হুগলী জেলায় বালিয়াবাসন্তী গ্রামে ১২৩৬ হিজরী সনে মওলুবী হাজী মােঃ মােকতাদির সাহেবের আবু বকর নামে এক সুযােগ্য সন্তান জন্মগ্রহণ করেন। আধ্যাত্মিকতায় তিনি অসাধারণ উন্নতি সাধন করেছিলেন। পরে তিনিই হয়েছিলেন ফুরফুরা শরীফের হযরত আবু বকর সিদ্দিকী (রহ.) সাহেব।
বালিয়াবাসন্তী গ্রামের নাম পরিবর্তন করে ‘ফারে ফারাহ’ কিংবা ‘ফর ফরা’ রাখা হয়েছিল। পরে তা থেকে পরিবর্তিত হয়ে হযরতে ‘ফুরফুরা’ নামে খ্যাতি লাভ করে। তিনি মুরীদ হয়ে ছিলেন হযরত সৈয়দ ফাতেহ আলীর (র.) নিকট। আর হযরত ফাতেহ আলীর (র.) পীর ছিলেন হযরত সুফী নূর মােহাম্মদ (র.) সাহেব। আবার হযরত নূর মােহাম্মদ সাহেবের (র.) পীর ছিলেন হযরত সৈয়দ আহমদ ব্রেলবী (রহ.)। যিনি বিশ্ব বিখ্যাত পীরে কামেল ছিলেন আবার ভারতে স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রধান নায়কও ছিলেন। ইংরেজদের বলে বলীয়ান শিখ যুদ্ধে তিনি শহীদ হন। আঘাতপ্রাপ্ত ইংরেজ তার ওপর ক্রোধ ও ঈর্ষা বশত ‘ওহাবী’ বলে আখ্যা দিয়েছে। অথচ ওহাবী বলে কোন দল ভারতে কোন দিনই ছিল না, আজও নেই। অবশ্য অধুনা যাদের ওহাবী বলে আমরা প্রচার করে থাকি তাদের কেউ-ই আদৌ ওহাবী নয়; বরং অন্য কিছু হতে পারেন।
যাইহােক, সুফী হযরত আবু বকর সিদ্দিকী (রহ.) বাংলা ১৩৫৪ সালে ৩ চৈত্র ৫টা ৪৫ মিনিটে ইহধাম ত্যাগ করেন। বাংলা তথা ভারতের মানুষ আজও তার নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে।
সংক্ষিপ্ত পরিচয়
প্রত্যেক ফকির ও অলিআল্লাহর জীবনী যদি মাঝারিভাবেও লেখা যায় তাহলে অন্তত এক হাজার জীবনী কমপক্ষে ইতিহাসে স্থান পাবেই। সুতরাং তা পৃথক পুস্তকেই সম্ভব। তাই সংক্ষেপে বলা যায়, হযরত বাইজিদ বােস্তামীও ঐ রকম একজন ফকির ৮৭৫ খৃস্টাব্দে তিনি পরলােকগমন করেন। এমনিভাবে হযরত শাহ সুলতান বলখী যিনি ৭৮৩ খৃস্টাব্দে দেহত্যাগ করেন। ১০৫৩ খৃস্টাব্দে আগমন করেন হযরত শাহ মুহাম্মদ সুলতান রুমী। বাবা আদম শহীদও ভারতের উল্লেখযােগ্য ফকির। তাঁর মৃত্যুর সঠিক তারিখ পাওয়া যায় না, তবে সুলতান জালালুদ্দিন ফতেহশার শাসনকালে ১৪৮৩ খৃস্টাব্দে নির্মিত একটি মসজিদের শিলালিপি হতে তাঁর বিশেষ পরিচয় পাওয়া যায়। শাহ নিয়ামতুল্লাহ ঢাকা শহরে ইসলাম প্রচারক হিসেবে উল্লেখযােগ্য। তাছাড়া মঙ্গলকোটে মখদুম শাহ গজনভী, বীরভূমের আবদুল্লাহ সাহেব, ঢাকার সৈয়দ আলী তাবরেজী, বগুড়ার শাহতুকান শহীদ, পাবনার মখদুম শাদৌল্লা (র.) উল্লেখযােগ্য ফকির ছিলেন।
