• মূলপাতা
  • ইতিহাস
    • ইসলামিক ইতিহাস
    • ভারতবর্ষের ইতিহাস
    • বিশ্ব ইতিহাস
  • বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
  • ধর্ম
    • ইসলাম
    • খ্রিস্টান
    • হিন্দু
    • ইহুদী
    • অন্যান্য ধর্ম
  • নাস্তিকতা
  • রাজনীতি
  • সিনেমা
  • সাহিত্য
    • কবিতা
    • ছোটগল্প
    • উপন্যাস
    • সাহিত্য আলোচনা
  • অন্যান্য
  • ই-ম্যাগাজিন
    • নবজাগরণ (ষাণ্মাসিক) – জীবনানন্দ ১২৫ তম জন্ম সংখ্যা – মননশীল সাহিত্য পত্রিকা
  • Others Language
    • English
    • Urdu
    • Hindi
Wednesday, July 16, 2025
নবজাগরণ
  • মূলপাতা
  • ইতিহাস
    • ইসলামিক ইতিহাস
    • ভারতবর্ষের ইতিহাস
    • বিশ্ব ইতিহাস
  • বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
  • ধর্ম
    • ইসলাম
    • খ্রিস্টান
    • হিন্দু
    • ইহুদী
    • অন্যান্য ধর্ম
  • নাস্তিকতা
  • রাজনীতি
  • সিনেমা
  • সাহিত্য
    • কবিতা
    • ছোটগল্প
    • উপন্যাস
    • সাহিত্য আলোচনা
  • অন্যান্য
  • ই-ম্যাগাজিন
    • নবজাগরণ (ষাণ্মাসিক) – জীবনানন্দ ১২৫ তম জন্ম সংখ্যা – মননশীল সাহিত্য পত্রিকা
  • Others Language
    • English
    • Urdu
    • Hindi
No Result
View All Result
নবজাগরণ
  • মূলপাতা
  • ইতিহাস
    • ইসলামিক ইতিহাস
    • ভারতবর্ষের ইতিহাস
    • বিশ্ব ইতিহাস
  • বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
  • ধর্ম
    • ইসলাম
    • খ্রিস্টান
    • হিন্দু
    • ইহুদী
    • অন্যান্য ধর্ম
  • নাস্তিকতা
  • রাজনীতি
  • সিনেমা
  • সাহিত্য
    • কবিতা
    • ছোটগল্প
    • উপন্যাস
    • সাহিত্য আলোচনা
  • অন্যান্য
  • ই-ম্যাগাজিন
    • নবজাগরণ (ষাণ্মাসিক) – জীবনানন্দ ১২৫ তম জন্ম সংখ্যা – মননশীল সাহিত্য পত্রিকা
  • Others Language
    • English
    • Urdu
    • Hindi
No Result
View All Result
নবজাগরণ
No Result
View All Result

ম্যাজিক রিয়ালিজম থেকে সাহিত্য আন্দোলন: এক সাহিত্যিক অভিযাত্রা

মুহাম্মাদ আব্দুল আলিম by মুহাম্মাদ আব্দুল আলিম
July 10, 2025
in সাহিত্য আলোচনা
0
ম্যাজিক রিয়ালিজম থেকে সাহিত্য আন্দোলন: এক সাহিত্যিক অভিযাত্রা

Image: AI Generated

Share on FacebookShare on Twitter

লিখেছেনঃ মুহাম্মাদ আব্দুল আলিম

সাহিত্যের ইতিহাসে আধুনিকতার উদ্ভব যেমন বাস্তবতার নিরন্তর অভিযাত্রার ফল, তেমনই সাহিত্যের নান্দনিক ও দার্শনিক ধারা সময়ের সাথে সাথে রূপান্তরিত হয়েছে নানা আঙ্গিকে। মানব সভ্যতার জটিল অভিজ্ঞতা, রাষ্ট্রনৈতিক টানাপোড়েন, ঔপনিবেশিক শোষণের বিরুদ্ধে নিঃশব্দে গড়ে ওঠা প্রতিরোধী মননের ছায়াতেই জন্ম নিয়েছে সাহিত্যের বহু রূপকথন। এইসব রূপান্তরেরই একটি অভিনব, শক্তিশালী ও ব্যাপক বহুমাত্রিক রূপ হল ‘ম্যাজিক রিয়ালিজম’। সময়ের সংবর্তে সাহিত্যের আধুনিকতার দাবিকে মান্যতা দিতে বাস্তবতার ক্রমঃবিবর্তিত পথেই আজ থেকে প্রায় এক শতাব্দী পূর্বে জন্ম হয়েছিল ম্যাজিক রিয়ালিজম-এর (‘Magic Realism’)।

ম্যাজিক রিয়ালিজম শব্দবন্ধটি যতই চেনা হোক, এর অন্তর্গত তাৎপর্য পাঠকসমাজে, বিশেষত বাঙালি সাহিত্যপ্রেমী ও গবেষকদের মধ্যে নানা ধরনের বিভ্রান্তি ও জটিলতা তৈরি করেছে। কারণ এর জন্ম, বিস্তার ও ক্রমবিকাশ একটি একরৈখিক পথে নয়; বরং বহু মাত্রায়, নানা ভূগোল ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এই ধারার রূপান্তর ঘটেছে। দীর্ঘায়িত চর্চায় সমস্যার চেহারাগুলো স্থানকালের প্রেক্ষাপটে যত বদলে যেতে লাগল, তত্ত্বরূপটি ততই জটিল হয়ে উঠল। মূলের রূপটি হয়ে গেল ফিকে। এই বিচ্যুতি থেকে পাঠক সমালোচক মহলে ছড়ালো বিভ্রান্তি। ফলে ম্যাজিক রিয়ালিজম ব্যাপারটি যে আসলে কী — সে সম্পর্কে সাহিত্যপ্রেমী, শিক্ষিত, বিশেষত বাঙালি পাঠক সমালোচকদের মধ্যে থেকে গেল ধোঁয়াশা। তালগোল পাকানো একটি বিশৃঙ্খল ধারণা। এই অস্থিরতা থেকে মুক্তি দিতে আমরা আরেকবার যাত্রা করব আজ থেকে এক শতাব্দী অতীতে। সেই সময়ের ভাঁজগুলো আস্তে আস্তে খুলে সমকালীন রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রনৈতিক সংকটকে পাশাপাশি রেখে আমরা দেখব জীবনের কোন তাগিদে শিল্পের এই অভিনব আভরণ দরকার হয়ে পড়ল।

একথা স্বীকার করতে হবে, সাহিত্যের ইতিহাসে যে কোনও আন্দোলন বা প্রবণতার জন্ম একক চেতনা থেকে নয়। বরং নানা সূত্র, অভিজ্ঞতা ও সময়চিহ্ন একত্রে মিলিত হয়ে গঠন করে একটি নির্দিষ্ট অভিমুখ। ম্যাজিক রিয়ালিজম তেমনি এক প্রবণতা যা কেবল সাহিত্যের গন্ডিতে সীমাবদ্ধ নয়; বরং তার সূচনা ঘটেছিল ভিজ্যুয়াল আর্ট, বিশেষত চিত্রকলার জগতে। এই পথেই দেখব যে, জার্মানিতে ফ্রাঞ্জ রো (Franz Roh : 1890–1965)—এর চিত্রকলার চেতনায় প্রথম ম্যাজিক রিয়ালিজম অভিধাটি সংযুক্ত হয় (১৯২৫-এ)। “Magischer Realismus” নাম দিয়ে তিনি এক নতুন ধরনের শিল্পভাবনার কথা বলেছিলেন, যেখানে বাস্তবতার মধ্যে এমন কিছু উপাদান বা মুহূর্ত থাকে, যা স্বপ্নময়, রহস্যময়, অথচ একেবারেই আমাদের চেনা জগতের মধ্যেই নিহিত। এই যে যাপিত বাস্তবের গভীরে রহস্যের চিহ্ন, এটাই ছিল রো-র দর্শনের কেন্দ্র।

রো’য়ের এই দর্শন মূলত ইউরোপীয় আধুনিকতার একটি বিকল্প রূপরেখা রচনা করছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী ইউরোপীয় সমাজে যে নিঃসঙ্গতা, অস্তিত্বসংকট এবং রাজনীতির অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছিল, তারই এক নান্দনিক প্রতিফলন ছিল ম্যাজিক রিয়ালিজম। তবে রো’র ম্যাজিক রিয়ালিজম চিত্রকলা ও ভিজ্যুয়াল আর্টে সীমাবদ্ধ ছিল। উপন্যাস বা কথাসাহিত্যে তার সার্থক রূপায়ণ ঘটল বহু পরে, তাও ইউরোপ নয়, লাতিন আমেরিকার বর্ণময়, রাজনৈতিকভাবে উত্তপ্ত এবং সাংস্কৃতিকভাবে মিথগাথায় সমৃদ্ধ ভূগোলে।

লাতিন আমেরিকার সাহিত্যিক আলেহো কার্পেন্তিয়ের (Alejo Carpentier: ১৯০৪–১৯৮০) রো’য়ের দর্শনের এক বিপরীত প্রান্তে দাঁড়িয়ে তার নতুন ভাষ্য নির্মাণ করেন। রো’য়ের মিস্টিক ধারণাকে নস্যাৎ করে কার্পেন্তিয়ের হাতে ম্যাজিক রিয়ালিজম হয়ে উঠল ‘মার্ভেলাস রিয়ালিজম’ (‘Marvelous Realism’)। যুক্ত হল দেশের বিস্ময়কর সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটের সত্য যোগ। লাতিন আমেরিকার ঔপনিবেশিক অতীত, বিপ্লব, আদিবাসী ইতিহাস এবং শ্রুতি-সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের সঙ্গে সাহিত্য যখন মিশে গেল, তখন এক অভিনব রচনাশৈলীর জন্ম হল, যেখানে যুক্তির বাইরের অভিজ্ঞতা, অলৌকিকতা, লোকবিশ্বাস এবং রাজনৈতিক প্রতিবাদের ছায়া মিলেমিশে এক সজীব ভাষার জন্ম দিল। দেশের স্বৈরতন্ত্রী শাসককে বিপরীত করে প্রতিরোধী চরিত্রের মধ্যে আনা হল রূপান্তর ক্ষমতা, ভৌতিক আবহ, অনুভবী ইতিহাস, সাংস্কৃতিক বিশ্বাস, আদিম সভ্যতার মিথ। ম্যাজিক রিয়ালিজম হয়ে উঠল কথাসাহিত্যের সর্বব্যাপ্ত এক আধুনিক বয়ান।

ম্যাজিক রিয়ালিজম থেকে সাহিত্য আন্দোলন: এক সাহিত্যিক অভিযাত্রা
চিত্রঃ আলেহো কার্পেন্তিয়ের, Image Source: theatlantic

এইভাবে ম্যাজিক রিয়ালিজম-এর স্পষ্টত দু’টি ধারা গড়ে উঠল। একটি রো’এর নির্মিত ইউরোপীয় ধারা, যেখানে চিত্রকলার এক অলৌকিক বাস্তবতাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল, যা অনেকটা দৃষ্টির অভ্যন্তরীণ অভিজ্ঞতা। অপরটি কার্পেন্তিয়ের নির্মিত লাতিন আমেরিকার ধারা, যা উপনিবেশের বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক প্রতিরোধের ভাষা হয়ে উঠল। রো’এর চিন্তাধারা ক্রমে ইতালি, বেলজিয়াম, ফ্রান্স, ব্রিটেনে ছড়িয়ে পড়লেও—সাহিত্য আন্দোলনের ব্যাপ্ত ইতিবৃত্তকে বদলে দিতে এই প্রথম কোন ইউরোপীয় আধিপত্যবাদকে ম্লান করে দিয়ে, সাহিত্য আন্দোলনের ঢেউ উত্তাল হয়ে উঠল তৃতীয় বিশ্বের দেশে।

লাতিন আমেরিকা থেকে ক্রমান্বয়ে তা ছড়িয়ে পড়বে ক্যারিবিয়ান, আফ্রিকা, ভারতের মতো তৃতীয় পরিসর হয়ে কানাডা, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড বা ব্রিটেনের মতো প্রথম বিশ্বের দেশে। যার তীব্র আঁচে ম্লান হয়ে যাবে রো’য়ের ইউরোপীয় চিন্তাসূত্রটি। গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস, সালমান রুশদি, টোনি মরিসন, বেন ওকেরি কিংবা অরুণ্ধতী রায়-এর লেখায় যে ম্যাজিক রিয়ালিজম-এর বিস্ময় ও প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়েছে, তার শিকড় মূলত লাতিন আমেরিকার সেই ‘মার্ভেলাস রিয়ালিজম’।

বিশেষত মার্কেসের One Hundred Years of Solitude কেবল এক উপন্যাস নয়, ম্যাজিক রিয়ালিজম-এর এক মহাকাব্যিক উদাহরণ। সেখানে ইতিহাস, পুরাণ, রাজনীতি ও পারিবারিক কাহিনির সংমিশ্রণে তৈরি হয়েছে এমন এক বাস্তবতা, যা অলৌকিক অথচ চেনা, অচিন্ত্য অথচ অনুভবযোগ্য। একইভাবে সালমান রুশদির Midnight’s Children উপনিবেশোত্তর ভারতের ইতিহাসের এক অলৌকিক অথচ নির্মম রূপকথা।

তৃতীয় বিশ্বের সাহিত্যে ম্যাজিক রিয়ালিজম একটি রাজনৈতিক নীতিকথার সমতুল হয়ে উঠল। এখানে অলৌকিকতা আসলেই অলৌকিক নয়, বরং চিরায়ত ঐতিহ্য, লোকবিশ্বাস ও সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতার অংশ। ঔপনিবেশিক দৃষ্টিভঙ্গি যেখানে এইসব বিশ্বাসকে ‘অবাস্তব’ বলে তাচ্ছিল্য করত, ম্যাজিক রিয়ালিজম তা উল্টে দিয়ে বলল, “এই বাস্তবতা আমার; এর অলৌকিকতা আমার ইতিহাসের অঙ্গ।”

ফলে ম্যাজিক রিয়ালিজম আর নিছক শৈলীর নাম থাকল না; হয়ে উঠল দৃষ্টিভঙ্গির এক বিপ্লব। ঔপনিবেশিক আধিপত্যকে ভেঙে দিয়ে নিজস্ব বাস্তবতাকে তুলে ধরার এক রাজনৈতিক ভাষা। আফ্রিকার উপন্যাসে যেমন দেখা গেল, প্রাকঔপনিবেশিক সমাজব্যবস্থার স্মৃতি ও উপনিবেশের নিষ্ঠুর অভিজ্ঞতা মিলেমিশে তৈরি হল এক বিস্ময়কর কাহিনি-ভুবন। ক্যারিবিয়ান বা দক্ষিণ এশিয়ার সাহিত্যে যেমন পিতৃতান্ত্রিক সামাজিক কাঠামোর সঙ্গে লড়াই করে নারীর কণ্ঠস্বর পাওয়া গেল অলৌকিক অভিজ্ঞতার আকারে।

এই প্রসঙ্গে বলা যায়, ভারতীয় উপমহাদেশে ম্যাজিক রিয়ালিজম একটি অনন্য মাত্রা পায়। এখানকার ধর্ম, পুরাণ, লোককথা, দর্শন ও রাজনৈতিক ইতিহাস একসঙ্গে মিলে যে বহুত্ববাদী বাস্তবতার জন্ম দেয়, তা ম্যাজিক রিয়ালিজম-এর জন্য এক উর্বর ভূমি। অরুন্ধতী রায়-এর The God of Small Things-এ যেমন ব্যক্তিগত ট্রাজেডি, সমাজের বৈষম্য ও জাতপাতের নির্মম বাস্তবতা মিলেমিশে এক অলৌকিক কাহিনি রচনা করে।

জাদুবাস্তবতার উৎস থেকে তাত্ত্বিক পরিসরীয় বিভ্রান্তিকর দ্বান্দ্বিকতার অবসান ঘটিয়ে, প্রেক্ষাপটের নিরিখে বিশ্বব্যাপী ক্রমবিবর্তনের চেহারাগুলোকে আমরা এবার ব্যাপ্ত পরিসরে দেখে নেওয়ার চেষ্টা করব। শুধুই সাহিত্যের শৈলী নয়, ম্যাজিক রিয়ালিজম আজ এক ধরণের দৃষ্টিভঙ্গির নাম, যা বাস্তবতার গভীরে লুকানো বিস্ময়, প্রতিরোধ, ইতিহাস ও মানবিকতার সূক্ষ্ম সুরকে স্পর্শ করতে চায়। এ এক কাব্যিক বাস্তবতা, যা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখায়—বাস্তবতা কখনও কেবল যুক্তি নয়, বরং অনুভব, সংস্কৃতি ও স্মৃতির সম্মিলিত প্রকাশ।

অতএব, ম্যাজিক রিয়ালিজম-এর বিকাশ ইতিহাসের প্রবাহেই যুক্তিপূর্ণ। এর রূপ পরিবর্তন হয়েছে সময়, সমাজ ও ভূগোলের সঙ্গে সঙ্গে। আজকের সাহিত্যবিশ্বে এর উপস্থিতি কেবল আলোচনার বিষয় নয়, বরং বঞ্চিত কণ্ঠস্বরের এক অনন্য অভিব্যক্তি। সুতরাং, ম্যাজিক রিয়ালিজমকে বুঝতে হলে শুধুমাত্র তার অলৌকিক উপাদান নয়, বরং তার অন্তর্নিহিত রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গিকেও বুঝতে হবে—যা তৃতীয় বিশ্বের সাহিত্যকে দিয়েছে এক নতুন বলিষ্ঠ ভাষা, এবং বিশ্বসাহিত্যের মানচিত্রে একটি বিকল্প আধিপত্যহীন পথ।

ম্যাজিক রিয়ালিজম-এর উৎপত্তি ও তাত্ত্বিক ভিত্তি

এক

আজ থেকে প্রায় এক শতাব্দী পূর্বে, যখন পৃথিবী এক অস্পষ্ট অনিশ্চয়তার মধ্যে দিয়ে এগোচ্ছিল, তখনই জন্ম নেয় এমন একটি সাহিত্য-চেতনা, যা বাস্তবতার নিরুত্তাপ কাঠামোর ভেতর এক নতুন জীবনীশক্তি, এক অলৌকিক শিহরণ এনে দেয়—এটাই ম্যাজিক রিয়ালিজম। প্রথমদিকে শব্দবন্ধটি কেবলমাত্র একটি শিল্পতাত্ত্বিক প্রয়োগ ছিল, কিন্তু সময়ের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে তা হয়ে উঠল সাহিত্যের এমন এক রীতির নাম, যা কেবল অলৌকিকতাকে নয়, বরং বাস্তবতার অন্তরালে লুকিয়ে থাকা অন্তসার ও বিস্ময়কে পুনরাবিষ্কার করে।

“Magic Realism”, “Magical Realism” এবং “Marvelous Realism”—এই তিনটি পরিভাষা একে অপরের পরিপূরক হলেও, এদের মধ্যে রয়েছে সাংগঠনিক ও দার্শনিক স্তরে মৌলিক পার্থক্য। এই শব্দবন্ধগুলির একটি জটিল তত্ত্বগত বিস্তার রয়েছে, যা ভেঙে বুঝতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে তিনটি প্রধান সময় পর্বে: প্রথমত, বিশ শতকের বিশের দশকে জার্মানিতে এর শিল্পগত সূচনা; দ্বিতীয়ত, ত্রিশের দশকে মধ্য আমেরিকায় এই ধারা সাহিত্যে প্রবেশের সূচনা; এবং তৃতীয়ত, চল্লিশের দশকে লাতিন আমেরিকায় এর রাজনীতিসচেতন ও সাংস্কৃতিক বিকাশ।

আমাদের আলোচ্য প্রবন্ধটি যদিও সাহিত্যকেন্দ্রিক, তবু ম্যাজিক রিয়ালিজমকে যে প্রথম উপলব্ধি করা হয় শিল্পকলার জগতে—তা ভুলে গেলে চলবে না। সেই শিল্পবোধের প্রেরণায়ই সাহিত্য তার অনন্য বিস্তার পেয়েছে। জার্মান শিল্প-সমালোচক ফ্রাঞ্জ রো ১৯২৫ সালে তাঁর চিত্রকলার অনুপুঙ্খ বিচার করতে গিয়ে “Magischer Realismus” নামক একটি তাত্ত্বিক ভিত্তি রচনা করেন। রো-এর মতে, চিত্রকলায় জাগতিক বাস্তবতাকে এমনভাবে উপস্থাপন করা যায়, যাতে তার অন্তর্নিহিত রহস্য ও অলৌকিকতা পাঠকের চেতনায় গভীরভাবে নাড়া দেয়। তাঁর চিত্রে আপাত বাস্তবের অন্তরালে যে জীবন-রহস্য উদ্ভাসিত হয়, তা কোনও অলীক কল্পনা নয়, বরং বাস্তবেরই এমন এক রূপ, যা আমরা প্রায়শই অগোচরে এড়িয়ে যাই।

এই তাত্ত্বিক বিকাশের পেছনে যে রাজনৈতিক, সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক প্রেক্ষাপট কাজ করেছে, তা বিশ্লেষণ করা একান্ত জরুরি। রো-এর এই চিন্তা জন্ম নিয়েছিল এক বিক্ষুব্ধ জার্মান পরিপ্রেক্ষিতে—যেখানে সদ্য সমাপ্ত প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪–১৯১৮) সমাজকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছিল। যুদ্ধের পর জার্মানি একদিকে রাজনৈতিকভাবে ভেঙে পড়ছিল, অন্যদিকে অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে তলিয়ে যাচ্ছিল। মুদ্রাস্ফীতি, বেকারত্ব, ক্ষুব্ধ জাতীয়তাবাদ, বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন—সব মিলিয়ে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিশাহীন সমাজ। এই সময়েই কোয়ালিশন সরকার ব্যর্থ হয়ে পড়ে গণমানুষের আস্থা হারায়, ফলে শিল্প ও সাহিত্যজগৎ এক গভীর সংকটে পড়ে।

এই পরিস্থিতিটি ধরতে গিয়ে জার্মান শিল্প-ইতিহাসবিদ সেরগুজ মিথলস্কি (Sergiusz Michalski) ব্যাখ্যা করেন,

“Ultimately, it was a reflection of German society at that time, turn between a desire for and simultaneous fear of unconditional modernity, between sober, objective rationality and residues of Expressionist and rationalist irrationalities.” (Norman Davies, Europe: A History, Oxford University Press, 1996, p. 941–942)।

অর্থাৎ, সেই সময়কার জার্মান সমাজ একদিকে যেমন খাঁটি যুক্তিবাদের প্রতি আকৃষ্ট, তেমনি ভয় পাচ্ছে পূর্ণাঙ্গ আধুনিকতার আগমনে। একপ্রকার দ্বৈত মানসিকতার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে সেই সময়ের চিত্র ও শিল্পচেতনা।

এই দ্বিধাদ্বন্দ্বের সময়েই ফ্রাঞ্জ রো তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি রূপায়িত করেন। প্রকাশবাদী (Expressionist) আন্দোলনের চরম আবেগ ও রক্তাক্ত অনুভব থেকে কিছুটা সরে এসে তিনি চেয়েছিলেন একটি নির্লিপ্ত, অথচ গভীর দর্শনসম্পন্ন চিত্ররীতি গড়ে তুলতে। তিনি বিমূর্ত নয়, বরং বাস্তবতাকে ব্যবহার করেই তার রহস্য ও গূঢ়তাকে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন। তাঁর মতে, জাদুবাস্তবতার লক্ষ্য আসলে বাস্তব জগত। কিন্তু পরাবাস্তবের মত তা মনস্তাত্ত্বিক বা অবচেতনার উদ্রেক নয়, বরং হবে ম্যাজিক্যাল—”our real world re-emerges before our eyes”। এই নতুন দৃষ্টিকোণে বাস্তবতা আর নিছক নিরাবেগ পরিসংখ্যান নয়, বরং এক বিস্ময়ের উপাখ্যান।

তাঁর প্রকাশিত রচনায় (১৯২৫) তিনি বাইশটি বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করেন, যেখানে এই নতুন চিত্ররীতির কাঠামো নির্মিত হয়। রো নিজে শুধু তত্ত্ব নির্মাণ করেননি, তাঁর সময়কার অন্তত পনেরোজন চিত্রশিল্পীর কাজকেও তিনি এই নতুন ধারার অন্তর্ভুক্ত করতে চেয়েছিলেন। ‘Magischer Realismus’ নামটি আমরা লেখ্যরূপে প্রথম দেখি ১৯২৫ সালে, কিন্তু চিন্তাসূত্রটির জন্ম হয়েছিল তারও পাঁচ বছর আগে, অর্থাৎ ১৯২০-তেই। সেই সময়েই জার্মানির শিল্প আন্দোলনগুলিতে এই প্রবণতা দানা বাঁধছিল। এই ধারার চিত্রকলা ইউরোপীয় যুক্তিবাদের কাঠামোকে নাড়িয়ে দেয়, কারণ বাস্তবতা এখানে শুধুই বৈজ্ঞানিক বা বস্তুগত নয়, বরং জাগতিক বাস্তবতার গভীরে নিহিত অলৌকিকত্বকেও শিল্পের অংশ হিসেবে ধরা হয়।

এই বিষয়ে শিল্প-সমালোচক ইরেনে গুন্থার (Irene Guenther) বলছেন,

“The juxtaposition of ‘magic’ and ‘realism’ reflected the monstrous and marvelous Unheimlichkeit (uncanniness) within human beings and inherent in their modern technological surroundings.” (Irene Guenther, Magic Realism, New Objectivity and the Arts during the Weimar Republic, in Zamora & Faris (Eds.), Magical Realism: Theory, History, Community, Duke University Press, 1995, p. 36)।

এখানে স্পষ্ট যে রো-র চিত্রতাত্ত্বিক ম্যাজিক রিয়ালিজম আসলে আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর সমাজের নির্লিপ্ততা ও মানবিক আবেগহীনতার ভেতরে বসবাসকারী একধরনের রহস্য বা অস্বস্তিকে ধরতে চায়।

এই জাদুবাস্তব দৃষ্টিভঙ্গি একদিকে যুক্তির শৃঙ্খলকে অস্বীকার করে না, আবার অপরদিকে, অচেনা, বিস্ময়কর ও শিহরণসঞ্চারী অভিজ্ঞতার জন্যও একটি দরজা খুলে দেয়। সিগমুন্ড ফ্রয়েড-এর অবচেতন মনস্তত্ত্ব এই ধারণাকে আরও শক্ত ভিত্তি দেয়। অবচেতন, স্বপ্ন, দুঃস্বপ্ন কিংবা শিশুসম অভিজ্ঞতার মতো অভ্যন্তরীণ মানসিক অবস্থা তখন চিত্রকলার বিষয় হয়ে ওঠে। বাস্তবতার কংক্রিট কাঠামোতে এই অন্তর্জগৎকে সংযুক্ত করার মধ্য দিয়েই ম্যাজিক রিয়ালিজম এক অনন্য মাত্রা পায়।

তবে এই তাত্ত্বিক রূপের মধ্যে একটি বিভ্রান্তি শুরু হয় যখন এই ‘ম্যাজিক’-কে সরাসরি অতিপ্রাকৃত, অলৌকিক বা পৌরাণিক বলে চিহ্নিত করা হয়। ফ্রাঞ্জ রো এর চিত্রতত্ত্ব কখনওই পরাবাস্তব বা সুররিয়ালিজমের মতো নয়। কারণ সুররিয়ালিজম যেখানে অবচেতনার অবাধ প্রবাহকে গুরুত্ব দেয়, ম্যাজিক রিয়ালিজম সেখানে চেনা বাস্তবতাকেই এমনভাবে উপস্থাপন করে, যা দেখেই পাঠক বা দর্শক একধরনের অভাবিত অভিজ্ঞতা লাভ করে।

এই দৃষ্টিভঙ্গির জোরে আমরা দেখতে পাই, ফ্রাঞ্জ রো-এর এই ইউরোপীয় ধারা পরবর্তীকালে স্প্যানিশ অনুবাদে পরিচিত হয় ‘Realismo Mágico’ নামে, এবং পরে ইংরেজিতে তা হয়ে যায় ‘Magic Realism’। যদিও তিনটি শব্দবন্ধই একই প্রবণতার ধারক, তবে এদের ভিন্ন ভিন্ন ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক পরিপ্রেক্ষিত রয়েছে। ‘Magic Realism’ মূলত শিল্পকলার ধারণা হলেও, পরবর্তীকালে এই ধারাটি সাহিত্যে এক গভীর শিকড় বিস্তার করে—বিশেষত লাতিন আমেরিকার সাহিত্যিকদের হাতে।

ফ্রাঞ্জ রো-এর তৈরি এই ধারণা ছিল যুক্তিবাদী বাস্তবতার কাঠামোর মধ্যে থেকেই চেতনাবিশ্বের রহস্যকে আবিষ্কারের চেষ্টা। এই ভাবনাটি ছিল একধরনের দৃঢ়, নির্লিপ্ত অথচ শিহরণ সৃষ্টিকারী দৃষ্টিভঙ্গি, যা দৃশ্যমান বাস্তবতার গভীরে অদৃশ্যতার রূপককে আবিষ্কার করে। এই শিল্পতত্ত্বের গুরুত্ব আজও অমলিন, কারণ এটি আমাদের শেখায়—বাস্তবতা কেবল একটিমাত্র নয়, বহুস্তরীয়; আর সেই বহুস্তরীয় বাস্তবতার অন্বেষণই হলো ম্যাজিক রিয়ালিজম-এর অন্তঃসার।

এইভাবেই দেখা যায়, জাদুবাস্তবতার বিকাশ কেবল একটি সাহিত্যমাত্রিক প্রবণতা নয়, বরং এটি ছিল এক গভীর শিল্প, মনস্তত্ত্ব ও সমাজবীক্ষণের ফল, যা সময়ের সাথে সাথে সাহিত্য, চিত্রকলার গণ্ডি ছাড়িয়ে হয়ে উঠেছে এক বিস্তৃত সাংস্কৃতিক আন্দোলন। ম্যাজিক রিয়ালিজম-এর এই বৌদ্ধিক যাত্রার সূচনা যে এত গভীর ও বহুমাত্রিক ছিল, তার চর্চা ও বিশ্লেষণ আজকের দিনে আরও বেশি জরুরি, কারণ এই ধারাই আমাদের শেখায় কিভাবে বাস্তবতার গহীনে নেমে, সেই বাস্তবতাকেই নতুন আলোয় চিনে নিতে হয়।

জাদুবাস্তবতা—এই শব্দটি কেবল একটি সাহিত্যিক কল্পনার ভঙ্গিমা নয়, বরং তা আধুনিক বিশ্বের অস্থির রাজনীতি, সাংস্কৃতিক সংকট ও আত্মসন্ধানী শিল্পচেতনার এক জটিল বহিঃপ্রকাশ। ফ্রাঞ্জ রো যখন ১৯২৫ সালে জার্মান চিত্রকলার পরিসরে “Magischer Realismus” ধারণাটি উদ্ভাবন করেন, তখন হয়তো তিনিও বুঝতে পারেননি যে, তাঁর এই শৈল্পিক প্রস্তাব একদিন ছাড়িয়ে যাবে ইউরোপীয় শিল্পভুবনের গণ্ডি, আর প্রবাহিত হবে লাতিন আমেরিকার বিস্ময়কর মাটিতে, তৈরি করবে এক অনন্য সাহিত্য আন্দোলন, যার রূপ হবে বহুমাত্রিক, এবং যার হৃদয় হবে এক অলৌকিক বাস্তবতা।

ম্যাজিক রিয়ালিজম-এর এই প্রারম্ভিক রূপটি কেবল জার্মানিতেই আবদ্ধ ছিল না, বরং রো’র প্রভাব পরবর্তীকালে ইউরোপের বিভিন্ন শিল্পনগরে ছড়িয়ে পড়ে—বিশেষত ফ্রান্স, হল্যান্ড, ইতালি, এমনকি আমেরিকাতেও। চিত্রকলার এই তাত্ত্বিক সংজ্ঞা ধীরে ধীরে সাহিত্যের ভাষা খুঁজে পেতে শুরু করে। এই সংক্রমণের সূচনালগ্নে একজন গুরুত্বপূর্ণ নাম হলেন ইতালিয়ান লেখক মসিমো বোনটেমপেল্লি (Massimo Bontempelli : 1878–1960)। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী ইউরোপ তখন চরম রাজনৈতিক সংকটে, ইতালির মাটিতে মুসোলিনির ফ্যাসিবাদী শাসন এক বিষাক্ত বাস্তবতার জন্ম দিয়েছে। এই পরিস্থিতি থেকেই জন্ম নেয় শিল্পীদের গভীর অভ্যন্তরীণ প্রতিক্রিয়া। বোনটেমপেল্লি সেই প্রতিক্রিয়ার সাহিত্যিক প্রকাশ ঘটান রো’র প্রভাবিত ধারায়।

তিনি ফ্রাঞ্জ রো-র রহস্যময় অথচ যুক্তিসিদ্ধ চিত্রচিন্তার ছাঁচে তাঁর সাহিত্যিক কল্পনাকে নির্মাণ করেন। ১৯২৬ সালে প্রকাশিত ‘Novecento’ ছিল সেই প্রয়াসের একটি স্বাক্ষর। এখানে তিনি বাস্তব জগৎকে উপস্থাপন করেন এমন এক আখ্যানধারায়, যেখানে চেনা বাস্তবতায় ঢুকে পড়ে অলৌকিক সম্ভাবনা, যেখানে একটি সাধারণ ঘটনাও পায় এক চমকপ্রদ রূপান্তর। ফ্যাসিবাদী শাসনের দমনমূলক বাস্তবতার প্রেক্ষিতে এই অলৌকিকতার সংমিশ্রণ যেন একটি কৌশল হয়ে দাঁড়ায়, যার মাধ্যমে দমন করা বাস্তবতাকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দেওয়া যায়। বোনটেমপেল্লির এই সাহিত্যিক মেজাজকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে রবার্ট ডোমব্রস্কি তাঁকে বলেছেন “the first magic realist creative writers”। কারণ, তিনিই সম্ভবত প্রথম ব্যক্তি যিনি রো-র চিত্রতাত্ত্বিক চেতনার সাহিত্যিক রূপায়ণ ঘটান।

ফ্রাঞ্জ রো-র ম্যাজিক রিয়ালিজম-এর আরেক গুরুত্বপূর্ণ বিস্তার দেখা যায় লাতিন আমেরিকায়। ঘটনাটি ঘটে যখন ১৯২৭ সালে রো-এর প্রবন্ধটি স্প্যানিশ ভাষায় অনূদিত হয়ে ইউরোপ ছেড়ে প্রবেশ করে লাতিন বিশ্বে। এই অনুবাদ ফ্রান্সের মাদ্রিদ থেকে হলেও, তার অভিঘাত পড়ে বহু দূর—বিশেষত আর্জেন্টিনার হোর্হে লুইস বোর্হেস, কিউবার আলেহো কার্পেন্তিয়ের, গুয়াতেমালার মিগেল আনহেল আস্তুরিয়াস এবং ভেনেজুয়েলার আর্তুরো উসলার পেত্রির মত প্রতিভাদের উপর।

বোর্হেস ও পেত্রি এই নতুন বাস্তবচিন্তার মধ্যে পেলেন এক অভিনব সাহিত্যদৃষ্টি। তাঁদের সাহিত্য, বিশেষত বোর্হেসের ছোটগল্প, এমন এক বাস্তবতায় নির্মিত, যেখানে দর্শন, ইতিহাস, কল্পনা ও বুদ্ধির জটিল খেলা চলে অবলীলায়। অথচ এই রহস্যময়তা রো’র সেই রহস্যঘন চিত্রজগতের সঙ্গে এক অলিখিত আত্মীয়তায় বাঁধা। তবে আলেহো কার্পেন্তিয়েরের ক্ষেত্রটি ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। তিনি ইউরোপ থেকে দেশে ফিরে হাইতির বিস্ময়কর, কুহক-ঘেরা পরিবেশে এসে প্রত্যক্ষ করেন এমন এক বাস্তবতা, যা ছিল ইউরোপের চেনা বাস্তবতার একেবারেই বিপরীত।

এই হাইতিয় বাস্তবতা থেকেই তিনি উপলব্ধি করেন যে, ইউরোপে যা ‘ম্যাজিক’, লাতিন আমেরিকায় তা বাস্তবেরই অংশ। ১৯৪৯ সালে লেখা প্রবন্ধ “On the Marvelous Real in America” তাঁর এই উপলব্ধিরই শিল্পতাত্ত্বিক ঘোষণা। তিনি লিখলেন,

“the virginity of the land, our upbringing, our ontology, the Faustain presence of the Indian and the black Men, the revelation constituted by its recent discovery, its fecund racial mixing [mestizaje], America is far from using up its wealth of mythologies. After all, what is the entire history of America if not a chronicle of the marvelous real?” (Carpentier, 1995, P. 88)।

এই বক্তব্যে একদিকে যেমন রয়েছে ইউরোপীয় আধিপত্যবাদী তত্ত্বের বিরুদ্ধে অবস্থান, অন্যদিকে আবার ধরা পড়ছে লাতিন আমেরিকার বহুস্বরিক সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের প্রতি তাঁর গভীর শ্রদ্ধা। এই বিশ্বাস নিয়েই তিনি লেখেন উপন্যাস The Kingdom of This World (১৯৪৯)। হাইতির প্রেক্ষাপটে নির্মিত এই উপন্যাসে একদিকে ইতিহাস, অন্যদিকে ভৌতিকতা, অনুভূতি ও কিংবদন্তি মিলেমিশে তৈরি করে এক অভিনব বয়ান। তিনি নিজেকে সরিয়ে নেন রো-র শিল্পতত্ত্ব থেকে, এবং তাঁর ‘marvelous real’ ধারণাকে প্রতিষ্ঠা করেন “the heritage of all of America” হিসেবে।

এই ‘marvelous real’ ধারণাটিকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সমালোচক লোইস পারকিনসন জামোরা বলেন,

“improbable juxtapositions and marvelous mixtures exist by virtue of Latin American’s varied history, geography, demography, and polities—not by Manifesto.” (Zamora & Faris, 1995, P. 75)।

অর্থাৎ, লাতিন আমেরিকার বিস্ময়কর বাস্তবতা কেবল একটি সাহিত্যিক রীতি নয়, বরং তা এই অঞ্চলটির বহুবিচিত্র ইতিহাস ও সংস্কৃতির অন্তঃসলিলা ধারারই বহিঃপ্রকাশ।

একইরকম উপলব্ধি হয়েছিল মিগেল আনহেল আস্তুরিয়াসের মধ্যেও। ফ্রান্সে পড়াশোনা করতে গিয়ে তিনিও প্রত্যক্ষ করেন ইউরোপীয় সাহিত্যধারার সীমাবদ্ধতা এবং বুঝে ওঠেন, লাতিন আমেরিকার স্বতন্ত্র কল্পনাবিশ্বের গুরুত্ব। সেই উপলব্ধি থেকেই ১৯৩০ সালে তিনি প্রকাশ করেন তাঁর কল্পিত কিংবদন্তিনির্ভর গল্প সংকলন Legends of Guatemala—যেখানে দেশীয় লোককথা, মিথ ও বাস্তবতা এক অপূর্ব মিশেলে উঠে আসে। পরবর্তীকালে তিনি লেখেন রাজনৈতিক উপন্যাস The President (১৯৪৬), যেখানে গুয়াতেমালার স্বৈরাচারী শাসকের বাস্তবতাকে তিনি রূপান্তর করেন প্রতীকময় ভাষায়।

তবে আস্তুরিয়াসের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ অবদান সম্ভবত Men of Maize (১৯৪৯)। এই উপন্যাসে তিনি শুধু একটি কাহিনি নয়, তুলে ধরেন এক জাতির স্বপ্ন, বিশ্বাস ও সাংস্কৃতিক শিকড়। মায়া সভ্যতার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে আশ্রয় করে তিনি এক নতুন জাদুবাস্তব আখ্যান নির্মাণ করেন, যেখানে দুর্দশাগ্রস্ত মানুষদের মুখে ফিরে আসে আশার কণ্ঠস্বর।

এইভাবে, ১৯৪৯ সাল হয়ে ওঠে এক মাইলফলক—যেদিন আলেহো কার্পেন্তিয়ের ও মিগেল আনহেল আস্তুরিয়াসের সাহিত্যিক প্রচেষ্টায় লাতিন আমেরিকার ম্যাজিক রিয়ালিজম নতুন রূপ লাভ করে। এই রূপ কোনও ইউরোপীয় তত্ত্বের অনুসরণ নয়, বরং নিজস্ব মাটি, নিজস্ব ইতিহাস ও নিজস্ব চেতনার প্রতিফলন।

ম্যাজিক রিয়ালিজম থেকে সাহিত্য আন্দোলন: এক সাহিত্যিক অভিযাত্রা
চিত্রঃ মিগেল আনহেল আস্তুরিয়াস, Image Source: Wikimedia

এই কারণেই অনেক গবেষক মনে করেন, উপন্যাসের ক্ষেত্রে ম্যাজিক রিয়ালিজম-এর জন্মলগ্ন আসলে লাতিন আমেরিকায়। কিন্তু এই বক্তব্য আংশিক সত্য। কারণ, যদিও উপন্যাসে এই ধারার প্রয়োগ ও বিস্তার ঘটে লাতিন আমেরিকায়, তবে এর তাত্ত্বিক ভিত্তি, শব্দবন্ধের উদ্ভব, এবং প্রাথমিক অভিপ্রায় রচিত হয়েছিল ইউরোপের শিল্পজগতে—ফ্রাঞ্জ রো’র মাধ্যমে।

এই ঐতিহাসিক বাস্তবতা স্মরণ করেই বলা যায়, লাতিন আমেরিকার সাহিত্য জগতে জাদুবাস্তবতা এক প্রবল দানা বাঁধে, কিন্তু তার চিন্তানির্ভর আন্দোলনের শিকড় পড়ে জার্মান শিল্প ও মনোভূমিতে। এইভাবে ম্যাজিক রিয়ালিজম আমাদের সামনে এক অনন্য সাহিত্যিক ঐতিহ্য খুলে দেয়—যা স্থান, কাল, সংস্কৃতি ও রাজনীতির ধারাবাহিক পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে এক নতুন বাস্তবতাকে তুলে ধরতে পারে।

জাদুবাস্তবতার এই ধারাটি পরে গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস, সালমান রুশদি, টোনি মরিসন, বেঞ্জামিনু বোটো, হর্ষা ভগতদের মতো লেখকদের হাত ধরে আরও অনেক দেশে বিস্তৃত হয়েছে। কিন্তু তার মূল চালিকাশক্তি থেকে যায় এই প্রাথমিক দশকে রচিত ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক যাত্রার মধ্যেই—যেখানে বাস্তবতা আর কেবল একটি ‘দৃষ্ট’ নয়, বরং একটি ‘অনুভূত চেতনা’। ম্যাজিক রিয়ালিজম সেই চেতনাকে আমাদের মধ্যে জাগিয়ে তোলে, যেখানে ইতিহাস, স্বপ্ন, প্রতিরোধ, সংস্কৃতি ও কল্পনা মিলেমিশে গড়ে তোলে সাহিত্যের এক অনন্য আধুনিকতা।

জাদুবাস্তবতা নিয়ে আলোচনা দীর্ঘ হলে তার যাত্রাপথে কিছু বিতর্ক জন্ম নেবে, এ তো স্বাভাবিক। কিন্তু বিস্ময়কর এই যে, ফ্রাঞ্জ রো-র ‘Magischer Realismus’ থেকে শুরু হওয়া ধারণাটি যখন লাতিন আমেরিকার মাটিতে একটি অনন্য সাহিত্যবোধে রূপান্তরিত হলো—সেটির প্রকৃত পথিকৃত কে, তা নিয়েই শুরু হলো তীব্র মতপার্থক্য। আমাদের আগের আলোচনায় যেমন আলেহো কার্পেন্তিয়ের ও মিগেল আনহেল আস্তুরিয়াসকে এই আন্দোলনের মূল পথপ্রদর্শক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল, ঠিক তেমনি কিছু বিদ্বান গবেষক এই সূত্রটিকে অন্যদিকে টেনে নিতে চাইলেন। কার্পেন্তিয়ের-আস্তুরিয়াসের আগে আলোচনায় উঠে এলেন ভেনেজুয়েলার আর্তুরো উসলার পেত্রি ও আর্জেন্টিনার হোর্হে লুইস বোর্হেস।

এই বিতর্কের প্রাথমিক সূত্রপাত ঘটে সমালোচক মারিয়া এলেনা আগুলো-র একটি বই থেকে। ১৯৯৫ সালে প্রকাশিত তাঁর গবেষণামূলক গ্রন্থ Magic Realism: Social Context and Discourse (Garland, New York) -এ তিনি দাবি করেন, পেত্রি-ই আসলে প্রথম লাতিন লেখক যিনি জাদুবাস্তবতাকে সাহিত্যের পরিসরে নিয়ে আসেন। তাঁর বক্তব্য অনুযায়ী, প্যারিসে লেখাপড়া করার সময় পেত্রি ফ্রাঞ্জ রো-র প্রবন্ধ পাঠ করেন এবং দেশে ফিরে ১৯৩০-এর দশকে বেশ কিছু ছোটগল্প রচনা করেন যেগুলোতে রো-র চিত্রশৈলীর ধারা স্পষ্ট। এই গল্পগুলো স্প্যানিশ ভাষাভাষী দেশগুলোর পাঠকের কাছে পরিচিতি পায় এবং একটি নতুন আঙ্গিক হিসেবে গৃহীত হয়।

তবে, এই বক্তব্যের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ অসংগতির ইঙ্গিত পাওয়া যায়। মারিয়া এলেনা আগুলো নিজেই স্বীকার করেন যে, পেত্রি রো-র তত্ত্বে প্রভাবিত হয়েই লিখছিলেন। অর্থাৎ, তাঁর সাহিত্যিক কল্পনার জন্ম ইউরোপীয় তাত্ত্বিক কাঠামোর ভিতরেই। এই নির্ভরশীলতা জাদুবাস্তবতার সেই দেশজ ধারার বিপরীত, যা কার্পেন্তিয়ের-আস্তুরিয়াসের লেখায় স্বাভাবিক ও অভ্যন্তরীণভাবে বিকশিত হয়েছিল। কারণ, তাঁদের লেখা কেবল রো-র চিন্তার প্রতিফলন ছিল না; বরং তা ছিল লাতিন আমেরিকার ভূগোল, ইতিহাস, জাতিগত বৈচিত্র্য ও সাংস্কৃতিক পরম্পরার এক রূপান্তরিত শিল্পপ্রকাশ।

তবু এই আলোচনা তাত্ত্বিকভাবে জোর পায় ১৯৫৫ সালে অ্যাঞ্জেল ফ্লোরেসের লেখা প্রবন্ধ “Magical Realism in Spanish American Fiction”-এর মাধ্যমে। এই প্রবন্ধটি একাধিক কারণে বিতর্কের জন্ম দেয়। প্রথমত, তিনি ‘Magic Realism’ ও ‘Marvelous Realism’-কে একটি সমার্থক পরিভাষা হিসেবে গুলিয়ে ফেলেন। দ্বিতীয়ত, তিনি কার্পেন্তিয়েরকে একেবারে উপেক্ষা করে বোর্হেসকে ম্যাজিক রিয়ালিজম-এর প্রথম প্রণেতা হিসেবে ঘোষণা করেন। তাঁর দৃষ্টিতে, হোর্হে লুইস বোর্হেসের ১৯৩৫ সালের সংকলন A Universal History of Infamy (Historia Universal de la Infamia) হচ্ছে লাতিন সাহিত্যে জাদুবাস্তবতার প্রাথমিক নিদর্শন।

এই বিশ্লেষণে দুটি মারাত্মক ত্রুটি রয়েছে। এক. রো-র চিত্রভিত্তিক ‘Magic Realism’ এবং কার্পেন্তিয়েরের সাংস্কৃতিক ভিত্তিক ‘Marvelous Realism’ এই দুই শৈলী যেমন তাত্ত্বিকভাবে ভিন্ন, তেমনি তাদের শিল্পপ্রয়াস ও বাস্তবতা অনুধাবনের দৃষ্টিভঙ্গিও বিপরীতমুখী। এই বিভাজনটিকে স্পষ্ট করে বিশ্লেষণ করেছেন সমালোচক ম্যাজি অ্যান বাওয়ারস। তিনি লিখেছেন,

“whereby magic realism is related to art forms reaching for a new clarity of reality, and marvellous realism refers to a concept representing the mixture of differing world views and approaches to what continuous reality.” (Bowers, 2004, P. 14–15)

ফ্লোরেসের দ্বিতীয় ত্রুটি হলো, বোর্হেসকে জাদুবাস্তবতার একমাত্র প্রবর্তক হিসেবে তুলে ধরা। নিঃসন্দেহে বোর্হেস আধুনিক সাহিত্যের আঙ্গিক নিয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। তাঁর ‘Ultraismo’ আন্দোলন, বা সাহিত্যে দর্শন, গণিত, অচেনা জ্ঞানতত্ত্বের সংমিশ্রণ তাঁকে সাহিত্য-প্রকল্পে আলাদা উচ্চতা দিয়েছে। কিন্তু তবু তাঁর সাহিত্যিক চেতনা মূলত একটি অভিজাত পাঠকদের উদ্দেশে, যেখানে চেতনাগত নির্মাণ বড়, আর দেশজ বাস্তবতার প্রতিচ্ছায়া অপেক্ষাকৃত কম। বোর্হেসের গল্পে বিস্ময় থাকলেও তা সমাজ ও ইতিহাসের বিস্ময়ে গাঁথা নয়; বরং তা এক দার্শনিক অনিশ্চয়তা, এক চিন্তাতাত্ত্বিক খেলা। তিনি নিজেই একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন,

“I am not interested in reality as a matter of mere description. My stories are more about dreams, concepts, paradoxes.”

