লিখেছেনঃ সুরজিৎ দাশগুপ্ত
ঐতিহাসিক অর্থে জাতীয়তাবাদ হল ঔপনিবেশিকবাদের সন্তান। ইউরোপে জাতীয়তাবাদের জন্ম হয় নেপোলিয়নের রাজ্যজয় প্রক্রিয়ার পরিণামে। ভারতেও ব্রিটিশরা উপনিবেশ স্থাপন করলে তার প্রতিক্রিয়াতেই ভারতীয় জাতীয়তাবাদ জন্ম লাভ করে। সিপাহি অভ্যুত্থানের পরে সরাসরি ব্রিটিশ রাজমুকুটের অধীনে নিয়ে আসা হয় ভারতকে। তার আট বছর পরে, ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দে, রাজধানী কলকাতার অনতিদূরে মেদিনীপুরের রাজনারায়ণ বসু প্রতিষ্ঠা করেন জাতীয় গৌরব সম্পাদনী সভা। সেই সঙ্গে সভার উদ্দেশ্য ও কর্মসূচি ব্যাখ্যা করে প্রকাশ করেন একটি পুস্তিকা। পুস্তিকাখানি পড়ে নবগোপাল মিত্র জাতীয়তাবাদ এ উদ্বুদ্ধ হয়ে পরের বছর হিন্দু মেলা প্রবর্তন করেন। হিন্দু মেলা একটি বার্ষিক অনুষ্ঠান, তার প্রেরণাকে সারা বছর ধরে বাঁচিয়ে রাখার জন্য স্থাপিত হয় জাতীয় সভা। এই জাতীয় সত্তার মূল কথা যে প্রাচীনকালের হিন্দু ধর্ম ও হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের গৌরব ও প্রতাপের পুনঃপ্রতিষ্ঠা তা মেলার নাম থেকেই স্পষ্ট বোঝা যায়।
একই সময় দাদাভাই নৌরজি ইংল্যান্ডে প্রতিষ্ঠা করেন ইস্ট ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন। এখানে ইস্ট ইন্ডিয়ান পূর্ব ভারতীয় নয়, প্রাচ্যের ভারতীয় সভা, যেমন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি মানে প্রাচ্যের ভারত-সংস্থা। ওই সভার শাখারূপে ১৮৭১ সালে গঠিত হয় বম্বে অ্যাসোসিয়েশন। ইতিপূর্বেই ১৮৬৭ সালে রানাডে ও গোখলে দাক্ষিণাত্যে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন পুণা সার্বজনিক সভা। এই দুটি সভারই উদ্দিষ্ট কর্মক্ষেত্র ছিল পশ্চিম ও দক্ষিণ ভারত। অর্থাৎ অঞ্চলভিত্তিক। সমগ্র ভারতকে নিয়ে কর্মক্ষেত্রের কল্পনা, প্রথম জেগেছিল সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মানসে। ব্রিটিশ উদারতা ও ন্যায়পরায়ণতা সম্বন্ধে তাঁর আশাভঙ্গের পরে ইংল্যান্ড থেকে ভারতে ফিরে ১৮৭৬ সালে তিনি ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন বা ভারতসভা প্রতিষ্ঠা করেন। এই সভার প্রধান দুটি উদ্দেশ্য ছিল এক সামান্য রাজনৈতিক স্বপ্নপূরণ ও স্বার্থসাধনের জন্য ভারতের সমস্ত মানুষের তথা ‘Indian reces’ – এর মধ্যে সংহতি সম্পাদনা এবং হিন্দু ও মুসলমান ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে সম্প্রীতি সম্পাদন। অর্থাৎ ভারতে বসবাসকারী সমস্ত জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রবাহিত বিভিন্ন শোণিতের এবং অনুসৃত বিভিন্ন বিশ্বাসের সম্মিলন। এই আদর্শ প্রচারে তার উত্তর ভারত পরিক্রমার প্রতিক্রিয়া দেখা গেল অচিরে। লালা লাজপত রাই সম্পাদিত ‘পাঞ্জাবি’ নামক পত্রিকায় লালা লালচাঁদ পরপর অনেকগুলি প্রবন্ধ লেখেন। সেগুলির মূল বক্তব্য এক কথায় হল— দেশপ্রেম শুধু ভূমিভিত্তিক হলে হবে না, তা অবশ্যই ধর্মভিত্তিক হওয়া চাই।।
