গুপ্তদের ইতিহাসের উৎসঃ বাংলায় গুপ্তদের শাসন সম্পর্কিত ইতিহাস রচনার বেশ কিছু উপাদান রয়েছে। এগুলাের মধ্যে লিপি, মুদ্রা এবং সাহিত্যিক উপকরণ বিশেষ উল্লেখযােগ্য। বহির্দেশীয় উপাদানের মধ্যে রয়েছে চৈনিক বিবরণ। এ সকল উপাদান বাংলায় গুপ্ত শাসনের ইতিহাসকে যথেষ্ট আলােকিত করেছে। গুপ্ত আমলে উৎকীর্ণ কয়েকটি তাম্রশাসনে উত্তর বাংলায় তাদের শাসন সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায়। এগুলাে হচ্ছে প্রথম কুমার গুপ্তের ধনাইদহ তাম্রশাসন (৪৩২-৩৩ খ্রি:); বৈগ্রাম তাম্রশাসন (৪৪৭-৪৮ খ্রি:); দামােদরপুর তাম্রশাসন (৪৪৩-৪৪ ও ৪৪৭-৪৮ খ্রি:); বুধগুপ্তের দামােদরপুর তাম্রশাসন (৪৭৬-৯৫খ্রি:); পাহাড়পুর তাম্রশাসন। (৪৭৮-৭৯ খ্রি:) এবং বৈন্যগুপ্তের গুনাইঘর তাম্রশাসন (৫০৭-০৮ খ্রি:) ইত্যাদি। এছাড়া বাকুড়ার কাছে সুসুনিয়ার পর্বতগাত্রে ক্ষোদিত একটি লিপি; দিল্লিতে মেহরাওয়ালী এলাকায় কুতুব মিনার সংলগ্ন কুয়াতুল ইসলাম মসজিদ প্রাঙ্গণে অবস্থিত লৌহ স্তম্ভগাত্রে ক্ষোদিত লিপি; সমুদ্রগুপ্তের সভাকবি হরিষেণ রচিত এলাহাবাদ প্রশস্তিলিপি; চৈনিক পর্যটক ইৎ-সিং-এর বর্ণনা; কালিদাসের ‘রঘুবংশম্’ এবং গুপ্তদের মুদ্রা ইত্যাদি বিখ্যাত।
গুপ্তদের আদি পরিচয়
গুপ্ত বংশের আদি পরিচয় ও বাসস্থান সম্পর্কে নানা প্রকার বিরােধী মতের মধ্যে সামঞ্জস্য সাধন করা বেশ। কষ্টসাধ্য। শ্রীগুপ্ত হচ্ছেন গুপ্ত বংশের আদি পুরুষ। ঐতিহাসিক এ্যালান মনে করেন, শ্রীগুপ্ত পাটলিপুত্র নগরের অদূরে রাজত্ব করতেন। কিন্তু এর বিপরীতে ডঃ ডি.সি. গাঙ্গুলী বলেন, গুপ্তদের আদি রাজত্ব ছিল বাংলার মুর্শিদাবাদে। ডঃ গাঙ্গুলী ইৎ-সিং-এর বর্ণনার ওপর নির্ভর করে তাঁর মতবাদ গঠন করেন। ইৎ-সিং ৬৭২ খ্রিস্টাব্দে ভারত ভ্রমণে এসেছিলেন। এর পাঁচশত বছর পূর্বে অর্থাৎ খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতকে চীনা পরিব্রাজক হুই লুন নালন্দা পরিদর্শনে যান। সে সময় মহারাজা শ্রীগুপ্ত ‘মৃগশিখাবন’ নামে একটি মন্দির চীনা পুরােহিতদের জন্য নির্মাণ করে দিয়েছিলেন। এই মন্দিরের ব্যয়-সংকুলানের জন্য ২৪টি গ্রামও দান করেছিলেন। মৃগশিখাবন মন্দিরটি নালন্দা হতে চল্লিশ যােজন পূর্বদিকে অবস্থিত। গঙ্গার গতিপথ ধরে চল্লিশ যােজন দূরত্বে মুর্শিদাবাদের অবস্থান। এভাবে ই-সিং-এর বিবরণের দূরত্ব ও দিক বিচারে গাঙ্গুলী গুপ্তদের আদি বাসস্থান বাংলার মুর্শিদাবাদে ছিল বলে মন্তব্য পেশ করেন।
