লিখেছেনঃ বিপন চন্দ্র
প্রথমেই বলে নেওয়া ভালাে যে আধুনিক ভারতে সাম্প্রদায়িকতা কী কারণে আবিভূত এবং বর্ধিত হয়েছিল সে প্রসঙ্গ এই রচনার মূল উপজীব্য নয়। এখানে প্রধানত আলােচনার বিষয় হলো ভারতবর্ষে ইতিহাস-রচনা এবং শিক্ষণের সঙ্গে সাম্প্রদায়িকতাবিস্তারের যােগ। সেইসঙ্গে ভারতীয় ঐতিহাসিকরা কেন সাম্প্রদায়িকতার অনুকূলে থেকেছেন সে সম্বন্ধেও কিছু আলােকপাতের চেষ্টা করা হবে। আজকের দিনে এ কথাটা অনেকেই মানবেন যে গত একশাে বছর সাম্প্রদায়িকতা প্রসারের জন্যে ভারতে ইতিহাসশিক্ষা অনেকটাই দায়ী। প্রকৃতপক্ষে, একটুও অত্যুক্তি না করেই বলা চলে যে ঐতিহাসিকদের সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গিই বরাবর ভারতবর্ষে সাম্প্রদায়িক মতবাদকে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করে এসেছে। এই দৃষ্টিভঙ্গি বাদ দিলে সাম্প্রদায়িক মতবাদের আর বিশেষ কিছুই বাকি থাকে না।
[১]
প্রথমেই দেখা যায় যে জাতীয়তাবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা, উভয়েই একই ধরনের একটি আধুনিক প্রক্রিয়ার ফল। এই প্রক্রিয়া হলে সমস্ত দেশের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক ঐক্য। এর ফলে আনুগত্য এবং অন্যান্য যােগসূত্রগুলি আরো ব্যাপক করবার প্রয়ােজন দেখা দিলাে। রাজনীতিক জীবনের ভিত্তিরূপ দরকার হলো নতুন ঐক্য নীতির। কাজে কাজেই, দুটি মতবাদই মূলত আঠারাে শতকের পরবর্তী আধুনিক লক্ষণ। দুই দলই অতীতকে সাক্ষ্য মানার চেষ্টা করেন, অতীতের মতবাদ, আন্দোলন ও ইতিহাসের সঙ্গে যােগাযােগ স্থাপনের চেষ্টা করতে পারেন। কিন্তু তার মানে এই নয় যে অতীতেও এই দুটি মতবাদের অস্তিত্ব ছিলাে। বস্তুত ডাঃ মিল থাপায় এবং শ্রীহরবংশ মুখিয়া তাঁদের আলােচনায় দেখিয়েছেন যে ভারতে ইতিহাসের প্রাচীন এবং মধ্যযুগে সাম্প্রদায়িক চেতনার অস্তিত্ব ছিলাে না।
জাতীয়তাবাদও সেইরকমই একটি সম্পূর্ণ নতুন সাংগঠনিক নীতি ও মতবাদ। প্রথমদিকের জাতীয়তাবাদী নেতারা, যেমন সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, লােকমান্য তিলক একথা মানতেন এবং ভারতবর্ষকে তারা মনে করতেন এমন একটি জাতি, যা সবে গড়ে উঠছে। মতবাদ হিসেবে জাতীয়তাবাদ সার্থকতা পেলে এই কারণে যে তা প্রকৃত সত্যের যথার্থ প্রতিফলন ভারতীয় জনসাধারণের সমগ্র স্বার্থ বিশেষ কয়ে একটি শক্রর (বিদেশী সাম্রাজ্যবাদ) বিরুদ্ধে গিয়ে সত্যই ক্রমশঃ এক হয়ে মিশে যাচ্ছিল। এমন কয়েকটি বিশেষ বিশেষ স্থানে ও স্তরে আবির্ভূত হলে, যেখানে এই নতুন জাতীয়তাবাদী চেতনা গড়ে উঠতে পারেনি। অন্যভাবে বলা যায় যে, জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি ও মতবাদ গভীরে প্রবেশ করতে পারলাে না বলেই সাম্প্রনায়িকতার সৃষ্টি হলাে।
এই পরিস্থিতিতে জনগণের মধ্যে ব্যাপকতর যােগাযােগ ও ঐক্যের প্রয়ােজন অত্যাবশ্যক হয়ে উঠেছিলাে। কিন্তু সেখানে যখন নতুন সংগঠননীতিটি (অর্থাৎ জাতীয়তাবাদ) বিশেষ গভীরে পৌঁছাতে পারলাে না, তখন সামাজিক, সাংস্কৃতিক এমন কি নতুন গড়ে ওঠা রাজনীতিক জীবনেও পূর্বপ্রচলিত স্তভেদও বিভেদনীতিকে আহ্বান জানানাে অবশ্যম্ভাবী হয়ে দাড়ালাে। অর্থাৎ এভাবে বলা যায় যে, যেখানে একাত্ম-চেতনার প্রয়ােজন ছিল অথচ নতুন জাতীয়তাবাদী ঐক্য গড়ে ওঠেনি সেখানে যখন ঐক্যের সন্ধান করা হলাে, তখন দরকার হল আয়ে পুরােনাে, অধিকতর পরিচিত একতাবােষের এই নতুন পরিস্থিতিতে সেগুলি যতােই অনুপযুক্ত হক না কেন। ধর্মীয় একাত্মতাবােধ শুধু নয়, বর্ণগত, উপজাতিগত, ভাষাগত এবং আঞ্চলিক ঐক্যবােধ—সবই একই উদ্দেশ্য সিদ্ধ করলাে। যেমন, মহারাষ্ট্রে যদিও এখানকার মতাে আগেও হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা যথেষ্ট প্রবল ছিলাে, তবুও তার নেতাদের সব উদ্দেশ্য বানচাল হয়ে গেলাে ব্রাহ্মণবিরােধী আন্দোলনের জন্যে। মাদ্রাজেও অনুরূপ ঘটনা ঘটলাে। দক্ষিণ পাঞ্জাবে (আজকের হরিয়ানায়) জাঠদের বর্ণাশ্রয়ী আন্দোলনের ফলে হিন্দু সাম্প্রদায়িক ও জাতীয়তাবাদী উভয়ই ক্ষতিগ্রস্ত হলেন।
সুতরাং সাম্প্রদায়িকতাকে অতীতের অবশেষ অথবা সনাতন মতবাদের পুনরুত্থান হিসেবে দেখলে ভুল হবে। সাম্প্রদায়িকতার মূলে বরাবরই থেকেছে, গত একশাে বছরের ইতিহাসের ধারা সম্বন্ধে একটি মিথ্যা চেতনা। পরে আমরা দেখবাে যে, সমসাময়িক সাম্প্রদায়িক রাজনীতির চাপে ঐতিহাসিকরা এটিকে অতীতের অমৃত ব্যাখ্যা হিসেবে ব্যবহার করেছেন।
[২]
সমসাময়িক রাজনীতি এবং আধুনিক ভারত ইতিহাস রচনা এই দুই ক্ষেত্রেই সাম্প্রদায়িকতার ফলে একটি বিশেষ ধারণা স্বীকৃতি পেয়েছিলাে। তা হলাে, ভারতবর্ষে বিভিন্ন ধর্মীয় গােষ্ঠ ছিলাে, এবং এত্যেকটি গােষ্ঠীর মধ্যে সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক স্বার্থ এক ছিলাে। তারা এই সবকটি ক্ষেত্রে একক সত্তা হিসেবে কাজ করতে পারতো। হিন্দুদের বা মুসলমানদের ‘ক’ বা ‘চিন্তা’ সন্ধে ঐতিহাসিকরা এমনভাবে উল্লেখ করতেন যাতে মনে হতাে যেন এরা প্রত্যেকেই এক একটি স্বতন্ত্র সত্তা। এমন কি, কখনাে কখনো তাঁরা ‘হিন্দু নেতা’ বা ‘মুসলমান নেতা’দের সম্বন্ধেও লিখতেন। এইভাবে দ্বি-জাতিতত্ত্বকে তারা (কেউ কেউ আবার শিখদের এবং অন্যান্যদের টেনে এনে এই তত্ত্বের সম্প্রসারণ করেছেন) মধ্যযুগীয় ও আধুনিক ভারতের ইতিহাসে টেনে এনেছেন এবং ভারতীয় রাজনীতি ও সমাজে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গির অবতারণা করেছেন।
সাম্প্রদায়িক মনোেভাবাপন্ন ঐতিহাসিকরা মনে করেন যে, হিন্দু ও মুসলমান কখনােই গ্রামে অথবা আঞ্চলিক, স্থানীয় বা অন্য কোনাে স্তরে পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত হয়ে একটি অখণ্ড গােষ্ঠী গড়ে তুলতে পারেননি। কিন্তু হিন্দু এবং মুসলমানদেরও যে ধর্মের ও সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে আলাদা করে কোনাে স্বতন্ত্র ঐক্যবদ্ধ সত্তা গড়ে ওঠেনি, একথাও তঁারা অস্বীকার করেছেন। অর্থাৎ, তঁারা একথা মানেন যে অতীতে হিন্দু ও মুসলমান উভয়ে মিলে একটি জাতির সৃষ্টি করতে পারেননি; কিন্তু তারা অস্বীকার করেন যে আলাদা করে হিন্দুজাতি বা মুসলমান জাতি বলেও কিছু ছিলােনা।
