলজি তিব্বত আক্রমণের পরিকল্পনা করে পথ-ঘাটের খোঁজ-খবর নিয়েছিলেন। তখনকার দিনে বাংলার উত্তরে হিমালয়ের পাদদেশে বিভিন্ন উপজাতির বাস ছিল এবং তিব্বত থেকে টাটুঘােড়া আমদানি করে তারা উত্তর বাংলার বিভিন্ন বাজারে বিক্রয় করত। মিনহাজ তাঁর গ্রন্থে ঘােড়া ব্যবসার প্রায় ৩৫টি বাণিজ্য পথের উল্লেখ করে বখতিয়ারের তিব্বত অভিযানের প্রকৃত উদ্দেশ্যের প্রতি আলােকপাত করেছেন। মিনহাজের মতানুসারে, করমবত্তন (সম্ভবত ভুটানের কুমরিকোটা) ও তিব্বত থেকে কামরূপ এবং সেখান থেকে উত্তরবঙ্গের জেলাগুলিতে টাটুঘােড়া সরবরাহের জাঁকজমকপূর্ণ ব্যবসা বিদ্যমান ছিল। বাংলায় ঘােড়ার বিশেষভাবে অভাব থাকায় বখতিয়ার সম্ভবত এই বিশেষ জাতের ঘােড়ার একচেটিয়া সরবরাহ পেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু অভিযানে তিনি অনেকক্ষেত্রে সীমা লঙ্ঘন করেছেন।৮৬ এ সময় মেচ উপজাতীয় একজন বখতিয়ারের সংস্পর্শে আসে এবং ইসলাম ধর্মে দীথিত হয়। তার নাম হয়েছিল আলি মেচ।৮৭ বখতিয়ার আলি মেচের নিকট থেকে তিব্বতের রাস্তা ও আনুষঙ্গিক বিষয়ে খোঁজ-খবর নিয়েছিলেন এবং আলি মেচ তার পথ-প্রদর্শক হিসেবে কাজ করতে রাজি হয়েছিল। তিব্বত অভিমুখে যাত্রার পূর্বে বখতিয়ার মুহাম্মদ শীরান খিলজি ও তার ভ্রাতা আহমদ শীরান খিলজিকে লাখনৌর (বর্তমান বীরভূম জেলার গৌর) আক্রমণ করতে প্রেরণ করেন। তবে এই অভিযানের কি ফলাফল হয়েছিল, সেই বিষয়ে মিনহাজ কোনাে উল্লেখ করেননি।
সকল প্রস্তুতির পর তিব্বতের উদ্দেশ্যে বখতিয়ার প্রায় দশ হাজার সৈন্যসহ৮৮ লখনৌতি ত্যাগ করেন। উত্তর-পূর্ব দিকে কয়েকদিন চলবার পর তারা মর্দানকোট বা বর্ধনকোট নামক একটি শহরে পৌঁছান। এই শহরের পূর্বদিকে বেগমতী নামক একটি নদী ছিল।৮৯ বখতিয়ার নদীটি অতিক্রম না করে উত্তর দিকে অগ্রসর হন এবং দশদিন চলার পর একটি পাথরের সেতুর নিকটে আসেন। সেতু পার হয়ে তিনি তার দুইজন সেনাপতিকে ওই স্থানে সেতু রক্ষণাবেক্ষণের জন্য মােতায়েন করে অগ্রসর হতে থাকেন। আলি মেচ ওই স্থানে বখতিয়ারকে ত্যাগ করেন। কামরূপের রাজার নিকট থেকে তিনি সংবাদ পান যে, ওই সময় তিব্বত আক্রমণ করা সমীচীন হবে না। কামরূপরাজ বখতিয়ারকে ফিরে যেতে বলেন এবং পরের বছর আবার এলে তিনি বখতিয়ারকে সাহায্য করবেন বলে আস দেন। বখতিয়ার এই কথায় কোনাে কান না দিয়ে উত্তর দিকে অগ্রসর হতে থাকেন। পনের দিনের পথ চলার পর শস্য-শ্যামলা এক স্থানে এসে পৌঁছান। সেখানে একটি কেল্লাও ছিল। ওই স্থানে স্থানীয় সৈন্যরা বখতিয়ারের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। বখতিয়ার যুদ্ধে জয়লাভ করলেও তার যথেষ্ট সৈন্য ক্ষতি হয়। বন্দি শত্রু-সৈন্যদের নিকট বখতিয়ার জানতে পারলেন যে, ওই স্থানের অদূরে ভুটানের করমবত্তন নামক শহরে পঞ্চাশ হাজার সৈন্য যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে। বখতিয়ার আর অগ্রসর না হয়ে প্রত্যাবর্তন করেন। ফেরার পথে তার সৈন্যরা অসীম কষ্ট সহ্য করে। অনেক কষ্টের পর পাথরের সেতুর নিকট পৌঁছে বখতিয়ার দেখেন, তার দুই সেনাপতি সেখানে নেই এবং সেতুটি সম্পূরূপে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। এখন বখতিয়ারের বাহিনী যেকোনাে উপায়ে নদী পার হওয়ার জন্য চিন্তা করতে লাগল। সামনে একটি দেব মন্দির (বােদেরী মন্দির) দেখতে পেয়ে বখতিয়ারের বাহিনী সে মন্দিরের ভিতর আশ্রয় নেয়। কামরূপ রাজ্যের বাহিনী তখন মন্দিরের চারিদিকে ঘিরে ফেলে মুসলিম বাহিনীকে আক্রমণ করে। এই আক্রমণে বখতিয়ারের বাহিনীর বহু সৈন্য নিহত হন। কোনাে উপায় না দেখে বখতিয়ারের বাহিনীর বাকি সৈন্যরা তখন দেওয়াল ভেঙে পাশের নদীতে পড়ে নদী পার হওয়ার জন্য। অবশেষে মরিয়া হয়ে বখতিয়ার সাঁতার কেটে নদী পার হন (নদীর তীরে আলি মেচ ও তার আত্মীয়স্বজন এসে বখতিয়ারকে নদী থেকে তােলেন। মিনহাজ-ই-সিরাজী লেখেন, “মােহাম্মদ বখতিয়ার পানি থেকে বের হয়ে আসলে কোচ-মেচদের এক দলের মধ্যে সংবাদ পৌঁছে গেল। পথপ্রদর্শক আলী মেচ তার আত্মীয়-স্বজনদের পথে রেখে গিয়েছিলেন। তারা উপস্থিত হয়ে অনেক সাহায্য ও সেবা করলেন।”৯০ বখতিয়ারের বিশাল সৈন্যবাহিনী নদীতে ডুবে বিধ্বস্ত হয়। অল্প সংখ্যক সৈন্য (১০০ জন) নিয়ে বখতিয়ার ভগ্ন হৃদয়ে দেবকোটে ফিরে আসেন। গৌহাটির নিকটে ব্রহ্মপুত্র নদীর তীরে কানাই বরশী বােয়া নামক স্থানে প্রাপ্ত শিলালিপিতে ১১২৭ শকাব্দে (১২০৬ মার্চ) ওই স্থানে তুরস্ক সেনাদলের বিধ্বস্ত হওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়।৯১ সমগ্র বাংলা জয় না করে কি কারণে বখতিয়ার তিব্বত অভিযানে বের হন। তা আজও স্পষ্ট নয়। তবে আমাদের মনে হয় তিনি তিব্বত পর্যন্ত যেতে পারেননি। কামরূপের পার্বত্য অঞ্চলে কামরূপ বাহিনী কর্তৃক বাধাপ্রাপ্ত হন।
মিনহাজ কর্তৃক প্রদত্ত বর্ণনার অনেকাংশ এত সংক্ষিপ্ত ও এত অসামঞ্জস্যপূর্ণ যে, তিব্বত অভিযানের গতিপথ, মিনহাজ বর্ণিত ভৌগােলিক অবস্থান ও মােহাম্মদ বখতিয়ারের গন্তব্যস্থল সম্বন্ধে কোনাে সুস্পষ্ট ধারণা করা অত্যন্ত দুরূহ ব্যাপার। অপরাজেয় (?) মুসলিম বাহিনীর বিপর্যয়ের জন্য যে প্রকৃতিই (এখানে নদীর গভীরতা) মূলত দায়ী ছিল, তা মিনহাজের বর্ণনার মধ্যে সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান। এতে অতি সঙ্গত কারণেই সন্দেহ হয় যে, সমুহ ঘটনাটি যেভাবে ঘটেছিল, ঠিক সেভাবেই তিনি। লিপিবদ্ধ করে গেছেন কিনা অথবা সঠিক তথ্যের সন্ধান তিনি আদৌ পেয়েছিলেন কিনা।
মিনহাজের বর্ণনা যতই সন্দেহব্যঞ্জক হােক না কেন, এ অভিযান সম্পর্কে এটি ছাড়া সে যুগের আর কোনাে বর্ণনাই নেই। এমনকি এ ঘটনার কয়েক শতবর্ষের মধ্যেও এমন অন্য কোনাে বর্ণনা নেই, যার উপর নির্ভর করা যেতে পারে। পরবর্তীকালে এ ঘটনার উপর যা লেখা হয়েছে, তা মিনহাজের বর্ণনারই চর্বিতচর্বণমাত্র অথবা কমবেশি কোনাে কাল্পনিক বর্ণনা। এসব কারণে এ ব্যাপারে কোনাে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে গেলে মিনহাজের বর্ণনাই একমাত্র অবলম্বন এবং এ বর্ণনাকে বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে যাচাই করে সত্যের সন্ধান করা ছাড়া আর কোনাে উপায় নেই।