ড. হেমচন্দ্র রায়চৌধুরী অন্য একটি বিষয়ে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তাঁর মতে, নেপালে একটি স্কুপের গায়ে বরেন্দ্রীর মৃগশিখাবন স্তুপ’ লেখা আছে। এ থেকে তিনি অনুমান করেন, বরেন্দ্র অর্থাৎ উত্তরবঙ্গ গুপ্তরাজগণের মূল বাসস্থান ছিল। এদিকে কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত ১০১৫ খ্রিস্টাব্দের একটি বৌদ্ধ পান্ডুলিপিতে একটি চিত্রের নিচে প্রদত্ত লেবেলে বরেন্দ্রীর মৃগস্থাপন স্তুপ’ শব্দটি লেখা আছে। এ থেকেও প্রমাণ হয় গুপ্তদের আদি নিবাস ছিল সম্ভবত বরেন্দ্র অঞ্চলে। এভাবে পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ অথবা উত্তরবঙ্গের বরেন্দ্রে গুপ্তদের আদি বাসস্থান ছিল বলে অনুমিত হয়। অনেকে এ কারণে গুপ্ত রাজগণের আদি পরিচয় তুলে ধরতে গিয়ে তাদেরকে ‘বাঙালি’ হিসেবে মন্তব্য করেন। তবে মনে রাখতে হবে এ বিষয়ক সিদ্ধান্তের সমর্থনে আরাে নির্ভরযােগ্য প্রমাণের প্রয়ােজন রয়েছে।
বাংলায় গুপ্ত সাম্রাজ্যের সম্প্রসারণ
প্রথম চন্দ্রগুপ্ত ও সমুদ্রগুপ্ত যখন বিশাল গুপ্ত সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট হন তখন বাংলায় সমতট, বঙ্গ, পুষ্করণ ইত্যাদি রাজ্যের অস্তিত্ব ছিল। সুসুনিয়া লিপিতে পুস্করণাধিপ সিংহবর্মা ও তাঁর পুত্র চন্দ্রবর্মার উল্লেখ আছে। পুষ্করণাধিপ চন্দ্রবর্মাই খুব সম্ভবত এলাহাবাদ প্রশস্তিতে উল্লিখিত সমুদ্রগুপ্ত কর্তৃক পরাজিত চন্দ্রবর্মা।
মেহরাওয়ালী স্তম্ভলিপির বক্তব্য বাংলায় গুপ্তদের রাজনৈতিক ক্ষমতা সম্প্রসারণের ইতিহাসে কিছু আলােকপাত করে। এই লিপিতে চন্দ্র নামধারী এক রাজার বিজয় কাহিনী লিপিবদ্ধ আছে। তাঁর অন্যান্য বিজয়ের সাথে এটিও উল্লেখ করা হয়েছে যে, তিনি বঙ্গে শত্রু নিধনে গৌরব অর্জন করেছিলেন এবং বঙ্গীয়েরা তার বিরুদ্ধে সম্মিলিত প্রতিরােধের ব্যবস্থা করেছিল। এই লিপিতে উল্লিখিত রাজা চন্দ্র কে এবং কোথায় রাজত্ব করতেন সে বিষয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতবিরােধ রয়েছে। ঐতিহাসিকগণ তাঁকে গুপ্তবংশীয় রাজা প্রথম চন্দ্রগুপ্ত বা দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত বলে সনাক্ত করেছেন। যদি প্রথম অনুমান ঠিক হয় তাহলে মনে করতে হবে যে, সমুদ্রগুপ্তের পিতা প্রথম চন্দ্রগুপ্তই বঙ্গ অঞ্চল (সমগ্র বাংলা নয়) গুপ্ত সাম্রাজ্যভুক্ত করেন। যদি দ্বিতীয় অনুমান (অর্থাৎ দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত) ঠিক হয় তাহলে মনে করতে হবে যে, সমুদ্রগুপ্তের বঙ্গ জয়ের পরও তার পুত্রকে অত্র অঞ্চল পুনর্বার জয় করতে হয়েছিল। আবার ‘চন্দ্র’ যদি নাম না হয়ে দেহসুষমা বর্ণনার উপমা হয়ে থাকে তবে তা সমুদ্রগুপ্তের ক্ষেত্রেও প্রযােজ্য হতে পারে। উপরােক্ত সব সিদ্ধান্তই আনুমানিক। তবে উক্ত আলােচনা হতে অন্তত এ সিদ্ধান্ত করা যায় যে, গুপ্ত যুগের প্রাক্কালে বা প্রাথমিক পর্যায়ে বঙ্গে স্বাধীন রাজ্য ছিল যারা সম্মিলিত প্রতিরােধ ব্যবস্থাও গ্রহণ করতাে।
গুপ্ত শাসনের প্রাক্কালে বাংলার কোন অংশ তাঁদের রাজ্যভুক্ত ছিল কিনা তা নিয়ে সন্দেহ থাকলেও সমুদ্রগুপ্ত যে বাংলার অধিকাংশ এলাকা তাঁর সাম্রাজ্যভুক্ত করেছিলেন সে বিষয়ে তেমন কোন সন্দেহ নেই। সমুদ্রগুপ্তের এলাহাবাদ প্রশস্তিতে তাঁর রাজ্যজয়ের যে বিবরণ আছে তা হতে এ সিদ্ধান্ত করা সম্ভব। সমুদ্রগুপ্ত যে বাংলার সমতট ব্যতিত অন্য সব জনপদই সাম্রাজ্যভুক্ত করেছিলেন তাও এই প্রশস্তি সূত্রে জানা যায়। তার বিস্তীর্ণ সাম্রাজ্যের পূর্বৰ্তম প্রত্যন্ত রাজ্য ছিল নেপাল, কর্তৃপুর, কামরূপ, ডবাক এবং সমতট। সমতট, অর্থাৎ বাংলার দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চল সম্ভবত গুপ্ত সাম্রাজ্যের করদ রাজ্য ছিল। তবে কালক্রমে এ অঞ্চল গুপ্ত সাম্রাজ্যভুক্ত হয়ে পড়ে। কারণ, ষষ্ট শতাব্দীর প্রথম দিকে (৫০৭-০৮খ্রি:) এখানে বৈন্যগুপ্ত নামে গুপ্তবংশীয় একজন রাজা ছিলেন। তিনি ত্রিপুরা জেলার কতকস্থান এক দানপত্র সম্পাদন করে তাঁরই একজন অনুগত ব্যক্তিকে প্রদান করেছিলেন বলে তাম্রশাসনে উল্লিখিত আছে। বৈন্যগুপ্ত ‘দ্বাদশাদিত্য’, ‘মহারাজ’, ‘মহারাজাধিরাজ’ উপাধিও ধারণ করেছিলেন।
সে যাহােক, সমগ্র উত্তর বাংলা যে গুপ্তদের সরাসরি অধীন ছিল পরবর্তীকালের তাম্রশাসনসমূহে তার সুস্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে। প্রাপ্ত তাম্রশাসন হতে প্রমাণিত হয় যে, উত্তর বাংলা দীর্ঘকাল গুপ্ত সাম্রাজ্যভুক্ত ছিল এবং এ অঞ্চলে গুপ্ত প্রাদেশিক শাসনের কেন্দ্রস্থল ছিল পুন্ড্রনগর (পরবর্তীকালের মহাস্থান, বর্তমানের বগুড়া)।
এখানে গুপ্তদের সুনিয়ন্ত্রিত শাসনব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। এ অঞ্চলের শাসনভার ন্যস্ত ছিল একজন প্রাদেশিক শাসনকর্তার ওপর।
বাংলায় গুপ্ত শাসনব্যবস্থা
