১৬১২ খ্রিস্টাব্দে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সর্বপ্রথম তাদের বাণিজ্য কুঠি খুলে সুরাটে। সূরাট সেই সময় ছিল ভারতের পশ্চিম তটের সর্ববৃহৎ বন্দর। প্রকৃতপক্ষে এটিই ছিল ভারতের সর্ববৃহৎ বন্দর। সুরাট বন্দরটি যথারীতি আওরঙ্গজেব তথা মুঘল সাম্রাজ্যের বহিঃ বাণিজ্যের বৃহত্তম কেন্দ্র ছিল।
১৬৬৩-১৬৬৪ খ্রিস্টাব্দে শায়েস্তা খাঁকে দাক্ষিণাত্যের সুবাদার পদ থেকে সরিয়ে শাহজাদা মোয়াজ্জামকে সুবাদার করে পাঠানো হয়। এই বদলির সুযোগ নিয়ে শিবাজী ৬ জানুয়ারি ১৬৬৪ প্রায় ৪০০০ অশ্বারোহী নিয়ে সুরাট আক্রমণ করেন। এই আক্রমণের উদ্দেশ্য দেশ দখল ছিল না বরং নীর্ভেজাল লুটপাট।
শিবাজী নরদুর্গ, মাহালি, কোয়াজ, রামনগর হয়ে সুরাটের উপর আপতিত হন। সেই সময় কল্যাণ- ভিওয়ান্দির মুঘল ফৌজদার শিবাজীর অগ্রগতি উপেক্ষা করেন। ফৌজদার তার গাফিলতি ধামা চাপা দেওয়ার জন্য, পর্তুগিজরাই শিবাজীকে সুরাট আক্রমণে সহায়তা দান করেছে এই অজুহাতে, মুম্বাইয়ের পর্তুগিজ অবস্থানে আক্রমণ করে।
শিবাজী ৪০০০ অশ্বারোহী সহ ১০০০০ ফৌজ নিয়ে সুরাট দখল করে নেন। অরক্ষিত সুরাট নগরীকে ফেলে রেখে ফৌজদার এনায়েত খান মাত্র ১০০০ রক্ষী নিয়ে শহর রক্ষা সম্ভব নয় দেখে দুর্গে আশ্রয় নেন। ইংরেজ ও ওলন্দাজ বণিকেরা নিজেদেরকে সুরক্ষায় আবদ্ধ করে নেন। শিবাজী ৬ থেকে ৯ জানুয়ারি তিনদিন সুরাটে অবস্থান করেন। প্রথমে তিনি সুরাটের বণিকদের সঙ্গে সম্পদ হস্তান্তর বিষয়ে আহ্বান করেন। কিন্তু সুরাটের বণিকেরা যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নেননি এই অজুহাতে ব্যাপক লুটপাট শুরু করেন। লুট করা হয়েছিল নগদ টাকা, সোনা, রুপা, হিরে, মুক্তো, রুবি, এমারেল্ড ইত্যাদি। লুট করা হয়েছিল বিরজি ভোরা, হাজি জাহিদ বেগ, হাজী কাশেম ইত্যাদি ব্যবসায়ীর গদি। মুঘল প্রশাসনিক এলাকায় আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। ঘরবাড়ি, ইমারত সহ নগরীর ২/৩ অংশ বহু সম্পদ সহ পুড়ে ছাই হয়ে যায়।
ইংরেজরা শিবাজীর বিশাল বাহিনীর সামনে অসহায় বোধ করলে নিজেদের ফ্যাক্টরির মধ্যে আবদ্ধ করে নেন। কিন্তু এন্টনি স্মিথ নামক এক সাধারণ কর্মচারী শিবাজীর বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে যায়। স্মিথের বর্ণনানুযায়ী যেসকল ব্যক্তি তাদের সম্পদের পরিমাণ কমিয়ে বলছিল, তাদের হাত-পা, মাথা কেটে নেওয়া হচ্ছিল। স্মিথকে অপারগ দেখে মারাঠারা ছেড়ে দিয়েছিল। বার্নিয়ের এই ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন,’শিবাজী মহান শিবাজী, কাপুচিনো রেভারেন্ড ফাদার এমব্রোজকে শ্রদ্ধা দেখিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। বলা হয়, ফরাসি পাদ্রীরা ভালো মানুষ, তাদের কেউ যেন না মারে। তা ছাড়াও দান-খয়রাত করে এবং করবে এই প্রতিশ্রুতি নিয়ে ডাচদের দেশীয় দালাল বা ব্রোকার মোহনদাস পারেখকে ছেড়ে দেওয়া হয়।’ বোঝাই যাচ্ছে, হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে সূরাটের সম্পদশালী ও ধনীদের লুটপাট করাই ছিল শিবাজির উদ্দেশ্য। ইউরোপীয়দের প্রতি তাঁর করুণা ঝরে পড়ার কারণ কি? বোঝা গেল না।
শিবাজী জীবনীকার পাগাড়ি সাহেব মারাঠি অস্মিতা প্রকাশ করে বলেছেন, ব্যাপক লুটপাটের পর ১০-ই জানুয়ারি প্রচুর ধনরত্ন নিয়ে শিবাজী দক্ষিণে চলে যান। আরও বলেছেন, মুঘল বাহিনী আরও সাত দিন পরে সুরাটে আসে। মুঘল বাহিনীকে দেখেই ফৌজদার কেল্লা থেকে বার হন। তবে সুরাটের নাগরিক তাঁকে বিদ্রূপ করে নোংরা ছুড়ে আপ্যায়ন করে। কিন্তু সংরক্ষিত নথি অনুযায়ী চারদিনের মাথায় মুঘল সৈন্য সুরাটে প্রবেশ করে এবং শিবাজী তাঁর বাহিনী নিয়ে দ্রুত দাক্ষিণাত্যে পালিয়ে যান(Galloped Southwards to Deccan)।
যদিও মুম্বাই দ্বীপটি ১৬৬১-৬২ নাগাদ যৌতুক হিসাবে ব্রিটিশ রাজ চার্লস পর্তুগীজদের নিকট থেকে পান। কিন্তু বিশেষ করে ওলন্দাজদের বাধা দানের ফলে মুম্বাই দ্বীপের দখল নিতে দেরি হয়ে যায়। স্যার জর্জ অক্সেনডেন ১৬৬৭ নাগাদ মৃুম্বাই দ্বীপের প্রথম গভর্নর নিযুক্ত হন। ভারতস্থ এই উচ্চপদস্থ ইংরেজ রাজকর্মচারীর ভাইপো স্যার হেনরি অক্সেনডেন শিবাজীর সঙ্গে ইংরেজদের সম্পর্ক অটুট ও আরও উত্তম করার জন্য নিযুক্ত হন। হেনরি সাহেব শিবাজীর রাজ্যভিষেকের (৬-ই জুন ১৬৭৪) সময়ও আমন্ত্রিত ছিলেন।
আওরঙ্গজেব এর চরম বিরোধী শিবাজীর বেশ কয়েকটি বিরোধিতা ও আক্রমণ তৎকালীন বর্ণনায় পাওয়া যায়। হেনরি অক্সেনডেনকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রেসিডেন্ট এবং কাউন্সিল দ্বারা নির্বাচিত হয়ে সুরাটে পাঠানো হয় শিবাজীর সঙ্গে ব্যবসা সংক্রান্ত সুবিধা আদায়ের জন্য। সমস্যাটি ছিল, আওরঙ্গজেব কে অসন্তুষ্ট না করে, যার হাতে পশ্চিমতটের বেশ কয়েকটি বন্দর রয়েছে সেই শিবাজীর সঙ্গে কিভাবে সমঝোতা করা যায়? অক্সেনডেন সফল হয়েছিলেন এবং ১২-ই জুন ১৬৭৪-এ শিবাজীর সঙ্গে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ব্যবসা সংক্রান্ত চুক্তি হয়। লন্ডনের ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরীতে এই চুক্তিপত্রটি সংরক্ষিত রয়েছে।