রাজা লক্ষ্মণ সেনের রাজত্বের শেষের দিকে ১২১৩ খৃস্টাব্দে জালালুদ্দিন তাবরেজী লক্ষ্ণৌতে এসেছিলেন ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে। ঠিক তার দশ বছর পূর্বে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ারের বঙ্গের রাজধানী লক্ষনাবতী ও নবদ্বীপ বিজয়ের ঘটনা ঘটে। এমনিভাবে আর একজন জালাল সাহেবের নাম ইতিহাসে পাওয়া যায়। অনেকে দুজনকে একই মনে করেন কিন্তু তা নয়। মালদহ জেলার জালাল সাহেব ১৩ শতাব্দীর এবং সিলেটের শাহ জালাল সাহেব ১৪ শতকের ফকির ছিলেন। (দ্রঃ Social and Cultural History of Wast Bengal)
শেখ বাহাউদ্দিন জাকারিয়া সাহেবও নেতৃস্থানীয় ফকির ছিলেন। আখি সিরাজুদ্দিন ও শেখ আলাউল হক যথাক্রমে ১৩৪২ ও ১৩৮৪ খৃস্টাব্দে দেহত্যাগ করেন। এরা উভয়েই সুফী ঐ ফকির ছিলেন। আলাউল হকের এক প্রখ্যাত পুত্র নূর কুতুবুল আলমও পিতা অপেক্ষা বেশি প্রভাবশালী ছিলেন। রাজা কংসকে আক্রমণ করার জন্য সুলতান শরকী এক বিরাট সেনাবাহিনী পাঠান। রাজা যুদ্ধ সম্ভব নয় ভেবে ফকির সাহেবের আশীর্বাদ প্রার্থী হন। কুতুব সাহেব বললেন, আমার দোয়া প্রার্থনা করার চেয়ে আপনি আমার মত হয়ে যান না? শুধু ইসলাম মেনে নিলেই তা সম্ভব। তিনি সপরিবারে মুসলমান হতে চাইলেন কিন্তু তার স্ত্রী বাধা দেওয়ায় তাঁর পুত্র যদুকে ইসলাম ধর্মে দান করলেন। কুতুব সাহেব তার নাম জালালুদ্দিন রাখলেন আর সুলতান শর্কী একটি ছােট্ট পত্র লিখলেন, যাতে তিনি কংসকে আক্রমণ না করেন। পত্র পেয়ে তিনি বিনা বাক্যে ফিরে গিয়েছিলেন। কুতুব সাহেবের কথামত যদুকেই সিংহাসনে বসানাে হয়েছিল। কিন্তু বিপদ কেটে যাওয়ার পরেই অত্যাচারী কংস পুত্রকে সরিয়ে নিজে সিংহাসনে বসে দনুজমর্দন নাম ধারণ করলেন এবং এক নিরেট সােনার গাভী তৈরি করে ব্রাহ্মণদের পরামর্শ অনুযায়ী টুকরাে টুকরাে করে কেটে তা ব্রাহ্মণদের মধ্যে দান করে দিলেন। অতঃপর জালালুদ্দিনকে আবার যদুতে পরিণত করা হলাে। এইবার কংস পূর্বাপেক্ষা মুসলমানদের ওপর অমানবিক অত্যাচার করতে থাকেন এবং কুতুব সাহেবের পণ্ডিত পুত্র আনােয়ারকে হত্যা করলেন। তাছাড়া আরও দুজন দরবেশ বদরুল আলম ও শেখ হােসাইনকে রাজা হত্যা করেন। কুতুব সাহেব পুত্রের মৃত্যুর প্রতিশােধে প্রতিবাদ কিছু না করে দু-রাকাত নামায পড়ে আল্লাহকে বললেন, বিচার তুমিই কর। রাজা অসুস্থ হলেন, শুধু প্রতি রাতে দুঃস্বপ্ন দেখতে থাকেন এবং কয়েক দিনের মধ্যেই তিনি মৃত্যু মুখে পতিত হন।
এই বার নূর কুতুব আলম সাহেব যদুর সঙ্গে দেখা করলেন। যদু দেখলেন কুতুব সাহেব হাসিমুখে দাঁড়িয়ে কথা বলছেন অথচ তাঁর পা মাটিতে লেগে নেই। তিনি আবার মুসলমান হলেন, এবং পূর্ব নাম গ্রহণ করলেন। তিনি ব্রাহ্মণদের ডাকলেন যারা স্বর্ণ গাভীর ভাগ নিয়েছিলেন। কৈফিয়ত চাইলেন এই নতুন বিধান ধর্মের কোন পুস্তকে আছে? কিন্তু প্রমাণাদি দেওয়া সম্ভব হয়নি। তখন তিনি বললেন, আপনাদের প্রত্যেককে গােমাংস খেতে হবে কারণ সােনার গাভীর যেমন করে ভাগ বণ্টন করে খেয়েছেন তেমিন করে মাংসের গাভীও খেতে হবে। এই আপনাদের মনমত ধর্ম বিধান তৈরির শাস্তি। বাধ্য হয়ে সকলকে তা খেতে হয়েছিল। এই গুরুত্বপূর্ণ তথ্যটুকু না জানা থাকলে জালালুদ্দিনের এই বাড়াবাড়ি বিচার ব্যবস্থার জন্য মুসলমান জাতি আর মহান ইসলাম দুটোই দায়ী হতে পারে। তাছাড়া হয়েছেও অনেক ক্ষেত্রে। ১৪১৫ খৃস্টাব্দে কুতুব সাহেবের পরলােক। প্রাপ্তি হন।
উপরােক্ত শহীদ আনােয়ার বিখ্যাত ওলি বা ফকির ছিলেন। কুতুব সাহেবের যাহেদ নামে এক পুত্র তিনিও বিখ্যাত ফকির ছিলেন। ১৪৫৫ সালে তিনি দেহত্যাগ করেন।
শেখ হুসামুদ্দিন (ম: ১৪৭৭), বিয়াবাণী, শাহগাদা, শাহ কাকু (মৃ: ১৪৭৭ খৃ:) উলুগই আজম খাঁর পরিচয় পশ্চিম দিনাজপুরের গঙ্গারামপুরে প্রাপ্ত শিলালিপিতে প্রমাণিত হয়। শিলালিপিটি মসজিদে বসানাে হয়েছিল। ১২৯৭ খৃ: ১৯ অক্টোবর। তিনিও ইসলাম প্রচারক ছিলেন।
শাহদৌল্লা শহীদের কবর রয়েছে পাবনায়। তখন অমুসলমান রাজা তার ইসলাম প্রচারে অসন্তুষ্ট হয়ে তাঁকে এবং তাঁর ২১ জন নামজাদা সঙ্গীকেও শহীদ করেছেন। সব কবর এক জায়গায় সারিবদ্ধভাবে সাজানাে আছে। মুহাম্মদ আতা ১৩৬৫ খৃস্টাব্দে দেহত্যাগ করেন। তিনিও উচ্চ শ্রেণীর ফকির ছিলেন। শাহ মােয়াজ্জেম বাগদাদ হতে এসেছিলেন তখন বঙ্গে সুলতান নসরৎ খানের শাসনকাল চলছিল। তিনি ১৫১৯ হতে ১৫৩২ খৃ: পর্যন্ত সিংহাসনে ছিলেন। রাজা হুসেন শাহের রাজত্বকাল ১৪৯৩ হতে ১৫৫৯ খৃ: পর্যন্ত ঐ সময়ে বিখ্যাত ফকির মাখদুম জালালুদ্দিন রূপােস আরব হতে আগমন করেন। নির্যাতিত অনেক অমুসলমান তাঁর উদারতা, সেবা ও চরিত্র মাধুর্যে মুগ্ধ হয়ে মুসলমান হয়। ১১৭ বছর বয়সে ১৫৯২ খৃস্টাব্দে তিনি ধরাধাম ত্যাগ করেন। শেখ বদরুদ্দিন দিনাজপুরে সমাধিস্থ। তার ইসলাম প্রচার এবং রাজা মহেশের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতার। ইতিহাস যদিও নানা মতের ওপর দোদুল্যমান তবুও রাজা মহেশের রাজবাড়িতেই তাঁর সমাধি দেখে একটা সঠিক সিদ্ধান্ত না দেয়ার মত কোন কারণ নেই।
এমনিভাবে শরীফ জিন্দানী, শাহ কলন্দর প্রমুখ সাধক প্রবর যথাক্রমে ঢাকা ও রংপুরে সমাধিস্থ। শাহ তুর্কান শহীদের নামও ভােলার মত নয়। তাছাড়া প্রকৃত ফকির মােবাল্লিগদের মধ্যে শেখ ইয়াহিয়া (কুমিল্লা), শাহ মুহাম্মদ বাগদাদী, কুতুবুল আওলিয়া, শাহ কামাল, সৈয়দ মীরণ শাহ, শাহ মালেক ইয়ামিন, কুতুবশা প্রমুখ মনীষীও পণ্ডিত প্রমুখের নাম সবিশেষ উল্লেখযােগ্য। এমনিভাবে ১২৬০ খৃষ্টাব্দে এসেছিলেন শেখ শরীফুদ্দিন আবু তাওয়ামাহ। তখন গিয়াসুদ্দিন বলবনের রাজত্বকাল চলছিল। শাহ আলী বাগদাদী, শাহ মান্নাহ জালাল হালবী, বদর শাহ, শেখ ফরিদ, ও শাহ আদম কাশ্মীরি, হাজী সালেহ প্রমুখ মনীষী বিরাট বিরাট প্রতিভা ও সাফল্যের অধিকারী ফকির ছিলেন। এরা যথাক্রমে ১৫৭৭, ১৮৮৩, ১৫৩৭, ১৪৪০, ১২৬৯, ১১০৯ ও ১৫০৬ খৃষ্টাব্দে পরলােকগমন করেন। এমনি আরও মুবাল্লিগদের মধ্যে শাহ সুফী শহীদ যিনি ১২৯৫ খৃস্টাব্দে শহীদ হন পাওয়াতেই তাঁর সমাধি আছে, জাফর খা গাজী ১৩১৩ খৃস্টাব্দে দেহত্যাগ করেন। তাঁর কবর আছে ত্রিবেণীতে, আনােয়ার কুলী হালবী হুগলি জেলার মােল্লাসিমলায় কবরস্থ হয়েছিলেন। মক্কা শরীফ থেকে এসেছিলেন সৈয়দ আব্বাস সাহেব, ডাক নাম গােরাচঁদ। সম্রাট গিয়াসুদ্দিন তােঘলকের সময়ে নিজের পীর শাহ হাসানের সঙ্গে ১৩২১ খৃস্টাব্দে বঙ্গে ২৪ পরগনা জেলায় ইসলাম প্রচার করতে চেষ্টা করেন। অনেক অলৌকিক ঘটনাও ঘটেছিল তাঁর জীবনে। তবুও তাকে অনেক বিপদের সম্মুখীন হতে হয় এবং শেষে ১২৬৫ খৃস্টাব্দে শহীদ হতে হয়। চদ্রকেতু নামক এক রাজাই ছিলেন তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী। আব্বাস সাহেবের এক বােনের নাম ছিল রওশনারা, তিনিও আধ্যাত্মিকতায় পূর্ণ প্রাপ্তা বিদূষী ছিলেন। তিনিও তার ভাইয়ের সঙ্গে মক্কা হতে একই সাথে এসেছিলেন। হাড়ােয়ায় তাঁর কবর হয়েছিল। শরীক শাহ গাজী সম্বন্ধে তার জন্ম ও মৃত্যুর সঠিক তারিখ দেওয়া কঠিন, তবে আব্বাস সাহেবের সঙ্গী অথবা সমসাময়িক ব্যক্তি হতে পারেন। তার কবর ঘুটিয়ারী শরীফে বর্তমান। এমনিভাবে বরখান গাজী, মুবারক গাজী প্রমুখ বিজয়ীদের নামও স্মরণীয়। দিগ্বিজয়ী তৈমুরের সময় এসেছিলেন তবলীগ করার জন্য সৈয়েদুল আরেফিন। তাঁর আসল নাম এটি নয়, এটি হচ্ছে তাঁর উপাধি, যার অর্থ হচ্ছে। ফকিরদের সর্দার। একদিল শাহও ছিলেন বিখ্যাত বুজুর্গ, যিনি বারাসতে কবরস্থ। খানই জাহান খুলনায় সমাধিস্থ। এরা সকলেই ইসলাম ধর্মের প্রচারক ছিলেন।
শাহ মাহমুদ গজনভীর সমাধি মঙ্গলকোটে আছে। রাজা বিক্রমকেশরী নামক এক হিন্দু রাজার সময়ে তিনি ইসলামের আদর্শ স্থাপনের চেষ্টা করেন। অনেকে তাঁর শিষ্যের তালিকাভুক্ত হন। কিন্তু রাজা কেশরী, মাহমুদ এবং তার শিষ্যদের ওপর নানাভাবে অত্যাচার করেন। ঐ সময় দিল্লী হতে সম্রাটের পক্ষ হতে একটি ফারসী ভাষায় লেখা পত্র নিয়ে এক দূতের আগমন ঘটে। কিন্তু রাজা। ঐ পত্রের পূর্ণ পাঠোদ্বারের জন্য ফকির সাহেব মাহমুদকে দরবারে ডাক দিলেন। তিনি তা পড়ে দিলেন। তাতে জানতে চাওয়া হয়েছিল তার অত্যাচার সম্বন্ধে। ফারসী ভাষাতে রাজা বিক্রম কেশরীর কথামত উত্তরও তাঁকেই লিখতে হয়েছিল। তিনি সবকিছু লিখে নিজেও এক কলম নিজের তরফ হতে লিখেছিলেন, যার মর্মার্থ অত্যাচারী রাজার বিরুদ্ধে ব্যবস্থাবলম্বন করুন। কিছু দিনের মধ্যেই রাজার বিরুদ্ধে একদল সৈন্যের আগমন ঘটে। উভয়পক্ষে যুদ্ধ হয়। রাজা বিক্রম পরাজিত হন এবং দেশ ত্যাগ করেন। এ ব্যাপারে শােক শুভােদয় গ্রন্থ হতে একটি সংস্কৃত শ্লোক সবিশেষ প্রণিধানযােগ্য- “পূর্বে বিক্রমাদিত্যস্য সভায়াং আকাশৎ পত্ৰং প্রতিতান্তে চতুবিংশােত্তরে শকে সহস্রক শতাধীকে। বেহার পাটনাৎ পূর্বং তুরস্ক সমুপাগত:” অর্থাৎ এখানে প্রমাণিত হচ্ছে পত্রটি দিল্লী হতে আকাশ থেকে পড়ার মত আকস্কিক পত্র আর তুর্কীদের দ্বারা একশত চব্বিশ শকাব্দে পাটনার পূর্বদিকে মুসলমান বিজয়ের বার্তা। তবে এই বিক্রমকেশরীই রাজা বিক্রমাদিত্য কি না তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে কিছু মতভেদ আছে। কিন্তু দরবেশ মাহমুদের উল্লেখযােগ্য ভূমিকা যে এ ঐতিহাসিক সত্য এ বিষয়ে সন্দেহ নেই।
এমনিভাবে শত সহস্র ফকির, আওলিয়া, দরবেশের ছােট বড় দল দিকে দিকে ভারত তথা সারা পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়তেন। বহু জায়গায় তাঁদের তবলীগ জামাত বা প্রচারকদলকে হত্যা করে শেষ করে দেওয়া হয়েছে। একথা শুধু স্বাভাবিক নয়, সত্য ও তথ্যযুক্ত বটে। যেমন রাজশাহী জেলার পাহাড়পুর বৌদ্ধ স্কুপে প্রত্নতাত্মিকগণ মাটির নিচ হতে বাগদাদের খলিফার নাম লেখা স্বর্ণমুদ্রা উদ্ধার করেছেন, তাতে তারিখ দেওয়া আছে ১৭২ হিজরী সন অর্থাৎ ৭৮৮ খৃস্টাব্দ। সংবাদে আরও প্রকাশ, কুমিল্লার ময়নামতি খননান্তে আরবী অক্ষরবিশিষ্ট স্বর্ণমুদ্রা পাওয়া গেছে। মহাপণ্ডিত ডঃ ইনামুল হক লিখেছেন,
“আমাদের বিশ্বাস কোন ইসলাম প্রচারকের দ্বারা পাহাড়পুরের কোন বৌদ্ধ বিহারে এই মুদ্রা নীত হয়। সম্ভবত তিনি স্বর্ণমুদ্রা সঙ্গে নিয়ে তথায় ইসলাম প্রচার করতে গমন করেন। তখন তিনি বৌদ্ধদের হাতে প্রাণ হারিয়েছিলেন এবং তাদের মুদ্রাটি বৌদ্ধ ভিক্ষুদের হস্তগত হয়েছিল।”