গুপ্ত সম্রাটগণ কর্তৃক শাসিত বাংলা অঞ্চলে কতগুলাে প্রশাসনিক বিভাগ ছিল, যেমন ‘ভুক্তি’, ‘বিষয়’, ‘মন্ডল’, ‘বীথি’ ও ‘গ্রাম’। এ সকল প্রশাসনিক ভাগের প্রত্যেকটির একটি করে প্রধান কেন্দ্র বা অধিষ্ঠান ছিল এবং সেখানে ছিল একটি ‘অধিকরণ’। ‘ভুক্তি’ ছিল সর্ববৃহৎ প্রশাসনিক বিভাগ এবং আধুনিককালের ‘বিভাগ’ এর অনুরূপ। সম্রাটের একজন প্রতিনিধি ভুক্তি শাসন করতেন। সমসাময়িক লিপিমালায় পুন্ড্রবর্ধন (সমগ্র উত্তরবঙ্গ) ও ‘বর্ধমান’ (প্রাচীন রাঢ়ের দক্ষিণাংশ) নামে দুটি ভুক্তি ছিল বলে জানা যায়। গুপ্তযুগের শিলালিপিতে নামবিহীন এক ভুক্তিরও উল্লেখ আছে। এর সদর দপ্তর ছিল ‘নব্যবকাশিকা’। সুবর্ণবীথি’ এর অন্তর্ভুক্ত ছিল। গুপ্ত সম্রাটদের দামােদরপুর তাম্রশাসনে পুন্ড্রবর্ধনভুক্তির শাসনকর্তাকে সম্রাটের সঙ্গে সম্পর্ক নির্দেশ করে তৎপাদপরিগৃহীত’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রথম কুমারগুপ্তের সময় ভুক্তি প্রশাসককে ‘উপরিক’ এবং বুধগুপ্তের সময় ‘মহারাজ উপরিক’ বলা হতাে। পাহাড়পুর তাম্রশাসন (৪৭৯ খ্রি:) থেকে জানা যায় যে, পুন্ড্রবর্ধন শহরে পুন্ড্রবর্ধনভুক্তির অধিকরণ’ (সদর দপ্তর) অবস্থিত ছিল। ভুক্তির পরবর্তী প্রশাসনিক বিভাগের নাম ‘বিষয়। বিষয় দ্বিতীয় বৃহত্তম প্রশাসনিক ইউনিট এবং শাসনক্ষেত্রে এর ভূমিকা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এগুলাে ছিল অনেকটা আধুনিক যুগের জেলার অনুরূপ। বিষয়ের শাসনকর্তাকে প্রথমদিকে বলা হতাে ‘কুমারমাত্য’ এবং গুপ্তযুগের শেষদিকে ‘আযুক্তক’। উত্তরবঙ্গ অঞ্চলে বিষয় প্রধানকে ‘বিষয়পতি’ও বলা হতাে। কোন কোন ক্ষেত্রে বিষয়পতিকে স্বয়ং সম্রাট সরাসরি নিয়ােগদান করতেন। তবে মূলত ভুক্তির শাসনকর্তাই ছিলেন এ পদের নিয়ােগদাতা। গুপ্ত তাম্রশাসন থেকে কয়েকটি বিষয়-এর নাম জানা যায় যেমন, ‘কোটিবর্ষ-বিষয়’, খােদাপাড়া বিষয়’, ‘পঞ্চনগরী বিষয়’, বরাকমন্ডল বিষয়’ এবং ‘ঔদম্বরিক বিষয়’ ইত্যাদি। দামােদরপুর তাম্রশাসনের বিবরণ হতে এটা স্পষ্ট যে বিষয়-এর সদর দফতরে (অধিষ্ঠান-অধিকরণম) পুস্তপাল’ (দলিল-রক্ষক) নামে এক শ্রেণীর কর্মচারী ছিলেন। এরা ভূমি ক্রয়-বিক্রয় ও দান সংক্রান্ত কার্যাবলী ছাড়াও নানা ধরনের দায়িত্ব পালন করতেন। কোটিবর্ষ বিষয়ের বিষয়পতির সহায়করূপে এক উপদেষ্টামন্ডলীর কথা জানা যায়। সেকালের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ শ্রেণীর প্রতিনিধিত্বকারী চারজন সদস্য ও স্বয়ং বিষয়পতির সমন্বয়ে এই উপদেষ্টামন্ডলী গঠিত হতাে। এ উপদেষ্টা সভার সদস্যরা ছিলেন ‘নগরশ্রেষ্ঠী’, ‘প্রথম-সার্থবাহ’, ‘প্রথম-কুলিক’ এবং ‘প্রথম-কায়স্থ’। নগর শ্রেষ্ঠী ছিলেন শহরের। বিভিন্ন গিল্ড বা কর্পোরেশনের অথবা ধনী ব্যাংকারদের সংস্থার সভাপতি। ‘প্রথম-সার্থবাহ’ ছিলেন বণিক সম্প্রদায় বা বিভিন্ন ব্যবসায়িক গিল্ডের প্রতিনিধিত্বকারী প্রধান ব্যবসায়ী। ‘প্রথম-কুলিক’ ছিলেন বিভিন্ন কারিগর শ্রেণীর প্রতিনিধিত্বকারী প্রধান কারিগর এবং ‘প্রথম-কায়স্থ’ ছিলেন কায়স্থ শ্রেণীর প্রতিনিধিত্বকারী প্রধান করণিক অথবা বর্তমানকালের অফিস সচিব ধরনের রাষ্ট্রীয় কর্মচারী। এভাবে জেলার প্রশাসনে বিভিন্ন। উপদেষ্টামন্ডলীর বর্ণনা নিশ্চিতভাবে প্রমাণ করে যে, প্রশাসনে স্থানীয় জনগণের সংযােগ ছিল এবং স্থানীয়। প্রশাসনে তাদের অংশগ্রহণের সুযােগ ছিল।
‘বিষয়’ বা জেলার পরবর্তী প্রশাসনিক বিভাগ ছিল ‘বীথি’। ‘বীথি’ শব্দটির প্রকৃত অর্থ অস্পষ্ট। কিছুসংখ্যক লিপিতে এই প্রশাসনিক ইউনিটের উল্লেখ আছে। নব্যবকাশিকায় অবস্থিত সুবর্ণবীথিকে ‘স্বর্ণবাজার’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রশাসনিক বিভাগ হিসেবে বীথির উল্লেখ মল্লসারুল তাম্রশাসনেও আছে। এই একই লিপিতে কোন বিষয়-এর উল্লেখ ছাড়াই বর্ধমানভুক্তির অন্তর্ভুক্ত বক্কটক্কবীথির নাম পাওয়া যায়। পাহাড়পুর তাম্রশাসনে দক্ষিণাংশক বীথিকে পুন্ড্রবর্ধনভুক্তির অন্তর্ভুক্ত বলা হয়েছে। এই তাম্রশাসনে বীথ্যধিকরণের অবস্থান সম্পর্কে সুস্পষ্ট উল্লেখ থাকলেও কীভাবে এ অধিকরণ গঠিত হতাে তা সঠিকভাবে বলা হয়নি। ভূমি দান-বিক্রয় সংক্রান্ত ব্যাপারে বীথ্যধিকরণের দায়িত্ব ছিল বিষয়াধিকরণের অনুরূপ। বীথির অধিকরণকে সহায়তা দানের জন্য বিশিষ্ট লােকদের সমন্বয়ে একটি পরিষদ থাকতাে। বীথির নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিগণের মধ্যে ‘মহত্তর’, ‘অগ্রহরীন’, ‘খড়গী’ (অসিযােদ্ধা) এবং অতপক্ষে একজন বহনায়ক’ (যানবাহন তত্ত্বাবধায়ক) মিলে এই পরিষদ গঠিত হতাে।
‘গ্রাম’ ছিল সেকালের সবচাইতে ছােট প্রশাসনিক ইউনিট। গ্রামের প্রধান ব্যক্তিরাই গ্রাম-প্রশাসন ও স্থানীয় ব্যাপারে জড়িত থাকতেন। বিষয় ও বীথি অধিকরণের মতাে গ্রাম শাসনযন্ত্রেও ‘মহত্তর’ ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের ভূমিকা লক্ষ করা যায়। প্রতিটি গ্রামেই যে প্রশাসনিক প্রধান হিসেবে ‘গ্রামিক’ ছিলেন তা পুরােপুরি প্রমাণ করা যায় না। পাহাড়পুর লিপিসাক্ষ্যে জানা যায় যে, ‘ব্রাহ্মণ’, ‘মহত্তর’, ‘কুটুম্বী’ ছিলেন গ্রামের প্রশাসনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বেসরকারি ব্যক্তি। গ্রামগুলােতে ভূমি দান-বিক্রয় সংক্রান্ত দলিলপত্রাদি সংরক্ষণের একটি কার্যালয় থাকতাে। গ্রাম-অধিকরণের যথার্থ গঠন বিভিন্ন সময় সম্ভবত ভিন্ন ভিন্ন ধরনের ছিল।
