লিখেছেঃ কৌশিক রায়
‘আরবি সাহিত্য’-এই দুটি শব্দ যখনই উচ্চারিত হয়, তখনই আমাদের বৌদ্ধিক মনশ্চক্ষে ভেসে ওঠে নবী হজরত মোহাম্মদ-এর মুখনিঃসৃত ‘হাদীস’-এর চিরায়ত উপদেশাবলী, কুরআন-শরিফের মানবতাবাদী, অসাম্প্রদায়িক, শাশ্বত ধর্মতত্ত্ব, ওমর-খৈয়াম-এর রোম্যান্টিক স্বপ্নবেশের কাব্যিক রুবাইয়াৎ, সৌদি আরবীয় রাআব আল-খালি মরু প্রান্তর, জনকীর্ণ মক্কা-রিয়াধ-জেড্ডা শহর পেরিয়ে বিশ্বের সর্বত্র, মোহাবিষ্ট জনমানসে চিরস্থায়ী আসন করে নেওয়—শাহজাদী শেহরাজাদ-এর কথিত, ‘আরব্য রজনী’ বা ‘আলেফ লায়লা’-র পৃষ্ঠায় সজীব হয়ে ওঠে নাবিক সিন্দবাদ, সং আলিবাবা, অসৎ কাসেম, বাগদাদের বাদশা হারুন-অল-রশিদের প্রজাকল্যাণের অমর কিসসা। তবে, আধুনিক সাহিত্যে ইংরেজ সাহিত্যিক উইলিয়ম শেকসপীয়র বা ডোরিস লেসিং, স্পেনীয় সাহিত্যিক গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ, ওক্রাভিও পাজ এবং মিগেল থেরভান্তেস, সোভিয়েত সাহিত্যিক মাক্সিম গোর্কি, লিও তলস্তয়, আলেক্সান্দার পুশকিন, অস্ট্রেলিয় সাহিত্যিক প্যাট্রিক হোয়াইট ও টমাস বোনেনি ও জার্মান সাহিত্যিক হের্টা মুয়েলার, টমাস মান বা ভলফ গাংফন গ্যেয়টে-র সামনে অনেকটাই নিষ্প্রভ হয়ে পড়েছেন আরবি দুনিয়ার কবি-সাহিত্যিকরা। এর পিছনে অবশ্যই কিছুটা প্রভাব আছে রাজনৈতিক অন্তর্ঘাত, একনায়কোচিত স্বৈরশাসন এবং লিঙ্গ বৈষম্যের। যদিও প্রকৃত ইসলামিয় শরিয়তে এই অপকর্মের বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ করা হয়েছে। তবে একমাত্র যে মানুষটির জন্য সমকালীন আরবি সাহিত্য সৌদি আরব থেকে ইয়েমেন, আলজিরিয়া থেকে মরক্কো, নাইজিরিয়া থেকে সোমালিয়া পর্যন্ত গর্বে আপ্লুত হয়ে উঠতে পারে, তিনি হলেন নোবেল পুরস্কার জয়ী একমাত্র আরবি সাহিত্যিক-মিশর বা সংযুক্ত আরব প্রজাতন্ত্রে জাত, প্রয়াত নাগিব মাহফুজ।

প্রখ্যাত ইংরেজ সাহিত্যিক উইলিয়ম সমারসেট ম্যম রচিত উপন্যাস—‘দ্য মুন অ্যাণ্ড দ্য সিক্সপেন্স’ এবং ছোট গল্প—‘দ্য লোটাস ইটারস’এ দৃষ্ট অস্তিত্ববাদী দর্শন বা Existential Philosophy বারংবার পরিলক্ষিত হয়েছে নাগিব মাহফুজ-এর ২৪টি উপন্যাস, ৪০০টি ছোট গল্প এবং নাটকগুলিতে। আসলে, রাজা ফারুখ-এর স্বৈরতন্ত্র, জগলুল পাশার-র দেশপ্রেম, রাষ্ট্রপতি আনওয়ার সাদাতের নিধন, হোসনি মুবারকের স্বেচ্ছাচারী শাসক হয়ে ওঠা, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে মিশরকে তুরুপের তাস বানিয়ে উইনস্টন