বখতিয়ার খিলজির তিব্বত অভিযানের ব্যর্থতার ফলাফল ছিল খুবই মারাত্মক। প্রায় অর্ধশতাব্দীকাল বাংলার ইতিহাসের গতি তিব্বত অভিযানের ব্যর্থতায় প্রভাবিত করে। প্রথমত, এর ফলে বাংলার হিন্দু নৃপতিরা কিছুকালের জন্য মুসলমান আক্রমণের আশঙ্কা থেকে পরিত্রাণ পেলেন। দ্বিতীয়ত, তিব্বত অভিযানে খিলজি বাহিনীর শক্তি অধিকাংশ বিনষ্ট হলে গৌড়ের মুসলমান রাজ্যের সম্প্রসারণের পথ সাময়িকভাবে রুদ্ধ হয়। তৃতীয়ত, বাংলার মুসলমান প্রভুত্ব থেকে বিহার বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। বিহার ছিল বখতিয়ারের সৈন্য সংগ্রহের অন্যতম কেন্দ্র। সুতরাং বিহার তুর্কিদের হস্তচ্যুত হলে তাদের সামরিক শক্তি বিশেষভাবে ক্ষুন্ন হয়। চতুর্থত, তিব্বত অভিযারে ব্যর্থতা সদ্য প্রতিষ্ঠিত মুসলমান রাজ্যের অভ্যন্তরীণ সংহতির ওপর চরম আঘাত হানে এবং খিলজিদের মধ্যে অন্তর্বিপ্লবের সূত্রপাত হয়। সদ্য প্রতিষ্ঠিত মুসলিম রাজ্যের অখণ্ডতা ও সংহতি সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে খিলজি অভিজাতরা বিজিত রাজ্য নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিলেন।
তিব্বতে বখতিয়ারের অভিযান ছিল সম্পূর্ণ অপরিকল্পিত। অভিযানের বিফলতার মূল কারণ সেনাপতির অদুরদর্শিতা, সেনাবাহিনীর অক্ষমতা ও সর্বোপরি প্রতিকূল পারিপার্বিক অবস্থা। এহেন সামরিক বিপর্যয়ের ফলে স্বাভাবিকভাবেই বখতিয়ার মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। তিনি নগর ভ্রমণে বের হওয়া বন্ধ করে দেন। শয্যাশায়ী বখতিয়ার ১২০৬ খ্রিস্টাব্দে দেবকোটেই মারা যান। কেউ কেউ বলেন যে, বখতিয়ারের মৃত্যুতে আলি মর্দান খিলজির হাত ছিল।৯২
[১২]
কিছু ‘নিরপেক্ষ’ ইতিহাসবিদের দেওয়া একটা ধারণায় অনেক শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষরাও প্রভাবিত হন। সেই ধারণাটি হল যে, তুর্কি বিজয়ের পরই কেবল বাংলার গ্রামাঞ্চলের মানুষের মধ্যে ইসলাম ধর্মের প্রসার সম্ভব হয়েছিল। অর্থাৎ সামরিক শক্তির প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষ প্রভাবেই ইসলাম ধর্ম বাংলার গ্রামীণ মানুষের মধ্যে স্থান করে নিতে সক্ষম হয়েছিল। প্রকারান্তরে বলা হল যে, বাংলায় তুর্কি বিজয় না হলে বাংলার মাটিতে ইসলাম ধর্মের প্রবেশ সম্ভব হত না। পাশাপাশি তাহলে ইসলামের ভয়ে পণ্ডিতদের পলায়নের তত্ত্বটিকেও সহজেই মান্যতা দেওয়া যায়।
কিন্তু এ ধারণাটা যে সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত নয় তার একাধিক অকাট্য পাথুরে প্রমাণ কিন্তু অতি সহজলভ্য। নদিয়া বা গৌড় বিজয়ের পর তুর্কিরা সপ্তগ্রাম অধিকার করেছিল ১২৯৮ সালে। এটি একটি প্রতিষ্ঠিত ঐতিহাসিক সত্য যে, দক্ষিণবঙ্গ তুর্কি বা অন্য কোনও মুসলমান শাসনের বাইরে ছিল ১২৯৮ সাল পর্যন্ত অর্থাৎ তুর্কিদের গৌড় জয়ের প্রায় একশত বছর পর পর্যন্ত। কিন্তু পরম বিস্ময়ের বিষয় হল যে, বীরভূম জেলার বােলপুর থানার সিওয়ান গ্রাম থেকে একটা প্রস্তর লিপি পাওয়া গেছে যাতে আরবি ভাষায় লেখা আছে যে একদল সুফির বাসের জন্য ১২২১ সালের ২৯ জুলাই সেখানে একটি খানকাহ স্থাপিত হয়েছিল। এই লিপিযুক্ত প্রস্তর খণ্ডটি সেই খানকাহ-র আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের সময়ে সেই গৃহে লাগান হয়েছিল।৯৩ এটা তর্কাতীত যে, দক্ষিণবঙ্গ মুসলমান শাসনে আসার বহু বছর আগে বীরভূমের গ্রামাঞ্চলে একদল সুফি ধর্মপ্রচারক বাস করতেন। এটা বলাই বাহুল্য যে, সেই সুফি দলটি ১২২১ সালেই সে গ্রামে আস্তানা গাড়েনি। দীর্ঘকালের প্রচেষ্টার পর তারা যখন এখানকার মানুষদের তাদের ধর্মমতে দীথিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন তাদের আর্থিক আনুকূল্যেই এই খানকাহটির উদ্বোধন হয়েছিল। এই খানকাহটির রক্ষণাবেক্ষণ এবং সুফি ধর্ম প্রচারকদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার পৌনঃপুনিক ব্যয়ও যে ওই নবদীক্ষিতদের কাছ থেকে আসবে সে ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েই তারা ওই খানকাহটির প্রতিষ্ঠা করতে প্রয়াসী হয়েছিলেন। এটা তাই নিশ্চিত সত্য যে, আরও কয়েক বছর আগে থেকেই ওই সুফি ধর্মপ্রচারকের দলটি সিওয়ান গ্রামে বাস করছিল। আর সুফিদের প্রভাবেই ওখানকার জনগণ ইসলাম ধর্মে দীথিত হয়েছিল।
বীরভূম জেলায় এই খানকাটির প্রতিষ্ঠা যে একটি ব্যতিক্রমী অনন্য ঘটনা নয় তারও কিন্তু ‘পাথুরে’ প্রমাণ রয়ে গেছে। ১২৯৮ খ্রিস্টাব্দে সপ্তগ্রাম বিজয়ী জাফর খান সপ্তগ্রামের নিকটবর্তী ত্রিবেণীতে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। এই মসজিদটির উৎসর্গ-লিপিতে খােদিত আছে,
“সিংহদের মধ্যে সিংহশ্রেষ্ঠ জাফর খান আবির্ভূত হয়ে যে দিকেই অভিযান করেছিলেন সে দিকের ভারতীয় নগরগুলি তিনি জয় করেছিলেন এবং (সে সব অঞ্চলের) দুর্দশাগ্রস্ত দাতব্য নির্ভর প্রতিষ্ঠানগুলির পুনরুজ্জীবন করেন। তিনি তার তরবারী ও বল্লমের দ্বারা বিধর্মীদের মধ্যে যারা অদম্য তাদের ধ্বংস করেছিলেন এবং তার ধনাগার থেকে অঢেল অর্থ দিয়ে সেই দুর্দশাগ্রস্তদের (সাহায্য) দেন।”৯৪
এই প্রশস্তি থেকে এ সিদ্ধান্ত মনে হয় তর্কাতীত যে, সপ্তগ্রাম বিজয়ের পূর্ব পর্যন্ত ওই দুর্দশাগ্রস্ত (ইসলামীয়) দাতব্য প্রতিষ্ঠানগুলি যে সব এলাকায় অবস্থিত ছিল সেগুলি তুর্কি শাসনের বাইরে ছিল। সে কারণেই সপ্তগ্রাম বিজয়ের পূর্ব পর্যন্ত সেগুলি তুর্কি শাসকদের অর্থানুকূল্য বঞ্চিত ছিল। উপরিল্লিখিত খানকাটিও সম্ভবত সেরকম এলাকাতেই অবস্থিত ছিল।
এটা সম্ভবত বলার অপেক্ষা রাখে না যে, সারা দক্ষিণবঙ্গ জুড়েই এরকম বেশ কয়েকটি ইসলামধর্মীদের দাতব্য প্রতিষ্ঠান অথবা দাতব্য নির্ভর প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়েছিল। সেগুলি জাফর খানের সপ্তগ্রাম তথা দক্ষিণবঙ্গ বিজয়ের বহু পূর্ব থেকেই দক্ষিণবাংলার গ্রামাঞ্চলের সেই নব দীক্ষিত ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের দ্বারা এবং তাদেরই আনুকূল্যে সেগুলি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। যেহেতু বাংলার এই ধর্মাবলম্বীরা গ্রাম বাংলার দারিদ্র পীড়িত মানুষ ছিল সে কারণেই গ্রাম্য অর্থনীতির তৎকালীন সংকটে তাদের দ্বারা পৃষ্ঠপােষিত ওইসব প্রতিষ্ঠানগুলিরও অর্থনৈতিক হাল শােচনীয় হয়ে উঠেছিল। সপ্তগ্রাম বিজয়ী জাফর খানের সে কারণেই তাদের অর্থ সাহায্য করতেন।
এই তথ্যই প্রমাণ করে যে বাংলার মানুষরা এমন কাপুরুষ ছিল না—যাঁরা ব্যবহার নয়, কেবল অস্ত্রের আস্ফালনেই তারা ভীত হয়ে দলে দলে ‘নীচ ধর্ম’ ত্যাগ করে বিজয়ী বাহিনীর ধর্মকে গ্রহণ করে আত্মরক্ষা করতে বাধ্য হয়েছিল। এমন অভিমত যারা পােষণ করেন তারা সজ্ঞানে বা অজ্ঞানে বাংলার মানুষদের চরিত্রে কালিমা লেপন করেন। পাশাপাশি অবাকের কথা হল এই যে, এদের মধ্যে বেশ বড়াে একদল আছেন যারা তাদের অতল প্রাজ্ঞে রায় দেন যে, তুর্কি আক্রমণের ফলে গৌড়ের মানুষরা দলে দলে এলাকা পরিত্যাগ করে।
উল্লেখ্য, অষ্টম শতাব্দী থেকে ভারতবর্ষের বিশেষ বিশেষ উপকূলীয় অঞ্চলে আরব বণিকেরা তাদের আধিপত্য বিস্তার করতে থাকেন। তার সঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই ইসলামের প্রভাবও এসে পড়ে। এই আরব বণিকদের সঙ্গে ধর্মপ্রচারক, সুফি, দরবেশ প্রমুখও এদেশে এসেছিলেন। রাজশাহি জেলার পাহাড়পুরে আবিষ্কৃত খলিফা হারুন অল রসিদের (৭৮৬-৮০৯) মুদ্রা সাক্ষ দিচ্ছে যে, এরা বঙ্গদেশেও পদার্পণ করেছিলেন।৯৫ এই সকল সুফি সাধকগণের মধ্যে মুন্সিগঞ্জ জেলার বিক্রমপুরস্থ রামপালের বাবা আদম, নেত্রকোনা জেলার মদনপুরস্থ শাহ মুহম্মদ সুলতান রুমি, বগুড়া জেলার মহাস্থানস্থ শাহ সুলতান মাহীসাওয়ার, পাবনা জেলার শাহজাদপুরের মখদুম শাহ, বর্ধমান জেলার মঙ্গলকোটে মখদুম শাহ মাহমুদ গজনবী, চট্টগ্রামের বায়েজিদ বােস্তামী এবং শেখ ফরিদ প্রভৃতি সুফি সাধকগণের আস্তানা আজও বিদ্যমান এবং তারা তাদের শিষ্যগণসহ বাংলায় মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার পূর্বে ইসলাম প্রচারের জন্য আগমন করেন এবং তৎকালীন উৎপীড়িত ও অধঃপতিত বৌদ্ধ ও নিম্নশ্রেণির হিন্দুগণ মুক্তির জন্য তাদের নিকট ভিড় জমাত। এই সকল সুফিগণ তাদের আদর্শস্থানীয় চরিত্র, আধ্যাত্মিক গুণাবলী এবং মানব হিতেষণামূলক কার্যাবলীর দ্বারা বাংলার মতাে একটি অমুসলিম দেশে ইসলাম ধর্মের অনুসারী তৈরি করতে সক্ষম হন। তারা এই দেশে ইসলাম বিস্তারে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠাকারী শাসকবর্গ অপেক্ষা অধিক কার্যকরী ভূমিকা পালন করেছেন এবং জনমানসকে দারুণ প্রভাবান্বিত করে ইসলাম ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট করেন। তাদের প্রতিষ্ঠিত খানকাগুলি আধ্যাত্মিক, মানবকল্যাণ এবং বুদ্ধিবৃত্তিক কার্যাবলীর প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। এই সূত্রে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার পূর্বে বাংলার কোনাে কোনাে অঞ্চলে যে ছােটো ছােটো মুসলিম বসতি স্থাপিত হয়েছিল তা আজ প্রমাণিত।৯৬ রাজা লক্ষ্মণ সেনের দরবারে যে একজন মুসলমান ফকিরের (উত্তরবঙ্গের পাণ্ডুয়ায় শেখ জালালউদ্দিন তাবরিজী) যথেষ্ট প্রতিপত্তি ছিল তার প্রমাণ মেলে রাজার সভাপণ্ডিত হলায়ুধ মিশ্রের ‘শেখ শুভােদয়া’ নামে এক সংস্কৃত গ্রন্থে। অতএব বােঝা যাচ্ছে, বঙ্গদেশে মুসলমান অভিযানের আগে থেকেই এদেশে ইসলাম ধর্মের সাম্য এবং ভ্রাতৃত্বের বাণী এসে পৌঁছেছিল। হিন্দু মানসে তার প্রভাব রাজা লক্ষ্মণ সেনের শেখতােষণে বিস্তৃত।
[১৩]
বিহারের নালন্দা মহাবিহার তথা বিধবিদ্যালয়৯৬ক ধ্বংসের জন্য বখতিয়ার খিলজির নির্মম আক্রমণকে দায়ী করা হয়েছে। এ তথ্য সর্বাংশে সত্য নয়। তবে এই আলােচনায় প্রবেশের পূর্বে আমরা নালন্দার সংক্ষিপ্ত পরিচিতি তুলে ধরতে পারি। বিভিন্ন ঐতিহাসিক উপাদানের ভিত্তি বিশ্লেষণ করে নালন্দার প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ-পঞ্চম শতাব্দী থেকে। তখন নালন্দা ছিল একটি সমৃদ্ধ শহর। কিন্তু নালন্দার অবস্থান নিয়ে ঐতিহাসিকেরা সহমত হতে পারেননি। বিভিন্ন তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে পার্ববর্তী অনেক স্থানের সঙ্গে নালন্দাকে সনাক্ত করেছেন ঐতিহাসিকেরা। কিন্তু এইসব তথ্য প্রমাণ থেকে নালন্দার সঠিক সনাক্তকরণ সহজসাধ্য নয়। কারণ অনেক তথ্যই পরস্পর বিরােধী। তবে পালি-বৌদ্ধ সাহিত্য ও জৈন উপাদান থেকে নালন্দার যে বর্ণনা পাওয়া যায়, সে নালন্দা এবং বর্তমান নালন্দা মােটামুটিভাবে একই, যা কিনা বিহার রাজ্যের রাজগীর শহরের উপকণ্ঠে অবস্থিত।৯৭
বৌদ্ধ সংঘের সংস্কৃত বা পালি প্রতিশব্দ হল বিহার, যার প্রকৃত অর্থ বৌদ্ধ ভি দের আশ্রয়স্থল। এইসব বিহারের অনেকগুলি পরবর্তীকালে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছিল, তার মধ্যে কয়েকটি আবার বৌদ্ধ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হয়েছিল, যেমন নালন্দা। এই নালন্দার উল্লেখ পাওয়া যায় খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে। কারণ ফা-হিয়েন যখন নালন্দাতে আসেন, তখন সেখানে কোনাে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল না।৯৮ গুপ্তযুগে নালন্দা বিহার থেকে মহাবিহারে রূপান্তরিত হয়েছিল মূলত রাজকীয় অনুদানের দ্বারাই। আর কোনাে মহাবিহার নালন্দার মত রাজকীয় অনুদান পায়নি। কারণ নালন্দা ছিল সে যুগের মানদণ্ডে বিশ্বমানের শিক্ষাক্ষেত্র। পাল রাজারাও ছিলেন নালন্দার পৃষ্ঠপােষক। পাল শাসনকালেই নালন্দা খ্যাতির চরম শিখরে পৌঁছেছিল। এই পাল রাজারা ছিলেন মহাযান বৌদ্ধধর্মের অনুসারী আর নালন্দা ছিল তাঁদের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র, যার ফলে তারা মুক্তহস্তে নালন্দাতে দান করছিলেন। সেই সময় নালন্দাতে ভারতের বাইরের বিভিন্ন দেশ থেকেও শিক্ষার্থীরা আসতাে, যারা জ্ঞানার্জনের শেষে প্রচুর আর্থিক সাহায্য নালন্দা মহাবিহারকে দিয়ে যেত—নালন্দার সমৃদ্ধির এটাও একটা অন্যতম প্রধান কারণ বলা যেতে পারে। এখানে প্রায় ১০,০০০ ছাত্র বসবাস করত ও অধ্যয়ন করত।৯৯ চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ স্বয়ং নালন্দার অধ্যক্ষ শীলভদ্রের কাছে পড়াশুনাে করতেন। তাঁর মতে, ভারতে তখন হাজার হাজার শিক্ষাকেন্দ্র ছিল কিন্তু শিক্ষণীয় বিষয়ের বৈচিত্র্য, শিক্ষাপদ্ধতির উৎকর্ষে ও বিশালত্বে নালন্দার স্থান ছিল সর্বশ্রেষ্ঠ।১০০