এর পরে পরে বাংলায় শুরু হল বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন। বঙ্গভঙ্গ প্রস্তাব উত্থাপিত হয়েছিল প্রথমে প্রশাসনিক কারণে বাংলা, বিহার ও ওড়িশা নিয়ে তৎকালীন বাংলা ছিল একই প্রশাসনের অধীনে এক বিশাল প্রদেশ, তাই এই একটা প্রদেশকে ভেঙে দুটো প্রদেশ করলে স্বাভাবিকভাবেই সুবিধে হবে প্রশাসনের, এই প্রাথমিক কারণের উপরে লর্ড কার্জন আরও একটি কারণ দেখলেন—এই প্রদেশের পূর্ব ও পশ্চিম ভাগের মধ্যে বাস্তব অবস্থার বৈষম্য। পশ্চিম ভাগে রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা পর্যাপ্ত, খনি ও বন সম্পদও প্রচুর, গড়ে উঠতে শুরু করেছে নানা কলকারখানা, জীবিকার বহু উপায় উন্মুক্ত হয়েছে, পক্ষান্তরে পূর্ব ভাগের সম্বল কৃষি ও নদীনির্ভর বাণিজ্য। এর মধ্যে যে হিন্দু-মুসলমানেরও ভাগাভাগি আছে এই ব্যাপারটা প্রস্তাবের ভেতরে ছিল না, সাম্প্রদায়িকতাকে রাজধানীর বঙ্গভঙ্গ বিরোধী নেতৃবর্গই প্রথম পরিস্ফুট করেন এবং লর্ড কার্জন তখন প্রশ্নটা স্বপক্ষে সদ্ব্যবহার করেন। লক্ষণীয় যে বঙ্গভঙ্গের জন্য পূর্ববঙ্গের প্রচার-পরিক্রমার প্রদও বক্তৃতাগুলির মধ্যে কার্জন মাত্র একটি ভাষণে উল্লেখ করেছেন মুসলমানদের সুবিধার কথা।
মোটকথা, বঙ্গভঙ্গ নিয়ে আন্দোলনের আবেগে স্বাদেশিকতা, রূপান্তরিত হল সাম্প্রদায়িকতাতে। ফলে এই আন্দোলনের থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়ে রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে চলে গিয়ে নিজেকে নিযুক্ত করলেন ‘গোরা’ উপন্যাস লেখার। তিনি এই উপন্যাসের মধ্যে রূপকের আকারে আপন কালের একটা সত্য কাহিনিকে যেন গোপন করলেন। যেমন স্বামী বিবেকানন্দের শিকাগো থেকে বিশ্বজয়ের অভিযান তেমনই গোরাও প্রথমে সগর্বে হিন্দু ধর্মের পতাকা উড়িয়ে বেড়িয়েছে জয়যাত্রার। কিন্তু যখন গোরা জানল, যে সে আসলে হিন্দুই নয়, জন্মসূত্র ছাড়া হিন্দু হওয়া যায় না, তখন সে হিন্দুগর্বের পতাকা নামিয়ে রেখে বলল, মা, তুমিই আমার মা। যে মাকে খুঁজে বেড়াচ্ছিলুম তিনিই আমার ঘরের মধ্যে এসে বসেছিলেন। তোমার জাত নেই, বিচার নেই, ঘৃণা নেই— শুধু তুমি কল্যাণের প্রতিমা। তুমিই আমার ভারতবর্ষ। বাস্তবে আমরা যাকে জানি ভগিনী নিবেদিতা নামে তিনি তো আসলে আইরিশ সন্তান। স্বামী বিবেকানন্দের ধর্মীয় আদর্শে আকৃষ্ট হয়ে জন্মসূত্রে পাওয়া ধর্ম ও দেশ ছেড়ে চলে এলেন ভারতবর্ষে। ধারণ করলেন গৈরিক বেশ। কিন্তু তিনি কি হিন্দু হতে পারলেন? গোত্র ছাড়া বর্ণ ছাড়া কি কেউ হিন্দু হয়? তুচ্ছ কারণে কি বিবেকানন্দের তৈরি রামকৃষ্ণ মিশনের সন্ন্যাসীবর্গ ছিন্ন করেননি নিবেদিতার সঙ্গে যোগসূত্র ? তা হলে নিবেদিতার নিহিত পরিচয় কী? তিনি কি গোত্রহীন বর্ণহীন এক অভিনব হিন্দু, নাকি জাতহীন বিচারহীন ঘৃণাহীন এক কল্যাণ প্রতিমা? এক নতুন ভারতবর্ষ? যে ভারতবর্ষ কোন্ বংশে কোন্ রক্তে জাত তার বিচার না করে দেখবে মানুষটা কোন্ সত্যে আলোকিত, জাতীয় পরিচয় অন্বেষণ না করে সন্ধান করবে ব্যক্তির মানবিক পরিচয়।
লক্ষ্যণীয় যে ১৯১৬ সালে রবীন্দ্রনাথ ভারতীয় জাতীয়তাবাদের বৈশিষ্ট্যকে যেভাবে বিশ্লেষণ করেন তার সঙ্গে গোরার উপলব্ধির স্বাশ্রয়ী সাদৃশ্য আছে। মার্কিন মুলুকে প্রদত্ত সেই ভাষণে তিনি বলেন,
“And when we talk of westenrn Nationality we forget that the nation there do not have physical repulsion, one for the other, that we have between different castes. Have we an instance in the whole world where a people who are not allowed to mingle their blood, shed their blood for one another except by coercion or for mercenary purposes? And can we ever hope that these moral barriers against our race amalgamation will not stand in the way of our political unity?”