চার্চিল, ফ্রাংকলিন রুজভেল্টের মিত্রশক্তি এবং হিটলার মুসোলিনির নৌশক্তির রেষারেষি, জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন, সুয়েজ খাল এবং আসওয়ান বাঁধ নির্মাণে রাষ্ট্রপ্রধান গামাল আব্দেল নাসের-এর প্রাধান্য এই সবকিছুই বাস্তব সাহিত্যাঙ্গনকে গড়ে তুলতে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল ১৯১১ সালে কায়রোর ফাতিমিদ শহরতলীতে জন্ম নেওয়া নাগিব মাহফুজকে। ৬ ভাইবোনের সাথে কায়রো, বাওয়িতি-আল-কোয়াদি এবং আব্বাসেইয়াতে বেড়ে ওঠেন মেহফুজ। ইংরেজ ঔপন্যাসিক টমাস হার্ডি-র উপন্যাসগুলিতে যেমন বর্ণিত, গ্রাম্য মাটির ক্যাস্টারব্রিজ ওয়েসেক্স প্রাধান্য পেয়েছে, রসিপুরম কুরুপ্পস্বামী নারায়ণের লেখাতে যেমন সজীব হয়েছে মালগুডি, তেমনি নাগিব মাহফুজের লেখাতেও বারংবার ফিরে এসেছে তার শৈশব-কৈশোরকে পরিশীলিত করা ওই স্থানগুলি ও তাদের আমজনতার সুখ-দুঃখ। আসলে মাহফুজ-এর পিতা আব্দেল আজিজ এব্রাহিম এবং নিরক্ষর মা ফাতিমা মাহফুজকে ছোটবেলা থেকেই শিখিয়েছিলেন ইসলামি শরিয়তের মূলনীতি হলো বর্ণ-জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সমস্ত মানুষকে ভালোবাসা, তাদেরকে নিয়ে লেখা। সেজন্যই মিশরের রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে ১৯১৯ সালের গণবিপ্লব এবং স্বদেশীয় তাওফিক-এল-হাকিম, হাফিজ নাজিব, তাহা হুসাইন এবং মহিলা লেখিকা সালামা মুসা-র জনমুখী এবং অন্ত্যজ গোকেন্দ্রিক রচনা নাগিব মাহফুজকে অত্যন্ত অনুপ্রাণিত করেছিল। কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকস্তরে দর্শন নিয়ে পড়াশোনা করার মাধ্যমে মাহফুজ ক্রমশই আত্মস্থ করেন ইমাম গাজ্জালী, ইম্যানুয়েল কান্ট, আর্টর শ্যোপেনহাওয়ার, স্বামী বিবেকানন্দ, শংকরাচার্য, ডেভিড হিউম, রেনে দেকার্তে-মানবকেন্দ্রিক দর্শনের নির্যাসকে। বেদ ও উপনিষদের সেই অমোঘ, শাশ্বত ব বাণীটিকে মনে রেখে সাহিত্যের ছায়াবীথিতে বিচরণ করতেন মেহফুজ-‘সৰ্ব্বে সত্তা সুখিনা হন্তু; সৰ্ব্বে সন্তু নিরাময়াঃ; মা ক্কচিৎ দুঃখভাগভবেৎ’—পৃথিবীর প্রতিটি জীব চিরসুখী, চির আরোগ্য হোক।
