লিখেছেনঃ মুহাম্মাদ আব্দুল আলিম
দিরিলিস আরতুগ্রুল (Dirilis Ertugrul) নামক এই ওয়েব সিরিজটি তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েব এরদোগানের তত্ত্বাবধানে বানানো হয়েছে। যা নেটফ্লিক্সেও সম্প্রসারণ করা হয়েছে। শুধু তাই নয় সারা বিশ্বে ৪০ টি ভাষায় ডাবিং হয়ে সম্প্রসারণ করা হয়েছে। এমনকি বাংলা ও উর্দু ভাষাতেও ডাবিং করা হয়েছে। যেটির বাংলা ডাবিং দেখানো হয় বাংলাদেশের মাছরাঙা চ্যানেলে এবং উর্দু ডাবিং কয়েকদিন আগে পাকিস্তানের সরকারী টিভি চ্যানেল পিটিভি তে সম্প্রসারণ শুরু হয়েছে।
এখন পর্যন্ত ১৫০টি এপিসোড টেলিকাস্ট হয়েছে। প্রতিটি এপিসোডের দৈর্ঘ্যতা ২ ঘন্টার অধিক। শুটিংপর্ব এখনো চলছে। তবে সবথেকে আশ্চর্যজনক খবর হল এই সিরিজটিকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। সৌদি আরব সহ বেশ কয়েকটি ইসলামিক দেশেও এর প্রদর্শণী বন্ধ করা হয়েছে। এছাড়াও ভারতের কাশ্মীরের ইন্টারনেট সার্ভার থেকেও “দিরিলিস আরতুগ্রুল” নামক এই সাড়া জাগানো ওয়েব সিরিজটিকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে যাতে কাশ্মীরিরা এটা দেখতে না পারে।
এই সিরিজটিকে নিয়ে আলোচনা করার আগে জেনে নিই যে, যে ব্যাক্তির জীবন নিয়ে “দিরিলিস আরতুগ্রুল” সিরিজটি বানানো হয়েছে এবং হচ্ছে তিনি আসলে কে ছিলেন।
“দিরিলিস আরতুগ্রুল” অর্থাৎ গল্পের মূল নায়ক আরতুগ্রুল গাজী ওরফে আরতুগ্রুল বেগ সালজুকী ছিলেন তুরস্কের অটোমান সাম্রাজ্য অর্থাৎ মহান উসমানিয়া খেলাফতের প্রতিষ্ঠাতা প্রথম উসমানের পিতা। ইতিহাসে বর্ণিত আছে, তিনিই বিশাল অটোমান সাম্রাজ্যের ভিত্তি স্থাপন করে যান। সেজন্য তাঁকে পৃথিবীর সব ধর্মভীরু মুসলমান গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করেন। তাঁর নামের শেষে ‘গাজী’ উপাধিটি সেইসব মুসলমান যোদ্ধাদের দেওয়া হয় যাঁরা ইসলামের জন্য যুদ্ধ করে বিজয়ী হয়ে ফিরে আসেন।
আরতুগ্রুল আহালাত শহরে জন্মগ্রহণ করেন আনুমানিক ১১৯১-১১৯৮ খ্রিস্টাব্দের কোন এক সময়ে। আরতুগ্রুল গাজী ছিলেন ‘কায়ি’ গোত্রের নেতা। ‘কায়ি’ একটি অঘুজ তুর্কি বংশোদ্ভূত যাযাবর জাতি। ১১শত শতাব্দীতে ‘কায়ি’ শব্দটি সর্বপ্রথম তুর্কি পণ্ডিত মাহমুদ আল কাশগারি সর্বপ্রথম উল্লেখ করেন। ‘কায়ি’ শব্দের অর্থ সম্পর্কের দ্বারা যার ক্ষমতা আছে। এই আরতুগ্রুল গাজীর পূর্বপুরুষ ‘সালজুক’ জন্মগতভাবে মুসলমান ছিলেন না। তিনি ছিলেন নাস্তিক অর্থাৎ নিরীশ্বরবাদী। ‘সালজুক’ তাঁর পৌত্র আরতুগ্রুলকে নির্দেশ দিয়েছিলেন ইসলামী জগতকে আক্রমণ করে ছিন্ন ভিন্ন করে দেবার জন্য। কিন্তু প্রকৃতির এক আদ্ভুত নিয়মে বাঁধা পড়ে তিনি আশ্চর্যজনকভাবে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন এবং তাঁর পুত্র প্রথম উসমান ‘উসমানিয়া খেলাফত’ (অটোমান সাম্রাজ্য) – এর ভিত্তি স্থাপন করেন। আরতুগ্রুল গাজী ইসলাম গ্রহণ করেন সুলতান মাহমুদ গযনবীর সময়ে। ইতিহাসে বর্ণিত আছে, একবার সুলতান মাহমুদ গাযনবী সালজুককে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “যদি কোন সময় তোমার কাছ থেকে সাহায্যের প্রয়োজন হয় তাহলে কতজন লোক আমার কাছে পাঠাতে পারবে?” তখন সালজুক সুলতান মাহমুদ গাযনবীকে একটা তীর দিয়ে বলেছিলেন, “যে কোন ব্যাক্তিকে এই তীর নিয়ে আমার কাছে পাঠিয়ে দেবে তাহলে কয়েক ঘন্টার মধ্যেই ১ লক্ষ তরবারী তোমাকে রক্ষা করার জন্য পৌঁছে যাবে।” সুতরাং সালজুক কি অসীম ক্ষমতার অধিকারী ছিল এই ঘটনার দ্বারা অনুমান করা যায়।
এই উসমানিয়া খেলাফতের খলিফারা ইউরোপ, আফ্রিকা ও এশিয়া এই তিনটি মহাদেশের ১০০ এর অধিক দেশ শাসন করেছেন। এই খেলাফতের সূচনা হয় প্রথম ১২৯৯ সালে এবং পতন ঘটে ১৯২৪ সালে। অর্থাৎ উসমানিয়া খেলাফত পৃথিবী শাসন করেছে ৬২৫ বছর। বিখ্যাত ঐতিহাসিক ইবন খালদুনের রাজনৈতিক দর্শন মতে মানুষের মতোই সব সাম্রাজ্যের একটা আয়ুষ্কাল রয়েছে। একটি সাম্রাজ্যের জন্ম হয়, এরপর বেড়ে উঠে, প্রাপ্তবয়স্ক হয়, তারপর আবার নিঃশেষ হতে হতে মৃত্যুবরণ করে।
সালজুকগণ স্বাভাবিকবভাবেই সুন্নী ইসলামকেই গ্রহণ করেছিলেন। শুধু তাই নয় সুন্নী মতাবলম্বী আরতুগ্রুল গাজী বাগদাদ এবং শাম দেশ থেকেই শিয়াদের সাম্রাজ্য ধুলিস্যাত করে দেন। অপরদিকে সুলতান সালাহুদ্দীন আইয়ুবী মিশরের ফতেমিয়া খেলাফত খতম করে ইসমাইলী শীয়াদের পতন ঘটান।
ইতিহাসে বর্ণিত আছে, ‘কায়ী’ গোত্র প্রধান পিতা সুলাইমান শাহ-এর আদেশমতো মাত্র ৪ শ’ ৪৪জন সৈন্য নিয়ে আরতুগ্রুল গাজী মঙ্গলীয়দের বিপক্ষে লড়াই করার জন্য রওনা করেন। পরবর্তীতে দুর্বল সেলজুকদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের ময়দানে একত্ববাদের পতাকা উড্ডীন করেন। বলতে গেলে আরতুগ্রুল ও তার সহযোদ্ধাদের বিপুল বীরত্বে মাত্র কয়েকশ যোদ্ধা বিশাল মঙ্গলীয় বাহিনীকে ধরাশায়ী করে ময়দান থেকে পালাতে বাধ্য করে।
তুর্কোমেন উপজাতির লোকেরা মূলত মধ্য এশিয়ার স্তেপ তৃণভূমি অঞ্চলের তুর্কি ভাষাগোষ্ঠীর মানুষ ছিল। এই ভাষা গোষ্ঠীর মধ্যে যারা বিস্তীর্ণ তৃণভূমি অঞ্চলের পশ্চিম অঞ্চলে বাস করত তাদের বলা হত অঘুজ উপজাতি, যারা ছিল দুর্ধর্ষ মোঙ্গলদেরই একটি শাখা। এদের বলা হত অঘুজ টার্ক বা অঘুজ তুর্কি- ধারাবিবরণী রক্ষকদের লেখায় এদেরই আবার অন্য নাম ছিল তুর্কমেন। এরা এশিয়ার বৃহত্তম লবণাক্ত জলের হ্রদ কাস্পিয়ান সাগরের পূর্বতীরে গড়ে তুলেছিল এদের বাসস্থান তুর্কমেনিস্তান। হ্রদের পশ্চিমদিকে বাস করে এদেরই আরেক গোষ্ঠী তুর্কিরা, যাদের বাসভূমির নাম তুরস্ক। প্রায় বারোশো বছর আগে থেকে কিছু অঘুজ উপজাতির পশুচারক কিছু যাযাবর মানুষ মঙ্গোলিয়ার পশ্চিম অঞ্চল থেকে অর্থাৎ মধ্য এশিয়ার উরাল-আলতাই অঞ্চল ছেড়ে ঘুরতে ঘুরতে চলে আসে এই অঞ্চলে।
নতুন বাসভূমিতে এসে এরা ‘সালজুক সাম্রাজ্যের’ অধীনে বাস করেছিল। সালজুক সাম্রাজ্য ছিল বর্তমান ইরান ও তুর্কমেনিস্তানের পুরনো বাসিন্দা অঘুজ তুর্কিদেরই সাম্রাজ্য।
হিজরীর সপ্তম শতকের শুরুর দিকে মঙ্গোলদের খোরাসান আক্রমণের ফলে সেখানকার অধিবাসীরা তুর্কমেনিস্তানের মার্ভ অঞ্চলে এসে বসবাস করতে শুরু করে। এই গোত্রটির নামই ছিল ‘কায়ি’ গোত্র। এদের গোত্রপ্রধান ছিলেন সুলাইমান শাহ। এই গোত্রের লোকেরা ছিল নিষ্ঠাবান মুসলমান। সুলাইমান শাহের নেতৃত্বগুণে তার গোত্র ছাড়াও সেখানে অবস্থানকারী লোকেরা তার নেতৃত্বের ছায়াতলে আসতে লাগল। চেঙ্গিস খানের দস্যুতার কারণে সবাই তখন নিজের নিরাপত্তার জন্য নিজের উপরই নির্ভর করতে হচ্ছিল। সুলাইমান শাহ তার জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তার জন্য শক্তি বৃদ্ধি করেন এবং যাতে তারা কোনভাবে ক্ষতির সম্মুখীন না হয় সেই দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতেন। অন্যদিকে খাওয়ারিজম সাম্রাজ্যের পতনের ফলে সুলাইমান শাহ খুব অল্প সময়ের মাঝেই অসংখ্য যোদ্ধা ও প্রচুর পরিমাণ যুদ্ধ সামগ্রী সংগ্রহ করতে সক্ষন হন।
সময়ের সাথে এইসব গোত্রগুলো নিজেদের ঘিরে স্বাধীন রাষ্ট্র গড়ে তুলতে শুরু করে। এই রাষ্ট্রগুলো ‘বেইলিক’ নামে পরিচিত ছিল এবং গাজী ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করার ধারণাকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছিল। প্রতিটি রাষ্ট্র একেকজন নেতাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠত যিনি সেই বেইলিক এর গাজীদের পরিচালনা করতেন এবং যুদ্ধে নেতৃত্ব দিতেন। ১৩ শতকের শেষের দিকে গোটা আনাতোলিয়া জুড়ে অসংখ্য বেইলিক এর অস্তিত্ব ছিল।
রুম সাম্রাজ্যের সুলতান প্রথম আলাউদ্দিন কায়কোবাদ আরতুগ্রুলকে কারাকা দাগের জমিতে থাকার অনুমতি দেন। রুম সাম্রাজ্য মধ্যযুগে আনাতোলিয়ায় অবস্থিত একটি তুর্কি-ফারসি সুন্নি মুসলিম। রোমান সাম্রাজ্যকে ফারসি “রুম” দ্বারা নির্দেশ করা হত। পূর্বের রোমান তথা বাইজেন্টাইন অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয়েছিল বলে সালজুকরা তাদের সাম্রাজ্যকে রুম বলে উল্লেখ করত।
চেঙ্গিস খান ৬২১ হিজরিতে (১২২৪ খ্রীঃ) সেলজুক সামাজ্যকে ধ্বংস করার জন্য এক বিরাট বাহিনী পাঠান। কালের পরিক্রমায় সালজুক সাম্রাজ্য তখন অস্তাগত। তখন সেলজুক সাম্রাজ্যের রাজধানী কনিয়াতে সিংহাসনে ছিলেন সুলতান আলাউদ্দিন কায়কোবাদ সালজুকী।
এই সময়ই সুলাইমান শাহের নিকট খবর পৌছল যে, মঙ্গোলরা আলাউদ্দিন কায়কোবাদের উপর হামলা চালিয়েছে। এই খবরে তিনি মর্মাহত হলেন। মুসলমান সুলতানের জন্য তার যথেষ্ট সহানুভূতি ছিল। তাই তিনি সুলতান কায়কোবাদকে সাহায্য করার উদ্দেশ্যে নিজ গোত্রকে রওয়ানা হতে বলেন।
এই সময়ই ঘটে এক অভূতপূর্ব ঘটনা। সেলজুক ও মঙ্গোলেরা যখন যুদ্ধ করছিল তখন সেখানে উপস্থিত হন আরতুগ্রুল গাজী। আরতুগ্রুল জানেন না যে কোন পক্ষ কারা। তাই তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন যে দুর্বল পক্ষের হয়ে তিনি যুদ্ধ করবেন। মঙ্গোল বাহিনী ছিল দুরন্ত ও দুর্ধর্ষ। তারা সহজেই সালজুক বাহিনীকে কোণঠাসা করে ফেলে। সৌভাগ্যক্রমে আরতুগ্রুল গাজী সিদ্ধান্ত নেন যে সালজুকদের তিনি সাহায্য করবেন। সাথে সাথেই তিনি ৪৪৪ জন যোদ্ধা নিয়ে সে সেলজুকদের পক্ষে যুদ্ধে নেমে পড়েন। তাদের বীরত্বে শেষ পর্যন্ত মঙ্গোলেরা সেখান থেকে প্রাণ নিয়ে পালাতে বাধ্য হয়। হেরে যাওয়া যুদ্ধে এমন অভাবনীয় সাফল্যে সুলতান কায়কোবাদ উল্লসিত হয়ে আরতুগ্রুল গাজীকে আলিঙ্গন করেন। ঠিক এমন সময়েই সুলাইমান শাহ তার বাহিনী নিয়ে সেখানে উপস্থিত হন। সুলতান আলাউদ্দিন কায়কোবাদ তাদের দুজনকেই এই পুরস্কার স্বরূপ পরিদেয় দান করেন। তিনি খুশি হয়ে ‘কায়ি’ গোত্রের জন্য আঙ্গোরা (বর্তমান আংকারা) কারাকা দাগের জায়গা বরাদ্দ করেন এবং সুলাইমান খানকে তার বাহিনীর সর্বাধিনায়ক নিযুক্ত করেন।
এখানে আলাউদ্দিন সালজুকীর তীক্ষ্ণবুদ্ধি ও দূরদর্শিতার কথা স্বীকার না করে পারা যায়না, তিনি আরতুগ্রুলকে সাম্রাজ্যের সর্বশ্রেষ্ঠ এলাকাটি ঠিক করেন। কনিয়া সাম্রাজ্য প্রথমে বেশ বড় ছিল। কিন্তু রোমান আর মঙ্গোলদের চাপে পড়ে কনিয়ার একেবারে ভগ্নদশা হওয়ার উপক্রম হয়েছিল এবং আয়তন ক্রমশ হ্রাস পেতে পেতে তা একটি ক্ষুদ্র রাজ্যের আকার ধারণ করেছিল যার অস্তিত্ব যে কোন মুহূর্তে বিলীন হয়ে যেতে পারত।
কারাকা দাগের অবস্থান ছিল একেবারে রোমান সীমান্তে। ১২৫১ সালে আরতুগ্রুল নাইসিয়ান শহর থেবাসিওন জয় করেন। এর নতুন নামকরণ করা হয় সাগুত এবং এটি তার সাময়িক রাজধানী হয়। তার এই কৃতিত্বপূর্ণ কাজের পুরস্কারস্বরুপ সুলতান আলাউদ্দিন সালজুকী আরতুগ্রুলকে আরও কিছু এলাকা ছেড়ে দেন। পরবর্তীতে ১২৯৯ সালে তার সন্তান প্রথম উসমান কর্তৃক এখানেই অটোমান সাম্রাজ্যের রাজধানী হিসাবে গড়ে উঠে। আরতুগ্রুল আরও শক্তিশালী হয়ে উঠায় রোমানদের দিক থেকে আক্রমণের আশংকা লোপ পায়। কিছুদিন পরে পিতা সুলায়মান শাহ ফুরাত অতিক্রম কালে পানিতে ডুবে মারা যান।
আরতুগ্রুল নিজ এলাকা শাসন করে যাচ্ছিলেন এবং নিজের রাজ্যের পরিধি ক্রমাগত বৃদ্ধি করছিলেন। এভাবে আরতুগ্রুলের একটি উল্লেখযোগ্য রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়। ওদিকে মঙ্গোলদের ক্রমাগত আক্রমণ সেলজুক সুলতানকে ব্যতিব্যস্ত রাখে এবং শেষ অবধি ৬৪১ হিজরিতে মঙ্গোলরা কনিয়াকে একটি করদ রাজ্যে পরিণত করে। এতে অবশ্য আরতুগ্রুল কিছু হল না। কারণ তিনি ছিলেন মঙ্গোলদের ধরাছোঁয়ার বাইরে। মঙ্গোলরা এশিয়া মাইনরের এই ছোট ছোট রাজ্যগুলোর ব্যাপারে কোনরূপ নাক না গলিয়ে তাদেরকে তাদের মত থাকতে দেয়। ৬৩৪ হিজরি (১২৩৬-৩৭ খ্রীঃ) আলাউদ্দিন কায়কোবাদ মারা গেলে তার পুত্র গিয়াসুদ্দীন কায়খসরু কনিয়ার সিংহাসনে আরোহণ করেন।
আরতুগ্রুলের বিবাহ হয় সালজুক সাম্রাজ্যের শাহজাদা নোমানের কন্যা হালিমা খাতুনের সাথে। ৬৫৭ হিজরিতে আরতুগ্রুলের একটি পুত্র সন্তান হয় তার নাম রাখা হয় উসমান খান। তাঁরই নামানুসারে তুর্কি বাদশাদের উসমানীয় সুলতান বা অটোমান সুলতান বলা হয়ে থাকে। ১২৮৭ সালে আরতুগ্রুল গাজী মারা যান। তখন উসমান খানের বয়স ছিল ত্রিশ বছর। তখন সেলজুক সুলতান, আরতগ্রুলের পর উসমান খানকেই তার স্থলাভিষিক্ত করেন। উসমান খানের যোগ্যতার দরুন সুলতান আকৃষ্ট হন এবং তাই তাকে নিজ সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক নিয়োগ করে তার সাথে নিজের মেয়ের বিবাহ দেন। খুব অল্প সময়ের মাঝেই তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে উন্নীত হন।
১২৯৯-১৩০০ খ্রিস্টাব্দে মঙ্গোলদের সাথে এক যুদ্ধে কায়খসরু মারা যান। তার একটি মাত্র কন্যা সন্তান ছিল। কোন পুত্র সন্তান ছিল না। তাঁর কন্যাকে সাথেই উসমান খান বিবাহ করেছিলেন। কাজেই সাম্রাজ্যের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা সর্বসম্মতিক্রমে উসমান খানকে কনিয়ার নতুন সুলতান হিসেবে ঘোষণা করেন। এভাবে ইসরাঈল ইবনে সালজুকের বংশধররা যে সাম্রাজ্য ৪৭০ হিজরিতে (১০৭৭-৭৮ খ্রীঃ) কায়েম করেছিল তার বিলুপ্তি ঘটে এবং তার জায়গায় বিশাল উসমানীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়।
‘সাগুত’ গ্রামে প্রথম উসমান কর্তৃক নির্মিত একটি গম্বুজ ও মসজিদ আরতুগ্রুলের স্মৃতির উদ্দেশ্যেই বানানো হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। কিন্তু অনেকবার পুনর্নির্মাণের ফলে এর উৎস সম্পর্কে সঠিক তথ্য পাওয়া যায়না। বর্তমান দরগাটি উনিশ শতকের শেষ দিকে সুলতান দ্বিতীয় আব্দুল হামিদ কর্তৃক নির্মিত হয়। প্রথম দিকের উসমানীদের স্মরণে সাগুত শহরে বাৎসরিক উৎসবের আয়োজন করা হয়।
১৮৬৩ সালে অটোমানদের নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ তার নামে আরতুগ্রুল নামকরণ করা হয়। তুর্কমেনিস্তানের আশখাবাদে একটি মসজিদও তার নামে নামকরণ করা হয়েছে।
উসমানীয় তথা অটোমান সাম্রাজ্যের ভবিষ্যৎ নির্মাতা হিসাবে তার দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ও বীরত্ব-গাথা জীবনের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা আছে। তাই তাকে এই সাম্রাজ্যের ভবিষ্যৎ নির্মাতা হিসাবে আখ্যা দেওয়া হয়।
অটোমান কিংবা উসমানীয় সাম্রাজ্য পৃথিবীর বুকে টিকে থাকা প্রভাবশালী এক ইসলামি সাম্রাজ্য ছিল, যার সূচনা করেছিলেন প্রথম উসমান। সালজুকদের সমর্থন পেয়ে উসমান আনাতোলিয়ার শাসনভার গ্রহণ করেছিলেন। খুব অল্প সময়ে রাজ্য পরিচালনার কাজে উসমানের দক্ষতা প্রকাশ পেতে থাকে। এর মাঝে সালজুকদের ভেতরগত রেষারেষির কারণে ভেতর থেকে সেলজুক সাম্রাজ্য ক্ষয়ে যেতে শুরু করে। একসময় উসমান উপলব্ধি করেন, সালজুকরা নিজেদের টিকিয়ে রাখতে পারবে না। তাই শুরুর দিকে অনুগত থাকলেও সাম্রাজ্যের ক্রান্তিলগ্নে এসে ১২৯৯ সালে নিজেই স্বাধীন একটি সাম্রাজ্য গড়ার ঘোষণা দেন। এভাবেই উসমানীয় সাম্রাজ্যের সূচনা ঘটে, যদিও শুরুর দিকে সামান্য কিছু অঞ্চল নিয়েই উসমান শাসনকার্য চালিয়ে যেতে থাকেন। পরবর্তীকালে সারা পৃথিবীর অর্ধেক অংশ তারা শাসন করে। বোঝায় যায় কি বিশাল ক্ষমতার অধীকারি ছিল এই এই উসমানিয়া খেলাফতের শাসকরা।
