লিখেছেনঃ মুহাম্মাদ আব্দুল আলিম
ঠাকুরবাড়ী ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অত্যাচারী ও প্রজাপীড়ক ছিলেন। রবীন্দ্রনাথকে অনেকে দয়ার প্রতিমূর্তী মেনে নিলেও বাস্তবে তিনি হি্ংস্র, স্বৈরাচারী ও সামন্ততান্ত্রিক ছিলেন। অধ্যাপক অমিতাভ চৌধুরী লিখেছেন, “রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সামন্তবাদী প্রজাপীড়ক জমিদার ছিলেন। তাঁর দফায় দফায় খাজনা বৃদ্ধি এবং জোর-জবরদস্তি করে তা আদায়ের বিরুদ্ধে ইসমাইল মোল্যার নেতৃ্ত্বে শিলাইদহে বিদ্রোহ হয়েছিল।” (জমিদার রবীন্দ্রনাথ, দেশ ১৪৮২ শারদীয় সংখ্যা দ্রষ্টাব্য)
অন্নদাশঙ্কর রায় লিখেছেন, “রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রাইভেট সেক্রেটারি অমিয় চক্রবর্তী একবার্ বিশাল জমিদারির একটি ক্ষুদ্র অংশ দরিদ্র প্রজাসাদধারণের জন্য দান করার প্রস্তাব করেছিলেন। ঠাকুরমশাই ইজিচেয়ারে আধাশোয়া অবস্থা থেকে সোজা হয়ে বসে বলেছিলেন-‘বল কি হে অমিয়! আমার রথীন (কবির একমাত্র পুত্রের নাম) তাহলে খাবে কি’?” (দ্রষ্টাব্যঃ অন্নদাশঙ্কর রায়ের রচনা থেকে উদ্ধৃত পুস্তক-রবীন্দ্রনাথের রাজনৈ্তিক চিন্তাধারাঃ আবু জাফর, তথ্যসূত্র- এ এক অন্য ইতিহাস, বক্তাসম্রাট গোলাম আহমাদ মোর্তজা)
দেখুন এত বিশাল জামিদারী থাকতেও রবীন্দ্রনাথ তাঁর জমিদারী থেকে ক্ষুদ্র অংশও তাঁর প্রজাদেরকে দিতে রাজি ছিলেন না। তাঁর এই বিশাল জমিদারীর মালিক তাঁর একমাত্র পুত্র রথীন হবে জানা সত্যেও তার খাওয়ার কথা চিন্তা করেছেন রবীন্দ্রনাথ। অথচ তাঁর প্রজাদের না খেতে পেলেও চলবে।
অধাপক অরবিন্দ পোদ্দার লিখেছেন, “জমিদার জমিদারই। রাজস্ব আদায় ও বৃদ্ধি, প্রজা নির্যাতন ও যথেচ্ছ আচরণের যেসব অস্ত্র চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত জমিদার শ্রেণীর হাতে তুলে দিয়েছিল, ঠাকুর পরিবার তা সদ্ব্যবহারে কোন দ্বিধা করেনি। এমনকি জাতিয়তাবাদী হৃদয়াবেগ ঔপনিবেষিক ঋষি মন্ত্রের পুনরাবৃত্তি এবং হিন্দু মেলার উদাত্ত আহ্বানও জমিদার রবীন্দ্রনাথকে তাঁর শ্রেণীস্বার্থ থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি।” (রবীন্দ্রনাথ ও রাজনৈ্তিক গ্রন্থ)
সাহিত্যিক অন্নদাশঙ্কর রায় আরও লিখেছেন, “শান্তিনিকেতনে একটি চাকরী পেয়ে তাঁর সরকারী চাকরী ছেড়ে দেওয়ার ইচ্ছা ছিল কিন্তু রবীন্দ্রনাথ হলেন জমিদার মর্জির, ঠিক নেই, কখনো আবার চাকরী নষ্ট করে দিলে আবার খাবার অভাব হবে। রবীন্দ্রনাথ ইন্টলারেন্ট (অসহিষ্ণু) ছিলেন। যে মাষ্টার রবীন্দ্রনাথের কথার প্রতিবাদ করতেন তাঁর চাকরী থাকতো না । (তথ্যসূত্র- এ এক অন্য ইতিহাস, বক্তাসম্রাট গোলাম আহমাদ মোর্তজা)