সেজন্যই ইংরেজ, নোবলজয়ী কবি টমাস স্টেয়ানর্স এলিয়ট-এর নিরাশাবাদী, বিশ্বযুদ্ধোত্ত ‘দ্য হলো ম্যান’, ‘দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড’‘জেরোনশিওন’ এবং ‘অ্যাশ ওয়েডেনসডে’ কবিতাগুলিকে পাঠ করতে চাননি নাস্তাইব মেহফুজ। ‘আল-রিসালাহ’ আর ‘আল-আহরম ’সংবাদপত্রে কর্মরত থাকার সময় তিনি সবসময় খুঁজে বেড়াতেন মানবসমাজে সমৃদ্ধি, সম্প্রীতি ও সততার উৎসগুলিকে। মিশরের সরকারি আমলা হয়ে, সংস্কৃতি মন্ত্রকের কর্তাব্যক্তি হয়েও অহমিকা ছেড়ে ভূমিপুত্র-কন্যাদের জীবনচর্চা করতেই বেশি পছন্দ করতেন নাগিব মাহফুজ। তার প্রতিটি রচনার মধ্যেই যেন অনুরণিত হতো সাগরপাড়ের গণহিতৈষী, বিদ্রোহী কবির মন্ত্রিত বাক্য-মিথ্যা শুনিনি ভাই/এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোনো মন্দির কাবা নাই।
৭০ বছরের সুদীর্ঘ সাহিত্যিক জীবনে নাগিব মাহফুজসবচেয়ে বেশি খ্যাতি অর্জন করেছেন ‘কায়রো ট্রিলজি’ নামে তিন খণ্ডের একটি উপন্যাস লিখে। এই মহাকাব্যীয় গ্রন্থে বিধৃত আছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের রুধিরোক্ত সময়সারণী থেকে ১৯৫২ সালে সামরিক অভুত্থানে (Coup d’état) ক্ষমতাচ্যুত রাজা ফারুখের সময় পর্যন্ত আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক দোলাচলের এক সজীব বিররণ। গ্রন্থটির সাথে অনায়াসে তুলনা করা চলে জার্মান ঔপন্যাসিক এরিখ মারিয়া রেমার্ক-এর প্রথম বিশ্বযুদ্ধমূলক পটভূমিতে রচিত উপন্যাস ‘অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট’ এবং সোভিয়েত লেখক নিকোলাই ওস্ত্রোভস্কি-র ‘ইস্পাত’ উপন্যাসটির। আল-আহরাম কাগজে নাগিব মাহফুজের বেশ কয়েকটি ছোট গল্প এবং উপন্যাস ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। ‘দার-এল-মা’ রাফ প্রকাশনা সংস্থা থেকে মেহফুজ-এর অনেকগুলি লেখা প্রকাশিত হয়।

প্রাচীন মিশরের ফারাও-প্রধান সময়কাল থেকে আধুনিককাল পর্যন্ত ঘটনাবলীকে নিয়ে এবং রাজধানী কায়রোর অলি-গলি, নৈশ ব্যভিচারকে উপজীব্য করে ‘আবাথ আল-আদার’ (ভাগ্যের পরিহাস), ‘র্যাডোপসিস’, কিফাহ তিবাহ (থিবস নগরীর সংগ্রাম)-এর মতো উপন্যাস লিখেছেন নাগিব মাহফুজ। এই রচনাগুলির মধ্যে বারংবার মাথা তুলেছে। সমাজতান্ত্রিকতা, আধ্যাত্মিকতা এবং সমকামিতা। ইতিহাসাশ্রিত উপন্যাস রচনার ক্ষেত্রে নাগিব মাহফুজ প্রভাবিত হয়েছিলেন ইংরেজ ঔপন্যাসিক স্যার ওয়াল্টার স্কট রচিত ‘রব রয়’, ‘আইভ্যানহো’ ও ‘দ্য ট্যালিসম্যান’, ফরাসি ঔপন্যাসিক আলেজাঁদ্রে দ্যুমা-র’ ‘দ্য থ্রি মাস্কেটিয়ার্স এবং ‘ম্যান ইন দ্য আয়রন মাস্ক’, লিও তলস্তয়ের ‘ওয়ার অ্যান্ড পিস’, ‘লিউ ওয়ালেস-এর ‘বেন হুর’ও ‘দ্য ফেয়ার গড’ এবং জর্জ বুলওয়র লিটন-এর ‘দ্য লাস্ট ডেজ অব পম্পেই’-এর মতো উপন্যাসগুলির সুবিশাল ঘটনা ও চরিত্র সম্মেলনের দ্বারা।