গুপ্ত যুগের ভূমি ব্যবস্থাও ছিল সুনিয়ন্ত্রিত। লিপি সাক্ষ্যে ‘ক্ষেত্র’, ‘খিল’ ও ‘বাস্তু’ ভূমির প্রমাণ পাওয়া যায়। চাষযােগ্য জমিই ‘ক্ষেত্র’, অনুৎপাদনশীল পতিত জমি ‘খিল’ এবংবসবাসযােগ্য জমি ‘বাস্তু’। ‘খিল’ জমির বর্ণনায় ‘অপ্রদ’ (অনুৎপাদনশীল), অপ্রহত (অকর্ষিত জমি) ও খিল (পতিত জমি) বলে উল্লেখ করা হয়েছে। গুপ্ত আমলে ভূমির যথার্থ পরিমাপের ব্যবস্থা ছিল। অবশ্য বাংলার সর্বত্র ভূমির পরিমাপ একই ধরনের ছিল না। এ সময় ভূমির পরিমাপের একক ছিল ‘কূল্যবাপ’ ও ‘দ্রোণবাপ’। এক কূল্য পরিমাপের বীজ দ্বারা যে পরিমাণ জমি বপন করা যায় ‘কূল্যবাপ’ শব্দ দ্বারা সাধারণত ঐ পরিমাণ জমিকে বােঝাতাে। অন্যদিকে কূল্যবাপের আটভাগের একভাগকে ‘দ্রোণবাপ’ বলা হতাে। পন্ডিতগণ মােটামুটিভাবে ধারণা ব্যক্ত করেছেন যে, এক কূল্যবাপ সমান বর্তমানের তিন বিঘা জমির মতাে হতে পারে। লিপিমালায় ভূমি পরিমাপের একক হিসেবে আরও কিছু শব্দের উল্লেখ পাওয়া যায় যেমন ‘পাটক’ বা ভূ-পাটক’, ‘আটক’, ‘কাকিনি’, ‘খাদিক’, ‘হাল’, ‘দ্রোণ’ ইত্যাদি।
লিপিমালাভিত্তিক উপযুক্ত আলােচনা থেকে একথা স্পষ্টরূপে প্রতীয়মান হয় যে, গুপ্তযুগে বাংলার শাসন ব্যবস্থায় কিছু গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি সাধিত হয়েছিল। গুপ্ত আমলে বাংলায় প্রচলিত শাসনব্যবস্থা যে সুনিয়ন্ত্রিত ও সুবিন্যস্ত ছিল তা বলাই বাহুল্য। প্রসঙ্গক্রমে বলা দরকার যে, গুপ্তযুগের শাসনব্যবস্থায় স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণের সুযােগ ছিল একটি দৃষ্টান্তমূলক ঘটনা। স্থানীয় জনগণ এ ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতেন। সুতরাং বাংলার শাসনব্যবস্থায় স্থানীয় জনতার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার কৃতিত্ব গুপ্ত সম্রাটদেরই প্রাপ্য। লিপিমালাসূত্রে স্থানীয় শাসনব্যবস্থার যে বিন্যাস চিত্র দেখা যায় তাঁকে বাংলায় স্থানীয় স্বায়ত্ত্বশাসনের আদি উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে এবং বাংলায় প্রশাসনিক ইতিহাসে এর গুরুত্বকে কোনভাবেই অস্বীকার করা চলে না।