এমনও সাম্প্রতিক তথ্য আমাদের সামনে আসছে যে, বখতিয়ার খিলজি নালন্দায় কোনােদিন যাননি। ঐতিহাসিক কে কে কানুনগাে ‘জার্নাল অফ দ্য এশিয়াটিক সােসাইটি অফ বেঙ্গল’-এ প্রকাশিত শরৎচন্দ্র দাশের ‘অ্যান্টিকুইটি অফ চিটাগাঁও’ প্রবন্ধ থেকে জানাচ্ছেন যে, কামিরের বৌদ্ধ পণ্ডিত শাক্য শ্রীভদ্র ১২০০ সালে মগধে গিয়ে দেখেছিলেন বিক্রমশীলা ও উদন্তপুরী বিহার ভয়ঙ্করভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তুর্কিদের ভয়ে শ্রীভদ্র ও ওই বিহার দুটির ভিক্ষুরা বগুড়া জেলার জগদ্দল বিহারে আশ্রয় নেন।১০১ কিন্তু শরৎচন্দ্র দাশ তাঁর উক্ত প্রবন্ধে এমন কথা বলেননি যে, ১২০০ সালে বিক্রমশীলা ও উদন্তপুরী বিহার দুটিকে ধ্বংস করা হয়েছিল। বরং তিনি তার সম্পাদিত তিব্বতীয় শাস্ত্র ‘পাগসাম ইয়ান জাং’-এ বলেছেন, বিহার দুটি ধ্বংস হয়েছিল ১২০২ সালে। ফলে শাক্য শ্রীভদ্র জগদ্দল বিহারে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। তাহলে দেখা যাচ্ছে, এই ঘটনা বখতিয়ারের বিহার অভিযানের (১২০৩) পূর্বেকার। আর এক্ষেত্রে বিশেষভাবে লক্ষণীয় বিষয় হল, ক্ষতিগ্রস্ত বিহারগুলির মধ্যে নালন্দার নাম নেই। তাছাড়া মিনহাজ বা অন্য কোনাে সুত্রেও নালন্দা ধ্বংসের কথা বলা হয়নি। ১২৩৪-৩৬ সালে অর্থাৎ বখতিয়ারের বিহার জয়ের ৩১ বছর পর তিব্বতী সাধু ধর্মস্বামী মগধে আগমন করেন ও সেখানে অবস্থান করেন। নালন্দা মঠকে তিনি তখন চালু অবস্থায় দেখতে পান। সেখানে মঠাধ্যক্ষ রাহুল শ্রীভদ্রের পরিচালনায় সত্তর জন সাধু অধ্যয়নে নিয়ােজিত ছিলেন এবং তিনি নিজে ছমাস সেখানে জ্ঞানার্জন করেন। তাহলে বিষয়টা দাঁড়াল এই যে, বখতিয়ারের আক্রমণে নালন্দা সম্পূর্ণ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় বলে যে প্রচারণা ছিল ধর্মস্বামীর বিবরণে তার উল্লেখ নেই। তবে তিনি বিক্রমশীলা মহাবিহারকে সম্পূর্ণ ধ্বংস অবস্থায় ও উদন্তপুরীকে তুর্কি সামরিক ঘাঁটি রূপে দেখতে পান।১০২
তাহলে নালন্দা ধ্বংস হল কিভাবে? এটা পূর্বে উল্লেখিত হিন্দু ও বৌদ্ধ সংঘাতের ফলশ্রুতি নয় তাে? কিংবদন্তি ও জনশ্রুতিতেও অনেক ঐতিহাসিক সত্য লুকিয়ে থাকে। বুদ্ধগয়া নালন্দা ও রাজগীরে বিখ্যাত তীর্থস্থান অথবা ধ্বংসাবশেষের উপরে লিখিত একটি পরিচিতি পুস্তিকায় এর কিছুটা আঁচ পাওয়া যাবে। যদিও সে বর্ণনায় কিছুটা অলৌকিকত্বের তত্ত্ব ঢােকানাে হয়েছে। বখতিয়ার খিলজির আক্রমণ তত্ত্বের সাথে কোনও ভনিতা না করে পুস্তিকাটিতে এ তথ্য সংযােজিত হয়েছে, “পঞ্চম শতাব্দীতে ব্রাহ্মণ দার্শনিক এবং প্রচারক কুমারভট্ট এবং শংকরাচার্যের প্রচেষ্টাতেই বৌদ্ধধর্মের প্রভাব ক্ষয় হয়ে গিয়েছিল। প্রবাদ আছে, তারা সারা ভারতে পরিভ্রমণ করে বৌদ্ধ পন্ডিতকে তর্কযুদ্ধে পরাজিত করে ধর্মান্তরিত করেন।…একদিন ঐ মন্দিরে যখন শাস্ত্র চর্চা চলছিল তখন দুজন কোমল স্বভাবের ব্রাহ্মণ সেখানে উপস্থিত হন। কয়েকটি অল্প বয়স্ক ভিক্ষু তাঁহাদের উপর পরিহাসােচ্ছলে জল ছিটিয়ে দেন। এতে তাঁদের ক্রোধ বেড়ে যায়। বারাে বৎসরব্যাপী সূর্যের তপস্যা করে তাঁরা যজ্ঞাগ্নি নিয়ে নালন্দার প্রসিদ্ধ গ্রন্থাগারে এবং বৌদ্ধ বিহারগুলিতে অগ্নিসংযােগ করেন। ফলে নালন্দা অগ্নিসাৎ হয়ে যায়।”১০৩ তবে তিব্বতীয় শাস্ত্র ‘পাগসাম ইয়ান জাং’-ও ‘উগ্র হিন্দুদের হাতে নালন্দার গ্রন্থাগার পােড়ানাে হয়েছে বলে উল্লেখ করেছে।১০৪ ডি আর পাতিল অবশ্য খুব পরিষ্কার করে বলেছেন যে, ওটা ধ্বংস করেছিল শৈবরা।১০৫ এই মতের দীর্ঘ আলােচনা করেছেন আর এস শর্মা এবং কে এম শ্রীমালি।১০৬
ষষ্ঠ শতকের রাজা মিহিরকুল বৌদ্ধদের সহ্য করতে পারতেন না। তিনি যখন পাটলিপুত্র আক্রমণ করেন তখন সম্ভবত নালন্দা মহাবিহার ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। এইচ হিরাস এ বিষয়ে লিখেছেন,
‘Nalanda University was not far from the capital, Pataliputra and its fame had also reached Mihirakula’s ears. The buildings of Nalanda were then probably destroyed for the first time, and its priests and students dispersed and perhaps killed.১০৭
এরপর সপ্তম শতকের মাঝামাঝি মগধে সংঘটিত যুদ্ধবিগ্রহের শিকারও হতে পারে নালন্দা। ঐতিহাসিক এস এন সদাশিবন নালন্দা ধ্বংসের জন্য মুসলমান ও ব্রাহ্মণ উভয়কেই কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন।১০৮ বুদ্ধ প্রকাশ তার ‘অ্যাসপেক্টস্ অফ ইন্ডিয়ান হিস্টরি অ্যান্ড সিভিলাইজেশন’ গ্রন্থে (আগ্রা, ১৯৬৫) নালন্দায় অগ্নি সংযােগের জন্য হিন্দুদেরই দায়ী করেছেন। অথচ এতদিন আমরা নালন্দা মহাবিহার ধ্বংসের জন্য মােহাম্মদ বখতিয়ার খিলজিকেই অভিযুক্ত করে এসেছি।
শুধু তাই নয়, ময়নামতী মহাবিহারও (অধুনা বাংলাদেশের রাজশাহী জেলার অন্তর্গত পাহাড়পুর গ্রামে অবস্থিত ময়নামতী) ধ্বংস হয় ব্রাহ্মণ্যবাদীদের হাতে। নালন্দার মতাে এক্ষেত্রেও দায়ী করা হত মূলত মুসলিম আক্রমণকারীদের। একাদশ শতকের শেষভাগে বৌদ্ধ চন্দ্রবংশ উৎখাত করে অবিভক্ত দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ব্রাহ্মণ্যবাদী বর্মণ রাজবংশ। এই বংশেরই অন্যতম শাসক ছিলেন জাতবর্মা। রাজ্য বিস্তারের লক্ষে তার দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়েছিল সােমপুর মহাবিহারের প্রতি। তিনি অচিরেই বৌদ্ধবিহারটি অবরুদ্ধ এবং লুণ্ঠন করেন। অবশেষে অগ্নি সংযােগে মহাবিহারটি ধ্বংস করেন।১০৯ ওই বিহারের মঠাধ্যক্ষ সুপণ্ডিত করুণাশ্রী মিত্রকেও তিনি অগ্নিদগ্ধ করে হত্যা করেন।১১০ ভােজবর্মার বেলাবলিপি থেকেও জানা যায়, পরম বিষ্ণুভক্ত জাতবর্মা সােমপুরের মহাবিহার ধ্বংস করেছিলেন। বৌদ্ধ নিপীড়নের কিছু নমুনা প্রসঙ্গে বিখ্যাত সােমপুর মহাবিহার ধ্বংসের কথা নীহাররঞ্জন রায় এভাবে উল্লেখ করেছেন, “…ভারতীয় কোনও রাজা বা রাজবংশের পথে পরধর্মবিরােধী হওয়া অস্বাভাবিক, এ যুক্তি অত্যন্ত আদর্শবাদী যুক্তি, বিজ্ঞানসম্মত যুক্তি তাে নয়ই। অন্যকাল এবং ভারতবর্ষের অন্য প্রান্তের বা দেশখণ্ডের দৃষ্টান্ত আলােচনা করিয়া লাভ নাই প্রাচীনকালের বাঙলাদেশের কথাই বলি। বঙ্গাল-দেশের সৈন্য-সামন্তরা কি সােমপুর মহাবিহারে আগুন লাগায় নাই? বর্মণ রাজবংশের জনৈক প্রধান রাজকর্মচারী ভট্ট-ভবদেব কি বৌদ্ধ পাষন্ড বৈতালিকদের উপর জাতক্রোধ ছিলেন না? সেন-রাজ বল্লাল সেন কি নাস্তিকদের (বৌদ্ধ) পদোচ্ছেদের জন্যই কলিযুগে জন্মলাভ করেন নাই?”১১১
[১৪]