প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সংস্কৃতি-সাহিত্যের মেলবন্ধন হওয়াটা যে বিশ্বায়ন এবং বিশ্ব মানবতার পক্ষে অতীব প্রয়োজনীয়, সেটা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সোভিয়েত সাহিত্যিক আইভান তুর্গেনেভ, আইরিশ লেখকদ্বয় উইলিয়ন বাটলার ইয়েটস এবং জেমস জয়েস, ফরাসি চিন্তাবিদ মার্সেল প্রস্ত ও চেক লেখক ফ্রাজ কাকা-র মতোই বিশ্বাস করতেন নাগিব মাহফুজ। ছোটগল্পগুলিতে তিনি কিন্তু বারংবার আমাদেরকে সতর্ক করে দিয়েছেন–পশ্চিমি দুনিয়ার অন্তঃসারশূন্য বৈভব এবং অযৌক্তিকবিলাসিতার পদলেহী না হতে। ‘কায়রো ট্রিলজি’-র কেন্দ্রীয় চরিত্র-এল সৈয়দ আহমেদ আবদেল গাওয়াদ-এর মধ্যেও সেই বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়েছে। জন গলসওয়ার্দি-র ‘দ্য ফরসাইট সাগা’-র কেন্দ্রীয় চরিত্র জেমস্ ফরসাইট-এর মতোই এই চরিত্রটিও যেন এক পূর্ণাঙ্গ জীবননাট্যের দর্শক।
নাগিব মাহফুজ কর্নেল গামাল আবদেল নাসের-এর সমালোচনা করে ‘থারথারা ফাওক আল-নীল’ (নীলনদে ভাসমান) নামক উপন্যাসটি লেখেন। ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে।নাসেরের পরোক্ষ স্বৈরাচারে মোটেই খুশি ছিলেন না তিনি। রাষ্ট্রপতি আনওয়ার সাদাতের সময়ে উপন্যাসটি চলচ্চিত্রায়িত হয়। তবে ১৯৫৯ সালে মাহফুজ-এর লেখা—‘চিলড্রেন অব দ্য গেবেলাউয়ি’ নামক গ্রন্থটিই । তাঁকে ১৯৮৮ সালে নোবেল পুরস্কার এনে দেয়। বাস্তব, ধর্ম এবং উপকথার সংমিশ্রণে ঠিক যেন এক ‘যাদু বাস্তব’ বা Magic Realism, এই উপন্যাসটিতে নাগিব মাহফুজ গড়ে তোলেন কেইন, অ্যাবেল, মোজেস, যীশু (ঈশ) এবং মোহাম্মদ-এর মতো চরিত্রগুলির মধ্যে দিয়ে অনেকটা মার্কেজের ‘হান্ড্রেড ইয়ারস অব সলিচুড’ গ্রন্থটির মতো। প্রধান চরিত্র গেবেলাউয়ির সন্তানদের মধ্যে ক্ষমতা আর উত্তরাধিকারের বংশানুক্রমিক সংঘাত, যেন বিভিন্ন ফারাও নিয়ে। বিশ্বে আবহমানকালব্যাপী রাজনৈতিক সংঘর্যের প্রতিষ্ঠা হয়ে উঠেছে। চরিত্রগুলির মধ্য দিয়ে বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে সমন্বয়সাধন করারও চেষ্টা করেছেন নাগিব মাহফুজ। তবে, বইটিতে ঈশ্বরনিন্দা করা হয়েছে এবং ইহুদি ধর্মের প্রচারক মোজেস (মুসা) এবং আব্রাহামের (এব্রাহিমের) প্রশংসা করা হয়েছে এই ওজুহাতে একমাত্র লেবানন ছাড়া গোটা আরব দুনিয়াতে একসময় নিষিদ্ধ হয় এই অসাধারণ উপন্যাসটি। তবুও দমানো যায়নি প্রতিবাদী