লিখেছেনঃ মুহাম্মাদ আব্দুল আলিম
এই ফারাজী আন্দোলন এর প্রাণপুরুষ ছিলেন হাজি শরীয়াতুল্লাহ। তিনি ১৭৮০/৮১ খ্রীষ্টাব্দের বর্তমান বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলার বন্দরপুর পরগণার বাহাদুরপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মাতা ছিলেন খুবই ধর্মপরায়ন। মাত্র ১৮ বৎসর বয়সে শরীয়াতুল্লাহ হজ করতে যান এবং দীর্ঘ ২০ বছর সেখানে অবস্থান করে আরবের বিভিন্ন প্রান্ত পরিদর্শন করেন। আরবে থাকাকালীন তিনি ওহাবী আন্দোলন সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করে আকৃষ্ট হন। তিনি সৈয়দ আহমদ শহীদের আন্দোলনের প্রতি প্রভাবিত হন এবং তিতুমীরের সঙ্গেও ঘনিষ্ট পরিচয় ঘটে। মক্কায় থাকাকালীন তিনি হানাফী মযাহাবের বিখ্যাত পণ্ডিত তাহের সোম্বালের নিকট সূফিতত্ত্বের উপর শিক্ষা লাভ করেন। পরে মিশরের আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করে বঙ্গদেশে ফিরে আসেন।
হাজি শরীয়াতুল্লাহ শাহ ওয়ালীউল্লাহর মতাদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি সৈয়দ আহমদ শহীদ ও তিতুমীরের আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যান।
‘ফরজ’ হল ইসলামী শরীয়াতের বাধ্যতামূলক কর্তব্য। এই ফরজ শব্দের বহুবচন হল ফারাজ। তাই ফারাজী আন্দোলন এর মূল লক্ষ্য ছিল শরীয়তের ফরজ বা বাধ্যতামূলক হুকুম আহকামগুলির চালু করার আন্দোলন। যখন সাধারণ মানুষ ইসলামের মূল অনুসরনীয় বিষয়গুলি ছেড়ে বিভিন্ন কুসংস্কারে আচ্ছন্ন ছিল তখন হাজি শরীয়াতুল্লাহ ফরজের উপর জোর দিয়েছিলেন।
হাজি শরীয়াতুল্লাহ এই আন্দোলনের স্বতন্ত্র নাম দিলেও বাস্তবে তা ছিল সৈয়দ আহমদ শহীদের জেহাদী (ওহাবী) আন্দোলন ও তিতুমীরের কৃষক আন্দোলনের অনুরুপ। এই দুই আন্দোলনের মধ্যে কোন মৌ্লিক পার্থক্য ছিল না।
হাজি শরীয়াতুল্লাহ প্রথমে কৃষক ও কারিগর নিয়ে তাঁর আন্দোলনের সূচনা করেন এবং সকল ধর্মের লোককে ঐক্যবদ্ধ করে জনকল্যানমুখী আন্দোলনের ডাক দেন। জমিদার শ্রেণী তাঁর আন্দোলনে ভীত হয় এবং ঢাকা থেকে তাঁকে বিতাড়িত করে। তাঁর সাংগঠনিক ক্ষমতা এমন ছিল যে তীব্র গতিতে তাঁর অনুচর বেড়ে যায় এবং অল্প সময়ের মধ্যে ফরিদপুর, বাখরগঞ্জ এবং ময়মনসিং ও ঢাকার এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলের মুসলমানরা তাঁর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে পড়েন। তাঁর অনুচরদের সংখ্যা ছিল ১২,০০০ ।
ঐতিহাসিক জেমস ওয়াইজ লিখেছেন,
“শরীয়াতুল্লাহ নির্বিকার ও মেরুদণ্ডহীন কৃষক, শ্রমিক ও জনসাধারণের মধ্যে যে অভূতপূর্ব কর্ম চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছিলেন তা তৎকালীন ইতিহাসে বিস্ময়কর ঘটনা। লোকে তাঁকে বলত বিপদে পরামর্শদাতা ও দুঃখ বেদনায় সান্তনা দানকারী পিতা।” (ইতিহাস কথা কয়, মোহাম্মাদ মোদাবেরঃ পৃষ্ঠা – ১২৪)