বখতিয়ার খিলজির বাংলা বিজয় ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। ইসলামের ইতিহাসে মুসলিম বিজয় পশ্চিম প্রান্তে যেমন স্পেন পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করে, তেমনি পূর্বপ্রান্তে বাংলা পর্যন্তও বিস্তৃত হয়। বখতিয়ারের বিজয় তাই মধ্যযুগের বাংলার ইতিহাসে নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ –
- ১. বখতিয়ার খিলজির বিজয়ের ফলে হিন্দু ও বৌদ্ধ অধ্যুষিত বঙ্গভূমিতে হিন্দু রাজত্বের অবসান সূচিত হয় ও বাংলায় প্রথম মুসলিম আধিপত্য বিস্তার লাভ করে।
- ২. বাংলায় মুসলিম সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হয়েছিল। মুসলিমরা পরবর্তী সাড়ে পাঁচশ বছর বাংলা শাসন করে।
- ৩. এ বিজয়ে বাংলার সামরিক দুর্বলতা প্রকটিত হয়েছে। এমনকি স্থানীয় মানুষেরা তুর্কি অভিযানের বিরুদ্ধে বড় ধরণের কোনাে প্রতিরােধ গড়ে তােলেনি, একটি স্মরণীয় যুদ্ধ সংঘটিত হয়নি। বারাে ভূঁইয়ারা মুঘলদের যেভাবে প্রতিরােধ করেছিল কিংবা বর্তমান ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলােতে তুর্কি ও মুঘল অভিযান যেভাবে মােকাবিলা করেছিল, বাংলায় তেমনটি দেখা যায়নি।
- ৪. বখতিয়ারের বিজয় বাংলায় ইসলাম সম্প্রসারণে সহায়ক হয়। অবশ্য মুসলিম সৈন্যগণ ধর্মপ্রচার করেননি। বস্তুত
- মুসলিম বিজয়ের পূর্বেই বহু সুফি-সাধক বাংলায় আগমন করেন। তবে একথা নিশ্চিত করে বলা যায় যে, বাংলায় সুফি-সাধকদের প্রকৃত প্রবেশ ঘটে বখতিয়ারেরই হাত ধরেই। তারা অনায়াসে ইসলাম প্রচারের সুযােগ পান।
- ৫. বখতিয়ার খিলজিকে বঙ্গদেশের মধ্যযুগের ইতিহাসের প্রতিষ্ঠাতা বলা যায়। এ বিজয়ের ফলে বাংলায় ধারাবাহিকভাবে ইতিহাস লেখা শুরু হয়। আরবি ও ফারসি ভাষায় রচিত ইতিহাস গ্রন্থে মুসলিম বিজয়ের কৃতিত্ব ও ইসলামের সম্প্রসারণের গুরুত্ব উল্লেখ করা হয়। এ সমস্ত গ্রন্থে মুসলিম সুফিদের বাংলায় আগমনের কথাও বলা হয়েছে।
- ৬. বখতিয়ার খিলজির বিজয়ের ফলে বাংলায় শুধু মুসলিম সার্বভৌমত্বই প্রতিষ্ঠিত হয়নি, বরং মুসলিম সমাজও প্রতিষ্ঠিত হয়। বখতিয়ার খিলজির সৈনিক ও প্রশাসকরা লখনৌতি রাজ্যে বসতি গড়ে তােলে। এছাড়া বহু জায়গা থেকে মুসলমানরা এখানে এসে স্থায়িভাবে বসবাস করতে থাকে। পীর আউলিয়ারও লখনৌতিতে এসে বসতি স্থাপন করে। দলে দলে হিন্দুরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। লখনৌতিতে অনেক মসজিদ, মাদ্রাসা, খানকা নির্মাণ করা হয়। এর ফলে লাখনৌতিতে মুসলিম সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়।
- ৭. বখতিয়ার খিলজির বাংলা বিজয়ের সাথে সাথে বাংলায় মুসলিম শিল্পকলার বিকাশ ঘটে। মধ্য এশিয়া ও অন্যান্য জায়গার স্থাপত্য কলার প্রভাবে এখানে মসজিদ, মাদ্রাসা ও খানকা, বাড়ীঘর, প্রাসাদ, দুর্গ নির্মিত হয়। তবে এসব স্থাপত্য কর্মে বিদেশি উপাদানের সাথে সাথে স্থানীয় প্রভাব লক্ষ করা যায়। এর ফলে বাংলার মুসলিম স্থাপত্য স্বতন্ত্র বা নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হয়।
- ৮. বখতিয়ার খিলজি নব প্রতিষ্ঠিত মুসলিম রাজ্যে সুশাসন প্রবর্তিত করেন। তিনি অধিকৃত অঞ্চলকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করেন এবং প্রত্যেক ভাগকে একজন সামরিক কর্মকর্তার উপর ন্যস্ত করেন। এরকম প্রত্যেক ভাগকে ‘ইকতা’ এবং এর শাসনকর্তাকে ‘মুকতা’ বলা হত। এভাবে তিনি বাংলায় প্রথম শাসনব্যবস্থা চালু করেন।
বাংলার ইতিহাসে বখতিয়ার খিলজির নাম স্বর্ণাক্ষরে লিখিত থাকবে, কারণ তাঁর বীরত্ব, নির্ভীকতা, সামরিক তৎপরতা ও দক্ষতার ফলে সর্বপ্রথম বৌদ্ধ-হিন্দু অধ্যুষিত বাংলা মুসলিম শাসনাধীনে আসে। আর এই বাংলার স্থায়িত্ব ছিল ইংরেজ ক্ষমতা দখল করার আগে পর্যন্ত। ত্রীতদাস না হলেও অত্যন্ত দীনাবস্থা থেকে স্বীয় প্রতিভা ও কর্মকৃতির বলেই তিনি এক সুদীর্ঘ অঞ্চল অধিকার করতে সক্ষম হয়েছিলেন। অল্প পরিসর জীবনের মধ্যে এই কর্মকুশলতা সত্যই অসাধারণ। প্রাক-সুলতানি যুগে দিল্লির প্রভাবাধীনে যতদিন বাংলা ছিল ততদিন গৌড় প্রাদেশিক রাজধানীর মর্যাদা পায়। এই কৃতিত্ব বখতিয়ারের। তিনি সমরাভিযান দ্বারা সৈন্য সামন্তকে সুশৃঙ্খল ও সদা প্রস্তুত রাখতেন। তিনি প্রথম শাসন কাঠামাে তৈরি করেন এবং স্থাপত্যকলার পৃষ্ঠপােষকতা করেন। বখতিয়ার স্বীয় ইচ্ছেমত শাসন করতেন এবং যুদ্ধ পরিচালনা করতেন, দিল্লির নির্দেশে নয়। তিনি যেমন একজন প্রতিভাবান ও দুঃসাহসিক সৈনিক ছিলেন, তেমনি তার ন্যায়পরায়ণতাও ছিল সর্বজনবিদিত। ঐতিহাসিক বলেছেন,
“Though plebeian by birth and deformed in body, he was a born leader of men, brave to recklessness and generous to a fabulous extent. His weaknesses were those born of overconfidence and uninterrupted success.’১১২
সর্বোপরি বলতে হয় যে, বখতিয়ার খিলজির বিজয়ের সঙ্গে সঙ্গে বাংলায় আগমনের পথ বহিরাগত মুসলিমদের জন্য উন্মুক্ত হয়ে যায়। বিভিন্ন দেশের মুসলমানগণ এদেশে শাসনকর্তা, সৈনিক, সেনাপতি, ধর্মপ্রচারক, শিক্ষক, বণিক ও ভাগ্য অন্বেষণকারীরূপে আগমন করেন। এই মুসলিম বহিরাগতদের সঙ্গে আরবীয় মুসলমানগণও আগমন করেন। এই আরবীয় বহিরাগতদের মধ্যে অধিকাংশই ছিলেন সুফি, ধর্মপ্রচারক ও বণিক সম্প্রদায়। নতুন অধিকৃত প্রদেশে ধর্মপ্রচারকারী ও ইসলাম শিক্ষাদাতা কয়েক শত সাধুপুরুষদের প্রত্যেকেই বহু শিষ্য ও অনুচর সহ এদেশে আগমন করেন। বিখ্যাত সুফি-সাধক শাহ জালাল ৩৬০ জন শিষ্য সহ আগমন করেন এবং তারা সকলেই বাংলায় বসতি স্থাপন করেন।১১৩ ইসলামের সাম্য ও সংহতির বাণী এই সমস্ত সৎ, সত্যনিষ্ঠ, ও মানবতাবাদী ধর্মপ্রচারকদের মাধ্যমে বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে প্রচারিত হওয়ায় অমুসলিম জনগােষ্ঠীর একটা অংশ ইসলামে ধর্মান্তরিত হয়। ফলে বাংলায় মুসলিম সমাজ-সংস্কৃতি গঠনের প্রকৃত প্রক্রিয়ার কাজ ত্বরান্বিত হতে থাকে। আর এটা সম্ভব হয়েছে বখতিয়ারের বাংলা বিজয়ের ফলে। ইসলাম ধর্ম ও সংস্কৃতির বিকাশে বখতিয়ার যে অবদান রাখেন তাতে বাংলায় ইসলাম সুদূরপ্রসারী হয়। তাই কে কে কানুনগাে যথার্থই বলেছেন, বাংলায় যতদিন ইসলাম থাকবে ততদিন বখতিয়ারের খ্যাতিও ইতিহাসে অম্লান থাকবে।১১৪
বখতিয়ার খিলজির বাংলা অভিযান ইতিহাসের পুনর্নির্মাণ [পর্ব ১]
তথ্যসূত্রঃ
- ৫৬. দীনেশচন্দ্র সেন, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫৩০-৩১ ও ৫৩২-৫৩৩।
