লিখেছেনঃ মুহাম্মাদ আব্দুল আলিম
স্বাধীনতা সংগ্রামের অতন্দ্র প্রহরী মাওলানা উবাইদুল্লাহ সিন্ধী ১৮৭২ খ্রীষ্টাব্দের ১০ই মার্চ পাঞ্জাবের শিয়ালকোট জেলার চেপানওয়ালী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বংশগতভাবে তাঁর পুর্বপুরুষেরা ছিল কর্মকার বা হিন্দু ধর্মাবলম্বী। পরে তিনি শিখ ধর্ম গ্রহণ করেন। ১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দে মাত্র ১২ বছর বয়সে শাহ ইসমাইল শহীদ দেহলবী (রহঃ) এর প্রণীত গ্রন্থ ‘তুফহাতুল হিন্দ’ বা ‘হিন্দুস্থানের উপহার’ নামক গ্রন্থটি পড়ে অত্যন্ত প্রভাবিত হন এবং ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হন। পরে তিনি শাহ ইসমাইল শহীদের তাওহীদের অমর গ্রন্থ ‘তাকবীয়াতুল ঈমান’ পড়েন। পরবর্তীকালে তিনি ‘আহওয়াতুল আখেরাত’ নামক গ্রন্থটি পড়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। যেহেতু ‘আহওয়াতুল আখেরাত’ নামক গ্রন্থটির লেখকের নাম উবাইদুল্লাহ তাই তিনি লেখকের নামানুসারে নিজের নামও রাখেন উবাইদুল্লাহ।
পারিপার্শ্বিক প্রতিকূলতার কারণে তিনি প্রথমে তাঁর ইসলাম গ্রহণের সংবাদ গোপন রাখেন। দুই বছর পর তিনি ইসলাম গ্রহণের সংবাদ সবার সম্মুখে প্রকাশ করেন। এরপর সিন্ধের আধ্যত্মিক রাহবার সায়্যিদুল আরেফীন হযরত হাফেজ মাওলানা মুহাম্মাদ সিদ্দিক ভারজুন্ডির খিদমতে হাজির হন এবং তাঁর কাছে আধ্যাত্মিকতার দীক্ষা গ্রহণ করেন। সেখানে তিনি ইসলাম গ্রহণের চার বছর অতিক্রম হতে না হতেই তিনি জগদ্বিখ্যাত আধ্যাত্মিক ও বিপ্লবী এলাকা রহীমইয়ার খানের দ্বীনপুর গ্রামে উপস্থিত হন। সেখানে মাওলানা উবাইদুল্লাহ সিন্ধী তৎকালীন সবচেয়ে শীর্ষস্থানীয় আলেম খাজা গোলাম মুহাম্মাদ সাহেব দ্বীনপুরীর কাছ থেকে দ্বীনি কিতাবাদীর শিক্ষা গ্রহণ শুরু করেন। এরপর মাওলানা উবাইদুল্লাহ সিন্ধী ১৮৯৯ খ্রীষ্টাব্দে দারুল উলুম দেওবন্দে পৌঁছেন এবং সেখানে শায়খুল হিন্দ মাওলানা মাহমুদুল হাসান দেওবন্দীর কাছে হাদীস শিক্ষা সমাপন করেন। মাওলানা উবাইদুল্লাহ সিন্ধী ছিলেন শায়খুল হিন্দের প্রিয় ছাত্রদের অন্যতম। একদিন মাওলানা উবাইদুল্লাহ সিন্ধী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) ও ইমামে আযম আবু হানীফা (রহঃ)কে স্বপ্নে দেখেন। মাওলানা উবাইদুল্লাহ সিন্ধী প্রায়ই বলতেন, শায়খুল হিন্দের সাক্ষাত লাভের পর কয়েক দিনের মধ্যেই আমার মন-মস্তিস্কে আন্দোলনের চিন্তা-চেতনা ব্যাপকভাবে নাড়া দেয়। আর এতে সবচেয়ে বেশী কার্যকারী ভূমিকা পালন করে হযরত শাহ ইসমাইল শহীদ দেহলবী (রহঃ) এর জীবনী গ্রন্থ পাঠের প্রভাব ছিল সবচেয়ে বেশী। মাওলানা উবাইদুল্লাহ সিন্ধী অভূতপূর্ব মেধা এবং অতুলনীয় স্মৃতিশক্তির অধিকারী ছিলেন। মাওলানা উবাইদুল্লাহ সিন্ধী শায়খুল হিন্দের কাছে এবং কুতুবে রাব্বানী হযরত মাওলানা রশীদ আহমদ গাঙ্গোহীর নিকটও হাদীসের শিক্ষা গ্রহণ করেন এবং সনদ প্রাপ্ত হন। শেখর ইসলামীয়া স্কুলের শিক্ষক মাওলানা মুহাম্মাদ কাজিম খান ইউসুফজাই এর কন্যার সাথে তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।