২২-শে মে রাজার আদেশে বিকেল তিনটের সময় পাঁচাড়া থেকে পাহাড়ে চড়া শুরু হল। আমরা রাহিরি (রায়গড়) দুর্গে পৌছালাম সূর্য ডোবার কিছুক্ষণ আগে। যতক্ষণ না কেউ বিশ্বাসঘাতকতা করছে ততক্ষণ দূর্গটি সুরক্ষিত, যত না রক্ষী দ্বারা তার থেকেও বেশি প্রকৃতি দ্বারা। দৈর্ঘে আড়াই মাইল ও প্রস্থে আধ মাইল। পাহাড়ের উপরে বেশ কয়েকটি শক্তপোক্ত অট্টালিকা রয়েছে যেখানে রাজার দরবার বসে, প্রায় ৩০০ জন মন্ত্রীর ঘরবাড়ি রয়েছে। তবে কোন গাছ পালা নেই, শস্যেরও চাষ নেই। রাজার বাড়ি থেকে আধ মাইল দূরে আমাদের থাকার ব্যবস্থা হল।
২৬-শে মে নারায়ণজি পণ্ডিতের মধ্যস্থতায় বহু ব্যস্ততা সত্বেও রাজার সঙ্গে সাক্ষাৎ হল। অভিষেক, বিবাহ, রাষ্ট্র পরিচালনা ইত্যাদি ব্যস্ততার মধ্যেও আমাদের হৃদতার সঙ্গে গ্রহণ করা হল। রাজা এবং তাঁর পুত্র শম্ভুজী রাজা আশ্বস্ত করলেন, তাঁদের অধিকারভুক্ত এলাকায় তাঁরা শান্তিতে ব্যবসা করতে পারেন। অক্সেনডেন বললেন, তাঁরাও তাই চান আর কোম্পানির কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট সেই উদ্দেশ্যেই আমাদের পাঠিয়েছেন। তবে হিন্দুস্তান এবং পারস্যে একটি চুক্তিপত্রে সাইন করা হয়েছে, সেভাবেই করা হোক। রাজা পেশোয়া মোরো পন্ডিতকে চুক্তিপত্রটি পড়ে তাঁকে জানাতে বললেন। যাবতীয় সই-সবুদ, আনুষ্ঠানিকতা রাজ্যভিষেকের পরেই হবে বলে জানানো হল। রাজা এবং তাঁর পুত্র নিজস্ব এলাকায় ফিরে গেলেন। সেখানে বেনিয়ানদের সঙ্গে অভিষেক ও অন্যান্য উৎসবের পরামর্শ বৈঠক করা হল। আমরাও আমাদের কক্ষে ফিরে গেলাম।
মে ২৮ নারায়নজি পণ্ডিতের সঙ্গে দেখা করে কাকে কি উপহার দিতে হবে সেই বিষয়ে খোঁজখবর নেওয়া হল। পন্ডিতজি বললেন, মোরো পন্ডিতের সঙ্গে নিজেই দেখা করতে হবে এবং একটি সূক্ষ্ম সুতি কাপড় পামেরিনের জায়গায় চারটি পামেরিন দিতে হবে। বাকি মন্ত্রীদের জন্য পামেরিনের ব্যবস্থা করে তা নারায়ন সিনয়ের মাধ্যমে দিলেও হবে। সেই অনুযায়ী, মোরো পন্ডিত ৪ টি পামেরিন, ওয়াকিয়ানবিশ দাদাজি পন্ডিত ১২৫ টাকা দামের একটি আংটি, দবির বা সচিব ৪ টি পামেরিন, সামজি নাইজি ৪টি পামেরিন, আবাজী পন্ডিত ৪ টি পামেরিন।
বর্ষা নামার আগেই এসবের ব্যবস্থা করা হল। বর্ষা নেমে গেলে রায়গড় (রাহিরি) দুর্গেই আটকে থাকতে হবে। নারায়নজি পন্ডিতের পুত্রকে সঙ্গে নিয়ে মোরো পন্ডিতের উপহারটি দেওয়া হল। তিনি অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে বললেন, রাজাকে চাপ দিয়ে সই করিয়ে নেবেন। নারায়ন সিনয়ের মাধ্যমে বাকি মন্ত্রীদের উপহার গুলি দেওয়া হল।
৩০ মে- রাজা (শিবাজী) চতুর্থ বিবাহ করলেন, আড়ম্বর ছাড়াই।
৯-১০ জুন- পর পর দু দিন নারায়নজি পণ্ডিতের কাছে দরবার করা হল, প্রবল বর্ষার আগে কাজটা যেন হয়ে যায়।
১১-ই জুন- নারায়ন জি খবর পাঠালেন চুক্তিপত্রের সমস্ত দাবি রাজা মেনে নিয়ে দস্তখত করে দিয়েছেন, এবার বাকি মন্ত্রীরা করে দেবেন।
১২-ই জুন- মন্ত্রীরা চুক্তি পত্রে দস্তখত করে দিয়েছেন, চুক্তিপত্রটি আনতে গেলাম। নারায়নজি বললেন, যখনই প্রয়োজন হবে তখনই ইংরেজরা যেন আসে এবং তাঁর তুতো ভাই চুক্তিপত্রটি অনুবাদ করতে পরিশ্রম করেছেন তাই তিনিও একটি পামেরিন পাওয়ার যোগ্য। নারায়নজির কাছ থেকে বিদায় নিলাম।
১৩-ই জুন-রাহিরি (রায়গড়) দুর্গ থেকে বিদায় নিলাম এবং ১৬ ই জুন হাতে শান্তি ও ব্যবসা চুক্তিটি হস্তান্তরিত করলাম।
যদিও এই ঐতিহাসিক দলিলে হেনরি সাহেবের শিবাজীর রাজ্যাভিষেকে উপস্থিত থাকার ঘটনাটি লেখা নেই। রায়গড় দুর্গে উপস্থিত থেকে অভিষেকে উপস্থিত না থাকাটাই বিচিত্র। তবে অন্য সূত্র থেকে উপস্থিতির বর্ণনা পাওয়া যায়। সমস্ত চুক্তিপত্রটিতে ব্যবসায়িক চুক্তি ছাড়াও শান্তি ও সহাবস্থানের কথারও উল্লেখ আছে। রাজ্যের মধ্যে রাজ্যের স্বীকৃতি আওরঙ্গজেব এর সার্বভৌমত্বের প্রতি একটি চ্যালেঞ্জ ছিল। ইংরেজরা ১০ বছরের মধ্যেই ভারত দখলের প্রথম প্রয়াস শুরু করে। তবে চূড়ান্তভাবে পরাজিত হয়ে আওরঙ্গজেব এর কাছে মাথা নত করে।
সামগ্রিকভাবে ইউরোপীয়রা চেয়েছিল দুর্বল কেন্দ্র। আওরঙ্গজেব এর ইহলোক ত্যাগের ৫০ বছর পরই ১৭৫৭ মাগাদ পলাশি প্রান্তরে ইউরোপীয় ইংরেজদের স্বপ্ন সফল হতে শুরু করে।
শিবাজীকে শায়েস্তা করতে গিয়ে মির্জা রাজা জয় সিংহ প্রথম যে কাজটি করেন তা হল শিবাজীর সহায়তাদানকারী পর্তুগিজ ও বিজাপুরের আদিল শাহিদের শিবাজী থেকে পৃথক করে দেওয়া। এরপরও শিয়া আদিল শাহীরা সরাসরি সাহায্য করতে থাকে। কিন্তু পর্তুগিজরা প্রকাশ্যে শিবাজীকে সাহায্যের কথা না বললেও গোপণে সাহায্য করতে থাকে। উত্তর কোঙ্কনের গভর্নরকে লেখা পর্তুগিজ একটি চিঠি,
“যদি ধরা পড়ে যাওয়ার ঝুঁকি না থাকে, তবে তবে অস্ত্রশস্ত্র এবং খাদ্য সম্ভার দিয়ে শিবাজীকে সাহায্য করতে পারেন, তবে টাকার বিনিময়ে। কারণ, যদি শিবাজী তার এলাকা থেকে বিতাড়িত হয় মুঘলরাই এলাকার সর্বেসর্বা হয়ে দাঁড়াবে।” (পাগাড়ি পৃ. ৪৯)
