লিখেছেনঃ অনিলচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়
বিংশ শতাব্দীর বাঙালি মনীষীদের মধ্যে আচার্য যদুনাথ সরকার সরকার অন্যতম প্রধান স্মরণীয় পুরুষ। দীর্ঘ ছয় দশক তিনি ভারতীয় ইতিহাসের মন্দিরে নিরলস সাধক ছিলেন। আধুনিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে ইতিহাসের মৌলিক গবেষণার ক্ষেত্রে তিনিই আমাদের দেশে পথিকৃৎ।
উনবিংশ শতাব্দীতে বঙ্গভূমি রত্নপ্রসবিনী ছিল। ১৮৭০ সালে (১০ ডিসেম্বর) আচার্য যদুনাথ সরকার বর্তমানে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত রাজশাহী জেলার করচমারিয়া গ্রামে এক সমৃদ্ধ কায়স্থবংশে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা রাজকুমার সরকার ১৮৫৭ সালে স্থাপিত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এনট্রানস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে বহরমপুর কলেজে এফ. এ. (ফাস্ট আর্টস) ক্লাসে ভর্তি হয়ে ছিলেন, কিন্তু পারিবারিক কারণে তাঁকে পড়া বন্ধ করে পৈতৃক জমিদারি দেখাশোনার কাজে আত্মনিয়ােগ করতে হয়। তিনি স্বাধীনচেতা দৃঢ়চরিত্র ব্যক্তি ছিলেন। ইংরেজি সাহিত্যে এবং ইতিহাসে তাঁর বিশেষ অনুরাগ ছিল। উত্তরাধিকারসূত্রে আচার্য যদুনাথ সরকার তাঁর এই দুটি গুণের অধিকারী হয়েছিলেন।
আচার্য যদুনাথ সরকার কৈশােরে শিক্ষালাভ করেছিলেন রাজসাহী কলেজিয়েট স্কুলে এবং কলকাতার হেয়ার স্কুলে আর সিটি কলেজিয়েট স্কুলে। ১৮৮৭ সালে তিনি রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুল থেকে এনট্রানস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং সরকারি বৃত্তি লাভ করেন। ১৮৮৯ সালে তিনি অসুস্থ অবস্থায় পরীক্ষা দিয়ে রাজসাহী কলেজ থেকে এফ. এ. পাশ করেন। তারপর তিনি কলকাতায় এসে প্রেসিডেনসি কলেজে ভরতি হন। থাকতেন ইডেন হিন্দু হােসটেলে। বি. এ. ক্লাসে আচার্য যদুনাথ সরকার ইংরেজি এবং ইতিহাস—এই দুটি বিষয়ে ‘অনারস’ নিয়েছিলেন। (সেকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ী একাধিক বিষয়ে ‘অনারস’ নেওয়া যেত এবং মেধাবী ছাত্রেরা এই নিয়মের সুযােগ গ্রহণ করতেন)।
প্রেসিডেনসি কলেজে যাঁদের কাছে আচার্য যদুনাথ সরকার ইংরেজি সাহিত্য পড়েছেন তাদের মধ্যে ছিলেন টনি, রাে এবং কলকাতায় ইংরেজি সাহিত্য অধ্যাপনার ক্ষেত্রে প্রবাদপুর পারসিভ্যাল। ১৮৯১ সালে তিনি দুই বিষয়ে ‘অনারস’ সহ বিশেষ কৃতিত্বের সঙ্গে বি. এ. পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং মাসিক পঞ্চাশ টাকা বৃত্তি লাভ করেন। তারপর তিনি প্রেসিডেনসি কলেজে ইংরেজি সাহিত্যে এম. এ. পড়েন এবং ১৮৯২ সালে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করে ওই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। (তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর শিক্ষাদানের ব্যবস্থা ছিল না, নির্বাচিত কয়েকটি কলেজে এম. এ. পড়ানাে হত। এম, এ. পড়ার সময় ছিল এক বৎসর)। এম. এ. পরীক্ষায় তিনি যত নম্বর পেয়েছিলেন তত নম্বর তার পরে—সম্ভবত তার পরেও—আর কোনাে পরীক্ষার্থী পান নি।
বিভিন্ন পরীক্ষায় অসামান্য কৃতিত্ব প্রদর্শনের জন্য আচার্য যদুনাথ সরকারকে ইংলন্ডে উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য সরকারি বৃত্তি দেওয়ার প্রস্তাব এসেছিল, কিন্তু তিনি সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে অধ্যাপনা এবং গবেষণায় আত্মনিয়ােগ করলেন। ১৮৯৩ সালে তিনি কলকাতায় রিপন কলেজে (বর্তমান নাম সুরেন্দ্রনাথ কলেজ) ইংরাজি সাহিত্যের অধ্যাপক নিযুক্ত হন। প্রায় তিন বৎসর সেখানে কাজ করার পরে তিনি কলকাতায় মেট্রোপলিটন ইনসটিটিউশনে (বর্তমান নাম বিদ্যাসাগর কলেজ) ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপকরপে যােগদান করেন। ১৮৯৮ সাল পর্যন্ত তিনি এই কলেজে কাজ করেন। ইতিমধ্যে ১৮৯৭ সালে তিনি প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ বৃত্তি লাভ করেন। ১৮৯৮ সালে তিনি সরকারি চাকুরি গ্রহণ করেন এবং এক বৎসর (১৮৯৮-৯৯) প্রেসিডেনসি কলেজে কাজ করার পর পাটনা কলেজে বদলি হন। (বাঙলা, বিহার এবং উড়িষ্যা তখন একটি প্রদেশরুপে সংগঠিত ছিল)। পরে ১৯০১ সালে কয়েক মাসের জন্য তিনি প্রেসিডেনসি কলেজে ফিরে এসেছিলেন। ১৯০২ সালে তিনি ফিরে গেলেন পাটনা কলেজে। ১৯১৭ সাল পর্যন্ত তিনি এখানে কাজ করেন। তারপর সরকারি চাকুরি থেকে ছুটি নিয়ে তিনি বারাণসী হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে যােগ দিলেন ইতিহাস বিভাগের অধ্যক্ষরপে। সেখানকার পরিবেশ তাঁর ভালো লাগল না, তাই ১৯১৯ সালে তিনি সরকারি চাকুরিতে ফিরে এলেন। ইতিমধ্যে ১৯১৮ সালে বিহার সরকারের উদ্যোগে ভারত সরকার তাঁকে ইনডিয়ান এডুকেশন্যাল সারভিসে উন্নীত করেছিলেন। বারাণসী থেকে প্রত্যাবর্তনের পর তিনি কটক রেভেনশ কলেজে যােগ দিলেন। ১৯২৩ সালে তাঁকে আবার পাটনা কলেজে বদলি করা হল। ১৯২৬ সালে তিনি সরকারি চাকুরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন।
আচার্য যদুনাথ সরকারের অধ্যাপকজীবনের অবসান ঘটেছিল প্রায় ষাট বছর আগে। যাঁরা তার ক্লাসে পড়বার সুযোগ পেয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে অনেকেই জীবিত নেই। কিন্তু তিনি যে বিভিন্ন বিষয়ের শিক্ষকরপে যথেষ্ট সাফল্য লাভ করেছিলেন তার কিছু প্রমাণ আছে। প্রেসিডেনসি কলেজে তিনি পড়াতেন ইংরেজি সাহিত্য। পাটনা কলেজে তিনি প্রথমে ইংরেজি সাহিত্য ও ইতিহাস, পরে শুধু ইতিহাস পড়াতেন। বােধহয় তিনি কিছুদিন অর্থনীতিও পড়িয়েছিলেন বিংশ শতাব্দীর গােড়ার দিকে —তখন অর্থনীতি ইতিহাসের অন্তর্ভুক্ত ছিল, পথিক পাঠ্যবিষয়রপে গৃহীত হয় নি। ১৯০৯ সালে তার ‘ব্রিটিশ ভারতের অর্থনীতি’ (‘ইকনমিকস অব ব্রিটিশ ইনডিয়া’) বইটি প্রকাশিত হয়েছিল। প্রধানত ছাত্রদের জন্য লেখা হলেও বইটি নিপুণভাবে সন্নিবদ্ধ বহু তথ্যের সমাবেশে সমৃদ্ধ হয়েছিল। আচার্য যদুনাথ সরকার ব্রিটিশ সরকারের অর্থনীতির সমালােচনা করেছিলেন। বহু কলেজের ছাত্র বইটির নানা অংশ মুখস্থ করে আবৃত্তি করত তাদের সহপাঠীদের মধ্যে দেশাত্মবােধ জাগাবার জন্য। কটক কলেজে আচার্য যদুনাথ সরকার প্রধানত ইতিহাস পড়াতেন, ইংরেজি সাহিত্যও পড়াতেন, আবার বাঙলা সাহিত্যও পড়াতেন। প্রেসিডেনসি কলেজে তার ছাত্র ছিলেন হরেন্দ্রকুমার মুখােপাধ্যায়। পাটনা কলেজে তার ছাত্র ছিলেন বিধানচন্দ্র রায়। অন্নদাশঙ্কর রায় তাঁর ছাত্র ছিলেন কটক কলেজে এবং পাটনা কলেজে।
স্বভাবত গভীর হলেও আচার্য যদুনাথ সরকার ছাত্রদের দূরে সরিয়ে রাখতেন না। তাদের ফুটবল খেলায় তিনি রেফারির কাজ করতেন। কটক থেকে একদল ছাত্র রাজগীর গিয়েছিল বেড়াতে। তাদের অধিনায়ক ছিলেন আচার্য যদুনাথ সরকার। তাঁর বয়স তখন পঞ্চাশ অতিক্রম করেছে। পাটনা কলেজ থেকে অবসরগ্রহণের দিন তিনি বৈকাল ৪টা পর্যন্ত ক্লাস নিয়ে বিদায়-অভিনন্দনসভায় গিয়েছিলেন।
সরকারি চাকুরি থেকে অবসর গ্রহণের আগেই বাঙলার গভরনর লর্ড লিটন তাঁকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিযুক্ত করেছিলেন। তার আগে কোনাে শিক্ষক উপাচার্য নিযুক্ত হন নি। (সম্ভবত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ভারতীয় উপাচার্য গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায় কিছুদিন বহরমপুরে অধ্যাপক ছিলেন)।
সেকালে উপাচার্যের কার্যকাল ছিল দুই বৎসর। আচার্য যদুনাথ সরকার ১৯২৬ সালের অগস্ট মাস থেকে ১৯২৮ সালের আগস্ট মাস পর্যন্ত উপাচার্য ছিলেন। সরকার তাঁকে আরও দুই বৎসরের জন্য পুননিয়ােগ করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তিনি স্বাস্থ্যের অজুহাতে সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। তখন উপাচার্যের পদ অবৈতনিক ছিল। আংশিক সময়ের কাজের জন্য নিযুক্ত হলেও যদনাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য প্রচুর সময় ব্যয় করতেন, এবং প্রচুর পরিশ্রম করতেন।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে আচার্য যদুনাথ সরকারের অভিজ্ঞতা প্রীতিপ্রদ হয় নি, আন্তরিক চেষ্টা সত্ত্বেও তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনাে উল্লেখযােগ্য উন্নতি করতে পারেন নি। এই পরিস্থিতির জন্য তার নিজের কিছু দায়িত্ব ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়কে সম্পূর্ণ নতুন রূপ দিয়েছিলেন স্যার অশুতােষ মুখােপাধ্যায়। আচার্য যদুনাথ সরকার পাটনায় থাকতেন; বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে তার কোনাে প্রত্যক্ষ সংযােগ ছিল না, সম্ভবত বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরিক ব্যাপার সম্বন্ধে তাঁর সঠিক ধারণা ছিল না। কিন্তু তিনি স্যার আশতােষের অনেক কাজের তীব্র সমালােচনা করে ‘মডারন রিভিউ’ পত্রিকায় কয়েকটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন ১৯১৭ সাল থেকে ১৯২৫ সালের মধ্যে। মডারন রিভিউ পত্রিকার সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় (আচার্য যদুনাথ সরকারের বিশিষ্ট বন্ধু) নিজেও বিশ্ববিদ্যালয়ের কঠোর সমালােচক ছিলেন। স্যার আশুতােষের মত্যুর পর বিশ্ববিদ্যালয় কার্যত নেতৃবিহীন হয়ে পড়েছিল। লর্ড লিটন এবং তার মন্ত্রীরা স্যার আশুতােষের প্রবর্তিত স্নাতকোত্তর শিক্ষাব্যবস্থা সম্বন্ধে অনুকুল মত পোষণ করতেন না। ভালাে ভালো কলেজে এম. এ. পড়ানাের প্রাচীন ব্যবস্থা বাতিল করে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে দাতকোত্তর শিক্ষার পর্ণ দায়িত্ব গ্রহণ করা অর্থের অপব্যয় মাত্র—এটাই তারা মনে করতেন। স্যার আশুতােষের কঠোর সমালােচক আচার্য যদুনাথ সরকারকে উপাচার্য নিযুক্ত করার এটাই সম্ভবত প্রধান কারণ।
বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে আচার্য যদুনাথ সরকার এক অস্বস্তিকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হলেন। সাধারণভাবে বলা যায়, সিনেট আর সিনডিকেটের সভ্যেরা এবং অধ্যাপকেরা তার সঙ্গে সহযােগিতা করলেন না। কিন্তু তাদের সহযােগিতা ছাড়া উপাচার্যের পক্ষে দৈনন্দিন কাজের বাইরে কোনাে গঠনমুলক কাজ করার সুযােগ ছিল না। তা ছাড়া, ভালাে কাজের জন্য অর্থের প্রয়ােজন, কিন্তু স্নাতকোত্তর শিক্ষার ব্যয়ভারে ভারাক্রান্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের আয় ছিল সীমিত। কোনােরকমে দুটি বৎসর কাটিয়ে আচার্য যদুনাথ সরকার স্বারভাঙ্গা ভবন থেকে বিদায় নিলেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব থেকে মুক্তি নিয়ে আচার্য যদুনাথ সরকার ফিরে গেলেন তাঁর সুপরিচিত গবেষণার ক্ষেত্রে। তিনি যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাপারে জড়িত হয়ে পড়তেন তবে ভারতীয় ইতিহাসচর্চা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হত, বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনাে বিশেষ উপকার হত না। তিনি একা, সম্পূর্ণ নিজের মত অনুসারে, কাজ করতে অভ্যস্ত ছিলেন। সম্ভবত এটা তাঁর মানসিক গঠনের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য। কোনাে সংগঠনের মধ্যে থেকে, অনেক রকম মানুষের সঙ্গে সহযােগিতা করে কাজ করা তিনি পছন্দ করতেন না। এটা তাঁর বারাণসী হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে আসার প্রধান কারণ। ১৯১৯ সালে তিনি ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজকর্মের সমালােচনা করে ‘মডারন রিভিউ’ পত্রিকায় দুটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন।
কলকাতার জলবায়ু যদুনাথ সরকারের সহ্য হত না। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিদায় নেবার পর ১৩ বৎসর তিনি বাস করেছিলেন দার্জিলিঙে, কেবল শীতের সময় কলকাতায় নেমে আসতেন। তার নিজস্ব বিপুল লাইব্রেরির অধিকাংশ বই, পাণ্ডুলিপি, মানচিত্র ইত্যাদি দার্জিলিঙে থাকত। সেখানে স্বার্থান্বেষীদের কোলাহল থেকে দুরে, শীতল শান্ত পরিবেশে, তিনি গবেষণার কাজ করতেন। বয়সবৃদ্ধির ফলে ক্রমে দাজিলিঙের উচ্চতা তার স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর হল। তাই ১৯৪১ সাল থেকে তিনি সেখানে যাওয়া বন্ধ করে কলকাতার স্থায়ী বাসিন্দা হলেন। কলকাতায় তিনি নানা অঞ্চলে ভাড়া বাড়িতে থাকতেন (১২/১ ডাফ স্ট্রীট, ১৮-বি মােহনলাল সীট, ৩৬/৮ সাহিত্য পরিষদ স্ট্রীট, ৯ বাদুড়বাগান রাে, ৭ ডি রামমােহন সাহা লেন, পি ১৬১ সাউদার্ন অ্যাভেনিউ, পি ৬২ ল্যানসডাউন রােড একসটেনশন)। পরে তিনি নিজে বাড়ি তৈরি করে সেখানে উঠে যান (পি ২৫৫ ল্যানসডাউন রােড একসটেনশন—বর্তমানে ১০ লেক টেরেস )। কিছুকাল আগে ভারত সরকারের আনুকল্যে এখানে একটি গবেষণা-প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়েছে, কিন্তু তার সঙ্গে আচার্য যদুনাথ সরকারের নাম সংযুক্ত হয় নি।
আচার্য যদুনাথ সরকার কয়েক বৎসর অবিভক্ত বাঙলার বিধানসভায় সরকার-মনােনীত সদস্য ছিলেন। ১৯৩২ সালে তিনি পদত্যাগ করেন।
পরিণত বয়সে আচার্য যদুনাথ সরকারকে গভীর শােক সহ্য করতে এবং কঠিন পারিবারিক দায়িত্ব বহন করতে হয়েছিল। ১৯৪৭ সালে তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র কলকাতায় দাঙ্গাবাজ মুসলমানদের ছুরিকাঘাতে নিহত হন। এই ঘটনার পরে তিনি এক চিঠিতে লিখেছিলেন,
“আমার বাড়িতে এখন দুই বিধবা কন্যা এবং এক বিধবা পুত্রবধু রয়েছে। যদি আমি আরও অন্তত দশ বৎসর না বাঁচি তবে দুই নাবালক পৌত্র এবং তিন নাবালক দৌহিত্রের শিক্ষার ব্যবস্থা এবং সাতটি নাবালিকা দৌহিত্রীর বিবাহের ব্যবস্থা কিভাবে করব?”
১৯৫৫ সালে তাঁর দ্বিতীয় পত্র দীর্ঘকাল রােগভােগের পর ইহলােক ত্যাগ করেন। এই নিদারুণ পারিবারিক দুর্যোগ আচার্য যদুনাথ সরকারের ইতিহাস সাধনায় ব্যাঘাত জন্মাতে পারে নি। দুষ্টান্তস্বরপ বলা যায়, তার “মােগল সাম্রাজ্যের পতন” (‘ফল অব দি মুঘল এম্পায়ার’) নামক বিরাট গ্রন্ধের চতুর্থ খণ্ড প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৫০ সালে, এবং ভারতের সামরিক ইতিহাস সম্বন্ধে ২৮টি মহামূল্যবান প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল ‘হিন্দুস্থান স্ট্যানডার্ড’ পত্রিকায় ১৯৫২-৫৫ সালে।
আচার্য যদুনাথ সরকার পরলােকগমন করেন ১৯৫৮ সালে (১৯ মে)।
[২]
আচার্য যদুনাথ সরকারের অন্তরঙ্গ সহৃদ ছিলেন মহারাষ্ট্রের সর্বশ্রেষ্ঠ ঐতিহাসিক গােবিন্দ সখারাম সরদেশাই। তাঁদের প্রথম সাক্ষাৎ ঘটেছিল ১৯০৪ সালে। তারপর অর্ধশতাব্দীকাল তারা পরস্পরের সঙ্গে পত্রবিনিময় করতেন, বহর। তাঁদের মধ্যে সাক্ষাৎ তথা ভাববিনিময় হয়েছে, তাঁরা ইতিহাসের উপকরণ সংগ্রহের জন্য বহুবার একসঙ্গে ভারতের নানাস্থানে বিশেষত পশ্চিম ও দক্ষিণ ভারতে ভ্রমণ করেছেন। বরােদা সরকারের চাকুরি থেকে অবসরগ্রহণ করে সরদেশাই বর্তমান শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকের শেষ দিকে পুনা শহর থেকে ২৯ মাইল দরে কামসেত নামক গ্রামে স্থায়িভাবে বাস করতে থাকেন। এই গ্রামটি মহারাষ্ট্রের ঐতিহ্যের সঙ্গে সংযুক্ত ইন্দ্রায়নী নদীর তীরে অবস্থিত। ওই নদীর তীরে দুটি বিভিন্ন প্রান্তে, সন্ত জ্ঞানেশ্বর এবং সন্ত তুকারামের আশ্রম অবস্থিত ছিল। খীষ্টপূর্ব প্রথম ও দ্বিতীয় শতাব্দীতে খােদিত অপব বৌদ্ধ ভাস্কর্যের নিদর্শন রয়েছে ইন্দ্রায়নীর তীরবর্তী কারলায়। আচার্য যদুনাথ সরকার অনেক বার কামসেত গিয়েছেন এবং সেখানে বা তার পার্শ্ববর্তী তালেগাঁওতে থেকেছেন সরদেশাইর সঙ্গলাভ এবং তার সঙ্গে মারাঠা ইতিহাসের নানাবিধ সমস্যা আলােচনার জন্য। এই অঞ্চলের জলবায়ু তিনি খুব পছন্দ করতেন।
বােম্বাই-পানা রােডে অবস্থিত লােনাভেলা নামক ছােটো শহরে একটি ঐতিহাসিক গবেষণাকেন্দ্র স্থাপনের জন্য তিনি আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন।
আচার্য যদুনাথ সরকার এবং সরদেশাই পরস্পরকে শত শত চিঠি লিখেছিলেন। তাদের মধ্য থেকে বাছাই-করা বহু চিঠি ১৯৫৭ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। (লাইফ অ্যান্ড লেটারস অব স্যার আচার্য যদুনাথ সরকার সরকার, সম্পাদক হরিরাম গন্ত, প্রকাশক পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়, হােসিয়ারপর, ১৯৫৭)। এই চিঠিগলিতে ব্যক্তিগত কথা খুবই কম। প্রায় সব চিঠির বিষয়বস্তু ঐতিহাসিক সমস্যা সম্বন্ধে প্রণােত্তর বা মতবিনিময়। একজন আর-একজনের ভুল দেখাচ্ছেন এবং সংশােধনের জন্য নির্দেশ দিচ্ছেন। তথ্যের ব্যাখ্যা সম্বন্ধেও কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে দুজনের মধ্যে মৌলিক মতবিরােধ ছিল, যেমন শিবাজীর রাজনৈতিক আদর্শ এবং মারাঠাদের হিন্দু পাদশাহি স্থাপনের প্রয়াস। আচার্য যদুনাথ সরকার যুক্তিভিত্তিক সমালােচনা প্রসন্নচিত্তে গ্রহণ করতেন। ১৯৪৩ সালে তিনি সরদেশাইকে লিখেছিলেন :
My sole interest is the discovery of truth from unassailable sources, and I am not so vain as to feel hurt it any statement in a book of mine is contradicted by later discovered (or published) sources. For, unless such continual supersession is welcomed, progress in human knowledge would be impossible.