মাহফুজকে। ‘দ্য থিফ অ্যান্ড দ্য ডগস’ উপন্যাসে একজন মাকর্সবাদী চোরের জীবনীকে বিবৃত করে তিনি দেখালেন ধর্মের নামে কীভাবে আচার সর্বস্বতাকে মেনে নিয়ে মানবতাবাদকে হত্যা করা হচ্ছে। সোভিয়েতের বিতর্কিত লেখক আলেক্সান্দার সোলজহেনিৎসিন-এর ‘গুলাগ আর্কিপেলাগো’ এবং ‘ক্যান্সার ওয়ার্ড’, হ্যাঙ্গেরিয় লেখক আর্তুর কোয়েসলার-এর ‘ডার্কনেস অ্যাট নুন’ উপন্যাসের মতোই ‘মিরামার’ উপন্যাসে তদানীন্তন স্বদেশীয় রাজনীতির কঠোর সমালোচনা করেন নাগিব মাহফুজ। ‘আখেনাতন দ্য জুয়েলার ইন টুথ’ বইটিতে মাহফুজ প্রাচীন ধর্ম এবং আধুনিক অস্তিত্ববাদের মধ্যে সংঘর্ষকে দেখিয়েছেন। আরব্য রজনীর লাস্য ও রহস্যময়তাকে পুনরুজ্জীবিত করা হয়েছে মাহফুজের ‘অ্যারাবিয়ান নাইট্স অ্যান্ড ডেজ’ উপন্যাসটিতে এবং ‘দ্য জার্নি অব ইবনে ফাতৌমা’-তে।
ইংরেজ রোম্যান্টিক ও ভিক্টোরিয় কবি রবার্ট ব্রাউনিং-এর মতোই বিভিন্ন সৃষ্ট চরিত্রের মুখে স্বগতোক্তি সংলাপ (Dramatic Monologue) ব্যবহারের পক্ষপাতী ছিলেন নাগিব মাহফুজ, যাতে করে সমকালীন জনমানসের আশা এবং আক্ষেপ প্রকাশিত হয় তার লেখার মধ্যে ইসলামিয় মৌলবাদকে সমূলে উৎপাটন করতে হলে নবী মোহাম্মদ স. অনুসৃত সমাজহিতৈষণা এবং সমন্বয়ী গণতান্ত্রিকতার প্রয়োজন আছে, সেটা ২য় বিশ্বযুদ্ধের পর মিশরে গড়ে ওঠা ‘ওয়াফাদ’ রাজনৈতিক দলকে সমর্থনের মাধ্যমে এবং ‘আল-খালিলি’ ও ‘নিউ কায়রো’ নামক দুটি উপন্যাস রচনার মাধ্যমে প্রকাশ করেছিলেন মাহফুজ। মূলত আরবি ভাষাতেই বেশিরভাগ লেখা তাঁর, যাতে আরবি দুনিয়াতে সকলে তাঁর সাহিত্য ও রাজনৈতিক ভাবনাকে বুঝতে পারেন। ‘মিররস’ নামক একটি আধা-আত্মজীবনীমূলক উপন্যাসে মাহফুজ সনাতনপন্থী ইসলামিক ব্রাদারহুড দলের প্রধান সৈয়দ কুতুব-এর একটি নেতিবাচক চরিত্র এঁকেছিলেন। তালিবান দলনেতা গুলবুদ্দিন হেকমাতিয়ার এবং আল-কায়েদা-র উগ্রপন্থী প্রধান প্রয়াত ওসামা বিন লাদেনকেও ইসলামিয় মানবনীতির বিরোধী হিসেবে সরাসরি সমালোচনা করতে ছাড়েননি নাগিব মাহফুজ। এরজন্য ১৯৯৪ সালে ঠিক তাঁর কায়রোস্থিত বাসভবনের বাইরেই পিঠে ছুরিকাঘাত করে মিশরের উগ্রপন্থী নেতাও ‘অন্ধ শেখ’ নামে কুখ্যাত ওমর আব্দুল রহমান-এর পোষ্য আততায়ীরা। ইসলামিয় উগ্রপন্থীদের মৃত্যু তালিকাতেও দীর্ঘদিন মাহফুজের নাম ছিল।
