লিখেছেনঃ সুরজিৎ দাশগুপ্ত
২০১২ সালের জুলাই মাসে অসমের পশ্চিমপ্রান্তে অবস্থিত বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে এমন ধীর পদে অশান্তির জাগরণ ও আইনশৃঙ্খলার অবনতি শুরু হয় যে অসম সরকার তা শুরুতেই নিয়ন্ত্রণ করার প্রয়োজন বোধ করেনি। দিন দশেক পরে যখন পরিস্থিতি যথেষ্ট ঘোরালো হল তখন রাজ্য সরকার নিজের পুলিশবাহিনি দিয়ে হামলা দমন না করে কেন্দ্রের কাছে সেনাবাহিনী চেয়ে পাঠাল। প্রশ্ন থেকেই যায় যে, রাজ্য সরকারের কেন এত দেরিতে হুঁশ হল আর রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য কেন কেন্দ্রীয় সরকারের দারস্থ হতে হল? রাজ্যের পুলিশ কি এ কাজের অযোগ্য?
ঢিমেতালে যে আগুন জ্বলছিল তা দাবানলের রূপ নিল ২০ জুলাই। সেদিন সন্ধ্যায় অল বোড়ো ল্যান্ড মাইনরিটি স্টুডেন্টস ইউনিয়নের নেতা মোহিবুল ইসলাম এবং অল অসম মাইনরিটি স্টুডেন্টস ইউনিয়নের নেতা আবদুল সিদ্দিকির ওপর অজ্ঞাত পরিচয় দুষ্কৃতীরা গুলি চালায়। এই দুর্ভাগ্যজনক ঘটনার কয়েক ঘন্টার মধ্যে একদা জঙ্গি সংগঠন বোড়ো লিবারেশন টাইগার্স-এর ৪ সদস্যের ওপর গুলি চালায় কারা যেন। এইসব মৃত্যুর খবরেই বোধহয় গোটা জেলায় সারারাত দাপিয়ে বেড়ায় নিশাচরবাহিনী। উদ্বিগ্ন প্রধানমন্ত্রী আইনশৃঙ্খলা কঠোর হাতে ফিরিয়ে আনার এবং ত্রাণ ও পুনর্বাসনের দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য নির্দেশ দেন মুখ্যমন্ত্রীকে। দেখামাত্র গুলি চালানোর নির্দেশ জারি হল ২৪ জুলাই।
বোড়ো পিপলস ফ্রন্ট-এর নেতা হগরাম মোহিলরির বক্তব্য অনুসারে এখানকার বহুকালের বাসিন্দা সংখ্যালঘুরা পরিশ্রমী ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে বিশ্বাসী, কিন্তু বাংলাদেশিরা ধুবড়ি ও ওইরকম কয়েকটি স্থানে ব্রহ্মপুত্র পার হয়ে সহজেই কোকরাঝাড় প্রভৃতি অঞ্চলে ঢুকছে ও এখানকার সীমিত জমি দখল করছে। আবার স্থানীয় অধিবাসীদেরও কেউ কেউ বিভিন্ন কারণে জমি বিক্রি করছে বহিরাগতদের কাছে।।
ঘোলাজলে মাছ ধরাই যাদের কাজ তারা সমস্বরে রা তুলল যে বাংলাদেশিদের ‘অনুপ্রবেশের কারণেই এই অশান্তি।’ সৌভাগ্যবশত কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক এই সরলীকৃত ব্যাধি-নির্ণয়কে স্বীকার করেনি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিবিড় তদন্তের নির্দেশ দিয়ে দিল্লি ফিরে যান। হাঙ্গামাতে যে আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহৃত হয়েছে তার প্রমাণ পাওয়া গেছে মৃতদের দেহের ময়নাতদন্তে। কেউ কেউ বলছেন যে এই অস্ত্র এসেছে ব্ৰহ্মপুত্ৰ পেরিয়ে। কিন্তু শুধু নদী পেরিয়েই ওইসব অস্ত্রশস্ত্র এসেছে এমনটা বলা হয়নি। সামরিক ও আধাসামরিক বাহিনীর পক্ষ থেকে কেন্দ্রের কাছে পাঠানো রিপোর্ট, আরও নানা সূত্র থেকে আসা অস্ত্রশস্ত্র মজুত করা হচ্ছে বলে হুঁশিয়ারি জানানো হয়েছে কেন্দ্রকে।
আমার সংবাদ-সূত্র অনুসারে ঝগড়ার সূত্রপাত ৬ জুলাই ব্রহ্মপুত্র চরবাসী ও ডাঙাবাসীদের মধ্যে। নদীর চরে যারা বাস করে তাদের মধ্যে যেমন বাংলাদেশি আছে তেমনই ভারতীয়রাও আছে। দিল্লি, মুম্বাই, চেন্নাই, এমনকি কলকাতার মানুষরাও বুঝতে পারবে না যে নদীর চরে কত মানুষ বাস করে। উত্তর অসমের মাজুলি নামের চর তো একটা শহর, সেখানে হাসপাতাল, স্কুল-কলেজ, ব্যাঙ্ক, পোস্ট অফিস ইত্যাদি সব শহুরে পরিষেবা আছে। বর্ষার জন্য ব্রহ্মপুত্রের চরগুলো প্লাবিত হওয়ার ফলে চরবাসীরা স্বাভাবিকভাবেই ডাঙার জমি দখলে প্রবৃত্ত হল। হয়তো রাজ্য সরকারও এটাকে প্রাকৃতিক কারণ উদ্ভূত সাময়িক পরিস্থিতি বলে প্রথম দিকে মাথা ঘামায়নি।
বোড়ো টেরিটোরিয়াল এরিয়াজ কাউন্সিল গঠিতই হয়েছিল বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোর শাসনকার্যে রাজ্য সরকারকে সাহায্য করার জন্য। এই অঞ্চলে বহুকাল ধরে বোড়ো, রাজবংশী, নাথযুগী প্রভৃতি মানুষের বাস। ব্রিটিশ আমলে ছোটনাগপুরের অধিবাসীদেরও বিপুল সংখ্যায় নিয়ে আসা হয় এখানে প্রধানত চা বাগানের শ্রমিক হিসেবে কোকড়াঝাড়, ধুবড়ি, গোয়ালপাড়া, প্রমথেশ বড়ুয়ার দেশ গৌরীপুর এসব তো ছিল বাংলার অন্তর্গত। যেহেতু বোড় জনজাতিই এখানকার আদি ও বৃহত্তম জনবাসী তাই তাদের একাংশ স্বতন্ত্র রাজ্যের জন্য কয়েক বছর ধরে যে আন্দোলন চালাচ্ছে তা মাঝে মধ্যেই জঙ্গি রূপ নেয় এবং তাদের হাতে যে যথেষ্ট মারণাস্ত্র আছে এ বিষয়ে কেন্দ্র ও রাজ্য উভয় সরকারই সম্পূর্ণ অবহিত। বোড়ো টেরিটোরিয়াল এরিয়জ কাউন্সিল গঠন করে যে স্বতন্ত্র বোড়োল্যাণ্ডের দাবিকে বোড়োদের মন থেকে একেবারে মুছে ফেলা গেছে এমন মনে করার কোনও কারণ আছে কি?
যাহোক, ঘোলা জলের জেলেদের প্রসঙ্গে ফিরে আসা যাক। এই জেলেরা অনুপ্রবেশ’কে অশান্তির মূল কারণ বলে প্রচারকে ক্রমশ তীব্র থেকে তীব্রতর করে তুলতে লাগল। দশচক্রে যেমন ভগবান ভূত হয় তেমনই ওই প্রচারের চাপে অনেকেরই মনে হতে লাগল যে অনুপ্রবেশই অশান্তির কারণ। এই প্রচারের পেছনে একটা ছদ্মবেশী ধর্মীয় বিদ্বেষ আছে। ‘বাংলাদেশি’ বলা মানে বাংলাদেশের বাঙালি মুসলমান।
কার্যত অসমের সাম্প্রতিক শোচনীয় ঘটনাবলির দায় গিয়ে পড়ল নেই-নেই-গ্রস্ত ভাগ্যহীন মুসলমানদের ওপর যাদের প্রায় কারোরই জমি নেই, ছাদ নেই, ভাত নেই, জামা নেই। কিন্তু অনুপ্রবেশকারীদের বাস্তব অবস্থার দিকে কে তাকাবে? ঘোলাজলের জেলেদের অপপ্রচারের অভাবিত প্রতিক্রিয়া প্রথম দেখা গেল তিন হাজার মাইল সুদূর মুম্বাইয়ে। মহারাষ্ট্র সরকার প্রশংসনীয় দক্ষতার সঙ্গে উদ্ভূত অশান্তিকে নিয়ন্ত্রণে আনে। কিন্তু সেজন্য পুরস্কারের বদলে তিরস্কারই পান। অসমের মতো মহারাষ্ট্র আর একটি রাজ্য যেখানে অসহিষ্ণুতা ও সাম্প্রদায়িকতার হাওয়া প্রবল।
তবে ঘটনাচক্র সেখানেই থেমে থাকল না, ঘোলাজলের জেলেরা যেমন এপারে আছে তেমনই ওপারেও আছে। এবার ওপারের ঘোলাজলের জেলেদের ঘুম ভাঙল। ওরাও শুরু করল তাদের প্রচার হামলা। ওদের লক্ষ্য শারীরিক ক্ষতিসাধন নয়, মানসিক নির্যাতন। উত্তর-পূর্ব ভারতের যেসব তরুণ-তরুণী দক্ষিণ ভারতে আধুনিক শিক্ষা ও জীবিকার সন্ধানে গিয়েছিল তারা আতঙ্কিত হয়ে হাজারে হাজারে নিজের ঘরে ও পরিবারে পালিয়ে আসতে লাগল। একে ইংরেজিতে বলে একসোডাস, বাংলায় অভিনিষ্ক্রমণ।
৬ জুলাইয়ের স্ফুলিঙ্গ ১৫ আগস্টের মধ্যে অবিশ্বাস্য দাবানলে পরিণত হলে ১৭ আগস্ট সংসদের অভ্যন্তরে এক মহান ঘোষণা উচ্চারিত হল, ‘অসম, ভারত তোমার পাশে আছে।’ ভালো কথা। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুশীল সিন্ধে বললেন, যাঁরা গেছেন তারা আর ফিরবেন না, এখন করণীয় হল অতীতকে ভুলে এই সত্যে ব্রতী হওয়া যে, প্রত্যেক ভারতীয়ের অধিকার আছে ভারতের যেকোনও স্থানে বসবাস করার। কেন্দ্রে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুশীল সিন্ধে তো বললেন, কিন্তু একই কথা কি অসমের মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ গলা উঁচু করে বলবেন? অসমের কোনও মুখ্যমন্ত্রী কি কখনও এইরূপ সত্যব্রত পালনের ডাক দিয়েছেন? এটা কি অদ্ভুত ব্যাপার নয় যে, বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীর আমলেই অর্থাৎ একবিংশ শতাব্দীর বারো বছরেই এই রাজ্যের অধিবাসীদের মধ্যে জাতিতে জাতিতে এতগুলো দাঙ্গা হয়েছে? এগুলোর মধ্যে ২০০৩ সালে আগেকার উত্তর কাছাড় এখনকার ডিমা হাসাওতে জাতিদাঙ্গাতে একশোরও বেশি মানুষ প্রাণ হারায়, ২০০৪ এ কাৰ্বি-কুকি সংঘর্ষে মৃত্যু হয় ১০৮ জনের, পরের বছরেই কার্বি- ডিমাসা সংঘর্ষে ৯০ জন মারা যায় এবং এভাবে গত বারো বছরে প্রায় ৪৫০ জনের মৃত্যু হয়েছে।
যেহেতু আইন-শৃঙ্খলার ব্যাপার রাজ্যের অভ্যন্তরীণ বিষয় তাই এসব খবর অসমের বাইরে প্রকাশ পায় না। তবে যখন অসমিয়ারা বিহারি শ্রমিকদের ওপর হামলা করে তখন তাদের আত্মীয়স্বজন নিজেদের অঞ্চলে অসমগামী ট্রেন থামিয়ে অসমিয়াদের ওপর বদলা নেয় এবং তখন তা জাতীয় সংবাদ হয়ে ওঠে। আবার ২০০৮ সালে বোড়োদের হাতে বাঙালি মুসলমান নিহত হলে তাকে বাংলাদেশিদের অনুপ্রবেশের স্বাভাবিক পরিণাম বলে সাফাই দেওয়া হয়।
