লিখেছেনঃ ড. অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়
Abstract In accordance with human civilization, ‘Nudity’ in art including all discipline was started in Europe from ancient time throughout history. However, nudity is restricted in most societies of eastern country rather than the West. Both male and female nude depictions were common in antiquity, especially in ancient Greece. Depictions of the naked body have often been used in symbolic scenario, as an extended metaphor for complex and multifaceted concepts. The Roman goddess Venus, whose functions encompassed love, beauty, sex, fertility and prosperity, was being centralized in to many religious festivals in ancient Rome and was venerated under numerous cult titles. The Romans adapted the myths and iconography of her Greek counterpart, Aphrodite, in their art and literature. In Europe, until the 18th century, non-segregated bathing in rivers was the norm. In addition, toplessness and nude swimming, especially for ladies in rivers or lakes was a very popular tradition and these were widely accepted among all social classes. Various portrait of nude female on lake was created and the ‘Lake Poets’ of Europe has made so many poetries at that time. In the early years of the 20th century, a nudist movement began to develop in Germany which was connected to a renewed interest in classical Greek ideas of the human body. Also, in 20th century, France has brought out the new concept of beauty in the view point of Rabindranath Tagore about nudity when he has visited in a French exhibition of Paris. The idea of nudity was totally different in Tagore’s look. In Tagore’s painting and poetry, the ‘Purity of Nudity’ depicted by P.B. Shelley, was being reformed with those parts of Indian philosophical idealism and conceptions which are holding our eastern morality. In addition, the eternal essence of beauty of human body and human mind was being rediscovered by Tagore in his poem in a new pathway.
শস্যদানার মতাে নগ্নতার অনুভব, যার সাথে মিলিয়ে নেওয়া যায় নীল মখমলের মতাে কিউবার রাতকে। রবীন্দ্রনাথ – এর ‘যােগাযােগ’-এর কুমুদিনী আর মধুসূদনের মধ্যেও দেখি প্রেমের সেই আজন্ম চাহিদা অথচ সীমাহীন গভীর প্রেমহীনতাকে। আদিম ইভ, অঁরি রুশাের ছবি কিম্বা আবহমান ভারতীয় কল্পনার সেই নারী যে তার আজানুলম্বিত লম্বা চুলে যতটা সম্ভব খােলা শরীর ঢেকে অপেক্ষারত রয়েছে তার প্রণয়ীর—ভালােবাসার কুসুমের মতাে সমাগত বসন্তের আবির্ভাবের আকাঙ্খায়। তবু জানি, আসলে মৃত্যুপথযাত্রী পৃথুলা হস্তিনীর মতাে গম্ভীর তার সে অপেক্ষা—পুরুষের কাছে, পুরুষেরই অশেষ, পিচ্ছিল ক্ষুধা আর কামনাই যার একমাত্র অন্তিম মূলধন। এর সাথে আবারও মিলিয়ে নিতে অসুবিধা হয় না ‘যােগাযােগ’-এর কুমুকে যে কাপড় বদলে, জামা ছেড়ে ডুরে শাড়ি পড়ে শুতে আসে, তবু তাকে মেনে নিতে হয় পুরুষের প্রেমহীনতার সেই শােচনীয় পরাজয়কে। ভারতীয় নারী যে পুরুষের নগ্নতা আর যৌনতায় প্রার্থিত অথচ প্রেমে বঞ্চিত সেই কবে থেকে? গেইনসবরাের নগ্না নারী যখন আরক্তিম লজ্জায় শিশুকে স্তন্য দেয়, বঙ্কিমের কপালকুন্ডলা যখন আশিরপদনখ। নগ্নতাকে তার গােড়ালি ছোঁয়া কেশজালে আবৃত করে নবকুমারকে প্রশ্ন করে—‘পথিক, তুমি কি পথ হারাইয়াছ?’ তখন থেকে? অথবা ‘সেই ট্রাডিশন সমানে চলছে’-র আদলে নগ্নতার এ ঘেরাটোপ বনফুলের রূপকথায় বিমল দাসের আঁকা ছবির কাঁচুলিবদ্ধ মঞ্জরী কিম্বা রত্নাবলী—কিম্বা তারও সীমানা ছাড়িয়ে সুবােধ ঘােষের ‘ভারত প্রেমকথা’র কুন্তী—সলজ্জতার পাহাড় প্রমাণ অধিবাস নিয়ে যিনি করেজ্জোর তুলির ছোঁয়া লেগে উদ্ভাসিত Danae-এর মতােই বাধ্য হয়ে মিলিত হয়েছিলেন আলাের রেণুর সাথে সেও তাে ছিল একরাশ কামনাই; যা ভীতা, বিহ্বলা—‘ঋষির বর ফলে কি না’ ভাবনায় পরীক্ষাকামিনী, অবিমৃশ্যকারী কুন্তীর সকাতর অনুরােধ “আপনি ফিরে যান সূর্যদেব’-কে ফিরিয়ে দিয়ে নগ্ন সূর্যকণার রেতঃপাতে হয়ে ওঠে চিরায়ত?
শারীর-সংস্থানবিদের চোখে নারী শরীরের সৌন্দর্য তুল্যমূল্য হলেও শিল্পীর চোখে তা চিরকালই এক গভীর বিস্ময়ের সৃষ্টি করেছে। যদিও অতীতের অধিকাংশ ভাস্কর্য, চিত্র কিংবা সাহিত্য শিল্পকলার ইতিহাস এ কথাই বলে যে, নারীদেহের সুষমা অঙ্কনে শিল্পীর চেতনায় যৌনতাই প্রধান বিবেচ্য বিষয় হয়ে ওঠে, সৌন্দর্য নয়। অথচ অনাবৃত দেহ-সুষমার পরিস্ফুটন যথাযথভাবে তুলে ধরার পেছনে প্রকাশ পায় শিল্পীর যে প্রগাঢ় শিল্পবােধ, প্রকাশের আবেগ আর শিল্পসৃষ্টির ব্যঞ্জনা তাকে অস্বীকার করার কোনাে উপায় নেই। বহুকালাবধি শিল্পসৃষ্টির নানাতর ক্ষেত্রে পাশ্চাত্য তথা ইউরােপীয় সংস্কৃতির সঙ্গে এশীয় তথা প্রাচ্য সংস্কৃতির পার্থক্য ও বৈশিষ্ট্যগুলি নব নব রূপে প্রাধান্য লাভ করেছে। ইউরােপীয় রেনেসাঁস শিল্পসৃষ্টির মুক্ত প্রকাশে সহায়ক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল। তাই হয়তাে নগ্নিকা বা ন্যুড ছবির প্রাবল্য প্রাধান্য পেয়েছে প্রাচীন গ্রিস থেকে ইতালি হয়ে আধুনিক ইউরােপের, বিশেষ করে ফ্রান্স, জার্মানি, স্পেন প্রভৃতি একাধিক দেশে। গ্রীক চিত্রাবলীতে দেখা যায়, দেবতার বাম উরুতে উপবেশন করে আছেন পীনস্তনী দেবী, যাঁর খােলা কোমরে দেবতার হাত; কখনাে উভয়ে মুখােমুখি দন্ডায়মান—দেবীর স্তন দেবদুর্লভ ফলের ন্যায় আঁজলায় ধরে আছেন দেবতা। এভাবেই প্রাচীন গ্রীক শিল্পীদের হাতে দেবী ভেনাসের নগ্নমূর্তি মূলত ভাস্কর্যের নানা ভঙ্গিতে শিল্পসৌন্দর্যের অপরূপতার প্রকাশ ঘটিয়েছে। গ্রীক ভাস্কর্যের ধারাবাহিকতা, রােমীয় বা ভেনিসীয় অসাধারণ চিত্রকলা-ইউরােপীয় রেনেসাঁসীয় শিল্পীদের অনুসরণে প্রতিভাবান চিত্রশিল্পীদের হাতে নারীদেহ চিত্রণ নানা অবয়বে আত্মপ্রকাশ করেছে। একসময় ডিমিটারের ডালা থেকে পাকা ফসল লুটে আনতে গ্রীসের কৃষকদের বীজবপন, হালকর্ষণ এবং ফসল আহরণের সময় নগ্ন থাকতে বলা হতাে। এক পর্যায়ে ধর্মীয় অনুশাসন ও রক্ষণশীলতা—শিল্পের এ ধারাকে ব্যাহত করলেও সে বাধা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ইউরােপীয় শৈল্পিক। রেনেসাঁসের সর্বোত্তম বহুমাত্রিক প্রতিভা লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির নগ্ন নারীদেহের সৌন্দর্য চিত্রণে যেমন শিল্পের বন্ধনমুক্তি ঘটেছে, তেমনি তাতে যে মানবিক চেতনার প্রকাশ দেখা যায় তাও এক অনস্বীকার্য সত্য। দ্য ভিঞ্চির আঁকা অসাধারণ শিল্পকর্ম ‘লিডা ও রাজহংস’ পৌরাণিক কাহিনির আড়াল নিয়ে রক্ষণশীলতার বিরুদ্ধে যুক্তির আঘাত হেনেছে। বত্তিচেলির সৃষ্টি সমুদ্রোখিতা নগ্ন ‘ভেনাসের জন্ম’ শীর্ষক শিল্পকর্মটি স্বচ্ছ আবরণ নিয়ে খ্রিস্টীয় সংস্কৃতির রক্ষণশীলতার প্রতি যেন তার শেষ সম্মান জানিয়ে বিদায় নিয়েছে। রক্ষণশীলতার বন্ধন থেকে ক্রমান্বয়ে মুক্ত উনিশ শতকের বন্ধনহীন শিল্পকর্মের ধারাবাহিকতা পরবর্তীকালের ইউরােপীয় শিল্প-সংস্কৃতি চর্চার প্রেরণা বলা যেতে পারে। তত দিনে ইউরােপীয় শিল্পের ভুবন মুক্তচিন্তার প্রকাশে প্রগলভ। তেমনি সাহিত্যেও। প্রমাণ আধুনিক আইরিশ কবি ডব্লিউ. বি. ইয়েটসের ‘লিডা ও রাজহংস’ কবিতাটি। মুক্ত শব্দচিত্রণে মনে হয় তা যেন দ্য ভিঞ্চির আঁকা ছবিটির প্রতিরূপ, উত্তরসূরি। প্রতিভাবান চিত্রশিল্পী বেলিনি ও তাঁর শিষ্যকুল, জর্জন ও টিশিয়ান এ ধারাকে সমৃদ্ধ করেছেন। তাঁদের হাতে নানা ভঙ্গির ভেনাস ন্যুড শিল্পের প্রতীক হিসেবে পরবর্তী যুগের শিল্পীদের জন্য প্রেরণার উৎস হয়ে ওঠে। জীবনাচরণের নানা উপলক্ষ নিয়ে এ ধারার বিকাশ। যেমন বেলিনির ধারাবাহিকতায় নারীদেহের শিল্পসম্মত সৌন্দর্যের প্রকাশ পায় নারীর স্নানদৃশ্যে, কখনাে মুক্ত আকাশতলে উল্লসিত স্নানলীলায়। প্রসঙ্গত, স্মরণযােগ্য বাঙালি কবি রবীন্দ্রনাথের ‘বিজয়িনী’ কবিতায় প্রতীকে হলেও নগ্ন নারীর স্নানলীলার সৌন্দর্যময় শাব্দিক দৃশ্যচিত্রটি।
