আমরা দেখেছি এনসিইআরটি পরিবেশিত সিলেবাস অনুযায়ী ষ্কুলগুলিতে মারাঠা, রাজপুত, মৌর্য, অশোক ইত্যাদি পড়ানো হয়। ৬ থেকে ১২ ক্লাস পর্যন্ত পাঠদানের সময় মুঘলদের সঙ্গে সঙ্গে বিজয়নগর, মারাঠা, সমুদ্র গুপ্ত এবং অশোকের সাম্রাজ্য নিয়ে পড়ানো হয়। বর্তমানে সমাজমাধ্যম ও কিছু কিছু মহল থেকে দাবি তোলা হচ্ছে স্কুলগুলিতে শুধুমাত্র মুঘল সাম্রাজ্য নিয়েই পড়ানো হয়। দাবি থেকে মনে হতে পারে গুপ্ত, মৌর্য, মারাঠা, রাজপুত, চোল বা অহম সাম্রাজ্য নিয়ে কোন কিছু পড়ানো হয় না।
দ্য কুয়িন্টের ওয়েবকুফ (The Quint’s WebQoof team) দলটি এন সি ই আর টি (ন্যাশনাল কাউন্সিল অফ এডুকেশনাল রিসার্চ এন্ড ট্রেনিং) পরিবেশিত ৬ থেকে ১২ শ্রেণীর ইতিহাস বইগুলিতে তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখেছেন, মুঘল সাম্রাজ্য ছাড়াও মারাঠা, রাজপুত, বিজয়নগর,গুপ্ত, মৌর্য, অশোকের সাম্রাজ্য নিয়েও পড়ানো হয়।
কুইন্টের কাছে এটা নতুন কথা নয়, এর আগেও কোন একটি মহল থেকে ইতিহাসকে বিকৃত করার অভিযোগের বিরুদ্ধে কাজ করতে হয়েছিল।
অভি ও নিয়ু (@abhiandniyu). টুইটার একাউন্টে দাবি করেছেন,
“স্কুলে পড়ার সময় আমরা হৃদয় দিয়ে বুঝেছি বাবরের উত্তরাধিকার সম্পর্কে। কেউ এখনও মুঘল রাজাদের নাম আবৃত্তি করতে পারে। এখন সময় এসেছে অন্যান্যদের সম্পর্কে জানার।”
টুইটটি অন্যান্যরা বারবার রিপিট করেছে। এ ক্ষেত্রে রিড ফেক নিউজ ইন্টারনেটে ইতিহাসকে পুনরায় বলার জন্য হিন্দুত্বকে সাহায্য করছে। এন সি ই আর টির ডিজিটাল সিলেবাস পরীক্ষা নিরীক্ষায় পর দেখা গেল ভাইরাল হয়ে যাওয়া এই দাবি সম্পূর্ণ মিথ্যা।
এন সি ই আর টি পরিবেশিত ১২ ক্লাসের সিলেবাস ‘থিমস অফ ইন্ডিয়ান হিস্টরি-২’ তৃতীয় অধ্যায়ে বিজয়নগর বংশ কাল হিসাবে ১৪ থেকে ১৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল এর পরের ১২৫ টকস-এ মুঘল সাম্রাজ্য নিয়ে আলোচনা রয়েছে।
(চিত্র-১)-এ বলা হয়েছে, সাম্রাজ্যের রাজধানী বিজয়নগর ১৪ থেকে ১৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।
বিজয়নগর অর্থাৎ ‘দ সিটি অফ ভিক্টোরি’ সাম্রাজ্য ও রাজধানী উভয়ের নাম ছিল। সাম্রাজ্যটি চৌদ্দ শতকে স্থাপিত হয়েছিল এবং তার সর্বোচ্চ বিস্তারকালে উত্তরে কৃষ্ণা এবং উপদ্বীপের সর্ব দক্ষিণ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। ১৫৬৫ খ্রিস্টাব্দে নগরীটি দখল হয়ে যায় এবং এরপরে পরিত্যক্ত হয়ে যায়। এর পর সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। কৃষ্ণা-তুঙ্গভদ্রা দুই জলবিভাজিকার মানুষদের মধ্যে কিন্তু এরা জাগরুক ছিল। তারা একে হাম্পি বলে ডাকত যা ছিল এক স্থানীয় দেবী ‘পম্পা দেবী’র নামানুসারে। মৌখিক নাম এবং প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন, ইমারত, খোদাইকৃত ইতিহাস এবং অন্যান্য আবিষ্কারের পর পন্ডিতেরা বিজয়নগর সাম্রাজ্যের অস্তিত্ব বুঝতে পারেন।