অন্যদিকে, কার্পেন্তিয়ের ও আস্তুরিয়াসের রচনাশৈলী সেই বিস্ময়কর বাস্তবতাকে ধারণ করে, যা সমাজের প্রান্তিক মানুষের ইতিহাস, তাদের দুঃখ, বিশ্বাস, সংস্কৃতি, উপনিবেশবিরোধী স্বপ্ন ও মিথলজির সঙ্গে গাঁথা। তাঁদের আখ্যানভুবন তাই বোর্হেসের তুলনায় অনেক বেশি বাস্তব, মানবিক এবং জাতিসত্তাভিত্তিক।

ফ্লোরেস আরও একটি বিতর্কিত বক্তব্য রেখেছিলেন। তিনি দাবি করেন, ম্যাজিক রিয়ালিজম-এর উৎস নিহিত আছে ষোড়শ শতাব্দীর স্প্যানিশ সাহিত্যিক সেরভান্তেসের ‘Don Quixote’ উপন্যাসে। তাঁর মতে, সেই কল্পনা ও বাস্তবতার দোলাচল, যা কিহোতের আচরণে প্রতিফলিত, তা-ই পরে ম্যাজিক রিয়ালিজম-এর আদি রূপ। এ ছাড়া তিনি আরও বলেন, এই ধারার সাহিত্যিক প্রভাব পড়েছে বিংশ শতকের ফ্রান্ৎস কাফকা ও চিত্রশিল্পী জর্জিও দ্য কিরিকোর উপর।

এই যুক্তি যেন এক ধারাবাহিক ইতিহাস গঠনের প্রচেষ্টা, যেখানে জাদুবাস্তবতার শিকড় খোঁজা হচ্ছে ইউরোপীয় আধিপত্যবাদী ঐতিহ্যে। অথচ এই সমান্তরাল ধরনকে আমরা অস্বীকার করি না ঠিকই, কিন্তু স্বীকার করতে নারাজ যে জাদুবাস্তবতা কেবলমাত্র ইউরোপীয় চিন্তাধারার উত্তরসূরি। বরং বলা যায়, ইউরোপীয় আধুনিকতার সঙ্গে সংঘর্ষে, উপনিবেশিক বাস্তবতার প্রতিক্রিয়ায়, এবং দেশজ ঐতিহ্য ও আধ্যাত্মিক চেতনার সম্মিলনে একটি বিকল্প আধুনিকতা গঠনের লক্ষ্যে লাতিন আমেরিকার জাদুবাস্তবতা জন্ম নেয়।

এই বিকল্প আধুনিকতা ক্রমে আরও বিস্তার লাভ করে। কার্পেন্তিয়ের-আস্তুরিয়াসের পথ ধরে মেক্সিকোর হুয়ান রুলফো, কার্লোস ফুয়েন্তেস, আর্জেন্টিনার মানুয়েল পুইগ, হুলিও কোর্তাসার, পেরুর মারিও ভার্গাস য়োসা, কলম্বিয়ার গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস, চিলির আন্তোনিও স্কারমেতা, ইসাবেল অ্যালেন্দে প্রমুখের লেখায় এই জাদুবাস্তবতা এক বহুমাত্রিক বাস্তবতার কাহিনিতে রূপান্তরিত হয়। মার্কেসের One Hundred Years of Solitude (১৯৬৭) কিংবা ইসাবেল অ্যালেন্দের The House of the Spirits (১৯৮২)—এই সমস্ত রচনাগুলো হয়ে ওঠে আন্তর্জাতিক সাহিত্য-জগতে লাতিন আমেরিকার আত্মনির্ভর আত্মপ্রকাশের ধ্বনি।

লাতিন আমেরিকান সাহিত্যিকদের এই কণ্ঠস্বর ছিল স্বতন্ত্র, তাদের লক্ষ্য ছিল প্রতিরোধের ভাষা খোঁজা। এই প্রতিরোধ শুধু রাজনৈতিক নয়, সাংস্কৃতিক এবং আধ্যাত্মিকও। ইউরোপীয় আধুনিকতার সেই একমাত্রিক যুক্তিবাদকে অস্বীকার করে তাঁরা বললেন—বিস্ময়ই আমাদের বাস্তবতা, মিথই আমাদের ইতিহাস, লুপ্ত ঐতিহ্যই আমাদের ভবিষ্যৎ।

ফলে, ফ্লোরেস বা আগুলোদের বিশ্লেষণ যেমন তাত্ত্বিকভাবে অসংলগ্ন, তেমনি একটি বৃহৎ সাংস্কৃতিক আন্দোলনের আদি মর্মবোধকে আড়াল করে দেয়। জাদুবাস্তবতা একটি ‘ইন্দ্রজাল’ নয়, বরং বাস্তবতার এক তীব্র জীবনসংলগ্ন রূপান্তর। ফ্রাঞ্জ রো-এর ইউরোপীয় চিত্রতত্ত্ব এখানে রয়ে যায় প্রেরণার স্তরে, আর লাতিন আমেরিকার বর্ণময় ভূগোল, মিথ, প্রতিরোধ, উপনিবেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতি—এই সবকিছুর সমন্বয়ে গড়ে ওঠে তার পূর্ণ বিকাশ। সে বিকাশ কেবলমাত্র এক অঞ্চলের সাহিত্য নয়, তা এক আধুনিক বিশ্ব-সাহিত্যিক পরিসরের জন্ম দেয়।

এই কারণেই ম্যাজিক রিয়ালিজম আজ একটি ভৌগোলিক ধারণা নয়, বরং একটি অভ্যন্তরীণ দৃষ্টিভঙ্গি—যা প্রথা, বলয় ও যুক্তির সীমার বাইরে গিয়ে বাস্তবতাকে অন্বেষণ করে বিস্ময়ের দৃষ্টিতে। আর এই দৃষ্টির ভিত্তি শুধু বোর্হেস বা পেত্রির মধ্যে নয়, বরং কার্পেন্তিয়ের, আস্তুরিয়াস, মার্কেসদের মধ্যেই নিহিত। যাঁরা আমাদের শিখিয়েছেন—বাস্তবতা কখনও কেবল দেখা যায় না, অনেক সময় তা অনুভব করা যায় কল্পনার চোখ দিয়ে।

দুই

অসংখ্য সাহিত্য ও শিল্পতাত্ত্বিক বিতর্কের মধ্যেও যেসব তত্ত্ব বা প্রবণতা প্রাসঙ্গিকতা হারায় না, ‘ম্যাজিক রিয়ালিজম’ বা ‘জাদুবাস্তবতা’ তাদেরই অন্যতম। বিংশ শতকের অন্যতম আলোচিত ও প্রভাবশালী ধারাগুলোর একটি হিসেবেই নয়, সাহিত্যিক, চিত্রশিল্প-ভিত্তিক এবং দর্শনসংলগ্ন পরিসরেও এই তত্ত্ব বিস্ময় ও ব্যতিক্রমের দাগ রেখে গেছে। তারই পরিণামে একে কোনো একক সংজ্ঞায় বা সোজাসাপ্টা তাত্ত্বিক গণ্ডিতে আবদ্ধ করা দুরূহ—এ কথা একাধিক সমালোচক ও গবেষক অকপটে স্বীকার করেছেন। কারণ, এটি একাধারে সাহিত্যিক আঙ্গিক, চিত্রকলার অনুষঙ্গ, রাজনৈতিক বাস্তবতা থেকে নির্গত একটি দৃষ্টিভঙ্গি, আবার একই সঙ্গে সাংস্কৃতিক বিদ্রোহেরও ভাষা।

এই বহুমাত্রিকতার জন্যই ম্যাজিক রিয়ালিজম নিয়ে তাত্ত্বিক জিজ্ঞাসা নানা দিক থেকে উঠে এসেছে। সমালোচক ক্রিস্টোফার ওয়ার্নস যখন লিখেছেন,

“A fundamental question concerns the type of category that is constituted by magical realism. Is magical realism simply a mode of narration that may be sporadically engaged by an author; is it a literary movement with a specific agenda and defined geographical and cultural boundaries; or is it a genre of fiction that can be compared across continents and languages?” (Christopher Warnes, Magical Realism and the Post Colonial Novel, Palgrave Macmillan, 2009, P. 2) 

তখন তিনি কেবল এক প্রশ্নই রাখেননি, বরং তার মধ্য দিয়ে এই তত্ত্বের অস্থিরতা ও পরিধির অসীমতা বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। এই প্রশ্নের অনুরণন আমরা পাই ব্রেন্ডা কুপারের বয়ানেও, যেখানে তিনি বলেন,

“magical realism is a mode, a genre, style, a politics?” (Brenda Cooper, Magical realism in West African Fiction: Seeing With a Third Eye, Routledge, 1998, P. 15)

তাত্ত্বিকভাবে এইসব প্রশ্ন একদিকে যেমন ম্যাজিক রিয়ালিজমের মৌল সংজ্ঞা নির্ধারণে সহায়, অন্যদিকে পাঠকের মনে তৈরি করে দ্বিধা—আসলে এই শৈলীটা কী? সাহিত্যিক ভাষায় একে আমরা কি শুধু একটি শৈলী বা আঙ্গিক বলব, নাকি একটি রাজনৈতিক অবস্থান? একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ড থেকে উঠে আসা সাহিত্যিক ঐতিহ্য? নাকি এটি হয়ে উঠেছে এমন এক ‘মোড’ বা ‘ধারা’—যা সময়-পরিস্থিতি ভেদে নানা রূপে আত্মপ্রকাশ করে?

সাহিত্যচর্চায় আমরা সাধারণত যেভাবে নানা সাহিত্যধারা পর্যালোচনা করি—রিয়ালিজম, ন্যাচারালিজম, সিম্বলিজম, সুররিয়ালিজম, সাইকোলজিক্যাল রিয়ালিজম, সোসালিস্ট রিয়ালিজম—তাদের প্রত্যেকটি কোনো না কোনো সময় ‘আন্দোলন’ বা Movement হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। তার একটি প্রেক্ষাপট ছিল, একটি দার্শনিক দর্শন ছিল, একটি দৃষ্টিভঙ্গির বুনোট ছিল যা ওই ধারার ভেতরে একরকম ঐক্য সৃষ্টি করেছিল। ম্যাজিক রিয়ালিজমকে যদি আমরা সেই একই কাঠামোয় ফেলি, তবে এটিও নিঃসন্দেহে একটি সাহিত্য আন্দোলন—যা স্বতন্ত্র এক সময়চেতনার প্রকাশ এবং বাস্তবতা অনুধাবনের ভিন্ন এক রূপ।

তবে বিষয়টি এখানেই সীমাবদ্ধ নয়। ‘The Oxford Dictionary of Literary Terms’ (2008 সংস্করণ) ম্যাজিক রিয়ালিজমকে অভিহিত করছে “a kind of modern fiction” হিসেবে। অন্যদিকে, J.A. Cuddon তাঁর ‘The Penguin Dictionary of Literary Terms and Literary Theory’ গ্রন্থে একে বলেন “forms of fiction”, “a kind of fiction” (1999, P. 488)। এইসব ব্যাখ্যার মধ্যে কোনো ভ্রান্তি নেই, বরং এখানেই লুকিয়ে আছে ম্যাজিক রিয়ালিজমের স্বরূপ: এটি একাধারে সাহিত্যিক আখ্যানের এক রূপ, আবার তাত্ত্বিক ও দার্শনিক অবস্থানেরও রূপায়ণ।

এই অনির্ধারিত অথচ বহুপারস্পরিক ব্যাখ্যা-সম্ভবতাই ম্যাজিক রিয়ালিজমকে কেবল ‘আঙ্গিক’ বা ‘ঘরানা’ বলার থেকে বিরত রাখে। বরং এইসব ব্যাখ্যাই আমাদের সামনে তুলে ধরে যে, এটি একধরনের narrative strategy, যা সময়বিশেষে ভাষার রীতিকে বাঁকিয়ে দেয়, বাস্তবতাকে প্রশ্ন করে, আবার জাদুর ভেতরেই বাস্তবের গভীর সত্যকে তুলে ধরে। লোইস পারকিনসন জামোরা যেমন এক জায়গায় কখনো একে ‘mode’, কখনো ‘fictional form’, আবার কখনো ‘literary genre’ বলেছেন, তেমনি সমালোচক ফ্রেডরিক জেমসন একে বলেছেন “a kind of narrative”—যার মধ্যে রয়েছে একাধারে ইতিহাস, প্রতীক, সমাজবাস্তবতা এবং বৈষম্যের বিরুদ্ধে কল্পনাপ্রসূত প্রতিরোধ।

ম্যাজিক রিয়ালিজম মূলত যে দেশগুলো থেকে উঠে এসেছে—লাতিন আমেরিকা, আফ্রিকা, দক্ষিণ এশিয়া—সেইসব পরাধীন ও উত্তর-ঔপনিবেশিক অঞ্চলের ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতা একে ব্যতিক্রমী করে তুলেছে। তাই একে কেবল ‘fictional form’ বা ‘genre’ বললে এর ঐতিহাসিক ও দার্শনিক বিস্তৃতি অবগাহন করা সম্ভব নয়। তার চেয়ে বরং এটি যে একটি movement, তা বলাই অধিক যথাযথ। কেননা এর শিকড় কেবল সাহিত্যচর্চায় নয়, বরং সমগ্র মানবিক আত্মপ্রতিষ্ঠার ভাষায়। আধুনিকতার যে ইউরোপকেন্দ্রিক ইতিহাস মানুষকে ‘বাস্তবতা’র নামে এক রৈখিক, বৈজ্ঞানিক ও বস্তুবাদী বয়ানে অভ্যস্ত করিয়ে তোলে, জাদুবাস্তবতা সেই ধারণাকে খণ্ডন করে। বাস্তবতা এখানে শুধুমাত্র যুক্তির নয়, বরং তা অনুভূতির, স্মৃতির, স্বপ্নের, বিশ্বাসের, কল্পনার—এই সবকিছুর সম্মিলনে গঠিত এক বৃহৎ বাস্তবের উপস্থাপনা।

এই বাস্তবতাকে তুলে ধরতে যে আখ্যানবিন্যাস ব্যবহৃত হয়, সেটাই মূলত ‘narrative mode’ হিসেবে কাজ করে। এখানে গল্প বলতে কোনো বিচ্ছিন্ন অলৌকিকতা নয়, বরং এমন এক দৃষ্টিভঙ্গি, যা আপাত স্বাভাবিক ঘটনাকেও এক প্রকার অসামান্যতা দিয়ে উদ্ভাসিত করে। তাই সমালোচক ম্যাজি অ্যান বাওয়ারস যথার্থই বলেন, এটি “a particular narrative mode”।

এই কথাগুলো মাথায় রেখেই আমরা বলতে পারি, ম্যাজিক রিয়ালিজম একটি বহুস্বরবিশিষ্ট, বহুস্তরীয় সাহিত্যিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলন। তার একটি দিক যেমন আখ্যানচর্চার কৌশল, তেমনি অন্য দিক রাজনৈতিক—এটি এক ধরনের ভাষা, যা দমন-পীড়ন, দারিদ্র্য, ঔপনিবেশিক নির্মাণ ও জাতিসত্তার উপর আরোপিত বিকারগুলোর বিরুদ্ধে আত্মপক্ষের কাহিনি বলে। এখানে ‘ম্যাজিক’ কোনো হ্যারি পটারধর্মী কল্পিত জাদু নয়, বরং জীবনঘনিষ্ঠ অভিজ্ঞতার সেই রহস্যময় উপলব্ধি, যা কোনো যুক্তিবাদের সঙ্গে পুরোপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, অথচ গভীরভাবে বাস্তব।

একদিকে যদি ইউরোপীয় ‘realism’ বাস্তবতার নিরপেক্ষ ও বস্তুগত উপস্থাপনায় মনোনিবেশ করে, অন্যদিকে ম্যাজিক রিয়ালিজম সেই বাস্তবতার গভীরে থাকা অস্পষ্টতা, বিস্ময়, প্রতীক এবং অতীতের ধ্বংসাবশেষের মধ্য থেকে উঠে আসা অর্থগুলিকে উদ্ঘাটন করে। এই দ্বৈত দৃষ্টিভঙ্গি তাকে অতুলনীয় করে তোলে।

তবে জাদুবাস্তবতা কেবল উপন্যাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকেছে এমনটা নয়। চলচ্চিত্র, নাটক, ছোটগল্প এমনকি কবিতায়ও তার প্রভাব সুগভীর। পেড্রো আলমোডোভার, গিলের্মো দেল তোরো, কিংবা দক্ষিণ আমেরিকার চলচ্চিত্রে এর প্রভাব সুস্পষ্ট। ভারতেও গিরীশ কর্নাড, সত্যজিৎ রায়, বিজয়ানন্দ গুহঠাকুরতা প্রমুখের কাজে এই শৈলীর নিরীক্ষা পাওয়া যায়।

এই প্রসঙ্গে মনে রাখা দরকার, ‘ম্যাজিক রিয়ালিজম’ আজ কোনো নির্দিষ্ট মহাদেশ বা ভাষার অভ্যন্তরে আবদ্ধ নেই। এটি হয়ে উঠেছে একটি আন্তঃসাংস্কৃতিক ‘ক্রসওভার মুভমেন্ট’। আফ্রিকান সাহিত্যিক চিনুয়া আচেবে, বেঞ্জামিন ওলিনা, নাইজেরিয়ার আমোস টুটোলা, ভারতীয় লেখক সালমান রুশদি বা অরুন্ধতী রায়ের লেখায় এই শৈলীর ব্যতিক্রমী প্রয়োগ লক্ষ্য করা যায়। ফলে এর অভিধাটি কেবল “genre” বা “form” বললে ভুল হবে। বরং এটি এক সাংস্কৃতিক রাজনীতি, এক প্রতিরোধশীল ন্যারেটিভ যা কাঠামোগত আধিপত্যের বিরুদ্ধে নিজস্বভাবে গড়ে তোলে অর্থের অবচেতন পরিসর।

শেষত, আমাদের বলতে হয়, ম্যাজিক রিয়ালিজম হচ্ছে এক ধরনের সৃজনশীল প্রতিবাদ—যা কল্পনার আশ্রয়ে বাস্তবতার গহিনতম সত্যকে অনাবৃত করে। সেই অর্থে এটি যেমন একটি ‘narrative mode’, তেমনি একটি জীবনদৃষ্টিও—যা বাস্তবকে শুধু যেভাবে আছে সেভাবে দেখে না, বরং যেভাবে হতে পারত বা এখনো হতে পারে, সেই সম্ভাবনার দরজাও খুলে দেয়। সুতরাং, যাঁরা ম্যাজিক রিয়ালিজমকে শুধুমাত্র একটি ঘরানাগত পরিভাষা হিসেবে দেখেন, তাঁরা এর বহুবর্ণতাকে পুরোপুরি আত্মস্থ করতে পারেন না। এটি একটি চলমান সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক অভিযাত্রা—যার শেষ নেই, গন্তব্য নেই—শুধু বিস্ময় আছে, গভীরতর সত্যের স্পর্শ আছে।

বিশ শতকের গোড়ায় যখন বিশ্বজুড়ে আধুনিকতা ও উন্নয়নের নামে ইউরোপকেন্দ্রিক আধিপত্যের বয়ান চূড়ান্ত রূপ নিতে শুরু করেছে, তখনই পৃথিবীর বিস্তীর্ণ অঞ্চল—বিশেষত লাতিন আমেরিকা, আফ্রিকা ও এশিয়া—এক ভিন্নধর্মী সাহিত্যিক এবং সাংস্কৃতিক প্রত্যাঘাতের ভাষা খুঁজছিল। এই প্রেক্ষাপটে ‘ম্যাজিক রিয়ালিজম’ বা জাদুবাস্তবতা কেবল একটি সাহিত্যিক আঙ্গিক নয়, বরং এক সাংস্কৃতিক প্রতিরোধের কৌশল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। যে বাস্তবতাকে ইউরোপীয় যুক্তিবাদ এবং রৈখিক ইতিহাসচেতনা চেনাতে অক্ষম, সেই জটিল, দুঃস্বপ্নময় ও সাংস্কৃতিকভাবে সংকর বাস্তবতাকে প্রকাশ করার জন্য প্রয়োজন হয়েছিল এমন একটি ধারার, যা কল্পনা, স্মৃতি, লোকবিশ্বাস ও রাজনৈতিক অভিজ্ঞতাকে একত্রে ধারণ করতে সক্ষম।

এই বাস্তবতা বোঝাতে গিয়ে ফ্রাঞ্জ রো যেমন বলেছিলেন, শিল্পী যখন বাস্তবকে কেবল দৃশ্যমান জগতে খুঁজে পায় না, তখন তাকে আশ্রয় নিতে হয় স্বপ্ন, কল্পনা ও স্মৃতির মধ্যে। জার্মানিতে ফ্যাসিবাদের উত্থান ও ইউরোপ জুড়ে গভীরতর সামাজিক-রাজনৈতিক সংকটের মধ্যে দিয়ে রো এমন একটি শৈলীর প্রস্তাব রাখলেন, যা বাস্তবের ভেতরেই জাদুর সঞ্চার ঘটায়। তবে তাঁর এই তত্ত্ব কেবল জার্মান শিল্পজগতে সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং রো-এর লেখনী ছড়িয়ে পড়ে ইতালি, ফ্রান্স, আমেরিকা হয়ে লাতিন আমেরিকায়। সেখানে এর সবচেয়ে বিস্ফোরক রূপ দেখা যায় সাহিত্যিক আলেহো কার্পেন্তিয়ের, আস্তুরিয়াস এবং পরবর্তীকালে গার্সিয়া মার্কেসদের হাতে।

কার্পেন্তিয়ের ফ্রাঞ্জ রো-কে পেছনে ফেলে নিয়ে এলেন এক নতুন তাত্ত্বিক পরিভাষা—‘Lo Real Maravilloso’ বা ‘Marvelous Real’। তাঁর ধারণায় জাদুবাস্তবতা ছিল লাতিন আমেরিকার দৈনন্দিন জীবনেরই অংশ, কোনো বাহ্যিক অলৌকিকতা নয়। তিনি দেখালেন, ইতিহাসের, পুরাণের, সংস্কৃতির এবং জাতিগত বৈচিত্র্যের যে সমাহার লাতিন আমেরিকায় ঘটেছে, তা এমন এক বাস্তবতা নির্মাণ করেছে, যা ইউরোপীয় যুক্তির সীমানায় বোঝা যায় না। বস্তুত যে বাস্তবতায় একসঙ্গে উপস্থিত আছে ইনকা-মায়া-আজটেক সভ্যতার প্রেতচ্ছায়া, আফ্রিকান দাসপ্রথার ভয়াবহ অভিজ্ঞতা এবং ঔপনিবেশিক শোষণের দীর্ঘ ক্ষতচিহ্ন, সেখানে অলৌকিক কোনো ব্যতিক্রম নয়, বরং অস্তিত্বের স্বাভাবিক এক অভিব্যক্তি।

কার্পেন্তিয়ের বলেছিলেন,

“the virginity of the land, our upbringing, our ontology, the Faustian presence of the Indian and the black Men…America is far from using up its wealth of mythologies.”

এই বক্তব্যে আমরা উপলব্ধি করতে পারি, তিনি ইউরোপীয় বাস্তবতার তুলনামূলক কাঠামোকে প্রত্যাখ্যান করে এমন এক সাহিত্যিক কণ্ঠ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন, যা তাদের নিজেদের বাস্তবতার ভাষায় কথা বলে। ফ্রাঞ্জ রো-এর ম্যাজিক রিয়ালিজম যেখানে একধরনের শিল্পিত বিস্ময়, সেখানে কার্পেন্তিয়েরের মারভেলাস রিয়েলিজম হয়ে ওঠে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অস্তিত্ব রক্ষার ভাষ্য।

কিন্তু প্রশ্ন ওঠে, বিশ শতকের শুরুতে কেন এমন একটি সাহিত্যিক ভাষার প্রয়োজন হলো?

এই প্রশ্নের উত্তর আমাদের খুঁজে নিতে হয় তৎকালীন রাজনৈতিক-সামাজিক প্রেক্ষাপটে। লাতিন আমেরিকায় একের পর এক স্বৈরশাসক এবং সামরিক একনায়করা দেশের রাজনৈতিক কাঠামোকে ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। মেক্সিকোর আন্তোনিও লোপেস, ইকুয়েডরের গাব্রিয়েল গার্সিয়া, এল সালভাদোরের মার্টিনেস কিংবা চিলি, উরুগুয়ের সেনাশাসকরা কেবল রাজনীতিকেই নয়, সমাজের সাংস্কৃতিক ও মানবিক ভিত্তিগুলোকেও বিপর্যস্ত করে তুলেছিলেন। লক্ষ লক্ষ মানুষ দেশান্তরী, শত শত লেখক ও বুদ্ধিজীবী বন্দি বা মৃত, লক্ষ লক্ষ শিশু অনাহারে অথবা সহিংসতায় মারা যাচ্ছে—এই ভয়াবহ বাস্তবতাকে চিত্রিত করার জন্য প্রয়োজন পড়ল এমন এক আখ্যানধারার, যা ঐতিহ্য, স্মৃতি, কল্পনা এবং প্রতিরোধকে একত্রে গাঁথতে পারে।

এইখানেই গার্সিয়া মার্কেসের বক্তব্য গভীর তাৎপর্যপূর্ণ। তাঁর নোবেল বক্তৃতায় তিনি বলেন,

“our crucial problem has been a lack of conventional means to render our lives believable.”

তাঁর মতে, ইউরোপীয় পরিমাপকাঠির মাধ্যমে লাতিন আমেরিকার বাস্তবতাকে ব্যাখ্যা করা যায় না, কারণ সেই বাস্তবতা নিজেই অভূতপূর্ব। তিনি আরও বলেন,

“The interpretation of our reality through patterns not our own, serves only to make us ever more unknown, ever less free, ever more solitary.”

এখানেই তিনি বুঝিয়ে দেন, এই সাহিত্যধারা ইউরোপের অনুকরণ নয়, বরং ইউরোপীয় আধিপত্যের বিরুদ্ধে এক সাংস্কৃতিক বিদ্রোহ।

তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে এই প্রয়োজনীয়তা আরও তীব্র হয়ে ওঠে। আফ্রিকা, ভারত, উপমহাদেশ কিংবা ক্যারিবীয় দ্বীপমালা—সবখানেই ছিল ঔপনিবেশিক নির্মাণ, শোষণ, দারিদ্র্য, জাতিগত বৈষম্য, ভাষা ও সংস্কৃতির পীড়ন। কিন্তু ইউরোপীয় সাহিত্য-আন্দোলনগুলো এই বাস্তবতাকে ধরতে পারেনি। তাদের কাঠামো ছিল যুক্তিবাদী, বস্তুবাদী এবং নিরাবেগ। অথচ এশিয়ার গ্রামীণ জীবনে, আফ্রিকার টোটেম-সংস্কৃতিতে, লাতিন আমেরিকার লোকবিশ্বাসে যেসব অলৌকিক উপকথা ও কিংবদন্তি মিশে ছিল—সেগুলো কোনোদিনও ইউরোপীয় আধুনিকতার চশমায় দেখা সম্ভব নয়। সেগুলোর ব্যাখ্যার জন্য চাই ছিল এমন এক ভাষা, যা প্রথাগত যুক্তিকে অতিক্রম করে অনুভবের জগতে পাঠককে টেনে নেয়।

গার্সিয়া মার্কেস যেমন বলেছিলেন, “a reality not of paper, but one that lives within us, and that nourishes a source of insatiable creativity”—সেই ধরনের বাস্তবতা রচনা করাই ছিল জাদুবাস্তবতার লক্ষ্য। এই ‘insatiable creativity’-ই ছিল তৃতীয় বিশ্বের জনগণের অস্তিত্বের হাতিয়ার। শোষণ ও নিপীড়নের বাইরে তাদের যেটুকু অবশিষ্ট ছিল, সেটাই ছিল তাদের ‘মিথ’, তাদের ‘লোকবিশ্বাস’, তাদের ভাষাহীন আকাঙ্ক্ষা, এবং এসবকেই রূপ দেওয়া সম্ভব হয়েছিল জাদুবাস্তবতার কাঠামোতে।

ম্যাজিক রিয়ালিজম থেকে সাহিত্য আন্দোলন: এক সাহিত্যিক অভিযাত্রা
চিত্রঃ গার্সিয়া মার্কেস, Image Source: ommons.wikimedia

জাদুবাস্তবতা কখনো কোনো শুদ্ধ সাহিত্যতাত্ত্বিক ফর্ম নয়। বরং এটি এক রাজনৈতিক ভাষ্য, যা দর্শনের ভাষায় নয়, কল্পনার ভাষায় প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ইউরোপীয় শুদ্ধতাবাদী সাহিত্যবোধ যেখানে অলৌকিকতাকে বর্জন করে, সেখানে জাদুবাস্তবতা সেই অলৌকিকতাকে স্বীকার করে নেয় বাস্তবতারই এক অংশ হিসেবে। বিশেষত যেখানে অলৌকিকতা লোকবিশ্বাসের মধ্য দিয়ে হাজার বছর ধরে মানুষের চেতনায় গেঁথে আছে।

তাই আমরা দেখতে পাই, লাতিন আমেরিকার বাইরে আফ্রিকার চিনুয়া আচেবে, আমোস টুটোলা কিংবা ওয়েস্ট ইন্ডিজের ডেরেক ওয়ালকট, নাইজেরিয়ার বেন ওকরি, ভারতের সালমান রুশদি, অরুন্ধতী রায়, আফগানিস্তানের খালেদ হোসেইনির মতো লেখকের লেখায়ও জাদুবাস্তবতার এই তীব্রতর ব্যবহার, যা তাদের নিজ নিজ বাস্তবতার প্রতিস্বর হয়ে ওঠে। তারা কেউই ফ্যান্টাসির আশ্রয় নেন না, তারা নির্মাণ করেন সেই কাহিনি—যেখানে অজস্র বঞ্চনা, অভিশাপ, তন্ত্রমন্ত্র, লোকবিশ্বাস এবং সমষ্টিগত স্মৃতির সমবায় একটি গভীরতর সত্য নির্মাণ করে।

এই দিক থেকে দেখতে গেলে, জাদুবাস্তবতা নিছক সাহিত্যিক শৈলী নয়, বরং এক ধরনের বিপ্লবাত্মক বয়ান। এটি শাসকের ভাষাকে প্রতিস্থাপন করে নিপীড়িতের ভাষায়। একে বলা চলে anti-narrative of power—যা উপনিবেশিক ইতিহাস, স্বৈরাচারী রাজনীতি, দারিদ্র্য ও নিঃসঙ্গতার বিরুদ্ধে এক নিরব প্রতিবাদ।

এই সাহিত্যধারা তাই একদিকে যেমন মানুষের বেদনার দলিল, তেমনি তার স্বপ্ন, সাহস ও সৃষ্টিশীলতারও নথি। ইউরোপের দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী এটি কখনো হয়তো দুর্বোধ্য, অতিরঞ্জিত বা অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে। কিন্তু যাদের অভিজ্ঞতা, ইতিহাস ও চেতনা থেকে এটি উঠে এসেছে—তাদের কাছে এই ‘অবিশ্বাস্য’-ই তাদের বাস্তব, এই অলৌকিকতাই তাদের প্রতিদিনের অস্তিত্বের জ্যোতির্বিজ্ঞান।

সার্বিকভাবে বললে, বিশ শতকের গোড়ায় জাদুবাস্তবতার আবির্ভাব কেবল একটি সাহিত্যিক প্রয়াস নয়, বরং এক অন্তর্জাগতিক ও রাজনৈতিক প্রয়োজন। এক গোষ্ঠীর, এক জাতির, এক ইতিহাসের নিজের মতো করে বেঁচে থাকার অধিকার। তাই একে শুধু ‘শৈলী’ বললে তাকে সংকুচিত করে ফেলা হয়। এটি হয়ে উঠেছে এমন এক ভাষা, যেখানে বাস্তবতা আর কল্পনা, ইতিহাস আর পুরাণ, লাঞ্ছনা আর মুক্তির আকাঙ্ক্ষা—সব মিলেমিশে এক অভূতপূর্ব সাহিত্যিক মহাকাব্য গড়ে তোলে।

বিশ শতকের গোড়ার দিকে পুঁজিবাদের উত্থান ও ঔপনিবেশিকতার বিষাক্ত ছোবলে দুখণ্ড পথে বেঁধে যায় তৃতীয় বিশ্বের সমাজ। এসব সমাজে পাশ্চাত্যের আধুনিক প্রযুক্তি যখন তীব্রতার সঙ্গে ঢোকে, তখন এর চাপ সহ্য করতে পারে এমন সাহিত্যের ভাষা প্রবলভাবে প্রয়োজন হয়ে ওঠে। সেই খুঁজেই যেন জন্ম নেয় ‘ম্যাজিক রিয়ালিজম’—যে ধারায় কল্পনা ও বাস্তব এক হয়ে যায়, ইতিহাসের দহন ও স্মৃতির অর্থনৈরাজ্যের মধ্যে বিস্ময় প্রকাশ পায়।

ফ্রেডরিক জেমসন যেমন লক্ষ করেন,

“As a kind of narrative raw materials derived essentially from present society, drawing in sophisticated ways on the world of village or even tribal myth.”

এটি যে কেন্দ্রীয়ভাবে গ্রামীণ স্কুল, উপজাতীয় পৌরাণিকদের জাদুকথা, এবং এই সত্যিকারের অলৌকিক উপাদানের সমন্বয়ে এক নতুন সাহিত্যের জন্ম, তা এই কথাতেই স্পষ্ট। বাস্তবতা যখন একদিকে শাসকের নির্মমতা ও নৃশংসতার গহ্বরে দাঁড়িয়ে যায়, তখন ভাষা হিসেবে ওই পৌরাণিক ও মিথজনিত ন্যারেটিভই একথার চাবিকাঠি হিসেবে কাজ করে।

লাতিন আমেরিকায় ম্যাজিক রিয়ালিজম সেইস্থিতি পায় বিশেষ ভূমিরূপে—কারন এখানে গ্রামীণ জনজীবন, আদিবাসী সংস্কৃতি, বিভাগের ইতিহাস, উপনিবেশবাদ ও পুঁজিবাদের সংযোগে এক অসম্ভব বাস্তবতা বিরাজমান ছিল। মায়া, ইনকা, আজটেকের সভ্যতার নির্মূলতা, উপনিবেশের যন্ত্রণা, পরে সাম্রাজ্যবাদ ও নতুন পুঁজিবাদের আগমন—সব মিলিয়ে এক বিশাল ধ্বংসাবশেষ তৈরি করেছিল। সেই ধ্বংসাবশেষ থেকেই জন্ম নেয় এক তীব্র সাংস্কৃতিক ঘূর্ণিঝড়; যাকে ইউরোপীয় যুক্তিবাদের ভাষায় লেখা যায় না—কারণ, যুক্তি এখানে অদৃশ্য হয়ে যায়, মানবদেহ ও আত্মার ভেতরে বাস করা ‘অলৌকিকতা’ আর ‘জাদু’ এখানে সত্যি হয়ে ওঠে।

গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের আদর্শের মতোই, একটি ‘জনঘন বাস্তবতা’ ফিরিয়ে আনা প্রয়োজন ছিল—

”a world of omens, premonitions, cures and superstitions that is authentically ours, truly Latin American.”

ইউরোপের ধরনের কল্পনা বা ফোকলোর এখানে প্রযোজ্য নয়; বরং মায়া ও ইনকার ইতিহাস, কৃষকের মধ্যবিত্ত জীবনের বিশ্বাস, ঈশ্বরবাদ ও জলবায়ুর ছোঁয়া—এসব একত্রে রচে দেয় এক অকল্পনীয় বাস্তবের বিদ্যুত।

এই প্রেক্ষাপটে মিখাইল বাখতিনের ‘কার্নিভালের (Carnivalesque) দৃষ্টিকোণ’ অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। কার্নিভালের মতো জাদুবাস্তবমূলক রচনায় থাকে বহু থিম, একাধিক কণ্ঠস্বর (‘polyphonic novel’), ‘multiple points of view’, এমনকি ‘social grope’—প্রতিটি দৃষ্টিভঙ্গিতে মুখোমুখি হয় ক্ষমতা ও প্রতিরোধ। জাদুবাস্তবতা শুধু অলৌকিক নাও বটে, এটি একটি কার্যকর রাজনৈতিক ভাষা। বাখতিন বলেন: “বাস্তবতায় শাসকের একককন্ঠ আধিপত্য” ভেঙে ফেলার জন্য, “লোকের আবেগ, মিথ, কল্পনা এবং বিশ্বাসের বহুবর্ণ পরস্পর-সংলাপ” আসাটাই দরকার। ম্যাজিক রিয়ালিজম সেটা করে—কারেনালার মতো, বৃহৎ এক বাক্যালাপ প্রতিষ্ঠায়।

এই বাক্যালাপের মধ্যে আটকে রয়েছে পুঁজিবাদী শাসন ও উগ্র রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অবিরাম বিরোধিতা। যেখানে সরাসরি বলার সাহস নেই, জনগণের ভেতর ছুঁয়ে থাকা লঙ্ঘিত ইতিহাস ও বাতিল সংস্কৃতিকে বলা যায় না, সেখানে ‘অবাস্তব’ নামেই কাটানতে হয়। ফ্যান্টাস্টিকity হয় ঠাট্টা, প্রতীক আর অচেনা ‘কার্নিভালিস্ট’ মেজাজে ভাষ্য—যা একদিকে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আঘাত বয়ে আনে, অন্যদিকে সামাজিক আত্মার পুনর্গঠনার কাজ করে।

নিকট উদাহরণ দেখা যায়:

  • গুন্টার গ্রাসের The Tin Drumে ওস্কার ম্যাটজেরাথের কাঠের ড্রাম আর ছোট্ট শিশুর টর্নেডো জাদু এক অবাস্তব দৃশ্যমায়ায় জার্মান নাৎসিবিরোধী জীবন যাপন তুলে ধরে।
  • টনি মরিসনের Beloved-এ দাসপ্রথার ট্রমা আর কামড়ানো কণ্ঠস্বর বাস্তবতার সঙ্গে নাড়া দেয় ‘ভয়াবহ কিছু অনধিকার কথা’—যা যুক্তিবাদী ভাষায় বলা যায় না, কিন্তু ইতিহাসের দিক থেকে সবচেয়ে ভয়ানক।
  • ইসাবেল অ্যালেন্দে The House of the Spirits এ পিনোচেতের আমলের চিলির ব্যভিচারের বিরুদ্ধে পুড়িয়ে রাখা স্মৃতি, মৃত আত্মা ও ভূতের কন্ঠে কথা বলেন—সেই ভাষাতেই শাসকের বর্বরতা চিহ্নিত হয়।

এই সব রচনায় জাদুবাস্তবতা কল্পনার সীমা ছাড়িয়ে গিয়ে প্রতিরোধের ভাষা হয়ে ওঠে। একত্রে লোক, রাষ্ট্র, ইতিহাস, মিথ—সব এক জায়গায় বসে গল্প বলে, যেখানে রাষ্ট্রীয় ফ্যাসীবাদের বিরুদ্ধে এতটাই শানিত আক্রমণ জমে থাকে, যে সরাসরি সামলে নেয়া যায় না। ঐ ভাষা হচ্ছে ‘অলৌকিক বাস্তবতা’, যা বিশ্বকে বলে, “আমি এখানে, তোমাদের দিকে তাকিয়ে। তুমি আমাকে কল্পনা না করেও আমাকে নাড়িয়ে যেতে পারবে না।”

তাই বিস্তৃত সাহিত্যপ্রেক্ষাপটে ম্যাজিক রিয়ালিজম এক অর্থে ‘এন্টি-ন্যারেটিভ অফ পাওয়ার’। একযুগের মাঝে তৈরি হয়েছিল, কিন্তু এর আবেদন এবং প্রয়োগ শুধু লাতিন আমেরিকায় সীমাবদ্ধ নেই। আফ্রিকা, এশিয়া—সবখানেই পাওয়া যায় ‘লোকের গল্প’, ‘আদিবাসী বিশ্বাস’, ‘ঔপনিবেশিক দমন ও প্রতিরোধের ইতিহাস’, যা কল্পনার চ্যানেলের মাধ্যমে বাঁচিয়ে রাখা যায়।

উদাহরণস্বরূপ:

  • নাইজেরিয়ার বেন ওকরি The Famished Road-এ পুত্রের দৃষ্টিতে দেখা হয় ধারণাগুচ্ছ—যা জাদুর মতো, কিন্তু সমাজের উত্তর-ঔপনিবেশিক বাস্তবতায় গাঁথা।
  • ভারতের অরুন্ধতী রায় The God of Small Things-এ লোক, পুরাণ, সমাজচাপ, এবং ভাষার মধ্যেই জ্বালামুখ আর অপ্রকাশিত প্রার্থনা জাগে—সে জাদুবাস্তব সাহিত্যের নিজস্ব স্তর।
  • আমোস টুটোলা অথবা চিনুয়া আচেবে নেই শুধু লোকের দৈনন্দিন বাস্তবতা, বরং ঝাঁকে ঝাঁকে ‘লোক-অভিজ্ঞতা’—একধরনের সাংস্কৃতিক বিদ্রোহ।

বিশ শতকের গোড়ায় এই সাহিত্যপ্রান্ত সত্ত্বেও, জাদুবাস্তবতা এখন ‘আন্তর্জাতিক ন্যারেটিভ মোড’। নির্দিষ্ট কোনো ভাববোঝার সরঞ্জাম নিরূপণ নয়, বরং জীবনঘনিষ্ঠ বাস্তবতার একটি বহুমাত্রিক উপস্থাপন। কারণ:

১. এটি বলার ভাষা, অন্যথায় বলা যায় না—একজন মানুষের জীবনে যে অযৌক্তিকতা, বিচ্ছেদ, প্রত্যাশার পরাভব, ক্ষতচিহ্ন—তোগুলোকে কল্পনাবিধি ছাড়া বলা অসম্ভব।

২. এটি প্রতিরোধের ভাষা, যাকে রাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত ইতিহাসকে প্রশ্ন করা যায়—যেহেতু রাষ্ট্রের কণ্ঠ ছাপিয়ে ওঠা ‘লোকজা-ঐতিহ্যের আওয়াজ’ নিয়মতান্ত্রিক নিরীক্ষা ছাড়িয়ে।

৩. এটি সাংস্কৃতিক সংযোজনের ভাষা—যেখানে আদিবাসী, কৃষক, শহর, উপনিবেশ, নতুন পুঁজিবাদ—সবই এক শিল্পময় ভারসাম্য তৈরিতে অবদান রাখে।

৪. এটি দার্শনিকভাবে যুক্তিবাদ, রহস্য ও অনুভূতির মধ্যে এক সেতু—যেখানে জাদু “ব্যতীত কোনো নির্দিষ্ট পন্থা” নয়, বরং “বিশ্বাস, ইতিহাস ও অনুভবের সম্মিলিত বহিঃপ্রকাশ”।

ফলে, ম্যাজিক রিয়ালিজম কেবল সাহিত্যিক শৈলী নয়, এটি এক ন্যারেটিভ সরঞ্জাম যা পুঁজিবাদী শাসন ও রাষ্ট্রীয় ইতিহাসের বাইরে ‘অণুপ্রতিরোধের ভাষা’ বলে। গ্রাস, মরিসন, অ্যালেন্দে—তাদের সব লেখায় জাদুবাস্তবতা ঐ ধরনের কণ্ঠস্বর উন্মোচন করেছে, যা “তোমাকে ভাঙতে পারি, কিন্তু তোমার ইতিহাস ও বিশ্বাসকে চেপে রাখতে পারবো না”—সেই আত্মার নির্ঘোষ। সাহিত্য হয়ে ওঠে এক একাত্তর চালিত অস্ত্র, যুক্তির বাইরে থাকা বিশ্বাস-ভাষায় তৈরি এক জাতীয় জাতীয় ক্লান্তি-বিপ্লবের রূপ।

ভবিষ্যতে এই ধারার প্রয়োগ আরও বিস্তৃত হবে। কারণ, বিশ্ব আজও ভুগছে আধিপত্যবাদ ও প্রযুক্তিবাদের সুশাসনের নাম ধরে নতুন শাসন ব্যবস্থায়—যেখানে সামাজিক বাস্তবতার নানাবিধ গন্ধ সরিয়ে ফেলে তাকে ডিস্কোর্সের কোনো এক মাত্র ভাষায় ফাঁসানো হয়। সেখানে ম্যাজিক রিয়ালিজমই পারে সেই ফাঁস বিচ্ছিন্ন করে, ভাষার গহ্বরে মানুষের চিৎকার তুলে ধরতে।

বাংলা সাহিত্যে জাদুবাস্তবতা এখন কেবল একটি শৈল্পিক কৌশল নয়, বরং এটি হয়ে উঠেছে একপ্রকার রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অস্ত্র। এই ধারার সাহিত্যে লেখকরা নানা রকম বিস্ময়কর, অবিশ্বাস্য ও অলৌকিক উপাদান প্রয়োগ করে বাস্তবতাকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করেন। এই শৈলীর মাধ্যমে লেখকেরা সামাজিক ক্ষমতা, দমননীতি, রাজনৈতিক নির্মমতা ও প্রান্তিক মানুষের সংগ্রামকে তুলে ধরেন এমনভাবে, যা বহুলাংশে প্রথাগত বাস্তবতার পরিধিতে অনুপস্থিত থাকে। বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে এই শৈলীর অন্তর্গত লেখাগুলোতে আমরা দেখতে পাই—জাদুবাস্তবতা শুধুমাত্র অলৌকিক কল্পনার জগত নয়; বরং এটি একটি প্রতিরোধের ভাষা, একটি বিকল্প সত্য, এবং একটি প্রতিবাদী আখ্যানবিন্যাস।

সোহরাব হোসেনের (১৯৫৬–২০১৮) ‘মাঠ জাদু জানে’ (২০১০) উপন্যাসটি এই ধারায় একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। এখানে জাদুবাস্তবতা কেবল অলৌকিকের পরিসর নির্মাণে ব্যবহৃত হয়নি, বরং ক্ষমতার বিরুদ্ধে এক সুসংহত প্রতিবাদের ভাষা হিসেবেও কাজ করেছে। উপন্যাসে মাঠ ও চাঁদের অলৌকিক ভাষ্য ব্যবহার করে লেখক এক তীব্র প্রতীকী আক্রমণ হানেন দাম্ভিক ও প্রতাপশালী বাম রাজনীতির ওপর। ঐতিহাসিকভাবে বামপন্থী রাজনীতির যে অন্তঃসারশূন্যতা ও ক্ষমতালোভ বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসে বারবার দেখা গেছে, তার রূপান্তর ঘটে এখানে ম্যাজিক রিয়ালিজমের ন্যারেটিভে। এই অলৌকিক, অলীক ভাষ্য লেখকের উদ্দেশ্য নয়; বরং মাঠ ও চাঁদের অস্তিত্ব ও ভাষা হয়ে উঠেছে বাস্তবের বিকল্প প্রতীক, যেখানে পাঠক খুঁজে পান এক নির্মম অথচ সত্যকথন। সোহরাব হোসেনের এই কৌশল, বাস্তবতাকে সরাসরি না বলে তার ভেতরে প্রবেশ করে অলৌকিকের মাধ্যমে নতুন বাস্তব নির্মাণ, এক্ষেত্রে দারুণভাবে কার্যকর।

ম্যাজিক রিয়ালিজম থেকে সাহিত্য আন্দোলন: এক সাহিত্যিক অভিযাত্রা
চিত্রঃ সোহরাব হোসেন, Image Source: Google

আবার, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের (১৯৪৩–১৯৯৭) ‘খোয়াবনামা’ (১৯৯৬) উপন্যাসে জমিদার শ্রেণির প্রতাপ ও নির্দয় শোষণকে তুলে ধরা হয়েছে এক জাদুবাস্তব চিত্রনির্মাণের মধ্য দিয়ে। মুন্সির অশরীরী রূপ দিয়ে শরাফৎ মণ্ডলকে আক্রমণ করার যে পন্থা অবলম্বন করা হয়েছে, তা কেবল অলৌকিকতার মোড়ক নয়; বরং এটি হলো একধরনের ঐতিহাসিক স্মৃতিচারণ, যেখানে জমিদার শ্রেণির বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের অন্তর্লীন ক্ষোভ, লাঞ্ছনা ও প্রতিহিংসার রূপ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এই ম্যাজিক রিয়ালিস্টিক রূপান্তর রাজনীতি, ইতিহাস এবং ক্ষমতা—এই তিনের দিকেই এক ধরনের কৌশলগত প্রতিঘাত। থিও দা’হায়েন যেভাবে বলেছেন, “ম্যাজিক রিয়ালিজমের মূল সংঘর্ষ উদ্ভূত হয় এই ‘power discourse’ থেকেই”, ঠিক তেমনভাবেই এই আখ্যানগুলোতে ক্ষমতার কাঠামোকে ভেঙে দিয়ে নতুন একটি আখ্যান বিনির্মাণের চেষ্টা লক্ষ করা যায়।

জাদুবাস্তবতার আরেকটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য হলো—এর ন্যারেটিভে প্রান্তিক ও বঞ্চিত জনপদের অনিবার্য উপস্থিতি। এরা ইতিহাসের মূল স্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন, তথাকথিত সভ্যতার মানচিত্রে তাদের ঠাঁই নেই। কিন্তু তাদের আছে নিজস্ব লোককথা, মিথ ও সংস্কৃতি। এই উপাদানগুলোই তাদের অস্তিত্বের শক্তি। সমসাময়িক রাজনীতি বা সাম্রাজ্যবাদের চাপে পিষ্ট হওয়া এই জনগোষ্ঠীই আসলে জাদুবাস্তব আখ্যানের হৃদয়। বাখতিনের ‘কার্নিভাল’ তত্ত্ব অনুসারে, যারা ক্ষমতার ভাষায় উচ্চারিত হয় না, তারাই হয়ে ওঠে এই আখ্যানের কেন্দ্রবিন্দু। মিগুয়েল আনহেল আস্তুরিয়াসের ‘Men of Maize’ (১৯৪৯) উপন্যাসে যেমন মায়ান জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি, কুসংস্কার, স্বপ্ন ও অন্ধবিশ্বাস—সবকিছু মিলেমিশে একটি বিকল্প বাস্তব নির্মাণ করে; যা আসলে আধিপত্যের মুখে এক প্রকার আত্মরক্ষামূলক অস্ত্র।