শিল্পসৃষ্টির ধারায় নারীদেহের সৌন্দর্য সুষমাকে চিত্রে-ভাস্কর্যে ফুটিয়ে তুলতে পূর্বসূরিদের থেকে ভিন্ন এবং নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে প্রতিভার ব্যবহার করেছেন ইউরােপে, বিশেষ করে ফ্রান্সের ইমপ্রেশনিস্ট ঘরানার চিত্রশিল্পীরা। বাদ যাননি স্পেনীয় শিল্পী যথা, পল রুবেন্স ও তাঁর উত্তরসূরিদের কেউ কেউ। দেব-দেবীর বদলে তাদের চিত্রকল্পে তখন সমাজজীবনের বাস্তবতাই একমাত্র পরিপ্রেক্ষিত হয়ে ওঠে। ১৮১৮ সালের ১৫ই ডিসেম্বর রুশ সাহিত্যিক ও চিত্রকর আলেকজান্দ্রা পৃশকিন ‘Le Baiser’ নামে আঁকেন নারী-পুরুষের এক যুম ছবি যেখানে নর-নারীর ঘনিষ্ট অনুভব এক গভীর জীবনানুভবেরই সামিল। তাঁর আঁকা ‘Portrait of Calypso’ নামের Portrait টি ১৮২১ সালে আঁকা। Daughter of a wealthy Chsinau Baron নামে চিহ্নিত এই ছবিটি যাকে মেলানাে যায় ‘If a delicate beauty was devoted to her’ নামে তাঁর লেখা একটি কবিতার সাথে। রবীন্দ্রনাথের মতােই নােটবুকে কবিতার আঁকিবুকি আর কাটাকুটি করা শব্দের মাঝে ছবি (Doodles) এঁকেছেন পুশকিনও। নারী ও পুরুষের বেশ কয়েকটি মুখাবয়বের ছবি পাৰ্শ্বিক। Anna Alexevyena Olenina- নামের নারীটিকে ভালােবাসতেন কবি, কিন্তু তাঁর আঁকা An n a -র Portrait টির মুখাবয়বটিও পার্শ্বিক ভাবে আঁকা আর সেখানে রাশি রাশি কালাে চুল এসে চোখ পর্যন্ত ঢেকে দিয়েছে। Anna-র মুখমন্ডলের প্রায় সবটাই। অঙ্কনের এই স্টাইলটি রবীন্দ্রনাথের আঁকা নারীমূর্তির ছবিগুলির সাথে বেশ মিলে যায়। Ring of Vorontsova’ নামের ছবিটিও Doodles জাতীয়। সারা জীবনে অসংখ্য নারীর প্রতিকৃতি অঙ্কন করেছেন পুশকিন। তাঁদের কয়েকজন নারী হলেন E. Raevskaya, 0.A. SmirnovaRosset, E. M. Hitrovo, Anna Kern, N.N. Goncharova, E.K. Vorontsova 91731 Cicas জীবনে যেমন জ্যোতিরিন্দ্র পত্নী কাদম্বরী দেবী ছিলেন অনুপ্রেরণা তেমনি পুশকিনের আঁকা ছবির নারীদেরও কেউ কেউ প্রেরণাদাত্রী হয়ে তাঁর কাব্য শক্তিকে ফলবতী করে তুলেছিল। প্রাত্যহিক জীবনের স্থিরচিত্র আঁকতে গিয়ে রমণীয় সৌন্দর্যকে উপজীব্য করে তােলেন বেশ কিছু ফরাসী চিত্রশিল্পীও। মহানগরী পারি এ জন্য কিছুটা হলেও অনুকূল ও মুক্ত পরিবেশ তৈরি করেছিল। কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে রক্ষণশীলতার টানও কিছুটা প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু সে বাধা মানেননি বেপরােয়া ফরাসি চিত্রশিল্পীদের অনেকেই। তাঁরা পূর্ব ঐতিহ্যের জের ধরে নারীদেহের নডচিত্র অঙ্কনে জীবনের প্রাত্যহিকতাকে নানাভাবে কাজে লাগিয়েছেন। এদিক থেকে রেনােয়া হয়তাে বা এক পা এগিয়ে তাঁর স্নানবিলাসী নারীচিত্র সিরিজের ছবিগুলাের জন্য। এগুলাের একেকটি ভিন্ন ভিন্ন ভঙ্গিতে, ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে ও তাৎপর্যে আঁকা। যে জন্য ছবিগুলি শিল্পবােদ্ধা সমাজে আধুনিক চিত্রকলার বিশেষ রূপ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। একইভাবে এডওয়ার্ড মানে, দেগা ও সেজানের নড ছবিগুলিকে পাশ্চাত্যের উল্লেখযােগ্য চিত্রকর্ম হিসেবে মূল্যায়িত করা হয়েছে। এরা সকলেই যেমন রমণীর স্নানদৃশ্যকে নিজস্ব চেতনার আঙ্গিকে প্রকাশ করেছেন, তেমনই গাছগাছালি ঘেরা পার্কের প্রাকৃত পরিবেশকেও কাজে লাগিয়েছেন। আবার কখনাে মুক্ত জল-পরিবেশ বা সাগরের বেলাভূমিতে একই প্রকার দৃশ্যের অবতারণা করেছেন। এডওয়ার্ড মানের ‘অলিম্পিয়া’ নামীয় ন্যুডচিত্রটি ফরাসি চিত্রবােদ্ধা সমাজে রীতিমতাে আলােড়ন তুলেছিল। এ ছাড়াও খ্যাতি অর্জন করেছিল পার্কের নয়নাভিরাম পরিবেশে তাঁর ন্যড চিত্রকর্ম ‘লাঞ্চ অন্য দ্য গ্রাস’, যেখানে ‘লাঞ্চ’ নয়, রমণীর শােভন দেহরূপটিই প্রাধান্য লাভ করেছে। খােদ পাশ্চাত্যের কবি রাঁবাের চিত্রেও দেখি এই নগ্নতার প্রতিবিম্ব। Arthur Rimbaud Haselmann Jr.-এর Drawing Art (Eternity,1994)-এ শিল্পীর চোখে পল ভেরলেনের বাগানে ফরাসী কবি জাঁ আর্তুর রাঁবােকে কবিখেয়ালে সম্পূর্ণ নগ্নদেহে সকালের রৌদ্র পােহাতে দেখা যায়।
পাশ্চাত্যের তুলনায় প্রাচ্যের রক্ষণশীলতা অবিসংবাদী। বিশেষ করে ভারতীয় উপমহাদেশের সমাজবিচারে। কিন্তু কখনাে কখনাে শিল্পকলার দিক থেকে প্রাচীন ভারতও পাশ্চাত্যের ন্যায় রক্ষণশীলতাকে গণ্য করেনি। প্রাচীন হিন্দু দেব-দেবী অথবা পৌরাণিক মানবীর নগ্নমূর্তি প্রাচীন ভারতীয় শিল্পকলার মধ্যে এক দেশজ ঐতিহ্যের সূচণা করেছে সত্য, কিন্তু শিল্পকর্মে এ ধারণাই যে শেষ কথা নয়, তার প্রমাণ—কোনারক, অজন্তা, বিশেষ করে খাজুরাহাের নগ্ন চিত্রগুলাে। এমনকি বঙ্গীয় মৃত্তিকাচিত্রেও নগ্নিকাদের উপস্থিতি কম চিত্তাকর্ষক নয়। খাজুরাহাের আদি মানবী পেরিয়ে শবরীচিত্রও প্রায় একই কথা বলে। এগুলাে এ দেশীয় নডচিত্রের ভিন্ন আর এক ধরন। আরাে অনেক পরে, বিশ শতকের বাংলায় নারীদেহের সৌন্দর্য-সুষমাকে ভারতীয় চিত্রশিল্পীরা বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেছেন ও অকুণ্ঠভাবে তা প্রকাশও করেছেন। প্রথমদিকে সেখানেও যৌনতা প্রধান বিষয় হয়ে ওঠে নি। যামিনী রায়, সুরেন্দ্রনাথ কর কিম্বা নন্দলাল বসুরা তাঁদের চিত্রের নারীদেহরূপ অঙ্কনে প্রাচ্য ঐশীচেতনার ঐতিহ্যকে সমাজজীবনের বাস্তবতায় নামিয়ে এনেছেন। তাই পাশ্চাত্যের ভেনাস নয়, পুরাণের ঐতিহ্য থেকে শুরু করে গ্রাম্য আটপৌরে পটুয়া শিল্প পর্যন্ত বাঙালীর পারিবারিক তথা গার্হস্থ্যজীবনের নিটোল সম্পর্কগুলিকেই তাঁদের আঁকা চিত্রে তাঁরা এক মেলবন্ধন দেবার চেষ্টা করেছেন। ক্রমে আধুনিক ভারতীয় চিত্র তথা শিল্পকলায় নাগরিক জীবনের নারীরাই শিল্পীদের শৈল্পিক চেতনায় বেশী প্রাধান্য লাভ করেছে। আরাে পরে, একবিংশ শতকে ফিদা মকবুল হােসেন প্রমুখের ছবিতে সৌন্দর্য চেতনায় যৌনতা আলাদাভাবে তার স্থান করে নেয়। সেইসঙ্গে কোলরিজের ‘বায়ােগ্রাফিয়া লিটারিয়া’-য় ‘Concordia Discordance, Unity in Diversity’-এর তাত্ত্বিকতার আভাস ফুটে উঠছে আজকের বাংলা কবিতার নগ্নতার অনুসন্ধানে, যেখানে মুহম্মদ নুরুল হুদার ‘তরঙ্গের তরবারি’-র মতাে কবিতার পরতে পরতে পরাবাস্তব আচরণের কাব্যানুভবে বিরােধের আকাঙ্খ মিলনেরই পূর্বলক্ষণ হয়ে উঠেছে। আর একেবারে হালের ওপার বাংলার কবি আল মাহমুদ তাঁর ‘সােনালী কাবিন’ কাব্যে শব্দ প্রতীক ও উপমার মাধ্যমে আদিমতাকে অপুর্ব চিত্রায়নে আদি থেকে অন্ত পর্যন্ত চিরন্তন রােমান্টিক ধারায় প্রােজ্জ্বল করেছেন এইভাবেঃ
‘তারপর তুলতে চাও কামের প্রসঙ্গ যদি নারী
খেতের আড়ালে এসে নগ্ন করাে যৌবন জরদ
শস্যের সপক্ষে থেকে যতটুকু অনুরাগ পারি
তারাে বেশী ঢেলে দেবাে আন্তরিক রতির দরদ। (সনেট ১০)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিত্রাঙ্কন বিষয়টি যে তাঁর স্বভাব-সৃজনের অন্যান্য দিকগুলির সঙ্গে আপাতভাবে মেলে না তা তাঁর কবিতা ও চিত্রগুলিকে পাশাপাশি রাখলেই আমরা দেখতে পাই। এটি যে তাঁর ভেতরের কোনাে বিরুদ্ধতার ‘বিষম দৌরাত্ম’ থেকেই উদ্ভূত সেটিও অনেক রবীন্দ্রভক্ত সমালােচকই শেষমেষ স্বীকার করে নিয়েছেন। কম করে দেখলেও রবীন্দ্রনাথের আঁকা চিত্রের সংখ্যা নেহাৎ কম নয়। চার খণ্ডের রবীন্দ্র চিত্রাবলীতে চিত্রের অনুলিপি রয়েছে দু হাজার তেষট্টিটি৷ দু-চারটি বাদে এর সব ছবি আঁকা হয়েছে ১৯২৪ থেকে তাঁর মৃত্যুর বছর ১৯৪১-এর মধ্যে। অর্থাৎ মাত্র ১৮ বছরে, তা-ও জীবনের একেবারে শেষ প্রান্তে। এর অর্থ দাঁড়ায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নামের অবিরল সৃজনশীল একজন মানুষ চিত্র রচনার মতাে ভিন্নধর্মী মাধ্যমে যখন কাজ করেন, তখনাে সেখানে সৃষ্টির প্রবল স্রোত একই মত্ততায় উদগীর্ণ হতে থাকে। প্রতিলিপিগুলাে দেখতে দেখতে এর লক্ষণ প্রতিভাত হয়ে ওঠে, যাকে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর অতুলনীয় ভাষাভঙ্গিতে বলেছেন ‘ভল্কানিক ইরাপশন’। আমরা লক্ষ্য করি, কবিতার মতােই, একই দিনে সৃষ্ট তাঁর ছবির সংখ্যা কখনাে কখনাে ষােলােসতেরাে ছাড়িয়ে যায়। মূলতঃ অসুন্দর, অবাস্তব, কুৎসিত, আদিম, জান্তব চেতনার জগৎ—যাকে রবীন্দ্রনাথ তাঁর লেখনীতে ধারণ করতে পারেননি, তারা রূপ পেয়েছে তাঁর ছবিতে। রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিসম্ভারের মাত্র দু’শতিন’শ প্রতিলিপি দেখলেও—তাঁর চিত্রকলা বিষয়ে লেখালিখির পরিমাণও নেহাত কম নয়। এর মধ্যে দেশিবিদেশি শিল্পী ও সমালােচকেরাও রয়েছেন।
নগ্নতা বিষয়ে ঠাকুরবাড়ীর অন্দরমহল থেকে প্রথম সােচ্চার হন হয়তাে বা বলে রবীন্দ্রনাথই। ঠাকুরবাড়ীর পত্রিকা ‘ভারতী’ ও ‘বালক’-এ প্রকাশিত হয় (পৌষ, ১২৯৬) বলেন্দ্রনাথের কয়েকটি লেখা, যার একটির নাম ‘নগ্নতার সৌন্দর্য’ যাতে তিনি শিল্পকলায় নগ্নতার সৌন্দর্য বর্ণনা করে লেখেনঃ
“দূর হইতে সৌন্দর্যের নগ্নতা দেখিয়া তাহাকে অনেক সময় সম্পূর্ণ আয়ত্তে মনে হয়, কিন্তু সন্নিকটে তাহার মধ্যে সহস্র এমন রহস্য বিকশিত হইয়া উঠে যে, নগ্নতার লাবণ্যে হৃদয় হারাইয়া যায়। নগ্নতার চতুর্দিকে একটা দীপ্ত লাবণ্য আচ্ছন্ন করিয়া থাকে, নগ্নতার সৌন্দর্যে প্রাণ সম্যক প্রস্ফুটিত, নগ্নতায় আত্মা পরিব্যাপ্ত। আচ্ছাদনে প্রাণের রহস্য উপভােগ করা যায়না, হৃদয় সৌন্দর্যে উথলিয়া উঠেনা, কেবল একটা আনন্দবিহীন জড় দেহ জাগিয়া থাকে মাত্র। নগ্নতায় গভীরতা আছে, আনন্দ আছে, সেখানে শ্রী কলায় কলায়। অলঙ্কার-আবরণ চক্ষু আকর্ষণ করে, নগ্নতা হৃদয় টানিয়া আনে। নগ্নতার মধ্যে স্বভাবের স্ফুর্তি হয়, এই জন্যই তাহার সৌন্দর্য কূলে কূলে। নগ্নতা সৌন্দর্যের কনক-মিলন। নগ্নতা পূর্ণ সুন্দরী।”
বলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরেরই আরেকটি উক্তিতে ‘নগ্নতা’ ও ‘যৌনতা’-র পারস্পরিক প্রভেদটি খুব সুন্দরভাবে চোখে পড়ে। সাধনা’-র ফাল্গুন (১৩০৪) সংখ্যায় ‘জয়দেব’ শীর্ষক প্রবন্ধে এই পার্থক্যটি খুব স্পষ্টভাবে ধরিয়ে দিতেই যেন বলেন্দ্রনাথ লেখেনঃ
“মানবের শরীরও হেয় নহে, উলঙ্গতাও অপবিত্র নহে। উলঙ্গ যােগীকে দেখিয়া কেহ ত সঙ্কোচ অনুভব করে না। বরঞ্চ নগ্ন দেহই পুণ্যদর্শন বলিয়া গণ্য হয়। উলঙ্গ শিশু কাহারও চক্ষে অপবিত্র নহে। এবং বন্য মানবের উলঙ্গতাও অশােভন বলিয়া গণ্য হয়। কারণ আর কিছুই নহে, ইহার মধ্যে কোনরূপ ঠার নাই ইঙ্গিত ইশারা, নাই, নাগরিকতা নাই।
গ্রীসীয় নগ্ন প্রস্তরমূৰ্ত্তি দেখিয়া কেহ ত অশ্লীল বলে না। প্রকৃতির অন্তর হইতে সেই নগ্ন গঠন যেন স্বভাবতই অভিব্যক্ত হইয়াছে। তাহার আবরণ নিষ্প্রয়ােজন। আবরণের কথা সেখানে মনেই আসে না। কিন্তু এই গ্রীসীয় প্রস্তরমূৰ্ত্তির পার্শ্বে ফরাসী চিত্রশালার একখানি নগ্নদেহ চিত্র স্থাপন কর, সে কুষ্ঠিত সম্রম নাই। ফরাসী চিত্রকর ঐ নারীমূর্তির সৰ্বাঙ্গ হইতে বসন স্থালিত করিয়া দিয়া পায়ে হয়ত জুতা রাখিয়াছেন, কিম্বা এমন করিয়া এমন কিছু রাখিয়াছেন, যাহাতে এই বর্তমান শতাব্দীর বসনভূষণের একটা ভাব মনে করাইয়া দেয় এবং এই বিবসনতার মধ্যে একটি সচেতন উদ্দেশ্য নির্দেশ করে।”
রবীন্দ্র চিত্রমালার উন্মােচন তাঁর নগ্নিকা ভাবনার কিছু স্বল্পলােচিত দিক নিয়ে গবেষণার অবকাশ করে দিয়েছে। তার একটি হলাে, তাঁর কিছু ছবিতে নগ্ন নারী ও পুরুষের প্রায় খােলামেলা রূপায়ণ—যাকে কেউ কেউ শিল্পীর অবদমিত যৌনবােধের প্রতিফলন বা অবদমিত বাসনার বহিঃপ্রকাশ বলতে চেয়েছেন। তাঁরা হয়তাে ভুলে যান যে রবীন্দ্রনাথের কবিতায় একেবারে তরুণ বয়স থেকেই নারীর শরীর ও অঙ্গ নিয়ে বেশ খােলামেলা উচ্ছ্বাস দেখা যায়। এটি প্রায় স্তুতিতে পরিণত হয়েছে ইউরােপ ভ্রমণকালে জাদুঘরে দেখা বিভিন্ন শিল্পীর আঁকা নগ্নিকা দেখার পর তাঁর ‘ইউরােপ-যাত্রীর ডায়েরী’তে। তবে নগ্ন পুরুষ শরীর বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের প্রশংসাসূচক মন্তব্য দেখা যায় ১৯১৬ সালে ‘জাপান যাত্রী’ লেখার একটি বর্ণনায় যেমনটি তাঁর অন্য লেখায় আর কখনাে দেখা যায়নি। ডব্লিউ জি আর্চার, শিবনারায়ণ রায়, সুশােভন অধিকারী প্রমুখ এ বিষয়ে লিখেছেন। তবে বেশির ভাগ নারী-পুরুষের ছবিতেই যৌনাঙ্গ ঢাকা বা অস্পষ্টতায় আবৃত হলেও রবীন্দ্রনাথের একটি নগ্ন পুরুষমূর্তির ছবিতে পুরুষাঙ্গ স্পষ্টভাবে প্রতিভাত, এর কোনাে ব্যাখ্যা হয়তাে এখনাে প্রকাশের অপেক্ষায়। অন্যদিকে তাঁর আঁকা নগ্ন নারীদেহের বহু আলােচিত আবক্ষ চিত্রটির (অ্যান্ড্রু রবিনসন অ্যালবাম, চিত্রসংখ্যা ১৪) উদ্ধৃত স্তনযুগল চড়া রঙের আড়ালে মুখ লুকায়। প্রধান হয়ে ওঠে তার উজ্জ্বল চাহনি। একইভাবে নৃত্য ভঙ্গিমায়। অর্ধনগ্ন নারীচিত্রে সুডৌল স্তনের আভাসটুকুই ফোটে, নিম্নাঙ্গ ঘাঘরায় ঢাকা থাকে। রবীন্দ্রনাথের অর্ধনগ্ন নারীচিত্রগুলাে এভাবেই পাশ্চাত্য নগ্নতার বিপরীতে তার আপন বৈশিষ্ট্যটিকে তুলে ধরেছে।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবদ্দশায় মােট বারাে বার বিশ্বভ্রমণে বেরিয়েছিলেন। ১৮৭৮ থেকে ১৯৩২ সালের মধ্যে পাঁচটি মহাদেশের ত্রিশটিরও বেশি দেশ ভ্রমণ করেন তিনি। প্রথম জীবনে দুই বার (১৮৭৮ ও ১৮৯০ সালে) তিনি ইংল্যান্ডে গিয়েছিলেন। ১৯১২ সালে ব্যক্তিগত চিকিৎসার জন্য তৃতীয়বার ইংল্যান্ডে গিয়ে ইয়েটস প্রমুখ কয়েকজন ইংরেজ কবি ও বুদ্ধিজীবীদের কাছে সদ্যরচিত গীতাঞ্জলি কাব্যের ইংরেজি অনুবাদ পাঠ করে শােনান। কবিতাগুলি শুনে তাঁরা মুগ্ধ হয়েছিলেন। ইয়েটস স্বয়ং উক্ত কাব্যের ইংরেজি অনুবাদের ভূমিকাটি লিখে দিয়েছিলেন। এই ভ্রমণের সময়েই চার্লস ফ্রিয়ার অ্যান্ড্রুজের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরিচয় ঘটে। ১৯১৩ সালে সুইডিশ অ্যাকাডেমি তাঁকে নােবেল পুরস্কারে সম্মানিত করে। ১৯১৬-১৭ সালে জাপান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ১৯২০-২১ সাল নাগাদ আবার ইউরােপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফরে যান কবি। এই সফরের সময় পাশ্চাত্য দেশগুলিতে তিনি সংবর্ধিত হয়েছিলেন। ১৯২৪ সালে তিনি যান চীন সফরে। এরপর চীন থেকে জাপানে গিয়ে সেখানেও জাতীয়তাবাদবিরােধী বক্তৃতা দেন কবি। জীবনের একেবারে শেষপর্বে এসে পারস্য, ইরাক ও সিংহল ভ্রমণের সমযও মানুষের পারস্পরিক ভেদাভেদ ও জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে তাঁর বিতৃষ্ণা আরও তীব্র হয়েছিল মাত্র। ১৯২৪ সালের শেষের দিকে পেরু সরকারের আমন্ত্রণে সেদেশে যাওয়ার পথে আর্জেন্টিনায় অসুস্থ হয়ে কবি ভিক্টোরিয়া ওকাম্পাের আতিথ্যে তিন মাস কাটান। স্বাস্থ্যের কারণে পেরু ভ্রমণ তিনি স্থগিত করে দেন। পরে পেরু ও মেক্সিকো উভয় দেশের সরকারই বিশ্বভারতীকে এক লক্ষ মার্কিন ডলার অর্থসাহায্য করেছিল। ১৯২৬ সালে বেনিতাে মুসােলিনির আমন্ত্রণে ইতালি সফরে যান কবি। মুসােলিনির আতিথেয়তায় মুগ্ধ কবি এরপর গ্রিস, তুরস্ক ও মিশর পরিভ্রমণ করে ভারতে ফিরে আসেন। ব্যাপক বিশ্বভ্রমণের ফলে রবীন্দ্রনাথ তাঁর সমসাময়িক অরি বের্গসঁ, আলবার্ট আইনস্টাইন, রবার্ট ফ্রস্ট, টমাস মান, জর্জ বার্নার্ড শ, এইচ জি ওয়েলস, রােম্যাঁ রােলাঁ প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযােগ পেয়েছিলেন।
উপনিষদবাদী রবীন্দ্রনাথ একদা প্যারিসের লুভ্যর চিত্রশালায় ন্যুড চিত্রের বিস্ময়কর সৌন্দর্যদর্শনে অভিভূত হয়ে ভেবেছিলেন, এ সৌন্দর্য এমনই দেহাতীত যে নিজের কন্যাকে সঙ্গে নিয়েও এর নান্দনিক সৌন্দর্যের আনন্দ ভাগ করে নেওয়া যায়। কারাে ডুরার আঁকা সেই নগ্নিকার ছবি দেখে অসম্ভব উচ্ছ্বসিত রবীন্দ্রনাথ বলেনঃ