মাওলানা উবাইদুল্লাহ সিন্ধী (রহঃ) এর ব্যাপারে শায়খুল হিন্দ মাহমুদুল হাসান দেওবন্দীর অধ্যায়ে কিছুটা হলেও আলোচনা করা হয়েছে, কেননা উক্ত দুই বুযুর্গের রাজনৈতিক জীবন এমন ওতপ্রাতভাবে জড়িত যে একজনের আলোচনা করলে অন্যজনের নাম স্বাভাবিকভাবেই চলে আসে। তাই আমরা এখানে মাওলানা উবাইদুল্লাহ সিন্ধীর বাকি রাজনৈক কার্যকলাপ সম্পর্কে আলোচনা করব।
মাওলানা উবাইদুল্লাহ সিন্ধী ১৯০১ খ্রীষ্টাব্দে ‘শেখরে দারুল এরশাদ’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। এবং ১৯০৯ খ্রীষ্টাব্দে তিনি শায়খুল হিন্দের পরামর্শে দেওবন্দে চলে আসেন এবং সেখানে তিনি প্রাক্তন দারুল উলুম দেওবন্দের ছাত্রদের নিয়ে ‘জমিয়াতুল আনসার’ নামে একটি ছাত্র সংগঠন গড়ে তোলেন। ১৯১৫ খ্রীষ্টাব্দের ১লা ডিসেম্বর তিনি শায়খুল হিন্দের নির্দেশে কাবুল যাত্রা করেন এবং সেখানে ব্রিটিশ বিরোধী কর্মকান্ডে তৎপর হয়ে উঠেন। সেখানে তিনি স্বাধীন ভারত সরকার গঠনে তৎপর হয়ে উঠেন। সেই সরকারের প্রেসিডেন্ট ছিলেন রাজা মহেন্দ্র প্রতাপ, প্রধানমন্ত্রী ছিলেন মাওলানা বরকাতুল্লাহ এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন মাওলানা উবাইদুল্লাহ সিন্ধী নিজে। এই স্বাধীন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য তিনি তুরস্ক, রাশিয়া ও জাপানের সাথে যোগাযোগ করেন। এবং আফগান সরকারকে তীক্ষ্ণ বুদ্ধি ও ব্যক্তিত্বের দ্বারা প্রভাবিত করেন এবং ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার অনুরোধ জানান। ব্রিটিশ শাসিত ভারতের সাথে আফগানদের যুদ্ধ বাঁধলে তিনি আফগানদের পক্ষ অবলম্বন করেন এবং ‘জুনুদুল্লাহ’ নামে নিজস্ব বাহিনী যুদ্ধে প্রেরণ করেন। মাওলানা উবাইদুল্লাহ সিন্ধীর আশ্চর্য্য কূটকৌশলে সেই যুদ্ধে ব্রিটিশদের পরাস্ত করেন। আফগানরা এই যুদ্ধে জয়লাভ করেন এবং স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত হয়। মাওলানা উবাইদুল্লাহ সিন্ধীর আশ্চর্য্য দুরদর্শীতার ফলে এই ব্যাপক সফলতা অর্জন করেন।
এই যুদ্ধের পর মিঃ টমসনকে তাঁরা ‘কুতুল উমরা’ নামক স্থানে বন্দী করে রাখেন। মিঃ টমসন পরাজয় স্বীকার করতে বাধ্য হয়। এই যুদ্ধে প্রায় ১৭০০ ব্রিটিশ সৈন্য মারা যায়। এই যুদ্ধে শায়খুল হিন্দ আফগানিস্তান, তুরস্ক ও ইয়াগীস্তান প্রভৃতি দেশের সাহায্য নিয়ে আফগানী মুজাহিদবৃন্দের সহযোগিতায় ইংরেজদেরকে নাস্তানাবুদ করে ছেড়ে দিয়েছিলেন। তৎকালীন বাংলার গভর্ণর W.W. Hunter তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘The Indian Musalman’ গ্রন্থের মধ্যে লিখেছেন,
