লিখেছেনঃ মুহাম্মাদ আব্দুল আলিম
ব্রিটিশ দের গোয়েন্দা রিপোর্টে উলামায়ে দেওবন্দকে প্রথম শ্রেণীর ব্রিটিশ বিরোধী ব্যক্তিত্ব বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। উলামায়ে দেওবন্দ ছিলেন ব্রিটিশ দের মহাশত্রু। তাই এবার উলামায়ে দেওবন্দ সম্পর্কে ব্রিটিশদের গোয়েন্দা রিপোর্ট থেকে মন্তব্য পেশ করছিঃ-
১) ওবাইদুল্লাহঃ- ১৯১৫ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে যখন লাহোরের সংগ্রামী ছাত্রগণ ফেরার হয়ে ভারতীয় উগ্রপন্থীদের সঙ্গে মিলিত হল, তখন সে লাহোরে অবস্থান করছিল। সে মাওলানা মাহমুদুল হাসানের পাক্কা মুরিদ। হযরত মাওলানা উপর সে প্রভাব বিস্তার করল এবং তাঁকে ইসলামী ঐক্য-আন্দোলনের জবরদস্ত প্রচারকের ভূমিকায় নামিয়ে দিল। সে যোগদান করত দেওবন্দের গোপন পরামর্শসভায়। ১৯১৫ সালের অক্টোবর মাসে সে কাবুলে উপস্থিত হল। প্রিন্স ইনায়াতুল্লাহ, সর্দার নসরুল্লাহ খান এবং আমীরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করল। …… তাছাড়া, জার্মান-মিশনের সদস্যবৃন্দের সঙ্গেও কাবুল সিভিল হাসপাতালে যোগাযোগ করল। সাক্ষাৎকার গোপনেই হয়েছিল। উবাইদুল্লাহ এবং মাওঃ আব্দুর রহীম মিশনের জার্মান এবং অষ্ট্রিয়ান সদস্যদেরকে স্বাধীন এলাকার কিছু জায়গা ঘুরিয়ে দেখাল। সে তো ভারত থেকে এসেইছিল জিহাদের মনোভাব নিয়ে আর সারা আফগানিস্থানকে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করার উদ্দেশ্যে।……… ১৯১৬ সালে জুলাই মাসে সে আব্দুল হক্বের মাধ্যমে হায়দ্রাবাদের শাইখ আব্দুর রহীমকে ‘রেশমী চিঠি’ পাঠিয়েছিল। ঐ চিঠি ফাঁস হয়ে গেল – ব্রিটিশ হস্তাগত হল। ‘জুনুদে রব্বানীয়া’ (Muslim Saltion Army)-র তালিকায় উবাইদুল্লাহ ‘সালার’ (GENERAL)- এর কাবুলস্থ প্রতিনিধি হিসাবে চিহ্নিত । [গোয়েন্দার মতে GENERAL হচ্ছেন মাওলানা মাহমুদুল হাসান (রহঃ)]

[প্রকাশ থাকে যে, প্রথম মহাযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সরকার মাওলানা উবাইদুল্লাহ (রহঃ) প্রভৃতির নামে ভারতীয় ফৌজদারী বিধির ১২১ (ক) ধারা অনুসারে মামলা দায়ের করেছিল। আলেমদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে আর্জিতে বলা হয়েছি যেঃ-
“হিজ ম্যাজিস্ট্রির সৈন্যদের বিরুদ্ধে লড়াই এর চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া, লড়াই করতে সাহায্য করা। ওরা ভারতীয় মুসলমানকে কুরআনের অপব্যাখ্যা করে’ বা অন্য পদ্ধতিতে ধর্মীয় উন্মাদনায় বিহ্বল করে’ তুলেছে, সীমান্তের উপজাতি এবং আফগানদের মধ্যে ব্রিটিশ বিরোধী আবহাওয়া সৃষ্টি করেছে। ওরা দেশের সাধারণ মানুষকেও ইংরেজদের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করেছে………।” (তাহরীকে শায়খুল হিন্দ, পৃষ্ঠা-১৮৮/৮৯)]
