মুসলমানদের ভারতে প্রথম পদার্পণ সম্বন্ধে দেশের প্রচলিত আটপৌরে ইতিহাসে পাওয়া যায়, ভারতে সর্বপ্রথম মুসলমান জাতির আগমনকাল মুহাম্মদ বিন কাসিমের সময় হতে। আসল ইতিহাস কিন্তু তা নয়; বরং আরও বহু তথ্যপূর্ণ ইতিহাস লুকিয়ে আছে ইতিহাসের ইতিহাসে।
আমরা এতক্ষণ পর্যন্ত অধিকাংশ ক্ষেত্রে শ্রী বিনয় ঘােষ ও তাঁর স্ত্রী ‘ইতিহাসের সিনিয়র শিক্ষয়ত্ৰী শ্ৰী বীনা ঘােষ এম এ বি-টি’র সহযােগিতায় লেখা ‘ভারত জনের ইতিহাস’ হতে উদ্ধৃতি দিয়েছি। তাতে তাদের জ্ঞান, বুদ্ধি, বিদ্যা, নিরপেক্ষতা ও দুরদর্শিতার পরিচয় পাওয়া গেছে যথেষ্ট। কারণ বৌদ্ধ, জৈন প্রভৃতির ইতিহাসে বিদ্বেষতার চিহ্ন পাওয়া যায়নি যদিও তারা হিন্দু ছিলেন না, বরং অহিন্দু বা তাঁর ভাষায় নাস্তিক প্রভৃতি। কিন্তু মুসলমানদের ক্ষেত্রে শ্রী ঘােষ মহাশয় নিরপেক্ষ ভূমিকা গ্রহণ করতে পারেননি বলে অনেকের বিশ্বাস। তার প্রমাণ একটু পরেই আসবে।
আসলে ইংরেজগণ তাঁদের স্বার্থ রক্ষার তাগিদে ইতিহাসে মুসলমান চরিত্রকে বিকৃত করেছিলেন এবং করিয়েছিলেন। আর হিন্দু-মুসলমান বিরাট দুটি জাতির মধ্যে ঘৃণা ও বিদ্বেষের বিষবৃক্ষ রােপণ করতে পারলেই তাদের কৃতকার্যতা। তাদের উদ্দেশ্য সিদ্ধি। তাই মুসলমানদের ইতিহাস লেখার সময় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অনেকে তাদের লেখায় প্রমাণ দিয়েছেন তারা মুসলমান জাতিকে কে কোন চোখে দেখেন! পুরস্কারপ্রাপ্ত বিনয় ঘােষও তার ব্যতিক্রম নন বলেই অনেকে মনে করেন। তিনি একজন ইতিহাস লেখক ও সরকারের দায়িত্ববহনকারী এবং শ্রীযুক্ত রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের বা স্বামী বিবেকানন্দের ভক্ত। তাঁর স্ত্রীও একজন উচ্চ শিক্ষিতা এবং তিনিও দেশের ভাবী নাগরিক গড়ে তােলার জন্য নির্বাচিত নাম করা শিক্ষানিকেতনের শিক্ষয়িত্রী। এখন তাদের লেখাও যদি নির্ভেজাল দোষমুক্ত না হয় তবে সাধারণ লেখক-লেখিকা, শিক্ষক-শিক্ষয়িত্রীর অবস্থা যে আরও ভয়াবহ হবে তাতে আশ্চর্য বা অবাক হওয়ার কী আছে? তাই এই আবশ্যকীয় অবতারণার প্রয়াস।
শ্ৰী ঘােষ তার ‘ভারত জনের ইতিহাসে’ একাদশ অধ্যায়ে ২৭৭ পাতায় শুরু করেছেন ‘ইসলামের অভিযান’। সেখানে মােটা অক্ষরে যা লেখা আছে একটু সূক্ষ্ম দৃষ্টি দিয়ে দেখলেই তা গভীর সাম্প্রদায়িকতা যুক্ত না মুক্ত তার বিচারের দায়িত্ব আমার সূক্ষ্মদর্শী পাঠক-পাঠিকার ওপরেই অর্পণ করলাম।
ঐ ইতিহাসে লিখিত আছে-
“হযরত মুহাম্মদের মৃত্যুর পর যাহারা ইসলাম ধর্মের ধারক হইলেন তাঁহাদের বলা হয় খলীফা। এই খলীফাদের শাসনকাল ক্রমে একটা সুসংহত মুসলমান রাজশক্তির বিকাশ হইলে এবং তাহা আরবের বাহিরে পরিব্যাপ্ত হইল। বিধর্মীদের বিরুদ্ধে ‘জিহাদ’ (ধর্মযুদ্ধ) ঘােষণা করা এবং তাদের ছলে বলে কৌশলে ধর্মান্তরিত করা ইসলামের প্রসার ও প্রতিষ্ঠার যুগে অন্যায় বলিয়া গণ্য হইত না।”
তার পূর্বেই ইতিহাসের ঐ পাতাতেই ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে লেখক বলেছেন,
“…৬৩২ খ্রিস্টাব্দে মুহাম্মদের মৃত্যুর পর তার উচ্ছ্বসিত তরঙ্গ আরবের ভৌগােলিক সীমা অতিক্রম করিয়া প্রচণ্ড বেগে চতুর্দিকে ছড়াইয়া পড়িয়াছিল। হিন্দুধর্ম বহু প্রাচীন, বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের প্রাচীনতাও কম নয়। খ্রিস্টধর্মের ৬০০ বছরের বেশি হইয়াছে। কাজেই নবজাত ইসলাম ধর্মের দুর্বার প্রাণশক্তি অন্তত সাময়িকভাবে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ধর্মানুরাগীদের বেশ বিভ্রান্ত ও বিপর্যন্ত করিয়া ফেলিয়াছিল।”
যাহােক বাচ্চাদের বই হতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বই পর্যন্ত পড়ে এটুকুই সাধারণত বলা হয়ে থাকে, ভারতে মুসলমানদের প্রথম অভিযান মুহাম্মদ বিন কাসিমের সময়। ভারতের ওপর লােভ-লালসার বশবর্তী হয়ে হিন্দু রাজা দাহিরের সময়ে মুসলমানগণ যেন বিনা কারণেই আকস্মিক আক্রমণ করেছিলেন, ইত্যাদি। কিন্তু বর্তমান সূক্ষ্মদর্শী গবেষক পণ্ডিতদের মতে, সিন্ধুস্তান হিন্দুস্তান বা ভারতবর্ষ মুসলমানদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় স্বতন্ত্র স্থান। সিন্ধু বা হিন্দু নামটি মুসলমানদেরই দেওয়া। হযরত মুহাম্মদের (সা.) সময়েই ভারত সম্বন্ধে একদিন তার বিখ্যাত শিষ্য হযরত আবু হােরাইরা (রা.) জানিয়েছিলেন, “হিন্দ বিজয়ের সুসংবাদ”। তাই সাহাবী বা শিষ্য হযরত আবু হোেরাইরা (রা.) বর্ণিত হাদীস গ্রন্থে আছে, “রাসূলুল্লাহ (সা.) আমাদের হিন্দ অভিযানে নিশ্চিত ওয়াদা (প্রতিশ্রুতি) দিয়েছেন।” তিনি আরও বলেছেন, “যদি আমি সেই সময় জীবিত থাকি তবে আমি আমার প্রাণ ও সম্পদ-সম্পত্তি বা অর্থাদি ব্যয় করতে কুণ্ঠাবােধ করব না। আর যদি নিহতই হই তাে সম্মানীয় স্বর্গীয় শহীদের সম্মান পাব, আর যদি নির্বিগ্নে বিজয়ীর বেশে ফিরে আসি তাহলে আমি হতে পারব নরকমুক্ত আবু হােরাইরা (রা.)।” [নাসায়ী হাদীস গ্রন্থ হতে খণ্ডঃ ২, পৃঃ ৬২]
হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবদ্দশায় খালেদ ইবনে ওলিদ (রা.) ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। তিনিই ইসরাইল-আফগান ও নিজের গােত্রের লােকদের পত্র দিয়ে জানান যে,
“সমস্ত ধর্মের প্রতিশ্রুত প্রতিক্ষীত পয়গম্বর ‘মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’ সারা বিশ্বের পাপীদের পরিত্রাণের পাথেয় নিয়ে শেষ নবী হয়ে ইসলাম ধর্ম প্রচার করছেন। আমি নিজে সেই শান্তি সাম্যের স্বয়ংসম্পূর্ণ ধর্মে দীক্ষিত হয়েছি এবং আপনারাও সুচিন্তিত পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন আশা করি। আল্লাহ ছাড়া কোন সৃষ্টির কাছে নতিস্বীকার করাকে ইসলাম চিরতরে বন্ধ করেছে। সংশােধিত চরিত্রবান এবং সভ্য ও উন্নত হয়ে স্বর্গের অধিকারী হওয়ার পূর্ণ পদ্ধতি আমরা উপলব্ধি করে উপকৃত হচ্ছি। তাই আপনাদেরও মঙ্গল কামনায় এই পত্র প্রেরণ…।” [‘তারিখে জাহাকুশ, ‘মজমাউল আনসা’ এবং ‘আছনাফুল মখলুকাত’ ইতিহাস গ্রন্থ দ্রষ্টব্য]