“তারা অর্থাৎ মুসলিম মুজাহিদরা ইংরেজ সৈন্যকে কবর দিয়েছিল প্রতিটি বালুকায়।”
আফগানিস্থানের জাহির শাহ বলেন, “আমরা দেওবন্দের মনীষীদের দ্বারাই বিজয়লাভ করেছি।” ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত হামফ্রে বলতে বাধ্য হন,
“এ জয় আফগানিস্তানের নয় এ জয় উবাইদুল্লাহর জয়।”
ব্রিটিশ গোয়েন্দা রিপোর্ট থেকে জানা যায়, জুনুদুল্লাহ বাহিনীর মেজর জেনারেল ছিলেন শায়খুল হিন্দ, লেফটেন্যান্ট জেনারেন ছিলেন খেলাফত আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা শওকত আলী, মাওলানা আব্দুল বারী ফিরিঙ্গিমহলী, মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানী, মাওলানা আবুল কালাম আযাদ, হাজী তুরঙ্গজাই, ডাঃ আনসারী, মেজর জেনারেল হিসাবে সৈয়দ সুলাইমান নাদভীরও নাম পাওয়া যায়। লেফটেন্যান্ট কর্ণের হিসাবে নাম পাওয়া যায় মাওলানা জাফর আলী, কর্ণেল হিসাবে মাওলানা ইবরাহীম শিয়ালকোটীরও নাম পাওয়া যায়। ব্রিটিশ গোয়েন্দা রিপোর্ট থেকে আরও যেসব ব্যক্তির নাম জানা যায় তাঁরা হলেন যথাক্রমে, মাওলানা খলীল আহমদ সাহারানপুরী, আল্লামা আনওয়ার শাহ কাশ্মিরী, হাফিজ নাসীর আহমদ, মাওলানা মুহাম্মাদ মিঁয়া, মাওলানা আব্দুর রহীম, হাজী আব্দুর রাজ্জাক, আল্লাহ নাওয়াজ খান, সৈয়দ হাদী, কালা সিং প্রভৃতি ব্যক্তিবর্গ। এইসব ব্যক্তিরা মাওলানা উবাইদুল্লাহ সিন্ধীর জুনুদে রব্বানীর সাথে যুক্ত ছিলেন বলে ব্রিটিশ গোয়েন্দা রিপোর্টে জানা যায়।
ব্রিটিশ গোয়েন্দা রিপোর্টে আরও জানা যায় যে, শায়খুল হিন্দ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সরকারকে উৎখাত করার জন্য তুর্কী খলিফাকে যে চিঠি দিয়েছিলেন তাতে ‘জমিয়তে হিজবুল্লাহ’র যে স্ট্যম্প ছিল তার তারিখ ছিল ১৯১৭ খ্রীষ্টাব্দের ১৫ই আগস্ট। এই ‘জমিয়তে হিজবুল্লাহ’ গঠন হয়েছিল ১৯১৩ খ্রীষ্টাব্দে কোলকাতায় মাওলানা আবুল কালাম আযাদের পৃষ্ঠপোষকতায়। ব্রিটিশ গোয়েন্দা রিপোর্ট থেকে আরও জানা যায় যে, ভারত থেকে সংগৃহীত অর্থে মক্কা শরীফের মাদ্রাসা ‘মাদ্রাসা সাওলাতিয়া’র কিছু ছাত্র শায়খুল হিন্দের ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েছিলেন। এর দ্বারাই বুঝা যায় যে বিদেশের সাথে শায়খুল হিন্দের যোগাযোগ কত বিস্তৃত ও বিশাল ছিল। কিন্তু দুঃখের বিষয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তুরস্কের পরাজয়ের ফলে সমস্ত পরিকল্পনা একেবারেই ভেস্তে যায়। ব্রিটিশ গোয়েন্দা রিপোর্টে লেখা আছেঃ –