ম্যাজিক রিয়ালিজম থেকে সাহিত্য আন্দোলন: এক সাহিত্যিক অভিযাত্রা
চিত্রঃ আখতারুজ্জামান ইলিয়াস , Image Source: Google

ঠিক তেমনভাবেই, মিলান কুন্দেরার ‘The Book of Laughter and Forgetting’ (১৯৭৯) উপন্যাসে দেখা যায়, ব্যক্তির মনোজগত ও রাষ্ট্রীয় ইতিহাস—এই দুইয়ের সংঘর্ষে জন্ম নেয় এমন এক জগৎ, যেখানে ভুলে যাওয়াই রাজনৈতিক অস্ত্র হয়ে দাঁড়ায়। এই ভুলে যাওয়ার মধ্য দিয়ে, ক্ষমতা যেমন ইতিহাস মুছে দেয়, তেমনি লেখক সেই ইতিহাসের প্রতিস্থাপন ঘটান এক অলৌকিক পরিসরে।

এই ধারায় আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস হলো বার্নার্ড কোজো লিং-এর ‘Search Sweet Country’ (১৯৮৬), যেখানে আফ্রিকার রাজনৈতিক উত্থান-পতনের পটভূমিতে প্রান্তিক মানুষের জীবনসংগ্রাম উঠে আসে। এখানে অলৌকিকতা যেন কেবল প্রতীক নয়; বরং এক উপমহাদেশীয় সামাজিক বাস্তবতার ভাষ্য।

বাংলা সাহিত্যেও এই প্রান্তিক স্বরের মেলবন্ধন ঘটেছে বহু উপন্যাসে। যেমন মনোজ দাসের ‘The Cyclones’ (১৯৮৭), দেবর্ষি সারগীরের ‘সওদাগর’ (২০০৮), সোহরাব হোসেনের ‘সরম আলির ভুবন’ (২০০৪), মহাশ্বেতা দেবীর ‘টেরোড্যাকটিল, পূরণ সহায় ও পিরথা’ (১৯৮৪), কিংবা রামকুমার মুখোপাধ্যায়ের ‘মিছিলের পরে’ (১৯৯৮)—সব ক্ষেত্রেই দেখা যায় প্রান্তিক জনপদের ব্যতিক্রমী জীবন, তাদের ভাষ্য, তাদের বিস্ময়, তাদের লড়াই। এইসব আখ্যানজুড়ে যেসব চরিত্র, তারা প্রায়শই শাসকের বিরুদ্ধে সংঘাতরত, বাস্তবের অসহায়তা অতিক্রম করতে চায় অলৌকিকের আশ্রয়ে।

জাদুবাস্তবতা আসলে এক বিস্ময়কর জগতের নির্মাণ। এই জগৎটি কল্পনা থেকে পৃথক—এটি অনেক বেশি সত্য, অনেক বেশি ঘন, অনেক বেশি মানবিক। এই জগতে বাস্তবতা এতটাই সঘন যে, অলৌকিক ঘটনাও যেন স্বাভাবিক মনে হয়। সমালোচক ক্যারিশ ব্যালডিক একে ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে, “a kind of modern fiction in which fabulous and fantastical events are included in a narrative that otherwise maintains a ‘reliable’ tone of objective realistic report.” অলৌকিকতার আশ্রয় নিয়েও যে বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি করা যায়, এটাই ম্যাজিক রিয়ালিজমের কুশলতা।

এই ধারায় আলেহো কার্পেন্তিয়েরের ‘The Kingdom of this World’ উপন্যাসটি এক ঐতিহাসিক নিদর্শন। উপন্যাসে দেখা যায়, এক নিগ্রো দাস মাকান্দালকে ঔপনিবেশিক খামার মালিকরা হত্যা করতে চায়। তাকে দড়িতে বেঁধে অগ্নিসংযোগ করতে প্রস্তুত হওয়া মাত্রই হঠাৎ বাঁধন খুলে যায়, আর মাকান্দাল উড়ে উড়ে মিলিয়ে যায় মহাশূন্যে। এই উড়ে যাওয়া নিছক অলৌকিক নয়—এটি হলো শোষিত জনগণের পলায়নের ভাষা, শাসকের অক্ষমতার প্রতীক, একটি ইতিহাসের প্রতিরোধী পুনর্লিখন।

নবারুণ ভট্টাচার্যের ‘কাঙাল মালসাট’ (২০০৩) উপন্যাসেও এমন এক প্রতিরোধী ভাষার উপস্থিতি লক্ষণীয়। এখানে হঠাৎ করে উড়ন্ত ফ্যাতাড়ুদের আবির্ভাব হয় যারা সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ, পুঁজিপতি, পুলিশ—সমস্ত এলিট শ্রেণিকে নাস্তানাবুদ করে। তারা বাস্তবের কঠোর নির্মাণ ভেঙে দিয়ে এক নতুন বাস্তব তৈরি করে, যেখানে শাসক ও শোষক ক্ষমতাহীন। এখানে উড়ে উড়ে বোমা মারা, বন্দুক চালানো শুধুমাত্র অ্যাকশন নয়; বরং শোষকের বিরুদ্ধে প্রান্তিক মানুষের জাদুবাস্তব সংগ্রামের চূড়ান্ত রূপ।

ম্যাজিক রিয়ালিজম থেকে সাহিত্য আন্দোলন: এক সাহিত্যিক অভিযাত্রা
চিত্রঃ নবারুণ ভট্টাচার্য, Image Source: Google

গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের ‘One Hundred Years of Solitude’ (১৯৬৭) উপন্যাসে মাকোন্দো শহর ও মেলকিয়াদেশের প্রেতাত্মার মাধ্যমে যে জাদুবাস্তবতা তৈরি হয়েছে, তা বিশ্বসাহিত্যে এক অনন্য নজির। শহরের মাঝে এক ঘর, যেখানে ধুলো নেই, মাকড়সার জাল নেই, আর সেই ঘর পাহারা দিচ্ছে এক মৃত জাদুকরের আত্মা—এই ঘর বাস্তবতার থেকেও বাস্তব। এটি হলো শেকড়ের ঘর, ইতিহাসের ঘর, এক পরিবারের স্মৃতির ধারক। এই বিস্ময়কর জগৎ আসলে জাদুবাস্তবতার অন্যতম প্রধান ব্যাখ্যা, যার মাধ্যমে বাস্তবকে নতুন করে দেখা সম্ভব হয়।

রবিশঙ্কর বলের ‘ছায়াপুতুলের খেলা’ (২০০৮) উপন্যাসেও আমরা এমন এক ঘরের দেখা পাই, যেখানে বসবাস করে অতীত, ঐতিহ্য, স্বপ্ন ও প্রেম। এই ঘর যেন বেঁচে থাকার রসদ হয়ে ওঠে কথকের জীবনে। ঘরের আয়নাতে দেখা যায় অতীতের সব ঘটনা। এটি কেবল স্মৃতির নয়; এটি জীবনের ধারাবাহিকতাকে টিকিয়ে রাখার এক বিকল্প বাস্তবতার জায়গা।

সবশেষে, জাদুবাস্তব আখ্যানের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো চরিত্রের রূপান্তর। এখানকার মানুষ শুধু দুঃস্বপ্ন দেখে না, প্রয়োজনে নিজের রূপ পরিবর্তন করে ফেলে। এটি নিছক কল্পনার খেলা নয়, বরং সমাজের কঠোর বাস্তবতায় টিকে থাকার এক কৌশল। যেমন কার্পেন্তিয়েরের উপন্যাসে মাকান্দাল নিজের রূপ পালটে নেয় গিরগিটি, কুকুর, নিশিপোকা বা হরিণে। এই রূপান্তর ক্ষমতার নজর এড়িয়ে বেঁচে থাকার ছদ্মবেশ। এটি যুদ্ধের রণকৌশল, বেঁচে থাকার রাজনীতি।

এইভাবে দেখা যায়, জাদুবাস্তবতা শুধু সাহিত্যিক কৌশল নয়—এটি এক বিকল্প ইতিহাস লেখার, এক বিকল্প বাস্তব নির্মাণের, এবং সর্বোপরি প্রান্তিক মানুষের অস্তিত্ব রক্ষার এক শৈল্পিক, রাজনৈতিক ভাষা। আধিপত্য, দমন ও শাসনের বিপরীতে দাঁড়িয়ে এই শৈলী নির্মাণ করে নতুন এক বয়ান, যেখানে অলৌকিকতা কেবল চমক নয়—এটি বাস্তবতারই এক ভিন্ন পাঠ।

জাদুবাস্তবতা এক গভীর সাহিত্যিক অভিব্যক্তি, যা শুধু অলৌকিকের বাহারি ছটা নয়, বরং এর ভেতর নিহিত থাকে রাজনীতি, ইতিহাস, সামাজিক বিপর্যয় ও প্রতিরোধের সাংস্কৃতিক ভাষ্য। যখন বস্তুগত বাস্তবতা ব্যর্থ হয়ে পড়ে জীবনের গভীর সংকটকে প্রকাশ করতে, তখন জাদুবাস্তবতার আশ্রয়ে লেখকেরা নির্মাণ করেন এমন এক আখ্যান, যেখানে অবিশ্বাস্য ও বিস্ময়কর ঘটনার মধ্য দিয়েই উঠে আসে জীবনের প্রকৃত সত্য। বাংলা সাহিত্যেও এই শৈলী শুধু আমদানিকৃত সাহিত্যপ্রবাহ নয়; বরং এ এক প্রাণবন্ত প্রতিবাদের ভাষা, যাকে বহু পূর্বে স্বদেশি সাহিত্যিকরাও গভীরভাবে অনুধাবন করেছিলেন।

ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের (১৮৪৭–১৯১৯) ‘কঙ্কাবতী’ (১৮৯২) উপন্যাস তার একটি প্রমাণ। এখানকার সমাজচিত্রে দেখা যায় অর্থপিশাচ জনার্দন চক্রবর্তীর প্রতাপ ও স্বার্থপরতা—যা আসলে ঔপনিবেশিক যুগের বাঙালি উচ্চবর্ণীয় মধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রতীক। এই চরিত্রকে শায়েস্তা করার জন্য কঙ্কাবতী বাঘের রূপ ধরে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়। অলৌকিক রূপান্তর এখানে প্রতিহিংসার বা প্রতিরোধের কৌশলমাত্র নয়, বরং এটি একপ্রকার প্রতীকী সাফোকেশন—যেখানে সামাজিক শিষ্টাচার ও পুরুষতন্ত্রের মধ্যে আটকে পড়া নারীর প্রতিবাদী রূপ হয়ে উঠে আসে এক হিংস্র খেতু বাঘের অবয়বে। জাদুবাস্তবতার অলৌকিক ভাষায় এই প্রতিবাদ যেন বাস্তব সমাজকে চমকে দেওয়ার মতো এক শুদ্ধীকরণ প্রক্রিয়া।

ম্যাজিক রিয়ালিজম থেকে সাহিত্য আন্দোলন: এক সাহিত্যিক অভিযাত্রা
চিত্রঃ ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়, Image Source: Google

এই ধরনের আখ্যানের আরেকটি প্রণিধানযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো—লোকাচার, সংস্কার ও প্রাচীন মিথ-পুরাণের সমন্বয়। ষষ্ঠত, জাদুবাস্তব আখ্যানের মধ্যে লেখকেরা প্রাচীন বিশ্বাস, লোকসংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের উপাদানগুলোকে একত্রে যুক্ত করে তৈরি করেন এক ধরনের গোষ্ঠীগত প্রতিবাদচেতনা। আধুনিকতার কোলাহলে যা হারিয়ে যেতে বসেছিল, সেই ঐতিহ্য, সেই লোকজ বিশ্বাসই এই সাহিত্যে ফিরে আসে এক রাজনৈতিক গতি সঞ্চারক শক্তি হয়ে। লোইস পারকিনসন জামোরা যথার্থই বলেছিলেন,

“magical realist draw upon cultural system that are no less ‘real’. …Their primary narrative investment may be in myths, legends, rituals—that is, in collective practices that bind communities together.”

এই উক্তির বাস্তব উদাহরণ পাওয়া যায় জার্মান লেখক প্যাটিক সুসকিন্ডের (Patric Suskind : ১৯৪৯) উপন্যাস ‘Perfume’ (১৯৮৫)-এ। এখানে ফ্রান্সের গ্রাসি অঞ্চলের একটি কুসংস্কারাচ্ছন্ন জনগোষ্ঠী বিশ্বাস করে যে তাদের দেবী ম্যাডোনার সর্বত্র দৃষ্টি রয়েছে। এই দৈবী দৃষ্টি একধরনের সামাজিক টানাপোড়েনের প্রতিক্রিয়া। সমাজ যখন একের পর এক খুনের ঘটনার মুখোমুখি হয়, তখন বিজ্ঞান নয়, যুক্তি নয়, বরং ঈশ্বরীয় শক্তির প্রতি অগাধ বিশ্বাসই জনগণকে সংহত করে তোলে। তারা বিশ্বাস করে, ঐ দেবীর আশীর্বাদেই তারা খুনিকে ধরতে সক্ষম হবে। এখানেই জাদুবাস্তবতার উপস্থিতি—যেখানে বাস্তব সামাজিক সংকটের মুখে দাঁড়িয়ে অলৌকিক বিশ্বাস হয়ে ওঠে প্রতিরোধের নৈতিক অস্ত্র।

বাংলা সাহিত্যেও এই কৌশলের সফল প্রয়োগ লক্ষ্য করা যায় আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘খোয়াবনামা’ (১৯৯৬) উপন্যাসে। এখানে ফকির বিদ্রোহের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য যেমনভাবে পুনর্জাগরিত হয়েছে, তেমনিভাবে দেখা যায় গানে গানে প্রতিবাদের ডাক। বৈকুণ্ঠ ফকির যখন গেয়ে ওঠে— “ভবানী নামিল রণে পাঠান সেনাপতি সনে গোরা কাটো আদেশ হুংকারে”

তখন সেটি শুধুই কোনো কিংবদন্তি বা ঐতিহাসিক পটভূমি নয়; বরং এটি হয়ে ওঠে এক রাজনৈতিক আহ্বান। এই গানে শাসকের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামের ডাক মেলে, যা শুধু জমিদার শরাফতের বিরুদ্ধেই নয়, বরং দেশভাগের মূল চক্রী মুসলিম লীগের বিরুদ্ধেও। ফকিরদের গান এখানে অস্ত্রের ধার শানানোর মতো। একটি সংগীত-সংস্কৃতির মাধ্যমে এমন সঙ্ঘবদ্ধ প্রতিবাদ, যাকে রাষ্ট্রীয় ভাষা চিহ্নিত করে ‘বিদ্রোহ’ বা ‘বিপ্লব’ নামে, তা আসলে একদল বঞ্চিত মানুষের ঐতিহ্যিক অস্ত্রভাণ্ডার। ষষ্ঠ অধ্যায়ে এই বিষয়টি আরো বিস্তারিতভাবে বিশ্লেষণ করা হয়েছে।

এই ধারার সাহিত্যিক রচনায় সপ্তমত যে বৈশিষ্ট্যটি লক্ষণীয়, তা হলো—মৃত মানুষের মুখে বলা জীবন্ত সমাজের গল্প। অনেক জাদুবাস্তব আখ্যানেই দেখা যায়, পুরো উপন্যাসটি ভূতের সংলাপে তৈরি। কিন্তু তা ভূতের গল্প নয়। শাসক-শোষকের নির্মমতা এমন পর্যায়ে পৌঁছে যায় যে, জীবন তার প্রাণশক্তি হারায়, এবং সমাজে নেমে আসে এক গভীর মৃত্যুশোক। এই শোকই রূপ নেয় এক শ্মশানের বর্ণনায়, যেখানে মৃতরাই ভাষ্যকার। ভূতের কণ্ঠে, মৃত মানুষের চোখে, সমাজের বর্তমান চেহারাকে লেখক এমনভাবে তুলে ধরেন যে পাঠকেরা গা শিউরে ওঠে।

মেক্সিকান লেখক হুয়ান রুলফোর ‘Pedro Páramo’ (১৯৫৫) উপন্যাস এই প্রসঙ্গে এক অনন্য নজির। উপন্যাসে শুরুতে মনে হয় আমরা একটি জীবন্ত কাহিনির ভেতর প্রবেশ করছি—যেখানে হুয়ান প্রেসিয়াদো মায়ের আদেশ পালনে কোমালা নামে একটি গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়, তার পিতা পেদ্রো পারামোর কাছ থেকে অধিকার আদায়ে। পাঠক তার সঙ্গে সঙ্গে পথ ধরে হাঁটেন, কথোপকথনে অংশ নেন। কিন্তু উপন্যাসের মধ্যখানে এসে হঠাৎ চমকে উঠতে হয়—হুয়ান নিজেই তো মৃত! আর কোমালা? সেখানেও কেউ জীবিত নেই। এক মৃত শহরের কণ্ঠে বলিত হচ্ছে জীবনের ভাষ্য। এই কোমালা আসলে ঔপনিবেশিক অত্যাচারে জর্জরিত, ইতিহাস থেকে মুছে দেওয়া একটি মৃত মেক্সিকোর প্রতিচ্ছবি। যেখানে মৃতদের সঙ্কেতেই আমরা বুঝতে পারি বেঁচে থাকা কেমন ভয়ানক এক অভিজ্ঞতা হতে পারে।

এইরকম শ্মশানের কাহিনির অভ্যন্তর থেকে উঠে আসে এক রাজনৈতিক চেতনা—যেখানে লেখক বাস্তবতা ও মৃত্যু, ইতিহাস ও অশরীরী কণ্ঠ—সবকিছুকে এক সুসংহত ও ভয়ংকররূপে জুড়ে দেন, যাতে জীবিত পাঠকেরা তাদের ঘুম থেকে জেগে ওঠে। এ যেন পুনর্জাগরণের গল্প, যেন ইতিহাসের ফসিল হয়ে যাওয়া ক্ষতের ওপর নতুনভাবে হাত বুলিয়ে দেওয়া।

জাদুবাস্তবতা, এইভাবে, তার সমস্ত অলৌকিক চিত্রভাষা, বিস্ময়কর ঘটনাপ্রবাহ, প্রাচীন সংস্কৃতির অন্তর্গত বিশ্বাস ও অস্তিত্বের অন্তরালে দাঁড়িয়ে একটি বৃহৎ রাজনৈতিক ভাষ্য গড়ে তোলে। এই ভাষ্য চিৎকার করে জানায়—প্রান্তিকের অস্তিত্বকে আর উপেক্ষা করা যাবে না, অতীতকে ভুলে ভবিষ্যৎ নির্মাণ করা যাবে না, এবং ক্ষমতার প্রতাপকে অলৌকিক ভাষায় ভেঙে ফেলা যেতেই পারে। ম্যাজিক রিয়ালিজম, সেই অর্থে, শুধুই কোনো সাহিত্যিক শৈলী নয়; এটি ইতিহাসকে পুনরাবিষ্কারের, ক্ষমতাকে প্রশ্ন করার, ও বঞ্চিতদের আত্মপরিচয় নির্মাণের এক অপরিহার্য সাহিত্যিক অস্ত্র।

এই অস্ত্র প্রয়োগের কৌশল যতই বিস্ময়কর হোক না কেন, এর মূল লক্ষ্য একটাই—সত্যকে নতুন আলোয় দেখা, অন্যরকম ভাষায় লেখা। আধুনিক পুঁজিবাদী, সাম্রাজ্যবাদী ও কর্তৃত্ববাদী সমাজব্যবস্থার সমান্তরালে এই সাহিত্যধারা আমাদের বারবার স্মরণ করিয়ে দেয়—যে বাস্তবতাকে আমরা গ্রহণ করি, তার বাইরেও অন্য এক বাস্তবতা আছে, যেটি আরও গভীর, আরও জটিল, আর অনেক বেশি মানবিক।

বাংলা সাহিত্যে জাদুবাস্তবতার পরিসর ক্রমাগত বিস্তৃত হয়েছে বহুমাত্রিকতা ও ঐতিহাসিক গভীরতায়। এই ধারার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো—বাস্তবতা আর অবাস্তবতার সীমানা মুছে দিয়ে এক নতুন ভাষ্য নির্মাণ, যা গভীরভাবে রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং মনস্তাত্ত্বিক। এই সাহিত্যে ইতিহাস শুধু ফ্রেম নয়, বরং জাদুর মিশ্রণে নবব্যাখ্যাত, প্রতীকী ও প্রতিরোধমুখর এক অস্তিত্ব। এই ধারায় আমরা যেমন রূপান্তর দেখি, তেমনই দেখি অলৌকিকের মাধ্যমে বিস্ময়কর ভাষায় উচ্চারিত অধিকার, যন্ত্রণার ইতিহাস ও অবদমিত স্মৃতির বিস্ফোরণ। বাংলা সাহিত্যে এর অনন্য উদাহরণ হিসেবে উঠে আসে রবিশংকর বলের ‘দোজখনামা’ (২০১০)। এখানে কাহিনি এগিয়ে চলে মৃত মির্জা গালিব ও সাদাত হাসান মান্টোর প্রেতাত্মার মুখে। তারা শুয়ে আছে কবরে—তবুও নির্বিবাদে বলে চলেছে ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষের চাপা পড়া সময়ের ইতিহাস।

এই ইতিহাস—যা বাস্তবে বলা যায়নি, শাসকের ভয়ে চেপে রাখা হয়েছে বহু দশক, সেইসব কথা উচ্চারিত হচ্ছে মৃত্যুর পর। মান্টো কেবল কথার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেন না, পাকিস্তানের কবর থেকে উড়ে এসে মির্জার কবরে হাজির হন। এই উড়ে আসা বাস্তব নয়, তবু যেন বাস্তবের চেয়ে অনেক বেশি সত্য। এই দৃশ্য শুধু ভৌতিক নয়, বরং প্রতীকী। ভূতের মুখে উচ্চারিত ইতিহাস আসলে সেই মৃত সত্য, যা জীবিতরা উচ্চারণের সাহস পায় না। সেই জন্যই এ ধরনের আখ্যান ‘ম্যাজিক্যাল’—কারণ তারা অবাস্তবের ভাষায় ব্যক্ত করে নিষিদ্ধ সত্যকে।

অষ্টমত, জাদুবাস্তবতা অনেক সময় ইতিহাসের প্রান্তচ্যুত বা মুছে ফেলা অধ্যায়কে পুনরুজ্জীবিত করে তোলে। ইতিহাসের সেই অংশ, যা শাসকের বয়ানে ঠাঁই পায়নি, বা সংবেদনশীলতার দোহাই দিয়ে উপেক্ষিত হয়েছে, তা উঠে আসে সাহিত্যিক ভঙ্গিমায়। যেমন, কলম্বিয়ায় কলাব্যবসায়ীদের দ্বারা সংঘটিত শ্রমিক গণহত্যা রাষ্ট্রের ইতিহাস থেকে মুছে ফেলা হলেও, গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের ‘One Hundred Years of Solitude’ উপন্যাসে মাকোন্দোর পটভূমিতে তা পুরোমাত্রায় উঠে আসে। এই ইতিহাস বাস্তবতায় লোপ পেলেও সাহিত্যিক অভিব্যক্তিতে তা স্বীকৃত হয়েছে।

মার্কেস নিজে সাংবাদিক ছিলেন বলে রাষ্ট্রের আড়ালের অনেক অজানা তথ্য তার জানা ছিল। তিনি সাহিত্যকে ব্যবহার করেছেন সেই মুছে ফেলা ইতিহাস পুনরুদ্ধারে। জন ফস্টার এ ধরনের ইতিহাসকে বলেছিলেন ‘felt history’—অর্থাৎ অনুভূতির মাধ্যমে উপলব্ধ সত্য, যেটি প্রমাণের চেয়ে বেশি জীবন্ত। বাংলা সাহিত্যে রবিশংকর বলের ‘ছায়াপুতুলের খেলা’ উপন্যাসেও আমরা দেখি দণ্ডকারণ্য উদ্বাস্তু শিবিরের এমন সব ঘটনাপ্রবাহ উঠে এসেছে, যা সাধারণ পত্রপত্রিকায় বা ইতিহাস গ্রন্থে অনুপস্থিত ছিল। এইভাবে সাহিত্য হয়ে ওঠে ইতিহাসের বিকল্প মুখপাত্র, যা নিছক দলিল নয়, বরং এক অনুভূতিপ্রবণ দলিলভিত্তিক চেতনা।

নবমত, জাদুবাস্তবতা বারংবার স্বপ্নকে আখ্যানে অন্তর্ভুক্ত করে। বাস্তব যখন অসহনীয় হয়ে ওঠে, তখন স্বপ্ন হয় একমাত্র আশ্রয়, প্রতিরোধ ও সম্ভাবনার স্থান। যেমন : শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘হিম পড়ে গেল’ (১৯৮২) উপন্যাসে বর্ষা ঋতু হারিয়ে যাওয়ায়, দেবকুমার বসু নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ে। সমাজ ও বাস্তবতার মুখ ফিরিয়ে সে চেতনার অন্তঃস্রোতে ঢুকে পড়ে। অতীতের স্মৃতি, শিশুসাহিত্যের প্রতি ভালোবাসা, প্রিয় লেখকের কথা তার মনোজগতে ঘুরপাক খায়। কিন্তু সেই বাস্তবে কোনো সমাধান আসে না। তখনই লেখক রচনা করেন এক স্বপ্নের বয়ান—যেখানে বিকল্প বাস্তবতার মধ্যে ঘটে সমাধান। স্বপ্ন হয়ে ওঠে অস্তিত্ব রক্ষার বিকল্প পথ।

এমনই স্বপ্নের বয়ান পাই অভিজিৎ সেনের ‘রহু চণ্ডালের হাড়’ (১৯৮৫) উপন্যাসে। এখানে প্রীতেম বাজিকর যখন বারবার বাস্তবের মাটি হারিয়ে ফেলেন, তখন তার মৃত পূর্বপুরুষরা স্বপ্নে এসে বাতলে দেয় নতুন পথ। স্বপ্নে যে নির্দেশ পাওয়া যায়, তার ভিত্তিতেই গোটা সম্প্রদায় পূর্বদিকে যাত্রা করে ও অবশেষে নিজেদের একটি নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে পায়। এখানেও বাস্তব সমাধানের অভাবে স্বপ্ন হয়ে ওঠে রাজনৈতিক ও অস্তিত্বগত আশ্রয়। মার্কেসের উপন্যাসেও, যেমন : ‘One Hundred Years of Solitude’-এ দেখা যায় হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া স্বপ্নেই খুঁজে পেয়েছিল মাকোন্দোর অবস্থান। অর্থাৎ, স্বপ্ন এখানে ভবিষ্যতের পূর্বাভাস নয়; বরং বেঁচে থাকার নিরুপায় উত্তরণ।

দশমত, জাদুবাস্তবতার ন্যারেশনে মিথের প্রয়োগ এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। মিথ এখানে নিছক কাহিনি নয়, বরং জাতিসত্তার অস্তিত্বের স্মারক। ডোনাল্ড শ্ব যথার্থই বলেছেন : “in magical realist narrative …certain myths are used to bring forth hidden truth.” অর্থাৎ মিথের মাধ্যমে আখ্যানে উদঘাটিত হয় সেই সত্য, যা সরল ভাষায় বলা সম্ভব নয়। যেমন : আস্তুরিয়াসের ‘Men of Maize’ উপন্যাসে গুয়াতেমালার অতীত মায়া সভ্যতার ‘পোপল ভু’ মিথ জেগে ওঠে। এই মিথ একদিকে জাতিসত্তার স্মৃতি, আবার অন্যদিকে ঔপনিবেশিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের সাংস্কৃতিক অস্ত্র।

এছাড়া মার্কেসের লেখায় ‘La Mama’ নামে অসম্ভব ক্ষমতাসম্পন্ন এক মিথ ব্যবহৃত হয়েছে, যা কলম্বিয়ার রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে এক সাংকেতিক প্রতিরূপ। আবার কখনো চরিত্র নিজেই মিথ হয়ে ওঠে। যেমন : কার্পেন্তিয়েরের ‘The Kingdom of This World’-এ মাকান্দাল এক অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন মানুষ, যে নিগ্রোদের কাছে জীবন্ত প্রতিরোধের মূর্তি। বাংলা সাহিত্যে সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘অলীক মানুষ’ উপন্যাসে বদিউজ্জামান জীবিত অবস্থাতেই হয়ে ওঠেন ধর্মীয় মিথ, যাকে ঘিরে গড়ে ওঠে বিশ্বাস ও ভক্তি। এমনকি আবুল বাশারের ‘মরুস্বর্গ’ উপন্যাসটি তো একটি পুরো মরুভূমির মিথিক রূপকেই ধারণ করে।

একাদশত, অনেক সময় লেখকেরা শাসকের চোখ এড়িয়ে কথা বলার জন্য কল্পিত জনপদ সৃষ্টি করেন। যেমন : মার্কেসের ‘মাকোন্দো’, হুয়ান রুলফোর ‘কোমালা’, হুয়ান কার্লো গিনেত্তির ‘সান্তা মারিয়া’, এবং বাংলা সাহিত্যে মহাশ্বেতা দেবীর ‘পিরথা’। এই জনপদগুলো বাস্তবে নেই, কিন্তু তাদের আখ্যান একেবারে রাজনৈতিক। তারা শাসকের ভাষার বাইরে গড়ে তোলে এক বিকল্প মানচিত্র, যেখানে শোষণের মুখোশ খুলে দেওয়া যায় নিরাপদে। এইসব নামের আড়ালে রয়েছে বিস্তৃত ইতিহাস, বঞ্চনা ও প্রতিরোধের সুর। এইভাবে জনপদ হয়ে ওঠে প্রতিবাদী ভূগোল।

দ্বাদশত, জাদুবাস্তবতার আখ্যান কখনোই সরলরৈখিক নয়। একাধিক বাস্তবতা, বহু স্তর, বিপরীত সত্তা, সময়ের ধ্বস্ত বিন্যাস—সব মিলিয়ে এর আখ্যান হয় গোলকধাঁধার মতো। এখানে প্লট গঠিত হয় বাস্তব ও কল্পনার সম্মিলনে, যেখানে কখনো ‘নগর বনাম গ্রাম’, কখনো ‘জীবন বনাম মৃত্যু’, কখনোবা ‘শরীর বনাম আত্মা’র দ্বৈরথ ঘটে। এই সব বিভেদের সমন্বয়ে গড়ে ওঠে এক ‘polyphonic’ বা বহুস্বরবিশিষ্ট আখ্যান। যেমন : আস্তুরিয়াসের ‘Men of Maize’ উপন্যাসে কোন কেন্দ্রীয় ঘটনা নেই, নেই নির্ধারিত শুরু বা শেষ। বিচ্ছিন্ন বহু প্লট—প্রতিটি আলাদা, তবু অলৌকিকভাবে একে অপরের সঙ্গে যুক্ত।

বাংলা সাহিত্যেও এই পদ্ধতির সফল প্রয়োগ দেখা যায় শহীদুল জহিরের ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’ (১৯৮৭) ও নবারুণ ভট্টাচার্যের ‘কাঙাল মালসাট’-এ। প্রথমটিতে গল্পের ক্যানভাসে উঠে আসে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও ব্যক্তিগত বেদনার সম্মিলিত সুর। দ্বিতীয়টিতে দেখা যায় ফ্যাতাড়ুদের উড়ে উড়ে হামলা—যা একদিকে পুঁজিপতির মুখোশ খুলে দেয়, অন্যদিকে পাঠককে চমকে দেয় বাস্তবতার এমন এক ব্যাখ্যায়, যেখানে চেতনায় গভীর আলোড়ন সৃষ্টি হয়।

এইভাবে আমরা দেখি, জাদুবাস্তবতা শুধু অলৌকিকতার বাহারি এক চিত্রনকশা নয়, বরং এটি এমন এক রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সাহিত্যভাষ্য, যা বাস্তবতার সীমার বাইরে গিয়ে বলবার সাহস রাখে, অনুভব করায় গভীরতর সত্য। এখানে ভূতের মুখ, স্বপ্নের আখ্যান, কল্পিত জনপদ, লুপ্ত ইতিহাস, মিথের জাগরণ—সব মিলিয়ে গড়ে ওঠে এক সম্পূর্ণ নতুন বাস্তবতা, যাকে অস্বীকার করা যায় না। বরং বলা যায়, এটি বাস্তবতারই অন্য ভাষ্য, যেখানে মানুষের চেতনা, প্রতিবাদ ও আত্মপরিচয় এক অলৌকিকভাবে সন্নিবেশিত হয়ে থাকে। এই সাহিত্যের মূল শক্তি এখানেই—যেখানে বাস্তব ও অবাস্তব মিলিয়ে উঠে আসে সেই সমাজ, যা আমাদের চোখের সামনেই আছে, অথচ প্রতিদিন উপেক্ষিত। জাদুবাস্তবতার সাহিত্যে সেই সমাজই নিজের মুখে নিজের কথা বলে।

জাদুবাস্তবতা শুধুমাত্র অলৌকিক ঘটনাকে বাস্তবতার ছাঁচে উপস্থাপন করে না, বরং সময়ের প্রথাগত গঠনকেও ভেঙে ফেলে নতুনভাবে নির্মাণ করে। পাঠক যখন এই ধারার কোনো উপন্যাসে প্রবেশ করেন, তখন তার সামনে খুলে যায় এক জটিল সময়-পরিবেশ, যেখানে অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ—সব মিলেমিশে যায় একসঙ্গে। সময় সেখানে যেন একটি কুয়াশায় ঢাকা নদী, যার স্রোত কখনো সামনে চলে যায়, আবার কখনোই বা অতীতে ফিরে আসে। এই সময়চেতনার গোলকধাঁধা-ধর্মিতাই ত্রয়োদশতম বৈশিষ্ট্য হিসেবে চিহ্নিত হয় জাদুবাস্তবতার আখ্যানে।

গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের ‘One Hundred Years of Solitude’ উপন্যাসে দেখা যায়, অরেলিয়ানো বাবিলোনীয় যখন পড়ে ফেলছে শতবর্ষ পুরোনো সেই পান্ডুলিপি, তখন সে অনুভব করে, সে সময়ের এমন এক বিন্দুতে পৌঁছে গেছে, যেখানে মাকোন্দোর অস্তিত্বই ছিল না। একটি এমন সময়, যখন কেবল সৃষ্টি-প্রক্রিয়া চলছিল, কিন্তু কিছুই স্থির হয়নি। ভবিষ্যতের এক চরিত্র পড়ে ফেলছে অতীতের এক ইতিহাস, যা আবার ভবিষ্যতের ভবিষ্যদ্বাণী। সময় এখানে আর কোনো রেখায় ধরা যায় না। এটি এক অদৃশ্য বৃত্ত, আবার তা কখনো সরল রেখা নয়; বরং সময় যেন একটি স্পাইরাল, যাকে ছুঁতে গেলে বারবার ফিরে যেতে হয় কেন্দ্রে।

একইভাবে, হুয়ান রুলফোর ‘Pedro Páramo’ উপন্যাসে আমরা দেখি এক অদ্ভুত সময়চেতনার নির্মাণ। হুয়ান তার মৃত্যুপথযাত্রী মাকে প্রতিশ্রুতি দেয়, সে কোমালায় যাবে এবং বাবার কাছ থেকে তার প্রাপ্য অধিকার আদায় করবে। কিন্তু উপন্যাস যত এগোয়, পাঠকের সামনে ধরা পড়ে এক বিপরীত বাস্তবতা—হুয়ান নিজেই মৃত, তার চারপাশের নগরীও মৃত, সব চরিত্র যেন ভূতের মতো কথা বলছে। সময় এখানে মৃত, অথচ জীবন্ত। এইভাবে ভবিষ্যতের এক প্রতিশ্রুতি থেকে আখ্যান পেছনে যেতে যেতে পৌঁছে যায় অতীতের নিঃসঙ্গ ও ভয়ানক বাস্তবে। পুরো আখ্যান যেন একটি মৃত্যুর শহরের দীর্ঘশ্বাস।

বাংলাদেশি লেখক শহীদুল জহির এই সময়ভঙ্গের বিষয়টি নিয়ে বলেছিলেন, “আমি বর্ণনায় টাইম ফ্রেমটাকে ভাঙতে চাচ্ছিলাম এবং আমার সময়ের এক তল থেকে অন্যতলে অনায়াসে যাতায়াত করতে চাচ্ছিলাম।” তিনি মনে করতেন যে ঐতিহ্যগত লিনিয়ার সময়রেখা সাহিত্যিক বক্তব্য প্রকাশে সীমাবদ্ধতা সৃষ্টি করে। তার ‘সে রাতে পূর্ণিমা ছিল’ উপন্যাসেও দেখা যায় সময় একটি ভাসমান কাঠামো—যেখানে বর্তমান, অতীত, স্বপ্ন ও স্মৃতি একসঙ্গে মিশে যায়। ষষ্ঠ অধ্যায়ে এর বিশদ আলোচনা করা হয়েছে। বাস্তবতার যে সময়-ভিত্তিক রূপরেখা, তা এখানে ভেঙে পড়ে এক অলৌকিক, স্মৃতিভিত্তিক, অনিশ্চিত জগতে।

এই টাইম সেন্স সম্পর্কে সাহিত্য সমালোচক ব্রেন্ডা কোপার বলেন,

“Time is poised in a liminal space and in an between time, which having broken out of the binary opposition between circular and linear, gives a third space and a different time the chance to emerge.”

এখানে ‘liminal’ শব্দটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। সময় যেন কোনো নির্ধারিত পথ বা নিয়ম মেনে চলে না, বরং তা এক অন্তর্বর্তী অবস্থা, যেখানে সব কিছু ভাসমান, অসমাপ্ত, একধরনের অনির্দিষ্টতার মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকে। জাদুবাস্তবতার এই সময়চেতনা কেবল কালিক ধারাকে জটিল করে না, বরং এর মধ্যে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থানগত টানাপোড়েনও জড়িয়ে থাকে।

চতুর্দশতম বৈশিষ্ট্য হিসেবে উঠে আসে জাদুবাস্তব আখ্যানের সংলাপের ভিন্নতা। এসব সংলাপে বাস্তবতার সীমা পেরিয়ে অলৌকিক এক ভাষার জন্ম হয়। এই সংলাপগুলো দেখে অনেক সময় পাঠক বিভ্রান্ত হতে পারেন—এগুলো কি কল্পনা, স্বপ্ন, না সত্যি? কিন্তু এখানেই তো জাদুবাস্তবতার মাহাত্ম্য। এই সংলাপগুলো প্রায়ই ঘটেছে জীবিত ও মৃতের মধ্যে, কখনো পশু ও মানুষের মধ্যে, আবার কখনো নিস্প্রাণ বস্তুর সঙ্গে। এটি কোনো পরাবাস্তবতার খেয়াল নয়, বরং বাস্তবতাকেই বিকল্প দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার এক মাধ্যম।

উইলিয়াম কেনেডির ‘Ironweed’ উপন্যাসে দেখা যায়, ফ্রান্সিস হেলেন কবরস্থানে বসে কথোপকথন চালিয়ে যাচ্ছে তার মৃত বাবা-মায়ের সঙ্গে। এমনকি মৃতরা কখনো কবর থেকে উঠে গাড়িতে ঘুরতে বেরিয়ে যায়, কখনো বা বাড়িতে এসে ঘুমায়। এই দৃশ্য আপাতত হাস্যকর বা অলৌকিক মনে হলেও, তা আসলে হেলেনের মনোজগতে জমা হয়ে থাকা দুঃখ, অপরাধবোধ এবং স্মৃতির প্রকাশ। এই সংলাপ মৃতের সঙ্গে, কিন্তু তা জীবনের গভীর এক অভিজ্ঞতার বহিঃপ্রকাশ।

মার্কেসের ‘One Hundred Years of Solitude’-এ দেখা যায়, হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া যখন গাছে বাঁধা, তখন তার সঙ্গী হয় প্রুদেনসিওর আত্মা। মৃত প্রুদেনসিও আসে নিঃসঙ্গতাকে ভাগ করে নিতে। এইভাবে লেখক জীবনের একান্ত নিঃসঙ্গ মুহূর্তে মৃত্যুকেই এনে দেন সঙ্গী হিসেবে। আবার বাংলার আখ্যানে সোহারাব হোসেনের ‘সরম আলির ভুবন’ উপন্যাসে আমরা দেখি সরম আলি কথোপকথন করছে মৃত তোরাপ চাচার সঙ্গে। কথোপকথনের দৃশ্য এখানেও ‘ভৌতিক’, কিন্তু এর ভিতরেই আছে তীব্র বাস্তবতা—গ্রামীণ জীবন, দারিদ্র্য, শোষণ এবং অভাবের বাস্তবতা।

এই ধরনের সংলাপগুলো ‘hallucinatory’ হলেও এগুলোর শিকড় থাকে জীবনের গভীরে। অলৌকিকতা এখানে কোন ভেল্কি নয়, বরং বাস্তবতার এক অন্যরকম প্রক্ষেপণ। এই সংলাপগুলো পাঠকের কাছে একধরনের ধাক্কা তৈরি করে, যাতে সে বুঝে নেয়—সব কিছু দেখা যায় না, শোনা যায় না, তবু অনুভব করা যায়।

এইভাবে আমরা বুঝতে পারি, জাদুবাস্তব আখ্যান একাধারে সময়ের এবং ভাষার কাঠামোকে ভেঙে দিয়ে নতুন এক বাস্তবতার জন্ম দেয়। এই বাস্তবতা কোথাও অতীত, কোথাও স্বপ্ন, কোথাও মৃত্যু, আবার কোথাও অলীক; কিন্তু সব মিলিয়ে তা জীবনকেই প্রকাশ করে। এই সাহিত্য আমাদের শুধু গল্প বলে না, বরং শেখায়—কীভাবে জীবন, মৃত্যু, অতীত, ভবিষ্যৎ আর স্মৃতিকে একসূত্রে বাঁধা যায়। জাদুবাস্তবতার ভাষায় তাই সময় কখনো ছুটে যায়, কখনো আটকে পড়ে; কখনো জীবিতদের মুখে মৃতের কথা শোনা যায়; আবার কখনো সময়ের স্তর ভেদ করে মেলে ইতিহাসের অন্য ভাষ্য। এইসব আখ্যান, এইসব সংলাপ, এইসব সময়ের জট—সব মিলিয়ে গড়ে তোলে এক অলৌকিক বাস্তবতা, যা বাস্তবের চেয়েও বাস্তব, অনুভবের চেয়েও গভীর।

জাদুবাস্তবতা শুধু একটি আখ্যানরীতি নয়, বরং এক অভিজ্ঞতার ভেতরে প্রবেশের দরজা। সেই দরজার ওপারে আছে এক অন্যতর বাস্তবতা, যেখানে অলৌকিকতা, রূপক, স্মৃতি, ইতিহাস, পৌরাণিকতা আর রাজনৈতিক প্রতিবাদ এক অনন্য বুননে গ্রথিত হয়ে ওঠে। সেখানে বাস্তব এবং অবাস্তবের বিভাজনরেখা অস্পষ্ট। প্রায়শই দেখা যায়, কথোপকথনের পরিসরে এমন কিছু চরিত্র, বস্তু কিংবা প্রাণী উপস্থিত হয়, যাদের সাধারণ বাস্তববোধে স্থান দেওয়া যায় না। অথচ তারা আখ্যানের ভেতরে প্রবেশ করে মানুষের সমস্যার মর্মে গিয়ে দাঁড়ায়, এবং কোনো না কোনো সমাধান সূচিত করে।

এই ধরনের এক বিস্ময়কর সংলাপ দেখা যায় গ্যুন্টার গ্রাসের ‘The Tin Drum’ উপন্যাসে। ছোট্ট ওস্কার মাৎজেরাথ একটি বিশেষ ক্ষমতা নিয়ে জন্ম নিয়েছিল—তার শৈশবকাল থেমে আছে, কিন্তু তার মনের অভিজ্ঞতা বহু গভীর। সে কথা বলে তার খেলনা টিন ড্রামের সঙ্গে, এবং তার কথোপকথন গড়ে ওঠে এমনকি যিশু খ্রিস্টের মূর্তির সঙ্গেও। এই মূর্তি শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় প্রতীক নয়, বরং ওস্কারের অন্তর্জগতের নানা দ্বন্দ্ব, ধর্মীয় দ্বিধা এবং রাজনৈতিক অবস্থানের প্রতীকও বটে। এই সংলাপ শুধুমাত্র এক অলৌকিক ঘটনা নয়, বরং সামাজিক-রাজনৈতিক চেতনারই এক বিকল্প ভাষ্য।

একই ধরণের অলৌকিক সংলাপ দেখা যায় নবারুণ ভট্টাচার্যের শক্তিশালী উপন্যাস ‘কাঙাল মালসাট’-এ। সেখানে বাম রাজনীতিতে কোণঠাসা সৎ কর্মী কমরেড আচার্য যখন আত্মিক ও আদর্শিক সংকটে ভোগে, তখন পাথরের স্তালিনের মূর্তি কথা বলে ওঠে। স্তালিনের সেই বাক্যগুলি কেবল কল্পনাপ্রসূত নয়, বরং এক গোটা রাজনৈতিক চিন্তার বহিঃপ্রকাশ। এইভাবে স্তালিন নামক ঐতিহাসিক চরিত্র হয়ে ওঠে কথোপকথনের জীবন্ত অংশ, যা ম্যাজিক রিয়ালিজম-এর অন্যতম রূপকার রূপে অনন্য।

আবার কখনো দেখা যায়, মানুষের সংকটের সময় তাকে পথ দেখাচ্ছে কোনো পশু বা পাখি। এইসব সংলাপে ফেবেলের ঐতিহ্য ঢুকে পড়ে জাদুবাস্তবতার ভেতর। তবে এগুলি শুধুমাত্র রূপক নয়, বরং গভীর সামাজিক সংকটের আলেখ্য। নাইজেরিয়ান লেখক বেন ওকোরি তাঁর ‘The Famished Road’ উপন্যাসে যে অ্যাজারো চরিত্রটি নির্মাণ করেন, সে আসলে দুজগতে বসবাস করা এক বালক, যার বাস্তবতা ও চেতনার সীমা অস্পষ্ট। যখন তার মা পথ হারায়, তখন একটি কচ্ছপ এসে তাকে পথ দেখায়। এখানে কচ্ছপটি শুধুমাত্র একটি প্রাণী নয়, বরং স্বদেশ ও পরিচয়ের সন্ধানদাতা এক প্রতীক, এক পুরাতন জ্ঞানবাহী প্রাণী। এই সংলাপ প্রতীকময় হলেও, তা বাস্তবের সীমানা অতিক্রম করে না—বরং বাস্তবতাকেই এক গভীর বোধে রূপান্তরিত করে।

এমন একটি প্রেক্ষিত আমরা দেখি ভারতীয় লেখক কিন্নর রায়ের ‘ধুলিচন্দন’ উপন্যাসেও। এই উপন্যাসে এক বিশাল হাতি বন ধ্বংস এবং মাওবাদী সহিংসতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাচ্ছে। শুধু তাই নয়, সে সংবাদমাধ্যমের সামনে দাঁড়িয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবও দিচ্ছে। এই ধরনের সংলাপ অস্বাভাবিক বলেই মনে হতে পারে, কিন্তু এই অলৌকিকতার মধ্যেই লেখক রাষ্ট্র, নাগরিকতা, পরিবেশ ও সহিংসতার এক রাজনৈতিক ভাষ্য নির্মাণ করেছেন। এক পশুর মাধ্যমে মানুষের অবিবেচনাপূর্ণ কাজকে লেখক প্রকাশ করেছেন, যেন এক মানবিক ব্যর্থতার আয়নায় প্রতিবিম্বিত হয় এই হাতি।

এই সমস্ত সংলাপ নির্মাণের ভেতরে লুকিয়ে আছে এক জটিল শৈলীর ব্যাকরণ। এখানেই উঠে আসে পঞ্চদশতম বৈশিষ্ট্য, যেটি হল বারোক রচনাশৈলী। আলেয়ো কার্পেন্তিয়ের এই রচনাশৈলীর প্রবক্তা হিসেবে দেখিয়েছেন কিভাবে লাতিন আমেরিকার প্রকৃতি, ধর্ম, ইতিহাস এবং রাজনীতি মিলেমিশে একটি গঠনে পৌঁছায়, যেটি হয় ‘বারোক’। বারোক ধারায় থাকে প্রচণ্ড রকম রূপক ও প্রতীক, ব্যাকরণগত ব্যতিক্রম এবং ভাষার প্রচণ্ড গতি ও অলংকার। এটি কেবল অলঙ্কার নৈপুণ্য নয়, বরং এক ধরনের দার্শনিক দর্শনও। যেমন, ‘The Kingdom of This World’ উপন্যাসে হাইতির দাস বিদ্রোহ, ধর্মীয় মিথ এবং রাজনীতি এক অদ্ভুত ব্যঞ্জনায় আবর্তিত হয়েছে। কার্পেন্তিয়ের এখানে বাস্তবকে এমনভাবে মিথ ও অলৌকিকতার মধ্য দিয়ে দেখান, যা একমাত্র জাদুবাস্তব আখ্যানে সম্ভব।

জাদুবাস্তবতার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল, প্রকৃতির অংশগ্রহণ। আখ্যানের পরতে পরতে প্রকৃতি কেবল এক পটভূমি নয়, বরং এক সক্রিয় চরিত্র হয়ে ওঠে। প্রাকৃতিক উপাদান যেমন জোয়ার-ভাটা, বৃষ্টিপাত, গাছপালা, নদী, কিংবা গন্ধ—সবই এখানে এক জীবন্ত অস্তিত্ব লাভ করে। যেমন, কার্পেন্তিয়েরের ‘The Lost Steps’ উপন্যাসে দেখা যায়, আধুনিক জীবন থেকে ক্লান্ত এক সঙ্গীতশিল্পী লাতিন আমেরিকার পুরানো লোকবাদ্যযন্ত্রগুলোর সন্ধানে বেরিয়ে পড়ে। প্রকৃতি এখানে হয়ে ওঠে এক নির্জন উপাসনাস্থল, যেখানে শিল্পী খুঁজে পায় এক ধ্রুপদী পবিত্রতা। প্রকৃতির এই আখ্যান-ভিত্তিক অংশগ্রহণে জাদুবাস্তবতা এক অদ্ভুত অন্তর্মুখী আবেগ ধারণ করে।

আবার কখনো প্রকৃতি হয়ে ওঠে অতীতের দরজা। রবিশংকর বলের ‘ছায়াপুতুলের খেলা’ উপন্যাসে আয়নার দিকে তাকালেই কথক পৌঁছে যায় তার উদ্বাস্তু জীবনের অভিজ্ঞতায়। এই প্রতিচ্ছবি কেবলমাত্র চেহারার নয়, বরং স্মৃতির, ইতিহাসের, বেদনার—যার মাধ্যমে আখ্যান বাস্তবতার বাইরে গিয়ে অতীতের অনভিজ্ঞ জগতে প্রবেশ করে। এই ‘reflected memory’ পাঠককে নিয়ে যায় তার নিজের জীবনের প্রতিচ্ছবির সামনে।

আবার কখনো এমন হয়, বস্তুর মধ্যেই জন্ম নেয় জীবন্ত প্রতিক্রিয়া। মার্কেসের সেই বিখ্যাত দৃশ্য—হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়ার মৃত্যু সংবাদ উরসুলার কাছে পৌঁছে যায় রক্তের প্রবাহে ভেসে। এই রক্ত যেন একটি চেতনাসম্পন্ন সত্তা, যে জানে কোথায় যেতে হবে, কী বার্তা পৌঁছে দিতে হবে। এটি অলৌকিক, অথচ বাস্তবতারই এক আকার। বাস্তবতা এখানে রূপক, স্মৃতি, এবং আবেগের গঠনে রূপান্তরিত।

এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, জাদুবাস্তবতা কখনোই বাস্তবতাকে এড়িয়ে চলে না। বরং, সেই বাস্তবতাকেই আরও জটিল, গভীর এবং বহুমাত্রিক করে তোলে। অলৌকিকতা, মিথ, প্রতীক কিংবা ভাষার গতি—সবই ব্যবহৃত হয় বাস্তবতার গভীরতর অর্থ প্রকাশের জন্য। তাই জাদুবাস্তবতাকে এক ধরনের ‘heightened realism’ বলা চলে, যা বাস্তবতার অন্তর্নিহিত রূপকে দৃশ্যমান করে তোলে।

এই ধারার সাহিত্যে, রাজনীতি, ইতিহাস, সমাজ, ধর্ম এবং সংস্কৃতি—সবই প্রবেশ করে এক বহুত্ববাদী আখ্যানের ভিতরে। একটি প্রাণহীন ছবি কথা বলে, একটি হাতি প্রতিবাদ করে, একটি মৃত আত্মা ফিরে আসে পথ দেখাতে—এই সবকিছুই শুধু বিস্ময় সৃষ্টি করার জন্য নয়, বরং আমাদের চারপাশের বাস্তবতা ও সত্যকে নতুন করে উপলব্ধির জন্য।

এইভাবে জাদুবাস্তবতা হয়ে ওঠে একটি বীক্ষার মাধ্যম—যার সাহায্যে আমরা দেখতে পাই সেইসব দিক, যা দৈনন্দিন বাস্তবতার মধ্যে অদৃশ্য। লেখকেরা এই শৈলী ব্যবহার করে শাসকের চোখ এড়িয়ে, কিংবা ইতিহাসের ছাঁটাই থেকে বাঁচিয়ে, একটি নতুন সত্য, নতুন উপলব্ধি ও নতুন রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা নির্মাণ করেন। বাস্তবতাকে অলৌকিকতার ভিতর দিয়ে ফের পাঠ করানোই জাদুবাস্তবতার চূড়ান্ত রূপ—যেখানে পাথরের মূর্তিও কথা বলে ওঠে, কচ্ছপ পথ দেখায়, আর স্মৃতির আয়নায় ভেসে ওঠে এক বিস্মৃত অতীত।

ম্যাজিক রিয়ালিজম: আধুনিক সাহিত্য আন্দোলনের প্রতিফলন

এক

নিঃসন্দেহে, ‘ম্যাজিক রিয়ালিজম’ একটি স্বতন্ত্র ও বহুবিধ অর্থে সমৃদ্ধ সাহিত্যিক পরিভাষা। এই শব্দবন্ধটি মূলত দুটি স্বতন্ত্র শব্দের সমন্বয়ে গঠিত—একটি হলো ‘ম্যাজিক’ (Magic), অপরটি ‘রিয়ালিজম’ (Realism)। এই দুটি শব্দ একত্রে বসে যে সাংস্কৃতিক, দার্শনিক ও সাহিত্যিক অভিঘাত তৈরি করে, তা নিঃসন্দেহে আধুনিক কথাসাহিত্যের অন্যতম গভীর ও বিচিত্র অভিব্যক্তি হিসেবে চিহ্নিত।

‘ম্যাজিক’ শব্দটির শাব্দিক ব্যুৎপত্তিগত বিশ্লেষণ আমাদের নিয়ে যায় প্রাচীন গ্রিক শব্দ ‘mageia’-র কাছে। এই শব্দের মূল উৎপত্তি আরও পুরাতন পারস্য সভ্যতার ‘magus’ থেকে—যা মূলত এক ধরনের পুরোহিত শ্রেণিকে বোঝাতে ব্যবহৃত হতো, যারা প্রকৃতি ও তার রহস্য উদ্ঘাটনে পারদর্শী ছিলেন। গ্রিকরা যখন এই শব্দটি গ্রহণ করে, তখন তারা এর মধ্যে অলৌকিকতার একটি তীব্র আবেশ খুঁজে পান। পরবর্তীতে পাশ্চাত্য অভিধানে এই শব্দটির ব্যাখ্যা ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভিন্ন আঙ্গিকে পরিবেশিত হয়েছে। ১৭৬৮ সালে প্রকাশিত Encyclopaedia Britannica-তে ম্যাজিক নিয়ে যেভাবে বিশদ আলোচনা করা হয়েছে, তা মূলত ইউরোপীয় যুক্তিবাদের পটভূমিতে গড়ে ওঠা সমাজচিন্তার প্রতিফলন। সেখানে স্পষ্টভাবে ম্যাজিককে দুটি ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে—‘White Magic’ ও ‘Black Magic’। সামাজিক নীতিনৈতিকতা ও ধর্মীয় রক্ষণশীলতার চাপে ‘Black Magic’ পরবর্তীকালে প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। কিন্তু ‘White Magic’—অর্থাৎ কল্যাণকামী, বিস্ময়জাগানো, প্রায় ঈশ্বরিক শক্তিসম্পন্ন অলৌকিকতা—সেই ধারণাটিই ধীরে ধীরে গ্রহণযোগ্য হয়েছে এবং আধুনিক সাহিত্যে এর প্রতিস্থাপন ঘটেছে।

তবে সাহিত্যে ‘ম্যাজিক’ শব্দটি কখনোই ক্লাসিক ম্যাজিক-শোর চমক বা কুসংস্কারের জগতে আবদ্ধ নয়। বরং এখানে ‘ম্যাজিক’ এক রহস্যময় ব্যতিক্রম, এক অন্তর্জাগতিক অভিঘাত—যা বাস্তবতার চেনা নিয়মে বাঁধা পড়ে না। যে ঘটনা ঘটছে, তা বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে ব্যাখ্যাতীত, অথচ পাঠক তাতে আশ্চর্য হলেও তাকে অবিশ্বাস করতে পারে না। এই ‘ম্যাজিক’ আসলে সাধারণ সমাজ-বাস্তবতার অতল পরত থেকে উঠে আসা এক গূঢ় উপলব্ধি, যার ভিত্তিতে সমাজের প্রান্তিক শ্রেণি, ঐতিহ্যগত আচার-আচরণ, লোকবিশ্বাস, বা জাতিগত স্মৃতি কখনো পরিণত হয় অলৌকিকতা বা বিষ্ময়-ঘটনায়।

অন্যদিকে, ‘রিয়ালিজম’ শব্দটির ইতিহাস অপেক্ষাকৃত পরিস্কার। এর উৎপত্তি দর্শনের জগতে হলেও সাহিত্যিক পরিসরে এর উত্থান ঘটে উনিশ শতকের মধ্যভাগে, ইউরোপীয় সমাজে শিল্পবিপ্লব-উত্তর বাস্তবতার হাত ধরে। তখন সাহিত্যিকদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল সমাজ, পরিবার, অর্থনীতি, ব্যক্তি ও শ্রেণিচেতনার সত্য উদঘাটন। বাস্তবতা বলতে বোঝানো হত দৈনন্দিন জীবনের কঠোর নৈর্ব্যক্তিক চিত্রণ, যেখানে অলঙ্কার, রূপকথা বা অতিলৌকিক উপাদান নিষিদ্ধ ছিল। ফ্লবেয়ার, বালজাক, ডিকেন্স, টলস্টয় প্রমুখ লেখকরা এই বাস্তবতার চিত্রকে সাহিত্যে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন নানা আঙ্গিকে। তবে রিয়ালিজম কখনোই নিছক বস্তুজগতের ফটোগ্রাফি নয়—বরং তার লক্ষ্য ছিল মানুষের অভিজ্ঞতা, সংকট ও দ্বন্দ্বকে এমনভাবে তুলে ধরা, যাতে পাঠক তার নিজের জীবনেরই প্রতিবিম্ব খুঁজে পান।

‘ম্যাজিক রিয়ালিজম’ শব্দবন্ধের বৈপ্লবিক দিকটি এখানেই—যেখানে ‘ম্যাজিক’ আর ‘রিয়ালিজম’ একে অপরের প্রতি বিরোধী হলেও, তাদের সহাবস্থান হয় নিখুঁতভাবে। প্রথমবারের মতো এই পরিভাষাটি ব্যবহার করেন জার্মান শিল্প সমালোচক ফ্রান্ৎস রো (Franz Roh), ১৯২৫ সালে চিত্রকলার একটি ধারাকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে। তিনি বলেছিলেন যে, শিল্পকর্মে বাস্তবতার ভেতরে একধরনের গূঢ়তা ও রহস্য গেঁথে থাকে, যা ‘Post-Expressionism’ বা ‘Magischer Realismus’ নামে চিহ্নিত হতে পারে। পরবর্তীতে, এই পদ্ধতি সাহিত্যে প্রবেশ করে এবং বিশেষত লাতিন আমেরিকার লেখকদের মাধ্যমে এটি পূর্ণতা লাভ করে। গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস, কার্পেন্তিয়ের, বোর্হেস, হুয়ান রুলফো, আস্তুরিয়াস, ইসাবেল আয়েন্দে প্রমুখ লেখকরা এই শৈলীকে সাহিত্যের কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসেন।

ম্যাজিক রিয়ালিজমে আমরা দেখতে পাই—বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতা এক গা ছমছমে অলৌকিক পরিমণ্ডলের ভেতর দিয়ে বর্ণিত হচ্ছে। কিন্তু তাতে কখনোই বাস্তবতা অস্বীকৃত হয় না। বরং যে বাস্তবতা মূলধারার ইতিহাস বা রাজনৈতিক বয়ানের ভেতর নিখোঁজ হয়ে যায়—সেই বাস্তবতাকে অলৌকিকের ছায়ায় ফিরিয়ে আনা হয়। মার্কেসের One Hundred Years of Solitude উপন্যাসে যেমন দেখি, একজন মৃত ব্যক্তির রক্ত নিজের পথ চেনে এবং ছেলের মৃত্যুসংবাদ দিতে যায় মায়ের কাছে। এই দৃশ্য অলৌকিক হলেও পাঠকের কাছে তা বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে, কারণ বাস্তব জীবনের দুঃখ, ক্ষয় ও স্মৃতির জোরে তা নির্মিত হয়েছে।

আবার ধরুন শহীদুল জহিরের সে রাতে পূর্ণিমা ছিল—এই উপন্যাসে সময়ের ভেতরে প্রবেশের যে কৌশল ব্যবহৃত হয়েছে, তা কেবল ম্যাজিক রিয়ালিজমেই সম্ভব। লেখক তাঁর কথাসাহিত্যকে গড়ে তুলেছেন এমন এক কাঠামোয়, যেখানে সময় কখনোই রৈখিক নয়। অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ একে অপরের মধ্যে মিশে গিয়ে তৈরি করেছে এক অনন্য বাস্তব অভিজ্ঞতা। ব্রেন্দা কুপারের ভাষায়,

“Time is poised in a liminal space… gives a third space and a different time the chance to emerge.”

এই তৃতীয় স্থানই আসলে ম্যাজিক রিয়ালিজম-এর সময়বোধ, যা চেনা সময়ের ধারণাকে বিঘ্নিত করে।

এখানে এক বিশেষ বিষয় লক্ষণীয়, ম্যাজিক রিয়ালিজম কখনোই রূপকথা নয়, কল্পবিজ্ঞান নয়, কিংবা কুসংস্কার-নির্ভর অলৌকিক সাহিত্যও নয়। বরং এটি এক ধরণের রাজনৈতিক, ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক ‘কাউন্টার ন্যারেটিভ’। যেখানে রাষ্ট্র বা শাসকগোষ্ঠী যে সত্য গোপন করে রাখে—সেই সত্য জাগিয়ে তোলে ‘ম্যাজিক’। এই ধারায় উঠে আসে প্রান্তিক গোষ্ঠীর আত্মজীবনী, অবদমিত ইতিহাস, ঔপনিবেশিক নির্মমতা, স্থানচ্যুতি, পরাধীনতা, ধর্মীয় বা জাতিগত দমন।

এই প্রসঙ্গে রবিশংকর বলের দোজখনামা বা ছায়াপুতুলের খেলা উল্লেখযোগ্য। এই উপন্যাসগুলোতে দেখা যায় মৃত মানুষদের কণ্ঠস্বর আবারও ফিরে আসে ইতিহাসের চেপে রাখা অধ্যায়গুলি খুলে দিতে। এই মৃত কণ্ঠগুলো কখনো প্রেতাত্মা, কখনো প্রতিচ্ছবি, কখনো স্মৃতি হয়ে আমাদের সামনে দাঁড়ায়। এদের মুখে যা বলা হয়, তা কোনো অলীক আশ্চর্য নয়—বরং ইতিহাসের অপ্রকাশিত বাস্তবতারই প্রতিধ্বনি।

তাই বলা যায়, ‘ম্যাজিক রিয়ালিজম’ শব্দবন্ধে ‘ম্যাজিক’ মানে কেবল চমক নয়, বরং তা এক ব্যতিক্রমী দৃষ্টিভঙ্গি, যা সমাজ, ইতিহাস, সংস্কৃতি ও স্মৃতিকে নতুনভাবে পাঠ করে। ‘রিয়ালিজম’ মানে কেবল বাহ্যিক বাস্তবতার অনুলিপি নয়, বরং অন্তরতম সত্যের ব্যঞ্জনা। এই দুইয়ের সংমিশ্রণে জন্ম নেয় এক ধরণের সাহিত্যিক অভিজ্ঞতা, যা একইসাথে আবেগময়, রহস্যময়, এবং রাজনৈতিক।

এই শৈলীতে বিশ্বাসযোগ্যতার ভিত্তি গড়ে ওঠে অনুভব, অভিজ্ঞতা, বিশ্বাস, স্মৃতি এবং ঐতিহ্যের ওপর। এই বিশ্বাস কেবল পাঠকের নয়, বরং চরিত্রের নিজের মধ্যেও থাকে—যার ফলে যতই অলৌকিক বা অদ্ভুতই হোক না কেন, পাঠক তা মেনে নেয়, কারণ আখ্যানের অভ্যন্তরীণ যুক্তি ও গঠনতন্ত্র তাকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলে।

সাহিত্যের ইতিহাসে যেসব মুহূর্তে বাস্তবতা ব্যর্থ হয়েছে—সেই মুহূর্তগুলোতে ম্যাজিক রিয়ালিজমই উন্মোচন করেছে সেই বাস্তবতার গভীরতর রূপ। অলৌকিকের মায়া দিয়ে গাঁথা হলেও, এই সাহিত্যধারা সর্বদাই যুক্তিবোধ, সচেতনতা ও রাজনৈতিক দায়বদ্ধতায় নির্মিত। তাই ম্যাজিক রিয়ালিজম কেবল একটি শৈলী নয়, বরং এক দর্শন, এক কাব্যিক প্রতিরোধ, এক চেতনাশীল প্রতিবাদ। সেই দৃষ্টিকোণ থেকেই এই ধারাটি আজও প্রাসঙ্গিক, উদ্দীপক ও প্রভূত পাঠ-উপযোগী।

অষ্টাদশ ও উনিশ শতকের ইউরোপীয় সাহিত্যে ‘বাস্তবতা’ শব্দটি কেন্দ্রীয় বিষয় হয়ে উঠেছিল। শিল্পবিপ্লবোত্তর সময়ে মানুষ যখন সমাজ, রাজনীতি, শ্রম ও ব্যক্তির অবস্থান নিয়ে নতুনভাবে ভাবতে শুরু করে, তখন সাহিত্যের ভূমিকাও বদলাতে থাকে। লেখকের কাছে সাহিত্য আর নিছক কল্পনার অবগাহন নয়, বরং এক সামাজিক দলিল, বাস্তবতার অনুপুঙ্খ চিত্রায়ন। এই চাহিদারই ফলস্বরূপ প্রথমে বাস্তববাদ (Realism), পরে যথাস্থিতবাদ বা ন্যাচারালিজম (Naturalism), তারপরে সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতা (Socialist Realism), এবং সর্বশেষে পরাবাস্তববাদ (Surrealism) ও জাদুবাস্তবতা (Magic Realism) পরপর আবির্ভূত হয়। এই ধারাগুলোর ক্রমবিকাশের ইতিহাস বুঝলেই পরিষ্কার হয়ে যায়—ম্যাজিক রিয়ালিজম কেন এত গভীরভাবে মানব-চেতনায় স্থান করে নিয়েছে এবং সাহিত্যের ভূগোলে এক বিশেষ অবস্থান দখল করেছে।

বাস্তববাদের (Realism) প্রাথমিক উৎস ছিল একটিই—বাস্তব জীবনকে, যতটা সম্ভব নিখুঁতভাবে, সাহিত্যে প্রতিফলিত করা। চরিত্রদের আবেগ, সমাজের অনিয়ম, ইতিহাসের চালচিত্র সবই এই ধারার মধ্যে উঠে আসে। ফ্রান্সে গুস্তাভ ফ্লবেয়ারের Madame Bovary কিংবা ইংল্যান্ডে চার্লস ডিকেন্সের Great Expectations—সবই বাস্তবতার নিরিখে মানুষের সংগ্রাম ও সমাজের অসঙ্গতিকে তুলে ধরতে সচেষ্ট। তবে এই ধারায় কল্পনা বা অলৌকিকতা ছিল একেবারে পরিত্যাজ্য। একমাত্র যেটুকু স্থান পেয়েছিল, তা ছিল যুক্তিগ্রাহ্য মানবিক অনুভব।

ম্যাজিক রিয়ালিজম থেকে সাহিত্য আন্দোলন: এক সাহিত্যিক অভিযাত্রা
চিত্রঃ চার্লস ডিকেন্স, Image Source: Google

কিন্তু একসময় দেখা গেল, নিছক বাস্তব চিত্রায়ন দিয়ে সমাজের গভীর অসন্তোষ, অবদমন, শ্রেণি-সংঘাত ইত্যাদি পুরোপুরি বোঝানো যায় না। ফলে ১৮৬৮ সালে এমিল জোলা (Emile Zola) নেতৃত্বে একদল লেখক ‘ন্যাচারালিজম’ নামে নতুন একটি সাহিত্যরীতির সূচনা করলেন। এখানে লেখক নিজেকে এক রকম বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষক হিসেবে ভাবলেন—যিনি কল্পনা ত্যাগ করে বাস্তবতার পিছনের মূল ‘কারণ’ অনুসন্ধান করবেন। অর্থাৎ, ব্যক্তি কেন নিরাশ্রয়, কেন বিপথগামী, কেন সমাজচ্যুত—এইসব প্রশ্নের উত্তর সমাজতাত্ত্বিক ও বিজ্ঞানসম্মত যুক্তিতে খোঁজা শুরু হল। জোলা নিজে তাঁর সাহিত্যকর্মকে এক ধরনের পরীক্ষাগার হিসেবে ব্যাখ্যা করেছিলেন, যেখানে চরিত্র ও পরিবেশ একে অপরকে নির্ধারণ করে।

এরপর উনবিংশ শতকের শেষে ও বিংশ শতকের শুরুর দিকে সমাজে আর এক নতুন প্রশ্ন উঠল—বিশ্ব পুঁজিবাদের উত্তরণ এবং শ্রমিক শ্রেণির আত্মপ্রতিষ্ঠার। এই দৃষ্টিকোণ থেকেই জন্ম নেয় ‘সোশ্যালিস্ট রিয়ালিজম’। ১৯০৭ সালে ম্যাক্সিম গোর্কি নেতৃত্বে রাশিয়ায় শুরু হওয়া এই সাহিত্য আন্দোলন সমাজতান্ত্রিক চেতনাকে সাহিত্যিক কাঠামোয় সংস্থাপন করল। এখানে সাহিত্য শুধু সমাজের চিত্রায়ন নয়, বরং সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার হয়ে উঠল। প্রোলেতারিয়েত শ্রেণিকে সামনে রেখে বিপ্লব, সংগ্রাম, আশা ও ভবিষ্যতের শ্রেণিহীন সমাজ এই ধারার মূল উপজীব্য হয়ে দাঁড়াল। লেখকরা চেয়েছিলেন, সাহিত্য সমাজে আশার বীজ বপন করুক—বিপ্লবকে উজ্জীবিত করুক।

এই দুই ধারার পাশাপাশি একদল লেখক তখন উপলব্ধি করতে থাকলেন, বাস্তবতা বলতে শুধু বাইরের জগত নয়, বরং ব্যক্তির অন্তর্জগৎ, অবচেতন মনও। বিশেষত প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর মানুষের ভেতরে যে বিভ্রান্তি, ভয়, অসারতা, হিংসা ও মানসিক ক্লান্তি জন্ম নিয়েছিল, তাকে ব্যাখ্যা করার জন্য যুক্তিবাদ ব্যর্থ হতে লাগল। সেই সময়েই ১৯২৪ সালে ফরাসি কবি আন্দ্রে ব্রেতোঁ (Andre Breton) Surrealist Manifesto প্রকাশের মাধ্যমে সূচনা করলেন Surrealism—অর্থাৎ পরাবাস্তববাদ। এই আন্দোলন বিশ্বাস করত, যুক্তি নয়, বরং অবচেতন মন, স্বপ্ন, ফ্যান্টাসি, হ্যালুসিনেশন, লিবিডো ও অতিরিক্ত ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যতা—এইসবই সাহিত্যের উপাদান হওয়া উচিত। ফ্রয়েডের মনোবিশ্লেষণ তত্ত্ব এই ধারার পেছনে দার্শনিক প্রেরণা জুগিয়েছিল। এই ধারায় লেখকগণ বাস্তব জগতকে স্বপ্নের ভিতর দিয়ে দেখেছিলেন—যার ফলে সমাজের গভীর গোপন মনস্তাত্ত্বিক বাস্তবতাও ধরা পড়েছিল।

এই সময়ে, প্রায় সমান্তরালভাবে, ১৯২৫ সালে জার্মান চিত্রসমালোচক ফ্রান্ৎস রো ‘Magischer Realismus’ শব্দবন্ধটি ব্যবহার করেন। যদিও তাঁর প্রেক্ষাপট ছিল চিত্রশিল্প, বিশেষত পোস্ট-এক্সপ্রেশনিজম-এর নিরীক্ষাপ্রসূত রেখাচিত্র। তিনি দেখিয়েছিলেন কিভাবে শিল্পীরা দৈনন্দিন বাস্তব চিত্রের ভেতরে এক প্রকার গূঢ়তা, অতিপ্রাকৃত রহস্য, ও অধরা সূক্ষ্মতা নির্মাণ করেন, যা শুধু বাহ্যত দৃশ্যমান নয়। পরবর্তীতে এই তত্ত্বটি সাহিত্যে আসে, বিশেষ করে স্প্যানিশভাষী লাতিন আমেরিকান সাহিত্যে, যেখানে ঔপনিবেশিক ইতিহাস, প্রান্তিকতা, আদিবাসী সংস্কৃতি ও বহুস্বরিক জাতিগত স্মৃতি মিলে তৈরি করে এমন এক সাহিত্যভূমি, যেখানে বাস্তবতার সঙ্গে অসম্ভব-অলৌকিকতা এমনভাবে মিশে যায় যে আলাদা করা যায় না।

এখানেই ম্যাজিক রিয়ালিজম নিজেকে স্বতন্ত্র করে তোলে। একদিকে তার রয়েছে রিয়ালিজমের ভিত্তি—অর্থাৎ সমাজ-ইতিহাস-মানবজীবনের প্রামাণ্য বয়ান, আবার অন্যদিকে ‘ম্যাজিক’-এর অলৌকিক-রূপান্তরবাদী পরিমণ্ডল। এই ধারাটি কোন কাল্পনিক জগৎ নির্মাণ করে না, বরং বাস্তব জগতে এমন সব ঘটনা ও অভিজ্ঞতা অন্তর্ভুক্ত করে, যা সাধারণ যুক্তি বা বিজ্ঞানে ব্যাখ্যা করা যায় না—কিন্তু সেই সংস্কৃতির মানুষদের কাছে তা বিশ্বাসযোগ্য। যেমন গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস তাঁর One Hundred Years of Solitude উপন্যাসে এমন একটি জনপদ গড়ে তুলেছেন—যেখানে মৃত মানুষেরা ফিরে আসে কথা বলতে, সময় ঘুরে ঘুরে ফিরে আসে, কিংবা রক্ত নিজে নিজে হেঁটে মায়ের কাছে চলে যায়।

অথচ এইসবই লেখা হয়েছে এমন ভঙ্গিতে, যেন তারা দৈনন্দিন ঘটনা—এতে নেই কোনো অতিশয় বিস্ময় প্রকাশ, নেই নাটকীয়তা। কারণ এগুলোর প্রতি আস্থা আছে সেই সমাজের। এই দৃষ্টিভঙ্গি—অর্থাৎ ম্যাজিককে বাস্তবতার সমান্তরাল বিশ্বাস হিসেবে প্রতিষ্ঠা—এই ধারার মূল কৌশল। ব্রাজিলের লেখক হোর্হে আমাদু, কিউবার কার্পেন্তিয়ের, গ্বাতেমালার আস্তুরিয়াস, মেক্সিকোর হুয়ান রুলফো প্রমুখ লেখক এই ধারায় সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। পরে ভারত, বাংলাদেশ, আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যেও এই ধারার বিস্তার ঘটে।

এখানে একটি বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ—যেখানে পূর্ববর্তী সাহিত্য আন্দোলনগুলো সমাজ, মন বা বাস্তবতার একটি মাত্রায় কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল, ম্যাজিক রিয়ালিজম সেখানে বহু মাত্রিকতা ও বহু বাস্তবতার (plural realities) ধারণা দেয়। এই ধারায় একই সঙ্গে বর্তমান, অতীত, ভবিষ্যৎ, জীবিত, মৃত, প্রান্তিক, কেন্দ্রীয়, ইতিহাস, কল্পনা—সব এক সঙ্গে সমবেত হয়। এটিই এর স্বাতন্ত্র্য।

লাতিন আমেরিকায় ম্যাজিক রিয়ালিজম-এর জনপ্রিয়তা এত বেশি ছিল বলেই গার্সিয়া মার্কেস নোবেল পুরস্কার পান, এবং তাঁর লেখাকে বিশ্বসাহিত্য এক নতুন স্তরে স্বীকৃতি দেয়। তবে এর বিস্তার শুধু স্প্যানিশ ভাষাতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। বাংলা সাহিত্যে শহীদুল জহির, মহাশ্বেতা দেবী, নবারুণ ভট্টাচার্য, রবিশংকর বল, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, সৈয়দ মুজতবা সিরাজ, এমনকি আবুল বাশারদের লেখায়ও এই ধারা প্রত্যক্ষ করা যায়।

সর্বোপরি, ম্যাজিক রিয়ালিজম তার শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করেছে কারণ এটি কেবল সাহিত্য নয়, বরং ইতিহাসের বিকল্প পাঠ, শাসকের বয়ান ভেঙে দেওয়া, প্রান্তিক ভাষ্যগুলোর চিৎকার হয়ে ওঠা। বাস্তবতাকে অবিকল নয়, বরং অনুভব ও ঐতিহ্যের দৃষ্টিতে নতুনভাবে পড়ে নেওয়ার যে ক্ষমতা এই ধারায় রয়েছে, অন্য কোন সাহিত্য আন্দোলনে তা এত গভীরভাবে উপস্থিত নয়। তাই এ শুধু একটি সাহিত্য মোড নয়, বরং এক বহুমাত্রিক বাস্তবতার চেতনা—যা মানবজীবনের ভাঙাচোরা ইতিহাস ও স্বপ্নকে একসাথে বয়ে নিয়ে যায়।

দুই

অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে দর্শনের জগতে ‘আইডিয়ালিজ্‌ম’-এর বিরুদ্ধধারায় যে ‘রিয়ালিজম’ শব্দটির উত্থান ঘটেছিল, তা ক্রমে সাহিত্যের ভুবনেও প্রবেশ করে। তখনো এর অর্থ ছিল ‘বহির্জগতের বাস্তবতা’—মানে একধরনের অবজেক্টিভ, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য, প্রমাণযোগ্য বাস্তব জগৎ, যা মানুষের চেতনার বাইরে অস্তিত্বশীল। এই ধারনাকে সাহিত্যে রূপ দিতে প্রথম এগিয়ে এলেন শিলার ও শ্লেগেল। তাঁরা সাহিত্যে ‘external reality’ অর্থে রিয়ালিজম শব্দটির ব্যবহার শুরু করলেন। এই সূত্র ধরেই উনিশ শতকের মাঝামাঝি ফ্রান্সে লেখকগণ অনুভব করলেন, কল্পনার রাজ্য থেকে সাহিত্যকে নামিয়ে আনা প্রয়োজন বাস্তব জীবনের রূঢ় সত্যের মাটিতে।

এই সময় শিল্পবিপ্লব, প্রযুক্তির প্রসার, নগরায়ণ, গণমাধ্যমের বিকাশ ইত্যাদি ইউরোপের সামাজিক ও রাজনৈতিক কাঠামোকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। পুঁজিবাদী আর্থিক কাঠামোর রমরমা প্রসারের মধ্যেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল—যাঁরা কেন্দ্রে রয়েছেন, তাঁরা উন্নয়নের ফসল ঘরে তুলছেন, কিন্তু যাঁরা প্রান্তে, শ্রমিক শ্রেণি, কৃষক, অভিবাসী, মহিলা, শিশু—তাঁদের জীবন হয়ে উঠছে আরও বেশি ক্লিষ্ট, জর্জরিত ও পরাভব-আক্রান্ত। সাহিত্যের দৃষ্টিভঙ্গি তখন বদলাল। আর এই পরিবর্তনের অন্যতম পথিকৃৎ হলেন বালজাক। তাঁর বাস্তববাদী বিশ্লেষণ, চরিত্র নির্মাণের সূক্ষ্মতা, সামাজিক ব্যাখ্যায় নিখুঁত দক্ষতা তাঁকে ফরাসি রিয়ালিজমের মূল ভিত্তি করে তুলল।

১৮৫৭ সালে প্রকাশিত শাঁফ্লুরির Le Realisme নামক গ্রন্থে রিয়ালিজমের সাহিত্যিক ধারণার ভিত সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। ওই বছরেই ফ্লবেরের Madame Bovary যখন প্রকাশিত হল, সাহিত্যের ইতিহাসে যেন এক যুগান্তর সূচিত হল। এই উপন্যাসে ফ্লবের তাঁর চরিত্র এমা বোভারির মাধ্যমে ফ্রান্সের মধ্যবিত্ত নারীজীবনের ক্লান্তিকর, স্বপ্নহীন ও অন্তঃসারশূন্য বাস্তবতার এক নির্মম ছবি আঁকলেন—যা এতদিন সাহিত্যে অনুপস্থিত ছিল।

ফ্রান্স থেকে এই বাস্তববাদ ছড়িয়ে পড়ল গোটা ইউরোপে। রাশিয়ায় লিও টলস্টয় ও দস্তয়েভস্কির সাহিত্যজগতে বাস্তবতার এই প্রবণতা দেখা যায়—যেখানে সমাজতাত্ত্বিক ও নৈতিক প্রশ্নগুলো সাহিত্যের মূল ভিত্তি হয়ে দাঁড়াল। ইংল্যান্ডে চার্লস ডিকেন্স শ্রমজীবী মানুষের জীবন, শিশুদের দুর্দশা এবং ধনিক শ্রেণির নির্লজ্জ শোষণের বিরুদ্ধে কলম ধরলেন। হেনরি জেমস আবার মনস্তাত্ত্বিক বাস্তবতার দিকটিকে সামনে নিয়ে এলেন। এইভাবে সাহিত্যে ‘বাস্তবতা’ রূপান্তরিত হল এক নতুন দৃষ্টিকোণে, যা কল্পনা, আদর্শ, অতিরঞ্জন ও রোমান্টিকতা থেকে দূরে, বরং বাস্তব মানুষের বাস্তব দুঃখ-কষ্ট, ক্লেশ, আনন্দ ও প্রতিবাদের গাথা।

আমেরিকায় উইলিয়াম হাওয়েলস এই ধারার অগ্রদূত হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। তিনিও বিশ্বাস করতেন, সাহিত্যকে হতে হবে বাস্তব জীবনের প্রতিচ্ছবি—যেখানে মানুষের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা, সমাজের চাপ, দারিদ্র্য, দুঃখ ও সংগ্রাম মুখ্য হবে।

প্রশ্ন উঠতে পারে, এই ধারার জন্ম কেন? একথা বলাই যায়, উনিশ শতকের ইউরোপে শিল্পের বিকাশ, পুঁজিবাদের বিস্তার, বৈজ্ঞানিক চিন্তা, ইতিহাস ও সমাজতত্ত্বের উত্থান—এসবই লেখকদের সামনে এক নতুন বাস্তবতার দ্বার খুলে দিল। তাঁরা আর কল্পনার কুহকেই যথেষ্ট মনে করলেন না। বরং চাইলে বাস্তবের অন্ধকার, অবদমন, নৈরাশ্য, শোষণ, বৈষম্য, যুদ্ধ ও ক্ষয়িষ্ণু মূল্যবোধের বিরুদ্ধে লেখা। এই দৃষ্টিকোণ থেকেই রিয়ালিজমের মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়াল—মানুষের জীবন ও সমাজকে অবিকল, নির্মোহ, ন্যূনতম অলংকরণের মাধ্যমে উপস্থাপন করা।

এখানে আসি ম্যাজিক রিয়ালিজম-এর প্রসঙ্গে। অনেকেই একে রিয়ালিজমেরই সম্প্রসারণ মনে করেন। কিন্তু আসলে নয়। এটি যেন একধরনের প্রতিবাদ—রিয়ালিজমের সীমাবদ্ধতার বিরুদ্ধে। গার্সিয়া মার্কেজ তাঁর এক সাক্ষাৎকারে যেমন বলেন, “realism, a kind of premenditated literature, that offers too static and exclusive a vision of reality…” —অর্থাৎ, বাস্তববাদ অনেক সময়ে বাস্তবতার একরৈখিক, একমাত্রিক ও অতিমাত্রায় পরিকল্পিত চিত্র দেয়। যেখানে বাস্তবতা শুধু বাহ্যিক ঘটনাপ্রবাহে আবদ্ধ। কিন্তু জীবনের রহস্য, সমাজের প্রান্তিক ইতিহাস, উপনিবেশিত গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক স্মৃতি—এইসব তো সেই কাঠামোয় ধরা পড়ে না।

ম্যাজিক রিয়ালিজম এই খোলা জায়গাটাতেই এসে দাঁড়ায়। মার্কেজ আরও বলেন,

“magic text is paradoxically more realistic than a realistic text.”

কী গভীর বক্তব্য! মানে, একদম অবাস্তব মনে হওয়া গল্প—যেখানে মৃতেরা ফিরে আসে, মেঘের সঙ্গে কথা বলা যায়, অলৌকিকভাবে শহর অদৃশ্য হয়ে যায়—এইসবই হতে পারে সত্যিকার অর্থে বাস্তব, যদি তা বিশ্বাস, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের পরিপ্রেক্ষিতে বিবেচিত হয়।

রিয়ালিজম ও ম্যাজিক রিয়ালিজম-এর এই ফারাকগুলো দেখতে গেলে আরও কিছু উদাহরণ জরুরি। যেমন ধরুন, ফ্লবের বা ডিকেন্স যে দারিদ্র্যের ছবি আঁকেন, তাতে বঞ্চনা আছে, কিন্তু অলৌকিকতা নেই। কিন্তু গার্সিয়া মার্কেজ যখন One Hundred Years of Solitude-এ গর্ভবতী নারীকে আকাশে উড়ে যেতে দেন, বা প্রজন্ম ধরে চলে আসা অভিশপ্ত ইতিহাসকে গুটিয়ে দেন এক পাণ্ডুলিপিতে—সেইসব দৃশ্য অসম্ভব হলেও, সমাজ-রাজনীতি-ইতিহাসের বাস্তবতাকে আরও গভীর করে তোলে।

এমনকি আমাদের বাংলা সাহিত্যেও এই পার্থক্য চোখে পড়ে। মহাশ্বেতা দেবীর পাতাচাঁদ কিংবা সোহরাব হোসেনের সরম আলির ভুবন—এইসব আখ্যানে যেমন শোষণ, নিপীড়ন, জাতিভেদ, ভাঙা সমাজ কাঠামোর বাস্তবতা উঠে আসে, ঠিক তেমনই আসে মৃত মানুষের সঙ্গে কথোপকথন, প্রেতাত্মার হাহাকার, অলৌকিকতার প্রতিবিম্ব। ফলে এইসব উপন্যাস আমাদের শুধুই দুঃখ বা বঞ্চনার বয়ান দেয় না, বরং একধরনের ঐন্দ্রজালিক স্মৃতির প্রতিচ্ছবি রচনা করে—যা অনেক সময় বাস্তবের চেয়েও বাস্তব মনে হয়।

ম্যাজিক রিয়ালিজম থেকে সাহিত্য আন্দোলন: এক সাহিত্যিক অভিযাত্রা
চিত্রঃ মহাশ্বেতা দেবী, Image Source: Google

দ্বিতীয়ত, রিয়ালিজম ও ম্যাজিক রিয়ালিজম উভয় ক্ষেত্রেই পুঁজিবাদী সমাজ কাঠামোর তীব্র সমালোচনা আছে। রিয়ালিজম তা করেছে যুক্তিবাদী পন্থায়—বাস্তবের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। ম্যাজিক রিয়ালিজম আবার সেই বাস্তবতাকে ভেঙে চুরে কল্পনার সাহায্যে অন্য বাস্তবতা নির্মাণ করেছে। যেন শোষকের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের কল্পনাও প্রতিবাদের এক অস্ত্র।

তৃতীয়ত, বাস্তববাদ সাহিত্যে স্থান-কাল-পাত্রের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণে যতটা গুরুত্ব দেয়, ম্যাজিক রিয়ালিজম ততটাই গুরুত্ব দেয় স্থান ও সময়ের পুনর্নির্মাণে। সময় সেখানে রৈখিক নয়, চক্রাকারে চলে। মানুষ সেখানে কেবল সমাজের অঙ্গ নয়, ইতিহাস ও সংস্কৃতির বহমান উত্তরাধিকার। ফলে সময়, বাস্তবতা ও ইতিহাসের একটা জটিল স্তরায়ন গড়ে ওঠে—যা রিয়ালিজম দিতে পারে না।

সবচেয়ে বড় কথা, ম্যাজিক রিয়ালিজম স্থানীয় বিশ্বাসব্যবস্থা, আধ্যাত্মিকতা, লোকস্মৃতি, আদিবাসী সংস্কৃতি, ঔপনিবেশিক ইতিহাস এবং ঐতিহ্যের জটিল মিশ্রণ। এখানেই তার সবচেয়ে বড় শক্তি। কারণ এটি কেবল একটা সাহিত্যিক ফর্ম নয়, বরং এক সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ—যা কেন্দ্র ও প্রান্তের মধ্যে নতুন সংলাপ তৈরি করে।

এইভাবে দেখতে গেলে, রিয়ালিজমের প্রকৃত উত্তরসূরি নয় ম্যাজিক রিয়ালিজম। বরং তা রিয়ালিজমের সঙ্গে এক বিকল্প বাস্তবতার সমান্তরাল টান তৈরি করে, যে বাস্তবতা আরও ব্যাপক, বহুমাত্রিক, সংস্কৃতিনির্ভর, প্রান্তিক স্বরপ্রধান এবং চেতনার গভীরে প্রোথিত। আর এই কারণে, রিয়ালিজমের কাঠামোয় আটকে না থেকে, ম্যাজিক রিয়ালিজম হয়ে উঠেছে সত্যিকারের একটি বিপ্লবী সাহিত্যিক রীতির নাম—যা শুধু বাস্তবকে দেখায় না, তাকে অনুভব করায়; শুধু চিত্রিত করে না, বরং পুনরায় নির্মাণ করে। বাস্তবতাকে। নিজেদের মতো করে। তাঁদের মতো করে—যারা এতদিন ইতিহাসে হারিয়ে ছিলেন।

রিয়ালিজম ও ম্যাজিক রিয়ালিজম-এর মধ্যে মূল পার্থক্যগুলি শুধুমাত্র আঙ্গিকগত বা কাহিনির গঠনে নয়, বরং এই দুটি সাহিত্যিক রীতির অন্তর্নিহিত দৃষ্টিভঙ্গিতেই নিহিত। প্রথমত, রিয়ালিজমে যে বাস্তবতাকে চিত্রিত করা হয়, তা মূলত পুঁজিবাদী অর্থনীতির পরিণত সমাজ কাঠামোর একটি বস্তুনিষ্ঠ পাঠ। একে কেন্দ্র করে যে সাহিত্যরূপ বিকশিত হয়েছে, তার প্রেক্ষাপট ইউরোপীয় সমাজ—বিশেষ করে ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, রাশিয়া কিংবা জার্মানির মতো তথাকথিত ‘প্রথম বিশ্বের’ দেশসমূহ। ফলে রিয়ালিজমের আলোচ্য বিষয়ও সেসব সমাজের অন্তর্গত ধনতান্ত্রিক শোষণ, সামাজিক বৈষম্য, ব্যক্তি মানসিকতার চিরন্তন টানাপোড়েন ও মধ্যবিত্ত জীবনের নিস্তরঙ্গতা।

কিন্তু ম্যাজিক রিয়ালিজম যে কেবল এই ইউরোপীয় অভিজ্ঞতার উত্তরাধিকার বহন করে, তা নয়। বরং বলা যায়, এই সাহিত্যিক রীতির জন্মই হয়েছে একধরনের ঔপনিবেশিক প্রতিস্পন্দন থেকে। ঔপনিবেশিক ইতিহাসের বুকে যারা ছিল পরাধীন, প্রান্তিক, উৎপীড়িত—তাদের কথাই যেন ম্যাজিক রিয়ালিজম-এর ভাষা হয়ে ওঠে। তাই লাতিন আমেরিকা, আফ্রিকা বা এশিয়ার মতো অঞ্চল—যারা একদা ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদী শাসনের অধীনে ছিল—সেই সব দেশের সাহিত্যেই এই ধারাটি সবথেকে বেশি বিকশিত হয়েছে। প্রথম বিশ্বের পরিপুষ্ট ইতিহাস নয়, বরং তৃতীয় বিশ্বের ধ্বস্ত-ভঙ্গুর, বিস্মৃতপ্রায় ইতিহাসই যেন এই আখ্যানের রসদ।

এই দৃষ্টিকোণ থেকে বললে, রিয়ালিজমের তুলনায় ম্যাজিক রিয়ালিজম-এর বাস্তবতার পরিধি অনেক বেশি বিস্তৃত ও বহুবর্ণ। কারণ এখানে ধনতন্ত্রের চিত্র যেমন থাকে, তেমনি ঔপনিবেশিক নিপীড়ন, দাসপ্রথার উত্তরাধিকার, জাতিগত বৈষম্য, কৌমস্মৃতি, স্থানীয় দেব-দেবীর অলৌকিকতা, লোকবিশ্বাস, কল্পলোকের মিথ—সবই পাশাপাশি বাস করে। ফলে এখানে বাস্তবতা হয়ে ওঠে বহুমাত্রিক, যা কেবল বস্তুনিষ্ঠ উপস্থাপন নয়, বরং সাংস্কৃতিক অনুবর্তনেরও প্রতিচ্ছবি।

দ্বিতীয়ত, আখ্যান কাঠামোর ক্ষেত্রে যে পার্থক্যটি সবচেয়ে স্পষ্টভাবে ধরা দেয় তা হল—রিয়ালিজম যেখানে একটি ক্লাসিক কাঠামো মেনে চলে, সেখানে ম্যাজিক রিয়ালিজম সেই কাঠামোকেই ভেঙে ফেলে। রিয়ালিস্ট উপন্যাসগুলো অধিকাংশ সময়ই আদি-মধ্য-অন্ত্যর একটি সুনির্দিষ্ট বিন্যাস অনুসরণ করে। একটি শুরু থাকে, সমস্যা থাকে, সংঘাতের পরিমণ্ডলে চূড়ান্ত উত্তেজনা থাকে এবং শেষে থাকে একধরনের পরিসমাপ্তি বা সমাধান। একে বলা যায় linear বা রৈখিক কাঠামো।

অন্যদিকে, ম্যাজিক রিয়ালিজমে কাহিনির গতি একরৈখিক নয়। বরং সেখানে সময় ও ঘটনাপ্রবাহ এক ধরনের চক্রাকার বা ভাঙাচোরা কাঠামোয় উপস্থাপিত হয়। সময়ের অগ্রগতিও সেখানে গোলকধাঁধার মতো। হুয়ান রুলফোর ‘Pedro Paramo’ উপন্যাসে যেমন দেখি, কাহিনি শুরু হয় এক বেঁচে থাকা ছেলের অভিযাত্রা দিয়ে; কিন্তু পরবর্তী অধ্যায়ে ধরা পড়ে সে আসলে মৃত—শুধু এক আত্মা, যে কোমালার মৃত মানুষদের শহরে প্রবেশ করছে। এইভাবে জীবিত আর মৃত, অতীত আর বর্তমানের বিভাজন রয়ে যায় ধোঁয়াটে। শুরু কোথায়, আর শেষ কোথায়—তা বলা যায় না স্পষ্টভাবে। ফলে পাঠক একটি জটিল সময়-ভাষার অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে এগিয়ে যায়।

তৃতীয়ত, রিয়ালিজমের একটি মৌলিক সীমাবদ্ধতা হল, এটি বাস্তবতার বর্ণনায় যতই দক্ষ হোক না কেন, তা সবসময় সমস্যা চিত্রণের গণ্ডিতেই আবদ্ধ থাকে। দারিদ্র্য, শোষণ, সামাজিক অবক্ষয়, নৈতিক দ্বন্দ্ব ইত্যাদি যত নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তুলুক না কেন, এই সাহিত্যিক রীতিতে কোনো মুক্তির সুর খুব কমই শোনা যায়। চরিত্রেরা যে যন্ত্রণা বহন করে, তা হয় অনিবার্য, নয়তো অপরিবর্তনীয়। দস্তয়েভস্কি, টলস্টয়, জোলা কিংবা ফ্লবেরের উপন্যাসে আমরা বারবার এই ক্লান্তিকর চিত্র দেখতে পাই। রবীন্দ্রনাথ কিংবা শরৎচন্দ্রও এর ব্যতিক্রম নন। সাহিত্য যেন তখন কেবলই জীবনের নিষ্ঠুর বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি—যেখানে কোনও অলৌকিক আলো নেই, যা চরিত্রদের মুক্তি দিতে পারে।

কিন্তু ম্যাজিক রিয়ালিজম এই একমাত্রিক কাঠামোকে অস্বীকার করে। এখানে বাস্তবতার সংকট যেমন আছে, তেমনি আছে মুক্তির বিকল্প সম্ভাবনাও। এই মুক্তি আসে কোনো রাজনৈতিক বিপ্লব নয়, বরং একধরনের অলৌকিক রূপান্তরের মধ্য দিয়ে। জাদুর ছোঁয়ায়, অতিপ্রাকৃত শক্তির মাধ্যমে, মৃত আত্মার প্রতিশোধের ভয়ে কিংবা রহস্যময় প্রতিকারের আশায়—এই সাহিত্যরীতিতে শাসকের শোষণ ও উৎপীড়ন কখনোই চিরস্থায়ী থাকে না।

নবারুণ ভট্টাচার্যের ‘কাঙাল মালসাট’ উপন্যাস তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। সেখানে সমাজের তৃতীয় পরিসরের প্রতিনিধিরা, যারা মূলধারার বাইরে পড়ে থাকা ‘অবাঞ্ছিত’ মানবসমষ্টি, তারাই শেষ পর্যন্ত জয়ী হয়। সমাজের সবথেকে এলিট গোষ্ঠীকে তারা জাদুবলে আক্রমণ করে, অস্ত্র নিয়ে শোষণের রক্তমাখা অট্টালিকা ভেঙে ফেলে। এই রূপান্তরের ভাষা বাস্তবের নয়, অথচ রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে অনেক বেশি কার্যকর। কারণ এ এক ধরণের কল্পনানির্ভর প্রতিশোধ, যা বাস্তবতাকে ছাড়িয়ে গিয়ে তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।

এই সমস্ত পার্থক্যগুলোকে সুন্দরভাবে বিশ্লেষণ করেছেন সমালোচক স্কট সিম্পকিনস। তাঁর মতে,

“Realism pertains to the terms ‘history’, ‘mimetic’, ‘familiarization’, ’empiricism/logic’, ‘narration’, ‘closure-ridden/reductive naturalism’, and ‘rationalization /cause and effect.’ On the other hand, magic realism encompasses the terms ‘myth/legend’, ‘fantastic/supplementation’, ‘defamiliarization’, ‘mysticism/magic’, ‘meta-narration’, ‘open-ended/expansive romanticism’, and ‘imagination/negative capability.’“ (Scott Simpkins, Magical Strategies: The Supplement of Realism, Twentieth Century literature, 1988, P. 140-154)

এই বিশ্লেষণে আমরা দেখতে পাই—রিয়ালিজম যেভাবে বাস্তবতার সঙ্গে যুক্তিবাদ ও কাঠামোগত নিয়ম মেনে চলে, ম্যাজিক রিয়ালিজম সেভাবে চলে কল্পনার স্বেচ্ছাচারিতায়। তবে এই কল্পনা শুধু পালানোর বাহন নয়; বরং তা হল রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অস্তিত্বগত আত্মপ্রতিষ্ঠার এক শক্তিশালী হাতিয়ার।

সার্বিকভাবে বলতে গেলে, রিয়ালিজম ও ম্যাজিক রিয়ালিজম দুটি আলাদা সাহিত্যিক অভিব্যক্তি হলেও, উভয়ের মধ্যে একটি মৌলিক সেতুবন্ধন রয়ে গেছে—তাদের দৃষ্টিভঙ্গির কেন্দ্রে থাকে ‘বাস্তবতা’। তবে একজন সেই বাস্তবতাকে বিশ্লেষণ করে, আর আরেকজন সেই বাস্তবতাকে ব্যাখ্যা করে; একজন শুধুই দেখায়, আর অন্যজন তার চেয়েও বেশি করে বুঝিয়ে দেয়; একজন বাস্তবের সীমার মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকে, আর অন্যজন সীমা ছাড়িয়ে গিয়ে নতুন বাস্তবতা নির্মাণ করে। আর এই নতুন বাস্তবতা নির্মাণের মধ্য দিয়েই ম্যাজিক রিয়ালিজম হয়ে ওঠে আধুনিক সাহিত্যের এক অপরিহার্য রূপ, যা প্রান্তের কণ্ঠস্বরকে কেন্দ্রে নিয়ে আসে, নিপীড়নের কাহিনিকে দেয় মহাকাব্যিক মাত্রা, এবং বাস্তবতাকে করে আরও বেশি জীবন্ত ও গভীর।

তিন

নবজাত বাস্তবতাবাদের এক পরিবর্তিত রূপ হিসেবে ন্যাচারালিজম উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ফরাসি সাহিত্যজগতে আবির্ভূত হয়। এটি ছিল রিয়ালিজমেরই আরও সূক্ষ্ম, আরও বৈজ্ঞানিক, এবং অনেক বেশি নির্মম প্রতিফলন। রিয়ালিজম যেখানে সমাজের বাস্তব চিত্রকে আবেগহীনভাবে দেখাতে চায়, সেখানে ন্যাচারালিজম সেই বাস্তবতাকে একপ্রকার পরীক্ষাগারের আলো-ছায়ায় বিচার করতে চায়। এই সাহিত্যরীতির সূচনা হয় ১৮৬৪ সালে গোঁকুর ভাইদের ‘Germinie Lacerteux’ উপন্যাস দিয়ে। কিন্তু একে আন্দোলনের পরিণত রূপ দেন এমিল জোলা, যার ‘Therese Raquin’ (১৮৬৮) উপন্যাসটি ন্যাচারালিজমের প্রকৃত সূচনার নিদর্শন। এরপর ‘The Experimental Novel’ (১৮৮০) ও ‘Germinal’ (১৮৮৫)-এ জোলা তার মতবাদকে সুসংহত করেন।

ন্যাচারালিজমের পেছনে দার্শনিক ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছে চার্লস ডারউইনের বিবর্তনবাদ, অগস্ত কোঁতের ধ্রুববাদ এবং ইিপোলিত তেইনের বস্তুবাদ। এই দার্শনিক শক্তিগুলি মানুষের চরিত্র, প্রবৃত্তি ও পরিবেশের সমন্বয়ে গঠিত জীবনকে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার মত বিশ্লেষণ করে। এই প্রবণতায় মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি, পরিবেশগত চাপ, বংশগত বৈশিষ্ট্য—এসবের সম্মিলিত প্রভাবে নির্মিত হয় চরিত্র ও কাহিনি।

ন্যাচারালিস্ট সাহিত্যিকরা বিশ্বাস করতেন যে, মানুষের আচরণ সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রিত হয় বংশগতি, পারিপার্শ্বিক অবস্থা ও জৈবিক প্রয়োজন দ্বারা। সেই হিসেবে তারা মানবজীবনের সবরকম গা-জ্বালানো, আদিম, পশুসুলভ দিক তুলে ধরতে কুণ্ঠিত হননি। ফরাসি সাহিত্যে মোপাসাঁ, ব্রিটিশ সাহিত্যে জর্জ মুর, জার্মান সাহিত্যে হাউপ্টম্যান এবং আমেরিকায় থিওডোর ড্রেজার, স্টিফেন ক্রেন প্রমুখ লেখক এই ধারার পথিকৃৎ।

বাংলা সাহিত্যেও এই প্রভাব লক্ষ করা যায়। বিশেষত শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়, প্রেমেন্দ্র মিত্র, জগদীশ গুপ্ত, এবং মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রথম পর্বের রচনায় যথাস্থিতবাদের নির্দিষ্ট ছাপ আছে। এই লেখকদের সাহিত্যে শহর ও গ্রামাঞ্চলের নিচুতলার জীবনের নিখুঁত ও অকৃত্রিম চিত্র উপস্থাপন করা হয়েছে। প্রাত্যহিক জীবনের ঘাম, ধুলো, ক্ষুধা, লালসা ও পরস্পরের প্রতি নির্মম ব্যবহার—সবকিছুই এসেছে নিরাবরণে। শৈলজানন্দের ‘কয়লাকুঠি’ কিংবা মানিকের ‘প্রাগৈতিহাসিক’ গল্প তার প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত।

তবে এই নির্মোহ বিশ্লেষণশীলতা অনেক সময় সাহিত্যকে এমন এক চরম বাস্তবতার দিকে নিয়ে যায়, যেখানে মানবিক বোধ, নৈতিকতা, আদর্শের জায়গা সংকুচিত হয়ে পড়ে। যৌনতা, হিংসা, পাশবিকতা—এসব অনিবার্য বাস্তবের আবরণে ঢেকে যায় সৌন্দর্য, প্রেম কিংবা মুক্তির সম্ভাবনা। সাহিত্য হয়ে ওঠে প্রায় যেন সমাজবিজ্ঞান কিংবা মনস্তত্ত্বের একটি জৈব বিশ্লেষণপত্র। এ প্রসঙ্গে ফ্রেডরিক জেমসনের মন্তব্য গুরুত্বপূর্ণ :

“it is important for the understanding of naturalism, however, to identify this curiously contradictory ideology as a class perspective, reflecting the bourgeoisie’s douts of its own hegemony and its fears of a rising working class, of immigration and the population, of the colonies of the overwhelming competition from other imperial nation-states and finally of its own inner loss of nerve.”

জেমসনের এই পর্যবেক্ষণ বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ তিনি দেখিয়েছেন যে, ন্যাচারালিজম যদিও সমাজের প্রান্তিক মানুষদের চিত্র তুলে ধরেছে, কিন্তু এটি মূলত ছিল মধ্যবিত্ত শ্রেণির একরকম অপরাধবোধ ও নিরাপত্তাহীনতার বহিঃপ্রকাশ। এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যায়, ন্যাচারালিজম একদিকে যেমন পাশবিক বাস্তবতাকে সাহিত্যের কেন্দ্রে নিয়ে এসেছে, অন্যদিকে এর মধ্যে দিয়ে মধ্যবিত্ত শ্রেণি তার শ্রেণিগত আধিপত্যকে ধরে রাখার একটা কৌশল হিসেবেও এটি ব্যবহার করেছে।

ন্যাচারালিজমের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা ছিল এর নিরস ও নিষ্ক্রিয় দৃষ্টিভঙ্গি। এই ধারার সাহিত্যে অধিকাংশ সময়েই কোনো মুক্তির পথ নেই, নেই কোনো নৈতিক পুনরুত্থানের সুযোগ। যেমন, ‘Germinal’-এ আমরা দেখি খনিশ্রমিকদের জীবনসংগ্রাম, কিন্তু সেই সংগ্রামের গন্তব্য কেবল হাহাকার আর মৃত্যু। বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’ উপন্যাসে শঙ্করের বিবেকবোধ কিংবা আদর্শ শেষ পর্যন্ত টিকে থাকলেও, তীব্র বস্তুনিষ্ঠতার মধ্যে রয়ে যায় বেঁচে থাকার কষ্টার্জিত চিত্র।

এই পরিপ্রেক্ষিতে ম্যাজিক রিয়ালিজম সম্পূর্ণ ভিন্ন এক দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করে। বাস্তবতা তার কেন্দ্রে থাকলেও, সেটি শুধু নিরেট বস্তুনিষ্ঠ বাস্তবতা নয়, বরং তার মধ্যে ঢুকে পড়ে লোকবিশ্বাস, পৌরাণিকতা, স্বপ্ন, জাদু, রহস্য এবং আধ্যাত্মিকতা। ম্যাজিক রিয়ালিজম-এর আখ্যানেও শাসকের দমন-পীড়ন, সামাজিক অবিচার, লাঞ্ছিত মানুষের হাহাকার আছে, কিন্তু এই দুঃসহ বাস্তবতার মধ্যে দিয়ে সে খোঁজে মুক্তির এক প্রতীকী বা অলৌকিক ভাষ্য। যেমন, গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের ‘One Hundred Years of Solitude’-এ বুয়েন্দিয়া পরিবারের পতনের আখ্যান জুড়ে আছে অতীত, ভবিষ্যৎ এবং মিথের এক জটিল সংমিশ্রণ।

ন্যাচারালিজম যেখানে ক্ষত দেখিয়ে থেমে যায়, ম্যাজিক রিয়ালিজম সেখানে ক্ষতের মধ্য দিয়েই রূপান্তরের ইঙ্গিত দেয়। ফলে নিচু শ্রেণির জীবন এখানে শুধু করুণ বাস্তব নয়, বরং সেখানে মৃত আত্মার আবির্ভাব, বেঁচে থাকা স্মৃতির মতো, নতুন অর্থ নিয়ে হাজির হয়। এখানেই দুটি ধারার মৌলিক পার্থক্যটি প্রকট হয়ে ওঠে।

ন্যাচারালিজম বাস্তবতাকে শীতল চোখে পর্যবেক্ষণ করে; ম্যাজিক রিয়ালিজম বাস্তবতার গভীরে ঢুকে তা নিয়ে কল্পনার রঙে তৈরি করে এক বিস্ময়কর জগত, যেটি একই সঙ্গে বাস্তব ও অলৌকিক। এটি শুধু যুক্তিবাদ নয়, আবেগ, স্মৃতি, সংস্কার ও প্রতিরোধের কাহিনি। তাই ‘যোগ্যতমের উদবর্তন’কেই একমাত্র সত্য ধরে নিয়ে যারা সাহিত্যে মানুষকে পরিবেশ ও বংশগতির দাস বানিয়ে ফেলেছিলেন, ম্যাজিক রিয়ালিজম তাঁদের বিপরীতে গিয়ে বলেছিল—মানুষ শুধু একটা সমাজতাত্ত্বিক বা জৈবিক সত্তা নয়, সে এক স্বপ্নদ্রষ্টা, ইতিহাসের উত্তরাধিকারী এবং একই সঙ্গে ভবিষ্যতের নির্মাতা।

ঔপনিবেশিকতা, পুঁজিবাদ, বৈষয়িক নির্দয়তা এবং দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে মানুষের দীর্ঘকালীন যাপন এবং তার সাংস্কৃতিক, মনস্তাত্ত্বিক, রাজনৈতিক প্রতিরোধের যে বিশাল উপাখ্যান তা সাহিত্যেই সবচেয়ে গভীরভাবে ধরা পড়েছে। এর বিশেষ প্রকাশ আমরা পাই ম্যাজিক রিয়ালিজম নামক সাহিত্যপ্রবাহে, যা শুধুই একটি শৈলী নয়, বরং একটি দর্শন, একটি প্রতিবাদী চেতনা। এটি এমন এক সাহিত্যরীতি যা প্রথাগত রিয়ালিজম বা ন্যাচারালিজমের মতো কেবল বাস্তবতার স্বরূপই তুলে ধরে না, বরং বাস্তবতার ভিতরে প্রবেশ করে, তার গূঢ় স্তরগুলি আবিষ্কার করে এবং সেইসব স্তর থেকে উঠে আসা অতিলৌকিক, অলীক অথচ মানবিক সত্যকে মূর্ত করে তোলে।

এই রীতির সবচেয়ে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ দিক হল—অন্তেবাসী জীবনের নানা স্তর থেকে উঠে আসা মানুষের বঞ্চনার ছবি, যা কখনও সরাসরি নয়, বরং সাংস্কৃতিক প্রতীকের মাধ্যমে, প্রতিধ্বনির ভেতর দিয়ে প্রকাশ পায়। বাস্তবের খণ্ডচিত্র নয়, বরং বাস্তবের আবেগগত ও চেতনতাগত অন্তরসুর ধরা পড়ে এই ধারায়। যেমন, “The Kingdom of This World” উপন্যাসে কার্পেন্তিয়ের যেভাবে হাইতিয়ান ইতিহাসের নির্দয় অধ্যায়কে তুলে ধরেছেন, তা যেন একটি উপনিবেশিত বিশ্বের প্রতিকৃতি হয়ে ওঠে। অঁরি ক্রিস্তফের নির্মাণকাজে নিযুক্ত নিগ্রো শ্রমিকটির রাতভর পাহাড় বেয়ে ইট টেনে নিয়ে যাওয়ার চিত্র, এবং এই কর্মযজ্ঞের টানা বারো বছরের বিবরণ, যেন বিশ্বজুড়ে নিগৃহীত জনসমষ্টির যন্ত্রণার প্রতীক। সেখানে প্রতিটি ইট যেন একেকটি রক্তজল করা মানবজীবনের বহিঃপ্রকাশ। এই ঘটনা নিছক শোষণের আখ্যান নয়, বরং একটি সভ্যতা নির্মাণের নামে অন্য এক সভ্যতাকে ধ্বংস করার ইতিহাসের প্রতিচ্ছবি।

এই ধরনের বর্ণনায় “রিয়ালিজম” থাকলেও তা ক্লাসিক্যাল রিয়ালিজমের মতো কেবল বাহ্যিক নয়, বরং মূর্ত হয়ে ওঠে প্রতীকী, রূপকথার মতো, অথচ এক আশ্চর্য বিশ্বাসযোগ্য বাস্তবতার আবরণে। এটা সেই বাস্তবতা, যা বহির্বিশ্বের বিজ্ঞানসিদ্ধ চোখে দৃশ্যমান নয়, কিন্তু নিপীড়িত মানুষের অভ্যন্তরীণ বাস্তবতায় তার গভীর অনুরণন আছে।

সেই একই ধারা আমরা খুঁজে পাই শাহযাদ ফিরদাউসের উপন্যাস ‘শাইলকের বাণিজ্য বিস্তার’ (১৯৯৯)-এ। এখানে ধনতন্ত্রের আক্রমণ আসছে আধুনিকতার মোড়কে, বিশ্বায়নের নাম নিয়ে। “শাইলক” নামটিই একটি প্রতীকের মতো ব্যবহৃত হয়েছে—যেখানে পুঁজিবাদী নীতিমালার আবরণে রক্তচোষা ব্যাঙ্কিং-কর্পোরেট ব্যবস্থার বিপজ্জনক বিস্তার ঘটেছে। এই শোষণ নতুন ধরনের, এটি আর অঁরি ক্রিস্তফের মতো প্রকাশ্য চাবুক বা খাটুনি নয়, বরং এটি কাগজে-কলমে সই করিয়ে অধিকার কেড়ে নেওয়া, চুক্তির নামে জমি-বসত ভোগ করে নেওয়া। এর ভেতরেও নিগৃহীত মানুষ আছে, যাদের আমরা দেখি গ্রামীণ পরিধির মানুষ সিকান্দারের মাধ্যমে। এই চরিত্রটি যেন এক আদর্শ প্রতিনিধিত্ব করে সমস্ত প্রান্তিক মানুষের, যাদের সংস্কৃতি, শ্রম, স্বপ্ন—সবই বাণিজ্যের গ্রাসে লোপ পায়।

এখানে একটা গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য তৈরি হয় রিয়ালিজম, ন্যাচারালিজম ও ম্যাজিক রিয়ালিজমের মধ্যে। ন্যাচারালিজম বাস্তবতাকে দেখে ডারউইনের বিবর্তনবাদ, তেইন-এর বস্তুবাদ আর কোঁতের ধ্রুববাদের চশমা পরে। ফলে সে যে বাস্তবতা দেখে তা নিরপেক্ষ হলেও অনেকটা শীতল, পরীক্ষাগারে অঙ্গচ্ছেদিত মানবদেহের মতো। যেমন, জগদীশ গুপ্তের ‘দুলালের দোলা’ (১৯৩১) গল্পে আমরা দেখি সতীশ নামক এক বিকৃত যৌনচরিত্রের উৎস সন্ধানে লেখক জেনেটিক্স, পারিবারিক ইতিহাস এবং পূর্বপুরুষদের জীবনে ফিরে যান। তার বাবা ছিলেন এক গণিকার সন্তান, তার ঠাকুমা বহুগামী—এইসব তত্ত্ব বিশ্লেষণ করে সতীশ নিজের পরিবারকে নিপীড়নের এক শিকার করে তোলে। এই আলোচনায় লেখক অবচেতনের প্রবৃত্তিগুলোকেও অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে বিশ্লেষণ করেছেন—তবে সেটা যেন এক অ্যানাটমিকাল প্যাথলজি রিপোর্টের মতো। জীবন আছে, কিন্তু প্রাণপ্রতীতি কম।

কিন্তু ম্যাজিক রিয়ালিজম যখন এই সমস্যার মুখোমুখি হয়, তখন তার চিত্রায়ণ আরও মানবিক, আরও প্রতিক্রিয়াশীল। এখানে নিপীড়ন আছে, কিন্তু তার বিরুদ্ধে স্বপ্ন আছে, প্রতিরোধ আছে, ঐতিহ্যের স্মৃতি আছে। এই স্মৃতিই একদিন জেগে উঠে সংগ্রামের রসদ জোগায়। যেমন, সোহরাব হোসেনের ‘সরম আলির ভুবন’ (২০০৪) উপন্যাসে প্রধান চরিত্র সরম। সমাজের একেবারে নিচুতলার মানুষ, নিঃস্ব, কিন্তু তার মধ্যেই এক অতল আত্মার সন্ধান পাই আমরা। যখন রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক বলয়ের নিষ্পেষণে সে প্রায় ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, তখনই অতীন্দ্রিয় স্তরে ঘটে যায় এক বিচিত্র রূপান্তর—সে তার মৃত চাচার সঙ্গে কথা বলে, এমনকি মার্ক্সের সঙ্গেও। এগুলো আপাতদৃষ্টিতে অলীক বা পাগলামী মনে হতে পারে, কিন্তু এখানে এগুলোই হয়ে ওঠে তার আত্মবিশ্বাস ও বাঁচার শক্তির উৎস। ফলে সে পরিণামে রূপান্তরিত হয় এক প্রতিবাদী নেতায়। এখানে “ম্যাজিক” হল অতীতের স্মৃতি, মৃতদের কণ্ঠস্বর, ঐতিহ্যের আত্মার পুনরাগমন, যা সরমের মতো এক অন্তর্হীন জীবনের গর্ভ থেকে উঠে আসে এবং বাস্তবকে পাল্টে দেয়।

এই ম্যাজিক রিয়ালিজমে বাস্তবতা ও অবাস্তবতার মধ্যবর্তী অঞ্চলটি বড় বেশি গূঢ়। এখানে মিথ, স্বপ্ন, স্মৃতি, রূপকথা—সব একত্রে এসে উপস্থিত হয়। বাস্তব যখন তার যুক্তিক ব্যাখ্যা দিতে ব্যর্থ হয়, তখনই এই অবাস্তব উপাদানগুলি প্রবেশ করে, কিন্তু তারা প্রবেশ করে এমন এক “reliable tone”-এর ভেতর দিয়ে, যা পাঠককে বিভ্রান্ত না করে, বরং অবাক করে, ভাবিত করে। এই নির্ভরযোগ্য স্বরেই ম্যাজিক রিয়ালিজম তার সৌন্দর্য গড়ে তোলে। এটি কল্পনার বাহাদুরি নয়, বরং নিপীড়িতের অভিজ্ঞতালব্ধ বাস্তবতার এক গূঢ় ব্যাখ্যা।

রিয়ালিজম ও ন্যাচারালিজমের মধ্যে সমস্যার বর্ণনা থাকলেও তার সমাধান বা প্রতিরোধের উপাদান খুব কমই থাকে। যেমন, বালজাক কিংবা জোলা যতই শ্রমিক শ্রেণির দারিদ্র্য বর্ণনা করুন, শেষ পর্যন্ত তা একটি নিষ্প্রভ বর্ণনাতেই সীমাবদ্ধ থাকে। কিন্তু ম্যাজিক রিয়ালিজম আমাদের সেই বিপন্ন মানবিক অবস্থান থেকে উত্তরণ ঘটাতে চায়। এই উত্তরণের পথে কখনও কাজ করে স্বপ্ন, কখনও স্মৃতি, কখনও অতীতের বীরত্বগাথা, কখনও মিথ। এটি নিছক কল্পনাবিলাস নয়, বরং ঐতিহাসিক অবচেতনের এক পুনর্জাগরণ। সেই অবচেতনই মূর্ত হয়ে ওঠে সরমের মৃত চাচা কিংবা মার্ক্সের কথোপকথনে।

উল্লেখযোগ্য যে, ম্যাজিক রিয়ালিজমের এই অভ্যন্তরীণ শক্তির উত্থান একেবারেই তৃতীয় বিশ্বের সাহিত্যিক অভিজ্ঞতা থেকে আসা। এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা—এইসব ভূখণ্ডের ইতিহাসই এমনভাবে নির্মিত, যেখানে আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে ওঠে স্বপ্ন, সংস্কৃতি, লোকগাথা ও আধ্যাত্মিক শক্তির সম্মিলনে। ফলে এই সাহিত্যধারায় মিথ বা অলৌকিকতা কখনও পালানোর রাস্তা নয়, বরং টিকে থাকার, বাঁচার, পাল্টে দেওয়ার হাতিয়ার।

যেখানে রিয়ালিজম বাস্তবতাকে একটি নিরপেক্ষ ক্যামেরা হিসেবে দেখে এবং ন্যাচারালিজম সেটিকে জীববিজ্ঞানের পর্যবেক্ষণ হিসেবে বিবেচনা করে, সেখানে ম্যাজিক রিয়ালিজম বাস্তবতাকে দেখে এক জীবন্ত, চলমান, প্রতিক্রিয়াশীল সত্তা হিসেবে। এই বাস্তবতা নির্জীব নয়, বরং এর ভিতর আছে ইতিহাস, আছে নিপীড়নের দীর্ঘ ছায়া, এবং সেই ছায়ার বিপরীতে দাঁড়িয়ে থাকা রূপকথার আলো।

ম্যাজিক রিয়ালিজমের সবচেয়ে গভীর তাৎপর্য সম্ভবত এখানেই—এটি আমাদের শেখায় কিভাবে এক নিঃস্ব, বলহীন মানুষও তার সংস্কৃতির স্মৃতির উৎস থেকে শক্তি আহরণ করে দাঁড়িয়ে যেতে পারে অত্যাচারের বিপরীতে। সুতরাং, ম্যাজিক রিয়ালিজম শুধুই একটি সাহিত্যের রীতি নয়, এটি নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর অস্তিত্ব রক্ষার ভাষা, আত্মপরিচয়ের পুনরুদ্ধার, এবং একটি বিপর্যস্ত সময়ের বিপরীতে দাঁড়িয়ে আত্মঘোষণার এক অন্তরতম আর্তনাদ।

এই আর্তনাদে আছে বাস্তবের ছায়া, কিন্তু তাতে মিশে আছে আশ্চর্যের আলো। তাই বলা যায়, ম্যাজিক রিয়ালিজম সেই রীতি যেখানে মানুষ তার সর্বনাশের মধ্যেও স্বপ্ন দেখে, এবং সেই স্বপ্নের বাস্তবায়ন ঘটে আত্মবিশ্বাসের অলৌকিকতায়। যে অলৌকিকতা বাস্তবেরই গভীরে লুকিয়ে ছিল।

চার

বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসে শিল্পধারা ও মতবাদের বিবর্তন কেবল শৈল্পিক আকৃতি নয়, বরং একেকটি যুগের শ্রেণিসংগ্রাম, রাজনৈতিক চেতনা এবং সাংস্কৃতিক ঘাত-প্রতিঘাতেরই প্রতিচ্ছবি। বিশেষত ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগ থেকে বিংশ শতকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত সাহিত্যের ভিতর দিয়ে যে প্রবল শ্রেণীসচেতনতা ও বৈপ্লবিক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠেছিল, তার মধ্যেই আমরা দেখি ‘সোশ্যালিস্ট রিয়ালিজম’ নামক একটি চেতনার অভ্যুদয়, যা সাহিত্যের ক্ষেত্রে এক দৃষ্টান্তমূলক পালাবদলের সূচনা করে। এই ধারাটি শুধু সাহিত্যের নান্দনিক রুচিকে নয়, বরং সমাজ পরিবর্তনের উদ্দেশ্যকেই সাহিত্যচর্চার কেন্দ্রে নিয়ে আসে।

রিয়ালিজম ও ন্যাচারালিজম পূর্ববর্তী সাহিত্যপ্রবাহে আমরা মানব জীবনের সীমাহীন সমস্যা, দারিদ্র্য, অসাম্য, বিকৃতি, ক্লান্তি, শূন্যতা, বৈষম্য ও প্রান্তিক অবস্থানের নিখুঁত, বিশ্লেষণাত্মক চিত্রায়ন দেখতে পাই। কিন্তু সেই সমস্ত সাহিত্যে সাধারণত প্রতিরোধের পথ বা ভবিষ্যতের নির্মাণের স্বপ্ন অনুপস্থিত থেকে যায়। সেখানে সমাজের অন্তর্গত বৈষম্য চিত্রায়িত হলেও, সমাজকে পাল্টানোর সংকল্প দেখা যায় না। অথচ সাহিত্যের ক্ষমতা কেবল আত্মপ্রকাশ বা বিষণ্ণতার বিবরণে সীমাবদ্ধ থাকলে চলে না; বিশেষত যখন মানুষের শৃঙ্খল ছিঁড়ে নতুন পৃথিবী নির্মাণের দাবি তীব্রতর হয়ে ওঠে।

এই বোধ থেকেই শুরু হয় ‘সোশ্যালিস্ট রিয়ালিজম’-এর যাত্রা। এটি নিছক সাহিত্যরীতি নয়, বরং একটি মার্ক্সীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে গঠিত সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন। এই ধারার সূচনা ও রূপায়ণকে চিহ্নিত করার জন্য যে গ্রন্থটিকে এক প্রকার ঘোষণাপত্র বলা চলে, সেটি হচ্ছে ম্যাক্সিম গোর্কির ‘Mother’ উপন্যাস (১৯০৭)। এখানে একটি সাধারণ, নিরক্ষর শ্রমজীবী মা তার ছেলের বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে, এবং শেষ পর্যন্ত নিজেই এক সংগ্রামী চরিত্রে রূপান্তরিত হয়। এর মধ্য দিয়ে গোর্কি দেখান যে, শ্রেণি-সচেতনতা ও বিপ্লবী আদর্শ কিভাবে মানুষের অন্তর্লোককে পাল্টে দিতে পারে। যদিও “সোশ্যালিস্ট রিয়ালিজম” পরিভাষাটির আনুষ্ঠানিক গ্রহণ ঘটে ১৯৩২ সালে সোভিয়েত রাশিয়ায়, লেনিনের নেতৃত্বাধীন সাংস্কৃতিক নীতিমালার ভিত্তিতে।

সোশ্যালিস্ট রিয়ালিজমের মূল দর্শন ছিল—সাহিত্য হবে শ্রমজীবী মানুষের হাতিয়ার, বুর্জোয়া বাস্তবতার ভ্রান্ত রূপ উন্মোচনকারী এবং সর্বহারার ভবিষ্যতের স্বপ্ন নির্মাণকারী। সে জন্যেই এই ধারায় ‘art for art’s sake’-এর বিপরীতে দাঁড়িয়ে বলা হয়, সাহিত্য হবে জনগণের, সংগ্রামের, শ্রেণীসচেতনতার বাহক। সাহিত্যিকদের প্রতি লেলিনের আহ্বানও ছিল এই লক্ষ্যে: “Party Organisation and Party Literature” (১৯০৫) রচনায় তিনি লেখকদের উদ্দেশে বলেন, তারা যেন সর্বহারার অন্তর্লোক, চেতনা ও সংগ্রামের সঙ্গে আত্মিক সম্পর্ক স্থাপন করেন। তবে এটি যেন কেবলমাত্র প্রচারধর্মী না হয়, বরং বাস্তবতা ও প্রতিনিধিত্বের ভারসাম্য রক্ষা করে।

এই ধারার সফল প্রয়োগ আমরা দেখতে পাই ফিয়োদর গ্ল্যাডকভের ‘Cement’ (১৯২৫) উপন্যাসে, যেখানে শিল্পায়ন-পরবর্তী সমাজে শ্রমিক শ্রেণির সংকট, তাদের সংগঠন এবং ব্যক্তিগত সম্পর্কগুলির নতুন বিন্যাস উঠে এসেছে। আবার মিখাইল শোলোখভের ‘Quiet Flows the Don’ (১৯৩৪) উপন্যাসেও দেখি রুশ গৃহযুদ্ধের পটভূমিতে কসাক কৃষকদের দ্বন্দ্ব, চেতনার বিবর্তন এবং সমাজতান্ত্রিক মূল্যবোধের ধীরে ধীরে অভ্যন্তরে প্রবেশ।

বাংলা সাহিত্যে এই সোশ্যালিস্ট রিয়ালিজমের চর্চা প্রধানত মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখায় দৃশ্যমান। তাঁর ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’ কিংবা ‘দিবারাত্রির কাব্য’-তে আমরা দেখতে পাই শ্রমিক শ্রেণির যন্ত্রণা, আত্মসংঘাত, মনস্তাত্ত্বিক সংকট এবং ধনতন্ত্রের যন্ত্রের ভেতর পিষ্ট মানুষের ভিতরে দানা বাঁধতে থাকা এক সমাজচেতনা। মানিকের রচনায় কেবল দারিদ্র্য বা দুর্ভাগ্য নেই, বরং তা থেকে উত্তরণের আকাঙ্ক্ষাও আছে—যা তাঁর সময়ের সাহিত্যিকদের তুলনায় আলাদা করে তোলে।

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
চিত্রঃ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, Image Source: Google

এই বিশ্লেষণের মধ্যেই উঠে আসে অপর একটি সমান্তরাল ও প্রভাবশালী সাহিত্যপ্রবাহ—ম্যাজিক রিয়ালিজম। একটি নির্দিষ্ট দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, এই দুই ধারার—সোশ্যালিস্ট রিয়ালিজম ও ম্যাজিক রিয়ালিজম—উদ্দেশ্য এক। উভয়ের লক্ষ্য অন্তেবাসী, নিপীড়িত মানুষের পক্ষে দাঁড়ানো; উভয়েই বুর্জোয়া শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী এবং ভবিষ্যতের রচনায় বিশ্বাসী। ‘struggle for the victory of Socialism’—এই মূলমন্ত্র উভয় প্রবাহেই পরোক্ষে কিংবা প্রত্যক্ষে কাজ করে। কিন্তু পথ আলাদা।

সোশ্যালিস্ট রিয়ালিজম দাঁড়িয়ে আছে মার্ক্সীয় অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ, ‘Base’ এবং ‘Superstructure’ তত্ত্বের উপর। অর্থাৎ, সমাজের মৌল কাঠামো হল অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, আর সেই কাঠামোর উপর গড়ে ওঠে আইন, ধর্ম, সাহিত্য ইত্যাদি ‘সুপারস্ট্রাকচার’। সাহিত্য তাই হতে হবে একটি পরিবর্তনশীল অস্ত্র, যা বাস্তবের গভীরে ঢুকে শোষণকে চিহ্নিত করবে, শ্রেণিসংগ্রামের পক্ষে অবস্থান নেবে। এই রীতি বিশ্বাস করে, ব্যক্তি নয়, শ্রেণিই ইতিহাসের চালিকাশক্তি। তাই সাহিত্যও হবে ব্যক্তিকেন্দ্রিক আত্মবিশ্লেষণের বদলে শ্রেণি-সচেতন রাজনৈতিক নির্মাণ।

অন্যদিকে, ম্যাজিক রিয়ালিজমের ভিত্তি আরও বিস্তৃত। এটি শুধুমাত্র অর্থনৈতিক কাঠামোর পরিবর্তনের উপর আস্থা রাখে না; বরং সাংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক ও বিশ্বাস-ভিত্তিক জগৎকে পরিপূর্ণ গুরুত্ব দেয়। বিশেষত তৃতীয় বিশ্বের সাহিত্যিক বাস্তবতায় এই ধারা রূপ লাভ করে এক বিকল্প প্রতিবাদী চেতনায়। ঔপনিবেশিকতা, স্বৈরতন্ত্র, ধর্মীয় গোঁড়ামি, জাতপাত, পুরুষতন্ত্র, সাংস্কৃতিক আধিপত্য ও সাম্রাজ্যবাদ—এইসব সামাজিক, রাজনৈতিক বাস্তবতার বিরুদ্ধে একটি নিগূঢ়, অলৌকিক, মিথিক আখ্যানের ভেতর দিয়ে প্রতিরোধ গড়ে ওঠে।

এই ধারায় বাস্তবতা কেবল বহির্জগতের তথ্যগত সত্য নয়, বরং মানুষের চেতনা, স্মৃতি, লোককথা, আত্মার অভিজ্ঞতা ও অতীত বিশ্বাসসমূহের সংগঠিত প্রকাশ। যেমন, সালমান রুশদির ‘Midnight’s Children’ উপন্যাসে ভারত ভাগ ও স্বাধীনতার সন্ধিক্ষণে জন্ম নেওয়া শিশুদের অলৌকিক ক্ষমতা বাস্তবতারই এক প্রতীকী রূপ—একান্ত বাস্তব সমাজঘটনার মধ্যেই অবাস্তবের অনুপ্রবেশ। সেলিম সিনাই-এর নেতৃত্বে এই শিশুরা কংগ্রেসি রাজনৈতিক প্রতারণার বিরুদ্ধে, এক বৃহত্তর ঐতিহাসিক সত্যের প্রতিনিধিত্ব করে।

ঠিক তেমনি সোহরাব হোসেনের ‘মাঠ জাদু জানে’ (২০১০) উপন্যাসে দেখা যায়, ক্ষমতাসীন বাম রাজনীতির দাম্ভিকতা ও একচেটিয়া শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ গড়ে ওঠে কাউছার নামক চরিত্রের নেতৃত্বে। কিন্তু এই প্রতিরোধ কেবল রাজনৈতিক সংগঠনের নয়; বরং তা জমি, স্বপ্ন, সংস্কৃতি, রূপক ও লোকবিশ্বাসের সম্মিলনে গঠিত। এই আখ্যানের চরিত্ররা রক্তমাংসের মানুষ, কিন্তু তারা অতীত বিশ্বাস ও অলৌকিকের ছায়া নিয়ে আত্মরক্ষা করে। তারা স্বপ্নে বিভোর, কিন্তু তাদের সেই স্বপ্ন এক বিপ্লবের রূপ ধরে।

এই পার্থক্যটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সোশ্যালিস্ট রিয়ালিজম যাকে “ভবিষ্যতের গন্তব্য” বলে দেখায় রাজনৈতিক সংগঠনের মাধ্যমে, ম্যাজিক রিয়ালিজম তা খোঁজে সাংস্কৃতিক গভীরতায়, অতীন্দ্রিয় অস্তিত্বে। এই ধারায় যখন বাস্তবতার ঘূর্ণিপাকে মানুষ আটকে যায়, তখন সে আশ্রয় নেয় লোকগাথার, স্মৃতির, মিথের, এবং অচিন্তনীয় শক্তির। এই আশ্রয় কোনও পলায়ন নয়, বরং তা হয়ে ওঠে প্রতিরোধের ভাষা।

এই দুই ধারার ন্যারেটিভ কাঠামোতেও পার্থক্য লক্ষণীয়। সোশ্যালিস্ট রিয়ালিজমে দ্বান্দ্বিকতা খুবই সুস্পষ্ট—শাসক বনাম শ্রমিক, ধনী বনাম দরিদ্র, পুঁজিপতি বনাম প্রলেতারিয়েত। অন্যদিকে, ম্যাজিক রিয়ালিজমে দ্বান্দ্বিকতা কখনও স্পষ্ট, কখনও অস্পষ্ট; এক রহস্যময় আবহে প্রতিপক্ষ উপস্থিত থাকে, যার বিরুদ্ধে সংগ্রামটি হয় ভেতরের ও বাইরের সমন্বয়ে। সেখানে শত্রু যেমন রাষ্ট্র হতে পারে, তেমনি হতে পারে অতীত থেকে জেগে ওঠা কোনো বিশ্বাসঘাতকতা।

তবে শেষ পর্যন্ত, দুই ধারাই অন্তর থেকে সমাজ পাল্টাতে চায়। একদিক থেকে দেখলে, সোশ্যালিস্ট রিয়ালিজম যেমন প্রান্তিক মানুষের রাজনৈতিক চেতনার মাধ্যমে মুক্তির পথ দেখায়, তেমনি ম্যাজিক রিয়ালিজম তাকে নিজের ঐতিহ্য, ইতিহাস, লোকসংস্কৃতি, রূপকথা ও ব্যক্তিক আত্মার অভিজ্ঞতার মধ্যে থেকেও প্রতিরোধ করতে শেখায়।

সাহিত্যতাত্ত্বিকভাবে বলতে গেলে, সোশ্যালিস্ট রিয়ালিজম হল এক বস্তুবাদী বাস্তবতা নির্মাণের শৈলী; এবং ম্যাজিক রিয়ালিজম হল সংস্কৃতিনির্ভর, প্রতীকসমৃদ্ধ এক অলৌকিকতায় উদ্বুদ্ধ বাস্তবতা। বাস্তবের ভিতরেই দুই ধারার অবস্থান, তবে তা একটির ক্ষেত্রে মাটির স্তরে, অন্যটির ক্ষেত্রে মাটির নিচের জলধারায়।

এই দুই ধারার সম্মিলনেই হয়তো ভবিষ্যতের সাহিত্য আরও গভীর, আরও সংগ্রামী এবং আরও মানবিক হয়ে উঠবে—যেখানে থাকবে রাজনৈতিক বোধ, সাংস্কৃতিক স্মৃতি ও চেতনার জোয়ার। কারণ মানুষের লড়াই কেবল রুটি-রুজির নয়, তার ভাষা, বিশ্বাস, স্বপ্ন এবং ইতিহাসের জন্যও। সেই ইতিহাসকে, সেই স্বপ্নকে রক্ষা করতেই সাহিত্য দাঁড়ায়—কখনও সোশ্যালিস্ট রিয়ালিজমের স্লোগানে, কখনও ম্যাজিক রিয়ালিজমের বিস্ময়ে।

সাহিত্য কোনোদিনই নিছক কল্পনার খেলা ছিল না। বরং তা সমাজের সঙ্কট, মানুষের সংগ্রাম এবং সময়ের বিবর্তনের এক আন্তঃপ্রাণ অভিব্যক্তি। বিংশ শতকে প্রবল রাজনৈতিক টানাপড়েন, শ্রেণীসংঘাত ও ঔপনিবেশিক আধিপত্যের প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে সাহিত্যও খুঁজে নিতে চেয়েছিল তার নিজের দায়িত্ব ও ভূমিকা। সেই চেষ্টার ফলেই বিশ্বসাহিত্যে জন্ম নিয়েছিল দুটি প্রবল প্রতিস্পর্ধী ও পরিপূরক সাহিত্যধারা—সোশ্যালিস্ট রিয়ালিজম ও ম্যাজিক রিয়ালিজম। এই দুই ধারার মধ্যে সাদৃশ্য যেমন ছিল, তেমনি ছিল দৃষ্টিভঙ্গির বিস্তর ফারাক।

সোশ্যালিস্ট রিয়ালিজমের জন্মরীতি ছিল নিখুঁতভাবে রাজনৈতিক। এর কেন্দ্রে ছিল মার্ক্স, এঙ্গেলস ও লেলিনের দর্শন। তাদের ধারণা অনুযায়ী, সাহিত্য হবে শ্রেণীসংগ্রামের হাতিয়ার। বাস্তব জীবনের সমস্যা, বৈষম্য, নিপীড়নের চিত্রায়নের পাশাপাশি তা হয়ে উঠবে ভবিষ্যতের সমাজতান্ত্রিক গঠনের জন্য প্রেরণার উৎস। ফলে এই ধারার সাহিত্যে এক ধরনের একরৈখিক দলগত চেতনা কাজ করত। ব্যক্তি নয়, সমাজ; একক কণ্ঠ নয়, সম্মিলিত কণ্ঠস্বরই ছিল এর মূখ্য দ্যোতনা।

এই ধারার এক গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য ছিল যূথবদ্ধতার ভাবনা। ব্যক্তি এখানে ছিল বৃহত্তর সংগ্রামী সংগঠনের অংশ। যেমন, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘হারানের নাতজামাই’ গল্পে দেখা যায়, যখন সংগ্রামী নেতা ভুবনকে গ্রেফতার করতে পুলিশ আসে, তখন পুরো গ্রাম একযোগে বিদ্রোহ করে। এই যূথবদ্ধতা যেন সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ হয়ে আছড়ে পড়ে রাষ্ট্রের রক্ষাকারী বাহিনীর গায়ে। এখানে বিপ্লব কেবল ব্যক্তির নয়, এক সম্প্রদায়, এক শ্রমজীবী শ্রেণির সম্মিলিত চেতনার প্রতিফলন। এই ধরনের চিত্রায়ন ছিল তৎকালীন সমাজতান্ত্রিক সাহিত্যপ্রয়াসের অভ্যন্তরস্থ কাঠামো।

কিন্তু বাস্তবতা কি সবসময় যূথবদ্ধ হতে পারে? যাদের কোনো সংগঠন নেই, যারা বহুবর্ণ শোষণচক্রে বিধ্বস্ত হয়ে সমাজের প্রান্তসীমায় ঠাঁই পেয়েছে, তাদের লড়াই কেমন হয়? এই প্রশ্নের উত্তর নিয়ে আবির্ভূত হয় ম্যাজিক রিয়ালিজম, একেবারে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির বাহক হিসেবে। এই ধারাটি সম্মিলিত সংগ্রামের পাশাপাশি ব্যক্তি প্রতিবাদ, প্রতীকী প্রতিরোধ, আত্মিক শক্তি, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির অলৌকিক রসদকে অস্ত্র হিসেবে গ্রহণ করে। ফলে এখানে শুধু সংঘবদ্ধ আন্দোলনের চিত্র নয়, ব্যক্তির একাকী বিদ্রোহও সাহসিকতার সঙ্গে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।

নবারুণ ভট্টাচার্যের ‘কাঙাল মালসাট’ উপন্যাসে যেমন দেখি—চোক্তা ও ফ্যাতাড়ুদের একসমবেত আক্রমণ, রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরুদ্ধে এক সাংস্কৃতিক ধ্বংসাত্মক বিস্ফোরণ। এখানে সম্মিলিত লড়াই আছে, তবে তা সমাজতান্ত্রিক সংগঠনের কাঠামোতে আবদ্ধ নয়। বরং এক বিপরীতধর্মী, বিশৃঙ্খল, সাবভার্সিভ চেতনার বহিঃপ্রকাশ। চোক্তাদের ভাষা অদ্ভুত, ফ্যাতাড়ুরা সমাজের গহীনতম প্রান্ত থেকে উঠে আসে। তাদের অস্ত্র সংস্কৃতি, তাদের যুদ্ধের কৌশল খিচুড়ি ভাষা, লোকবিশ্বাস, নাটক, গান, প্রতীক। কিন্তু এদের সবার মধ্যেও ব্যক্তি প্রতিবাদের এক অদ্ভুত পরত কাজ করে।

আরও স্পষ্টভাবে এই প্রবণতা আমরা দেখি সোহরাব হোসেনের ‘মহারণে’ উপন্যাসে। এখানে কেয়ামত নামক চরিত্রটি একা নামেন রাষ্ট্র ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে। সমষ্টি তার পাশে থাকে না। কারণ, ধূর্ত পার্টি নেতা চতুর বক্তৃতা দিয়ে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করে ফেলে। তারা ভয় পায়, বিভ্রান্ত হয়, অথবা হাল ছেড়ে দেয়। কিন্তু কেয়ামত পিছিয়ে যান না। তিনি শক্তি জোগাড় করেন নিজের সাংস্কৃতিক শিকড় থেকে। দাদিমার মুখে শোনা রূপকথা, সাধিকা ছপুরার জীবন্ত জীবনবোধ, মৃত বিপ্লবী নেতা মজনু শাহ অথবা কার্ল মার্ক্সের আদর্শ—সব মিলিয়ে তিনি গড়ে তোলেন এক ‘ম্যাজিকাল’ প্রতিবাদী অস্তিত্ব। তাঁর অস্ত্র তলোয়ার নয়, তথ্য নয়, সংগঠনও নয়। তাঁর অস্ত্র বিশ্বাস, স্মৃতি ও চেতনার অলৌকিক শক্তি।

এখানেই এই দুটি ধারার মৌল তফাৎ। সোশ্যালিস্ট রিয়ালিজমে সংগ্রামের সাফল্য নির্ভর করে সমষ্টির উপর। দল ছাড়া বিপ্লব অসম্ভব। অথচ ম্যাজিক রিয়ালিজমে এমন এক ব্যক্তিকে আমরা দেখতে পাই, যিনি একা, নিঃসহায়, তবুও সমাজের শক্তিশালী বলয় ভেদ করে সামনে এগিয়ে চলেন। এখানেই ম্যাজিক রিয়ালিজম মানব আত্মার এক অলঙ্ঘ্য শক্তিকে তুলে ধরে।

পরবর্তী পার্থক্যটি টেকনিক্যাল, বা ন্যারেটিভ স্ট্রাকচারে। সোশ্যালিস্ট রিয়ালিজম অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সরলরৈখিক প্লট নির্মাণে বিশ্বাসী। ঘটনাগুলি কালানুক্রমে ঘটে, এবং পাঠক খুব সহজেই বুঝতে পারেন কীভাবে গল্প এগোচ্ছে, কোথা থেকে কোথায় যাচ্ছে। এই প্লট গঠন একটি নির্দিষ্ট আদর্শগত ছাঁচ অনুসরণ করে চলে। গোর্কির ‘Mother’ উপন্যাস তার এক নিটোল দৃষ্টান্ত। সেখানে একজন মায়ের চেতনার জাগরণ, ছেলের সংগ্রামের প্রতি সহানুভূতি, এবং শেষ পর্যন্ত নিজেই বিপ্লবের অংশ হয়ে ওঠার গল্পটি সময়ের প্রবাহ মেনে এগিয়ে চলে।

ম্যাজিক রিয়ালিজম এই প্রথাগত প্লট ও সময়চেতনার কাঠামোকে ছিন্নভিন্ন করে দেয়। এখানে প্লট এলোমেলো, অরৈখিক। সময় কখনও বর্তমান, কখনও অতীত, কখনও ভবিষ্যতের স্বপ্ন। চরিত্ররা এক সময়ে বর্তমানকে প্রত্যক্ষ করছে, আবার হঠাৎ তারা ছুটে যাচ্ছে স্মৃতির কোনো গোপন অলিন্দে। এই সময়জ্ঞান যেন তৃতীয় বিশ্বের অন্তেবাসী জীবনের প্রতিচ্ছবি, যেখানে সময় কখনও ইতিহাস, কখনও মিথ, কখনও দুঃস্বপ্নে মিলিয়ে যায়। অতীত ও বর্তমানের এই যাতায়াত যেন এক মানসিক বাস্তবতা, যা বহু প্রজন্মের দুঃখ-বঞ্চনার ইতিহাস বহন করে।