মাহফুজ তার বিভিন্ন প্রবন্ধের মাধ্যমে লেখক সমাজে বাকস্বাধীনতার প্রাসঙ্গিকতাকে তুলে ধরেন। চার্লস ডিকেন্সের ডেভিড কপারফিল্ড এবং অলিভার টুইস্ট, হ্যারিয়েট বীচার স্টোরি-র সৃজিত কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাস টমকাকা, হাওয়ার্ড ফাস্ট-এর লেখনীতে আবার জীবন্ত হয়ে ওঠা রোমান দাস বিদ্রোহের নেতা স্পার্টাকাস, নাইজেরিয় লেখক চিনুয়া আচেবের স্বাধীনচেতা, ঔপনিবেশিকতাবাদ বিরোধী চরিত্র ওকোংকোকে এই জন্যই যথেষ্ট শ্রদ্ধা করতেন মাহফুজ। নোবেল পুরস্কার কমিটিও স্বীকার করেছিলেন নাগিব মাহফুজ-এর সাহিত্য-অলংকার, ছান্দসিক গদ্য, অন্তর্লীন অনুসন্ধিৎসা এবং সমাজমুখীনতা যেন পিছিয়ে পড়া মানব সমাজের প্রতিবাদ, আবেগ, হাসি-কান্নার অনপনেয় দেওয়াল লিখন হয়ে উঠেছে। ২০০৬ সালে নাগিব মাহফুজের প্রয়াণ পর্যন্ত, শেষে কয় বছর এই কৃতবিদ্য, নিরভিমানী, জনদরদী, অসাম্প্রদায়িক রচনাকারের ছায়াসঙ্গী ছিলেন আইনজীবী নাবিল মৌনির হাবিব। মৌনির বিশাল গ্রন্থাগার থেকেই মাহফুজ তার বিভিন্ন রচনার উপাদান সংগ্রহ করেছেন। প্রিয় সাহিত্যাদর্শ-শেক্সপীয়র, এডগার অ্যালান পো, রবার্ট ব্রাউনিং, হাবার্ট জর্জ ওয়েলস্-এর দাম্পত্য জীবন সুখের হয়নি বলে নিজেও বিবাহিত হতে ভয় পেতেন নাগিব মাহফুজ। ভাবতেন বিবাহিত জীবনে হয়তো যৌন উত্তেজনা এবং সাংসারিক চাপ তাঁর সাহিত্যের স্বতঃস্ফুর্ত ফল্গুধারাটিকে স্তব্ধ করে দেবে, রুদ্ধ করে দেবে তার জনসংযোগকে। অবশেষে ৪৩ বছর বয়সে আলেক্সন্দ্রিয়া নিবাসিনী আত্তিয়াল্লাহ ইব্রাহিমকে বিবাহ করে কায়রোর আকৌজা অঞ্চলে অর্থাৎ নীলনদের পশ্চিম তীরে বসবাস করতে শুরু করেন নাস্তইব মেহফুজ। শেষ জীবন পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথের মাধুরীলতার মতোই নারী স্বাধীনতায় বিশ্বাসী নাগিব মাহফুজকে সাহিত্যচর্চায় সাহায্য করে গেছেন তার দুই সুযোগ্য, বিদূষী কন্যা–ফাতিমা আর উম্মে কালসুম। নাগিব মাহফুজ-এর বিভিন্ন রচনা ‘দ্য ক্যোয়েল অ্যাণ্ড অটাম’, ‘প্যালেস অব ডিজায়্যার’, ‘দ্য হনিমুন’, ‘দ্য সার্চ’, ‘দ্য বেগার’-এ ছড়িয়ে আছে সেই নারী স্বাধীনতা এবং লিঙ্গসাম্যের প্রয়োজনীয়তা।
(সৌজন্যেঃ নতুন গতি, মাসান্তিক, ২০১৬)
‘নবজাগরণ’ অ্যান্ড্রোয়েড অ্যাপ্লিকেশনটি প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
![]()
‘নবজাগরণ’ এর টেলিগ্রাম চ্যানেলে জয়েন হতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর ফেসবুক পেজে লাইক করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
নবজাগরণ (ষাণ্মাসিক) – জীবনানন্দ ১২৫ তম জন্ম সংখ্যা – মননশীল সাহিত্য পত্রিকা