“মুসলমান জাতির এক অংশ তখনও (১৯১৪-১৯১৫) ইংরেজদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র আন্দোলনে লিপ্ত ছিল। জেহাদী আন্দোলনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছাড়াও আর এক দল মুসলমান বিদেশী রাষ্ট্র কাবুল ও তুরস্কের সহায়তায় ইংরেজ বিতাড়নের ষড়যন্ত্র করতো। তাঁদের নেতা ছিলেন দেওবন্দ মাদ্রাসার মাওলানা উবাইদুল্লাহ ও তাঁর সহকর্মী মাওলানা মাহমুদুল হাসান। তারা হিজাজ ও কাবুলে উপমহাদেশীয় মুসলিম প্রবাসীদের সহায়তায় ও কাবুলের আমীরের সাহায্যে বিদ্রোহ ষড়যন্ত্র করতেন।” (Sedition Committee Report, P. 174)
কাবুলে মাওলানা উবাইদুল্লাহ সিন্ধীর যাত্রা ও কাবুলের সুলতান তথা আমীর হাবীবুল্লাহর সঙ্গে সম্পর্কের ব্যাপারে তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেছেনঃ-
একটি বিষয় স্বীকার না করলে অন্যায় হবে যে, হযরত শায়খুল হিন্দের সঠিক পরামর্শ আমি না পেলে আমার কথা এত কার্যকরী হতো না। হয়ত আমি আফগান রাজদরবারে নিজেকে এক ভারতীয় মুসলমান হিসাবে পরিচয় না দিয়ে কেবল একজন মুসলমান বলেই পরিচয় দিতাম। অল্পদিন পরেই হয়তো আমাকে ভারতীয় বলে প্রমাণ করতে হতো।” (রোজনামচা, উবাইদুল্লাহ সিন্ধী)
১৯১৭ খ্রীষ্টাব্দের জুন মাসে ব্রিটিশ সরকারের নির্দেশে আমীর হাবীবুল্লাহ খান কাবুলে মাওলানা উবাইদুল্লাহ সিন্ধীকে এবং অন্যান্য বিপ্লবী দলের নেতৃবৃন্দকে নজরবন্দী করেন এবং অস্থায়ী ভারত সরকারকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। মাওলানা উবাইদুল্লাহ সিন্ধীসহ ২০/২৫ জনকে একটি ছোট্ট কুঠরীতে আবদ্ধ করে রাখা হয়েছিল। পরে সিন্ধীকে জালালাবাদে স্থানান্তরিত করা হয়। অবশ্য ১৯১৯ খ্রীষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারীতে আমানুল্লাহ খান কাবুলে ক্ষমতায় এলে দীর্ঘ ১ বছর ৮ মাস পর মাওলানা সিন্ধীকে কারামুক্ত করে কাবুলে ফিরিয়ে আনেন। এরপর তিনি ৩ বছর ৮ মাস আমানুল্লাহ খানের আস্থাভাজন হিসাবে আমানুল্লাহ সরকারের কল্যানে কাজ করে যান। এসময় তিনি অস্থায়ী ভারত সরকারের বিকল্প হিসাবে কংগ্রেসের একটি শাখা প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯১৯ খ্রীষ্টাব্দের মে ও জুনে আমানুল্লাহর সাথে ব্রিটিশ ভারতের যে যুদ্ধ হয় তাতে মাওলানা সিন্ধীর জুনুদে রব্বানীর মুজাহিদরা বীরত্বের সাথে লড়াই করে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। ফলে আমানুল্লাহ বাহিনী তাতে জয়ী হয় এবং ব্রিটিশদের পরাজয়ের মুখ দেখতে হয়। যা এর আগে বর্ণনা করা হয়েছে।
সর্বমোট ৭ বছর ৭ দিন কাবুলে অবস্থান করার পর আন্তর্জাতিক চাপের মুখে তাঁকে বাধ্য হয়ে কাবুল ছাড়তে হয়। এভাবেই তাঁর এ পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়ে যায়। আপাতদৃষ্টিতে এ আন্দোলনের যবনিকাপাত ঘটলেও মূলতঃ সে আন্দোলনই যুগে যুগে স্বাধীনতার ইন্ধন যুগিয়েছে।
এ ভাবে প্রথম পরিকল্পনা ব্যর্থ হবার পর ১৯২২ খ্রীষ্টাব্দের ২২শে অক্টোবর তিনি ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্য নতুন ক্ষেত্র তৈরীর উদ্দেশ্যে রাশিয়ার পথে যাত্রা করেন।
নেতাজী সুভাসচন্দ্র বসু ও মাওলানা উবাইদুল্লাহ সিন্ধী
মাওলানা উবাইদুল্লাহ সিন্ধী বিদেশনীতির ব্যাপারে কতখানী দুরদর্শী ও কুটনৈতিক রাজনীতিবিদ ছিলেন তা বুঝা যায় যখন তিনি নেতাজী সুভাসচন্দ্র বসুকে বিদেশে পাঠান।
নেতাজী সুভাসচন্দ্র বসু বুঝেছিলেন নরমপন্থী কংগ্রেসের সাথে থেকে পূর্ণ স্বাধীনতা লাভ করা কখনো সম্ভব নয়। তাই তিনি চরমপন্থী নীতিকে অনুসরণ করে কংগ্রেস ত্যাগ করেন। নেতাজী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান থেকে জাপানে পালিয়েছিলেন এর মূলেও ছিল মাওলানা সিন্ধীর পূর্ব অভিজ্ঞতা। নেতাজী মেজার হামিদের সহযোগিতা নিয়ে অতি গোপনে সাবমেরিনে চড়ে দেশ ত্যাগ করেছিলেন। বিদেশে যাওয়ার আগে নেতাজী মাওলানা উবাইদুল্লাহ সিন্ধীর পরামর্শকে কাজে লাগিয়েছিলেন। শায়খুল হিন্দ মাহমুদুল হাসান দেওবন্দীর নেতৃত্বে মক্কা, হেজাজ, তুরস্ক প্রভৃতি বিদেশে সংগঠন করে ভারত আক্রমণের পথ বেছে নিয়েছিলেন। অনুরুপ নেতাজীও জাপান, জার্মান, ফ্রান্স, কাবুল প্রভৃতি বিদেশী শক্তির সাহায্য নিয়ে ভারতকে আক্রমণ করার পথ বেছে নিয়েছিলেন। নেতাজীর বিদেশনীতির মূলেও ছিল মাওলানা উবাইদুল্লাহ সিন্ধীর পরিকল্পনা। নেতাজী যে ব্রিটিশদের কারাগারে নজরবন্দী থাকাকালীন মৌনব্রত পালন করেছিলেন, অসুখের ভান করেছিলেন, একাকীত্ব থাকার পথ অবলম্বন করেছিলেন তার সব পরিল্পনা ছিল মাওলানা উবাইদুল্লাহ সিন্ধীর। পরে কাবুলীওয়ালার পোষাক পরে টুপি দাড়ী ছেড়ে মাওলানা জিয়াউদ্দীন ছদ্মনাম ধারণ করে ফার্রাটেদার (চোস্ত) উর্দূ বলতে বলতে ব্যবসার নাম করে অতি সঙ্গোপনে গভীর রাত্রিতে ভাইপো শিশির কুমার বসুকে সাথে নিয়ে কারে করে জার্মানির উদ্দেশ্য দুর্গম-গিরি-কান্তার মরু দুস্তরভাবে পড়ি দেন তার সমস্ত পরিকল্পনা ছিল মাওলানা উবাইদুল্লাজ সিন্ধী দেওবন্দীর। নেতাজীর মাওলানা জিয়াউদ্দীন ছদ্মনাম দিয়েছিলেন মাওলানা সিন্ধী নিজে।
মাওলানা উবাইদুল্লাহ সিন্ধী এটা বুঝতে পেরেছিলেন যে বৈদেশীক আক্রমণের মাধ্যমেই ব্রিটিশদের এদেশ থেকে তাড়ানো সম্ভব। তাই তিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধকে হাতিয়ার বানিয়ে তুরস্কের সাহায্য নিয়ে ব্রিটিশ ভারত আক্রমণ করার পরিকল্পনা করেছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ বিশ্বাসঘাতকদের ষড়যন্ত্রে সব পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়। তাই