১৯৩৭ সালে সরদেশাইকে লেখা আচার্য যদুনাথ সরকারের এক চিঠিতে দেখা যায়, তিনি কিভাবে মনের জানালা খুলে রাখতেন। তখন ‘মােগল সাম্রাজ্যের পতন’ গ্রন্থের তৃতীয় খণ্ড ছাপা হচ্ছে, ছয় ফরমা ছাপা হয়ে গেছে। এই সময় আচার্য যদুনাথ সরকার ব্রিটিশ মিউজিয়াম থেকে ফারসি কাগজপত্রের নকল (১৬০০ পৃষ্ঠা) পেয়ে দেখলেন, তিনি যা লিখেছেন তার প্রচুর সংশোধন দরকার। ছয়টি অধ্যায়ের মধ্যে দুটি নতুন করে লেখা হল, চার মাসের কঠোর পরিশ্রম ব্যর্থ হল।
আচার্য যদুনাথ সরকারের গবেষণাপদ্ধতি ঠিকমত বুঝতে হলে এই চিঠিগুলি খুব ভালাে করে পড়তে হবে। তাঁর পাণ্ডিত্য, সত্যান্বেষণে নিষ্ঠা, পরিশ্রম করার শক্তি এবং আগ্রহ প্রভৃতি গণ এই চিঠিগলিতে সুস্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। মাঝে-মাঝে সাধারণ মানবিক গুণের প্রকাশ তাঁর আপাতকঠোর চরিত্রের উপর নতুন আলাে বিচ্ছুরিত করে। ১৯৩৭ সালে তিনি সরদেশাইকে লিখেছিলেন :
Kamshet may be a quiet asrama but dreadfully lonely, and you require mental relaxation, suitable conversation or the frolics of children to cheer your last days in this Vale of Tears.
আচার্য যদুনাথ সরকার যে শিশুদের হাসিমুখ পছন্দ করতেন তার প্রমাণ এই দুই বয়ােবৃদ্ধ এবং জ্ঞানবৃদ্ধ ঐতিহাসিকের চিঠিতে পাওয়া যায়। ১৯৩২ সালে আচার্য যদুনাথ সরকার লিখেছিলেন,
My little grandson, aged 10 months… dotes on me, and therefore has hitherto taken much of my daytime!!!
যাঁরা আচার্য যদুনাথ সরকারের সংস্পর্শে এসেছেন তাদের পক্ষে দশ-মাস-বয়স্ক পৌত্রের সঙ্গে ক্রীড়ারত ঐতিহাসিকের ছবি কল্পনা করাও অসম্ভব। সরদেশাই অন্য প্রসঙ্গে লিখেছেন, ভবভূতির সেই বিখ্যাত মন্তব্য—বজ্রদপি কঠোরণি মদনি কুসুমাদপি/লােকোত্তরনাং চেতাংসি’, আচার্য যদুনাথ সরকার সম্বন্ধে প্রযােজ্য।
সরদেশাই প্রধানত মারাঠি ভাষায় লিখতেন, ইংরেজি ভাষার উপর তাঁর দখল তেমন ছিল না। এই দুর্বলতা সম্বন্ধে সচেতন হয়ে ১৯৪৩ সালে—৭৭ বৎসর বয়সে তিনি ইংরেজি ভাষা থেকে উপযুক্ত শব্দচয়নের পদ্ধতি সম্বন্ধে আচার্য যদুনাথ সরকারের উপদেশ চেয়েছিলেন। আচার্য যদুনাথ সরকার লিখলেন :
In fact, the surest means of acquiring a good style is (1) to read aloud the best English prose-avoiding ornate and involved authors, such as Dr. Johnson and Macaulay.–for half an hour every morning, (2) to avoid trashy authors, except when it is necessary to pick facts out of them, and (3) to pause and revise frequently in the course of our writing. This is the method that has borne most fruit with me, besides certain advantages that I had in my college.
…I compress as much as I can, and hence I have the time to revise and polish my words, or rather as I meditate before writing, the words flow well chosen out of my pen…
…the elements of a good prose style include not merely the choice of apt phrases, but also the judicious and most effective marshalling of the facts, the order of development of the parts of the theme or proposition you intend to prove, and the proper proportion in the length of the different parts. The true difficulty is to decide what to omit and what to keep, because we cannot give every facts: some must go out, probably many. “The half is better than the whole”, is a Greek adage, which Macaulay admires.
ইংরেজি সাহিত্যের দিগ্বিজয়ী ছাত্র এবং কৃতী অধ্যাপক আচার্য যদুনাথ সরকার বিদেশী ভাষায় স্বদেশের ইতিহাস রচনার জন্য কত পরিশ্রম আর চিন্তা (মেডিটেট ) করতেন সেটা ভাবলে বিস্মিত হতে হয়। তার বিপলকায় দুটি গ্রন্থে (‘হিস্টরি অব আওরঙ্গজেব’ এবং ‘ফল অব দি মঘল এম্পায়ার’) মােগল স্থাপত্যের বিশালতা এবং দক্ষিণ ভারতের ইতিহাসখ্যাত মন্দিরগুলির গাম্ভীর্য আছে, কিন্তু চোখধাঁধানাে কারুকার্য নেই। আচার্য যদুনাথ সরকার ইতিহাস রচনা করেছেন সুদক্ষ স্থপতির দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। বাহুল্য বর্জন করে, যতটুকু ঘটনাপ্রবাহকে স্বচ্ছ গতি দেবার জন্য দরকার ঠিক ততটুকুই তিনি দিয়েছেন; বিপুল পরিশ্রমে সংগৃহীত তথ্যপূঞ্জের ভারে তিনি পাঠককে বিভ্রান্ত করেন নি। বিভিন্ন অঞ্চলের বিভিন্ন ধরনের ঘটনা বিভিন্ন খাতে প্রবাহিত হয়েছে; কিন্তু সমগ্র ভারতের ইতিহাসের মূল ধারা থেকে তারা কখনও বিচ্ছিন্ন হয় নি। অলংকারবিহীন ভাষা পার্বত্য ঝরনার জলের মতো স্বচ্ছ; তার প্রবাহ ক্ষণকালের জন্যও প্রস্তর- খণ্ডে বাধা পায় না, তার মৃদু দীপ্তি মনকে আলােকিত করে।
১৯৩৭ সালে আচার্য যদুনাথ সরকার ইংরেজ ঐতিহাসিক ফিশার- এর সদ্য প্রকাশিত ‘হিস্টরি অব ইউরােপ’ বইটি সরদেশাইকে জন্মদিনের উপহার দিয়েছিলেন। ইতিহাস রচনায় ইংলন্ডে মেকলে এবং স্টাবস-এর যুগ তখন – অতীত হয়েছে, ফিশার এবং ট্রেভেলিয়ন-এর যুগ শুরু হয়েছে। যে যুগে মেকলের রচনাশৈলী সর্বত্র সমাদৃত হত সেই যুগের ছাত্র আচার্য যদুনাথ সরকার ইংরেজি ভাষার নবরপগ্রহণ সম্বন্ধে সম্পূর্ণ সচেতন ছিলেন।
ইংরেজি ভাষার ব্যবহারে আচার্য যদুনাথ সরকার যে সংযমের পরিচয় দিয়েছেন সেটা তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের প্রতিফলন। প্রাত্যহিক জীবনযাত্রায় তিনি কঠোরভাবে সংযমী ছিলেন। কঠোর পরিশ্রম ছিল তার মূলমন্ত্র। তিনি বলেছেন, ইউরােপ নানা দিকে এগিয়ে চলেছে,
This is the result of an army of her best intellects carrying on to higher and higher stages the gains of her predecessors by working without cessation, without a break.
ইউরােপের মনীষীদের এই দৃষ্টান্ত আচার্য যদুনাথ সরকার, অনুসরণ করতেন। ১৯৫৬ সালে, ৮৫ বৎসর বয়সে, তিনি সরদেশাইকে লিখেছিলেন :
I too share your disgust at having to pass my old age in indolence, unable to work, while the brain is still fit.