১৮০০ খ্রিস্টাব্দে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ইঞ্জিনিয়ার ও প্রত্নতত্ত্ববিদ কর্নেল কলিন মাকেঞ্জী সর্বপ্রথম এই স্থানটির উপর আলোকপাত করেন। তিনি এলাকার প্রথম সার্ভে মানচিত্র প্রস্তুত করেন এবং সাহায্য নেন স্থানীয় বিরুপাক্ষ মন্দিরের পুরোহিত ও পম্পা দেবীর মন্দিরের পুরোহিতের নিকট থেকে। ১৮৩৬ থেকে হাম্পির বিভিন্ন মন্দির থেকে খোদাইকৃত বিভিন্ন বস্তু সংগ্রহ করা শুরু হয় ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে ফটোগ্রাফি শুরু হয়। এরপর নগরী ও সাম্রাজ্যের ইতিহাসের পুনর্নির্মাণে ইতিহাসবিদরা বিদেশি পর্যটকদের লিখিত বর্ণনা, তামিল, তেলেগু, হিন্দি ও সংস্কৃত ভাষার সাহিত্যের সাহায্য নেন।
হিন্দু ভগবানদের বিতর্কিত গ্রাফিক নিয়ে কেউ কোনো মন্তব্য করেনি। পশ্চিমবঙ্গের পাঠ্যপুস্তকেও বিজয়নগর নিয়ে বিস্তারিত লেখা রয়েছে। ওসব জানতে গেলে কুইন্টের দ্বারস্থ হওয়ার প্রয়োজন নেই চোখ কান খোলা রাখলেঔ পাওয়া যায়। পশ্চিমবঙ্গের পাঠ্যপুস্তকে বিজয়নগর সম্পর্কিত পরিব্রাজকদের বর্ণনাসমূহ দিয়েছি। (চিত্র ১-এ)
এনসিইআরটি পরিবেশিত সপ্তম শ্রেণীর বই আওয়ার পাস্টস-২-র দ্বিতীয় অধ্যায়ের নাম “নিউ কিংস এন্ড দেয়ার কিংডামস”। এই অধ্যায়ে স্থান পেয়েছে চাহমান, গুর্জর, চান্ডেল, পারমার ইত্যাদি বংশ। একটি মানচিত্র প্রকাশিত হয়েছে যেখানে এই বংশগুলি বিস্তার লাভ করেছিল। এই অধ্যায়ে এই বংশগুলির সাংস্কৃতিক পরম্পরা সম্বন্ধেও আলোচনা রয়েছে। (চিত্র-২)
সপ্তম শতাব্দীর পর বিভিন্ন বংশ প্রকাশ্যে আসে। ১ নং মানচিত্রে দেখতে পায় সপ্তম থেকে দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে গুর্জর- প্রতিহার, রাষ্ট্রকূট, চোল, পাল বংশ, চাহমান বা চৌহানরা রাজত্ব করেছিল। এখন কি কেউ বলতে পারে এদের সম্রাজ্য কোন কোন জায়গায় ছিল?
রাজা রাজা-১ কে চোল রাজাদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী বলা হযলত। ৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে রাজত্ব লাভ করেন এবং সমস্ত এলাকায় রাজ্য বিস্তার করেন। রাজারাজ-১-এর পুত্র রাজেন্দ্র-১ গাঙ্গেয় উপত্যকা থেকে শ্রীলংকাসহ পুর্ব ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ পর্যন্ত সাম্রাজ্য বিস্তার করেছিলেন।
থাঞ্জাভুর ও গাঙ্গালকান্ডাপুরমের বিশাল বিশাল মন্দিরগুলি নির্মাণ করেছিলেন রাজা রাজা-১ ও তদীয় পুত্র রাজেন্দ্র-১। এইগুলি স্থাপত্য ও ভাস্কর্যগত ভাবে অত্যাশ্চর্য।
চোলরা যেখানেই মন্দির নির্মাণ করেছেন সেখানেই উপনিবেশ তৈরি করেছিলেন। এগুলি ছিল হস্ত শিল্প উৎপাদন কেন্দ্র। মন্দির গুলির জন্য রাজা ও অন্যান্য মহান ব্যক্তিরা জমি বরাদ্দ করতেন। এই সকল জমির উৎপাদন মন্দির বসত নির্মাণ কাজে লাগতো। ছবিতে গঙ্গালকান্ডাপুরমের মন্দিরের ছবি দেখা যাচ্ছে। ছবিতে ছাদের উপর পর্যন্ত যাওয়ার রাস্তা দেখা যাচ্ছে। ছবিতে মন্দিরের বাইরের গাত্র সুসজ্জিত করার জন্য প্রচুর প্রস্তর নির্মিত স্থাপত্য দেখা যাচ্ছে। ৭-ম শ্রেণীর বই আওয়ার পাস্ট-২-র দশম অধ্যায়ে মারাঠা ও রাজপুতরা স্থান পেয়েছে। এই অধ্যায়েই মারাঠা ও রাজপুতরা মুঘল সাম্রাজ্যের সংকোচনে বা সমস্যা তৈরিতে কতটা সহায়তা দান করেছিল তার বর্ণনা পাওয়া যায়।