বাংলায় গুপ্ত শাসনের ইতিহাস জানার জন্য তাম্রশাসনই প্রধান উৎস। অবশ্য এ অঞ্চলে গুপ্ত মাম্রাজ্যের সম্প্রসারণ সম্পর্কে অপরাপর কিছু উৎসেও তথ্য পাওয়া যায়। সাধারণভাবে মনে করা হয় আদি পরিচয়ে গুপ্তরা ছিলেন বাঙালি। সম্ভবত বাংলার মুর্শিদাবাদ অথবা উত্তরবঙ্গের বরেন্দ্র অঞ্চলে তাদের পূর্বপুরুষদের বসবাস ছিল। তবে এ বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায় না। গুপ্ত সম্রাটগণ যখন বাংলার দিকে সরাসরিভাবে রাজনৈতিক ক্ষমতা সম্প্রসারণের চেষ্টা করেন তখন স্থানীয় শক্তি তাদের বিরােধীতা করেন। গুপ্তরা বাংলায় শত্রু নিধনে গৌরব অর্জন করেছিলেন সত্য, কিন্তু তাঁদের বিরুদ্ধে বঙ্গীয়েরা সম্মিলিত প্রতিরােধের ব্যবস্থা করেছিল। উত্তর ও পশ্চিম বাংলায় গুপ্তদের প্রত্যক্ষ শাসন প্রচলিত ছিল। সমতট অঞ্চল ছিল সম্ভবত করদরাজ্য। বাংলায় শাসন কাঠামাে গড়ে তােলার ক্ষেত্রে গুপ্তদের অবদান দৃষ্টান্তমূলক। সুনিয়ন্ত্রিত এবং সুবিন্যস্ত শাসনব্যবস্থা প্রণয়নের মাধ্যমে গুপ্তরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তৎকালীন প্রশাসনিক ইউনিটগুলাে হচ্ছে ভুক্তি, বিষয়, মন্ডল, বীথি ও গ্রাম। প্রত্যেকটি ইউনিটের আবার পৃথকভাবে অধিষ্ঠান-অধিকরণ বা সদর দপ্তর ছিল। কোন কোন ক্ষেত্রে শাসনব্যবস্থায় স্থানীয় জনগণের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের সুযােগ ছিল।বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ শ্রেণীর প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে উপদেষ্টামন্ডলী গঠন করা হতাে। তারা শাসনকাজে ভূমিকা রাখতেন। এভাবে স্থানীয় প্রশাসনে গণতান্ত্রিক রীতি-নীতির অনুসরণ সেকালেই শুরু হয়। এ ব্যবস্থাকে স্থানীয় স্বায়ত্ত্বশাসনের আদি নজির হিসেবেও উল্লেখ করা যায়।
আরও পড়ুন,
১। সাতবাহন রাজবংশঃ ইতিহাস ও তার রাজনৈতিক মূল্যায়ন
২। হিন্দু মন্দির ধ্বংস ও ভারতে মুসলিম প্রশাসনঃ একটি ঐতিহাসিক পুনর্মূল্যায়ন
৩। মুহাম্মদ বিন তুঘলক কি পাগল ছিলেনঃ পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ
৪। সুলতান মুহাম্মদ বিন তুঘলক ও তুঘলক বংশের প্রতিষ্ঠাঃ ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ
৫। মৌর্য সাম্রাজ্যের উদ্ভব ও চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যঃ ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা