লিখেছেনঃ চৌধুরী আতিকুর রহমান
সাম্প্রতিক ভারতবর্ষের ইতিহাস সম্বন্ধে প্রচলিত বইগুলো থেকে মনে হয় যে বাংলায় বহুকাল ধরেই ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা সংখ্যায় গরিষ্ঠ। কিন্তু অমলেন্দু দে ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত ‘রুটস অফ সেপারিটিজম ইন নাইনটিনথ সেঞ্চুরি বেঙ্গল’ গ্রন্থে এবিষয়ে বহু কৌতূহলোদ্দীপক তথ্য নিরেপেক্ষভাবে উদ্ঘাটন করেছেন।‘নোটস অন দ্য রেসেস, কাস্টস অ্যান্ড ট্রেডস অফ ইস্টার্ন বেঙ্গল’ প্রণেতা ডক্টর জেমস ওয়াইজের সাক্ষ্য থেকে তিনি দেখিয়েছেন –
‘previous to the eighteenth century the Hindu inhabitants of Bengal far exceeded the Muhammadan in numbers’ – অর্থাৎ – তখনও পর্যন্ত আধুনিক পদ্ধতিতে লোকগণনা শুরু হয়নি, তাই প্রকৃত সংখ্যা পাওয়া যায়নি। কিন্তু এই ব্যাপারটা বিশেষ অভিনিবেশ দাবি করে যে যখন ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের হাতে সত্যই অনেক শক্তি ছিল তখন ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা সংখ্যায় লঘু ছিলেন।
১৮৭১ খ্রীস্টাব্দেও দেখা গেছে, হিন্দু ধর্মাবলম্বীর সংখ্যা ১৮১ লক্ষ, পক্ষান্তরে ইসলাম ধর্মাবলম্বীর সংখ্যা ১৭৬ লক্ষ, অর্থাৎ দুই ধর্মাবলম্বীর মধ্যে জনসংখ্যার ব্যবধান অনেক কমে এসেছে। কুড়ি বছরের মধ্যে পরিস্থিতির উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন দেখা গেল -১৮৯১-এর লোকগণনার হিসাবে দেখা যায় যে হিন্দু ধর্মাবলম্বীর সংখ্যা যেখানে ১,৮০, ৬৮,৬৫৫ সেখানে ইসলাম ধর্মাবলম্বীর সংখ্যা বহুল পরিমাণে বর্ধিত হয়ে হয়েছে ১,৯৫,৯২,৩৪৯।এ প্রসঙ্গে অমলেন্দু দে ‘সেনসাস অফ ইন্ডিয়া ১৮৯১’ প্রণেতা সি.জে.ও ডোনেলের যে মন্তব্যের উদ্ধৃতি দিয়েছেন এখানেও সেটা উদ্ধৃত করার প্রলোভন সংবরণ করা অসম্ভব। ডোনেল সাহেব লিখেছেন –
The slight increase of Hindus between 1872 and 1881, amounting to only 1,41,135 persons or 0.8%, that of Musalmans being 7.1%, was a sufficiently noticeable fact, but from the foregoing figures it appears that nineteen years ago in Bengal proper, Hindus numbered nearly half a million more than Musalmans have not only overtaken the Hindus, but have surpassed them by a million and a half.’
এ প্রসঙ্গে আরও একটা ব্যাপার লক্ষণীয়, যে শ্রেণির থেকে অকস্মাৎ ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করল সেটা কোন্ শ্রেণি ? সম্ভ্রান্ত হিন্দু শ্রেণিকে যেমন মধ্যবিত্ত বা ভদ্রলোক শ্রেণি বলে তেমনই মুসলিম সম্ভ্রান্ত শ্রেণিকে বলে শরীফ বা আশরাফ। নিম্ন শ্রেণির মুসলমানদের বলে আজলাফ বা আতরাফ শ্রেণি। চাষাভুষো, জোলা, খলিফা (দর্জি), দপ্তরী, হাজাম, মাদারী, বেদে প্রভৃতি নানাধরনের বৃত্তিজীবীদের নিয়েই আতরাফ শ্রেণি গঠিত। যে ব্যাপারটা বিশেষ অনুধাবনযোগ্য সেটা হল মূলত আতরাফ শ্রেণির সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ।তথ্যসূত্রঃ ভারতবর্ষ ও ইসলাম, সুরজিৎ দাশগুপ্ত, (পৃ.৯২-৯৩)শঙ্কর প্রকাশন, ১৫/১-এ, যুগলকিশোর দাস লেন, কলিকাতা-৬সংযোজন : জাত্যভিমানী মুসলিমদের একাংশ নিজেদেরকে ‘আশরাফ’ ও নিম্ন পেশাজীবী মুসলিমদের ‘আতরাফ’ বোধ করলেও, ইসলামের শিক্ষা অনুসারে, মুসলিম সমাজে জাতপাত-বংশ তথা আশরাফ/আতরাফের কোনও ভিত্তি নেই বরং সকল মুসলিমই সমান মর্যাদার অধিকারী।