উবাইদুল্লাহ সিন্ধী চেয়েছিলেন আবার বৈদেশীক আক্রমণের মাধ্যমেই ব্রিটিশ ভারকে আক্রমণ করতে। কিন্তু এটা তাঁর পক্ষে আর দ্বিতীয়বার করা সম্ভব ছিল না এবং সেরকম কোন পরিস্থিতিও ছিল না। তাই তিনি এই কাজ করার জন্য নির্বাচন করেছিলেনহ নেতাজী সুভাসচন্দ্র বসুকে। আর নেতাজীর রাজনৈতিক গুরু ছিলেন মাওলানা উবাইদুল্লাহ সিন্ধী। ঐতিহাসিক সুপ্রকাশ রায় লিখেছেন, “নেতাজীকে যিনি পূর্ণ স্বাধীনতার মন্ত্রে দীক্ষিত করেছেন তিনি হলেন উবাইদুল্লাহ সিন্ধী। তিনিই নেতাজীর নাম দিয়েছিলেন মাওলানা জিয়াউদ্দীন। তিনিই ছদ্মবেশে প্রথমে কাবুলে তারপর বিভিন্ন দেশে পাঠান।” (ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে উলামায়ে কেরামদের অবদান, পৃষ্ঠা-২৮)
নেতাজী মাওলানা উবাইদুল্লাহ সিন্ধীর পরিকল্পনা পুরোপুরী মেনে চলেন এবং বিদেশ থেকে ব্রিটিশ ভারত আক্রমণ করাকেই শ্রেয় মনে করেন। সেজন্য মাওলানা উবাইদুল্লাহ সিন্ধী ও নেতাজী সুভাসচন্দ্র বসুর নেতৃত্বের আদর্শগত মিল দেখতে পাওয়া যায়।
উবাইদুল্লাহ সিন্ধী | নেতাজী সুভাসচন্দ্র বসু |
১। আন্দোলন করেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধে | ১। আন্দোলন করেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে |
২। অভিযান করেন-উঃ পঃ সীমান্ত | ২। অভিযান করেন-উঃ পূ সীমান্ত |
৩। সাহায্য পান-আফগান তুরস্ক | ৩। সাহায্য পান-জাপান ও জার্মানদের |
৪। কাবুলে স্বাধীন ভারত সরকার গঠন ১৯১৫, ১ লা ডিসেম্বর | ৪। সিঙ্গাপুরে স্বাধীন ভারত সরকার গঠন ১৯৪৩, ২১ অক্টোবর |
৫। নিজ বাহিনীর নাম জুনুদুল্লাহ | ৫। নেতাজীর আজাদ হিন্দ ফৌজ |
৬। প্রেসিডেন্ট ছিলেন রাজা মহেন্দ্র প্রতাপ | ৬। কর্ণেল আবিদ হাসান, জেনারেল শাহনাওয়াজ |
সুতরাং উলামায়ে দেওবন্দ উপহার দিয়েছেন নেতাজী সুভাসচন্দ্র বসুর মত একজন দেশপ্রেমী নেতা ।
মাওলানা উবাইদুল্লাহ সিন্ধী দীর্ঘ ২৫ বছর কারাগারে জীবন অতিবাহিত করেন। যখন তাঁকে জেলে বন্দী করা হয় তখন তার দাড়ি গজায় নি কিন্তু যখন তিনি জেল থেকে ছাড়া পান তখন তাঁর দাড়ি পেকে সাদা হয়ে গিয়েছিল। তিনি দেশের জন্য যে আত্মবলীদান দিয়েছেন তাতে ভারতবাসী তাঁকে কোনদিন ভুলতে পারবে না।
শায়খুল হিন্দ মাওলানা মাহমুদুল হাসান দেওবন্দীকে মাল্টার জেল থেকে মুক্ত করার দশ বছর পর তাঁকে দেশের মাটিতে আনা হয়। যতদিন শায়খুল হিন্দ জীবিত ছিলেন ততদিন মাওলানা সিন্ধীকে দেশে ফিরতে দেওয়া হয় নি। কারণ ব্রিটিশ বেনিয়ারা জানত শায়খুল হিন্দ ও মাওলানা সিন্ধী একত্রে থাকলেই ব্রিটিশদের কাছে এক বড় বিপদ। তাই শায়খুল হিন্দ মারা যাবার পর মাওলানা সিন্ধীকে দেশে আনা হয়। মাওলানা সিন্ধীকে দেশে এনেও দিয়েও ব্রিটিশরা শান্তিতে থাকতে পারেনি। পরে বিষ পান করিয়ে হত্যা করে। তিনি ১৯৪৪ খ্রীষ্টাব্দে মারা যান। কিন্তু ব্রিটিশরা দেশবাসীকে তা জানতে দেয় নি। তিনি ১৯৪৫ খ্রীষ্টাব্দের ১লা সেপ্টেম্বর এক বছর ৯ দিন পর সরকারীভাবে স্বীকার করে যে মাওলানা সাহেব নিহত হয়েছেন। মাওলানা উবাইদুল্লাহ সিন্ধীর স্বাধীনতা সংগ্রামের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে মাওলানা আবুল কালাম আজাদ মাওলানা জহীরুল হককে একটি চিঠিতে লেখেনঃ-
স্নেহের মওলুবী জহীরুল হক
আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহ
আজাদী উপলক্ষে আপনার প্রতি প্রেরিত পত্রের জন্য শুভেচ্ছা জানাই। পত্র পড়ে স্মৃতি-পটে ভাসে শুধু মওলানা উবাইদুল্লাহ সিন্ধীর স্মৃতি। সে ঘটনা অনেক লম্বা। সংক্ষেপে করলেও যথেষ্ট সময়ের প্রয়োজন। ১৯১৪ সালের বিশ্বযুদ্ধের সময় শাহ ওয়ালীউল্লাহর কাফেলার নেতা হযরত মওলানা মাহমুদুল হাসান (রাঃ) অত্যন্ত কঠিন পরিস্থিতিতে মওলানা ওবায়দুল্লাহ সিন্ধীকে কাবুল প্রেরণ করেন। সেখানে মওলানা ওবায়দুল্লাহ বিভিন্ন রাষ্ট্রে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে কাজ করবার সুযোগ লাভ করেন। তারমধ্যে জার্মান, ফ্রান্স ও জাপানের এমন সব কর্মী নেতা ছিলেন যাঁরা পরবর্তীকালে শাসন ক্ষমতার উচ্চ পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। ……
পঁচিশ বছর নির্বাসন দণ্ড ভোগ করে ১৯৩৯ এ তিনি যখন এখানে আসেন তখন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। তিনি তাঁর নিজস্ব পরিকল্পনা কংগ্রেসের কাছে পেশ করে সর্ব ভারতীয় সংগ্রামের প্রোগ্রাম রচনা করেন। সেই সময় গান্ধীজী পর্যন্ত ওই প্রোগ্রামের বিরোধীতা করেন। তাহলেও ‘ভারতছাড়ো’ আন্দোলনটুকু অনুমোদন লাভ করে।
দ্বিতীয় দফায় উথলা হতে দিল্লী পর্যন্ত আট মাইল সড়কের কোন একটি জন মানব শূন্য স্থানে তাঁর সঙ্গে সুভাসের দেখা হয়। তার পরের সাক্ষাৎটি হয়েছিল কলকাতার বালিগঞ্জ এলাকায়। এখানেই তিনি সুভাসকে জাপান যাত্রার জন্য রওনার ব্যবস্থা করেন। জাপান সরকারের নামে অন্তর্বর্তী কালীন সরকারের যাত্রী হিসাবে তিনি একটি পরিচয়পত্র দেন এবং সেখানকার প্রধান সেনাপতির নামে একটি ব্যক্তিগত বিশেষ বার্তা পাঠান। এই সুভাস সেখানে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে জাপান সরকারের সৈন্য বিভাগ ও তাঁর প্রতি আস্থা স্থাপন করতে পেরেছিলেন। ……
শেষ পর্যন্ত ভয়ঙ্কর বিষ প্রয়োগে মওলানা সাহেবের জীবন শেষ করা হয়।
১৯৪৫ সালের ১লা সেপ্টেম্বর পুরো এক বছর ন’দিন পর সরকারী ভাবে স্বীকার করা হয় মওলানা সাহেব নিহত হয়েছেন। স্বাভাবিক এমনি একটি বিপ্লবীকে ওজনের তুলাদণ্ডের এক পাল্লায় রেখে অন্য পাল্লায় সারা পৃথিবী চাপালেও এই বিপ্লবীর সমান হয় না। ….