বোঝা যায়, জাতপাতের বিচার সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথের মনে একটা গভীর বিবাদ ছিল। বর্ণ বিভেদের সঙ্গে ছিল জাতি বিভেদের প্রশ্ন। কত রকম জাতির, কত রকম দেশের, কথা রকম বিশ্বাসের, কত রকম নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যের মানুষ বাস করে ভারতবর্ষে। এখানে জাতীয়তাবোধের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ সংহতির প্রশ্ন। তাই রবীন্দ্রনাথ ভারতে জাতীয়তাবাদ বিষয়ক ওই একই ভাষণে বলেন,
‘India is too vast in its area and too diverse in its races. It is many countries packed in one geographical receptacle. It is just the opposite of what Europe truly is, namely, one country made into many. Thus Europe in its culture and growth has had the advantage of the strength of the many as well as the strength of the one. India. on the contrary, being naturally many. Yet adventitiously one, has all alone suffered from the looseness of its diversity and the feebleness of its unity. A true unity is like a round globe, it rols on, carrying its burden easily, but diversity is a many- cornered thing which has to be dragged and pushed with all force.‘
একই যাত্রায় তিনি আর-একটি ভাষণে বলেন,
“The abstract being, the Nation is ruling India. We have seen in our country some brand of timed food advertised as entirly made and packed without being touched by hand… But we, who are governed, are not a mere abstraction. We, on out side, are individuals, with living sensebilities. What comes to us in the shape of a mere bloodless policy may pierce into the very care of our life, may threaten the whole furure of our people with a perpetual helplessness of emasculation, and yet and may never touch the chord of humanity on the other side, or touch it in the most inadequately feeble manner.‘
অন্তত রবীন্দ্র সার্ধশতবর্ষে আমরা একবার পেছন ফিরে দেখতেই পারি যে, যে জাতীয়তাবাদ কে আমরা সেই রাজনারায়ণ বসুর আমল থেকে এক অত্যন্ত পবিত্র আবেগ বলে চর্চা করছি তার সম্পর্কে তথা ঔপনিবেশিক জাতীয়তাবাদ সম্বন্ধে, রবীন্দ্রনাথের ভাবনা কীরকম ছিল। ওই একই ভাষণে তিনি আরও বলেন,
‘I have not come here, however, to discuss the question as it affects my own country, but as it affects the future of all humanity. It is not a question of the British government, but the government of the Nation-the Nation which is the organised selfinterest of a whole people, where it is least human and least spiritual.’
জাতীয়তাবাদ সম্বন্ধে যখন এরকম ছিল রবীন্দ্রনাথের পর্যবেক্ষণ তখনও ভারতের রাজনীতির আকাশে গান্ধিজির আবির্ভাব হয়নি। গান্ধিজির অহিংসার ও সত্যাগ্রহের আদর্শের প্রতি, পীড়িত ও নিপীড়িতদের সম্বন্ধে মানসিকতার প্রতি রবীন্দ্রনাথের অসীম শ্রদ্ধা ছিল, কিন্তু গান্ধিজির জাতীয়তাবাদী রাজনীতির প্রতি ছিল আত্ম বিচারের আবেদন।
ভারতের রাজনীতিতে গান্ধিজির চমকপ্রদ আবির্ভাব চম্পারণ সত্যাগ্রহে সাফল্যের ভেতর দিয়ে। তারপর ১৯১৯-এর মার্চ মাসে তিনি শুরু করলেন রাউলাট আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলন। মুখ্য কর্মসূচি হল যেদিন থেকে এই আইন কার্যকর হবে সেই ৩০ মার্চ হরতাল পালন। সমগ্র উত্তর ভারত উৎসাহে উত্তাল হয়ে উঠল। কিন্তু দেশ জুড়ে রাউলাট আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের প্রস্তুতি যথেষ্ট হয়নি ভেবে গান্ধিজি ৩০ মার্চের পরিবর্তে ৬ এপ্রিল হরতালের আহ্বান জানালেন। তবু দিল্লি ও আরও কয়েক শহরে ৩০ মার্চও হরতাল হয়। তাই নিয়ে কিছু অশান্তি হয় কোনও কোনও শহরে। অশান্তির খবরে গান্ধিজি বম্বে থেকে দিল্লি যাত্রা করলে সরকার পক্ষ তাকে পথে আটকে ফেরত পাঠিয়ে দেয় বোম্বেতে। রটে যায় যে গান্ধিজিকে গ্রেপ্তার করেছে সরকার। প্রকৃতপক্ষে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন ড. সত্যপাল ও ড. কিচলু। গ্রেপ্তারের এইসব রটনা ও ঘটনাতে অমৃতসরের জনতা যখন ৯ এপ্রিল বিক্ষোভ-মিছিল বের করে তখন হন্ গেট ব্রিজে তাদের উপর গুলি চালানো হয়। তাতে জনতা খেপে গিয়ে পাঁচ ইউরোপিয়কে হত্যা করে, একজন ইউরোপীয় মহিলা ডাক্তারের চরম লাঞ্ছনা করে, দুটি ব্যাঙ্ক লুঠ করে, টেলিফোন এক্সচেঞ্জ ভাঙচুর করে, অগ্নিসংযোগ করে গির্জায় ও টাউন হল-এ। পক্ষান্তরে পুলিশের গুলিতে বিক্ষোভকারীদের প্রায় ত্রিশজনের মৃত্যু হয়। তাদের মৃতদেহ নিয়ে ১১ এপ্রিল সকালে মিছিল বের হল এবং নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হল যথোচিত সৎকার। সেদিনই বিকেলে জারি হল সামরিক আইন। এদিকে পাঞ্জাবিদের বার্ষিক বৈশাখী উৎসব ছিল ১৩ এপ্রিল জালিয়ানওয়ালাবাগে। ওই উৎসব প্রাঙ্গণে যে হত্যাকাণ্ড হয় তা ব্রিটিশ ভারতের ইতিহাসের বোধহয় কলঙ্কতম দিন। সে কাহিনির পুনরাবৃত্তি নিষ্প্রয়োজন।
গান্ধিজির আদর্শের প্রতি রবীন্দ্রনাথ গভীর শ্রদ্ধাশীল ছিলেন, কিন্তু রাউলাট আইনের বিরুদ্ধে তার আরব্ধ আন্দোলনের গতিপ্রকৃতির প্রতি রবীন্দ্রনাথের মন ক্রমশই উদ্বিগ্ন হয়ে উঠছিল। রবীন্দ্রনাথ তখন ছিলেন শান্তিনিকেতনে, সমস্ত সংবাদই তখন পৌছত তিন-চার দিন পরে। গান্ধিজিকে দিল্লি যাওয়ার পথে বাধা দিয়ে জোর করে বম্বের ট্রেনে তুলে দেওয়ার ফলে দিল্লিতে অশান্তির খবরে চঞ্চল হয়ে রবীন্দ্রনাথ ১২ এপ্রিল একটি চিঠি লিখলেন :
‘Power in all its forms is irrational, it is like the horse that drags the carriage blind-folded. The moral element in it is only represented in the man who drives the horse… I know your teaching is to fight against evil by the help of the good. But such a fight is for heroes and not for men led by impulses of the moment. Evil on one side naturally beget evil on the other, injustice leading to violence and insult to vengefulness. Unfortunately such a force that already been started and either through panic or through wrath, our authorities have shown us their claws whose sure effect is to drive some of us into the secret path of resentment and others into utter demoralisation.’
