লিখেছেনঃ আবু রিদা
ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে ব্রিটেনের চার্লস রবার্ট ডারউইন একটি তত্ত্ব খাড়া করেন বিশ্বের সামনে যা তাঁর সফরের পর্যবেক্ষণের ওপর ছিল প্রতিষ্ঠিত। তিনি দাবি করেন, তাঁর সফরকালীন সময়ে বনজঙ্গল ও সমুদ্রে তিনি যেসব পর্যবেক্ষণ করেন সেসব থেকে পৃথিবীর সৃষ্টি রহস্য সম্পর্কে তিনি এক নতুন ভিশন ও বিভিন্ন নতুন বিষয় লক্ষ্য করেন। তিনি বিভিন্ন যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করেন যে, পৃথিবীর প্রতিটি বস্তু স্বাভাবিক ও প্রকৃতিগতভাবেই বিবর্তিত ও উন্নীত হয়েছে। বস্তু ও প্রাণী সময়ের অগ্রগতির সাথে সাথে তার প্রকৃতি বদলে ফেলছে আপনাআপনিই। জলে, স্থলে, সমুদ্র ও জঙ্গলে যেসব বড় বড় প্রাণী আজকাল দেখতে পাওয়া যায় সেসব আগে ছিল অন্যরকম। বুকে ভর করে চলা প্রাণী হাজার হাজার বছরে চতুষ্পদ প্রাণীতে উন্নীত হয়। আবার চতুষ্পদ প্রাণী দ্বিপায়ী প্রাণীতে উন্নীত হয় বহু বছর পরে। এর আগে জলের প্রাণী স্থলে আসলে তার প্রকৃতি বদলে যায়। এই ছিল ডারউইনের তত্ত্ব।
কিন্তু ডারউইনের কাছে তার তত্ত্বের স্বপক্ষে তেমন বৈজ্ঞানিক যুক্তি ছিল না। বস্তুর প্রকৃতি, এর রাসায়নিক প্রক্রিয়া, সচল প্রাণীর সৃষ্টি প্রক্রিয়া, এদের উপাদান সমূহের বিন্যাস, এদের দেহের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ইত্যাদি বিষয়ে গভীর পরীক্ষা-নীরিক্ষা তিনি করেননি। কেবল বাহ্যিক গঠন ও এর সাদৃশ্যের ওপর ভিত্তি করে তিনি অনুমানের ঘোড়া দৌড়িয়েছেন। আর তার এই অনুমানভিত্তিক তত্ত্ব পশ্চিমা পরিবর্তন অনুগামী ও ধর্মহীন সমাজে গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে ব্যাপক। এর বুনীয়াদী কারণ ছিল এই তত্ত্বের মাধ্যমে আল্লাহর অস্তিত্বকে করা হয়েছিল অস্বীকার। বস্তু ও প্রাণীর আপনা আপনিই অস্তিত্ব, বিবর্তিত ও উন্নীত হয়ে নতুন নতুন আকার ধারণ করার মতবাদের অর্থ সৃষ্টিকর্তাকে অস্বীকার। আর পশ্চিমারা এই মতবাদকে খুবই প্রচার-প্রসারিত করে। এবার আর মানুষ আদম-সন্তান থাকল না। বানরসন্তান বা বানরের উন্নত রূপ হয়ে উঠল।
ডারউইনের এই কাল্পনিক তথ্যকে বিভিন্নভাবে সত্য প্রমাণ করার চেষ্টা করা হয়েছে এবং এর ভিত্তিতে হাজার হাজার বছরের মানবেতিহাসকে সম্পাদিত করা হয়েছে নতুন করে। ডারউইন যেসব পর্যপেক্ষণের ভিত্তিতে এই মতবাদের ইমারত খাড়া করেছিলেন তার সত্যতা বিচার করার তেমন গভীর প্রয়াস করা হয়নি।
-
ডারউইনের তথাকথিত গবেষণা