ভারতের সামরিক ইতিহাস সম্বন্ধে এই অবসরাত পণ্ডিতের ১২টি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৫৫ সালে! যিনি অক্লান্ত পরিশ্রমে জ্ঞানের সাধনায় নিজেকে নিযুক্ত রাখতে বদ্ধপরিকর তাঁর পক্ষে সাধারণ বাঙালি ভদ্রলােকের মতাে ঢিলেঢালা জীবনযাপন সম্ভব হয় না। কর্মের প্রেরণা যুদনাথকে অসামাজিক করে রেখেছিল। তার সঙ্গে কেউ সাক্ষাৎ করতে গেলে তিনি তিন মিনিটের বেশি সময় দিতেন না, অনেককে তার আগেই বিদায় করতেন তার কোনাে প্রশ্ন থাকলে তার উত্তর দিয়ে। অনেক সময় দরজায় দাঁড়িয়েই কথা বলতেন, যিনি এসেছেন তাকে বসতে বলতেন না। আচার্য রমেশচন্দ্র মজুমদার আমাকে বলেছিলেন, তাঁর সঙ্গে আচার্য যদুনাথ সরকারের প্রায় অর্ধশতাব্দীর পরিচয়, কিন্তু আচার্য যদুনাথ সরকার কখনও তাকে চা দেন নি। আড্ডা দেওয়া বাঙালির সামাজিক ঐতিহ্যের অঙ্গ। আচার্য যদুনাথ সরকারকে এই ঐতিহ্য স্পর্শ করতে পারে নি। অপরাহ্নে তিনি বেড়াতে যেতেন, তখনও তিনি কোনাে সঙ্গীর সাহচর্য পছন্দ করতেন না। কোনাে প্রিয় শিষ্যের কাছ থেকেও তিনি কোনাে রকম উপহার—যেমন, একঝুড়ি আম—গ্রহণ করতেন না।
আচার্য যদুনাথ সরকার মিতব্যয়ী ছিলেন। পরিবারের প্রয়ােজন মেটাতে তিনি আবশ্যকীয় অর্থ ব্যয় করতেন, কিন্তু নিজের নূনতম স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য তিনি অর্থ ব্যয় করতে অনিচ্ছুক ছিলেন। তাঁর ঘনিষ্ঠ শিষ্য ড. কালিকারঞ্জন কানুনগো বলেছেন, যে ক্ষুর তিনি ১৮ বৎসর ব্যবহার করেছেন সেটি পরিত্যাগ করে একটি নতুন ক্ষুর কিনতে তাকে রাজি করানাে যায় নি। শুনেছি, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য থাকার সময় তিনি ট্রামে কর্মস্থলে যাতায়াত করতেন। ভারতের বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণের সময় তিনি ট্রেনে সেকালের মধ্যম শ্রেণীতে (ইনটার ক্লাস) যেতেন, প্রথম বা দ্বিতীয় শ্রেণীতে যেতেন না। কিন্তু এই আপাত-কৃপণ মানুষটির বাড়িতে—কটকে এবং পাটনায়—কয়েকজন ছাত্র বৎসরের পর বৎসর বিনা ব্যয়ে বাস করত। বহু সহস্র টাকা খরচ করে তিনি বিপুল লাইব্রেরি গড়ে তুলেছিলেন; তাতে বই এবং মানচিত্র ছাড়া দেশবিদেশের নানা স্থান থেকে সংগৃহীত ফারসি পুঁথি ছিল। এ ব্যাপারে তিনি মুক্তহস্ত ছিলেন।
খ্যাতি-প্রতিপত্তির লােভ কখনও আচার্য যদুনাথ সরকারকে আকৃষ্ট করতে পারে নি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিযুক্ত হয়ে তিনি সরদেশাইকে লিখলেন:
I shall have to bid good bye to historical research (during the two years of my term as V.C.) instead of being able to devote all my time, as a pensioner, to my literary work.
উপাচার্যরপে কার্যকাল সমাপ্তির সঙ্গে-সঙ্গে। তিনি সরদেশাইকে লিখলেন :
Hurrah ! I am a free man again, and feel cheerful like a bird escaped from its cage.
১৯২৯ সালে আচার্য যদুনাথ সরকারকে ‘স্যার’ উপাধি দেওয়া হয়। সন্ধ্যা ছয়টার সময় সরকারি উরদি-পরা এক ব্যক্তি তাঁর হাতে একটি সরকারি খাম দিল। তখন তিনি তার বাড়ির সামনে পায়চারি করছিলেন। তিনি খামটি ছিঁড়ে ভেতরকার চিঠিটি পড়লেন, তারপর নীরবে পায়চারি করতে লাগলেন। বাড়ির মধ্যে মহিলারা ব্যাপারটা লক্ষ করেছিলেন। সরকারি লােক কী বার্তা নিয়ে এসেছে তা জানবার জন্য তারা স্বভাবতই খুব উৎসক ছিলেন; কিন্তু আচার্য যদুনাথ সরকার বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করেও কিছু বললেন না, তাঁরাও তাকে জিজ্ঞাসা করতে সাহস করলেন না। রাত্রিতে খাবার সময় আচার্য যদুনাথ সরকারের স্ত্রী তাঁকে বললেন:
“শুনছি তুমি নাকি কী একটা হয়েছ। এটা কি ঠিক?” তিনি উত্তর দিলেন : “ঠিকই শুনেছ। আজ থেকে লােকে তােমাকে লেডি সরকার বলবে।”
১৯৩৯ সালে আচার্য যদুনাথ সরকারের জন্মদিন উপলক্ষে তাকে অভ্যর্থনা জানানাের ব্যবস্থা হয়েছিল। এই ব্যবস্থাকে ‘সরকারের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া’ (‘সরকার ফিউন্যারেল’) বলে বর্ণনা করে তিনি সরদেশাইকে এক চিঠি লিখেছিলেন।
১৯১৯ সালে ভারতসরকার ইতিহাসসংক্রান্ত কাগজপত্র সংগ্রহ করা এবং নতুন তথ্য উদ্ধার করার জন্য। ‘ইনডিয়ান হিস্টরিক্যাল রেকডস কমিশন’ গঠন করেন। কয়েকজন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারি এবং কয়েকজন সরকার-কতৃক মনােনীত বেসরকারি ঐতিহাসিক কমিশনের সদস্য হতেন। আচার্য যদুনাথ সরকার ১৯১৯ সাল থেকে ১৯৪১ সাল পর্যন্ত কমিশনের সদস্য ছিলেন। তিনি কয়েকবার কমিশনের অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেছিলেন। তাঁর বহ, মূল্যবান প্রবন্ধ কমিশনের বিভিন্ন অধিবেশনে পঠিত হয়েছিল। ১৯৪১ সালে কমিশন পুনর্গঠিত হয়, কিন্তু আচার্য যদুনাথ সরকারকে সদস্য হিসাবে মনােনীত করা হয় না। তখন ড. সুরেন্দ্রনাথ সেন কমিশনের কর্মসচিব, স্যার জন সারজেনট ভারত সরকারের শিক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা এবং নলিনীরঞ্জন সরকার বড়লাটের একসিকিউটিভ কাউনসিলে শিক্ষাবিভাগের ভারপ্রাপ্ত সদস্য। সুরেন্দ্রনাথ সেন স্যার আশুতোষ মুখােপাধ্যায়ের একান্ত অনরাগী এবং তার কাজের তীব্র সমালােচক যদুনাথের প্রতি বিরুপ ছিলেন। মহারাষ্ট্রে একদল ঐতিহাসিক আচার্য যদুনাথ সরকার। এবং সরদেশাইর বিরােধী ছিলেন। তাদের মধ্যে প্রধান ছিলেন দত্ত বামন পােতদার। তার সঙ্গে সুরেন্দ্রনাথ সেনের সৌহার্দ্য ছিল। সরদেশাই ১৯৪১ সালে আচার্য যদুনাথ সরকারকে লেখা এক চিঠিতে বলেছিলেন, সেন এবং পােতদারের কারসাজিতে আচার্য যদুনাথ সরকারকে কমিশনের বাইরে রাখার ব্যবস্থা হয়েছিল। আচার্য যদুনাথ সরকারের যেসব চিঠি প্রকাশিত হয়েছে তাতে এ বিষয়ের কোনাে উল্লেখ নেই।
পােতদারের উদ্যোগে ভারতীয় ইতিহাস কংগ্রেসের প্রথম অধিবেশন হয়েছিল পুনাতে, ১৯৩৫ সালে। এখানে কেবলমাত্র আধুনিক যুগের ইতিহাস সম্বন্ধে আলােচনা হয়েছিল। সভাপতি ছিলেন এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসের প্রধান অধ্যাপক ড. সাফতে আহম্মদ খাঁ। তাঁর উদ্যোগে ১৯৩৮ সালে এলাহাবাদে কংগ্রেসের দ্বিতীয় অধিবেশন হয়েছিল। এখানে প্রাচীন যুগ, মধ্য যুগ এবং আধুনিক যুগের ইতিহাস সম্বন্ধে আলােচনার রীতি প্রতিত হয়েছিল। আচার্য যদুনাথ সরকার এবং সরদেশাই এই অধিবেশনে, বা কংগ্রেসের পরবর্তী কোনাে অধিবেশনে, যােগদান করেন নি। বারবার অনুরােধ করা সত্ত্বেও আচার্য যদুনাথ সরকার কংগ্রেসের সভাপতির পদ গ্রহণ করতে সম্মত হন নি। তিনি বলতেন, ‘এটা একটা বিরাট তামাসা’।
১৯৩৮ সালে সরদেশাই এলাহাবাদের ব্যবস্থা সম্বন্ধে আচার্য যদুনাথ সরকারকে যা লিখেছিলেন তাতেই আচার্য যদুনাথ সরকারের এই মন্তব্যের কারণ সস্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
I think our object is essentially different from that of Allahabad. Paper reading, speech making and other advertising items are their mainstay : while we here will have quiet heart to heart talks, consultations and deliberations, throughout night and day as we sit together and devote practically all our time to the subject’.
ঢাক-ঢােল বাজিয়ে, গভরনর বা রাষ্ট্রপতির দ্বারা সভার উদ্বোধন করিয়ে, শত শত সভ্যের সমাবেশে প্রকৃত গবেষণার পক্ষে সহায়ক কোনাে কাজ হতে পারে, এটা আচার্য যদুনাথ সরকার বিশ্বাস করতেন না।
[৩]
আচার্য যদুনাথ সরকারের ইতিহাস-সাধনা সম্বন্ধে দুটি প্রাথমিক প্রশ্ন সহজেই মনে আসে। প্রথমত তিনি এম. এ. পরীক্ষার জন্য ইতিহাসের পরিবর্তে ইংরেজি বেছে নিয়েছিলেন। তবে ঠিক এম. এ. পরীক্ষার পরেই প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ বৃত্তি সংক্রান্ত গবেষণার জন্য ইতিহাস নির্বাচন করলেন কেন?
দ্বিতীয়ত, প্রাচীন ভারতের ইতিহাস বাদ দিয়ে তিনি মধ্যযুগের ইতিহাস, বিশেষত আওরঙ্গজেবের মতাে হিন্দু বিদ্বেষী সম্রাটের ইতিহাস, গবেষণার বিষয়রূপে গ্রহণ করলেন কেন?
আচার্য যদুনাথ সরকার কলকাতায় আকাশবাণীতে প্রদত্ত এক ভাষণে বলেছিলেন যে তাঁর পিতা তাঁর মনে ইতিহাসের প্রতি অনুরাগের বীজ বপন করেছিলেন, এবং পাশ্চাত্য জগতের ইতিহাস অধ্যয়নের মাধ্যমে তিনি স্বদেশের ইতিহাসচর্চার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। কোনাে দেশের সাহিত্য ভালাে করে বুঝতে হলে সেই দেশের ইতিহাস জানা দরকার। দান্তের মহাকাব্যের রসাস্বাদনের জন্য আচার্য যদুনাথ সরকার ইটালির ইতিহাস পড়েছিলেন সিসমনডির গ্রন্থে। তাঁর কাছে সাহিত্য এবং ইতিহাস পরপরের অনুপুরক ছিল। ইংরেজি সাহিত্য পাঠের ফলে ইংরেজি ভাষায় ভাবপ্রকাশে তিনি অসাধারণ দক্ষতা লাভ করেছিলেন। ইউরােপের ইতিহাস পাঠের ফলে ইতিহাস সম্বন্ধে তাঁর ধারণা দেশকালের গণ্ডি অতিক্রম করেছিল। ইতিহাস এক মহাদেশ নামক বাংলা প্রবন্ধে তিনি বলেছেন : “তুলনামুলক নতত্ত্ব, জনকাহিনী, প্রবাদ ইত্যাদির গত পঞ্চাশ বৎসরে যে অগাধ চর্চা হইয়াছে তাহার ফলে প্রাগ ইতিহাস নামে একটি নতুন মহাদেশ আবিস্কৃত হইয়াছে।” যিনি অর্ধশতাব্দীর অধিক কাল মধ্যযুগের ফারসি আর মারাঠি বই এবং কাগজপত্রের স্তুপে ডুবে ছিলেন তার পক্ষে ইতিহাসের সীমানার বিস্তার সম্বন্ধে এই সচেতনতা সত্যই বিস্ময়কর। নৃতত্ত্ব, জনকাহিনী, প্রবাদ—এসব উপাদান যে ঐতিহাসিকের বিবেচ্য, তা স্বীকার করে তিনি গবেষণার আধুনিকতম ধারার সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেছেন।
বিভিন্ন যুগের বিভিন্ন দেশের ইতিহাস এবং সাহিত্য সম্বন্ধে আচার্য যদুনাথ সরকারের গভীর জ্ঞান ছিল। ১৯৩৩ সালে তিনি সরদেশাইকে লিখেছিলেন :
Writing a history that will live requires not only mere industry (a copyist’s industry) in collecting materials, but what is far higher-extensive reading (not narrow specialised study), power of deep thinking and connecting together the near and the distant, things Indian and foreign (by way of comparative estimate and liberal interpretation) and a certain advance in age.
এখানে আচার্য যদুনাথ সরকার তিনটি গুণের উপর জোর দিয়েছেন : (১) নানা বিষয়ে পড়াশুনা, (২) গভীরভাবে চিন্তা করার ক্ষমতা, (৩) মানসিক শক্তি পরিণতি লাভ করেছে এমন বয়স। আজকাল যারা তিন বৎসরে গবেষণা-গ্রন্থ রচনা করে ডক্টর হন তাঁদের কাছে এসব কথা বৃধের প্রলাপ বলে মনে হবে।
আচার্য যদুনাথ সরকার প্রাচীন ভারতের ইতিহাস সম্বন্ধে গবেষণা করেন নি কিন্তু এই দুরহ বিষয়ে তার জ্ঞান কত গভীর ছিল তার কিছু প্রমাণ আছে। সরদেশাই বলেছেন, একদিন কামসেতে স্থানীয় স্কুলের প্রধান শিক্ষক তার কাছে এসেছিলেন হিন্দু নববর্ষ উপলক্ষে একটি বাণীর জন্য। আচার্য যদুনাথ সরকার সেখানে উপতি ছিলেন। সরদেশাই যখন ভাবছিলেন তিনি কী লিখবেন তখন।
Jadunath quietly pulled out a piece of paper and wrote on it in his own hand a line from the Heliodorus pillar inscription at Bhilsa (cir. 130 B.C.) which means that the best religion consists in carrying into practice self-restraint, self-sacrifice and right thinking. What more fitting message from Ancient India could a venerable Guru give to Modern India!
১৯৪০ সালে আচার্য যদুনাথ সরকার প্রাচীন ভারতের ইতিহাস সম্বন্ধে একটি পুস্তকের তালিকা সরদেশাইকে পাঠিয়েছিলেন তার পড়বার জন্য। তাতে প্রাচীন ভারতে রাষ্ট্রশাসনপদ্ধতি সম্বন্ধে জায়সবালের প্রসিদ্ধ বই সম্বন্ধে লিখেছিলেন :
The writings of K. P. Jayaswal, though containing a few original discoveries, are ninetynine per cent pure nationalistic brag and moonshine.
এই কয়টি শব্দে যদুনাথ জায়সবালের বই সম্বন্ধে প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাসে বিশেষজ্ঞদের মত প্রকাশ করেছিলেন।
সেকালে কেউ কেউ ইংরেজি এবং ইতিহাসে অনারস নিয়ে পরে ইংরেজিতে এম. এ. পড়তেন, কিন্তু পরে ইতিহাসে তাঁদের অনুরাগ বাড়ত। রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্রপ্রসাদ ছিলেন এই শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত। কংগ্রেস নেতা এবং রাষ্ট্রপতি থাকার সময় তিনি ইতিহাসচর্চায় সক্রিয়ভাবে সহায়তা করতেন। আচার্য যদুনাথ সরকারের ক্ষেত্রে ইংরেজিতে এম. এ. পাশ করে ইতিহাসচর্চায় আত্মনিয়ােগ করা একটা আকস্মিক ঘটনা বলে মনে করার কারণ নেই।
আচার্য যদুনাথ সরকার যখন কলেজে পড়তেন তখন হিন্দু ধর্মের পুনরভ্যুদয়ের যুগ চলছে। ইউরােপীয় পণ্ডিতদের প্রদর্শিত পথে ভারতীয় পণ্ডিতেরা প্রাচীন ভারতের কীতিগাথা রচনা শুরু করেছিলেন। রমেশচন্দ্র দত্তের ‘হিস্টরি অব সিভিলাইজেশন ইন এনসিয়েট ইনডিয়া’ (তিন খণ্ড) প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৮৯-৯০ সালে। মহাজনের প্রদর্শিত পথ অনুসরণ না করে আচার্য যদুনাথ সরকার মধ্যযুগের ইতিহাস—বিশেষত আওরঙ্গজেবের ইতিহাস তাঁর গবেষণার বিষয়বপে গ্রহণ করলেন কেন? ড. কালিকারঞ্জন কানুনগো বলেছেন, প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের প্রধান উপাদান শিলালিপি আর মুদ্রাতত্ত্ব প্রভৃতি আচার্য যদুনাথ সরকারের সাহিত্যিক প্রতিভার পক্ষে আকর্ষণীয় ছিল; তাই ফারসিতে লেখা ইতিহাস এবং চিঠিপত্র ব্যবহার করে তিনি মধ্যযুগের রাজনৈতিক ইতিহাস রচনা করতে চেয়েছিলেন। আওরঙ্গজেবকে তিনি কেন বেছে নিলেন সে সম্বন্ধে ড. কানুনগাে কিছু বলেন নি। আমার মনে হয়, এই বহু গুণে সমৃদ্ধ সম্রাটের জীবনের ট্রাজেডি (যা সমগ্র ভারতের পক্ষেও ট্রাজেডি) তার সাহিত্যিক প্রতিভা আকৃষ্ট করেছিল। আওরঙ্গজেব সম্বন্ধে আচার্য যদুনাথ সরকার বলেছেন :
The ruler was free from vice, stupidity, and sloth. His intellectual keenness was proverbial, and at the same time he took to the business of governing with all the ardour which men usually display in the pursuit of pleasure. In industry and attention to public affairs he could not be surpassed by any clerk. His patience and perseverance were as remarkable as this love of discipline and order. In private life he was simple and abstemious like a hermit. He faced the privations of a campaign or forced march as uncomplainingly as the most seasoned private. No terror could daunt his heart, no weakness or pity melt it. Of the wisdom of the ancients which can be gathered from ethical books, he was a master. … And yet the results of fifty years’ rule by such a sovereign was failure and chaos. The cause of this political paradox is to be found in Aurangzib’s policy and conduct.
সাম্প্রতিক কালের ঐতিহাসিকেরা মনে করেন, প্রধানত অর্থনৈতিক কারণেই মােগল সাম্রাজ্যের পতন ঘটেছিল। আচার্য যদুনাথ সরকার এ সম্বন্ধে অবহিত ছিলেন, কিন্তু তিনি অর্থনৈতিক কারণগুলি বিশ্লেষণ করেন নি। তিনি বলেছেন, কৃষিপ্রধান দেশে কৃষির উপর দেশের আর্থিক সমৃদ্ধ নির্ভর করে, কিন্তু আওরঙ্গজেবের সামরিক অভিযানগুলি কৃষির যথেষ্ট ক্ষতি করেছিল। শাসকশ্রেণীর নৈতিক চরিত্রের অবনতির উপর তিনি জোর দিয়েছেন।
মৃত্যুর অব্যবহিত পর্বে আওরঙ্গজেব তাঁর পুত্র আজমকে এক চিঠি লিখেছিলেন। তার একটি পঙক্তি বিশেষ অথবহ: ‘দেখবে যেন কৃষকেরা এবং সাধারণ মানুষ অন্যায়ভাবে উৎপীড়িত না হয় এবং মুসলমানের নিহত না হয়…’। হিন্দুদের নিধন সম্বন্ধে মত্যুশয্যাশায়ী সম্রাট কোনাে সাবধানবাণী উচ্চারণ করেন নি।
আচার্য যদুনাথ সরকার আওরঙ্গজেবের ধর্মনীতির সমালােচনা করে সেকালের মুসলমানদের কাছে অপ্রিয় হয়েছিলেন এবং সাম্প্রতিক ঐতিহাসিকেরা তাঁকে সাম্প্রদায়িক লেখকরপে নিন্দা করেছেন। কিন্তু তিনি মুসলমানদের লেখা ইতিহাস এবং মােগল দরবারের দলিলপত্র থেকে উপাদান সংগ্রহ করে মন্দির ধংস, জিজিয়া, ব্যবসায়-বাণিজ্য সম্বন্ধে হিন্দু বিরােধী ব্যবস্থা প্রভৃতি সম্বন্ধে যা লিখেছেন তার সত্যতা কেউ অস্বীকার করতে পারেন নি। ১৯৪৬ সালে আচার্য যদুনাথ সরকার সরদেশাইকে লিখেছেন:
True, interpretation must differ according to the writer’s personality ; but the basis of the conclusions must be unquestionable facts (as established by latest research) and not mere conjecture. Moreover, the interpretation must be such as to convince an impartial outsider.