২) শওকত আলী মওলবীঃ- এ হচ্ছে কুখ্যাত মুহাম্মাদ আলী এম, এ, অফ ‘কমরেড’- এর ভাই। এক্সাইস ডিপার্টমেন্টে আগে সে চাকুরী করত। উবাইদুল্লাহর একনিষ্ঠ সঙ্গী। কথিত আছে, শেষোক্ত ব্যক্তির কাবুল-সফরের সময় ‘ও’ তাকে অর্থ সাহায্য করেছিলে।……..গ্রেফতার হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত ‘আনজুমানে খুদ্দামে কাবা’র সেক্রেটারী ছিল সে। তাকে এবং তার ভাইকে মধ্যপ্রদেশে ১৯১৫ সালে নজরবন্দ করা হয়েছে। ‘জুনুদে রব্বানীয়া’র ফিরিস্তিতে ‘লেফটেন্যান্ট জেনারেল’ রুপে ‘ওর’ নাম পাওয়া গেছে।
৩) হসরত মুহানীঃ- ……কুখ্যাত লেখক – স্বদেশী আন্দোলনের সমর্থক। আবুল কালাম আযাদ, উবাইদুল্লাহ, মুহাম্মাদ আলী (কমরেড পত্রিকার সম্পাদক) এবং শওকত আলীর ঘনিষ্ঠ সঙ্গী এই ব্যক্তি। আধুনাপুপ্ত ‘উর্দূ-এ-মুআল্লা’র সম্পাদক। জানা গেছে তিনি উগ্র ব্রিটিশ বিরোধী ও ষড়যন্ত্রের অংশীদার হয়েছিল।

৪) আব্দুল বারী মওলবী, ফিরিঙ্গিমহল লক্ষ্ণৌঃ- ‘আনজুমানে খুদ্দামে কাবা’র সভাপতি – ইসলামী ঐক্য-আন্দোলনের উগ্রপন্থী সমর্থক। লোকটি মাওঃ মাহমুদুল হাসানের সঙ্গে যোগাযোগ রাখত। তারই মতের অনুসারী ছিল। ‘জুনুদে রব্বানীয়া’র ‘লেফটেন্যান্ট কর্ণেল’ পদাধীকারী।
৫) গোলাম রসুল মওলবীঃ- দেওবন্দ মাদ্রাসার অধ্যাপক। মনে হচ্ছে, মাওঃ মাহমুদুল হাসানের ষড়যন্ত্রী দলের সেও অন্যতম সদস্য।
৬) হুসাইনঃ- জিদ্দার পরবর্তী ঘটনার উল্লেখ করে উবাইদুল্লাহ হযরত মাওলানাকে যে পত্র দিয়েছিলেন, তাতে এই নাম রয়েছে। এ হচ্ছে হুসাইন আহমদ মাদানী। ‘জুনুদে রব্বানীয়া’র তালিকায় এ লোকটি ‘লেফটেন্যান্ট জেনারেল’ রুপে চিহ্নিত। এই খান্দান আসলে ইউ, পির ফইজাবাদ জেলার। তবে ১৮৯৯ সালে ওরা আরবে হিজরত করেছিল। মওলবী হুসাইন আহমদ মদনী মুফতী – ভারত ত্যাগের পূর্বে সে অধ্যপনা করত দেওবন্দে। সে মাওঃ মাহমুদুল হাসানের পাক্কা মুরিদ – জিহাদের জবরদস্ত প্রচারক। ……… মক্কার শরীফ হুসাইনের নির্দেশে ১৯১৬ সালের ২০শে ডিসেম্বর বা তার কাছাকাছি নাগাদ ঐ ব্যক্তি গ্রেফতার হয়। তারপর তাকে জিদ্দায় পাঠানো হয়। সেখান থেকে তাকে ১৯১৭ সালের ১২ই জানুয়ারী মিশরে প্রেরণ করা হয়।
৭) আনওয়ার শাহ মওলবীঃ দেওবন্দ মাদ্রাসার অন্যতম অধ্যাপক, কাশ্মিরী, বিখ্যাত আলিম। দেওবন্দে তার সম্মান খুব বেশী।…….বিদেশী দ্রব্য বর্জনের এও এক সমর্থক। মনে হচ্ছে, এম, আনওয়ার শাহও চক্রান্তের অংশীদার।
৮) মাদ্রাসা সওলাতীয়াঃ- মক্কার বিখ্যাত আরবী মাদ্রাসা। ভারত থেকে সংগৃহীত চাঁদার দ্বারা এর ব্যয় নির্বাহ করা হয়। এর কিছু শিক্ষক এবং ছাত্র – যাদের অনেকেই ভারতীয় – ১৯১৫ সালে মাওলানা মাহমুদুল হাসানের জিহাদী ষড়যন্ত্রে যোগদান করেছিল।
৯) নাসির আহমদ হা-ফিজ দেহলবীঃ- এ লোক দিল্লীতে এক বড় দরের পীর। মাওঃ মাহমুদুল হাসান পরিচালিত ষড়যন্ত্রে এ লোকটি ভালভাবেই অংশগ্রহণ করেছিল।…….