ডারউইন জন্মগ্রহণ করেন ১৮০৯ সালে। আর তাঁর মৃত্যু হয় ১৮৮২ সালে। তাঁর এই ৭১ বছরের জীবনে তিনি মাত্র একবার যান ইংল্যাণ্ডের বাইরে। সে সময় তাঁর বয়স ছিল মাত্র ২২ বছর। দক্ষিণ আমেরিকা ও এর উপকূল অঞ্চলে অবস্থিত দ্বীপসমূহে ভ্রমণকালে সম্ভবত: তিনি মানুষের গঠন ও কাঠামোর সঙ্গে সাদৃশ্যমান বনমানুষ অথবা এই দ্বীপপুঞ্জে এমনসব প্রাণী দেখেছিলেন যেসবকে তিনি এর আগে দেখেননি। তিনি সফরকালীন সময়ে যা কিছু দেখেন, বলা হয়, তাতে জীবনের বৈচিত্র সম্পর্কে তাঁর ধ্যানধারণা বদলে দেয়।
মজার কথা হল মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যে ইংল্যাণ্ডে ফিরে এসে তিনি আর কখনও সফর করেননি সারা জীবনে। তিনি তাঁর বাড়ির একটি ছোট কুঠুরিতে সফরের পর্যবেক্ষণের ওপর ভিত্তি করে তার থিওরী প্রতিষ্ঠা করতে গোটা জীবন অতিবাহিত করেন। অথচ তিনি ছিলেন না সে যুগের আলবেরুনী অথবা ইবনে বতুতা যারা তৎকালীন দুনীয়ার অধিকাংশ স্থান সফর করেছিলেন। অপরদিকে তৎকালীন বিজ্ঞান এত উন্নত হয়নি যে তিনি তাঁর ঘরে বসে বসে হাজারো পর্দার অভ্যন্তরে নিরীক্ষণ করতে পারেন অথাব শতাব্দী-শতাব্দীর অগ্রপশ্চাতের পর্যবেক্ষণ করতে পারেন। একটি অপরিচিত মহাদেশের ছোট অংশ এবং তার আশপাশের কিছু দ্বীপ ভ্রমণকারী কোন ব্যক্তি যদি এ দাবি করেন যে, তিনি পৃথিবীর বৈচিত্র এবং বিশ্বভূখণ্ডে বিরাজমান প্রাণীদের প্রকৃতি সম্পর্কে অবগত হয়েছেন তাহলে তাকে উন্মাদই বলতে হবে। কিন্তু ডারউইনের সাথে এমনটা হয়নি। বরং তার থিওরী অসাধারণ গুরুত্ব পেয়ে গেল।
-
ডারউইনের মতবাদের উৎস
তাহলে দেখা যাক এর কারণ ও প্রেক্ষাপট কি ছিল? এটা দেখা বেশি আকর্ষক হবে যে, তিনি যা বলেন তার মূলে কি ছিল? আসলে বহু শতাব্দী পূর্বে গ্রীক দর্শনে এ ধারণার ভিত্তি ছিল যে পৃথিবীর অস্তিত্ব একটি কারণের পরিনাম। এই পৃথিবীর প্রকৃত সৃষ্টিকর্তা যেই হোক না কেন তিনি প্রথমে একটি কারণই সৃষ্টি করেন। তারপর এই কারণ থেকে দ্বিতীয় কারণ সৃষ্টি হয় এবং প্রথমোক্ত কারণের বিনাশ ঘটে। যেমনভাবে প্রথম কারণ সৃষ্টি করার পরে তার স্রষ্টার যেমন কোন অস্তিত্ব বজায় থাকেনি, আর যদি বজায় থেকেও থাকে তা নামমাত্র যা কোন বস্তুর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয়। দ্বিতীয় থেকে তৃতীয়, তৃতীয় থেকে চতুর্থ এভাবে সৃষ্টি হতে থাকে। আর এভাবে প্রতিটি কারণ সৃষ্টি হওয়ার পরে তার জন্মদাতার কারণের বিনাশ ঘটতে থাকে। এভাবে আপনাআপনি অস্তিত্বে আসতে থাকে। আর আজ পর্যন্ত এই পৃথিবী এই ব্যবস্থার ওপর প্রতিষ্ঠিত।