আচার্য যদুনাথ সরকার সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি দ্বারা প্রণােদিত হয়ে আওরঙ্গজেবের ধর্মনীতির সমালােচনা করেন নি। বর্তমানের চশমা দিয়ে অতীতকে দেখা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। মারাঠা ঐতিহাসিকদের মধ্যে অনেকে মনে করেন যে তিনি মারাঠাদের হিন্দ, সাম্রাজ্য স্থাপনের প্রচেষ্টাকে স্বীকৃতি দেন নি। ১৯৪০ সালে তিনি সরদেশাইকে লিখেছিলেন;
It is pure moonshine to suggest that Baji Rao and (Sawai) Jai Singh), of Jaipur) planned to co-operate in founding a Hindu Pat-Padshahi. We make ourselves ridiculous when we read the thoughts of 20th century Englisheducated nationalists into the lives of sectarian or clannish champions of the 17th and 18th centuries.
বিংশ শতাব্দীর জাতীয়তাবাদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আচার্য যদুনাথ সরকার আওরঙ্গজেবের রাজত্বকালের ঐতিহাসিক তাৎপর্য বিচার করেছিলেন। মােগল সম্রাটেরা ভারতে প্রশাসনিক ঐক্য স্থাপন করেছিলেন, কিন্তু আচার্য যদুনাথ সরকারের ভাষায় (মড়ারন রিভিউ, নভেম্বর ১৯৪২) বলা যায়:
Mere autocratic dictation, the mere drawing of the administrative road roller over the rough face of the people’s heads, cannot grind them into true uniformity; at least such uniformity is not natural and does not last long,
আওরঙ্গজেবের হিন্দু বিরােধী নীতি সম্বন্ধে যদুনাথ বলেছেন :
With every generous instinct of the soul crushed out of them, with intellectual culture merely adding a keen edge to their sense of humiliation, the Hindus could not be expected to produce the utmost of which they were capable; their lot was to be hewers of wood and drawers of water…Amidst such social conditions the human hand and the human mind cannot achieve their best; the human soul cannot soar to its highest pitch. The barrenness of the Hindu intellect and the meanness of spirit of the Hindu upper classes are the greatest condemnation of Muhammadan rule in India.
এই দুর্গতি থেকে হিন্দুদের উদ্ধারের পথ দেখিয়েছিলেন শিবাজী। আচার্য যদুনাথ সরকার বলেছেন :
Shivaji has shown that the tree of Hinduism is not really dead, that it can rise from beneath the seemingly crushing load of centuries of political bondage, exclusion from the administration, and legal repression; it can again lift its head up to the skies.
আওরঙ্গজেব তার সুদীর্ঘ রাজত্বকালের (১৬৫৮ —১৭০৭) অধিকাংশ সময় রাজপুত এবং মারাঠাদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত ছিলেন। তাঁর নীতি মােগল সাম্রাজ্যকে ধংসের পথে এগিয়ে দিয়েছিল।
আচার্য যদুনাথ সরকারের বিশাল গ্রন্থ ‘হিস্টরি অব আওরঙ্গজেব’ পাঁচ খণ্ডে বিভক্ত। প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশিত হয়েছিল ১৯১২ সালে, তৃতীয় খণ্ড ১৯১৬ সালে, চতুর্থ খণ্ড ১৯১৯ সালে এবং পঞ্চম খণ্ড ১৯২৪ সালে। যখন নতুন সংস্করণ প্রয়ােজন হত তখনই আচার্য যদুনাথ সরকার নতুন তথ্য সংযােজিত করতেন।
এই মহাগ্রন্থ পড়তে-পড়তে পাঠকের মনে হবে তিনি এক ঘুর্ণায়মান রঙ্গমঞ্চে এক পঞ্চাক ট্রাজিক নাটকের অভিনয় দেখছেন—যে নাটকে কল্পনার স্থান নেই, ভাবােচ্ছাস নেই, কঠিন নিষ্ঠুর সত্যের লৌহকাঠামাের মধ্যে যার স্থিতি। তিনি মােগল বাহিনীর সঙ্গে-সঙ্গে যাবেন মধ্য এশিয়ায়, কান্দাহারে, উত্তর-পশ্চিম সীমাতের দুর্গম পার্বত্য অঞ্চলে, পাঞ্জাবে, ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায়, চট্টগ্রামে, মধ্যভারতে, রাজস্থানে, মহারাষ্ট্রে। এই সুবিস্তৃত অঞ্চলের বৈচিত্র্য তার চোখের সামনে ভেসে উঠবে জয়ের উল্লাস। এবং পরাজয়ের হতাশা তাকে স্পর্শ করবে। তিনি আরও দেখবেন, দারাকে হত্যা করার নিষ্টুর দৃশ্য; বন্দী শাহজাহানের অসহায় ক্রন্দন তিনি শুনবেন; তিনি দেখবেন, শিবাজীর পুত্র বন্দী সম্ভুজীর দেহ টুকরাে টুকরাে করে কুকুরগুলির দিকে ছুঁড়ে দেওয়া হচ্ছে। শেষ দৃশ্যে দেখা যাবে, সাম্রাজ্যের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে শঙ্কিত, স্ত্রী-পুত্র-কন্যা-পৌত্র-পৌত্রীদের মত্যুতে বিচলিত, ৮৯ বৎসর (১৬১৮-১৭০৭) বয়স্ক জরাজীর্ণ সম্রাটের দেহ মত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে। দেহাবসান ঘটল ইসলামের পবিত্র দিন শুক্রবারে। পরম করুণাময় আল্লাহ তাঁর ভক্তের সকল অপরাধ ক্ষমা করলেন—এটা কি তারই ইঙ্গিত?
আচার্য যদুনাথ সরকার বলেছেন, মধ্যযুগে সকল দেশে—বিশেষত। ভারতবর্ষে-রাজাকে প্রজাদের সুখ-দুঃখের জন্য দায়ী করা হত। স্বৈরতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় এটাই স্বাভাবিক। সুতরাং রাজাকে কেন্দ্র করেই ঐতিহাসিক ঘটনাগুলি সাজাতে হবে এবং তাঁর চরিত্র এবং নীতির মধ্যেই সেগুলির ব্যাখ্যা খুঁজতে হবে। এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই আচার্য যদুনাথ সরকার তাঁর গবেষণার গতি নিয়ন্ত্রণ করেছেন। স্বভাবতই তিনি রাজনৈতিক ইতিহাসকে অত্যধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। এজন্য আজকাল যারা তার সমালােচনা করেন তাঁরা দুটি কথা ভুলে যান। প্রথমত সামাজিক এবং অর্থনৈতিক ইতিহাস সম্বন্ধে অর্থবহ আলােচনার জন্য রাজনৈতিক ইতিহাসের সুদৃঢ় এবং সুস্পষ্ট কাঠামাে গঠন করা দরকার। সন-তারিখ আর সামরিক অভিযান নিয়ে ব্যস্ত আচার্য যদুনাথ সরকার সেই কাঠামাে রেখে গেছেন। কোনাে সাম্প্রতিক ঐতিহাসিক সেই কাঠামােতে ফাটল ধরাতে পারেন নি। দ্বিতীয়ত, বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে সামাজিক এবং অর্থনৈতিক ইতিহাসের গুরুত্ব সম্বন্ধে। যে সচেতনতা এসেছে সেটা আচার্য যদুনাথ সরকারের যুগে পৃথিবীর কোনাে দেশেই ছিল না। ‘তাঁর কাছে এটা আশা করা উচিত নয় যে, যে গবেষণার যুগ পরে এসেছে তার সে গবেষণা আগেই আসা উচিত ছিল।’
‘হিস্টরি অব আওরঙ্গজেব’ রচনার জন্য আচার্য যদুনাথ সরকার প্রধানত ফারসিতে লেখা বই, সরকারি দলিল এবং চিঠিপত্র ব্যবহার করেছেন। পাঞ্জাবি, রাজস্থানি, মারাঠি, অহমিয়া, ইংরেজি প্রভৃতি ভাষায় লেখা উপকরণও তিনি কাজে লাগিয়েছেন। তিনি বলেছেন,
“শিবাজীর জীবনী রচনা করিতে গিয়া আমাকে ভাল করিয়া পার্সী ও মারাঠি ভাষা শিখতে হয়, তা ছাড়া ইংরাজি, সংস্কৃত ও রাজস্থানি ডিগল ভাষা তাে আছেই।”
বহু যত্নে প্রচুর অর্থব্যয়ে তিনি যেসব উপকরণ সংগ্রহ করতেন তার সবই তিনি নির্বিচারে ব্যবহার করতেন না, কোনটি কতখানি বিশ্বাসযােগ্য তা খুঁটিয়ে দেখতেন। সংগৃহীত তথ্যগুলিকে কোনােরকমে এলােমেলােভাবে সাজানাে তাঁর রীতিবিরুদ্ধ ছিল। ১৯৩৩ সালে তিনি সরদেশাইকে লিখেছিলেন :
The true historian’s function is that of the stomach in digesting and extracting the vital juice from the raw food stuff passed down the throat.
আজকাল মাঝে-মাঝে শােনা যাচ্ছে, আচার্য যদুনাথ সরকার ফারসি আর মারাঠি ভাষা ভালাে জানতেন না। তিনি ‘মাসির-ইআলমগীরী’ গ্রন্থের যে ইংরেজি অনুবাদ করেছেন তা কলকাতার এসিয়াটিক সােসাইটি থেকে প্রকাশিত হয়েছে। ‘আইন-ই-আকবরী’র জ্যারেট-কৃত অনুবাদ (দ্বিতীয় ও তৃতীয় খণ্ড) তার সম্পাদনায় এসিয়াটিক সােসাইটি প্রকাশ করেছে। তা ছাড়া তিনি অনুবাদ করেছেন ‘আখামই-আলমগীরী’, মারাঠা ইতিহাস সংক্রান্ত ফারসিতে লেখা কাগজপত্র, ইত্যাদি। এইসব অনুবাদে কোনাে ভুল সাম্প্রতিক কালের পণ্ডিতেরা গবেষকদের নজরে এনেছেন বলে শুনি নি। মারাঠি ভাষায় তাঁর কতখানি দখল ছিল সেটা সরকার-সরদেশাই পত্রাবলী পড়লে বেশ বােঝা যায়। পুনায় সংরক্ষিত পেশােয়া দপ্তরের পত্রাবলী (মারাঠি ভাষায় লেখা) সরদেশাই সম্পাদনা করেছিলেন (৪৫ খণ্ড) আচার্য যদুনাথ সরকারের নির্দেশ তথা সহযােগিতা নিয়ে। আচার্য যদুনাথ সরকার প্রাচীন মােড়ী লিপি পড়তে অসুবিধা বােধ করতেন, কিন্তু তাঁর সময় ওই লিপিতে লেখা চিঠিপত্রের দেবনাগরী অনুলিপি প্রস্তুত হয়েছিল।
উইলিয়ম আরভিন ১৭০৭ সাল থেকে পরবর্তী ত্রিশ বৎসরের ইতিহাস (‘লেটার মুঘলস’) লিখেছিলেন। বইটি অসম্পূর্ণ এবং অপ্রকাশিত রেখে তিনি পরলােকগমন করেন। আচার্য যদুনাথ সরকার বইটি সম্পাদনা করেন এবং নিজে তিনটি অধ্যায় যােগ করেন। ১৯২২ সালে বইটি প্রকাশিত হল; আওরঙ্গজেবের মত্যুর পর থেকে নাদির শাহের আক্রমণ (১৭০৭-৩৯) পর্যন্ত মােগল সাম্রাজ্যের ইতিহাস সদৃঢ় ভিত্তির উপর স্থাপিত হল।
‘হিস্টরি অব আওরঙ্গজেব’ লিখতে আচার্য যদুনাথ সরকার সময় নিয়েছিলেন ২৫ বৎসর ; অবশ্য এই সময়ের মধ্যে আরাে কয়েকখানি বই এবং বহু প্রবন্ধ লিখেছিলেন। ১৯২৪ সালের ডিসেম্বর মাসে ‘হিস্টরি অব আওরঙ্গজেব’, পঞ্চম খণ্ড, প্রকাশিত হয়েছিল। পরবর্তী ২৫ বৎসরে তিনি লিখলেন চার খণ্ডে বিভক্ত ‘ফল অব দি মুঘল এম্পায়ার’। প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৩২ সালে, দ্বিতীয় খণ্ড ১৯৩৪ সালে, তৃতীয় খণ্ড ১৯৩৮ সালে এবং চতুর্থ খণ্ড ১৯৫০ সালে। এই বিরাট গ্রন্থে ১৭৩৯ সাল থেকে ১৮০৩ সাল পর্যন্ত সুদীর্ঘ কালের ইতিহাস বর্ণিত হয়েছে। মারাঠা পাদশাহির উত্থান-পতনের কাহিনী এই ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, কিন্তু আচার্য যদুনাথ সরকার সযত্নে একটি সীমারেখা টেনে দিয়েছেন। মারাঠাদের কর্মকাণ্ডের যে অংশ মােগল সাম্রাজ্যের ভাগ্যের সঙ্গে যুক্ত নয় সেটা তিনি বাদ দিয়েছেন। ইংরেজ, ফরাসি প্রভৃতি বিদেশী জাতির কর্মকাণ্ড সম্বন্ধেও তিনি এই নীতি অনুসরণ করেছেন।
আওরঙ্গজেবের রাজত্বকালে তাঁর প্রচণ্ড ব্যক্তিত্ব এবং অক্লান্ত পরিশ্রম বিচ্ছিন্ন ঘটনাপ্রবাহ নিয়ন্ত্রিত করত। তিনি ছিলেন রঙ্গমঞ্চের কেন্দ্রবিন্দু। ঘটনাস্থলে তিনি উপস্থিত না থাকলেও তাঁর অশরীরী উপস্থিতি স্থানীয় নায়কদের প্রভাবিত করত। অষ্টাদশ শতাব্দীর ভারত ছিল খণ্ড-ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন, বিচ্ছিন্ন ঘটনাগুলি এক নীতি অনুসারে নিয়ন্ত্রণ করার অধিকার দাবি করতে পারেন এমন কোনাে বিরাট পুরষ ছিলেন না। বিভিন্ন দৃশ্যে বিভিন্ন নায়ক। এই বিচ্ছিন্নতার ইতিহাস একটি কাঠামাের মধ্যে টেনে আনা এবং তাকে একটি সুসংহত ছবির রূপ দেওয়া অতি কঠিন কাজ। ৫৫ বৎসর বয়সে কাজটি আরম্ভ করে ৮০ বৎসর বয়সে আচার্য যদুনাথ সরকার এই মহাযজ্ঞ সম্পূর্ণ করেছিলেন।
আচার্য যদুনাথ সরকারের ব্যবহৃত উপাদানের বৈচিত্র্যও এই প্রসঙ্গে উল্লেখযােগ্য। ফারসি এবং মারাঠি বাদে ইংরেজি, ফরাসি, হিন্দি, রাজস্থানি এবং সংস্কৃত ভাষায় লেখা বিপুল উপাদানের সম্ভার তিনি ব্যবহার করেছিলেন।
নাদির শাহের আক্রমণের সঙ্গে-সঙ্গেই মােগল সাম্রাজ্যের পতন ঘটেছিল। কিন্তু সাম্রাজ্যের মৃতদেহ ষাট বৎসর সুসজ্জিত শবাধারে রাখা হয়েছিল। দীর্ঘকাল মােগল শাসনে অভ্যস্ত মানুষ মনে করত যে মােগল সাম্রাজ্য বেচে আছে। ঐতিহ্যের মােহ সাম্রাজ্যের এক ছায়ামতি সৃষ্টি করেছিল। মারাঠারা উত্তর ভারতে সাম্রাজ্য স্থাপন করেও সেই ছায়ামতিকে সরিয়ে দেয়া নি। আহম্মদ শাহ সেই ছায়ামতির নামে নিজের প্রতিনিধি নজীবউদ্দৌলার নামে দিল্লী শাসন করতেন। ইংরেজ কোম্পানি সেই ছায়ামূর্তির কাছ থেকে বাংলা বিহার-উড়িষ্যার দেওয়ানি গ্রহণ করেছিল। সেই ছায়ামতির নামে মহাদাজী সিন্ধিয়া রাজপুত রাজাদের কাছে কর আদায় করতেন। সেই ছায়ামতিই ‘ফল অব দি মােগল এমপায়ার’ গ্রন্থের নায়ক। তাকে কেন্দ্র করেই আচার্য যদুনাথ সরকার এক বিরাট অশ্রুসিক্ত, রক্তাপ্লুত নাটক রচনা করেছেন।
শব্দের মালা গেঁথে অপুর্ব চিত্র রচনা করেছেন আচার্য যদুনাথ সরকার। পুতুল বাদশাহ দ্বিতীয় আলমগীরের সময় অর্থাভাবে সম্রাটের প্রাসাদে রান্না হয় না,
…one day the princesses could bear starvation no longer, and in frantic disregard of the parda, rushed out of the palace for the city…
পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধে মারাঠা বাহিনী বিধস্ত হয়েছে, পেশােয়ার জ্যেষ্ঠপুত্র বিশ্বাস রাও নিহত হয়েছেন। তাঁর খুল্লতাত, প্রধান সেনাপতি সদাশিব রাও ভাউ স্বেচ্ছায় মত্যু বরণ করলেন।
He could not show his face at Poona after having lost the precious charge entrusted to his hands by a weeping mother. Death had lost all its bitterness, because life had no longer any meaning for him.
রােহিলা সদর গােলাম কাদির দিল্লী অধিকার করে পুতুল বাদশাহ দ্বিতীয় শাহ আলমের (যিনি ইংরেজ কোম্পানিকে দেওয়ানি দিয়েছিলেন ) চক্ষু উৎপাটন করল।
…in unimaginable brutality, he called for the Court-painter and made him draw a picture of himself as he knelt on his half-dead master’s bosom and carved out one eye-ball with his dagger, while the other eye was extracted by Qandahari Khan. The wounded old man was left for days together without a drop of water…
কিছুদিন পরে মহাদাজী সিন্ধিয়া দিল্লী অধিকার করলেন, গােলাম কাদিরের চক্ষু উৎপাটন করে শাহ আলমের হাতে দেওয়া হল, তার দেহ খণ্ড-খণ্ড করে একটা গাছে ঝুলিয়ে দেওয়া হল।
…a black dog with white rings round its eyes sat below it (i.e., the body) and lapped up the blood dripping from the neck…
যে মারাঠারা হিন্দু পাদশাহির ধ্বজা তুলেছিল তাদের অত্যাচার থেকে মুক্তিলাভের কোনাে উপায় না দেখে জয়পুরের রাজা ঈশ্বরী সিংহ আত্মহত্যা করেন।
Iswari Singh ordered his servant to bring a live cobra and some arsenic as needed for preparing a medicine. It was done. At midnight he swallowed the poison and caused the cobra to sting him. Three of his queens and one favourite concubine took poison along with him and all five of them died…
অষ্টাদশ শতাব্দীর নিমজমান ভারতবর্ষে নৈতিক অবনতি সমাজকে বিষাক্ত করেছিল। বীরত্বের পণ্যভূমি রাজপুতনায় জয়পুরের রাজা সওয়াই প্রতাপ সিংহ, সম্বন্ধে আচার্য যদুনাথ সরকার বলেছেন:
Anticipating the decadent Nawabs of Oudh, he used to dress himself like a female, tie bells to his ankles and dance within the harem.
মারাঠা রাষ্ট্রনায়ক নানা ফড়নবীশ তার ব্যক্তিগত কোষাগারে দুই কোটি টাকা সঞ্চয় করেছিলেন। এই বিপুল অর্থ রাজ্যের মঙ্গলের জন্য ব্যয় করা হত না। তার নৈতিক চরিত্র অত্যন্ত জঘন্য ছিল।
দ্বিতীয় মারাঠা যুদ্ধের শেষদিকে, ১৮০৩ সালে, বন্ধ অন্ধ পুতুল বাদশাহ দ্বিতীয় শাহ আলম পরাজিত দৌলত রাও সিনিয়ার কতৃত্ব থেকে মুক্ত হয়ে ইংরেজ কোম্পানির আশ্রয় গ্রহণ করলেন। মােগল সাম্রাজ্যের পূর্ণ সূর্যাস্ত হল।
সপ্তদশ এবং অষ্টাদশ শতাব্দীতে মােগল সাম্রাজ্যের ইতিহাসের সঙ্গে মারাঠাদের ইতিহাসের অঙ্গাঙ্গী সম্বন্ধ ছিল। ১৯০৭ দালে আচার্য যদুনাথ সরকার শিবাজী সম্বন্ধে ‘মডারন রিভিউ’ পত্রিকায় একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন। তখন বাঙলায় স্বদেশী যুগ, বাঙালি তিলক-কতৃক প্রবর্তিত শিবাজী উৎসব পালন করছে, রবীন্দ্রনাথের ‘শিবাজী উৎসব’ কবিতা জাতীয় ঐক্য ও স্বাধীনতার প্রেরণা যােগাচ্ছে। ১৯১৯ সালে আচার্য যদুনাথ সরকারের ‘শিবাজী’ গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। তার জীবদ্দশায় বইটির পাঁচটি সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল; প্রত্যেক বারই তিনি নতুন তথ্য সংযােজন করেছিলেন। ‘হিস্টরি অব আওরঙ্গজেব’ গ্রন্থের চতুর্থ খণ্ডে মারাঠা শক্তির অভ্যুদয়, শিবাজী এবং শাজী সম্বন্ধে বিস্তৃত বিবরণ আছে। পঞ্চম খণ্ডে মারাঠাদের স্বাধীনতা-সংগ্রাম (১৬৮৯-১৭০৭) দমনে আওরঙ্গজেবের প্রাণপণ প্রয়াস এবং ব্যর্থতা বর্ণিত হয়েছে। ‘ফল অব দি মােগল এমপায়ার’ গ্রন্থে অষ্টাদশ শতাব্দীতে উত্তর ভারতে মারাঠা সাম্রাজ্যের উথান এবং পতনের কাহিনী পাওয়া যায়। পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধের বর্ণনায় এবং তার রাজনৈতিক ও সামরিক দিকের বিশেলষণে আচার্য যদুনাথ সরকার যে কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন তার তুলনা ভারতের ঐতিহাসিক সাহিত্যে নেই। আমার মনে হয়, কেবলমাত্র উইনস্টোন চারচিলের রচিত মারলবরাের জীবনীতে স্পেনের উত্তরাধিকার-সংক্রান্ত সংগ্রামের বর্ণনার সঙ্গে আচার্য যদুনাথ সরকারের পানিপথসংক্ৰাত অধ্যায়গুলির তুলনা করা যায়। অবশ্য আচার্য যদুনাথ সরকারের ভাষায় তথা রচনাভঙ্গিতে চারচিলের ভাষার অলংকারের দীপ্তি নেই, কিন্তু সুষ্ঠ শব্দপ্রয়ােগ থেকে উদ্ভূত প্রখর্য আছে, ঘটনাপ্রবাহ ঝরনার জলের মতাে অবিরাম অস্থির নৃত্যে প্রবাহিত হচ্ছে। আচার্য যদুনাথ সরকার একাধিকবার পানিপথের রণক্ষেত্র পদব্রজে পরিক্রমা করেছেন; ১৭৬১ সালের পর ঐ অঞ্চলে যমুনা নদী দেড় মাইল সরে গিয়েছে, এটাও তিনি লক্ষ করেছেন।
১৮০৩ সালে কেবলমাত্র মােগল সাম্রাজ্যের সুর্যান্ত হয় নি, মারাঠা সাম্রাজ্যেরও সুর্যান্ত হয়েছিল: পেশােয়া দ্বিতীয় বাজীরাও ইংরেজ কোম্পানির আনুগত্য স্বীকার – করেছিলেন। পুনায় পেশােয়াদের দরবারে ১৭৮৬ সাল থেকে ইংরেজ কোম্পানির রেসিডেন্ট থাকতেন। রেসিডেন্টরা যেসব চিঠিপত্র লিখতেন সেগুলি সমসাময়িক যুগের ইতিহাসের অত্যন্ত মূল্যবান উপাদান। আচার্য যদুনাথ সরকার এবং সরদেশাইর মিলিত চেষ্টায় ১৫ খণ্ডে এই চিঠিগুলি প্রকাশিত হয়েছিল (‘পুনা রেসিডেনসি করেসপনডেনস’)। আচার্য যদুনাথ সরকার ছিলেন এই গ্রন্থাবলীর সাধারণ সম্পাদক। তিনি নিজে তিন খণ্ডের সম্পাদনা করেছিলেন।
মহারাষ্ট্রের সাধারণ মানুষ সম্বন্ধে আচার্য যদুনাথ সরকারের উচ্চ ধারণা ছিল। তিনি লিখেছেন :
I have travelled extensively through the Sahyadri hill range and the river valleys, and everywhere have noticed with surprise the free self-reliant character of the common people, peasants and day Inbourers, such as can never be seen among the helpless ryots of big zamindars in Hindustan, the police-ruled population of indigo-growing areas, the vassals (serfs) of feudal jagirdars in Rajputana and Malwa.
কিন্তু মারাঠা শাসকশ্রেণীর নৈতিক অধঃপতন এবং উত্তর ভারতে মারাঠাদের লুন্ঠন আর অত্যাচার সম্বন্ধে আচার্য যদুনাথ সরকার বারবার অতি কঠোর মন্তব্য করেছেন। এজন্য মহারাষ্ট্রে উগ্র জাতীয়তাবাদীরা তাঁকে ক্ষমা করে নি। ১৯৪৮ সালে সরদেশাই আচার্য যদুনাথ সরকারকে লিখেছিলেন :
…more than 90 p.c. of Maratha history is the result of your singular untiring labours of half a century.
এই মন্তব্য গুণমুগ্ধ বন্ধুর অত্যুক্তি নয়।
বাঙলার ইতিহাস সম্বন্ধে তার দুটি গ্রন্থ বিশেষ উল্লেখযােগ্য। প্রধানত কবিরাজ গােস্বামীর ‘চৈতন্যচরিতামৃত’ অবলম্বন করে তিনি ইংরেজিতে চৈতন্যদেবের জীবনী রচনা করেছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রকাশিত ‘হিস্টরি অব বেঙ্গল’ (দ্বিতীয় খণ্ড, বক্তিয়ার খলজী থেকে পলাশী) গ্রন্থের তিনি ছিলেন সম্পাদক, এবং ছাব্বিশটি অধ্যায়ের মধ্যে দশটি এবং আর-একটির অধাংশ তিনি নিজে লিখেছিলেন। এই গ্রন্থের উপসংহারে তিনি ইংরেজের আগমনের ফলে বাংলার নবজাগরণ বা রেনেসাস সম্বন্ধে যে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন তাকে ভিত্তি করেই তিন দশক যাবৎ বিষয়টির আলােচনা চলছে।
মাতৃভাষার প্রতি আচার্য যদুনাথ সরকারের বিশেষ অনুরাগ ছিল। শিবাজী সম্বন্ধে তিনি বাঙলায় একটি বই লিখেছিলেন। তাঁর লেখা বহ, বাঙলা প্রবন্ধ আছে। রবীন্দ্রনাথের কয়েকটি প্রবন্ধের ইংরেজি অনুবাদ করে তিনি কবিগুরুর বাণীর বিভিন্ন দিক অবাঙালি পাঠকসমাজের কাছে উপস্থিত করেছিলেন।
আচার্য যদুনাথ সরকারের যে কয়টি গ্রন্থের কথা এই প্রবন্ধে উল্লেখ করা হয়েছে তা ছাড়া তিনি আরও কয়েকটি মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। ইতিহাস এবং অন্যান্য নানা বিষয়ে তিনি ইংরেজিতে বহু প্রবন্ধ রচনা করেছিলেন। কৌতুহলী পাঠক অমলেন্দু দে এবং বিনয়ভূষণ রায় কর্তৃক সংকলিত ‘স্যার আচার্য যদুনাথ সরকার রচনাপঞ্জী’ (১৯৭৩) দেখতে পারেন।
বর্ধমান বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনের ইতিহাস শাখার সভাপতিরপে আচার্য যদুনাথ সরকার যে ভাষণ (প্রবাসী, বৈশাখ ১৩২২) দিয়েছিলেন তার কয়েকটি পঙক্তি ইতিহাসচর্চায় নিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির পক্ষে স্মরণীয়: ‘সত্য প্রিয়ই হউক, আর অপ্রিয়ই হউক, সাধারণের গৃহীত হউক আর প্রচলিত মতের বিরােধী হউক, তাহা ভাবি না। আমার স্বদেশগৌরবকে আঘাত করুক আর করুক, তাহাতে দুক্ষেপ করিব না। সত্য প্রচার করিবার জন্য, সমাজের বা বন্ধুবর্গের মধ্যে উপহাস ও গঞ্জনা সহিতে হয়, সহিব। কিন্তু তবুও সত্যকে খুঁজিব, বুঝিব, গ্রহণ করিব। ইহাই ঐতিহাসিকের প্রতিজ্ঞা।’
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দশক থেকে বিংশ শতাব্দীর মঠ দশক পর্যন্ত আচার্য যদুনাথ সরকার এই প্রতিজ্ঞা পালন করেছেন।
আওরঙ্গজেবের জীবন থেকে আচার্য যদুনাথ সরকার যে শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন সেটা সাম্প্রতিক কালের জাতীয় সংহতির প্রবক্তাদের বিবেচনা করা কর্তব্য।
If India is ever to be the home of a nation able to keep peace within and guard the frontiers, develop the economic resources of the country and promote art and science, then both Hinduism and Islam must die and be born again. Each of these creeds must pass through a rigorous vigil and penance, cach must be purified and rejuvenated under the sway of reason and science.
দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে শিখধর্ম সম্বন্ধেও এই বক্তব্য প্রযােজ্য।
‘নবজাগরণ’ অ্যান্ড্রোয়েড অ্যাপ্লিকেশনটি প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর টেলিগ্রাম চ্যানেলে জয়েন হতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর ফেসবুক পেজে লাইক করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।