১০) সুলাইমান সৈয়দ নাদভীঃ- মওলবী শিবলী নুমানীর অনুগত। তার ‘নাদওয়াতুল উলামা’ নামক প্রতিষ্ঠানের একান্ত সহযোগী। দারভাঙ্গা মাদ্রাসা ইমদাদিয়ায় সৈয়দ মুর্তাজা হুসাইন চাঁদপুরীর নিকট সে শিক্ষালাভ করেছিল। পরে পুনা কলেজের প্রফেসার হয়েছে। ‘জুনুদে রব্বানীয়া’র ফিরিস্তিতে এ ব্যক্তি মেজর জেনারেল রুপে চিহ্নিত।
১১) খলীল আহমদ মাওলানাঃ- ওরফে খলীলুর রহমান অফ মাদ্রাসা ইসলামীয়া, সাহারানপুর। খুব সম্মান ও শ্রদ্ধার পাত্র এই মওলবী। ভারতে তার মুরিদ-ভক্ত অজস্র।……১৯১৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসের গোড়ার দিকে আরবে অবস্থানকালে এ লোক মাওঃ মাহমুদুল হাসানের রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রে যোগদান করল; গালিব পাশার ব্যাপারেও জড়িয়ে ফেলল নিজেকে। বিশ্বাস করা যায়, মক্কার ধরমপুর রেবাতে জিহাদসংক্রান্ত বৈঠকে ওর যোগাযোগ ছিল।
১২) হাজি সাহেব তুরঙ্গজয়ঃ- হযরত মাওলানার প্রতি উবাইদুল্লাহ যে পত্র লিখেছিল, তাতে কেবল ‘হাজি’ নামের উল্লেখ আছে। ‘জুনুদে রব্বানীয়া’র তালিকায় এ ব্যক্তি ‘লেফটেন্যান্ট জেনারেল’ রুপে চিহ্নিত। ওর আসল নাস ‘ফজল অহেদ’।….. উগ্র কট্টরপন্থী। সরকার বিরোধীতার ভাবাবেগ ওর মধ্যে প্রচণ্ড। মাওঃ মাহমুদুল হাসান দেওবন্দীর ইঙ্গিতে ১৯১৫ সালে স্বাধীন এলাকায় চলে গিয়েছিল।….. কাবুল ষড়যন্ত্রী দলের সঙ্গেও ‘ওর’ যোগাযোগ আছে। পানিপথের এম, হামদুল্লাহ এবং লাহোর সুফী মসজিদের মওলবী আহমদের মাধ্যমে দেওবন্দ পার্টি থেকে সে সাহায্য লাভ করেছে।
১৩) মাদ্রাসাঃ হযরত মাওলানার নামে লিখিত পত্রে এই শব্দের উল্লেখ আছে। এর অর্থ দেওবন্দের আরবী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এটা স্থাপন করেছিল মাওলানা মুহাম্মাদ ক্বা-সিম। দেওবন্দ সাহারানপুর জেলায় অবস্থিত।……রেশমী রুমাল ষড়যন্ত্রে যেসব মওলবী জড়িত, তারা প্রায় সকলেই এই মাদ্রাসার সনদপ্রাপ্ত। পরে এই মাদ্রাসা ইসলামী ঐক্য আন্দোলন তথা জিহাদী তৎপরতার দুর্গে পরিণত হয়েছে।
১৪) ক্বা-সিমুল মাআরিফঃ দেওবন্দস্থিত ‘জমিয়াতুল আনসার’ তথা প্রাক্তন ছাত্র সংস্থার কোলকাতা শাখার নাম।……বলকান যুদ্ধের সময় এই সোসাইটি ‘হেলাল আহমর’ নামক তুর্কী সংস্থার উদ্দেশ্যে চাঁদা সংগ্রহ করার ব্যাপারে বড়ই তৎপরতা দেখিয়েছে। (এম, উবাইদুল্লাহ করাচীতে এই নামে যে সংগঠন গড়েছিলেন, সেটা কিন্তু এই সংস্থা থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র)
