লিখেছেনঃ মুহাম্মাদ আব্দুল আলিম
শায়খুল আরবে ওয়াল আজম হযরত মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানী (রহঃ) ১৮৭৯ খ্রীষ্টাব্দের ৬ই মে (১২৯৬ হিজরী ১৯শে শাওয়াল) ভারতের ফায়জাবাদ জেলার ট্যান্ডায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর মাতা-পিতা উভয়েই হযরত হুসাইন (রাঃ) এর বংশধর ছিলেন। তাঁর ১৯ তম পূর্ব পুরুষেরা দ্বীন ইসলাম প্রচার করার জন্য ভারতবর্ষে এসেছিলেন। সুলতানী যুগ থেকেই তাঁরা ভারতের জায়গীরদার ও জমিদারী লাভ করেছিলেন। শিক্ষা দীক্ষার ক্ষেত্রেও তাঁর পরিবারটি বিশেষ সুখ্যাতির অধিকারী ছিল। তাঁর পিতা হাবীবুল্লাহ সাহেব ছিলেন স্থানীয় স্কুলের প্রধান শিক্ষক। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করার পর মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানী (রহঃ) দেওবন্দে ১৪ বছর বয়সে মীযান জামাতে ভর্তী হন এবং সেখানে তিনি দীর্ঘ ৭ বছর পড়াশুনা করেন । তাঁর উস্তাদ (শিক্ষক) ছিলেন শায়খুল হিন্দ মাওলানা মহমুদুল হাসান দেওবন্দী (রহঃ)। শায়খুল হিন্দের সাথে তাঁর ঘনিষ্টতা গড়ে উঠে। ১৩১৫ হিজরীতে তিনি দারুল উলুম দেওবন্দ থেকে শিক্ষা সমাপ্ত করে নিজ বাড়িতে ফিরে যান। এ সময় পিতা ব্রিটিশ বেনিয়াদের অত্যাচারে অতিষ্ঠা হয়ে সপরিবারে মদীনা শরীফ হিজরত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানী মদীনা যাওয়ার আগে হযরত মাওলানা রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী (রহঃ) এর কাছে বায়’আত গ্রহণ করেছিলেন। মদীনায় গিয়ে হযরত হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী (রহঃ) সাথে ইসলাহী সম্পর্ক গড়ে তুলেন এবং পরে হযরত মাওলানা রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী (রহঃ) এর কাছে খেলাফত লাভ করেন।
মদীনায় থাকাকালীন তিনি দীর্ঘ ১৮ বছর মসজিদে নববীতে হাদীসের শিক্ষা দান করেন। শায়খুল হিন্দ (রহঃ) মদীনায় পৌঁছালে মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানী তাঁর সাথে রাজনৈতিক তৎপরতায় জড়িয়ে পড়েন এবং ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। পরে শায়খুল হিন্দকে মাল্টায় জেলে বন্দী করলে তিনিও উস্তাদের সাথে স্বেচ্ছায় কারাবরণ করেন এবং দীর্ঘদিন মাল্টার জেলে বন্দী থাকেন।
মাল্টা থেকে মুক্তি লাভ করার পর হযরত মাদানী আর মদীনায় না ফিরে গিয়ে শায়খুল হিন্দের সাথে ভারতে ফিরে আসেন। শায়খুল হিন্দ বাদশাহ শরীফ হোসেনের রাজত্বকালে সেই অঞ্চলকে নিরাপদ মনে করেন নি। কেননা, ব্রিটিশ গোয়েন্দা রিপোর্টে হযরত মাদানী (রহঃ)কে এ আন্দোলনের অন্যতম নেতা হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছিল, তাছাড়াও তুরস্কের পক্ষে মদীনায় আনোয়ার পাশা ও জামাল পাশা কর্তৃক আয়োজিত দু’আর মাহফিলে তিনি জিহাদের পক্ষে জ্বালাময়ী বক্তৃতা দেওয়ার অপরাধের অপরাধী করা হয়। এছাড়াও ইংরেজ সরকারের ফাইলে তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহীতার বিভিন্ন অভিযোগ ছিল।
ব্রিটিশ সরকার শায়খুল হিন্দ সম্পর্কে একটি কমিটি গঠন করেছিল। সেই কমিটির তদন্তের পর এক হাজার পৃষ্ঠা ব্যাপি একটি রিপোর্ট পেশ করে। সে রিপোর্টে আন্দোলনে কার কার ভূমিকা ছিল তাও সবিস্তারে উল্লেখ করা হয়েছিল। পরবর্তীকালে ইতিহাসে এটাকে ‘রোল্ট কমিটির রিপোর্ট’ বলে আখ্যায়িত করা হয়।
সেই রিপোর্টে উল্লেখ করা হয় যে, “এ আন্দোলনকে সফল করার জন্য একটি আন্তর্জাতিক সামরিক বাহিনী গঠনের পরিকল্পনাও নেতৃবৃন্দের রয়েছে, যার সদর দফতর মদীনায় কায়েম করা হবে এবং এর প্রধান সেনাপতি থাকবে মাওলানা মাহমুদুল হাসান দেওবন্দী, বিভিন্ন স্থানে এর আঞ্চলিক ঘাঁটি স্থাপনের সিদ্ধান্তও তাদের রয়েছে। প্রস্তাবিত ঘাঁটিসমূহ হচ্ছে কনস্টান্টিনোপল, তেহরান ও কাবুল। মাওলানা উবাইদুল্লাহ সিন্ধীকে কাবুলের সেনাপতি করার প্রস্তাবও তাদের রয়েছে ।”
সুতরাং ইংরেজদের পোষ্যপুত্র শরীফ হুসাইনের শাসনাধীন অঞ্চলে হযরত মাদানীর জন্য নিরাপদ নয় মনে করেই শায়খুল হিন্দ হযরত মাদানীকে ভারতে চলে আসার পরামর্শ দেন।
মসজিদে নববীতে দীর্ঘ ১৮ বছর হুসাইন আহমদ মাদানী (রহঃ) হাদীসের শিক্ষা দেন। এর বদৌলতেই ভারতের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তাঁকে শিক্ষক হিসাবে পাওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে পড়ে। বোম্বাই-এ সংবর্ধনা দিতে এসে আমরুহা জামে মসজিদ সংলগ্ন মাদ্রাসার মুহাতামিম মাওলানা হাফেজ জাহীদ হাসান সেখানেই হযরত মাদানীকে তাঁর মাদ্রাসার সদরুল মুদাররেসীন (সহ শিক্ষক) হিসাবে কাজ করার প্রস্তাব দেন। শায়খুল হিন্দও এই প্রস্তাবকে সমর্থন করেন এবং সেখানে যাওয়ার ব্যাপারে চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত দিয়ে দেন। এ দিকে দারুল উলুম দেওবন্দের মুহতামিম হযরত হাফেজ আহমদ সাহেব এ সংবাদ জানতে পেরে শায়খুল হিন্দকে জানালেন যে, দারুল উলুম দেওবন্দে হযরত মাদানীকে পূর্ব থেকেই নিয়োগ দানের সিদ্ধান্ত হয়ে আছে। কিন্তু শায়খুল হিন্দ আমরুহায় যাওয়ার বিষয়টি প্রাধান্য দেন। কিছুদিন ইউ, পিতে সফর ও রাজনৈতিক সভা সমাবেশে অংশগ্রহণ করার পর শাওয়াল মাসে হযরত মাদানী (রহঃ) আমরুহায় গমন করেন এবং নিয়মিত দরস দিতে শুরু করেন। কিন্তু দুই মাস পর অর্থাৎ মুহাররাম মাসে শায়খুল হিন্দ (রহঃ) হযরত মাদানীকে দেওবন্দ চলে আসার জন্য সংবাদ পাঠান। কিন্তু আমরুহার মুহতামিম সাহেব অন্য একজন শিক্ষক নিয়োগ করা পর্যন্ত তাকে সেখানে রাখার অনুমতি চাইলে শায়খুল হিন্দ সম্মত হন। কিন্তু ইতিপূর্বে শায়খুল হিন্দের সহযোগিতা না করার জন্য যে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন, সে ডাকে সাড়া দিয়ে আলীগড়ের ছাত্ররা সরকারী ইউনিভার্সিটি বয়কট করে এবং একটি স্বধীন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলার জন্য বিরাট কনফারেন্দ আহ্বান করে। শায়খুল হিন্দ ছিলেন তার সভাপতি। এ সময় শায়খুল হিন্দ হযরত মাদানীকে আমরুহা হতে সরাসরি আলীগড়ে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেন। অগ্যতা তিনি আলীগড়ে চলে যান। সম্মেলন শেষে ‘জামিয়া মিল্লিয়া’র উদ্বোধন করতঃ শায়খুল হিন্দ দিল্লীতে ফিরে আসেন। হযরত মাদানীও তাঁর সাথে দিল্লীতে চলে আসেন। ঠিক এহেন মুহুর্তে (১৯২০ সালের নভেম্বর) মাওলানা আব্দুল্লাহ মিশরী মাওলানা আবুল কালাম আজাদের পক্ষ থেকে এই বার্তা নিয়ে শায়খুল হিন্দের নিকট আগমন করেন যে, “কলকাতার আলীয়া মাদ্রাসার ছাত্ররাও সরকারী মাদ্রাসা বর্জন করেছে এবং কলকাতার নাখুদা মসজিদে মাওলানা আব্দুর রাজ্জাক মালিহাবাদীকে প্রধান শিক্ষক করে একটি স্বাধীন কওমী মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে । এখানে একজন যোগ্য আলেমের প্রয়োজন। সুতরাং একজন যোগ্য ব্যক্তিকে প্রেরণ করুন।” হযরত শায়খুল হিন্দ হযরত মাদানীকে সেখানে যাওয়ার নির্দেশ দেন।