অনুরূপ একটি পত্র পেয়ে কয়স নামে একটি প্রভাবশালী নেতার নেতৃত্বে আফগানিস্তান হতে একটি দল মদীনায় হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন এবং অনেক আলােচনার পর স্বেচ্ছায় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। সেই সঙ্গে কয়সও হযরতের হাতে হাত দিয়ে ইসলামের ওপর আত্মসমর্পণ করলেন। হযরত তখন কয়সের নাম পরিবর্তন করে নতুন নাম রাখলেন আবদুর রশিদ। কারণ প্রত্যেক মুসলমানের নাম মুসলমানের মত হওয়া একান্ত আবশ্যক। এবার আবদুর রশিদ (রাঃ) সঙ্গে আর একজন সাহাবা বা সঙ্গী দিয়ে আদেশ দিলেন ইসলামের বাণী প্রচার করতে। তিনি নিজের দেশ অর্থাৎ আফগানিস্তানে ইসলাম ধর্ম প্রচার করে বহু গােত্রীয় অগােত্রীয় লােককে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করে ৭৮ বছর বয়সে পরবর্তীকালের কাজের দায়িত্ব জীবিত মুসলমানদের ওপর ন্যস্ত করে পরলােক গমন করলেন।
মুসলমানরা একহাতে তলােয়ার আর অপর হাতে কুরআন নিয়েই নাকি ইসলাম প্রচার করেছে বলে যা মিথ্যা অপপ্রচার আমাদের মধ্যে প্রচারিত তা কত অসার, অবাস্তব এবং পরিকল্পনাপ্রসূত ভারতে ইসলাম আগমনের প্রথম অভিযাত্রার ইতিহাস পাঠ করলেই প্রমাণিত হবে।
ভারত রাষ্ট্রের মাদ্রাজ তামিলনাড়ু প্রদেশের একটি জেলার নাম ‘মলাবার’ বা মালাবার। এই ‘মালাবার’ ঘাঁটিটি আরবদের জন্য এক বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ স্থান ছিল। কারণ, মাদ্রাজের এই বন্দরের উপর দিয়েই আরবরা চীনে যাতায়াত করতেন। যেমন করেই হােক সারা বিশ্বের প্রত্যেক স্থানে ইসলামের বাণীকে পৌঁছে দেওয়া তারা ফরয বা অবশ্য কর্তব্য বলে জানতেন। অবশ্য প্রত্যেক দেশ বা জাতিকে মুসলমান করা ফরয নয়, তবে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর বাণী শুনিয়ে দেওয়া ফরয। তাই আরবরা রাতে নামায সাধনায় রত থাকতেন আর দিনে সিদ্ধান্ত শেষে বিশাল কর্ম-সমুদ্রে চালাতেন তাদের অব্যর্থ অভিযান। যাহােক, আরবরা এই জায়গাটিকে বলতেন ‘মাবার’, আরবীতে এর অর্থ অতিক্রম করে যাওয়ার স্থল-পারঘাট। আরব বণিক ও নাবিকেরা এই ঘাট পার হয়েই মাদ্রাজ ও মক্কার কাছে হেজাজ প্রদেশে যাতায়াত করতেন এবং মিসর হতে চীনে এবং যাত্রাপথের নগর ও বন্দরগুলােতে যাতায়াত করতেন। এ জন্যই ‘মাবার’ নাম রেখেছিলেন তাঁরাই। ঐ যাতায়াতের পথে মূল্যবান কর্তব্য ইসলামের বাণী পৌছে দেওয়ার দায়িত্ব তারা যথাযথভাবে পালন করতেন। ফলে তাদের হাতেই বহু মানুষ মুসলমান ধর্মে দীক্ষিত হয়েছিল!
বিশ্বকোষের শ্রী সম্পাদক মশাই তাঁর গ্রন্থে লিখেছেন,
“পরাবৃত্ত পাঠে জানা যায় যে চেরব রাজ্যের (ভারতের) শেষ রাজা চেরুমাল পেরুমাল ইচ্ছা করিয়া সিংহাসন ত্যাগ করিয়া মুসলমান ধর্মগ্রহণ অভিলাষে মক্কানগরীতে গমন করেন। (দ্রঃ বিশ্বকোষ ১৪ : ২৩৪ পৃঃ)
তাছাড়া একজন মুসলমান ঐতিহাসিক লিখিত ‘তােহফাতুল মুজাহেদীন’ গ্রন্থেও পাওয়া যায়,
“একজন রাজার মক্কা গমন, তাঁর হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর নিকট উপস্থিত হওয়া এবং স্বেচ্ছায় ইসলাম গ্রহণের বিবরণ প্রদত্ত হয়েছে। রাজা কিছুকাল হযরতের কাছে থেকে দেশে প্রত্যাবর্তনের সময় ‘শহর’ নামক স্থানে পরলােক গমন করেন।” (তােহফাতুল মুজাহেদীন দ্রষ্টব্য)
এখানে দেখা যাচ্ছে, উভয় লেখকের বক্তব্যের মধ্যে যথেষ্ট পরিমাণে সামঞ্জস্য রয়েছে। অতএব অব্যর্থভাবে প্রমাণিত হচ্ছে মাদ্রাজেই প্রথমে ভারতের রাজা স্বেচ্ছায় মুসলমান হওয়ার জন্য মক্কায় গিয়েছিলেন। আরও প্রমাণ হয়, তরবারি দিয়ে ইসলাম প্রচারের মিথ্যা ঘৃণ্য অভিযােগটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। তদুপরি আরও প্রমাণ হয়, রাজার মুসলমান হওয়ার আগেই হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মহত্ব মহানুভবতা ও মর্যাদার কথা মুসলমান নাবিক বা তবলীগ জামাতের (ধর্ম প্রচারক দল) নিকট জ্ঞাত হয়ে, সাধারণ মুসলমানের মত তিনি তাদের হাতে দীক্ষা না নিয়ে মূল কেন্দ্রে গিয়ে মুখ্য আলােক উৎসে পৌছিলেন। অর্থাৎ সাধারণ নাগরিকরা অনেকেই মুসলমান হয়েছিলেন অনেক পূর্বে।
একজন প্রাচীন ঐতিহাসিক ভারতীয়দের মুসলমান হওয়ার কারণ প্রসঙ্গে বলেছেন-
“তাহার মধ্যে প্রধান হইতে বৌদ্ধ ও জৈনদের মতবাদ, তাহাদের ওপর হিন্দু পণ্ডিতগণের নিষ্ঠুর অত্যাচার এবং পক্ষান্তরে কয়েকজন মুসলমান সাধু পুরুষের সাক্ষাৎ লাভ ও তাহাদের মুখে হযরতের ও ইসলামের ধর্মের পরিচয় লাভ।”
‘সাধু পুরুষদের সাক্ষাৎ লাভ’ কথাটি অত্যন্ত প্রণিধানযােগ্য। মুসলমান ফকির ও আওলিয়াগণের চরিত্র তাদের আধ্যাত্মিক অলৌকিক প্রভাবেও অনেকে মুসলমান হয়েছিলেন। সে সম্পর্কে পূর্ণ ঐতিহাসিক তথ্য পরিবেশন করতে হলে গ্রন্থ আরও বেড়ে যাওয়ার ভয়ে এখানেই সংযত হতে হচ্ছে।
মাদ্রাজের মালাবারের অধিবাসীদের ‘মােপলা’ বলা হয়। তাঁদের প্রধান কাছ ছিল তাবলিগী বা ধর্ম প্রচার। মােপলাদের সম্বন্ধে বিশ্বকোষ সম্পাদক মহাশয়ের লেখা হতে কিঞ্চিৎ তুলে ধরা হচ্ছে,
“ইহারা অধ্যবসায়শীল, কর্মক্ষম এবং বর্ধিষ্ণু… ইহাদের অবয়ব সুগঠিত ও বলিষ্ঠ… ইহারা দেখতে সুশ্রী….ইহাদের ন্যায় পরিশ্রমী দ্বিতীয় জাতি ভারতবর্ষে আর কোথাও দৃষ্ট হয় না… সাহসিকতায় ইহারা চির প্রসিদ্ধ… আরবীয় ধর্ম মতে দীক্ষাদানই ইহাদের প্রধান কর্ম। ইহারা শত্রু (গোঁফ দাড়ি) ধারণ করে, কেশকর্তন করে। সকলেই মস্তকে টুপি দেয়… ইহারা স্বভাবত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন।” (বিশ্বকোষ ১৪ : ৬১৭ পৃঃ দ্রঃ)
তাহলে আমরা বেশ বুঝতে পারছি ভারতে মুসলমান অভিযাত্রীদের আক্রমণের সময়, পদ্ধতি, কারণ ও রহস্য যেন হজম করে একটা গােলকধাঁধা সৃষ্টি হয়েছে। তবে এর পশ্চাতে কি কোন পূর্ব পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র ছিল না? অবশ্যই ছিল। যার ইঙ্গিত পূর্বেই করা হয়েছে এবং পরে আলােচনায় আরও পরিষ্কার হয়ে উঠবে বােধকরি ।
মালবারেরই প্রাচীন নাম চেরর বা কেরল। ওখানে সেই যুগেই দশটি মসজিদ তৈরি করা হয়েছিল যথাক্রমে কোবঙ্গ নূরে, কুইলনে, হিলি ধারায়া পর্বতে, পাকদূরে, মঙ্গলর নগরে, দরফতন নগরে, শালিয়াত নগরে, কুণ্ড পুরমে, যান্দারিনায়, কজর কোট প্রভৃতি স্থানে। বিশ্বকোষ প্রণেতা বলেন,
“মসজিদ প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গেই এতদুদ্দেশে মুসলমান প্রভাব বিস্তৃত হইয়াছিল তাহাতে সন্দেহ নেই। (দ্রঃ ১৪ : ৬১৮ পৃঃ)।
হযরত মুহাম্মদের (সা.) পরলােক গমনের মাত্র কয়েক বছর পর হতেই আবরদের ভারত যাতায়াত শুরু হয়। অবশ্য প্রমাণের প্রয়ােজনীয়তা স্বীকার করি। মহারাজা মনীন্দ্র কলেজের প্রিন্সিপ্যাল শ্রী অনিলচন্দ্র লিখিত ইতিহাসে পাওয়া যায়- “ভারত বর্ষে মুসলমান আক্রমণ বহুদিন পূর্বেই আরম্ভ হইয়াছিল। মুহাম্মদের মৃত্যুর আশি বছর যাইতে না যাইতেই আরবরা ভারতের পশ্চিম সীমান্তে সিন্ধুদেশ অধিকার করে।… সিন্ধু দেশ আরবদের অধিকারে আসার ৩০০ বছর পরে গজনীর সুলতান মাহমুদ ভারতবর্ষ আক্রমণ করিয়া উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে এবং পাঞ্জাব অধিকার করেন। তখনও সিন্ধুদেশ আরবদের অধীন ছিল, কিন্তু উত্তরভারতে অন্যান্য প্রদেশ সমগ্র দক্ষিণ ভারতে হিন্দু রাজা স্বাধীনভাবে রাজত্ব করিতেছিলেন।” (ভারত ও পৃথিবী, ৯১ পৃঃ দ্রষ্টব্য)।
সিন্ধু বিজয়ের আলােচনা করলেই মনে আসে হিন্দু রাজা শ্রী দাহির আর মুসলমান সুলতান মুহাম্মদ বিন কাসিমের কথা। কিন্তু মুহাম্মদ বিন কাসিমের অনেক পূর্বেই হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সময়ে হিজরি সনের ১৫ সালেই সিন্ধু অঞ্চল অভিযানের প্রয়ােজন হয়েছিল। মুহাম্মদ বিন কাসিমের পূর্বে সিন্ধু অঞ্চলে অনেক আরবীয় তবলীগ জামাত বা অভিযাত্রী দল আগমন করেছিলেন। বিখ্যাত ইতিহাস ‘ফাতহুল বুলদান’-এর মূল্যবান তথ্যে জানা যায় যে, ইসলামের দ্বিতীয় খলীফা হযরত ওমর (রা.)-এর সময়ে ওসমান নামের এক বিজ্ঞ বীরকে ‘বাহরায়েন’ ও ‘আম্মানে’র গভর্নর নিযুক্ত করা হয়। ওসমান নিজের ভাইকে বাহারায়েন নিজের পদে বহাল রেখে আম্মান হইতে একটি সৈন্যবাহিনী ভারত সীমান্তে পাঠান। ওখান হইতে অভিযান সমাপ্তির পর তাহার ভাই মুগীরাকে দেবল বা করাচিতে পাঠান। মুগীরা সাফল্য লাভ করেন যদিও করাচি অঞ্চলে তাঁকে বিপুল বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছিল।
এইবার তৃতীয় খলীফা হযরত ওসমান (রা.) [যিনি হযরত মুহাম্মদ (সা.)এর জামাতা] আবদুল্লাহ ইবনে আমরকে ইরাকের শাসনকর্তা করে পাঠান এবং তদানীন্তন ভারতের পূর্ণ সংবাদ সংগ্রহের আদেশ দেন। হাকেম নামক জনৈক ব্যক্তিকে ভার -র সংবাদ প্রেরকের দায়িত্ব-প্ত পদে নিয়ােগ করা হয় তিনি যে রিপাের্ট দেন তার ভাবার্থ হচ্ছে এই যে, ভারতে আরব সৈন্য না যাওয়া উত্তম কারণ সেখানে তখন খাদ্য ও পানীয়ের অভাব ছিল। তাই হিজরি সনের ৩৮ সাল পর্যন্ত ভারতে অভিযান স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।
এরপর চতুর্থ খলীফা হযরত আলীর (রা.) অনুমতিতে হারিস সিন্ধু সীমান্তে অভিযান করেন। ভারতে প্রবেশ ও প্রতিষ্ঠা লাভের বিরুদ্ধে ভারতের নেতাগণ প্রবল বাধা দান করেন কিন্তু সেই বাধা দুর্দমনীয় আরব সেনাদের কাছে টেকেনি। তুমুল যুদ্ধ হয়। উভয় পক্ষের হতাহতও হয়েছিল অনেক। অবশেষে মুসলমনিদেরই জয় হল। বহু মাল সম্পদ আরবদের হস্তগত হয় এবং বহু ভারতীয় সৈন্য আরব সেনাদের হাতে বন্দি হয়। বন্দিদের হত্যা না করে তাদের খাওয়া পরার এবং আরও অন্য দায়িত্বসহ এক হাজার বন্দিকে আরব সৈন্যদের মধ্যে বণ্টন করে দেয়া হয়। অপর দিকে ‘কায়য়ান’ নামক স্থানে মুসলমান বাহিনী যখন আকস্মিকভাবে আক্রান্ত হয়, সেই সময়ে যুদ্ধের কোনও সম্ভাবনা নেই দেখে মুসলমান সৈন্যরা গর্ব ভরে কাল ক্ষয় করছিল। তাই আক্রমণ ও আঘাতের বিরুদ্ধে পাল্টা আক্রমণ করার মত কোন প্রস্তুতিই আরবদের ছিল না। তাই পরাজিত হতে হয়েছিল ভীষণভাবে। কিন্তু দুঃখের বিষয় যুদ্ধ শেষে মুসলমান বন্দিদের নিষ্ঠুরভাবে নিহত হতে হয়েছিল।
তারপর ৪৪ হিজরি সনে আমীর মােয়াবিয়ার (রা.) শাসনকালে মােহাল্লাব ভারত সীমান্তে অভিযান করেন। তাঁর সঙ্গে কয়েকটি উল্লেখযােগ্য যুদ্ধ সংঘটিত হয় কিন্তু তার অগ্রসর-অনগ্রসরের সঠিক সংবাদ ইতিহাসে পাওয়া যায়নি বলে এখানে আন্দাজ-অনুমানে গ্রন্থকে কলঙ্কিত করা অপ্রয়ােজন মনে করি।
যাহােক, মােহাল্লাবের মৃত্যুর পর মােয়াবিয়া (রা.) আবদুল্লাহ ইবনে সওয়ারকে ভারতের দিকে পাঠালেন। তিনি কয়েকটি যুদ্ধে জয়লাভ করে বেশকিছু মালপত্র উপঢৌকন নিয়ে আমীরের নিকট ফিরে গেলেন। পরে ডাকাত কর্তৃক তিনি শহীদ হয়েছিলেন।
তারপর রাশেদ একবার ভারতের দিকে ধাবিত হয়েছিলেন। অবশেষে ‘ময়দ দেবল’ নামক স্থানের যুদ্ধে তিনি নিহত হন, কিন্তু তার স্থানে সেনান এসে পুনরায় ঐ অঞ্চলে যুদ্ধের ডাক দেন। যুদ্ধে জয়ী হয়ে তিনি ওখানেই দুই বছরকাল অবস্থান করেন।
তারপর জিয়াদের পুত্র আব্বাসও ভারত আক্রমণ করে বীরত্বের পরিচয় দেন। এরপর মুনজীর ইবনে জরুদ আব্দদীও ভারত সীমান্তে যুদ্ধ পরিচালনা করেন এবং বিজয় মাল্যে ভূষিত হন। বিজয়ী ও বীরত্ব এই জন্যই বলছি যে, তখনও এক রাজ্য হতে অপর রাজ্য আক্রমণ করা বীরত্ব বলেই বিবেচিত হতাে। শুধু তাই নয়; বরং কোন রাজা কোন রাজাকে আক্রমণ না করলে অথবা কারাের আক্রমণ প্রতিহত করতে না পারলে কে কাপুরুষতার কলঙ্ক ইতেই হতাে। তাই সেকালের নীতির ওপর এই যুগের নীতিকে কেন্দ্র করে মন্তব্য করার সময় সাবধানতা অবলম্বন করা একান্ত প্রয়ােজন।
বিখ্যাত মুসলিম ঐতিহাসিক বালাজুরীর বর্ণনায় জানা যায় যে, ইউসুফ ছকফীর পুত্র হাজ্জাজ ইরাকের শাসনকর্তা নিযুক্ত হয়েছিলেন। হাজ্জাজ সিন্ধু অভিযানের জন্য হারুনের পুত্র মুহাম্মদ, উবাদুল্লাহ ও বােদাযালাক পরপর সিন্ধু অভিযাত্রী হিসেবে নিয়ােগ করেছিলেন। প্রত্যেকেই বিক্ষিপ্তভাবে ও অপূর্ণভাবে বিজয়ী হলেও সমগ্র বা ব্যাপক বিজয়ের দিকে তারা মনােনিবেশ করেননি।
আরবের উমাইয়া বংশের খলীফা আল-ওয়ালিদের সিংহাসনে উপবেশন করার পরেই তাঁর বিখ্যাত সেনাপতি মুসার বীরত্ব ও সাধনার ফলস্বরূপ উপাস্য আল্লাহর ওপর নির্ভর করে আফ্রিকা মহাদেশের দিকে ধাবিত হলেন। রাতে সাধনায় সঞ্চিত শক্তি নিয়ে দিনেরবেলায় বীরবিক্রমে আক্রমণের ফলে সমগ্র আফ্রিকা দখল করে নিলেন, অর্থাৎ ইসলামের মানবতা, উদারতা ও শক্তি সাহসের সাথে আফ্রিকাবাসী পরিচিত হয়ে ধন্য হলাে।
এইবার বীর মুসা হঠাৎ দিনেরবেলায় ‘সালাতুল হাজাত’ নামে একপ্রকার নামায সাধনা সম্পন্ন করে আল্লাহর দরবারে হাত তুলে কেঁদে বললেন,
“ওগাে প্রতিপালক! ওগাে পরিচালক! তুমি আমার ওপর যেমন অনুগ্রহ করেছ তার জন্য কৃতজ্ঞতা স্বীকার করছি। তুমি আমার সঙ্গীদেরও সাহসী ও বলশালী কর। এবং তাদের দ্বারা ইসলামকে সারা বিশ্বে পৌছে দেওয়ার ব্যবস্থা কর।”