- ৫৭. দীনেশচন্দ্র সেন, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫২৮।
- ৫৮. মিনহাজ-ই-সিরাজী তবকাত-ই-নাসিরী, র্যাভার্টি অনূদিত, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫৭৬।
- ৫৯. এ বি এম হাবিবুল্লাহ, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৭-৪৮।
- ৬০. বখতিয়ার খিলজির নদিয়া জয়ের অন্তত ১৪৬ বছর পরে বা মিনহাজের বাংলায় আগমনের প্রায় ১০৮ বছর পরে ১৩৫০ সালে ফখরউদ্দিন ইসামি ‘ফুতুহুস সালাতিন’ গ্রন্থ (ফারসি) রচনা করেন।
- ৬১. নীহারঞ্জন রায়, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪১২-১৩।
- ৬২. উদ্ধৃত-অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রাগুক্ত, পৃ. ৭৬।
- ৬৩. বখতিয়ারের অধিকৃত অঞ্চল একসময় স্বাধীন সুলতানি বাংলার অন্তর্ভুক্ত হয়। কিন্তু এই ঘটনাটি সংঘটিত হয়েছিল বখতিয়ারের নদিয়া বিজয়ের প্রায় দেড় শতক পরে। সুলতান ইলিয়াস শাহ ১৩৫২ খ্রিস্টাব্দে পূর্ববঙ্গ অধিকারের মধ্য দিয়ে পুরাে বাংলাকে একটি স্বাধীন দেশের মানচিত্রে নিয়ে আসেন। এইভাবে চৌদ্দ শতকের মাঝপর্বে ইলিয়াস শাহ সর্বপ্রথম পুরাে বাংলাকে একই শাসনের আওতায় আনেন।
- ৬৪. সম্ভবত লক্ষ্মণ সেন বার্ধক্যজনিত দুর্বলতা ও অন্যান্য কারণে জীবনের শেষ পর্যায়ে রাজ্য শাসনের প্রতি অমনােযােগী হয়ে পড়েছিলেন। এই কারণেই হয়তাে লক্ষ্মণ সেন ভাগীরথী নদীতীরবর্তী তীর্থস্থান নদিয়াতে বসবাস করছিলেন।
- ৬৫. এ কে এম যাকারিয়া, মুহম্মদ বখতিয়ার্স কঙ্কুয়েস্ট অফ নুদিয়া, জার্নাল অফ দ্য বরেন্দ্র রিসার্চ মিউজিয়াম, খণ্ড-৬, রাজশাহী, ১৯৮০-৮১, পৃ. ৫৭-৭২ আরও দেখুন- মিনহাজ-ই-সিরাজী তবকাত-ই-নাসিরী, এ কে এম যাকারিয়া অনূদিত ও সম্পাদিত, প্রাগুক্ত, পরিশিষ্ট।
- ৬৬. সুখময় মুখােপাধ্যায়, বাংলায় মুসলমান অধিকারের আদিপর্ব, প্রাগুক্ত, পরিশিষ্ট।
- ৬৭. আবদুল করিম, প্রাগুক্ত, পৃ. ৮৮।
- ৬৮. বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন ‘সপ্তদশ অারােহী লইয়া বখতিয়ার খিলজি বাঙ্গালা জয় করিয়াছিল, একথা যে বাঙ্গালীতে বিধাস করে, সে কুলাঙ্গার। রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্তব্য ‘অষ্টাদশ অারােহী লইয়া মহম্মদ-ইবখতিয়ারের গৌড় বিজয় কাহিনী বির্বাসযােগ্য বলিয়া বােধ হয় না। গৌড় জয়ের প্রকৃত ঘটনা এখনও অন্ধকারাচ্ছন্ন আছে।…কোন সময়ে কিরূপে গৌড়দেশ মুসলমান বিজেতার হস্তগত হইয়াছিল, তাহা অদ্যাবধি নির্ণীত হয় নাই। (রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রাগুক্ত, পৃ. ২২২-২২৩) অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন মাত্র সতের জন (উনিশ জন) হাতিয়ারধারি লুঠেরা বণিকের বেশে হানা দিয়া এত বড়াে কাণ্ডকারখানা ঘটাইল, ইতিহাসে তাহার দ্বিতীয় দৃষ্টান্ত নাই।” দেখুন-অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রাগুক্ত, পৃ. ৬৯।।
- ৬৯. এ বি এম হাবিবুল্লাহ, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৮।
- ৭০. সুখময় মুখােপাধ্যায়, বাংলায় মুসলিম অধিকারের আদি পর্ব, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৬১-৬২।
- ৭১. তবে অন্য বক্তব্যও রয়েছে। মােহাম্মদ বখতিয়ার খিলজি ভুল করে উদন্তপুরী মহাবিহারকে দুর্গ ভেবে বিহারের বাসিন্দাদের তথা বৌদ্ধভি দের হত্যা করেছিলেন, এ বর্ণনা ‘তবকাত-ই-নাসিরী’তে রয়েছে। বখতিয়ার পরে বৌদ্ধদের সঙ্গে একটা মিটমাট করেছিলেন এবং স্থানীয় বৌদ্ধদের সাথে একটা আপসমূলক সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন। ফলে বৌদ্ধরা বাংলা অভিযানে বখতিয়ারকে সাহায্য করেছিল, এর মধ্যে অস্বাভাবিকতা নেই।
- ৭২. চার্লস স্টুয়ার্ট, হিস্টরি অফ বেঙ্গল, দ্বিতীয় সংস্করণ, ১৯১০, পৃ. ৬১ এডওয়ার্ড টমাস, ক্রনিকলস্ অফ দ্য পাঠান। কিংস অফ দিল্লি, লন্ডন, ১৮৭১, পৃ. ১১০।
- ৭৩. মিনহাজ-ই-সিরাজী তবকাত-ই-নাসিরী, র্যাভার্টি অনূদিত, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫২৪, টীকা হেনরি ব্লকম্যানের বিবৃতি, জার্নাল অফ এশিয়াটিক সােসাইটি অফ বেঙ্গল, ১৮৭৬।
- ৭৪. নীহাররঞ্জন রায়, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪০৯।
- ৭৫. এ এইচ দানি, দ্য ফাস্ট মুসলিম কঙ্কুয়েস্ট অফ লখনুর, ইন্ডিয়ান হিস্টরিক্যাল কোয়ার্টার্লি, খণ্ড-৩০, নং -১, মার্চ ১৯৫৯।
- ৭৬. ইন্ডিয়ান হিস্টরিক্যাল কোয়ার্টার্লি, জুন ১৯৫৪, পৃ. ১৪৫।
- ৭৭. এ বি এম হাবিবুল্লাহ, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৭।
- ৭৮. অতুলচন্দ্র রায়, হিস্টরি অফ বেঙ্গল (তুর্কো-আফগান পিরিয়ড), লালবানি পাবলিশার্স, নিউদিল্লি, ১৯৮৬, পৃ. ১৬/১৭।
- ৭৯. আবদুল করিম, প্রাগুত্ত, পৃ. ৮৮-৯৪।
- ৮০. আবদুল করিম, ডেট অফ বখতিয়ার খিলজিস কঙ্কুয়েস্ট অফ নদিয়া, জার্নাল অফ দ্য এশিয়াটিক সােসাইটি অফ বাংলাদেশ, খণ্ড-২৪-২৬, ঢাকা, ১৯৭৯-৮১, পৃ. ১-১০।
- ৮১. এ এম চৌধুরি, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৫২-৫৮।
- ৮২. পরমেধারীলাল গুপ্ত, দ্য ডেট অফ বখতিয়ার খিলজিস অকুপেসন অফ গৌড়, জার্নাল অফ দ্য বরেন্দ্র রিসার্চ মিউজিয়াম, রাজশাহী, ১৯৭৫-৭৬, পৃ. ২৯-৩৪ অনিরুদ্ধ রায়, মধ্যযুগের বাংলা ১২০০-১৭৬৫, প্রগ্রেসিভ পাবলিশার্স, প্রথম প্রকাশ, কলকাতা, ২০১২, পৃ. ২৭।
- ৮৩. আবদুল করিম, প্রাগুক্ত, জাতীয় সাহিত্য প্রকাশ, পৃ. ৮৪।
- ৮৪. অনিরুদ্ধ রায়, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৮।
- ৮৫. যদুনাথ সরকার সম্পাদিত, হিস্টরি অফ বেঙ্গল, খণ্ড-২, ঢাকা বিধবিদ্যালয়, ঢাকা, ১৯৪৮, পৃ. ১৭।
- ৮৬. এ বি এম হাবিবুল্লাহ, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৯-৫০।