সিন্ধেজি সংসদে অতীতকে ভুলে গিয়ে ভারতের সর্বত্র ভারতীয় মাত্রের বসবাসের সমান অধিকার ঘোষণা করলেও সেই বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে অসমিয়া রাজনৈতিক নেতৃত্ব ‘অসম শুধু অসমিয়াদের’ হুংকার তুলে যে উত্তেজনায় অসমিয়াদের দীক্ষিত করেছিল তার আবেগ থেকে কি আজকের অসমবাসীরা সম্পূর্ণ মুক্ত? এটা তো ঘটনা যে, ১৯৩১-এর আদমশুমারিতে ব্রহ্মপুত্র ও বরাক দুটি উপত্যকায় মিলে বাংলাভাষীর সংখ্যা প্রায় ৩৯ লক্ষ আর অসমিয়াভাষীর সংখ্যা প্রায় ২১ লক্ষ ছিল। যুদ্ধের জন্য ১৯৪১-এ জনগণনা হয়নি। তারপর ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা ও দেশভাগ হলে বরাক উপত্যকার অনেকটাই পূর্ব-পাকিস্তানে চলে যাওয়ার ফলে ১৯৫১-র আদমশুমারিতে দেখা গেল বাংলাভাষীর সংখ্যা কমে হয়েছে প্রায় ১৭ লক্ষ আর অসমিয়াভাষীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৯ লক্ষ। সেনসাস রিপোর্টের অষ্টম ভাগের সম্পাদক এটাকে শুধু ‘বায়োলজিক্যাল মিরাকল’ বলেই ক্ষান্ত হননি, সেই সঙ্গে মন্তব্য করেছেন যে, অসমের ভাষাভিত্তিক উগ্র জাতীয়তাবাদ প্রতিফলিত হয়েছে এই হিসেবে। পরের জনগণনার বছর ১৯৬১- তে বরাক উপত্যকার বাংলাভাষীরা বাংলাকে তৃতীয় একটি সরকারি ভাষার জন্য স্বীকৃতি চেয়ে পেয়েছে বন্দুকের গুলি, শহিদ হয়েছে এগারোজন, অতঃপর মিলেছে প্রার্থিত স্বীকৃতি। আবার অশান্তি বেধেছে পরবর্তী জনগণনার বছরে। অসমিয়াই হবে শিক্ষার একমাত্র মাধ্যম এই ফরমানের প্রতিবাদ করতে গিয়ে ১৯৭২ সালে শহিদ হলেন আর একজন বাংলাভাষী। তিন বছর পরে ক্ষমতায় এল অসম গণপরিষদ। নতুন সরকার, কিন্তু পুরোনো ভাষাবিদ্বেষ। আরও দুজন ভাষা শহিদ হলেন ১৯৮৬ সালে।
অপরের ভাষার প্রতি অসহিষ্ণুতা, অপরের ধর্মের প্রতি অসহিষ্ণুতা তথা অপরের প্রতি অসহিষ্ণুতা কি অসমের ইতিহাসে বার বার প্রকাশ পায়নি? উত্তর-পূর্ব ভারতের প্রধান রাজ্য অসমে অন্যায় অসহিষ্ণুতা ও নিন্দনীয় হিংসার প্রকাশ ঘটল বলেই তো বৈদ্যুতিন বার্তার তথা সাইবার মাধ্যমে দক্ষিণ ও পশ্চিম ভারতে প্রবাসী উত্তর-পূর্ব ভারতীয়দের মধ্যে বদলার আতঙ্ক ছড়ানো ও অভিনিষ্ক্রমণের প্ররোচনা জোগানো সম্ভব হল। বদলাটা কীসের? বদলাটা কেন? আসলে তো সেটা অসমের একাংশে ঘটে অসহিষ্ণুতা ও হিংসার বদলা। সেটা না ঘটলে বা ঘটার সঙ্গে সঙ্গে সরকারি সক্রিয়তার সুফল দেখা গেলে তো কেউ সাইবার কাণ্ডটা ঘটাত না, ঘটাবার সুযোগই পেত না। সাইবার মাধ্যম এখন অপরাধীদের একটা নতুন অস্ত্র, অবশ্যই তার সুরক্ষা চাই।
কিন্তু যে মানসিকতা থেকে অসমে বার বার বিদ্বেষ ও হিংসার অর্থাৎ এক প্রকার সাম্প্রদায়িকতার প্রকাশ ঘটছে তারও আমূল পরিবর্তন চাই। নেতাদের জেলায় জেলায় গ্রামে গ্রামে ঘুরে ঘুরে সম্প্রীতির বার্তা প্রচার করতে হবে, সব ভারতীয়র অসমে আসবার, থাকবার, রোজগার করবার অধিকার আছে।
সবাই ভারতীয়, জনজাতিরাও ভারতীয়, একই ভারতের অধিবাসী, তবে জনজাতিদের জন্য কিছু স্বতন্ত্র ব্যবস্থা আছে, তবু আমাদের এক দেশ, আমরা এক জাতি। অভারতীয়দের চিহ্নিত করতে হবে অসহিষ্ণুতার হুজুগে নয়, একান্তভাবে আইনানুগ পদ্ধতিতে।