অন্নদাশঙ্কর রায় আরও লিখেছেন, “জমিদার হিসাবে ঠাকুর পরিবার ছিল অত্যাচারী। গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন। বুট পরে প্রজাকে লাথি মেরেছেন, পায়ে দলেছেন দেবেন ঠাকুর (রবীন্দ্রনাথের পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর)। এটাই রেকর্ড করেছিল হরিনাথ মজুমদার। যিনি মহর্ষী বলে পরিচিত, তিনি এরকম ভাবে মানুষকে পদাঘাতে দলিত করেন! গ্রাম জ্বালাবার কথাও আছে। আবুল আহসান চৌধুরীর কাছে এর সমস্ত ডকুমেন্ট আছে। সমগ্র ঠাকুর পরিবার কখনো প্রজার কোনও উপকার করে নাই। স্কুল করে দীঘি কাটানো এসব কখনো করে নাই। মুসলমান প্রজাদের চিট্ করার জন্য নমঃশূদ্র প্রজা এনে বসতি স্থাপনের সাম্প্রদায়িক বুদ্ধি রবীন্দ্রনাথের মাথা থেকেই বের হয়েছি। কাঙাল মজুামদার তাঁর ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিকা’ পত্রিকায় ঠাকুর পরিবারের প্রজাপীড়নের কথা লিখে ঠাকুর পরিবারের বিরাগভাজন হয়েছিলেন।” (দৈনিক বাংলা বাজার, ১৪/৪/১৯৯৭ এবং ১/৫/১৯৯৭ সংখ্যা)
স্বামী বিবেকানন্দের কনিষ্ঠ ভ্রাতা ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত লিখেছেন, “রবীন্দ্রনাথ অত্যন্ত সামন্ততান্ত্রিক।” (দীপেন চট্টোপাধ্যায়ের ঐ বই, পৃষ্টা-৪)
মহর্ষী দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এতোগুলো ছেলে মেয়ের মধ্যে জমিদার হিসাবে তিনি নির্বাচন করলেন চোদ্দ নম্বর সন্তান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে। এও এক বিস্ময়। অত্যাচার, শোষণ, শাসন, চাবুক, চাতুরী, প্রতারণা কলাকৌশলে রবীন্দ্রনাথই কি যোগ্যতম ছিলেন তাঁর পিতার বিবেচনায় ? অনেকের মতে তাঁর পিতৃদেব ভুল করেন নি। (তথ্যসূত্র- এ এক অন্য ইতিহাস, বক্তাসম্রাট গোলাম আহমাদ মোর্তজা)
স্বপন বসু লিখেছেন, “জমিদারবাবুরা নতুন নতুন যেসব কর গরীব প্রজাদের কাছ হতে আদায় করতেন তা হৃদয় বিদারক। নানা নামের করগুলি ছিল অত্যন্ত অদ্ভুত । যেমন গ্ররুর গাড়ি করে মাল পাঠালে ধুলো উড়তো, তাই গাড়ির মালিককে যে কর দিতে হোত তার নাম ‘ধুলট’। প্রজা নিজেদের জায়গায় গাছ লাগালেও তাকে একটি কর দিতে হোত, তার নাম ‘চৌথ’। গরীব প্রজারা আখেড় গুড় তৈ্রী করলে যে কর লাগতো তা ‘ইক্ষুগাছ কর’। হতভাগ্য প্রজাদের গরু মোষ মরে গেলে ভাগাড়ে সেই মৃত পশু ফেলার পর যে কর লাগতো তা হোল ‘ভাগাড়ে কর’ নৌকোয় মাল উঠালে বা নামালে সে করের নাম ছিল ‘কয়ালী’। ঘাটে নৌকা ভিড়ালে একটি কর লাগতো তার নাম ‘খোটাগাড়িৌ কর’। জমিদারের সঙ্গে দেখা করতে হলে একরকমের কর দিয়ে সম্মান জানাতে হোত, তার নাম ‘নাজরানা’। জমিদার কোনও কারণে হাজতে গেলে তাঁকে ছাড়িয়ে আনতে প্রজাদের একটি কর দিতে হোত, তার নাম ‘গারদ সেলামি’ ইত্যাদি।” (গণ অসন্তোষ ও উনিশ শতকের বাঙালী সমাজ, পৃষ্টা-১৬৫)