শায়েস্তা খাঁ-র সঙ্গে শিবাজীর বাহিনীর বারবার লড়াইয়ের ফলে আর্থিক সংকট দেখা দেয়। এই আর্থিক সংকট কাটাতেই শিবাজী সুরাট আক্রমণ করে লুটপাট করেন। শিবাজীর বর্বরতা আওরঙ্গজেব সহ্য করেননি। আওরঙ্গজেব কঠোর হস্তে শিবাজীকে দমন করার জন্য মির্জা রাজা সাওয়াই জয় সিংকে স্বাধীন অধিকার দেন।
তিনি কয়েকটি শক্তপোক্ত সামরিক স্পর্শকাতর এলাকায় ছাউনি তৈরি করেন। স্থানগুলি হল কল্যান, লোহাগড় ও পুনা। উদ্দেশ্য ছিল শিবাজী তার এলাকা থেকে বার না হতে পারে, এবং আক্রমণ করে তরবারি ও অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে শিবাজীর এলাকা বিধ্বস্ত করতে পারে, যাতে শিবাজীর আত্মসমর্পণ করা ছাড়া অন্য কোন উপায় না থাকে।
জয় সিং বাদশাহর কাছে লিখে দাবি জানালেন,
১) যুদ্ধযাত্রার ক্ষেত্রে একক নিয়ন্ত্রণ থাকবে।
২) সেনাবাহিনীর উপর প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ আওরঙ্গাবাদস্থিত শাহজাদা মোয়াজ্জেমের হাতে না রেখে তাঁর হাতে দিতে হবে।
৩) পরীন্দা ও আহমদনগরের মত দুর্গগুলির রাজকীয় সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ তাঁর হাতে রাখতে হবে।
৪) আওরঙ্গাবাদের রাজকীয় ট্রেজারি থেকে যথেচ্ছ অর্থ সংগ্রহ করার স্বাধীনতা দিতে হবে যাতে শিবাজীর লোকজনকে বশীভূত করা যায়।
তিনি কৌশলে আওরঙ্গজেব এর একটি পরামর্শ নাকচ করে দেন। বলেন, তালকোঙ্কনে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করলে শিবাজী এবং আদিল শাহ একত্রিত হবে। জয় সিং এর পরিকল্পনা অত্যন্ত কার্যকর ছিল। জয়সিং শিবাজীকে দিচ্ছি করতে চেয়ে ছিলেন। জওহার ও রামনগরের রাজা, জাওয়ালীর মোরেরা, বিজাপুরের মোল্লা আহমেদ, জঞ্জিরার সিদ্দিরা মারাঠা পক্ষ ত্যাগ করে জয় সিংএর পক্ষে চলে এলেন।
৩০ মার্চ ১৬৬৫ বন্দর দুর্গ অবরোধ করা হল। তিনি আগেই দিলির খানকে গোলন্দাজ বাহিনী নিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। জয় সিং পুনা থেকে ১৪-ই মার্চ পুরন্দর এর উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। পুনাতে এহতেসান খানের তত্ত্বাবধানে ৪ হাজার সৈন্য রাখা হল। মারাঠাদের প্রবল বাধা সত্ত্বেও পুরন্দর ও রুদ্রমালের মধ্যবর্তী অংশে মুঘলরা দৃঢ় অবস্থান নিল। নেতাজি পালকার লিখলেন,’ তারা হঠাৎ করে আক্রমন করত এবং রাত্রেও আক্রমন করত। রাস্তা অবরোধ করত এবং পাহাড়ি পাকদণ্ডী রাস্তাও অবরোধ করত। জঙ্গলে আগুন লাগিয়ে দিত। এসকল কারণেই ইসলামি বাহিনীর অবস্থা সঙ্গিন হয়ে পড়ল। সেনাবাহিনীর প্রচুর পশু মারা গেল।’
জয় সিং খান্দেশের ফৌজদার দাউদ খানের সেনাপতিত্বে ৭০০০ অশ্বারোহীর একটি চলমান বাহিনী (Flying Squad) তৈরি করলেন। অভিজ্ঞ অফিসার রাজা রাই সিং, অমর সিং চন্দ্রাওয়াত, মহম্মদ সালেহ, সারজা খান দাউদ খানকে সাহায্যের জন্য নিযুক্ত হলেন। মারাঠাদের বিরুদ্ধে এঁরা পোড়ামাটির নীতি নিয়েছিলেন,” দাউদ খান, রাজা রাইসিং ও অন্যান্য মুঘল অফিসাররা ২৭ এপ্রিল রোহিদা কেল্লার নিকট পৌঁছান। তাঁরা ৫০ গ্রামে আগুন লাগিয়ে দেন, যার মধ্যে চারটি ছিল পাহাড়ের উপরে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়। বেশ কয়েকজন অধিবাসীকে বন্দি করা হয়। পশু পাল এবং জিনিসপত্র কেড়ে নেওয়া হয়। ২-রা মে কোন্দানার নিকটবর্তী গ্রামগুলি বিধ্বস্ত করে দেওয়া হয়। কুতুবউদ্দিন খান কোনওয়াড়ি দুর্গের দিকে যাওয়ার সময় এলাকার গ্রামগুলিকে পুড়িয়ে দেন। ৫-ই মে লোহাগড় দুর্গের নিকটবর্তী জনবহুল গ্রামগুলিকে পুড়িয়ে দেন।
জয় সিং এর হাফ্ত আঞ্জুমান চিঠিপত্র থেকে জানা যায় মুঘলরা ১৪-ই এপ্রিল রুদ্রমাল দখল করে নেয়। পুরন্দরের নিম্নবর্তী কেল্লা অবরোধ করা হয়। মুঘলদের পরিখাগুলি কেল্লার উত্তর-পূর্বে খাদকালা মিনারের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে দমদমা (উঁচু বেদি) প্রস্তুত করে কামান প্রতিষ্ঠিত করা হয়। কেল্লার ভেতর থেকে বেদি গুলি ভাঙ্গার উদ্দেশ্যে গোলাগুলি চালানো হলেও সফলকাম হল না। কেল্লার পাঁচটি পর্যবেক্ষণ মিনার মুঘল ফৌজ দখল করে নিল। মারাঠারা কেল্লার আরও আভ্যন্তরীন বৃত্তে প্রবেশ করল।
১৬৬৫-র মে মাসের শেষদিকে মারাঠাবাহিনীর অবস্থা সঙ্গীন হয়ে উঠল। শিবাজী যখন দেখলেন যুদ্ধ আরও টেনে নিয়ে যাওয়া মানে তার দেশের বিপুল ক্ষতি তখন তিনি বেশ কয়েকটি চিঠি মারফত জয় সিংকে জানালেন যে তিনি বীজাপুর দখলে মুঘল বাহিনীকে সাহায্য করবেন। কিন্তু শিবাজীর অনুরোধ পত্রপাঠ নাকচ করে দিয়ে বলা হল সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ করতে হবে।