ডারউইনের এই দর্শনের উৎস অবশ্যই এই প্রাচীন (গ্রীক) দর্শন। যাকে তিনি উপস্থাপিত করেছেন নতুন রূপে। সেই সঙ্গে তার যুক্তির গুরুত্ব বাড়ানোর জন্য তিনি পর্যবেক্ষণের রামকাহিনি যোগ করেছেন এর সঙ্গে। এরপর এর ভিত্তিতে পৃথিবীর অস্তিত্বে আসার এক নতুন কাহিনি নির্মাণ করেছেন। পৃথিবী প্রথমে একটি অগ্নিগোলা ছিল যাতে বিস্ফোরণ ঘটে। তারপর বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের বিভিন্ন বস্তু অস্তিত্বে আসে। চাঁদ, গ্রহসমূহ আবর্তন করতে শুরু করে নিজ নিজ কক্ষপথে। এরও পরে প্রথমে পানিতে জীবনের অস্তিত্ব সৃষ্টি হয় এবং প্রথম প্রথম সৃষ্ট এইসব সচল প্রাণী থেকে উন্নীত হয়ে স্থলে ছড়িয়ে পড়ে অসংখ্য প্রাণী। যাদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত মানুষও।
এই থিওরীর উপরে ভিত্তি করে আজও প্রতিটি ওই জায়গায় জীবনের অনুসন্ধান চালানো হয় যেখানে পানি আছে। এই থিওরী এই বিশ্বকে কত ক্ষতির সম্মুখীন করেছে! সেই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কোন স্রষ্টা নেই, কোন মালিক নেই। এটা আপনাআপনি এক আকস্মিক ঘটনার পরিণাম। এতে আর বেশি ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই। শুধু এটাই বলা যায় যে, ডারউইন এবং তারপর ফ্রয়েডের মত পাশ্চাত্য চিন্তাবিদেরা মানুষকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন জন্তু-জানোয়ারের কাতারে। মানুষ আর মানুষ থাকেনি। পরিণত হয় বানর সন্তানে।
মুসলিম ওলামা ও বিজ্ঞানীরা ডারউইনের এই ভিত্তিহীন, থিওরীর মুখোশ খুলে দেওয়ার প্রয়াস পান প্রতিটি যুগে। বিশ্ববাসীকে এটা বলার নিরন্তর প্রয়াসে রত হন যে মানুষ আদম সন্তান। বিশ্বের একজন সৃষ্টিকর্তা আছেন। তিনি প্রত্যেক সৃষ্টিজীবকে তাঁর নিজস্ব অবয়বে সৃষ্টি করেছেন। সেই সৃষ্টিকর্তাই প্রকৃত বিশ্বব্যবস্থা পরিচালনা করছেন।
কিন্তু ডারউইনের এই থিওরী প্রচারের ১৫০ বছরের ইতিহাসে এই প্রথম কোন মুসলিম বিজ্ঞানী এত মজবুত দলীল, যুক্তিপ্রমাণ, বৈজ্ঞানিক তথ্য ও পাকাপোক্ত প্রমাণ সহকারে ডারউইনের এই ভিত্তিহীন থিওরীর পর্দা ফাঁস করেছেন। এই থিওরীর ভিত্তিকে টলিয়ে দিয়েছেন।
-
হারুন ইয়াহইয়ার গবেষণা
এই মুসলিম বিজ্ঞানী হলেন হারুন ইয়াহইয়া। তিনি শুধুমাত্র ৮০০ পাতার প্রামাণ্য দলীল লিখেই ক্ষান্ত হননি। বরং ইউরোপ ও আমেরিকার তামাম উল্লেখযোগ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বৈজ্ঞানিক সংস্থায় এই গ্রন্থটিকে পাঠিয়ে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন যে তারা যেন এর জবাব দেন। সুতরাং এই থিওরীর (ডারউইনের বিবর্তনবাদ) ভিত্তি নড়বড়ে হয়ে