এছাড়াও সোশ্যালিস্ট রিয়ালিজমের আরেকটি বড় সীমাবদ্ধতা ছিল এর প্রচারধর্মীতা। অনেক সময় সাহিত্যের শিল্পমানকে উপেক্ষা করে আদর্শ প্রচারের প্রতি অতিরিক্ত ঝোঁক দেখা গিয়েছে। ফলে সাহিত্য হয়ে উঠেছিল অনেক সময়ে দলের ইস্তেহারের মতো। ভাষা হয়ে পড়েছিল শ্লোগানময়, চরিত্র হয়ে উঠেছিল দ্বিমাত্রিক। ভালো মানুষ পুরো ভালো, খারাপ মানুষ পুরো খারাপ—এই ধরনের ধাঁচা চরিত্রায়ন সাহিত্যকে প্রায়শই সংক্ষিপ্ত ও সংকীর্ণ করে তোলে।

এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যায়, সোশ্যালিস্ট রিয়ালিজম প্রধানত ইউরোপীয় প্রেক্ষাপটে গড়ে ওঠা এক সাহিত্যচেতনা। ইউরোপীয় প্রলেতারিয়েতরা শোষিত ছিল, কিন্তু তারা উপনিবেশিক শাসনের দ্বারা পরাধীন ছিল না। তারা ছিল নিজেদের রাষ্ট্রের নাগরিক। ফলে তাদের মধ্যে একধরনের অধিকারচেতনা ও আত্মবিশ্বাস ছিল, যা তাদের সংগ্রামকে স্পষ্টভাবে সংগঠিত করেছিল। অথচ ম্যাজিক রিয়ালিজম-এর কেন্দ্রীয় চরিত্ররাই প্রায়শই থাকে ঔপনিবেশিক বাস্তবতার মধ্যে। তারা শুধু শোষিত নয়, বরং শিকড়চ্যুত। তাদের ইতিহাস চুরি হয়ে গেছে, তাদের ভাষা খণ্ডিত হয়েছে, তাদের সংস্কৃতি বিকৃত হয়েছে, তাদের বিশ্বাসকে অবজ্ঞা করা হয়েছে।

এইসব বাস্তবতার প্রেক্ষিতে তাদের সংগ্রাম কখনোই কেবলমাত্র অর্থনীতিনির্ভর হতে পারে না। তাদের অস্তিত্বের লড়াই তাই বহুস্তরীয়, বহু মাত্রিক। সেই কারণে ম্যাজিক রিয়ালিজম একটি দীর্ঘস্থায়ী ও বিস্তৃত ধারায় পরিণত হয়েছে। এটি শুধু সাহিত্য নয়, একটি সাংস্কৃতিক রাজনৈতিক চেতনার প্রতিনিধিত্ব করে। এটি স্বপ্ন, মিথ, ফোকলোর, স্মৃতি ও অলৌকিকতার মাধ্যমে প্রান্তিক মানুষের নিরব কান্নাকে শব্দ দেয়, বিপন্নতার মধ্যেও তাকে শক্তি জোগায়।

সব মিলিয়ে বলা যায়, সাহিত্য কেবল সমাজের আয়না নয়, তা সমাজ পাল্টানোর রূপকল্পও বটে। সোশ্যালিস্ট রিয়ালিজম সে রূপকল্পকে দিয়েছে দলগত চেতনা, মার্ক্সীয় যুক্তি, শ্রেণীসংগ্রামের পাটিগণিত। আর ম্যাজিক রিয়ালিজম তা দিয়েছে ইতিহাস-ঐতিহ্য-লোকবিশ্বাসের গহনে ভেসে ওঠা অলৌকিক কল্পনার ভেতর দিয়ে। দুই ধারার পার্থক্য যতই থাকুক, দুটোই মানবমুক্তির স্বপ্নে বিশ্বাস করে, দুটোই বুর্জোয়া শাসনের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। তবে পথে, দৃষ্টিতে ও ভাষায় তাদের ব্যবধান একেবারে অপরিহার্য। এই ব্যবধানই সাহিত্যকে দেয় বহুস্তরীয়তা, মানবিকতা ও গভীরতার এক অনির্বচনীয় দীপ্তি।

পাঁচ

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ভয়াল পরিণতি, মানবতার উপর তার অমানবিক থাবা, এবং শিল্প-সাহিত্যে এর গভীর প্রভাব যে এক নতুন সাহিত্যবোধের সূচনা করবে, তা ছিল অনিবার্য। যেভাবে বুর্জোয়া সভ্যতা সভ্যতার মুখোশ পরে রক্তস্নাত যুদ্ধ চালিয়ে গেল, তা দেখে অনেক লেখক-শিল্পীই বিদ্রোহ ঘোষণা করলেন শৃঙ্খলিত যুক্তিবাদের, প্রতিষ্ঠিত ভাষার, এবং তথাকথিত সভ্যতার কাঠামোর বিরুদ্ধে। সেই বিদ্রোহ থেকেই জন্ম নিল দুটি শক্তিশালী সাহিত্য আন্দোলন—ডাডা ও সুররিয়ালিজম। এই আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল বুর্জোয়া সমাজের ভণ্ডামি ও সংকীর্ণতাকে প্রকাশ্যে চ্যালেঞ্জ জানানো এবং ভাষা, যুক্তি ও নান্দনিকতার প্রচলিত মানদণ্ড ভেঙে দিয়ে এক নতুন সত্যের অনুসন্ধান।

এই ধারাবাহিকতায় ১৯২৪ সালে আন্দ্রে বেঁত ‘Manifeste du Surréalisme’ প্রকাশ করে পরাবাস্তববাদকে একটি সাংগঠনিক চেহারা দেন। তাঁর মতে, মানব চেতনা শুধু জাগতিক নয়, বরং তার এক বিশাল অংশ অবচেতন জগতে নিমজ্জিত। তাই শিল্পের সত্যিকারের রূপধারণ করতে হলে শুধু যুক্তিসিদ্ধ, সংবিধিবদ্ধ বাস্তবতাকে তুলে ধরলে চলবে না; বরং সেই অচেতন প্রবাহ, স্বপ্ন, কল্পনা, মানসিক বিকৃতি, ইন্দ্রিয়-অতীত অভিজ্ঞতা সবকিছুকেই সাহিত্যের অন্তর্গত করতে হবে। সেই জন্যেই তিনি উচ্চারণ করলেন, “the Surrealist atmosphere created by automatic writing.” এই ‘অটোমেটিক রাইটিং’ বা স্বতঃস্ফূর্ত লেখালেখির ধারণা মনোবিকলন বিদ্যার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। ফ্রয়েডীয় বিশ্লেষণকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এই ধারণা শিল্পকে করে তোলে মনস্তাত্ত্বিকভাবে গভীর, অদ্ভুত, প্রথাভাঙা।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর ইউরোপে এই চেতনাই তখন বিস্তীর্ণ হচ্ছিল। পুঁজিবাদের অসারতা ও জাতীয়তাবাদের ধ্বংসাত্মকতা থেকে শিল্পীরা ফিরে আসছিলেন স্বপ্ন ও অবচেতনের আশ্রয়ে। গীয়ম আপোলোনিয়ের ১৯১৭ সালে প্রথমবারের মতো “surrealistic” শব্দটি ব্যবহার করেন, যার মাধ্যমে বাস্তবের সীমা অতিক্রম করে নতুন এক উচ্চতর সত্য অন্বেষণের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। এরপর আন্দ্রে বেঁত, পল এলুয়ার, লুই আরাগঁ প্রমুখ কবি ও শিল্পী এই আন্দোলনকে গড়ে তোলেন একটি সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক চেতনায় রূপান্তরিত করে।

এই অবস্থানেই সুররিয়ালিজমের সঙ্গে অনেক সময়ই ম্যাজিক রিয়ালিজম-এর বিভ্রান্তি দেখা যায়। কারণ, দুই ধারাতেই স্বপ্ন, অবচেতন, রহস্যময়তা, এবং বাস্তবের সঙ্গে অলৌকিক বা প্রতীকী উপাদানের সংমিশ্রণ ঘটে। ফলে একে অপরের সঙ্গে মিলিয়ে ফেলার প্রবণতা দেখা যায়, কিন্তু মূলত এদের দৃষ্টিভঙ্গি ও উদ্দেশ্যে রয়েছে মৌলিক পার্থক্য।

প্রথমত, উভয় আন্দোলনের জন্ম পুঁজিবাদ ও ঔপনিবেশিক আধিপত্যের বিরুদ্ধে এক ধরনের সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ হিসেবে ঘটলেও, তাদের লক্ষ্যবস্তু ছিল পৃথক। যেমন, আন্দ্রে বেঁতের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা সুররিয়ালিস্টরা ১৯২৫ সালেই মরক্কো যুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে রাজনৈতিক জড়িয়ে পড়েন। ডেভিড হপকিন্স লেখেন,

“The Surrealists engagement with politics had begun in 1925, when they opposed the colonial war in Morocco.”

এই বিবৃতিই প্রমাণ করে যে, তারা পুঁজিবাদের নির্মমতা ও ঔপনিবেশিকতার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন।

একইভাবে, ম্যাজিক রিয়ালিজম-এরও জন্ম হয়েছে ঔপনিবেশিক ও পরাধীন সমাজে—লাতিন আমেরিকা, আফ্রিকা, ভারতীয় উপমহাদেশ ইত্যাদি অঞ্চলে। সেখানে লেখকেরা যখন দেখেন প্রাতিষ্ঠানিক ভাষা, ইতিহাস ও সংস্কৃতি কেবলই শাসকগোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষা করছে, তখন তারা ফিরে যান লোককথা, মিথ, ঐতিহ্য ও ব্যক্তিগত বিশ্বাসের জগতে। তারা নির্মাণ করেন এক অলৌকিকতাসম্পৃক্ত বাস্তব, যা আরোপিত ‘বস্তুনিষ্ঠ’ বাস্তবতার থেকে অনেক বেশি সত্য।

দ্বিতীয়ত, দুই ধারাতেই প্রাতিষ্ঠানিকতার বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিক্রিয়া ছিল। সুররিয়ালিজম প্রত্যাখ্যান করেছিল স্কুলে পড়ানো ভাষা, প্রাতিষ্ঠানিক যুক্তি, ও যুক্তিবাদের সাংস্কৃতিক পরাকাষ্ঠাকে। তারা বলেছিলেন, বাস্তবতা শুধু বস্তুসংগত তথ্য নয়; বরং মনোজাগতিক প্রবাহ, স্বপ্নের আবছায়া, এবং অবচেতনের আর্তি সব মিলিয়েই গঠিত হয় ‘বাস্তব’। এই ধারণাই তাকে যুক্তিবাদবিরোধী করে তোলে। একইভাবে, ম্যাজিক রিয়ালিজমও প্রত্যাখ্যান করে উপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থা, পশ্চিমা ইতিহাসচর্চা এবং আধুনিকতার গোঁড়া সংস্কৃতি।

তৃতীয়ত, এই দুই আন্দোলনের একটি মৌলিক সাদৃশ্য হল বাস্তব ও অবাস্তব, স্বপ্ন ও জাগরণ, চেতনা ও অবচেতনার সীমারেখা ভেঙে দেওয়া। তারা দুজনেই প্রচলিত দ্বৈতবোধের বিরোধিতা করে। সুররিয়ালিজম স্বপ্নকে বাস্তবতার অঙ্গ করে তোলে। আবার ম্যাজিক রিয়ালিজমও বাস্তবের বর্ণনার মাঝে এমনভাবে জাদুকরী বা অতিপ্রাকৃত উপাদান ঢুকিয়ে দেয়, যেন তা রীতিমতো স্বাভাবিক মনে হয়। এই রীতিটি বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয় সালমান রুশদির ‘Midnight’s Children’ উপন্যাসে, যেখানে শিশুদের অলৌকিক ক্ষমতা এক অবিচ্ছেদ্য বাস্তবতা হিসেবেই হাজির হয়।

তবে মিলের তুলনায় অমিল বেশি। প্রথমত, সুররিয়ালিজম মূলত ব্যক্তিকেন্দ্রিক, মনস্তাত্ত্বিক ও আত্মমুখী। তার দৃষ্টিভঙ্গির কেন্দ্রবিন্দু হল ‘ব্যক্তির অভ্যন্তরীণ মুক্তি’। স্বপ্ন, অবচেতনের বিশ্লেষণ, যৌনতা, মিথ ভাঙা, বিদ্রোহ এবং শিল্প-সৃষ্টির নিছক আনন্দ—এইসবই তার ক্যানভাস। ভবিষ্যতের সমাজ কী হবে, বা সংগ্রামের মাধ্যমে শোষণমুক্ত বিশ্ব কেমন হতে পারে—এই প্রশ্নগুলি তার পরিধির বাইরে। ফলে রাজনৈতিক অঙ্গীকার থাকলেও, সেটি সাংগঠনিক নয়, আদর্শগতও নয়। বরং একটি ধ্বংসের আনন্দময়তা, সৃষ্টির অদ্ভুত অনুপ্রেরণা এবং ব্যক্তিগত মুক্তিই তার লক্ষ্য।

অন্যদিকে, ম্যাজিক রিয়ালিজমে রয়েছে এক দৃঢ় রাজনৈতিক সমাজভাবনা। সেখানে শোষণমুক্ত সমাজের স্বপ্ন রয়েছে। প্রান্তিক মানুষের ইতিহাসকে পুনর্লিখন করার আকাঙ্ক্ষা রয়েছে। যেমন, নাসরিন জাহানের ‘চন্দ্রলেখার জাদুবিস্তার’ উপন্যাসে আমরা দেখি অত্যাচারী রানী চন্দ্রলেখার মৃত্যুর পর প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা হয়। এটি নিছক অলৌকিকতার বাহুল্য নয়, বরং এক ধরনের রাজনৈতিক রূপক, যা বোঝায় অত্যাচারী শক্তির পতন ও গণচেতনার জাগরণ। আবার টনি মরিসনের ‘Beloved’ উপন্যাসেও দেখি, দাসপ্রথার অভিশপ্ত ইতিহাস এক ভূতের রূপ নিয়ে ফিরে আসে, এবং তার থেকে মুক্তি পাওয়া মানে হল এক ঐতিহাসিক আত্মশুদ্ধি, এক শোষণহীন ভবিষ্যতের সম্ভাবনা।

তদুপরি, ভাষার ব্যবহারে ও কাঠামোগত নির্মাণেও দুই ধারার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। সুররিয়ালিস্টরা ভাষাকে ভেঙে দিয়েছিলেন, কখনো তা অচেনা করে তুলেছিলেন, কখনো তা পরাবাস্তব উপমায় ভরিয়ে তুলেছিলেন। তাদের ভাষা সচরাচর পাঠযোগ্য নয়, এবং পাঠকের কাছ থেকে চায় এক বিশেষ মনস্তাত্ত্বিক প্রস্তুতি। অন্যদিকে, ম্যাজিক রিয়ালিজম-এর ভাষা অনেক বেশি প্রাঞ্জল, পাঠযোগ্য ও প্রমিত। লেখক এখানে অলৌকিকতাকে বাস্তবের মধ্যে এমনভাবে স্থাপন করেন, যেন পাঠকের মনে হয়, ‘এটাই তো স্বাভাবিক’। যেমন, গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের ‘One Hundred Years of Solitude’ উপন্যাসে একজন চরিত্র আকাশে উড়ে যায়, অথবা বৃষ্টি টানা চার বছর ধরে চলতে থাকে—এইসব ঘটনাকে লেখক উপস্থাপন করেন এমনভাবে, যেন সেগুলো কোনো বিস্ময়কর ব্যাপারই নয়।

অতএব, বলা যায়, দুই ধারার মধ্যে একটি গভীর আদর্শগত বিভাজন রয়েছে। সুররিয়ালিজম যেখানে এক প্রকার শিল্প-সম্ভোগের মধ্য দিয়ে ব্যক্তিস্বাধীনতার সন্ধান করে, সেখানে ম্যাজিক রিয়ালিজম ইতিহাসের প্রবাহে শোষিত মানুষের আত্মরক্ষার ও পুনর্জাগরণের এক সাংস্কৃতিক কৌশল। একজন খোঁজেন অবচেতনের স্বপ্নরাজ্যে মুক্তির আনন্দ, আর অন্যজন খোঁজেন বাস্তবতার কষ্টের মধ্যে দাঁড়িয়ে জাদুর আশ্রয়ে বাঁচার পথ।

সাহিত্যের পরিসরে উভয় ধারাই এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছেছে। কিন্তু পাঠকের পাঠপ্রবণতা ও রাজনৈতিক চেতনার উপরে নির্ভর করে—কে কোন ধারাকে কাছে টেনে নেবে। তবে শেষ কথা এই, মানবজীবনের ভেতরের গভীর রহস্য ও বাহ্যিক শোষণের বাস্তবতাকে যেভাবে এই দুই ধারা নিজেদের ভিন্ন কৌশলে তুলে ধরেছে, তা সাহিত্যের সম্ভাবনাকে অনেক দূর পর্যন্ত প্রসারিত করেছে। আর তার মধ্য দিয়ে আমরা বুঝতে পারি—বাস্তবতা একটিমাত্র নয়, বহুবর্ণ, বহুরৈখিক, বহুমাত্রিক। কখনও তা চেতনার আলোয় উদ্ভাসিত, কখনও তা অবচেতনের গহিনে প্রোথিত। সেই দ্বৈতসত্তার মধ্যে দিয়ে সাহিত্যের জন্ম হয়। হয়তো সেই কারণেই—সাহিত্য কখনো কেবল বাস্তব থাকে না, কখনো কেবল অলৌকিক হয় না—তা জাদু ও প্রতিবাদের সম্মিলনেই একটি পরিপূর্ণ রূপ লাভ করে।

পরাবাস্তববাদ ও জাদুবাস্তববাদের বিভাজনরেখা যতই সূক্ষ্ম হোক না কেন, গভীরে তাকালে এদের দার্শনিক অবস্থান, মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি ও রাজনৈতিক ভূমিকা এতটাই আলাদা যে, একটিকে অন্যটির সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা একপ্রকার বোধের বিভ্রান্তি। বিশেষ করে যখন আলোচনা কেন্দ্রীভূত হয় জাদুবাস্তববাদের রাজনৈতিক প্রেক্ষিত, তখন এ বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

দ্বিতীয়ত, পরাবাস্তববাদে প্রাতিষ্ঠানিকতাকে অস্বীকার করে গুরুত্ব দেওয়া হয় ব্যক্তি মনের অবচেতনার অতল রহস্যকে। সেখানে সমাজ, ইতিহাস বা শ্রেণি—এসব বৃহত্তর কাঠামোর তুলনায় মনস্তাত্ত্বিক উদ্ঘাটনই বেশি গুরুত্ব পায়। আত্মনিমগ্নতা, অন্তর্জগতে প্রবেশ, স্বপ্ন ও কামনাজর্জর চেতনার বিস্তার—এসবই তাকে অনন্য করে তোলে। পরাবাস্তববাদ এখানে এক ধরণের স্বপ্ন-যুক্তি বা ‘dream logic’-এর আশ্রয় নেয়। কিন্তু জাদুবাস্তববাদে প্রাতিষ্ঠানিকতাকে অস্বীকার করার পেছনে ব্যক্তি নয়—বৃহত্তর একটি বঞ্চিত সমাজ, যারা দাস, উদ্বাস্তু, পরাধীন, ঔপনিবেশিক নিপীড়নে আক্রান্ত—তাদের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করাই মুখ্য। এরা সব কার্নিভালের শক্তির অংশ। তৃতীয় বিশ্বের বৃহত্তর ‘তৃতীয় পরিসর’। তাদের দিকেই মুখ ফেরায় জাদুবাস্তববাদ, এবং তার বিপরীতে অবস্থান করে রাজনৈতিক ক্ষমতার দাপট, যা পরাবাস্তববাদে কার্যত ব্রাত্য।

তৃতীয়ত, পরাবাস্তববাদীরা যুক্তিবাদকে অস্বীকার করে ডুব দিলেন মগ্ন চৈতন্যে, ফ্রয়েড কথিত ‘ইদ’ (id)-এর জগতে। যেখানে চিন্তা, ইচ্ছা, কামনা ও কল্পনা হয়ে ওঠে মুক্তপ্রবাহমান। সেখানে সব কিছু হবে স্বতঃস্ফূর্ত, ইচ্ছা-অনিচ্ছা নিরপেক্ষ। যৌক্তিকতা, নৈতিকতা, সামাজিক বিধি সেখানে বাধা নয়, বরং ভাঙার বস্তু। এই কারণে তাদের ভাষা ভাঙে, অর্থ ছড়িয়ে যায়।

কিন্তু জাদুবাস্তববাদীরা রীতিমতো ‘ইদ’ ছাড়িয়ে কখনো ‘ইগো’ (Ego)-র জগতে, যেখানে বাস্তবতাকে সচেতনভাবে পর্যবেক্ষণ করা যায়, আবার কখনো তাকে ছাড়িয়ে ‘সুপার ইগো’ (Super Ego)-র স্তরে, যেখানে বাস্তবের সমস্যা দূর করার জন্য অলৌকিকতার কল্পনা হাতে তুলে নেওয়া হয়। এই অলৌকিকতা নৈতিক বুদ্ধি ও বিবেকের সমন্বয়ে গঠিত একটি প্রতিরোধচেতনার বাহন হয়ে ওঠে। ফলে এখানে গঠনাত্মক কল্পনার ভূমিকা আছে—যেখানে স্বপ্ন, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, লোকবিশ্বাস মিলে গড়ে ওঠে এক মুক্তির পথ।

চতুর্থত, এই কারণে পরাবাস্তববাদে যেমন কোনো যুক্তিবোধ থাকে না, তেমনি থাকে না কোনো কার্যকারণ সম্পর্ক (logical sequence)। পাঠককে ছেড়ে দেওয়া হয় মুক্ত অবচেতনায়, যেখানে তিনি নিজেই গড়ে তোলেন অর্থের সম্ভাব্যতা। কিন্তু জাদুবাস্তববাদে অলৌকিকতা যেন জাদুকরের কৌশলের মতই—বাইরে থেকে বোঝা না গেলেও ভিতরে ভিতরে এক গভীর লজিকাল কাঠামো থাকে। কারণ এই অলৌকিকতা নিছক বিভ্রম নয়, বরং একটি শোষণমুক্ত সমাজ গঠনের দিকনির্দেশ। বাস্তবতার সঙ্গে এর সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। এই বাস্তব-অলৌকিক মিলনের সূত্রটি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সমালোচক ম্যাজি অ্যান বাওয়ার বলেছেন,

“Surrealism is most distinct from Magic realism since the aspects that it explores are associated not with material reality but with the imagination and the mind, and in particular it attempts to express the ‘inner life and psychology of humans thought art. The extraordinary in magical realism is realy presented in the form of a dream or a psychological experience because its accepted and uquestioned position in tangible and material reality.” (Maggie Ann Bowers, Magic(al) Realism, London, Routledge, 2004, P. 22)

পঞ্চমত, পরাবাস্তববাদে স্বপ্ন ও বাস্তব, ফ্যান্টাসি ও বাস্তব—সব মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। এমনকি পাঠক প্রায়ই নিশ্চিত হতে পারেন না, তিনি কোন জগতে রয়েছেন। কিন্তু জাদুবাস্তববাদে স্বপ্ন, উদ্ভটতা, বা অতিপ্রাকৃত ব্যবহৃত হয় এক কঠিন বাস্তব সংকট থেকে মুক্তির পথ নির্মাণ করতে। অলৌকিকতার প্রবেশ ঘটে নির্দিষ্ট পটভূমিতে—সংস্কার, রাজনীতি, দমননীতি, অথবা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের বিরুদ্ধে। এই অলৌকিকতা অকারণ নয়। যেমন, “The Famished Road” (1991) উপন্যাসে অ্যাজারো নামের বালকটি সমস্যায় পড়লেই সমাধানের জন্য আবিকু শিশু হয়ে মৃত্যু-পরবর্তী জগতে চলে যায়, গভীর জঙ্গলে প্রেতাত্মাদের সঙ্গে কথোপকথনে অংশ নেয়, সমাধানসূত্র পেয়ে গেলে আবার সে ফিরে আসে এবং বেঁচে ওঠে। এই ন্যারেটিভ শুধু অলৌকিকতাকে নয়, আত্মপরিচয়ের রাজনৈতিক স্তরকে তুলে ধরে।

ষষ্ঠত, পরাবাস্তববাদের সাহিত্যক্ষেত্র প্রধানত কবিতা ও চিত্রকলার। সেখানে ভাষা প্রায়ই হয় বিমূর্ত, নির্জ্ঞাসু। চিত্রকল্প তৈরি করে এক মনোজাগতিক ঘূর্ণি। আবার অনেক ক্ষেত্রে শব্দের গঠন ভেঙে ফেলা হয়, চেতনাপ্রবাহ বা ‘automatic writing’-এর আশ্রয়ে লেখক নিজেই যেন এক অবচেতন সত্তায় রূপান্তরিত হন। কিন্তু জাদুবাস্তববাদ তার সাহিত্যের বিচরণক্ষেত্র হিসেবে বেছে নিয়েছে উপন্যাসকে। কারণ উপন্যাসে সমাজ, ইতিহাস, ক্ষমতা, সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক সংঘাতকে একসাথে ধরে রাখা সম্ভব হয়। এই উপন্যাসেই তাই দেখা যায়, এক বৃহত্তর আখ্যান গঠনের প্রয়াস—যেখানে ব্যক্তির সঙ্গে সঙ্গে উঠে আসে গোষ্ঠীর ইতিহাস, সাংস্কৃতিক স্মৃতি ও রাজনৈতিক উপলব্ধি।

এই উপন্যাসধর্মিতার ভিতর দিয়েই তাই জাদুবাস্তববাদ হয়ে ওঠে তৃতীয় বিশ্বের শ্রান্ত-শোষিত মানুষের এক নতুন প্রতিরোধের ভাষা। এই ভাষায় কখনো শাসক শক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়ানো হয়, কখনো ঔপনিবেশিক আগ্রাসনের মুখোশ উন্মোচিত হয়, আবার কখনো স্বৈরশাসকের নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত অলৌকিকতা হয়ে ওঠে এক জাতীয় প্রতিরোধচেতনার ভাষ্য। ফলে এর ক্ষেত্র পরাবাস্তবতার তুলনায় বহুগুণ বিস্তৃত ও বহুমাত্রিক। পরাবাস্তববাদ যেখানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর একসময় স্তিমিত হয়ে যায়, সেখানে জাদুবাস্তববাদ ১৯৪৯ থেকে বিশ্বসাহিত্যে নতুন জোয়ার আনে, এবং বিশ শতকের পরেও তার ধারা বহমান থাকে।

রিয়ালিজম, ন্যাচারালিজম, পরাবাস্তববাদ—এই ধারাবাহিক আলোচনার পর আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, জাদুবাস্তববাদ তার নিজস্ব অভিপ্রায় ও রূপবৈচিত্র্যে এক স্বাধীন ও প্রভাবশালী সাহিত্যধারা হয়ে উঠেছে। তবে এখানেই আলোচনার শেষ নয়। জাদুবাস্তববাদের সঙ্গে প্রায়শই তুলনা করা হয় অন্য কিছু ধারার—বিশেষ করে বিজ্ঞানধর্মী উপন্যাস (science fiction), ফ্যান্টাস্টিক উপন্যাস (fantastic literature), ও হরর বা ভৌতিক সাহিত্যের। এই তুলনাগুলির মধ্যেও স্পষ্ট বিভাজনরেখা আছে। এইবার আমাদের নজর দিতে হবে সেই দিকগুলোতে, যাতে করে বোঝা যায়—জাদুবাস্তবতা কী নয়, এবং কেন তা একমাত্রিক অলৌকিকতার বিপরীতে বহুমাত্রিক বাস্তবতার প্রতিবিম্ব।

ছয়

বিজ্ঞানধর্মী উপন্যাস ও জাদুবাস্তবতাধর্মী উপন্যাস—এই দুটি উপন্যাস-রীতির মধ্যে বাহ্যত কিছু মিল দেখা গেলেও, প্রকৃতপক্ষে তারা একে অপরের পরিপূরক নয়, বরং সম্পূর্ণ পৃথক দুই সাহিত্যিক মেজাজ ও দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন। দুটোতেই কল্পনার ব্যবহারে বিস্ময় তৈরি হয়, দুটোতেই পাঠকের প্রচলিত বাস্তববোধে ধাক্কা লাগে। কিন্তু এই বিস্ময় বা ধাক্কার চরিত্র, এর ব্যাকরণ, এর অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য এবং পরিণতির রূপ একেবারে ভিন্ন।

বিজ্ঞানধর্মী উপন্যাসের ভিত্তি গড়ে ওঠে বিজ্ঞানের সম্ভাব্যতা ও প্রযুক্তির ভবিষ্যত অভিযাত্রাকে কেন্দ্র করে। সেখানে অলৌকিকতা নেই, আছে ভবিষ্যতের সম্ভাব্যতা। বিজ্ঞান ও যুক্তির চূড়ান্ত সীমা পর্যন্ত গিয়ে কল্পনা যা তৈরি করে, তাই হল বিজ্ঞানধর্মী সাহিত্যের কেন্দ্রমূলে। এই পার্থক্যটি আরও স্পষ্ট করে তুলতে সমালোচক ম্যাজি অ্যান বাওয়ার বলেন,

“The science fiction narrative’s distinct difference from magical realism is that it is set in a world different from any known reality and its realism resides in the fact that we can recognize it as a possibility for our future. Unlike magical realism, it does not have a realistic setting that is recognizable in relation to any past or present reality.” (Maggie Ann Bowers, Magic(al) Realism, London, Routledge, 2004, P. 28)

এই বক্তব্যকে সামনে রেখে অল্ডাস হাক্সলির বিখ্যাত উপন্যাস Brave New World এর দিকে তাকালে বিষয়টি পরিষ্কার হয়। এখানে এক ভবিষ্যৎ সমাজ ব্যবস্থার চিত্র আঁকা হয়েছে, যেখানে মানুষ জন্ম নিচ্ছে কৃত্রিম উপায়ে, রাষ্ট্র পরিচালিত ল্যাবরেটরিতে রাসায়নিক প্রক্রিয়ায়। মানুষের ভাগ্য, তার শ্রেণিগত অবস্থান, এমনকি তার যৌনতা পর্যন্ত নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে সরকারের পরিকল্পিত প্রযুক্তির মাধ্যমে। বাস্তব পৃথিবীতে এমন প্রযুক্তি এখনো বাস্তবায়িত না হলেও, কল্পনায় তা এক পরীক্ষিত বৈজ্ঞানিক অনুমান হিসাবে ধরা হয়েছে। এখানে যে বাস্তবতা আছে তা ভবিষ্যতের সম্ভাব্যতা, বর্তমান বা অতীতের বাস্তবতা নয়। এই বিজ্ঞানধর্মী উপন্যাসে কল্পনার ভরকেন্দ্র প্রযুক্তি, আর ভবিষ্যতের ‘if’—এই দুটি বিষয় ঘিরে আবর্তিত।

ম্যাজিক রিয়ালিজম থেকে সাহিত্য আন্দোলন: এক সাহিত্যিক অভিযাত্রা
চিত্রঃ অলডাস হাক্সলি, Image Source: Google

এই দৃষ্টিকোণ থেকে যদি জাদুবাস্তবতাধর্মী উপন্যাসের দিকে তাকাই, তবে দেখা যাবে—এই ঘরানার আখ্যান বাস্তবতার মধ্যেই অবস্থিত, কিন্তু সেখানে অলৌকিকতা প্রবেশ করে ‘matter-of-fact’ ভঙ্গিতে। এই অলৌকিকতা প্রযুক্তি নির্ভর নয়, বরং সাংস্কৃতিক চেতনা, ঐতিহাসিক ক্ষোভ, লোকবিশ্বাস, এবং প্রান্তিক মানুষের অভিজ্ঞতার সাথে মিশে গড়ে ওঠে। এখানে অতীত ও বর্তমানের বাস্তবতা মিলেমিশে এমন এক জগৎ তৈরি করে, যেখানে অলৌকিকতা প্রায় প্রতিদিনের জীবনের মতো স্বাভাবিক। এই অলৌকিকতার লক্ষ্য মানবিক বা সামাজিক সংকট থেকে মুক্তির এক সম্ভাব্য ন্যারেটিভ তৈরি করা।

ফলে দেখা যাচ্ছে, বিজ্ঞানধর্মী সাহিত্য যেখানে বাস্তবতা থেকে দূরে, সেখানে জাদুবাস্তবতায় বাস্তবতা অনুপস্থিত নয়, বরং তার ভেতরেই একটি অতিরিক্ত মাত্রা যুক্ত হয়েছে। এই মাত্রা রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও প্রতিরোধমুখী। প্রযুক্তিনির্ভরতা যেখানে বিজ্ঞানধর্মী সাহিত্যের ভিত্তি, সেখানে ঐতিহ্য ও লোকবিশ্বাস জাদুবাস্তবতার স্তম্ভ।

এই ভেদরেখা আরও বিস্তৃত হয় যখন আমরা ফ্যান্টাস্টিক উপন্যাসের সঙ্গে জাদুবাস্তবতার তুলনায় মনোযোগ দিই। বহু নামী সমালোচক এই দুই ধারাকে একাকার করে দেখেছেন। আমেরিকার বিখ্যাত ফ্যান্টাসি লেখক গেনে ওলফ বলেছিলেন, ‘magic realism is only another name for fantasy fiction.’ তাঁর এই উক্তি অনেকে মেনে নিলেও, বিষয়গত বিচারে তা অনেকাংশে বিভ্রান্তিকর।

এই একই ভুল করেছেন সমালোচক নেল কর্ণওয়েল, তাঁর বিখ্যাত ফ্যান্টাসি সমালোচনা গ্রন্থ The Literary Fantastic : from Gothic to Postmodernism -এ, যেখানে তিনি সালমান রুশদির Midnight’s Children এবং টনি মরিসনের Beloved -কে সরাসরি ফ্যান্টাস্টিক সাহিত্যের অংশ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু এসব উপন্যাসের ভাষ্য কাঠামো, চরিত্রের গভীরতা এবং অলৌকিকতার সামাজিক-রাজনৈতিক অভিঘাত বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, এগুলি নিছক ‘fantasy’ নয়।

ফ্যান্টাস্টিক সাহিত্যের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে সমালোচক ক্যারিশ ব্যালডিক বলেন,

“A mode of fiction in which the possible and the impossible are confounded so as to leave the reader with no consistent explanation for the story’s strange events.” (Charis Baldick, The Oxford Dictionary of Literary Terms, New York, The Oxford University Press, 2008, P. 125)

অর্থাৎ, ফ্যান্টাসি বা ফ্যান্টাস্টিক সাহিত্যে সম্ভব ও অসম্ভবের মধ্যে এমন এক ধূসর এলাকা তৈরি হয়, যা পাঠককে দ্বিধায় ফেলে দেয়। সেখানে অলৌকিকতার কোন ‘inner logic’ থাকে না। যেমন, হেনরি জেমস-এর The Turn of the Screw উপন্যাসে দেখা যায়, এক গৃহশিক্ষিকা একটি পুরনো বাড়িতে একাকী বাস করতে গিয়ে ভূতের উপস্থিতি টের পায়, যা কখনোই নিশ্চিত করা যায় না। এখানে পাঠকও নিশ্চিত নন, তিনি বাস্তব দেখছেন, নাকি কল্পনা। অলৌকিকতা এখানে অবিশ্বাসকেই জন্ম দেয়।

অন্যদিকে জাদুবাস্তবতায় অলৌকিক উপাদান থাকে কিন্তু তা পাঠকের বিস্ময় তৈরি করে না, বরং তাকে এক অল্টারনেট বাস্তবতার দিকে ঠেলে দেয়। এই অলৌকিকতা প্রতীকের মতো কাজ করে, যা বাস্তব সংকটের নিরসনে ভূমিকা রাখে। উদাহরণস্বরূপ, শাহযাদ ফিরদাউসের শাইলকের বাণিজ্য বিস্তার (১৯৯৯) উপন্যাসের শেষাংশে আমরা দেখি, সিকান্দার তার পিতা ও পুত্রকে হারিয়ে এক উন্মত্ততার মধ্যে কবরের দিকে ছুটে যায়। গভীর রাতে হঠাৎ সে দেখে তার পিতা উঠে দাঁড়িয়েছে কবর থেকে। সে জানায়, সে মরেছে কারণ অতীত ও বর্তমানের সবকিছু বিক্রি হয়ে গিয়েছিল। এরপর দেখা যায় তার পুত্র যীশুও মৃত, এবং মাত্র কয়েক ঘণ্টাতেই পরিণত যুবক হয়ে উঠেছে! বাস্তব ও অবাস্তব এই বিন্যাস পাঠককে বিভ্রান্ত না করে বরং এক দার্শনিক উপলব্ধির দিকে নিয়ে যায়—সময়ের সঙ্গে বিক্রি হয়ে যাওয়া মানুষ ও সমাজের ভবিষ্যৎ নিয়ে এক ধাক্কা। এই দৃশ্য পাঠকের মনে স্থায়ী দাগ ফেলে। সিকান্দার ঘোর থেকে ফিরে বুঝে ফেলে, কেবল অর্থের জন্য সে কীভাবে অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সব কিছু বিক্রি করে ফেলেছিল। এবার সে উঠে দাঁড়ায়—সমাজকে বাঁচাতে। অর্থাৎ, অলৌকিকতা বাস্তবতার একটি রূপক, সমাজ-রাজনীতির সংকট থেকে মুক্তির বার্তা।

এই বৈশিষ্ট্যটি স্পষ্টভাবে নির্দেশ করেন সমালোচক অমরয়ল কেনেডি, যিনি বলেন,

“in contrast to the fantastic, the supernatural in magical realism does not disconcert the reader.”

অর্থাৎ ফ্যান্টাসির মতো পাঠককে বিহ্বল না করে, ম্যাজিক রিয়ালিজম পাঠককে অলৌকিকতার ভিতর দিয়েই একটি গভীর বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করায়। অলৌকিকতা সেখানে অবিশ্বাসের বিষয় নয়, বরং গ্রহণযোগ্য বাস্তবের রূপ। তাই এখানে ‘supernatural’ বিষয়টি শেষ পর্যন্ত হয়ে যায় ‘matter of fact’। এ ধরনের সাহিত্য সমাজের প্রান্তিক মানুষের কণ্ঠস্বরকে বাস্তবতার আলোকে উপস্থাপন করে, অলৌকিক উপাদান হয়ে ওঠে সেই উচ্চারণের বাহন। এই জায়গাটিই ফ্যান্টাসির সঙ্গে ম্যাজিক রিয়ালিজম-এর গভীর ব্যবধান তৈরি করে।

ফলে বিজ্ঞানধর্মী ও ফ্যান্টাস্টিক উপন্যাসের সঙ্গে জাদুবাস্তবতার পার্থক্য মূলত নিহিত থাকে বাস্তবতা, কল্পনার উদ্দেশ্য, অলৌকিকতার ব্যাকরণ ও পাঠকের বৌদ্ধিক অভিজ্ঞতায়। এই পার্থক্য বোঝার জন্য ম্যাজিক রিয়ালিজমকে বুঝতে হবে সমাজ, সংস্কৃতি ও রাজনীতির একটি নিরবচ্ছিন্ন কথনে—যা নিছক সাহিত্যিক অলংকার নয়, বরং সামাজিক বাস্তবতার এক নতুন পরিপ্রেক্ষিত।

ম্যাজিক রিয়ালিজম : প্রেক্ষাপটের আলোকে বিবর্তনধারা

এক

বিজ্ঞানধর্মী উপন্যাস ও জাদুবাস্তবতাধর্মী উপন্যাস—এই দুটি উপন্যাস-রীতির মধ্যে বাহ্যত কিছু মিল দেখা গেলেও, প্রকৃতপক্ষে তারা একে অপরের পরিপূরক নয়, বরং সম্পূর্ণ পৃথক দুই সাহিত্যিক মেজাজ ও দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন। দুটোতেই কল্পনার ব্যবহারে বিস্ময় তৈরি হয়, দুটোতেই পাঠকের প্রচলিত বাস্তববোধে ধাক্কা লাগে। কিন্তু এই বিস্ময় বা ধাক্কার চরিত্র, এর ব্যাকরণ, এর অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য এবং পরিণতির রূপ একেবারে ভিন্ন।

বিজ্ঞানধর্মী উপন্যাসের ভিত্তি গড়ে ওঠে বিজ্ঞানের সম্ভাব্যতা ও প্রযুক্তির ভবিষ্যত অভিযাত্রাকে কেন্দ্র করে। সেখানে অলৌকিকতা নেই, আছে ভবিষ্যতের সম্ভাব্যতা। বিজ্ঞান ও যুক্তির চূড়ান্ত সীমা পর্যন্ত গিয়ে কল্পনা যা তৈরি করে, তাই হল বিজ্ঞানধর্মী সাহিত্যের কেন্দ্রমূলে। এই পার্থক্যটি আরও স্পষ্ট করে তুলতে সমালোচক ম্যাজি অ্যান বাওয়ার বলেন,

“The science fiction narrative’s distinct difference from magical realism is that it is set in a world different from any known reality and its realism resides in the fact that we can recognize it as a possibility for our future. Unlike magical realism, it does not have a realistic setting that is recognizable in relation to any past or present reality.” (Maggie Ann Bowers, Magic(al) Realism, London, Routledge, 2004, P. 28)

এই বক্তব্যকে সামনে রেখে অল্ডাস হাক্সলির বিখ্যাত উপন্যাস Brave New World এর দিকে তাকালে বিষয়টি পরিষ্কার হয়। এখানে এক ভবিষ্যৎ সমাজ ব্যবস্থার চিত্র আঁকা হয়েছে, যেখানে মানুষ জন্ম নিচ্ছে কৃত্রিম উপায়ে, রাষ্ট্র পরিচালিত ল্যাবরেটরিতে রাসায়নিক প্রক্রিয়ায়। মানুষের ভাগ্য, তার শ্রেণিগত অবস্থান, এমনকি তার যৌনতা পর্যন্ত নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে সরকারের পরিকল্পিত প্রযুক্তির মাধ্যমে। বাস্তব পৃথিবীতে এমন প্রযুক্তি এখনো বাস্তবায়িত না হলেও, কল্পনায় তা এক পরীক্ষিত বৈজ্ঞানিক অনুমান হিসাবে ধরা হয়েছে। এখানে যে বাস্তবতা আছে তা ভবিষ্যতের সম্ভাব্যতা, বর্তমান বা অতীতের বাস্তবতা নয়। এই বিজ্ঞানধর্মী উপন্যাসে কল্পনার ভরকেন্দ্র প্রযুক্তি, আর ভবিষ্যতের ‘if’—এই দুটি বিষয় ঘিরে আবর্তিত।

এই দৃষ্টিকোণ থেকে যদি জাদুবাস্তবতাধর্মী উপন্যাসের দিকে তাকাই, তবে দেখা যাবে—এই ঘরানার আখ্যান বাস্তবতার মধ্যেই অবস্থিত, কিন্তু সেখানে অলৌকিকতা প্রবেশ করে ‘matter-of-fact’ ভঙ্গিতে। এই অলৌকিকতা প্রযুক্তি নির্ভর নয়, বরং সাংস্কৃতিক চেতনা, ঐতিহাসিক ক্ষোভ, লোকবিশ্বাস, এবং প্রান্তিক মানুষের অভিজ্ঞতার সাথে মিশে গড়ে ওঠে। এখানে অতীত ও বর্তমানের বাস্তবতা মিলেমিশে এমন এক জগৎ তৈরি করে, যেখানে অলৌকিকতা প্রায় প্রতিদিনের জীবনের মতো স্বাভাবিক। এই অলৌকিকতার লক্ষ্য মানবিক বা সামাজিক সংকট থেকে মুক্তির এক সম্ভাব্য ন্যারেটিভ তৈরি করা।

ফলে দেখা যাচ্ছে, বিজ্ঞানধর্মী সাহিত্য যেখানে বাস্তবতা থেকে দূরে, সেখানে জাদুবাস্তবতায় বাস্তবতা অনুপস্থিত নয়, বরং তার ভেতরেই একটি অতিরিক্ত মাত্রা যুক্ত হয়েছে। এই মাত্রা রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও প্রতিরোধমুখী। প্রযুক্তিনির্ভরতা যেখানে বিজ্ঞানধর্মী সাহিত্যের ভিত্তি, সেখানে ঐতিহ্য ও লোকবিশ্বাস জাদুবাস্তবতার স্তম্ভ।

এই ভেদরেখা আরও বিস্তৃত হয় যখন আমরা ফ্যান্টাস্টিক উপন্যাসের সঙ্গে জাদুবাস্তবতার তুলনায় মনোযোগ দিই। বহু নামী সমালোচক এই দুই ধারাকে একাকার করে দেখেছেন। আমেরিকার বিখ্যাত ফ্যান্টাসি লেখক গেনে ওলফ বলেছিলেন, ‘magic realism is only another name for fantasy fiction.’ তাঁর এই উক্তি অনেকে মেনে নিলেও, বিষয়গত বিচারে তা অনেকাংশে বিভ্রান্তিকর।

এই একই ভুল করেছেন সমালোচক নেল কর্ণওয়েল, তাঁর বিখ্যাত ফ্যান্টাসি সমালোচনা গ্রন্থ The Literary Fantastic : from Gothic to Postmodernism -এ, যেখানে তিনি সালমান রুশদির Midnight’s Children এবং টনি মরিসনের Beloved -কে সরাসরি ফ্যান্টাস্টিক সাহিত্যের অংশ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু এসব উপন্যাসের ভাষ্য কাঠামো, চরিত্রের গভীরতা এবং অলৌকিকতার সামাজিক-রাজনৈতিক অভিঘাত বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, এগুলি নিছক ‘fantasy’ নয়।

ফ্যান্টাস্টিক সাহিত্যের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে সমালোচক ক্যারিশ ব্যালডিক বলেন,

“A mode of fiction in which the possible and the impossible are confounded so as to leave the reader with no consistent explanation for the story’s strange events.” (Charis Baldick, The Oxford Dictionary of Literary Terms, New York, The Oxford University Press, 2008, P. 125)

অর্থাৎ, ফ্যান্টাসি বা ফ্যান্টাস্টিক সাহিত্যে সম্ভব ও অসম্ভবের মধ্যে এমন এক ধূসর এলাকা তৈরি হয়, যা পাঠককে দ্বিধায় ফেলে দেয়। সেখানে অলৌকিকতার কোন ‘inner logic’ থাকে না। যেমন, হেনরি জেমস-এর The Turn of the Screw উপন্যাসে দেখা যায়, এক গৃহশিক্ষিকা একটি পুরনো বাড়িতে একাকী বাস করতে গিয়ে ভূতের উপস্থিতি টের পায়, যা কখনোই নিশ্চিত করা যায় না। এখানে পাঠকও নিশ্চিত নন, তিনি বাস্তব দেখছেন, নাকি কল্পনা। অলৌকিকতা এখানে অবিশ্বাসকেই জন্ম দেয়।

অন্যদিকে জাদুবাস্তবতায় অলৌকিক উপাদান থাকে কিন্তু তা পাঠকের বিস্ময় তৈরি করে না, বরং তাকে এক অল্টারনেট বাস্তবতার দিকে ঠেলে দেয়। এই অলৌকিকতা প্রতীকের মতো কাজ করে, যা বাস্তব সংকটের নিরসনে ভূমিকা রাখে। উদাহরণস্বরূপ, শাহযাদ ফিরদাউসের শাইলকের বাণিজ্য বিস্তার (১৯৯৯) উপন্যাসের শেষাংশে আমরা দেখি, সিকান্দার তার পিতা ও পুত্রকে হারিয়ে এক উন্মত্ততার মধ্যে কবরের দিকে ছুটে যায়। গভীর রাতে হঠাৎ সে দেখে তার পিতা উঠে দাঁড়িয়েছে কবর থেকে। সে জানায়, সে মরেছে কারণ অতীত ও বর্তমানের সবকিছু বিক্রি হয়ে গিয়েছিল। এরপর দেখা যায় তার পুত্র যীশুও মৃত, এবং মাত্র কয়েক ঘণ্টাতেই পরিণত যুবক হয়ে উঠেছে! বাস্তব ও অবাস্তব এই বিন্যাস পাঠককে বিভ্রান্ত না করে বরং এক দার্শনিক উপলব্ধির দিকে নিয়ে যায়—সময়ের সঙ্গে বিক্রি হয়ে যাওয়া মানুষ ও সমাজের ভবিষ্যৎ নিয়ে এক ধাক্কা। এই দৃশ্য পাঠকের মনে স্থায়ী দাগ ফেলে। সিকান্দার ঘোর থেকে ফিরে বুঝে ফেলে, কেবল অর্থের জন্য সে কীভাবে অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সব কিছু বিক্রি করে ফেলেছিল। এবার সে উঠে দাঁড়ায়—সমাজকে বাঁচাতে। অর্থাৎ, অলৌকিকতা বাস্তবতার একটি রূপক, সমাজ-রাজনীতির সংকট থেকে মুক্তির বার্তা।

এই বৈশিষ্ট্যটি স্পষ্টভাবে নির্দেশ করেন সমালোচক অমরয়ল কেনেডি, যিনি বলেন,

“in contrast to the fantastic, the supernatural in magical realism does not disconcert the reader.”

অর্থাৎ ফ্যান্টাসির মতো পাঠককে বিহ্বল না করে, ম্যাজিক রিয়ালিজম পাঠককে অলৌকিকতার ভিতর দিয়েই একটি গভীর বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করায়। অলৌকিকতা সেখানে অবিশ্বাসের বিষয় নয়, বরং গ্রহণযোগ্য বাস্তবের রূপ। তাই এখানে ‘supernatural’ বিষয়টি শেষ পর্যন্ত হয়ে যায় ‘matter of fact’। এ ধরনের সাহিত্য সমাজের প্রান্তিক মানুষের কণ্ঠস্বরকে বাস্তবতার আলোকে উপস্থাপন করে, অলৌকিক উপাদান হয়ে ওঠে সেই উচ্চারণের বাহন। এই জায়গাটিই ফ্যান্টাসির সঙ্গে ম্যাজিক রিয়ালিজম-এর গভীর ব্যবধান তৈরি করে।

ফলে বিজ্ঞানধর্মী ও ফ্যান্টাস্টিক উপন্যাসের সঙ্গে জাদুবাস্তবতার পার্থক্য মূলত নিহিত থাকে বাস্তবতা, কল্পনার উদ্দেশ্য, অলৌকিকতার ব্যাকরণ ও পাঠকের বৌদ্ধিক অভিজ্ঞতায়। এই পার্থক্য বোঝার জন্য ম্যাজিক রিয়ালিজমকে বুঝতে হবে সমাজ, সংস্কৃতি ও রাজনীতির একটি নিরবচ্ছিন্ন কথনে—যা নিছক সাহিত্যিক অলংকার নয়, বরং সামাজিক বাস্তবতার এক নতুন পরিপ্রেক্ষিত।

সাহিত্যে বাস্তববাদ প্রশ্নকেন্দ্রিক যতগুলি আন্দোলন সংগঠিত হয়েছে, তার সবকটিরই সূচনা ও বিস্তারের প্রেক্ষাপট ছিল ইউরোপ। এই আন্দোলনের বুদ্ধিবৃত্তিক ইতিহাসের মধ্যে ইউরোপের উপনিবেশবাদের বিস্তার অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে। ফলে ইউরোপীয় চিন্তাধারাগুলোর সঙ্গে উপনিবেশগুলোর সাহিত্যের সম্পর্কও প্রভুত পরিমাণে সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের ভেতর দিয়েই গঠিত হয়। বৌদ্ধিক পরিসরকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদ কেবল বন্দুক, কামান ও শাসন দিয়ে নয়, চিন্তন ও রুচি-রাজনীতির ক্ষেত্রেও একপ্রকার দখলদারি কায়েম করেছিল।

এই সাংস্কৃতিক উপনিবেশবাদী ধারা থেকে মুখ ফিরিয়ে এক প্রকার আত্মচেতনার অভিমুখে দাঁড়াল ম্যাজিক রিয়ালিজম। পঞ্চাশের দশকে এই নতুন বয়ান যেন ইউরোপীয় আধিপত্যবাদকে চোখে চোখ রেখে পাল্টা জবাব দিল। এই প্রথম কোনও সাহিত্য আন্দোলন যার ঢেউ উত্থিত হয়েছিল তৃতীয় বিশ্বের মাটিতে, পরবর্তীকালে তা ছড়িয়ে পড়েছিল প্রথম বিশ্বের সাহিত্য জগতে। মূলত সেই সব পোস্টকলোনিয়াল ভূখণ্ড, যারা শতাব্দীজুড়ে ঔপনিবেশিক শোষণ-নিপীড়নের শিকার হয়েছিল, সেখান থেকেই উঠে এসেছিল এই সাহিত্যের শক্তিশালী ধারা। আজ অবধি ইউরোপের বাইরের দেশগুলির সাহিত্যধারা বলতে যা বোঝানো হয়—তৃতীয় বিশ্বের সাহিত্য—তার প্রকৃত স্বাধীন অস্তিত্ব ম্যাজিক রিয়ালিজম-এর মাধ্যমে সাংগঠনিক রূপ পায়।

এই আন্দোলনের সূতিকাগার ছিল লাতিন আমেরিকা। ইতিহাস, মিথ, আদিবাসী সংস্কৃতি, উপনিবেশিক শোষণের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা, ভৌগোলিক বিচিত্রতা এবং রাজনৈতিক উথালপাথাল—এই মিলিত প্রেক্ষাপটকে ঘিরেই গড়ে উঠেছিল এক ধরণের কল্পনার বাস্তবতা, যা ছিল ইউরোপীয় বাস্তববাদের পরিপূরক নয়, বরং বিরোধী। এখানেই ম্যাজিক রিয়ালিজম হয়ে উঠল এক নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির নাম, যা ইউরোপকেন্দ্রিক সাহিত্য-ভাবনার বিকল্প পথ তৈরি করল।

লাতিন আমেরিকার ম্যাজিক রিয়ালিজম-এর সূচনালগ্নে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নাম আলেহো কার্পেন্তিয়ের। তিনি সাহিত্য ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে “marvelous realism” শব্দটি ব্যবহার করেন, যাকে আমরা জাদুবাস্তবতা হিসেবেই বুঝি। তিনি ইউরোপীয় ম্যাজিক রিয়ালিজমকে আখ্যায়িত করেছিলেন “tiresome pretension” হিসেবে, অর্থাৎ ক্লান্তিকর এক অনাবশ্যক ভঙ্গি, যার সঙ্গে ঐতিহ্য বা সংস্কৃতির কোনও সম্পর্ক নেই। ইউরোপ যেখানে যুক্তিবাদী দর্শনের উপর দাঁড়িয়ে মিস্টিসিজমের খোলস পরিয়ে ম্যাজিক নির্মাণ করে, সেখানে লাতিন আমেরিকার বাস্তবতা নিজেই এত বিস্ময়কর, এত নাটকীয়, এত মিথ-ভিত্তিক যে সেখানে ম্যাজিক আর কল্পনা নয়—বাস্তবতারই রূপ।

এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই জন্ম নিয়েছিল কার্পেন্তিয়ের-এর প্রথম ম্যাজিক রিয়ালিস্ট উপন্যাস ‘The Kingdom of This World’ (১৯৪৯)। এই উপন্যাসে তিনি ১৮ শতকের হাইতির ঐতিহাসিক ক্রীতদাস বিদ্রোহের পটভূমিতে গড়ে তোলেন একটি বিস্ময়কর অথচ ঐতিহাসিক সত্যভিত্তিক বয়ান। মূল চরিত্র মাকান্দাল তার গায়ের রঙ, দেহের গঠন বা আকৃতি বদলে উড়ে যেতে পারে, প্রাণীর রূপ নিতে পারে—এই অলৌকিক ক্ষমতার মধ্য দিয়েই তিনি নিজের দাসত্ব ঘুচিয়ে বিপ্লব সংগঠিত করেন। কার্পেন্তিয়ের তার বিখ্যাত প্রবন্ধ “The Baroque and the Marvelous Real”-এ লেখেন,

“Mackandal revolt, which makes thousands and thousands of slaves in Haiti believe that he has lycanthropic powers…”

এই বিশ্বাসই পরবর্তীকালে এক বিস্ময়কর বিপ্লবের জন্ম দেয়।

এই ধারণার বীজ থেকেই আরও গভীরে গিয়ে কার্পেন্তিয়ের লেখেন ‘The Lost Step’ (১৯৫৩)। এখানে তিনি একজন আধুনিক শিল্পীর যাত্রাপথকে কেন্দ্র করে সাজান এমন এক আখ্যান, যেখানে সেই শিল্পী চলচ্চিত্রের জন্য সংগীত তৈরি করতে করতে আদিম বাদ্যযন্ত্র সংগ্রহ করতে গিয়ে নিজের শিকড়ে, অতীতে পৌঁছে যায়। এটি কেবল সংগীত সংগ্রহের আখ্যান নয়, বরং একটি সভ্যতার আত্মসন্ধানের রূপক।

এই আত্মসন্ধানী ধারার পথ ধরেই এগিয়ে আসেন মিগুয়েল আনহেল আস্তুরিয়াস। তাঁর উপন্যাস ‘The President’ (১৯৪৬) এবং ‘Men of Maize’ (১৯৪৯) লাতিন আমেরিকার স্বৈরতন্ত্র ও ঔপনিবেশিক নিপীড়নের বিরুদ্ধে এক বিশাল ক্যানভাসে লড়াইয়ের ন্যারেটিভ নির্মাণ করে। বিশেষত দ্বিতীয় উপন্যাসে মায়ান মিথ এবং বিশ্বাসকে উপজীব্য করে একটি প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর পুনরুত্থানের কাহিনি রচনা করেছেন। ‘রেইন ওমেন’-এর আগমন একটি অলৌকিক অভিজ্ঞতা হলেও, তা চরিত্রদের বাস্তবতাকে পালটে দেয়, তাদের অস্তিত্ব রক্ষার শক্তি জোগায়। এই অলৌকিকতা কখনও মিষ্টিক নয়, বরং বাস্তব রাজনৈতিক বঞ্চনার বিরুদ্ধে এক ধরণের প্রতিরোধী কল্পনাশক্তি।

অন্যদিকে মেক্সিকোর সাহিত্যেও ম্যাজিক রিয়ালিজম এক শক্তিশালী প্রতিবাদের ভাষা হয়ে ওঠে। হুয়ান রুলফোর ‘Pedro Paramo’ (১৯৫৫) উপন্যাসে এক মৃত মানুষের শহরে একজন মানুষ এসে পৌঁছায়, যেখানে শুধু অতীত, শুধু স্মৃতি। বেঁচে থাকা চরিত্রগুলোরও যেন কণ্ঠস্বর মৃতদের কণ্ঠস্বর। এই মৃত্যুচেতনাই আসলে লাতিন আমেরিকার রাজনৈতিক অবক্ষয়ের রূপক। নতুন সরকার আসে, পুরাতন শাসকের পোশাক পরে তারা আবার ক্ষমতা ধরে রাখে। এই প্রহসনের ভেতর দিয়েই রুলফোর আখ্যান এক ধরণের স্মৃতিনির্ভর ম্যাজিকাল টোন নিয়ে গড়ে ওঠে।

কার্লোস ফুয়েন্তেস এই ধারাকে আরও গভীরতর করেন ‘Aura’ (১৯৬২) ও ‘Distant Relations’ (১৯৮০) উপন্যাসে। সেখানে সময়, স্মৃতি ও অলৌকিকতার মিশেল এক চমৎকার বয়ান সৃষ্টি করে, যেখানে অতীতের ভূতেরা বর্তমানকে চালনা করে। তাঁর লেখায় স্প্যানিশ উপনিবেশিক ইতিহাস, আধুনিক জাতিসত্তার সংকট এবং স্মৃতির রাজনীতি একত্রে কাজ করে।

আর্জেন্টিনার মানুয়েল পুইগ ‘Betrayed by Rita Hayworth’ (১৯৬৮) উপন্যাসে তুলে ধরেন গণমাধ্যম-নির্ভর সমাজে গড়ে ওঠা হলিউডপ্রেমী চরিত্রদের, যারা বাস্তব জীবনের অভাবে সিনেমার স্বপ্নে বাঁচে। এই বাস্তবতাবর্জিত জীবনও এক ধরনের সাংস্কৃতিক নিপীড়ন। অন্যদিকে ‘Kiss of the Spider Woman’ (১৯৭৬) উপন্যাসে চরিত্রেরা ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রের হাতে বন্দি হয়, এবং অলৌকিক কথোপকথনের মাধ্যমে নিজেদের বেঁচে থাকার উপায় খুঁজে পায়। এই অলৌকিকতা বা কল্পনার আশ্রয় এখানে বাস্তব রক্ষার কৌশল।

মারিও ভার্গাস য়োসা পেরুর সামরিক স্বৈরতন্ত্র, বর্ণবৈষম্য ও আদিবাসী নিপীড়নের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন তাঁর ‘The Green House’ (১৯৬৬), ‘Conversation in the Cathedral’ (১৯৬৯) উপন্যাসে। তাঁর রচনায় ম্যাজিক রিয়ালিজম কেবল অলৌকিকতার খেলা নয়, বরং একটি রাজনৈতিক ন্যারেটিভের অংশ—যেখানে ক্ষমতার কেন্দ্রীয় রূপটি ভেঙে দেওয়ার জন্য ঐতিহ্য, স্মৃতি এবং কল্পনাকে একত্রে যুক্ত করা হয়। তাঁর মতে, “সাহিত্য হল আগুন”—যেখানে আপোষ নয়, বিরোধিতা এবং বিদ্রোহই লেখকের মৌলিক ধর্ম।

এইভাবে গোটা লাতিন আমেরিকান অঞ্চলে ম্যাজিক রিয়ালিজম হয়ে উঠেছিল একধরনের প্রতিবাদী কাব্যভাষা। প্রতিটি লেখকের হাতে এই কৌশল নতুনভাবে রূপান্তরিত হয়েছে, কিন্তু মূল লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হয়নি। ইউরোপীয় যুক্তিবাদ, বস্তুবাদ এবং একমাত্রিক বাস্তবতার বিরুদ্ধে এই আন্দোলন আত্মপরিচয়, সংস্কৃতি ও ইতিহাসকে জড়িয়ে গড়ে তুলেছিল এক নতুন বয়ান—যা কেবল সাহিত্যের নয়, এক সাংস্কৃতিক প্রতিরোধের নামও বটে।

তবে লাতিন আমেরিকার জাদুবাস্তবতার বিস্ফোরণ ঘটেছিল যাঁর কলমে, যাঁর কল্পনাশক্তির উর্বরতায়, যাঁর ঐতিহাসিক চেতনার গভীরতায়, তিনি নিঃসন্দেহে গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস। জাদুবাস্তবতা শব্দটি লাতিন আমেরিকার সাহিত্য-সংস্কৃতির সঙ্গে একাকার হয়ে যায় মূলত মার্কেসের লেখনীর মধ্য দিয়ে। তার আগে আলেহো কার্পেন্তিয়ের এই ধারাটির তাত্ত্বিক ভিত্তি নির্মাণ করেছিলেন, উপনিবেশ-উত্তর লাতিন আমেরিকান জীবনের সাংস্কৃতিক এবং ইতিহাসচর্চার এক নতুন পদ্ধতি হিসেবে ‘marvelous realism’-এর ধারণা তুলে ধরেছিলেন, কিন্তু মার্কেস এই দর্শনকে কেবল তাত্ত্বিক স্তরে রাখেননি, বরং তার উপন্যাসের আখ্যান নির্মাণে তাকে প্রতিফলিত করেছিলেন নিখুঁত শিল্পসুষমায়। এই দুই লেখকের মধ্যে যেন এক সম্পূর্ণ চক্রের সৃষ্টি হল। কার্পেন্তিয়ের যে বাস্তবতার মর্মস্থলে পৌরাণিক বিশ্বাস ও ঐতিহ্যকে স্থাপন করে নতুন বাস্তবতা নির্মাণের কথা বলেছিলেন, মার্কেস সেখানে যোগ করলেন নস্টালজিয়া, যোগ করলেন লোপাট হয়ে যাওয়া ইতিহাসের (“Felt History”) অনুসন্ধান।

এই দুই মেরুর মধ্যে ভরকেন্দ্র স্থাপন করেই গড়ে উঠেছিল মার্কেসের জাদুবাস্তবতা। তাঁর উপন্যাসে একদিকে দৃশ্যমান, অভিজ্ঞতালব্ধ বাস্তবতা, অন্যদিকে সময়ের গর্ভে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া অথচ গোষ্ঠীগত স্মৃতিতে জীবন্ত হয়ে ওঠা ইতিহাসের বয়ান। এই দ্বৈত বাস্তবতাই লাতিন আমেরিকার জাদুবাস্তবতার পূর্ণতা প্রদান করে। ঔপনিবেশিক ইতিহাসচর্চার যে চেতনাভিত্তিক নির্মাণ আছে, মার্কেস তার বিপরীতে দাঁড় করালেন আরেকটি চৈতন্য, যেটি নির্জনতা, হাহাকার, হিংসা ও স্মৃতির অনিঃশেষ জগৎ থেকে উঠে আসে।

মার্কেস জন্মগ্রহণ করেছিলেন এমন একটি কলম্বিয়ায়, যেখানে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও হিংসার দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। ১৮৯৯ সালে কলম্বিয়া এক গৃহযুদ্ধের মুখোমুখি হয়, যা ‘The War of a Thousand Days’ নামে পরিচিত। এরপর ১৯৪৮ থেকে ১৯৫৮ পর্যন্ত সময়কাল জুড়ে চলে আরেকটি নিষ্ঠুর অধ্যায়, যা পরিচিত হয় ‘La Violencia’ নামে। হাজার হাজার মানুষ প্রাণ হারান, গণহত্যা, ধর্ষণ, গুম, দমন-পীড়নের ইতিহাসে কলম্বিয়া পরিণত হয় এক বিভীষিকার রাষ্ট্রে। এই রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়েই রচিত হয় মার্কেসের অমর কাব্যিক উপন্যাস, ‘One Hundred Years of Solitude’ (1967)। এই উপন্যাস কেবল একটি পরিবারের সাত প্রজন্মের কাহিনি নয়; এটি এক বিপন্ন জনপদের ইতিহাস, এক বেদনার্ত ভূখণ্ডের আত্মজৈবনিক চিত্র।

মাকন্দো নামক কাল্পনিক জনপদে যে ইতিহাসের জাল বোনা হয়, সেটি কেবল একটি বিশেষ ভূগোলের প্রতিনিধিত্ব করে না, বরং উপনিবেশ-উত্তর লাতিন আমেরিকার রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, সামাজিক নিপীড়ন এবং সাংস্কৃতিক বিচ্যুতির প্রতীক হয়ে ওঠে। মার্কেস নিখুঁত কুশলতায় যুক্ত করেন পৌরাণিক উপাদান, প্রেতচরিত, অলৌকিকতা, অতিলৌকিক দৃষ্টিভঙ্গি, এমনকি ঐতিহাসিক সত্য, এবং তাদের মিশিয়ে দেন এমনভাবে যে, পাঠকের চোখে তা বাস্তব বলেই প্রতিভাত হয়। এই নিখুঁত সংমিশ্রণই ম্যাজিক রিয়ালিজম-এর সত্য বৈশিষ্ট্য।

পরবর্তীকালে ‘The Autumn of the Patriarch’ (El Otoño del Patriarca, 1975) উপন্যাসে মার্কেস সরাসরি আক্রমণ করেন লাতিন আমেরিকার স্বৈরাচারী শাসকদের। এই উপন্যাস নির্মিত হয়েছে এমন একটি স্বৈরশাসকের কাহিনিকে ঘিরে, যার মৃত্যু হয় বারবার, কিন্তু সে আবার ফিরে আসে নতুন চেহারায়, নতুন প্রতাপে। মার্কেস এখানে যেন ইতিহাসকে তুলে ধরেন না, বরং ইতিহাসের পুনরাবৃত্তিকে সামনে আনেন। প্রতিটি স্বৈরাচার শেষ হয়, কিন্তু তার জায়গা নেয় আরেকজন, আরেক হিংস্র মুখ। প্রতিটি স্বপ্ন ব্যর্থ হয়, আর প্রতিটি বিপ্লব খোয়ায় নিজের চেতনা। এই রাজনৈতিক সত্যকেই তিনি উপন্যাসে প্রকাশ করেন এক অলৌকিক আখ্যানে, যেখানে মৃত্যুই যেন জীবনের একমাত্র স্থায়ী অনুষঙ্গ।

মার্কেসের সাহিত্যজগৎ নির্মাণে এক গভীর প্রভাব ফেলেছিল তাঁর শৈশবের পরিবেশ। ঠাকুরমার মুখে শোনা অলৌকিক গল্প, মামাদাদুর কুসংস্কারাচ্ছন্ন দৃষ্টিভঙ্গি, প্রেতচর্চা, অদ্ভুত আচার-অনুষ্ঠান, এবং পরিবারের নারীদের নিঃশব্দ অথচ দৃঢ় উপস্থিতি, এসবই তাঁর সাহিত্যিক নির্মাণে গভীর ছাপ ফেলেছিল। এই ব্যক্তিগত ইতিহাসই সামাজিক ইতিহাসে রূপান্তরিত হয় তাঁর ‘The Incredible and Sad Tale of Innocent Eréndira and Her Heartless Grandmother’ (1972) নামক উপন্যাসে। এখানে একটি তরুণী নাবালিকার গল্পের মধ্য দিয়ে তিনি চিত্রায়ন করেন নারীশোষণ, পারিবারিক নিষ্ঠুরতা, এবং সমাজের নৈতিক পতনের চিত্র। এই উপন্যাসে নারী-ক্ষমতায়নের স্পষ্ট ইঙ্গিত থাকলেও তা একমাত্রিক নয়, বরং জাদুবাস্তবতায় আচ্ছাদিত হয়ে তৈরি করে এক প্রহেলিকাময় বাস্তবতা।

লাতিন আমেরিকার জাদুবাস্তবতার আরেক বিস্ময়কর কণ্ঠ হলেন আন্তোনিও স্কারমেতা। চিলির ইতিহাসের রক্তাক্ত অধ্যায়, গণতন্ত্রের পতন, এবং বহুজাতিক বাণিজ্য সংস্থার শোষণ তাঁর লেখায় উঠে আসে গভীর আবেগ ও তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গের ছায়ায়। তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস ‘Ardiente Paciencia’ (1985) কেবল প্রেমের আখ্যান নয়, বরং সেখানে রাজনৈতিক সংগ্রাম, স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা, এবং ভাষার শক্তিকে তিনি একত্রে গেঁথেছেন। পিনোচেতের স্বৈরাচারী শাসনের ছায়ায় এই উপন্যাসে চিলির কবি পাবলো নেরুদার বাস্তব জীবনকেও মিশিয়ে দেন স্কারমেতা। এখানে কাব্য আর রাজনীতি একত্রে গড়ে তোলে এক প্রগাঢ় আবেগনির্ভর জগৎ।

চিলির আরেক গুরুত্বপূর্ণ জাদুবাস্তব ঔপন্যাসিক ইসাবেল অ্যালেন্দে। তাঁর ‘The House of the Spirits’ (La Casa de Los Espíritus, 1982) উপন্যাসটি জাদুবাস্তবতার প্রায় এক অভিধান। একটি পরিবারের তিন প্রজন্মের আখ্যানের মধ্যে তিনি সুনিপুণভাবে তুলে ধরেন স্বৈরাচারের উত্থান ও পতনের চিত্র, নারীর আত্মপ্রতিষ্ঠা, প্রেতচরিত ও পূর্বপুরুষদের আত্মার অস্তিত্ব, এবং রাজনৈতিক বোধের বিকাশ। আল্বা চরিত্রটি এই আখ্যানের মর্মস্থলে অবস্থান করে, যাকে তার পূর্বপুরুষদের আত্মারা পথ দেখায়। ভুতুড়ে পরিবেশ, অলৌকিক উপস্থিতি, এবং অতিপ্রাকৃত শক্তির প্রয়োগ এখানে কেবল চমক সৃষ্টির জন্য নয়, বরং তারা সক্রিয় রাজনৈতিক উপাদান হিসেবে কাজ করে। আল্বা এক সময়ে বুঝে যায় তার দায়িত্ব, তার লড়াই, তার অস্তিত্ব কেবল ব্যক্তিগত নয়—এটি একটি গোটা জাতির মুক্তির ইঙ্গিত।

আর্জেন্টিনার মানুয়েল পুইগ তাঁর ‘Betrayed by Rita Hayworth’ (La Traición de Rita Hayworth : 1968) উপন্যাসে তুলে ধরেন মধ্যবিত্ত সমাজের স্বপ্নভঙ্গের বেদনাকে। এখানে হলিউডি সিনেমার রঙিন দুনিয়া বাস্তব জীবনের ক্লেদাক্ত রাস্তায় ধাক্কা খায়। সিনেমার নায়কদের মতো হতে চাওয়া চরিত্রগুলো বাস্তবের মুখোমুখি হয়ে ক্রমশ ভেঙে পড়ে। মার্কেস যেমন বাস্তবতার সঙ্গে অতিপ্রাকৃত যুক্ত করেন, পুইগ সেখানে বাস্তবতার সঙ্গে মিডিয়ার কাল্পনিকতাকে যুক্ত করেন, এবং নির্মাণ করেন এক ধরনের সাংস্কৃতিক জাদুবাস্তবতা। তার ‘Kiss of the Spider Woman’ (El Beso de la Mujer Arana : 1976) উপন্যাসে আবার তিনি লিঙ্গরাজনীতি, যৌনতা, এবং রাজনৈতিক বিশ্বাসের সংঘর্ষকে তুলে ধরেন অলৌকিক আখ্যানের গঠনরীতিতে।

ম্যাজিক রিয়ালিজম থেকে সাহিত্য আন্দোলন: এক সাহিত্যিক অভিযাত্রা
চিত্রঃ মানুয়েল পুইগ, Image Source: Google

লাতিন আমেরিকার জাদুবাস্তবতার ধারাটি পূর্ণতা পায় যখন আমরা পেরুর নোবেলজয়ী লেখক মারিও ভার্গাস য়োসার দিকে তাকাই। তাঁর উপন্যাসে উঠে আসে প্রজাতান্ত্রিক ক্ষমতার দখল নিয়ে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, দলবাজি, দুর্নীতি এবং রাজনৈতিক হিংসার করুণ চিত্র। তাঁর ‘The Green House’ (La Casa Verde : 1966), কিংবা ‘Conversation in the Cathedral’ (Conversación en la Catedral : 1969) উপন্যাসে দেখা যায়, কিভাবে এক একটি রাষ্ট্র নৃশংসতা আর চক্রান্তের মধ্যে দিয়ে নিজেদের শাসন বজায় রাখে। এই সমস্ত ঘটনা তিনি চিত্রায়ন করেন এমনভাবে, যেখানে বাস্তবতা যেন চমৎকৃত হয়ে যায় অলৌকিকতার মুখোমুখি হয়ে। তাঁর ভাষা, আখ্যানের গঠন, সময়-চক্রের ভঙ্গুরতা এবং স্মৃতির অলিন্দে বিচরণ—সব মিলিয়ে গড়ে ওঠে এক গভীর রাজনৈতিক জাদুবাস্তবতা।

মার্কেস একবার বলেছিলেন,

“I’m a journalist. I’ve always been a journalist. My books couldn’t have been written if I weren’t a journalist because all the material was taken from reality.”

এই কথার মধ্যেই লুকিয়ে আছে লাতিন আমেরিকার জাদুবাস্তবতার মূল সূত্র: এখানে কিছুই নিছক কল্পনা নয়, বরং প্রতিটি অলৌকিক ঘটনাই এমন এক বাস্তবতার অংশ, যা হয়তো চোখে দেখা যায় না, কিন্তু অভিজ্ঞতায় প্রবলভাবে অনুভব করা যায়। এই অনুভবই ইতিহাসের বিকল্প রূপ নির্মাণ করে। লাতিন আমেরিকার সেই বিকল্প ইতিহাসের ধারাবাহিকতা, নিপীড়িত স্বরগুলোর দৃশ্যমানতা, এবং ঐতিহ্যের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের মিথিক উপস্থিতিই হল এই সাহিত্যের কেন্দ্রবিন্দু।

এভাবেই লাতিন আমেরিকার জাদুবাস্তবতা গড়ে তুলেছিল এক নবজাগরণ—যেখানে কাহিনি আর কল্পনা কেবল শিল্পের অনুষঙ্গ নয়, বরং এক তীব্র রাজনৈতিক হাতিয়ার। একদিকে শোষকের প্রতাপ, অন্যদিকে শোষিতের কল্পনার শক্তি-এই দুই বিপরীত স্রোতের সংঘাতে জন্ম নেয় জাদুবাস্তবতার এই বিশালতর ন্যারেটিভ। এবং সেটিই হয়ে ওঠে ইতিহাসের বিকল্প পাঠ।

দুই

লাতিন আমেরিকায় জন্ম নেওয়া ও পরিণত হয়ে ওঠা জাদুবাস্তবতা (Magical Realism) সাহিত্যরীতিটি একুশ শতকে এসে আর কেবল একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। বরং বলা চলে, এর প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের নানা প্রান্তে, বিভিন্ন ভাষাভাষী সাহিত্যে, বিভিন্ন রাজনৈতিক বাস্তবতায়। এই বিশ্বব্যাপী বিস্তারের প্রক্রিয়ায়, লাতিন আমেরিকার বাইরেও যে অঞ্চলটি প্রথম প্রত্যক্ষভাবে এই সাহিত্যরীতির অনুপ্রেরণায় নতুন লেখালিখির সূচনা ঘটায়, তা হচ্ছে কানাডা। এর পরপরই দেখা যায় ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ, পশ্চিম আফ্রিকা, এবং তারপর ধাপে ধাপে ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড সহ ইউরোপের একাধিক দেশে এর ছায়াপাত। ইউরোপের ক্ষেত্রে ফ্রাঞ্জ রো’য়ের (Franz Roh) নান্দনিক তাত্ত্বিক প্রভাব, যিনি ‘ম্যাজিক রিয়ালিজম’ শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেছিলেন চিত্রকলা সম্বন্ধে, বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে। তাঁর চিন্তার সূত্র ধরেই পরবর্তীতে ইতালি, বেলজিয়াম, ইংল্যান্ড, জার্মানি ও ফ্রান্সের সাহিত্যেও জাদুবাস্তবতার প্রবেশ ঘটে।

জাদুবাস্তবতা এমন এক সাহিত্যধারা, যা একই সঙ্গে বাস্তবতার অন্তঃসার অনুধাবন করে এবং সেই বাস্তবতার গায়ে অলৌকিকতার আবরণ যুক্ত করে দেয়। এটি কেবলমাত্র অলৌকিক উপাদানের ব্যবহার নয়, বরং এমন এক দৃষ্টিভঙ্গি যা দৈনন্দিনের মধ্যেই বিস্ময় ও অপ্রত্যাশিতের উপস্থিতিকে স্বাভাবিক করে তোলে। যে দেশগুলো নিজস্ব রাজনৈতিক ইতিহাসে ঔপনিবেশিক শাসনের ভার বহন করেছে, সাংস্কৃতিকভাবে প্রান্তিক হয়ে উঠেছে, তাদের সাহিত্যেই জাদুবাস্তবতার প্রতি বিশেষ টান লক্ষ করা যায়। এরকমই এক দেশ কানাডা।

কানাডা বিশ্বের সবচেয়ে সচেতন, রাজনৈতিকভাবে সংবেদনশীল এবং বৈচিত্র্যপূর্ণ দেশগুলির একটি। অথচ এদেশও এড়াতে পারেনি ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক আধিপত্য। প্রথমে ব্রিটিশ শাসনের মাধ্যমে, পরবর্তীতে নব্য উপনিবেশিক মোড়কে যুক্তরাষ্ট্রের সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের মাধ্যমে একধরনের প্রান্তিক জাতিতে পরিণত হয় তারা। ফলে গড়ে ওঠে একধরনের সাংস্কৃতিক সংকট ও আত্মপরিচয়ের অন্বেষণ। এই পটভূমিতেই লাতিন আমেরিকার জাদুবাস্তবতা এসে পৌঁছায় কানাডায়, এবং একরকম আত্মীয় আত্মার মতো মিশে যায় কানাডীয় সাহিত্যের অভ্যন্তরে।

সমালোচক আগনিয়েজকা রাজেপা (Agnieszka Rzepa) যথার্থই লক্ষ করেন,

“the major impetus behind Canadian magic realist literary production in the 1970s was undoubtedly that of the Latin American boom of the 1950s and 60s, Garcia Marquez’s One Hundred Years of Solitude (1967) providing probably the most important single influence.” (Agnieszka Rzepa, Feats and Defeats of Memory : Exploring Space of Canadian Magic Realism, UAM, University of Ottawa, P. 31)।

অর্থাৎ, কানাডীয় সাহিত্যিকরা যখন তাদের আত্মপরিচয়ের সংকটে ভুগছেন, তখনই মার্কেসের ‘One Hundred Years of Solitude’ যেন হয়ে উঠল এক বিকল্প কল্পনা ও ভাষার পাথেয়।

এই প্রভাবকে বাস্তব রূপ দেন রবার্ট ক্রোয়েচ (Robert Kroetsch)। তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস What the Crow Said (1978) একটি পরিপূর্ণ পোস্ট-কলোনিয়াল উপাখ্যান। এখানে মার্কেসের প্রভাব অস্বীকার করার উপায় নেই। তিনি উপন্যাসে উপস্থাপন করেন পশ্চিম কানাডার প্রান্তিক এক জনপদের মানুষজন, যারা দীর্ঘদিন ধরে ঔপনিবেশিক দমননীতির শিকার। ব্রিটিশ এবং আমেরিকান দু’ধরনের শাসনের প্রতীক হিসেবে তিনি তুলে ধরেন মৌমাছিদের—যারা মাতৃভূমি ভেরাকে আক্রমণ করে চলে। ভেরা, এই নারী প্রতীকী চরিত্রটি নিজেই যেন কানাডার রূপ। মৌমাছির আক্রমণের মধ্য দিয়ে লেখক এক শতকের ঔপনিবেশিক শোষণ ও আঘাতের কথা স্মরণ করিয়ে দেন। তবে লক্ষণীয়, লাতিন আমেরিকার মতো সাংস্কৃতিক বিপর্যয়ের তীব্রতা এখানে অনুপস্থিত। বরং ক্রোয়েচের বক্তব্য যেন একধরনের পুনর্দখলের প্রচেষ্টা—প্রান্তিক কণ্ঠস্বরকে সাহিত্যের কেন্দ্রে নিয়ে আসা।

এই সাহিত্য-প্রবণতা আরও গভীর রূপ পায় জ্যাক হগিন্স (Jack Hodgins)–এর লেখায়। তাঁর উপন্যাস The Invention of the World (1977) এক অনন্য জাদুবাস্তব পটভূমি নির্মাণ করে, যেখানে উপনিবেশবাদ-উত্তর যুগের টানাপোড়েন এবং দার্শনিক অন্বেষণ মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। এই উপন্যাসে আমরা দেখতে পাই এমন এক জাদুকরী চরিত্র, যার অস্তিত্ব আলেহো কার্পেন্তিয়েরের মাকান্দালের মতো—যিনি নিজ শরীরকে রূপান্তর করতে পারেন, স্থান-কাল ভেদ করে উপস্থিত হতে পারেন নানা প্রান্তে। এই চরিত্রটি যেন স্বাধীনতার স্বপ্নকে বাস্তবায়নের প্রতীক। লেখকের দৃষ্টিতে, ঔপনিবেশিকতা শুধু ভূমি দখল করে না, আত্মাও বন্দি করে রাখে—তাই সেই আত্মার মুক্তির জন্য প্রয়োজন একধরনের জাদুবাস্তবীয় চেতনার।

এমন আরও এক উদাহরণ গেইল অ্যান্ডারসনের (Gail Anderson) উপন্যাস The Cure for Death by Lightning (1996)। স্থানীয় কানাডীয় মিথোলজিকে ভিত্তি করে তিনি নির্মাণ করেন এক নারী-কেন্দ্রিক জাদুবাস্তব জগৎ, যেখানে চরিত্রেরা নিজের রূপ বদলাতে পারে, আকাশে উড়তে পারে। এ উপন্যাসেও আমরা কার্পেন্তিয়েরীয় প্রভাবের প্রতিফলন দেখি। এখানে জাদুবাস্তবতা কেবল অলৌকিক রূপে নয়, বরং সমাজ ও বাস্তবতার বিকল্প ব্যাখ্যার পথ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।

নারীবাদী দৃষ্টিকোণ থেকেও জাদুবাস্তবতা হয়ে উঠেছে এক শক্তিশালী অস্ত্র। অ্যান মারি ম্যাকডোনাল্ড (Ann Marie Macdonald) তাঁর Fall on Your Knees (1996) উপন্যাসে তুলে আনেন কানাডার সেই সংস্কৃতিকে, যা পিতৃতন্ত্রের দাপটে হারিয়ে যেতে বসেছিল। হারিয়ে যাওয়া নারীকণ্ঠ, চাপা পড়া ইতিহাস, সামাজিক অনাচার—এইসব বাস্তবতা জাদুবাস্তবতার কল্পমাধ্যমে ফিরে আসে পাঠকের সামনে। এই পুনরুদ্ধারই নারীবাদী সাহিত্যিকদের জন্য একধরনের জাদু।

মাইকেল ওন্দাটাজে (Michael Ondaatje) তাঁর আত্মজৈবনিক উপন্যাস Running in the Family (1982)-তে ব্যবহার করেন মার্কেসীয় বয়ানের ধাঁচ। এখানে গল্প বলা হয় ঠাকুমার মুখে শোনা উপকথার মাধ্যমে, যার মধ্যে বাস্তব আর অলৌকিকের সীমারেখা ক্রমে মুছে যায়। এই গল্পশৈলীর মাধ্যমে লেখক পাঠককে এমন এক জগতে নিয়ে যান, যেখানে ব্যক্তিগত স্মৃতিও হয়ে ওঠে সমাজের ইতিহাস, এবং সেই ইতিহাস জাদুবাস্তবতার ভাষায় রূপান্তরিত হয়।

এই ধারাবাহিকতায় ক্যারিবিয়ান অঞ্চলের সাহিত্যও হয়ে ওঠে জাদুবাস্তবতার উর্বর ভূমি। এখানেও, যেমন লাতিন আমেরিকায়, রয়েছে ঔপনিবেশিক শাসনের দীর্ঘ ইতিহাস, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য এবং জাতিগত বিভাজনের জটিলতা। এই সমস্ত বাস্তবতা একত্রিত হয়ে নির্মাণ করে একধরনের রহস্যময় পরিপার্শ্ব, যেখানে জাদুবাস্তবতা একটি স্বাভাবিক দৃষ্টিভঙ্গি হিসেবেই গৃহীত হয়।

গায়ানার লেখিকা পলিন মেলভিল (Pauline Melville) এই ভূগোল ও ইতিহাসের প্রেক্ষিতে নির্মাণ করেন The Ventriloquist’s Tale (1997) এবং The Migration of Ghosts (1998)। প্রথমটি মূলত ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের আন্তঃসংস্কৃতিগত সম্পর্ক ও সাংস্কৃতিক পরিচিতির টানাপোড়েন নিয়ে রচিত, যেখানে স্থান ও কালের ধারা ভেঙে গিয়ে এক নতুন ন্যারেটিভ তৈরি হয়। দ্বিতীয়টি ভূগোলিকভাবে আরও বিস্তৃত, যার পটভূমি লন্ডন থেকে শুরু হয়ে স্পেন পর্যন্ত বিস্তৃত। এখানে লেখিকা ‘Shape Shifter’ (1990) রচনার সময় কার্পেন্তিয়েরের ‘transformation’-এর ধারণাকে অনুসরণ করেন, যেখানে এক ব্যক্তি বা চরিত্র নিজের রূপ, পরিচয়, ইতিহাস পরিবর্তন করতে পারে।

অন্যদিকে উইলসন হ্যারিস (Wilson Harris) তাঁর Jonestown (1996) উপন্যাসে এমন এক চেতনার জন্ম দেন, যা অনেকাংশে কার্পেন্তিয়েরের ‘marvelous realism’-এর ধাঁচে রচিত। গায়ানার পুরাতাত্ত্বিক ও লোকমুখে প্রচলিত আমেরিন্ডিয়ান মিথ এবং জাতিগত ইতিহাসকে কেন্দ্রে রেখে তিনি রচনা করেন এমন এক কাহিনি, যা সমকালীন রাজনীতি, অতীত ঐতিহ্য ও আধ্যাত্মিক চেতনার সংমিশ্রণে গঠিত। এখানে বাস্তবতাকে অতিক্রম করার প্রক্রিয়া জাদুবাস্তবতায় পরিণত হয় না, বরং বাস্তবতার ভেতরেই লুকিয়ে থাকে সেই অলৌকিকের বীজ।

এইভাবে দেখা যায়, লাতিন আমেরিকার বাইরে জাদুবাস্তবতা যেসব দেশে ছড়িয়ে পড়েছে, তাদের সবারই একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা রয়েছে—ঔপনিবেশিকতা। এই অভিজ্ঞতা শুধু বাহ্যিক শাসনের নয়, বরং মানসিক, সাংস্কৃতিক ও আত্মপরিচয়ের ওপর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাবের। সেই ক্ষত থেকেই উঠে এসেছে নতুন ভাষা, নতুন কল্পনা, আর সেই কল্পনার প্রধান ভাষা হয়ে উঠেছে জাদুবাস্তবতা।

কানাডা ও ক্যারিবিয়ান সাহিত্য এই জাদুবাস্তবতার সৃষ্টিশীল ব্যবহার এবং তার মধ্য দিয়ে একটি বিকল্প বাস্তবতা নির্মাণের প্রয়াসে নিজস্ব এক পথ নির্মাণ করেছে। এটি এমন এক সাহিত্যিক যাত্রা, যা কেবল অনুকরণের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং নতুন নতুন দৃষ্টিকোণ ও বয়ানভঙ্গিকে যুক্ত করে একটি বিস্তৃত, বহুমাত্রিক সাহিত্যজগতের নির্মাণ করেছে। যেখানে সত্যের সঙ্গে মিশে আছে বিস্ময়, ইতিহাসের ভেতরেও জেগে থাকে অলৌকিকতার বোধ। এই ধারাটিই আজও বিশ্বের নানা প্রান্তে নানা রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংকটে সাহিত্যের বিকল্প ভাষা হয়ে উঠছে।

তিন

যখন জাদুবাস্তবতার বিস্তারের ইতিহাস পর্যালোচনা করি, তখন স্পষ্ট দেখা যায়—এর দিগন্ত কেবলমাত্র লাতিন আমেরিকার আকাশে সীমাবদ্ধ থাকেনি। উপনিবেশবিরোধী জাতিসত্তার নির্মাণ যেখানে যত গভীরে গিয়েছে, সেখানে তত বেশি প্রভাব ফেলেছে এই সাহিত্যের রূপকথাভাষ্য। ঠিক সেই কারণে আফ্রিকাও হয়ে উঠেছে জাদুবাস্তবতার এক উর্বর জমিন। লাতিন আমেরিকার মতোই আফ্রিকা ছিল ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকতার নির্মম শিকার, আর এই অভিজ্ঞতাই দুই ভূখণ্ডের মধ্যে গড়ে তুলেছিল এক প্রগাঢ় আত্মিক ঐতিহাসিক সম্পর্ক। উপনিবেশিকতার নির্মাণ, শোষণ, জবরদখল, সাংস্কৃতিক দমন এবং নব্য ঔপনিবেশিক পুনর্নির্মাণের প্রেক্ষাপটে আফ্রিকার সাহিত্যে জাদুবাস্তবতার প্রবেশ ঘটে একেবারে অভ্যন্তর থেকে, বহিরাগত কোনো চাপের প্রভাবে নয়।

এই প্রসঙ্গে সমালোচক ব্রেন্ডা কোপার অত্যন্ত সূক্ষ্ম অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে বলেছিলেন,

“Magical realism …such zones occur where burgeoning capitalist development mingles with older pre-capitalist modes in postcolonial societies.” (Brenda Cooper, Magical Realism in West African Fiction : Seeing With a Third Eye, London, Routledge, 1998)।

তার বক্তব্যে স্পষ্ট—পুঁজিবাদী বিকাশের যে ঢেউ আফ্রিকান সমাজে আছড়ে পড়েছে, তা প্রাচীন প্রাক-পুঁজিবাদী সংস্কৃতি ও চর্চার সঙ্গে মিশে তৈরি করেছে এমন এক অঞ্চল, যেখানে জাদুবাস্তবতা স্বাভাবিক এক বয়ানরীতি হিসেবে স্থান করে নিতে পেরেছে। এখানে বাস্তব আর অলৌকিকতা কোনও বিপরীত ধারণা নয়, বরং পরস্পর-সম্পৃক্ত একধরনের বাস্তবতার দ্বৈত রূপ।

আফ্রিকার বহুবর্ণ ও বহুস্তরীয় লোকসংস্কৃতি, মৌখিক ঐতিহ্য, অ্যানিমিজম, পূর্বপুরুষপূজা, জীবজন্তুর সঙ্গে আত্মিক সংযোগের ধারণা—এই সবই জাদুবাস্তবতার বুনটে এসে মিশে যায়। ব্রেন্ডা কোপার আবারও বলেন,

“African writers very often adhere to this animism, incorporate spirits, accestors and talking animals, in stories, both adapted folktales and newly invented yarns in order to express their passions, their aesthetics and their politics.” (P. 15 Ibid, P. 40)।

অর্থাৎ আফ্রিকান লেখকেরা শুধু সাহিত্য রচনার জন্য এই অলৌকিক উপাদান ব্যবহার করেননি, বরং তাঁদের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থান ব্যক্ত করতেও এই মাধ্যম গ্রহণ করেছেন।

আফ্রিকার সাহিত্যে জাদুবাস্তবতার সূচনা বুঝতে গেলে আমাদের ফিরে তাকাতে হবে ইতিহাসের এক নির্মম পর্বের দিকে—যা লাতিন আমেরিকার সঙ্গে আফ্রিকাকে সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিকভাবে যুক্ত করেছে। এদুয়ার্দো গার্সিয়ার Cuba for Beginners পাঠ করলে স্পষ্ট বোঝা যায়, কিভাবে আফ্রিকার মানুষদের জোর করে দাস হিসেবে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল আমেরিকায়। এই দাসব্যবসা শুধু দেহের নয়, আত্মারও শৃঙ্খল ছিল। ফলে আফ্রিকার মানুষের মনে জন্ম নেয় গভীর ভয়, শিকড়চ্যুতির আশঙ্কা ও পরিচয়হীনতার তীব্র যন্ত্রণা—এই বেদনাই পরবর্তীকালে সাহিত্যে প্রতিরোধী ভাষ্য হিসেবে প্রকাশ পেয়েছে।

নাইজেরিয়ার সাহিত্যিক ড্যানিয়েল ফাগুনওয়া (Daniel Fagunwa) এই ধারার এক পূর্বসূরি। তাঁর The Forest of a Thousand Demons (1938) উপন্যাসে আমরা দেখতে পাই এক অরণ্যভূমি, যেখানে বাস করে নানা ধরনের জাদুকর, দানব ও অতিপ্রাকৃত সত্তা। যদিও এই উপন্যাস জাদুবাস্তবতার আধুনিক তাত্ত্বিক কাঠামোর আওতায় পড়ে না, তবুও এটি আফ্রিকান আখ্যানচর্চার সেই ধারার সূচনা করে, যেখানে অলৌকিকতা আদৌ অবাস্তব নয়, বরং ঐতিহ্যের গভীরে নিহিত এক উপলব্ধি।

এই ধারাকে আরও সুসংবদ্ধ রূপ দেন আমোস তুতুলা (Amos Tutuola)। তাঁর উপন্যাস The Palm-Wine Drinkard (1952) জাদুবাস্তবতার অন্যতম প্রাচীন উদাহরণ হিসেবে আজও পাঠকের বিস্ময় জাগায়। এখানে ওরুবা সংস্কৃতির মূল বিশ্বাস, প্রাকৃতিক শক্তির সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক, মৃতদের আত্মার সঙ্গে সংযোগ—সবই অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে, কোনও পাশ্চাত্য তাত্ত্বিক প্রভাব ছাড়াই, উপস্থাপিত হয়েছে। এই উপন্যাসে গল্পের নায়ক মৃত বন্ধুর আত্মাকে ফিরিয়ে আনতে অলৌকিক জগতের ভেতরে প্রবেশ করে। এটি একদিকে আফ্রিকার লোকবিশ্বাসের পুনঃস্থাপন, অন্যদিকে ঔপনিবেশিক আধিপত্যের বিরুদ্ধে এক আত্মিক প্রতিরোধ।

পরবর্তী উপন্যাস My Life in the Bush of Ghosts (1954) আরও বেশি রাজনৈতিকভাবে সজাগ। এখানে তুতুলা পৌঁছাতে চান সেই গভীর কেন্দ্রে, যেখানে প্রাচীন বিশ্বাস আর আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির সংঘাত ঘটে। শিকারি জীবন, আত্মাদের রাজত্ব, এবং বংশগত স্মৃতির মধ্যে লেখক খুঁজে পান এক বিকল্প বাস্তবতা, যা ইউরোপীয় বাস্তবতার কঠোর কাঠামোর মধ্যে ধরা যায় না। তুতুলা এবং ফাগুনওয়া দুজনেই পাশ্চাত্যের তাত্ত্বিক আধিপত্যের বাইরে থেকে নিজস্ব এক বয়ানভাষ্য নির্মাণ করেছেন, যা পরবর্তীতে আফ্রিকান সাহিত্যে জাদুবাস্তবতার এক স্বাধীন ও নিজস্ব ধারা গঠন করেছে।

চিনুয়া আচেবে (Chinua Achebe) সেই ধারাকে একটি গভীর রাজনৈতিক চেতনার সঙ্গে যুক্ত করেন। নাইজেরিয়ায় বিয়াফ্রার স্বাধীনতা যুদ্ধ (The Civil War : 1967-70) চলাকালে তিনি নিজ জাতির পক্ষে এক স্পষ্ট অবস্থান গ্রহণ করেন। তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস Things Fall Apart (1958) এবং Arrow of God (1964) মূলত ইগবো জনজাতির প্রাচীন জীবনব্যবস্থার অন্তর্নিহিত যুক্তি ও আধ্যাত্মিকতাকে তুলে ধরে। এখানে আমরা দেখি লোককাহিনি, প্রবচন, বংশানুক্রমিক স্মৃতি ও মৌখিক ইতিহাস কীভাবে এক অলৌকিক অভিজ্ঞতার বয়ানে পরিণত হয়। আচেবের এই সাহিত্যবোধ কোনো সরাসরি জাদু নিয়ে নয়, বরং একটি সাংস্কৃতিক প্রতিরোধের ভাষা নির্মাণ—যেখানে ঐতিহ্যকে পুনরায় প্রাণ দেয়া হয়।

গ্রাহাম সুইফট
চিত্রঃ চিনুয়া আচেবে, Image Source: Google

জাদুবাস্তবতার সর্বাধিক প্রশংসিত এবং আন্তর্জাতিকভাবে সমাদৃত আফ্রিকান রচনাগুলির অন্যতম নিঃসন্দেহে বেন ওকোরি (Ben Okri)-র The Famished Road (1991)। এই উপন্যাসটি একটি আবিকু শিশুর জীবনের আখ্যান, যে একাধারে জীবিত এবং মৃত দুই জগতেই বিচরণ করতে পারে। আবিকু শিশু—আফ্রিকান লোকবিশ্বাস অনুযায়ী—সেই সন্তান, যারা বারবার জন্মায় এবং মারা যায়, কখনোই দীর্ঘকাল এই জগতে থাকে না। ওকোরি এই ধারণাকে আধুনিক এক রাজনৈতিক উপন্যাসের কাঠামোয় রূপ দেন। শিশুটি একদিক থেকে উপনিবেশিকতার দ্বারা বিধ্বস্ত জাতিসত্তার প্রতিনিধি, অন্যদিকে তার অলৌকিক শক্তি প্রতিরোধ এবং পুনর্গঠনের প্রতীক। এখানেই ওকোরি জাদুবাস্তবতার মধ্য দিয়ে ব্যক্ত করেন এক গভীর দার্শনিক অবস্থান—এই পৃথিবীর চেয়েও বড় এক আত্মিক জগৎ আছে, যেখানে প্রজন্মের স্মৃতি, সংস্কৃতি, প্রতিরোধ আর আশার ভাণ্ডার জমা থাকে।