এদিকে ১৯২০ সালের ১৯, ২০, ২১ শে ডিসেম্বর দিল্লীতে হযরত শায়খুল হিন্দকে সভাপতি ঘোষণা করে জমিয়ত উলামার এক কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়। অসুস্থতার কারণে তিনি তাতে ভাষণ দিতে পারেন নি। তার পক্ষ থেকে ‘অসহযোগ’ শিরোনামে একটি লিখিত ভাষণ হযরত মাওলানা শাব্বির আহমদ উসমানী (রহঃ) পাঠ করে শুনান। হুসাইন আহমদ মাদানী (রহঃ) এ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন। সম্মেলন শেষে শায়খুল হিন্দের নির্দেশ মুতাবিক মুরাদাবাদ পথে তিনি কলকাতার উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে যান। ট্রেন আমরুহা স্টেশনে পৌঁছালে সম্বর্ধনা জ্ঞাপনের জন্য আগত লোকজন তাকে জানায় যে, খলীল আহমদ সাহারানপুরী আমরুহায় অবস্থান করছেন, তিনি তাঁকে সেখানে যেতে বলেছেন। অগত্যা তিনি আমরুহায় নেমে যান। খলীল আহমদ সাহারানপুরীর সাথে দেখা করলে তিনি তাঁকে জানান যে, এখানে শিয়া সুন্নীদের মাঝে একটি বাহাসের প্রস্তুতি চলছে। অথচ বিষয়টি সময়ের প্রশ্নে বড়ই নাজুক। কারণ ইংরেজ বিতাড়নের প্রশ্নে সর্বভারতীয় ঐক্যই এখন সময়ের বড় দাবী। এ সময় এ ধরণের একটি বিতর্ক কারো নিকট কাঙ্খিত হতে পারে না। সুতরাং কোন একজন ভারতীয় পর্যায়ের ব্যক্তির মাধ্যমে এই বাহাস মূলতবী করানোর উদ্দেশ্যেই তিনি তাকে এখানে ডেকে পাঠিয়েছেন।
সুতরাং শহরময় ঘোষণা হয়ে গেল, ‘শায়খুল ইসলাম হুসাইন আহমদ মাদানী (রহঃ) বক্তৃতা করবেন।’ দু’ পক্ষের লোকই সমবেত হয় । তিনি দুই আড়াই ঘন্টা ব্যাপী বক্তৃতায় উপস্থিত জনতার সামনে বিশ্বব্যাপীয়া ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের আগ্রাসনের চিত্র তুলে ধরেন এবং একথা বুঝাতে চেষ্টা করেন যে, এ মুহুর্তে দলমত নির্বিশেষে সকলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সাম্রাজ্যবাদ ইংরেজকে তাড়াতে হবে। কেননা ওরা টিকে থাকতে কোন ধর্ম ও মতাদর্শের লোকেরাই নির্বিঘ্নে ধর্মকর্ম পালন করতে পারে না। কোন সম্প্রদায়ের ধর্মীয় পবিত্র স্থানই রক্ষা পাবে না। তাই এ সময় আমাদের সুসংগঠিত হওয়া প্রয়োজন, এ সময় নিজেদের মাঝে মতবিরোধ সৃষ্টি করার সময় নয়। তাঁর এ ভাষণে উভয় দল খুশী হয়ে ফিরে যায় এবং বাহাস মূলতবী হয়ে যায়।
সম্মেলন শেষে তিনি কলকাতার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবেন, এ সময় দিল্লী থেকে টেলিগ্রাম আসল যে, শায়খুল হিন্দ (রহঃ) ইন্তেকাল করেছেন। তাঁর লাশ জানাযা ও দাফন কাফনের জন্য দেওবন্দ পাঠানো হচ্ছে। অগত্যা তিনি কলকাতায় না গিয়ে দেওবন্দের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে যান।
দাফন কাফন শেষে কয়েকদিন দেওবন্দে অবস্থান করার পর শায়খুল হিন্দের অন্তিম নির্দেশ পালনার্থে তিনি কলকাতার পথে রওয়ানা হয়ে যান। এ সময় হাফেজ আহমদ সাহেব তাকে দেওবন্দের শিক্ষক হিসাবে থেকে যাওয়ার জন্য পূণর্বার অনুরোধ করেন, কিন্তু শায়খুল হিন্দের নির্দেশ পালন ছিল তার কাছে অনেক বড়।
(তথ্যসূত্রঃ দেওবন্দ আন্দোলনঃ ইতিহাস ঐতিহ্য অবদান, মাওলানা আবুল ফাতাহ মুহাম্মাদ ইয়াহইয়া)
মাল্টা থেকে প্রত্যাবর্তন করার পর যতদিন শায়খুল হিন্দ জীবিত ছিলেন ততদিন হযরত মাদানী শায়খুল হিন্দের সাথে বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক সম্মেলনে সঙ্গে সঙ্গে থেকেছেন। কিন্তু শায়খুল হিন্দ মারা গেলে তিনিই অঘোষিতভাবে এ আন্দোলনের কেন্দ্রীয় ব্যাক্তিত্বে পরিণত হন। হযরত মাদানীর রাজনৈতিক তৎপরতা শুরু হয় মূলতঃ কলকাতায় শিক্ষকতা জীবন থেকে। সে সময় খেলাফত আন্দোলন ছিল তুঙ্গে। তখন অসহযোগ আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে এবং সারা দেশে মিটিং মিছিল সভা সমাবেশের হিড়িক পড়ে যায়। এই কঠিন পরিস্থিতিতে হযরত মাদানী দেশের বিভিন্ন এলাকায় এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলে অনুষ্ঠিত সভা-সমাবেশে যোগদান করে জনগণকে ব্রিটিশ বিরোধী তৎপরতায় অনুপ্রাণিত করে তোলেন। ১৯২১ খ্রীষ্টাব্দে কলকাতার মৌলবী বাজারে অল – ইণ্ডিয়া কংগ্রেস, খেলাফত আন্দোলন ও জমিয়ত উলামায়ে হিন্দের উদ্যোগে এক বিরাট যৌথ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। হযরত মাদানী এই সমাবেশে সভাপতির পদ অলঙ্কৃত করেন। ১৯২১ খ্রীষ্টাব্দে সিউহারার বিজনৌর জমিয়ত উলামায়ে হিন্দ ও খেলাফত কনফারেন্সের পৃথক পৃথক সম্মেলন একই মঞ্চে অনুষ্ঠিত হয়। সেই সম্মেলনের জমিয়ত উলামায়ে হিন্দের সভাপতি ছিলেন দারুল উলুম দেওবন্দের ভাইস প্রেসিডেন্ট মাওলানা হাবীবুর রহমান এবং খেলাফত কনফারেন্সের অধিবেশনে সভাপতি ছিলেন হুসাইন আহমদ মাদানী (রহঃ)। এই সম্মেলনে তিনি দেশীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির উপর অত্যন্ত জোরালো বক্তব্য পেশ করেন।
এই সমাবেশে তিনি খেলাফতের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করার পর যুক্তি প্রমাণ সহ অত্যন্ত বলিষ্ঠভাবে প্রমাণ করেন যে, খেলাফতের সময়কাল ত্রিশ বছরের মাঝে সীমিত নয়। তুর্কী খিলাফতের সদিচ্ছার কথা বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করার পর তিনি এই বিভান্তির অপনোদন করতে চেষ্টা করেন যে, “ব্রিটিশ ভারতের সাথে ভারতীয়দের যে চুক্তি হয়েছে তা লঙ্ঘণ করা সমীচিন হবে না।” তিনি প্রচুর অকাট্য প্রমাণ পেশ করে বলেন যে, মুলতঃ ব্রিটিশ সরকার ও মুসলমানদের মাঝে কোন চুক্তি নেই। থাকলেও বর্তমানের প্রেক্ষাপটে মুসলমানদের জন্য তা মানা জরুরী নয়। কেননা ব্রিটিশরা নিজেরাই সে চুক্তি ভঙ্গ করেছে। মক্কা মদীনা, হিজাজ, তায়েফ, ইত্যাদি অঞ্চলের উপর বর্বরোচিত আক্রমণ চালিয়ছে, বায়তুল মুকাদ্দাস দখল করে নিয়েছে, কাজিমন, নজদ, কারবালা, বাগদাদ ইত্যাদি অঞ্চলের উপর তাদের আধিপত্য বিস্তার করে রেখেছে, সুতরাং মুসলমানদের জন্য তাদের চুক্তি রক্ষা করার কোন প্রয়োজন নেই।
তিনি তাঁর ভাষণে আরো বলেন যে, ভারতের স্বাধীনতা এজন্যও প্রয়োজন যে, রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা ছাড়া মুসলমানদের ধর্মীয় স্বাধীনতা কোন কালেই অর্জিত হবে না। অথচ ধর্মীয় স্বাধীনতা মুসলমানদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও বুনিয়াদী বিষয়। তাছাড়া ভারতবর্শের স্বাধীনতার সাথে মুসলিম বিশ্বের অনেক দেশের স্বাধীনতার প্রশ্ন জড়িত। ভারত স্বাধীন হলে তারাও স্বাধীনতা লাভ করতে পারবে । মূলতঃ ভারতের উপর ভিত্তি করেই তারা সে সব দেশের উপর আধিপত্য বিস্তার করে রেখেছে।