আশ্চর্যের বিষয় হলাে যে সব ব্রিটিশ ঐতিহাসিক ও আমলাবর্গ ইতিহাসচর্চায় ‘হিন্দু-মুসলমান’ তত্ত্বটির গােড়াপত্তন ও লালন করেছেন, তাঁরাই আবার বর্ণ এবং জাতিকে (বাঙালী জাতি, পাঞ্জাবী জাতি, মারাঠা জাতি) ভারতীয় সমাজ ও রাজনীতির মূলনীতি হিসেবে দেখিয়েছে। ঠিক যেভাবে তাঁরা দিল্লীর সুলতানদের আমল অথবা মােগল সাম্রাজ্যে মুসলমান আধিপত্যের কথা বর্ণনা করেছেন ঠিক সেইভাবেই তাঁরা অষ্টাদশ শতকে মারাঠী সাম্রাজ্যের ওপর ব্রাহ্মণ আধিপত্যের কথা লিখেছেন। তারা যেমন মুসলমান শাসন, মুসলমানদের কার্যকলাপ এবং মুসলমান দৃষ্টিভঙ্গির কথা বলেছেন, ব্রাহ্মণদের বিষয়েও ঠিক তেমনিভাবেই তারা একই কথা বলেছেন। কিন্তু ভারতীয় ঐতিহাসিকরা শেষােক্ত দৃষ্টিকোণটি গ্রহণ করেননি। এইভাবে আমরা দেখতে পাই সমসাময়িক সাম্প্রদায়িক ধারণা কীভাবে ভারতীয় ইতিহাস রচনাকে প্রভাবিত করতে পারে। যেমন, জি. এস. সারদেশাই লিখেছেন, “যদিও বলা হয় যে মাধব রাও ও নারায়ণ রাও’র শাসনকালে দেশস্থ এবং কোঙ্কণস্থ (ব্রাহ্মণগণ) পরস্পরের সঙ্গে ঘাের বিবাদে লিপ্ত ছিলেন, কিন্তু তা একেবারেই ঠিক নয় । আমি দেখাতে পারি যে উভয় জাতেরই কিছু কিছু লোক অন্য পক্ষে দৃঢ়ভাবে অবস্থান করেছেন (মেন্ কারেন্টশ, পৃ. ১৮২)।” অথচ সারদেশাই একই যুক্তি অনুসারে হিন্দু ও মুসলমানদের পরস্পর বিরােধিতার তত্ত্ব খণ্ডন করতে অস্বীকার করবেন। অর্থাৎ, ভারতীয় সমাজকে যদিও বিশেষভাবে ধর্মের ক্ষেত্রে বিভক্ত, এমন কি বিখণ্ডিত বলে মনে করা হয়েছে, হিন্দু সমাজকে কিন্তু একটি অখণ্ড সত্তা বলে দেখা হয়েছে। এই মনােভাব ঐতিহাসিক সত্যের প্রতিফলন নয়, এ হলো সারদেশাই প্রমুখ ঐতিহাসিকদের সীমিত জাতীয় সংহতিবােধ।
সাম্প্রদায়িকতাবাদী লেখকরা অবশ্য ধর্ম ছাড়া আর কোনাে সাংগঠনিক নীতি স্বীকার করেন নি। কিন্তু এই মনােভাবের অবশ্য স্তাবী ফল হিসেবে অন্যরাও তাদের অনুসরণ করছেন, কেবল ধর্মের জায়গায় তারা বর্ণ ইত্যাদিকে স্থান দিয়েছেন। বস্তুত আজকের দিনে অনেক পাশ্চাত্য লেখক মনে করেন যে বর্ণ ও ভাষার ওপর ঝোঁক দেবার প্রবণতা আরাে জোরদার করা উচিত। যেমন তাঁরা দাবি করেন যে ভারতে জাতীয় আন্দোলনের উন্মেষের কারণ সাম্রাজ্যবিরােধী, জাতীয়তাবাদী চেতনা নয়, অথবা সাম্প্রদায়িক ধর্মীয় ঐক্যবদ্ধতাও নয়, তা হলাে বর্ণগত ও ভাষাগত আনুগত্য ও সংহতির চাপ। বর্ণবাদী ও ভাষাবাদী এবং অন্যধরনের সাম্প্রদায়িকতাবাদী (যেমন শিখ সাম্প্রদায়িকতা) বহু ভারতীয়ও একই কথা বলছেন।
[৩]
ভাবাদর্শের ক্ষেত্রে কতকগুলি কারণ ছাড়া সাম্প্রদায়িকতা আধুনিক ভারতীয় চেতনার অত গভীরে অনুপ্রবেশ করতে পারতো না। এবিষয়ে আলােচনার আগে আমি যে ব্যাপারে জোর দিয়ে বলতে চাই, তা হলাে যে, যতক্ষণ না আমরা বুঝতে পারছি চেতনার কতটা গভীরে এই মনােভাব অনুপ্রবেশ করেছে, ততক্ষণ এই বিষয়টিও আমরা পুরােপুরি ধরতে পারব না। আমার এক ছাত্র সাম্প্রদায়িকতা বিষয়ে আলােচনার পর একবার বলেছিলো যে প্রত্যেকবার আলােচনার পর সে মনে করে সাম্প্রদায়িকতার প্রভাব থেকে সে একেবারে মুক্তি পেয়েছে, কিন্তু পরবর্তী আলােচনা শুরু হলে আবার সে বুঝতে পারে যে এখনাে তার মনে যথেষ্ট ছাপ রয়ে গেছে। আসলে, আমরা যারা নিজেদের ‘পাকা’ জাতীয়তাবাদী বলে মনে করে থাকি, এমন কি আমাদের মধ্যে যারা সক্রিয়ভাবে জাতীয় সংহতি গড়ে তোেলার চেষ্টা করেন, তাঁদের অনেককেই গৃঢ় অথচ গভীরভাবে সাম্প্রদায়িকতা প্রভাবিত করেছে। এটা প্রধানত ইতিহাস, সমাজ ও সংস্কৃতি সম্বন্ধে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গির ফল, যে চিন্তাধারায় আমরা প্রায় প্রত্যেকেই শৈশব থেকেই বর্ধিত হয়েছি।
আগেই বলা হয়েছে যে জাতীয়তাবাদী মতবাদ বিশেষ গভীরে সঞ্চারিত হতে পারেনি বলে সাম্প্রদায়িকতার প্রভাব অটুট থেকে গেছে। যেখানে বিজ্ঞানসম্মত জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির অভাব রয়ে গেছে, যেখানে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদীদের আবেদন লােকের ওপর রেখাপাত করবেনা। সাম্প্রতিক চেতনায় ওপর এই ধরনের আবেদন ব্যর্থ হয়, অথচ প্রাত্যহিক জীবনে ধর্ম এতে প্রভাবশালী বলে লােকে সাম্প্রদায়িকতাকে অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক মনে করে। গােড়ার দিকের জাতীয়তাবাদী নেতারা এ ব্যাপারটি খুব ভালাে করে বুঝতেন। তাই তাঁরা শুধু জাতীয়তাবাদের কথাই প্রচার করতেন না, জাতীয়তাবাদী চেতনাকে গড়ে তােলার ও তার সম্প্রসারণের চেষ্টা করতেন। অন্যদিকে জওহরলাল এমুখ উনিশশাে কুড়ি ও তিরিশের নেতারা ভুল করে বলেন হবে পাশ্চাত্য সমাজের মতো এখানেও জাতীয়তাবাদ সমাজে মধ্যে সঞ্চারিত হয়ে গেছে, কাজেই তাদের কর্তব্য হলাে তাকে লড়াইয়ের স্তরে উপনীত করা। তাই সাম্প্রদায়িকতার বিরুয়ে তাদের আন্দোলনের রূপ ছিলাে প্রধানত জনসাধারণকে বলা যে সাম্প্রদায়িকতা হলাে জাতীয়তাবিরােধী। কিন্তু যেসব লােক আলো জাতীয়তাবাদী নন, তাদের মধ্যে একথা একেবারেই সাড়া জাগলাে। উনিশশাে সাতচল্লিশের পরও এ ভুলটি রয়ে গেলাে। আমাদের শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানগুলি, আমাদের গণসংযােগের মাধ্যমগুলি যথা সংবাদপত্র ও আকাশবাণী এবং রাজনৈতিক দলগুলি জনসাধারণের মধ্যে জাতীয়তাবাদ সম্বন্ধে আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত ধারণা ও চেতনা প্রচারিত করার কোনাে চেষ্টা করেননি। জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির প্রসারে তাঁরা ব্যর্থ হয়েছেন। ফলে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদের প্রতি তাদের মৌখিক আবেদন বহু ব্যক্তির উপরে কোনাে রেখাপাত করেনি। অন্যদিকে তাদের নিজেদের জাতীয়তাবাদও খুব স্পষ্ট নয় বলে তাদের এই আবেদনের ফলে অনেক সময় সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি আরাে বেশি শক্তিলাভ করেছে।
[৪]
জনগণকে আধুনিক জাতীয়তাবাদের নতুন চেতনায় উদ্বুদ্ধ করার দায়িত্বটি খুব দুরূহ মনে হওয়ায়—বিশেষত এক্ষেত্রে যখন সাধারণ মানুষকে তাদের জীবন ও স্বার্থের সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদবিরােধী আন্দোসনের যােগটি বুঝিয়ে বলতে হতাে—অনেক জাতীয়তাবাদী নেতা একটি সহজ পন্থা অবলম্বন করলেন। তাঁরা পুরনাে চেতনা, অর্থাৎ ধর্ম-চেতনার প্রতি আবেদন জানালেন। একথা সত্যি যে তাদের উদ্দেশ্য ছিলাে সম্পূর্ণ ই আধুনিক এবং মহৎ। কিন্তু এভাবে তাঁরা যে শুধু জনগণের জাতীয়তাবাদী চেতনাকে দুর্বল করে দিলেন তা নয়, তাদের নিজেদের চিন্তা এবং লেখাও সাম্প্রদায়িকতা দোষে দুষ্ট হয়ে উঠলাে। লােকমান্য তিলক, প্রথম দিকের সন্ত্রাসবাদীগণ, অরবিন্দ ঘােষ এবং অংশত গান্ধী (যেমন রামরাজ্যের প্রতি তার ঝোঁক এবং খিলাফৎ সম্বন্ধে তাঁর নীতি)-এরা সকলেই এর উদাহরণ। এর ফলে অন্যভাবেও জাতীয় সংহতি ক্ষতিগ্রস্ত হলো। যে জাতীয় আন্দোলনের ভিত্তি হলো হিন্দু শাস্ত্র তার ধর্মীয় চিত্রকল্প এবং আচারপ্রথা, তা মুসলমানদের কেমন করে অনুপ্রাণিত করবে? নিম্নবর্ণের নিপীড়িত (হিন্দু) জনগণের তখনও যথেষ্ট আত্মােপলব্ধি হয়নি, অন্যথা তারাও উচ্চবর্ণের মানসিকতার ও এই সব প্রতীক ব্যবহারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতেন। দক্ষিণ ভারতে এরকম অভ্যুত্থান প্রায় ঘটতে চলেছিলাে।