তারপর তাঁর সৈন্যদের মধ্যে সেরা সৈনিক তারিক’কে আলিঙ্গন করে আশীর্বাদ করলেন এবং স্পেনের দিকে পাঠালেন। জাদু খেলার মত স্পেন দেশ তারিকের অধীনে এসে গেল। শত্রু-মিত্র সকলেরই মুখে একই কথা- মুহাম্মদ (সা.)-এর দাবি সত্যই সঠিক।
তারপরেই ‘কুতাইবা’ রাতের অন্ধকারে আরাধনান্তে আর দিনে ‘সিয়াম সাধনা’ অর্থাৎ উপাস্যের উদ্দেশ্যে উপবাসব্রত অবস্থায় অভিযান শুরু করলেন প্রাচ্য ভূমির উপর। কুতাইবা দিনের বেলায় উপবাস থেকেও যুদ্ধ চালিয়ে যেতেন কিন্তু সৈন্যদের বলতেন,
“আল্লাহর নামের কৃতজ্ঞতা স্বীকার কর আর খুব খাও ও পান কর। ইসলাম ধর্মে যদিও বেশি খাওয়া, বেশি শোওয়া, বেশি কথা বলা ভাল নয়, কিন্তু প্রিয়নবীর আইনের অনুকূলেই আমি তােমাদের বেশি বেশি করে খেতে বলছি। কারণ যােদ্ধাদের জন্য ঐ আইনটি ছাড় আছে।”
যাহােক, অল্প কিছু দিনের মধ্যে বিশাল মহাদেশের মধ্য পর্যন্ত এসে ইসলামের আলাে জ্বলে উঠল। নতুন সভ্যতা, শিক্ষা ও ভাবধারার সঙ্গে পরিচিত হল এশিয়া মহাদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল সেই বিখ্যাত কুতাইবার কত কামনা ও গবেষণার শেষে ডাঃ ঈশ্বরী প্রসাদ তার ইতিহাসে লিখেছেন-
“The earliest Muslim invaders of Hindustan were not the Turks but the Arabs, who issued out from their desert homes after the death of ihe great Prophet to spread their doctrine through out the world, which was, accordinngto Them “The key of heaven and hell” Whenever they went, there intrepidity and vigour roused to the highest pitch by their proud feeling of a common nationality and their zeal for the faith enabled the Arabs to make themselves’ msters of syria, palestine, Egypt, persia within the short space of twenty years. The conquest of persia made them think of their expansion eastword and when they learnt of the fabulous wealth and idolatry of India from the merchants who Sailed from Shraz and Hurmuz and landed on the Indian coast, They discounted the difficulties and obstacles which nature placed in their way, and determined to lead and expedition to India which at once received the sanction of religious enthusiasm and political ambition. The first recorded expedition was sent From Uman to pillage the cost of India in the year 63637 A. D. during the Khilafat of Umar.
অর্থাৎ-হিন্দুস্তানের প্রথম মুসলমান বিজয়ীগণ তুর্কী ছিলেন না; বরং তারা ছিলেন আরব জাতি। মহান নবীর পরলােক গমনের ঠিক পরেই এই আরব জাতি ইসলামের বানী প্রচার ও প্রসারকল্পে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েন। তবলীগ বা ধর্ম প্রচারের মধ্যেই আছে পরকালের ভালমন্দ, এই ছিল তাদের বিশ্বাস। এই আরবগণ যেখানেই গেছেন বিক্রমপূর্ণ দুর্জয় সাহসের পরিচয় দিয়েছেন সেখানে এবং জাতীয়তাবাদের গৌরবােজ্জ্বল প্রেরণাকে কেন্দ্র করে এইভাবে সত্যের অনুসন্ধানপ্রাপ্ত আরবগণ মাত্র বিশ বছরের মধ্যে সিরিয়া, প্যালেস্টাইন, মিসর ও ইরানের অধিকারী হতে পেরেছিলেন। পারস্য ইরান বিজয়ের পর আরবগণ তাদের এই বিজয়কে পূর্ব দিকে আরও সম্প্রসারিত করতে প্রয়াস পান। সিরাজ ও হরমুজের ব্যবসাদারগণ তখন ব্যবসায়ী কার্যোপলক্ষে ভারতের উপকূলবর্তী অঞ্চলে গমনাগমন করতেন। আরবগণ তাঁদের মুখ হতেই ভারতের ধর্মনৈতিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংবাদ পেয়েই ভারত অভিযানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন । এবং প্রথমে ৬৩৬-৩৭ খ্রিস্টাব্দে উমারের (রা.) খেলাফতকালে ‘ওমান’ হতে ভারতে প্রথম অভিযান হয়েছিল।
আরবী ৪০ হিজরিতে মুসলিম ধর্ম প্রচারকগণ (তবলীগ জামাত) ভারতবর্ষ পৌঁছেন। তাছাড়া ভারতের পশ্চিম উপকূলে বনি উমাইয়াদের আমলে খলীফা ওলিদের সময় ৭০৫ খ্রিস্টাব্দে মুহাম্মদ বিন কাসিম কর্তৃক সিন্ধু বিজয় হয় এবং সেটা খােরাসান প্রদেশের অংশরূপে একটি গুরুত্বপূর্ণ সীমান্ত এলাকায় পরিণত হয়।
যারা ভারতে এসেছিলেন তারা বেশির ভাগ ‘তাবেয়ীন’ বা ‘তাবেতাবেয়ীন’। অর্থাৎ হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর শিষ্যের শিষ্য বা শিষ্যের প্রশিষ্যের সঙ্গ লাভের সুযােগ পেয়েছিলেন। হযরতের বাণী শুধু প্রচারে নয় তার প্রসারে এবং নিজেদের ভারতের অধিবাসী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে তারা এখানে স্থায়ী বসবাস করেছিলেন।
প্রথম ও দ্বিতীয় শতাব্দী খুব ভালভাবেই কেটেছিল, তৃতীয় শতাব্দীতে মুসলমান নামধারী ‘বাতেনী’ দলের প্রভাবে মুসলিম জাতি মুসলিম জগতের সাথে যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
পঞ্চম শতাব্দীতে সুলতান মাহমুদ গজনবী খাইবার গিরিপথ দিয়ে ভারতে প্রবেশ করেন এবং পাঞ্জাব ও সিন্ধু দখল করেন। ফলে ভারতের সঙ্গে পুনর্বার মুসলিম জাতির যােগাযােগ স্থাপিত হয়।
তারপর সপ্তম শতাব্দীতে ভারতের প্রায় সকল অংশই মুসলমানদের দখলে আসে। তারাই সর্বপ্রথম দিল্লিকে ভারতের রাজধানী নির্বাচিত করেন। এই সময় এশিয়ার অন্তর্গত খােরাসান, তুরস্ক প্রভৃতি স্থান হতে বহু সৈনিক ব্যবসায়ী, আলেম ও বুযুর্গ স্থায়ীভাবে বাস করতে থাকেন। আলেমদের সিদ্ধান্ত ও পরামর্শ বাদশাহদের রাজনীতি, সৈন্যদের বিক্রম, পীর বুযুর্গদের ইবাদত, সাধনা, চরিত্রবল ও আদর্শ স্থাপনা সব একত্রিত হয়ে ইসলাম ধর্ম সারা ভারত তথা এশিয়া তথা বিশ্বে ক্ষিপ্রগতিতে ছড়িয়ে পড়ে। দেহের এক অঙ্গের সাথে অন্য অঙ্গের যেরূপ নিরবচ্ছিন্ন সম্পর্ক, ঠিক তেমনি উপরােক্ত আগতদের বেলাতেও অনুরূপ এক নিগূঢ় সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল।
সত্যের অপ-প্রচার
আমরা শুধুমাত্র সমালােচক পুস্তক প্রণয়নেই এই গ্রন্থ সংকলনে অগ্রসর হয়নি, বরং চাপাপড়া সব ইতিহাসকে মানুষের সামনে তুলে ধরতে এই ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা। তবুও সত্য রক্ষার খাতিরে কিছু কিছু সমালােচনা না করলে ছাত্রছাত্রীদের সমালােচনা যােগ্য শক্তি সৃষ্টিতে উৎসাহ আসবে না। তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও এই প্রয়াস।
শ্রী বিনয় ঘােষ লিখেছেন, “খলীফাধীন পারস্য সাম্রাজ্যের শাসক হাজ্জাজ মনেপ্রাণে সাম্রাজ্যলােভী ছিলেন এবং কাশগড়ে চীনাদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হন। অতঃপর কাবুল ও সিন্ধুদেশ অভিযান আরম্ভ হয়।
সিংহলের রাজা কিছু মূল্যবান উপঢৌকন নাকি খলীফা ও হাজ্জাজের সন্তুষ্টির জন্য পাঠিয়েছিলেন কিন্তু তাহা পথে সিন্ধুর দেবল অঞ্চলের জলদস্যুরা লুট করেছিল, অতএব দেবলের দস্যুদের শায়েস্তা করা দরকার এই ছিল হাজ্জাজের সিন্ধু অভিযানের অযুহাত।” [দ্রষ্টব্য ‘ভারত জনের ইতিহাস’]
বলাবাহুল্য, শ্রী ঘােষের লেখায় আর শ্রী বজায় থাকছে না; বরং বিশ্রী বস্তুর দুর্গন্ধে নিরপেক্ষ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে সাম্প্রদায়িকতার নিদর্শনরূপে গণ্য যাবে না, একথা শপথ করে সকলে বলবে বলে মনে হয় না। অবশ্য অনেকের মতে, শ্রী ঘােষকে আসলে দোষ দেয়া যায় না। কারণ স্বামী স্ত্রীর যুগ্ম প্রতিভাতে যে ইতিহাস তারা লিখেছেন তা ইংরেজি ইতিহাস আর আমাদের দেশের হাটে পাওয়া সহজ ইতিহাসকেই অবলম্বন করে। কিন্তু আগেই বলেছি প্রকৃত ঐতিহসিক হতে হলে আরবী, ফারসী প্রভৃতি বিদেশী ভাষা না জানলে মূল ইতিহাস বােঝা বা বুঝে উদ্ধার করা সম্ভব নয়। হয়তাে শ্রী এবং শ্রীমতী ঘােষের পক্ষে ওকালতি করে কেউ বলতে পারেন-তারা যে আরবী-ফারসি জানতেন না তারই যা প্রমাণ কী? প্রমাণ তাদের লেখা ঐ ইতিহাসের ২৭৯ পৃষ্ঠায় মওজুদ আছে। তারা ‘মুহাম্মদ বিন কাসেম’-এর নামের পরিবর্তে বারবার ব্যবহার করেছেন শুধু ‘কাসিম’। আমার সরল চিত্ত কোন পাঠক হয়তাে বলবেন যে, এতবড় নামের পরিবর্তে শুধু মাত্র ‘কাসিম’ ব্যবহার করে একটু সংক্ষেপ করা হয়েছে তাতে ক্ষতি কী? ক্ষতি হচ্ছে এই যে, অযােধ্যার ইতিহাস লিখতে গিয়ে রামচন্দ্রের স্থানে দশরথ লিখলে যা হয় তাই। শ্রী ঘােষকে শ্রদ্ধার সঙ্গে দেশের ছাত্র সমাজ যদি প্রশ্ন করেন-সিন্ধু বিজয়ে ভারতে প্রথমে কোন মুসলমান এসেছিলেন? উত্তরে প্রথম ভূল হয়তাে হবে এই যে, যারা আগেই ইতিহাসের পাতায় সিন্ধু অভিযানের জন্য অমর হয়ে আছেন তাদের নামােল্লেখ না করেই বলবেন-‘কাসিম’। কিন্তু প্রশ্নকর্তা ও উত্তরদাতা নির্বিশেষে প্রত্যেক ইতিহাস অনুরাগীকেই জেনে রাখা ভালাে যে, সিন্ধু বিজয়ী মুসলমান ব্রাহ্মণ রাজা দাহিরের প্রতিদ্বন্দ্বীর বাবার নাম ‘কাসিম’। তার নিজের নাম ‘মুহাম্মদ’। মুহাম্মদ বিন কাসিমের অর্থ হল-মুহাম্মদ কাসিমের পুত্র। অর্থাৎ কাসিমের পুত্র মুহাম্মদ। এখন যদি নামের সংক্ষেপ করতে হয় তাহলে ‘মুহাম্মদ’ লেখা উচিত ছিল। ‘বিন’ বা ‘ইবন’ মানে ছেলে। আরবদের নিয়ম যােগ্য পিতার নামে নিজের নাম যুক্ত করা।
বিখ্যাত ইতিহাস ‘আববোঁ কী জাহারাণী’, ‘ফাতহুল বুলদান’ প্রভৃতি আরও বহু আরবী, ফারসি ও উর্দু এবং ইংরেজি ও বাংলা ইতিহাস সামনে রেখে আসল তথ্য আমরা তুলে ধরছি নিরপেক্ষ অনুসন্ধিৎসুদের জন্য। হাজ্জাজের সিন্ধু অভিযানের অনেক কারণ ছিল।
প্রথমত, হাজ্জাজ ইরান বা পারস্যের যুদ্ধে প্রাণপণে যখন সৈন্যদের নিয়ে লড়ছিলেন তখন ভারত হতে মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিশেষভাবে সাহায্য করা হয় ফলে মুসলমানদের মনে একটা গভীর চাপা দুঃখ বা জ্বালা এবং প্রতিশােধপ্রবণতা জাগ্রত ছিল। আজ বিংশ শতাব্দীতেও কোন যুদ্ধের সময় অপর রাষ্ট্র শত্রুকে সাহায্য করলে সেই রাষ্ট্রের সাথে সঙ্গে সঙ্গেই কূটনৈতিক সম্পর্ক ছেদ করা হয়।
দ্বিতীয়ত, হাজ্জাজের শাসনকালে পারস্য হতে একটি বিদ্রোহী দল ভারতে আসে এবং তদানীন্তন ব্রাহ্মণ রাজা দাহির তাঁদের সাহায্য ও আশ্রয় দিয়েছিলেন। অবশ্য পেছনে রাজনৈতিক কারণও ছিল।
তৃতীয়ত, আরবের কিছু সাধক পুরুষ ও মহিলা এবং অনেক সাধারণ নরনারী সমেত কয়েকটি আরবীয় জাহাজ সিন্ধু অঞ্চলে লুট হয়ে যায় এবং পুরুষ-নারী নির্বিশেষে সকলকে পাইকারিভাবে হত্যা করা হয়। তখন হাজ্জাজ সিন্ধুরাজ দাহিরের নিকট দস্যুদের শাস্তি দিতে এবং ক্ষতিপূরণ করার জন্য দাবি করলেন। দাহির জানিয়ে দিলেন, ক্ষতিপূরণ দেওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয় আর দস্যুদের শায়েস্তা করার দায়িত্বও তিনি নিতে বাধ্য নন।
এইবার ক্রোধের বশবর্তী হয়ে হাজ্জাজ একদল সৈন্যসহ একজন বিচক্ষণ সেনাপতিকে পাঠালেন সিন্ধু অঞ্চলে। এ যুদ্ধ আরব সভ্যতা, শিক্ষা ও হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর বাণী প্রচারের জন্য করা হয়েছিল বলা যাবে না, বরং ক্রোধের ওপর নির্ভর করেই ছিল এই অভিযান। যুদ্ধ হল সিন্ধুবাসীদের সাথে মুসলমনিদের। প্রাথমিক অবস্থায় সিন্ধীরা পরাজয়ের দিকে যাচ্ছিল, হঠাৎ তাদের ধর্মের বিধানদাতাদের পরামর্শে দেবমূর্তি যুদ্ধ ক্ষেত্রে বহন করে নিয়ে যাওয়া হলে যুদ্ধে কিন্তু মুসলমানদের ভাগ্যে দারুণ পরাজয় নেমে এল। যুদ্ধ শেষে বিরাট সৈন্যবাহিনীর এমনকি সেনাপতিকে পর্যন্ত প্রত্যেক মুসলমানকে ঠাকুরের সম্মুখে নির্মমভাবে টুকরাে টুকরাে করে হত্যা করা হয়েছিল। জীবন্ত বন্দি জীবনযাপন করার সৌভাগ্য কোন মুসলমান সেনার হয়ে ওঠেনি।
শ্রী বিনয় ঘােষও তার ইতিহাসের ২৭৮ পৃষ্ঠায় লিখেছেন,
“কিন্তু এই অভিযান ব্যর্থ হয়। দেবলের তথাকথিত দস্যুদের শায়েস্তা করা সম্ভব হয় না। সিন্ধীদের প্রবল প্রতিরােধে আরব সেনাপতি পর্যন্ত নিহত হন।”
অতঃপর হাজ্জাজ তাঁর আর এক অল্প বয়স্ক সুদর্শন বীরকে সেনাপতি নির্বাচিত করে পুনরায় সিন্ধু অভিমুখে মুসলমান বাহিনী পাঠালেন। ইনিই ইতিহাসে মুহাম্মদ বিন কাসিম নামে পরিচিত। ঐ তরুণ সেনাপতি হাজ্জাজের আপনজন, পিতৃব্য পুত্র। শুধু তাই নয়, আরও গভীর সম্পর্কে ঐ যুবক তাঁরই জামাতা।