১৫) রশীদুল্লাহ পীর ঝাণ্ডেওয়ালাঃ হায়দ্রাবাদ জেলায় হালা তাহশীলের অন্তর্গত গোঠ পীরঝাণ্ডার অধিবাসী বিখ্যাত সিন্ধী পীরসাহেব। অত্যন্ত উগ্রপন্থী – উন্মাদনায় ভরপুর । সিন্ধু, কাথিওয়াড়, বেলুচিস্তান, ভাওয়ালপুর প্রভৃতি এলাকায় তার ছয় লক্ষ মুরিদ আছে।……যুদ্ধ আরম্ভ হওয়ার ছ’সাত বছর আগে এই পীর ধর্মীয় উন্মাদনা প্রকাশ করত, বক্তৃতার মাধ্যমে ইংরেজী কৃষ্টি-ঐতিহ্য তথা খ্রীষ্টান ধর্মের ভুলত্রুটির সমালোচনা করত।……তুর্কীদের সাফল্য সম্পর্কেও ঐ পীর কথাবার্তা বলত। সম্ভবত উবাইদুল্লাহর কুপ্রভাবে ও এইসব বাজে কথা বলে বেড়াত। উবাইদুল্লাহ সরে যাওয়ার পর থেকে লোকটি নিজের মনের ভাব ব্যক্ত করার ব্যাপারে সতর্ক হয়ে পড়েছে। পরবর্তী তদন্তে জানা গেছে, পীর রশীদুল্লাহর যোগাযোগ দেওবন্দী ষড়যন্ত্রকারীদের সঙ্গেও ছিল। এরুপ শোনা যায়, ঝাণ্ডেওয়ালা পীর ধর্মযুদ্ধের শপথ নিয়ে থাকে মুরিদ ভক্তদের থেকে।
১৬) আনসারী ডাক্তারঃ ‘জুনুদে রব্বানীয়া’র তালিকায় এ লোকটি ‘লেফটেন্যান্ট জেনারেল’ রুপে চিহ্নিত।…….১৯১৩ সালে বলকান যুদ্ধের সময় তুরস্কের সাহায্যার্থে যে ‘ভারতীয় মেডিকেল মিশন’ রওনা হয়েছিল, এ ব্যক্তি তারই লিডার এবং অর্গানাইজার। (এ লোক) হাকীম আব্দুর রাযযাক্বের ভাই – মাওঃ মাহমুদুল হাসানের গোঁড়া ভক্ত। প্যান – ইসলামীযমের ঘোর সমর্থক – ভারতস্থ তুর্কী অনুরাগীদের মধ্যে সবথেকে ভয়ঙ্কর মুসলমান।
১৭) ইবরাহীম মওলবী অফ শিয়াকোটঃ- শিয়ালকোটের মিস্ত্রী ক্বা-দির বকসের পুত্র খ্যাতনামা, প্রভাবশালী এবং উগ্রপন্থী প্রচারক। ভারতে এ লোক সফর করে। ওহাবীদের সভায়, ভিন্ন সম্প্রদায়ের সঙ্গে বিতর্কমূলক সমাবেশ ঝাঁঝাঁলো বক্তৃতা দিয়ে থাকে। এম, ইবরাহীম সম্পর্কে সন্দেহ করা হচ্ছে, ব্রিটিশ-বিরোধী প্রোপাগান্ডায় ওর হাত রয়েছে। ‘জুনুদে রব্বানীয়া’র তালিকায় এ লোক ‘কর্ণেল’ পদবাচ্য।
১৮) সৈয়দ হাদীঃ- মাওঃ মাহমুদুল হাসানের আরব যাত্রা করার পর এই ছিল টাকাকড়ি এবং অস্ত্রশস্ত্রের জিম্মাদার। হাদী হাসান মাওঃ রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী এবং দেওবন্দ মাদ্রাসার মুফতী আযীযুর রহমানের ভক্ত মুরিদ। ষড়যন্ত্রী দলের সে একজন সদস্য।……কথিত আছে, হাদী হাসান ঐসব ফরমান ছাড়াও এম, মাহমুদুল হাসানের লেখা এক চিঠিও এনেছিল – যেটা লেপের মধ্যে সেলাই করা অবস্থায় ছিল। প্রথম তল্লাসীর সময় ওটা পুলিশের নজরে পড়েনি। এম, খলীল আহমদ ব্যাপারটা জানতে পারল, তখনই ওটা নষ্ট করে ফেলল।