গেছে। তাহলে এর অট্টালিকা আর কিভাবে দাঁড়িয়ে থাকবে। অথচ, এই থিওরীর ওপরেই পাশ্চাত্য পণ্ডিত ও বিজ্ঞানীরা গর্বিত ছিলেন। বিগত ১৫০ বছর ধরে এই ভিত্তিহীন মিথ্যা থিওরী প্রচার করা হতে থাকে জোরেশোরে। কিন্তু হারুন ইয়াহইয়া বিশ্ববাসীকে অন্ধকার থেকে আলোয় আনার এক মহান কর্মকাণ্ড বাস্তবায়িত করেছেন। এ ডারউইনের মিথ্যা থিওরীকে মিথ্যা অভিহিত করার হাজারো মানুষ মওজুদ আছেন পাশ্চাত্য দুনীয়ায়। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়, আমেরিকায় প্রটেস্ট্যান্ট খ্রিস্টানপন্থীরা। এই মিথ্যা থিওরীর প্রচারের বিরুদ্ধে এবং এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেই আসছেন তারা। ইউরোপীয় দেশসমূহের বহুলোকও এই মিথ্যা থিওরী গলাধঃকরণ করতে প্রস্তুত ছিলেন না। কিন্তু এই প্রতিবাদী কণ্ঠকে এবার তুরস্কের আদনান উক্তার আল-মারূফ উরফ হারুন ইয়াহইয়া দান করেছেন অসাধারণ শক্তি। তিনি বহুল সংখ্যায় গ্রন্থ, ভিডিও, ডি.বি.ডি প্রস্তুত করে জ্ঞানবিজ্ঞান ও বিজ্ঞানের বহু বিষয়ে করেছেন ব্যাপক আলোকপাত। এইসব গ্রন্থের একটি হল ‘এ্যাটলাস অব ক্রিয়েশন’ (Atlas of Creation = সৃষ্টিতত্ত্বের এ্যাটলাস)।
এই গ্রন্থ, বর্তমানে পৌঁছে গিয়েছে ইউরোপ ও আমেরিকার উল্লেখযোগ্য বিজ্ঞানী, পার্লিয়ামেন্টের সদস্য, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্রের টেবিলে টেবিলে। ১১x১৭ ইঞ্চির বড় সাইজের ৮০০ পাতার এই বিশাল গ্রন্থ ডারউইনের থিওরীকে এমন মজবুত দলীল ও যুক্তি প্রমাণে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে যে একে খণ্ডন করা কারো পক্ষে সহজ নয়। বিবর্তনবাদকে পুরোপুরি নস্যাৎ করে দিয়েছে হারুন ইয়াহইয়ায় এই গ্রন্থ।
এই গ্রন্থ ফ্রান্সের স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও বিজ্ঞান মিউজিয়ামে এই বিষয়ে এক গভীর বিতর্কের ঝড় তুলেছে। কলেজ ডি ফ্রান্সের হিস্ট্রিক্যাল বাইওলজির অধ্যাপক আরমণ্ড দে রেকলস বলেন, এখন পর্যন্ত তো এর ওপর দেশে আসলে এরকম বই দুর্লভ যাতে পৃথিবীর সৃষ্টি রহস্যের দর্শন বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু তিনি একথা স্বীকার করেন যে খুবই মজবুত কেন্দ্রীয় পরিচালন ব্যবস্থা সত্ত্বেও এই ধরনের কোন বই ছাত্রদের হাতে পৌঁছে যাওয়া প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। কিন্তু আমেরিকানদের প্রতিক্রিয়া সম্পূর্ণ অন্যরকম। বাইওলজির জনৈক মার্কিন অধ্যাপক বলেন, আমাদের দেশে এই ধরনের প্রলাপের কোন স্থান নেই।
-
প্রলাপ কে বকছে?
তাহলে প্রলাপ বকছে কে? যিনি পাকাপোক্ত প্রমাণ ও বৈজ্ঞানিক দলীল প্রমাণের সাথে এটা প্রমাণ করে দিয়েছেন যে, মানুষ বানর সন্তান নয়, ডারউইনের দর্শনের উৎস বেবুনীয়াদ, মনগড়া এবং কাল্পনিক কাহিনির ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত তিনি, না যিনি মানুষকে জন্তু-জানোয়ারের কাতারে দাঁড় করিয়ে তার বাতিল আকীদার মুখোশ উনন্মোচিত হওয়া সত্ত্বেও তাকে স্বীকার করতে প্রস্তুত নন—তিনি? কুরআনে আল্লাহ স্পষ্টভাবে জানাচ্ছেন :
তিনিই তোমাদের সৃষ্টি করেছেন; তোমাদের মধ্যে কেউ কেউ অবিশ্বাস করে ও কেউ কেউ বিশ্বাস করে। তোমরা যা কর আল্লাহ্ তা ভালো করেই দেখেন। তিনি সৃষ্টি করেছেন আকাশ ও পৃথিবী যথাযথভাবে ও তোমাদের আকৃতি দিয়েছেন, তোমাদের আকৃতি করেছেন সুন্দর, আর প্রত্যাবর্তন তো তার কাছেই। [৬৪ সূরা তাগাবুন : ২-৪]
এরপরে আল্লাহ কড়া সাবধানবাণী উচ্চারণ করেছেন :
হে মানুষ! তোমাকে কিসে তোমার মহান প্রতিপালক সম্বন্ধে বিভ্রান্ত করল? যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন, তারপর সুঠাম ও সুসামঞ্জস্য করেছেন, তিনি তোমাকে তার ইচ্ছে মত আকৃতিতে গঠন করেছেন। না (বিভ্রান্তির কিছু নেই), কিন্তু তোমরা ধর্মকে প্রত্যাখান করে থাক। [৮২ সূরা ইনফিতার : ৬-৯]
মানুষের সৃষ্টিতত্ত্ব সম্পর্কে মহান আল্লাহ ঘোষণা করেন :
তিনি যিনি তার প্রত্যেকটি সৃষ্টিকে উত্তমরূপে সৃষ্টি করেছেন, আর মাটি থেকে মানব সৃষ্টির সূচনা করেছেন। তারপর তুচ্ছ তরল পদার্থের নির্যাস থেকে তিনি তার বংশধর পয়দা করেন। পরে তিনি ওকে সুঠাম করেছেন ও তার মধ্যে রুহ সঞ্চার করেছেন। আর তিনি তোমাদের দিয়েছেন চোখ, কান ও হৃদয়। তোমরা খুব কমই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর। [৩২ সূরা সিজদা : ৭-৯]
বিজ্ঞানী হারুন ইয়াহহিয়া আল্লাহর এই শাশ্বত সৃষ্টিতত্ত্বকে মজবুত যুক্তি প্রমাণের সঙ্গে তুলে ধরেছেন।
ডারউইনের মতবাদ অনুযায়ী বিশ্বভূখণ্ডের জীবনের অস্তিত্ব এইভাবে হয় যে, কিছু প্রাণহীন অণু-পরমাণুর পারস্পরিক মিলনে আকস্মিকভাবে প্রাণের সঞ্চার ঘটে। এরপর এই (প্রাণহীন অণু-পরমাণুর আকস্মিক মিলনে সৃষ্ট প্রাণ) প্রাণ থেকে আকস্মিকভাবে অদৃশ্য ও অতি ক্ষুদ্র প্রাণী অস্তিত্বে আসে এবং ব্যাকট্রিয়া থেকে মানুষে উন্নীত হওয়া পর্যন্ত তামাম প্রাণী অস্তিত্বে আসে আকস্মিকভাবে। তাহলে কি এই বাতিল মতবাদকে মজবুত দলীল ও বৈজ্ঞানিক প্রমাণ সহকারে বাতিল মনে করা প্রলাপ অথবা বহু যুগের অভিজ্ঞতায় এটা প্রমাণ হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও যে প্রাণহীন অণু-পরমাণুতে কোন আকস্মিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ফলে প্রাণ সৃষ্টি হতে পারে না?
মানবেতিহাসে কখনও এরূপ ঘটেনি, কারো পর্যবেক্ষণে এরূপ ধরা পড়েনি যে প্রাণহীন অণু-পরমাণুর মিলনে কোন প্রাণ অস্তিত্বে এসেছে। কোন জেদের ওপর অটল থাকা প্রলাপ ও অজ্ঞতা। হারুণ ইয়াহইয়া তাঁর গ্রন্থ ‘এ্যাটলাস অব ক্রিয়েশনে‘ ডারউইনের মতবাদকে বাতিল প্রমাণ করেছেন মাইক্রোবাইওলজি, বাইও ম্যাথমেটিক্স, সেল বাইওলজি, বাইও কেমিস্ট্রি, এ্যানাটমি, ফিজিওলজি, এ্যানগ্রো বাইওলজি এবং পিলিওনটোলজির মত বিজ্ঞানের দলীল প্রমাণের সাহায্যে। তবে এসবের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতীয়মান, আম বোধগম্য, অখণ্ডযোগ্য ও অসাধারণ প্রমাণযোগ্য সেই হাজার হাজার বছরের প্রাচীন ফোসিলের রেকর্ড যা চিত্রসহ তাঁর গ্রন্থে তুলে ধরেছেন হারুন ইয়াহইয়া। আর পশ্চিমাদের উদ্বেগ সেখানেই। কারণ এর মাধ্যমে আলে ডারউইনই শিকারে পরিণত ডারউইনের হাতিয়ারেই।
ডারউইন তাঁর শয়তানী মতবাদের বুনীয়াদ রেখেছিলেন পর্যবেক্ষণের ওপর। আর এর জন্য তিনি এক কাহিনি খাড়া করেন। তিনি তাঁর জীবনে মাত্র একবার ইংল্যাণ্ডের বাইরে দক্ষিণ আমেরিকায় যান। কিন্তু তিনি এবং তাঁর অনুসারীরা এই সফরকে এত বাড়িয়ে-চড়িয়ে পেশ করে যে, তিনি যেন পৃথিবীর বৃহৎ অংশ সফর করেন। এরপর কল্পনাকে পর্যবেক্ষণের নাম দেওয়া হয়। বিজ্ঞানী হারুন ইয়াহইয়া এই তথাকথিত পর্যবেক্ষণের মুখোশ উন্মোচিত করেন। তিনি বলেন, ডারউইন এবং তাঁর অনুসারীরা পর্যবেক্ষনের কথা বলেন। এটা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ধোকা। এটা দুনীয়াকে বোকা বানিয়ে রেখেছে বহু দিন ধরে এবং মানুষের চোখে ধুলো দিয়ে আসছে। নতুবা প্রকৃত বাস্তব হল এই যে, এই দুনীয়ার হাজার হাজার বছরের পর্যবেক্ষণ এই কথা বলে যে, প্রাণীর মৌলিকতায় কখনও কোন পরিবর্তন আসেনি। ঝিঁঝিঁ পোকা হাজার হাজার বছর আগেও ছিল ঝিঁঝিঁ পোকা। টিকটিকির চেহারা লক্ষ লক্ষ বছর আগেও ছিল একইরকম যেমন এখন আছে। উদ্ভিদ-গাছ, প্রাণী, মানুষ হাজার হাজার, বরং লক্ষ লক্ষ বছরের অবসরেও তাদের মৌলিকতায় কোন পরিবর্তন হয়নি যেমন ছিল তেমনই থেকে গেছে। কখনও এমন হানি রে একটি প্রাণী উন্নীত হয়ে পরিণত হয়েছে অন্য প্রাণীতে। এই সৃষ্টিতত্ব প্রসঙ্গে কুরআনে ঘোষিত হয়েছে :
আল্লাহ পানি হতে সমস্ত জীব সৃষ্টি করেছেন। এদের কিছু বুকে ভর দিয়ে চলে, কিছু দুই পায়ে চলে আর কতক চার পায়ে। আল্লাহ তো সর্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান। [২৪ সূরা নূর : ৪৫]
অন্যত্র কুরআনের ঘোষণা :
তার অন্যতম নিদর্শন আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টি আর এই দুইয়ের মধ্যে তিনি ছড়িয়ে দিয়েছেন যেসব জন্তু সেগুলো। যখন ইচ্ছা তিনি তাদের সমবেত করতে পারেন। [৪২ সূরা শূরা : ২৯]।
- ফসিল রেকর্ড
এবার দেখা যাক ফসিল রেকর্ড কি? পারিভাষিক অর্থে কোন প্রাণীর দেহকে ফসিল বলে যা মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছে বহুকাল আগে, কিন্তু আজও অস্তিত্বে রয়েছে স্বাভাবিকভাবে। যেমন মানুষ বা প্রাণীর সেই কঙ্কাল বা হাজার হাজার বছর আগে দাফন করা হয়েছিল অথবা মাটির মধ্যে প্রোথিত অবস্থায় পাওয়া গেছে। বর্তমানে বিজ্ঞান উন্নতির এমন চরম শিখরে পৌঁছেছে যে, যে কোন বস্তু ও কঙ্কালের বয়স ও প্রাচীনত্ব জানা যেতে পারে। কার্বন-ডেটিং এর মাধ্যমে জানা যেতে পারে কোন কিছুর প্রাচীনত্ব। সুতরাং দুনীয়া জুড়ে প্রাপ্ত কঙ্কালের বয়স জানা এখন আর তেমন কঠিন নয়। এই অবশিষ্ট কঙ্কালের গভীর গবেষণা ও বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নীরিক্ষা থেকে প্রাপ্ত তথ্যাবলীকে ফসিল রেকর্ড বলে।
প্রাচীনকালের হাজার হাজার বছরের পুরানো প্রাণী প্রসঙ্গে সর্বোত্তম পাকাপোক্ত প্রমাণ হল ফসিল। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ফসিল প্রাপ্ত হয়েছে লক্ষ লক্ষ সংখ্যায়, যেসব ভূপৃষ্ঠের প্রাণীর চেহারা ও ইতিহাস জানতে সহায়ক হয়ে চলেছে। এই লক্ষ লক্ষ ফসিলই বলে দেয় যে, তারা তাদের পরিপূর্ণ উন্নত ও জটিল চেহারায় অবস্মাৎ উন্নীত হয়েছে না প্রথমে অতি সাধারণ চেহারা থেকে ধীরে ধীরে উন্নীত হয়েছে বর্তমান রূপে। দৃষ্টান্তস্বরূপ একটি ব্যাঙকে ধরা যাক। বর্তমানে ব্যাঙের যে চেহারা, ২৮০ মিলিয়ন বছরের পুরানো ফসিল বলছে যে সে-সময়ও ব্যাঙের চেহারা এইরকমই ছিল। এখানকার ব্যাঙ আর তখনকার ব্যাঙের মধ্যে কোন ফারাক পরিলক্ষিত হয়নি।
১৫০ বছর অথবা তার আগে পৃথিবীর বিভিন্ন মৃত্তিকা গর্ভে প্রাপ্ত লক্ষ লক্ষ ফসিল বলে যে মাছ সব সময়েই ছিল মাছ। পোকা-মাকড় ছিল পোকা-মাকড়ই। পাখি সর্বদাই ছিল পাখি। বুকে ভর করে চলা প্রাণী বুকে ভর করে চলে আসছে চিরকালই। এই অবকাশে কোন এমন একটিও ফসিল শনাক্ত করা যায়নি যা থেকে সামান্যতমও ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে কোন প্রাণীর মৌলিকতায় কোন পরিবর্তন এসেছে। এমন হয়নি যে, কোন মাছ ব্যাঙে পরিণত হয়েছে বা বুকে ভর করে চলা প্রাণী পরিণত হয়েছে পাখিতে। আল্লাহ পরিষ্কার – জানাচ্ছেন :
ওরা কি লক্ষ্য করে না ওদের জন্য আমি নিজ সৃষ্টি করেছি আনআম (গৃহপালিত পশু) আর ওরাই এগুলোর মালিক? আর আমি এগুলোকে ওদের বশীভূত করে দিয়েছি। এগুলোর কিছু ওদের বাহক আর কিছু ওদের খাদ্য। ওদের জন্য এদের মধ্যে আছে নানা উপকার ও পানীয়। তবুও কি ওরা কৃতজ্ঞ হবে না! [৩৬ সূরা ইয়াসিন : ৭১-৭৩]
আল্লাহর আরো ঘোষণা :
তারা কি লক্ষ্য করে না পাখি আকাশের শূন্যে সহজইে ঘুরে বেড়ায়? আল্লাহই ওদের স্থির রাখেন। এর মধ্যে তো নিদর্শন রয়েছে বিশ্বাসী সম্প্রদায়ের জন্য। [সূরা নাহল : ৭৯]
যখন হাজার হাজার বরং লক্ষ লক্ষ বছরের পর্যবেক্ষণে এরকম কিছু ধরা পড়েনি তাহলে ডারউইন ও তার অনুগামীরা কোন পর্যবেক্ষণের কথা বলেন? হারুন ইয়াহইয়ার এ প্রশ্নের জবাবে গোটা দুনীয়ার প্রকৃতিবাদীদের কাছে নেই কোন জবাব। এই পৃথিবী এবং এই পৃথিবীতে যা কিছু আছে আল্লাহ সব কিছু সৃষ্টি করেছেন—কুরআনের এই সত্যকে অগ্রাহ্য করে যে তত্ত্ব খাড়া করা হয় তা আজ আবার উপেক্ষিত।