এছাড়াও তিনি তার সে ভাষনে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয়ের উপর আলোকপাত করেন। যা ছিল তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞার উৎকৃষ্ট দলীল।
বঙ্গীয় অঞ্চলে ১৯২১ খ্রীষ্টাব্দের ২৫শে মার্চ রংপুর জেলার রহীমগঞ্জে উলামায়ে বাঙ্গালের উদ্যোগে বিরাট সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। তিনি সেখানেও সভাপতিত্ব করেন। এ সম্মেলনে বাংলার বিরাট সংখ্যক আলেম উলামা উপস্থিত ছিলেন। সেই সভায় হযরত মাদানী বঙ্গীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করার পর আলেম উলামাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেন। তিনি বলেন, “উলামায়ে কিরামদের কি দায়িত্ব ছিলনা গ্রামে গ্রামে বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে সাধারণ মানুষকে বুঝানো যে, এই সরকারের সেনাবাহিনী ও পুলিশ বাহিনীতে চাকুরী করা হারাম, যদি হালাল মনে করে তাহলে কাফির হয়ে মরবে জাহান্নামী হবে।”
১৯২১ খ্রীষ্টাব্দের ৮ই সেপ্টেম্বর। এই দিন মাওলানা মুহাম্মাদ আলী জওহারের সভাপতিত্বে নিখিল ভারত খিলাফত কনফারেন্সের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সম্মেলনে হযরত হুসাইন আহমদ মাদানী প্রকাশ্যে ঘোষণা করেন যে,
“ইংরেজ সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়া বা তাদের যে কোনভাবে সাহায্য করা এবং যে কোন প্রকারে তাদেরকে উৎসাহিত করা সবই শরীয়াতের দৃষ্টিতে হারাম।”
এই ফতোয়া ছাপিয়ে সারা দেশব্যাপী প্রচার করা হয়। এর সমর্থন করেছিলেন মাওলানা মুহাম্মাদ আলী জাওহর, মাওলানা শাওকত আলী, মাওলানা নেসার আহমদ প্রভৃতি আলেমগণ। হযরত মাদানীর এই ফতোয়ার সাক্ষরকারী ছিলেন, মাওলানা নেসার আহমদ ও পীর গোলাম মুজাদ্দিদ।
হযরত মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানীর এই পুরুষোচিত এবং যুগোপযোগী ফতোয়া গোটা ব্রিটিশ শাসনে তোলপাড় সৃষ্টি করে দেয় এবং গোটা ভারতবর্ষে বিদ্রোহের দাবনানল জ্বলে উঠার উপক্রম হয়। করাচীর সম্মেলনে আড়াই মাস পর ১৮ই সেপ্টেম্বর হুসাইন আহমদ মাদানী (রহঃ) কে শায়খুল হিন্দের বাড়ি থেকে গ্রেফতার করা হয়। তাঁকে গ্রেফতার করতে গিয়ে পুলিশকে যথেষ্ট ধকল পোহাতে হয় এবং জনসাধারণের কাছ থেকে পুলিশকে কিল থাপ্পড়ও খেতে হয়। অবশেষে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য সাহারানপুর থেকে রিজার্ভ ফোর্স আনিয়ে রাতের অন্ধকারে তাঁকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হয়। সকালে হযরত মাদানীর গ্রেফতারের খবর ছড়িয়ে পড়লে সারা শহরে স্বতঃস্ফুর্তভাবে হরতাল পালিত হয়।
হযরত মাদানীকে গ্রেফতার করে করাচীর জেলে নিয়ে যাওয়া হয়। অবশেষে ২৬ সেপ্টেম্বর করাচীর ‘খালেক দ্বীনা’ হলে এই ঐতিহাসিক মামলার শুনানী হয়। সেই মামলাই হযরত মাদানী কোন উকিল নিযুক্ত করেন নি। নিজেই আত্মপক্ষ সমর্থন করে বলেন,
“মাননীয় আদালতের সকল প্রশ্নের জবাব আমি নিজেই লিখিত আকারে পেশ করব।”
সেই নজীরবিহীন বক্তৃতায় তিনি প্রথমে ব্রিটিশ সরকারের পক্ষ থেকে যে ধর্মীয় স্বাধীনতার স্বীকৃতি দেওয়া আছে সে কথা আদালতকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন,
“আমি একজন মুসলমান এবং আলেমও বটে। মুসলমান হিসাবে কুরআন ও সুন্নাহর প্রতি দ্বিধাহীন বিশ্বাস রাখা আমার দায়িত্ব। আর আলেম হিসাবে কুরআন ও সুন্নাহর বাণী সাধারণ মানুষ পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়া আমার কর্তব্য।”
এরপর তিনি এই বিষয়ে কুরআন হাদীসের বহু দলীল প্রমাণ পেশ করে এবং বলেন যে,
“ইসলামী ফিকাহ বিশেষজ্ঞ মাওলানা আব্দুল হাই ফিরিঙ্গি মহল্লী, শাহ আব্দুল আজীজ ও হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানবী (রহঃ) প্রমূখ মনীষীগণও ইংরেজ সরকারের অধীনে সেনাবাহিনীতে চাকুরী করা হারাম বলে ফতোয়া দিয়েছেন। অতএব একথা সুস্পষ্ট যে, জমিয়ত উলামায়ে হিন্দের এ সিদ্ধান্ত নতুন কোন বিষয় নয়, এটা ইসলামী আকিদার চিরন্তন ফায়সালা। বর্তমানের প্রেক্ষাপটে ইসলামের এ বিধানকে প্রচার করা আমি আমার ধর্মীয় দায়িত্ব মনে করি । আর এর প্রচারে বাধা প্রদানকে আমি আমার ধর্মীয় অধিকারে হস্তক্ষেপ বলে মনে করি। এ বক্তৃতার শেষ পর্যায়ে তিনি এসে বলেন, আমাদের ধর্মীয় স্বাধীনতা নস্যাৎ করাই যদি সরকারের উদ্দেশ্য হয় তাহলে তা পরিস্কার ভাষায় ঘোষণা করে দেওয়া হউক। তখন সাত কোটি মুসলমান চিন্তা করে দেখবে যে, তারা কি মুসলমান হিসাবে বেঁচে থাকবে না সরকারের প্রজা হিসাবে বেঁচে থাকবে? অনুরুভাবে ২২ কোটি হিন্দুরাও চিন্তা করে দেখবে তাদের কি করা উচিৎ। কারণ ধর্মীয় স্বাধীনতা যখন হরণ করা হবে তখন সব ধর্মেরই করা হবে। আর যদি লর্ড রেডংকে এজন্যই ভারতে প্রেরণ করা হয়ে থাকে যে, সে কুরআন সুন্নাহকে নিশ্চিহ্ন করে দেবে; তাহলে ইসলামের জন্য সর্বপ্রথম প্রাণদানকারী আমিই হব।”
তিনি আরও বলেন, মিঃ লয়েড জর্জ ও মিঃ চার্চিল যখন এ ঘোষণা করেছেন যে, তুর্কী খিলাফতের সঙ্গে তাদের যে যুদ্ধ, সেটা ক্রুসেডের ধর্মযুদ্ধ, ইসলাম ও খ্রীষ্টধর্মের শেষ বুঝাপড়ার যুদ্ধ, তখন মুসলমানদের পক্ষে ইসলাম বিরোধী সকল শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা সব চাইতে প্রধান ফরজ হয়ে দাঁড়িয়েছে।……
১৮৫৭ সালে সারা ভারতে যখন বিপ্লব আন্দোলন জ্বলে উঠেছিল, তখন রানী ভিক্টোরিয়া বলেছিলেন – কখনো কারো ধর্মে হস্তক্ষেপ করা হবে না। ব্রিটিশ পার্লামান্টেও তা স্বীকার করা হয়েছিল। এমনকি পরবর্তীকালে সপ্তম এডওয়ার্ড এবং পঞ্চম জর্জও তো সমর্থন করেছিলেন। কিন্তু বর্তমান সরকার যদি ভারতীয় ধর্ম বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে তাহলে এ দেশের কোটি কোটি মুসলমানকে চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তাঁরা মুসলমান হিসাবে বেঁচে থাকতে চাই না নিরেট ইংরেজ বংশবদ প্রজা হিসাবে। ভারতের তেত্রিশ কোটি হিন্দুকেও অনুরুপ সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
যদি সরকার ধর্মীয় স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করে তাহলে মুসলমানেরা নিজের ধর্ম রক্ষার খাতিরে জীবন উৎসর্গ করে দিতে কিছু মাত্র ইতস্তত করবে না।
এই মামলা চলাকালীন পাঁচশ আলেমের উপস্থিতিতে ইংরেজ জজ হযরত মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানীকে তাঁর ফতোয়া সম্পর্কে প্রশ্ন করতে থাকেন। তখন হযরত মাদানী (রহঃ) অত্যন্ত সাহসিকতা, অস্বাভাবিক বিচক্ষণতা এবং সত্যবাদীতার সাথে বলেন,
“ফতোয়া যা হবার আমি তাই দিয়েছি। যতদিন আমার শিরা-উপশিরায় এক ফোটা রক্তও সচল থাকবে ততদিন এর প্রচার প্রসার এবং যথার্থ বাস্তবায়নের আহ্বান অব্যাহত থাকবে।”
এই সময় হঠাৎ মাওলানা মুহাম্মাদ জাওহার হযরত হুসাইন আহমদ মাদানীর পায়ে পড়ে চিৎকার করে বলে উঠলেন,
“মহান আল্লাহর দোহাই, আপনি আপনার বক্তব্য পরিবর্তন করুন। অন্যথায় আপনার ফাঁসী হয়ে যাবে । আর এই নাজুক পরিস্থিতিতে আপনার মত লোকের বেঁচে থাকা জাতির জন্য একান্ত প্রয়োজন।”
তাঁর এই আবেগ তাড়িত অভিব্যক্তি শুনে হযরত মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানী বললেন, “হে জাওহার! যদি বক্তব্য পরিবর্তন হয়ে যায় তাহলে তো ঈমানও পরিবর্তন হয়ে যাবে। তাহলে আর থাকবে কি? সারা জীবন আক্বিদার বিভ্রমে কাটবে।”
দীর্ঘ তিনদিন শুনানীর পর হযরত মাদানী সহ সকল আসামীকে ভারতীয় দণ্ডবিধি ৫০৫ ও ১০৯ ধারা মতে ২ বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। তাদেরকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় সাবরমতি জেলে। জেলখানায় তাঁদের প্রতি অমানুষিক নির্যাতন করা হয়। কিন্তু হযরত মাদানীনে কারার আবদ্ধ প্রাচীরও নিরস্ত্ করতে পারেনি। জেলখানার অভ্যন্তরে বিভিন্ন অনাচারের বিরুদ্ধেও তিনি হয়ে উঠেন আন্দোলনমূখর।
জেলে বন্দী থাকাকালীন তাঁর ভক্তরা যে অসংখ্য চিঠিপত্র হযরত মাদানীকে লিখতেন সেগুলে একত্রে সংকলন করে ‘হায়াতে মাদানী’ নামে প্রকাশ করা হয়েছে।
একবার করাচীতে খিলাফত কমিটির সম্মেলন হয়েছিল। সেই সম্মেলনে ৯ লক্ষ্য লোকের মত জনসমাগম হয়েছিল। গান্ধীজিও সেই সভাই উপস্থিত ছিলেন। সভা চলাকালীন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে জ্বালাময়ী ভাষণ দিয়েছিলেন হযরত হুসাইন আহমদ মাদানী। এমন সময় ব্রিটিশদের পক্ষ থেকে হযরত মাদানীকে গুলি করার হুকুম হয়। হযরত মাদানী অকুতভয়ে কোটের বোতাম খুলে কামানের গোলন্দাজের সামনে বুক ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন। সেসময় হযরত মাদানী বুক ফুলিয়ে বলেছিলেন,
লিয়ে ফিরতে হ্যায় বুলবুল চোঁচ মে গুল
শহীদ নায কি তারবিয়াত কাহাঁ হ্যায় ।।
অর্থাৎ
ফুল নিয়া ঠোঁটে ঘুরিয়া বেড়ায় উড়ন্ত বুলবুল
খুঁজিয়া বেড়ায় শহীদ সমাধি দেয়ার তরে ফুল ।।
লোকেরা হুসাইন আহমদ মাদানীর হিম্মত ও জযবা দেখে নারায়ে তাকবীরের ধ্বনিতে আকাশ বাতার প্রকম্পিত করে তুলেছিল। আধ ঘণ্টা শ্লোগান ধ্বনি চলার পর গোলন্দাজের গুলিও স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল।
এই শায়রী তখন তিনি একবার পড়েছিলেন যখন তিনি আদালতে বিচারাসন্ন ছিলেন। ডেরাগাজি খানে খিলাফত সম্মলেনের সময় হযরত মাদানীকে গুলি করার হুকুম হয় তখন তিনি ইংরেজকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন,
“খিলোনা সমঝকর না বরবাদ করনা
হম ভি কিসিকে বানায়ে হুয়ে হ্যাঁয়
ফিরিঙ্গি কি ফৌজোঁ মে হুরমত কে ফতয়ে হ্যায়
সরদার চঢ়া কর ভি গায়ে হুয়ে হ্যাঁয়
সজুর আজাদী কো খুঁ দে কে সিঁচা
কে ফল ইসকে পকনে কো আয়ে হুয়ে হ্যাঁয় ।।”
অর্থাৎ
খেলনা মনে করে ধ্বংস করো না আমায়
আমাকেও কেউ সৃজন করেছেন ।
ইংরেজ সৈন্য সম্পর্কে যে হারামের ফতওয়া
ফাসির কাষ্ঠেও তা বলবত থাকবে ।
আযাদীর বৃক্ষে রক্ত সিঞ্চন করতে হয়
তাহলে তার ফল অচিরেই পাকবে ।
করাচীর জেলে বন্দী থাকাকালীন তিনি দেওবন্দবাসীদের উদ্দ্যেশ্যে যে দীর্ঘ চিঠি লিখেছিলেন, তার এক স্থানে তিনি লিখেনঃ-
“আমাদেরকে জোরদার মুকাবিলা করতে হবে। কুরআন ও হাদীস আমাদেরকে এ পথেই আহ্বান জানায়। সুতরাং যতদিন আমরা অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে না পারব অর্থাৎ ভারতবর্ষের স্বাধীনতা, আরব বিশ্বের স্বাধীনতা ও হিন্দুস্থানের স্বাধীনতা অর্জিত না হবে, পাঞ্জাবসহ সারাদেশ জুড়ে বর্বরদের জুলুম ও নির্যাতনের প্রতিশোধ নিতে সক্ষমা না হব ততদিন পর্যন্ত দুর্বার গতিতে আন্দোলন চালিয়ে যাব।”
সে চিঠির অন্যস্থানে তিনি লিখেনঃ-
“কাজ যেন দ্রুত গতিতে চলতে থাকে, এ সময় পারস্পরিক মতবিরোধ থেকে আমাদের উর্ধ্বে থাকতে হবে। আমাদের ভারতের স্বাধীনতা ও ধর্মীয় লক্ষ্যগুলো সফলতার দিকে এগিয়ে যেতে শুরু করেছে। আল – হামদুলিল্লাহ! দেশ ও জাতি অত্যন্ত দ্রুত গতিতে অগ্রসর হচ্ছে। আমরা দুর্বল হলেও আল্লাহর সাহায্যে আমাদের সঙ্গে রয়েছে। আল্লাহর মেহেরবানীতে আমরা ঐ ইংরেজ বেনিয়া গোষ্ঠীকে বিভিন্ন দিক থেকে আক্রমণ করে জাহান্নামে অতল গহ্বরে নিক্ষেপ করে ছাড়ব ইনশা – আল্লাহ।”
হযরত মাদানী (রহঃ) ১৯২১ খ্রীষ্টাব্দের ২১শে ফেব্রুয়ারী খিলাফত আন্দোলনের কনফারেন্স হয়। সেই কনফারেন্সে সভাপতির ভাষণ দেওয়ার সময় হযরত মাদানী বলেছিলেনঃ-
“হে ভারত! ফ্রান্সের ময়দানে, ইটালীর পাহাড় পর্বতে, সালুনিকার মাঠে ঘাটে, দারাদানিয়ালের প্রস্তর ভূমিতে, সিনাই উপত্যকা এবং সুয়েজ ও শিবিয়ার বালুকা প্রান্তরে, এডেন ও ইয়ামেনের কঙ্কর ভূমিতে, ইরাক, ইরানের মাঠে ময়দানে পূর্ব ও পশ্চিম আফ্রিকার জার্মান অধিকৃত অঞ্চলে, মধ্য এশিয়া ও কাফকাঞ্জিয়ার তুষার ভূমিতে এবং কৃষ্ণ সাগর, লোহিত সাগর ও স্বেত সাগরের উপকূল সমূহে বন্য পশু ও জন্তুর ন্যায় অত্যন্ত নির্দয়ভাবে তের লক্ষ কচি কচি সন্তানের রক্তের স্রোত প্রবাহিত হচ্ছে, তাদের উপর গোলা বারুদের বর্ষণ চলছে, লক্ষ লক্ষ মানুষ দুনিয়া থেকে বিদায় নিচ্ছে। কিন্তু জিজ্ঞেস করি হে ভারত, এ বিনিময়ে তোকে কি পুরস্কার দেওয়া হলো? উত্তরে এ ছাড়া তোর আর কি বলার আছে যে, এর পুরস্কার স্বরুপ তোর ভাগ্যে জুটেছে স্ত্রীর বিধবা হওয়া, সন্তানের এতিম হওয়া। তোর গলায় গোলামীর শিকল পরানো, রাওলাট বিল পাশ করা, কোর্ট মার্শালের কবলে পড়া, পাঞ্জাবের দিক দিগন্তকে রঞ্জিত করা, জালিয়ানওয়ালাবাগে মেশিন গানের বর্ষণ তোর নিরীহ সন্তানদের উপর পাশবিক ও অপমানজনক ব্যবহার, তোর স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া তোর উপর নানাবিধ ট্যাক্স বসানো, তোকে রাজদ্রোহিতার নামে নানারুপ বেড়াজালে পতিত করা।
ভাইসব, এর একমাত্র কারণ আপনারা চিন্তা করেছেন কি? আমাদের একতার অভাব এবং বিদেশীদের সঙ্গে আমাদের এক শ্রেণীর লোকের বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার কারণেই এসব সম্ভব হচ্ছে। আজ যদি আমরা গোটা ভারতবাসী ঐক্যবদ্ধ হয়ে যাই, পৃথিবীর কোন শক্তি আমাদের প্রতি চক্ষু তুলে তাকাবার সাহস পাবে না। তখন তাদের গোলাগুলিতে দুরের কথা শক্তিশালী বিদ্যুৎ পর্যন্ত আমাদের বালুকা সদৃশ স্তুপের মধ্যে প্রবেশ করতে পারবে না।…….
আমাদের নিষ্ক্রিয়তা ও মত বিরোধ কেবল আমাদেরকেই বিপদে পতিত হতে হবে না বরং এর ফলে প্রাচ্যের অন্যান্য দেশ ও জাতিগুলোর স্বাধীনতাও বিপন্ন হয়ে পড়বে।” (হায়াতে মাদানী)
জেল থেকে মুক্তি লাভ করার পর হযরত মাদানীকে দারল উলুম দেওবন্দ সহ বিভিন্ন মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করার জন্য আহ্বান জানানো হয়। কিন্তু আসাম অঞ্চলের ধর্মীয় শিক্ষার করুণ পরিস্থিতির কথা চিন্তা করে তিনি ১৯২৪ খ্রীষ্টাব্দে তৎকাল আসামের অন্তর্ভূক্ত সিলেট শহরের নয়া সড়ক মসজিদ সংলগ্ন খিলাফত বিল্ডিংয়ে শিক্ষাদানে নিরত হন। এখানে শিক্ষকতা ও আধ্যাত্মিক প্রশিক্ষণের মাঝে তাঁর তি বছর কেটে যায়। এ সময় তিনি সিলেট ও আসামের প্রত্যন্ত অঞ্চলের বিভিন্ন সভা সমাবেশে অংশগ্রহণ করে দ্বীনের হিদায়াত দান ও রাজনৈতিক স্বচেতনতা সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব আঞ্জাম দেন।
১৯২৭ খ্রীষ্টাব্দে দারুল উলুম দেওবন্দ থেকে তাঁর উস্তাদ এবং দেওবন্দের সহকারী মুহতামিম হযরত মাওলানা হাবীবুর রহমান উসমানীর পক্ষ থেকে এই মর্মে চিঠি আসে যে, দারুল উলুমের কর্তৃপক্ষ তাঁকে দারুল উলুমে উপস্থিত হতে অনুরোধ জানিয়েছেন। উস্তাদের চিঠি পেয়ে তিনি দেওবন্দে আসেন। এই সময় আভ্যন্তরীণ মতপার্থক্যের কারণে হযরত মাওলানা আনওয়ার শাহ কাশ্মীরি (রহঃ) সহ বেশ কয়েকজন উচ্চপদস্থ উস্তাদ দারুল উলুম ছেড়ে চলে যান। এই শূণ্যতা পূরণার্থে তৎকালীন মুহতামিম হযরত মাওলানা হাফেজ আহমদ সাহেব তাঁকে সদরুল মুদাররেসীন (সহকারী শিক্ষক) পদ গ্রহণের আবদার জানান। উস্তাদের প্রস্তাবকে তিনি কোন অসম্মতি জ্ঞাপন না করে সহকারী শিক্ষকের পদ গ্রহণ করেন। কিন্তু তিনি জানান যে,
“আপনাদের নির্দেশ পালনের ব্যাপারে আমার অসম্মতি নেই। তবে বিষয়টি আরো গভীরভাবে চিন্তা করে নিলে ভাল হয়। কেননা আমি শায়খুল হিন্দ (রহঃ) এর মিশনকে নিজ জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হিসাবে গ্রহণ করেছি। কাজেই আমি যতদিন জীবিত থাকব ততদিন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনে নিজের চেষ্টা ও সাধনাকে সর্বোতভাবে নিয়োজিত রাখব। আমি সংকল্প করেছি যে, হয়ত এ পথে জীবন উৎসর্গীকৃত হবে, নয়ত ব্রিটিশ বেনিয়ারা এদেশের মাটি থেকে বিতাড়িত হবে। অথচ দারুল উলুমের কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত হল, কোন শিক্ষক রাজনীতির সাথে জড়াতে পারবে না। সুতরাং এ দায়িত্ব পালন আমার পক্ষে কি করে সম্ভব?”
হযরত মাদানীর এই বক্তব্য শুনে মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ পরামর্শ করে তাঁকে নিয়োগ করেন যে, তিনি রাজনীতির ব্যাপারে মাদ্রাসার সকল প্রশাসনিক নীতির আওতা বহির্ভূত থাকবেন।
১৯৩৭ খ্রীষ্টাব্দে দিল্লীতে এক জনসভায় হযরত মাদানী বক্তৃতা দেন। বক্তৃতাকালে তিনি ইংরেজদের Divid and Rule Policy (বিভেদ নীতি) – এর পলিশির কথা আলোচনা করেন। তারা যে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন শ্লোগান তুলে ঐক্যবদ্ধ শক্তিকে ভেঙ্গে দেওয়ার পাঁয়তারা চালিয়ে যাচ্ছে এ বিষয়ে আলোকপাত করতে গিয়ে তিনি বলে যে, “তারা আরব ও তুরস্কের ঐক্যে ফাটল ধরানোর জন্য সেখানে ভৌগলিক অঞ্চল ভিত্তিক জাতীয়তার ধোঁয়া তুলে আরব জাতি যে ভিন্ন এক জাতি এই শ্লোগান পাঠিয়েছে এবং আরবদেরকে আরব জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ করে তুরস্ক থেকে বিচ্ছিন্ন করে একটি বৃহৎ শক্তিকে ভেঙ্গে খান খান করে দিয়েছে। অনুরুপভাবে ভারতে ইংরেজ বিতাড়নের প্রশ্নে সর্বভারতীয় সমন্বয়ে যে বৃহৎ ঐক্য গড়ে উঠেছে, ধর্মভিত্তিক জাতীয়তার ধোঁয়া তুলে তা ভেঙ্গে খান খান করে দিতে চাচ্ছে। সুতরাং এ মুহুর্তে ইংরেজদের দেওয়া এই জাতীয়তার থিওরীর পিছনে না পড়ে সকল ধর্ম সম্প্রদায়ের লোকেরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে, জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সকল ভারতীয় মিলে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়া উচিৎ। তিনি আরো বলেন, বর্তমান ভারতবর্ষের রাজনৈতিক অবস্থার প্রেক্ষিতে ‘আমরা সকল ধর্মাবলম্বী ভারতবাসী’ – এই ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হওয়া সময়ের একান্ত দাবী। যতদিন পর্যন্ত নিখুঁত ইসলামী শাসনের পরিবেশ গড়ে না উঠে ততদিন পর্যন্ত বিদেশীদের অধীনতা মেনে নেওয়ার চাইতে স্বদেশী সকল ধর্মাবলম্বীদের সাথে মিলে মিশে সম্মিলিত শাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলাই উত্তম হবে। পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে এহেন পদক্ষেপ শরীয়াতের লক্ষ্য উদ্দেশ্যের পথে অগ্রসর হওয়ার জন্য পূর্ব প্রস্তুতিমূলক অত্যাবশকীয় পদক্ষেপ হিসাবে বিবেচিত হওয়ার দাবী রাখে।
কিন্তু এই বক্তৃতাকে সম্বল করে মুসলিম লিগ সমর্থক পত্রিকা ‘আল আমান দিল্লী’- পর দিন প্রথম শিরোনামে বড় বড় অক্ষরে এই বিভ্রান্তি রিপোর্ট করে বসে যে, মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানী বলেছেন যে,
“জাতীয়তার ভিত্তি ভৌগলিক অঞ্চল, ধর্ম জাতীয়তার ভিত্তি নয়।”
আর যায় কোথায়, সারা দেশে এই রিপোর্টের ভিত্তিতে তুলকালাম কাণ্ড ঘটে যায়। মুসলিম লীগ সমর্থক পত্রিকাগুলো রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হিসাবে এর উপর আলোচনা পর্যালোচনা এমনভাবে শুরু করে যে, এটি সময়ের সব চেয়ে মুখ্য বিষয়ে পরিণত হয়। বিষয়টি এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে, শেষ পর্যন্ত হযরত মাদানীকে কাফের ফতোয়া দেওয়া হয় । এমনকি আল্লামা ইকবালের মত পণ্ডিত ব্যক্তিও বিভ্রান্তির শিকার হয় এবং হুসাইন আহমদ মাদানী (রহঃ) কে ব্যাঙ্গ বিদ্রুপ করে তিনটি শায়রী (কবিতা) লিখেন। কিন্তু পরে আল্লামা তালাতের মাধ্যমে হযরত হুসাইন আহমদ মাদানী (রহঃ) এর সঠিক অবস্থান আল্লামা ইকবালের নিকট পৌঁছালে তখন তিনি নিজের ভূল স্বীকার করে ক্ষমা প্রার্থনা করে চিঠি পাঠিয়ে ছিলেন। যা পরে ২৮ মার্চ ১৯৩৮ এ লাহোর থেকে প্রকাশিত দৈনিক ‘ইহসান’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