১৯) রায়ওয়ালা মাওলানাঃ- হযরত মাওলানার নামে উবাইদুল্লাহ যে চিঠি লিখেছিল তাতে এর কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। এ ব্যক্তি সম্ভবতঃ ইউ, পির সাহারানপুরের অন্তর্গত রায়পুরের মৌলবী আব্দুর রহীম। ‘মাওলানা রায়পুরী’ নামেই এ লোক প্রসিদ্ধ। সে অংশগ্রহণ করেছিল মাওঃ মাহমুদুল হাসানের জিহাদ পরিকল্পনায়। তবে ভারত থেকে হিজরতের বিরোধী ছিল সে। দেওবন্দ মাদ্রাসা কমিটির অন্তর্ভূক্ত ছিল ঐ ব্যক্তি। মনে হচ্ছে, মাওঃ মাহমুদুল হাসানের হাসানের অনুপস্থিতিতে তাকে সহ-প্রতিনিধি নিযুক্ত করা হয়। টাকাকড়ি সংগ্রহ করা এবং হামদুল্লাহর কাছে তা পৌঁছে দেওয়া ঐ ব্যক্তির দায়িত্ব ছিল।
২০) যা’ফর আহমদ মওলবীঃ- ‘জুনুদে রব্বানীয়া’র তালিকায় এ লোক ‘লেফটেন্যান্ট জেনারেল’ পর্যায়ভুক্ত।……বর্তমানে রুড়কী আরবী স্কুলের শিক্ষক – জিহাদী ষড়যন্ত্রের এক অতি উৎসাহী নায়ক। বরাবর দেওবন্দে এসে সে গোপন বৈঠকে যোগ দিত। এম, মাহমুদুল হাসানের আরব সফরের সাহায্যার্থে বিজনৌর, নগীনা এবং পার্শ্বস্থ এলাকা থেকে কাটাকড়ি সংগ্রহ করত। তাকে বলা হয়েছিল, মুহাম্মাদ মিয়া – মাওলানার সঙ্গে যে আরব সফর করেছিল – ফিরে না আসা পর্যন্ত যেন অর্থ সংগ্রহে নিযুক্ত থাকে।
২১) আল্লানয়াজ খানঃ- মুলতালের অনারবী ম্যাজিষ্ট্রেট খানবাহাদুর রব্বনওয়ায খানের পুত্র। লাহোর গভর্ণমেণ্ট কলেজের এইসব উগ্রপন্থী ছাত্রদের অন্যতম – যারা ১৯১৫ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে ফেরার হয়ে সীমান্তের ওপারে গিয়েছিল। হিজরতের প্রশ্নে ছাত্রদের মধ্যে এ ব্যক্তি বড়ই কট্টর প্রকৃতির। কলেজের বোডিং হাউসে এর ঘরটি সেমময় ষড়যন্ত্রের লীলাক্ষেত্র হয়ে উঠেছিল।
২২) কুহাস্তানী মোল্লাঃ- ‘জুনুদে রব্বানীয়া’র তালিকায় এ লোক ‘লেফটেন্যান্ট জেনারেল’ পদবাচ্য। ‘সওয়াত’ এলাকায় সন্দার মোল্লা এবং অন্যান্য স্থানে কুহিস্তানী মোল্লা বা ফকির নামে পরিচিত। ১৯১৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সওয়াত এলাকায় ব্রিটিশ সৈন্যদের উপর আক্রমণ করার জন্যে এ ব্যক্তি সওয়াত জনগণের মধ্য থ্যেকে সৈন্য সংগ্রহ করেছি।