‘সালাতুল হাজাত’ (প্রয়ােজনের নামায) নামক উপাসনা অন্তে উলামা ও আওলিয়াদের পরামর্শ ও শুভাশিস নিয়ে মুহাম্মদ বিন কাসিম এবার ধর্মনৈতিক কারণেই অভিযান চালালেন। মুহাম্মদ বিন কাসিম জলপথে এবং স্থলপথে উভয় দিক হতে সেই সময়ের বিখ্যাত কেন্দ্র দেবল মন্দির আক্রমণ করলেন। সিন্ধীরা এাহ্মণ রাজা দাহিরের আদেশে প্রবল বাধা দেয়ার জন্য বীরবিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। আবার পূর্ব সমরের ন্যায় জনসাধারণ ঠাকুরদের নামে জয়ধ্বনি দিতে লাগলেন। কিন্তু এবার নিমেষে দাহিরের সৈন্যরা মনােবল হারিয়ে ফেললেন। মুসলমান সৈন্যরা ‘আল্লাহু আকবার’ (আল্লাহই মহানতম) বলে চিৎকার করতে লাগলেন। যুদ্ধ পুরােদমে চলতে লাগল। রাজা দাহির হাতির উপর উপবিষ্ট হয়ে যুদ্ধ করছিলেন, এমন সময় বিপক্ষ বাহিনীর একটা তীর রাজার হাতির পিঠে হাওদায় পড়ে হু হু করে আগুন জ্বলে উঠে। হাতি প্রাণের ভয় ও আতঙ্কে জলাশয়ে নেমে পড়ে। দাহির মাটিতে দাঁড়িয়েই যুদ্ধ করতে লাগলেন। কিন্তু তার সৈন্যদল আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। একটা কথা রটে গেল, মুসলমানরা অগ্নিতীর ব্যবহার করে, যা লেলীহান শিখা নিয়ে জ্বলে উঠে। শ্রী বিনয় ঘােষও তাঁর ইতিহাসে এ বিষয়ে একটু আলােকপাত করেছেন। যেমন তিনি লিখেছেন,
“দাহিরের হাতির হাওদায় আরবদের একটি অগ্নিতীর বিধিয়া আগুন জ্বালিয়া উঠে, হাতি দৌড়াইয়া জলের মধ্যে ঝাঁপাইয়া পড়ে।” (ভারত জনের ইতিহাস)
অনেকের মত, অলৌকিক ঘটনা বা দৈব ঘটনা ওটা যাই হােক দাহির যুদ্ধে বাধা দিতে গিয়ে নিহত হলেন। দাহিরের স্ত্রী সৈন্যদের সাহস যােগাতে এবং পুনঃ একতাবদ্ধ হয়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে উৎসাহিত করেন। কিন্তু রানীর কথায় কোন কাজ হয়নি। অবশেষে রানী ও তার সঙ্গিনীগণ বিপদগ্রস্ত হওয়ার পূর্বেই আগুনে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করলেন।
৭১২ খ্রিস্টাব্দে জুন মাসে ব্রাহ্মণ রাজা দাহির সাহসের সাথে যুদ্ধ করেও নিহত হলেন। তারপর এক বছরের মধ্যেই দাহিরের গােটা সাম্রাজ্য মুহাম্মদ বিন কাসিমের দ্বারা মুসলমানদের অধিকারে আসে।
হযরত মুহাম্মদ (সা.) ৬৩২ সালে পরলােকগমন করেন আর কাসিমের পুত্র মুহাম্মদ ৭১২ খ্রিস্টাব্দে এই ঐতিহাসিক যুদ্ধে ইসলামের বিজয় কেতন ভারত ভূমিতে উড্ডীন করেন। তাঁরা ইচ্ছা করলে হয়তাে ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চল করতলগত করতে পারতেন। কিন্তু অনেকের কাছে এ যুদ্ধ খুব গুরুত্বপূর্ণ হলেও আরবদের কাছে সেটা সাধারণ একটা যুদ্ধ ছিল মাত্র। কারণ পৃথিবীর প্রত্যেক দিকেই তাঁদের অভিযান আরও নাটকীয় ও আশ্চর্যজনক ঘটনা, যা মারাত্মক প্রতিকূল অবস্থাতেও নিশ্চিত পরাজয় হতে গিয়ে মুহূর্তের মধ্যে তা জয়ে পরিণত হয়েছিল ।
এখানে উল্লেখযােগ্য ঘটনা এই যে, ব্রাহ্মণদের ধর্মীয় সংকীর্ণতা তথা পক্ষপাতিত্ব ও অবিচারের ফলে ভারতের ‘জাঠ’ সম্প্রদায় এবং ‘মেড’ সম্প্রদায় রাজার ওপর অসন্তুষ্টই ছিল; তদুপরি তথাকথিত নীচ জাতি বা শােষিত অবহেলিত, অনুন্নত সম্প্রদায় এমনকি হিন্দু ছাড়া ভারতীয় প্রায় প্রত্যেক সম্প্রদায় রাজাদের ওপর ভাল ধারণাপােষণ করত না। যুদ্ধের সময় তাদের সহযােগিতা স্বাভাবিকভাবে পাওয়া যায়নি। তবে ‘জাঠ’ ও ‘মেড’ সম্প্রদায় অত্যন্ত সাহসী ও বলিষ্ঠ জাতি। তারা মুসলমানদের পক্ষ প্রকাশ্যভাবে সমর্থন করে দাহিরের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে সাহায্য করে। দাহিরের শােচনীয় পরাজয়ের এটি একটি কারণ।
মুহাম্মদ বিন কাসিমের মন্দির আক্রমণের কথা পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন যে, মুহাম্মাদ বিন কাসিম মন্দির আক্রমণ করতে গেলেন কেন? কারণ মুহাম্মদ বিন কাসিমের পূর্বে ভারত অভিযানকারী পরাজিত মুসলমানগণ নির্মূল হয়েছিলেন। তাতে জনসাধারণের তাে ধারণা হয়েছিল যে, দেবল মন্দিরের ঠাকুরের দ্বারাই এই জয় সম্ভব হয়েছে। তার ওপর নতুন মুসলমান যারা হয়েছিলেন তাঁদেরও ধর্ম বিশ্বাস শিথিল হয়ে গিয়েছিল। তাই মানবজাতিকে সৃষ্টির কাছে মাথানত না করে বা ঠাকুর-দেবতার কাছে যথাসর্বস্ব বিলিয়ে না দিয়ে স্রষ্টার কাছে মাথানত হবার প্রেরণা যােগানোর জন্যই এ মন্দিরের সম্মুখে যুদ্ধ আয়ােজনের প্রয়ােজন হয়েছিল।
ব্রাহ্মণদের দেবতা ঠাকুরের ওপর আনুগত্য স্বাভাবিকভাবেই ছিল। তার ওপর গত যুদ্ধে মুসলমানদের পরাজয়ের কারণে তারা স্বাভাবিকভাবেই ঐ মন্দিরের। ঠাকুর দেবতার ওপর আরও নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিলেন। তাই রাজার মূল্যবান ধনাগার স্থানান্তরিত করা হয়েছিল ঐ মন্দিরে। ফলে যুদ্ধ শেষে বহু মূল্যবান দ্রব্যসামগ্রী মুসলমানদের হাতে অতি সহজেই এসে গিয়েছিল।
মুসলমান ধর্মে বহু হিন্দু আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন দেবতার পূজা নিষ্ফল মনে করার কারণে। অতএব মুহাম্মদ বিন কাসিম যদি ঐ মন্দিরের প্রাঙ্গণে তথা পক্ষান্তরে দেব শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণা করে বিজয়ী না হতেন তাহলে এইসব নব মুসলিমদের ধর্মান্তরিত হওয়া ব্যর্থ বলে প্রমাণিত হতাে।
আগেই বলা হয়েছে, ব্রাহ্মণ রাজা দাহিরের মৃত্যুর পর তাঁর স্ত্রী ও অন্য মহিলারা মৃত্যুবরণ করেন। এ ঘটনাও সত্য। তাই বলে বিকৃত ব্যাখ্যা করে মুসলমানদের চারিত্রিক দুর্বলতার কারণ বলে বর্ণনা করা নিঃসন্দেহে তা পক্ষাপাতিত্ব দোষে দুষ্টামি ও নষ্টামি। আসল কারণ হচ্ছে; হিন্দুধর্মের বিধান মতে, সম্ভ্রান্ত হিন্দু মহিলাদের আগুনে পুড়ে মৃত্যুবরণ করাটা খুবই মহৎ কাজ বলে বিবেচিত হতাে। যেমন সতীদাহ প্রথার প্রাবল্যে স্বামীর মৃত্যুর পর জ্বলন্ত চিতায় ঝাঁপ দেওয়া। এক্ষেত্রে স্বামীর মৃত্যুর পর সন্তান, শ্বশুর, দেবর ও ভাসুরদের চারিত্রিক দুর্বলতার কারণে তাদের পুড়ে মরতে হতাে না। আসলে দুর্বলা নারীদের চারিত্রিক দুর্বলতা ও দুশ্চিন্তার ওপর ধর্মীয় সংবিধানের পরিপ্রেক্ষিতে স্বর্গের কথা মনে করেই নিজেদের আত্মহত্যা করা ছিল বীরাঙ্গনার পরিচয়। আর তাই দেখে দুর্বল মুহূর্তে মৃত্যুবরণের হিড়িক পড়ে যেত। অবশ্য এ প্রথা যে একটা অসভ্যতা, বর্বরতা ও কাপুরুষতা ছিল এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।
যাহােক, মুহাম্মদ বিন কাসিম যুদ্ধান্তে কিছুদিন নিজের মুখ্য পদগুলােতে নিজেদের নিয়ােজিত লােককে বহাল করেছিলেন। কিন্তু কিছুদিন পর দাহিরের সময়ে যে হিন্দু কর্মচারী যে পদ নিয়ে থাকত তাকে সেই পদে পুনর্বহাল করে চরম উদারতার পরিচয় দিয়েছিলেন। এবং উল্লেখযােগ্য ঘটনা এই যে, “ব্রাহ্মণদের ওপর রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব দেওয়া হইয়াছিল।”
খুব মনে রাখার কথা হচ্ছে এই যে, ঐ সময় ভারতে কুরআন শরীফ ও হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর বাণী বা হাদীস হিন্দুদের মধ্যে বিশেষভাবে পরিচিত, পঠিত ও সমাদৃত হয়। সেই সময় মুসলমান রাজার প্রবল আগ্রহে ভারতের পুরাতন পুঁথিপত্র এবং ধর্ম গ্রন্থাদি অনুবাদের দ্বারােদঘাটনও সম্ভব হয়। শুধু তাই নয়, হিন্দুধর্মের পুস্তকপত্র আরবেও নিয়ে যাওয়া হয়। তাদের ধারণা ছিল, যে দেশে থাকতে হবে সেই দেশের পরিবেশ, ইতিহাস ও সংস্কৃতিকে না জানতে পারলে অনেক অসুবিধার সম্মুখীন হওয়ার সম্ভাবনা। তাই অত্যন্ত অধ্যবসায়ী আরবরা ভারতীয় প্রাচীন ভাষা শিক্ষা লাভের জন্য বেনারসে এসেছিলেন। বিখ্যাত ঐতিহাসিক আমীর খসরু লিখিত ইতিহাসে আছে- আবু মুসা দশ বছর ধরে হিন্দু ধর্মশাস্ত্র পড়ার জন্য পরিশ্রম করেছিলেন।
আরও আসুন, শ্রী ঘােষ তাঁর ইতিহাসের ২৭৯ পৃষ্ঠায় লিখেছেন,
“দাহিরের দুই কন্যাকে বন্দি করিয়া কাসিম খলীফার হারেমের জন্য পাঠাইয়া ছিলেন। কিন্তু তাহারা খলীফার কাছে অভিযােগ করিলেন যে, কাসিম তাহাদের ইজ্জত নষ্ট করিয়া খলীফার কাছে পাঠাইয়াছেন। ইহাতে খলীফা ক্রুদ্ধ হয়ে হুকুম দেন যেন কাঁচা গােচর্মে আপাদমস্তক মুড়িয়া সেলাই করিয়া কাসিমকে তাঁহার কাছে অনতিবিলম্বে পাঠানাে হয়। খলীফার আদেশ আল্লাহর আদেশের মতাে, কাজেই কাসিম (?) নিজেই ঐভাবে মৃত্যুবরণ করেন। এই কাহিনীর সবটুকু হয়তাে ঐতিহাসিক সত্য নয়। কিন্তু কাসিমের জীবনের করুণ পরিণতির কথা অনেকেই স্বীকার করেন।”
শ্রী ঘােষ ভারতের সুশীল ছাত্রছাত্রীদের মাথায় একটা কিংবদন্তীর ছাপ কেমনভাবে এঁকে দেয়ার চেষ্টা করেছেন তা লক্ষ করার বিষয়। তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন, কাহিনীটির সবটুকু ঐতিহাসিক সত্য নয়, অথচ সন্দেহজনক ও সাম্প্রদায়িকতা বৃদ্ধিকর এই মারাত্মক কথা ইতিহাস বলে চালিয়ে যাওয়ার পেছনে লাভ কতটুকু তা দেখা দরকার।
এর উত্তরে স্মরণ করা যেতে পারে যে, ইতিহাসের দিকে তাকালেই দেখা যায়, অনেক জাতির মধ্যে রাজা-রানীদের বিপদের সময় আত্মহত্যা করার ঘটনা আছে। কিন্তু একমাত্র মুসলমান রাজত্বে আত্মহত্যার ইতিহাস দেখতে পাওয়া যায় না। কারণ ইসলাম ধর্মে আত্মহত্যা তার পক্ষে পরকালে স্বর্গে যাওয়া সহজে সম্ভব নয়। তাই মুসলমান জাতি ঐ কাপুরুষতা হতে মুক্ত। অবশ্য ইদানীং ভারতে সাধারণ মুসলমান দু-একজন আত্মহত্যা করলেও প্রথমত, তারা ধর্মের তত ধার ধারে না। দ্বিতীয়ত, তারা প্রতিবেশীর প্রভাবেই প্রভাবিত। কিন্তু ঐ সময় মুহাম্মদ বিন কাসিমের পক্ষে আত্মহত্যা করা কোনমতেই সম্ভব ছিল না।
এ ছাড়া আরও এক কারণে এরূপ ঘটনা মিথ্যা বলে বিবেচিত হচ্ছে। সেটা হচ্ছে এই যে, ইসলাম ধর্মের সংবিধানে আসামি বাদী ও সাক্ষী ছাড়া অপর কারাের মুখ হতে কিছু শুনে (সত্য মিথ্যা যা হােক) আসামির বক্তব্যকে ব্যক্ত করতে না দিয়ে দূর হতে আদেশ বা নির্দেশ পাঠিয়ে কোন কিছু নির্ধারণ করা সম্পূর্ণ নীতিবহির্ভূত। অতএব যদি ঐ ঘটনা সত্যই হতাে তাহলে মুহাম্মদ বিন কাসিমকে জানানাে হতাে এবং তার কী অভিযােগ তা জানিয়ে সেই পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর বক্তব্য শােনার পর সুবিচার-অবিচার যাই হােক হতে পারত। কিন্তু তাঁকে জীবন্ত আসতেই দেওয়া হল না; বরং কাটা গােচর্মে মুড়িয়ে তার মৃতদেহ আনানাে হল-এটা সবই অবিশ্বাস্য ও ভ্রান্ত। আবার যদি শূকরের চামড়া মুড়িয়ে আনার নির্দেশ থাকত তবে খলীফার ক্রুদ্ধ হওয়ার প্রমাণ হতাে। কিন্তু মিথ্যা ইতিহাসে অর্থাৎ ইংরেজ ও তাদের দালাল দ্বারা লিখিত ইতিহাসে গরুর চামড়ার কথা বলা হয়েছে। অথচ গরুর চামড়া মুসলমানদের নিকট অপবিত্র নয়, যেমন অপবিত্র নয় খাসি বা হরিণের চামড়া ঠিক তেমনিই।
আসল কথা মুহাম্মদ বিন কাসিম স্বাভাবিকভাবে মারা গিয়েছিলেন। তাঁর ন্যায় বিখ্যাত বীরের মৃতদেহ রাজকীয় মর্যাদার সাথে উপযুক্ত স্থানে কবর দেবার জন্যই ম্যমি করার মত চামড়া সদৃশ মূল্যবান সাদা মখমল কাপড়ে মুড়া অবস্থায় কাঠের বাক্সে করে পৌঁছেছিল।
শ্রী ঘােষ আরও লিখেছেন, “নারীর মর্যাদা কলঙ্কিত হইতে পারে এই আশঙ্কায় তিনি (রানী) এবং দুর্গের ভিতরে অন্য মহিলারা অগ্নিকুণ্ডে ঝাঁপাইয়া পড়িয়া জীবন বিসর্জন দেন।” এখন আলােচনায় আসা যাক। যদি এটা সত্য হয় তাহলে দাহিরের সুন্দরী কন্যাদ্বয় মৃত্যুর পরে কী আবার বেঁচে উঠেছিল? নতুবা তারা তাে অগ্নিতে ঝাঁপ দেন নাই। তাহলে ইজ্জত নষ্ট হতে পারে, এই আশঙ্কাই যদি সত্য হয় তবে তাদের বােঝা উচিত ছিল আমাদের যেখানে পাঠানাে হবে সেখানেও এই কাজের পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে। অতএব বিধবা মা অপেক্ষা কুমারী কন্যাদের আগেই মৃত্যুবরণ করা উচিত ছিল। কিন্তু তা যখন হয়নি তখন নিঃসন্দেহে এহেন এক ঘৃণ্য ধারণার অযৌক্তিকতা প্রতিপন্ন হয়।
লেখক আরও লিখেছেন, “খলীফার আদেশ আল্লাহর আদেশের মতাে”। এটি মুসলমানদের মনে গভীর দুঃখ দিতে বাধ্য। কারণ আল্লাহর মত কোন কাউকে মনে করা বা বিশ্বাস করাকেই ইসলাম শিরক অংশীদারীত্ব বলে। আর এই “শিরক” সমস্ত অপরাধের চেয়ে মারাত্মক আর তা মার্জনার অযােগ্য প্রায়। অতএব “খলীফার আদেশ আল্লাহর আদেশের মতাে” এই উক্তির মধ্য দিয়ে বিশ্ব মুসলিমকে অমুসলিম সাব্যস্ত করার পশ্চাতে কোন মনােভাবের পরিচয় নিহিত আছে পাঠকবর্গই তা চিন্তা করবেন।
(শ্রী ঘােষ আরও জানিয়েছেন, “হিন্দুদের নিকট হইতে তাঁহারা রাষ্ট্রশাসন ব্যবস্থা শিক্ষা করিলেন।”)