ডাঃ জেমস ওয়াইজ আরও বলেছেন, ফরিদপুর জেলার বাহাদুর গ্রামের হাজি শরীয়তুল্লাহ ছিলেন ফারাজি আন্দোলন এর জনক (১৮২০ খ্রীষ্টাব্দ) তিনি স্বেচ্ছাচারী নীলকর জমিদার ও মহাজনদের মোকাবিলা করতেন। তাঁর সমাজ সচেতন দর্শনের স্বচ্ছতা এবং বিনম্র অথচ আপোসহীন সাহসিকতা তাঁকে দরিদ্রের প্রিয় ভগবানে পরিণত করেছিল। তাই তাঁকে পিতার আসনে বসিয়েছিল । (দ্রঃ স্বাধীনতা সংগ্রামে মুসলিম অবদান, শান্তিময় রায়)
এটা অবশ্যই মনে রাখা দরকার যে হাজি শরীয়াতুল্লাহর আন্দোলন শুধু হিন্দু জমিদারদের বিরুদ্ধেই ছিল না বরং এই আন্দোলনের প্রতিকুলে যেসব মুসলমান জমিদার ছিল তাঁদের বিরুদ্ধেও তিনি চিরকার আন্দোলন করে গেছেন।
হিন্দু জমিদাররা মুসলমান কৃষকদের উপর জোর করে কালীপুজা, দুর্গাপুজা ইত্যাদিতে চাঁদা আদায় করত যা সম্পূর্ণভাবে ছিল ইসলামবিরোধী। জমিদাররা এখানেই ক্ষান্ত ছিল না তাঁরা ঈদুল আজহাতে গরু জবাই করাও নিষিদ্ধ করে দিয়েছিল। হাজি শরীয়াতুল্লাহ জমিদারদের এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালেন এবং মুসলমানদেরকে পূজোয় চাঁদা দিতে নিষেধ করলেন এবং ঈদুল আজহাতে গরু জবাইয়ে উৎসাহ দান করলেন।
হাজি শরীয়াতুল্লাহ ১৮৪০ খ্রীষ্টাব্দে ইহলোক ত্যাগ করেন। তিনি মারা গেলে তাঁর সুযোগ্য পুত্র আলাউদ্দীন ওরফে দুদুমিঁঞা ফারাজী আন্দোলন এর নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। তিনিও আরবে গিয়ে ইসলামী শাস্ত্রে বুৎপত্তি অর্জন করেন এবং হজ করে ফিরে আসেন।
দুদুমিঁঞা ফারাজী আন্দোলন এর নেতৃত্ব গ্রহণ করলে এই আন্দোলনের ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছিল। পিতার মৃত্যুর পর তিনি সংগ্রামের ধারা পরিবর্তন করেন। হিন্দু মুসলমান দরিদ্র শ্রেণীর মানুষের কানে তিনিই সাম্যবাদ প্রচার করেন। আরও বলেন, জমিদার ও ইউরোপীয় নীলকরদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রস্তুত থাকতে হবে। যদি হিন্দুদের উপর অত্যাচার হয় তাহলেও ইসলাম অনুযায়ী আমাদের তাদের পাশে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে যাওয়া ধর্মের বিধান। যদি না যাওয়া হয়, তাহলে অধর্মের কাজ হবে। তিনি শাসনতন্ত্র কায়েম করলেন। তাঁর বাহিনী তলোয়ার সড়কি, তীর, ধনুক প্রভৃতি অস্ত্রে সজ্জিত হয় । সর্বপ্রথম তিনি ‘বিপ্লবী খেলাফত ব্যবস্থা’র প্রতিষ্ঠা করলেন পুরোপুরিভাবে। এই পদে সর্বোচ্চ স্থানে যিনি থাকতেন তাঁকে বলা হয় ‘ওস্তাদজী’। তাঁদের পরামর্শদাতা দু’জন ছিলেন ‘খলিফা’। এমনিভাবে সুপারিনটেনডেন্ট খলিফা, ওয়ার্ড খলিফা, গাঁও খলিফা প্রভৃতি নানা নামে নানা পদের ব্যবস্থা ছিল। তিন – চারশো বিপ্লবী পরিবার নিয়ে একটি গ্রাম – ইউনিট ছিল। সুপারিনটেনডেন্ট খলিফার একজন পিয়ন ও একজন পিয়াদা থাকতো, তাদের নিচে হতে উপর মহলে যোগাযোগ ও নির্দেশ পাঠাবার ব্যবস্থা ছিল। (History of the Faraidi Movement in Bengal, M.A. Khan, P. 104-112)
অধ্যাপক ডাঃ শান্তিময় রায় লিখেছেন,
“দুদুমিঞা ১৮২৪ সালে ঘোষণা করেন, ‘পৃথিবীর সমস্ত জমির মালিক আল্লাহ, তাঁর চোখে সব মানুষই সমান। তাই আমরা যারা আল্লাহকে মান্য করি – তারা কেউ জমিদারের খাজনা দেব না। নীলকর সাহেবদের জন্য নীল বুনব না ও বিদেশী ফিরিঙ্গিদের রাজত্বকেই মানব না।” (মুক্তি সংগ্রামে ভারত)
ফারাজী আন্দোলন এর মুজাহিদরা আদালত গঠন করে সমস্ত অঞ্চলের বিচার নিজেরাই করতে লাগলেন । মুসলমানদের কাছ থেকে ওশর, জাকাত ইত্যাদি আদায় করে মক্তব – মাদ্রসা তৈরী করেন এবং সেনাবাহিনীকে আরও শক্তিশালী করে তোলেন। তৎকালীন যুগে মুজাহিদদের পক্ষ থেকে জনগণের সুবিচার করা মানেই ব্রিটিশ বিরোধীতার নামান্তর। ইতিহাসের গ্রন্থে লেখা আছে,
“এই সুবাদে অমুসলমানরাও অনেকে তাঁদের (ফারাজীদের) কাছে কেশ করতেন। বিচার সুক্ষ্মভাবে হোত। বিচারের রায় না মানলে তা মানিয়ে নেবার ক্ষমতা আলাউদ্দিনের সৈন্য বিভাগের ছিল। শেষে অবস্থা অনুকূলে দেখে তিনি তাঁর এলাকায় ঘোষণা করলেন, সমস্ত বিচার আমাদের স্বদেশী আদালতে হবে; যদি কেউ ইংরেজদের আদালতে বিচারপ্রার্থী হয় তাহলে তাকে শাস্তি দিতে হবে। এতে ইংরেজ ব্যবসায়ী বা নীলকরের সাহেবরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিল, আর জমিদার শ্রেণীও খুব অসন্তুষ্ট হোল। কিছু মুসলমানের সহযোগিতায় তাঁরা বলতে লাগলেন, ‘গরীব ছোটলোকদের’ এত মাথায় তোলা অবিচার মাত্র। অবশেষে ইংরেজদের স্তম্ভ জমিদার শ্রেণী, হিন্দু এবং মুসলমান উভয় শ্রেণীর বিপ্লবীদের উপর আক্রমণ শুরু করে এবং তা বহুদিন পর্যন্ত চলতে থাকে।” (Proceeding of the Judicial Department. O.C. No. 25, 29 May 1843, P. 462)
ঐতিহাসিক গোলাম আহমদ মোর্তাজা লিখেছেন,
“আলাউদ্দিন সাহেব ১৮৪১ খৃষ্টাব্দে কানাইপুরের সিকদার ও ফরিদপুরের জয়নারায়নের জমিদারদ্বয়ের বিরুদ্ধে সৈন্যসহ আক্রমণ করে পরাজিত করেন। খুব মনে রাখা দরকার যে, ঐ লড়াই হিন্দু – মুসলমানের নয় বরং কৃষক জমিদারের লড়াই, অথবা ইংরেজ শাসকের শোষনের বিরুদ্ধে মুসলমান বিপ্লবীদের সংগ্রাম। এরপরে কানাইপুরের জমিদার জয়নারায়নবাবু ১৮৪২ খৃষ্টাব্দে প্রবলভাবে বিপ্লবীদের বাধা দেন। ফলে যুদ্ধ তুমুল রূপ নেয়। শেষে বিপ্লবীরা জমিদারের ভাই মদনবাবুকে ধরে নিয়ে চলে যায়। অনেকে বলেন, তাঁকে তুলে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হয় এবং পদ্মা নদীতে নিক্ষেপ করা হয়। [দ্রঃ M.A. Khan, p. 27-29) ঐ হামলায় ৮০০ জন মুসলমান বিপ্লবী যুক্ত ছিলেন। জমিদাররা ইংরেজের আদালতে বিচার করলে বিচারে ২২ জনের ৭ বছর জেল হয়। আলাউদ্দীনের (দুদুমিঞা) অবশ্য কোন শাস্তি হয়নি, তিনি মুক্তি পান । অনেকের মতে এও ঠিক যে, তাঁর শাস্তি হলে হিতে বিপরীত হোত। কেননা পুলিশী রিপোর্ট অনুযায়ী ঐ সময় আলাউদ্দিনের হাতে আশি হাজার লোক প্রাণ দেবার জন্য প্রস্তুত ছিল। [দ্রঃ P.J.D.O.C. No. 99, 7.4. 1847, P. 146/তথ্যসূত্র চেপে রাখা ইতিহাস, পৃষ্ঠা – ২১৬]