২৩) মুহাঃ ইউসুফ মৌলবী গাঙ্গুহীঃ- জুনুদে রব্বানীয়ায় এ লোক ‘কর্ণেল’ তালিকাভুক্ত। মৌলবী মুহাম্মাদ ইউসুফ গাঙ্গুহী মাওঃ রশীদ আহমদ গাঙ্গুহীর নাতি- যিনি (রশীদ আহমদ) মাওঃ মাহমুদুল হাসানের পীর। এটা ওয়ার কনাল ডিপার্টমেন্টের জেলা-অধিকর্তা। বলকান যুদ্ধের সময় এ লোক তুরস্কে গিয়েছিল ডাক্তার আনসারীর সঙ্গে। মাওঃ মাহমুদুল হাসানের সঙ্গে ওর যোগাযোগ ছিল। তবে এটা বলা যাবে না যে, সে ওর মুরিদ শ্রেণীভুক্ত কি না।
২৪) মুহাম্মাদ হাসান মৌলবী অফ মুরাদাবাদঃ- জুনুদে রব্বানীয়ার তালিকায় এ লোল ‘মেজর জেনারেল’ রুপে চিহ্নিত। এ ব্যক্তি ভূপান স্টেট কাউন্সিলের সদস্য, মাওঃ মাহমুদুল হাসানের দলের অন্যতম নেতা, দেওবন্দ কমিটির মেম্বার।
২৫) আব্দুল্লাহ মৌলবী অফ গাজিপুরঃ- মৌলবী হা-ফিজ আব্দুল্লাহ গাজিপুরী বিখ্যাত ওহাবী মৌলবী। এ ব্যক্তি অধিকাংশ সময় বিহার এবং উড়িষ্যায় থাকে। ১৯০৬ সালে মৌলবী আব্দুল্লাহ শাহাবাদ আহমাদীয়া মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করত। ১৯০৭ সালে আরা মাদ্রাসার হেড মৌলবী এবং সেক্রেটারী পদে নিযুক্ত হল। আরা মাদ্রাসা হচ্ছে বাংলা, বিহার এবং উড়িষ্যার সমস্ত ওহাবী মাদ্রাসার মূল প্রেরণাদাতা বা কেন্দ্রস্থল। জুনুদে রব্বানীয়ার তালিকায় এ লোক ‘লেফটেন্যান্ট জেনারেল’ রুপে চিহ্নিত।
২৬) আব্দুর রাযযাক সাহেব হাজীঃ- ……কাবুলে ভারতীয় বিপ্লবী দলের পৃষ্ঠপোষক হচ্ছে এই লোক। সীমান্তের ওপারে সন্ত্রাসবাদী যে সব তৎপরতা প্রকাশ পেয়েছিল তার নেতৃত্ব দিয়েছে এ লোক। সাম্প্রতিক উপজাতীয় বিদ্রোহের সঙ্গেও ওর সম্পর্ক নিবিড়। যখন রুশগণ আব্দুল বারী এবং ডাঃ মথুরা সিংকে গ্রেফতার করল, তখন তাদের কাছে ছিল এই আব্দুর রাযযাক্বের সই করা পাসপোর্ট।
২৭) মুহাম্মাদ মিয়া মওলবী ওরফে মওলবী মনসুরঃ- …….দেওবন্দে সে শিক্ষালাভ করেছিল। যখন মৌলবী আবু আহমদ ‘জমিয়াতুল আনসার’-এর সহকারী কার্য্যাধ্যক্ষ ছিল, তখন সেখানে ও পড়াশুনা করে। শিক্ষালাভের পর কিছুদিন ‘নাগীনা’তে চাকুরী করেছিল। পরে দারুল উলুম দেওবন্দে বহাল হয়। ঐ সময়েই সে মাওঃ মাহমুদুল হাসানের মুরিদ-ভক্তে পরিণত হয়। মাওলানার সঙ্গে ওর সম্পর্ক খুব ঘনিষ্ঠ। সে ষড়যন্ত্রের বিশেষ অংশীদার। দেওবন্দের গোপন বৈঠকে যোগদান করত সে । ১৯১৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মাওঃ মাহমুদুল হাসানের সঙ্গী হয়ে আরব যাত্রা করেছিল ঐ লোক। দলের কোষাধ্যক্ষ রুপে সে কাজ করেছে। ১৯১৬ সালের এপ্রিল মাসে ‘গা-লিব নামা’ নিয়ে ও ফিরে আসে; ভারত ও স্বাধীন এলাকার ষড়যন্ত্রীদেরকে ওটা দেখানোর পর ’১৬ সালের জুন মাসে কাবুল পৌঁছয়। এখন পর্য্যন্ত উবাইদুল্লাহ প্রভৃতির সঙ্গে কাবুলেই অবস্থান করছে। সম্ভবতঃ হযরত মাওলানা নামে ঐ ব্যক্তিই চিঠি লিখেছিল।
২৮) মুজাহিদীনঃ- …….মুজাহিদীন বা ভারতীয় উগ্রপন্থী এক পরিভাষা। ভারত বিশেষতঃ গঙ্গার অববাহিকা অঞ্চল থেকে আগত উদ্বাস্তুদের কলোনিকেই বোঝানো হত। ঐ কলোনি গড়ে উঠেছিল সীমান্তের ‘ইউসুফজাই’ এলাকায় ১৮২৪ সালে – বেরেলীর সৈয়দ আহমদ শহীদের ব্যবস্থাপনায়।…….১৮৫৭র সিপাহী বিদ্রোহের সময় ভারতীয় উগ্রপন্থীরা সীমান্তের ওই এলাকায় সাধারণভাবে বিদ্রোহের আগুন ছড়িয়ে দেওয়ার একান্ত চেষ্টা করেছিল। ১৮৬৫ সালে ‘ওহাবী’দের বিরুদ্ধে যে মামলা নথিভুক্ত হয়, তার বিবরণ জানা যায়, উগ্রপন্থীরা ভারতস্থ নিজ ভাইদের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছিল।…….গত কয়েক বছরে ওদের দুষ্টামি করার ক্ষমতা বেশ হ্রাস পেয়েছিল। কিন্তু ১৯১৫ সালে ওদের তৎপরতা আবার বৃদ্ধি পায়।
উগ্রপন্থীদের সংখ্যা বিভিন্ন অনুমান অনুসারে ছয়শ’ থেকে দু’হাজার। ওদের মধ্যে চারশ’ লোক লড়াই করার উপযুক্ত। মুখ দিয়ে টোটা ভরা যায়, এরুপ বন্দুক ওদের কাছে আছে। তাছাড়া আধুনিক বন্দুকও ওরা রেখেছে। ওদের হেড কোয়ার্টার হল ইসমাস।…….ইসমাসের ভূতপূর্ব ফৌজি কামাণ্ডার মওলবী আব্দুল করীম এক শাখা-সংগঠনের আমীর। ইসমাসে একটা প্রেসও আছে। উদ্দেশ্য জিহাদের নির্দেশিকা, ঘোষণাবলী, বিদ্রোহমূলক প্রচার-পত্র ইত্যাদি মুদ্রিত করা। সীমান্তে সইফুর রহমান এবং অন্য লোকের তৎপরতার সঙ্গে উগ্রপন্থীদের যোগ রয়েছে। এ থেকে পরিস্কার বোঝা যায়, ভারতের কোন কোন মারাত্মক দল – যদিও ‘ওহাবী’ মতবাদের পূর্ণ অনুসারী নয় – ইচ্ছা করেই ভারতে এবং সীমান্ত এলাকায় সেই পুরাতন আন্দোলনকে ‘প্যান-ইসলামীযম’ এবং শত্রুতার বশবর্তী হয়ে আবার প্রাণবন্ত করে তুলেছে।
[তথ্যসূত্রঃ তাহরীকে শায়খুল হিন্দ (ব্রিটিশ গোয়েন্দা রিপোর্ট)]
ইণ্ডিয়া অফিস, লণ্ডনের সৌজন্যে ব্রিটিশ গোয়েন্দার পূর্ণ প্রতিবেদনের ফটোকপি পাওয়া গেছে। অনেক অজানা ও দুর্লভ তথ্য সেই প্রতিবেদনে রয়েছে। মাওলানা মুহাম্মাদ মিয়া সাহেদ সেই প্রতিবেদনকে একত্রিক করে সংকলন করেছেন এবং নাম দিয়েছেন ‘তাহরীকে শায়খুল হিন্দ’।
নবজাগরণ (ষাণ্মাসিক) – জীবনানন্দ ১২৫ তম জন্ম সংখ্যা – মননশীল সাহিত্য পত্রিকা