ঔপনিবেশিক জাতীয়তাবাদের প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের কথা বারবার কেন? কারণ ভারতের ঔপনিবেশিক জাতীয়তাবাদকে তিনিই সবচেয়ে ভালো চিনেছিলেন, তার অন্ধতা, তার দুর্বলতা, তার সীমাবদ্ধতাকে নির্ণয় করেছিলেন ভূয়োদর্শী সমাজবিজ্ঞানীর মতো। অন্ধ আবেগে তাড়িত হয়ে জনতা যদি ৯ এপ্রিলের দুষ্কর্মগুলি না করত তা হলে জালিয়ানওয়ালাবাগের ঘটনা অমন মাত্রা লাভ করত কি না সন্দেহ। একই কাণ্ড ঘটে ১৯২২-এর ফেব্রুয়ারিতে বারদৌলিতে গণ আইন অমান্য আন্দোলনের ডাক দেওয়ার পরে। অহিংস সংগ্রামের এক মহান দৃষ্টান্ত স্থাপনের জন্য ভারতীয় জাতীয়তাবাদীরা যখন প্রস্তুত তখনই গান্ধিজি আন্দোলন প্রত্যাহার করে নিলেন যুক্তপ্রদেশের চৌরিচৌরাতে ৫ ফেব্রুয়ারিতে পুলিশের উপরে জনতার হিংস্র আক্রমণে। ছোটো মাপে একই ধরনের কাণ্ড ঘটে বেরিলিতেও। যাঁরা গান্ধিজির নেতৃত্ব স্বীকার করতেন না বা তার আদর্শে বিশ্বাস করতেন না তার ট্রেন লুঠ করেছেন, অস্ত্রাগার লুঠ করেছেন, সশস্ত্র সংগ্রাম করেছেন পুলিশ বাহিনীর সঙ্গে। এসব বিপ্লবীদের নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ‘চার অধ্যায়’ লিখেছেন। তার মৃত্যুর পরে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে যোগদানের প্রশ্নে গান্ধিজির নেতৃত্বে কংগ্রেস ১৯৪২-এর ৭ আগস্ট সিদ্ধান্ত নিল যে ইংরেজ ভারত ছাড়লে স্বাধীন ভারত অক্ষশক্তির বিরুদ্ধে মিত্র পক্ষে যোগ দেবে ও যুদ্ধে সাহায্য করবে মিত্র পক্ষকে। ভারত ছাড়ো আন্দোলন শুরু করার আগেই ৯ আগস্ট ভোরে গান্ধিজি ও কংগ্রেস নেতাদের গ্রেপ্তার করল সরকার। অমনই স্বাধীনতার জন্য জনতা যে-লড়াই শুরু করল তা আগস্ট বিপ্লব নামে ইতিহাসে গৌরবান্বিত হয়েছে বটে, কিন্তু সমস্তটা ছিল গান্ধিজির আদর্শ ও প্রেরণার পরিপন্থী। এবারেও জনতা ঠুলি-বাঁধা ঘোড়ার মতো দৌড় দিয়েছে, তাকে চালনা করার মতো নেতৃবৃন্দ ছিলেন কারারুদ্ধ। পরে জওহরলাল আক্ষেপ করেছেন যে বিশ বছরের বেশি সময় ধরে অহিংস সংগ্রামের যে-শিক্ষা দেওয়া হয়েছিল তা দেশবাসীরা ভুলে গিয়েছিল। বল্লভভাই প্যাটেল লিখেছেন যে স্বাধীনতার জন্য ব্যস্ত ভারতবাসীরা অহিংসার পথ ছেড়ে হিংসার পথ ধরেছিল। সৌভাগ্যক্রমে অহিংস জাতীয়তাবাদের এই পরিণাম দেখার জন্য রবীন্দ্রনাথকে বেঁচে থাকতে হয়নি।
গান্ধিজির তথা কংগ্রেসের উপলব্ধ ভারতীয় জাতীয়তাবাদের সীমানার বাইরে আরএকটা জাতীয়তাবাদ বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই আগাছার মতো বেড়ে উঠেছে যা গান্ধিজির অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহারের পরবর্তী পর্যায়ে শক্ত বৃক্ষের রূপ নেয়। একদা যিনি ব্রিটিশ বিরোধিতার জন্য আন্দামানে কারারুদ্ধ সেই বিনায়ক দামোদর সাভারকর ব্রিটিশের অনুগত হয়ে মুক্তি লাভ করে ১৯২৩ সালে A Maharatta ছদ্মনাম নিয়ে একটি পুস্তিকা লিখলেন ‘Hindutva! Who is a Hindu?’ নামে। পুস্তিকাটির নামের মধ্যে যে প্রশ্নটি তুলছেন তার উত্তর দিলেন সহজভাবে, a person who regards the land of Bharatvarsha from Indus to the seas as his pitribhumi, as well as his punyabhumi – that is the cradle land of his religinon.’ দেওয়ালি, রাখীবন্ধন, কাশী-কেদারনাথ-পুরী প্রভৃতি তীর্থদর্শনকে ‘from a national and racial point of view’ হিন্দুদের পবিত্ৰকৃত্য রূপে নির্ধারণ করলেন সাভারকর। তার আদর্শে ও দর্শনে উদ্বুদ্ধ হয়ে দু বছর পরে ড. কেশব বলিরাম হেডগেওয়ার নাগপুরে প্রতিষ্ঠা করলেন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ। পাশাপাশি আর্য সমাজী শ্ৰদ্ধানন্দ ১৯২৬ সালে প্রকাশ করলেন ‘Hindu Sangathan : Saviour of a Dying Race’ নামে একটি পুস্তিকা। বিশ শতকের শুরুতেই একটা ধারণা চালু করার চেষ্টা হয়েছিল যে ১৯৫০-এর মধ্যে পৃথিবীকে হিন্দুশূন্য করে ফেলার চক্রান্ত চলছে। শ্ৰদ্ধানন্দ যারা অস্পৃশ্যতার জন্য হিন্দুসমাজ ছেড়ে অমুসলমান বা খ্রিস্টান হয়ে যাচ্ছে তাদেরকে শুদ্ধ করে হিন্দু সমাজে ফিরিয়ে আনার এবং সেই সঙ্গে অস্পৃশ্যতার বিরোধিতা করার জন্য সংগঠন গড়ে তোলার আহ্বান জানালেন।
কংগ্রেসের ভারতীয় জাতীয়তাবাদ এবং আর্যসমাজ বা হিন্দু মহাসভা বা রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের হিন্দু জাতীয়তাবাদের মধ্যে বিভেদ থাকলেও দেখতে পাই যে ১৯২৪ সালে বারাণসীতে অনুষ্ঠিত হিন্দু মহাসভার বিশেষ অধিবেশনে বাবু রাজেন্দ্রপ্রসাদ ছিলেন সভাপতি আর লবণ সত্যাগ্রহে যোগ দিয়ে হেডগেওয়ার ১৯৩০ সালে কারাবরণ করেন। কিন্তু হিন্দু জাতীয়তাবাদের আহ্বান রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ প্রতিষ্ঠার পর থেকে ক্রমশ উচ্চকিত হয়ে উঠতে লাগল। দেশের নানাস্থানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাও ঘটতে লাগল যেগুলির পরিপ্রেক্ষিতে লালা লাজপত রাই ১৯২৫-এর উত্তরপশ্চিম ভারতের মুসলিম প্রধান অংশগুলি নিয়ে পৃথক একটা দেশ গড়ে তোলার প্রস্তাব করেন। এই প্রস্তাবকে দেশভাগের প্রথম প্রস্তাব বলেও অভিহিত করতে পারি। এদিকে সাইমন কমিশন আসে ১৯২৭ সালে। কমিশনের সকলেই ছিলেন ইংরেজ।
এমন একটি কমিশনের পক্ষে ভারতের নিজস্ব সমস্যাগুলো তথা স্থানীয় বাস্তবতাকে বোঝা সম্ভব নয়। কমিশনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখাতে গিয়ে পুলিশের প্রহারে মৃত্যু হল লালা লাজপত রাইয়ের। দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতির উপরে একটি প্রতিবেদন প্রস্তুত করার দায়িত্ব দেওয়া হল মোতিলাল নেহরু ও তেগ বাহাদুর সপ্রুর উপরে। এই প্রতিবেদন নিয়ে আলোচনার জন্য ১৯২৮-এর ডিসেম্বরে সর্বদলীয় সম্মেলন ডাকা হল কলকাতায়। তখন জিন্না বলেন যে হিন্দু মুসলমানের মিলিত প্রচেষ্টা ছাড়া ভারতের কোনও প্রগতি হতে পারে না। তাতে হিন্দু জাতীয়তাবাদী এম. আর. জয়কর আপত্তি জানিয়ে বললেন, হিন্দুরা এক প্রাচীন জাতি আর মুসলমানরা এক অর্বাচীন সম্প্রদায়। দুইয়ের মধ্যে মিলন বাস্তব নয়, বাঞ্ছনীয়ও নয়। অতঃপর সজল নয়নে জিন্নার হাওড়া স্টেশন ত্যাগ।
মুসলমানদের এক প্রধান প্রতিনিধিকে যথোচিত জবাব দেওয়া গেছে ভেবে জয়কার উল্লসিত হয়েছিলেন কি না জানি না। কিন্তু হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা যে পররোৎসাহে আপনাদের আদর্শ প্রচারে উদ্যোগী হলেন তার প্রচুর প্রমাণ সুলভ। নাগপুরে ১৯৩৮এ অনুষ্ঠিত হিন্দু মহাসভার বার্ষিক অধিবেশনে পুনর্নির্বাচিত সভাপতির ভাষণে সাভারকর বললেন ?
‘The idea that there could be one homageneous all-India nationhood was mirage.’
জয়কর দশ বছর আগে জিন্নাকে যে জবাব দিয়েছিলেন তারই পুনরাবৃত্তি করে তিনি বললেন ?