- ৮৭. মিনহাজ-ই-সিরাজী তবকাত-ই-নাসিরি, এ কে এম যাকারিয়া সম্পাদিত, প্রাগুক্ত, পৃ. ২১৫ আরও দেখুন-গােলাম হুসেন সলীম রিয়াজ-উস-সারাতিন, রামপ্রাণ গুপ্ত সম্পাদিত, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫৯। আলি মেচকে জোর করে মুসলমান করা হয়েছিল বলে অভিযােগ করা হয়। আলি মেচকে যে বলপূর্বক ধর্মান্তরিত করা হয়নি, সে বিষয়ে নির্ভরযােগ্য প্রমাণের অভাব নেই। তিব্বত অভিযানে কামরূপ বাহিনীর কাছে বখতিয়ারের পুরাে বাহিনী হারিয়ে। মাত্র ১০০ জন সৈন্য সহ বখতিয়ার যখন আলি মেচের এলাকায় কোনােরকমে প্রাণ নিয়ে পৌঁছেছিলেন, তখন তার সেই চরম দুর্দিনে আলি মেচের লােকেরাই তাকে সব ধরণের সাহায্য করে নিরাপদে দেবকোটে পৌঁছিয়ে দিয়েছিলেন। অথচ তারা ইচ্ছা করলে বখতিয়ারকে হত্যা করতে পারত। এতে ধারণা করা যায়, আলি মেচের ইসলাম গ্রহণের পেছনে আর যাই হােক না কেন, অন্তত কোনাে জোর-জবরদস্তি ছিল না। আর এটাও প্রমাণিত হয় যে, আলি মেচ ও তার দলবলের সঙ্গে বখতিয়ারের একটা আন্তরিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল। জোর করে ধর্মান্তরিতকরণের মাধ্যমে আন্তরিকতাপূর্ণ সম্পর্ক সাধারণত স্থাপিত হতে দেখা যায় না, হওয়াটা কিছুটা অস্বাভাবিকও বটে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, তিব্বত অভিযানকালে একজন অভিজ্ঞ ও বিধস্ত পথপ্রদর্শকের যে প্রয়ােজন ছিল তা অনস্বীকার্য এবং আগে থেকে নির্দিষ্ট করা পথপ্রদর্শক নিযুক্ত না করে শুধু দৈবের উপর ভরসা করে মােহাম্মদ বখতিয়ার এতবড় দুরূহ অভিযানে অগ্রসর হয়েছিলেন, সম্ভাবনার দিক থেকে তা আদৌ গ্রহণযােগ্য বলে বিবেচিত হতে পারে না। এদিক থেকে বিচার করতে গেলেও আলি মেচের সঙ্গে মােহাম্মদ বখতিয়ারের সংযােগ তিব্বত অভিযানের আগেই হবার কথা, অভিযানকালে নয়। অভিযান অগ্রসর হবার আগেই যে মােহাম্মদ বখতিয়ার আলি মেচকে ডেকে পাঠান এবং তাকে পথপ্রদর্শক হিসেবে নিযুক্ত করে অভিযানে অগ্রসর হন, এ ধারণা অধিক যুক্তিসম্মত। আলি মেচের পথ প্রদর্শনে মােহাম্মদ বখতিয়ার মানকোট বা বর্ধনকোটে আগমন করেন।
- ৮৮. তিব্বত অভিযানে সৈন্যসংখ্যা আনুমানিক ১০,০০০ ছিল বলে মিনহাজউদ্দিন উল্লেখ করেছেন। (দেখুন- তবকাত-ই নাসিরী, এ কে এম যাকারিয়া সম্পাদিত, প্রাগুক্ত, পৃ. ২১৫)। ঐতিহাসিক গােলাম হুসেন সলীমের মতে, ১০০০০/১২০০০ সেনা তিব্বত পথে অগ্রসর হয়। দেখুন-গােলাম হুসেন সলীম, রামপ্রাণ গুপ্ত সম্পাদিত, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫৯।
- ৮৯. কোনাে কোনাে পণ্ডিত মনে করেন যে, নেপালের কাঠমান্ডু শহর ও নেপালের পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত ‘বাগমাতাে’ নদীই হচ্ছে মিনহাজ সিরাজী বর্ণিত বাঁকমতি বা বেগমতি নদী। (মিনহাজ সিরাজী তবকাত-ই-নাসিরী, এ কে এম যাকারিয়া সম্পাদিত, প্রাগুক্ত, উপক্রমিকা দ্রষ্টব্য, পৃ. ৭৪) বর্তমানে এই নদীকে করতােয়া বলে অনেকে অভিহিত করেছেন এবং এই করতােয়া নদীই কামরূপ ও বরেন্দ্র রাজ্য দুটির সীমা নির্দেশ করে।
- ৯০. দেখুন- মিনহাজ-ই-সিরাজী তবকাত-ই-নাসিরী, এ কে এম যাকারিয়া অনূদিত ও সম্পাদিত, প্রাগুক্ত, পৃ. ২১৮।
- ৯১. হেনরি ব্লকম্যানের বিবৃতি, জার্নাল অফ এশিয়াটিক সােসাইটি অফ বেঙ্গল, ১৮৭৫, পৃ. ২৮৩। কানাই বড়শী শিলালিপি সম্বন্ধে কিছু আলােচনার প্রয়ােজন আছে। শিলালিপিটি যে জাল এ সম্বন্ধে লিপিবিশারদ রণজিৎ শর্মা যে বিশদ আলােচনা করেছেন তার কিয়দংশ এখানে তুলে ধরা হল। তিনি বলেছেন “..লিপিতাত্ত্বিক বিচারের মানদণ্ডে বহুল আলােচিত এই কানাই বড়শী শিলালিপিকে কোনােমতেই আমরা ১১২৭ শক বা ১২০৫-০৬ খৃস্টাব্দে উৎকীর্ণ বলে মেনে নিতে পারি না। বরং একথা মনে করার যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে যে, প্রাচীন বাংলা লিপি সম্পর্কে কিছুটা অভিজ্ঞ কোনাে ব্যক্তি উদ্দেশ্য প্রণােদিত হয়ে আলােচ্য লিপিখানি অনেক পরবর্তীকালে, সম্ভবত ১৯ শতকের শেষভাগে উৎকীর্ণ করেন। অন্তর লিপির অক্ষর গঠন প্রণালী সেই সাক্ষই দেয়।” এই অভিমতের বিরুদ্ধে অনেক ওজর আপত্তি তুলে প্রয়ােজনে-অপ্রয়ােজনে অনেক কথা বলে শেষ পর্যন্ত সুখময় মুখােপাধ্যায় যা বলেছেন তা তুলে ধরা হল “সত্যের খাতিরে আমরা স্বীকার করছি যে, এই শিলালিপি ১১২৭ শকাব্দে উৎকীর্ণ না হয়ে তার দু’তিনশাে বছর বাদেও উৎকীর্ণ হতে পারে অর্থাৎ ১১২৭ শকের ১৩ চৈত্রে কামরূপ থেকে মুসলমানদের বিতাড়নের কথা ঐ সময়ে কিংবদন্তীর আকারে প্রচলিত ছিল এবং তাই সম্ভবত কোনাে রাজার উদ্যোগে খােদাই করা হয়েছিল। কিন্তু এই তারিখ পরবর্তীকালে আবিষ্কৃত অন্যান্য তথ্য দ্বারা সমর্থিত হচ্ছে।” (বাংলায় মুসলিম অধিকারের আদিপর্ব, পৃ. ২২২)। এ প্রসঙ্গে বক্তব্য এই যে, এই জাল গিরিলিপি ‘দু-তিনশাে বছর বাদেও উৎকীর্ণ হতে পারে’ সুখময়বাবুর এই মন্তব্য সম্বন্ধে আমাদের বিনীত নিবেদন এই যে, এটি যে একটি কৃত্রিম দলিল এটিই তার বড় এবং একমাত্র পরিচয়। সেই কৃত্রিম বস্তুটি কবে, কীভাবে ও কেন আত্মপ্রকাশ করেছিল সে বিষয়ে বাক্য ব্যয় করা অনভিপ্রেত এবং সেই সঙ্গে অসঙ্গত দশটি মিথ্যার আশ্রয় নিলেও আদি মিথ্যাটিকে কোনােমতেই ঢাকা যায় না। কানাই বড়শী গিরিলিপি সম্পর্কে আলােচনা শেষ করার আগে আর একটি কথা বলতে চাই। সুখময়বাবুর অভিমত অনুসারে প্রবল কিংবদন্তী ছিল জাল কানাই বড়শী গিরিলিপি সৃষ্টির পিছনে। তাই বলে বখতিয়ার খিলজির চরম বিপর্যয় এই গিরিলিপির অদূরেই ঘটেছিল সেই অবাস্তব প্রস্তাব মেনে নেওয়া যায় না। বিশাল কামরূপ রাজ্যের অন্য কোথাও সেই বিপর্যয়ের ঘটনা ঘটেছিল এবং গৌহাটির নিকটবর্তী রাজ্যের একটি প্রকৃষ্ট স্থানে উঁচু পাহাড়ের গায়ে এই জাল লিপিটি কোনাে এক সময়ে সৃষ্টি হয়েছিল। এ ছাড়া ওই জাল লিপি সম্বন্ধে আর কিছুই বলা যায় না, বলা সঙ্গত নয়।
- ৯২. মিনহাজ-ই-সিরাজী বলেন, আলি মর্দান খিলজি বখতিয়ারকে হত্যা করেন। দেখুন- মিনহাজ-ই-সিরাজী তবকাত-ই নাসিরী, এ কে এম যাকারিয়া অনূদিত ও সম্পাদিত, প্রাগুক্ত, পৃ. ২১৮-১৯। আরও দেখুন- গােলাম হুসেন সলীম, প্রাগুক্ত, পৃ. ৬০।
- ৯৩. ইটন, দ্য রাইজ অফ ইসলাম অ্যান্ড দ্য বেঙ্গল ফ্রন্টিয়ার ১২০৪-১৭৬০, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, নয়াদিল্লি, ২০০২, পৃ. ৭২, পাদটীকা।
- ৯৪. সামসুদ্দীন আহমেদ, ইক্রিপস অব বেঙ্গল, বরেন্দ্র রিসার্চ মিউজিয়াম, রাজশাহী, ১৯৬০, পৃ. ২০।
- ৯৫. এনামূল হক, পূর্ব পাকিস্তানে ইসলাম, পুনর্মুদ্রণ, ঢাকা, ১৯৮৪, পৃ.১২।