ডানলপ নামের এক প্রভাবশালী নীলকরের পার্শ্বচর ও গোমস্তা কালীপ্রসন্ন কাঞ্জিলালকে দিয়ে আলাউদ্দিনের বাড়ি আক্রমণ করতে পাঠালেন। কালীপ্রসন্ন কাঞ্জিলাল আট শত সশস্ত্র লোক নিয়ে আলাউদ্দিনের বাড়ি আক্রমণ করেন। বাড়ির চারজন প্রহরীকে হত্যা করে এবং বহু ব্যাক্তিকে হতাহত করে তৎকালীন বাজারের দেড় লক্ষ টাকার অর্থ ও সম্পদ নিয়ে পালিয়ে যান। আলাউদ্দিনও থেমে থাকার পাত্র নন। তিনিও প্রতিশোধ নেবার জন্য ১৮৪৬ সালে ৫ই ডিসেম্বর ডনলাপ সাহেবের কুঠি আক্রমণ করলেন। পরে তিনি গোমস্তা কালীপ্রসন্ন কাঞ্জিলালকে বাখরগঞ্জ এলাকায় অপহরণ করে নিয়ে গিয়ে হত্যা করেন। এবং তাঁদের ২৬ হাজার টাকার ক্ষতি হয়। ঐতিহাসিক অমলেন্দু দে বলেন,
“তাঁদের তুলনায় ডনলাপের ক্ষতির পরিমান অল্পই ছিল।”
সেই সময়কার ম্যাজিষ্ট্রেট ছিলেন ডানলপের বন্ধু। সেই সুবাদে অনায়াসেই ডানলপ অনায়াসেই কোর্টে কেস করলেন। আলাউদ্দিন এবং ৬৩ জন মুসলমান বিপ্লবীকে বন্দী করে বিচার চালাতে থাকে। বিচারে সকলের শাস্তি হয়। সে রায়ের বিরুদ্ধে কলকাতার সর্বোচ্চ আদালতে আপীল করা হয়। চতুর ইংরেজ অবস্থা বুঝে সকলের মুক্তি দেয়। ১৮৪৭ সালে মুক্তি পেয়ে আলাউদ্দিন সারা ভারতে প্রত্যেক কেন্দ্রে সংবাদ পাঠান যে, চারিদিক হতে একসঙ্গে ইংরেজ বিধ্বংস অভিযান চালাতে পারলে ইংরেজকে তাড়িয়ে দেশ স্বাধীন করা সম্ভব হবে। ষড়যন্ত্র চলতে লাগলো। শেষে খুবই গোপনে এই সিদ্ধান্তে আসা গেল যে, সারা ভারতের আন্দোলন ও বিপ্লবকে ইংরেজ তার সৈন্য বাহিনী দিয়েই দমন করছে, সুতরাং সৈন্যদের কোন প্রকারে ক্ষেপিয়ে তুলতে পারলেই উদ্দেশ্য সফল হতে পারে। ১৮৫৭ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ ভয়াবহ রূপ নেবার পূর্বেই সরকার টের পায় যে, নেতা আলাউদ্দিনকে ছেড়ে দেওয়া ছাড়া পেরে উঠা সম্ভব হবে না। তাই তাঁকে বন্দী করে জেলে খুব অত্যাচার ও দুর্ব্যবহারের ইন্ধন করা হয়। শরীর দুর্বল এবং অসুস্থ থাকলেও মন আর মস্তিষ্ক কিন্তু দুর্বল হয়নি একটুও। তাঁকে ছাড়া হয়েছিল ১৮৬০ সালে। শুধু ভয় করেই এবং নিজেদের নিরাপত্তার জন্যই যে ইংরেজ সরকার তাঁকে বন্দী করেছিল তাতে সন্দেহ নেই। (M.A. Khan, p. 42-43)
১৮৬২ সালের ২৪শে অক্টোবর স্বাধীনতা আন্দোলনের এই মহান বিপ্লবী নেতার দেহাবসান হয়। আলাউদ্দিন মারা গেলে তাঁর সুযোগ্য পুত্র গিয়াসুদ্দিন হায়দার এই আন্দোনের নেতৃত্ব দেন। তাঁর পুত্রদের মধ্যে আব্দুল গফুর ও সাঈদ উদ্দিনও এই আন্দোলনের সাথে জড়িয়ে পড়েন। ১৮৬৯ সালে সাঈদ উদ্দিনের মৃত্যু হলে তাঁর পুত্র মুহসিন উদ্দিন এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। ৮ই আগস্ট ১৮৯৭ সালে তিনিও মৃত্যু বরণ করেন।