আপনার সম্মানীয় মাতার প্রতি রইল আন্তরিক সালাম।
ইতি
আবুল কালাম আজাদ।
(দ্রষ্টাব্যঃ ইনসানিয়াত পত্রিকা মওলানা মোহাম্মদ তাহের, অনুবাদ-মওলানা আব্দুল কাদের/তথ্যসূত্রঃ ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে মুসলমানদের অবদান, শেখ আজিবুল হক)
মাওলানা উবাইদুল্লাহ সিন্ধী একজন ভাল লেখকও ছিলেন। নির্বাসনের পর তিনি কিছু গ্রন্থও রচনা করেন। যার মধ্যে ‘এলহামুর রহমান’ একটি উঁচু পর্যায়ের তাফসীর গ্রন্থ হিসাবে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্ । এই তাফসীরে তিনি জাতিকে ইসলামের বিপ্লবী ও জিহাদী আহ্বান নতুন আঙ্গিকে পেশ করেন। এছাড়াও তিনি ‘শাহ ওয়ালীউল্লাহ আউর উন কি সিয়াসী তাহরীক’ (শাহ ওয়ালীউল্লাহ ও তাঁর রাজনৈতিক চিন্তাধারা), ‘কুরআনী দস্তুরে ইনকিলাবী’, ‘শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলবীর দর্শন’।
মাওলানা উবাইদুল্লাহ সিন্ধী পরাধীন দেশের মুসলিমদের হুঁশিয়ার করে বলেছিলেনঃ- “তোমরা এ যে খেলনার ঘর তৈরী করেছ এবং একই বিশাল আসমান বলে বিশ্বাস করে নিয়েছ কালের প্রবাহের মুখে এ টিকে থাকতে পারে না। তোমাদের অর্থনীতি সব কিছুর মধ্যে ঘুণ ধরেছে। তোমরা একেই ইসলামী সভ্যতা নাম দিয়েছ, কিন্তু এতে ইসলামের কোন চিহ্ন নেই। তোমরা তোমাদের গোঁড়ামিকেই মাজহাবের নামে চালিয়ে নিচ্ছ। মুসলমান হতে চাও তো ইসলাম কি, সে আগে বোঝ। তোমরা যাকে ইসলাম বলছ, ইসলামের সাথে তার কোন সম্পর্ক নেই। তোমাদের নেতৃবৃন্দ পদমর্যাদা লোভী। তোমাদের শাসকবৃন্দ ভোগ বিলাসী এবং তোমাদের জনসাধারণ বিভ্রান্ত। জাগো পরিবর্তন আনো। নতুবা যুগ তোমাদের চিহ্ন মিটিয়ে দেবে।”
মৃত্যুশয্যায় হযরত মাওলানা উবাইদুল্লাহ সিন্ধী (রহঃ) বলেছিলেন, “আমি পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে সফর করেছি। সর্বত্রই বলিষ্ঠ কন্ঠে মুক্তির শ্লোগান দিয়েছি। পাহাড়-পর্বত, গুহা, মাঠ, জঙ্গল, নদী-সাগর, এক কথায় সর্বত্রই জীবনের বিস্বাদ ও তিক্ত রাত্রি যাপন করেছি। তুরস্ক, আফগানিস্তান, রাশিয়া, চীন ও হেজাজ, যেখানেই গিয়েছি সেখানেই মুসলমানদের উপর ইংরেজ তথা ইহুদী খ্রীষ্টান অমুসলিম পশুদের পৈশাচিক নির্যাতনের চিত্র দেখেছি।
আমার চিন্তা শক্তি আহত, আমার কলিজা রক্তাক্ত, আমার চিন্তা-চেতনা বিপর্যুস্ত, কাজেই আমি কোথা হতে আযাদীর দুস্প্রাপ্ত সম্পদ তোমাদেরকে দিবো।
তোমরা আমাকে আমার অবস্থায় ছেড়ে দাও। মুনাফিক, প্রতারক ও ধুর্তরা আমার শায়খুল হিন্দ (রহঃ) – এর এই আন্তর্জাতিক আন্দোলনকে নস্যাৎ করে দিয়ে জাতিকে একটি দীর্ঘ সময়ের জন্য দাসত্বের জিঞ্জির পরিয়ে দিয়েছে। যা আমার অস্তিত্বের ক্রন্দন এবং আহাজারীর নমূনা হয়ে রয়েছে। কোন মানুষের প্রতি আমার আকর্ষণ নেই। কোন আহার্য আমার ভাল লাগে না। কোন কিছুতেই আমি শান্তি পাচ্ছি না। তারা আমার দেহ-মনকে দীর্ণ-বিদীর্ণ করে আমাকে যেন জন মানবহীন প্রান্তরে ছেড়ে দিয়েছে।” [তথ্যসূত্রঃ আকাবিরদের জিহাদী জীবন, মাওলানা জিয়াউর রহমান ফারুকী শহীদ (রহঃ), পৃষ্ঠা – ৮৪]