কুরআন খুব স্পষ্ট করেই বলেছে যে মাছি, মশা, বিচ্ছু থেকে বড় শরীর বিশিষ্ট তামাম প্রাণী আল্লাহরই সৃষ্টি। সেই আল্লাহই পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন, ভূপৃষ্ঠ ও আকাশ সৃষ্টি করেছেন। চাদ, সূর্য, তারকা, মানুষ, প্রাণী সবকিছুই তার সৃষ্টি। কোন, দুর্ঘটনা বা বিবর্তনের পরিনাম নয়। এই পৃথিবীতে যা কিছু বিবর্তন বা প্রাকৃতিক নিয়মকানুন পরিলক্ষিত হয় তা সবকিছুই তারই কুদরত। যার ওপর কুরআনুল করীম বারবার ভাবনাচিন্তা করার আমন্ত্রণ জানিয়েছে। এর ওপর যত ভাবনাচিন্তা করা হবে ততই আল্লাহর কুদরতের প্রতি মানুষের ঈমান পোক্ত হবে। কুদরত প্রকাশের পর্যবেক্ষন আল্লাহর অস্তিত্ব এবং তাঁর বৈশিষ্ট ও গুনাবলীর প্রতি মানুষের ঈমান ও ইয়াকীন মজবুত করে। কিন্তু এটা নিজ নিজ তকদীর ও তৌফীকের কথা যে কে তা থেকে হিদায়েতপ্রাপ্ত হবে এবং কে আরো গুমরাহ বা বিভ্রান্তির শিকার হবে বেশি বেশি।
এই সৃষ্টি রহস্য সম্পর্কে ভাবনাচিন্তা করার আমন্ত্রণ জানিয়ে আল্লাহ বলেন :
তার নিদর্শনাবলীর মধ্যে একটি নিদর্শন এই যে, তিনি তোমাদের মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন। এখন তোমরা মানুষ সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছ। আর তার নিদর্শনগুলোর মধ্যে আর একটি নিদর্শন তিনি তোমাদের জন্য আমাদের মধ্য থেকে তোমাদের সঙ্গিনীদের সৃষ্টি করেছেন যাতে তোমার ওদের কাছে শান্তি পাও, আর তিনি তোমাদের মধ্যে পরস্পরের প্রতি প্রেম ও স্নেহ সৃষ্টি করেছেন, চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য এতে অবশ্যই নিদর্শন রয়েছে। [৩০ সূরা রূম ২০-২১]
অন্যত্র আল্লাহ ঘোষণা করেছেন :
তিনি তোমাদের মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন, পরে শুক্রবিন্দু থেকে, তারপর জমাট রক্ত থেকে, তারপর তোমাদের শিশুরূপে বের করেন। তারপর তোমরা যৌবন লাভ কর, তারপর পৌঁছো বার্ধক্যে। তোমাদের মধ্যে কারও কারও পূর্বেই মৃত্যু ঘটে, আর এ জন্য যে তোমরা যাতে তোমাদের নির্ধারিত কাল প্রাপ্ত হও ও যাতে অনুধাবন করতে পার। [৪০ সূরা মুমিন : ৬৭]
নিবর্তনবাদ সম্পর্কে আরও জানতে নিচের আর্টিকেলগুলি পড়ুন,
তুরস্কের জনপ্রিয় বৈজ্ঞানিক হারুন ইয়াহইয়ার সংক্ষিপ্ত পরিচয়
গবেষণায় প্রমাণিত : ডারউইনের বিবর্তনবাদ মিথ্যা : মানুষ বানর সন্তান নয়
‘নবজাগরণ’ অ্যান্ড্রোয়েড অ্যাপ্লিকেশনটি প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর টেলিগ্রাম চ্যানেলে জয়েন হতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর ফেসবুক পেজে লাইক করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।