যদি উপযুক্ত মত সত্য হত তবে ভারতবাসী অর্থাৎ আমরাই আরব জয় করতাম, জয় করতাম আফ্রিকা, ইউরােপ, আমেরিকা। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তা সম্ভব হয়নি, বরং আমাদরে ভারতের সাথে আরবের তুলনা করলে দেখা যাবে আরব সভ্যতাই সারা বিশ্বে প্রভাব সৃষ্টি করেছে ও ধর্মমত প্রচার করেছে। কী ইতিহাসে, কী বিজ্ঞানে, কী ভূগােলে, কী গণিতে, কী সংস্কৃতে, কী দর্শনে, কী চিকিৎসা বিজ্ঞানে, কী মানচিত্র অঙ্কনে, কী জ্যোতির্বিজ্ঞানে, কী রাষ্ট্র বিজ্ঞানে, কী সমাজ বিজ্ঞানে মুসলমানরাই ছিল সারা বিশ্বের গুরু। আরব ভূমিই ছিল বিশ্বের জ্ঞান সাগরের উৎসকেন্দ্র। অতএব মুসলমানরা হিন্দুদের কাছে জ্ঞান শিক্ষা করেছে। এরূপ ধারণা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত। তাছাড়া নিজের ধর্ম ও সমাজ মানুষ তখনই ত্যাগ করে যখন সে বােঝে আমাকে আমার চাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে যা পাওয়া দরকার তা এর দেবার ক্ষমতা নাই। আর নতুন ধর্ম যখন গ্রহণ করে তখন এই কথাই বােঝে, আমি যা পাই না তা পাব এই পন্থায় । কিন্তু হিন্দুধর্ম অপরকে নিজের মধ্যে টেনে নিতে পারেনি বরং অপর ধর্মকে ভারত হতে তাড়িয়ে দিয়েছে। যেমন বৌদ্ধধর্ম অথবা নিজেরা মুসলমান ও খ্রিস্টান প্রভৃতি ধর্ম ও সমাজে প্রবেশ করে তাদের সমৃদ্ধি বৃদ্ধি করেছে। অতএব বলা যায়, “তাহারা রাষ্ট্রশাসন শিক্ষা করিলেন” কথাটি কল্পনাপ্রসূত।
ইংরেজি ইতিহাসের সবকিছু বর্জন করার বস্তু তাও যেমন আমাদের মত নয়, তেমনি এ কথাও বিশ্বাস্য যে সুযােগ বুঝে ইংরেজি ইতিহাসের উদ্ধৃতি দিয়ে মিথ্যা ইতিহাসের প্রচারের অপচেষ্টাও অনুচিত।
মুহাম্মাদ বিন কাসিমের বিজয় কীর্তি যখন পৃথিবীর বুকের ওপর সূর্যালােকের মত ছড়িয়ে গেল তখন তাঁর বয়স মাত্র ১৭ বছর। এতবড় বৃহৎ বৈশিষ্ট্যময় বীরের বীরত্বকে ম্লান আর মিথ্যায় পরিণত করতে তাঁর মৃত্যু নিয়ে মিথ্যা কল্পনাকের গল্প আর কিংবদন্তীকে ইতিহাস বলে খাপ খাইয়ে দেশের উন্নতি নয় বরং অবনতির ইন্ধনের যােগান দেবার উকট প্রচেষ্টাকে আজকাল সুধী সমাজ বরদাশত করতে পারেন না কোনক্রমেই। ইতিহাসকে যাঁরা তাঁদের উপন্যাস আর ছায়াছবি, নাট্যমঞ্চের ভেতর দিয়ে পাল্টাতে চান তাদের মনে রাখা উচিত যে, ইতিহাস নিয়ে কলম ধরার অধিকার তাদের নেই। কারণ এই উল্টানাে বা পরিবর্তন ইতিহাসের ক্ষেত্রে দুর্গন্ধময় গলিত কুষ্ঠ। দস্তুর মত ঐতিহাসিক দলিল নিয়ে প্রমাণ করা যায় যে, মুহাম্মদ বিন কাসিমের মৃত্যু হয়েছিল রাজনৈতিক কারণে নয় বরং আকস্মিকভাবে।
অবশ্য তার যখন মৃত্যু সম্বন্ধে আধুনিক ঐতিহাসিকগণ আজও এক মত নন। কেউ কেউ মনে করেন মুহাম্মদ বিন কাসিম আততায়ী কর্তৃক নিহত হয়েছেন আবার কেউ খলীফার চক্রান্ত হত্যা বলে মনে করেন। মােটকথা অল্প বয়সে তাঁর আকস্মিক মৃত্যু হয় তাতে কারাে সন্দেহ নেই। সন্দেহ শুধু ঐ পদ্মা দেবী আর সূর্য দেবীর কেচ্ছা-কাহিনীতে। ঐ মিথ্যা ঘটনায় এও উল্লেখ আছে, মুহাম্মাদ বিন কাসিমের প্রাণদণ্ডের পর সুন্দরীদ্বয় খলীফার কাছে স্বীকার করেছিলেন যে, “মুহাম্মদ সাধু চরিত্রের লােক, আমাদের আত্মীয়-স্বজনদের মৃত্যুর প্রতিশােধের জন্য আমরা তার ওপর মিথ্যা অভিযােগ করেছি।” তখন খলীফা অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হয়ে দুই বােনকেই হত্যার আদেশ দিলেন। ফলে তাদের উভয়কেই প্রাণদণ্ড দেওয়া হয়েছিল।
শ্রী ঘােষ তাঁর ইতিহাসে লিখেছেন, “দাহিরের দুই কন্যাকে বন্দি করিয়া কাসিম খলীফার হারেমের জন্য পাঠাইয়া দিয়াছিলেন।” অর্থাৎ আপনা আপনিই অক্ষরে অক্ষরে ফুটে উঠছে, খলীফা ব্যভিচারী বা নারীভােগী ছিলেন, তাই কুমারী নারী পেলেই সেনাপতিরা খলীফার ভােগের জন্য পাঠিয়ে দিতেন। কিন্তু শিক্ষিত সমাজ আজ চিন্তা করতে শিখেছে; তাই তারা বেশ বুঝতে পারছেন, নারীভােগী মুসলমান অবিবাহিতা রাজকুমারীর মত দুইজন সুন্দরী শিকার হাতে পেয়ে তাদের মায়াকান্না আর অভিমানের বায়না মিটাতে গিয়ে মুহাম্মদ বিন কাসিমকে মৃত্যুদণ্ড দিতে পারেন- এটা যদি সত্য হয় তাহলে মুহাম্মদ বিন কাসিমের মৃত্যুর পর যখনই ঐ সুন্দরীদ্বয়ের স্বীকারােক্তিতে বুঝতে পারলেন যে, তারা মুহাম্মদ বিন কাসিমের ওপর মিথ্যা অভিযােগ করেছিল সঙ্গে সঙ্গেই তাদের মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করলেন। লম্পট চরিত্রের স্বাভাবিক নিয়মে তা হয় না। লম্পট ব্যাভিচারীদের বিজাতি, কুমারী-অকুমারী ভেদাভেদ থাকে না। আর যেখানে ঐ রাজকন্যাদের রূপের মােহে পাগল হয়ে বাদীপক্ষের কোন মন্তব্য, কোন কৈফিয়ত না শুনেই খলীফা মুহাম্মদ বিন কাসিমকে প্রাণদণ্ড দিতে পারলেন তখন ঐ রূপলাবণ্য, সৌন্দর্যে আভিজাত্যের অভিনব জীবন্ত প্রতীক সুন্দরীদের হত্যা করা লম্পট চরিত্রের পক্ষে অবশ্যই অস্বাভাবিক। সুতরাং খলীফার চরিত্রের ওপর অভিযোেগ এবং মুহাম্মদ বিন কাসিমের প্রতি নারী সরবরাহের অভিযােগ কল্পনার ইতিহাস মাত্র।
অতএব এই প্রকার ঐতিহাসিকতা অনেকের মতে ভারতের উন্নতির পরিপন্থী এবং অবনতি আর অঘটনের কারণ।
আমাদের মনে রাখতে হবে, ইংরেজ বা তাদের পােষা বান্ধব বা দালাল দ্বারা লিখিত ঐতিহাসিক তথ্য যেমন পরিহার যােগ্য তেমনি এও মনে রাখতে হবে, প্রত্যেক জাতি বা গােত্রের প্রত্যেক ঐতিহাসিক একই ছাঁচে ঢালা নন। তাছাড়া একজন দুষ্ট ঐতিহাসিকের সমস্ত তথ্য বা বাক্যই পঙ্কিল পরিকল্পনাপ্রসূত নয়। তবে ঐতিহাসিকতা পরিবেশনের সময় অবশ্যই মনে রাখা দরকার আমি যা লিখছি তা পড়ে দেশ জাতি তথা সারা ভারতের মানুষ উপকৃত হবে না অপকৃত হবে? যদি হিন্দু মুসলমান বা এক জাতি অপর জাতির মাঝখানে সাম্প্রদায়িকতার প্রাচীর খাড়া করা যায় তাহলে প্রাচীরের সংখ্যা যত বেশি হবে ভারত তত টুকরাে টুকরাে বা খণ্ডিত হবে। গতকালের বিরাট ভারত আজ ত্রিভাগে বিভক্ত। তার জন্য সম্পূর্ণ দায়ী সমাজের সেইসব লােক, যারা নেতা বলে পরিচিত হয়ে সরল, সবল, স্বচ্ছ ও সুন্দর নেতৃত্বের পরিবর্তে দেশকে দিয়েছেন নির্লজ্জ সাম্প্রদায়িকতা, সংকীর্ণতা, ছুতমার্গ আর দালালীপূর্ণ নকল নেতৃত্ব। অনেকের মতে তাদের অপরাধ অমার্জনীয় আর অনেকের মতে, যা হবার হয়ে গেছে তার পুনরাবৃত্তি না ঘটতে দিয়ে অশুদ্ধ ও বিষাক্ত ঐতিহাসকে বিশুদ্ধ ও উপযােগী করে সত্যের সঠিকতা বজায় রেখেই ভারতের উন্নতির পরিপ্রেক্ষিতে এমন তথ্য ছাত্রছাত্রী বা দেশবাসীর সামনে তুলে ধরা, যা এক জাতি অপর জাতিকে তথা এক সম্প্রদায় অপর সম্প্রদায়কে বন্ধু বলে মনে করতে পারে। যিনি বা যারা এই অসাধ্য সাধন করতে পারবেন তারাই হবে প্রকৃত ইতিহাস বিজ্ঞানী।
‘নবজাগরণ’ অ্যান্ড্রোয়েড অ্যাপ্লিকেশনটি প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর টেলিগ্রাম চ্যানেলে জয়েন হতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর ফেসবুক পেজে লাইক করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।