১০৭১ সালের গ্রীষ্মের প্রচণ্ড গরমে আনাতোলিয়ার পূর্বাংশে (বর্তমান তুরস্ক) এক ঐতিহাসিক ভয়ঙ্কর যুদ্ধ চলছিল। মধ্য এশিয়ার বংশোদ্ভুত সালজুক তুর্কীরা দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়া জুড়ে কয়েক দশক আগে একটি শক্তিশালী সাম্রাজ্য গড়ে তুলতে সামর্থ হয়েছিল। কালক্রমে তারা শক্তিশালী বাইজেইন্টাইন সাম্রাজ্যের সাথে যুদ্ধ শুরু করে, যারা সেই ভূখন্ড শাসন করে আসছিল কয়েক শতক ধরে। প্রকৃতপক্ষে, ৭ম শতক থেকেই বাইজেন্টাইন রোমান ও মুসলমানদের মধ্যে থেমে থেমে যুদ্ধ চলছিল। ১০৭১ সালে মানজিকার্ত (Manzikert) এর যুদ্ধে বাইজেন্টাইনদের বিরুদ্ধে সালজুক সুলতান আল্প আরসালানের নেতৃত্বে সালজুকদের জয় ছিল এক নজিববিহীন ঘটনা। ইতিপূর্বে কোন মুসলিম বাহিনীই এমন জয় প্রত্যক্ষ করেনি, যুদ্ধে বাইজেন্টাইন বাহিনীকে পুরো নাস্তানাবুদ করে ছেড়ে দেয়া হয়েছিল।
এরপরের দশক ও শতকগুলোতে আনাতোলিয়াকে তুর্কীদের বসতি গড়ার জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। তুর্কীরা তাদের বাসভূমি ছেড়ে পূর্বে বাইজান্টাইনদের এলাকায় বসতি গড়তে তুলতে শুরু করে, নিজেদের শহর ও নগর গড়ে তোলে এবং ইসলাম গ্রহণ করা স্থানীয় জনগণের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে থাকে।
মানজিকার্তে ভয়াবহভাবে পর্যুদস্ত হওয়ার পরও বাইজান্টাইনরা ছিল তুর্কীদের জন্য হুমকিস্বরূপ। এ কারণে তুর্কীরা প্রায়সময়ই বাইজেন্টাইনদের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত থাকতো। এভাবে তুর্কীরা এমন একটি সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলে যেখানে সৈন্যদের গড়ে তোলা হতো, যারা বাইজেন্টাইনদের সাথে বিভিন্ন যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করতো। ইসলামের বাণী সমুন্নত রাখতে বাইজেন্টাইনদের সাথে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করা এই যোদ্ধাগণ “গাজী” হিসেবে পরিচিত ছিলেন। জনপ্রিয় ও সফল গাজীদের ঘিরে যোদ্ধাদের বিভিন্ন দল জড়ো হতো, তারপর ছোট ছোট সেনাদল গঠন করে গোটা আনাতোলিয়ার গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে পড়তো।
সময়ের সাথে এই সেনাদল গুলো নিজেদের ঘিরে স্বাধীন রাষ্ট্র গড়ে তুলতে শুরু করে। এই রাষ্ট্রগুলো ‘বেইলিক’ নামে পরিচিত ছিল এবং গাজী সমাজ প্রতিষ্ঠা করার ধারণাকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছিল। প্রতিটি রাষ্ট্র একেকজন নেতাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠতো যিনি সেই বেইলিক এর গাজীদের পরিচালনা করতেন এবং যুদ্ধে নেতৃত্ব দিতেন। ১৩ শতকের শেষের দিকে গোটা আনাতোলিয়া জুড়ে অসংখ্য বেইলিক এর অস্তিত্ব ছিল।
আরতুগ্রুল গাজী পুত্র ওসমান গাজী
এই বেইলিকগুলোর মধ্যে একটি বেইলিক এর গাজী ছিলেন আরতুগ্রুল গাজী পুত্র ‘ওসমান গাজী’। তাঁর জন্ম ১২৫৮ খ্রিস্টাব্দে, যে বছর মঙ্গোলরা বাগদাদ ধ্বংস করে। মঙ্গোল যুদ্ধের সাথে ওসমানের বেইলিক এর ভাগ্য জড়িত ছিল।
ওসমানের জনশক্তির আরেকটি উৎস ছিল পূর্বদিকে মঙ্গোল আগ্রাসনের কারণে পালিয়ে আসা শরণার্থীরা। মঙ্গোলরা তখনও দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ায় তাদের তাণ্ডব চালিয়ে যাচ্ছিল আর শরণার্থীরা জীবন রক্ষার্থে মুসলিম বিশ্বের শেষ প্রান্তে চলে আসছিল (আনাতোলিয়া ছিল এই অঞ্চলের শেষ মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চল, এর পরেই পশ্চিমে বাইজেন্টাইন রোমান সাম্রাজ্য)। এভাবে তাদের অনেকেই ওসমানের বেইলিক এ তাদের নতুন আবাসস্থল খুঁজে পায়।
যোদ্ধা বৃদ্ধির সাথে সাথে ওসমানের পক্ষে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের প্রতি চাপসৃষ্টি করা সম্ভব হচ্ছিল। সেই সময়ে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য ছিল পুরো পতনমুখী। তাদের স্বর্ণযুগ অতীত হয়ে গিয়েছে অনেক আগেই, তাদের পক্ষে ওসমান ও তাঁর দুর্ধর্ষ গাজীদের মোকাবেলা করা ক্রমশই কঠিন হয়ে পড়ছিল। ফলে ১৪ শতকের শুরুর দিকের দশকগুলোতে ওসমান তাঁর বেইলিক এর সীমানা প্রবল আকারে বিস্তৃত করেছিলেন। এই সময়টিকেই ঐতিহাসিকগণ ওসমানের বেইলিক এর একটি সাম্রাজ্যে রূপান্তরিত হওয়ার সময় বলে উল্লেখ করেন। ওসমানীগণ তাদের রাষ্ট্রকে ডাকতেন “দেভলেত-ই-উসমানীয়ে”, যার অর্থ “ওসমান এর রাষ্ট্র”। ইংরেজীতে অটোমান (“Ottoman”) শব্দটি ওসমান এর নামের বিকৃতরূপ।
ওসমানের স্বপ্ন
ওসমান তরুণ বয়স থেকেই সবার কাছে ধর্মভীরু হিসেবে পরিচিত ছিলেন। একসময় তিনি শেখ এদেবালি নামক এক ধর্মগুরুর ব্যক্তিত্ব ও জ্ঞানের গভীরতায় প্রভাবিত হয়ে নিয়মিত তার সাথে দেখা করতে যেতেন। এস্কিসেহির শহরের এক গ্রাম ইতবার্নুতে এদেবালির সাথে দেখা করতে যেতেন ওসমান। একদিন এদেবালির মেয়ে মাল হাতুনের সাথে দেখা হয়ে যায়। মাল হাতুনের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে ওসমান তাকে ভালোবেসে ফেলেন। ফলে এদেবালির বাড়িতে যাওয়া-আসার মাত্রা আরও বেড়ে যায়। একসময় তিনি এদেবালিকে সব কথা খুলে বলেন। কিন্তু এদেবালি এ বিয়েতে রাজি হন নি।
এমন প্রত্যাখ্যান সহজে মেনে নিতে পারেন নি তরুণ ওসমান গাজী। তাই তিনি প্রায়ই বন্ধুদের কাছে নিজের হতাশা ব্যক্ত করতেন।
এতকিছুর পরেও এদেবালির সাথে ওসমানের যোগাযোগ ছিলো। একদিন রাত্রে এদেবালির বাড়িতে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন ওসমান। মাল হাতুনের কথা ভাবতে ভাবতেই ঘুমিয়ে পড়েন তিনি। ঘুমের মাঝেই তিনি এমন একটি স্বপ্ন দেখেন ইতিহাসে বিখ্যাত হয়ে আছে।
স্বপ্নটি হল,
“ওসমান এবং এদেবালি এক জায়গায় বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। হঠাৎ করেই এদেবালির বুকের ভেতর থেকে একটি পূর্ণ চাঁদ বের হয়ে তা আবার ধীরে ধীরে ওসমানের বুকের ভেতর হারিয়ে যায়।
এরপরই বেশ চমৎকার একটি গাছ ধীরে ধীরে বড় হতে শুরু করে। তার যেন আর থামার নাম নেই, বড় হচ্ছে তো হচ্ছেই। এভাবে গাছটির শাখা-প্রশাখা, ছায়া পৃথিবীর দিগন্তের প্রায় তিন ভাগকে ঢেকে ফেলার আগপর্যন্ত বড় হতেই থাকে। এ গাছের নিচে ছিলো চারটি পাহাড়- ককেশাস, অ্যাটলাস, টোরাস ও হীমাস। দেখে মনে হচ্ছিলো যে, এ পাহাড়গুলোর উপর ঠেস দিয়েই দাঁড়িয়ে আছে সুবিশাল সেই গাছ। গাছটির গোড়া থেকে বেরিয়ে এসেছিলো টাইগ্রিস, ইউফ্রেটিস, দানিয়ুব ও নীল নদ। বড়-ছোট পাল তোলা অনেক জাহাজই ঘুরে বেড়াচ্ছিলো সেসব জায়গায়।
মাঠগুলো ভরে গিয়েছিলো খাদ্যশস্যে, পাহাড়গুলোর আশেপাশেও ছিলো বিস্তীর্ণ বনাঞ্চল। পাহাড়গুলোর মধ্যবর্তী এলাকা জুড়ে ছিলো জাঁকজমকপূর্ণ শহরের উপস্থিতি। অগণিত গম্বুজ, পিরামিড, ওবেলিস্ক, মসজিদের মিনার আর সুউচ্চ টাওয়ার জানান দিচ্ছিলো সেই শহরটির আভিজাত্যের মাত্রা। তাদের শীর্ষভাগে শোভা পাচ্ছিলো এক অর্ধচন্দ্র। দূর থেকে ভেসে আসছিলো মুয়াজ্জিনের আজানের সুমধুর ধ্বনি। হাজার হাজার নাইটিঙ্গেলের মনমাতানো ডাকের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিলো সেই আজানের সুর।
মিষ্টি কন্ঠের অসংখ্য পাখির সমাবেশ ঘটেছিলো সেখানে। তাদের কিচিরমিচির ডাক যেন মাতাল করে ছাড়ছিলো গাছটিকেও। গাছটির প্রতিটি পাতাই ছিলো তুর্কীদের পুরনো আমলের খঞ্জরের মতো দেখতে। হঠাৎ করেই বাতাসের বেগ যেন বেড়ে গেলো। আর সেই সাথে পাতাগুলোর তীক্ষ্ম দিকগুলোও বিশ্বের নানা শহরের দিকে মুখ করে ঘুরে গেলো। তবে সেগুলো বিশেষভাবে কনস্টান্টিনোপলের দিকে মুখ করে ঘুরে ছিলো। দুটো সাগর ও দুটো মহাদেশের মিলনস্থলে অবস্থিত সেই শহরটিকে দুটো স্যাফায়ার ও দুটো এমারেল্ডের মাঝে বসানো একটি ডায়মন্ডের মতো লাগছিলো। এর ফলে বিশ্বের সবচেয়ে মূল্যবান পাথরই যেন হয়ে উঠেছিলো সেটি। ওসমান গাজী যখন সেই দৃষ্টিনন্দন পাথর বসানো আংটি নিজের আঙুলে ঢোকাতে যাচ্ছিলেন, তখনই তার ঘুম ভেঙে যায়।”
ঘুম থেকে উঠে ওসমান এদেবালিকে তার স্বপ্নের কথা জানান। এদেবালি বুঝলেন যে, এটি কোনো সাধারণ স্বপ্ন নয়। বরং এর মাঝেই লুকিয়ে আছে ওসমান ও তার মেয়ে মাল হাতুনের এক হওয়া থেকে শুরু করে ওসমানের ভবিষ্যতে অনেক ক্ষমতা ও প্রতিপত্তির মালিক হওয়ার ইঙ্গিত। এরপর তাই আর বিয়েতে আপত্তি করলেন না এদেবালি। নিজের পছন্দের শিষ্য দরবেশ তোরুদকে ডেকে এনে ওসমান আর মাল হাতুনের বিয়ে পড়ানোর ব্যবস্থা করেন।