৬ ষ্ঠ এন সি ই আর টি পরিবেশিত সিলেবাসের নাম আওয়ার পাস্টস-১-এ অন্য রাজাদের কথা বলেছে, এবং সাম্রাজ্য পরিচালনায় যে পদ্ধতি তারা অবলম্বন করেছে। এই বইয়ের পঞ্চম অধ্যায়ে বলা হয়েছে আড়াই হাজার বছর আগে মগধ ছিল ভারতবর্ষের সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী সাম্রাজ্য। এই বইটির সপ্তম অধ্যায়ে সম্রাট অশোক ও তাঁর মৌর্য সাম্রাজ্য সম্বন্ধে জানা যায় এবং দশম অধ্যায় সমুদ্রগুপ্ত সম্বন্ধে বিস্তারিত জানা যায়। সম্রাট অশোক যিনি যুদ্ধ-বিগ্রহ পরিত্যাগ করেছিলেন।
রোহনের রুপি: রোহন তার জন্মদিনে তার দাদুর দেওয়া কড়কড়ে নোটটিকে মুঠো করে ধরল। যখন তার প্রয়োজন ছিল একটি সিডি কেনার। সে এটাও চাইছিল কড়কড়ে নতুন নোটটিকে দেখার এবং অনুভব করার। এরপর সে লক্ষ্য করলো নোটটির ডানদিকে ডানদিকে গান্ধীজীর হাস্যরত ছবি অঙ্কিত রয়েছে, এবং বামদিকে রয়েছে একটি ক্ষুদ্র চিহ্ন। সে আশ্চর্য হয়ে বলল এখানে সিংহ কেন?
একটি বৃহৎ রাজ্য – একটি সাম্রাজ্য
আমরা আমাদের নোট ও মুদ্রায় যে সিংহের ছবিগুলি দেখে তার পিছনে রয়েছে একটি ইতিহাস। এগুলি খোদিত হয়েছে পাথরের উপরে এবং সারনাথের বিশাল পাথরের স্তম্ভের উপর স্থাপিত হয়েছে ( যেমন তোমরা সপ্তম অধ্যায়ে পড়েছ)। অশোক হলেন ইতিহাসে একজন মহত্তম শাসক যিনি তাঁর নির্দেশগুলি স্তম্ভের উপর লিখে রাখা হতো, একইসঙ্গে পাথরের উপর। এই সকল নির্দেশগুলিতে কি লেখা থাকত তা জানার আগে জেনে নিই তাঁর রাজ্যকে সাম্রাজ্য কেন বলা হত?
যে সাম্রাজ্যে সম্রাট অশোক রাজত্ব করতেন সেই সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন তাঁর ঠাকুরদা চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য ২৩০০ বছর আগে। চন্দ্রগুপ্তকে সহায়তা দান করেছিলেন এক জ্ঞানী ব্যক্তি যাঁর নাম চাণক্য বা কৌটিল্য। অর্থশাস্ত্র নামক পুস্তকে চাণক্যের বিভিন্ন আইডিয়াগুলি লিপিবদ্ধ রয়েছে।
রাজবংশ তাকেই বলে যখন একই বংশের শাসকরা উত্তরাধিকারসূত্রে রাজত্ব করে। মৌর্য হল একটি রাজবংশ খানের তিনটি উল্লেখযোগ্য রাজা ছিলেন চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য, তদীয় পুত্র বিন্দুসার এবং বিন্দুসার-এর পুত্র অশোক। এটি একেবারে স্বচ্ছ যে সোশ্যাল মিডিয়ায় যে দাবি করা হয়েছে স্কুল গুলির ইতিহাস বইগুলিতে শুধুমাত্র মুঘল সাম্রাজ্যের ঘটনাই পড়ানো হয় হল একটি মিথ্যা দাবি। দ্য কুইন্ট এটা আগে প্রমাণ করেছে যে এটা মিথ্যা।
কুইন্টের মতে তারা শুধুমাত্র জনসাধারণের কাছেই দায়বদ্ধ। সদস্য হয়ে সংবাদিকতা নির্মাণে তারা একটা সক্রিয় ভূমিকা রাখতে চায়। কারণ, সত্য এটাই চায়।
ফ্যাক্ট চেক-এর কোন প্রয়োজনই নেই। আমাদের ক্লাস সিক্স, সেভেন, এইটের অতীত ও ঐতিহ্য ঘাঁটলেই প্রকৃত তথ্য উঠে আসে। মুসলিম আবির্ভাবের অনেক আগে থেকেই প্রাচীন ভারতীয় হিন্দু ও বৌদ্ধ রাজাদের কীর্তিকলাপ আলোচিত হয়েছে।
‘নবজাগরণ’ অ্যান্ড্রোয়েড অ্যাপ্লিকেশনটি প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর টেলিগ্রাম চ্যানেলে জয়েন হতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর ফেসবুক পেজে লাইক করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।