‘ধনধান্য পুষ্পভরা’ ভারতবর্ষের প্রতি বিদেশী পর্যটক তথা ভ্রমণকারীদের আকর্ষণ প্রাচীনকাল থেকেই। ভ্রমণ কাহিনিগুলাে পড়লেই বুঝতে পারা যায়, অর্থনৈতিক কারণ ছাড়াও নতুন নতুন দেশ দেখার নেশা, ধর্ম প্রচার, ব্যবসার মাধ্যমে মুনাফা লাভ, দস্যুবৃত্তি, রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার ও অন্যান্য উদ্দেশ্য পরিভ্রমণের অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল। ধর্মীয় ও বৈষয়িক মানসিকতা অবশ্য কোনাে কোনাে পর্যটকের মধ্যে একেবারেই ছিল না। জ্ঞান সংগ্রহ ও নিছক কৌতুহলই তাদেরকে ঘর ছাড়া করেছিল। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে ভারতবর্ষে এসেছেন মেগাস্থিনিস, খ্রিস্টীয় প্রথম শতকে —পি-নি (Tamralipta), দ্বিতীয় শতকে টলেমি (Gangaridi), পঞ্চম শতকে ফা-হিয়েন (Tamralipta), ষষ্ঠ শতকে তারনাথ, সপ্তম শতকে হিউয়েন সাঙ (৬২৯-৬৪৫) ও ইসিং, নবম শতকে সােলায়মান (৮৫১), দশম শতকে মাসুদী (৯১৫-১৬), আল ইসতাখরী, ইবনে হওকাল ও আবু জায়েদ, একাদশ শতকে আলবিরুনী, ত্রয়ােদশ শতকে মার্কোপােলাে, ফ্রান্সিস ফ্রিয়ার, মন্টেক ভিনাে, ফ্রেয়ার অডােরিক ও ফ্রেয়ার জর্ডানাস, চতুর্দশ শতকে ইবন বতুতা (১৩৩৪-৪৭), পঞ্চদশ শতকে মা-হুয়েন (১৪০৯-১০), ডমিংগাে পাত্রস (১৪৯৯-১৫০২), আলবুকার্ক, নিকোলাে কন্তি (১৪২০), নিকিতিন, ভাস্কো-ডা-গামা (১৪৯৮), আবদুর রাজ্জাক (১৪৪২-৪৩) ও ফেইসিন (১৪১১-১৫), ষােড়শ শতকে হুয়ান সিং, ইয়েন সং, নুনিজ, জি ডি বেরস, মনসারেট (১৫৮০-৮৩), বারবােসা (১৫০০-১৫১৬), পিনহাইরাে, ভারথেমা (১৫০২-৬), সিজার ফ্রেডারিক (১৫৬৭-৮১), ফাদার বারতােলি ও র্যালফ ফিচ (১৫৮৩-৯১), সতের শতকে মির্জা নাথান, আব্দুল লতিফ (১৬০০-০৯), পেলসার্ট, ফিঞ্চ (১৬০৮-১৬১১), নিকোলাস পাইমেন্টা, ক্যাপ্টেন হকিন্স (১৬০৮-১৬১১), এডওয়ার্ড টেরি (১৬১৫) টমাস রাে (১৬১৫), পিয়েত্রে দেল্লাভাল্লে (১৬২৩), করেত, ব্রুটন, কার্টরাইট (১৬৩২), পিটার মান্ডি (১৬৩০-৪৩), জেরম জেভিয়ার (১৫৯৭-১৬১৭), ডে-লায়েট, আলবার্ট মান্ডেফ্লোর (১৬৩৮-৩৯), থেভনাে (১৬৬৭-৮৪), গ্যামেলী কেরি (১৬৯৫), মানরিক (১৬২৮-৪৩), মনুচি (১৬৫৩-১৭০৮), বার্নিয়ের (১৬৫৮-৬৮), টমাস বাওরি, ফ্রাসোঁয়া মাতার (১৬৬৮-১৭০৬), গােতিয়ার স্কুটেন, জন ফ্রায়ার, ওভিংটোন, ফাদার বােতেলহাে (১৬৪৮-৫৪), হেনরি মিডলটন (১৬১০-১১), যােসেফ সালব্লাঙ্ক, দ্য