এরপর, বিষয়টির সাথে সংশ্লিষ্ট যে দিকটির ওপর আলোকপাত করা দরকার, সেটি হলো, ১৮৭১ থেকে ১৮৯১-এর মধ্যে বঙ্গদেশে হিন্দু জনসংখ্যা এত কমে গেল এবং মুসলিম জনসংখ্যা হু হু করে বেড়ে গেল – এমনটা কেমন করে হলো ? এর নেপথ্য কারণ কী ? জন্মের হার বৃদ্ধি পাওয়ার কারণেই কি বাংলার মুসলিম জনসংখ্যা এত অল্প সময়ে এত বেশি বৃদ্ধি পেয়েছিল, আর হিন্দুরা দলেদলে এখান থেকে অন্য কোথাও চলে যাওয়ার কারণে কি তাঁদের সংখ্যা এত বেশি কমে গিয়েছিল !? তা তো হয় নি ! তাহলে ?১) মুসলিমদের হাতে তখন তরবারি নেই, বরং মুসলিমরা ইংরেজ শাসনে ছিল মজলুম, তাই তরবারি দিযে ইসলাম প্রচার তত্ত্বটি এখানে চলে না।২) অধিক সন্তান উৎপাদনের মাধ্যমে সংখ্যায় বেড়ে যাওয়ার তত্ত্বটি অচল। কারণ, সেইসময় বাঙালির সম্পদ অঢেল তাই হিন্দু-মুসলিম উভয়েরই অধিক সন্তান হত। একটি উদাহরণই যথেষ্ট বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ছিলেন প্রচুর ভাই-বোনের মধ্যে একজন। সেইসময় জীবনদায়ী ওষুধ কম পাওয়া যেত বলে গ্রামাঞ্চলে শিশুমৃত্যুর হার ছিল বেশি। রাজ্যপাট হারানোর ফলে শহরের শিক্ষিত মুসলিমরাও গ্রামের জমি-জায়গার উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে, গ্রামমুখি হয়ে পড়ে।৩) বাঙালি হিন্দুদের ভিনদেশে পাড়ি দেওযার ফলে তাদের সংখ্যা কমে যাওয়ার বিষয়টি ধোপে টেকে না, তাদের মধ্যে কালাপানি পার হওয়া ছিল ধর্মবিরোধী। প্রথম কালাপানি পার হওয়ার কুসংস্কারটি ভাঙেন রাজা রামমোহন রায় (যদিও তিনি ব্রাহ্ম ছিলেন)। তারও আগে মির্জা এহতেসামউদ্দিন ও দীন মহম্মদ বিদেশ যান, যাঁদের কালাপানি পার হওয়ার বাধা ছিল না।৪) ব্রিটিশ ক্ষমতায় এসেই লুঠপাটের দিকে মন দেয়, উদ্দেশ্য যতটা সম্ভব বাংলার সম্পদ ব্রিটেনে চালান দেওয়া। ১১৭৬ সনের মন্বন্তরে বাংলার এক তৃতীয়াংশ মানুষ মারা গেলেও সেইসময় ব্রিটিশ রাজস্ব আদায় করেছিল পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় বেশি। এরপর চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে ভূমির সঙ্গে সম্পর্কহীন কোলকাতা কেন্দ্রিক হঠাৎ বড়লোকরা জমিদার হয়ে বসে। এদের একমাত্র লক্ষ্য ছিল যেনতেন প্রকারে রাজস্ব আদায় ও ব্রিটেনের সন্তুষ্টি। এই সাঁড়াশি আক্রমণে সর্বাপেক্ষা ক্ষতিগ্রস্ত হয় হিন্দু-মুসলিম কৃষকেরা। এইসময় কমসেকম ডজনখানেক কৃষকবিদ্রোহ হয় যার অধিকংশেরই নেতৃত্বে ছিল মুসলিমরা। আসল কথা, উচ্চবর্ণের বৈষম্য আর হিন্দু জমিদারদের অত্যাচার থেকে বাঁচার জন্যে বাংলার গরিব শ্রেণির হিন্দু কৃষকরা দলেদলে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। [কারণ মুসলিম কৃষকরা জমিদার তথা ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতেন। রুখে দাঁড়াতেন।] তাই অখন্ড বাঙালিদের মধ্যে মুসলিমরাই এখনও সংখ্যাগরিষ্ঠ।[বর্তমানেও সেই ‘ট্রাডিশন’ কিছুটা চলছে। নিম্নবর্ণের মানুষ (দলিত)-দের ওপর উচ্চবর্ণের অত্যাচার আজও চালু আছে। চোখ রাখুন উত্তর ভারত তথা ‘গো-বলয়’এর দিকে।)]
চৌধুরী আতিকুর রহমানের আরও একটি প্রবন্ধ পড়ুন
রবীন্দ্র রচনায় শিক্ষা ও সমাজ ভাবনা