হুসাইন আহমদ মাদানী (রহঃ) ও নিজের বক্তব্য ব্যাখ্যা করেন। অবশ্য তাঁর বক্তব্য হুবহু ‘তেজ’ ‘আনসারী’ ও ‘ইহসান’ পত্রিকায় ছেপে প্রকাশ করা হয়। কিন্তু প্রচরণার জন্য পরিস্থিতি খুবই নাজুক হয়ে যায়। হযরত মাদানী জাতীয়তা সম্পর্কে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ‘মুত্তাহিতা ক্বওমিয়াত আউর ইসলাম’ (Compasile Nationalism and islam) নামে পুস্তিকা লিখে তা প্রকাশ করেন এবং জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে সঠিক ব্যাখ্যা তাতে প্রদান করেন। এই পুস্তকে তিনি মুহাম্মাদ আলী জিন্না ও আল্লামা ইকবালের পাকিস্তান প্রস্তাব ও দ্বিজাতি তত্ত্বের সক্রিয় ধর্মীয় বিরোধীতা করে লিখেছেন। এর উপর তিনি কুরআন শরীফ ও হাদীস শরীফ থেকে উদ্ধৃত করে দেখিয়েছেন যে, হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) যখন মক্কা থেকে৪ হিজরত করে মদীনাতে বাস করেছিলেন, তখন সেখানে মুসলমান, ইহুদী ও পৌত্তলিক আরবদের সমন্বয়ে গড়েছিলেন Ummah Wahidah, যাঁদের স্বীয় ধর্মচারণের স্বাধীনতা, এবং বহিঃশত্রু ইংরেজদের বিরুদ্ধে হিন্দু মুসলমানকে এক হয়ে লড়তে হবে, স্বাধীন দেশে স্বীয় ধর্মচারণের অধিকার নিয়েই একত্রে বসবাস করতে হবে।
এছাড়াও তিনি বিভিন্ন সভা সমাবেশে তাঁর এই বক্তব্যের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করেছেন যাতে প্রচারণা দ্বারা মানুষ বিভ্রান্ত না হয়। জৈনপুরে অনুষ্ঠিত জমিয়তের বার্ষিক অধিবেশনেও তিনি বিষয়টি আরো অধিকতর ব্যাখ্যা প্রদান করে বিষয়টি সুস্পষ্ট করে দিয়েছেন।
ক্রিপস মিশন ও হযরত মাদানীঃ
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে সারা পৃথিবীতে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। তাতে ভারতীয়দের স্বাধীনতার দাবীর প্রতি ব্রিটিশ সরকারকে নমনীয় হতে বাধ্য করে। ফলে ১৯৪২ খ্রীষ্টাব্দের ২৫শে মার্চ স্বাধীনতাকামীদের সাথে তাদের দাবী দাওয়ার বিষয়ে আলোচনা করার জন্য ব্রিটিশ সরকার মিঃ স্যার ক্রিপসকে পাঠান। এসময় সকল রাজনৈতিক দল ভারতের স্বাধীনতার রুপরেখার ব্যাপারে নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গির কথা মিঃ ক্রিপস এর সামনে তুলে ধরে । জমিয়ত উলামায়ে হিন্দের পক্ষ থেকে হযরত মাদানীও খুব গুরুত্বপূর্ণ ফরমূলা পেশ করেন। যা ইতিহাসে ‘মাদানী ফরমূলা’ নামে খ্যাত। এই ফরমূলায় হযরত মাদানী বলেনঃ-
১) মুসলমানদের পার্শনাল ল যথা – বিবাহ, তালাক, ওয়াকফ, ধর্মীয় শিক্ষা, ধর্মীয় বিশ্বাস, ধর্মীয় অনুষ্ঠান, উপাসনালয়, ধর্মীয় প্রচার ইত্যাদি ব্যাপারে সরকার বা আইন সভা হস্তক্ষেপ করতে পারবে না।
২) পূর্ণ স্বাধীনতা আমাদের লক্ষ্য।
৩) স্বাধীন ভারতের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের কালচার ভাষা ধর্মীয় অনুশাসন অনুষ্ঠান ইত্যাদি ক্ষেত্রে কেউ কোন প্রকার হস্তক্ষেপ পারবে না।
৪) যে কোন মামলার নিস্পত্তির জন্য ইসলাম ধর্ম অনুযায়ী মুসলমান কাজী জরুরী সেখানে মুসলমান কাজী নিয়োগ করতে হবে।
৫) প্রত্যেক প্রাপ্ত বয়স্কের ভোটাধিকার থাকবে।
৬) নির্বাচন যুক্তভাবে হবে।
৭) পাঞ্জাব ও বাংলায় কোন সম্প্রদায়ের জন্য আসন সংরক্ষন করা চলবে না । তবে সংখ্যানুপাতে কেউ দাবী জানালে তা করা হবে। অনুরুপভাবে অন্যান্য প্রদেশে আইন সভা এবং ফেডারেল এসেম্বলিতে সংখ্যানুপাতে সংখ্যালঘুদের আসন রিজার্ভ থাকবে।
৮) রাষ্ট্র ব্যাবস্থা ফেডারেল হবে। প্রত্যেকটি প্রদেশ পূর্ণ স্বাধীন থাকবে। সারা ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক সমান এবং সকল প্রদেশের সর্ব-সম্মত প্রদত্ত অধিকারগুলিই মাত্র কেন্দ্র বা ফেডারেল এসেম্বলির হাতে থাকবে।
কেউ কারু অনুগ্রহের উপর নির্ভর করে বাস করবে না। কেন্দ্রীয় সংগঠনের উপর আলোচনার মাধ্যমে পরস্পর সমঝোতা সাক্ষর পেশ করবেঃ-
১) নিম্ন অনুপাতে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের সদস্য কেন্দ্রীয় পরিষদে থাকবেন। হিন্দু ৪৫, মুসলমান ৪৫, অন্যান্য সম্প্রদায় ১০ ।
২) মুসলমান সদস্যের দুই-তৃতীয়াংশ যদি কোন বিল বা প্রস্তাবকে নিজ ধর্ম কৃষ্টি কালচার এবং রাজনৈতিক স্বাধীনতার উপর অশুভ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টিকর বলে মনে করে তবে উক্ত বিল পাশ হবে না।
৩) সমসংখ্যক মুসলমান এবং অমুসলমান ও জজ নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট যাবতীয় বিরোধের নিষ্পত্তি করবে।
জমিয়ত উলামায়ে হিন্দ বার বার এ বিষয়ে ঘোষণা দিয়ে আসছে যে, ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতাই জমিয়তের মূল দাবী। এ বিষয়ে গোটা ভারতবর্ষের মুসলমানদের ঐক্যমত রয়েছে এবং এটাকে তারা নিজেদের একমাত্র উপায় বলে মনে করে। জমিয়তের পক্ষ থেকে একথা স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, স্বদেশের স্বাধীনতার এই আবর্তে মুসলমানরা সম্পূর্ণরুপে স্বাধীন থাকবে। যে সব আইনের ভিত্তি এ সকল বিষয়ের পূর্ণ স্বাধীনতার উপর প্রতিষ্ঠিত হবে না এমন কোন আইন মুসলমানরা কখনোই মেনে নেবে না।
জমিয়ত উলামায়ে হিন্দ ভারতবর্ষের প্রদেশগুলোর পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধীকারের পূর্ণ সমর্থক। এক্ষেত্রে অনুল্লিখিত সকল বিষয়ের পূর্ণ ক্ষমতা ও ইখতিয়ার প্রদেশগুলোর হাতেই ন্যস্ত থাকবে। আর কেন্দ্রীয় সরকার কেবল ঐ সমস্ত বিষয়েরই অধিকার লাভ করবে, যেগুলো সকল প্রদেশের ঐক্যমতের ভিত্তিতে কেন্দ্রের উপর ন্যস্ত করা হবে এবং তা সকল প্রদেশের উপরই সমানভাবে কার্যকর হবে।
জমিয়ত উলামায়ে হিন্দের দৃষ্টিতে স্বাধীন প্রদেশগুলোর রাজনৈতিক ঐক্য একান্ত অপরিহার্য এবং এটা দেশের জন্য কল্যানকরও বটে। কিন্তু তা এমন রাজনৈতিক ঐক্য ও কেন্দ্রীয় শাসন ব্যবস্থা না হতে হবে যাতে নিজস্ব কৃষ্টি ও সংস্কৃতির ধারক নয়কোটি মুসলমানকে কোন সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের দয়া-দাক্ষিণ্যের উপর জীবন যাপন করতে হয়। এ হেন ঐক্য এক মুহুর্তের জন্য বরদাস্ত করা হবে না বরং কেন্দ্রের প্রশাসনিক অবকাঠামো এমন কিছু নীতিমালার উপর প্রতিষ্ঠিত হওয়া অত্যবশকীয় যাতে মুসলমানরা নিজেদের ধর্মীয়, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক স্বাধীনতার ক্ষেত্রে পূর্ণ আশ্বস্ত থাকতে পারে।