“সেদিন ফ্রেঞ্চ একজিবিশনে একজন বিখ্যাত আর্টিস্ট রচিত একটি উলঙ্গ সুন্দরীর ছবি দেখলুম। কী আশ্চর্য সুন্দর! দেখে কিছুতেই তৃপ্তি হয়না। সুন্দর শরীরের চেয়ে সৌন্দর্য পৃথিবীতে কিছু নেই—কিন্তু আমরা ফুল দেখি, লতা দেখি, পাখি দেখি, আর পৃথিবীর সর্বপ্রধান সৌন্দর্য থেকে একেবারে বঞ্চিত। মর্ত্যের চরম সৌন্দর্যের উপর মানুষ স্বহস্তে একটা চির অন্তরাল টেনে দিয়েছে। কিন্তু সেই উলঙ্গ ছবি দেখে যার তিলমাত্র লজ্জা বােধ হয় আমি তাকে সহস্র ধিক্কার দিই। আমি তাে সুতীব্র সৌন্দর্য-আনন্দে অভিভূত হয়ে গিয়েছিলাম, আর ইচ্ছে করছিল আমার সকলকে নিয়ে দাঁড়িয়ে এই ছবি উপভােগ করি। বেলি যদি বড় হত তাকে পাশে নিয়ে দাঁড়িয়ে আমি এ ছবি দেখতে পারতুম। এ রকম উলঙ্গতা কী সুন্দর!” (য়ুরােপযাত্রীর ডায়েরী, ১৮৯০)।
পাশ্চাত্যের নগ্ন নারীদেহরূপ প্রদর্শন চিত্রশালায় যৌনতার পরিবর্তে সৌন্দর্যের নান্দনিক রূপই এখানে উপজীব্য বা উপভােগ্য বিষয় হয়ে উঠেছে কবির শিল্পসুষমার বিচারে। শ্লীলতা-অশ্লীলতার বিষয়টি সেখানে অপ্রাসঙ্গিক। তখনকার কবি ‘নিবাও বাসনাবহ্নি নয়নের নীরে’ জাতীয় কথা বলে দেহ-নিবৃত্ত হতে চাননি। তবু বলবাে, রবীন্দ্রনাথ তাঁর নিজের চিত্রকর্মে পাশ্চাত্যের এই ন্যুড ধারাটিকে পুরােপুরি অনুসরণ করেননি। রবীন্দ্রনাথ যে নগ্ন নারীদেহ চিত্রগুলি এঁকেছেন, সেগুলিকে পশ্চিমা ন্যুডচিত্রের বিচারে ঠিক ন্যুড ছবি বলা চলে না। বড় জোর তাকে ‘অর্ধ-নুড’ বলা যেতে পারে। অথচ রবীন্দ্রনাথের চিত্রশিল্পকর্মে পশ্চিমা শিল্প এক বড়াে অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। কাব্য ক্ষেত্রে তাঁর নিজস্বতা বা স্বতন্ত্রতা থাকলেও তাঁর চিত্রশিল্পের ক্ষেত্রে এমন কথা বলা যায় না। সেখানে পাশ্চাত্য প্রভাব বড়াে কম নয়। কিন্তু এমনটা কেন? রবীন্দ্রনাথ একসময় তাঁর ‘পশ্চিম যাত্রার ডায়েরি’ তে বলেছিলেনঃ “আর্টের সাধনা কি? আর্টের একটা বাইরের দিক হচ্ছে আঙ্গিক, টেকনিক- তার কথা বলতে পারি নে। কিন্তু ভেতরের কথা জানি। সেখানে জায়গা পেতে চাও যদি তাহলে সমস্ত সত্তা দিয়ে দেখাে।…..দেখতে পাওয়া মানে প্রকাশকে পাওয়া। বিশ্বের প্রকাশকে মন দিয়ে গ্রহণ করাই হলাে আর্টের সাধনা।” অর্থাৎ আমাদের চোখ দিয়ে আমরা যা দেখি তাকে কোন ভাবনার আঙ্গিকে প্রকাশ করতে পারব সেইটাই হলাে আর্টের মূল কথা আর আর্টিস্টের মূল সাধনা। আর্ট বা শিল্প হলাে আমাদের মনেরই বহিঃপ্রকাশ। ভারতীয় চিত্রকলার তৎকালীন প্রেক্ষাপটে কবির এই অনুভব ছিল বিশিষ্ট। বহুকাল ধরে ভারতীয় চিত্রকলা ছিল বর্ণনাত্নক। চিত্রে ধর্মীয়, পৌরাণিক অথবা ঐতিহাসিক আখ্যানের প্রাধান্য বা বর্ননাই ছিল চিত্রকলার প্রধান কাজ। চিত্রকলা ছিল ইলাস্ট্রেশন ধর্মী। তার স্বাধীনতা ধর্ম, পুরাণ বা ইতিহাসের কাছে যেন বন্ধক রাখা ছিল। তৎকালীন ইউরােপীয় শিল্পীরা, যারা চিত্রকলা চর্চায় পারদর্শী ছিলেন তাদের ক্ষেত্রেও এ বন্ধন দশা ঘােচেনি বরং সামান্য রঙ বদল ঘটেছিল মাত্র। সে অর্থে রবীন্দ্রনাথ ভারতীয় চিত্রকলায় এক নবরূপ প্রদান করেছিলেন যেখানে তাঁর অন্যান্য রচনার মতােই মানুষ ও মানবতা এক বড়াে স্থান অধিকার করেছিল। তাঁর অবচেতন শিল্পচিন্তায় কি দৈহিক সৌন্দর্যের তুলনায় অধ্যাত্ম সৌন্দর্যের বােধ অধিকতর শক্তিমান ছিল? হয়তাে তাই। ১৯২৬-২৭ সালে, তাঁর চিত্ররচনার প্রাবল্যের মধ্যে, রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন,
‘আমার আপনার মধ্যে এই নানা বিরুদ্ধতার বিষম দৌরাত্ম আছে বলেই আমার ভিতরে মুক্তির জন্যে এমন নিরন্তর এবং এমন প্রবল কান্না”। (‘পথে ও পথের প্রান্তে’, ১ বৈশাখ, ১৩৩৪)।
তাঁর মানসপ্রবণতাই ছিল দৈহিক নগ্নতার স্থানে ঐশী সৌন্দর্যকে স্থাপন করা। যে জন্য নারীদেহের নগ্ন রূপচিত্রণে তাঁর আগ্রহ ছিল কম এবং সে জন্যই তিনি তাঁর আঁকা আধাে-আলাে, আধাে-অন্ধকারময় নগ্নিকাচিত্রে নারীদেহের কান্তি আর অঙ্গ সৌষ্ঠবের প্রকাশকে গাঢ় রঙের ব্যবহারে ক্রমেই অস্পষ্ট আর রহস্যময় করে তুলেছেন। তাঁর আঁকা চমকপ্রদ রমণীয় দেহচিত্রে নগ্নতার আধাে প্রকাশই ঘটে, কালাে রঙের টানে তা যেন অনেকটাই ঢাকা পড়ে যায় (ললিতকলা একাডেমি সংকলন, ২৭ সংখ্যক চিত্র)। পরিবর্তে তিনি নারীর দেহভঙ্গিমা ও মুখাবয়ব অঙ্কনে যত্ন ও মনােযােগী হয়েছেন অনেক বেশি। সামান্য কিছু নারী মুখাবয়বের ছবিতে অদ্ভুত সৌন্দর্য ও আনন্দানুভূতির চিহ্নও রয়েছে। ছবি গুলি বেশীর ভাগই কালিতে অথবা জল রঙে আঁকা। নারী ও পুরুষের যুগ্ন ছবিও আছে। এ ছবিতে তাদের দৃষ্টি স্থির, সম্মুখবর্তী, মূর্তিবৎ এবং কিছুটা বা ভাবলেশহীন। ছবির মুখ গুলি ছায়ার আড়ালে থাকায় আড়ষ্ট। কিন্তু তারা যেন ঐ ছায়ার আড়াল থেকে বেরিয়ে কিছু বলতে চায়। চিত্রশিল্পে আগ্রহী রবীন্দ্রনাথ যে ন্যড শিল্পকর্মের শৈল্পিক সৌন্দর্য উপভােগ করেছেন অথবা তা উপভােগ্য বলে বিবেচনা করেছেন, তেমন প্রমাণের অভাব নেই। তা সত্ত্বেও প্রশ্ন ওঠে, জীবনের শেষ দশকে পৌঁছে চিত্রকলাকে যখন তিনি ‘নবীনা প্রেয়সী’ হিসেবে বিবেচনা করছেন এবং তা নিয়ে সরস উক্তিও করছেন, তখন পাশ্চাত্যের ন্যায় সাহসী নগ্নিকা চিত্র অঙ্কনে তিনি আর বেশী আগ্রহী অথবা অগ্রসর হননি কেন? এর একটি কারণও সম্ভবত এই যে—বয়ােবৃদ্ধ কবি (তাঁর তখন ৭০ বছর বয়স) যখন চিত্রকলায় আত্মনিয়ােগ করেন তখন পশ্চিমে তাঁর এক বড়াে পরিচয় প্রাচ্যের ঋষি রূপে। নােবেলজয়ী কবিকে ডব্লিউ বি ইয়েটস তখন অন্ততঃ সেভাবেই দেখেছেন। আর অন্য কারণটি হয়তাে—দেশে-বিদেশে খ্যাতিমান কবি শেষ বয়সে এসে তথাকথিত নগ্ন নারীদেহ-সুষমা এঁকে স্বদেশে এবং বিদেশে প্রখর সমালােচনার মুখােমুখি হতে চাননি, চাননি অযাচিতভাবে সে সময়ের কঠোর অথবা কট্টর স্বদেশি রক্ষণশীলদের মুখােমুখি হতে।
কিন্তু প্রথম জীবনে কবিতার শব্দ চয়নচিত্রে নগ্নিকার বর্ণনায় রবীন্দ্রনাথ অন্ততঃ এমন কোনাে বাধা মানেননি। সেখানে যেন তাঁর কবিতাকে William Blake-এর ভাষাতে বলতে হয়ঃ “Art can never exist without naked beauty displayed.’ তবে সমগ্র রবীন্দ্র কাব্যধারার উপর পাশ্চাত্য প্রভাব প্রসঙ্গে প্রথমেই উঠে আসে তাঁর মূল কাব্যভাবনার পরিধির কথা। উনিশ শতকীয় রবীন্দ্র কবিতার প্রধান সুরটি যে ‘বেদনার গীতােচ্ছাস’ তা আমাদের ইংরেজি রােমান্টিক কবিবর্গ ও তাঁদের কবিতার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। ‘সন্ধ্যাসঙ্গীত’এর দ্বন্দ্বক্ষত জীবনভাষ্য, ‘কড়ি ও কোমল’-এর ফরাসি বিলাসিতা, ‘মানসী’-এর করুণ লাবন্য, ‘সােনার তরী’-এর সৌন্দার্যানুভূতি, ‘চিত্রা’-এর কীটীয় ইন্দ্রিয়চেতনা—এসবে যে ইংরেজি রােমান্টিক কবিতার অনুসৃতি আছে তা অস্বীকার করার উপায় নেই। তাঁর গীতালি’, ‘গীতিমাল্য’, গীতাঞ্জলি’-তে মানবপ্রেম যেখানে ঈশ্বরপূজায় সমর্পিত হয়, সেখানে আছে অগস্ত কোঁতের প্রভাব, ‘বলাকা’র গতিতত্ত্বে আছেন বার্গ, ‘প্রান্তিক’-এ বিশ্ব-ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে কবির রুখে দাঁড়ানাে এমনকি ‘পুনশ্চ’, ‘শেষ সপ্তক’, ‘শ্যামলী’-তে নতুন সমাজের স্বপ্ন—সর্বত্রই অনুভব করা যায় পাশ্চাত্য প্রভাব, কোনাে-না-কোনাে সূত্রে। আধুনিক চেক গবেষক ভি, লেসনি রবীন্দ্রকাব্যের রােমান্টিকতার বিষয়ে বলতে গিয়ে একবার শেলীর নাম করেছেন। এছাড়া রবীন্দ্রনাথের গল্প প্রসঙ্গে একবার মাত্র তিনি কিপলিং-এর কথা বলেছেন। আর একবার বলেছেন যে—দান্তের কাছে যেমন ছিলেন ভার্জিল, রবীন্দ্রনাথের কাছে তেমনই ছিলেন কালিদাস। (চেক গবেষক ভি, লেসনি লিখিত রবীন্দ্রজীবনী দ্রষ্টব্য)
ভারতীয় শিল্পকলা সম্পর্কে একবার পাশ্চাত্যের বিদগ্ধজন হ্যাভেলের মনে হয়েছিলঃ It is upon spiritual beauty that the artist is always insisting.’ একথা বােধহয় প্রাচীন কাল থেকেই সকল ভারতীয় শিল্পকলা প্রসঙ্গেই খাঁটি, তা সে কোনারক, অজন্তা কিম্বা খাজুরাহাের নগ্ন চিত্রগুলিই হােক না কেন! তা যদি শুধুমাত্রই নিছক যৌনাবেদনময় কামকেলির প্রদর্শন হতাে তবে সহস্র দশক পার করার তার বিকৃতি অবধারিত ছিল। কিন্ত তা তাে হয় নি! এর কারণ, আমাদের প্রাচ্য শিল্প পরম্পরার অপরিসীম ধারণক্ষমতা। জন্মলগ্ন থেকেই ভারতবর্ষ যে ত্যাগ ও তিতিক্ষার মন্ত্রে উদ্বোধিত তা কখনও জীবন ও শিল্পে বাহ্য ইন্দ্রিয়াসক্তির উল্লাসতাকে স্বীকার করে নি। বিংশ শতক ব্যাপী আমাদের জাতীয় ইতিহাস ও ঐতিহ্য শিক্ষার পরম্পরাও তা নয়। দুর্ভার্গ্যজনক হলেও বাস্তব এই যে, বর্তমান শতকে আধুনিকতার নামে শিল্পের অনাচার কিম্বা কদাচারের যে বাড়াবাড়ি, তার অনেকটাই এসেছে পাশ্চাত্যের অনুকরণে। তবে সেখানেও সুদূর অতীতের বাস্তব ছবিটা কিছু অন্যরকম ছিল। আমরা দেখি, একসময় ইওরােপে রেনােয়া কিম্বা কুর্বের আঁকা নগ্ন নারীর স্নানচিত্রগুলিও (যথাঃ ‘আফটর দ্য বাথ’) পাশ্চাত্যবাসীদের কাছে তাৎপর্যপূর্ণভাবেই অপরিসীম শিল্পশােভনীয় ছিল।
শিল্পশােভনতার সেই মাধুরীকে বিংশ শতকের ভারতীয় চিত্রকলাতে প্রতিভাত করার চেষ্টা করেছিলেন অতুল বসুর মতাে চিত্রকরেরা, যাঁর স্নানসিক্তা রমনীর ছবি সেযুগে তাে বটেইএমন কি এ যুগেও আমাদের, হৃদয়গহনে শৈল্পিক নান্দনিকতার ছোঁয়া জাগায়। এ তাে গেল ছবির প্রসঙ্গ। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘চিত্রা কাব্যগ্রন্থের ‘বিজয়িনী’ কবিতায় নগ্ন নারীর স্নানের প্রস্তুতিপর্বের বর্ণনায় লেখেনঃ
‘লুটায় মেখলাখানি ত্যজি কটিদেশ
মৌন অপমানে; নুপূর রয়েছে পড়ি;
বক্ষের নিটোল বাস যায় গড়াগড়ি
ত্যজিয়া যুগল স্বর্গ কঠিন পাষাণে।’
বনান্তরাল থেকে মদনদেব নগ্না নারীর এই স্নানলীলা দেখে পুলকিত। অকস্মাৎ মদনের সুপ্ত পৌরুষ অকল্প প্রকম্পনে চূড়ান্ত অবলেহিত হয় যখন সেই স্নানসিক্তা নারী নগ্না দেহে—বিলসিত নয়নে, স্খলিত চরণে তীরে উঠে আসে। কবির ভাষায় সে বর্ণনাঃ
……..তীরে উঠিল রূপসী-
ত্রস্ত কেশভার পৃষ্ঠে পড়ি গেল খসি।
অঙ্গে অঙ্গে যৌবনের তরঙ্গ উজ্জ্বল
লাবণ্যের মায়ামন্ত্রে স্থির অচঞ্চল
বন্দী হয়ে আছে, তারি শিখরে শিখরে
পড়িল মধ্যাহ্ন রৌদ্র—ললাটে, অধরে,
উরু ‘পরে, কটিতটে, স্তনাগ্রচূড়ায়,
বাহুযুগে, সিক্ত দেহে রেখায় রেখায়
ঝলকে ঝলকে।’
আপৎকালীনভাবে এ পংক্তি পাঠে মদনের ন্যায় পাঠক কামাহত হলেও তার ইন্দ্রিয়াসক্তির ঊর্ধে স্থাপিত বুদ্ধিবৃত্তির আলােয় যখন তা পাশ্চাত্যের ভেনাস বা আফ্রোদিতির ন্যায় মায়াময় রূপে প্রতিভাত হয় তখনই যাবৎ সে কামপ্রবৃত্তির অকস্মাৎ অবসান ঘটে। কবিতার দীর্ঘস্থায়ী ফলটিও তাই। এ প্রসঙ্গে Rachilde-এর একটি উদ্ধৃতি ভাগ করা যেতে পারে। আধুনিক সমালােচক Rachilde তাঁর Monsier Venus (A Materialist Novel)- এ লিখেছেন: ‘The terrible poetry of human nudity, I understand it at last, I who tremble for the first time in trying to read it with blase eyes.’ রবীন্দ্রনাথের প্রথম জীবনে লেখা বাসনার্তিময় প্রেমের কবিতাগুলি পড়তে গিয়ে অনেকটা এমন অনুভূতিই হয়। অন্তরের কামনার দীপ্ত শিখা পূর্ণ প্রজ্জ্বলিত হলেও বাইরের প্রকাশভঙ্গিমায় তা সংযত, দিব্যকান্তিময়। তবুও রবীন্দ্রনাথের প্রথম জীবনে লেখা ‘মানসী’ বা ‘কড়ি ও কোমল’-এর প্রিয়ার কামনার সংগে যে অনেকখানি আরক্তা সেকথা স্বীকার করে নিতেই হয়।‘মানসসুন্দরী’তে কবি অনায়াসে বলতে পেরেছেনঃ
‘চুম্বন মাগিব যবে, ঈষৎ হাসিয়া
বাঁকায়াে না গ্রীবাখানি, ফিরায়াে না মুখ,
উজ্জ্বল রক্তিমবর্ণ সুধাপূর্ণ মুখ
রেখাে ওষ্ঠাধর পুটে।’
অথবা,
‘মৃদু হাসি ভাসি উঠে, বসি মাের কোলে,
বক্ষ বাঁধি বাহুপাশে, স্কন্ধে মুখ রাখি
হাসিয়াে নীরবে অর্ধনিমীলিত আঁখি।
পরবর্তীতে কবি এমন বাসনার্তিময় কাব্য আর লেখেননি। অথচ, প্রথম জীবনে লেখা কবিতায় প্রেমের আধারে কামনার সুরা পরিবেশনে কবি কুণ্ঠা বােধ করেন নি। তাই বলেছেনঃ
নারীর প্রাণের প্রেম মধর কোমল
বিকশিত যৌবনের বসন্ত সমীরে
কুসুমিত হয়ে ওই ফুটিছে বাহিরে,
সৌরভসুধায় করে পরাণ পাগল। (‘স্তন’)
এর সাথে মিলিয়ে নেওয়া যায় বােদলেয়ারের একটি কবিতাকে যা কবি বুদ্ধদেব বসুর একটি অনুবাদেঃ
‘ন্যাকড়া – কানি ঢাকে না তাের লাজ:
তার বদলে দরবারি এক সাজ
নিস্বনিত লম্বা ভাঁজে – ভাঁজে
পড়ুক পায়ের খাঁজে;
রময়, ছিন্ন মােজা জোড়া,
তার বদলে সােনার এক ছােরা
জঙ্ঘা তাের যেন মােহন রেখায়
লম্পটেরে দেখায়;
হালকা গেরাে উন্মােচন করুক
দুটি চোখের মতাে রে তাের বুক
দীপ্তিময় – লাবণ্যের চাপে
আমরা জ্বলি পাপে;
নির্বাসনের সময় বাহুযুগল
যেন অনেক আরজিতে হয় উতল,
ফিরিয়ে দিতে না যেন হয় ভুল
দুর্জনের আঙুল।’ (লালচুলের ভিখিরি মেয়েকে)
দেখা যাচ্ছে, নারীদেহের একই গােপনাঙ্গের বর্ণনায় পাশ্চাত্য কবিরা যতটা অসংযমী, আমাদের কবি তার কাছাকাছিও নন। তিনি অনেক শােভন, সুন্দর। ব্যঞ্জনায় আবদ্ধ নারী শরীর সেখানে যৌনতা অপেক্ষা তার নান্দনিক সৌন্দর্যের ইঙ্গিতেই বেশী সােচ্চার। একইভাবে রবীন্দ্রনাথের লেখা আর একটি কবিতার লাইনঃ
‘গৃহ ছেড়ে নিরুদ্দেশ দুটি ভালােবাসা
তীর্থযাত্রা করিয়াছে অধর সঙ্গম
দুইটি তরঙ্গ উঠি প্রেমের নিয়মে
ভাঙ্গিয়া মিলিয়া যায় দুইটি অধরে।’ (‘চুম্বন’)
এ যেন ইওরােপের Neurotic Poets-দের একজন P.B. Shelley-এর লেখা ‘To a Skylark’ কবিতারঃ
‘Teach me half the gladness
That thy brain must know,
Such harmonious madness
From my lips would flow.’
লাইনগুলিরই প্রতিধ্বনি! কবির জীবনের প্রথম দিকে লেখা ‘সােনার তরী’ কাব্যের ‘মানস সুন্দরী’ কবিতাতেও এই নগ্নতার জয় ঘােষিত হয়েছে। কড়ি ও কোমল কাব্যের ‘বিবসনা’ কবিতায় কবি বলেনঃ
‘ফেলাে গাে বসন ফেলাে, ঘুচাও অঞ্চল
পরাে শুধু সৌন্দর্যের নগ্ন আবরণ। (‘বিবসনা’)
এর চেয়ে চূড়ান্ত নগ্নতার আশ্লেষ রবীন্দ্রকাব্যে আর মেলেনা। লেডী রানু বা আর্জেন্টিনার নারী ভিক্টোরিয়া ওকাম্পাের প্রতি কবির দুর্বলতার কথা সাহিত্যে অনালােচিত নয়। ওকাম্পাের ডায়েরী থেকে জানা যায়, একসময় বিদেশে থাকাকালীন প্রায় প্রতিদিন কবি তাঁর কপালে ও গালে চুম্বন করতেন। কিন্তু সেইসব অভিব্যক্তিগুলি কোনাে অর্থেই কামকলুষ ছিলনা। ভুল সম্ভোগ অপেক্ষা নয়নাভিরাম সৌন্দর্যোপলব্ধিই সেখানে বড় কথা ছিল। দিলীপ কুমার রায়ের ‘তীর্থঙ্কর’ গ্রন্থে যৌনতা ও দাম্পত্য সম্পর্ক নিয়ে কবির নানা মতামত ও চিঠির কথা জানা যায়। কিন্তু তা ছিল স্বাভাবিক যৌনতা বিষয়ক, উচ্ছংখলতা বা উন্মুক্ত স্বেচ্ছাচার নয়। এদিক থেকেও তিনি সমকালীন পাশ্চাত্য লেখকদের তুলনায় স্বতন্ত্রই ছিলেন। পাশ্চাত্যের কবি হুইটম্যানের কবিতায় ভাবের যে বেআব্রু বহিঃপ্রকাশ আমরা দেখি তাতে আতঙ্কিত হলেও ক্ষুব্ধ হইনা। হুইটম্যানের ভাষায়ঃ
“It is 1, you women, I make my way
I am stern acrid, undissuble, but I have you
I do not hurt you any more than is necessary for you
I pour the stuff to starts sons and daughters fit for these states
I press with slow rude muscle
I brace myself effectually. I listen to no entreaties
I dare not with draw till deposit what has so long accumulated within me.’
একইভাবে বলা যায়, ‘ম্যাক্সিম দ্যু কাঁ’-কে লেখা বােদলেয়ারের দুটি কবিতা, যা বুদ্ধদেব বসুর অনুবাদেঃ
১
‘যা পেয়েছি পুঞ্জিত মেঘের মধ্যে, দৈবের প্রসাদে;
আর ছিলাে হৃদয়ে অনবরত কামের উদ্বেগ!
-পুলকের অভ্যুদয় কামনার বাড়ায় ক্ষমতা।
হে কাম, প্রাচীন বৃক্ষ, সুখময় তােমার প্রান্তর,
যদিও বল্কলে বাড়ে দিনে-দিনে কঠিন ঘনতা
ডালপাখা উর্ধ্বে উঠে সূর্যেরেই খোঁজে নিরন্তর। (ভ্রমণ)
২
‘সে-রাতে ছিলাম কদাকার ইহুদিনীর পাশে,
পাশাপাশি দুটো মৃতদেহ যেন এ ওকে টানে;
ব্যর্থ বাসনা; পণ্য দেহের সন্নিধানে
সে- বিষাদময়ী রূপসী আমার স্বপ্নে ভাসে।
মনে পড়ে গেলাে সহজাত রাজভঙ্গি তার,
দৃপ্তললিতে সে-কটাক্ষের সরঞ্জাম,
গন্ধমদির মুকুটের মত অলকদামযার
স্মৃতি আনে প্রণয়ের পুনরঙ্গীকার।
ও-বরতনুতে চুম্বনরাশি দিতাম ঢেলে,
শীতল পা থেকে কাল চুল পর্যন্ত
ছড়িয়ে গভীর সােহাগের মণিরত্ন,
বিনা চেষ্টায় যদি এক ফোঁটা অশ্রু ফেলে
কোনাে সন্ধ্যায়- নিষ্ঠুরতমা হে রূপবতী!