- ৯৬. সুখময় মুখােপাধ্যায়, বাংলার ইতিহাস, প্রাগুক্ত, পৃ. ১১৩-১১৪। ৯৬ক, আধুনিক গবেষকদের অনেকেই মনে করেন যে, নালন্দা মহাবিহারকে আর যাই হােক বিববিদ্যালয় বলে অভিহিত করা যায় না। নালন্দার ইতিহাস বৌদ্ধযুগের শেষ পর্যায়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত। চীনা পর্যটক হিউয়েন সাঙ, ইৎ-সিং, হুই-লি প্রমুখের লিখিত বিবরণ থেকে এর সম্বন্ধে অনেক তথ্য পাওয়া যায়। গুপ্ত ও পাল রাজাদের দরাজ আর্থিক সাহায্য পুষ্ট হয়ে নালন্দায় গড়ে উঠেছিল বৌদ্ধদের এক বিশালায়তন মহাবিহার। এখানে একসঙ্গে বহু বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর (কেউ বলেছেন দশ হাজার, আবার কেউ বলেছেন তিন হাজার) থাকার সুব্যবস্থা ছিল। এখানে একটা বিশাল শিক্ষাকেন্দ্রও গড়ে উঠেছিল, যা প্রায় ৮০০ বছর (পঞ্চম থেকে ত্রয়ােদশ শতক) ধরে সমগ্র এশিয়ায় ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছিল। এখানকার সুবৃহৎ গ্রন্থাগারটিও ছিল বিখ্যাত। এই মহাবিহারে বহু ছাত্র আবাসিক জীবনযাপন করে শিক্ষা লাভ করত। এমন সব তথ্যের ভিত্তিতে নালন্দার শিক্ষায়তনটিকে বিধবিদ্যালয় ভেবে ফেলা হয়েছে। টোল-চতুষ্পঠী জাতীয় বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রাচীন ও মধ্যযুগে ভারতে গড়ে উঠেছিল, একথা সত্যি। মুসলিম বাদশাহদের আমলেও মাদ্রাসা-মক্তব জাতীয় বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়েছিল। কিন্তু আধুনিক স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটির মতাে শিক্ষায়তন প্রাচীন ও মধ্যযুগে শুধু ভারতে কেন ইউরােপেও গড়ে উঠেনি, গড়ে উঠবার মত বাস্তব পরিস্থিতিও তখন পর্যন্ত তৈরি হয়নি। পঞ্চম থেকে ত্রয়ােদশ শতক পর্যন্ত ভারতে স্মৃতিশাস্ত্র অনুমােদিত জাতিভেদ প্রথা যেভাবে জাঁকিয়ে বসেছিল তাতে এমনিতেই সমাজের তিন-চতুর্থাংশ লােকের বিদ্যাশিক্ষার কোনাে অধিকারই ছিল না। ব্রাহ্মণদেরও গরিষ্ঠ অংশ পূজাপাঠ-পৌরহিত্য-জ্যোতিষচর্চা করেই সন্তুষ্ট ছিল। সত্যি কথা বলতে উনিশ শতকের শেষ কিংবা বিশ শতকের গােড়া পর্যন্তও নালন্দা-তক্ষশীলা-বিক্রমপুরের মত প্রাচীন ‘বিশ্ববিদ্যালয়গুলির কথা কারাের মাথাতে আসেনি।
- ৯৭. বি এন মিশ্র, নালন্দা সাের্সেস অ্যান্ড ব্যাক গ্রাউন্ড, খণ্ড-১, বি আর পাবলিশিং কর্পোরেশন, ১৯৯৮, পৃ. ১৬৩।
- ৯৮. বি এন মিশ্র, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৮১।
- ৯৯. নালন্দা উৎখননের ফলে যে বাড়িগুলি আবিষ্কৃত হয়েছে তাতে দশ হাজার ছাত্রের থাকার ব্যবস্থাকে সমর্থন করা যায়। ৬৭০ সালে ইৎ-সিং নামে অপর এক চীনা পরিব্রাজক নালন্দা পরিদর্শন করেন। তার মতে, এখানে তিন হাজার ভি, থাকত। ইৎ-সিং এর বক্তব্যই বেশি সমর্থনযােগ্য ও যুক্তিসম্মত বলে মনে করেন প্রখ্যাত ঐতিহাসিক রামশরণ শর্মা। দেখুন-রামশরণ শর্মা, ভারতের প্রাচীন অতীত, ওরিয়েন্ট ব্ল্যাকসােয়ান, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ, ২০১১, পৃ. ২৬৭।
- ১০০. আর সি মজুমদার, এনসিয়েন্ট ইন্ডিয়া, দিল্লি, ১৯৭৪, পৃ. ৪৫২-৫৪।
- ১০১. যদুনাথ সরকার সম্পাদিত, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩২-৩৩ নীহাররঞ্জন রায়, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪১১।
- ১০২. জি রােয়েরিখ সম্পাদিত, বায়ােগ্রাফি অফ ধর্মস্বামী, কে পি জয়সওয়াল রিসার্চ ইনস্টিটিউট, পাটনা, ১৯৫৯, পৃ. ৬৪, ৯০-৯৩।
- ১০৩. বুদ্ধগয়া গয়া-দৰ্শন রাজগীর নালন্দা পাওয়াপুরী পর্যটক সহায়ক পুস্তিকা, নালন্দা, পৃ. ১৬-১৭ দ্রঃ-আমীর হােসেন, বাঙালীর বিভাজন, অনুষ্টুপ, বিশেষ শীতকালীন সংখ্যা ১৪০৮, কলকাতা। বিশিষ্ট তাত্ত্বিক লেখক ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত নালন্দা মহাবিহার ধ্বংসের জন্য ব্রাহ্মণ্যবাদীদের আক্রমণকে মান্যতা দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, “নালন্দার লাইব্রেরী কয়েকবার বিধ্বস্ত হয়।” P. al. Jor-এর তিব্বতীয় পুস্তকে উল্লিখিত হয়েছে। যে ধর্মসগন্ধ অর্থাৎ নালন্দার বৃহৎ লাইব্রেরী তিনটি মন্দিরে রক্ষিত ছিল। তীর্থিক (ব্রাহ্মণ) ভিক্ষুদের দ্বারা অগ্নিসংযােগে তাহা ধ্বংস করা হয়। মগধের রাজমন্ত্রী কুকুতসিদ্ধ নালন্দায় একটি মন্দির নির্মাণ করেন। সেখানে ধর্মোপদেশ প্রদানকালে জনকতক তরুণ ভিক্ষু দু’জন তীর্থিক ভিক্ষুদের গায়ে নােংরা জল নিক্ষেপ করে। তার ফলে তারা ক্ষুব্ধ হয়ে ‘রত্নসাগর’, ‘রত্নধনুক’ আর নয় তলাযুক্ত ‘রত্নদধি’ নামক তিনটি মন্দির অগ্নিসংযােগে ধ্বংস করে। উক্ত তিনটি মন্দিরেই সমষ্টিগতভাবে ধর্মগ্রন্থ বা গ্রন্থাগার ছিল।” দেখুন-ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত, বাঙ্গলার ইতিহাস, চিরায়ত প্রকাশন, প্রথম পরিমার্জিত সংস্করণ, কলকাতা, ২০১৪, পৃ. ৮৬। আরও দেখুন- P. al. Jor. : History of the Rise, Progress and Downfall of Buddhism in India, Edited by S. Das, P. 92.
- ১০৪. বি এন এস যাদব, সােসাইটি অ্যান্ড কালচার ইন নর্দার্ন ইন্ডিয়া ইন দ্য টুয়েলভথ সেঞ্চুরি, এলাহাবাদ, ১৯৭৩, পৃ. ৩৪৬।
- ১০৫. ডি আর পাতিল, অ্যান্টিকোয়ারিয়ান রিমেই অফ বিহার, পাটনা, ১৯৬৩, পৃ.৩০৪।
- ১০৬. আর এস শর্মা ও কে এম শ্রীমালি, এ কমপ্রিহেসিভ হিস্টরি অফ ইন্ডিয়া, খণ্ড-৪, ভাগ-২ (৯৮৫-১২০৬), অধ্যায় ২৫-খ বৌদ্ধধর্ম, পাদটীকা, পৃ. ৭৯-৮২।
- ১০৭. এইচ হিরাস, দ্য রয়েল পেট্রনস্ অফ দ্য ইউনিভার্সিটি অফ নালন্দা, জার্নাল অফ দ্য বিহার অ্যান্ড উড়িষ্যা রিসার্চ সােসাইটি, পার্ট-১, খণ্ড-১৪, ১৯২৮, পৃ. ৮-৯।
- ১০৮. এস এন সদাশিবন, এ সােস্যাল হিস্টরি অফ ইন্ডিয়া, নিউদিল্লি, ২০০০, পৃ. ২০৯।
- ১০৯. এপিগ্রাফিয়া ইন্ডিকা, খণ্ড-২১, বিপুলশী মিত্রের নালন্দা তাম্রশাসন, পৃ. ৯৭।
- ১১০. এপিগ্রাফিয়া ইন্ডিকা, খণ্ড-২১, বিপুলশী মিত্রের নালন্দা তাম্রশাসনের দ্বিতীয় পংক্তি দ্রষ্টব্য।
- ১১১. নীহাররঞ্জন রায়, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫০৬ ও পৃ. ৪১৯, ৩০২।
- ১১২. উদ্ধৃত-অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রাগুক্ত, পৃ. ৭৬।
- ১১৩. G.H. Damant, Journal of the Asiatic Society of Bengal, 1876, Vol.- XLIII, P. 215.
- ১১৪. যদুনাথ সরকার সম্পাদিত, প্রাগুক্ত, পৃ. ১২-১৩।
‘নবজাগরণ’ অ্যান্ড্রোয়েড অ্যাপ্লিকেশনটি প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর টেলিগ্রাম চ্যানেলে জয়েন হতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর ফেসবুক পেজে লাইক করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।