স্যার ক্রিপস রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলোচনার পর এরুপ একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, শুধুমাত্র প্রতিরক্ষা মন্ত্রালয় ব্রিটিশ সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন থাকবে, আর অন্য সকল বিষয়ে স্বাধীনতাকামীদের দাবী দাওয়া মেনে নেওয়া হবে। তবে বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা হবে।
ঠিক এই সময়ে ২০, ২১, ২২ মার্চ ১৯৪২ ইং হুসাইন আহমদ মাদানী (রহঃ) এর সভাপতিত্বে জমিয়ত উলামার বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনে সভাপতির ভাষণে হযরত মাদানী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কতগুলো বিষয়ের উপর আলোকপাত করেন।
বিশ্বযুদ্ধ সম্পর্কে তিনি বলেন, এ যুদ্ধ ভারত থেকে অনেক দূরে চলছে। কিন্তু কুচক্রী ইংরেজরা ভারতকে এ যুদ্ধের সাথে জড়িয়ে ফেলার চেষ্টা করছে। অথচ এ যুদ্ধ চলাকালে ব্রিটিশ সরকার তার অধীনস্থ অন্যান্য সাম্রাজ্যগুলোকে আপন আপন সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ দিয়েছে, কিন্তু ভারতবর্ষকে সে সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে তিনি ‘আটলান্টিক চার্টার’ চুক্তির কথা উল্লেখ করে বলেন যে, এই বিশ্ব পরিকল্পনার আওতায় ব্রিটিশ সরকারও তার অধীনস্থ অসহায়, স্বাধীনতা বঞ্চিত মানুষের জন্য স্বাচ্ছন্দ ও স্বাধীনতা প্রদানের চিত্তাকর্ষক অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছিল। ফলে ভাতবাসীও আশা করেছিল যে, এই চুক্তির অঙ্গীকার মোতাবিক তারাও স্বাধীনতা লাভ করতে পারবে। কিন্তু ১৯৪১ সালের সেপ্টেম্বরে মিঃ চার্চিল এ কথা পরিস্কার করে দিয়েছেন যে, ভারতবাসীরা যদি এই চার্টারের অঙ্গীকার মুতাবিক তাদের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের আশা করে থাকে তাহলে এটা তাদের জন্য নিষ্ফল আশা হবে। এ চুক্তির আওতায় ইউরোপের ক্ষুদ্র ক্ষুত্র অঞ্চলগুলোকে স্বাধীনতা লাভের সুযোগ প্রদান করা হয়েছে মাত্র।
হুসাইন আহমদ মাদানী (রহঃ) বলেন, এজন্যই জমিয়ত মনে করে যে, মিঃ ক্রিপসের সাথে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে আলোচনা করতে হবে। কারণ ওরা আমাদেরকে বারবার ধোঁকা দিচ্ছে। আমরা আমাদের স্বাধীনতার অভীষ্ট লক্ষ্য থেকে কখনোই পিছপা হতে চাই না। অত্যাচারী জালেমের সম্মুখে মাথা নত করতে আমরা কখনোই প্রস্তুত নই।
দেশে বিরাজমান সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার উপর আলোকপাত করতে গিয়ে তিনি বলেনঃ- এটা মূলতঃ ইংরেজ পলিশিরই পরিণতি। অন্যথায় দীর্ঘকাল যাবৎ এদেশে হিন্দু মুসলমান মিলে মিশে বাস করে আসছে, কখনোই তাদের মাঝে এরুপ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছিল না। তিনি আরও বলেন, যদিও এদেশে দীর্ঘদিন মুসলমানরা রাজত্ব করেছে, কিন্তু সে সময় হিন্দুরাও বড় বড় সরকারী পদে নিয়োজিত ছিল। একথা বলতে দ্বিধা নেই যে, ভারতবর্ষের স্বাধীনতা রক্ষা ও সমাজ পুনর্গঠনে মুসলমানদের অবদান অনেক বেশী। এদেশে মুসলমানের সংখ্যা নয় থেকে দশ কোটি। সভ্যতা ও সাংস্কৃতিক বিকাশে মুসলমানদের ভূমিকায় অগ্রগণ্য। তারা সারা দেশেই ছড়িয়ে রয়েছে। মোট ১১টি প্রদেশের মাঝে ৪টিতে তারা সংখ্যা গরিষ্ঠ। ভবিষ্যত পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রদেশের সংখ্যা ১৩তে উন্নতি করা হলেও ৬টিতে মুসলমান সংখ্যা গরিষ্ঠতা সৃষ্টি হবে। এই পরিস্থিতিতে যদি মুসলমানদের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বলে গণ্য করা হয় তবে মারাত্মক ভূল করা হবে। ব্রিটিশের অনুগ্রহ ছাড়া জীবন ধারণ দুষ্কর হবে – মুসলমানরা কি এখনও এই বিভ্রান্তিতে থাকবে? কখনোই না, মুসলমান হয়ত নিজের ধর্মীয় স্বাধীনতা, আদর্শ ও সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা নিয়ে বেঁচে থাকবে, অন্যথায় গোলামীর জীবন অপেক্ষা মৃত্যুকেই প্রাধান্য দিবে।
স্বাধীন ভারতের রুপরেখা সম্পর্কে রাজনৈতিক দলগুলোর দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি আলোকপাত করতে গিয়ে তিনি বলেন, একদল এরুপ চিন্তাভাবনা করছে যে, স্বাধীনতার পর এদেশের ক্ষমতা সংখ্যা গরিষ্ঠ হিন্দুদের হাতেই থাকবে। আরেক দলের চিন্তাভাবনা এর সম্পূর্ণ বিপরীত। তারা সর্বভারতীয় ঐক্যকে ভেঙ্গে দিয়ে প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্য পৃথক ভূ-খণ্ডের দাবী উত্থাপন করছে, আর এই ভাগ বণ্টনের দায়িত্ব তারা ব্রিটিশ সরকারের হাতেই ন্যস্ত করতে চাচ্ছে। স্বতন্ত্র পাকিস্তানের দাবী তারা বেশ জোরেশোরেই প্রচার করছেন। কিন্তু তারা কি করে দেখেছেন যে, ভারতের প্রত্যেক প্রদেশেই রয়েছে মুসলমানদের অধিবাস, রয়েছে তাদের ধর্মীয় পবিত্র স্থান – মসজিদ, মাদ্রাসা, খানকা ও বিস্তর ওয়াকফ সম্পত্তি। হাজার বছরে গড়ে উঠা এইসব ঐতিহ্য যা তিলে তিলে গড়ে উঠেছে – তা ছেড়ে যাওয়া কি সম্ভব? সেদিন তিনি যেন ভবিষ্যৎ সম্পর্কে চাক্ষুস দেখে দেখে বলেছিলেন যে, “পাকিস্তান আন্দোলনের নেতৃবৃন্দের যে দৃষ্টিভঙ্গি তাতে ইসলামের দোহাই দিয়ে অর্জিত ভূ-খণ্ডের শাসন ব্যবস্থা কখনই ইসলামী শাসন ব্যবস্থা হবে না। বরং সে রাষ্ট্রের সংবিধানের মূল ভিত্তি হবে ইউরোপীয় গণতন্ত্র। যদি মুসলমানদের জন্য পৃথক ভূ-খণ্ড করা হয় তাহলে অবশিষ্ট হিন্দু অধ্যুষ্যিত ভূ-খণ্ডে মুসলমানদের সংখ্যা সর্বোচ্চ সংখ্যা দাঁড়াবে শতকরা চৌদ্দজন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এ সংখ্যা শতকরা ৫% থেকে ৬% এ নেমে আসবে। পক্ষান্তরে মুসলমানদের জন্য পৃথক করা ভূ-খণ্ডে অমুসলিমদের সংখ্যা হবে শতকরা ৪৫ জন। এমতাবস্থায় এই সংখ্যাভারী সংখ্যালঘু সম্প্রদায় প্রস্তাবিত মুসলিম রাষ্ট্রের জন্য এক বিরাট হুমকী হয়ে দাঁড়াবে। অথচ হিন্দু অধ্যুষিত এলাকায় অবস্থানরত প্রায় সাড়ে তিনি কোটি মুসলমানকে এক করুণ পরিণতি ও অসহায় মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হবে। একি কোন দুরদর্শী রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত হবে? এটা বরং আত্মহননেরই নামান্তর। কেননা এ প্রস্তাবে যেখানে মুসলমানরা সংখ্যা গরিষ্ঠ সেখানে মুসলমানদের হিফাজত ও নিশ্চিত জীবনের ব্যবস্থা রয়েছে বটে কিন্তু যেখানে তারা সংখ্যালঘু অসহায় সেখানে তাদেরকে নিশ্চিত ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেওয়ার আয়োজন করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে তিনি স্বাধীন ভারতের রূপরেখা সম্পর্কে জমিয়ত উলামায়ে হিন্দের দৃষ্টিভঙ্গির কথাও তুলে ধরেন। তিনি বলেন, অন্য একটি চিন্তা ভাবনা এরুপ যে, প্রত্যেক প্রদেশ স্বাধীন ও স্বায়ত্বশাসিত সরকার কর্তৃক পরিচালিত হবে, স্বাধীন ভারতকে সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালনার জন্য সুনির্দিষ্ট কতিপয় মৌলিক নীতিমালার আওতায় প্রত্যেক প্রদেশ থেকে সদস্য নিয়ে একটি কেন্দ্রীয় সরকার গঠিত হবে। কেন্দ্রীয় সরকার প্রাদেশিক সরকারের স্বাধীনতার উপর কোনরুপ হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। কেন্দ্রীয় সরকারের জন্য নির্ধারিত সকল প্রদেশের সদস্যরা সর্বসম্মতিক্রমে যে সব অধিকার কেন্দ্রকে প্রদান করবে কেন্দ্রীয় সরকার কেবল মাত্র সে সব বিষয়ে নিয়ন্ত্রনের অধিকার প্রাপ্ত হবে। প্রত্যেক সরকারই সংখ্যালঘুদের সভ্যতা সংস্কৃতি এবং ধর্মীয় অধিকার সংরক্ষণের প্রতি যত্নবান হতে আইনগতভাবে বাধ্য থাকবে। প্রত্যেক সম্প্রদায়ই তাদের ধর্মীয় ও সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করবে। এ পন্থায় প্রশাসনিক অবকাঠামো গড়ে উঠলে প্রত্যেক অঞ্চলেই সংখ্যালঘুরা নিরাপত্তার সাথে বসবাস করতে পারবে। আর যেহেতু কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণ থাকবে সুতরাং কোন অঞ্চলেই সংখ্যাগুরুরা সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচার করতে পারবে না।
মিঃ ক্রিপসের প্রস্তাব ছিল একটি ভবিষ্যত অঙ্গিকার মাত্র। কারণ যুদ্ধ শেষ হলেই তা কার্যকর করার উদ্যোগ নেওয়া হবে। সুতরাং এ প্রস্তাবে স্বাধীনতাকামী কোন দলই সম্মত হয়নি। বরং তারা আইন অমান্য আন্দোলন শুরু করে। ফলে ব্যাপক ধরপাকড় শুরু হয়। এ সময় যারা কারাবরণ করেন তাদের মাঝে মাওলানা আহমদ আলী (সভাপতি জমিয়ত উলামায়ে হিন্দ, পাঞ্জাব), মাওলানা হিফজুর রহমান সিউহারবী, মাওলানা কাসেম শাহজাহানপুরী, মাওলানা আবুল ওয়াফা শাহজাহানপুরী, মাওলানা শাহেদ মিয়া এলাহাবাদী, মাওলানা ইসমাইল সামবুলী, মাওলানা আখতারুল ইসলাম মুরাদাবাদীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এ সময় কংগ্রেসেরও অনেক নেতাকে গ্রেফতার করা হয়। (তথ্যসূত্রঃ দেওবন্দ আন্দোলনঃ ইতিহাস ঐতিহ্য অবদান)
মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানী (রহঃ) ছিলেন একদিকে প্রখর রাজনীতিবিদ তেমনি উদার এবং অসাম্প্রদায়িক। তিনি দ্বি-জাতিতত্ত্বে (Two Nation Theory) বিশ্বাসী ছিলেন না। তিনি হিন্দু মুসলমানের সমন্ববিশ্বাসী ছিলেন। সেজন্য মুসলিম লীগ তাঁকে শারিরিক নিগ্রহ করে এবং হামলা এবং হত্যার হুমকী দেয়। তাঁর উপর অনেকগুলি হামলা করা হয়। এরকম একটি হামলার দৃষ্টান্ত ঐতিহাসিক সুরজিৎ দাশগুপ্ত তাঁর গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন,
“পাকিস্তান প্রস্তাবের জবাবে হিন্দুস্থান মুলকে এক ঐক্যবদ্ধ ও যৌগিক, সংযুক্ত ও সংহত জাতির ধারণাকে প্রচার করার জন্য মৌলানা মাদানী সেবার মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশ অখণ্ড বাংলায় আসেন। রাজশাহী ও রংপুরে কয়েকটি সভা করে পার্বতীপুর জংশন হয়ে সৈয়দপুরে যাবেন। পার্বতীপুরে তাঁকে ঘেরাও করে লীগপন্থীরা তাঁকে হত্যার জন্য হুমকী দিতে শুরু করে। মৌলানার সঙ্গীরা নিজেদের প্রাণ বিপন্ন করে তাঁকে বাঁচান, কেউ কেউ জখমও হয়। হামলাবাজদের মধ্যে অনেকে ছিল ঘোর মাতাল। মৌলানা ও তাঁর সঙ্গীরা কোনও মতে পার্বতীপুর স্টেশনের ভেতরে ঢুকে পড়েন এবং সেখানেই রাত কাটান। ভোরের ট্রেনে কটিহার আসেন। পার্বতীপুরে ছিল গুণ্ডা ও মাতালের হামলা, কিন্তু কটিহারে এক দল স্কুলের ছাত্র তাঁকে ছেঁড়া জুতোর মালা পরিয়ে দিয়ে মাখিয়ে দেয় নর্দমার পাঁক। সেই সঙ্গে ছেলের দল তাঁকে মেরে ফেলার জন্য আওয়াজ তুলতে থাকে।” (প্রসঙ্গঃ সাম্প্রদায়িকতা, পৃষ্ঠা-১৩৩/১৩৪)
এই হামলা তাঁর উপর এজন্যই করা হয়েছিল যে তিনি দ্বি-জাতি তত্ত্বের সমর্থক ছিলেন না এবং পাকিস্তান প্রস্তাবে তিনি সমর্থন করেন নি। তিনি চান নি ভারত ভেঙ্গে টুকরো হোক। আর সব থেকে বড় কারণ ছিল মুসলিম লীগের হুসাইন আহমদ মাদানী (রহঃ) এর জাতিয়তাবাদের উপর যে বক্তব্য দিয়েছিলেন তার ভূল ব্যাখ্যা।
নিজ জাতির প্রতি তাঁর ভালবাসা এতই ছিল যে, তিনি সর্বদা স্বদেশে তৈরী পোষাকাদী পরিধান করতেন এবং স্বদেশী পণ্যই ব্যবহার করতেন। এটি তিনি একাই করতেন না বরং অন্যদেরকেও এ ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করতেন। এছাড়াও, তাঁর ঘোষণা ছিল – আমি ঐ ব্যক্তির জানাযা পড়বো না যার কাপড় স্বদেশী না হবে। ঐ বিবাহ পড়াবো না যে বিবাহে মেয়ের পক্ষ থেকে উপঢৌকন হযরত ফাতেমা (রাঃ) – এর উপঢৌকনের ন্যায় না হবে। এভাবে তিনি সারা জীবন বিভিন্নভাবে ন্যায় প্রতিষ্ঠা ও সমাজ সংস্কারসহ ব্রিটিশ দুঃশাসনের বিরুদ্ধে জিহাদ করে গেছেন।
হযরত মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানী (রহঃ) তাঁর জীবনে ৬২ বছরে ইলম এবং আমলের এমন এমন আলোকবর্তিতা তৈরী করে গেছেন যার দ্বারা পাক-ভারত ছাড়াও সদূর হেজাজের জ্ঞানপিপাসুরাও উপকৃত হয়েছেন। একটি তথ্য মতে ৪০ হাজার আলেম তাঁর কাছ থেকে জ্ঞান লাভ করে ধন্য হয়েছেন। তিনি তিনি ১৬৭ জনকে ইসলাহী খেলাফত দানে সম্মানিত করেন। তাসাউফ এবং আধ্যাত্মিকতার জগতেও তিনি ছিলেন সেকালের অদ্বিতীয় ব্যক্তিত্ব। তিনি দীর্ঘকাল যাতৎ জমিয়ত উলামায়ে হিন্দের সভাপতি ছিলেন। তিনি ছোট-বড় প্রায় চল্লিশের বেশীর গ্রন্থ রচনা করে জাতির জন্য রেখে গেছেন। হযরত মাদানী ছিলেন সুন্নতে নববীর অনুপম প্রতিচ্ছবি ও অকৃত্রিম প্রেমিক। তাঁর গোটা জীবনের প্রতিটি ক্রিয়া-কর্মই সুন্নতের আঙ্গিকে সম্পাদিত হয়েছে।