মােটকথা, প্রত্যেক ফকির আওলিয়াদের চরিত্র আলােচনা করলে আমরা সর্বগুণের সমন্বয়ে এক জীবন্ত আদর্শ ও নিখুঁত চরিত্রের সন্ধান পাই। অবশ্য একথাও ঠিক যে, নিছক বিদ্বেষ আর ঈর্ষার বশবর্তী হয়ে কিছুসংখ্যক কলমনবীশ তাঁদের চরিত্রের ঐতিহাসিক অবদানকে অস্বীকার করে তাঁদের ওপর ‘পঞ্চম বাহিনী’, ‘গুপ্তচর’ প্রভৃতি অভিযােগ ও অপবাদ আরােপ করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু প্রকৃত ঐতিহাসিকগণ তা অস্বীকার করেছেন। আমাদের দেশীয় ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকারও তীব্রভাবে প্রতিবাদ করে বলেছেন,
“We have no reason to hold that these warriors in the path of Aleah were so degenerate as to act as fifth columnist of the Muslim State against the other,” (History of Bengal, vol-2, p-76 দ্রঃ)
অর্থাৎ আমরা এ কথার সমর্থনে কোন কারণই খুঁজে পাই না যে, আল্লাহর পথে এই সমস্ত পরিশ্রমী সাধকরা অপর রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে মুসলিম রাষ্ট্রের পঞ্চম বাহিনীর ন্যায় অধঃপতিত। শ্ৰীযুক্ত বিমান বিহারী মজুমদার মহাশয়ও এই তাপস শ্রেণীর কৃতিত্ব ও চরিত্র অঙ্কন করতে গিয়ে বলেছেন,
“হিন্দু ধর্মের পুনঃঅভ্যুত্থানের দ্বিতীয় শত্রু হয়েছিল মুসলমান ধর্ম। এক শ্রেণীর লােক পীর ও তাপসগণের মহান ধর্ম প্রবণতায় আকৃষ্ট হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন।” (দ্রঃ বৈষ্ণব সাহিত্যে সামাজিক ইতিহাসের উপকরণ নামক প্রবন্ধ)
সমস্ত ফকির দলের সম্মানে আমরা যথাযথ ভক্তি প্রদর্শন করে পাঠক-পাঠিকাদের জ্ঞাতার্থে লিখি যে, ফকির আরবী শব্দ অর্থ ভিখারী কিন্তু উপরােক্ত দরবেশ, পীর, ওলী বা তাপস দল কোন মানুষের দরবারের ভিক্ষুক নন, বরং তারা আল্লাহর দরবারের সায়েল (ভিক্ষুক)। আজকাল প্রকৃত পীর বুজুর্গদের কথা অবশ্য স্বতন্ত্র। কিন্তু অনেক গাজারে বেনামাজী বেশরিয়তী ধোঁকাবাজ সমাজধ্বংসী ভণ্ড পীর, যারা ধর্ম নিয়ে ছিনিমিনি খেলে তাদের সঙ্গে এদের কোন মিল নেই এবং বৈপরীত্যের বৈচিত্র্যই পরিলক্ষিত হয় সর্বাংশে। তাই ব্যথিত হৃদয়ে বলব, মুসলিম মহা মনীষীদের জীবন ইতিহাস আজ সমাজের মানস পট হতে বহু দূরে নিক্ষিপ্ত হলেও প্রকৃত বিশ্ব ইতিহাসের পাতায় তাঁদের স্বর্ণোজ্জ্বল জীবনালেখ্য যুগ যুগান্তর ধরে জীবন্ত আছে ও থাকবে।
‘নবজাগরণ’ অ্যান্ড্রোয়েড অ্যাপ্লিকেশনটি প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর টেলিগ্রাম চ্যানেলে জয়েন হতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর ফেসবুক পেজে লাইক করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।