সির্রা লিওনের লেখক সেল চেনই কোকার (Syl Cheney Coker) তাঁর উপন্যাস The Last Harmattan of Alusine Dunbar (1990)-এ আধুনিক আফ্রিকার রাজনৈতিক দুরবস্থার পাশাপাশি অতিপ্রাকৃত বয়ানের মাধ্যমে তুলে ধরেন জাতিগত নিপীড়ন ও শাসকের ব্যর্থতা। মালাগুয়েতা নামের এক কাল্পনিক দেশের সরকার এখানে প্রতীক হয়ে ওঠে আফ্রিকান দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনৈতিক ব্যবস্থার। চরিত্র অ্যালুসিন ডানবার এবং তার মেয়ে অতিমানবিক ক্ষমতা সম্পন্ন, যারা সাধারণ মানুষের পক্ষে হয়ে জাদুর আশ্রয়ে ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। এই আখ্যানও আবিকু চেতনার ধারক, যেখানে মৃতের সঙ্গে সংযোগ থাকা মানেই ক্ষমতার নতুন রূপ ধারণ করা।

ঘানার সাহিত্যিক বার্নার্ড কোজো লিং (Bernard Kojo Laing) তাঁর Search Sweet Country (1986) উপন্যাসে তুলে ধরেন ব্রিটিশ উপনিবেশিকতার নির্মমতা এবং তার পরবর্তী প্রভাব। তাঁর অভিজ্ঞতা ছিল এক ধরনের আত্ম-পরিচয় সংকট, যেখানে নিজ দেশের ভৌগোলিক, সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক পরিচিতি পর্যন্ত ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে উপনিবেশিক শাসনের চাপে। উপন্যাসের চরিত্র বেনি বাইদো যখন শাসকের বিরুদ্ধে লড়াই করে, তখন তার ভেতরে প্রবেশ করে আবিকু আত্মার জাদু—সে রূপান্তরিত হতে পারে, নিজের পরিচয় বদলাতে পারে। আরেকটি চরিত্র কফি, মৃত ও জীবিতদের মধ্যে যাতায়াত করতে পারে, ভূতের সঙ্গে কথা বলতে পারে। এই উপন্যাসটি একপ্রকার আফ্রিকার আত্মার পুনর্জাগরণ, ঠিক যেমনটি আমরা দেখি লাতিন আমেরিকার সাহিত্য ঐতিহ্যে—যেখানে মৃত পূর্বপুরুষরাও বর্তমান রাজনৈতিক সংকটের ভাষ্যকার হয়ে ওঠেন।

এইভাবে আফ্রিকান সাহিত্য যখন জাদুবাস্তবতার বয়ান নির্মাণ করে, তখন তা কেবল অলৌকিক অভিজ্ঞতার ভাষ্য নয়, বরং এক শক্তিশালী রাজনৈতিক উচ্চারণ হয়ে ওঠে। লোকবিশ্বাস, মিথ, আত্মা, জাদু—এসব উপাদান ব্যবহৃত হয় ইউরোপীয় আধিপত্যের প্রতিকূলে দাঁড়িয়ে নিজস্ব ইতিহাস পুনর্লিখনের জন্য। লাতিন আমেরিকার মতই আফ্রিকাও তার সাংস্কৃতিক শিকড়ে ফিরে গিয়ে খুঁজে পায় এক বিকল্প ভাষা, যেখানে রাজনীতি, aesthetics এবং আত্মিকতা একাকার হয়ে যায়। এই সাহিত্য তাই কেবল প্রতিরোধ নয়, পুনর্গঠনও বটে—একটি ভাঙা ভূখণ্ডের আত্মাকে নতুন করে নির্মাণের এক প্রয়াস।

চার

জাদুবাস্তবতার বয়ান ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের নানা প্রান্তে—যা শুরু হয়েছিল লাতিন আমেরিকার রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিরোধের ভাষা হিসেবে, তা অচিরেই বিশ্বসাহিত্যের এক প্রতিস্পর্ধী ধারায় রূপান্তরিত হয়। বিশেষ করে ঔপনিবেশিক শাসনের অভিজ্ঞতা, জাতীয় পরিচয়ের সংকট এবং স্মৃতির দ্বন্দ্বময়তা যেখানে গভীর, সেইসব ভূখণ্ডেই এই সাহিত্যরীতি গ্রহণ করা হয়েছে সর্বাধিক আন্তরিকতায়। এই পর্বে আলোচ্য বিষয় হলো—ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আধিপত্যের বিরুদ্ধে জাদুবাস্তবতা কীভাবে একধরনের প্রতিরোধী সাহিত্যচর্চায় রূপ নিয়েছে, বিশেষত ভারতীয় উপমহাদেশীয় প্রেক্ষাপটে।

লাতিন আমেরিকার সাহিত্যে আমরা দেখেছি—জাদুবাস্তবতার বয়ান স্বৈরতন্ত্রী শাসনের বিরুদ্ধে জনস্মৃতি, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং প্রতিরোধের অভিব্যক্তি হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। একই ধারা অনুসরণ করে ভারতীয় উপমহাদেশে এই রীতি কখনও ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে, কখনও পরবর্তী রাজনৈতিক অসারতা কিংবা বহিরাগত সাংস্কৃতিক আধিপত্যের প্রতিক্রিয়ায় আত্মপ্রকাশ করেছে। তবে এই পর্বে আলোচ্য লেখকেরা অধিকাংশই প্রবাসী—তাঁরা পশ্চিমা নাগরিকত্ব গ্রহণ করলেও তাঁদের সাহিত্যচৈতন্য গভীরভাবে শিকড়গাঁথা ভারতীয় ইতিহাস, সংস্কৃতি ও রাজনীতিতে। তাঁরা কখনও ভাবনায় ভারতীয়, আবার কখনও ভাষায় কসমোপলিটন। এই দ্বৈত অবস্থান তাঁদের জাদুবাস্তবতাকে করে তুলেছে অধিকতর বহুমাত্রিক।

এই ধারার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নাম নিঃসন্দেহে সলমন রুশদি। তাঁর উপন্যাস Midnight’s Children (1981) ভারতীয় উপমহাদেশের ঔপনিবেশিক পরিণতি ও স্বাধীনতা-উত্তর বাস্তবতার জাদুময় বিবরণ। “১৯৪৭ সালের মধ্যরাতে ঠিক দেশভাগের মুহূর্তে জন্ম নেয় যেসব শিশুরা, অদ্ভূতভাবে তারা সবাই জাদুশক্তি ক্ষমতাসম্পন্ন। তাদেরই একজন সালিম।” এই সালিম শুধুমাত্র উপন্যাসের ন্যারেটর নয়, জাতির প্রতীকও বটে। তাঁর মাধ্যমে জাতির জন্ম, পার্থক্য, বিভাজন ও সংগ্রামের ইতিহাস ফুটে ওঠে। রুশদির জাদুবাস্তবতা এখানে কোনো পৌরাণিক অলৌকিকতায় নয়, বরং রাজনৈতিক বাস্তবতার বিকল্প পাঠ নির্মাণে ব্যবহৃত হয়েছে। আয়নার ভেতর প্রবেশ, গন্ধ শুঁকে নেতা শনাক্তকরণ, ঝুড়িতে লুকিয়ে ভূতস্বরূপ দেশদর্শন—এই সমস্ত ঘটনার মধ্যে নিহিত এক গভীর প্রতীকতত্ত্ব, যা ভারতের ঐতিহাসিক ট্রমা ও বিভাজন থেকে উদ্ভূত।

এই উপন্যাসে ভারত-পাকিস্তান বিভাজনের রাজনৈতিক পরিণতি, ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি অবস্থা, এমনকি বাংলাদেশের জন্ম পর্যন্ত ঘটনাপ্রবাহকে গেঁথে দেওয়া হয়েছে এমনভাবে, যেখানে বাস্তবতা ও ফ্যান্টাসির ভেদরেখা চূড়ান্তভাবে ঝাপসা হয়ে যায়। এটি ইতিহাসের পুনর্লিখন, ক্ষমতার বিরুদ্ধে এক শৈল্পিক প্রত্যুত্তর।

রুশদির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ এবং বিতর্কিত উপন্যাস The Satanic Verses (1988) মূলত ধর্মীয় সংকীর্ণতা এবং পাশ্চাত্যের উপনিবেশিক মনোভঙ্গির বিরুদ্ধে এক দুঃসাহসিক প্রতিবাদ। “they have the power of description।” এই বাক্যেই ফুটে উঠেছে তাঁর বার্তা—কথা বলার, ব্যাখ্যা করার, অর্থ নির্ধারণের ক্ষমতা যারা রাখে, তারাই বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করে। উপন্যাসের চরিত্র সালাদিন চামচা যখন ছাগলের রূপে রূপান্তরিত হয় এবং পাশ্চাত্যের হাসপাতালে দৈত্যদের সঙ্গে শুয়ে থাকে, তখন সেটি কেবল একটি জাদুবাস্তব দৃশ্য নয়, বরং একটি গভীর রাজনৈতিক বক্তব্য। ব্রিটিশ অভিবাসন নীতির বাস্তবতা, মুসলিম অভিবাসীদের সাংস্কৃতিক উদ্বাস্তুত্ব এবং তাদের মানবিক অধিকার হরণের নীতিনৈতিক প্রতিবাদ এই জাদুপ্রেক্ষিতেই ফুটে ওঠে।

জিবরাইল ফেরেস্তার স্বপ্নের ভেতর দিয়ে যে ধর্মীয় পুনর্মূল্যায়নের আখ্যানটি নির্মিত হয়, তা লেখকের উদ্দেশ্যকে স্পষ্ট করে—পশ্চিমের দ্বারা নির্মিত ‘অপর’ ধারণার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ, এবং সেইসঙ্গে পূর্বের ধর্মীয় অনমনীয়তা ও অন্ধত্বের বিরুদ্ধেও এক চ্যালেঞ্জ। স্বপ্নে দেখা যায় খ্রিস্টানদের দেওয়া অবমাননাকর নাম ‘মাহুণ্ড’, বা পতিতালয়ের নারীদের মাধ্যমে মুক্তির আখ্যান—সবই প্রতীকী স্তরে ধর্মীয় ইতিহাসের বিকল্প পাঠ। রুশদির এই সাহিত্যকৌশল, যদিও বিতর্ক উসকে দেয়, তবু এটিকে শুধু ‘নিন্দনীয়’ বলে খারিজ করা যায় না। বরং এটি ছিল আত্মপরিচয় পুনর্নির্মাণের এক সৃজনশীল প্রয়াস।

রুশদির এই সাহিত্যে দেখা যায়—জাদুবাস্তবতা মূলত ব্যবহৃত হচ্ছে ক্ষমতার কাঠামোর মধ্য দিয়ে বাস্তবতার অন্যতর ব্যাখ্যা উপস্থাপন করতে। উপনিবেশিক পর্ব, ধর্মীয় ও জাতিগত রাজনীতি, এবং পরিচয়ের দ্বন্দ্ব—সব মিলিয়ে এই উপন্যাসগুলো হয়ে ওঠে ঔপনিবেশিক আধিপত্যের বিরুদ্ধে এক কল্পনার রাজনীতি।

অন্যদিকে, অমিতাভ ঘোষ এই ধারাকে খানিক ভিন্ন প্রেক্ষিত থেকে চর্চা করেছেন। তাঁর The Calcutta Chromosome (1995) উপন্যাসটি নির্মিত হয়েছে প্রযুক্তি ও আধ্যাত্মিকতার এক অপূর্ব মেলবন্ধনে। একদিকে এখানে আছে কম্পিউটার ও তথ্যপ্রযুক্তির আধুনিকতা, অন্যদিকে রয়েছে এমন এক ধর্মীয় সম্প্রদায়, যারা আত্মার স্থানান্তর ঘটাতে পারে এক শরীর থেকে অন্য শরীরে। এই আখ্যান গড়ে ওঠে এক প্রকার রহস্যময় জাদুবাস্তবতায়, যেখানে বৈজ্ঞানিক যুক্তি আর অতীন্দ্রিয় অভিজ্ঞতা পরস্পরের পরিপূরক।

ঘোষের এই বয়ান রাজনৈতিক হলেও সরাসরি কোনো ইতিহাসনির্ভর আখ্যান নয়। বরং ইতিহাসের ফাঁকে ফাঁকে, বিশেষ করে ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষের চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাসে এক অলৌকিক রূপক গেঁথে দেন তিনি। এখানে রোনাল্ড রস-এর গবেষণাকে ঘিরে এক বিকল্প ব্যাখ্যা হাজির করা হয়েছে, যেখানে ভারতীয় এক গোপন সম্প্রদায় নিজেরা আবিষ্কারের পথ নির্দেশ করেছে কিন্তু ব্রিটিশ বিজ্ঞানী সেই কৃতিত্ব দখল করে নিয়েছে। উপনিবেশিক বিজ্ঞানের মধ্যেও যে জবরদখল ও নির্মূলের রাজনীতি কাজ করত, তা-ই এখানে ফুটে ওঠে।

এই উপন্যাসে অতিপ্রাকৃততা কোনো রূপকথা নয়, বরং তথ্যপ্রযুক্তির আধুনিক বিশ্বে প্রাচীন আধ্যাত্মিকতার প্রত্যাবর্তন। এটি একধরনের স্মৃতি পুনর্নির্মাণ, যা ঔপনিবেশিক অতীতের বয়ানকে প্রশ্ন করে, ইতিহাসের আড়ালে চাপা পড়ে থাকা প্রান্তিক কণ্ঠস্বরকে দৃশ্যমান করে।

রুশদি ও ঘোষ উভয়ের মধ্যেই জাদুবাস্তবতা ব্যবহৃত হয়েছে একধরনের রাজনৈতিক পুনর্বিন্যাস হিসেবে। কিন্তু তাদের কৌশল ভিন্ন। রুশদি যেখানে ইতিহাস ও স্মৃতির ন্যারেটিভে ঢুকে পড়েন বর্ণময় ভাষার বিস্ময়, স্যাটায়ার ও রাজনৈতিক রূপকের মধ্য দিয়ে; সেখানে ঘোষ বেশি নিরীক্ষাধর্মী, তুলনামূলকভাবে মৃদু, কিন্তু সমানভাবে গভীর। ঘোষের উপন্যাসে বাস্তবতার ভেতরেই গেঁথে থাকে অলৌকিকতার ছায়া, যা কখনও মুখ্য নয়, কিন্তু সর্বদা উপস্থিত।

এই লেখকেরা প্রমাণ করেছেন, জাদুবাস্তবতা কেবল লাতিন আমেরিকার প্রাকৃতিক ঐন্দ্রজালিক ভূদৃশ্য বা স্প্যানিশ ঔপনিবেশিকতার প্রতিরোধ নয়, এটি এক বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক চেতনার বহিঃপ্রকাশ। ঔপনিবেশিকতা-পরবর্তী সমাজে, যেখানে সাংস্কৃতিক হেজিমনি, ইতিহাসের নির্মাণ ও আত্মপরিচয়ের সংকট উপস্থিত, সেখানে জাদুবাস্তবতা এক কার্যকর সাহিত্যকৌশল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে।

ভারতীয় উপমহাদেশীয় সাহিত্যে এই ধারাটি এখনও মূলধারার মধ্যে গণ্য না হলেও, এটি প্রতিনিয়ত জাতীয় স্মৃতি, সাংস্কৃতিক প্রশ্ন ও রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিকে গভীরভাবে আলোড়িত করে চলেছে। প্রবাসী লেখকদের কলমে যে জাদুবাস্তবতা জন্ম নিয়েছে, তা বহুমাত্রিক, বহুস্বরিক, এবং একাধারে ঐতিহাসিক ও ব্যক্তিগত। এটিই এর সবচেয়ে বড় শক্তি।

পাঁচ

বিমিশ্রিত সাংস্কৃতিক চেতনাবোধ থেকে আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে যে সমস্ত পোস্টমডার্নিজমধর্মী উপন্যাস লেখা হয়েছে, তার সিংহভাগেই মোড হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে জাদুবাস্তবতা বা ম্যাজিক রিয়ালিজম। বিশেষত অভিবাসী অভিজ্ঞতা, জাতিগত পরিচয়ের সংকট, সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্ব ও লিঙ্গ রাজনীতির মত বিষয়গুলো নিয়ে যখন সাহিত্যিকরা কথন গড়ে তোলেন, তখন এই সাহিত্যরীতিটি হয়ে ওঠে সবচেয়ে কার্যকর অস্ত্র। এই লেখকদের একটি বড় অংশই কর্মসূত্রে অথবা পারিবারিক ইতিহাসে যুক্তরাষ্ট্রের প্রবাসী। ফলে যুক্তরাষ্ট্রে গড়ে ওঠে এক বিশিষ্ট ধরনের জাদুবাস্তববাদী সাহিত্যধারা, যা একাধারে রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং নারীবাদী।

এখানে শুধুমাত্র ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধেই নয়, যুক্ত হয় বর্ণবাদ, পুরুষতন্ত্র, লিঙ্গবৈষম্য এবং পুঁজিবাদের মত আধুনিক বিশ্বব্যবস্থার জটিল সংকটগুলো। মার্কিন সাহিত্যপ্রাঙ্গণে এই জাদুবাস্তব বয়ান মূলত গড়ে উঠেছে নানা জাতিগোষ্ঠীর ক্রস-সংস্কৃতির অভিজ্ঞতা থেকে, যেখানে আফ্রিকান-আমেরিকান, চীনা-আমেরিকান, ল্যাটিনো, আদিবাসী এবং অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর অন্তর-বাহির জীবনের দ্বন্দ্ব পরিস্ফুট হয়েছে।

এই প্রবণতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নাম নিঃসন্দেহে টনি মরিসন (Toni Morrison)। তিনি ছিলেন এমন এক কণ্ঠস্বর, যিনি আফ্রিকান-আমেরিকান নারীর অভিজ্ঞতাকে মূলধারার সাহিত্যে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করেন। Song of Solomon (1977) উপন্যাসে তিনি লাতিন আমেরিকার আবিকু শিশুদের মতোই এক উড়ে যাওয়া মানুষের কাহিনি বর্ণনা করেছেন। কিন্তু এই উড়ে যাওয়া নিছক অলৌকিক কোনো বিষয় নয়—এটি নিপীড়িত আফ্রিকানদের মুক্তির আকাঙ্ক্ষার প্রতীক। একইভাবে Beloved (1987) উপন্যাসে এক ভৌতিক আত্মার উপস্থিতি, নাড়িবিহীন নারীর শরীর, অতীতের মৃত সন্তান ফিরে এসে বর্তমানকে বিপর্যস্ত করে তোলা—এই সব উপাদান নিছক অলৌকিকতা নয়, বরং দাসপ্রথার নির্মম স্মৃতিকে ফিরে দেখার এক জাদুময় পন্থা। টনি মরিসনের ভাষা, রচনাশৈলী ও আখ্যান কাঠামো সর্বাংশে পোস্টমডার্ন, কিন্তু তার ভেতর প্রবাহিত হয়েছে গভীর রাজনৈতিক ও নারীবাদী চেতনা।

এই ধারায় আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ নাম ম্যাক্সাইন হং কিংস্টন (Maxine Hong Kingston)। চীনা-আমেরিকান পরিচয়ের দ্বন্দ্ব, অভিবাসী চৈনিক সমাজের ভেতরকার জেন্ডারভিত্তিক নিপীড়ন, ও সাংস্কৃতিক পিতৃতান্ত্রিকতা—এইসবের সমন্বয়ে তিনি গড়ে তুলেছেন এক অসাধারণ জাদুবাস্তব বয়ান The Woman Warrior: A Girlhood Among Ghosts (1976)। এখানে চীনা লোককাহিনি, মৌখিক ইতিহাস এবং বাস্তব অভিজ্ঞতা মিলেমিশে এক নতুন আখ্যান গঠিত হয়েছে।

উপন্যাসে মা ও মেয়ের সম্পর্ক যেমন একদিকে চৈনিক ঐতিহ্যের ধারক, তেমনই পশ্চিমা সমাজে নারীর টিকে থাকার সংগ্রামের এক প্রামাণ্য দলিল। কিংস্টনের ভাষায়, এই আখ্যান আসলে ‘ghost stories’, অর্থাৎ পূর্বপুরুষের স্মৃতি, বংশগত কল্পনা ও বাস্তবতার ভেতরে তৈরি এক সংকর পৃথিবী, যা শুধুমাত্র সাহিত্য নয়—একধরনের আত্মপরিচয় পুনর্গঠনের প্রয়াস।

আদি আমেরিকান ও মেক্সিকান বিশ্বাসব্যবস্থাকে যুক্ত করে আরেকটি শক্তিশালী কণ্ঠস্বর হিসেবে উঠে আসেন লেসলি মারমন শিল্কো (Leslie Marmon Silko)। The Almanac of the Dead (1991) উপন্যাসে তিনি ইতিহাস, রাজনীতি, পৌরাণিকতা ও সমসাময়িক বাস্তবতার ভেতর জাদুবাস্তবতার এক ব্যতিক্রমী দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করেন। এখানে আছে আদিবাসী আমেরিকানদের মিথ, আছে মেক্সিকোর টাচো (Tacho) পৌরাণিক আখ্যান, আছে আফ্রিকান আধ্যাত্মিক চর্চা। এই উপন্যাসে স্পষ্টভাবে পশ্চিমা সভ্যতার দখলদার মনোভাব, পৃথিবীর সম্পদের উপর লোভ এবং তার প্রতিক্রিয়ায় জাতিগত সংস্কৃতি ও ভূমিস্বত্ব রক্ষার আন্দোলন তুলে ধরা হয়েছে। জাদুবাস্তবতার ভাষা শিল্কোর কাছে অস্ত্র, প্রতিরোধের হাতিয়ার।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও মেক্সিকো সীমান্ত অঞ্চল, যা একসময় মেক্সিকোর ভূখণ্ড ছিল, সেখানে গড়ে উঠেছে এক বিশাল ক্রস-কালচারাল স্পেস। এই অঞ্চলের সাহিত্যও জাদুবাস্তবতার নিরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে। আনা কাস্টিলো (Ana Castillo) সেই প্রেক্ষাপটে লিখেছেন So Far from God (1993)। এই উপন্যাসে চার মেয়ে এবং তাঁদের মা সোফিয়ার মধ্য দিয়ে মেক্সিকান-মার্কিন অভিজ্ঞতা বর্ণনা করা হয়েছে। আখ্যানটি পুরোটাই এক প্রকার জাদুময় বাস্তবতায় গড়ে ওঠে—এক মেয়ে মৃত্যুর পর কবর থেকে ফিরে আসে, এক মেয়ের শরীরে পবিত্রতার অলৌকিকতা দেখা যায়, অন্য একজন নান হয়ে অলৌকিক কাজ করে। এই উপন্যাসে নারী, পরিবার, ধর্ম ও সংস্কৃতির চক্রবৃদ্ধির ভেতর জাদুবাস্তবতার মাধ্যমে রাজনৈতিক বয়ান তৈরি হয়েছে।

তবে জাদুবাস্তবতার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রে শুধু জাতিগত ও লিঙ্গ রাজনীতি নয়, পুঁজিবাদ ও অর্থনৈতিক শোষণও তীব্রভাবে সমালোচিত হয়েছে। রিচার্ড ব্রাউটিগান (Richard Brautigan) তাঁর উপন্যাস Trout Fishing in America (1967)-এ আমেরিকার তথাকথিত মিথ নির্মাণের বিরুদ্ধে একধরনের স্যাটায়ারিক ম্যাজিক রিয়ালিজম ব্যবহার করেন। তাঁর বয়ানে দেখা যায়—এক অলীক, বিচিত্র বাস্তবতা, যেখানে মাছ ধরা আর আমেরিকার স্বপ্ন পরস্পর মিশে গেছে। এই উপন্যাস যেন আমেরিকান আদর্শের ওপর এক নির্মম প্রশ্নচিহ্ন—যেখানে মানুষ মাছ ধরতে গিয়ে হারিয়ে যায় নিজেরই নির্মিত মিথের ফাঁদে।

অন্যদিকে জন ইরভিং (John Irving) The World According to Garp (1978) উপন্যাসে বারোক রচনাশৈলী ও জাদুবাস্তবতার মধ্য দিয়ে লিঙ্গ রাজনীতি ও নারীর সামাজিক অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। এখানে আখ্যান-আধার পোস্টমডার্ন, চরিত্রগুলো অতিরিক্তরকম বহুমাত্রিক এবং বাস্তবতার সঙ্গে যুক্ত হয় অলৌকিকতার, গ্রোtesque-এর, ও হিউমারের। যদিও তাঁর বয়ানে সরাসরি লাতিন আমেরিকান প্রভাব নেই, তবু তাঁর উপন্যাসে বাস্তব ও অসম্ভবের মিলনে একটি অভ্যন্তরীণ ম্যাজিকাল কাঠামো তৈরি হয়।

গ্রাহাম সুইফট
চিত্রঃ জন ইরভিং, Image Source: Google

এইসব লেখকেরা দেখিয়েছেন, ম্যাজিক রিয়ালিজম শুধু একটি সাহিত্যরীতি নয়, বরং একটি রাজনীতি। এটি ইতিহাসের ভিন্ন পাঠ, দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে আত্মপ্রকাশ, এবং আত্মপরিচয় খুঁজে পাওয়ার একটি পদ্ধতি। মার্কিন সাহিত্যে এই ধারাটি বহুধা রূপে বিকশিত হয়েছে—আফ্রিকান-আমেরিকান অভিজ্ঞতা, এশীয় অভিবাসী বাস্তবতা, ল্যাটিনো সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার, এবং প্রাচীন আদিবাসী বিশ্বাসের মিলিত সমাবেশে।

ম্যাজিক রিয়ালিজম-এর এই বহুমাত্রিকতা তাকে একদিকে করেছে রাজনৈতিক, অন্যদিকে শিল্পসম্মতভাবে পরিপক্ব। যুক্তরাষ্ট্রে গড়ে ওঠা এই সাহিত্যধারা কখনও কখনও নিজের শিকড়ের দিকে ফিরে যেতে চায়, আবার কখনও নিজেকে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করতে চায় একটি বিশুদ্ধ কল্পলোক নির্মাণের মধ্য দিয়ে। অথচ এই কল্পলোক কখনও নিছক স্বপ্ন নয়, বরং বাস্তবতারই অন্য এক পাঠ—যা তথাকথিত যুক্তিবাদী সমাজে অসম্ভব বলে মনে হয়, কিন্তু আসলে তা জীবনেরই অন্তঃসলিলা সত্য।

এই লেখকেরা, তাঁদের যাপিত জীবন, সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতা, জাতিগত লড়াই এবং নারীজাগরণ—সবকিছুকে মিলিয়ে এমন এক সাহিত্যিক পরিসর তৈরি করেছেন, যেখানে ম্যাজিক রিয়ালিজম হয়ে উঠেছে কণ্ঠস্বরহীনদের কণ্ঠস্বর, ইতিহাসহীনদের ইতিহাস এবং উপস্থিতিহীনদের উপস্থিতি।

ছয়

জাদুবাস্তবতার উৎসভূমি ইউরোপ হলেও, এই ধারার সাহিত্যিক বিকাশ ও রাজনৈতিক ব্যঞ্জনা সবচেয়ে গভীরভাবে ফুটে উঠেছে পরবর্তীকালে লাতিন আমেরিকা এবং তৃতীয় বিশ্বের সাহিত্যে। তবে ইউরোপীয় প্রেক্ষিতে জাদুবাস্তবতার যে বিস্তার ঘটেছে, তার ঐতিহাসিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এবং সাংস্কৃতিক আবহ ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল ফ্রাঞ্জ রো-এর পোস্ট-এক্সপ্রেশনবাদী (Post Expressionism) ধারণার সঙ্গে।

এই ধারার সূচনা হয় ১৯২০-এর দশকে ইতালিতে, যেখানে লেখক ও নাট্যকার মসিমো বনটেমপেল্লি জাদুবাস্তবতার প্রাথমিক রূপটি নির্মাণ করেন। একদিকে মুসোলিনির ফ্যাসিস্ট একনায়কতন্ত্রের উত্থান, অন্যদিকে ইউরোপীয় সমাজে আধুনিকতার ঘূর্ণিঝড়—এই দ্বৈত টানাপোড়েনের মধ্যে বনটেমপেল্লি বুঝতে পেরেছিলেন যে,

“the prime function of a property modern literature on the collective consciousness by opening new mythical and magical perspectives on reality।” (Robert Dombroski, The Rise and Fall of Facism, in Peter Brand and Lino Pertile (editors) The Cambridge History of Italian Literature, Cambridge, Cambridge University Press, 1996)

এই ভাবনার ভিত্তিতে বনটেমপেল্লি যে সাহিত্যভুবন নির্মাণ করেন, তা ছিল একদিকে রহস্যময়, অন্যদিকে রাজনৈতিকভাবে সজাগ। তাঁর প্রভাবে বেলজিয়ামের লেখক জোহান ডেইসেন ও হুবার্ট ল্যাম্পো গড়ে তোলেন যুদ্ধোত্তর ইউরোপের জাদুবাস্তববাদী কল্পনাভুবন। ডেইসেনের ‘The Stairs of Stone and Clouds’ (1942) উপন্যাসটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে রচিত একটি টেক্সট, যেখানে স্বপ্ন ও বাস্তবের মেলবন্ধনই হয়ে ওঠে প্রধান ভাষ্য। বাস্তব থেকে পালিয়ে শৈশবের জাদুকরী অনুভবে ডুব দিয়ে তিনি এক নতুন সাহিত্যিক ঘরানা নির্মাণ করেন।

অন্যদিকে হুবার্ট ল্যাম্পো তাঁর ‘Kasper in the Underworld’ (1969) উপন্যাসে স্বপ্ন, ইউরোপীয় মিথ এবং লোককথার সংমিশ্রণে এমন এক কাহিনি নির্মাণ করেন, যেখানে চরিত্ররা প্রাণীদের সঙ্গে কথা বলে, আর সেই কথোপকথনের মধ্যেই জন্ম নেয় রাজনৈতিক প্রতিবাদ। কার্ল জং-এর মনোবিশ্লেষণতত্ত্বের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ল্যাম্পো তাঁর আখ্যানে ‘collective unconscious’-এর ধারণাকে জাদুবাস্তবতার প্রেক্ষিতে রূপান্তরিত করেন।

জাদুবাস্তবতার ইউরোপীয় আখ্যানের এক অনন্য উদাহরণ হল গুন্টার গ্রাসের ‘The Tin Drum’ (1959)। এই উপন্যাসে চরিত্র অস্কার মাতৃতালয়েই সিদ্ধান্ত নেয় সে বড় হবে না, এবং নিজের চিৎকার দিয়ে কাঁচ ভেঙে দিতে পারার ক্ষমতা রাখে—এই অলৌকিক ক্ষমতার মধ্য দিয়ে চরিত্রটি হয়ে ওঠে নাৎসি জার্মানির প্রতীকী সমালোচক। তাঁর চিৎকার একদিকে ব্যক্তিগত অস্তিত্বের প্রতিবাদ, অন্যদিকে জার্মান রাজনৈতিক ইতিহাসের ট্র্যাজেডির প্রতি এক মেটাফোরিক চ্যালেঞ্জ। ‘নিওবে’ মূর্তির প্রতিশোধ, কিংবা পাথরের যীশুর সঙ্গে কথোপকথনের যে ব্যঞ্জনা গ্রাস ব্যবহার করেন, তা জাদুবাস্তবতার অন্তর্নিহিত শক্তিকে রাজনৈতিকভাবে প্রবল করে তোলে।

গ্রাসের উত্তরসূরিরা ইউরোপীয় জাদুবাস্তবতাকে আরও বৈচিত্র্যময় রূপ দিয়েছেন। প্যাট্রিক সুস্কিনের ‘Perfume : The Story of a Murderer’ (1985) উপন্যাসটি তার একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ। এখানে গন্ধ অনুভব করার অতি-মানবীয় ক্ষমতাকে কেন্দ্র করে এক কাহিনি গড়ে ওঠে, যা শেষ পর্যন্ত নারী-দেহের গন্ধ দিয়ে তৈরি পারফিউমের ভেতর দিয়ে মানুষের প্রলোভন, হত্যা ও ক্ষমতার বিশ্লেষণ করে। সুগন্ধিকে ঘিরে চরিত্রটির অপরাধ-সঞ্চার এবং অলৌকিক গন্ধের প্রভাবে সমাজে প্রভাব বিস্তারের দিকটি এক জাদুময় রাজনৈতিক ভাষ্য হয়ে ওঠে।

তবে ইউরোপীয় জাদুবাস্তবতা শুধু রাজনৈতিক ইতিহাসকে চ্যালেঞ্জ করেনি, নারী-অস্তিত্বের ভূগোলেও এক নতুন মাত্রা এনেছে। ব্রিটিশ লেখিকা অ্যাঞ্জেলা কার্টার ছিলেন এর অন্যতম পুরোধা। তাঁর ‘Nights at the Circus’ (1984) উপন্যাসে কেন্দ্রস্থলে রয়েছেন এক ট্রাপেজ শিল্পী—এক শ্রমজীবী নারী, যার শরীরে ডানা রয়েছে। তাঁর এই রূপকধর্মী উত্থান, পুরুষতান্ত্রিক ক্ষমতার কাঠামোকে ভেঙে দেয়। পাশ্চাত্য শিল্প ও কল্পনায় যেখানে নারীকে ‘object of gaze’ হিসাবে দেখা হয়েছে, কার্টার সেখানে সেই নারীকেই ক্ষমতাসম্পন্ন, স্বাধীন এবং উজ্জ্বল রূপে প্রতিষ্ঠা করেন। মানুষ-পশুর সংলাপ, ঘড়ির কণ্ঠস্বর, কিংবা ফরাসি পরাবাস্তববাদী টেকনিকের ব্যবহার তাঁর আখ্যানে জাদুবাস্তবতাকে শুধু অলৌকিক নয়, বরং রাজনৈতিক ও নারীবাদী উপাদান হিসেবে স্থাপন করে।

‘Wise Children’ (1991) উপন্যাসটিতেও কার্টার একইসাথে পুরুষতন্ত্র ও শ্রেণিভিত্তিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে জাদুবাস্তবতার প্রয়োগ করেছেন। এখানকার বৃদ্ধা নারী চরিত্র অভিজাত পিতৃপরিচয়হীন সন্তানদের মধ্যে যৌন সম্পর্ক ও দ্বৈত পরিচয়ের মাধ্যমে সমাজের তথাকথিত ‘মর্যাদার কাঠামো’ ভেঙে দেন। তাঁর এই নারীবাদী প্রতিবাদ একদিকে ব্রিটিশ পুরুষতান্ত্রিক ঐতিহ্যের বিরুদ্ধে আঘাত, অন্যদিকে শ্রমজীবী নারীর আত্ম-অভিযাত্রার কাহিনি।

জাদুবাস্তবতার ইউরোপীয় সাহিত্যে ব্রিটেনে আরও কিছু বিশিষ্ট অবদান আছে। ডি. এম. থমাসের ‘The White Hotel’ উপন্যাসে ফ্রয়েডীয় মনোবিশ্লেষণ ও লিবারো-ফ্যান্টাসির সংমিশ্রণ দেখা যায়। এই উপন্যাসে নারী চরিত্রের যৌন অভিজ্ঞতা ও ট্রমার সঙ্গে ঐতিহাসিক বাস্তবতা মিশে গিয়ে এক জাদুময় অভিজ্ঞতা তৈরি করে।

গ্রাহাম সুইফটের ‘Waterland’ (1992) উপন্যাসটি ইতিহাস ও ব্যক্তিগত স্মৃতির মধ্যে সম্পর্ককে জাদুবাস্তবতার প্রেক্ষিতে ব্যাখ্যা করে। এখানে স্থানিক স্মৃতি ও ভূগোলের সংমিশ্রণ এক অলৌকিক বাস্তবতার পরিসর তৈরি করে, যা সময় ও ইতিহাসকে প্রশ্ন করে।

গ্রাহাম সুইফট
চিত্রঃ গ্রাহাম সুইফট, Image Source: Google

জেনেট উইন্ডারসনের ‘The Passion’ (1987) উপন্যাসটি ভেনিসের প্রেক্ষাপটে রচিত, যেখানে ঐতিহাসিক নেপোলিয়নিক যুদ্ধ ও প্রেমিক-প্রেমিকার মিথোলজিক্যাল যাত্রা এক অভূতপূর্ব বাস্তবতার মিশ্রণে তৈরি হয়েছে। উপন্যাসের নারী চরিত্র হেনরিয়েটের হৃদয় চুরি হয়ে যায় এবং সে হৃদয়হীন অবস্থাতেও প্রেম করতে পারে—এই অলৌকিক ঘটনার মাধ্যমে লেখক যুদ্ধ, ভালোবাসা এবং অস্তিত্বের প্রশ্নগুলোকে তুলে ধরেছেন।

এইভাবে আমরা লক্ষ্য করি যে, ইউরোপে জাদুবাস্তবতার প্রয়োগ ঘটেছে মূলত দুটি প্রবণতায়। প্রথমত, রহস্যময়তা ও ঐতিহাসিক শূন্যতার মধ্যে নতুন বাস্তবতার সন্ধান। দ্বিতীয়ত, পুরুষতন্ত্র, যুদ্ধ, সামাজিক অনাচার এবং স্মৃতির অভিঘাতকে ভাষ্য রূপে রূপান্তরিত করা। আলেহো কার্পেন্তিয়েরের ভাষায়, ইউরোপের জাদুবাস্তবতা এক ধরনের কল্পনাপ্রসূত রহস্যময়তা—এটি ইউরোপীয় আধুনিকতার সঙ্গে যুক্ত, কিন্তু তাতে নেই লোকসংস্কৃতির আত্মিক যোগ বা ঔপনিবেশিক স্মৃতির প্রতিরোধী ভাষ্য।

ফলে, ইউরোপ জাদুবাস্তবতার নির্মাতা হলেও, তার ব্যঞ্জনা ও রাজনীতি সবচেয়ে গভীরভাবে বিকশিত হয়েছে লাতিন আমেরিকা ও তৃতীয় বিশ্বের সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে। সেখানে জাদুবাস্তবতা হয়েছে প্রতিবাদের ভাষা, আত্মপরিচয়ের হাতিয়ার, এবং অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামের সাহিত্যিক কৌশল।

 

সূত্রনির্দেশ

  • ১. Norman Davies, Europe: A History, Oxford, Oxford University Press, 1996.
  • ২. Robert Dombroski, ‘The Rise and Fall of Fascism’, in Peter Brand and Lino Pertile (ed.), The Cambridge History of Italian Literature, Cambridge, Cambridge University Press, 1996.
  • ৩. Fernando Vela, Realismo Magico, Post Expressionismo: Problemas de la Pintura Europea Mas Reciente, Madrid: Revista de Occidente, 1977.
  • ৪. Maggie Ann Bowers, Magic(al) Realism, London, Routledge, 2004.
  • ৫. Christopher Warnes, Magical Realism and the Post Colonial Novel, UK, Palgrave Macmillan, 2009, p. 2.
  • ৬. Brenda Cooper, Magical Realism in West African Fiction: Seeing With a Third Eye, London, Routledge, 1998.
  • ৭. Charis Baldick, The Oxford Dictionary of Literary Terms, New York, Oxford University Press, 2008.
  • ৮. J. A. Cuddon, The Penguin Dictionary of Literary Terms and Literary Theory, London, Penguin Books, 1999.
  • ৯. Gabriel García Márquez, ‘The Solitude of Latin America’, Nobel Lecture, 8th December, 1982.
  • ১০. Plinio Apuleyo Mendoza and Gabriel García Márquez, The Fragrance of Guava, trans: An Write, London, Verso, 1983.
  • ১১. Nancy Gray Diaz, The Radial Self: Metamorphosis from Animal Form in Modern Latin American Literature, Columbia, University of Missouri Press, 1988.
  • ১২. আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, খোয়াবনামা, কলকাতা, নয়া উদ্যোগ, দ্বিতীয় মুদ্রণ: ১৯৯৮।
  • ১৩. Donald L. Shaw, The Presence of Myth: Borges, Carpentier, Asturias, Rulfo & Garcia Marquez, in Stephan M. Hart and Wen-chin Ouyang (ed.), A Companion to Magical Realism, USA, Tamesis, 2005.
  • ১৪. Magical Realism and Mythic Consciousness in Latin America, CELA, 1985.
  • ১৫. শহীদুল জহিরের সাক্ষাৎকার, আলাপনে আহমদ মোস্তাফা কামাল, শহীদুল জহির সমগ্র, সংগ্রহ ও সম্পাদনা: মোহাম্মদ আবদুল রশীদ, বাংলাদেশ, পাঠক সমাবেশ, ২০১৩।
  • ১৬. Benet’s Readers’s Encyclopaedia, 1948, UK.
  • ১৭. Webster’s New International Dictionary, 1950, USA.
  • ১৮. The Modern Encyclopaedia, Vol-5, 1961, New York.
  • ১৯. The Chambers Dictionary, 1993, New Delhi.
  • ২০. Scott Simpkins, ‘Magical Strategies: The Supplement of Realism’, Twentieth Century Literature, 1988, pp. 140–154. Web: http://www.jstor.org/stable/440074.
  • ২১. Fredric Jameson, ‘A Note on Literary Realism in Conclusion’, in Matthew Beaumont (ed.), Adventures in Realism, USA, Blackwell Publishing Ltd., 2007.
  • ২২. Baguley, Devi, Naturalist Fiction, Cambridge, Cambridge University Press, 1992.
  • ২৩. Lillian Frust and Peter Skrine, Nationalism, London, Methuen, 1971.
  • ২৪. Christopher Innes, A Source Book on Naturalist Theatre, London, Routledge, 2000.
  • ২৫. C. Vaughan James, Soviet Socialist Realism: Origins and Theory, London, Palgrave MacMillan.
  • ২৬. André Breton, Manifesto of Surrealism, trans: Richard Seaver & Helen R. Lane, Arbor Paperbacks, 1969.
  • ২৭. David Hopkins, Dada and Surrealism, USA, Oxford University Press, 2004.
  • ২৮. মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, বাস্তবের কুহক কুহকের বাস্তব, কলকাতা, প্রতিভাস, ২০১৩।
  • ২৯. Agnieszka Rzepa, Feats and Defeats of Memory: Exploring Space of Canadian Magic Realism, UAM, University of Ottawa.
  • ৩০. Lois Parkinson Zamora & Wendy B. Faris (ed.), Magical Realism: Theory, History, Community, USA, Duke University Press, 1995.
  • ৩১. Alejo Carpentier, The Kingdom of This World, trans: Harriet De Onís, Canada, Harper Collins Publishers, 1989.
  • ৩২. Graciela Ricci, On Magical Realism and Myth. [উৎসের বিস্তারিত অনুপস্থিত]
  • ৩৩. Encyclopaedia Britannica, entry on “Magic”.
  • ৩৪. Mila, CELA, Mythic Consciousness and Magical Realism in Latin America, 1985.
Post Views: 296
Tags: Bangla LiteratureFantasy and RealityLiterary CriticismLiterary MovementLiterature HistoryMagic RealismMagical Realism in LiteratureModern Literatureআধুনিক সাহিত্যজাদুবাস্তবতাবাংলা সাহিত্যম্যাজিক রিয়ালিজমসাহিত্য আন্দোলনসাহিত্য ইতিহাসসাহিত্য বিশ্লেষণ
ADVERTISEMENT

Related Posts

সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ : বাংলাসাহিত্যের এক অনন্য কথাশিল্পী
সাহিত্য আলোচনা

সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ : বাংলাসাহিত্যের এক অনন্য কথাশিল্পী

লিখেছেনঃ মুহাম্মাদ আব্দুল আলিম সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ বাংলা সাহিত্যের এক বিশিষ্ট নাম, যাঁর সাহিত্যিক জীবনপথ রচিত হয়েছে একাধারে প্রকৃতির...

by মুহাম্মাদ আব্দুল আলিম
July 9, 2025
নজরুল ইসলামের উপন্যাসে মানবতাবাদ
সাহিত্য আলোচনা

নজরুল ইসলামের উপন্যাসে মানবতাবাদ

লিখেছেনঃ মুহাম্মাদ আব্দুল আলিম মহৎ ঔপন্যাসিক মাত্রই মানবতার পথপ্রদর্শক। সাহিত্য মানেই মানুষের কথা, তার জীবনযাপন, আনন্দ-বেদনা, প্রেম-সংঘর্ষ, বিশ্বাস-অবিশ্বাসের এক...

by মুহাম্মাদ আব্দুল আলিম
June 25, 2025
বনলতা সেন ও জীবনানন্দ দাশের নায়িকারা
সাহিত্য আলোচনা

বনলতা সেন ও জীবনানন্দ দাশের নায়িকারা

লিখেছেনঃ আহমদ রফিক শ-পাঁচেক বছর আগে চিত্রশিল্পের অন্যতম ‘গ্রেট মাস্টার’ লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির আঁকা আবক্ষ নারীপ্রতিকৃতি ‘মোনালিজা’কে নিয়ে ইতালি-প্যারিস...

by অতিথি লেখক
November 19, 2024
কাজি নজরুল ইসলাম ও আন্তর্জাতিকতা
সাহিত্য আলোচনা

কাজি নজরুল ইসলাম ও আন্তর্জাতিকতা

লিখেছেনঃ সুমিতা চক্রবর্তী কাজি নজরুল ইসলামকে অনেক ভাবেই আমরা চিনি। তিনি উৎপীড়িতের পক্ষে দাঁড়ানো একজন সাহিত্যিক; তিনি অসাম্প্রদায়িক মনের...

by অতিথি লেখক
November 5, 2024

POPULAR POSTS

  • সুলতান মাহমুদ

    সুলতান মাহমুদের ভারত অভিযান ও সোমনাথ মন্দির প্রসঙ্গ (১ম পর্ব)

    181 shares
    Share 181 Tweet 0
  • বাউরী সম্প্রদায়ের উৎপত্তির ইতিহাস ও ঐতিহাসিক পর্যালোচনা

    0 shares
    Share 0 Tweet 0
  • আর্যদের ভারত আগমন, বিস্তার, সমাজ ও সভ্যতা: এক ঐতিহাসিক পর্যবেক্ষণ

    0 shares
    Share 0 Tweet 0
  • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে বৌদি কাদম্বরী দেবীর সম্পর্ক আদৌ কি প্রেমের ছিল?

    0 shares
    Share 0 Tweet 0
  • হিন্দু পদবীর উৎপত্তির ইতিহাস, বিবর্তন ও ক্রমবিকাশঃ বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা

    0 shares
    Share 0 Tweet 0

Facebook Page

নবজাগরণ

ADVERTISEMENT
নবজাগরণ

'Nobojagaran' is a website of its kind where you can gather knowledge on all the unknown facts of the world. We human beings always have a thirst for knowledge. Nobojagaran takes its first steps to quench this thirst of ours. We are now in the era of digital world, where we get almost anything online. So how about a bit of knowlyfrom online?

Connect With Us

No Result
View All Result

Categories

  • English (9)
  • অন্যান্য (11)
  • ইসলাম (28)
  • ইসলামিক ইতিহাস (23)
  • ইহুদী (3)
  • কবিতা (37)
  • খ্রিস্টান (6)
  • ছোটগল্প (6)
  • নাস্তিকতা (18)
  • বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি (24)
  • বিশ্ব ইতিহাস (26)
  • ভারতবর্ষের ইতিহাস (196)
  • রাজনীতি (38)
  • সাহিত্য আলোচনা (70)
  • সিনেমা (18)
  • হিন্দু (16)

Pages

  • Cart
  • Checkout
  • Checkout
    • Confirmation
    • Order History
    • Receipt
    • Transaction Failed
  • Contact
  • Donation to Nobojagaran
  • Homepage
  • Order Confirmation
  • Order Failed
  • Privacy Policy
  • Purchases
  • Services
  • লেখা পাঠানোর নিয়ম
  • হোম
No Result
View All Result
  • মূলপাতা
  • ইতিহাস
    • ইসলামিক ইতিহাস
    • ভারতবর্ষের ইতিহাস
    • বিশ্ব ইতিহাস
  • বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
  • ধর্ম
    • ইসলাম
    • খ্রিস্টান
    • হিন্দু
    • ইহুদী
    • অন্যান্য ধর্ম
  • নাস্তিকতা
  • রাজনীতি
  • সিনেমা
  • সাহিত্য
    • কবিতা
    • ছোটগল্প
    • উপন্যাস
    • সাহিত্য আলোচনা
  • অন্যান্য
  • ই-ম্যাগাজিন
    • নবজাগরণ (ষাণ্মাসিক) – জীবনানন্দ ১২৫ তম জন্ম সংখ্যা – মননশীল সাহিত্য পত্রিকা
  • Others Language
    • English
    • Urdu
    • Hindi

©Nobojagaran 2020 | Designed & Developed with ❤️ by Adozeal

Login to your account below

Forgotten Password?

Fill the forms bellow to register

All fields are required. Log In

Retrieve your password

Please enter your username or email address to reset your password.

Log In
Don't have an account yet? Register Now
1
Powered by Joinchat
Hi, how can I help you?
Open chat
wpDiscuz
0
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x
| Reply