লেত, উইথিংটন, জোরডিন, উইলিয়াম নরিস, জেমস ল্যানকাস্টার (১৬১০-১১), নিকেলাস ডাউটন (১৬১৪-১৫), টমাস বেস্ট (১৬১২-১৪) ও তাভার্নিয়ে (১৬৪১-৬৭), আঠার শতকে যােসেফ টিফেনথেলার, জেমস রেনল, জেমস টড, লুই পােয়াতিয়ের, স্টাভােরিন ও মােদাভ (ফরাসি), উনিশ শতকে ভিক্টর জ্যাকমো ও আলেকজাণ্ডার সােমা দ্য কোরাস এসেছেন। জেনেছি তাদের ভ্রমণকথা, এমনকি ইডেন ভগিনীদ্বয়ের ভারত ভ্রমণকথাও আমরা অনেকে পড়েছি। না পড়ে থাকলেও সবাই জানেন তাদের নামেই ইডেন গার্ডেন স্টেডিয়াম। কিন্তু ইংরেজ ভ্রমণকারী ফ্যানি পার্কসের (গ্রেট ব্রিটেনের ওয়েলস প্রদেশের কনওয়ে নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন ১৭৯৪-এ। আসল নাম ফ্রান্সিস সুসান আর্চার। বাবা মেজর এডওয়ার্ড কলফিল্ড আর্চার, যিনি ছিলেন ‘টুরস ইন আপার ইণ্ডিয়া’ ১৮৩৩ গ্রন্থের লেখক, মা অ্যানি। মৃত্যু ১৮৭৫-এ) নাম আমরা শুনিনি বললেই চলে।
শুধু ফ্যানি পার্ক নয়, ওই সময় বেশ কয়েকজন ইংরেজ ললনা স্বাধীনভাবে জলদস্যু, পিণ্ডারী, আফ্রিকায় সিংহ, ভারতে বাঘ, আর সবচেয়ে বিপজ্জনক কট্টর কলােনিয়াল ইংলিশম্যান ইত্যাদি বিবিধ আপদ, উপদ্রব ও সংস্কারের বাধা অতিক্রম করে নানা মহাদেশ ও বহু দ্বীপপুঞ্জ পর্যটন করেছিলেন। এঁদের ছবি, ডায়েরি ও চিঠিপত্র নিয়ে ২০০৫-এ ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে বিলেত থেকে এক ভ্রাম্যমান প্রদর্শনী এসেছিল যার নাম ছিল ‘ব্রিটিশ উইমেন এক্সপেরারস্ অফ দ্য আর্লি নাইনটিন সেঞ্চুরি’। কী সব ছবি!কিন্তু যেটা এই প্রদর্শনীতেও স্পষ্ট হয়নি তা হল ফ্যানি পার্কসের ভারত-ভ্রমণ সংক্রান্ত নথি। কেন এই উপেক্ষা? ব্ল-ব্লাডের অধিকারিনী নন বলে ইংরেজরা যে তাদেরই উপনিবেশিক আগ্রাসনের বড় সমালােচক ফ্যানিকে উপেক্ষা করবেন তাতে অবাকের কিছু নেই, কিন্তু আমরা অর্থাৎ ভারতীয় লেখককুল যাঁরা পূর্বোক্ত ভ্রমণকারীদের সমাদরে তাদের লেখায় অতি সামান্য হলেও স্থান দিয়েছি কিংবা তাদের ভ্রমণকথা নিয়ে আলােচনা করেছি, সেখানে ফ্যানি পার্কসের মত ভ্রমণকারী অপাংক্তেয় হয়ে থাকলেন কোন যুক্তিতে? ফ্যানি গভীর মমতায় যেভাবে ব্রিটিশ শাসনের প্রথমার্ধে সংস্কারমুক্ত মনে ভারতীয় কৃষ্টি সম্বন্ধে উচ্চধারণা পােষণ করে দুঃসাহসিকতার পরিচয় রেখেছেন, তাতে তার বুদ্ধিমত্তার প্রশংসা না করে পারা যায় না। অথচ তিনি বা তার ভ্রমণকথা আমাদের অজানা হয়ে রইল!
উনিশ শতকের প্রথমার্ধের গােড়ার দিক। মধুসূদন তখন ইংরেজি, ইতালিয়ান, ফরাসি ইত্যাদি সাহিত্য শুধু নয় গােটা ইউরােপীয় সভ্যতার প্রেমে বিভাের! প্রিন্স দ্বারকানাথ সমানে সমানে বাণিজ্য করছেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে, গ্রীক হুন পাঠান মুঘলদের মত। ইংরেজদের তখন আহ্বান করা হচ্ছে ভারতে স্থায়ী বসবাস করতে। তখন রামমােহনের ব্যক্তিগত বন্ধু গভর্নর জেনারেল স্বয়ং। এরকম এক সময়ে চাকরি সূত্রে স্বামী চার্লস পার্কসের সঙ্গে ফ্যানি পার্ক ভারতবর্ষে আসেন (১৮২২), থাকেন ১৮৪৫ অবধি—প্রধানত কলকাতা, কানপুর ও এলাহাবাদে।।
তখন ভারতবর্ষে ইংরেজ সবেমাত্র থাবা বসাচ্ছে, স্তিমিত হয়ে আসছে ভারতের উজ্জ্বল-অভিজাত তারকাদের জীবন। কিন্তু তখনাে তারা আছেন, রাজা-রানি-বাদশাহ-বেগমেরা, আছে দরবার হারেম সতীদাহ। এসব ছবি ধরা পড়েছে সাধারণ এক গৃহবধূর চোখে, যিনি ক্রমে সাধারণ থেকে বিখ্যাত হয়ে উঠেছেন। ফ্যানি মেমসাহেব পরিণত হচ্ছেন এক ভারতপ্রেমিক রাজনীতিবিদ ও দার্শনিকে। আকৃষ্ট হলেন এখানকার কৃষ্টি, ইতিহাস, প্রাকৃতিক পরিবেশ ও সম্পদ, ধর্ম, ভাষা ও সর্বোপরি জনসমাজের প্রতি। তার পুরাে সমর্থন ভারতের প্রতি, শিখেছেন হিন্দুস্থানী ও উর্দু ভাষা, পরেছেন ভারতীয় পােশাক ও গয়না, বাজাচ্ছেন সেতার, খাচ্ছেন হাত দিয়েই। বস্তুত তৎকালীন ভারত ও ভারতীয় সমাজ, ইতিহাস, রীতিনীতি, জীবনযাত্রা, ধর্ম, রাজনীতি, সংস্কার, সংস্কৃতি, পরিবেশ-আবহাওয়া ও অন্যান্য দিক যথা-ফসল, খাদ্যদ্রব্য, পােষাক, বিনােদন, উৎসব, বিবাহ ও নারী-ভাবনা, স্থাপত্য শিল্প, দুর্ভিক্ষ সবকিছুর একটি অনন্য সুন্দর ছবি ফ্যানি পার্কসের ‘ভ্রমণবৃত্তান্ত’।
দীর্ঘদিনের ভারত ভ্রমণে এসে ফ্যানি ভারতীয় হয়ে গিয়েছিলেন অজ্ঞাতসারেই। তার গ্রন্থের ছত্রে ছত্রে ভারত প্রেমের প্রমাণ ছড়িয়ে রয়েছে। গ্রন্থে ভারতীয় পরিভাষা ও প্রবাদ বাক্যের অকাতর ব্যবহার অন্ততপথে সেকথারই জানান দেয়। তিনি হিন্দু পৌরাণিক কাহিনিগুলাে অনুধাবনে সচেষ্ট হয়েছেন। আগ্রহভরে সংগ্রহ করেছেন হিন্দু ভাস্কর্য ও স্মারক। সেইসঙ্গে কোন ভারতীয় প্রথা যখন তার বিতৃষ্ণ উদ্রেক করেছে তখন তিনি তার বিচারবিশ্লেষণেও রত থেকেছেন বৌদ্ধিকভাবে। দেবনাগরী অক্ষরে ‘শ্রীগণেশ নামে একটি বহুবর্ণ চিত্র তাঁর গ্রন্থের শােভাবর্ধন করেছে। ভূমিকায় লেখিকা লিখেছেন “শ্রী গণেশ পাক্কা হিন্দু হলেও কালাপানি পার হয়ে আমার সঙ্গে ইংল্যাণ্ডে এসেছেন। তিনি তাঁর হিন্দুত্বের সমস্ত মর্যাদা ও ঐশ্বর্য নিয়ে আমার। সামনে উপবেশন করে আছেন। আমার প্রেরণা ও ক্ষমতার উৎস তিনি।” এই ‘শ্রীগণেশ’কে ‘সেলাম সেলাম’ বলে বন্দনা করে ফ্যানি পার্কস ইংল্যাণ্ডবাসিনী মায়ের জন্য ভ্রমণপঞ্জি লিখতে শুরু করেছিলেন। শুধু তাই নয়, মাকে উৎসর্গকৃত এই গ্রন্থে উৎসর্গবাণীর নিচে ফ্যানি নিজে স্বাক্ষর করেছেন উর্দুতে।