ভারতীয় জাতীয় চরিত্রের নিন্দা করার উদ্দেশ্যে এবং স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র লাভ করার ব্যাপারে ভারত কতটা অনুপযুক্ত তা প্রমাণ করার জন্যে ব্রিটিশরা ভারতীয় ইতিহাসকে ব্যবহার করতেন। এর ফলে ভারতীয়দের ইতিহাস রচনা ও রাজনীতিতে আরেকরকমের বিকৃতি দেখা দিলাে। এই বিজ্ঞানবিরােধী ও অনৈতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিরােধে ভারতীয়রাও সমান অনৈতিহাসিক এক দৃষ্টিভঙ্গি খাড়া করলেন। তারা অতীতের মাহাত্ম কীর্তন শুরু করলেন। এখানে তাদের এই দৃষ্টিভঙ্গির ঐতিহাসিক যাথার্থ্য বিচারের সুযােগ নেই। স্পষ্টতই এর উৎস ছিলাে জাতীয় আত্মচেতনা এবং গর্ববােধ। কিন্তু জাতীয়তাবাদের দিক থেকে যা দুর্ভাগ্যজনক হয়ে দাড়ালাে তা হ’ল মাহাত্মকীর্তনের জন্য যে-অতীতকে বাছা হলো তা প্রাচীন যুগ। অংশত এর কারণ হচ্ছে মােগল-শাসনের স্মৃতি তখনাে লােকের মনে বেশ স্পষ্ট ছিলাে, তাই এই পর্বের গৌরবসাধন করা ঠিক সম্ভব ছিলােনা। অন্যদিকে প্রাচীন যুগ ছিলো দূর অতীত এবং সে-যুগ সম্বন্ধে একমাত্র সরকারী বা প্রায়-সরকারী নথিপত্র থেকে জানা যায়। মােগলযুগের স্মৃতি সম্বন্ধে যা বলেছি তা মারাঠা সাম্রাজ্য বা রণজিৎ সিংহের শাসন সম্বন্ধেও খাটে, সুতরাং সাম্প্রদায়িকতার পূর্ণ বিকাশের আগে তাঁদের শাসনের গৌরবগাথাও রচিত হতে পারেনি। এইভাবে ধীরে ধীরে কিছু কিছু উপকথা তৈরি হলে যার প্রত্যেকটি সুস্থ, ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদকে দুর্বল করে তুললো, এগুলি সাম্প্রদায়িকতার শক্তিবৃদ্ধি যদি না-ও করে থাকে এর প্রসারণের সুযােগ করে দিলো। বেশ কিছু গোঁড়া জাতীয়তাবাদী এবং ধর্মনিরপেক্ষ ব্যক্তি এসবে বিশ্বাস করতেন এবং এগুলির প্রচার করতেন বলে এ-ধরনের উপকথার সর্বনাশী শক্তি এবং ক্ষমতা সীমাহীনভাবে বেড়ে গিয়েছিলো।
উপকথা গুলির মধ্যে প্রথম হলাে ভারতীয় সমাজ ও সভ্যতা সম্বন্ধে এই বিশ্বাস যে প্রাচীন ভারতে সংস্কৃতির সর্বোচ্চ উৎকর্ষ সাধিত হয়েছিলাে, তখন ছিলো ভারতের স্বর্ণযুগ। তারপর মধ্যযুগে ক্রমশ তার অবনতি ঘটতে লাগলাে, এবং মধ্যযুগ অভিহিত করা হলাে অধঃপতন ও পরাধীনতার যুগ বলে। পুনর্জাগরণবাদী আন্দোলনের ফলে অবস্থার খানিকটা উন্নতি হলো বটে, কিন্তু অতীত গৌরব ও সভ্যতার পুনরুদ্ধারের গুরু দায়িত্ব এখনাে অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে। আবার বলছি, ভেবে দেখা উচিত যে কয়জন হিন্দু আছেন যারা এই ধারণার মূল প্রতিপাদ্যে বিশ্বাস করেননা। এর থেকে অতি সহজেই পরের ধাপে চলে আসা যায়, অর্থাৎ অবনতির জন্যে ইসলাম বা ‘মুসলমান শাসন’ এবং বিজাতীয় পাশ্চাত্যকে দায়ী করা। স্বভাবতই মুসলমানরাও এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে আরবযুগের কীর্তিকে ‘স্বর্ণযুগ’ বলে মনে করতে লাগলেন, কারণ তাদের পক্ষে নিজেদের ধর্মকে ভারতীয় সভ্যতার ‘অবনতির কারণ’ হিসেবে মেনে নেওয়া সম্ভব ছিলােনা। বলাই বাহুল্য যে সাম্প্রদায়িকতাকে উৎপাটিত করতে হলে আমাদের শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক দলসমূহ ও গণ সংযােগের মাধ্যম—প্রত্যেককেই এই অযৌক্তিক ও অনৈতিহাসিক মতের প্রচার বন্ধ করতে হবে। বরং তাদের তুলে ধরতে হবে যুগে যুগে ও বিভিন্ন ধারায় প্রবাহিত ভারতীয় সংস্কৃতির ঐতিহাসিক ক্রমবিকাশের রূপটি। এরই মধ্যে মাদ্রাজের ডি. এম. কে আন্দোলন এটি অস্বীকার করছে। যখনই নিম্নবর্ণের লােকেরা সবাক এবং আত্মসচেতন হয়ে উঠবেন, তখনই তারা স্বর্ণযুগের এই প্রতিরূপটির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবেন। কারণ এর মূলে আছে বর্ণাশ্রমধর্ম ও উচ্চবর্ণের আধিপত্য। উপজাতিরাও এ ধারণাটি পছন্দ করতে পারেননা।
দ্বিতীয় উপকথাটির উৎপত্তির মূলে ছিল মানবসভ্যতার ইতিহাসে প্রাচীন ভারতের স্বর্ণযুগকে অদ্বিতীয় বলে প্রমাণ করার প্রয়ােজন। বস্তুগত সত্যকার ক্ষেত্রে নিশ্চয়ই একথা খাটতে পারে না, যদিও কোনাে উন্মাদ বলে থাকে প্রাচীন ভারতে বিমান ও পারমাণবিক বােমা সবই ছিলো। সুতরাং এই উপকথা তৈরি করা হলো যে ভারতীয় সভ্যতা ছিলাে আধ্যাত্মিক এবং বস্তুবাদী পাশ্চাত্য সভ্যতার চেয়ে উন্নততর। কাজেই অরবিন্দ ঘােষ বললেন “পশ্চিমে যেখানে যুক্তি, বিজ্ঞান ও নির্মাণকৌশলের উৎকর্ষ ঘটেছে, সেখানে ভারতে পরিবর্ষিত হয়েছে আত্মিক শক্তি, যা মানুষের অন্য সব শক্তির উর্ধ্বে কার্যকরী হতে পারে, আত্মলব্ধ প্রজ্ঞা, দর্শনসম্মত ধর্মজীবনের সামঞ্জস্যবােধ, অনাদি ও অনন্তের অনুভব।” এমনকি, ভারতবর্ষের বর্ণভেদ প্রথাও নাকি পশ্চিমের শ্রেণীভেদের চেয়ে শ্রেয়, কারণ শ্রেণীভেদ কেবল মাত্র বস্তুভিত্তিক, কিন্তু ভারতীয় বর্ণভেদের মূলে আছে আধ্যাত্মিক ও নৈতিকভিত্তি। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো যে প্রায় একই সময়ে চীনের কীয় মতাবলম্বী ম্যাণ্ডারি বা অভিজাতশ্রেণীও একই জিগির তুলেছিলেন কারণ তারাও বিশ্বাস করতেন যে কনফুশীয় চীনের সত্যতা আধুনিক পাশ্চাত্য ইউরােপীয় সভ্যতার চেয়ে অনেক বেশি অগ্রসর ছিলাে। সুতরাং তারাও বলতেন “চৈনিক শিক্ষা থাকবে মূলনীতি হিসেবে এবং পাশ্চাত্য শিক্ষা থাকবে বাস্তবে প্রয়ােগের জন্য।” ভারত এবং চীন, জায়গাতেই পশ্চিমী লেখক এবং শাসকগণ এই মতবাদকে উৎসাহ দিতেন কারণ তারা চাইতেন যে এই দুইদেশের মানুষ যেন শাসন ও অর্থনীতির বস্তুভিত্তিক কাজের দায়িত্বটা তাদের হাতে ছেড়ে দিয়ে নিজেরা আধ্যাত্মিক কার্যকলাপে নিমগ্ন থাকুন।
তৃতীয় উপকথাটি আৰ্যত্ব প্রসঙ্গে। ‘টিউটন’ ও ‘অ্যাংলাে স্যাকসন’ উপকথার অনুকরণে সাদা চামড়ায় মানুষের বর্ণ বৈষম্যনীতির প্রতিক্রিয়ায় এটি রচিত হয়েছিলো। এই উপকথা অনুযায়ী ভারতীয় ‘আৰজাতি’ ভুক্ত এবং খাটি ভারতীয় সংস্কৃতি ও সমাজ হলাে বৈদিকযুগের আর্য সমাজ ও সংস্কৃতি।
এই তিনটি উপকথাই পশ্চাদমুখী মনােভাবের বশবৃদ্ধি করতে এবং প্রগতি ও ভবিষ্যতে বিশ্বাসকে খর্ব করে সুস্থ জাতীয়তাবাদের পরিপন্থী হয়ে দাড়ালাে। উদাহরণস্বরূপ, এই মনােতাৰ লােককে সাহসের সঙ্গে নিয়ে সমাজের ঐতিহাসিক দুর্বলতা মেনে নিয়ে বর্তমানে ও ভবিষ্যতে তার প্রতিকারে সচেষ্ট হতে দেখায়নি। বরং, অতীতের গৌরব স্মরণ করেই দিন কাটাতে উৎসাহ দিয়েছে।
এছাড়া এইসব উপকথা থেকে এই বিশ্বাস গড়ে উঠলো এবং প্রতিফলিত হলাে যে ভারতীয় ইতিহাসের ধারা সমস্ত বিশ্ব ইতিহাসের অচ্ছেদ্য অংশ নয় তা হ’ল সম্পূর্ণ একটি ব্যতিক্রম।