ম্লান করে দিতে ঠাণ্ডা চোখের তীব্র জ্যোতি।’ (‘সে-রাতে ছিলাম…’)
রবীন্দ্রনাথের লেখা ‘ফাল্গুনী’ কিম্বা মানসসুন্দরী’ কবিতার লাইনগুলিকে এর পাশাপাশি রাখলেই পশ্চিমা কবিদের সাথে রবীন্দ্রনাথের লেখনীর বিশেষ পার্থক্যটি চোখে পড়ে। পাশ্চাত্যের কবিদের কাছে যা উন্মত্ত বাসনা ছাড়া আর কিছুই নয়, কবির কাছে তাই-ই হলাে হেমকল্পশুদ্ধ। তবে শুধুই তাে পাশ্চাত্য কবিবর্গ নয়। আধুনিক বাংলা কবিতায় ইওরােপীয় ভাবনাকে যে সকল কবিরা বেশী মাত্রায় প্রাধান্য দিয়েছিলেন, বুদ্ধদেব বসু তাঁদের মধ্যে সর্বাগ্রগণ্য। তাঁর কাব্যভাবনাতেও স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়ে ওঠে বেপরােয়া যৌনতা যখন তিনি বলেনঃ
‘সােনালী আপেল, তুমি কেন আছ? চুমাে খাওয়া হাসির কৌটোয়
দাঁতের আভায় জ্বলা লাল ঠোঁটে বাতাস রাঙাবে?
ঠাণ্ডা, অটো, কঠিন কোনারকের বৈকুণ্ঠ জাগাবে?
অপ্সরীর স্তনে ভরা অন্ধকার হাতের মুঠোয়?’ (স্টিল লাইফ)
সেকালে তাে বটে, এমন কি একালেও—রন্ধ্রে রন্ধ্রে তীব্র যৌনাবেদন ভরা এ কবিতা পড়তে গিয়ে কণ্ঠ কেঁপে যাওয়া কিম্বা কর্ণমূল লাল হয়ে ওঠা খুব স্বাভাবিক। তাঁর নতুন পাতা কাব্যে বুদ্ধদেব ‘লক্ষবর্ষ উপবাসী শৃঙ্গার কামনা করে বলেনঃ
‘তুমি মিলবে আমার মধ্যে
তুমি শুভ, নগ্ন, নিঃসঙ্গ
নিসঙ্গ, নগ্ন, শুভ্র আমার মধ্যে। (নতুন পাতা)।
একই শব্দগুলিকে শুরু থেকে শেষ এবং শেষ থেকে শুরু অবধি বারংবার কেটে কেটে বলার মধ্য দিয়ে কামনার অতিরেককেই শুধু প্রকাশই করা হয় নি, বরং তাকে সংক্রামিত করার একটা কবিকৃত প্রয়াসও এখানে লক্ষ্য করা যায়। এমন কোনাে চেষ্টাকৃত প্রয়াস অন্ততঃ রবীন্দ্রনাথের ‘মানসসুন্দরী’ কাব্যে পরিলক্ষিত হয় না। সেখানে কবি বলেনঃ
‘স্থালিত বসন তব শুভ্র রূপখানি
নগ্ন বিদ্যুতের আলাে নয়নেতে হানি
চকিতে চমকি চলি যায়।’ (মানসসুন্দরী)
নগ্নার শুভ্রতাকে এখানে দেবী আফ্রোদিতির ন্যায় আর তার নিসঙ্গতাকে ভেনাসের ন্যায় শুদ্ধ আর পবিত্র বলে মনে হয়। ‘চিত্রা’ কাব্যগ্রন্থের ‘জ্যোস্নারাত্রে’ কবিতাতেও তেমনটি দেখতে পাই যেখানে কবি তাঁর মনাঞ্জলির ধারাবিধৌত অকপট কামনাকে আঘাত করে বলতে পারেনঃ
‘উদভ্রান্ত বাসনা বক্ষে করিছে আঘাত
বারম্বার, তুমি এসাে স্নিগ্ধ অশ্রুপাত
দগ্ধ বেদনার ‘পরে’।
পাশ্চাত্যের শেলী যেমন তাঁর ‘কুইন ম্যাব’ কবিতায় বলেনঃ “All beautiful in naked purity এর সাথে মিলিয়ে নেওয়া যায় ‘মানসসুন্দরী’-র সেই লাইনকটিকে যেখানে কবি লেখেনঃ
‘নগ্নবক্ষে বক্ষ দিয়া
অন্তর রহস্য তব শুনে নিই প্রিয়া।” (“মানসসুন্দরী’)
রবীন্দ্রনাথের ‘উর্বশী’ কবিতার উর্বশীও যেন প্রাচ্য পুরাণের সুরসুন্দরীর ন্যায়, অথবা তা পাশ্চাত্যের ভেনাস কিম্বা আফ্রোদিতির পুনঃনির্মাণ। কবি দেখেছেন তার ‘কুশুভ্র নগ্নকান্তি’। যাকে দেখে পুরুষের রক্তে উদ্দীপনা জেগে ওঠে, চিত্ত হয় চঞ্চল ও আত্মহারা, তার বিবরণ কবির ভাষায়ঃ
‘মুক্তকেশী বিবসনে, বিকশিত বিশ্ববাসনার
অরবিন্দ মাঝখানে পাদপদ্ম রেখেছ তােমার
অতি লঘুভার।
এরই সাথে সাযুজ্যের বন্ধনে বন্ধনীভূক্ত হতে পারে আধুনিক কবি Kenneth Walter Simpson-এর। ‘Occupational Therapy-এর মতাে কবিতা, যেখানে কবির চোখে অতি আধুনিক জীবনে দেখা তথাকথিত ‘Sexy Beach Girl’ ‘মিথ’-এর কল্যাণে হয়ে ওঠেন আফ্রোদিতে, আর একইসাথে সেখানে নারীর সৌন্দর্যানুসন্ধানে রত Simpson শেষপর্যন্ত সেই ‘Purity of Nudity’-এর মধ্যেই তাঁর প্রার্থিত শ্বাশ্বতের খোঁজ লাভ করে প্রায় শেলীর মতােই বলে ওঠেনঃ
Flirting with dream and myths
A fling with Aphrodite
So sexy in a bikini
Lying on the sand
… … … …
The purity of nudity
For all eternity.’
অথবা জীবনানন্দের ‘আকাশনীলা’ কবিতায় যেখানে কবি বলেনঃ
‘ফিরে এসাে সুরঞ্জনা;
নক্ষত্রের রূপালি আগুন ভরা রাতে
ফিরে এসাে এই মাঠে, ঢেউয়ে;
ফিরে এসাে হৃদয়ে আমার।
সৌন্দর্যের আদর্শ বিচারে এভাবেই হয়তাে সব যুগের আর সব কালের কবিরাই শেষে এক হয়ে যান। তাই আধুনিকতার কলুষ স্রোত সামনের দিকে ক্রমে আরাে দ্রুততার সাথে ধাবিত হলেও নান্দনিকতার সংজ্ঞাবাহী এই ‘Purity of Nudity’-এর শ্বাশ্বত মর্মবাণীটি আজও সমানভাবে সত্য হয়ে ওঠে। তাই তাে আধুনিক কবি Kiarra Dean তাঁর ‘A PSA To Self Confidence’ কবিতায় নির্দ্বিধায় বলতে পারেনঃ
Some people think its gross
Some think your being a prude
But I think it is a wonderful thing
When done in the right mannor
When you feel so good about yourself
You want to show your body off
Then that is wonderful
For most people I know
Including myself, for a while
Would never have dreamt ever so.’
রবীন্দ্রনাথের অন্তরের অনন্ত সৌন্দর্যলােকবাসিনী, অনিন্দিতা ‘উর্বশী’ প্রসঙ্গে তাঁর ‘কবি রবীন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রকাব্য’ গ্রন্থে সমালােচক মােহিতলাল মজুমদার বলেনঃ “উর্বশীতে পাশ্চাত্য কবিপ্রসিদ্ধি ও তথাকার নব্য কামকল্পনার রং আছে এবং রসসম্ভোগের স্বপ্নসুখেই কবি নব্য য়ুরােপীয় ‘কামনা’র সুর যুক্ত করিয়াছেন।’ উর্বশী চিরকালই কামার্ত পুরুষের আকাঙ্খিতা। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিতে তিনি কামবন্দিতা নন বরং সৌন্দর্যময়ী, বিশ্ববিমােহিনী। কবির ভাষায়ঃ
“আদিম বসন্তপ্রাতে উঠেছিলে মন্থিত সাগরে,
ডান হাতে সুধাপাত্র, বিষভান্ড লয়ে বাম করে,
তরঙ্গিত মহাসিন্ধু মন্ত্রশান্ত ভুজঙ্গের মতাে
পড়েছিল পদপ্রান্তে উচ্ছ্বসিত ফণা লক্ষ শত
করি অবনত।”
এ লাইনগুলি নারী সৌন্দর্য সম্পর্কে প্রাচ্য অথবা ভারতীয় চিত্র-স্থাপত্য শিল্পকলারই পরিপূরক এবং পরিপােষক। চিত্র-স্থাপত্যরূপ ভারতীয় শিল্পকলাতেও যে একসময় দেব-দেবী প্রাধান্য ছিল সেকথা পূর্বেই বলেছি। রবীন্দ্রনাথ তাঁর চিত্রে না হলেও, ‘চিত্রা’ কাব্যগ্রন্থের ‘উর্বশী’ কবিতায়—মিথের নিরুচ্চার অনুপ্রবেশে সেই ঐতিহ্যেরই বিনির্মাণ করেছেন। বলা যেতে পারে, কবি এখানে নিজস্ব সচেতনতা অথবা অসচেতনতার বশবর্তী হয়ে পরম্পরাবাহী একটি নির্দিষ্ট ভারতীয় ঐতিহ্যকে মেনে নিয়েই যেন তাঁর শিল্প রচনা করতে চেয়েছেন। সমুদ্রমন্থনের দ্বারা সৌন্দর্যরূপিনী ঐশ্বর্যলক্ষ্মীর পুরাণসম্মত আবির্ভাবকে এখানে অনন্ত সৌন্দর্যলক্ষ্মী দেবী উর্বশীর আবির্ভাবের সাথে মিলিয়ে দেবার প্রয়াসে একদিকে যেমন রক্ষণশীল প্রাচ্য শিল্পকলার মুখ রক্ষা করা হয়েছে, তেমনই ভারতীয়দের চোখে সৌন্দর্যের সংজ্ঞা কি—তারও ভাব প্রকাশের একটা চেষ্টা রয়েছে। একদা সতীশচন্দ্র চক্রবর্তী বলেছিলেনঃ “রবীন্দ্রনাথের প্রণয়গীতি আবাল্য পূজার রাগিণীতে বাঁধা। কিন্তু আমাদের মনে হয়, কবির চেনা এ ‘উর্বশী যেন তার থেকেও কিছু অংশে বেশী। ‘বৃন্তহীন পুস্পসম’ বিকশিতা অকল্পনীয় সৌন্দর্যের অধিকারিনী এই সুরনারী শুধু কবির একার সৌন্দর্য অধিষ্ঠাত্রী দেবী নন, ঐতিহ্যের পরম্পরায় তিনি সকল ভারতীয়ের, বা বলা ভালাে সকল ভারতীয়ত্বের। কবির সৌন্দর্য বন্দনার আর এক উৎসমুখ হলাে ‘চিত্রাঙ্গদা’। এ কাব্যনাট্যের একস্থানে সখীদের দল বলেঃ
‘দিনে দিনে হৃদয়ের গ্রন্থি তব
খুলিব প্রেমের গৌরবে।
পাঠকের কাছে কবিরও মনের কথা তাই। আবার এ কাব্যনাট্যে সখীদের মুখে যেন প্রচারের ভঙ্গিমায় কবি বলে ওঠেনঃ
“রমণীর মন ভােলাবার ছলাকলা
দুর করে দিয়ে উঠিয়া দাঁড়াক নারী
সরল উন্নত বীর্যন্ত অন্তরের বলে
পর্বতের তেজস্বী তরুণ তরু-সম,
যেন সে সম্মান পায় পুরুষের।
রজনীর নমসহচরী
যেন হয় পুরুষের কর্মসহচরী,
যেন বামহস্তসম
দক্ষিণহস্তের থাকে সহকারী
তাহে যেন পুরুষের তৃপ্তি হয়, বীরােত্তম।
সখীদের এ স্পষ্টভাষণে পরিস্কার হয়ে যায় পুরুষের কামনাময়ী নর্মসহচরী থেকে জীবনের মর্মসহচরী হবার তথাকথিত নারীদেহী রূপান্তর। এ কথা তাে শুধু চিত্রাঙ্গদা নয়, বরং রবীন্দ্র-সাহিত্যে দৃশ্যমান তাবৎ নারীকূলের ক্ষেত্রে প্রযােজ্য, কবির লেখনী যাঁদের চারিত্রিক নির্মলতা দানের পাশাপাশি করেছে ব্যক্তিস্বাতন্ত্রে উজ্জ্বল, অন্ততঃ পুরুষের পাশে। একসময় কবি দ্বিজেন্দ্রলাল রায় ‘চিত্রাঙ্গদা’ নাটক প্রসঙ্গে দুর্নীতির অভিযােগ এনে লেখেনঃ রবীন্দ্রবাবুর চিত্রাঙ্গদার সম্ভোগ অভিসারিকার সম্ভোগ। অবশ্য প্রমথ চৌধুরী তাঁর সাহিত্যে চাবুক’ নামক প্রবন্ধে দ্বিজেন্দ্রলালের এই বিরূপ সমালােচনার যথাবিরুদ্ধ জবাব দেন। বস্তুতঃ অন্তর দিয়ে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, ‘চিত্রাঙ্গদা’ কাব্যের সৌন্দর্যস্তুতিতে একবিন্দুও ভােগস্পৃহা নেই।
রবীন্দ্রনাথ জার্মান কবি হেনরিখ হাইনের ‘Book of Songs’-এর চারসংখ্যক কবিতা অবলম্বনে ‘আঁখিপানে সবে আঁখি তুলি’, চব্বিশসংখ্যক কবিতা অবলম্বনে ‘স্বপ্ন দেখেছিনু প্রেমাগ্নি জ্বালায়’ সহ আরাে কয়েকখানি কবিতার অনুবাদ করেন। হাইনের হৃদয়ের অন্তহীন দুঃখের কঠিন দহনই তাঁর অনূদি একবিতাগুলির মূলভাব ছিল। তবে রবীন্দ্রনাথ হাইনের শিরােনামসহ কোনাে কবিতার অনুবাদ করেননি। আবার তাঁর দীর্ঘ কবিতাগুলিকেও বাদ দিয়েছেন। কিন্তু হাইনের কবিপ্রতিভার পরিচয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে এমনভাবে ধরা পড়েছিল যে, মাত্র কয়েক লাইনের কবিতায় তিনি কবির বেদনাবিধুর হৃদয়টি সকলের কাছে অতি সহজেই গভীরভাবে তুলে ধরতে পেরেছিলেন। তিনি বােঝাতে পেরেছিলেন, Book of Songs-এর ‘গভীর রাগিণী উঠে বাজি বেদনাতে। প্রথম প্রেমের ব্যর্থতা বােহেমীয় হাইনের জীবনাচরণে যে বিষণ্ণতর ঝড় বয়ে এনেছিল তা থেকে তিনি কোনােদিন মুক্ত হতে পারেননি। তার জীবনে দ্বিতীয়বার প্রেমের সার্থকতাও আসেনি। তাই ক্ষোভের সঙ্গে স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে উঠেছে তাঁর পরিহাসপ্রিয়তা। নিজের ওপর তাঁর এ নিষ্ঠুরতায় অবাক হয়েছে সবাই। রবীন্দ্রনাথ এরকমই একটি কবিতার অনুবাদ করেছিলেন। হাইনের মূল কবিতাটি ছিল এরূপঃ
“He who for the first time loveth
Though his hopeless is a God!
But the man who hopeless loveth,
For the second time’s a fool,
1, a fool like this, and loving
Once more, with no love responsive;
Sun and moon, and stars are laughing
I, too, join the laugh and die.’
আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরেরর অনুবাদঃ
‘বারেক ভালােবেসে যে জন মজে
দেবতাসম সেই ধন্য,
দ্বিতীয়বার পুনঃপ্রেমে যে পড়ে
মুখের অগ্রগণ্য।
আমিও সে দলের মূর্খরাজ
দু’বার প্রেমপাশে পড়ি
তপন শশী তারা হাসিয়া মরে
আমিও হাসি- আর মরি।
চিলিয়ান সাহিত্যিক পাবলাে নেরুদা ও গ্যাব্রিয়েলা মিস্ত্রাল, মেক্সিকান লেখক অক্টাভিও পাজ ও স্প্যানিশ লেখক হােসে অরতেগা ওযাই গ্যাসেৎ, থেনােবিয়া কামবি আইমার, ও হুয়ান রামােন হিমেনেথ প্রমুখ স্প্যানিশ-ভাষী সাহিত্যিকদেরও অনুবাদের সূত্রে অনুপ্রাণিত করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ১৯১৪ থেকে ১৯২২ সালের মধ্যে হিমেনেথ-কামপ্রবি দম্পতি রবীন্দ্রনাথের বাইশটি বই ইংরেজি থেকে স্প্যানিশে অনুবাদ করেছিলেন। ‘দ্য ক্রেসেন্ট মন’ (শিশু ভােলানাথ) সহ রবীন্দ্রনাথের বেশ কিছু রচনার বিস্তারিত পর্যালােচনা ও স্প্যানিশ সংস্করণ প্রকাশও করেছিলেন তাঁরা। উল্লেখ্য, এই সময়েই হিমেনেথ ‘নগ্ন কবিতা’ (স্প্যানিশ উচ্চারণে poesia desnuda) নামে এক বিশেষ সাহিত্যশৈলীর উদ্ভাবন ঘটান। পাবলাে নেরুদার লেখা ‘Ode a la Bella Desnuda (Ode to a Beautiful Nude’)-ও এরকমই এক বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ।
নিজের আঁকা ছবি সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বিভিন্ন সময়ে নানা মন্তব্য করেছেন। যেমন কখনাে বলেছেনঃ ‘ঐগুলি কেবল রেখাই নয়, ঐগুলি তার থেকেও কিছু বেশি, আমার চিত্রাঙ্কিত স্বপ্ন এক কাব্যিক কল্পনার দর্শন। আমার চিত্র রেখার ছন্দে আবদ্ধ কবিতা। আরাে বলেছেন, “আমি বিশ্ব সংসারকে কল্পনা করতে পারি রেখার জগৎ সংসার হিসেবে যেগুলাে তাদেরকে মূর্ত প্রবাহের অন্তহীন শৃঙ্খলে পর্বতশ্রেণী ও মেঘমালা, বৃক্ষরাজি, ঝর্ণাধারা, অগ্নিগর্ভ জ্যোতিষ্কমণ্ডল, নিরন্তর জীবনস্রোত; নিশ্চপ মহাকাল নিরবধি মহাশূন্য পেরিয়ে ভঙ্গিমারাজির। মহাসংগীত মিলিত হয়ে যায় রেখাপুঞ্জের আর্তনাদে; যেন তারা আকস্মিক ইচ্ছাপূরণের আকাঙ্ক্ষায় সংগীহীনা বেদেনীর লক্ষ্যহীন ঘুরে বেড়ানাে। রবীন্দ্রনাথের এ কথা গুলি থেকে একটা জিনিস পরিস্কার, যা হলাে- মূলতঃ তিনি কবি আর ছবি হলাে তাঁর ইচ্ছাপূরণের অঙ্গ। এখানে বিখ্যাত রুশ সাহিত্যিক ও চিত্রকর পুশকিনের সাথে রবীন্দ্রনাথের চিত্র ও কবিতার ভাবসম্মীলনের বিষয়ে কিছুটা আলােচনা করা যেতে পারে। দুজনেরই শিল্পীসত্তা তাঁদের কবি সত্তার মধ্যে হারিয়ে গেছে। কিন্তু যখন তাঁদের ছবিগুলিকে দেখি তখন তাঁদের সেই আপন কবি সত্তাকেই যেন আবার খুঁজে পাই। কারণ পুশকিন ও রবীন্দ্রনাথ উভয়েরই শিকড় মাটির গভীরে প্রােথিত। মর্তমাটির মায়া আর মানুষী কায়া উভয়েরই কাব্য ভাবনায় মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়। দিবাবসানে কৃষ্ণকায়, ক্ষিপ্র গতিসম্পন্ন ঘােড়ার পিঠ থেকে লাফ দিয়ে নেমে খড়ের গাদার মধ্যে দিয়ে দৌড়ে গিয়ে ক্লান্ত পুশকিন যখন পৌঁছােন তাঁর কুটীরে- খুলে দেন কাঠের জানালা, তখন ভাসমান খন্ড খন্ড দুধসাদা মেঘের বুক থেকে উঁকি মারা চাঁদের আলাে ভাসিয়ে দিয়ে যায় তাঁর ঘর। অকস্মাই আবির্ভূত হয় কোনাে এক স্প্যানিস আত্মা। লেবু আর জলপাই-এর মােহমদির সৌরভে ভরে ওঠে সারা কক্ষ। এরই মাঝে কবি যেন অনায়াসে বলতে পারেন:
‘I loved you, and I probably still do,
And for a while the feeling may remain…
But let my love no longer trouble you,
I do not wish to cause you any pain.
I loved you; and the hopelessness I knew,
The jealousy, the shyness – though in vain –
Made up a love so tender and so true
As may God grant you to be loved again.’