পরবর্তীকালে অলৌকিকভাবে ওসমানের স্বপ্নে দেখা বৃক্ষটির শাখা প্রশাখা যতদুর বিস্তার লাভ করেছিল, ঠিক ততদূর উসমানিয় সাম্রাজ্যও বিস্তার লাভ করেছিল। বর্ণনা মতে সেই বৃক্ষের শাখা প্রশাখা তিনটি মহাদেশ অর্থাৎ আফ্রিকা, ইউরোপ ও এশিয়া মহাদেশে বিস্তার লাভ করেছিল, পক্ষান্তরে বিশাল উসমানিয়া খেলাফতও উক্ত তিনটি মহাদেশে বিস্তৃতি লাভ করেছিল।
ওসমানের উত্তরসুরীগণ এই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেয়ার আগে ওসমানের বেইলিক এর অবস্থান ছিল উত্তর-পশ্চিম আনাতোলিয়ার “সোউত” (তুর্কীঃ Söğüt) নগরীকে ঘিরে, বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের সীমানা ঘেঁষে।
বুরসা নগরীতে রয়েছে ওসমান গাজীর সমাধি
ওসমান গাজীর পুত্র ওরহান তাঁর শাসন কালের প্রথম দিকেই বাইজেন্টাইনদের গুরত্বপূর্ণ শহর বুরসা দখলের মাধ্যমে পৈতৃক সূত্রে লাভ করা বিশাল সাম্রাজ্যের পরিধি বৃদ্ধি করেন। পরবর্তী দশকগুলোকে ওরহান, এরপর প্রথম মুরাদ (শাসনকালঃ ১৩৬২-১৩৮৯), এবং প্রথম বায়জিদ (অর্থাৎ বায়জিদ য়িলদিরিম, শাসনকালঃ ১৩৮৯-১৪০৩) ওসমানী সাম্রাজ্যের পরিধি বিস্তার করতে থাকেন। একদিকে পশ্চিমে তাঁরা বাইজেন্টাইনদের থেকে বিভিন্ন এলাকা জয়লাভ করতে থাকেন (পরবর্তীতে ইউরোপ মহাদেশস্থ বাইজেন্টাইন অঞ্চলেও বিস্তার লাভ করেন), অন্যদিকে অন্যান্য তুর্কী রাষ্ট্রগুলোকে সন্ধিচুক্তি, বৈবাহিক বন্ধন ও কখনো কখনো যুদ্ধের মাধ্যমে নিজেদের আয়ত্বে আনেন। ১৪ শতকের শেষদিকে শুধুমাত্র কনস্ট্যান্টিনোপোল (বর্তমান নাম ইস্তানবুল) ছাড়া বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের অধিকাংশই ওসমানী সাম্রাজ্যের অধীনে চলে আসে। ১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দে তাঁরা কনস্ট্যান্টিনোপোলও জয় করেন।
এই হল উসমানী খেলাফতের প্রতিষ্ঠাতা প্রথম উসমানের পিতা আরতুগ্রুল গাজীর সংক্ষিপ্ত পরিচয়। এই আরতুগ্রুল গাজীর জীবন নিয়েই তুরস্কের উক্ত ওয়েব সিরিজটি বানানো হয়েছে। যেখানে প্রতিটি পর্বে আরতুগ্রুল গাজীর বীরত্ব দেখানো হয়েছে। এই ওয়েব সিরিজটাকেই সারা পৃথিবীর বেশ কয়েকটি রাষ্ট্রে বাজেয়াপ্ত করা হয়।
সালজুক ও উসমানিয়া সাম্রাজ্যের প্রতিটা দিক ‘দিরিলিস আরতুগ্রুল’ এ পরিচালক মুহাম্মাদ বোজদাগ সুনিপুণভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। পর্দায় ফুটে ওঠা যুবক আরতুগ্রুলের অসীম সাহসীকতা ও বীরত্ব মুসলিম যুবকদের অন্তরে দুর্দান্ত প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়েছে।
আরতুগ্রুল গাজীর জনপ্রিয়তার প্রধানতম কারণ হল তাঁর আধ্যাত্মিকতা। জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে তৎকালীন জগৎবিখ্যাত সুফী ও পীর শায়েখ মুহিউদ্দিন ইবনুল আরাবি (১১৬৫-১২৪০) এর নির্দেশনা পূর্ণাঙ্গরূপে অনুস্মরণ করতেন। তিনি কখনো হতাশ হতেন না বরং কোন প্রতিকূল পরিবেশের সম্মুখীন হলেই ইবনে আরাবির নিকটে যেতেন এবং সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে তার পরামর্শ পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে মেনে চলতেন।
ঐতিহাসিক এই ড্রামা সিরিয়ালে আরতুগ্রুলের চরিত্রে অভিনয় করেছেন এনজিন আলতান দোজায়তান–তার অনবদ্য অভিনয়ও ‘দিরিলিস আরতুগ্রুল’ দর্শকপ্রিয়তা পাওয়ার অন্যতম কারণ। এক কথায় দর্শক যখন দিরিলিস আরতুগ্রুল দেখতে বসেন নিঃসন্দেহে তার অনুভূতি এমনই হয় যে, সে যেন সেই হাজার বছর আগের সেই বাস্তব রোমাঞ্চকর ঈমানদীপ্ত ইতিহাসকেই স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করছেন।
সৌদি আরবে বাজেয়াপ্ত করা হল কেন?
সৌদি আরবে কেন দিরিলিস আরতুগ্রুল বাজেয়াপ্ত করা হল তা জানার আগে একটা সংক্ষিপ্ত ইতিহাস জানা জেনে রাখা উচিৎ। সেই ইতিহাস জানতে এখানে ক্লিক করুন।
সৌদি আরবে বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে একটিই কারণে, যেহেতু সৌদি আরবও এক সময় উসমানিয়া খেলাফতের অধীনে ছিল। আরব জাতীয়তাবাদের উত্থানের সময় সৌদিতে বিদ্রোহের হয় এবং উসমানিয়া সাম্রাজ্য থেকে তারা মুক্ত হয়। অপরদিকে যেভাবে উক্ত ওয়েব সিরিজটিতে উসমানিয়া খেলাফতের প্রকৃত সূচনাকারী আরতুগ্রুল গাজীর বীরত্ব দেখানো হয়েছে তাতে বিভিন্ন তরুন মুসলিম যুব মানসে নতুনভাবে প্রাণের সঞ্চার হচ্ছে। সারা পৃথিবীর মুসলিম যুবকেরা উদ্বুদ্ধ হয়ে নতুনভাবে খেলাফতের দাবীতে আন্দোলন শুরু করলে সৌদির রাজপরিবারে ক্ষমতা হাতছাড়া হবার সম্ভাবনা প্রবল হয়ে পড়বে। সুতরাং উক্ত ওয়েব সিরিজ বাজেয়াপ্ত করাই তাদের কাছে উপযুক্ত মনে হয়েছে।
অপরদিকে ইন্টারনেটের বেশ কয়েকটি ওয়েবসাইট মারফত খবর পাওয়া যাচ্ছে যে “দিরিলিস আরতুগ্রুল” দেখে ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট মাদুরো ইসলাম গ্রহণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তাঁর দাবী উক্ত ওয়েব সিরিজে ইসলামের সঠিক বক্তব্যগুলো দর্শকের কাছে তুলে ধরা হয়েছে। এখানেই শেষ নয় এই সিরিজ দেখে বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করা সুপারহিট তুর্কি টিভি সিরিয়াল ‘দিরিলিস আরতুগ্রুল’ বা দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেছেন মেক্সিকান দম্পতি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলসে একটি সম্মেলনে এই সিরিজটির অভিনেতাদের একজনের সাথে সাক্ষাত করার পরে ইসলাম গ্রহণ করেন উক্ত মেক্সিকান দম্পতি। সিরিজটির আবদুর রহমান আল্প চরিত্রে অভিনয় করা সেলাল আল একটি মুসলিম সংস্থার অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়েছিলেন। তিনি মুসলিম আমেরিকান সোসাইটির (এমএএস) ২২তম বার্ষিক সভায় অংশ নিয়ে সিরিয়াল এবং তুরস্ক সম্পর্কে আলোচনা করেছিলেন। তিনি যাকাত ফাউন্ডেশনের অতিথি হয়ে এসেছিলেন। পরে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মুসলমানদের এই সংস্থা কর্তৃক আয়োজিত অনুষ্ঠানে উপস্থিত সবার সাথে দেখা করেন। অনুষ্ঠানের শেষে এক মেক্সিকান দম্পতি এই বিখ্যাত অভিনেতার হাতে কালেমায়ে শাহাদাত পড়েন এবং ইসলাম গ্রহণ করেন। মেক্সিকান দম্পতি বলেন,
“আমরা তুর্কি টিভি সিরিজ ‘দিরিলিস আরতুগ্রুল’ দেখে এবং বিশ্বজুড়ে তুরস্কের মানবিক কার্যক্রমে প্রভাবিত হয়ে ইসলাম গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”
মুসলিম হওয়ার পরে অভিনেতা সেলাল আল ওই দম্পতিকে ইংরেজি ও স্প্যানিশ ভাষার দুটি কুরআন ও তুরস্কের পতাকা উপহার দেন। অভিনেতার বক্তব্যঃ
‘‘এটা আমাদের জন্য আনন্দের বিষয় যে বিশ্বের মানুষেরা তুরস্কের মানবিক কর্মকাণ্ডে খুব আগ্রহী। লস অ্যাঞ্জেলসে এর উদাহরণ দেখে আমি অনেক খুশি।’’
ত্রয়োদশ শতাব্দীর আনাতোলিয়ায় উসমানিয়া খিলাফতের প্রতিষ্ঠাতার পিতা আরতুগ্রুল গাজীর জীবনী নিয়ে ‘দিরিলিস আরতুগ্রুল’ সিরিজটি নির্মাণ করা হয়। সিরিজটিরতে আরতুগ্রুল গাজী ও তার সাথীদের নাইটস টেম্পলার ও মঙ্গল আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে পরিচালিত বিভিন্ন যুদ্ধ দেখানো হয়। তুরস্ক বিশ্বের শীর্ষ পাঁচটি সিরিজ-রফতানিকারী দেশগুলির একটি। লাতিন আমেরিকা থেকে এশিয়ায় দর্শকদের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে তুর্কি সিরিয়ালগুলো। তুরস্কের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সূত্রে জানা গেছে, দেড় শতাধিক দেশে তুরস্কের কয়েক ডজন সিরিজ পাঁচ কোটিরও বেশি দর্শক দেখেছে। এই সিরিজের জনপ্রিয়তা এতটাই বেড়ে গেছে যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম শ্রেণীর সংবাদপত্র ওয়াশিংটন পোষ্ট লিখেছে যে ‘দিরিলিস আরতুগ্রুল’ তুর্কী প্রেসিডেন্ট এরদোগানের একটা সফট এটোম বোমা।
মুসলমানদের বিজয়গাঁথা ইতিহাস, তাদের জাতিসত্ত্বার অসীম ত্যাগ কিছুটা উপলব্ধি করা যায় এটা দেখে। ছোট্ট মুসলিম গোষ্ঠীটি সাত শ’ বছর তিনটি মহাদেশ শাসন করেছে, ইতিহাসের সাথে মিল রেখে করা সিরিজটিতে “ইতিহাসের উজ্জ্বল তারকা গাজী আরতুগ্রুল বেগ” -এর নেতৃত্বে তুর্কী মুসলিমদের যে উত্থান হয়েছিলো তাই-ই চমৎকৃতভাবে দৃশ্যপাত করা হয়েছে দিরিলিস আরতুগ্রুলে।
নারী চরিত্র রেখেও অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে সব ধরণের অশ্লীলতাকে এড়িয়ে গিয়েছেন পরিচালক মেটিন গুনে। অসাধারণ স্ক্রীনপ্লে লিখেছেন মেহমেত বোজদা।
তুর্কি প্রেস জানিয়েছে, এরদোগান সরকারের সহযোগিতায় নির্মিত এই সিরিজের শুটিং সেটে অন্তত ২৫ টি দেশের রাষ্ট্রপ্রধান ঘুরতে গিয়েছেন।
সুতরাং পশ্চিমা বিশ্ব এই সিরিজের প্রদর্শণী কেন বন্ধ করে দিয়েছে সহজেই বোঝা যাচ্ছে।
সিনেমা সংক্রান্ত পরের আর্টিকেল পড়তে এখানে ক্লিক করুনঃ ক্যাপ্টেন জ্যাক স্প্যারো
‘নবজাগরণ’ অ্যান্ড্রোয়েড অ্যাপ্লিকেশনটি প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর টেলিগ্রাম চ্যানেলে জয়েন হতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর ফেসবুক পেজে লাইক করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।