যেহেতু মহর্ষী দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর রবীন্দ্রনাথকে জমিদার নির্বাচন করেছিলেন তার এইসব কর আদায় করতেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্বয়ং। তাই এই জমিদাররা সাধারণ প্রজাদের সন্ত্রাসের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন তাই রবীন্দ্রনাথ ছিলেন তাঁর যুগে প্রজাদের কাছে সব থেকে বড় সন্ত্রাসবাদী (Terrorist)।
ঠাকুর পরিবারের প্রতি কটাক্ষ করে হরিনাথ লিখেছেন, “ধর্মমন্দিরে ধর্মালোচনা আর বাহিরে আসিয়া মনুষ্য শরীরে পাদুকা প্রহার একথা আর গোপন করিতে পারিনা।” (অশোক চট্টোপাধ্যায়ঃ প্রাক্ ব্রিটিশ ভারতীয় সমাজ, পৃষ্টা-১২৭)
প্রজারা অতিষ্ঠ হয়ে ঠাকুরবাড়ির অত্যাচারের প্রতিশোধ নেবার বিক্ষিপ্ত চেষ্টা করলে তা ব্যর্থ হয়। ঠাকুরবাড়ি থেকে বৃটিশ সরকারকে জানানো হোল যে, একদল শিখ বা পাঞ্জাবী প্রহরী পাঠাবার ব্যাবস্থা করা হোক। মঞ্জুর করা হোল সঙ্গে সঙ্গে। সশস্ত্র শিখ প্রহরী দিয়ে ঠাকুরবাড়ি রক্ষা করা হোল আর কঠিনহাতে নির্মম পদ্ধতিতে বর্ধিত কর আদায় করাও সম্ভব হোল। ঠাকুরবাড়ির জন্য শ্রী অশোক চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘অথচ এরাও কৃষকদের উপর থার্ড ডিগ্রি (প্রচন্ড প্রহার) করতে পিছপা হননি, কর ভার চাপানোর প্রতিযোগিতায় শীর্ষস্থান অধিকার করেছেন, পরন্তু ভয় দেখিয়ে কর আদায়ের জন্য এবং বিদ্রোহীদের মোকাবেলার জন্য একদল শিখপ্রহরী নিযুক্ত করেছিলেন’।“ (প্রাক্ ব্রিটিশ ভারতীয় সমাজ, পৃষ্টা-১৩২)
স্বপন বসুও লিখেছেন, “সে সময়ে সাজাদপুরের অবস্থা সম্পূর্ণ শান্ত ও হিংসাত্মক ঘটনার অনুপস্থিতি থাকা সত্বেও জমিদারি রক্ষা করার জন্য কলকাতা থেকে সাজাদপুরে একদল পাঞ্জাবীকে সশস্ত্র পাহারাদারীর জন্য পাঠান দ্বিজেন্দ্রনাথ (ইনি কবির সহোদর ভাতা)। (গণ অসন্তোষ ও উনিশ শতকের বাঙালী সমাজ, পৃষ্টা-১৬৫)
‘বুর্জোয়া’ শব্দটি একরকমের গালি বললেও অত্যক্তু নয়। যার অর্থ কায়েমী স্বার্থবাদী বা স্বার্থপর ধনী। রবীন্দ্রনাথকেও যখন ‘বুর্জোয়া’ বলা হোল, তিনি কিন্তু তা মেনেই নিলেন। কারণ তিনি ছিলেন ধনী জমিদার। আর জমিদারেরা অধিকাংশই যে অত্যাচারী ও লুন্ঠনকারী তা অস্বীকার করা যায় না। দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন, “রবীন্দ্রনাথকে ‘বুর্জোয়া’ বলাটা অপবাদের শামিল নয় এবং এটা অনিবার্য ঐতিহাসিক ঘটনা।” (তথ্যসূত্র- এ এক অন্য ইতিহাস, বক্তাসম্রাট গোলাম আহমাদ মোর্তজা)