(‘I loved you, and I probably still do’, Alexandar Pushkin, অনুবাদ. Genia Gurarie)
অথবা
‘ওলগা, সকালের তারা তুমি,
আফ্রোদিতির ধর্ম কন্যা,
অলৌকিকতা সৌন্দর্যের,
সােহাগে জড়াতে
কত সাবলীল তুমি,
অবহেলায় জাগাও
উন্মাদনা। উষ্ণ চুম্বনে কামনার
গােপন মুহূর্ত গড়াে;
তারপর যখন অগ্নি ঘেরে আমাদের,
বাইরে দাঁড়াই,
শুনি তােমার চাপা স্বর
কৌতুকের হাসি
অভিমানী সখীর সাথে
বন্ধ ঘরে। (‘ওলগা ম্যাসনের প্রতি’, আলেকজান্ডার পুশকিন, অনুবাদ রেজা নুর)
এরই পাশাপাশি রাখতে পারি রবীন্দ্র নাথের সেই কবিতা, যেখানে কবি বলেনঃ
“সেইখানেতে সাদায় কালােয়
মিলে গেছে আঁধার আলােয়-
সেই খানেতে ঢেউ ছুটেছে এ পারে ওই পারে
নিতলনীল নীরব মাঝে বাজল গভীর বাণী
নিকষেতে উঠল ফুটে সােনার রেখা খানি
মুখের পানে তাকাতে যাই,
দেখি দেখি দেখতে না পাই-
স্বপন সাথে জড়িয়ে জাগা, কাঁদি আকুল ধারে
রাত্রি এসে যেথায় মেশে দিনের পারাবারে
তােমায় আমায় দেখা হলাে সেই মােহানার ধারে।”
ভালােবাসা আর রং-রূপের এ এক আশ্চর্য সহাবস্থান যা বিচিত্র ভাবে মিশে গেছে দুজনের গড়ে তােলা দ্বৈত শিল্প মাধ্যমে। পুশকিনের কবিতার উন্মাদনা, ভালােবাসা আর যন্ত্রনা ঘিরে আছে তাঁর আঁকা নারীরূপের রঙে, রেখায়, ভাষায়, ব্যঞ্জনায়। আর রবীন্দ্র কল্পনার অধরা প্রেমময়ী- যে বারবার আশা আর আশাভঙ্গের বেদনা জাগায় কবি-মনে, সেই-ই যেন ভাষারূপ পেয়েছে কবির আঁকা অর্ধালােকিত নারী চিত্র গুলির মাঝখানে। শুধু তাই নয়, ছবি ও কথা যেন এখানে পরস্পর মিলে মিশে একাকার। কি নেই সেখানে? আছে স্থান (মােহানা), কাল (আঁধার-আলাে, রাত্রি, দিনের পারাবার), আছে চরিত্র (তােমায়-আমায়) আর আছে চিত্রবৎ রং-রূপ-রেখা (নীতল নীল, সাদা-কালাে, সােনার রেখা)। এখানেই শেষ নয়। কবির এ কাব্য। ভাবনা গুলি যখন তাঁর আঁকা নারী মুখের সাথে মিলে যায় তখন তার সাথে জড়িয়ে যায় সেই মানবী বিষন্নতাও যা কবিকেও নিবিড়ভাবে আচ্ছন্ন করে। কবির ‘দেখি দেখি করেও দেখতে না পাওয়া’ আর ‘স্বপন সাথে জড়িয়ে জাগা ও আকুল ধারে কাঁদা’ সেই বিপন্ন ব্যথাকেই তীব্র করে যা রােমান্টিক কবিময়তারই লক্ষণ। এই আলােআঁধারি, দৃশ্য-অদৃশ্য, পাওয়া-না-পাওয়ার বিষাদঘন অনুভূতিকেই তাে আমরা রবীন্দ্র কল্পনায় গড়ে ওঠা নারী চিত্রাবয়বগুলিতে খুঁজে পাই। সেই অতৃপ্ত সৌন্দর্যাকুতিকে খুঁজে পাই যা আমাদের মনকেও ভারাক্রান্ত করে, রহস্যমেদুর এক রােমান্টিক প্রীতিকেই জাগিয়ে তােলে যা আমাদের হৃদয়কে আরাে বেশী রবীন্দ্রানুসন্ধানী করে তােলে। পাঠকের মনে কবিসত্তার ও চিত্রীসত্তার এই যে মহামিলন, এখানেই লুকিয়ে আছে কবির চিত্রময় কাব্যভাবনা অথবা কাব্যময় চিত্রলতার এক সার্থক সমন্বয়।
তবু প্রশ্ন জাগে, শব্দচিত্রে অর্থাৎ কবিতায় যিনি নারীদেহ বর্ণনায় মুক্তহস্ত, তিনি কেন চিত্রকলার মতাে মুক্ত মাধ্যমে একই বিষয় প্রকাশ করেননি? এ প্রশ্নের সঠিক উত্তর আজ পাওয়া কঠিন। কেউ যদি বলেন, এর কারণ তাঁর উপনিষদ-মানসিকতা, তা-ও সার্বিক বিচারে ধােপে তেঁকে না। কারণ নারীদেহের সৌন্দর্য, সুষমা বা লাবণ্য নিয়ে রবীন্দ্রনাথ যথেষ্ট সচেতন ছিলেন। প্রাচীন ভারতীয় চিত্রশিল্পের নগ্নতা, যৌনতা বা মিথুন চিত্র নিয়ে কখনও তাঁর কোনাে বিরূপ মন্তব্য প্রকাশ পায়নি। একথা সত্য যে, পুশকিন কিম্বা রবীন্দ্রনাথের অঙ্কন শিল্প তাঁদের কবিতার মতাে সেই বিশেষ উচ্চতায় পৌঁছতে পারে নি যা একজন খ্যাতিমান পেশাদার চিত্রশিল্পীর পক্ষে পাওয়া সম্ভব, কিন্তু তা যেভাবে যুগ ও কালকে আশ্রয় করে তাঁদের সাহিত্য তথা জীবনভাবনার আকর হয়ে উঠেছে তা অর্জন করা হয়তাে বা কোনাে পেশাদার শিল্পীর পক্ষেও কোনােকালেই সম্ভব নয়। আসলে রং-রূপ-সুর-তাল-লয়-ছন্দকে সঠিক মাত্রায় মিশিয়ে দিতে পারেন যিনি, মানের বিচারে তিনিই বােধ হয় প্রকৃত শিল্পী পদবাচ্য হয়ে ওঠেন। আর্টের এই সংমিশ্রণ অথবা পরস্পর সংবেদী প্রভাব আমরা রবীন্দ্রনাথের মধ্যে ভীষণ ভাবে খুঁজে পাই। রবীন্দ্র নৃত্য, রবীন্দ্র সঙ্গীত অথবা রবীন্দ্র চিত্রগুলি একে-অপরে মিলে হয়ে ওঠে তাঁর সামগ্রিক সাহিত্য ভাবনারই পরিপূরক। বিচিত্র সত্তার এই সার্থক সমন্বয়ই রবীন্দ্র ভাবনা তথা রবীন্দ্র দর্শনকে পুষ্ট ও শক্তিশালী করেছে। কিন্তু আজও লজ্জার সাথে স্বীকার করতে হয়, রবীন্দ্রনাথকে অনুধাবন করেন নি, এমন কি পড়েন নি এমন পাশ্চাত্য সাহিত্যিকের সংখ্যা কম নয়। রবীন্দ্রনাথের মূল বাংলা। কবিতা পড়েননি এমন বহু পাশ্চাত্য সাহিত্যিক ও সাহিত্য সমালােচক রবীন্দ্রনাথের গুরুত্বকে প্রায় অস্বীকার করেছিলেন। তাই হয়তাে গ্রাহাম গ্রিন একসময় সন্দিগ্ধচিত্তে মন্তব্য করেছিলেন, ‘ইয়েটস সাহেব ছাড়া আর কেউই রবীন্দ্রনাথের লেখাকে গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করেন না।’ রবীন্দ্রনাথের কিছু পুরােনাে লাতিন আমেরিকান খণ্ডাংশ সম্প্রতি আবিষ্কৃত হয়েছে। নিকারাগুয়া ভ্রমণের সময় সালমান রুশদি এই জাতীয় কিছু উদাহরণ দেখে অবাক হন।
একদা শেলী বলেছিলেন: Poetry is a mirror which makes beautiful that which is distorted.’ রবীন্দ্রনাথের কাছেও তা ছিল তাই। সে কারণেই ‘Only Thee’ কবিতায় কবি লিখলেনঃ
‘That I want thee, only thee-let my heart repeat without end
All desires that distract me, day and night
Are false and empty to the core.’
কবি জানেন, নগ্নতা যদি কায়া হয়, তবে প্রেম হলাে তার ছায়া। সেই ছায়া সুনিবিড়তাতেই কায়া তার মার্জনা পায়, প্রেম হয় সুবাসিত। যৌনতাকে সৌন্দর্য সৌকুমার্য দেয়, বিকৃতি তাকে করে তােলে রিরংসাময়। প্রেমের বিরল উপলব্ধিও সেই সাধনারই ফল, নগ্নতা ও যৌনতা যেখানে উপলক্ষ মাত্র—প্রাচ্যের অন্যতম কবি রবীন্দ্রনাথ তার অন্যতম দিকদর্শক। ঈশ্বরের কাছে কবির তাই আন্তরিক প্রার্থনাঃ ‘Give me the supreme confidence of Love, this is my prayer—the confidence that belongs to life in death, to victory in defeat, the power hidden in the frailest beauty, to that dignity in pain which accepts hurt but disdains to return it.’ আবার এ ভালােবাসা কি শুধুই প্রণয়িণীর কাছে তার প্রণয়াস্পদের, না কি তা সকল মানুষের জন্য কবিকাঙ্খিত ভালােবাসা? হয়তাে বা শেষটাই। তবু বাস্তবিক অর্থেই যে ব্যক্তিক অর্থে ভালােবাসার জন্ম কবিমনে, তাকে অমর করে দিতেই যেন তিনি তাঁর ‘Unending Love’ কবিতায় লেখেনঃ
‘I seem to have loved you in numberless forms, numberless times…..
In life after life, in age after age, forever.
My spellbound heart has made and remade the necklace of songs
That you take as a gift, wear round your neck in your many forms,
In life after life, in age after age, forever.’
এ কবিতার প্রতিটি পংক্তি আবহমান কাল ধরে ঘােষণা করে চলে—প্রেমের পবিত্রতা, প্রমাণ করে চলে তা যৌনগন্ধী নয় বরং শ্বাশ্বত প্রাণের আবেগে তা চিরভাস্বর। যে কারণেই তিনি আবারও বলতে পারেনঃ
‘Love is an endless mystry, For it has nothing else to explain it.’
[লেখকঃ সহযােগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, নহাটা যােগেন্দ্রনাথ মন্ডল স্মৃতি মহাবিদ্যালয়, উত্তর চব্বিশ পরগণা, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত]
সহায়ক গ্রন্থঃ
১. ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ, গীতাঞ্জলী, কলকাতা বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ, ১৪১৯ বঙ্গাব্দ
২. ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ, সঞ্চয়িতা, কলকাতা বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ, ১৪২০ বঙ্গাব্দ
৩. গােল্ডেন বুক অব টেগাের, সত্তর বর্ষ পূর্তি উপলক্ষ্যে প্রকাশিত রবীন্দ্র-স্মারক গ্রন্থ, ১৯৩১
৪. সেন, প্রিয়রঞ্জন, ওয়েস্টার্ন ইনফ্লুয়েন্স ইন বেঙ্গলি, লিটারেচার, ইউনিভার্সিটি অব ক্যালকাটা, ১৯৩২
৫. রাধাকৃষ্ণন, এস., দ্য ফিলসফি অত্ রবীন্দ্রনাথ টেগাের, ম্যাকমিলান অ্যান্ড কম্পানি, লন্ডন, ১৯১৮
৬. মনসুর, আবুল, রবীন্দ্র চিত্রাবলী, পুনর্নিরীক্ষণের আলােকে, প্রথম আলাে, মে ২০১৬
৭. রিদয়ের ব্লগ, শার্ল বােদলেয়ারের কবিতা(বুদ্ধদেব বসুর অনুবাদ),
https://sakibhasanhridoy.wordpress.com, জানুয়ারী ২০১৪,
৮. মুখােপাধ্যায়, তরুণ, নগ্নতা ও রবীন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ : প্রয়ােজনে-অপ্রয়ােজনে, সহযাত্রী, কলকাতা, | বৈশাখ ১৪১৯
৯. সাহিত্যসুধা, শার্ল বােদলেয়ারের কবিতা (বুদ্ধদেব বসুর অনুবাদ),
https://sahityosudha.wordpress.com, জুলাই ২০১৫
১০. অধিকারী, সুশােভন, শিল্পে নগ্নতা: সাম্প্রতিক ভাবনা, অন্যপত্র, https://anyapatra.com, সেপ্টেম্বর ২০১৪।
১১. চক্রবর্তী, ড. জগন্নাথ, গীতাঞ্জলি’ অস্তিত্ব, বিরহ, আনন্দ পাবলিশার্স, প্রথম সংস্করণ, ডিসেম্বর, ১৯৮৮
১২. অবনীন্দ্র রচনাবলী, ১ম ও ২য় খন্ড, কামিনী প্রকাশালয়, ২০১২
১৩. অধিকারী, সুশােভন ও ডাইসন, কেতকী কুশারী, রঙের রবীন্দ্রনাথ, কলকাতা, ১৯৯৮
১৪. সােম, শােভন, টেগাের্স পেন্টিংস : ভার্সিফিকেশন ইন লাইন (ভূমিকা: পবিত্র সরকার), নিয়ােগী বুকস্।
১৫.হাসনাত, আবুল, (ভূমিকা), রবীন্দ্র চিত্রকলা, ছায়ানট, জানুয়ারী, ২০১১
১৬. চট্টোপাধ্যায়, মঙ্গলাচরণ, (অনুবাদ), নির্বাচিত রচনাবলীঃ আলেক্সান্দার পুশকিন
১৭. Achala Moulik, Pushkin’s Last Poem, Paperback, 1st Edition, 2008
১৮. H. Stacy, Robert, India in Russian Literature, Shri Jatidra Press, 1st Edition, Delhi, 1985
১৯. Kowshik, Dinkar, Doodled Fancy, Rabindra Bhavan, Viswa Bharati, August, 1999
২০. প্রতিমা দেবী, গুরুদেবের ছবি, নির্বাচিত প্রবন্ধ সংগ্রহ ১৯৪২-২০০৩, প্রসঙ্গ রবীন্দ্রনাথ, অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য, বিশ্বভারতী পত্রিকা, কলকাতা, আগস্ট, ২০০৫