জয় সিং সম্রাটের নিকট পত্র লিখে পাঠালেন, “জিলহজ ৭, ১১-ই জুন ১৬৬৫, দিনের এক প্রহর পেরিয়ে গেছে, আমি যখন সভাসদদের নিয়ে সভা করছি, সেই সময় সংবাদ বাহক খবর নিয়ে এলেন শিবাজী কাছাকাছিই এসে গেছেন, সঙ্গে রয়েছেন ৬ ব্রাহ্মণ এবং কয়েকজন পালকিবাহক। আমি উদয়সেন মুন্সি ও উগ্রসেন কাছওয়াকে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের জন্যে পাঠালাম এবং বলতে বললাম যদি তিনি তাঁর সমস্ত দুর্গ সমর্পণ করতে রাজি হন তবে তিনি আসতে পারেন, নয়তো ফিরে যাওয়াই ভালো। খবরটি শুনে শিবাজী বলে পাঠালেন,’আমি এখন সাম্রাজ্যের সেবায় নিয়োজিত হয়েছি। আমার বহু কেল্লা সাম্রাজ্যের সেবায় লেগে যাবে।’ এই কথা বলে তিনি আমার লোকজনসহ পৌঁছালেন। আমি জানি বেগ বক্সী কে তাঁবুর দরজায় পাঠালাম তাকে আপ্যায়ন করে আনতে।”
প্রচুর টানাপোড়েনের পর একটি চুক্তিতে পৌছানো গেল। ১) রায়গড় এবং আরও ১১ টি কেল্লা শিবাজী নিজের হাতে রাখলেন, যাদের থেকে রাজস্ব আসত ৪ লাখ টাকা (১ লাখ হনস)। তবে শর্ত থাকল মুঘল সাম্রাজের আনুগত্যের এবং প্রয়োজনে সেবার।
২) বড়-ছোট মিলিয়ে বাকি কেল্লাগুলির ২৩ টি মুঘলদের হাতে হস্তান্তর করা হবে, যার থেকে প্রাপ্ত ১৬ লাখ (৪ লাখ হনস) টাকার সমস্ত রাজস্ব মুঘলরাই ভোগ করবে।
৩) শিবাজীর পুত্র সম্ভাজি ৫ হাজারি মনসব ভোগ করবেন।
৪) নিজের জন্যে শিবাজী বললেন, তাঁকে মনসবদারি ও সরকারের হয়ে যুদ্ধ থেকে রেহাই দেওয়া হোক। বরং দক্ষিণের কোন যুদ্ধের সময় আমাকে ডাকা হলে আমি তৎক্ষণাৎ হাজির হব।
৫) বিজাপুরের তালকোঙ্কন যার রাজস্ব ১৬ লাখ টাকা এবং বালাঘাটের কয়েকটি মহল যার রাজস্ব ২০ লাখ টাকা শিবাজীর কাছে রয়েছে। শিবাজী চান সরকার ফরমান দ্বারা তাঁর অধিকার স্বীকার করে নেন। যখনই বাদশাহ বিজাপুর দখলে অগ্রসর হবেন তখনই শিবাজী প্রতি বছর ৩ লাখ টাকা করে ৫০ লাখ টাকা দেবেন।
এই চুক্তিতে শিবাজী ২/৩ অংশ জমি হারান। এরপর আগ্রা দুর্গে সম্রাটের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে যান, দূর্ব্যবহারের ফলে বন্দি হন। অতঃপর মথুরার ব্রাহ্মণ জমিদারদের ষড়যন্ত্রে আগ্রা দুর্গ থেকে পলায়ন করেন। এরপর শিবাজী অপ্রতিরোধ্য হয়ে পড়েন।
তথ্যসূত্রঃ
- ১) মা’আশির ই আলমগীরী ( আলমগীর নামা/ আওরঙ্গজেব এর জীবনী)-সাকি মুস্তাঈদ খান- অনুবাদ স্যার যদুনাথ সরকার, এশিয়াটিক সোসাইটি।
- ২) শিবাজী- সেতুমাধবরাও এস পাগাড়ি
- ৩) ক্রুসেডের ইতিবৃত্ত- আশকার ইবনে শাইখ
- ৪) মা”আশির আল উমারা-এশিয়াটিক ডোসাইটি।
‘নবজাগরণ’ অ্যান্ড্রোয়েড অ্যাপ্লিকেশনটি প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর টেলিগ্রাম চ্যানেলে জয়েন হতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর ফেসবুক পেজে লাইক করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।