আগেই বলেছি, এইসব উপকথা স্বভাবতই বেশির ভাগ তারতীয়ের কাছে গ্রহণযােগ্য নয়। আশ্চর্যের বিষয় হলো, এই মতবাদগুলি খাঁটি ভারতীয়ত্ব প্রসঙ্গে হলেও আসলে প্রত্যেকটি ধারণাই পশ্চিম থেকে নেওয়া। স্বর্ণযুগের ধারণাটি, এবং জনগণকে অতীতের গৌরবে উদ্বুদ্ধ করা—এসবই পাশ্চাত্য জাতীয় আন্দোলন থেকে সচেতনভাবে ধার করা হয়েছে। ভারতীয় অধ্যাত্মবাদের ধারণাটি প্রথমে ইংরেজরা প্রচার করেছিলেন ভারতীয়দের বােঝাবার জন্থে যে তারা বাস্তব, দৈনন্দিন দায়িত্ব বহন করতে অক্ষম। ‘আর্য’ উপকথাটির মূল কোথায়, তা আর গােপন নেই। কিন্তু ইটালি, গ্রীস বা পােল্যাণ্ডে এর ফলে ততােটা ক্ষতি হয়নি, কারণ সেখানে ভারতের মতো সমাজে এতে বিবিধ ধর্ম, বর্ণ ও সংস্কৃতি নেই। কাজেই এখানে জাতীয়তাবাদে ও দেশের কাজে আত্মত্যাগে সকলকে উদ্বুদ্ধ করার ব্যাপারে এগুলির বিশেষ মূল্য তাড়াতাড়িই ফুরিয়ে গেলো—অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দ্বিতীয় পর্যায়ের জাতীয়তাবাদী নেতাদের জীবনকালেই তা নিঃশেষিত হলো। কিন্তু তার দীর্ঘ মাশুল আজও গুণতে হচ্ছে। সাম্প্রদায়িক উদ্দেশ্যে ইতিহাসের অপব্যবহার সংশােধন করার জন্যে আন্তরিক চেষ্টা করতে গেলে আমাদের এইসব উপকথাগুলিকেও ধ্বংস করতে হবে।
[৫]
এই প্রবন্ধে আমার প্রধান বক্তব্য হলাে যে একধরনের ভারতীয় দের মধ্যে, বিশেষত ঐতিহাসিকদের মধ্যে, সাম্প্রদায়িকতা প্রসারের কারণ হচ্ছে এই মতবাদগুলির সাহায্যে পরােক্ষ ভাবে অথবা খিড়কি দুয়ার দিয়ে জাতীয়তাবাদ প্রচার করা যেতো। সাম্প্রদায়িক মতবাদী লােকেরা সাম্রাজ্যবাদ, অর্থাৎ ভারতীয় জনগণকে যে বিদেশী শক্তি শাসন ও শােষণ করছে, তার বিরুদ্ধে না গিয়েও নিজেদের জাতীয়তাবাদী বলে মনে করতে পেরেছেন। অর্থাৎ, এর ফলে ব্যক্তিগতভাবে কোনাে বিপদের ঝুঁকি না নিয়েও তারা জাতীয়তাবাদী মনােভাব পােষণ করতে পেরেছেন। এই ব্যাপারটি আরেকটু বিস্তারিতভাবে বলা দরকার।
বেশির ভাগ আধুনিক ভারতীয় ঐতিহাসিকই জাতীয়তাবাদ সম্বন্ধে বিশেষ সােজাসুজি, স্পষ্ট, প্রত্যক্ষ আগ্রহ দেখাননি এবং সেরকম আগ্রহ থাকলে যে ধরনের প্রসঙ্গ উঠতে পারতাে তার কোনাে আলােচনাও করেননি। ভারতের মানুষ যেসব প্রকাণ্ড সমস্যার ভারে জর্জরিত, তার কোনো কিছুই তাদের কাজে—অর্থাৎ তাদের গবেষণার বিষয়-নির্বাচনে অথবা গবেষণার ধরনে – প্রতিফলিত হয়নি। দেশের পক্ষে অথবা ঐতিহাসিকদের পক্ষে তখনকার সংগ্রামী জাতীয় আন্দোলনকে সবচেয়ে প্রধান ও কেন্দ্রিক সমস্যা হিসেবে তাঁরা দেখেননি। প্রকৃতপক্ষে, আমার মনে হয় যে তারা যদি এব্যাপারের আদৌ কোনাে গুরুত্ব দিয়ে থাকেন, তা জাতীয় আন্দোলনকে নয়, তা হলো সরকার প্রদত্ত সাংবিধানিক পরিবর্তনকে, এবং ব্রিটেনের অভিভাবকত্বকে যার ফলে ব্রিটিশ শাসন ধীরে ধীরে ‘সহৃদয় একাধিপত্ব’ থেকে ‘সহৃদয় গণতন্ত্রে’ পরিণত হবে। সুতরাং অধিকাংশ আধুনিক ভারতীয় ঐতিহাসিকই জাতীয় অনুভূতি সম্বন্ধে খুব বেশি সজাগ ছিলেননা এবং তাকে বিশেষ স্বীকারও করতেন না।
এর ফলে তাঁরা উভয় সঙ্কটে পড়ে গেলেন। ১৮৭০ সন থেকে, বিশেষত ১৯০৫ থেকে ভারতবর্ষে শাসকের সঙ্গে শাসিতের, বিদেশী সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে ‘উদীয়মান’ জাতীয় আন্দোলনের মৌলিক রাজনৈতিক সংগ্রাম চলছিলাে। এই তীব্র, সজীব বিরােধের যুগেও অধিকাংশ ভারতীয় ঐতিহাসিক শাসিতের পক্ষে সক্রিয়ভাবে যােগ দিতে পারলেন না, কারণ তারা প্রায় সকলেই সরকারী অথবা সরকার নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন। অথচ নিতান্ত বশংবদ ছাড়া অন্যদের পক্ষে শাসকদের পক্ষে থাকাও শক্ত হয়ে দাড়ালাে। তাছাড়া তাঁরাও জাতীয় আন্দোলনের সময়কার মানুষ, তাই তাঁদের নিজস্ব জাতীয় অনুভূতিও প্রকাশের পথ খুজতে লাগল।
এই উভয়সঙ্কট থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার প্রধান উপায় হলো পরােক্ষ বা ‘খিড়কি দুয়ারি’ অথবা ‘মিথ্যা যা জাতীয়তাবাদ আঞ্চলিকতা অথবা সাম্প্রদায়িকতার রূপ নিলো; এর ফলে এঁদের জাতীয় অনুভূতিও পরিতৃপ্ত হলাে, অথচ সরকারকেও চটাতে হলো, কেননা সরকার যখন তারতীয় সমাজের ক্ষেত্রে সবরকমের বিভেদনীতিকেই প্রশ্রয় দিতেন। সুতরাং বাস্তবজীবনে জাতীয়তাবাদী হওয়ার ও সাম্রাজ্যবাদের বিরােধিতা করার অক্ষমতার দরুন যাকে ‘বিমসৃষ্টিকারী জাতীয়তাবাদ’ বলা যায় এমন এক আশ্চর্য প্রবণতা দেখা দিলো। অবস্থাটা এমনই দাড়ালাে যে জাতীয় আন্দোলনের চরম পর্বেও যারা ব্রিটিশের দেওয়া খেতাবের জন্যে ব্যাকুল ছিলেন, এমন কি খেতাব পেয়েও যেতেন, তারাই আবার রাজপুত বা শিখ বা মারাঠা দলনায়কদের কথা লিখতে গিয়ে প্রচণ্ড জাতীয়তাবাদী হয়ে উঠতেন। এইসঙ্গে বলে নেওয়া যায় যে, ১৯৪৭ সালের পূর্ববর্তী সাম্প্রদায়িক দল ও ব্যক্তি সম্বন্ধেও একথা প্রযােজ্য। সক্রিয় ভাবে সাম্প্রদায়িক দলভুক্ত ব্যক্তি বা প্রায় কখনােই, বিশেষত ১৯১৯-এর পরবর্তী সংগ্রামের যুগে সক্রিয় জাতীয়তাবাদী হতেন না।
ভারতীয় ঐতিহাসিকদের মধ্যে যারা পরােক্ষ জাতীয়তাবাদী, তাদের অনুভূতির প্রকাশ ঘটেছিলো ব্রিটিশ শাসনের নিন্দায় নয়, অষ্টাদশ, উনবিংশ এবং তার পূর্বতন শতকের ভারতীয় শাসকদের প্রশংসায়। প্রত্যক্ষভাবে তারা সাম্রাজ্যবাদের বিরােধিতা করতেন না, যেমন ঐতিহাসিক অনুশীলনের সাহায্যে ব্রিটিশ শাসনের যথা চরিত্র, প্রকৃত স্বার্থ এবং শােষণমূলক নীতি উদ্ঘাটনের চেষ্টা তার করতেননা। তাঁদের জাতীয় অনুভূতি ‘পরক্ষ’ ছিলো বলে তাঁরা প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় ভারতীয় সাম্রাজ্যগুলির এবং অষ্টাদশ, উনবিংশ শতকের রাজ্যগুলির শাসকদের যশােগান করতেন এবং পাঞ্জাবে, রাজপুতানায়, মহীশূরে, এমন কি জাঠদের মধ্যেও এবং সবচেয়ে বেশি করে মারাঠাদের মধ্যে রীতিমতো জাতীয়তাবাদ আবিষ্কার করতেন। এইসব অনেক ভারতীয় শাসকদের শাসনকে তাঁরা গণভিত্তিক এবং জনহিতৈষী বলে চিত্রিত করতেন। এক্ষেত্রে আমরা নানারকম সুমধুর বর্ণনা শুনতে পাই, যেমন—‘মাতৃভূমির মুক্তিসাধন’, ‘স্বদেশ’, ‘দেশের সন্তান’, ‘জাতীয় কল্যাণ’, ‘জনপ্রিয় নেতা ইত্যাদি। কিন্তু যারা প্রকৃতই ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছিলেন, যেমন ১৮৫৭ বিদ্রোহের নেতারা, তাদের গৌরব খুব কমই স্বীকৃতি পেয়েছে। এইসঙ্গে লক্ষণীয় যে কোনো পেশাদার ঐতিহাসিক ভারতীয় জাতীয় আন্দোলনের কোনাে দিক নিয়ে আলােচনা করেননি। অন্যদিকে পরোক্ষ জাতীয়তাবাদ বহুলাংশে ভারতের ইতিহাসচর্চা ও রাজনীতির ক্ষতি ও বিকৃতি ঘটিয়েছে।
[৬]
বহু আধুনিক ভারতীয় ঐতিহাসিক সাম্প্রতিক সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে অতীতেও টেনে নিয়ে গেছেন এবং হিন্দু-মুসলমানের যে বিরােধ ১৯শ এবং বিংশ শতকেও চলছে তাই দিয়ে আঠারাে শতকের রাজনীতির ব্যাখ্যা করেছেন। এই বিরােধকে অনেকেই অষ্টাদশ শতকের প্রধান সমস্যা বলে মনে করেছেন। আগেই বলেছি, এই সাম্প্রদায়িক মনােভাবের ফলে হিন্দু, শিখ ও মুসলমানদের সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র সামাজিক তথা রাজনৈতিক সত্তা হিসেবে দেখা হয়েছে। এই মনোভাবের চরম পর্যায়ে গিয়ে ‘ইসলাম’ শব্দটিতে প্রায় প্রাণরােপণ করা হয়েছে—যেমন বলা হয় ইসলাম বিজয়ী হলো, ইসলাম চিন্তা করল, ‘ইসলাম’ স্থির করল, ‘ইসলাম’ লাভবান হল। মােগলদের এবং অন্যান্য মধ্যযুগীয় মুসলমান শাসকদের বিদেশী বলে মনে করার প্রবণতাও লক্ষ্য করা যায়। কোনাে কোনো ঐতিহাসিক এমন কি শাসন ও ভূমিরাজস্বের ব্যাপারেও ‘হিন্দু ও মুসলমান’ নীতির কথা বলে থাকেন। মারাঠা সাম্রাজ্য ও রাজ্যসমূহ, রাজপুত রাজ্য ও রাজ্যাধিপতি, জাঠদলনায়ক —সবকিছুই একসঙ্গে একত্রিত করা হয় হিন্দুরাজ্য নামে, অন্যদিকে দক্ষিণ ও উত্তরের মুসলমান শাসনাধীন রাজ্যগুলিকে আলাদা করে ‘মুসলমান রাজ্য’ বলা হয়। এই মনােভাবের এবং ব্রিটিশ ঐতিহাসিকদের কৃপায় আমরা এই ধরনের বিশেষীকরণে এতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি যে আমরা মনেই রাখিন যে পৃথিবীর অন্য কোথাও অনুরূপ পর্ববিভাগ নেই। আশ্চর্যের বিষয়, এদের কেউই ব্রিটিশ শাসনকে খ্ৰীষ্টান শাসন বলে অভিহিত করবেন না, অথচ মােগলশাসনে যে কয়জন সরকারী কর্মচারী মুসলমান ছিলেন, এই আমলে তুলনায় তার চেয়ে ঢের বেশি সংখ্যক কর্মচারী খ্রীষ্টান ছিলেন।
আসলে সাম্প্রদায়িক ঐতিহাসিকরা মারাঠা, রাজপুত, এমন কি রণজিৎ সিংহের শাসনাধীন পাঞ্জাবেরও রাজ্যগুলির ‘হিন্দুত্ব’ প্রমাণ করার উদ্দেশ্যে ঐতিহাসিক তথ্যের যথেচ্ছ অপব্যবহার করেছেন। প্রথমেই একটি ছবি বা ধারণা খাড়া করা হয়েছে এবং তারপরে তার সমর্থনে তথ্যগুলিকে সন্নিবেশিত করা হয়েছে। যেসব তথ্য বা ঘটনা এই ধারণার সঙ্গে খাপ খায়নি সেগুলির ব্যাখ্যা করার সময় সেইসব হিন্দু রাজ্যাধিপতিদের (যাঁরা প্রায়ই সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিলেন), ‘দুষ্টলােক’ বা ‘হিন্দু হিসেবে মন্দ’, অথবা ‘জাতি এবং সম্প্রদায়ের প্রতি বিশ্বাসহন্তা বলে ব্যতিক্রম হিসেবে দেখানো হয়েছে। তথাকথিত কোনো ‘ভাল’ হিন্দু শাসকের কোনাে কাজ অস্বস্তির কারণ হয়ে দাড়ালে তাকে ব্যতিক্রম বলে উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। যখন দেখা যায় যে হিন্দু রাজারা ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করেননি, এমন কি সাধারণত যাকে হিন্দুধর্মের রক্ষাকার্য বলা হয় তার জন্যেও নয়, এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্যেও সময় সময় হিসেবে সংঘবদ্ধভাবে তারা দাড়াননি, তখন এক মনে করা কয় না যে সে সময়ে কোনে:রকম সাম্প্রদায়িক মানসিকতাই ছিলােনা। বরং সাম্প্রদায়িক ঐতিহাসিকরা সেক্ষেত্রে মনে করেন যে হিন্দুরা স্বভাবতই বিভক্ত অথবা স্বার্থপর।
[৭]
সুতরাং ইতিহাস প্রণয়নে সাম্প্রদায়িকতা হলে ‘পরােক্ষ জাতীয়তাবাদের একটি দিক এবং সেই সঙ্গে সমসাময়িক সাম্প্রদায়িকতার প্রতিফলন। এ হলাে ‘হিন্দু জাতীয়তাবাদ’ ও মুসলমান জাতীয়তাবাদকে আরো অতীতে টেনে আনার ফল।
কিন্তু তাছাড়াও এটি হলাে পাশ্চাত্য প্রচেষ্টার অনুসরণ। যে সব ভারতীয় পাশ্চাত্য ইতিহাস অধ্যয়ন করেছেন, তাঁরা খানিকটা চেষ্টা করেন ক্যাথলিক-প্রটেস্টান্ট সংঘর্ষকে ভারতে হিন্দু-মুসলমান বিয়ােধে রূপায়িত করতে। তাছাড়া, ভারতীয় রাজ্যগুলির হিন্দু ও মুসলমান চরিত্র, অষ্টাদশ শতক বা তার আগে হিন্দু-মুসলমান সংঘর্ষ এবং উনবিংশ ও বিংশ শতকের হিন্দু-মুসলমান বিরােধ-এ সবের বিষয়ে মূল সামান্যীকরণ ব্রিটিশ ঐতিহাসিক এবং প্রচারকের আগেই করে গেছেন, ভারতীয়রা তাদের অনুসরণ করেছেন মাত্র। তাঁদের পক্ষে এ চেষ্টা সহজ ছিলো কারণ ব্রিটিশ আমলারা ইতিহাসের সাম্প্রদায়িক ব্যাখ্যায়, অথবা প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় শাসক এবং ‘বীর’দের মাহাত্মকীর্তনে আপত্তি করতেন না। কেবল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের নিন্দা করার চেষ্টাকে তারা সব সময়ে দমন করতেন।
বহু ঐতিহাসিকের সাম্প্রদায়িক মনােভাবের মূলে আছে সামরিক ও কূটনৈতিক ইতিহাসের প্রতি অখণ্ড মনোেযােগ, যার ফলে ধর্মের প্রসঙ্গ তাঁদের কাজের পক্ষে অত্যাবশ্যক হয়ে দাড়িয়েছে। কূটনৈতিক এবং সামরিক মৈত্রীর জন্যে আবেদন করার সময় অনেকরকম কথা বলা হয় এবং তাঁদের মধ্যে সঙ্গতি রাখার চেষ্টা করা হয়। বৈবাহিক কুটুম্বিতা আত্মীয়তা, ভাষা, ‘জাতি’, বর্ণ এবং এইসঙ্গে ধর্মের কথাও ভােলা হয় কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এইধরনের মৈত্রীর মূল উদ্দেশ্য থাকে শুধুই স্বার্থ।
যদি ব্যাপকতর সংজ্ঞার্থ অনুসারে ইতিহাস লেখা হতাে, তাহলে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি সম্পূর্ণই লােপ পেতে। যেমন অর্থনৈতিক ইতিহাস উদঘাটিত করতে শ্রেণীস্বার্থ, শ্রেণী-ঐক্য এবং শ্রেণীবিরােধ যা ধর্মের সীমানা অতিক্রম করে যায়। অর্থনৈতিক শােষণের ছবি স্পষ্ট হলে সমধর্মী সব মানুষের মধ্যে সাম্য ও ঐক্যের ধারণাটি ঘুচে যেতাে। এইভাবে যদি সমাজের শ্ৰেণী ভাগ করা হয় যার একভাগে আছে যারা অতিরিক্ত উৎপাদন করে এবং অন্যভাগে আছে যারা সেই উৎপাদন আত্মসাৎ করে, তাহলে দেখা যাবে যে উভয়পক্ষেই নানাধর্মের লােক আছে। সামাজিক ও অর্থনৈতিক ইতিহাস তাহলে দেখাতে পারতো সুলতানদের অথবা মােগলদের আমলে মুসলমান শাসন বলে কিছু ছিলােনা। কারণ সব মুসলমানই শাসকশ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত ছিলেননা। মুসলমান জনসাধারণ হিন্দু জনসাধারণের মতােই দরিদ্র এবং নিপীড়িত ছিলেন। উপরন্তু হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে রাজা, অমাত্য, গােষ্ঠীপতি এবং জমিদার সকলেই তাঁদের নিকৃষ্ট, ইতর জীব বলে গণ্য করতেন। সামাজিক ইতিহাস প্রতিপন্ন করতে পারতো যে হিন্দুদের মধ্যে যেমন জাতিভেদ ছিলাে, ‘মুসলমান‘দের মধ্যেও শরীফ, মুসলমানরা নিজেদের ‘আলফ’ বা নিম্নশ্রেণীর মুসলমানদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ মনে করতেন। শাসনপদ্ধতির ইতিহাস পড়লে চাকুরিতে নিয়ােগপদ্ধতি, রাজস্বনীতি, শাসন-ব্যবস্থার ভিত্তি ইত্যাদি স্পষ্ট হয়ে উঠতে এবং বােঝা যেতাে মধ্যযুগীয় অষ্টাদশ শতকের রাজ্যগুলিকে হিন্দু বা মুসলমান হিসেবে দেখা একান্তই ভ্রান্ত এবং প্রকৃত শাসনব্যবস্থায় সাম্প্রদায়িকতা একেবারেই খাটতােনা। মারাঠা, মােগল, এমন কি ব্রিটিশ আমলেও খাজনার বিলি-ব্যবস্থায় যথেষ্ট মিল ছিলাে। এমন কি, রাজনৈতিক ইতিহাসও যত্ন করে পড়লে বােঝা যেতো যে পৃথিবীর তান্যান্য জায়গার মতো ভারতীয় রাজ্যগুলিতেও রাজনীতি নির্ধারিত করতে ধর্ম নয়, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বার্থ। শাসক ও বিদ্রোহী, উভয়েই নিজেদের জাগতিক স্বার্থ ও উচ্চাকাঙ্ক্ষার বহিরাবরণ হিসেবে ধর্মকে ব্যবহার করতেন।
সমাজ ও সংস্কৃতির ইতিহাস পড়লে দেখা যেতো সমাজের উচু স্তয়ে যেমন সাংস্কৃতিক আদান প্রদান ও সমন্বয় ছিল এবং একটি যৌথ সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল, সেরকম নিচের দিকে গ্রামেও হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সৌহার্দ্য ছিলাে। এও দেখা যেত যে অষ্টাদশ শতকে, এমন কি বিশ শতকেও উচ্চশ্রেণীর একজন মুসলমানের সঙ্গে একজন নিম্নশ্রেণীর মুসলমানের চাইতে একজন সমশ্রেণীর হিন্দুর সাংস্কৃতিক যোেগ ঢের বেশি ছিলো; কিংবা একজন পাঞ্জাবী হিন্দুর সংস্কৃতির সঙ্গে একজন বাঙালী হিন্দুর চাইতে কোনাে পাঞ্জাবী মুসলমানের অনেক বেশি নৈকট্য ছিলো। সেরকম, কোনো বাঙালী মুসলমানও পাঞ্জাবী মুসলমানের থেকে নিশ্চয়ই কোনাে বাঙালী হিন্দুর প্রতি বেশি আত্মীয়তা অনুভব করতেন।
সমাজ ও সংস্কৃতির ইতিহাসচর্চা ধর্ম ছাড়াও অন্য ধরনের সামাজিক বিভেদ ও বৈচিত্র্য স্পষ্ট করে তুলতে; যথা সম্প্রদায় ও বর্ণগত বৈষম্য। যেমন ধরা যাক অষ্টাদশ শতকের মাদ্রাজে ‘ডান-হাতি’ জাত ও ‘বাঁ হাতি’ জাতের তীব্র সংঘর্ষ। এই সংঘর্ষকে দ্বি-জাতিতত্ত্বের আলােয় বিচার করা কি ঠিক হবে? জনসংখ্যা বিষয়ক খুব সাধারণ। একটি তথ্য—১৯০১ সালে রাজপুতানায় রাজপুতরা ছিলেন মােট জনসংখ্যার শতকরা ৬৪ ভাগ মাত্র-এটা মনে রাখলেই মধ্যযুগীয় রাজপুত রাজ্যগুলির তথাকথিত ‘জাতীয়’ বা ‘হিন্দু’ সংগ্রামগুলিকে নতুন আলােয় দেখা যায়। সর্বোপরি সাধারণ মানুষের জীবন এবং সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক জীবনের অগ্রগতিতে তাদের অবদান বিচার করলে বােঝা যায় ইতিহাসে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি কোনােমতেই খাটেনা। এ-ও বলা যায় যে ঐতিহাসিকরা যদি সাম্রাজ্যবাদ এবং জাতীয় আন্দোলন নিয়ে সত্যি আলােচনা করতেন, তাহলে তারা সাম্রাজ্যবাদবিরােধী সংগ্রামে ভারতীয় জনগণের একই রকম স্বার্থ ও পরাধীন অবস্থা লক্ষ্য করতে বাধ্য হতেন।
উনিশশো বিশ এবং তিরিশের যেসব ঐতিহাসিকরা সাম্প্রদায়িক মনােভাবসম্পন্ন ছিলেন, তাদের কাজ সব বাতিল করে দেওয়া উচিত হবেনা। তাদের অনেকেই নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গির দুর্বলতা সম্বন্ধে পুরােপুরি সচেতন ছিলেন না। যখন ইতিহাসের এক অধ্যায় সম্পূর্ণ হলে কেবল তখনই সব ঘটনা ও মনােভাবের পুরো তাৎপর্য স্পষ্ট হয়ে উঠলাে। কিন্তু আমরা ১৯৪৭-এর দেশবিভাগের দিনগুলির ভেতর দিয়ে এসেছি এবং প্রতিনিয়তই জাতীয় সংহতির প্রয়ােজন অনুভব করছি। আমাদের বুঝতে হবেই যে সাম্প্রদায়িকতা আমাদের প্রায় কিছুই দিতে পারেনা। এর ফলে শুধু যে, প্রচণ্ড ক্ষতি হয়ে গেছে তাই নয়, ভবিষ্যতেও আরাে অনেক বড়াে ক্ষতি হতে পারে। যেমন, মুসলিম লীগের দ্বি-জাতিতত্ত্ব প্রণয়নের ঢের আগেই ব্রিটিশ ও ভারতীয় ঐতিহাসিকরা তার একটি পূর্বতন সংস্করণ খাড়া করেছিলেন, যাকে বলা যেতে পারে একজাতিতত্ত্ব। এই তত্ত্ব অনুসারে ভারতীয় জাতির মানে হলাে হিন্দুজাতি, ভারতীয় জনগণ বললে হিন্দু জনগণকে বােঝয়, মুসলমান শাসন ছিলো বিদেশী শাসন সুতরাং ভারতে মুসলমানরা বহিরাগত বিদেশী মাত্র ছিলেন, ইত্যাদি।
[৮]
ভারতে জাতীয় আন্দোলন এবং সামাজিক ও ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন যেহেতু ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার ফল বিশেষ এবং যেহেতু একটি নতুন ও দ্রুত পরিবর্তনশীল পরিস্থিতিতে অনেক হাতড়ানাে, অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা, অনেক ভুলভ্রান্তির মধ্য দিয়ে এদের সৃষ্টি হয়েছিলাে, সেইজন্যে এটা অনিবার্য ছিলো যে, এদের মধ্যে পরস্পরবিরােধী অনেক কিছুই থাকবে। সুস্থ ও অসুস্থ, দু-ধরনের প্রবণতাকে এরা স্বভাবতই সৃষ্ট ও বর্ধিত করেছিলো। যে সময় ভারতের মানুষ জাতীয়তাবাদের পথ হাতড়ে বার করতে শুরু করেছিলেন তখন পরিবর্ধমান জাতীয় অনুভূতির সঙ্গে সাম্প্রদায়িকতা, বর্ণাশ্রয়িতা ইত্যাদি অনেক কিছু যে মিশে থাকবে এটাও অবশ্যম্ভাবী। গতিশীল আন্দোলনের নেতৃবর্গ ও তাদের উত্তরপুরুষদের অবিরাম কর্তব্যই হলো নীর থেকে ক্ষীর বেছে নেওয়া। অকৃতকার্য হলে তার দায়িত্ব হবে পথিকৃৎদের নয়, তাঁদেরই—যেমন ভুল চিন্তার প্রায়শ্চিত্ত তাদেরই করতে হবে।
দুর্ভাগ্যবশত অতীতের সবকিছু দ্বিধায় গ্রহণ করার ফলে ভারতীয় রাজনীতির বিভিন্ন ধারাগুলির মধ্যে স্বচ্ছতা ও পৃথকীকরণের অভাব ঘটেছে এবং এর ফলে অতীতে ও বর্তমানে প্রচুর ক্ষতি হয়ে গেছে। উনিশ শতকের সমাজ-সংস্কার এবং বিশ শতকের রাজনৈতিক আন্দোলনগুলিকে আমরা সমালােচনার উধ্বে বলে মনে করি। রাজা রামমােহন রায়, স্বামী দয়ানন্দ, বিবেকানন্দ, অরবিন্দ ঘােষ, লােকমান্য তিলক, লাজপৎ রায়, গান্ধীজী প্রমুখ সকলের বিষয়ে আমরা কেবলই গতানুগতিক স্তোকবাক্যের পুনরুক্তি করে থাকি। আমাদের গণসংযােগের সব মাধ্যমগুলি, বিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তক, আকাশবাণীসকলেই একভাবে তাদের নিরঙ্কুশ প্রশংসা করে চলেছে। ফলে, সাম্প্রদায়িক মনােভাবাপন্ন ব্যক্তিরা এবং অন্যান্যরা তাদের জীবনের নেতিবাচক দিকগুলি নিজেদের সুবিধার জন্যে ব্যবহার করতে পারেন। আমরা তাে জনসাধারণকে বিশেষত অল্পবয়স্কদের কখনােই একথা বলিনা যে এইসব মহাপুরুষরা প্রকৃতপক্ষে মানুষই ছিলেন এবং স্বাভাবিকভাবেই তাদেরও বােধশক্তি এবং কার্যকলাপ অভ্রান্ত ছিলােনা।
যদিও সেসময়ের পক্ষে তাদের ভুলভ্রান্তি হয়তাে মার্জনীয়, তবু তখনও তার জন্যে অনেক ক্ষতি হয়েছিল এবং অন্য এক ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিতে দেখতে গেলে তার ফলে খুবই সর্বনাশ হয়েছে। অনবরত তাদের প্রশংসা করার প্রবণতা এক হিসেবে সাম্প্রদায়িকতা, বর্ণাশ্রয়িতা এইসবের কাছে হার মানা। কারণ গােখলে, রানাডে, দাদাভাই নওরােজী এবং বিপিনচন্দ্র পাল প্রমুখ কোনাে কোনাে নেতাকে আমরা তাঁদের যথার্থ ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করে থাকি, জাতীয়তাবাদের পথে তাঁদের বিরাট অবদান স্বীকার করেও বলি যে তাদের সাম্রাজ্যবাদ বিরােধিতা যথেষ্ট দৃঢ় ছিলােনা।
একথা মনে রাখাও অনুরূপ প্রয়ােজন যে উনবিংশ এবং বিংশ শতকের বহু ভারতীয় নেতাদের প্রচুর অবদান থাকলেও ধর্মের সঙ্গে রাজনীতির সম্পর্কবিচারে, জাতিভেদপ্রথা সম্পর্কে, ঐতিহাসিক সমস্যা অথবা ভারতীয় সমাজগঠন সম্বন্ধে বা সংখ্যালঘু ধর্মীয় গােষ্ঠীগুলির ব্যাপারে তাদের চিন্তাতেও অনেক দুর্বলতা ছিলাে। আমাদের পাঠ্যপুস্তক, সংবাদপত্র, আকাশবাণী এবং রাজনৈতিক নেতাদের এইসব ব্যক্তিদের ওপর নির্বিচারে সবকিছু মহত্ত্ব আরােপের চেষ্টা থামাতেই হবে, কারণ এ চেষ্টা পরােক্ষভাবে হলেও জাতীয় সংহতিকে দুর্বল করে তােলে।
[৯]
ইতিহাস সম্বন্ধে সাম্প্রদায়িক মনােভাব, পরােক্ষ জাতীয়তাবাদ, ১৯৪৭ সালের পূর্ববর্তী বিদেশী শাসনের বিরুদ্ধে না গিয়েও ‘জাতীয়তাবাদী’ হওয়া, ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদী লােকের মনেও সাম্প্রদায়িকতার গভীর ও সূক্ষ্ম প্রভাব জাতীয় গণসংযােগ ও শিক্ষাব্যবস্থায় ধর্মনিরপেক্ষতার পরাজয়, এমন কি সাম্প্রদায়িকতার প্রচার সকলকেই সন্তুষ্ট রাখার বিপজ্জনক নীতি, সমগ্ৰ অতীত, বিশেষত জাতীয় আন্দোলনের সাম্প্রতিক ইতিহাসকে সমালােচনার উধ্বে বসানাের চেষ্টা—একটা বিশেষ পরিচিত দৃষ্টান্ত দেখালেই সবকিছু পরিষ্কার হবে। তা হলাে জাতীয় মহাপুরুষ সৃষ্টি ও প্রচার।
উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে জাতীয়তাবাদের সূচনায় যখন দেশের নেতারা জাতীয় চেতনা প্রসারের কাজ হাতে নিলেন, তখন মনে করা হয়েছিলে যে “জাতীয় মহাপুরুষ”-দের উদাহরণ তুলে ধরলে তাদের কাজ ত্বরান্বিত হবে। জাতীয় চেতনা যাদের পক্ষে বুদ্ধি দিয়ে গ্রহণ করা কঠিন, জাতীয় মহাপুরুষদের কেন্দ্র করে তাঁদের চিত্তকেও দেশপ্রেমের প্রতি আকৃষ্ট করা সম্ভব হবে। সুতরাং এই মহাপুরুষেরা জাতীয় আবেগের প্রতীক হয়ে দাড়ালেন এবং এখনাে ব্যাপকতাৰে তাঁদের এভাবেই ব্যবহার করা হয়। দ্বিতীয়ত বহু লেখক, সাংবাদিক ও শিক্ষাবি জাতীয় মহাপুরুষ পূজা প্রচারের মাধ্যমে নিজেদের দেশপ্রেমের প্রকাশ খুঁজেছেন এবং তা তাদের প্রাত্যহিক জাতীয়তাবাদী প্রচার কার্যের অংশ ছিলো। তৃতীয়ত, বৃটিশদের ধারণা ছিলো ভারতীয়দের মধ্যে স্বায়ত্তশাসনের ক্ষমতা, ইচ্ছা এবং তার জন্যে সংগ্রাম করার দৃঢ় সংকল্পের একান্ত অভাব আছে, সুতরাং এই মতটি খণ্ডন করার জন্যেও কিছু কিছু ঐতিহাসিক চরিত্রের গৌরবকীর্তনের প্রয়ােজন দেখা দিয়েছিলাে। সবশেষে, সাম্প্রদায়িক নেতারা তাদের নিজেদের ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক মতের সমর্থনের জন্যে এক আন্দোলনের যথার্থ, বাস্তব বীরদের আরােহণ ঠেকানাের উদ্দেশ্যে অন্য প্রতীক তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। এ সবের ফলে রাণা প্রতাপ, গুরুগগাবিন্দ সিংহ এবং শিবাজী প্রমুখ অনেক ঐতিহাসিক চরিত্রকে সংবাদপত্র, ইস্তাহার, গল্প, কবিতা এবং নাটক, বিদ্যালয় ও আকাশবাণীর সাহায্যে “জাতীয় মহাপুরুষ” হিসেবে জনসমক্ষে তুলে ধরা হয়েছে।
এটা পরিষ্কার করে বােঝা দরকার যে মহাপুরুষ সৃষ্টির এই প্রক্রিয়ার পেছনে কোনাে ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ বা বিচারের ব্যাপার ছিলােনা। সবটাই ছিলাে রাজনীতির প্রশ্ন এবং রাজনৈতিক কৌশল এ চেষ্টার ফলে এটি সম্ভব হয়েছিলো। বিশেষ একজন কোনাে মহাপুরুষকে বেছে নেওয়া ও তার সামাজিক ও রাজনৈতিক উপযােগিতার সঙ্গে ঐতিহাসিক তথ্য, অবদান এবং বিশ্লেষণের প্রায় কোনো যােগ ছিলােনা। মহাপুরুষ সৃষ্টি করা হয়েছিলো আধুনিক ভারতীয় রাজনীতির উদ্দেশ্যসাধনের জন্যে। সেই উদ্দেশ্যর মাপকাঠিতেই তাদের রাজনৈতিক উপযােগিতা বা সার্থকতা বিশ্লেষণ করতে হবে, ঐতিহাসিক ব্যাখ্যার ভিত্তিতে নয়।
আমরা এবার দেখবাে যে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে নানাকারণে যাঁরা বলিষ্ঠ সংগ্রাম করেছিলেন, তাদের মধ্যে থেকে রাজনৈতিক কারণে সৃষ্টি এইসব বীরদের বেছে নেওয়া হয়নি। বাহাদুর শাহ, ঝাসির রাণী, নানাসাহেব, তাতিয়া টোপী, ফৈজাবাদের মৌলান আহম্মদুল্লাহ, কুঁয়ার সিং প্রমুখ ১৮৫৭-র বিদ্রোহীবৃন্দ, ঝিনের রানী, দেওয়ান মূলজ, বাসুদেও. বি. কাড়কে, চাপেকার ভ্রাতৃদ্বয়, সঁওতাল ও নীল বিদ্রোহের নায়করা এবং আরাে পরে ক্ষুদিরাম বসু, কল্পনা দত্ত প্রভৃতি—জাতীয়তাবাদী নেতৃত্বের সমগ্ৰ তালিকায় কিন্তু এদের বেছে নেওয়া হয়নি।
সাহিত্যের ক্ষেত্রেও দেখা যায় যে নীল বিদ্রোহের ওপর রচিত ‘নীল দর্পণ’-এর মতো প্রকৃতই অগ্নিগর্ভ, যথার্থ আধুনিক জাতীয়তাবাদী নাটকটি সমস্ত উত্তর ভারতে একবারও অভিনীত হয়নি এবং বই হিসেবেও একটিও বিক্রি হয়নি। বরং জাতীয়হাবাদের উদ্বোধন ঘটেছিলাে পৃথ্বীরাজ এবং হকিকৎ রায়কে কেন্দ্র করে জনপ্রিয় নাটকের মাধ্যমে। স্বভাবতই ক্রমশ মুসলমান সাম্প্রদায়িকরাও এর উত্তরে তাদের নিজস্ব পৃথক মহাপুরুষদের সৃজন করলেন এবং এদের খুঁজে বার করতে গিয়ে ‘ক্রুসেড’ বিরােধী সংগ্রামী যুগে পর্যন্ত তাদের ফিরে যেতে হয়েছিলাে।
কেন এরকম হ’লাে? মহাপুরুষ-পুরাণ সৃষ্টির সময়ে তার পেছনে প্রধানতম কারণ নিশ্চয়ই ছিলাে ব্রিটিশ শাসকদের মনােভাব। যথার্থ জাতীয়তাবাদ অথবা সাম্রাজ্যবাদবিরােধিতার কোনােরকম প্রকাশকে তঁারা একেবারেই বরদাস্ত করতেন না। যারাই তাদের শাসন প্রতিষ্ঠার বিয়ােধিতা করেছিলেন, তাদের গৌরবকীর্তনে তারা বিশেষভাবে বিরূপ ছিলেন। ১৮৫৭-র বীরদের স্বপক্ষে যারাই কিছু লিখতেন বা বলতেন, তাঁদের দমন করতে তাঁরা কিছুমাত্র দ্বিধা করতেন না। বিদ্যালয়ের বহু সংখ্যক শিক্ষক, লেখক, সাংবাদিকরা প্রায়ই সরকারি পৃষ্ঠপােষকতার ওপর নির্ভর করতেন, তাঁরা আমলাদের বিশেষ অপ্রীতিভাজন হবার মতাে কোনাে ঝুঁকি নিতে চাইতেন না। অন্যদিকে আমলারাও পরােক্ষ জাতীয়তাবাদকে উৎসাহই দিতেন, কারণ তাদের বিভেদপন্থী নীতির সঙ্গে তা বেশ মিলে যেত। ইতিহাস ও সাহিত্যের পাঠ্যপুস্তকে সাম্প্রদায়িক, বর্ণাশ্রয়ী এবং প্রাদেশিক মহাপুরুষদের গুণগান করা চলতে এমন কি উৎসাহ দেওয়া হতো যতক্ষণ না ব্রিটিশরাজের যারা বিরােধিতা করেছেন তাঁদের উল্লেখ করা হচ্ছে। শুধু ভাবাদর্শের ক্ষেত্রে নয়, বাস্তব রাজনীতিতেও ব্রিটিশদের সঙ্গে হিন্দু ও মুসলমান সাম্প্রদায়িক দের এবং জাতিভেদ প্রথার সমর্থকদের পূর্ণ সহযােগিতা বারবার চোখে পড়ে, ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে তারা এক সঙ্গেই লড়াই করেছেন।
এ তথ্যটিও লক্ষণীয় যে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের ‘নরমপন্থী’ যুগেই অধিকাংশ মহাপুরুষ-পুরাণের সৃষ্টি হয়েছিলাে। শিবাজী, গুরুগগাবিন্দ সিংহ, রাণা প্রতাপ—এদের ‘জাতীয় বীরের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, জাস্টিস রানাডে, মদনমােহন মালব্য, রমেশচন্দ্র দত্ত এবং প্রথমযুগের অপেক্ষাকৃত নরমপন্থী তিলক। সেদিনের জাতীয়তাবাদীরা ব্রিটিশ শাসনকে পূর্বতন শাসকদের তুলনায় ঐতিহাসিক বিচারে অগ্রগামী মনে করতেন এবং সেজন্য যাঁরা তার প্রতিষ্ঠার বিরােধিতা করেছিলেন, তাঁদের প্রশংসা করতে অপারগ ছিলেন। উপরন্তু সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তে শাসকদের অপ্রীতিভাজন হ’তেও তারা ঠিক ইচ্ছুক ছিলেন না। ১৮৯৭ সালে ব্রিটিশদের তিলকবিরােধী অভিযানের কথা এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে। মুসলমান বিরােধী নেতারূপে শিবাজী: বন্দনায় শাসকগােষ্ঠীর একেবারেই কোনাে আপত্তি ছিলেন। তাঁরা হস্তক্ষেপ করলেন তখনই, যখন তাদের মনে হলো যে তিলক শিবাজীপূজার মাধ্যমে ব্রিটিশবিরােধী মনােভাব প্রচার করেছেন। আমি আবার বলতে চাই যে প্রথমযুগের জাতীয় নেতাদের এই মহাপুরুষ সৃষ্টির কিছু সঙ্গত কারণ ছিলো। অঙ্গানা এক সমুদ্রে তারা সবেমাত্র পাড়ি দিতে আরম্ভ কয়েছিলেন, নিজেদের কার্যাবলীর সম্পূর্ণ তাৎপর্য সম্বন্ধে তারা তখনো অবহিত ছিলেন। তাদের বিরাট অবদান গ্রহণ তরে তাদের ভুলগুলি শুধরে নেওয়ার দায়িত্ব ছিলাে পরবর্তী জাতীয়তাবাদীদের।
ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয় সংহতিকে দুর্বল করার কাজে এধরনের মহাপুরুষ সৃষ্টি—রাণা প্রতাপ, শিবাজী, গুরু গােবিন্দ সিংহ ইত্যাদি যারা মধ্যযুগে মােগল শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছিলেন তাঁদের সম্বন্ধে উপকথারচনা—অন্য যে কোনো মতবাদের চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ ছিলােনা। এক কলমের খোঁচায়, প্রায় স্বতঃসিদ্ধভাবে এই ধরনের মহাপুরুষ-পুরাণ দ্বি-জাতিতত্ত্ব বা মূল সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গির যাথার্থ্য প্রমাণ করে দিয়েছিলো। কী হিসেবে তারা জাতীয় নায়ক, এবং তাদের সংগ্রাম কী অর্থে ‘জাতীয় সংগ্রাম’। তারা বিদেশীদের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত ছিলেন বলে? কী অর্থে মােগলেরা বিদেশ? কারণ তারা মুসলমান ছিলেন। রাণা প্রতাপ, শিবাজী এবং গুরু গােবিন্দ সিংহের জাতীয়তাবাদের ঐক্যসূত্র কী ছিলাে? তাঁরা হিন্দু বা অ-মুসলমান ছিলেন। এভাবে মহাপুরুষ-পুরাণগুলি স্বতঃস্ফূর্তভাবে সাম্প্রদায়িকতার সৃষ্টি করেছিলাে।
যে শিশু বা বয়স্ক ব্যক্তি শিবাজী কিংবা রাণা প্রতাপের জাতীয় নেতা হিসেবে গৌরব গান শুনেছে সে স্বতঃস্ফূর্তভাবেই বিশ্বাস করবে যে মধ্যযুগের ভারতে একটি হিন্দু জাতির অস্তিত্ব ছিলাে এবং তা ‘বিদেশী মুসলমান’দের বিরুদ্ধে আগাগােড়া লড়াই করে এসেছে। আজও আমাদের পাঠ্যপুস্তক, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, গণসংযােগের মাধ্যমগুলি এবং বিশেষ করে আকাশবাণী মধ্যযুগের মহাপুরুষ-পুরাণগুলি ব্যবহার করছেন জাতীয়তাবাদকে জাগ্রত করার জন্যে। এই প্রবণতা আরাে বেশি করে দেখা যায় বিশেষ কোনো জাতীয় সঙ্কটের সময়। এ ব্যাপারে পথিকৃৎদের চেয়ে তাঁদের দায়িত্ব আরাে বেশি, কারণ এর ফলে যা ক্ষতি হতে পারে তা আজ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে এবং বাস্তবজীবনে প্রকৃত সাম্রাজ্যবাদবিরােধী সংগ্রাম করেছেন এমন ঐতিহাসিক চরিত্রের বিষয়ে এখন যথেষ্ট জানা যায়। এইসব মহাপুরুষপুরাণের অযৌক্তিকতা ও উদ্ভটত্ব বেশ বােঝা যায় যখন শেঠ গােবিন্দদাস প্রমুখের রচনার মত অসংখ্য বেতার-নাটকে প্রত্যেকটি জমিদার ও জায়গিরদারদের তুচ্ছ বিবাদ-বিসংবাদের মধ্যে জাতীয়তাবাদের অনুসন্ধান চলে, যদি অবশ্য জমিদারটি রাজপুত বা হিন্দু হন এবং শাসক মুসলমান।
আর একবার বলি। এর সঙ্গে ঐতিহাসিক সত্য বা সততার কোনাে সম্বন্ধ নেই। কারণ সব মহাপুরুষ-পুরাণ প্রকৃত ঐতিহাসিক রচনা নয়। এগুলি রাজনীতির সৃষ্টি এবং রাজনৈতিক উপযােগিতার মাপকাঠিতে এগুলি বিচার্য। দ্বিতীয়ত, এইসব মহাপুরুষরা জাতীয় নেতা ছিলেননা বলতে গিয়ে আমি কিন্তু তাদের ঐতিহাসিক ভূমিকা অস্বীকার করছি না। নিশ্চয়ই তাদের নিজেদের ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিতে শিবাজী, রাণা প্রতাপ বা গুরু গােবিন্দ সিংহের যথেষ্ট গুরুত্ব ছিলো। কিন্তু তা জাতীয় সংগ্রামের পরিপ্রেক্ষিতে নয়। অন্যথায় আমরা যদি সাম্প্রদায়িকতাকে অতীতে নিয়ে গিয়ে এদের হিন্দু জাতীয়তাবাদী রূপে দেখি, তাহলে অন্যেরা তাদের ধর্মনিরপেক্ষ, সংহত জাতীয়তাবাদকে অতীতে নিয়ে গিয়ে এদের ভারতীয় ঐক্য, রাষ্ট্র এবং অতএব জাতীয়তার পরিপন্থী হিসেবে চিত্রিত করতে পারেন। দ্বিতীয় মতটি যে উদ্ভট তা সবাই স্বীকার করবেন ; প্রথম দৃষ্টিভঙ্গিটিও কিন্তু সমান অলীক। তাছাড়া যে যুগে জাতীয়তাবাদের অস্তিত্ব ছিলােনা, সে যুগের কাউকে জাতীয়তাবাদী না বলাটা নিন্দনীয় নয়। ‘জাতীয় নায়ক’ হওয়াই একমাত্র সম্মান নয়। তাহলে আমরা একথা ঘােষণা করি না কেন যে, অশােক, হর্ষ, গুরু নানক, চৈতন্য বা আকবরকে জাতীয় নায়ক না বলা মানে তাদের অপমান করা? আসলে আমার প্রকৃত উদ্দেশ্য হলো শিবাজী, রাণা প্রতাপ, গুরু গােবিন্দকে সাম্প্রদায়িকে যেভাবে অপব্যবহার করেছেন তার অবসান ঘটানাে। বস্তুত রাণা প্রতাপ আকবরের চেয়ে বা শিবাজী ঔরংজেবের চাইতে বড়ো জাতীয় নায়ক ছিলেন না। কাল্পনিক ইতিহাসে তাদের ওপর একটি মিথ্যা ‘জাতীয়’ চরিত্র আরােপ করে আমরা আধুনিক ও সাম্প্রতিক ইতিহাসে জাতিবিরােধী ও সংহতি-বিরােধী কাজ করছি।
মহাপুরুষ-পুরাণের সাম্প্রদায়িক দিকটি আরেকভাবে দেখা যায়। আশ্চর্যের বিষয় এই যে, যদিও অশােক, চন্দ্রগুপ্ত বা হর্ষ তথাকথিত স্বর্ণযুগের লােক ছিলেন, তবু তাদের জাতীয় নেতা রূপে চিত্রিত করায় সাম্প্রদায়িকদের প্রায় কোনাে উৎসাহ দেখা যায়নি। তার কারণ, সাম্প্রদায়িকেরা জানেন যে মুসলমানবিরােধী মনােভাব জাগ্রত করার কাজে এইসব নাম ব্যবহার করা যায়না। এদের ‘জাতীয়তাবাদ’ মুসলমানবিরােধী বা সাম্প্রদায়িক হওয়া সম্ভব নয়। এটা বেশ কৌতূহলপ্রদ যে তথ্যনিষ্ঠার নামে আজকের একজন প্রধান সাম্প্রদায়িক ঐতিহাসিক ঝাসির রানী এবং নানা সাহেবকে খর্ব করার চেষ্টা করেছেন, যদিও তাঁরা ছিলেন হিন্দু এবং সত্যিকারের এক বিদেশী শাসনের বিরুদ্ধে তারা লড়াই করেছেন। কিন্তু তশরা তাে কোনাে মুসলমান শাসকের বিরুদ্ধে যাননি, এমনকি মুসলমানদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে একজন মুসলমানকেই সম্রাট বলে স্বীকার করেছিলেন।
সংখ্যালঘু এবং অবদমিত গােষ্ঠীগুলির ওপরে নেতিবাচক প্রভাবের দ্বারা এইসব উপকথাগুলি জাতীয় সংহতির কতটা ক্ষতি করেছে তা আমাদের একেবারেই তুচ্ছ করা উচিত নয়। যে জাতীয়তাবাদে জাতীয় নায়কেরা বিদেশী মুসলমানদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে জাতীয় সম্মান পেয়েছেন, তাকে মনেপ্রাণে গ্রহণ করে সােৎসাহে যােগ দেওয়া কোনো মুসলমানের পক্ষে সহজ নয়। নিম্নবর্ণ এবং নিম্ন শ্রেণীর মধ্যে যতােই সামাজিক ও রাজনৈতিক চেতনা ছড়িয়ে পড়বে, ততােই নিশ্চয়ই তার জমিদার, দলাধিপতি ও শাসকদের (যারা তাদের শোষণ ও পীড়ন করেছেন) গৌরবগানে একই রকমভাবে আপত্তি জানাবেন।
এইসব মহাপুরুষ-পুরাণের পরিবর্তে অন্য কোনো যথার্থ জাতীয় মহাপুরুষ নিয়ে উপকথা সৃষ্টি করতে আমি বলছিনা। এখন সময় এসেছে সাধারণের সামনে খাটি মানুষকে, তার অবদানের তালােয়মন্দয় মেশানাে সম্পূর্ণ দিকটি তুলে ধরার। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা, আকাশবাণী ও গণসংযােগের অন্যান্য মাধ্যমগুলির, রাজনৈতিক দল এবং নেতাদের, এই দায়িত্ব গ্রহণ করা উচিত। এইভাবে আরাে ভালো করে জনসাধারণকে রাজনৈতিক শিক্ষা দেওয়া যাবে এবং উন্নততর সামাজিক ও রাজনৈতিক আদর্শে উদ্বুদ্ধ করা যাবে। কিন্তু যদি কোনাে কারণে মহাপুরুষ-পুরাণ সৃষ্টির প্রয়ােজন অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে, তাহলে তাদের উপযােগিতা ও বাস্তব ভিত্তি সম্বন্ধে বিশেষ চিন্তা করে তা বাছাই করতে হবে।