ফ্যানি পার্কস স্বামীর সঙ্গে কলকাতা এলাহাবাদ ও কানপুরে বাস করেছেন, কিন্তু ফ্যানি ঘুরেছেন এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে নৌকা, পালকি, ঘােড়ার গাড়ি ও ঘােড়ায় চড়ে। ‘ভ্রমণবৃত্তান্ত’-এ স্বামী বিষয়ে তিনি প্রায় নীরব থেকেছেন। মাত্র দু’এক স্থানে স্বামীর উল্লেখ পাওয়া যায়। শীতকালে ফ্যানি পার্কসের স্বামী মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলতেন। ফ্যানির জীবন তাই খুব মসৃণ ছিল না। তবে তিনি নিজেকে ‘স্বাধীন নারী’ বলে বর্ণনা করতে পছন্দ করতেন। ভারতে ইংরেজদের আগ্রাসন যে তার কতাে খারাপ লাগছে তা বলতে দ্বিধা করেননি। সারা দেশের সাধারণ মানুষদের সঙ্গে যেমন, তেমনইনবাব-বেগম-রাজা-রানির সঙ্গে তিনি করেছেন বন্ধুতা। এক গৃহবধূর দৃষ্টিতে দেখা ভারত ভ্রমণের এক ‘ইউনিক’ দলিল এই ‘ভ্রমণবৃত্তান্ত।
১৮৫০ সালে ‘Wanderings of a pilgrim in search of the picturesque during four-and-twenty years in the East with Revalations of life in Zenana’ (Pehlam Richardson) নামে ফ্যানি পার্কসের দীর্ঘ ভারতবাসের বৃত্তান্তটি প্রথম প্রকাশিত হয় লণ্ডন হতে। মূল বইটির পৃষ্ঠা সংখ্যা ৮০০। ২০০২ সালে উইলিয়াম ডালরিম্পল কর্তৃক সম্পাদিত হয়ে বইটি ‘Begums, Thugs and White Mughals’ নামে ‘পেঙ্গুইন বুকস্’ হতে প্রকাশিত হয়েছে, পৃষ্ঠা সংখ্যা ৩৬১। কলকাতার প্রতিভাস’ থেকেও মীনাক্ষী দত্ত অনূদিত ফ্যানি পার্কসের ‘ভ্রমণবৃত্তান্ত প্রকাশিত হয়েছে সাহেব বিবি বণিক হারেম’ (২০০৬) নামে, পৃষ্ঠা সংখ্যা ২৪০। এছাড়া ফ্যানি পার্কসের ‘ভ্রমণবৃত্তান্তর কলকাতা’ অংশ (১৮২২২৮) আমরা পাই প্রসিদ্ধ গবেষক বিনয় ঘােষের গ্রন্থে।
শেষে বলি, ভিক্টোরিয়া অধ্যায়ের অন্তিম পর্বে ও এডওয়ার্ডিয়াল অধ্যায়ে আমরা মানবীয় জীবনদর্শন ও বােধের একঘেয়েমির পরিচয় পাই। সাহিত্য-ইতিহাসবেত্তারা অন্তত তা-ই মনে করেন। কিন্তু ফ্যানি পার্কসের ‘ভ্রমণবৃত্তান্ত’ এক্ষেত্রে ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত। ঔপনিবেশিক ঔদ্ধত্য এখানে অনুপস্থিত। এখানে আমরা দেখতে পাই ভারতীয় জনজীবনের এক প্রাণময় প্রতিচ্ছবি। তবে পরিপূর্ণতার ও ধারাবাহিকতার দিক থেকে সংক্ষিপ্ত ও বিক্ষিপ্ত হলেও আমাদের জাতীয় জীবনের ইতিহাস রচনায় ও ঐতিহ্যের পরিচয় সংগ্রহে ভারতপ্রেমী ফ্যানি পার্কসের ভারত ভ্রমণের এমন ‘বৃত্তান্ত’ গবেষক ও তত্ত্বানুসন্ধানীদের কাছে মণিমুত্তার মত দুর্লভ ও দুর্মূল্য হিসেবে অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
‘নবজাগরণ’ অ্যান্ড্রোয়েড অ্যাপ্লিকেশনটি প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।