‘The Hindu-Muslim schism was an unpleasant fact. It could not be wished away or overcome by compromise. The only was to recognise that all India was Hindusthan, the land of the Hindus, of once their fatherland and holy land, and the only land with which Hindus, unlike Muslims, were concerned; that there was only one nation in India, the Hindu nation; and that the Muslims were only a minority community and as such must take their place in a single Indian Stage.
ওই একই বছরে গুরু গোলওয়ালকার ‘We or Our Nationhood Defined’ নামে যে পুস্তিকাটি প্রকাশ করেন তাতে শুরুতেই তিনি হিটলারের ‘Cultural Nationalism’-এর তত্ত্বকে এবং purging the country of the semitic races and cultures’-এর কর্মসূচিকে ‘a good lesson for us in Hindusthan to learn and profit by’ বলে রায় দেন। অর্থাৎ ভারতের ঔপনিবেশিক জাতীয়তাবাদের পর্বেই তথা বিংশ শতাব্দীর আধুনিকতার অন্যতম লক্ষণ রূপে অসহিষ্ণু উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদের উদ্ভব ও বিকাশ।
এবার হিন্দু জাতীয়তাবাদের দৃষ্টান্তে বা নজিরে তুখোড় আইনজীবী মহম্মদ আলি জিন্না আর এক জাতীয়তাবাদ নির্মাণ করলেন ভারতীয় মুসলমান ইরানি নয় তুর্কি নয় তারা ভারতীয় মুসলমান, তারা এক স্বতন্ত্র জাতি, উত্তর-পশ্চিম ভারত তাদের বাসভূমি বা হোমল্যান্ড। তাঁর এই নির্মাণের ভিত্তিতে সিকান্দার হায়াত খান প্রস্তুত করেন একটি ভাষণ এবং এই ভাষণটি ১৯৪০-এর ২৩ মার্চ মুসলিম লিগের লাহোর অধিবেশনে পাঠ করেন ফজলুল হক। ভাষণটি পাঠ করার ছলে তিনি দাবি করেন ?
‘that geographyically contiguous units demorcated into regions which should be so constituted with such territarial readjustments as may be necessary, that the areas in which the Muslims are numerically in a majority as in the northwestern and eastern zones of India should be grouped to constitute “Independent States”, in which the constituent units shall be autonomous and sovereign.”
(বাক্যের জটিলতা লক্ষণীয়) এর মধ্যেই গোপন থাকল পাকিস্তানের প্রাণ। হিন্দু জাতীয়তাবাদের উত্তরেই যে ভারতীয় মুসলমান জাতীয়তাবাদের জন্ম এই সত্যটাকে মেনে নেওয়া প্রয়োজন।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধর অবসান হলে বৃটিশ রাজশক্তি পৃথিবীর বৃহত্তর সাম্রাজ্যের অন্যতম অঙ্গ ভারতকে স্বাধীনতা দেওয়ার কথা ঘোষণা করল। প্রকৃতপক্ষে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ ইউরোপের সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির সমস্ত রক্ত ও শক্তি শুষে নিয়ে এমন দুর্বল করে দিয়েছিল যে এশিয়া ও আফ্রিকার উপনিবেশগুলোর উপর কর্তৃত্ব বজায় রাখা তাদের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়েছিল। যেই ভারতের স্বাধীনতার সম্ভাবনা উজ্জ্বল হল তখনই ভারতের বিভিন্ন জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠী আপন আপন অংশের দাবি তুলতে লাগল। ভারতীয় মুসলমানরা উত্তর-পশ্চিম ভারতে দাবি করল পাকিস্তান। একই সঙ্গে যোদ্ধার জাতি রূপে শিখরা খলিস্তান দাবি করল। বাংলার সমস্যা অন্য— এখানে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও বাংলা ছিল তথাকথিত পাকিস্তান প্রস্তাবের বাইরে এবং শরৎচন্দ্র বসু, সুহরাবর্দি প্রমুখ নেতারা চাইলেন ভারত, পাকিস্তান ও খলিস্তানের বাইরে এক অখণ্ড বাংলা, কিন্তু দু’দিক থেকে অখণ্ড বাংলার প্রস্তাবে বিরোধিতা এল। অখণ্ড বাংলার জন্য প্রস্তাবের বিরোধিতা করে এবার রঙ্গমঞ্চে প্রবেশ করলেন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। তিনি পশ্চিম বাংলার শহরে শহরে, গ্রামে গ্রামে সভা করা বাঙালিকে বোঝালেন যে অখণ্ড বাংলাতে মুসলমানরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ হবে, গণতান্ত্রিক নির্বাচনে তারাই কর্তৃত্ব পাবে, সুতরাং হিন্দু বাঙালিকে বঁচাবার জন্য বাংলা ভাগ চাই। অন্যদিক থেকে জওহরলাল নেহরু বললেন যে, আজ বাঙালিকে ভাষার ভিত্তিতে দেশ গড়তে দিলে দুদিন পরে তেলুগু তামিলরাও স্বাধীন দেশ গড়তে চাইবে আপন আপন ভাষার ভিত্তিতে অর্থাৎ ভারতের বলকানীকরণের পথ খুলে দেওয়া হবে। ফলে বাংলা ভাগ হল এবং পশ্চিমবাংলা হল বিভক্ত স্বাধীন ভারতের একটি রাজ্য।
কিন্তু জওহরলাল ভাষাভিত্তিক রাজ্যগড়া সম্বন্ধে যে ভয় পেয়েছিলেন সেই ভয়ের কারণ দূরীভূত হল না। অসমের নেতা গোপীনাথ বরদলোই ‘Assam is for, Assamese’ বলে যে ডাক দিলেন তা খুব ফলাও করে ২৯ আগস্ট ১৯৪৭-এ ছাপা হল ‘Shillong Times’ দৈনিক পত্রিকায়। অসমীয়া ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ সংখ্যাতাত্ত্বিক প্রত্যক্ষ রূপ পেল ১৯৫১ সালের জনগণনায়। অসমের ১৯৩১ সালে যে জনগণনা হয় তাতে বাঙালির সংখ্যা ছিল প্রায় ৪০ লক্ষ, যুদ্ধের জন্য ১৯৪১-এ কোনও জনগণনা হয়নি। দশ বছর বাদে ১৯৫১-র জনগণনাতে বাঙালির সংখ্যা হল প্রায় ১৭ লক্ষ। এত কম হল কী করে তার কারণ দেখাতে গিয়ে অসমের জনগণনা বিভাগের তৎকালীন কর্তা আর বি ভাগ্যইওয়ালা শুধু ‘biological miracle’ বলে ব্যাপারটাকে কটাক্ষ করেই ক্ষান্ত হননি, সেসঙ্গে মন্তব্য করেন, The figures do not fail to reflect the aggressive linguistic nationalism now prevailling. in Assam’.
অসম যদি অসমিয়াভাষীদের হয় তা হলে তেলুগুদের জন্য কেন তেলুগুদেশ হবে না? এরপর ১৯৫২-তে ১৯ অক্টোবর শ্রীরামলু পত্তি তেলুগুভাষীদের জন্য এক স্বতন্ত্র প্রদেশের দাবিতে অনশন শুরু করে ১৬ ডিসেম্বর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ। অবশেষে ১৯৫৩-র ১ অক্টোবর মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি থেকে কেটে অন্ধ্রপ্রদেশ গড়তে হল। ওদিকে বরদলোইয়ের নীতি মেনে অসম থেকে কেটে ১৯৬৩তে নাগাল্যান্ড, ১৯৭২-এ মেঘালয় এবং ১৯৮৭-তে মিজোরাম বানানো হল। তা হলে দেখা যাচ্ছে দেশভিত্তিক ও ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের সঙ্গে আর এক প্রকার জাতীয়দাবাদের আবির্ভাব হয়েছে – ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ। গুরুমুখীভাষী খলিস্তান হয়নি, কিন্তু পাঞ্জাবের হিন্দিভাষী অঞ্চল কেটে নিয়ে ১৯৬৬-র ১ নভেম্বর গঠন করা হয়েছে হরিয়ানা।
কিন্তু উত্তর-ঔপনিবেশিক ভারতে যে-জাতীয়তাবাদ সবচেয়ে পরাক্রান্ত রূপে দেখা দিয়েছে, তা হল হিন্দু জাতীয়তাবাদ। ব্রিটিশ শাসনের কালে যারা জনচক্ষুর আড়ালে বাস করত তারাই স্বাধীন ভারতে দাঁত-নখ বার করে ভারতের নতুন ইতিহাস রচনায় নিজেদেরকে নিযুক্ত করল। সেই ইতিহাস লেখার জন্য তারা সাজানো সাদা কাগজ পেল পূর্ববঙ্গ থেকে পশ্চিমবঙ্গে আসা উদ্বাস্তুদের উপনিবেশে। বাংলা ভাগের পরে পূর্ববঙ্গ থেকে বহু হিন্দু আপন বাস্তু ফেলে চলে আসে এবং এদের এক বিপুল অংশ পশ্চিমবঙ্গে নতুন বাস্তুর অন্বেষণে ঐক্যবদ্ধভাবে অভিযান চালিয়ে প্রথম যেখানে সাফল্যলাভ করে সেই জায়গার নাম রাখে বিজয়গড়। বাংলার সংস্কৃতিতে হিন্দু জাতীয়তাবাদ কর্ষণের সুবর্ণ সুযোগ লাভ করে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ১৯৫১-তে বিজয়গড়ের মাঠে এক বিশাল জনসভার আয়োজন করে একপাশে যুবক অটলবিহারী বাজপেয়ী ও অন্যপাশে তরুণ লালকৃষ্ণ আদবানিকে নিয়ে জনসঙঘ নামে এক নতুন রাজনৈতিক দলের জন্মবার্তা ঘোষণা করেন এবং সেই সঙ্গে অভিনন্দন জানান বাস্তুর জন্য সংগ্রামে বিজয়লাভের সাফল্যে। তিরিশ বছর পরে, ১৯৮০ সালে, জনসঙঘীরা নতুন জন্ম লাভ করে ভারতীয় জনতা দল নামে। ওদিকে কসমোপলিটন শহর রূপে বিখ্যাত বম্বেতে মহারাষ্ট্রীয় জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে কার্টুনিস্ট ও সাংবাদিক বাল ঠ্যাকারে ১৯৬৬ সালে প্রতিষ্ঠা করলেন শিবসেনা। এই শিবসেনা বা শিবাজির বাহিনীর আক্রমণের প্রথম লক্ষ্য হল মহারাষ্ট্রে বসবাসকারী তথা উপার্জনকারী তামিল সম্প্রদায়, তার পরে তাদের কর্মসূচি হল বিহার ও উত্তরপ্রদেশ থেকে বম্বেতে এসে যারা অর্থোপার্জন করছে তারা এবং অবশেষে তাদের মন্ত্র হল মুসলমান বিতাড়ন। অর্থাৎ শিবসেনারা মারাঠা হিন্দু জাতীয়তাবাদের প্রেরণাতে উদ্বুদ্ধ। এসবগুলির সঙ্গে আরও উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদের আদর্শে ইতিহাসের মঞ্চে প্রবেশ করল বিশ্ব হিন্দু পরিষদুবজরঙ্গ দল প্রভৃতি সংগঠনও। অবশেষে ১৯৯২-এর ৬ ডিসেম্বর বাবরি মসজিদ ধ্বংস।
আশির দশক থেকে মুসলমান জঙ্গিবাদ নামে এক ধরনের হত্যা ও হিংসার কর্মকাণ্ড সারা পৃথিবী জুড়ে শুরু হয়। প্যালেস্টাইন কেটে ইজরাইল গঠনের প্রতিক্রিয়াতে এই জঙ্গিবাদের জন্ম। লক্ষণীয় যে শীতল যুদ্ধের অবসানে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ এখন এক নতুন জাতীয়তাবাদের রূপ নিয়েছে। শীতল যুদ্ধের অন্তিম পর্বে আফগানিস্তানে সোভিয়েত রাশিয়ার প্রভাব যখন নিজে থেকেই দূর্বল হতে শুরু করেছে তখন মার্কিন জাতীয়তাবাদ সাউদি আরবের মাধ্যমে পাকিস্তানের জেনারেল জিয়া উল-হককে বুদ্ধি ও বিত্ত দেয়—সেই পরিকল্পনা অনুসারে পাকিস্তানের আফগান সীমান্তে কতকগুলো মাদ্রাসা স্থাপিত হয়, এইসব মাদ্রাসায় ইসলামের সেসব অংশের তালিম দেওয়া হয় যেসব অংশে অসহিষুতা সংকীর্ণতা, হিংসা ও হত্যার কথা আছে। এইভাবে তৈরি করা হয় তালিবান বাহিনী। তালিবানের প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল সোভিয়েত রাশিয়ার প্রতিনিধি ও সমর্থকদের নির্মূল করা, তালিবান বাহিনীকে নেতৃত্ব দেন মোল্লা মহম্মদ ওমর। অপর নেতা ছিলেন ওসামা বিন লাদেন, তাঁর নিজস্ব বাহিনীর নাম আলকায়দা। যে কৌশলে ও বীরত্বে সোভিয়েত রাশিয়ার অস্ত্রের অর্থে বলিয়ান আহমেদ শাহ মাশুদের বাহিনীকে লাদেন চূর্ণ করেছিলেন তা আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের মানুষ সহজে ভুলবে না। অবশ্য বিশ্বের মানুষ লাদেনের নাম মনে রাখবে ২০০১ সালে ১১ সেপ্টেম্বর কাণ্ডে। হিটলার যেমন ১৯৪১-এর জুন মাসে পূর্বের মিত্র রাশিয়া আক্রমণ করে তাঁর পতনকে ত্বরান্বিত করেছিলেন তেমন লাদেনও সোভিয়েত রাশিয়ার পুতুল সরকারকে আফগানিস্তান থেকে নিশ্চিহ্ন করে তার পূর্বের মিত্র আমেরিকাকে আক্রমণ করে জানিয়ে দিলেন মার্কিন জাতীয়তাবাদকে, তার হিংসাতে আফগান মানুষ ও প্রকৃতির সর্বনাশ ঘটালেন এবং ডেকে আনলেন নিজের মৃত্যুকেও। কিন্তু লাদেনের মৃত্যুতে সন্ত্রাসবাদের যে মৃত্যু হতে পারে না হাতের কাছে তার প্রমাণ মিলল বিগত ১৩ জুলাই মুম্বাই বিস্ফোরণে।
জঙ্গিবাদ বা সন্ত্রাসবাদের হয়তো একটা উন্মাদনা একটা রোমাঞ্চ আছে। তা না হলে হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের একটা অংশ ২০০৬-এর ৮ সেপ্টেম্বর সবেবরাতের দিন মালেগাও বিস্ফোরণ, আবার ২০০৭-এর ১৮ ফেব্রুয়ারি সমঝোতা এক্সপ্রেস বিস্ফোরণ প্রভৃতি মতিচ্ছন্ন কাণ্ড ঘটায় কেন? কার বিরুদ্ধে এই সন্ত্রাস? হিন্দুরাও সন্ত্রাস ঘটাতে পারে এ ছাড়া আর কোন্ বাণী উচ্চারিত হল? এটা নিশ্চিত মুসলমান সন্ত্রাসবাদ বা হিন্দু সন্ত্রাস কি অন্য কোনও সন্ত্রাসবাদ বিশ্বের কোনও না কোনও হতাশার শিকার। তাদের পেছনে কোনও সামাজিক অনুমোদন নেই। প্রত্যেককেই একদিন মরতে হবে। তার জন্য ভয় পেয়ে কী হবে? বরং জাতীয়তাবাদ সামাজিক অনুমোদন লাভ করে ইতিহাসকে যথেষ্ট প্রভাবিত করতে পারে এবং সেজন্য জাতীয়বাদের স্বাস্থ্য আমাদের অনেক বেশি বিবেচ্য বিষয়। জাতীয়তাবাদও আসলে একপ্রকার ভাবাবেগ, কিন্তু তার একটা সৃষ্টিশীল দিকও আছে, তার স্বাস্থ্য ভালো থাকলে তার সৃষ্টিশীলতা বিকাশ লাভ করতে পারে। আমাদের জাতীয়তাবাদ সুস্থ তো? সৃষ্টিশীল তো?